শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – ৫. পঞ্চমাঙ্ক (শেষ)

পঞ্চমাঙ্ক

প্রথম গর্ভাঙ্ক

প্রতিষ্ঠানপুরী-রাজদেবালয়-সম্মুখে
(বিদূষক এবং কতিপয় নাগরিকের প্রবেশ।)

বিদূ। আঃ! তোমরা যে বিরক্ত কল্যে! তোমরা উন্মত্ত হয়েছ? ঐ দেখ দেখি, সূর্য্যদেবের রথ আকাশমণ্ডলের মধ্যভাগে অবস্থিত হয়েছে, আর এই পথপ্রান্তের বৃক্ষসকলও ছায়াহীন হয়ে উঠলো। তোমরা কি এ রাজধানীর সর্ব্বনাশ করবে না কি?

প্রথ। কেন মহাশয়?

বিদূ। কেন কি? কেন, তা আবার জিজ্ঞাসা কচ্যো? বেলা প্রায় দুই প্রহরের অধিক হয়েছে, আমার এখনও স্নান-আহ্নিক, আহারাদি কিছুই হলো না। যদি আমি ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে, কি জানি হঠাৎ এ রাজ্যকে একটা অভিশাপ দিয়ে ফেলি, তবে কি হবে, বল দেখি?

প্রথ। (সহাস্য বদনে) হাঁ, তা যথার্থ বটে, তা এর মধ্যে দুই প্রহর কি, মহাশয়? ঐ দেখুন, এখনও সূর্য্যদেব উদয়গিরির শিখরদেশে অবস্থিতি কচ্যেন, আর শিশিরবিন্দু সকল এখন পর্য্যন্তও মুক্তা-ফলের ন্যায় পত্রের উপর শোভমান হচ্যে।

বিদূ। বিলক্ষণ! তোমরা ত সকলি জান। (উদরে হস্ত দিয়া) ওহে, এই যে ব্রাহ্মণের উদর দেখছ, এটি সময় নির্ণয় কত্যে ঘটীযন্ত্র হতেও সুপটু। আর তোমরা এ ব্যক্তিটে যে কে, তা ত চিনলে না; ইনি যে সূর্য্য-সিদ্ধান্ত-বিষয়ে আর্য্যভট্টের পিতামহ।

প্রথ। তার সন্দেহ কি? আপনি যে একজন মহাপণ্ডিত মনুষ্য, তা আমরা সকলেই বিলক্ষণ জানি।

দ্বিতী। (স্বগত) এ ত দেখছি নিতান্ত পাগল, এর সঙ্গে কথা কইলে সমস্ত দিনেও ত কথার শেষ হবে না। (প্রকাশে) সে যা হৌক্‌ মহাশয়, মহারাজ যে কিরূপে এ দূরন্ত অভিশাপ হতে পরিত্রাণ পেলেন, সে কথাটার যে কোন উত্তর দিলেন না?

বিদূ। (সহাস্যবদনে) ওহে, আমরা উদরদেবের উপাসক, অতএব তার পূজা না দিলে আমাদের নিকট কোন কৰ্ম্মই হয় না। বিশেষ জান ত, যে সকল কার্য্যেতেই অগ্রে ব্রাহ্মণভোজনটা আবশ্যক?

দ্বিতী। (হাস্যমুখে) হাঁ, তা গো-ব্রাহ্মণের সেবা ত অবশ্যই কৰ্ত্তব্য।

বিজু। বটে। তবে ভালই হলো; অগ্রে আমি ভোজন করবো, পরে তুমি স্বয়ং প্রসাদ পেলেই তোমার গো-ব্রাহ্মণ দুয়েরই সেবা করা হবে।

প্রথ। ঐ যে মন্ত্রী মহাশয় এ দিকে আসচেন।

বিদূ। ও কি ও! তোমরা কি এখন আমাকে ছেড়ে যাবে নাকি? এ কি? ব্রাহ্মণ-সেবা ফেলে রেখে গোসেবী আগে?—হ্যাঁ দেখ, আশা দিয়ে না দিলে তোমাদের ইহকালও নাই, পরকালও নাই।

দ্বিতী। (হাস্যমুখে) না, না, আপনার সে ভয় নাই।

(মন্ত্রী এবং কতিপয় নাগরিকের প্রবেশ।)

প্রথ। আসতে আজ্ঞা হৌক, মহাশয়! মহারাজ যে কি প্রকারে দুরারোগ্য হয়েছেন, সেইটে শুনবার জন্যে আমরা সকলেই ব্যস্ত হয়েছি, আপনি আমাদের অনুগ্রহ করে বলুন দেখি।

মন্ত্রী। মহাশয়। সে সব দৈব ঘটনা, স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হবার নয়। রাণী মহারাজের সেইরূপ দুর্দশা দেখে দুঃখে একবারে উন্মত্তার ন্যায় হয়ে উঠলেন; পরে তার প্রিয়সখী পূর্ণিকা তাকে একান্ত কাতরা ও অধীর দেখে পুনরায় মহৰ্ষির নিকটে নিয়ে গেলেন। রাজমহিষী আপনার জনকের সমীপে নানাবিধ বিলাপ কল্যে পর, ঋষিরাজের অন্তঃকরণ দুহিতা-স্নেহে আৰ্দ্ৰ হলো, এবং তিনি বল্যেন, “বৎসে, আমার বাক্য ত কখন অন্যথা হবার নয়, তবে কেবল তোমার স্নেহে আমি এই বলছি, যদি মহারাজের কোন পুত্র তার জরাভার গ্রহণ করে, তা হলেই কেবল তিনি এ বিপদ হতে নিস্তার পান, এ ভিন্ন আর কোন উপায় নাই।” রাণী এ কথা শ্রবণমাত্রেই গৃহে প্রত্যাগমন করলেন এবং মহারাজকেও এ সকল বৃত্তান্ত অবগত করালেন। অনন্তর রাজা প্রফুল্লচিত্তে স্বীয় জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ যত্নকে আহ্বান করে বললেন, “হে পুত্ত্র, মহামুনি শুক্রের অভিশাপে আমি জরাগ্রস্ত হয়ে অত্যন্ত ক্লেশ পাচ্যি; তুমি আমার বংশের তিলক, তুমি আমার এই জরারোগ সহস্র বৎসরের নিমিত্তে গ্রহণ কর, তা হলে আমি এ পাপ হতে পরিত্রাণ নাই। আমার আশীৰ্ব্বাদে তোমার এ সহস্র বৎসর স্রোতের ন্যায় আতি ত্বরায় গত হবে। হে প্রিয়তম! জরারোগ হতে পরিত্রাণ পেলে আমার পুনর্জন্ম হয়, তা তুমি আমাকে এই ভিক্ষ দাও, আমাকে এ পাপ হতে কিয়ুৎকালের জন্য মুক্ত করো।”

প্রথ। আহা! কি দুঃখের বিষয়! মহাশয়, এতে রাজপুত্ৰ যদু কি বল্লেন?

মন্ত্রী। রাজকুমার যদু পিতার এরূপ বাক্য শ্রবণে বিরস বদনে বল্যেন, “হে পিতঃ, জরারোগের ন্যায় দুঃখদায়ক রোগ আর পৃথিবীতে কি আছে? জরারোগে শরীর নিতান্ত দুৰ্ব্বল ও কুৎসিত হয়, ক্ষুধা কি তৃষ্ণার কিছুমাত্র উদ্রেক হয় না, আর সমস্ত সুখভোগে এককালে বঞ্চিত হতে হয়; তা পিতঃ, আপনি আমাকে এ বিষয়ে ক্ষমা করুন।”

প্রথ। ইঃ! কি লজ্জার কথা! এতে মহারাজ কি প্রত্যুত্তর দিলেন।

মন্ত্রী। মহারাজ যদুর এই কথা শুনে তাকে সরোষে এই অভিসম্পতি প্রদান ল্যেন, যে তার বংশে রাজলক্ষ্মী কখনই প্রতিষ্ঠিতা হবেন না।

প্রথ। ই, এ উচিত দণ্ডই হয়েছে বটে, তার আর সংশয় নাই। তার পর মহাশয়?

মন্ত্রী। তার পর মহারাজ ক্রমে আর তিন সন্তানকে আনয়ন করে এইরূপ বল্যেন, তাতে সকলেই অস্বীকার হওয়াতে মহারাজ ক্রোধাম্বিত হয়ে সকলকেই অভিশাপ দিলেন।

দ্বিতী। মহাশয়, কি সৰ্ব্বনাশ! তার পর? তার পর?

বিদূ। আরে, তোমরা ত এক “তার পর” বলে নিশ্চিন্ত হলে, এখন এত বাক্যব্যয় কত্যে কি মন্ত্রী মহাশয়ের জিহ্বার পরিশ্রম হয় না? তা উনি দেখছি পঞ্চানন না হলে আর তোমাদের কথার পরিশেষ কত্যে পারেন না।

মন্ত্রী। অনন্তর মহারাজ এ চারি পুত্রের ব্যবহারে যে কি পৰ্য্যন্ত দুঃখিত ও বিষয় হলেন, তা বলা দুঃসাধ্য। তিনি একবারে নিরাশ হয়ে অধোবদনে চিন্তাসাগরে মগ্ন হলেন। তার পর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র পুরু পিতার চরণে প্রণাম করে বললেন, “পিতঃ, আপনি কি আমাকে বালক দেখে ঘৃণা কল্যেন? আপনার এ জরারোগ আমি গ্রহণ কত্যে প্রস্তুত আছি, আপনি আমাতে এ রোগ সমর্পণ করে স্বচ্ছন্দে রাজ্যভোগ করুন। আপনি আমার জীবনদাতা,—আপনি এ অতি সামান্য কৰ্ম্মে যদি পরিতৃপ্ত হন, তবে এ অপেক্ষা আমার আর সৌভাগ্য কি আছে?” মহারাজ পুত্রের এই কথা শুনে একবারে যেন গগনের চন্দ্র হাতে পেলেন আর পুত্রকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে কোলে নিলেন।

প্রথ। আহা! রাজকুমার পুরুর কি শুভ লগ্নে জন্ম!

মন্ত্রী। মহারাজ পরম পরিতুষ্ট হয়ে পুত্রকে এই বর দিলেন, যে, পুত্ৰ! তুমি পৃথিবীর অধীশ্বর হবে এবং তোমার বংশে রাজলক্ষ্মী কারাবদ্ধার ন্যায় চিরকাল আবদ্ধ থাকবেন।

প্রথ। মহাশয়। তার পর? মন্ত্রী। তার পর আর কি? মহারাজ জরামুক্ত হয়ে পুনরায় রাজকৰ্ম্মে নিযুক্ত হয়েছেন। আহা! মহারাজ যেন কন্দর্পের ন্যায় ভস্ম হতে পুনৰ্ব্বার গাত্রোত্থান করলেন; এ কি সামান্য আহ্বাদের বিষয়।

প্রথ। মহাশয়, আমরা আপনার নিকট এ কথা শুনে এক্ষণে যথার্থ প্রত্যয় কল্যেম। তবে কয়েক দিনের পরে অদ্য রাজদর্শন হবে, আমরা সত্বর গমন করি। (নাগরিকদিগের প্রতি) এসো হে, চলো রাজভবনে যাওয়া যাক।

মন্ত্রী। আমিও দেবদর্শনে গমন কচ্যি, আর অপেক্ষা করবো না।

[ নাগরিকগণের ও মন্ত্রীর প্রস্থান।

বিদূ। (স্বগত) মা কমলার প্রসাদে রাজসংসারে কোন খাদ্যদ্রব্যেরই অভাব নাই, এবং সকলেই এ দরিদ্র ব্রাহ্মণের প্রতি যথেষ্ট স্নেহও করে থাকে, কিন্তু তা বলে ঐ নাগরিকদের ছেড়ে দেওয়াও ত উচিত নয়! পরের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে খাওয়ায় বড় আরাম হে। তা না হলে সদাশিব দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে উদর পূরেন কেন?

(নটী ও মন্ত্রিগণের প্রবেশ।)

(সচকিতে) আহা হা! এ কি আশ্চৰ্য্য!—এ যে দেখছি তৃষ্ণা না এগিয়ে জল আপনি এগিয়ে আসচেন! ভাল, ভাল; যখন কপাল ফলে, তখন এমনিই হয়। (নটীর প্রতি) তবে তবে, সুন্দরি, এ দিকে কোথায় বল দেখি? তুমি কি স্বর্গের অপ্সরী মেনকা? ইন্দ্র কি তোমাকে আমার ধ্যানভঙ্গ কত্যে পাঠিয়েছেন?

নটী। কি গো ঠাকুর। আপনি কি রাজর্ষি বিশ্বামিত্র না কি?

বিদূ। হাঃ হাঃ হাঃ, প্রায় বটে। কি তা জান? আমি যেমন বিশ্বামিত্র, তুমিও তেমনি মেনকী! তা তুমি যখন এসেছ, তখন ইন্দ্ৰত্ব আমার কি ছার! এসো এসো, মনোহারিণি, এসো।

নটী। যাও যাও, এখন পথ ছেড়ে দাও, আমি রাজসভায় যাচ্চি।

বিদূ। সুন্দরি, তুমি যেখানে, সেই খানেই রাজসভা! আবার রাজসভা কোথা? তুমি আমার মনে রাজ্যের রাজমহিষী! (নৃত্য।)

নটী। (স্বগত) এ পাগল বামুনের হাত থেকে পালাতে পেলে যে বাঁচি। (প্রকাশে) আরে, তুমি কি জ্ঞানশূন্য হয়েছ না কি?

বিদূ। হাঁ, তা বৈ কি? (নৃত্য।)

নটী। কি উৎপাত!

[বেগে প্রস্থান।

বিদূ। ধর ধর, ঐ চোর মাগীকে ধর। ও আমার অমূল্য মনোরত্ন চুরি করে পালাচ্যে।

প্রথম মন্ত্রী। এ আবার কি!

দ্বিতীয় ঐ। ওটা ভাড়, ওর কথা কেন জিজ্ঞাসা কর। চল আমরা যাই।

[প্রস্থান।


দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

প্রতিষ্ঠানপুরী— রাজসভা।
[রাজা যযাতি, রাজ্ঞী দেবযানী, বিদূষক, পূর্ণিকা, পরিচারিকা, সভাসদগণ ইত্যাদি।]

রাজা। অদ্য কি শুভ দিন! বহু দিনের পর ভগবান্‌ ঋষিপ্রবরের শ্রীচরণ দশন করবো, এতে আমার কি আiনন্দ হচ্যে!

রাজ্ঞী। হে প্ৰাণেশ্বর, ভগবান্‌ তাতকে আনয়ন কত্যে মন্ত্রী মহাশয় কি একাকী গিয়েছেন?

রাজা। না, অন্যান্য সভাসদগণকেও তার সঙ্গে পাঠান হয়েছে।

(নেপথ্যে) বম্ ভোলানাথ!

গীত
(রাগিণী বেহাগ, তাল জলদ তেতালা।)

জয় উমেশ শঙ্কর,             সৰ্ব্বগুণাকর,
ত্রিতাপ সংহর, মহেশ্বর।
হলাহলাঙ্কিত,              কণ্ঠ সুশোভিত,
মৌলিবিরাজিত সুধাকর॥
পিনাকবাদক,            শৃঙ্গনিনাদক,
ত্রিশূলধারক, ভয়ঙ্কর।
বিরিঞ্চিবাঞ্ছিত,            সুরেন্দ্রসেবিত,
পদাজপূজিত, পরাৎপর॥

রাজা। (সচকিতে) ঐ যে মহৰ্ষি আগমন কচ্যেন! (সকলের গাত্রোত্থান।)

(মহর্ষি শুক্রাচাৰ্য্য, কপিল, মন্ত্রী ইত্যাদির প্রবেশ।)

শুক্র। হে মহীপতে, আপনাকে জগদীশ্বর চিরবিজয়ী এবং চিরজীবী করুন। (দেবযানীর প্রতি) বৎসে, তোমার কল্যাণ হোক, আর চিরকাল সুখে থাক।

রাজা। (প্রণাম করিয়া) ভগবন্‌, আপনকার পদার্পণে এ চন্দ্রবংশীয় রাজধানী এতদিনে পবিত্রা হলো, বসতে আজ্ঞা হৌক। (কপিলের প্রতি) প্রণাম মুনিবর, বসুন (সকলের উপবেশন।)

কপি। মহারাজের কল্যাণ হৌক! (দেবযানীর প্রতি) ভগিনি! তুমি চিরসুখিনী হও।

শুক্র। হে নরাধিপ, আমার প্রিয়তমা দৈত্যরাজনন্দিনী শৰ্ম্মিষ্ঠা কোথায়?

রাজা। (মন্ত্রীর প্রতি) আপনি শৰ্ম্মিষ্ঠাদেবীকে অতি ত্বরায় এখানে আনান!

মন্ত্রী। মহারাজের আজ্ঞা শিরোধার্য্য।

[ প্রস্থান।

শুক্র। হে নরেশ্বর, আপনার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র পুরু যে এই বিপুল চন্দ্রবংশে প্রধান হবেন, এ জন্যেই বিধাতা আপনার উপর এ লীলা প্রকাশ করেন। যা হোক, আপনি কোন প্রকারে দুঃখিত বা অসন্তুষ্ট হবেন না। বিধির নির্বন্ধ কে খণ্ডন কত্যে পারে? (দেবযানীর প্রতি) বংসে, তোমার সন্তানদ্বয় অপেক্ষা সপত্নী-তনয় পুরুর সন্মানবৃদ্ধি হলো বলে, এ বিষয়ে তুমি ক্ষোভ করো না, কেন না, জগৎ-মাতা যা করেন, তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করা মহাপাপ কৰ্ম্ম। বিশেষত: ভবিতব্যের অন্যথা কত্যে কে সক্ষম?

(শৰ্ম্মিষ্ঠা এবং দেবিকার সহিত মন্ত্রীর পুনঃ প্রবেশ।)

শৰ্ম্মি। আমি মহর্ষি ভাগবের শ্রীচরণে প্রণাম করি, আর এই সভাস্থ গুরুলোকদিগকে বন্দনা করি।

শুক্র। রাজনন্দিনি, বহু দিবসের পর তোমার চন্দ্ৰানন দর্শনে যে আমি কি পৰ্য্যন্ত সুখী হলেম, তা প্রকাশ করা দুষ্কর ৷ কল্যাণি, তোমার অতি শুভক্ষণে জন্ম! যেমন অদিতিপুত্র স্বীয় কিরণজালে সমস্ত ভূমণ্ডলকে আলোকময় করেন, তোমার পুত্র পুরুও আপন প্রতাপে সেইরূপ অখিল ধরাতল শাসন করবেন। তা বংসে, অদ্যাবধি তুমি দাসীত্ব-শৃঙ্খল হতে মুক্ত হলে, আর দুঃখান্তেই নাকি সুখানুভব অধিকতর হয়, সেই নিমিত্তেই বুঝি বিধাতা তোমার প্রতি কিঞ্চিৎকাল বিমুখ হয়েছিলেন, তার মৰ্ম্ম অদ্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ হলো। (রাজার প্রতি) হে রাজন্‌, যেমন আমি আপনাকে পূর্বে একটি কন্যারত্ন সম্প্রদান করেছিলেম, অধুনা এঁকেও আপনার হস্তে অৰ্পণ কল্যেম, আপনি এ কন্যারত্বের প্রতিও সমান যত্নবান হবেন। এখন এঁকেও গ্রহণ করে আপনার এক পার্শ্বে বসান।।

রাজা। ভগবান্‌ মহর্যির আজ্ঞা শিরোধাৰ্য্য। (দেবযানীর প্রতি) কেমন প্রিয়ে, তুমি কি বল?

রাজ্ঞী। (সহাস্যমুখে) নাথ, এত দিনে কি আমার অনুমতির সাপেক্ষা হলো?

শুক্র। বৎসে, তুমিও তোমার সপত্নী অথচ আবাল্যের প্রিয়সখী শৰ্ম্মিষ্ঠাকে ষথোচিত সন্মান কর;–আর আপনার সহোদরার ন্যায় এর প্রতি পূৰ্ব্বমত স্নেহমমতা করবে।

রাজ্ঞী। (গাত্রোত্থানপূর্ব্বক শৰ্ম্মিষ্ঠার কর গ্রহণ করিয়া) প্রিয়সখি, আমার সকল দোষ মার্জন কর!

শৰ্ম্মি। প্রিয়সখি, তোমার দোষ কি? এ সকল বিধাতার লীলা বৈ ত নয়!

রাজ্ঞী। সে যা হোক, সখি, অদ্যাবধি আমাদের পূর্বপ্রণয় সঞ্জীবিত হলো। এখন এসো, দুই জনেই পতিসেবায় কিছু দিন সুখে যাপন করি। (রাজার প্রতি) মহারাজ, এক বিশাল রসাল তরুবর, মালতী আর মাধবী উভয় লতিকার আশ্রয়স্থল হলো।

রাজা। (প্রফুল্ল মুখে উভয়কে উভয় পার্থে বসাইয়া) অদ্য একবৃন্তে যুগল পারিজাত প্রস্ফুটিত। (আকাশে কোমল বাদ্য।)

শুক্র। (আকাশমার্গে দৃষ্টিপাত করিয়া) এই যে, ইন্দ্রের অঙ্গরীরা, এই মাঙ্গলিক ব্যাপারে দেবতাদের অনুকূলতা প্রকাশকরণার্থে উপস্থিত হয়েছে।

(আকাশে পুষ্পবৃষ্টি।)

বিদূ। মহারাজ, এতক্ষণ ত আকাশের আমোদ হলো, এখন কিছু মর্ত্ত্যের আমোদ হলে ভাল হয় না? নৰ্ত্তকীরা এসেছে, অনুমতি হয় ত এখানে আনয়ন করি।

রাজা। (হাস্যমুখে) ক্ষতি কি?

বিদূ। মহারাজ, ঐ দেখুন, নটীরা নৃত্য কত্যে কত্যে সভায় আসচে। (জনান্তিকে রাজার প্রতি) বয়স্য, দেখুন, মলয়-মারুতের স্পর্শমুখামুভবে সরসী হিল্পোলিত হলে যেমন নলিনী নৃত্য করে, এরাও সেইরূপ মনোহররূপে নেচে নেচে আসচে।

রাজা। (সহাস্যবদনে জনান্তিকে) সখে, বরঞ্চ বল, যে যেমন মন্দ প্রবাহে কমলিনী ভাসে, এরও পঞ্চ স্বর তরঙ্গে তদ্রূপ প্লবমানা হয়ে এদিকে আসচে।

(চেটাদিগের প্রবেশ।)

চেটী। (প্রণাম করিয়া) রাজদম্পতী চিরবিজয়িনী হউন! (নৃত্য)

রাজা! আহ, কি মনোহর নৃত্য! সখে মাধব্য, এদের যথোচিত পুরস্কার প্রদানে অনুমতি কর।

শুক্র। এই ত আমার মনস্কামনা পূর্ণ হলো। হে রাজন্‌, এখন আশীৰ্ব্বাদ করি, যে তোমরা সকলে দীর্ঘজীবী হয়ে এইরূপ পরম মুখে কালযাপন কর, এবং শর্ম্মিষ্ঠার কীৰ্ত্তিপতাকা ধরাতলে চিরকাল উডীয়মান থাকুক।

রাজ। ভগবন, সিদ্ধবাক্য অমোঘ; আমি ঐহিক সুখের চরম লাভ অদ্যই করলেম।

(যবনিক পতন।)

ইতি শৰ্ম্মিষ্ঠ নাটক সমাপ্ত।

2 Comments
Collapse Comments
নিশির শিশির August 25, 2022 at 10:14 pm

পড়ে ঋদ্ধ হ‌ইলাম

অসাধারণ,আমার প্রিয় কবির লেখা নাটক❤️

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *