শুক্লপক্ষের তারা – ৪১-৬০

৪১.

আমার কাজ তো শেষ। থাকার কি দরকার।
আর অপেক্ষাই করব কার জন্যে ?
এখানে হৃদয় ভাঙ্গে
এখানে হৃদয় বদলায়-
তার চেয়ে চলে যাই। বিদায় !

৪২.     

এসেছিলে আচম্বিতে। চলে গেলে নিঃশব্দে। 
ধূসর রঙ ছড়িয়ে অস্তমিত সূর্যের মতো অস্তদিগন্তে মিলিয়ে গেলে। 

বসন্তসন্ধ্যা ঘন হয়ে আসে আজও। জোনাকির ঝংকারে প্রতিদিন শুনি —- এই বুঝি সে এলো, এই বুঝি এলো। 
মালবিকা শুধু একবার এসো তুমি, অরণ্যের পথ বেয়ে অন্তহীন এই কালস্রোতে। 

এসে পূর্ণ কর, এসে চরিতার্থ কর — অসমাপ্ত চুম্বন তোমার।

৪৩.      

যে সব ভালোবাসা আমি পেয়েছি,
তা আজ যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়ে এলাম । ঘৃণাগুলোও রেখে এলাম গহীন বালুচরে। 

জল বলেছিল বারবার —
তুমি স্নান করো, পবিত্র করো দেহ, 
অসুন্দরগুলো নাও মুছিয়ে।

৪৪. 

প্রতিদিন রাত্রি নেমে আসে। আলো জ্বেলে তাকে খুঁজে আনি। চোখে চোখ রেখে দেখি তার সুবর্ণখচিত মুখ। আমি জানি, সকাল হলেই সংসার শুরু হবে এবং সেখানেই সে আবার হারিয়ে যাবে।

৪৫.

মনে হয়, জগতের সকল অন্ধকার দিয়ে তোমাকে আমি ঢেকে রাখি। রাখিও তাই। কিন্তু কখন যে তুমি শত সহস্র আলোকবর্তিকা হয়ে অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে ওঠো। আর মুহূর্তেই যেন আমার অন্ধকার ঘরটি আলোকিত হয়ে যায়।

৪৬.

‘তোমাকে ভালোবাসি। কোনো দিন ভুলব না। ছেড়ে যাব না।’
কত প্রতিশ্রুতি!

সেই তুমি কিসের টানে চলে গেলে, ফেলে রেখে গেলে
তোমার স্মৃতি। 

কথা রাখলে না, ফিরে আর আসলে না, ভেঙে ফেললে
সকল প্রতিশ্রুতি।

৪৭.      

আবির দিচ্ছিলাম তার তুলতুলে গালে
সে তখন বলে ওঠে — এ তুমি কি করছো !
কী করছো! 
আমি বলি, আজ বসন্ত দিন। শহর জুড়ে চলছে
লাল হলুদের উৎসব,
যেতে হবে যে — বকুল শিমুল কৃষ্ণচূড়া আর মহুয়া বনে।

৪৮.  

প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভেঙে যায় 
দেহ জুড়ে ক্লান্তির অবসাদ
তখনও ফুরায়নি রাত 
পাজরে ধরে আছে তার কোমল হাত –
হৃদপিণ্ডের গভীরে 
অনুভবে বুঝতে পারি আমার অস্তিত্ব 
জুড়ে সে-ই আছে।

৪৯.

আমার জীবন যে পথ দিয়ে চলে যায়, 
তুমি সেই পথেই আমার পায়ের চিহ্ন চিনে 
ফিরে আসো। 
আমি বললে, বলো —
তুমি যেখানে যাও আমার জীবন সেখানেই 
ফিরে যায়।

৫০.      

যে চলে যেতে চায়, সে যাওয়ার আগে 
অনেক আচরণেই বুঝিয়ে দেয় — 
সে চলে যাচ্ছে। 
কিন্তু আমরা আবেগে এতটাই মুঢ় হয়ে থাকি যে, 
তার চলে যাবার সংকেতগুলো বুঝি না।

চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারি — 
সে চলে গেছে।

৫১.

সংসার ধর্ম আর ভালো লাগে না। বৈরাগ্যই শান্তি। এসো এই বসন্তেই আমরা পথে বেরিয়ে পড়ি। সামনের বসন্ত নাও পেতে পারি। বাকী জীবন পথে প্রান্তরে, আশ্রমে আর আখড়ায় কাটিয়ে দিই।

৫২.

নি:সঙ্গ নাভি দেখি, 
নিসর্গ শোভা দেখি, 
চুপচাপ পুষ্পবৃন্ত দেখি, 
তৃণভূমি দেখি ।

দুহাতে ধরেছি অরণ্য, 
মুঠোয় ভরি এর সুগন্ধ। 
ছিঁড়ে যাচ্ছে মায়ার টান। 
উল্টে যাচ্ছে যতিচিহ্ন। 

ঠোঁটের স্পর্শে জেগেছে প্রেম 
জ্বলছে বহ্নিশিখা,
ছিনিয়ে নিচ্ছি তার শেষ আলোটুকু, নিঃশেষ হচ্ছে স্বেদ কণিকা।

৫৩.     

‘আমি তোমার জীবনেও আছি, মরণেও আছি।’
এই কথাটি যে বার বার বলত সে আজ আর জীবনে নেই। 

মানুষ কখন যে জীবনে আসে, 
আর কখন চলে যায়। 
কেউ বলতে পারে না। 
যে থাকতে চেয়েছিল জীবনে, সে এখন রয়ে গেছে মনে।

৫৪.

পোড়ামাটির প্রতিমার গন্ধ ছিল তোমার শরীরে
কাঁচা মাটি ছানতে গিয়ে পেয়েছিলাম তার স্বাদ
পুড়েছ আর জ্বলেছ ভালোবাসায় হয়েছ নিখাদ।

৫৫.

ভালোবেসে কাছে আসতে পারোনি যখন
তখন বিচ্ছেদই অনন্ত হয়ে থাক,
তোমার জন্য রোগে শোকে জ্বলবে শরীর
স্মৃতিগুলো পুড়ে খাক হয়ে যাক।

৫৬.

দুপুরের রোদ্দুর নিভে গেল, অলৌকিক এক আঁধার হলো।
এই বসন্তে বৃষ্টি এলো।
এক অপ্রেমিকের আবদারে বিবাগী গান বেজে উঠল তার বীণা তারে।

৫৭.

অন্ধকার পছন্দ করো, বুকের খাঁজে তাই তোমাকে রেখেছি
তা দেখে রাত্রিও হিংসা করে-
শরীরের ঘ্রাণ পেয়ে আহলাদী হয়ে ওঠো-
আমিও তখন স্বপ্ন বীজ বুনি তোমার উর্বর মৃত্তিকায়।

৫৮.

চলে যাব সব ফেলে, এই অবগুণ্ঠিত নীলাকাশ, 
জলে ভরা টইটম্বুর এই নদী, স্মৃতির বসতবাড়ি, শ্রাবণ কদম্ব ফুল।
রেখে যাব লুকিয়ে রাখা জীর্ণ প্রেমপত্র আর তোমাকে দেওয়া নাকফুল।

৫৯.     

তোমার মনে বসন্তের আগুন লেগেছে। এই আগুন আমিই নিভে দিতে পারি। যদি চাও আমার জল বৃষ্টি মেঘ।

৬০.       

ভরা নিশীথ দেখলে ভয় লাগে। যদি কাছে টানতে যেয়ে আড়াল হয়ে যাও? যদি অন্ধকার ঘিরে ধরে? তারচেয়ে পূর্ণিমায় এস, ওগো পূর্ণিমা নিশীথিনী। ধবল আলোর পশর নামবে ধরণীতে। সে আলোয় পথ চিনে নেব এবং চিনেও নেব তোমার সাদা শাড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *