কলেজ জীবন

কলেজ জীবন

বি. এ’র দরজা থেকে

আগেই বলেছি ছাত্র হিসাবে আমি নাম করা ছাত্রই ছিলাম। আই. এ পাশ করে বাবাকে বললাম লক্ষ্মৌ মরিস মিউজিক কলেজে পড়তে যেতে চাই, সেখানে গানও শিখব, কলেজে বি. এও পড়ব। কিন্তু আমার এ আবেদন তিনি মনযুর করেন নি। তখন কুচবিহার ছেড়ে নতুন এক পরিবেশে লেখা-পড়া করার জন্য মনে জেগেছে আকুল স্পৃহা। রংপুর কলেজে ভর্তি হব বলে রংপুরে গেলাম। দিগন্তবিস্তৃত মাঠের মাঝখানে কলেজের সুদৃশ্য ইমারত, দূরে দূরে বাংলো প্যাটার্নের প্রফেসরদের কোয়াটার্স, সুন্দর সুন্দর ছাত্রাবাস। বড় ভালো লাগল। রাতে মুসলমান ছাত্রাবাসে এক বন্ধুর কামরায় ঘুমাব বলে একখানা খাটে শয্যা গ্রহণ করলাম। বন্ধুবর মশারী খাটিয়ে দিব্যি নাক ডাকাতে শুরু করলেন। আমি আর ঘুমুতে পারলাম না। মনে হল সারা বাংলার মশক- কুল রংপুর হোষ্টেলে সেদিন এক ঐকতান বাদনের জন্য আহুত হয়েছে।

তাদের পুনঃ পুনঃ গুণ গুণানি এবং আমার সশব্দ আক্রমণ হয়েই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম রাত পোহালে কলেজের গণ্ডী ছেড়ে যেদিকে দু’চোখ যায় বেরিয়ে পড়ব। এলাম রাজশাহী। বেশ লাগল বাড়ী ফিরে এসে। রাজশাহী কলেজে বি. এ. পড়ব এ বাসনাটা বাবাকে জানতে তিনি মনযুর করলেন।

রাজশাহী কলেজে চার মাস বি. এ. থার্ড ইয়ারে পড়েছিলাম। ফুটবল খেলা, গান-বাজনা, লেখাপড়া তিনটাই সমানভাবে চালিয়েছিলাম। জনবরেণ্য প্রফুল্ল রায় রাজশাহীতে এলেন। ছাত্রদের সভায় তিনি বক্তৃতা দিলেন। আমি গেয়েছিলাম সে সভায়, “ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর।” আজে। যেন আমার পিঠে তাঁর সাবাস্ বলে ধপাস ধপাস করে কিলের ব্যথাটা ব্যথা-মধুর হয়ে জেগে আছে!

রাজশাহীর জলবায়ু সইল না। গ্রীষ্মের বন্ধে বাড়ী এসে দীর্ঘ একমাস রেমিটেন্ট ফিবারে ভুগলাম। আর বাবা আমাকে রাজশাহী যেতে দিলেন না, ভর্তি হলাম আবার কুচবিহারে।

বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে বড়খাতায় ( রংপুর ) গিয়েছি আমার এক বন্ধু আবুল হোসেনের বাড়ীতে। গান, পাথীশিকার, ফুটবল খেলে দিন পনের কেটে গেছে, অকস্মাৎ আমার বড় ভাইয়ের পেলাম টেলিগ্রাম-”বাবা মৃত্যুশয্যায় শীঘ্র এসো,” সেই দিনই ছুটলাম বাড়ী।

তিন চারদিন পরে এক রাত্রে বাবার অবস্থা সত্যিই সংগীণ হয়ে উঠল। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল, শুধু নিঃশ্বাসটুকু বইছে। ঘর শুদ্ধ সবারই কান্নাকাটি উঠল। তখন রাত চারটা। আমি অকস্মাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ীর সামনের দলিজে জায়নামাজে সেজদায় গিয়ে পুকুরে ওজু করে বাহির বাড়ীর খোদার কাছে আকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে বললাম, “অন্তর্যামী, জীবনে জ্ঞানোন্মেষের সাথে সাথেই এই জ্ঞান দিয়েছ যে বি. এ. পাশ করে মানুষ হতে হবে। এই বি. এ. পাশের জন্য তুমি জান মালিক ছুটে চলেছি। এই দুটি অক্ষর জীবনের জন্য তুমি ছিনিয়ে নাও। বিনিময়ে তুমি বাঁচাও আমার জন্মদাতাকে।”

কতক্ষণ জায়নামাজে পড়েছিলাম মনে নেই। হঠাৎ মনে হল বাড়ীতে কান্নাকাটি থেমে গেছে, সূর্য উঠছে লাল হয়ে। ভাবলাম সব শেষ গেছে, তাই সবাই চুপ হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে বাবার ঘরে গেলাম। ঘর থেকে রোরুদ্যমান সবাইকে বের করে দেয়া হয়েছে। বাবার সমস্ত শরীরে স্বাভাবিক উত্তাপ ফিরে এসেছে। এদিক-ওদিক চাইছেন, আমাকে দেখে বললেন, “বাবা ফজরের নামাজ পড়লে? ওঃ কী যেন একটা দুঃসহ পাথর এতক্ষণ আমার বুক চেপে ধরেছিল। এখন ভাল মনে হচ্ছে।”

খোদা আমার প্রার্থনা মনযুর করেছেন। কোটী শুকুর তাঁর দরগায়, বাবা আমার নবজীবন লাভ করলেন। এরপর শারীরিক নানা অসুখ থাকা সত্বেও তিনি দীর্ঘ ১১৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত বাঁচেন। ১৯৪৫ সালে বলরামপুরে তিনি ইন্তেকাল করেন ( ইন্নালিল্লাহে…….রাজেউন )। কিন্তু সেবারে বাবার নবজীবন লাভের সাথে সাথে কলেজের নামকরা ছেলের নামটা আর গেজেটে ছাপার অক্ষরে বের হল না।

বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন সবাই অবাক। আমি বিন্দুমাত্রও বিচলিত হই নি। খোদার উপর আমার বিশ্বাস আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠল।

অনেক যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়ে বাবা আমাকে পাঠালেন আবার বি. এ’র দরজায়। আবার ভর্তি হলাম।

বি. এ. ফেল করে মাস তিনেক বাড়ীতে বসেছিলাম। সেই তিনমাস অমানুষিক পরিশ্রম করেছি। বাড়ী থেকে পাঁচ মাইল দূরে কৃষ্ণপুর নামে এক জায়গায় আমাদের এক হাটের ইজারা ছিল। সপ্তাহে ফুঁ’দিন প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে এই পাঁচ মাইল পথ হেঁটে যেতাম দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দুরে সেই হাটে পয়সা তহশীল করতে। বাড়ীতে ফিরতে ফিরতে কোন কোন দিন রাত দশটা এগারোটা বেজে যেত। দুপুরে অসম্ভব গরম, রাতে ফিরবার সময় হয়ত আসত ভীষণ জোরে বৃষ্টি মাথায় করে পথ হাঁটতাম। কালজানি নদী একুল ওকুল দেখা যায় না। খেয়াপারে পাটনীর জন্য অপর পারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষ। করতাম ঘণ্টার পর ঘণ্ট।। এক বৃদ্ধ মাড়োয়ারী রামরতন ঠাকুর তার নাম। সহানুভূতির সুরে আমাকে বলতেন, “তোমার এমন মিষ্টি গলা –তোমার কি আর এই সব কাজ পোষায়? কলকাত। যাওনা— সেখানে কলের গানে গান দাও, কত টাকা পয়সা হবে।” আমি বলতাম “আমি ত’ যেতে চাই ঠাকুর—বাবা যে যেতে দেন না।” বর্ষার মেঘের পরদা ফাঁক করে আকাশে চাঁদ উকি মারত। ঠাকুর মশায়ের কথার ইংগিতে যেন আকাশের মায়াময় চাঁদের হাসি দেখতে পেতাম। ঠাকুর মশায় বলতেন, আরে ভাই, গান গাও একখানা—বেটা নৌকা নিয়ে আসবে তাহলে তাড়াতাড়ি। গান ধরতাম—নদীর ঢেউয়ের উপর দিয়ে সে সুরের কাঁদন হয়ত কাঁপতে কাঁপতে দূরে মিলিয়ে যেত। বাড়ী থেকে কলকাত। দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণের আকাশে উদাস দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকতাম — ভাবতাম, কলকাতায় কত লোক কুলিমজুরী করেও দিন কাটায় — আমি কি কোন কাজ করে জীবন যাপন করতে পাব না সেখানে গেলে?

দি সংস আই হার্ড নো মোর

পূজার ছুটিতে একবার বাড়ীতে এসেছি। ঝাঁকি – জাল দিয়ে মাছ ধরার বড় সখ আমার। বাড়ী থেকে ঢু মাইল দূরে ঝাপই নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছি। মাছ ধরার নেশায় জাল বাইতে বাইতে নদীর ধারে ধারে বহুদূর চলে গিয়েছি। অকস্মাৎ বাঁশীর মত মিষ্টি কণ্ঠ কানে এল। অমন অপূর্ব মধুময় কণ্ঠ আমার জীবনে আর শুনি নি। কোথা থেকে গান ভেসে আসছে ঠিক করতে পারছিলাম না। স্বর ক্রমশঃ নিকটবর্তী। তারপর দেখি মহিষের পিঠে মহিষের মত বা তার চাহিতে ও কালো একটি ছেলে গাইতে গাইতে মহিষটাকে পানি খাওয়াবার জন্য নদীতে নামিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে গান ভার বন্ধ হয়ে গেল। কাছে গিয়ে কত অনুনয় করলাম—সিগারেট দিতে চাইলাম —আর কিছুতেই তাকে রাজী করতে পারলাম না। জীবনে অমন কণ্ঠ আর শুনি নি।

কুচবিহারে মাঝে মাঝে জলপাইগুড়ি থেকে কুমার সরোজ রায়কত আসতেন। রাজপুত্রের মত অনিন্দিত কান্তি। খেয়াল, ঠুংরী থেকে শুরু করে সব রকম গান কি মিষ্টি কণ্ঠেই না গাইতেন। আমরা তখন কলেজে পড়ি। তিনি কুচবিহার এলে তাঁর গানের আসর বসত সরকারী উকিল রাজেন রায়ের বাসায়। রাজেনবাবু তখনকার দিনে সারা উত্তর বংগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ খেয়াল গাইয়ে ছিলেন। অমন দরাজ কণ্ঠ আর দ্বিতীয়টি শুনিনি আজ পর্যন্ত। সেতারেও তাঁর মিষ্টি হাত ছিল। সরোজবাবুকে শেষে “সরোজদা” বলে ডাকতাম গান—”ওরে মাঝি তরী হেথা বাঁধব নাকো” আমি তাঁর কাছে শোনা প্রায় শততম রজনী কলকাতা রেডিওতে গেয়েছি। তাঁর গলার অভিনবত্ব ছিল–যত উপরের পর্দায় গাইতেন ততই পাপিয়ার মত মিষ্টি লাগত। তাঁর গলায় বেস পার্ট বা খাদ বেশী ছিল না বলে রেকর্ড জগতে তিনি বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেন নি।

এই সরোজদার গান শোনার জন্যে রাজেনবাবুর বৈঠকখানাও নিমন্ত্রিত শ্রোতাদের দ্বারা ভরে উঠত। আমরা রবাহূতের দল বাইরে বসে চুপ করে শুনতাম আর আমি মনে মনে খোদার কাছে বলতাম—“খোদা এমন গায়ক কবে হতে পারব, যেদিন আসরের সবার উৎসুক দৃষ্টি শুধু আমার উপর নিবদ্ধ থাকবে।”

আমিও তখন রাজেনবাবুর কাছে পরিচিত ছিলাম। তাঁর ছেলে সুনীল রায় আমার বাল্যবন্ধু। সুনীলকে তিনি খেয়াল শেখাতেন মাঝে মাঝে। আমার কণ্ঠেরও তারিফ করতেন, কিন্তু যেহেতু ভিনি মুখ ফুটে কোনদিনও আমাকে শেখাতে চান নি আমিও ভাই শিখবার মহ। আগ্রহ সত্ত্বেও তাঁকে কিছু বলি নি। সরোজদা’র আসর বসলে তিনি আমাদের মত চুনোপুটিকে পাত্তা দিতেন না কিন্তু মনে মনে প্রশ্ন জাগত এমন আসরে গাইবার সুযোগ কি জীবনে আসবে না?

আমার আর একজন বাল্যবন্ধু এবং বি.এ.পর্যন্ত সহাধ্যায়ী সুরেন্দ্রনাথ রায় বলুনিয়ার দরাজ কণ্ঠ কুচবিহারবাসীর কাছে পরিচিত। সেই দরাজকণ্ঠের সাথে একটি জিনিষের একটু অভাব ছিল, সেটা হচ্ছে কণ্ঠে সুরের মাধুর্য। সেই মাধুর্য একটু বেশী পরিমাণে তাঁর কণ্ঠে বিরাজ করলে আজ সে বন্ধুটিও সারা বাংলায় সুপরিচিত হতে পারত। আমার জীবনে সে জড়িয়ে আছে এবং থাকবে—কারণ ছেলেবেলায় তুফানগঞ্জ হোষ্টেলে থাকতে ওরই হারমোনিয়াম এনে নিজে নিজেই হারমোনিয়াম বাজাতে শিখেছি। বন্ধুর সেই উপকারের কিছুটা শোধ দেবার জন্য তাঁকে দিয়ে কয়েকখানা ভাওয়াইয়া গান রেকর্ড করিয়েছি—কিন্তু রোড- জগতে তিনি বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেন নি।

কুচবিহারে আমাদের গানের আসর বসত আমার আর এক অকৃত্রিম বন্ধু এবং সহাধ্যায়ী সত্যনারায়ণ শুকুলের বাসায়। সে বন্ধু একাধারে অভিনেতা, কবি, সাহিত্যিক এবং ভাল তবলা বাজিয়ে। কলেজ ছুটির পর রোজ বিকালে তার বাসায় প্রায় সাত আট জন গাইয়ে জুটাতাম গিয়ে। জিতেন মৈত্র, সুনীল রায়, জগদীশবাবু—এরা সবাই সেখানে জুটতেন। তাল-সহযোগে গান গাওয়ার অভ্যাস ঐখান থেকেই শুরু হয়। আমি আ জীবন এজন্য সত্যশুকুলের কাছে ঋণী। শুধু কি তাই? আমার প্রথম রেকর্ড যখন বাজারে বের হল সত্য-শুকুলই তখন কলেজের প্রফেসর, ছাত্র সবাইকে একদিন ওর বাসায় নিমন্ত্রণ করে তখনকার প্রিন্সিপ্যাল যতীন সেনগুপ্ত মহাশয়কে সভাপতি করে আমাকে এক মানপত্র প্রদান করে। জীবনে প্রথম স্বীকৃতি রেকর্ড-গায়ক হিসাবে ওরই কল্যাণে এবং প্রচেষ্টায়। আমার এই অকৃত্রিম সুহৃদটি আজ প্রায় ষোল বছর থেকে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে কাশীধামে দিন কাটাচ্ছে।

কুচবিহারে আমার একজন প্রফেসর আমাকে বি. এ. পড়বার সময় বারবার উৎসাহ দিয়ে বলতেন, “কলকাতা যাও আব্বাস, কেন এখানে পড়ে আছ? রেকর্ডে গান দাও। অদ্ভুত সুন্দর তোমার গলা।, তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রীচূণীলাল মুখার্জি। পরবর্তীকালে চূণীবাবু অধ্যাপকের পদে ইস্তফা বিয়ে কুচবিহারে বিরাট ব্যবসা করে বেশ সংগতিপন্ন অবস্থা করেছেন। আজও দেখা হলে তিনি বলে ওঠেন, “কেমন আব্বাস, তোমাকে বলিনি কলকাতায় যাও?”

দেশভ্রমণে

দেশ বিদেশ দেখবার দারুণ ইচ্ছা অতি ছোটবেলা থেকেই। বাবা কিছুতেই আমাকে চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। তা না হলে কি বাড়ীর কাছে বারে! মাইল দূরে হাইস্কল থাকতে তিনি বাড়ীর স্কুলে ছাত্রবৃত্তি পড়িয়ে জীবনের কতগুলো বছর মাটি করতেন? নেহাৎ যখন আর গ্রামে উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয় নেই তখন বাধ্য হয়ে কুচবিহারে পাঠাতে হয়েছিল। তাঁর হুকুম ছাড়া কুচবিহার রাজ্যের বাইরে বড় জোর রংপুর পর্যন্ত গিয়েছি। আই, এ, পরীক্ষা দিয়ে এক সুযোগ এল। আমার গ্রামের এক মাড়োয়ারী বন্ধুর বিয়েতে বিকানীর নিয়ে যাবার জন্ম আমার বাবার কাছে বন্ধু প্রস্তাব দিল। “না যাওয়া হবে না” এই রায় তিনি দিলেন। আমি বাবাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, দেশ বিদেশ দেখবার এমন সুযোগ কি ছাড়তে আছে? কিন্তু কিছুতেই মত দেন না। শেষে যখন দেখলেন নেহাৎই নাছোড়বান্দা তখন নিমরাজী হয়ে মত দিলেন আর কি! চললাম মাড়োয়ারের পথে কুচবিহার থেকে কাটিহার লাইনে। যেতে প্রায় চারদিন লাগল। আজকালকার মত তখন এক্সপ্রেস, মেইল এসব ট্রেন খুব কম চলত। যাক, চারদিন ধরে পথে ভাতের মুখ দেখিনি! ওখানে পৌঁছেই বন্ধুকে বললাম, “বন্ধু ভাতের জোগাড় কর।”

চমৎকার দেশ—লাডমু গ্রাম। কিন্তু গ্রাম ঠিক নয়, বিরাট বিরাট ইমারত। বাংলা দেশ থেকে নিয়ে ঘর দুয়ার সোনা মাণিক্যে ভরিয়ে ফেলেছে। এক একটা ঘর শুধু রূপোর গ্লাশ দিয়ে সাজিয়েছে— কোনটা বা শুধু সোনার গ্লাশ দিয়ে সাজিয়েছে। ঝাড়-লণ্ঠন, গালিচা। ত্রিশ বছর আগের কথা, তখুনি যা দেখেছি, এতদিনে হয়ত বা সে দেশ আগাগোড়া সোনা দিয়ে মুড়ে ফেলেছে

ওদের গুরুদেবের আখড়ায় একদিন গিয়েছিলাম। মুসলমান বলে সেই সৌম্যশান্ত পুরুষটি আমাকে হতাদর করলেন না, বরং তাঁর শুভ্র আসনের পাশে আমাকে বসিয়ে বললেন, “শুনা হ্যায় গান। ভি আতা হ্যায় বাবা, কুচ্ তো শুনাও।” আমি গেয়েছিলাম—

হরিনাম শিমরে সুখধাম জগতমে
জিউ না দুদিন কা
পাপ কপট ক্যর মায়া ছোড় ক্যর
বাস হুয়া বন কা মেরে রামা

এরপর আবার তাঁর অনুরোধে গেয়েছিলাম “মুখরা ক্যা দেখো দরপণমে।” আজও মনে পড়ে সেই ধু ধু বিস্তৃত মরুভূমিতে বিকালে সবাই মিলে বেড়াতে যেতাম দল বেঁধে। হরিণ আর ময়ূর কাছে এসে তাকিয়ে থাকত সুন্দরভাবে, অতি অপূর্ব সে দৃশ্য।

মাড়োয়ারে দু’মাস ছিলাম। দেশে ফিরবার পথে জয়পুর, যোধপুর, আজমীর, মথুরা, বৃন্দাবন, লক্ষ্ণৌ, কানপুর আগ্রা প্রভৃতি জায়গা দেখে আসি।

জয়পুর শহরটি অতি চমৎকার। বিরাট প্রশস্ত রাস্তা। এক রাস্তার দু’ধারে একই রঙের দালানের সারি — আবার অন্য রাস্তায় অন্য রঙের একই ডিজাইনের বাড়ী। যাকে বলে সুপরিকল্পিত নগরী। ওখান থেকে টাঙায় চড়ে পুরান জয়পুর শহর “অম্বর” দেখতে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের উপর রাজা মানসিংহের রাজপ্রাসাদ দেখে কত ইতিহাসের পাতাই যে ভেসে উঠল মনের পাতায়। যশোরের এক বিরাট কালীমূর্তি সেই প্রাসাদের কক্ষে রক্ষিত আছে। সেই কালী মূর্তির চোখদুটো সেনার চোখের দিকে তাকালে ত্রাসের সঞ্চার হয়। সমস্ত শহরটা জনশূন্য হয়ে পড়ে আছে। সেখানে এখন শুধু বাস করছে কিষ্কিন্ধার প্রাণীরা জয়পুর থেকে আজমীর শরীফে গিয়ে খাজা বাবার মাজার জিয়রত করি। সেখানে দুটো ডেক্‌চিতে যা শিরনী রান্না হয় তাতে হাজার হাজার লোকের উেই সে তবার রুক্ থেকে বঞ্চিত হয় না। দেখলাম আনা সাগর। সেখান থেকে গেলাম পুষ্কর তীর্থ। মরুভূমির মাঝখানে হ্রদের মত পুষ্করিণী দেখে প্রাণটা সজীব হয়ে উঠল 1 সেই হ্রদের চারধারে বিরাট বিরাট বাড়ী। বড় সাধ হল ডুবে স্নান করি কিন্তু দেখলাম হাঙর কুমীরে ভর্তি সেই পুকুর, কাজেই যাকে বলে ঘাট-গঙ্গার অবগাহন তাই সেরে নিয়ে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে বেয়ে উঠলাম সতীতীর্থে।

শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল—হিন্দুমুসলমানের তীর্থক্ষেত্রগুলিও যেন হাত ধরাধরি করে গড়ে উঠেছে। আজমীরে লক্ষ লক্ষ যাত্রী যায় খাজাবাবার মাজারে, আবর হিন্দুরাও তেমনি যায় পুষ্করতীর্থে, সীভাতীর্থে, ওদিকে জৈন্যরাও যায় তাদের শিল্পখচিত জৈন-মন্দিরে।

আজমীর থেকে এলাম আগ্রায়। তাজমহল দেখে মহাবিস্ময়ে শুধু স্তব্ধ হয়ে ভাবছিলাম—কে বলে এই সৌধ কত কালের! মনে হয় এই সেদিন এর কাজ শেষ হয়েছে-যমুনাকে বেঁধে যেন যমুনার তীরতটে শ্বেত শুভ্রা মর্মর-দেহা কোন অনিন্দ্যসুন্দরী নারী স্নিগ্ধ ধারার অবগাহন করছেন। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। মেঘ-শুভ্র সুনীল আকাশ থেকে পৌর্ণমাসীর চাঁদ তার ষোলকলা যৌবনের উজ্জ্বল জ্যোতি বিকীরণ করছিল ধরণীর বুকে। রূপগরবিনী তাজও সেই হাসির স্নিগ্ধধারা গায়ে মেখে ছোট ছোট ঢেউ-জাগানে। যমুনার জলে অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এই তাজকে যেদিন বিদায় দিয়ে লক্ষ্ণৌর পথে রওয়ানা হই, জানিনা কেন যেন অলক্ষ্যে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল ট্রেনের জানালা -পথে, মনে পড়েছিল আমার কিশোর কালের সেই প্রথম প্রিয়ার কথা।

কানপুরে এসে আমার এক সহপাঠীর বাসায় আশ্রয় নিলাম। কামাখ্যা মজুমদার। বাড়ী থেকে পালিয়ে এসে সে এখানে অল্প বয়সে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। খুব ভাল গল্প লিখতে পারত, গল্প বলতে পারত আর সুন্দর বাঁশী বাজাতে পারত। · ওর কাছে দিন দশ বারো থেকে বাড়ী ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়লাম। এরপর একটু জ্বরও হল। আমাকে বিদায় দিল সে। কুচবিহার এসে যখন হোষ্টেলে উঠলাম আমাকে দেখে সবাই বলছে, “তোমার গায়ে মুখে এ সব কি?” আমি বললাম “কানপুরে ভয়ানক মশা।” অথচ অসম্ভব মাথা ব্যথা। ডাক্তার এসে বললে, “এ ত’ স্মল পক্স। ……আধঘণ্টার মধ্যেই সমস্ত হোষ্টেল ফাঁকা হয়ে গেল! ঘরে আমি একা। সেই বিপদে আমার পাশে এসে যে দাড়াল সে রেয়াজ মিঞা—তখন তিনি বি, এ, পড়েন। সেবা শুশ্রূষা তিনিই আরম্ভ করলেন। বাড়ীতে খবর গেল। পুষ্প রোজাকে সাথে নিয়ে বাবা এলেন— দু’চার দিনেই সব শুকিয়ে গেল। তারপর বলরামপুরের বাড়ীতে আসি। আমি গরুর গাড়ীতে আর বাবা সমস্তটা পথ হেঁটে এসেছিলেন, আজও মনে পড়ে। ভাল হয়ে যখন উঠলাম বাবা তখন আদর করে বলেছিলেন, “বাবারে, এইজন্যই তোমাদের চোখের আড়াল করতে চাই না।”

কলেজ জীবনের টুকিটাকি

কুচবিহারে বি, এ, পড়ি। আমার এক হিন্দু বন্ধু, নাম বললাম না, আমাদের নিমন্ত্রণ করল, “চল যাই মাথাভাঙা (কুচবিহারের একটা সাব- ডিভিসন) আমার বড় ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে।” আমি বললাম, “আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভবপর হবে না।” মেয়ে দেখে এসে মাসখানেক পরে আবার এসেছে আমার হোষ্টেলে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে। বিয়ের চিঠিতে দেখি এই বন্ধুরই বিয়ে। বললাম, “ব্যাপার কি রে, তোর বড় ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেলি, এ যে ভোর-ই বিয়ে।” বললে, “ভাই এক মজার ব্যাপার হয়েছে! মেয়ে ত’ দেখতে গেলাম— অর্থাৎ বৌদি নির্বাচনে। বললাম, “গান জানেন?” মেয়ে সলাজ হাসি হেসে বললে, “জানি সামান্য।” বললাম “গান শোনান একখানা।“ গান ধরলেন তিনি—

এতদিন যে বসেছিলাম পথ চেয়ে আর কালগুণে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে
বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়
এ কি গো বিস্ময়
….  …. ….
মন্ত্র তোমার গোপন রাখ কোন তুণে!

গান শুনে মনে হল, এ গান আমাকেই লক্ষ্য করে গাওয়া হল। বাড়ী এসে মার কাছে বায়না ধরলাম, “ও মা, দাদার জন্য অন্য বৌদি ঠিক করে এনে দেব—ও মেয়েকে আমিই……” দিন দশেক হল বড় ভাইয়ের বিয়েও হয়ে গেছে। এখন আমার এ বিয়েতে তোকে যেতেই হবে ভাই।” আমি বললাম, “ওরে এতে তোর ক্ষতি হবে না ত’? যে গান দিয়ে তোকে জয় করেছে তার জবাব ত’ দিতে পারিস নি। গান জানিস না। আমি যদি গান দিয়ে তার জবাব দিই তুই তাহলে কোথায় থাকবি বল?”

বি, এ, পড়ার সময়ই আমাদের হোষ্টেলের এক ভদ্রলোক বিয়ে করে ফেললেন। আমি বাংলা ভাষায় একটু সাহিত্যচর্চা করি। ভদ্রলোক জানতেন। একদিন আমার ঘরে এসে বললেন, “আপনার সাথে আমার একটু গোপন কথা আছে। দরজাটা বন্ধ করে দিই।” আমি বললাম, “কী এমন কথা বলুন।” ভদ্রলোক বলি বলি করেও দু’চার মিনিট ধরে নানা ভূমিকা করতে লাগলেন। তারপর সলজ্জভাবে বললেন, “দেখুন, আমি বিয়ে করে এসেছি, সে কথা ত’ শুনেছেন। তা আমার বাংলা ভাষায়ও জোর নেই আর হাতের লেখাও যাচ্ছেতাই। কাজেই আপনি যদি দয়া করে আমার হয়ে আমার স্ত্রীর কাছে একখানা মানে যে এই প্রথম চিঠি লিখে দেন!!” আমি হাসব কি কাঁদব ঠিক করতে পারছি না। বললাম, ‘দেখুন, আবার বলুন। আমার শুনতে ভুল হল কি? চিঠি লিখব আমি আপনার স্ত্রীকে? কি বলে সম্বোধন করব?” তিনি এবার বললেন, “আহা, আপনি ত’ কবি মানুষ; স্ত্রীকে এই ধরুন প্রথম প্রেমপত্র!!” বুঝলাম ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। বললাম, “আপনি ঘরে যান, কাল সকালেই পাবেন।”….ওঃ, কী বিষম পরীক্ষা। রাতে বসে লিখলাম দীর্ঘ প্রেমপত্র। সে চিঠির কপি ত’ আর নেই। তবে ব্যাপার কি দাঁড়িয়েছে অতঃপর তাই বলছি।

ভদ্রলোক পরদিন সকালে আমার ঘরে এলেন। আমি বললাম, “চিঠিখানা ঘরে নিয়ে গিয়ে পড়ুন এবং দয়া করে ভুল করে আবার এইখানাই পাঠাবেন না। এই চিঠি আপনার হাতে নকল করে দেবেন।” তিনি বললেন, “একশো বার। “

তিনি আবার একদিন এসে আমাকে বললেন, “দেখুন, আপনার কাছ থেকে চিঠি লিখে দিন।” আমি বললাম, “আগের খানার উত্তর পেয়েছেন?” তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “হ্যাঁ, না—ত’, হ্যাঁ পেয়েছি।” আমি বললাম, “সেখানা না পড়লে উত্তর দেব কি করে?” বাধ্য হয়ে ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর চিঠিখানা আমার টেবিলে রেখেই লজ্জাবতী লতার মতই ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

চিঠি পড়ে শিরে করাঘাত করে উঠলাম। এ যে দস্তুরমত সাহিত্যিকার চিঠি। উচ্ছ্বাস, আবেগ, মান, অভিমান, বিরহ, দীর্ঘশ্বাস, চোখের জল এ ত’ আছেই, সব চেয়ে মারাত্মক কথা “তোমার মুক্তার মত হাতের লেখা, আর আমার এই কাকের ঠ্যাং—”বলে কি, হাবাচন্দ্র দেখি আমার আস্ত চিঠিখানাই পাঠিয়েছে। তার ঘরে গিয়ে বললাম, “উত্তর ত’ দেব কিন্তু মহা বিভ্রাট করে বসেছেন যে। আমার চিঠিখানাই যে পাঠিয়েছেন। এরপর ত’ আপনি স্ত্রীর কাছে হবেন ইম্‌পষ্টার।” ভদ্রলোক বললেন, “না, না, এবার আর তা হবে না।” মনে মনে বললাম, “তবেই হয়েছে।”

যাক্, এবার আরও ভাবোচ্ছ্বাস তরংগায়িত করে রূপালী স্বপ্নের রঙীন কল্পনাকে যতখানি রূপায়িত করা সম্ভব পত্রের প্রতি ছত্রে ফুটিয়ে তুলবার প্রয়াস করলাম। বললাম, “দোহাই, এবার কিন্তু চিঠিখানা কপি করে দেবেন।” কিন্তু ভদ্রলোকের মনে ধরেছে রঙীন ফানুস। এ ফানুস যে একদিন ফেটে তার মুখের উপর শব্দ করে উঠবে—একি তখন ভাবতে পেরেছেন তিনি?

যথাসময় গ্রীষ্মের বন্ধের ছুটিতে দেশে গেছেন তিনি। বন্ধ শেষ হয়ে গেছে। হোষ্টেল আবার সরগরম। তিনিও এসেছেন, কিন্তু ভদ্রলোকের আর পাত্তা নেই, অর্থাৎ আমার রুমের সামনে দিয়ে ত’ যানই না, এমনকি খাওয়ার ঘরেও লক্ষ্য করেছি, আমি খেতে এলে তিনি দরজা থেকে আমাকে দেখেই আবার স্বঘরে ফিরে যান। কৌতুহল হস। যার নাড়ীর খবর পর্যন্ত আমাকে জানবার সুযোগ দিলেন তিনি কিনা আর দেখাটি পর্যন্ত করেন না।

হঠাৎ একদিন গিয়ে তাঁর রুমে হাজির হলাম। “এই যে আদাব, কেমন আছেন—?” “বসুন ভালো আছি।” “কী ব্যাপার আর আপনার দেখা নেই; বাড়ীতে, মানে যে সব ভাল? ভাল কথা- চিঠিগুলো পড়ে তিনি খুব খুশী হয়েছেন?”

এবার তিনি কথা বললেন, আপনাকে বলতে ভুলে গেছি। আমার জীবনে বড় ট্র্যাজেডি নেমে এল দেখছি।” আমি সহানুভূতি দেখিয়ে বললাম, “আহা কী হয়েছে বলতে যদি দোষ না থাকে তা হলে–।”

তিনি বললেন, “দেখুন আপনার লেখা চিঠির উত্তর যা পেয়েছি (আপনিও দেখেছেন) তাতে মনে মনে আমি এই ছবিই এঁকেছি যে আমাদের বিবাহিত জীবন হবে বেশ মধুময়, কাব্যিক। প্রথম রাতেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমার চিঠিগুলো তোমার কেমন লাগত?” সে উত্তর দিল, ‘মামি অত কী বুঝি?’ ভাবলাম, লজ্জায় বলতে পারছে না। আবার বললাম, ‘আমার চিঠির উত্তরে তুমি যা উত্তর দিতে তা আরও চমৎকার।’ গ্রামের সরলা বালা। ফিক করে হেসে বললে, ‘আমি কি অত বড় বড় বাংলা বুঝি? ওসব চিঠির উত্তর লিখিয়ে নিয়েছি শরিফা বুবুর কাছ থেকে।’

আমার প্রথম রেকর্ড

নজরুলকে নিয়ে এলাম কলকাতা থেকে, ছাত্রদের মিশাদ উপলক্ষ্যে। দু’দিন রইলেন কুচবিহারে, কিন্তু গানে গানে কী যে উন্মাদনা সৃষ্টি করে গেলেন। আর ও’ মনকে কিছুতেই বইয়ের আখরে ধরে রাখতে পারি না। আমার মনের গহন বনে সুরের পাখী সর্বদাই বিচিত্র সুরকাকলিতে আমায় করে তোলে উন্মনা।

এরপর কাজিদা’র সাথে দ্বিতীয় দেখা দার্জিলিংয়ে। শৈলনিবাস দার্জিলিং। জীবনে দার্জিলিং গিয়েছি বহুবার। দাজিলিংয়ের আবাল- বৃদ্ধ-বর্ণিতার কাছে পরিচিত হবার সুযে।গ এসেছিল একবার একদিনের একটি ঘটনায়। কাজিদা গেছেন দার্জিলিংয়ে। তখন রেকর্ডে গান দিই নি। নৃপেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল হলে কাজিদার গান ও আবৃত্তির আয়োজন। তিল ধারণের স্থান নেই হলের ভিতর। বহু কষ্টে ঢুকলাম। কাজিদা তখন আবৃত্তি করেছেন তাঁর বিপ্লবী কবিতা “বিদ্রোহী”। পূর্ণ নিস্তব্ধতা কক্ষে বিরাজমান। জলদগম্ভীর সুরে আবৃত্তি করে চলেছেন। প্রতিটি শ্রোত। পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে তাঁর মুখের পানে। শেষ হওয়ার সাথে সাথে কি বিপুল করতালি। লুই জুবিলী স্থানিটোরিয়ামের এক পরিচিত ভদ্রলোক ষ্টেজের উপর বসে আছেন। “আমার দিকে চোখ পড়তেই তিনি আমাকে ইশারায় ডাকলেন। বহু কষ্টে গেলাম। এরপর তিনি ধরলেন গান—গানের পর গান, তারপর গান। একটু বিরতির জন্য তিনি চায়ের পেয়ালায় মনঃসংযোগ করলেন। সেই ভদ্রলোক কাজিদা’র কানে কানে বললেন আমার উপস্থিতির কথা। তাঁর সাথে এই দ্বিতীয়বার দেখা। প্রথম দেখা ও জানাশোনা এর আগের বছর কুচবিহারে যখন মিলাদের সভায় নিয়ে আসি। কাজিদা বলে উঠলেন, “কই, কোথায়?” আমি সামনে এগিয়ে এসে আদাব করলাম। তিনি দাঁড়িয়ে উঠে ঘোষণা করলেন, “এক নতুন শিল্পীর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি— শ্রীমান আব্বাসউদ্দীন।” নাম ত’ বলে দিলেন কিন্তু কী গান গাই? বললাম, “আপনার গানই গাই কেমন?” সানন্দে অনুমতি দিলেন। ধরলাম—’ঘোর ঘোররে আমার সাধের চরকা ঘোর।‘ এক গানেই আসর মাৎ। এবার আবার চীৎকার! দার্জিলিংয়ে নেপালী-ভাষায় একখানা গান শিখেছিলাম এর আগে। ধরলাম সেই গানখানা,

আজুরে যাঁউ যাঁউ
ভলিরে যাঁউ যাঁউ
পরশি তো যাঁ যায়লা
লাইবরিয়া যাঁউ যাঁউ।।

ঘরে বহু নেপালী জনসাধারণ এ গান শুনে মহা খুশী! তার পর দিন নেপালীয়া যেখানে যখন আমাকে দেখেছে নমস্কার করে বলে উঠেছে, “বাংগালীবাবু রামরছ—আজোরে যাউ যাউ ভমিরে রামরছ।” অর্থাৎ “বাংগালীবাবু বড় ভাল — আজোরে গান বহুৎ আচ্ছা গেয়েছো।” – এরপর যতবার দার্জিলিং গিয়েছি—নেপালীদের কাছ থেকে পেয়েছি যথেষ্ট আস্তরিকতা, বন্ধুত্ব এবং প্রাণখোলা আনন্দ।

সুযোগ এল কলকাতা যাবার – আমার এক বন্ধু জীতেন মৈত্রের বিয়ের বরযাত্রী হয়ে। গ্রামোফোন কোম্পানীতে গেলাম। প্রফেসর বিমল দাসগুপ্ত তখন গ্রামোফোনে কাজ করেন। কুচবিহারে এর বাবা আমাদের স্কুলমাষ্টার ছিলেন। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে তাঁকে গিয়ে বললাম, “বিমলদা, রেকর্ডে আমার গান দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন?” বললেন, “গাও দেখি একখানা গান।” আমি গাইলাম কাজিদার ‘কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট।’ গলা শুনে তিনি খুবই খুশী হয়ে বললেন, “আচ্ছা, তোমার ঠিকানা রেখে যাও চিঠি দেওয়া হবে।”

আমার তখন কাসিয়াঃ যাবার কথা হচ্ছিল। বললাম, “আমি কুচবিহার গিয়েই কাসিয়াং যাব, সেখান থেকে আপনাকে চিঠি দেব।” বন্ধুর বিয়ে ঢুকে গেল।…. কুচবিহার গিয়েই মাসখানেক পরে কাসিয়াং গেলাম আমার দোস্ত মশারফ হোসেন ও তাঁর স্ত্রীসহ। সেখানে গিয়ে বিমলদাকে চিঠি লিখলাম। দিন সাতেক পরে জবাব এল, “রেকর্ড করবার জন্য চলে এস কলকাতায়।”

কী আনন্দই যে হল! জীবনে নতুন ঊষার সূর্য্যোদয় দেখতে পেলাম, যেমন দেখছি চিঠিখানা পাবার দু’দিন আগে দার্জিলিংয়ের টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয়। অপূর্ব বিস্ময়, অভাবিত পুলক, অব্যক্ত এক অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল চোখের সামনে ধীরে ধীরে আঁধারের কুহেলি সরিয়ে দিয়ে স্বপ্নোত্থিতের মত প্রথম সূর্যের স্বপ্রকাশ, আকাশের কোলে।

রবীন্দ্রনাথের গানের কলি মনে পড়ছিল,

আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
…. …. …. …. ….
না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ!

তেমনি মনে হল, রেকর্ডে গান দেব, আমার আশৈশবের স্বপ্ন সফল হবে!!

এলাম কলকাতায়। আমার দোস্ত কশারফ হোসেন আমার হাতে দিল একশ’টি মুদ্রা, বললে, “আরও দরকার হলে লিখো।” প্রথম গান শৈলেন রায়ের রচনা— “স্মরণ পারের ওগো প্রিয়” আর “কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো।” প্রথমখানার সুর সংযোগ একরকম শৈলেন রায় ও আমারই, দ্বিতীয়খানা ধীরেন দাসের।

তখনকার দিনে রেকর্ড হত বেলেঘাটায়। আমার সেদিন রেকড হবে। আলাপ হল কে, মল্লিকের সাথে। আমি মুসলমান, একথা জানতে পেরে তিনি প্রথম আত্মীয়তার সুরেই আমাকে বললেন, “কী গান রেকর্ড করবে, গাও দেখি একবার। আমার গান শুনে তিনি বললেন, “চমৎকার গলা। কিন্তু… ও বিমলবাবু, আজ ত’ এর রেকর্ড হতে পারে না।” আমি ভড়কে গেলাম। এ কিরে বাবা- ভাল ত’ বিপদ দেখছি। “কী ব্যাপার” বলে বিমলদা এগিয়ে এলেন।

কে. মল্লিক মশায় বললেন, “একে নতুন আর্টিষ্ট মশাই, তাতে আবার মুসলমান। দেখুন না গানের উচ্চারণ; আজ থাক! সারাদিনে আমি ওর উচ্চারণগুলো ঠিক করে দিই—কাল রেকর্ড করবেন।” প্ৰাণে এতক্ষণে জোর এল। বিমলদা বলে উঠলেন, “হবে না—জাতের টান ত!”

এ কথার অর্থ আমি বুঝলাম না। জিজ্ঞাসু নয়নে কে, মল্লিক মশায়ের মুখের দিকে তাকাতাম! তিনি হেসে বললেন, “উনি ঠিকই বলেছেন, আমিও ত’ মুসলমান।” আকাশ থেকে ফেরেশতা নেমে এসে হলফ করে বললেও বিশ্বাস করতাম না। কেমন করে করি? বললাম, “কিন্তু ছেলেবেলা থেকে ত’ শুনে আসছি আপনার গান, ঐ শুধু “আর কবে দেখা দিবি মা” “ওমা অন্তে যেনও চরণ পাই–” এই সব গান। তিনি হেসে বললেন, “তাতে কি হয়েছে? গান গান, তাতে হরিই বা কী শ্যামাই বা কী।” মনের সন্দেহ তবু যায় না, যাগে তাঁর অতি যত্নের রেকর্ডে ́র উচ্চারণভংগীগুলি দু’এক ঘণ্টার মধ্যেই আয়ত্ব করে ফেললাম। তাঁর এই অযাচিত উপদেশ ও শিক্ষার জন্য আমি এখনও তাকে পরম শ্রদ্ধার সাথে নিত্য স্মরণ করি। আমার রেকর্ডের গান উচ্চারণদোষে দুষ্ট নয়—এ কথা বোধ হয় আমার রেকর্ড-শ্রোতারা স্বীকার করবেন।

রেকর্ডে গান দিলাম। গ্রামোফোন কোম্পানীর ম্যানেজার ভগবতীবাবু ষাট বছরের ঝাণু বৃদ্ধ। আমার ‘ডিস্‌ক কপি’টা বোধ হয় শুনেছেন, তাই তাঁর কাছে বিদায় নেবার দিন বললেন, “দেখুন, আমার ইচ্ছা যে আপনি কলকাতার থেকে আরও অন্ততঃ আটখানা গান রেকর্ড করে যান।” সামনেই বিমলদা বসেছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, “না না তা হয় না। ছেলেমানুষ, কার্সিয়াং থেকে এসেছে ঐখানেই থাক, বায়ু পরিবর্তন করবার সুযোগ পেয়েছে, যাক ঐখানে।” এর পরও ভগবতীবাবু প্রশ্ন করলেন,”কি, তা হলে থাকবেন ক’দিন এখানে নতুন রেকর্ড করবার জন্য?” আমি অনিচ্ছাসত্বেও বললাম, “না, কার্সিয়াংয়েই যাব আজ রাতে!”

আমার আসা-যাওয়া থাকা-খাওয়া ইত্যাদি সব মিলে আমাকে তিন শ’ টাকা দিলেন। বাইরে এসে বিমলদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “বেশ ত’ আরও আটথান। গান দিতাম ক্ষতি কি ছিল?” তিনি বললেন, “বোকা ছেলে, আরও আটখানা গান দিলে টাকা তোমাকে এই তিনশ’ই দিত। মাঝখান থেকে দু’বছর আর রেকর্ড কোম্পানী তোমাকে ডাকত না, কারণ ঐ রেকর্ড দু’বছর ধরে বের করত, ফলে গ্রামোফোন কোম্পানী উঠত ফেঁপে, তোমার পকেটে জ্বলত লালবাতি।”

রেকর্ড ত’ করে এলাম। বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বলেছি, দেখিস আমার গান রেকর্ডে বেরোবে। সবাই খুব খুশী। কিন্তু দু’মাস, চার মাস এমন কি ছ’মাস হয়ে গেল, রেকর্ড আর বেরোয় না বাজারে। এবার রেকর্ড করার ব্যাপার নিয়ে বন্ধুরা বেশ টিটকারি দেওয়াই শুরু করলে। আমাকে দেখলেই বলে ওঠে, “ঐ দেখ রেকর্ড ́ গাইয়ে।” কেউবা বেশ টেনে টেনে বলে “হি-জ মা-স্টা-র-স্ ভ–য়ে—স্।”

গ্রামের বাড়ীতে এসেছি। আমার এক বন্ধু শশধরবাবুর চিঠি পেলাম, “তোর রেকর্ড বেরিয়েছে চলে আয়।” শহরে এসে সেই বন্ধুর বাড়ীতে গেলাম। সে বাড়ীতে মাঝে মাঝে গানের আসর বসত। প্রায় কুড়ি-প’চিশ জন বন্ধু-বান্ধব বসে আছে দেখলাম। সবাই বসে গম্ভীর। ব্যাপারটা যেন কেমন মনে হল। যে বন্ধুটি চিঠি লিখে আমায় আনিয়াছে, সে রেকর্ড বাজাতে শুরু করলে। এ রেকর্ড, সে রেকর্ড, প্রায় পাঁচ-ছ’ খানা। একজন হো হো করে হেসে উঠে বললে, “আরে আব্বাসের রেকর্ডখানা জুড়ে দে।” কিন্তু এত ঘটা করে আমায় ডেকে আমার রেকর্ড না বাজিয়ে যখন অন্য রেকর্ডই চালিয়ে যাচ্ছে এরা তখন বুঝলাম নিশ্চয় এয়। আমাকে সভা করে অপদস্থ করার মতলব এঁটেছে। আমি হঠাৎ দাড়িয়ে উঠে বললাম, “চলি ভাই, কাজ আছে।” সমস্বরে সবাই বলে উঠল, “আরে তোমার গানটা শুনে যাও।” আমার চোখ তখন ছলছল, বাইরে ছুটে গিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। জোড়হাত করে বললাম, “তোমরা মাফ কর ভাই, রেকর্ডে আমি গান দিই নি, এতদিন মিছেই ধাপ্পা দিয়েছি।” এই কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি, এমন সময় আমার কণ্ঠে গান বেজে উঠল গ্রামোফোনের যন্ত্রের ভিতর দিয়ে—

“কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল ঝরে গো।”

তিন-চারজন বন্ধু তখন আনন্দে, উচ্ছ্বাসে আমাকে একরকম শূন্যে করে কাঁধে তুলে নিয়ে এল। ওঃ বাবা, এত কষ্ট নিজের গান শুনবার জন্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *