শেয়াল কেমন জব্দ

শেয়াল কেমন জব্দ

ওয়াক থুঃ, বরফের উপর হাঁস থুতু ফেলে। বরফের উপর থুতু পড়তেই ধোঁয়া উঠতে লাগল। হাঁসবাবাজির তো ভারী ভয় হল। পালা-পালা-পালা। এ তল্লাটে আর থাকে? পালাতে পালাতে দেখা মোরগের সঙ্গে।

হাঁস বলে, ‘পালা, পালা। মাটিতে আগুন লেগে গেছে।’

হাঁস আর মোরগ তো পালাচ্ছে। ছুট, ছুট, ছুট। পথে দেখা খরগোশের সঙ্গে।

‘মোরগভাই, মোরগভাই তোমরা চললে কোথায়?’

‘আরে ভায়া পালাও পালাও। জলদি করো। মাটিতে আগুন লেগে গেছে।’

তিনজন এবার ছুটতে লাগল। পথে দেখা শেয়ালের সঙ্গে। শেয়াল শুধোয়, ‘তোমরা সবাই চললে কোথায় ভাই?’

‘ভাল চাও তো, আমাদের সঙ্গে পালাও। মাটিতে আগুন লেগে গেছে।’ দু’জনে একসঙ্গে উত্তর দেয়। শেয়ালও ছুটতে লাগল। পথে দেখা নেকড়ের সঙ্গে। নেকড়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী শেয়ালমামা যাচ্ছ কোথায়?’

‘খরগোশকে শুধোও।’

খরগোশ বলে, ‘শুধোও মোরগকে।’

মোরগ বলে, ‘হাঁসবাবাজিকে শুধোও।’

নেকড়ে বলে, ‘হাঁসবাবাজি, ও হাঁসবাবাজি, তা বলি চললে কোথায় সবাই মিলে?’

‘আরে ভাই আমরা যাচ্ছি তুমিও চলো। জানো না মাটিতে আগুন লেগে গেছে।’

সবাই ছুটতে শুরু করল। পথে দেখা এক ভালুকের সঙ্গে। ভালুক নেকড়েকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাই নেকড়ে তোমরা সব চললে কোথা?’

‘শেয়ালকে শুধোও’, বলে নেকড়ে।

শেয়াল বলে, ‘খরগোশকে শুধোও।’

খরগোশ বলে, ‘শুধোও মোরগভায়াকে।’

মোরগ বলে, ‘শুধোও হাঁসবাবাজিকে।’

নেকড়ে তখন ভারী ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘হাঁসবাবাজি, হাঁসবাবাজি তা বলি চললে কোথায়?’

‘আরে ভাই আমরা যাচ্ছি, তুমিও চলো। জানো না মাটিতে যে আগুন লেগে গেছে।’

এবার নেকড়েও দলে জুটে গেল। সবাই ছুটছে। পথে দেখা ভালুকের সঙ্গে। ভালুক ভারী অবাক হয়ে ভাবে এরা সব ছুটছে কেন? চলছে কোথা? নেকড়কে জিজ্ঞেস করে, ‘নেকড়েদাদা চললে কোথা?’

নেকড়ে বলে, ‘শেয়ালকে শুধোও।’

শেয়াল বলে, ‘খরগোশকে শুধোও।’

খরগোশ বলে, ‘মোরগকে শুধোও।’

মোরগ বলে, ‘হাঁসবাবাজিকে শুধোও।’ জিজ্ঞেস করতে করতে মাথা ঘোরে, ঘাম ঝরে। ভালুক এবার বলে, ‘হাঁসবাবাজি, ও হাঁসবাবাজি তা বলি কোথা চললে সবাই মিলে?’

হাঁস বলে, ‘চলো, চলো, আমাদের সঙ্গে চলো। জানো না মাটিতে আগুন লেগে গেছে।’

সবাই ছুটছে। বাঁকা পা ভালুক ছোটে পিছে পিছে। দেখা শজারুর সঙ্গে। শজারু শুধোয়, ‘তোমরা সবাই, চললে কোথায়?’ সবার তাড়া। কারও সময় নেই উত্তর দেবার। শেষপর্যন্ত হাঁসবাবাজিই উত্তর দেয়,

‘ছোট রে চাচা,

আপন বাঁচা।

খবর খাঁটি,

জ্বলছে মাটি।

রইলে পিছে,

মরবি মিছে।’

ছোট ছোট ছোট। আর কি দাঁড়ায়? এতদূর ছুটে এসে সকলেরই ভারী তেষ্টা পেয়েছে।

মোরগ তখন হাঁসবাবাজিকে বলল,

‘কোঁকর কো আমি পারি,

জলের কাছে নিয়ে যেতে আমি পারি।

কিন্তু বাপু একটা কথা। একটা গভীর খাদ পেরিয়ে যেতে হবে।’

‘ঠিক আছে। তাই হবে।’ সবাই রাজি। ভারী জল তেষ্টা পেয়েছে কিনা। মোরগ আগে ধায় পিছে পিছে সবাই যায়। সবাই এসে পৌঁছোল এক গভীর খাদের কাছে। হাঁস আর মোরগ ডানা মেলে এক লাফে খাদ পেরিয়ে গেল। এবার খরগোশের পালা। মারলে এক লাফ। ঝপাং করে খরগোশ পড়ল সোজা খাদে। পিছন পিছন শেয়াল লাফাল— ধপাস, এক্কেবারে সোজা খাদে। থপ থপ থপ। এগিয়ে এল ভালুকভায়া। এক লাফ, যাঃ সোজা সেই গর্তে। ভালুকভায়া হাঁকুপাঁকু করে। কত ওঠার চেষ্টা করে। উঁহু, যে গর্তে ছিল সেই গর্তেই রইল। ধার বেয়ে বেয়ে ওঠে। বাইরে আসতে চায়। ধুপধাপ পড়ে বড়ই ব্যথা পায়, সারা গায়।

হঠাৎ শেয়াল গান জুড়লে—

‘শেয়ালমামা,

গাল ভরা নাম

ডাকতে আরাম।

নেকড়েভায়া

নামটি ভাল

যে যাই বলো।

খরগোশ ভাই, মিষ্টি ডাক

তর্ক থাক।

(আর) শজারুর ঝি

নামের ধাঁচা

বিশ্রী পচা।’

শজারু যে কখন খাদে পড়েছিল কেউ দেখেনি। ধূর্ত শেয়াল টপ করে খেয়ে ফেললে শজারুটাকে। আবার গান জুড়ল। গান শেষ হল। আর শেয়াল এবার খরগোশটাকে দিলে মুখে পুরে। মস্ত গাল ফুলিয়ে ফুলিয়ে খেয়েই ফেলল সুন্দর লালচোখ খরগোশটাকে। শেয়াল আবার গান ধরল।

‘জুড়ল আবার গান,

নেকড়ের খাড়া কান,

(ভাবে) খাবে নাকি মোরে?

দেব টুঁটি ধরে,

একদম মেরে।’

নেকড়ে মনে মনে বলে। আচমকা শেয়াল নেকড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর সে কী মারামারি আঁচড়া-কামড়ি। শেষ পর্যন্ত শেয়াল জিতল। নেকড়ে মরল। আস্ত নেকড়েটাকে খেয়ে ফেলল শেয়ালটা। কী কাণ্ড! তাতেও সাধ মিটল না। গুছিয়ে খেতে বসল নেকড়ের নাড়িভুঁড়ি। খায় আর বলে, ‘আঃ কী সোয়াদ, তোফা খেতে।’ চেটেপুটে খাচ্ছে। বোকা ভালুক ততক্ষণে খিদে তেষ্টায় মরোমরো। ভালুক ভাবে এ তো যে সে শেয়াল নয়! নেকড়ে খাওয়া কি কম কথা! দিল সাবাড় করে! এবার কি তার পালা? ভয়ে ভয়ে পিটপিট চোখ, থপথপে পা, লোমে ভরা গা ভালুক এসে দাঁড়াল শেয়ালের সামনে।

‘কী খাচ্ছ ভাই শেয়ালদাদা? একটু দাও না ভাই। খিদের চোটে মরি। সময় এলে আমি তোমার উপকার করব দাদা, কথা দিচ্ছি।’ শেয়াল ভারী চালাক। সে তখন কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘আর বলো কেন ভাই দুঃখের কথা। তোমার যা দশা আমারও তাই, জল নাই, খাবার নাই। নিজের পেটটাই তাই ছিঁড়ে ফেললাম ভাই।’ ভালুক বলে, ‘তবে আমার পেটটাও ছিঁড়ে ফেলি? একটু খেয়ে বাঁচি।’ এই না বলে বোকা ভালুক দিল তার ধারালো নখ দিয়ে পেট চিরে। ব্যস, ভালুক গেল মরে। সবাইকে ঠকিয়ে মেরে খেয়ে শেয়ালের ভারী তেষ্টা পেল। কিন্তু জল কই?

হঠাৎ দেখে গর্তের পাড়ে বাইরে উঁচু গাছের ডালে বসে আছে একটা ছোট্ট নীল রঙের পাখি। এক কাঠঠোকরা। শেয়াল পাখিটাকে বলে, ‘একটা সিঁড়ি বানিয়ে দেবে ভাই? তোমাকে চমৎকার একটা গাছ বানিয়ে দেব। তুমি সেই গাছে বাসা বাঁধবে, ডিম পাড়বে।’

রঙিন কাঠঠোকরা ওড়ে আর ঠোকে, ঠোকে আর ওড়ে। ওমা, ঠুকে ঠুকে কী চমৎকার একটা সিঁড়ি বানিয়ে দিলে। শেয়াল অমনি চটপট গর্তের বাইরে এল চলে। রঙিন কাঠঠোকরাকে দিল একটা ঝোপ খুঁজে। রঙিন পাখি বাসা বাঁধলে। বাসায় ডিম পাড়ল। ডিমে তা দিতে বসল। একদিন শেয়াল এসে হাজির। বলল, ‘নীলপাখি, নীলপাখী ভারী বিপদ।

আমাকে একটা ডিম দেবে ভাই

ঘরে কুটুম, কুটোটি নাই।

ভিখ মাগতে এলেম যে তাই

কী খাওয়াব বলো তো? এদিকে কুটুম উপোস থাকলে তো অমঙ্গল হবে সবার— আমার, তোমার।’

ভালমানুষ ছোট্ট পাখি শেয়ালকে একটা ডিম দিল। পরদিন সকালে আবার শেয়াল এসে হাজির, বলে, ‘বাড়িতে কুটুম। একটা ডিম দেবে ভাই?’ ভালমানুষ কাঠঠোকরা দিয়ে দিল একটা ডিম। একটা একটা করে ছোট্ট রঙিন পাখির সব ক’টা ডিম শেয়াল চেয়ে নিল। রঙিন পাখি বাসার চারধারে ওড়ে আর কাঁদে। ওই পথে দুটো কুকুর যাচ্ছিল। পাখির কান্না শুনে জিজ্ঞেস করল, ‘ছোট্ট পাখি, ওগো রঙিন পাখি কাঁদছ কেন?’

‘শেয়াল আমার সব ক’টা ডিম খেয়ে ফেলল। একটাও বাকি নেই।’

‘কিচ্ছু ভেবো না, আমরা শেয়ালের মজা দেখাচ্ছি।’ এই কথা বলে কুকুর দুটো খড়ের গাদায় লুকিয়ে রইল।

একটু পরেই শেয়াল এসে হাজির। বললে, ‘ছোট্ট পাখি। রঙিন পাখি, একটা ডিম দাও তো ভাই। বাড়িতে কুটুম, কী করি বলো তো?’

ধরা গলায় রঙিন ছোট্ট পাখি জবাব দেয়, ‘আমার আর একটিও ডিম নেই।’

‘শিগগিরি দে বলছি। নয়তো লেজের বাড়ি মেরে তোর বাসা ভেঙে তছনছ করে দেব।’ তারপর তার লোমে ভরা মোটা লেজ দিয়ে সে কী আছাড়ি পিছাড়ি।

হঠাৎ শেয়াল দেখে খড়ের গাদার নীচে দুটো কুকুর।

শেয়াল শুধোয়, ‘দড়িগাছা এখানে কে রেখে গেছে রে?’

‘একটি মেয়ে এসেছিল। সে রেখে গেছে।’ রঙিন ছোট্ট পাখি উত্তর দেয়।

‘দে তো আমার দড়িগাছা। বাড়ি নিয়ে যাব। আর ছেলেমেয়েগুলোকে সপাং সপাং করে মেরে সিধে করব।’ বললে শেয়াল।

এই কথা শুনেই কুকুর দুটো খড়ের তল থেকে বেরিয়ে এল। আর তাড়া করল শেয়ালটাকে। শেয়াল ছুটতে ছুটতে গিয়ে একটা গর্তে ঢুকল। কুকুর দুটো নড়েও না চড়েও না। খালি চুপচাপ বসে থাকে। একটু পরে শেয়াল ভাবল এতক্ষণে নিশ্চয়ই কুকুর দুটো চলে গেছে। ব্যাটারা মহা বদ। বিড়বিড় করে নিজের মনেই শেয়াল ছড়া কাটে,

‘ঠ্যাংগুলো মোর বাধ্য,

জুতোয় মোজায় রাখব ঢেকে

যেদিন হবে সাধ্য।

চোখ দুটো বিশ্বস্ত

সুযোগ পেলেই আনব কিনে

আয়না একটা মস্ত।

সজাগ আমার কান

সোনার ঝোলা দুল পরাব

একখান একখান।’

শেয়াল বলে, ‘আর আমার ল্যাজ; তুই ব্যাটা কোনও কম্মেরই নোস। তোকে নিয়ে খালি আমার ঝঞ্ঝাটই সার।’ এই বলে ল্যাজটাকে শাস্তি দেবার জন্য দিল গর্তের বাইরে করে। কুকুর দুটো তৈরি ছিল। ধরলে কামড়ে লেজটা। তারপর ল্যাজ ধরে টেনে বের করল শেয়াল ব্যাটাকে। শেয়াল চেঁচায়, ‘ছাড় ছাড়, ছাড়, ওটা আমার ল্যাজ নয়। ওটা গাছের শিকড়।’

কুকুর দুটো কি আর এতই বোকা? শেয়ালটাকে বাগিয়ে ধরে, চামড়া ছাড়িয়ে শান্ত হল। কুকুরের রাগ ক্ষান্ত হল।

তারপর? তারপর থেকে কুকুর দুটো গাছের তলায় তলায় পাহারা দিয়ে বেড়ায়। রঙিন পাখি আবার বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে। কুকুরদের সঙ্গে তার ভারী ভাব।

মরল শেয়াল ধূর্ত স্বভাব।

কুকুর পাখির দিব্যি যে ভাব।

এখনও প্রতি বসন্তে রঙিন পাখিরা ডিম দেয় আর গাঁয়ের কুকুররা পাহারা দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *