প্রথম গানের প্রেরণা

প্রথম গানের প্রেরণা

মোহররমের মর্সিয়া

আমার নাম ছিল শৈশবে শ্রী সেখ আব্বাসউদ্দীন আহমদ। গ্রামে তথা সমস্ত কুচবিহারে মুসলমান সমাজে এক আন্দোলন উঠল—নামের পূর্বে এই ‘সেখ’ কথাটা তুলে দিতে হবে। আমার তখন বয়স হবে আট বছর। পরিষ্কার মনে পড়ে আমাদের মহুকুমা তুফানগঞ্জে আমি সেদিন বাবার সাথে গিয়াছিলাম এক বিরাট সভায় যোগদান করতে। এক পয়সার কার্টিজ কাগজের শত শত কাগজে সবাই নাম লেখা আরম্ভ করল ‘সেখ’টা বাদ দিয়ে শ্রী অমুক বলে— সেই দস্তখত-নামা কাগজগুলো দরখাস্ত-সহ সেখানকার কাছারীতে জমা দেওয়া হয়েছিল। এর কারণ তখন বুঝিনি। পরে বুঝেছিলাম যে তখন সাধারণতঃ শিয়া মুসলমানরা নাকি নামের আগে ঐ শব্দটি ব্যবহার করতেন। অতএব আমাদের সুন্নীদের এটি পরিত্যাগ করতে হবে। গ্রামে আরও প্রচার হতে লাগল যে এবার যারা মোহররমের সময় বাড়ীতে তাজিয়া তৈরী করবে তাদের সংগে সামাজিকতা চলবে না। আমাদের গ্রামের সমাজে তখন সত্যিই বড় কড়াকড়ি নিয়ম ছিল। ছোটখাট মামলা-মোকদ্দমা আমার বাবা মৌলবী জাফর আলী আহমদ, বড় মামা ও কুচবিহার মহারাজার নাজিরের বংশধর কুমার গৌরনারায়ণ সিং এঁরাই মীমাংসা করে দিতেন। আমি অতশত বুঝতাম না, তবে মনটা বেশ খারাপ হল এই ভেবে যে গ্রামে আর তাজিয়া দেখতে পাব না। কী অপূর্বভাবে কাঁচি দিয়ে কাগজ কেটে সূক্ষ্ম কারুকার্যের পরিচয় দিত গ্রামের তাজিয়া তৈরী করার দল–এমন সুন্দর জিনিয উঠে যাবে গ্রাম থেকে……..আর বন্ধ হয়ে

যাবে মোহররমের বাজনা এবং সংগে সংগে মোহররমের জারী!!

মোহররমের বাজনা সত্যিই গ্রামে বন্ধ হল কিন্তু ভিন গাঁয়ে উঠল কাড়া-নাকাড়া শানাইয়ের বাদ্য। তারা যখন আমাদের গ্রামের গঞ্জে দলে দলে এসে বাজনা এবং লাঠিসোটার খেলা দেখাতে লাগল তখন আমাদের গ্রামের যুবকরা যারা সমাজের ভয়ে দল ভেঙেছিল তারাও লুকিয়ে গিয়ে ‘ডম্প’ (এক রকম ঢোল বাদ্যবিশেষ) নিয়ে দলের সাথে ভিড়ে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের গ্রামের আশেপাশে প্রায় দশ বারোখানা গ্রামের মোহররমের দল ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।

বাড়ী থেকে প্রায় দুই তিন মাইল দূরে সত্য-পীরের গান শুনতে গেলাম একদিন। যেখানে সেই দলের মূল গায়েন গেয়ে উঠল,

ও ভাই আল্লা বলরে রসুলের ভাবনা
দিনে দিনে হইল ফারাজি সিন্নি খাওয়া মানা ॥

অবশ্য এ গান শুনেছিলাম মোহররম উপলক্ষ্যে। তাজিয়া দিয়েছিল কালজানি নদীর ওপারে বিরাটভাবে এক জোতদার। তখনকার দিনে শুনেছি পাঁচ টাকার নাকি গোলমরিচই কিনেছিল সেই মেজমানীতে লোক, খাওয়াবার জন্য। গান শুনে আমার মনে হয়েছিল যার। শিয়াদের রীতিনীতি পরিত্যাগ করে খাঁটি সুন্নীমত গ্রহণ করেছিল তাদের উদ্দেশ্য করেই এ গান রচনা। ফারাজি মানে নামাজী; সিন্নি মানে তাজিয়। উপলক্ষ্যে যে সিন্নি বা খাওয়ার আয়োজন করা হয়।

গ্রামের অধিকাংশই ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। তাঁরা রূপান্তরিত হলেন সুন্নী মুসলমানে। কাজেই গান বলতে মর্সিয়া আর মোহররমের বাদ্য গ্রাম থেকে নিল চিরবিদায়।

কিন্তু আমার ভাগ্য ভাল আমার গ্রামে ছিল বহু ভাওয়াইয়া গায়ক, সারা গ্রামট। সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত গানের সুরে মুখরিত হয়ে থাকত। বাড়ীর পূর্বে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমাদের আধিয়ারী প্রজার। হাল বাইতে বাইতে পাট নিড়াতে নিড়াতে গাইত ভাওয়াইয়। গান….। সেই সব গানের সুরেই আমার মনের নীড়ে বাসা বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখী।

ক’ ভাবী মোর বঁধুয়া কেমন আছে রে?
তোর বঁধুয়া আছে রে ভালে
দিন কতক কন্যার জ্বর গেইছে রে
ওকি কন্যা চায়া পাঠাইছে জিয়া মাগুর মাছ রে ॥

এ গানের সুর আমার সমস্ত সত্বায় এনে দিত আলোড়ন। গ্রামের চাষীর কণ্ঠের সুর অবিকল আয়ত্ব করে ফেলতে আমার এক মিনিটও লাগত না। বাড়ী থেকে ছাত্রবৃত্তি স্কুল পায়ে হেঁটে প্রায় বিশ মিনিটের রাস্তা। বাড়ীর আড়াল হয়ে বন্দরে কুঞ্জ পালের দোকান ছাড়লেই ধরতাম সেই গান। ঠিক বন্দরের মুখেই করতাম গান বন্ধ—কারণ সেখানে থাকত লোকজন। এমনি ভাবে হঠাৎ স্থ একদিন বাবার সামনে পড়ে যেতাম, তিনি হয়ত বন্দর থেকে বাড়ীর দিকে ফিরছেন, আমি চলেছি স্কুলে। কিছুই বলতেন না গান শুনে। একটু হেসে আমার গালে একটা চুমু দিয়ে বলতেন, “ভাত খেয়ে এসেছে। তো বাবা, যাও, স্কুলে যাও।” আমার মামাদের সামনে পড়ে গিয়েছি অনেকদিন, তার মধ্যে অন্য মামাদের চাইতে বড় মামাই কেবল ধমক দিয়ে বলে উঠতেন, “পাজী ছেলে মুসলমানের গান গাইতে আছে?” তাই বড় মামাকে বড্ড ভয় করতাম, কিন্তু বাবার মৌন সম্মতি আছে বুঝতে পেরে মামার এই ধমকরে কোনো দিনও গ্রাহ্যের মধ্যে আনতাম না।

আমার ফুল প্রীতি

গানের মত ফুলও আমি ভালোবাসতাম ছোটবেলা থেকেই। আমাদের বাড়ীর খুব কাছেই পি, ডব্লিউ, ডি’র ডাকবাংলো। সেখানে গোলাপ, বেলি, গন্ধরাজ ও আরও নানান ফুলের সুন্দর এক বাগান। সেই বাগানে রোজ অতি ভোরে গিয়ে ফুল চুরি করতাম। একদিন মালীর কাছে ধরা পড়ে যাই। মালী বললে, “না বলে ফুল নাও কেন? বরং ফুলের ডাল নিয়ে যাও, বাড়ীতে পুঁতে দিও, ফুল হবে।” খুব ভাল কথা……..এমনি করে গড়ে উঠল আমার বাড়ীতে ফুলের বাগান। দেখতে দেখতে এক বছরের মধ্যে গন্ধরাজ, গোলাপ, বেলি, নানারকম পাতাবাহারে আমার বাগান ভরে উঠল। রোজ ভোরবেলা উঠে তবু ডাকবাংলো থেকে ফুল চুরি করে আনতাম। মালীর কাছে আবার ধরা পড়ে গেলাম। বললে, “দুষ্টু ছেলে, তোমাদের বাগানে তো এখন খুব ফুল ফোটে, আমার এখান থেকে ফুল নিয়ে যাও কেন?” বললাম, “মালী, আমার নিজের বাগানের ফুল লাগে।” মালীটা দেখলাম এ কথায় রাগ করল না। সে বলল, “ঠিক কথা খোকা, নিজের বাগানের ফুল ছিঁড়তে, বড্ড মায়া লাগে। তবে আমার বাগান থেকে না বলে নেয়াটা তো চুরি করা হয়।  আর ওতে আমারও তো আমারও তো ফুল কমে যায়, আমিও দুঃখ পাই।“ আমার এই ফুলের বাগান করা দেখে গ্রামে অনেক সহপাঠী তাদের বাড়ীতে -ছোটখাট বাগান করেছিল।

ভোরবেলা বাবার শিয়রের কাছে বেলফুল, গন্ধরাজ রেখে আসতাম। কোনো কোনো দিন মালা গেঁথে মাষ্টার মশায়ের জন্য স্কুলে নিয়ে যেতাম। মালাটা মাষ্টারকে দিতাম, তিনিও খুব উৎসাহ দিয়ে বলতেন, “যারা ফুল ভালবাসে তাদের মনটা চিরকাল ফুলের মতো নিৰ্মল থাকে।” আজো আমার ফুলের নেশা যায়নি। এ ফুল আমার জীবনে এক পরম কৌতুহলের জিনিষ। আমার বাগানে যখন অসংখ্য রজনীগন্ধা ফোটে, তখন তার বর্ণ আমার মনে নিয়ে আসে বিস্ময়। ডালিয়া, যুঁই, শেফালি, গেঁদা সবাই নিয়ে আসে নব নব পুলকের ভালি, নিয়ে আসে ঋতুর আগমনী-বার্তা। গোলাপের কুঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি….আস্তে আস্তে দিনে দিনে সে কুঁড়ি স্ফুটনোম্মুখ হয়, তারপর যেদিন প্রথম সূর্যেদয়ের মত আকাশের চারিদিকে আলোর দ্যুতি ফেলে সূর্যের আবির্ভাব হয়, গোলাপ ফোটার প্রথম মুহূর্তটি ঠিক তেমনি মনে হয় আমার কাছে। ভোরবেলা স্ফুটনোম্মুখ গোলাপ পাপড়ির দিকে চেয়ে থাকি। চোখের সামনে ফুটে উঠে, মনে হয়, প্রথম সৃষ্টির দিনও বিধাতা পুরুষ আঁধারের দিকে চেয়ে চেয়ে অকস্মাৎ ‘কুন’ বলার এমনি ভাবে আলো-ঝলমল পৃথিবী তাঁর চোখের সামনে জন্মলাভ করেছিল। তাই এই ফুলের দিকে তাকালেই সৃষ্টির রহস্ত জাল বুনতে খাকে মনের কোণে। বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি এই ফুল।

ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি হিন্দু ছেলেরা ভোরবেলা উঠে ফুলের ডালি নিয়ে ছোটে এর বাগান ওর বাগান। সাজি ভর্তি করে বাড়ী ফেরে। জিজ্ঞেস করতাম স্কুলে, “তোরা এত ফুল তুলিস ভোরবেলা! কই দু’ একখানা মালা গেঁথে তো মাষ্টার মশায়ের জন্য নিয়ে আসতে পারিস? “ ওরা বলতো “দূর বোকা কোথাকার, ফুল দিয়ে মালা গাঁথব কি, বাড়ীতে যে রোজ পূজো হয় ফুল দিয়ে?” সে পূজা কল্পনায় ঠাঁই পেত না, পরে স্কুলে যখন সরস্বতী পূজা আরম্ভ করল ছেলেরা তখনই দেখলাম প্রতিমার সামনাটি ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিল একেবারে। কি সুন্দর বড় বড় পদ্মফুল দিয়ে সাজিয়ে দিল প্রতিমার চারধারটা। তারপর দুপুর বেলা ছেলেরা বামুন ঠাকুরের দেখাদেখি ফুল দিয়ে অর্ঘ্য দিতে লাগল সেই প্রতিমার পায়ে।

গ্রাম্য যাত্রাদল

মনে পড়ছে জীবনের ফেলে আসা দিনগুলির কথা। অতি ছোটবেলা থেকে গান-বাজনার ওপর কী নিদারুণ ঝোঁকটাই না ছিল আমার। ভিনগাঁ থেকে যে সমস্ত মোহররমের দল আসত তার বাজনা শুনে তাদের সাথে সাথে আমি চলে যেতাম পাঁচ মাইল সাত মাইল দূরে। আমার বাবা লোক পাঠিয়ে সেখান থেকে আমাকে বাড়ীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন। স্কুলে একটা দল করেছিলাম। ছুটির পর একজনের বাড়ীতে গিয়ে সেইখানে কেরাসিনের টিন দিয়ে মোহররমের বাজনার মতো করে বাজাতাম প্রায় বিশ-পঁচিশ জন ছেলে। বয়স আমার যখন বছর দশেক, তখন সেই টিনের কনসার্ট পার্টির সাথে পাটের দাড়ি গোঁফ, বাঁশের তলোয়ার তৈরী করে রীতিমত যাত্রার রাজা, মন্ত্রী সেজে যাত্রার অভিনয় করতাম। শ্রোতা জুটত পাড়ার যত ছেলেমেয়েরা।….যাত্রাগান শোনার জন্যই কি কম কষ্ট করেছি! গ্রামে বড় বড় যাত্রাপার্টি আসত। প্রতি বছর ঠিক শীতের সময়। ভোরবেলা থেকে যাত্রাগান শুরু হবে—রাতে ছটফট করতাম কখন ভোর হবে— কারণ আসরের প্রথম জায়গাটি দখল করে বসা চাই কিনা! সূর্যোদয়ের সাথে সাথে যাত্র। গান শুরু হত! বেলা প্রায় দু’টোর সময় আসর ভংগ হত। কোথায় ক্ষুধা তৃষ্ণা? সব ভুলে যাত্রার সখিদের গানের সুর যেন গিলতাম। যাত্রার দলে চলে যাওয়ার পরেও আমরা আমাদের সখেন্ন যাত্রা পার্টিতে গাইতাম,

দাদা, কেবা কার পর কে কার আপন
পথিকে পথিকে পথের আলাপন।।

আমাদের গ্রামে যখন প্রথম থিয়েটার দেখি, তখন আমার বয়স দশ বছর। গ্রামের যুবকরাই সে থিয়েটার করেছিল। তার মধ্যে দুজনকে বহু বয়স হয়ে লোকান্তরিত হতে দেখেছি। একজনের নাম কালীমোহন চৌধুরী আর একজনের নাম আইনুদ্দিন। এঁর। অবশ্য পরে আমাদের গ্রামেই রীতিমত যাত্রার দল খুলেছিলেন এবং সে দল সারা কুচবিহার রাজ্যে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। সে দলে এক সংগীত মাষ্টার নিয়ে আসা হয়েছিল কুচবিহার শহর থেকে। সেই মাষ্টার আমার গলা শুনে অবাকই হল। বলল, “এই ছোঁড়াকে পেলে আমাদের দলের ভীষণ নাম হবে।” কিন্তু আমাকে যাত্রার দলে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করবে আমার বাবার কাছে, কার এমন সাহস?

একবার এক যাত্রার দল আমাদের গ্রামে প্রায় দশ বারো পালা গান করে। তাহলে বুঝতে হবে গ্রামে সবাই খুব অবস্থাপন্ন লোক। আসলে তা নয়। তখনকার দিনে যাত্রাগান বাড়ীতে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল একেবারেই অন্য কারণে। ধরুন, কারো বাড়ীতে যাত্রা গান হবে। অধিকারী মশায়ের সাথে ঠিক হল এক পালা গান এক রাত্রির জন্যে পঞ্চাশ টাকা। গৃহস্বামী গ্রামবাসী সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন। নিমন্ত্রিত অভ্যাগতেরা  গান শুনে কেউ আট আনা, কেউ এক টাকা, কেউ বেশী জোর দু’ টাকা দিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেন। তাতে যাত্রার অধিকারীকে তাতে যাত্রার অধিকারীকে পঞ্চাশ টাকা দিয়েও গৃহস্বামীর লাভ দাঁড়াত কোনো সময় পঞ্চাশ টাকা, কোনো সময় বা এক শো টাকা। কাজেই এইভাবে গ্রামে অনেক দিন ধরে এর বাড়ী ওর বাড়ী গান হত।

এইভাবে এক যাত্রার দল গ্রামে দশ-বারো দিন যাত্রার জন্য থেকে যায়। আমার গান শুনে অধিকারী মশাই সত্যি সত্যিই বাবার কাছে এসে প্রস্তাব করল তাঁর ছেলেটিকে যাত্রার দলে দিতে তিনি রাজী আছেন কিনা! গৃহে অতিথি এলে অপমান করতে নেই, তাঁকে যথাযথ অভ্যর্থনা জানিয়ে বাবা বিনীতভাবেই তাঁকে বলেছিলেন, “ছেলে হয়ত ভবিষ্যতে গাইয়ে ‘হবে, কিন্তু তার আগে তাকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলতে হবে—সুতরাং….।”

প্রথম গ্রামোফোনে গান শোনা

উচ্চ প্রাইমারী পরীক্ষা দিয়ে বাড়ীতে বসে আছি। কোনো কাজ নেই, খাওয়া-দাওয়া আর বিকাল তিনটা বাজতেই ফুটবল নিয়ে মাঠে গিয়ে সেই তিনটার রোদ্দুর থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত শ্রান্তিবিহীন বল খেলা।

হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, “আব্বাস, তোমাদের বাড়ীতে কলের গানের গান হচ্ছে…” শুনেই ভোঁ দৌড়। তাজ্জব কাণ্ড—চোঙ্গাওয়ালা এক কলের গান থেকে সত্যিই গান বেরুচ্ছে। অবাক হয়ে গেলাম কী করে একটা বাক্সের ভিতর থেকে গান হয় এ কৌতুহল আর দমন করতে না পেরে লোকটাকে, “খুলে দেখাও তে। ভিতরে কে গান গাইছে?” লোকটা কিন্তু বাড়ী বাড়ী দুই চারখানা রেকর্ড শুনিয়ে স্কুসের এক সের চাউল বা পয়সা যে যা দেয়, তাই নেয়। বললে, “পাঁচ ছ’ সের, চাউল নিয়ে এসো খোকা, আমি দেখাচ্ছি ভিতরে কে গায়। মহা উল্লাসে বাড়ীর ভিতরে ছুটলাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না রান্নাঘরে। ডেকে হয়রান….মা কোথায়, বোনরা কোথায়! ও খোদা, তারা যে সবাই আমাদের দক্ষিণের ঘরের ভিতর জানালা জুড়ে বসে গান শুনছিল খেয়াল করিনি। মাকে বললাম, “মা পাঁচ ছ’ টালা (চাউল মাপার পাত্র, এক টালায় দেড় সের) চাউল দাও, কলের গানের ভিতরে লোক আছে, সেটাকে খুলে দেখাবে লোকটা।”….চাউল দিলাম, কিন্তু যন্ত্র খুলে দেখাল, না আছে লোক, না আছে কেউ! বললে লোকটা, “নারে বাবা, ভিতরে লোক নাই, এই যে কুকুর মার্কা শ্লেট মানে রেকর্ডখানা দেখতে পাচ্ছ, এই ছোট্ট সূঁই মানে পিনটা লাগিয়ে দিলেই দেখ কী সুন্দর গান হয়!” আজো মনে পড়ে সে গান….

“বুড়ী তুই গাঁজার জোগাড় কর
ওলো তোর জামাই এলো দিগম্বর ॥”

সে গান প্রসিদ্ধ কৌতুক অভিনেতা চিত্তরঞ্জন গোস্বামীর।

সেই প্রথম কলের গান শোনার অভিজ্ঞতার সাথে বাংলাদেশের বহু ছেলে-মেয়ের অভিজ্ঞতার মিল আছে, এ কথা হলপ করে বলতে পারি।

ঐ কলের গানের গান শুনে সেই শৈশব থেকেই প্রাণে-মনে দোলা লেগেছিল, আমি কি কোনোদিন ঐভাবে কলের গানে গান দিতে পারব না? আমাদের বাড়ীতে প্রকাণ্ড ইদারা, সেই ইঁদারায় পানি তুলতে তুলতে হঠাৎ যেন কার ডাকে সাড়া দিয়ে উঠেছি, ইদারার ভিতরে একটা সুন্দর প্রতিধ্বনি হল। মনে হল এ প্রতিধ্বনিটা ঠিক কলের গানেই শুনেছি। একবার ‘আ’ করে উঠলাম, ঠিক ‘আ’-এর প্রতিধ্বনি হল ‘আ’। আর একবার বললাম ‘ই’ উত্তর হল ‘ই’….একখানা গান ধরলাম, গানের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। মনে কী উল্লাস, মাকে ডাকছি ভাইদের ডাকছি শোন শোন শুনে যাও কলের গান!….এইভাবে যতবার ইদারার পারে যেতাম গলাটা ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে গান গাইতাম-ই!! একটু সঙ্কোচ হত বাবাকে। কিন্তু অনেকদিন দেখেছি আমার ঐ চীৎকার ব। গান শুনে তিনি এসে দূরে দাঁড়িয়ে শুধু হাসছেন।

আমার শৈশবের কথা

ধনীর ঘরের দুলাল না হলেও বাবার অবস্থা মোটামুটি ভালো। পঁচিশ ত্রিশ খানা হালের জমি, প্রায় দেড়শো বিঘা খাস্ আবাদী জমি আর পাঁচ হাজার বিঘা প্রজাপত্তনী জমির মালিক ছিলেন তখন আমার বাবা। এত বড় সম্পত্তি দেখাশুনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার, পাইক, বরকন্দাজ রেখেও বাবা ওকালতি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি তখন ফিফথ ক্লাসে পড়ি।

এই রকম অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। আমাদের শৈশবটা কিভাবে কেটেছে এখনকার ছেলের। হয়ত সেকথা ভাবতেও পারে না। তখনকার দিনে, মানে উনিশ শো চৌদ্দ-পনের সালে, ধুতি পরতাম; ধুতি ছিল একখানা, গায়ে ছিল একটা শার্ট। আমাদের গ্রাম বলরামপুরের স্কুলটা প্রকাণ্ড এক পুকুরের ধারে। সকাল দশটায় ভাত খেয়ে রেখে স্কুলে গিয়ে বইপুঁথি রেখে স্কুলের প্রায় সব ছেলেই সার্ট আর ধুতি পুকুরের পারে রেখে দিগম্বর হয়ে পুকুরে লাফিয়ে পড়তাম। চোখ দু’টো জবা ফুলের মতো লাল না হওয়া পর্যন্ত সাঁতার কাটতাম। তার পর পণ্ডিত মশাই, যিনি সকাল থেকে এগারোটা পর্যন্ত নিজের সামান্য জমিতে হালচাষ করে স্কুলে আসতেন তাঁর গর্জন শুনে পুকুর থেকে উঠতাম। পাঁচ ছ’ দিন পরে পরে পুকুরে নামবার আগেই. ধুতি কেচে শুকোতে দিতাম—তারপর সেই ধুতি পরতাম। জুতা বলে কোন জিনিষ গ্রামে ব্যবহারও হত না, আমাদের দরকারও হত না। প্রত্যেক হাটের বার বাবা আমাদের ছুটি করে পয়সা দিতেন। এক পয়সায় দশ গণ্ডা মানে চল্লিশটা মোয়া কিনতাম, আর এক পয়সায় বাতাসা, তাও প্রায় পঁচিশ ত্রিশটা। এই দিয়ে ভোর সকালবেলা হত আমাদের নাস্তা। আটমাস দশমাস পরে নতুন সার্ট বা ধুতি পেতাম। সেই নতুনের গন্ধ যাতে ফুরিয়ে না যায় সেজন্য কাপড় প্রথম পানিতে ভিজাতাম তা প্রায় পনের বিশ দিন পরে। বাবুগিরি কাকে বলে হাইস্কুলে না যাওয়া পর্যন্ত জানতাম না।

আগেই বলেছি, আমাদের বাড়ীর পূর্বে দিগন্ত মাঠ—তারপর বয়ে চলেছে কালজানি নদী। বর্ষায় চেয়ে চেয়ে দেখতাম তার অপরূপ শোভা। সারাটা মাঠ সবুজ ধানে ভরে উঠত। পূবালী বাতাসে সেই ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যেত। সাদা মেঘ নদীর পারে বৃষ্টির জাল বুনতে বুনতে আসত মাঠের মাঝখানে, পড়ত আমাদের বড় বড় টিনের ঘরে ঝমঝম ঝমঝম শব্দে। তখনকার দিনের বৃষ্টির কথা জীবনে ভুলতে পারব না। বৃষ্টি যখন আরম্ভ হত একমাস দেড়মাসের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য বিরাম হত না। অনেকের বাড়ীতে জ্বালানী কাঠ থাকত না। বর্ষার আগে তাই দশ পনের দিনের উপযোগী চিড়ামুড়ি তৈরী করে রাখত অনেকে। বৃ ষ্টতে ভিজতাম, বড় ভাল লাগত অহেতুক বৃষ্টিতে ভিজতে। কোন কোন বছর বৃষ্টিতে ভেজার জন্য হত সর্দি, জ্বর কখনো বা ম্যালেরিয়া। ছেলেরা দল বেঁধে বড়শী নিয়ে যেত মাঠের দিকে, আমারি নাকের ডগার উপর দিয়ে, শুয়ে শুয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করতাম জ্বরের উপর। তখনকার দিনের ম্যালেরিয়ার একমাত্র সুহৃদ ছিল “ডি, গুপ্তের টনিক।” মাকে বলতাম, “হোক ভেতো, বেশী করে ওষুধ দাও, জ্বরটা তাড়াতাড়ি মরে যাক। দেখনা সবাই কেমন মাছ ধরতে যাচ্ছে—আমি ক’দিন থাকব বিছানায় শুয়ে?” মা বলত, “পাগল ছেলে, এক সাথে এক দাগের বেশী ওষুধ খেলেই কি জ্বর পালিয়ে যায়? নিয়মমত খেতে হয়।”

বসন্তের কোকিল ডাকা প্রভাত-বেলায় কে আমায় ধরে রাখতে পেরেছে ঘরের মায়ায় বন্দী কবে? কত ভোরে উঠে একাই বেরিয়ে পড়তাম। দু’ধারে বিরাট বিরাট শিশু-গাছের অ্যাভিনিউ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড রাস্তার উপর দিয়ে প্রায়ই নদীর পাড় পর্যন্ত। অত ভোৱে কোকিল, বৌ কথা কও, ফটিক জল, ঘুঘুর ডাক—সারাটা গ্রামে যেন পাখীর ডাকের ঐকতান বেজে উঠত। গ্রামে জীবনে কেউ পাখী মারার জন্য বন্দুকের আওয়াজ কখনো শোনেনি। তাই গ্রামে বসতি বেঁধেছে নানা পাখীর দল নির্ভয়ে।

গরমের দিনে কাছারী ঘরের বারান্দার নীচে বেঞ্চ পেতে শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকতাম অনন্ত নীল আকাশের দিকে। এক এক সময় মনে হত মাথার উপর এই নীল আকাশটা কেন? ওটার উপরে যেখানে আর কিছুই নেই, অমন নীল রাজ্যও নেই, সেখানে যেতে পারব না কোনদিন? মন খুনিই ছিল কল্পনাপ্রবণ! ঘর থেকে দেখা যেত হিমালয় পাহাড়, আকাশের মতই নীল। মনে হত আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে আর একটা নীল আকাশ ঘুমিয়ে আছে। ঐ নীলের কি শেষ নেই? অসংখ্য চিল উড়ত মাথার উপর সেই মহাশূন্যে। ভাবতাম আমারও যদি অমনি পাখা হত, কি মজার হত! এই ছোট্ট গ্রামে আমাকে কেউ বেঁধে রাখতে পারত না—উড়তাম, উড়তাম, উড়তাম!

দিনের বেলা এমনি কতশত কল্পন। মনে জাগত। জ্যোৎস্না রাতেও মনে হত চাঁদের দেশে যাব, ঐ ছোট ছোট তারার দেশে যাব; কিন্তু আঁধার পক্ষ এলেই সব গুলিয়ে যেত অর্থাৎ যত কল্পনা সব ছুটি নিত মন থেকে। অতি শৈশব থেকে ভাবপ্রবণ ছিলাম আমি। বিছানায় শোয়ামাত্র আর সব ছেলে যেমন ঘুমিয়ে পড়ত আমার ঠিক তা হত না। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকটা যেন মনে হত রাত্রির গান। তাই সন্ধ্যা হলে খাইয়ে-দাইয়ে মা বিছানায় যেতে বললেই যে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম, তা নয়। চুপটি করে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, বড়রা যখন খেয়ে দেয়ে শোবে, আর কোনো রকম শব্দ হবে না কারুর, তখন শুনব ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান। ঐ গান সারা প্রাণ দিয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম।

শুধু কি তাই? ভোরবেলা বিশেষ করে শীতের রাতে অতি ভোরে গ্রামে যখন প্রথম মোরগটা ডেকে উঠত, সেই মোরগের ডাক থেকে এর ডাকে আর একটা তার ডাক শুনে বহু দূরের বাড়ীর আর একটা মোরগ ডেকে উঠত তখন মনে হত ঐ অত ভোরে এর। কে কাকে কি বলছে? মাকে জিজ্ঞেস করতাম’ “মা, মোরগগুলো কি বলে?” মা বলতেন, “সত্যকাল হোক।” এখন ভাবছি সত্যকাল তখনি ছিল—সে কালতো আর এখন নেই! অত ভোরে শীতের দূরগ্রামে শিঙা ফুঁকত কি করুণ মিষ্টি সুরে। “অত ভোরে ওঠে কেন ওরা, ওটা কি বাজায়?” মাকে জিজ্ঞেস করতাম। মা অনেক সময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, “আঃ ঘুমাও বাবা—এখনো অনেক রাত আছে। ওরা শিশু! বাজাচ্ছে, আজ হয়তো কোথাও বাহুইতে নদী মারবে।, এ কথার অর্থ বুঝতাম না। বয়স হলে বুঝেছি—ভোর বেল। ঐ শিঙ। ফুঁকালে বহু গ্রামের লোক একসাথে সেদিন কোন বিল বা নদীর ছাড়ায় দল বেঁধে মাছ মারবে। ভাওয়াইয়া গানের একটা লাইনে পাওয়া যায়—’ওরে বাহুইতে নদী মারে জোর শিঙা দিয়া রে।

তারপর ডেকে উঠত শিয়াল। এক শিয়াল ডেকে উঠল, ‘হুক্কা হুয়া। হুক্কা হুয়া’….অমনি কিছু দূরে আর একটা, তারপর মনে হত গ্রামে শুধু বুঝি শিয়ালই থাকে! আরম্ভ হল সব্বাই মিলে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া শেষে শুধু হুয়া হুয়া হুয়া। মনে হত সবাই মিলে যাত্রা গানের ছেলের দলের মত কোরাসে যেন গান ধরেছে।

শীতকাল চলে গেল। এলো ফাল্গুন মাস। ভোর বেলা ঘুম ভেঙে যায়। গ্রামে তো আর গাছ-গাছালির অভাব নেই। সেইসব গাছ থেকে ভোরে ডেকে ওঠে কী মষ্টি সুরে কোকিল, শ্যামা, দোয়েল আর পাপিয়া। সকাল হয়। বিছানা থেকে উঠে ভাইবোনদের কাছে কোকিলের সুর নকল করে বলে উঠতাম—কু-কু-কু!

আসে বোশেখ মাস। আকাশের উত্তরে মেঘ জমে— রাত আসে ভীষণ ঝড় থেমে যায়—আকাশে চাঁদ ওঠে। বাড়ীর উত্তরে কাঁঠাল গাছটার উপর দিয়ে একটা পাখী উড়ে যায়, গেয়ে যায় “বউ কথা কও, বউ কথা কও।” কী মিষ্টি সুর, বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠত! আছ। অমন মিষ্টি করে যদি আমি গাইতে পারতাম!!

জষ্টিমাসের কাঠফাটা রোদ্দুর। মা বলতেন, “খবরদার এই দুপুর রোদ্দুরে কোথাও বেরুবি নে, ঘরে শুয়ে থাক, ঘুমোও।” মট্‌কা মেরে ঘুমাবার ভাণ করে শুয়ে থাকি। পূর্বের ঘরের পাশে বড় আমগাছটায় ঘুঘু ডাকতে থাকে, ঘুঘু, ঘুটু-ঘুঘ, ঘুটু….মনটা যেন কেমন করে ওঠে, ও পাশে’ গোলাঘর, পায়রাগুলো গেয়ে উঠত বাক বাকুম্ কুম কুম্—বাক্‌ বাকুম কুম!!

জষ্টি মাসের শেষ, এই আষাঢ় মাসের প্রথমের দিকটায় আমাদের পুকুরের পানি বৃষ্টির পানিতে কামার কানায় ভর্তি না হলেও বেশ পানি থৈ-থৈ হয় আর কি! পুকুরের পাড়ের নীচু জমিগুলো পানিতে ডুবে যায়। পাশে বাঁশঝাড়। ভোরবেলা আম কুড়োতে যেতাম, পুকুরের পশ্চিম পাড়ে আম গাছতলায়। আম কুড়াব কি, পুকুরের পাড়ের নীচু জমি যা বৃষ্টির পানিতে ভর্তি হয়ে আছে, সেসব জায়গায় দেখি হলুদ গায়ে মেখে ইয়া বড়া বড়া ব্যাঙ একটা আর একটার পিঠে চড়ে কী মিষ্টি একটানা গান জুড়ে দিয়েছে, কী ঘ্যাকো কি ঘ্যাক, কী ঘ্যাকোঙা কি ঘ্যাক! ওরে আম কুড়াব কি, থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ওদের কাণ্ডকারখানা! একটা দুটো কি ব্যাঙ, রাশি রাশি হাজার হাজীর, শত শত, কত শত তখন কি ছাই গুণতে শিখেছি, মোটকথা মনে হচ্ছিল হুলুন গায়ে মেখে যেন হলদে পরীর বাচ্চারা আনন্দে গান গেয়ে চলেছে।

রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে যাব, আকাশ মেঘে ভর্তি, হয়ত বা বৃষ্টি আসবে, হঠাৎ কানে এল সেই ব্যাঙের ডাক, থামে না, কী মিষ্টিমধুর মনে হতে লাগল। একটানা সেই সুর, তার সাথে ঝি ঝি পোকার সুর, সেই সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম।

ছোট্টবেলা থেকে ঐ মোরগের ডাক, শিয়ালের ডাক, ঘুঘুর ডাক, পায়রার ডাক, ব্যাঙের ডাক, কোকিল, দোয়েল, বউ কথা কও, পাপিয়ার সুর শুনে শুনে আমার গলায় সুর বাসা বেঁধেছিল। এমন কি, স্কুলের যখন ঘণ্টা পড়ত, সেই ঘণ্টার শব্দের শেষ মুরটুকু—ঢং…এর….অং….টুকু গলায় তুলে নিতাম।

আমার শৈশবের সেই কল্পনা-প্রবণ মন আজ হাতড়ে দেখি কোথায় কবে বিদায় নিয়েছে। শত জঞ্জালে চিরকালের জন্যই হয়ত ও মনের চিরসমাপ্তি ঘটেছে। অথচ মনে হয় এই তো সেদিনকার কথা।

‘পাগারু’ নামে এক বুড়ো খুব ভাল দোতারা বাজিয়ে গান গাইত। প্রথম দোতারা বাজনা তার কাছে শুনি। গান গেয়ে যখন সেই সুরটা দোতারায় বাজাত মনে হত দোতারা নিজেই গেয়ে উঠল। গ্রামে কোন বাড়ীতে পাগারুর গান হলে বাড়ীতে ধরে রাখে কার সাধ্য? কুশান গান অর্থাৎ পালা গান প্রথম শুনি অতি ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের বন্দরে। ছোট ছোট ছেলেরা মেয়ের পোষাক পরে কি সুন্দর নাচে। তাদের নাচগান শুরু হত সন্ধ্যায়—অবিরাম তিন চার ঘণ্টা নেচে গেয়েও যেন পরিশ্রান্ত নয় কেউ! কত ছন্দ, কত তাল, কত হাসি, কত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় সে গানে! সেই কুশান গান গাওয়া হত খোল, করতাল আর বেণা নামক এক যন্ত্র সহযোগে। এই বেণা জিনিষটা অনেকটা বেহালার মত। তবে তাতে চারটা তার নেই। একগুচ্ছ ঘোড়ার লেজের চুল দিয়ে এই বেণা তৈরী। গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ছেলেদের ধরে গ্রামের এক ঘোড়াকে দড়ি বেঁধে লেজ কাটতে গিয়ে কি বিপদ। একটা ছেলে তো ঘোড়ার লাথি খেয়ে অজ্ঞান! গ্রামের লোক বহু কসরৎ করে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। যাক, ঘোড়ার লেজ কেটে জোগাড় করতে পেরেছি ‘বেণা’ তৈরীর সরঞ্জাম, মনে কি স্ফূতি! তারপর বেণা তৈরী করে বেণা বাজিয়ে যেদিন গান গাইতে শুরু করলাম সেদিন আরও কি আনন্দ! বাবা তো একদিন বলেই বসলেন, “তুই কি গান বাজনাই করবি, পড়াশুনা করবি নে?”

তুফানগঞ্জে

ফিফথ ক্লাসে উঠে কুচবিহার শহর থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে চলে আসি তুফানগঞ্জ স্কুলে। কোথায় কুচবিহার শহর, আর তুফানগঞ্জ একটা মহুকুমা মাত্র। গ্রামের মত। তুফানগঞ্জ আসার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলাম এর গ্রাম্য পরিবেশের জন্য। শহরে তে। কোথাও গলা ছেড়ে গান গাইতে পারিনা—তাই তুফানগঞ্জে আসার জন্য বাবার কাছে জেদ ধরলাম। তাঁরও কর্মস্থল এই তুফানগঞ্জ। তিনিও এখানকার আদালতে ওকালতি করতেন তাই হয়ত বা মত দিয়েছিলেন। এই স্কুলে এসে গান শুনবার সুযোগ পাই প্রথমে ওখানকার সরকারী ডাক্তার মোবারক হোসেন সাহেবের কাছে। তিনি বেশ রবীন্দ্র-সংগীত গাইতেন অর্গান সহযোগে। হোষ্টেল থেকে কাছেই ডাক্তারের কোয়ার্টার। রোজ যেতাম তাঁর কাছেই। তিনি গাইতেন, দু’বার শুনেই সুর. আয়ত্ব করে ফেলতাম।

ফিফথ্, ক্লাসে বাৎসরিক পরীক্ষার প্রথম স্থান অধিকার করলাম। ডাক্তার সাহেব স্কুল কমিটির মেম্বার। পুরস্কার বিতরণীর সময় তিনি প্রস্তাব করলেন, যে ছেলে সুন্দর গান গাইতে পারবে, তাকেও একটা পুরস্কার দেওয়া হবে, দশ টাকার বই দশ টাকার বই মানে তখনকার দিনে এক গাদা বই। স্কুলে গানের একটা প্রতিযোগিতা হল, আমাকেই সবাই প্রথম স্থান দিলেন। পুরস্কার বিতরণী সভার উদ্বোধনী সংগীত গাইলাম, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’ আর সমাপ্তি সংগীত গাইলাম, ‘সভা যখন ভাঙবে তখন শেষের গানটি যাব গেয়ে।’ সেবারের পুরস্কার বিতরণী সভাতে একটা নতুনত্বের সৃষ্টি করল এই গান। এর পর সেকেণ্ড ক্লাস পর্যন্ত সব পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েছি। পড়াশুনার জন্যে প্রথম পুরস্কার, “গুড কন্ট্রাক্টের” পুরস্কার, “বেষ্ট অ্যাটেনড্যান্সে’র পুরস্কার, “নেটিভ” পুরস্কার মানে কুচবিহারী অধিবাসীদের মধ্যে প্রথম পুরস্কার এবং সংগীতে প্রথম পুরস্কার…….. বার বার প্রথম পুরস্কারের জন্য আমার নাম ধরে ডাকত প্রধান শিক্ষক আর সভাপতি মশায় অবাক হয়ে ভাবতেন, এই ছোট্ট ছেলেটি বেশ তো, সব বিষয়েই ভাল! সেধে আলাপ করতে উৎসাহ দিতেন।

ছোট্ট শহর, আবালবৃদ্ধবণিতার কাছে আমি পরিচিত। এমন কোনো বাড়ী নেই যে বাড়ীর ভিতরে ছিল না আমার অবাধ গতিবিধি। তখনকার দিনে আমাদের ওদিকে অর্থাৎ কুচবিহারে একটা রেওয়াজ ছিল, স্কুলে মুসলমান ছেলেদের সেকেণ্ড ল্যাংগোয়েজ নিতে হত সংস্কৃত আর হিন্দু ছেলেদের নিতে হত ফারসী। তাই বি, এ, পর্যন্ত আমার সংস্কৃত ছিল এবং সংস্কৃতে আমি “কাব্যরত্নাকর” উপাধিও পেয়েছিলাম। হোষ্টেলে প্রত্যেক ঘরে দুজন হিন্দু ছেলে, দুজন মুসলমান ছেলেকে থাকতে হত। শুধু রান্নাঘর ছিল আলাদা। এইভাবে ছেলেবেলা থেকে পরস্পর দুটো জাতের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নিবিড় আত্মীয়তা! কুচবিহারে তাই আমি প্রতি ঘরে ঘরে আবাসদা’ বলে পরিচিত। ছাত্রদের মধ্যে আমরা সেবা-সমিতি গড়ে তুলেছিলাম। কারো বাড়ীতে কোন ছেলের জ্বর, টাইফয়েড, নিমোনিয়া হলে আমরা সেই সেবা-সমিতি থেকে পালা করে রাত্রে রোগীর শিয়রে বসে সেবা করতাম। অভিভাবকদের রাত জাগতে দিতাম না। সেই জন্য এই সেবা-সমিতির মেম্বারদের শহরের সবাই ভালবাসতেন। আমার বিশেষ খাতির ছিল, রোগীকে গান শোনাতাম, রোগীর মন ভাল থাকত, ভাল হয়ে উঠে সে রোগী আমাকে বিশেষ উপহার দিত হয়ত দু’চারটে বেদানা, এক থোকা আঙুর বা দশবিশটা কমলালেবু। তাকেও সামনে বসিয়ে আরো দু’চারজন বন্ধু-বান্ধবকে ডেকে তখনি সেগুলো সাবাড় করে ফেলতাম।

তুফানগঞ্জে অতি ছোটবেলায় আমাদের স্কুলে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন কিভাবে গড়ে উঠবে এ নিয়ে সতর্ক প্রহরীর মত আমাদের উপর কঠোর দৃষ্টি রাখতেন আমাদের স্কুলের হেডমাষ্টার গোপাল চক্রবর্তী। তাঁকে হেডমাষ্টার বলে “ম্বোধন করার উপায় ছিল না। স্কুলের সমস্ত ছাত্রই তাঁকে ডাকতাম বড়দা’ বলে। জীবনে তিমি কোন ছেলেকে বেত মারেন নি। পড়া না পারলে কোনদিনই বকতেন না। হেসে কথা বলতেন সব সময়। তাঁর রাগ বুঝতে পারতাম তখনই, যখন দেখতাম কথা বেশী বলেন না—বেশ গম্ভীর।

ম্যাট্রিক টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেলেই যার। এ্যালাউড হত তাদের তিনি নিয়ে আসতেন তাঁর বাসায়। সেখানে সন্ধ্যা থেকে রাত একটা দু’টা পর্যন্ত রোজ নিতেন কোচিং ক্লাশ। প্রতি বছর তাই এ্যালাউড হওয়া ছাত্র একটিও ফেল করত না। আমরা ছিলাম সপ্তরথী, মানে সাতজন এ্যালাউড ছেলে। সন্ধ্যাবেলা হোষ্টেল থেকে খেয়ে আসতাম তাঁর বাসায়। হোস্টেল থেকে অল্প দূরে তাঁর বাসা ছিল। রাত দশটা এগারোটায় বেশ ক্ষিদে লাগত। মুখে বলতাম না, কিন্তু দু’চারদিন যেতে না যেতে তিনি কি করে বুঝতে পারলেন। হঠাৎ একদিন বললেন, “হোষ্টেলের খাওয়া বন্ধ করে দিও—সন্ধ্যার সময় ভাত খেলে তো ঘুম পায়। পড়াশুনা করে এখানেই খাবে।” আর সত্যি, তিন তিনটা মাস রোজ রাতে ওর ওখানেই আমাকে খেতে হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী কি আদর করেই না আমাকে খাওয়াতেন। বড়দা’র এক ভাই তখন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক। তিনিও সে সময় বাড়ীতে এসেছেন। আমি অংকে একটু কাঁচা ছিলাম। অংকের ভার নিলেন তিনি তিনি। ছোড়দা বলে ডাকতাম। তিনি বলতেন “অংকটা তো আর গানের মত মজার জিনিষ নয়। তবে শোন কি মজার জিনিষ—এই এখানে রইল একটা সেতার, এখানে একটা এস্রাজ আর এই একটা বেহালা, এমনি করে তিনটি সাজিয়ে রাখলাম। কি হল? ঠিক তোমার জ্যামিতির ত্রিভুজের মত হল না? এখন দেখ এর একটা কোণ……..” ইত্যাদি। এমন মজার গল্পের ভিতর দিয়ে জ্যামিতি বুঝিয়ে দিলেন যে সত্যি কথা বলতে কি জ্যামিতির একটাও আমার ভুল হয়নি পরীক্ষায়।

তুফানগঞ্জে প্রতি বৎসর দোলের সময় বসত একটা মেলা পনের দিন ধরে। ভাল ভাল যাত্রা আসত সে মেলায়। পনের দিন আর বইপুখির সাথে কোনো। সম্বন্ধ থাকত না। যাত্রাগানের আসরে প্রথম স্থান দখল করবার জন্য সাজগোজ করে থাকাটা হত তখনকার দৈনন্দিন কর্মসূচীর প্রথম কাজ।

যাত্রার দলের মধ্যে সব চাইতে বেশী আকৃষ্ট করে আমাকে মুকুন্দ দাসের যাত্রা। যাত্রা তে। নয়, মহু। সমাজ-সংস্কারক অনুষ্ঠান। গানের ভিতন দিয়ে জমিদারের অত্যাচার, হিন্দুর বিয়ের প্রথার ভয়াবহতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বক্তৃতা ও গান আমার ঐ ছোট্টবেলার ছোট্ট বুকে তুলেছিল এক বিরাট আলোড়ন।

দলের লোকের নেই রাজার পোষাক, নেই ছেলেদের মন-ভুলানো পোষাকের চাকচিক্য। সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবী আর ধুতি পরে গান। এ যেন এক নবচেতনার উন্মেষ। তখন আরম্ভ হয়েছে স্বদেশী যুগের গোড়াপত্তন, খদ্দরের কথা শুনতাম, কিন্তু মুকুন্দ দাসের গান শুনতে গিয়ে জীবনে প্রথম দেখলাম খদ্দরের পোষাক। কুচবিহারে সে ঢেউ তো দোলা দিতে পারে না, কারণ কমদ-মিত্র রাজ্যে রাজাই সর্বস্ব, সৰ্বপ্ৰধান। সেখানে বাংলা সরকারের মত আইন নয়। কাজেই খদ্দরের পোষাক সে রাজ্যে প্রবেশ করতে পারেনি। নানাদিকে তবু তখন আলোচনা চলছে যে বাংলা দেশে স্বদেশী যুগের নতুন সুর উঠেছে।

কুচবিহারে তার ঢেউ এল নীরব চরণ ফেলে। দু’একটি ছেলে কলকাতা ফেরৎ তারা আমাকে বললে, “আরে শোন, কী মজার গান

কলকাতায় শুনে এলাম, খুব গায় এ গান। কোথায় লাগে ভোর রবি ঠাকুরের গান!” বললাম, “গা দেখি।” সে ছেলে হয়ত গাইল :

“যায় যাবে জীবন চলে
শুধু দেশের কাজে মায়ের ডাকে
বন্দেমাতরম বলে।“

ভাল লাগল না। বললাম, “আর একটা গা দেখি শুনি।” তখনই সে খুদীরামের ফাঁসির ইতিহাসটা আগে বলল। তারপর গাইল কেঁদে কেঁদে :

“একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।”

এ গানে সত্যি আমার কান্না এল। কিন্তু গানটা শোনা পর্যন্তই, শিখলাম না, কারণ এ সব গান গাওয়। শুনেছি অপরাধ। কী দরকার বাবা, গান গাইলে যদি দোষ হয়, অমন দোষের গান নাই বা গাইলাম।

কিন্তু একটা কথা মনে জাগল, এ গান দিয়ে দেশের জনসাধারণকে অপূর্ব প্রেরণার উদ্বুদ্ধ করতে পারা যায়। আরো। মনে হত যদি গায়ক হতে পারি তা হলে আমার সেই গানের সুর মানুষের হৃদয় স্পর্শ করবে আর সেই সুরের রেশ যখন সারা জগতে ছড়িয়ে যাবে তখন আমার মনের প্রতিধ্বনি প্রতি স্তরের প্রতি মানুষের ভিতর খুঁজে পাব আমি এবং সেই-ই হবে আমার শিল্পী জীবনের সব চাইতে বড় সার্থকতা।

তুফানগঞ্জে ছেলেবেলায় পড়বার সময় একটি হিন্দু পরিবারের সাথে কতটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল, সেটা না বললে জীবনের একটা অধ্যায় অলিখিত থাকবে, তাই বলছি। আমি তখন ফোর্থ ক্লাশে।

নতুন এক দারোগা এলেন থানায়, নাম রাধাশ্যাম চক্রবর্তী। গোলাপের মত দশ বছরের একটি, সাত বছরের একটি—এই দু’টি ছেলেকে নিয়ে তিনি স্কুলে গেলেন। অমন মনভোলানো দুটি শিশু দেখে সেধে গিয়ে আলাপ করলাম। কি মিষ্টি কলকাতার ভাষায় কথা বললে। একজনের নাম সুশীল আর একটির নাম অনিল। বিকালে ওদের বাসায় গেলাম। শুর বাবা বললেন, “কি চাই খোকা?” আমি বললাম, “আজ যে ছুটি ছেলেকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ওদের সাথে আলাপ করতে চাই।” তিনি বললেন, “তুমি কোন ক্লাশে পড়? ক্লাশে পরীক্ষায় ফাষ্ট হও!” আমি বললাম, “হ্যাঁ, প্রত্যেক বছর আমি ফাষ্ট হই।” তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠল। আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবা মা আছেন? তোমার বাবা কি করেন?” আমি বললাম, “হ্যা, বাবা মা আছেন। বাবা ওকালতি করতেন, এখন একরকম ছেড়ে দিয়েছেন, বাড়ীতে জমাজমি দেখাশোনা করেন।” তিনি বললেন, “বেশ বেশ। ওরে সুশীল এদিকে আয়, দেখ তোদের এক দাদা এসেছে।” তারপর তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন, “দেখ দেখ, কি সুন্দর ছেলে, ক্লাশে ফাষ্ট হয়, ওর বাবা! উকিল, তা তোমার নামটি তো জানা হয়নি বাবা। কি নাম তোমার?” বললাম। ভিনি বললেন, “তাতে কি হয়েছে? দেখ দেখ, কে বললে এ মুসলমানের ছেলে? আমাদের বামুনের ছেলে মনে হয় নাকি? “ ( বলে রাখি তখনকার দিনে ভাল চেহারার মুসলমানকে দেখলে হিন্দুরা ঐভাবেই বলতেন)। দারোগাবাবুর স্ত্রী একদম আমার সামনে এসে আমাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “তুমি আমাকে মা বলে ডাকবে কেমন? আর আমার খোকা খুকীরা তোমাকে দাদা বলে ডাকবে। তুমি যখন ভাল বংশের ছেলে, ক্লাশে পড়াশুনায় ভাল, তুমি বাবা আমার ছেলেপেলেদেরও ঠিক ছোট ভাইবোন মনে করে এদের খারাপ ছেলেপেলের সাথে মিশতে দিও না। আর তুমি রোজ কিন্তু স্কুল ছুটির পর এখানে এসে জলখাবার খেয়ে যাবে, কেমন।” আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “আচ্ছা।” তিনি বললেন, “না শুধু আচ্ছা নয়, বল আচ্ছা মা।” বললাম “আচ্ছা মা।” আমাকে একদম বুকে জড়িয়ে ধরে মায়ের মতই চুমু দিয়ে স্নেহাভিষিক্ত করলেন।

প্রায় রোজই তাদের বাসায় আসতে লাগলাম। দারোগাবাবুর বাড়ী রাজশাহী, কিন্তু ছেলেদের মামার বাড়ী কলকাতায় অর্থাৎ আমার এই নতুন মা কলকাতার। আমার কথায় কুচবিহারী ভাষাই মিশানো ছিল। এঁদের সাহচর্যে এসে আমার কথ্য ভাষায় এল পরিবর্তন। কলকাতা থেকে মা নিয়ে এসেছেন ছেলেদের উপযোগী খুব ভাল ভাল বই। ‘আমাকে দু’ তিন দিন পরে পরেই সেই সব বই পড়তে দিতেন। এরপর আমার বাবা একদিন তুফানগঞ্জে এলেন। বাবাকে দারোগাবাবু তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ করে খুব খাওয়ালেন। খাওয়ার শেষে তিনি বললেন, “আপনার খোকাকে বিন্তু আমার ছেলের সামিল করে নিয়েছি।” বাবাও বললেন, “বেশতে। আমার খোকার অভিভাবক হয়েছেন—নিশ্চিন্ত হলাম।”

এরপর আর বাসায় গেলে শুধু জলযোগ নয়, কোনো কোনো দিন ভাত পর্যন্ত খেতে হত। আর এই ব্রাহ্মণ পরিবারে আমার জন্য রইল না আলাদা গ্লাশ, থালা-বাসন! আমিও এদের আপন ভাইবোন ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।

এক বছর স্কুলে পড়ার পর সুশীলকে ওর মামা নিয়ে গেলেন কলকাতায়। সেখানকার স্কুলে পড়বে, হাজার হলেও এটা মফঃস্বল। সুশীল যেদিন চলে যায় এখনও পরিস্কার মনে পড়ে ওর অদর্শনে পাঁচ ছ’দিন শুধু কেঁদেছিলাম। মা এত করে বুকের কাছে টেনে এনে এটা ওটা খাওয়ার জন্য সাধতেন আর আমি শুধু কেঁদে বুক ভাসাতাম। বলতাম, “ওযে আমার কতখানি বুক জুড়ে বসে আছে তোমরা কি বুঝবে বল? মায়ের চোখেও আসত পানি। ওর বাবা শুধু হাসতেন আর হয়তো ভাবতেন আমার নতুন ছেলের ভায়ের প্রতি কী টান! দিন যায় কিন্তু রোজই বাসায় গিয়ে সুশীলের গল্পই করি। মা একদিন বললেন, “আচ্ছা বাবা এগুলে। ভাইবোনকে তুই ভালবাসিস না? সুশীল আছে ওখানে কলকাতায় বড় স্কুলে, কত পড়াশুনা শিখবে, এতো তোরি আনন্দের কথা! ছোট ভাই ওখানে ভাল করে লেখাপড়া করে খুব বিদ্বান হবে, বড়লোক হবে, এতো আনন্দ করবার কথা! তা নয় খালি ওর নাম করে কান্নাকাটি!” সেদিন থেকে সত্যি সত্যিই মন থেকে মুছে ফেললাম যত বাজে দুঃখ। ওদের শেখাতে লাগলাম আমার মত কবিতা লেখা। সুশীল, অমিল এদের হু’ভায়ের হাতের লেখা আজও আমার লেখার এত কাছাকাছি যে অমিল খুঁজে বার করা ভারী কঠিন।

আমি কুচবিহার কলেজে তখন আই, এ, পড়ি। এর মধ্যে দারোগাবাবু কুচবিহারের বহু সাব-ডিভিশনে কাজ করে সদরে বদলী হয়ে এসেছেন। এর মধ্যে ছুটি বোনের বিয়ে হয়েছে। অনিল ম্যাট্রিক দেবে। কুচবিহারে দু’জন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর পদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। কি খেয়াল হল, দরখাস্ত করলাম। তখন কুচবিহারের পুলিশ সুপার ছিলেন মিঃ লেন্সী। ইন্টারভিউয়ের আমন্ত্রণ পেলাম। লেলী সাহেব আমার ইন্টারভিউয়ে খুশী হয়ে একেবারে সংগে সংগে নিয়োগপত্র দিয়ে দিলেন। মহানন্দে হোস্টেলে এলে বন্ধুবান্ধবদের কাছে সগৌরবে চাকুরী প্রাপ্তির কথা ঘোষণা। করলাম। তখনকার দিনে দারোগাগিরী মহা লোভনীয় পদ। কাজেই আনন্দটা রাজ্যজয়ের চাইতে নেহাৎ কম ছিল না। দিন পাঁচেকের মধ্যেই কাজে যোগদান করতে হবে।

সুশালের বাবা বাইরে মফঃস্বলে গিয়েছিলেন। মফঃস্বল থেকে ফিরে এসে অফিসে গিয়ে শুনেছেন আমার চাকুরী হয়েছে। এখবর শুনেই তিনি খোদ পুলিশ সুপারের কাছে হাজির। সাহেবকে বললেন, “শুনলাম, আপনি নাকি আব্বাসকে সাব ইন্সপেক্টর নিয়োগ করেছেন?”

সাহেব হেসে বললেন, “হ্যা, এরকম চৌকস লোকই আমাদের দরকার।”

—”কিন্তু আপনাকে এই নিয়োগপত্র নাকচ করতে হবে।”

সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “কেন?”

সুশীলের বাবা বললেন, “দেখুন, আমার ছেলেকে আমি পুলিশের চাকুরী করতে দিতে পারি না।”

সাহেব আরও অবাক হয়ে বলেন, “তার মানে?”

তিনি বললেন, “মানে, আব্বাসউদ্দীন, আমার ছেলে, তার পুলিশের চাকুরী করা চলবে না।”

সাহেব চক্ষু চড়কগাছ করে বললেন, “কি বললে? তুমি হলে বামুন চক্রবর্তী আর সে হল মুসলমানের ছেলে আহমদ।”

তিনি বললেন, “দ্যাখে। সাহেব, ছোটবেলা থেকে ও ছেলেকে আমরা নিজের ছেলের মতই জানি, কাজেই নিজের ছেলেকে আর দারোগা- গিরীতে নয়।”

আমার চাকুরী করা ফুরিয়ে গেল, এ খবর যখন পেলাম ভয়ে ভয়ে বহুদিন আর বাসায় যাইনি। খবরটা যখন আমার বাড়ীতে বাবার কানে গিয়েছিল; বাবা ওঁকে চিঠি লিখেছিলেন, “আপনি সত্যি মহানুভব। ছেলেকে যে এভাবে দারোগাগিরীর মোহ থেকে বাঁচিয়েছেন এজন্য ধন্যবাদ।”

আমার প্রথম প্রেম

বয়স যখন সতের কি আঠার বছর, তখন প্রেম এসেছিল জীবনে, নীরব চরণ ফেলে।

তুফানগঞ্জে নদীর পারে রোজই বিকালে বেড়াতে যেতাম, যখন নদীর পার জনশূনা হত, গলা ছেড়ে গান গাইতাম’। সন্ধ্যার ঠিক আগে হোস্টেলে ফিরছিলাম। বাগানে দাঁড়িয়ে একটি বারো বছরের অনিন্দ্য-সুন্দরী কিশোরী। চোখ পড়ল তার চোখে! স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেও তাকিয়ে আছে, আমিও তাকিয়ে আছি। মুখে কারুর ভাষা নেই। অনেকক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর অকস্মাৎ বলে উঠলাম, “একটা ফুল দেবে?” বালিকার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার মুখের হাসি ফুলের হাসির চেয়েও মনে হল সুন্দর, নিষ্পাপ। এক পা, ভূ’পা করে হাতে একটি গোলাপ নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল কাছে এসে হেসে হেসে বললে, “ফুল খুব ভালবাস?“

আমি বললাম, “যে ফুল দেয় তাকেও।”

ফুলটা আমার হাতে দিয়েই চঞ্চলা হরিণীর মত ছুটে পালিয়ে গেল বাগান থেকে বাড়ীর ভিতর। যাওয়ার পথে যেন ছড়িয়ে গেল হাজার ফুলের পাঁপড়ি।

সারাটা সন্ধ্যা বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে উকি মারতে লাগল সেই চপল মেয়ের মিষ্টি হাসিটুকু।

কেমন এক মধুর আবেশে সারাটা রাত কাটল। পরদিন স্কুল ছুটির পর চললাম আবার নদী তীরে। সেদিনও সেই আগের পুনরাভিনয়। আমি বললাম, ‘তুমি কী পড়?”

সে বললে, “বাড়ীতেই পড়ি, তা’ অনেক বই, এবার মাইনর পরীক্ষা দেব।”

বললাম, “এমনি সময় রোজ আসবে?”

সে বললে, “রোজ আসব, কিন্তু সাবধান, বেশীক্ষণ থেক না ওভাবে হাবার মত দাঁড়িয়ে, বাবার যে এ সময় অফিস থেকে ফেরার সময়। বাবা ভীষণ কড়া লোক, জান না?

“কড়া লোক, কড়া লোক মানে?”

“কড়া লোক মানে তুমি যে ঐ নদীর পারে গান গাও, বাবা যদি জানতে পারে তবে আর এ রাস্তা দিয়ে পথ-চলা তোমার বন্ধ হবে।”

“আামি যে গান গাই কী করে বুঝলে?”

“বারে তোমার গান শুনবার জন্যই তো এখানে দাঁড়িয়ে থাকি।”

“ও দুষ্ট, মেয়ে, চুরি করে তুমি আমার গান শোনো।”

সে হেসে বললে, “যা হবার হয়েছে, আর তোমার গান শুনবার জন্য দাঁড়াব না এসে” এই বলে সে নিমেষে ছুটে গেল চোখের আড়াল হয়ে।

পরদিন, তারপর দিন, আবার পরের দিন, এমনি করে বুঝতে পাচ্ছি, ওর অদর্শন আমাকে যেন অধীর করে তুলছে। যেদিন ওর দেখা পাইনা সে রাতটা যে কী বিশ্রীভাবে কাটে, কেন যেন বুক ছাপিয়ে আসে কান্না। মনে হত মেয়েটি আমার পাশে শুধু বসে থাক আর আমি সারাদিন শুধু পড়ব। ওর দিকে তাকাবও না।

ধীরে ধীরে ওর বাড়ীতে গিয়ে পরিচয়ের সূত্র মেলে দিলাম। ভালো ছাত্র বলে আমার খ্যাতি। কাজেই তার কঠিন কঠোর বাবা আমাকে ভালোভাবেই গ্রহণ করলেন। গান গাওয়াটা তিনি সত্যিই পছন্দ করতেন না, তবে প্রতি জুম্মার নামাজ পড়তে যেতাম বলে বোধ হয় মনে মনে গান-গাওয়ার সামান্য অপরাধটা তিনি ক্ষমাই করেছিলেন, তাই বাড়ীতে তাঁর পাঠরত ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি, “হ্যা তোমরা হবে এর মত, কী সুন্দর পড়াশুনায় ফার্স্ট হয়, আবার নামাজ-বন্দেগীতেও ঠিক হাজির।”

আসে সারা প্রকৃতিতে আগুন ছড়িয়ে ফাগুন মাস। শুরু হয় দোলের মেলা। সন্ধ্যা হয়েছে। সেই দোলের মেলায় সওদাগরের দোকানে দেখি সেই মেয়ে বসে আছে তার বাবার সাথে। এটা ওটা কী যেন কিনছে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। অকস্মাৎ মেলার লোকজনের ছুটোছুটি—কী, কী, ব্যাপার কী? কার যেন বাড়ীতে আগুন লেগেছে, লোকজন সেইদিকে ছুটছে।

ওর বাবা আমাকে দেখতে পেয়ে ইশারায় তাঁর কাছে ডাকলেন। কাছে গেলাম। ব্যস্তভাবে বললেন, “তুমি বাবা একে বাসায় নিয়ে যাও, আমি আগুন নেবাতে চললাম। কারো বাড়ীতে আগুন লাগলে যেতেই হয়।

আমার কল্পলোকের ছোট্ট রাণীকে নিয়ে আগেই চললাম এক মিষ্টি দোকানে। বললাম, “কী খাবে?” হেসে বললে, “দোকানে বসে কিছুতেই খেতে পারব না……..তার চেয়ে চল নদীর পারে খানিকটা বেড়াই, তারপর আমাকে বাসায় দিয়ে আসবে!”

তাই চললাম। ফাগুন মাসের পূর্ণিমা। নদীর পানিতে পড়েছে চাঁদের হাসি, এক চাঁদ শত চাঁদ হয়ে হাসছে ছোট ছোট ঢেউয়ের বুকে। নদীর ওপারে কুল বন! নির্জন নদীতীরে আমরা দু’জন একা একা। মনে হতে লাগল আজ প্রাণ ভরে কত কথা বলব। ওর একখানা হাত ধরে বললাম, “দুষ্টু মেয়ে, বাড়ী এলে আমায় দেখে পালিয়ে যাও কেন? তোমাদের বাসায় এত আসি কেন, জান!“

তখন সে নিরুত্তর! দেখছি তার চোখ থেকে নিশঃব্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। একটু ভড়কে গেলাম। কান্নার এতে কী আছে। কী এমন বললাম। ভয়ানক অভিমানী মেয়ে তো!

শুধু বললে, “কই তুমি তো রোজ আসনা, সেই কবে একদিন এসেছিলে, তারপর তো আর দেখা নেই।”

হেসে ফেললাম। “ও……..তাহলে খুব ঘন ঘন আসতে বল তোমাদের বাসায়, কেমন? কিন্তু কি জান, আমার হয়েছে বিপদ…. তোমার যে সেই ভাই দু’টো কেমন যেন ভাব দেখায় আমার সাথে, তারা বোধ হয় আমার আসাটা ঠিক পছন্দ করে না।“

সে বললে, “কেন তোমার তাতে কি? জান, তুমি যেদিন আসনা সে রাত আর ঘুমুতে পারি না। আচ্ছা বলতো এ আমার কী হল?”

আমিও ঠিক ওই কথাই বললাম, “তুমি বলতে পার আমারো এ হল কী? মন তো বলে রোজই আসি—–।”

সে বললে, “দেখ, তুমি যাই বল না কেন রোজ ঠিক সন্ধ্যার আজানের সময় বাগানের ওই ধারটায় একবার এসে দাঁড়াবে, তোমাকে একটিবার শুধু দেখে যাব—কেমন?”

আমি বললাম, “ঠিক, ঠিক, ঠিক, এর আর নড়চড় হবে না। কিন্তু বলতে পার, এমনি করে তোমার সাথে প্রাণ খুলে কথা বলবার সুযোগ আর জীবনে ক’দিন আসবে?

কী আশ্চর্য, কি অদ্ভুত উত্তর-ই না দিলে এ কথার! বললে, “কথা বলার চাইতে তোমার ওই মুখের দিকে চেয়ে থাকতেই যে আমার ভালো লাগে।”

দু’টি হৃদয় যখন পূর্ণ—কথা তখন নির্বাক।

অনেকক্ষণ পরে আমি বললাম, “আচ্ছা একটা কথা। নাঃ থাক সেই মিষ্টি হাসি হেসে সে বললে, “কী, থেমে গেলে কেন বল? আচ্ছা, আমিই বলি। বলি যে তুমি পড়াশুনায় তো ভালে। ছেলে, তা এমন দুষ্ট, ছেলে হয়ে গেলে আর পড়বে কখন?”

এবার অকস্মাৎ আমার কান্না এল। কান্নার বেগ থেমে গেলে ধরা গলায় বললাম, “জানিনা তোমাকে ছাড়া আমি আর জীবনের কূলে পাড়ি জমাতে পারব কি না।”

এবার সে হেসে উঠল। এতটুকু একরত্তি বারো বছরের মেয়ে বলে উঠল কিনা, বড় জিনিষ লাভ করতে হলে বড় ত্যাগ আর সাধনা চাই।” কে জানে সে রাতের সেই কথা আমার জীবনে মহাসত্যাদর্শ হয়ে দেখা দেবে।

এর পর…ওর কথা মত ঠিক সাঁঝের আঁধারে ওদের বাগান বাড়ীর উত্তর পাশে যেদিকে লোকচলাচল নেই সেখানে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়াতাম আর সে চুপি চুপি পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার একটা হাত ধরে আবেশে বিহ্বল হয়ে যেত, আর হাতে একটি ফুল দিয়ে বলত, “আচ্ছা যাও, অনেকরাত পর্যন্ত পড়, আমার গোলাপটা —।”

“তা আর বলতে হবে না”— প্রতি সন্ধ্যার গোলাপই হত আমার রাতজাগার সাথী! পড়াশুনা শেষ করে সেই গোলাপের সাথে শুরু করতাম কত না প্রলাপ।

এরপর শুরু হল পত্র-বিনিময়!! বাড়ী ওদের ঠিকই যাই, কিন্তু কথা তো আর অত হয় না! দুটো চারটে ছিন্ন কথার টুকরো এধারে ওধারে ফেলে দেওয়া। তাই কথার মালা গেঁথে চললাম, রাত জেগে চিঠির মাধ্যমে।

প্রাণে প্রেমের জোয়ার এলে বিশ্ব হয় মধুময়, আকাশের চাঁদ আসে মাটীতে নেমে, প্রিয়ার মুখ হয় তখন চাঁদের চেয়েও সুন্দর। নদীর কুলুকুলু-তান তখন মিলনের উলুধ্বনি হয়ে ওঠে। কোকিলের গান মিলনের আগমনী শোনায়।

এমনি কোকিল-ডাকা এক রাতে কি যেন একটা কাজে ওদের বাড়ীতে গিয়েছি, তখন আমি ফার্স্ট ক্লাশে পড়ি, বাসায় গিয়ে এক চাকরের কাছে শুনলাম বাড়ীশুদ্ধ সবাই গেছে কার বাড়ীতে দাওয়াত খেতে। চাকরটা বললে বাসায় শুধু আছে ‘সে’ এবং এক বুড়ী দাদী।

তাকে বললাম, “চুপটি করে ওকে বলতো আমার কথা।”

বাইরে এলো। বললাম, “কি ব্যাপার? তুমি যাওনি যে বড়?” বললে, “তুমি একটুখানিক দাঁড়াও আমি আসছি।” মিনিট দুয়েকের ভেতরই আবার এল, বললে, “চাকরটাকে দাদীর ঘরে দিয়ে এলাম। বলে এলাম আমি পাশের ঘরে বসে পড়ব, আমাকে ডেকো না।” তারপর এমন এক জায়গায় গিয়ে বসলাম যেখানে থেকে বাড়ীর চাকরের আসা আর বাইরের দিকে লোক আসা যাওয়া সবই লক্ষ্য করা চলে।

সে বললে, “আচ্ছা, এবার তোমার ম্যাট্রিক দেবার বছর। এরপর? অর্থাৎ ম্যাট্রিক পাশের পর?”

আমি বললাম, ‘ম্যাট্রিক পাশের পর বিয়ে দেব। তারপর আই, এ, তারপর ইংরাজী বি, এ, তারপর দেখা যাবে।”

“ও, তাহলে ম্যাট্রিক পাশ করেই বিয়ে দিচ্ছ? আর ওদিকে যে, মানে বুঝতেই পারছ!”

আমি বললাম, “কী, ব্যাপার কি?”

সে বললে,”দেখ একতরফা কিছুই হয়না, আমি এমন কেঁদে কেঁদে।”

বলেই সে কী কান্না! কান্নার বেগ প্রশমিত হলে বললে, “যাও তুমি আর এসো না, এ বাড়ী এলে অপমানিত হবে।”

“বল লক্ষ্মীটী, কি ব্যাপার বল!” চুপ করে রইল সে, কিছুই বলতে পারছে না, শুধু থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস পড়ছে

আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, “তবে কি আমার চিঠিপত্র….কেউ….।”

জানই তে। আমার ভাইদুটো কী হিংসুটে! আরম্ভ হয় যেন সি আই ডি’র চোর ধরার মত সেই আমার এক ভাইয়ের চোখে আর ধূলো

বললে, ‘ঠিকই ধরেছ! তুমি বাসায় এলেই ওদের এদিক-ওদিক সতর্ক দৃষ্টি। দিতে পারলাম না। তোমার চিঠিগুলো তো সাধারণতঃ আমি অতি তিনদিন আগে তোমার চিঠি পড়ছিলাম, গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি। আমার সেই ভাইটি একদম দরজা খুলে সামনে উপস্থিত। হাত থেকে চিঠি নিয়ে পড়ে ফেলে বললে, “হ্যা আমি বহুদিন থেকে টের পেয়েছি। আচ্ছা এবার যদি ও আসে তবে ওরই একদিন কি আমারই একদিন।” চিঠিখানা এখনো ওর কবলে। বহু সাধ্যসাধনা করেছি, দেয়নি….এখনো বাবা কিছুই বলে নি। কিন্তু আমার ভয় হয় তোমাকে কখন কি করে বসে, কাজেই কাজ নেই তোমার আর এখানে এসে নিজের জীবনকে বিপদাপন্ন করার। জানি আমি, আমাকে না দেখে তোমার—”।

আর বলতে পারল না সে। দুজনের চোখের জলে বুঝি বিশ্ব ভেসে যায়। বুকে উঠেছে দু’জনারি সাত সাগরের ঝড়

ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। তুফানগঞ্জ থেকে এসেছি গ্রামের বাড়ীতে। আমার এই ভালোবাসার কাহিনী বন্ধুবান্ধব মহলে এক আধটু যে ছড়িয়ে পড়েনি, তা নয়। অবস্থাটা তখন আমার দিক থেকে যেমন উগ্র, অপর দিক থেকেও ঠিক ততখানি। আমি খাওয়াদাওয়া একরকম ছেড়েছি। বাড়ীতে মা বললে, “কি বাবা, কি হল তোর, শরীর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, খাস ন! কেন?” মাকে একদিন সব বললাম। বলতে বলতে কেঁদেই ফেললাম। মা বললেন, “বেশ তো বাবা, তোর বাবাকে বলব তোর বিয়ের কথা।”

বাবা শুনে রাগ করেননি, তবে খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি আমার ভগ্নীপতিকে ডেকে বলে দিলেন, “দেখ বাবা, ছেলে আমার সেখানে বিয়ে করলে সুখী হয়, নিশ্চয়ই সেখানে বিয়ে দেব। কিন্তু কথাটা হচ্ছে এই বড় আশা ছিল ওর উপর। সে বি, এ, পাশ করবে, ব্যারিষ্টার হবে। এই অল্পবয়সে বিয়ে করলে সে সব আশা আমার চুর্ণ হয়ে যাবে। যাক, যখন গোঁ ধরেছে তুমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাও।”

ওদিকে মেয়ের বাপকে ওর ভাই আমার সেই চিঠি দেখিয়েছে এর ভিতরই চিঠিতে অবশ্য চিরশাশ্বত প্রেমের কথাই। তার বাপ পড়েছেন জানতে পারলাম, মনে মনে খুশীই হয়েছেন, কারণ মনে মনে নাকি তিনি এমনিই একটা সেতু রচনা করেছিলেন। এটা জানতে পারলাম আমার ভগ্নীপতি যখন খবর নিয়ে এসে বাবাকে বললেন, “হ্যাঁ, এ আমার প্রস্তাব তাঁরা সানন্দে গ্রহণ করেছেন। এখন দিনক্ষণ ঠিক করে দেওয়া, দেনা পাওনা ইত্যাদি।”

আমার মা ভাই-বোনেরা সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। আমি খবরটা শুনে কেমন যেন ঝিম ধরে রইলাম।

মনে পড়ে বৈশাখ মাস। রাতে এসেছিল সারা দুনিয়া কাঁপিয়ে কালবোশেখীর ঝড়! ঘণ্টাখানেক ছিল সে ঝড়ের বেগ। ঝড় থেমে গেছে। প্রকৃতি শান্ত। গ্রাম ঘুমে অচেতন। আমি আমার ঘর ছেড়ে বাইরে এলাম। পূবের দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠে আকাশের চাঁদ ফেলেছে তার মায়াময় স্নিগ্ধ কিরণ! তাকিয়ে রইলাম পূর্ব দিকে। পূর্ব দিকেই আমার প্রিয়ার দেশ। কত কথা, কত কান্না, কত হাসি–তিন বছরের হাজারো দিনের লাখো স্মৃতি বায়োস্কোপের ছবির মত ভেসে উঠতে লাগল মনের পরদায়। শত সুরে গেয়ে উঠল অন্তর-বীণা। সে আসবে, সে আসবে, আমার কিশোর জীবনের কিশোরী প্রিয়া আসবে রাণীর বেশে, বধুর বেশে। আসবে ঘোমটা দিয়ে, লাজনত আঁখি তুলে তাকাবে আমার মুখের পানে, বাহুবন্ধনে তাকে আনব আমার কাছে মধুযামিনী হবে শেষ!

কিন্তু তারপর, তারপর এ কি? ভাবতেও যে শরীর শিউরে উঠে! আমার মনমোহিনী রাণী নেমে আসবে ধরার ধূলায় আটপৌরে শাড়ী পরে কোমর বেঁধে ঢুকবে রান্নাঘরে— আমার ভাবী, বোন এদের মত সংসারের কাজে দেবে নিজেকে বিলিয়ে। রাণীর আসন থেকে নেমে এসে সন্মার্জনী হাতে আমার ঘরের স্তূপীকৃত জঞ্জাল আসবে সরিয়ে দিতে।

না না এ হতেই পারে না। আমার মানস প্রতিমা, আমার জীবনের প্রথম প্রেমের কল্পতরুকে কিছুতেই পারব না স্বর্গ হতে ধরার ধূলায় নামিয়ে আনতে।

নেমে আসুক আমার কণ্ঠে বিরহের সুর, ফুটে উঠুক আমার কল্পনার তুলিতে বিরহী যক্ষের মেঘদূত, চাই না আমি আমার ধ্যানের ছবিকে ধূলাবলুন্ঠিত করতে।

সারারাত ঘুমুতে পারলাম না। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে, সে আমার শিয়রে এসে হেসে হেসে বলছে, “বড় জিনিষ লাভ করতে হলে বড় ত্যাগ আর সাধনা চাই। ঘুম ভেঙে গেছে, কিন্তু বিড় বিড় করে বলছি, “বড় জিনিষ লাভ করতে হলে বড় ত্যাগ আর সাধনা চাই।” আমার ভগ্নীপতিকে গিয়ে বললাম, “হল না মিঞাভাই, হবে না, বাবাকে বলে দেবেন, তাঁর মনের গোপন বাসনাই আমি পূর্ণ করব। বড় জিনিষ লাভ করতে হলে বড় ত্যাগ আর সাধন চাই।”

ত্যাগ আমি করলাম কিনা জানি না, তবে সাধনার পথে পা বাড়ালাম তার স্মৃতিকে আমার ধ্রুবতারা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *