শিল্পীর আসনে
কলকাতায় প্রতিষ্ঠা
বৃহত্তর জীবনের অনাগত দিনগুলি হাতছানি দিয়ে ডাক দিচ্ছিল। যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম, বি.এ. পাশই জীবনের লক্ষ্য নয়। ওরে নীড়হারা, পথহারা গানের পাখী, ফিরে আয়, ফিরে আয়। কলকাতার জনসমুদ্রে ডুবিয়ে দে তোর বি.এ. পাশের মোহ-তরী। এই সমুদ্রে ভেসে ওঠ, উঠে দাঁড়া। মনুমেন্টের সু-উচ্চ চূড়ায় গানের সুরে স্তব্ধ করে দে জনতার কলরব।
কলকাতা চলে এলাম। অভিভাবকের বিনানুমতিতে, সোজা কথায় পালিয়ে এলাম। আমার বন্ধু জীতেন মৈত্র কলকাতায় আইন পড়ছে তখন। তার চেষ্টায় প্রখ্যাত আইনজীবি (কিছুকাল পূর্বে ঢাকার পাবলিক প্রসিকিউটর) তসকিন আহমদ সাহেবের বাড়ীতে আমার থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হল। বিনিময়ে আমাকে সে বাড়ীর দু’তিনটি ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে পড়াতে হবে। কিন্তু আমার হাত-খরচের পয়সা চাই ত’। জলপাইগুড়ির শফিকুল ইসলামের ( তখনকার ডি. পি. আই’র পি. এ.) সাথে দেখা করলাম। তিনি আমাকে ডি.পি. আই অফিসে মাসিক ৪৫ টাকা বেতনে এক চাকুরী দিলেন। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে চাকুরী করি আর দু’বেলা ছাত্র পড়াই। তসকিন সাহেবের বড় ভাই তকরীম আহ্ মেদ, ভারী সুন্দর বাঁশী বাজান। একদিন তাঁর বাঁশী শুনলাম, শুধু তাই নয়, ঠুংরীও গাইতেন চমৎকার — তারপর আরও অবাক হলাম, যখন দেখলাম তাঁর সেতার, তবলা ও পিয়ানোতেও চমৎকার হাত।
গ্রামোফোন কোম্পানীতে গেলাম। ভগবতীবাবু আমার গান নিতে চাইলেন। এবার গাইলাম শৈলেন রায়ের লেখা, “আজি শরতের রূপ দীপালি” আর জীতেন মৈত্রের লেখা, “ওলো প্রিয়া নিতি আসি তব দ্বারে মন ফুল মালা নিয়া।” গান দু’খানা সুরে অভিনবত্বে বাজারে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করল।
জীতেনের ভগ্নীপতির বাসায় গিয়ে মাঝে মাঝে গানের আসরে যোগ দিতাম। সেখানে নাকু ঠকুরকে দেখতাম। তাদের বাসার বাজার সরকার। বাড়ির বাজার করে দিয়ে ভদ্রলোক সারারাড উধাও হয়ে থাকতেন। ঠিক সকালে আবার বাজার করবার জন্য আসতেন। আমার গান শুনতেন, শুধু মুচকি মুচকি হাসতেন কিছুই বলতেন না। কে জানত যে এই নাকু ঠাকুরই ওদের বাসায় বাজার সরকারের কাজ করে সারারাত গোপনে তার গুরুগৃহে গিয়ে সাধনা করতেন উচ্চাংগ সংগীত। এই নাকু ঠাকুরই হচ্ছেন ভারতের বিখ্যাত ওস্তাদ শ্রীতারাপদ চক্রবর্তী!!
কলকাতার পথে পথে ঘুরি, বিরাট কলকাতা। এই বিরাট বিশাল শহরে কি কোনদিন প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারব না?—মনের এই সূক্ষ্ম অভিলাষ খোদ। হয়ত মনযুর করেছেন, তাই কি করে এর সুত্রপাত হল তাই বলছি।
একদিন জীতেন এসে বললে, “দেখ, আজ কিন্তু পাঁচটার আগেই অফিস থেকে বাসায় ফিরবি। আমাদের আইনের ছাত্রদের রি-ইউনিয়ন উপলক্ষ্যে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে সন্ধ্যা সাতটায় বিরাট এক গানের জলসা হবে! এই দেখ, হ্যান্ডবিলে তোর নাম ছাপানো হয়েছে। না গেলে আমি বড় লজ্জা পাব। “ হ্যিগুবিলে আমার ছাপ। অক্ষরে নাম দেখে খুশী হলাম বটে, কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ মল্লিক এই সব মহারীদের নাম দেখে দস্তুরমত ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, “ওদের মাঝে আমি গাই কি করে? অত বড় বড় জাদরেল গাইয়ে! না ভাই, মাফ করিস, পারব না।” ও বললে, “আচ্ছা গাইতে হবে না। ওদের গান ত’ শুনতে পাবি, এইটাই ত’ লাভ।” আমি খুশী হয়ে বললাম, “হ্যাঁ, ঠিক নিশ্চয়ই আসব।” সাড়ে ছ’টার সময় ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে গেলাম। লোকে লোকারণ্য।…. ড্রপ উঠল সাতটায়। প্রথমেই কৃষ্ণচন্দ্র দে গান সুরু করলেন। কি মধুময় দরাজ কণ্ঠ। মুগ্ধ হয়ে গেলাম।…. গানের পর গান, তিনখানা গান গেয়ে তিনি নিষ্ক্রান্ত হলেন। তারপর কে, মল্লিকের গানের সময় হলে বেশ কথাবার্তা ও গুঞ্জন উঠল। তারপর আরও দু’ একজনকে আসরে নাবতে হল, কারও গানই জুৎসই হল না……..। এবার আমার কাছে ক’টি ছেলে এসে মহাবিনয়ে বলে উঠল, “স্তার, এবার ত’ আপনাকে যেতে হয়।” আমি খোদাকে ডাকছিলাম, কিছুতেই আমি পারব না, প. ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে। এর মধ্যেই ড্রপ উঠল। এক ভদ্রলোক ‘ঘোষণা করে দিলেন : এবার নবাগত শিল্পী মিঃ আববাসউদ্দীন আহমদ আপনাদের গান শোনাবেন।
বলির পাঠার মত কাঁপতে কাঁপতে ষ্টেজে প্রবেশ করে হারমোনিয়ামটা কোলে টেনে নিলাম। জানি না খোদার কী মেহেরবানী, মুসলমান নাম শুনেই হোক বা আমার তখনকার পহিলে দর্শনধারী চেহারার গুণেই হোক জনতা খুব শান্তভাব ধারণ করল। প্রথমেই গাইলাম, “আজি শরতের রূপ দীপালি”। . গান শেষে কী করতালি! ভাবলাম গান বুঝি খারাপ হয়েছে, শত চীৎকার উঠল, “আর একখানা।” গাইলাম, “কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো।” এ গান শুনেও মহা উল্লাস। “আবার, আবার! আর একখানা!” আমি চোখে ইশারা করলাম ড্রপ ফেলে দিতে। জীতেন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।….সে দিন অন্তত পঞ্চাশ ষাট জন ছেলে আমার ঠিকানা লিখে নিল। বুঝলাম, আল্লাহ আমার অন্তরের কামনা মনযুর করেছেন।
এরপর থেকে আসতে লাগল প্রত্যহ কত নিমন্ত্রণ। স্কটিশচার্চ কলেজ, প্রেসিডেন্সী কলেজ, “ওন” হোস্টেল, বেকার হোষ্টেলে, কারমাইকেল হোষ্টেল, হাওড়া, হুগলী, রাণীগঞ্জ, শ্যামবাজার, টালীগঞ্জ, ডায়মণ্ডহারবার থেকে আসতে লাগল আমন্ত্রণ! সরস্বতী পূজার রাতে হোষ্টেল, স্কুল-কলেজ থেকে এত নিমন্ত্রণ আসতে লাগল যে বাধ্য হয়ে তখন আমার গানের জন্য কিছু পারিশ্রমিক বরাদ্দ করতে হল।
১২২ নং বি, বউবাজার ষ্ট্রীটের চারতালায় মেস। সেই মেসে প্রায় দু’ বছর থাকি! পনের ষোলজন মেম্বার। অধিকাংশই চাকুরে। একজন ল’ ক্লাশের ছাত্র— সিলেট বানিয়াচঙের আবদুল মজিদ। অমন পরোপকারী লোক খুব কম দেখেছি। মেসে কারো অসুখবিসুখ হলে ডাক্তার ডাকা, ওষুধ আনা, পথ্য তৈরী করে খাওয়ানো, রোগীর শুশ্রুষা করা থেকে কারে। দেশ থেকে কোন বিয়েশাদির ব্যাপারে কারুর খরচপত্র করবার জন্য সাহায্য করা, নতুন কেউ এলে তাকে নিয়ে শহরের এটা ওটা দেখানো—মোটকথা সব কাজেই সবার প্রয়োজনে এগিয়ে আসতেন এই মজিদ সাহেব। এই মেসেই থাকতেন ডাঃ এনামুল হক। মাঝে মাঝে আসতেন ডাঃ শহীদুল্ল।। ডাঃ শহীদুল্লার এক শ্যালক তাঁকে আমরা সবাই ডাকতাম জুমু ভাই’ বলে, ভাল নাম মিঃ মোতাদাইয়েন বি, এল। ওকালতি না করে পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করতেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহারের জন্য নববর্ষে আমরা মেসের সবাইকে যে উপাধি দেওয়া হতমোতাদাইয়েন দি জেন্টলম্যান। পরবর্তীকালে পার্কসার্কাসে আমরা একই বাসার পরিবারবর্গ নিয়ে বসবাস করি।
এই বৌবাজার মেসে থাকতে একদিনের একটা ঘটনা আজো ভুলিনি। সন্ধ্যার পর মেসে একদিন গানের জলসা বসেছে। আসর জমজমাট। আসরে চা চলছে, পানদোক্তার সদ্ব্যবহার করছেন অনেকেই। হঠাৎ এক পথচারী আমাদের ঘরে এসে হস্তদন্ত হয়ে উপস্থিত ভদ্রলোকের ধুতি পাঞ্জাবী রক্ত-রাগ-রঞ্জিত। ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “উপর থেকে কে এ কাজ করেছেন? সাহস থাকে বলুন!” গান তখন থেমে গেছে। তাঁর মুখের দিকে চেয়ে মনে হল চেনা চেনা। কাছে গিয়ে দেখি এ ভদ্রলোকের সাথে তো রোজই আমার দেখা রাবটার্স বিল্ডিং পোষ্ট অফিসে। সেভিংস সেকশনে কাজ করেন। আর ভদ্রলোকের এ অবস্থাও যে আমিই করেছি। বলে উঠলাম, “আরে আপনি?” তিনিও বিস্মিত হয়ে বলে উঠলেন, “আপনি এইখানেই থাকেন!” বললাম, “অজ্ঞে হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছেন গান-বাজনা চলছে, পান খেয়ে উপর থেকে ও কীর্তি আমিই করেছি, মাফ করবেন।” ভদ্রলোক গায়ের পাঞ্জাবীটা খুলে ফরাসে বসে পড়লেন। বলে উঠলেন, “মাফ করব যদি গানের আসর আবার চলে।” আবার চা এল, পান এল, ভদ্রলোক চায়ে, পানে, গানে রঙীন হয়ে উঠলেন তারপর তাঁর রঙীন পাঞ্জাবীটা আবার গায়ে দিয়ে রাঙ। ঠোঁটে নিষ্ক্রান্ত হলেন।
এই মেসের আর দু’জনের কথা ভুলিনি। বারাসত-বসিরহাটে বাড়ী একজন তওক্কাল সাহেব, তাঁকে সবাই ডাকতাম, বড় ভাই’ বলে। তিনি মেসের মধ্যে সবারি বয়সে বড়। তিনি প্রত্যেক কথার মধ্যেই বলতেন ‘মানে যে। আমি যে তাঁকে মানে যে ভীষণ মানে যে মানে যে করে খ্যাপাতাম। প্রথম প্রথম মানে যে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন নি, কিন্তু ক্রমশঃ মানে যে এত ঘন ঘন ঐ লফজ টা বলতাম তাতে মানে যে একদিন তিনি দস্তুরমত রেগে গিয়ে আমাকে বকুনি দিতে গিয়ে শুধু মানে যে মানে যে ছাড়া আর কিছুই বলতে পারলেন না।
আর একজন ছিলেন আমাদের সার্বজনীন নানা। তিনি বৃদ্ধ বয়সে তরুণী ভার্যা নিয়ে খুব রসাপ্লুত ছিলেন। আমরা সেই নানাকে নিয়ে যে কী রসালাপই করতাম!!
কলকাতায় তখন এই মেস জীবনে এক এক মাসে এক একজন ম্যানেজার হতাম বাজার খরচ ও হিসাবপত্তর রাখার। মাসে দশটাকার বেশী খরচ উঠলে কী আলোড়ন উঠতো! আর সেই দশটাকাতে সারা মাসে মোটামুটি ভালো খেয়েও মাসের শেষে একটা গ্র্যাণ্ড ফিষ্ট হত।
ইসলামী গান, আমি ও কাজিদা
কাজিদার লেখা গান ইতিমধ্যে অনেকগুলো রেকর্ড করে ফেললাম। তাঁর লেখা ‘বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধূর, ‘অনেক ছিল বলার যদি দু’দিন আগে আসতে’, ‘গাঙে জোয়ার এলো ফিরে তুমি এলে কৈ’, ‘বন্ধু আজো মনে রে পড়ে আম কুড়ানো খেলা’ ইত্যাদি রেকর্ড করলাম।
একদিন কাজিদাকে বললাম, “কাজিদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা উর্দু কাওয়ালী গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রী হয়, এই ধরণের বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না? তারপর আপনি তো জানেন কি ভাবে কাফের কুফর ইত্যাদি বলে বাংলায় মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে আপাংক্তেয় করে রাখবার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ! আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।”
কথাটা তাঁর মনে লাগল। তিনি বললেন, “আব্বাস, তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তাঁর মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারব না।” আমি ভগবতী ভট্টাচার্য অর্থাৎ গ্রামোফোন কোম্পানীর রিহার্সাল ইন চার্জকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “না না না ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।”
মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলাম। এর প্রায় ছ’মাস পরে। একদিন দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানীর রিহার্সেল ঘরে গিয়েছি। দেখি একটা ঘরে বৃদ্ধ ভগবতীবাবু বেশ রসাল গল্প করছেন। আমি নমস্কার দিতেই বৃদ্ধ বললেন, “বসুন বসুন।” আমি বৃদ্ধের রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম, এই-ই উত্তম সুযোগ। বললাম, “যদি কিছু মনে না করেন তা হলে বলি। সেই যে বলেছিলাম ইসলামী গান দেবার কথা, আচ্ছা, একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রী না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কি?” তিনি হেসে বললেন, “নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা করা যাবে।”
শুনলাম পাশের ঘরে কাজিদা আছেন। আমি কাজিদাকে বললাম যে ভগবতীবাবু রাজী হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজিদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজিদা বলে উঠলেন, “ইন্দু তুমি বাড়ী যাও, আব্বাসের সাথে কাজ আছে।” ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোংগা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভিতরই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।’ তখুনি সুরসংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন ঠিক এই সময় আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, “ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলে নবীন সওদাগর।”
গান দু’খানা লেখার ঠিক চারদিন পরেই রেকর্ড করা হল। কাজিদার আর ধৈর্য মানছিল না। তাঁর চোখেমুখে কী আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল। তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হত শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দু’খানা আমার তখন মুখস্থও হয়নি। তিনি নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের উপর ঠিক আমার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজিদা নিজেই সেই কাগজখানা ধরলেন, আমি গেয়ে চললাম। এই হল আমার প্রথম ইসলামী রেকর্ড!! দু’মাস পরে ঈদুল ফেতর। শুনলাম গান দু’খানা তখন বাজারে বের হবে।
ঈদের বাজার করতে একদিন ধর্মতলার দিকে গিয়েছি। বি. এন. সেন অর্থাৎ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানীর বিভূতিদার সাথে দেখা। তিনি বললেন, “আব্বাস আমার দোকানে এসো।” তিনি এক ফটোগ্রাফার ডেকে নিয়ে এসে বললেন, “এর ফটোটা নিন তো।” আমি তো অবাক। বললাম, “ব্যাপার কি?” তিনি বললেন, “তোমার একটা ফটো নিচ্ছি, ব্যস আবার কি?”
ঈদের বন্ধে বাড়ী গেলাম। বন্ধের সাথে আরো কুড়ি পঁচিশ দিন ছুটী নিয়েছিলাম। কলকাতা ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিস যাচ্ছি। ট্রামে একটি যুবক আমার পাশে গুণ গুণ করে গাইছে, “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে।” আমি একটু অবাক হলাম। এ গান কি করে শুনল? অফিস ছুটীর পর গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েছি, মাঠে বসে একদল ছেলের মাঝে একটি ছেলে গেয়ে উঠল….ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে। তখন মনে হল এ গান তো ঈদের সময় বাজারে বের হবার কথা। বিভূতিদার দোকানে গেলাম। আমাকে দেখে তিনি একদম জড়িয়ে ধরলেন। সন্দেশ, রসগোল্লা, চা এনে বললেন, “খাও।” আমার গান দুটো এবং আর্ট পেপারে ছাপানো আমার বিরাট ছবির একটা বাণ্ডিল সামনে রেখে বললেন, “বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বিলি করে দিও। আমি প্রায় সত্তর আশী হাজার ছাপিয়েছি, ঈদের দিন এসব বিতরণ করেছি। আর এই দেখ দু’হাজার রেকর্ড এনেছি তোমার!!“
আনন্দে খুশীতে মন ভরে উঠল। ছুটলাম কাজিদার বাড়ী। শুনলাম তিনি রিহার্সেল রুমে গেছেন। গেলাম সেখানে। দেখি দাবা খেলায় তিনি মত্ত। দাবা খেলতে বসলে দুনিয়া ভুলে যান তিনি। আমার গলার স্বর শুনে একদম লাফিয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, “আব্বাস তোমার গান কী যে—” আর বলতে দিলাম না, পা ছুঁয়ে তাঁর কদমবুসি করলাম। ভগবতীবাবুকে বললাম, “তা হলে এক্সপেরিমেন্টের ধোপে টিকে গেছি কেমন?” তিনি বললেন, “এবার তাহলে আরো ক’খানা এই ধরণের গান….” থোদাকে দিলাম কোটি ধন্যবাদ।
এরপর কাজিদা লিখে চললেন ইসলামী গান। আল্লা-রসুলের গান পেয়ে বাংলার মুসলমানের ঘরে ঘরে জাগল এক নব উন্মাদনা। যারা গান শুনলে কানে আংগুল দিত তাদের কানে গেল, “আল্লা নামের বীজ বনেছি” “নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহ্ মদ বোল।” কান থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনল এ গান, আরো শুনল “আল্লাহ্, আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়।” মোহররমে শুনল মর্সিয়া, শুনল “ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়।” ঈদে নতুন করে শুনল “এলো আবার ঈদ ফিরে এলে। আবার ঈদ, চল ঈদগাহে।” ঘরে ঘরে এল গ্রামোফোন রেকর্ড, গ্রামে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আল্লা রসুলের নাম।
কাজিদাকে বললাম, “কাজিদা, মুসলমান তো একটু মিউজিক মাইণ্ডেড হয়েছে। এবার তরুণ ছাত্রদের জাগাবার জন্যে লিখুন।” তিনি লিখে চললেন, “দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠিছে” “শহীদী ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারী” “আজি কোথায় তখতে তাউস, কোথায় সে বাদশাহী।”
ইসলামী গান পাঁচ ছ’খানা বাজারে বের হওয়ার সাথে সাথে বাংলা দেশ থেকে বহু চিঠি সাসতে আরম্ভ করল গ্রামোফোন কোম্পানীর ঠিকানায় আমার নামে কেউ লিখল, হুজুর, কুকুর মার্কা হলুদ রেকর্ড অর্থাৎ ‘টুইনে’ গান দিলে বারো আনা এক টাকায় আমরা অনায়াসে কিনতে পারি।
কাজিদাকে বললাম। তিনি তো খুব আপত্তি তুললেন। বললেন “পাগল, এই কিছুদিনের মধ্যেই রেকর্ডে রয়ালটি প্রথা চালু হবে। আর্থিক দিক দিয়ে তুমি ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” আমার শুধু মনে ভাবনা গরীব মুসলমান, যদি বারো আনা এক টাকায় রেকর্ড পায়, হোক গে আমার আর্থিক ক্ষতি, গানগুলো তো ঘরে ঘরে প্রচার হবে। জাগবে ইসলামী ভাব, জাতীয় ভাব। “নাঃ, কাজিদা হোক গে আমার আর্থিক ক্ষতি।” তখন কোম্পানীর সাথে বন্দোবস্তু হল আমি টুইনেই গান দেব। তার দরুণ রেকর্ড প্রতি কোম্পানী আমাকে মাত্র একশত টাকা করে দিতে রাজী হল। বাংলার গরীব মুসলমানের মুখ চেয়ে আমি আমার প্রায় প্রতিটি নামকরা ইসলামী গান টুইনে রেকর্ড করেছি। এইসব রেকর্ড থেকে তাই ঐ এককালীন একশত টাকা ছাড়া অর্থের দিক থেকে আমার কিছু জোটে নি।
কিন্তু প্রতিমাসে একখানার বেশী তা আর গান বের করতে পারে না কোম্পানী। অথচ ইসলামী গানের কী চাহিদ।!! মাসে দু’তিনখানা বের হলেও বোধ হয় সবি সমান বিক্রী হয়। তকরীম আহমদকে নিয়ে এসে তাঁকে দিয়ে ‘চারখানা গান রেকর্ড করিয়ে নিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে আবদুল লতিফ নামে একটি ছেলেকে আবিষ্কার করলাম। ভারী মিষ্টি কণ্ঠ, সেও ক’খানা গান রেকর্ড করল। তিলজালার শাপগাছি গ্রামে তার বাড়ী। দুঃখের বিষয় ছেলেটি দু’তিন বছর রেকর্ড করেই মারা যায়।
আগেই বলছি প্রায় প্রতিমাসেই আমার রেকর্ড বাজারে বের করা আঃন্ত হল। কিন্তু প্রতি মাসে গান বের হলে একজন আর্টিষ্টের গান এক-ঘেঁয়ে হয়ে যায়। অথচ ইসলামী গান গ্রামোফোন কোম্পানীর ঘরে এনেছে অর্থের প্লাবন। তাই মুসলমান গায়কের অভাব বলে ধীরেন দাস সাজলেন গণি মিঞা, চিত্ত রায় সাজলেন দেলোয়ার হোসেন, আশ্চর্যময়ী, হরিমতী এঁরা কেউ সাজলেন সকিনা বেগম, আমিনা বেগম, গিরীণ চক্রবর্তী সাজলেন সোনা মিঞা।
যাই হোক আমার মনে কিন্তু দিনরাত খেলে যাচ্ছে এক অপূর্ব আনন্দোন্মাদনা। এই তো চাই। মুগলমানের ঘুম ভেঙেছে! তারা জেগে উঠে গাইছে “বাজিছে দামামা বাঁধরে আমাম। শির উঁচু করি মুসলমান।” এই তো আমার সারা জীবনের ছিল কামনা।
সব চাইতে ফ্যাসাদে পড়লাম কে; মল্লিককে নিয়ে। আমার জীবনে প্রথম রেকর্ড করার সময় মল্লিক সাহেবই আমাকে উচ্চারণভংগী শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একদিন আমায় ধরলেন। বললেন, “আব্বাস, আমার একটা উপকার করতে হবে ভাই।” আমি বললাম, “একশোবার, কী করতে হবে বলুন।” তিনি বললেন, “দেখ, জীবন ভরে শ্যামাবিষয়ে গান গাইলাম, বাংলার মুসলমানদের ধারণা আমি মল্লিক মশায়, আমি হিন্দু, অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধররাও জানবে আমি মল্লিক মশায়। তা ভাই আমি যে মুসলমান এটা বলতে আর তো সংকোচের নেই। এই তো তুমি দিব্যি আববাস ‘আব্বাস’ হয়েই ঘরে ঘরে পরিচিত হলে। তা আমার দুঃখটা তুমিই পার ঘুচিয়ে দিতে। এই কাজি সাহবকে বলে আমার জন্য মাত্র দু’খানা ইসলামী গান গাইবার বন্দোবস্ত করে দাও, আর সংগে সংগে ভগবতীকে বলেও—দেখ ও আমি নিজে বলতে পারব না তুমি যদি ভাইটি—’ আমি বাধা দিয়ে বললাম “আর বেশী বলতে হবে না, আমি আমার প্রাণপণ শক্তি দিয়ে এটা করিয়ে নেবই।”
বললাম কাজিদাকে। কিন্তু কোন ফল হল না। তিনি বললেন, “আমি পারবো না, তুমি যদি ভগবতীবাবুকে রাজী করাতে পার। কারণ জান অববাস, এই মল্লিস্ক মশায় যদি একবার ইসলামী গান দেন, তাহলে তাঁর শ্যামাবিষয়ক গানে বিক্রীর ভাটা পড়ে যাবে। হিন্দুরা যখন জানতে পারবে কে. মল্লিক মুসলমান তখন তার শ্যামাবিষয়ক গান আর কেউই কিনবে না। জানই তো, মল্লিক মশায়ের গলার সেই পেটেণ্ট টান কিছুতেই খাবে না। ওর রেকর্ড বাজালেই ধরা পড়ে যাবে। তবে দেখ যদি ভগবীবাবুকে রাজী করতে পার।”
ভগবতীবাবুকে বললাম। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “মশাই এ কি কথা! মল্লিক মশায়কেও শেষ পর্যন্ত আপনি!!” আমি বললাম, “আজ্ঞে আমি নই, তিনিই!”
এরপর অবশ্যি ভগবতীবাবুর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। বৃদ্ধ বেচারী আমাদের এসব আবদার অভিযোগের দিকে কান না দিয়ে অকস্মাৎ একদিন পরপারে চলে গেলেন।
সে জায়গায় এলেন শ্রীহেমচন্দ্ৰ সোম! এমন উদার মতাবলম্বী বন্ধু- বৎসল মানুষ খুব কম দেখেছি। তাঁকে একদিন বল। মাত্রেই তিনি “বেশ তো, মল্লিক মশায় বুড়ো হয়েছেন, গ্রামোফোন কেম্পানী লক্ষ লক্ষ টাকা তাঁকে দিয়ে কামিয়েছে। তিনি যদি ইসলামী গান গেয়ে আনন্দ পান আলবৎ তাঁকে গাইতে দেওয়া হবে।”
কাজিদা ও মল্লিক সাহেব আমার উপর সেদিন কী খুশী!!
চাকুরী ও বিয়ে!
দু’বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা অর্জন করলাম। বাংলা সরকারের কৃষি দফতরে একটা পাকা চাকুরী খালি হল, দরখাস্ত করলাম। চাকুরীটা হয়ে গেল। ডি. পি. আই অফিসের অস্থায়ী চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে পাকা চাকুরীতে ঢুক্লাম। আমার ঊর্ধ্বতন, কৃষি বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর ওয়েষ্টার্ন সার্কল, তিনি একদিন বললেন, “আচ্ছা, আপনার নাম কি সেই আজকাল যার রেকর্ডে ́ খুব নাম শুনি……..সেইই?” আমি অতি বিনয়ে বললাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ।” তাঁর নাম যদুনাথ সরকার। তিনি হেড এ্যাসিষ্টাণ্টকে ডেকে বললেন, “দেখুন, এঁকে কোনও জটিল কাজ দেবেনে না। অফিসে এসে নাম দস্তখত করে যেখানে খুশী সেখানে যাবেন, বিশেষ করে দুপুরে যদি রেকর্ড করবার জন্য রিহার্সেলে যেতে চান কক্ষণো বাধা দেবেন না। আমার বিভাগে এমন লোক পেয়েছি এতে। আমাদের সৌভাগ্য।” বলা বাহুল্য বৃদ্ধ হেড এ্যাস্টিান্ট ধর্মদাস- বাবু এ নিয়মের কোন ব্যতিক্রম করেন নি। আমি তাই এই দুজনের কাছেই কৃতজ্ঞ। এঁদের কাছে বাঁধাধরা নিয়মে চাকুরী করতে গেলে সত্যিই আমি আমার সংগীতসাধনার পথে নির্বিবাদে এগুতে পারতাম না।
গ্রামোফোন কেম্পানীতে একদিন কাজিদার ঘরে হরিদাস, মৃণাল আর কে কে বসে গল্প হচ্ছিল। এমন সময় আমি গেলাম। জানি না কি ব্যাপার, হঠাৎ কাজিদা বলে উঠলেন তাদের উদ্দেশ্য করে, “দেখ তোমাদের কাছে একটা কথা বলি। আব্বাস আমার ছোট ভাই। দিন দিন গানে চমৎকার নাম করছে। যদি তোমরা কেউ একে কোনদিন খারাপ পথে নিয়ে যাও তাহলে তোমাদের জ্যান্ত রাখব না।” বলাই বাহুল্য কাজিদার একথা সবাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল।
একদিনকার একটা ঘটনা বলি। কবি শৈলেন রায় আমার বাল্যবন্ধু। অভিনেত। দুর্গাদাসবাবু ভারী রসিক লোক, শৈলেন ও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। প্রায়ই আমাদের দুজনকে বলতেন, “একদিন হোক না একপাত্র! দোষ কি?’ আমি একদিন বললাম, ‘আপনার হাতে হাতখড়ি হওয়া মানে তো অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে খবর বলা।’ তিনি হেসে বলতেন, ‘আরে না না, কাকপক্ষীও জানতে পারবে না।’ শৈলেন বলত, ‘তা দুর্গাদা’ আমাদের সজীব লিভারের ওপর আপনার এত হিংসা কেন?’ নাঃ ডাল আর গলে না। দুর্গাদাসবাবুকে অনেকের কাছে বলতে শুনেছি, ‘বাবা এরা কাদায় বাস করে কিন্তু কাদা গায়ে মাখে না।’
গ্রামোফোন কোম্পানীর রিহার্সেল রুমটা ছিল তখন অতি জঘন্য জায়গায়। ১৬০নং আপার চিৎপুর রোড, বিষ্ণুভবন। তার আশেপাশের বহুদূরে ভদ্রলোকের বাস ছিল না। ঐ দূষিত আবহাওয়ায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা কতদিন সম্ভবপর হবে এই নিয়ে দস্তুরমত চিন্তিত হয়ে পড়লাম। অকস্মাত্ একদিন মনস্থির করে ফেললাম। বাবাকে জানিয়ে দিলাম, আমি বিয়ে করতে রাজী।
হলদিবাড়ীতে আমার দোস্ত মশারফ হোসেনের কাছে বাবা চিঠি দিলেন। আমার জীবনের অন্তরংগতম বাল্যবন্ধু আমার দোস্ত মশারফ হোসেন। কুচবিহার জেনকিন্স স্কুলে যখন সিস্কথ, ক্লাশে ভর্তি হই, তখনই তার সাথে আমার প্রথম বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। একই হোস্টেলে থাকি। তারা তিনভাই বিরাট সম্পত্তির মালিক—আশৈশব পিতৃহীন। সম্পত্তি তাদের কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে। এর বড় ভাইয়ের সাথে ছিল আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুত্ব—তাই আমাদের দু’জনের মাঝেও গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। হোষ্টেলের সবাই বললে, বাঃ এরা ছুটিতে বেশ মিল দোস্তালি পাতাও। তাই দু’জন দু’জনকে দোস্ত বলে ডাকতাম। আমার দোস্ত এখন রংপুর ধাপে বাস করছেন।
দোস্ত আমাকে চিঠি দিল, তার ওখানে গেলাম, রংপুর জেলার ডেমার গিয়ে মেয়ে দেখলাম। দশ বার দিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল।
তখন সমাজের অবস্থা কি ছিল বলতে গিয়ে বিয়ের দিনের একটা ঘটনা বলতেই হচ্ছে। যেদিন মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম সেদিন হুবু শ্বশুরবাড়ীতে কী গানের ঘটা। হারমোনিয়াম বাজিয়ে কত গানই গেয়েছিলাম। পাড়ার লোক সেদিন আসর জমিয়েছিল।
বিয়ের দিন কলকাতা থেকে বন্ধুবান্ধব এসেছে। বিয়ের পর রাতে তকরীম আহমদ যেই সেতারে একটু টুংটাং শব্দ তুলেছে অমনি উঠেছে প্রতিবাদ। না, একি মুসলমানের বিয়ে-বাড়ী, গান-বাজনা সামাজিক প্রচলন নেই ইত্যাদি! বন্ধুদের এই অবমাননায় আমি গণ্ডগোলের ফাঁকে আঁধার রাতে শ্বশুরবাড়ী থেকে চলে গিয়ে রাত কাটিয়েছি দূরে এক হাই
স্কুলের টেবিলে। রাতে ভীষণ ঝড় উঠেছিল। সমাজের এই রূঢ় আচরণে আমার বুকেও উঠেছিল সেদিন সাত-সাগরের ঢেউ!
সারা রাত বর কোথায় বর কোথায় করে খুঁজেছিল সবাই। আমাকে পায়নি। বিয়ে-বাড়ীতে এ নিয়ে উঠেছিল মহা আলোড়ন। ভাগ্যিস বিয়ে পড়ানে। আগেই হয়ে গিয়েছিল–কাজেই সবাই মনে করেছিল, পাখীকে শিকল পরানো হয়েছে, আরতে। উড়তে পারবে না, খাঁচায় আসতেই হবে ফিরে।
সারারাত বাইরের ঝড় আর মনের ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে ভোরের দিকে টেবিলের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছি। প্রাতঃভ্রমণরত দু’একজন শ্বশুরবাড়ীর লোক আমাকে ঐ অবস্থায় আবিষ্কার করে শেষ পর্যন্ত নিয়ে আসেন মানভঞ্জনের পালার দৃশ্যে অবতীর্ণ হবার জন্য।
পরবর্তীকালে অবশ্যি শ্বশুরবাড়ীতে যতবারই গিয়েছি গানের জন্য বাধা তো দূরের কথা যে ক’দিন থাকতাম গলার অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকত যে দস্তুরমত পনের-বিশ দিন গলাকে বিশ্রাম দিতে হত।
আমার প্রথম পুত্রের জন্মগ্রহণের সংবাদ পাই কলকাতায়। কাজিদাকে বললাম, “কাজিদা আল্লার অসীম অনুকম্পায় আমার এক খোকা এসেছে ঘরে, আপনি যদি খোকার একটা নামকরণ করেন।” মহা উল্লাসিত হয়ে দু’দণ্ড চোখ বুজে বলে উঠলেন, “খোকার নাম রইল মোস্তাফা কামাল। কামালের মতোই যেন একদিন দেশ স্বাধীন করতে পারে—দেশের অনাচার অবিচারকে দলিত মথিত করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে পারে—আর ডাক নাম রইল দোদুল।” এই দোদুলকে আমি একটু পালটে রাখলাম।
ওর বয়স যখন তিন বছরের তখন কলকাতায় কড়েয়া রোডের এক বাসায় নিয়ে এলাম ওর মাকে সাথে করে। তিন বছরের শিশু কী সুন্দর সুর করে গাইত,
ত্রিভুবনের প্রিয় মোহম্মদ এলো রে দুনিয়ায়
আয়রে ছাগল আকাশ বাতাস দ্দেগবি যদি আয়।
আমরা হেসে লুটোপুটি!
তিন বছরের শিশু আমার একগাদা রেকর্ড সবগুলো ওলট পালট করে রাখলেও বলে দিতে পারত কোনটা কি গান এবং কার গান। আরো অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, মুখে মুখে এ বয়সে প্রথম ভাগ যেমন ‘অরুণ রবি উঠল, আমার ঘুম ছুটল’ ইত্যাদি সবকিছু মুখস্থ বলতে পারত সে।
পল্লী সংগীতে
কাজিদা তখন গ্রামোফোন কোম্পানীর জন্য গান লিখে চলেছেন। আঙুরবালা, ইন্দুবালা, হরিমতী, কানন দেবী, কমলা ঝরিয়া, ধীরেন দাস, কমল দাশগুপ্ত, মৃণালকান্তি ঘোষ সবাই তাঁর গানের জন্য ‘কিউ’ লাগিয়ে বসে থাকে। ওদিকে ইসলামী গান আর একা কত লিখবেন। আমিও দু’দিন চারদিন দশদিন তাঁর কাছে গিয়েও গান পাই না।
ইত্যবসরে কবি গোলাম মোস্তফার সংগেও আমার পরিচয় হয়েছে। কারমাইকেল হোস্টেলে তিনি থাকতেন। দেখলাম তিনিও সংগীতজ্ঞ। গান জানেন। গান দেখেনও। আমার সংগে তিনি মাঝে মাঝে গ্রামোফেন ষ্টুডিওতে যেতেন। তাঁর গানও আট দশখানা রেকর্ড করলাম তাঁকে দিয়েও কয়েকখানা গান রেকড করালাম। তিনিও উৎসাহিত হলেন।
এর মধ্যে গ্রামোফোন রেকর্ডের পাইকারী পরিবেশক মিঃ জে, এন, দাস নিজস্ব একটা কোম্পানী খুললেন। নাম দিলেন তার মেগাফোন কোম্পানী। হ্যারিসন রোডের উপর দোকান ও রিহার্সেল রুম করলেন। হিজ মাষ্টার্স ভয়েসের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমার ছয়খানা গান তিনি রেকর্ড করলেন। কাজিদার প্রসিদ্ধ গান “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে”–মেগাফোনে রেকর্ড করি। আমার ভাওয়াইয়া গান কাজিদা খুবই পছন্দ করতেন। তাই “নদীর নাম সই কচুয়া, মাছ মারে মাছুয়া” আর “তোরষা নদীর পারে পারে লো দিদিলো মানসাই নদীর পারে” এই দু’খানা গানের সুরে তিনি মেগাফোনের জন্য লিখলেন, “নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা”, আর “পদ্মদীঘির ধারে ধারে” এই দু’খানা গান।
ইতিমধ্যে ভাটিয়ালী সুরে “ঐযে ভরা নদীর বাঁকে কাশের বনের ফাঁকে ফাঁকে” গানখানিতে বাজার ছেয়ে গেছে।
ভাটিয়ালীর ক্ষেত্রে কাজিদার রচনা ও গ্রাম্য সুরের সংযোগে আমি প্রথম নাম করি। পল্লীগীতির গায়ক হিসেবে আমার নাম যখন বেশ কিছুটা ছড়িয়ে পড়েছে তখন পল্লীকবি জসিমউদ্দিন নিজে থেকেই একদিন আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমার “নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা” শুনে তিনি আমার উদ্দেশ্যে কবিতা রচনা করেছিলেন ‘কোন অঞ্জনা, তীরে খঞ্জনা পাখী।’
জসিম তার স্বভাবসিদ্ধ গেঁয়ো কথার জালে আমাকে বেঁধে ফেলল। এরপর তার প্রথম গান গাইলাম, “আমার গহীন গাঙের নাইয়া।” তারপর গাইলাম, “ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না।” সারা বাংলায় আবার নতুন করে সাড়া পড়ে গেল।
আমি আর জসিম দুইজনে তখন এক অভিযান শুরু করলাম। ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিটিউটে, স্কটিশচার্চ কলেজে সভা ডেকে ভাটিয়ালী গান শোনাতাম। প্রথম খুব সাড়া পাওয়া যায় নি। কিন্তু আমাদের দলে যোগ দিলেন রায় বাহাদুর খগেন মিত্তির, রায় বাহাদুর দীনেশ সেন, গুরুসদয় দত্ত, কাজেই দিন দিন পল্লীগীতির উপর একটা শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠল।
কলকাতায়ই এর প্রতিক্রিয়া হল সবচাইতে বেশী। কলকাতার শতকরা আশী ভাগ লোকেরই বাড়ী পল্লী অঞ্চলে। তারা রুজি-রোজগারের জন্যে আছে কলকাতায়। মন পড়ে থাকে দেশের গ্রামটিতে রেকর্ড, রেডিওর মাধ্যমে যখন আমার কণ্ঠে ধ্বনিত হল পল্লীর সেই মেঠো সুর পথচারী দাঁড়াল থমকে! একি….এ সুরের সাথে যে আমার নাড়ীর যোগাযোগ….একি বাণী, এ যে দেখি আমাদের প্রাণেরই প্রতিধ্বনি। পল্লী সংগীতের সুরে বাংলার আকাশ বাতাস নতুন করে হল সুরশ্রীসমৃদ্ধ।
পল্লীগীতির রেকর্ডও বাজারে এক নতুন রেকর্ডের সৃষ্টি করল। কলকাতার অভিজাত সমাজেও এ গান বিশেষ আদৃত হতে লাগল। ছাত্রদের যে কোন অনুষ্ঠান হলেই আমার ডাক পড়ত। আসতে আরম্ভ করল গানের টিউশনি। মাসে চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা। গানের টিউশনি মাসে বা সপ্তাহে দু’দিন এক ঘণ্টা করে। দু’টো তিনটে টিউশনি নিলাম। অফিস থেকে ফিরে এসে যেই মনে হত আজ ঐ টিউশনিতে যেতে হবে, মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ত। মনে আছে, ঠিক এক মাস টিউশনি করে ছাত্রীর অভিভাবকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বলেছি, “মাফ করবেন, টিউশনি করতে পারি, তবে টাকা নিয়ে নয়, কারণ টাকা নিলেই আমাকে ঠিক দিন ও সময়মত আসতে হবে। এই বাধ্যবাধকতার রেল-লাইনের ভেতর দিয়ে আমার জীবনের এই মূল্যবান দিনগুলিকে চালিয়ে যেতে পারব না। তবে আমি আসব, গান শিখিয়ে যাব যেদিন যখন মন চায়, টাকা আমি নিতে পারব না।”
ভাটিয়ালী গান তখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। আমার মনে এল এক নতুন কল্পনা। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমার কানে যে সুর প্রথম ঝংকার তুলেছিল সে হল ভাওয়াইয়া। এই সুরে গান রেকর্ড বার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। গ্রামোফোন কোম্পানীর কর্তা বললেন, “কুচবিহারের ভাষায় গান? ওসব আঞ্চলিক ভাষা চলবে না।” কিন্তু আমার রেকর্ড তখন বাজারে এনেছে নববিস্ময়, কোম্পানী লুটছে মোটা টাকা, কাজেই আমার আবদারটা একদম উড়িয়েও দিতে পারল না। আমাকেও এক ডিগ্রী নীচে নেমে আসতে হল। যে গানের বাণী ছিল :
তোরষা নদীর ধারে ধারে ও
দিছিলো মানসাই নদীর পারে
ওকি সোনার বঁধু গান করি যায় ও
দিদি তোরে কি মরে
কি শোনের দিদি ও।।
সে গান দাঁড়াল এই রকম :
তোরষা নদীর পারে পারে ও
দিদিলো মানসাই নদীর পারে
আজি সোনার বঁধু গান গেয়ে যায় ও
দিদি তোর তরে কি মোর তরে
কি শোনেক দিদি ও।।
তোরষা নদী—খরস্রোতা ছোট্ট পাহাড়ী নদী তোরষা—কুচবিহারের পাদমূল ধৌত করে তরতর বেগে চলেছে। তারি তীরে তীরে গান গেয়ে চলেছে মোষের পিঠে করে দোতারা বাজিয়ে মেষ-চালক মৈশালের দল। তাদের কণ্ঠের সুর ছেলেবেলায় আমার কণ্ঠে বেঁধেছিল বাসা। তাদের মুখের ভাষাই আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষাকে অবিকৃত রেখে গান দিতে পারলাম না। মনে জেগে আছে ক্ষোভ। এই গান বাজারে বের হবার তিন চার মাস পরে ম্যানেজারবাবু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বললেন, “আচ্ছা এবার ঐ ধরণের ভাওয়াইয়া গানই দিন।” আমি বললাম, “দিতে পারি এক শর্তে। আমার দেশের ভাষাকেই রাখতে হবে অবিকৃতভাবে।” তিনি আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। আমি বললাম, “দেখুন, আমার দেশের ভাষাও বাংলা ভাষা এবং সে ভাষায় কথা বলে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি এবং আসামের বহু জায়গার জনসাধারণ। তা ছাড়া সে ভাষায় আছে কাব্য, আছে সাহিত্য, সার্বজনীন আবেদন, আচ্ছা একখানা দিয়েই দেখি না!” তারপর গাইলাম “ওকি গাড়ীয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে।” গাইলাম, “ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে।” এসব গানে শুধু উত্তরবংগে নয়, সারা বাংলায় জাগিয়েছিল বিপুল আলোড়ন। একমাত্র উত্তরবংগের ভাষায় ভাওয়াইয়া গানই নয় এ-ভাষায় পাঁচখানা নাটকও রেকর্ড ́ করি—মধুমালা, মরুচমতি কন্যা, হলদী-শানাই ও মহুয়া সুন্দরী। এর সব কয়টিই আমার ছোট ভাই আবদুল করিমের লেখা। তার লেখা বহু ভাওয়াইয়া গানও আমি রেকর্ড করেছি।
এ গান প্রতি মাসে বার হতে আরম্ভ করল। তখন কুচবিহার থেকে আমার বন্ধুবান্ধব এবং গায়কদের এনে তাদের দিয়ে ভাওয়াইয়া গান রেকর্ড করাতে আরম্ভ করলাম। কমল দাশগুপ্ত একদিন আমায় বলে “আব্বাস তুমি এত বোকা কেন? তুমি তো ভাওয়াইয়া গানে সম্রাট, তোমার কি উচিত হচ্ছে দেশ থেকে অন্য লোককে নিয়ে এসে তোমার পথে প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করানো?” আমি তার উত্তরে বলেছি, “বিশাল এই বাংলা দেশে গায়ক-গায়িকা কত ছড়িয়ে আছে। অনাঘ্রাত পুষ্পের মত গায়ে গায়ে নামহারা হয়ে তারা, গেয়ে চলেছে। আদর তো তাদের আমরাই করব ভাই। নাম, যশ, স্বীকৃতির পথে তো আমরাই তাদের নিয়ে আসব। তা ছাড়া, ভীমনাগের সন্দেশের দোকানের পাশে দু’চারটে দোকান না হলে মানুষ বুঝবে কি করে যে ভীমনাগের সন্দেশই সবচাইতে ভালো।”
কুচবিহারের এইসব গায়কদের ভেতর নায়েব আলী (টেপু), কেশব বর্মণ, ধীরেন চন্দ ও সুরেন্দ্রনাথ রায় বস্তুনিয়ার গান আজও বাজারে বেশ কাটতি।
এই ভাওয়াইয়। গান গাইতে গিয়ে একটা দিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল। শ্যামবাজার এলাকায় কোন স্কুলের এক সভায় একদা তদানীন্তন মন্ত্রী শ্রীনলিনীরঞ্জন সরকার উপস্থিত ছিলেন। আমারে। গাইবার জন্য নিমন্ত্রণ ছিল। সভাপতি অমৃতবাজারের সম্পাদক শ্রীতুষারকান্তি ঘোষ আমার উপস্থিতিটা বিশেষ কাম্য বলে মনে হচ্ছিল না। আমি বলে উঠলাম, “দেখুন যদি আপনার। কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি। সভার কার্যসূচীতে আমার উদ্বোধনী-সংগীত এবং বিদায়-সংগীত গাইবার কথা লেখা আছে। আমার অন্যত্র কাজ আছে, তবে দয়া করে যদি অনুমতি করেন উদ্বোধনী সংগীতের পরেই আর একখানা গান গেয়ে আমি চলে যাব।” একথায় সবাই সায় দিল। আমি প্রথমে গাইলাম একখানা ভাটিয়ালী। তারপর ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে।’ এই গানখানার একটু ভূমিকা দিয়ে গানটা গাইলাম।
সভাপতি তুষারকান্তি ঘোষ মশায় গানের সময় লক্ষ্য করছিলাম ঘন ঘন রুমালে চোখ মুছছিলেন। গান শেষ হলে তিনি উঠে রোরুদ্যমান কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আজ এ সভার কাজ চালাতে পারব না। এ গান আমাকে আজ সম্পূর্ণ উন্মনা করে তুলেছে, আমি আব্বাস ভাইকে নিয়ে চললাম।” এই কথা বলে সত্যিই তিনি আসন থেকে উঠে আমার হাত ধরে আমাকে বাইরে নিয়ে এসে বললেন, ‘চলুন আমার অমৃতবাজার অফিস।’ সেখানে নিয়ে এই ধরণের ভাওয়াইয়া গানের রেকর্ড তালিকা যা তখন পর্যন্ত বেরিয়েছে সব লিখে নিলেন। তাঁর কাগজের কলকারখানা সব দেখালেন এবং আমার ঠিকানা লিখে রেখে গাড়ীতে করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন।
আমার এ ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ যখন রেকর্ড আকারে বের হয়, তখন সে সময়কার হিজ মাষ্টার্স ভয়েস প্রচার পুস্তিকায় বের হয় :
‘উত্তর-বংগ অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই শ্রেণীর গানের বিশিষ্ট সুর ছাড়াও রচনাও অন্যতম আকর্ষণ। শিক্ষিত কবির কাব্যে যখন পড়ি, এ-পারে চক্রবাক ওপারে চক্রবাকী, ‘মাঝেতে বহে বিরহবাহিনী! তখন মনের আগে বুদ্ধি দিয়ে আমরা রস উপলব্ধি করি। কিন্তু অশিক্ষিত কবির গানে যখন দেখি—’ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে,’ আর বিরহিনী বগীর মর্মব্যথায় সারা আকাশ ছলছল! তখন আর বুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। বিরহের এই অতি সহজ প্রকাশভংগী তীরের মত সোজা এসে মানুষের মর্মে বেঁধে। আমাদের মনে হয়, নিরলংকার এই বস্তুতান্ত্রিক প্রকাশভংগীই গ্রাম্য গানের বিশেষতঃ ভাওয়াইয়া গানের চাহিদার প্রথম কারণ।
“পল্লী-গীতি রাজ্যের দুয়োরাণী এই ভাওয়াইয়া গানকে সর্বপ্রথম আব্বাস সাহেবই আদর করে রাজ-অন্তঃপুরে ডেকে আনলেন। তখন আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম উপেক্ষিত দুয়োরাণীর রূপ-শ্রী সুয়োরাণীর চেয়ে ত’ কম নয়। এবং তার চেয়ে মুগ্ধ হলাম তার নিতান্ত সরল হৃদয়ের মাধুরীতে! এর জন্য সমগ্র রসিকজনের অভিনন্দনের মালা পাওয়া উচিত পল্লী দুলাল আব্বাস সাহেবের। বহু দুর্লভ ভাওয়াইয়া গান তিনি সংগ্রহ করে আপনাদের উপহার দিয়েছেন।”
বাংলার মুসলমান সমাজে কাজিদার ইসলামী গান গেয়ে পরিচিত হলাম আর বাংলার আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত হলাম পল্লীবাংলার ভাটিয়ালী, জারি, সারি মুর্শিদা, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, চটক, ক্ষীরোল গান গেয়ে। পূর্ববংগের ভাটিয়ালী, বিচ্ছেদী, মুর্শিদা ইত্যাদি গানের সংগ্রাহক আমার অনুজপ্রতীম গ্রীকানাইলাল শীলের কাছে আমি চিরঋণী। পূর্ব বাংলার মাঠে-ঘাটে এই পল্লীগীতি ছড়িয়ে ছিল, লুকিয়ে ছিল, অনাদৃত হয়ে পড়েছিল। কানাইর সহায়তায় সেই হারানো মাণিক উদ্ধারের কাজে এগিয়ে এলাম। কানাইর মত দোতরা- বাদক পাক-ভারত উপমহাদেশে বিরল। তার সাহায্য না পেলে সত্যিকারের লোকগীতি লোকসমাজে পরিবেশন করা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। আদি ও অকৃত্রিম পল্লীগীতির ওপর রংচং লাগিয়ে কয়েকজন আধুনিক পল্লীকবির গানও অবশ্য রেকর্ড করেছি, কিন্তু যখন সত্যিকারের ট্রাডিশনাল গানের সন্ধান পেয়েছি তখন থেকে এদের গান রেকর্ডে দেওয়া বন্ধ করেছি।
সিনেমার চৌকাঠ থেকে
যৌবনে সবাই আমাকে সুদর্শম বলতেন। ভাই বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে হাওড়ায় জয়নারায়ণ বাবুকে সাথে করে একদিন জ্যোতিষ বাড়,য্যের সাথে দেখা করলাম। তিনি আমার গান শুনে এবং চেহারা দেখে খুবই খুশী হয়ে বললেন, “বিষ্ণুমায়া’ নামে একখানা সবাক ছবি শীগগীরই ধরব। আপনাকে সেই বইতে গানের পার্ট দেব, ঠিক সময়ে জানাব।” সত্যি সত্যি মাসখানেক পরে আমার নামে এক চিঠি এল টালিগঞ্জে তাঁর সাথে দেখা করবার জন্য। সেখানে গিয়ে একঘর লোকের ভিতর তিনি আমাকে গাইতে বললেন! গানে পাশ করলাম; তখন বললেন, ‘জীবনে থিয়েটার করেছেন কখনো? আমি বললাম, “তা যথেষ্ট করেছি—দেবলা দেবী, শাজাহান, মিশর-কুমারী, রিজিয়া, আরো অনেক বইতে!” ‘মেবার পতন,’ বইখানা। এগিয়ে দিয়ে দু’ একটা জায়গা পড়তে বললেন।…. পাশ করলাম বোঝা গেল, কারণ আমাকে দু’খানা গান আর কিছু সামান্য পার্ট লেখা একখানা কাগজ দিয়ে বললেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে সুর টুর করে আসবেন।’
পার্ট আমার অংকুরের। কাননবালা কৃষ্ণের ভূমিকায়। বিদুরের ঘরে কৃষ্ণকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসতে হবে। তারপর গান।
যাই হোক প্রথম ছবিতে অবতীর্ণ হলাম! মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনছি। জ্যোতিষ বাবুকে বললাম- ‘ছবিতে নামলাম, কিছু পারিশ্রমিক তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বলে উঠলেন, ‘বল কি হে, ছবিতে নামতে পারলে, এই তো যথেষ্ট। যাক এর পরের ছবিতে দেখা যাবে।’ কিন্তু পরের ছবির জন্য হাঁটাহাঁটি করে আমার দু’জোড়া জুতা ক্ষয়ে গেছে- চান্স আর পাই নি।
একদিন নাট্টনিকেতনে শিশির ভাদুড়ীর সাথে পরিচয় হল। শিশির ভাদুড়ী তখন একটা দৃশ্য করে গ্রীন রুমে ঢুকছেন। শিশিরবাবু বলে উঠলেন, “হু, ভাল গাইতে পার? আচ্ছা এই ড্রপ সিনটা পড়লে তারপরেই ষ্টেজে ঢুকে একটা গান গাইতে পারবে?” মহা ফ্যাসাদে পড়লাম। আমার মাথায় একটা গেরুয়া পাগড়ী বেঁধে দেওয়া হল। “আমার গহীন গাঙের নাইয়া” গানটা অর্গান-বাজিয়ের সাথে ঠিক করে নিলাম একটু গুণ গুণ করে…….. তারপর ড্রপ তুলতেই আমকে ঢুকতে হল। গাইলাম। এনকোর এনকোর, আবার গাও…দু’বার গাইলাম। হাততালি আর থামে না। শিশিরবাবু বললেন, “যেয়ো না প্লে শেষ হলে দেখা কোরো।”
প্লে’র শেষে গ্রীন রুমে সবাই রং ওঠাচ্ছে মুখ থেকে—একটা বড় ঘরে হারমোনিয়াম, তবলা রেখে দেওয়া হল – বুঝলাম গান হবে। শিশিরবাবু এসে বসলেন। সবাইকে ডাকলেন। বললেন, “গাও দেখি।” দু’তিন খানা গাইলাম। কে একজন বলে উঠল, এর একখানা গান শুনুন “ওরে মাঝি তরী হেথা বাঁধবো নাকো আজকের সাঝে। “ সবাই বলে উঠল—বেশ বেশ। আমি বললাম, “গাইতে পারি। তিনটা শর্ত আছে। প্রথম, এই গানের সাথে তবলা বাজবে না। দ্বিতীয়, গানের সময় একটা কথাও কেউ বলতে পারবেন না; তৃতীয়, ঘরের আলো নিবিয়ে দিতে হবে।” তথাস্তু। গান আরম্ভ হল।……. গানের দুটা কলি গেয়েছি, এমন সময় তবলচি তবলায় চাঁটি মারল। গান থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আলো জ্বালুন।” শিশিরবাবু বললেন, “কী, ব্যাপার কি? গান থামালে কেন?” বললাম, “শর্ত ভংগের অপরাধে।” “ও তবলা বেজেছে এই জন্য?” “ঠিক তাই।” বললেন, “আচ্ছা আর বাজাবে না গাও।“ আমি বললাম, “আজ আর এ গান হবে না।” তিনি বললেন, “তাতে কি হয়েছে, গাও!” আমি বললাম “হাজার টাকা দিলেও না।” তিনি বললেন “যদি দশ হাজার টাকা দিই?” আমি বললাম, “লাখ টাকা দিলেও আজ আর এ গান গাইতে পারব না।”
শিশিরবাবু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বলে উঠলেন, “Here is true artist। শুনলে, শুনলে, লাখ টাকা দিলেও গান গাইবে না!” শিশিরবাবু তাঁর ছোট ভাইকে বললেন, দেখ আমার ‘সীতা বইতে একে আমি বৈতালিকের পার্ট দেব! আচ্ছা কাল তুমি আমার বাসায় যাবে, কেমন?’
পরদিন বিডন ষ্ট্রীটে তাঁর বাসায় গেলাম। কঙ্কাবতীকে ডেকে বললেন, ‘আচ্ছা ছেলেটির গান শোনো তো।’ আরো বললেন, ‘সীতা বই দেখেছ?” বললাম, “দেখেছি।” “আচ্ছা, বৈতালিকের গানের সুরগুলো জানা আছে?” আমি একে একে ‘জয়সীতাপতি সুন্দর তবু’ থেকে আরম্ভ করে অবিকল কেষ্টবাবুর গলার স্বর নকল করে গাইলাম। অবাক হয়ে তিনি বললেন, “কি করে কেষ্টবাবুর গলার মত স্বর বের করছ?”
যাক, প্রতিদিন তাঁর বাসায় একবার করে যাওয়া আরম্ভ করলাম। কঙ্কাবতীকে প্রায় পাঁচ ছ’ খানা গানও শিখিয়ে দিলাম। আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার আমার গানের টেকিং কোনদিন হবে?” তিনি বললেন, ‘চিন্তা কোরোনা, তোমাকে ঠিক সময় বলব। পার্টটার ভেতর কথা তো নেই, শুধু গান ক’খানা, আর সুর তো তোমার হয়েই আছে। মাস খানেক, পরে একদিন সন্ধ্যার সময় কঙ্কাকে গান শেখাচ্ছি। শিশিরবাবু ঘরে ঢুকলেন। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন….কক্ষণ পরে আমার কাছে এসে আমার হাতদুটো চেপে ধরে ছেলেমানুষের মত কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘ভাই আমাকে ক্ষমা কর। তোমাকে বোধ হয় পার্টটা দিতে পারলাম না! ফিনানসিয়ার বলছে, রামায়ণের যুগে কোন্ আব্বাসউদ্দীন ছিল? এ বইতে কিছুতেই মুসলমানকে নাবতে দেব না। ত! ভাই, তোমার নামটা যদি পালটে দেয়া যায়….।” আমি তাঁর কথা শেষ করতে দিলাম না বললাম, “বাংলার নটসূর্য আপনি! যে স্নেহ আমায় দেখিয়েছেন জীবন ভরে মনে থাকবে, কিন্তু ও অনুরোধ আমাকে করবেন না রামায়ণের যুগে মুসলমান ছিল না ঠিকই, কিন্তু আপনার প্রযোজককে বলবেন অভিনয় মাত্র। সেখানে মুসলমান বা হিন্দু যে নামেই অভিনয় করুক না কেন ভাল অভিনয় করলেই বই উৎরে যাবে, নামে কিছু যাবে আসবে না। আমি সিনেমায় আমার নাম পালটে আর এক অভিনয় করতে পারব না।”
এই ঘটনার পর আর চিত্রজগতে আত্মপ্রকাশ করবার বাসনা বহুদিনের জন্য মৃত হয়ে রইল।
বহুদিন পর সুযোগ এল একবার। তুলসী লাহিড়ীর “ঠিকাদার” ছবিতে। চা-বাগানে ছবি নেওয়া হবে। কুচবিহার থেকে উত্তরে ডুয়ার্স চা-বাগানে সেখানকার সুরের সাথে সংগতি রেখে গাইতে হবে।” আমার কাছে প্রস্তাব করলে শৈলেন রায়, “তোমাকে এবার ছবিতে নামতে হবে।” সংগীত রচয়িতা শৈলেন রায় নিজে, কাজেই তার কথা সিনেমাওয়ালাদের কেউ উপেক্ষা করতে পারল না। চুক্তিতে সই করলাম। সদলবলে কুচবিহার গেলাম। প্রায় পনের-কুড়ি দিন ধরে আলিপুরদুয়ার থেকে কাছেই দমপুর স্টেশনের এক চা-বাগানে ছবি নেওয়া হতে লাগল। সেখানে গাইতে হল—
“পৌষের পাহাড়ী বায়
কাঁটা যে বিঁধিল গায়
নকরী আর করব কি মরব কি মরব না ॥”
—সিনেমায় চারটা মাত্র ছবিতে আমার আত্মপ্রকাশ করবার সুযোগ হয়েছে “বিষ্ণুমায়া” “মহানিশা” “একটি কথা” আর “ঠিকাদার।”
গানের আলো ছড়িয়ে দিলাম সবখানে
পিয়ারু কাওয়ালের উর্দু গান বাজার ছেয়ে গেছে। বড় শখ হল, উর্দুওয়ালা না হতে পারি, মুসলমানের ছেলে তো! গাই না ক’খানা কাওয়ালী গান! সোমবাবু রাজী হলেন। পিয়ারু কাওয়ালের ট্রেনিংয়ে আটখানা উর্দু গান দিলাম। উচ্চারণ এমনিই ভালো যে, উর্দু ওয়ালারা আমাকেও এক নতুন কাওয়াল বলে বরণ করে নিল। পিয়ারু সাহেবের সাথে আমারো একদিন এক মুজরোতে দাওয়াত এসেছিল। কিন্তু সারারাত জেগে পান চিবিয়ে চিবিয়ে গানের মজলিশ করা আমার ধাতে সইবে না বলে জীবনে আর কোন দিনও তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করিনি।
পঁচিশ বছর আগে রেডিওতে গান গাইবার জন্য কি আকুল আগ্রহই না জেগেছিল!….তখন গান শুনতে হত হেডফোনে। প্রথম দিন রেডিও শুনি কলকাতায় নাটোর রাজবাড়ীতে জীতেন মৈত্রের সাথে। কানে দিলাম রেডিও, ঠিক ফোনের মত। কানের ভিতরে বেজে উঠল কৃষ্ণচন্দ্র দে’র গান! কী স্বপ্নই যে সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময়টিতে! নিজে চেষ্টা করে ( তখনকার দিনে অল ইণ্ডিয়া রেডিও কলকাতার ষ্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন নৃপেন মজুমদার ) প্রথম যেদিন রেডিওতে গান গাই—সেদিন আমার শিল্পী-জীবনে এক নতুন অনুভূতির স্বাদ পেলাম। আমি শুনেছি রেডিওতে গান গাইলে টাকা পাওয়া যায়! কিন্তু গানের প্রথমেই কণ্টাক্ট সই করতে গিয়ে একটু হোচট খেলাম— কারণ পারিশ্রমিকের কলমে লেখা আছে ‘এ্যামেচার’ যাক, রেডিওতে গাইতে পারলাম, এই তো ভাগ্যি! কতজনে হয়ত আমার গলার সুর কানের ভিতর ধরেছে। এই তো চরম পুরস্কার!
কাজিদা একদিন বললেন, “আব্বাস, ঘোড়াকে দানা না খাওয়ালে ঘোড়া চলবে কি করে? তুমি ক্ল্যাসিকাল গান শেখো।” ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁ যাঁকে কাজিদা বলতেন “ঠুংরীর বাদশাহ্ “ তাঁর কাছে গিয়ে হাতে ন্যাড়া বাঁধলাম। আমি আর কবি গোলাম মোস্তফা। এই ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁ সাহেবকে প্রথমে যেদিন গ্রামোফোন কোম্পানীতে দেখি মুগ্ধ হয়ে যাই এঁর চেহারা দেখে। রাজপুত্রের মত চেহারা দেখে। রাজপুত্রের মত চেহারা, পায়ে লপেটা, কোচানো ধুতি, সুন্দর এক জোড়া গোঁফ। কথাও বলতেন ভারী মিষ্টি করে। আঙ্গুর, ইন্দু; ঝরিয়। এঁরা তো ওঁরই সুরের দৌলতে এত বড় নাম-করা গাইয়ে বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। একখানা গান দেওয়া হল, গানখানা তিনি একবার পড়লেন ব্যস হারমোনিয়াম নিয়ে তক্ষুণি সুর হয়ে গেল। এতবড় ত্বড়িৎ সুরস্রষ্টা দেখিনি জীবনে, দেখব কিনা আর জানি না। সে সুরে কী যে যাদু মেশান থাকত জানি না, বাজারে রেকর্ড বেরোবার সাথে সাথেই বিক্রী হত গরম জীলিপীর মত। একবার দু’খানা বাংলা গান নিয়ে যাই তাঁর কাছে। বললাম, “ওস্তাদজী, আমার বড় ইচ্ছা আপনার দেওয়া সুরে দু’খানা বাংলা গান গাই।” গান দু’খানা তিনি উর্দুতে লিখে নিলেন। সেই মুহূর্তেই কী অপরূপ সুর করলেন। কবি গোলাম মোস্তফার গানের বাণী সুরের স্পর্শে হল মূর্তিমতি। একখানা হচ্ছে, ‘ফিরে চাও বারেক ফিরে চাও, হে চির নিঠুর প্রিয়া।’ আর একখানা ‘সেতো মোর পানে কভু ফিরে চাহে না হায়।’
ওস্তাদজীর বাসায় বহুবার ঘরোয়ানা মজলিশে বড় বড় ওস্তাদের গান-বাজনা সোনার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ওস্তাদ এনায়েত খাঁর সেতার, প্রফেসর আজিম খাঁর তবলা, প্রফেসর ছোটে খার সারেংগী, এমনি কত কি।
দূর্ভাগ্য আমার বেশীদিন তাঁর কাছে শেখা সম্ভবপর হয়নি, কারণ চাকুরী, রেডিও, রেকর্ডের জন্য গানের প্রস্তুতি, আর নিত্যনৈমিত্তিক এখানে-ওখানে গান গাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে যাওয়া-আসা।
গ্রামোফোন কোম্পানী আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিচ্ছে, আর্টিষ্টদের মধ্যে উঠল গুঞ্জন। বিলাতে সব আর্টিষ্টদের দেয় রয়ালটি, ভারতীয় শিল্পীরা কেন পাবে না? সব শিল্পীরা মিলে আর্টিষ্টস্ এসোসিয়েশন করলাম। আমাকে করা হল এ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারী। গ্রামোফোন কোম্পানীর কাছে প্রতিনিধিদল পাঠানো হল। তারা মেনে নিল শিল্পী পাবে শতকরা ৫ হারে রয়ালটি, কোন কোন ক্ষেত্রে শতকরা সাড়ে বার পর্যন্ত। গানের রচয়িতা পাবে শতকরা আড়াই আর যন্ত্রশিল্পীদের দেয়া হবে নগদ পারিশ্রমিক।
রবিবাসরের বহু সভায় আমি যোগদান করেছি। সুসাহিত্যিক এস, ওয়াজেদ আলী নিজে শুধু সাহিত্যিকই ছিলেন না সাহিত্যামোদীও ছিলেন। তাঁর বাসায় সবগুলি রবিবাসরীয় সাহিত্যসভায় গান গেয়েছি। এ ছাড়া সাহিত্যিকদের বড় বড় সভায়ও আমার ডাক পড়ত। একটি বিশেষ কারণে সাহিত্যিক বা কবিরা আমার সাথে পরিচিত হতে চাইতেন। তাঁদের রচিত গান সভায় গাইলে তাঁরা একটু আনন্দিত হতেন, বলাই বাহুল্য। তখনকার দিনের লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকদের সাথে পরিচিত হয়ে আমিও নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করতাম।