শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – ১. প্রথমাঙ্ক

প্রথমাঙ্ক

প্রথম গর্ভাঙ্ক

হিমালয় পৰ্ব্বত—দূরে ইন্দ্রপুরী অমরাবতী।
(একজন দৈত্য যুদ্ধবেশে)

দৈত্য। (স্বগত) আমি প্রতাপশালী দৈত্যরাজের আদেশানুসারে এই পৰ্ব্বতদেশে অনেক দিন অবধি ত বাস কচ্যি; দিবারাত্রের মধ্যে ক্ষণকালও স্বচ্ছন্দে থাকি না; কারণ ঐ দূরবর্তী নগরে দেবতারা যে কখন কি করে, কখনই বা কে সেখান হতে রণসজ্জায় নির্গত হয়, তার সংবাদ অসুরপতির নিকটে তৎক্ষণাৎ লয়ে যেতে হয়। (পরিক্রমণ) আর এ উপত্যকাভূমি যে নিতান্ত অরমণীয় তাও নয়;–স্থানে স্থানে তরুশাখায় নানা বিহঙ্গমগণ সুমধুর স্বরে গান কচ্যে; চতুর্দিকে বিবিধ বনকুসুম বিকশিত; ঐ দূরস্থিত নগর হতে পারিজাত পুষ্পের সুগন্ধ সহকারে মুহমন্দ পবন সঞ্চার হচ্যে; আর কখন কখন মধুর-কণ্ঠ অঙ্গরীগণের তান-লয় বিশুদ্ধ সঙ্গীতও কর্ণকুহর শীতল করে; কোথাও ভীষণ সিংহের নাদ, কোথাও ব্যাঘ্র-মহিষাদির ভয়ঙ্কর শব্দ, আবার কোথাও বা পৰ্ব্বতনিঃস্থত বেগবতী নদীর কুলকুল ধ্বনি হচ্যে। কি আশ্চর্য্য! এই স্থানের গুণে স্বজনবান্ধবের বিরহদুঃখও আমি প্রায় বিস্মৃত হয়েছি। (পরিক্রমণ) আহো! কার যেন পদশব্দ শ্ৰুতিগোচর হোল না! (চিন্তা করিয়া) তা এ ব্যক্তিটা শক্র কি মিত্র, তাও ত অনুমান কত্যে পাচ্চি না; যা হোক, আমার রণসজ্জায় প্রস্তুত থাকা উচিত। (অসি চৰ্ম্ম গ্রহণ) বোধ হয়, এ কোন সামান্য ব্যক্তি না হবে। উঃ! এর পদভরে পৃথিবী যেন কম্পমানা হচ্যেন।

(বকাসুরের প্রবেশ)

(প্রকাশে) কত্ত্বং?

বক। দৈত্যপতি বিজয়ী হউন, আমি তারই অনুচর।

দৈত্য। (সচকিতে) ও! মহাশয়? আসতে আজ্ঞা হউক। নমস্কার।

বক। নমস্কার। তবে দৈত্যবর, কি সংবাদ বল দেখি!

দৈত্য। এ স্থলের সকলি মঙ্গল। দৈত্যপুরীর কুশলবাৰ্ত্তায় চরিতার্থ করুন।

বক। ভাই হে, তার আর বলবো কি? অদ্য দৈত্যকুলের এক প্রকার পুনর্জন্ম।

দৈত্য। কেন কেন, মহাশয়?

বক। মহর্ষি, শুক্রাচার্য্য ক্রোধান্ধ হয়ে দৈত্য-দেশ পরিত্যাগে উদ্যত হয়েছিলেন।

দৈত্য। কি সৰ্ব্বনাশ! এ কি অদ্ভুত ব্যাপার, এর কারণ কি?

বক। ভাই, স্ত্রীজাতি সৰ্ব্বত্রই বিবাদের মূল। দৈত্যরাজকন্যা শর্ম্মিষ্ঠা গুরুকন্যা দেবযানীর সহিত কলহ করে তাকে এক অন্ধকারময় কূপে নিক্ষেপ করেন, পরে দেবযানী এই কথা আপন পিতা তপোধনকে অবগত করালে, তিনি ক্রোধে প্ৰজ্জ্বলিত হুতাশনের ন্যায় একবারে জ্বলে উঠলেন! আঃ! সে ব্ৰহ্মাগ্নিতে যে আমরা সনগর দগ্ধ হই নাই, সে কেবল দেবাদেব মহাদেবের কৃপা, আর আমাদের সৌভাগ্য।

দৈত্য। আজ্ঞে, তার সন্দেহ কি? কিন্তু গুরুকন্যা দেবযানী রাজকুমারী শৰ্ম্মিষ্ঠার প্রাণস্বরূপ, তা তাদের উভয়ে কলহ হওয়াও ত অতি অসম্ভব।

বক। হা, তা যথার্থ বটে, কিন্তু ভাই, উভয়েই নবযৌবনমদে উন্মত্তা।

দৈত্য। তার পর কি হলো মহাশয়?

বক। তার পর মহর্ষি শুক্রাচার্য্য, ক্রোধে রক্তনয়ন হয়ে রাজসভায় গিয়ে মুক্তকণ্ঠে বলেন, “রাজন্‌! অদ্যাবধি তুমি শ্ৰীভ্রষ্ট হবে, আমি এই অবধি এ স্থান পরিত্যাগ কল্যেম, এ পাপ-নগরীতে আমার আর অবস্থিতি করা কখনই হবে না।” এই বাক্যে সভাসদ সকলের মস্তকে যেন বজ্রপাত হলো, আর সকলেই ভয়ে ও বিস্ময়ে স্পন্দহীন হয়ে রৈল।

দৈত্য। তার পর মহাশয়?

বক। পরে মহারাজ কৃতাঞ্জলিপুটে অনেক স্তব করে বললেন,“গুরো! আমি কি অপরাধ করেছি, যে আপনি আমাকে সবংশে নিধন কত্যে উদ্যত হয়েছেন? আমরা সপরিবারে আপনার ক্রীতদাস, আর আপনার প্রসাদেই আমার সকল সম্পত্তি।” তাতে মহর্ষি বললেন, “সে কি মহারাজ? তুমি দৈত্যকুলপতি, আমি একজন ভিক্ষাজীবী ব্রাহ্মণ, আমাকে কি তোমার এ কথা বলা সম্ভবে?” রাজা তাতে আরো কাতর হয়ে, মহর্ষির পদতলে পতিত হলেন, আর বলতে লাগলেন, “গুরো, আপনার এ ভয়ানক ক্রোধের কারণ কি, আমাকে বলুন।”

দৈত্য। তা মহর্ষি এ কথায় কি আজ্ঞা কল্যেন?

বক। রাজার নম্রতা দেখে মহর্ষি ভূতল হতে তাকে উত্থিত কল্যেন, আর আপনার কন্যার সহিত রাজকুমারীর বিবাদের বৃত্তান্ত সমুদয় জ্ঞাত করিয়ে বললেন, “রাজন্‌! দেবযানী আমার একমাত্র কন্যা, আমার জীবনাপেক্ষাও স্নেহপাত্রী, তা, যে স্থানে তার কোনরূপ ক্লেশ হয়, সে স্থান আমার পরিত্যাগ করা উচিত।” রাজা এ কথায় বিস্ময়াপন্ন হয়ে, করযোড় করে এই উত্তর দিলেন, “প্রভো! আমি এ কথার বিন্দুবিসর্গও জানি নে, তা আপনি সে পাপশীলা শর্ম্মিষ্ঠার যথোচিত দণ্ডবিধান কর‍্যে ক্রোধ সম্বরণ করুন, নগর পরিত্যাগের প্রয়োজন কি?”

দৈত্য। ভগবান্‌ ভার্গব তাতে কি বল্যেন?

বক। তিনি বল্যেন, “এ পাপের আর প্রায়শ্চিত্ত কি আছে? তোমার কন্যা চিরকাল দেবযানীর দাসী হয়ে থাকুক, আমার এই ইচ্ছা।”

দৈত্য। উঃ! কি সৰ্ব্বনাশের কথা!

বক। মহারাজ এই বাক্য শুনে যেন জীবন্মতের ন্যায় হলেন। তাতে মহর্ষি সক্রোধে রাজাকে পুনৰ্ব্বার বল্লেন, “রাজন্‌! তুমি যদি আমার বাক্যে সম্মত না হও, তবে বল আমি এই মুহূৰ্ত্তেই এ স্থান হতে প্রস্থান করি।” মহর্ষি ভার্গবকে পুনরায় ক্রোধাম্বিত দেখে মন্ত্রিবর কৃতাঞ্জলিপূৰ্ব্বক মহারাজকে সম্বোধন করে বললেন, “মহারাজ! আপনি কি একটি কন্যার জন্যে সবংশে নিৰ্ব্বংশ হবেন? দেখুন দেখি, যদি কোন বণিক্‌ সুবর্ণ, রৌপ্য ও নানাবিধ মহামূল্য রত্নজাত-পরিপূর্ণ একখানি পোত লয়ে সমুদ্রগমন করে, আর যদি সে সময়ে ঘোরতর ঘনঘটা দ্বারা আকাশমণ্ডল আবৃত হয়ে প্রবলতর ঝটিকা বইতে থাকে, তবে কি সে ব্যক্তি আপনার প্রাণরক্ষার নিমিত্তে সে সময়ে সে সমুদয় মহামূল্য রত্নজাত গভীর সমুদ্রমধ্যে নিক্ষেপ করে না?”

দৈত্য। তার পর মহাশয়?

বক। দৈত্যাধিপতি মন্ত্রিবরের এই হিতকর বাক্য শুনে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করে রাজকুমারীকে অগত্যায় সভায় আনয়ন করতে অনুমিত দিলেন; পরে রাজদুহিতা সভায় উপস্থিতা হলে মহারাজ অশ্রুপূর্ণলোচনে ও গদগদবচনে তাকে সমুদয় অবগত করালেন, আর বললেন, “বংসে! অদ্য তোমার হস্তেই দৈত্যকুলের পরিত্রাণ। যদি তুমি মহর্ষির এই নিষ্ঠুর আজ্ঞা প্রতিপালন কত্যে স্বীকার না কর, তবে আমার এ রাজ্য শ্ৰীভ্রষ্ট হবে এবং আমিও চিরবিরোধী দুর্দ্দান্ত দেবগণ কর্তৃক পরাজিত হয়ে নানা ক্লেশে পতিত হব।”

দৈত্য। হায়! হায়! কি সৰ্ব্বনাশ!—রাজকুমারী পিতার এতাদৃশ বাক্য শ্রবণে কি প্রত্যুত্তর দিলেন?

বক। ভাই হে! রাজতনয়ার তৎকালীন মুখচন্দ্ৰ মনে কল্যে পাষাণ-হৃদয়ও বিদীর্ণ হয়। রাজকুমারী যখন সভায় উপস্থিত হলেন, তখন তার মুখমণ্ডল শরচ্চন্দ্রের ন্যায় প্রসন্ন ছিল, কিন্তু পিতৃবাক্যে মেঘাচ্ছন্ন শশধরের ন্যায় একবারে মলিন হয়ে গেল। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) হা হতদৈব, এমন সুন্দরীর অদৃষ্টে কি এই ছিল! অনন্তর রাজপুত্ৰী শর্ম্মিষ্ঠা সভা হতে পিতৃ-আজ্ঞায় সম্মত হয়ে প্রস্থান করলে পর, মহারাজ যে কত প্রকার আক্ষেপ ও বিলাপ করতে আরম্ভ করলেন, তা স্মরণ হলে অধৈর্য্য হতে হয়! (দীর্ঘনিশ্বাস।)

দৈত্য। আহা, কি দুঃখের বিষয়। তবে কি না বিধাতার নির্বন্ধ কে লঙ্ঘন করতে পারে? হে ধনুৰ্দ্ধারিন্‌! এক্ষণে আচাৰ্য্য মহাশয়ের কোপাগ্নি ত নিৰ্ব্বাণ হয়েছে?

বক। আর হবে না কেন?

দৈত্য। তবে আপনি যে বলেছিলেন অদ্য দৈত্যকুলের পুনর্জন্ম হলো তা কিছু মিথ্যা নয়। (চিন্তা করিয়া) হে অসুর-শ্রেষ্ঠ! যখন মহৰ্ষির সহিত মহারাজের মনান্তর হবার উপক্রম হয়েছিল, তখন যদি ঐ দুর্দ্দান্ত দেবগণেরা এ সংবাদ প্রাপ্ত হতো, তা হলে যে তারা কি পৰ্য্যন্ত পরিতুষ্ট হতো, তা আর অনুমান করা যায় না।

বক। তা সত্য বটে। আর আমিও তাই জানতে এসেছি যে দেবতারা এ কথার কিছু অনুসন্ধান পেয়েছে কি না। তুমি কি বিবেচনা কর, দেবেন্দ্র প্রভৃতি দৈত্যারিগণ এ সংবাদ পায় নাই?

দৈত্য। মহাশয়। দেবদূতেরা পরম মায়াবী, এবং তাদের গতি মনোরথ আর সৌদামিনী অপেক্ষাও বেগবতী। স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল, এই ত্রিভুবনের মধ্যে কোন স্থানই তাদের অগম্য নয়।

বক। তা যথার্থ বটে, কিন্তু দেখ, ঐ নগরে সকলেই স্থিরভাবে আছে। বোধ করি, অমরগণ দৈত্যরাজের সহিত ভগবান্‌ ভার্গবের বিবাদের কোন সূচনা প্রাপ্ত হয় নাই, তা হলে তারা তৎক্ষণাৎ রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে নগর হতে নির্গত হতো।

দৈত্য। মহাশয়। আপনি কি অবগত নন, যে প্রবল বাত্যারম্ভের পূৰ্ব্বে সমুদয় প্রকৃতি স্থিরভাবে অবস্থিতি করেন?—যা হউক, সুকুমারী রাজকুমারী এখন কোথায় আছেন?

বক। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) তিনি এখন গুরুকন্যা দেবযানীর সহিত আচার্য্যের আশ্রমেই অবস্থিতি কচ্যেন। ভাই হে! সেই সুকুমারী রাজকুমারী ব্যতিরেকে দৈত্যপুরী একবারে অন্ধকারময়ী হয়ে রয়েছে! রাজমহিষীর রোদনধ্বনি শ্রবণ করলে বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হয় এবং মহারাজের যে কি পৰ্য্যন্ত মনোদুঃখ, তা স্মরণ হলে ইচ্ছা হয় না যে দৈত্যদেশে পুনর্গমন করি।

(নেপথ্যে রণবাদ্য, শঙ্খনাদ ও হুহুঙ্কার ধ্বনি।)

দৈত্য। মহাশয়। ঐ শ্রবণ করুন,—শত বজ্রশব্দের ন্যায় দুর্দ্দান্ত দেবগণের শঙ্খনাদ শ্রুতিগোচর হচ্যে। উঃ, কি ভয়ানক শব্দ!

বক। দুষ্ট দস্যুদল তবে দৈত্যদেশ আক্রমণে উদ্যত হলো না কি?

নেপথ্যে। দৈত্যকুল সংহার কর। দৈত্যদেশ সংহার কর।

দৈত্য। আহো! এ কি প্রলয়কাল উপস্থিত, যে সপ্তসমুত্র ভীষণ গর্জ্জন পূর্ব্বক তীর অতিক্রম কচ্যে?

বক। ওহে বীরবর। এ স্থানে আর বিলম্ব করবার প্রয়োজন নাই; দুষ্ট দেবগণের অভিলাষ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পাচ্যে। চল, ত্বরায় দৈত্যরাজের নিকট এ সংবাদ লয়ে যাই। ঐ দুষ্ট দেবগণের শঙ্খধ্বনি শুন্‌লে আমার সর্বশরীরের। শোণিত উষ্ণ হয়ে উঠে।

[উভয়ের প্রস্থান।


দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

দৈত্য-দেশ–গুরু শুক্রাচার্য্যের আশ্রম।

(শৰ্ম্মিষ্ঠার সখী দেবিকার প্রবেশ।)

দেবি। (আকাশ প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া স্বগত) সূর্য্যদেব ত প্রায় অস্তগত হলেন। এই যে আশ্রমে পক্ষিসকল কূজনধ্বনি করে চারিদিক হতে আপন আপন বাসায় ফিরে আসছে; কমলিনী আপনার প্রিয়তম দিনকরকে গমনোন্মুখ দেখে বিষাদে মুদিত প্রায়; চক্ৰবাক ও চক্রবাকবধূ, আপনাদের বিরহ-সময় সন্নিহিত দেখে, বিষন্নভাবে উপবিষ্ট হয়ে, উভয়ে উভয়ের প্রতি একদৃষ্টে অবলোকন কচ্যে; মহর্ষিগণ স্বীয় স্বীয় হোমাগ্নিতে সায়ংকালীন আহুতি প্রদানের উদযোগে ব্যস্ত; দুগ্ধভারে ভারাক্রাস্ত গাভীসকল বৎসাবলোকনে অতিশয় উৎসুক হয়ে বেগে গোষ্ঠে প্রবিষ্ট হচ্যে। (আকাশমণ্ডলের প্রতি পুনর্দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া) এই ত সন্ধ্যাকাল উপস্থিত, কিন্তু রাজকুমারী যে এখনও আসচেন না, কারণ কি? (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) আহা! প্রিয়সখীর কথা মনে উদয় হলে, একবারে হৃদয় বিদীর্ণ হয়! হা হতবিধাতঃ! রাজকুলে জন্মগ্রহণ করে শৰ্ম্মিঠাকে কি যথার্থই দাসী হতে হলো? আহা প্রিয়সখীর সেই পূৰ্ব্ব রূপলাবণ্য কোথায় গেল? তা এতাদৃশী দূরবস্থায় কি প্রকারেই বা সে অপরূপ রূপলাবণ্যের সম্ভব হয়? নিৰ্ম্মল সলিলে যে পদ্ম বিকশিত হয়, পঙ্কিল জলে তাকে নিক্ষেপ করলে তার কি আর তাদৃশী শোভা থাকে? (অবলোকন করিয়া সহৰ্ষে) ঐ যে আমার প্রিয়সখী আসছেন।

(শৰ্ম্মিষ্ঠার প্রবেশ)

(প্রকাশে) রাজকুমারি! তোমার এত বিলম্ব হলো কেন?

শৰ্ম্মিষ্ঠা! সখি! বিধাতা এক্ষণে আমাকে পরাধীন করেছেন; সুতরাং পরবশ জনের স্বেচ্ছানুসারে কৰ্ম্ম করা কি কখন সম্ভব হয়?

দেবি। প্রিয়সখি! তোমার দুঃখের কথা মনে হলে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়। হা কুসুমকুমারি। হা চারুশীলে! তোমার অদৃষ্টে যে এত ক্লেশ ছিল, এ আমি স্বপ্নেও জান্‌তেম না। (রোদন)

শৰ্ম্মি। সখি! আর বৃথা ক্ৰন্দনে ফল কি?

দেবি। প্রিয়সখি! তোমার দুঃখে পাষাণও বিগলিত হয়!

শৰ্ম্মি। সখি! দুঃখের কথায় অন্তঃকরণ আর্দ্র হয় বটে, কিন্তু কৈ, আমার এমন দুঃখ কি?

দেবি। প্রিয়সখি! এর অপেক্ষা দুঃখ আর কি আছে? শশধর আকাশমণ্ডল হতে ভূতলে পতিত হয়েছেন! দেখ, রাজদুহিতা হয়ে দাসী হলে! হা দুর্দ্দৈব! তোমার কি সামান্য বিড়ম্বনা!

শৰ্ম্মি। সখি! যদিও আমি দাসীত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ, তথাপি ত আমি রাজভোগে বঞ্চিত হই নাই। এই দেখ! আমার মনে সেই সকল সুখই রয়েছে। এই অশোক-বেদিক আমার মহাৰ্হ সিংহাসন (বেদিকোপরি উপবেশন)। এই তরুবর আমার ছত্ৰদণ্ড, ঐ সম্মুখস্থ সরোবরে বিকশিত কুমুদিনীই আমার প্রিয়সখী। মধুকর ও মধুকরীগণ গুন্‌ গুন স্বরে আমারই গুণকীৰ্ত্তন কচ্যে। স্বয়ং সুগন্ধ মলয়-মারুত আমার বীজনক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হয়েছে; চন্দ্রমণ্ডল নক্ষত্রগণ সহিত আমাকে আলোক প্রদান কচ্যেন। সখি! এ সকল কি সামান্য বৈভব? আমাকে এত সুখভোগ করতে দেখেও তোমার কি আমাকে সুখভোগিনী বলে বোধ হয় না?

দেবি। (সস্মিতবদনে) রাজনন্দিনি! এ কি পরিহাসের সময়?

শৰ্ম্মি। সখি! আমি ত তোমার সহিত পরিহাস কচ্যি না। দেখ, সুখদুঃখ মনের ধৰ্ম্ম; অতএব বাহ-সুখ অপেক্ষা আন্তরিক সুখই মুখ। আমি পূৰ্ব্বে যেরূপ ছিলাম, এখনও সেইরূপ, আমার ত কিঞ্চিম্মাত্রও চিত্তবিকার হয় নাই।

দেবি। সখি! তুমি যা বল, কিন্তু হতবিধাতার এ কি সামান্য বিড়ম্বন? (রোদন।)

শৰ্ম্মি। হা ধিকৃ! সখি! তুমি বিধাতাকে বৃথা নিনা কর কেন? দেখ দেখি, যদি আমি কোন ব্যক্তিকে দেবভোগতুল্য উপাদেয় মিষ্টান্ন ভোজন করতে দি, আর সে যদি তা বিষ সহকারে ভোজন করে চিররোগী হয়, তবে কি আমি সে ব্যক্তির রোগের কারণ বলে গণ্য হতে পারি?

দেবি। সখি, তাও কি কখন হয়? ہتے শৰ্ম্মি। তবে তুমি বিধাতাকে আমার জন্যে দোষ দেও কেন? বিধাতার এ বিষয়ে দোষ কি? গুরুকন্যা দেবযানীর সহিত আমার বিবাদ-বিলম্বাদ না হলে ত আমাকে এ দুর্গতি ভোগ করতে হতে না! দেখ, পিতা আমার দৈত্যরাজ; তিনি প্রতাপে আদিত্য, আর ঐশ্বৰ্য্যে ধনপতি; তার বিক্রমে দেবগণও সশঙ্কিত; আমি তার প্রিয়তমা কন্যা। আমি আপন দোষেই এ দুর্দশায় পতিত হয়েছি,—আমি আপনি মিষ্ট্রান্নের সহিত বিষ মিশ্রিত করে ভক্ষণ করেছি, তায় অন্তের দোষ কি?

দেবি। প্রিয়সখি! তোমার কথা শুনলে অন্তরাত্মা শীতল হয়। তোমার এতাদৃশী বাকৃপটুতা, বোধ হয়, যেন স্বয়ং বাগ দেবীই অবনীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। হা বিধাতঃ! তুমি কি নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করবার আর স্থান পাও নাই? এমত সরল বালাকেও কি এত যন্ত্রণা দেওয়া উচিত? (রোদন)

শৰ্ম্মি। সখি! আর বৃথা রোদন করো না! অরণ্যে রোদনে কি ফল?

দেবি। ভাল, প্রিয়সখি! একটা কথা জিজ্ঞাসা করি,—বলি, দাসী হয়েই কি চিরকাল জীবনযাপন করবে?

শৰ্ম্মি সখি! কারাবদ্ধ ব্যক্তি কি কখন স্বেচ্ছানুসারে বিমুক্ত হতে পারে? তবে তার বৃথা ব্যাকুল হওয়ায় লাভ কি? আমি যেরূপ বিপদে বেষ্টিত, এ হতে করুণাময় পরমেশ্বর ভিন্ন আর কে আমাকে উদ্ধার করতে সক্ষম? তা, সখি, আমার জন্যে তোমার রোদন করা বৃথা।

দেবি। রাজনন্দিনি, শাস্তিদেবী কি তোমার হৃদয়পদ্মে বসতি কচ্যেন যে তুমি এককালীন চিত্তবিকারশূন্যা হয়েছ? কি আশ্চৰ্য্য! প্রিয়সখি! তোমার কথা শুনলে, বোধ হয়, যে তুমি যেন কোন বৃদ্ধ তপস্বিনী, শান্তরসাস্পদ আশ্রমপদে যাবজ্জীবন দিনপাত করেছ। আহা! এও কি সামান্য দুঃখের বিষয়! হা হতবিধে! দুর্লভ পারিজাতপুষ্পকে কি নির্জ্জন অরণ্যে নিক্ষেপ করা উচিত? অমূল্য রত্ন কি সমুদ্রতলে গোপন রাখবার নিমিত্তেই স্বজন করেছ? (দীর্ঘনিশ্বাস।)

শৰ্ম্মি। প্রিয়সখি! চল, আমরা এখন কুটীরে যাই। ঐ দেখ, চন্দ্রনায়িকা কুমুদিনীর ন্যায় দেবযানী পূর্ণিকার সহিত প্রফুল্লবদনে এই দিকে আসচেন। তুমি আমাকে সৰ্ব্বদা “কমলিনী, কমলিনী” বল; তা যদ্যপি আমি কমলিনীই হই, তবে এ সময়ে আমার এ স্থলে বিকশিত হওয়া কি উচিত? দেখ দেখি, আমার প্রিয়সখী অনেকক্ষণ হলো অস্তগত হয়েছেন, তাঁর বিরহে আমাকে নিমীলিত হতে হয়। চল, আমরা যাই।

দেবি। রাজকুমারি। ঐ অহঙ্কারিণী ব্রাহ্মণকন্তাকে কি কুমুদিনী বলা যায়? আমার বিবেচনায় তুমি শশধর, আর ও দুষ্ট রাহু। আমি যদি সুদর্শনচক্র পাই, তা হলে ঐ দুষ্টা স্ত্রীকে এই মুহূৰ্ত্তেই দুই খণ্ড করি।

শৰ্ম্মি। হা ধিক্। সখি, তুমি কি উন্মত্তা হলে। ঐ ব্রাহ্মণকন্যার পিতৃপ্রসাদেই আমাদের পিতৃকুল সেই সুদর্শনচক্র হতে নিস্তার পায়। তা সখি! চল, এখন আমরা যাই।

[উভয়ের প্রস্থান।

(দেবযানী এবং পূর্ণিকার প্রবেশ।)

দেব। (আকাশ প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া) প্রিয়সখি! বসুমতী যেন অদ্য রাত্রে স্বয়ম্বরা হয়েছেন; ঐ দেখ, আকাশমণ্ডলে ইন্দু এবং গ্রহনক্ষত্র প্রভৃতির কি এক অপূৰ্ব্ব এবং রমণীয় শোভা হয়েছে! আহা! রোহিণীপতির কি অনুপম মনোরম প্রভা। বোধ হয়, ত্রিভুবনমোহিনী জলধিদুহিতা কমলার স্বয়ম্বরকালে পুরুষোত্তম দেবসমাজে যাদৃশ শোভমান হয়েছিলেন, সুধাকরও অদ্য নক্ষত্রমধ্যে তদ্রূপ অপরূপ ও অনিৰ্ব্বচনীয় শোভা ধারণ করেছেন। (চতুৰ্দ্দিক অবলোকন;করিয়া) প্রিয়সখি! এই দেখ, এ আশ্রমপদেরও কি এক অপরূপ সৌন্দৰ্য্য! স্থানে স্থানে নানাবিধ কুসুমজাল বিকশিত হয়ে যেন স্বয়ম্বরা বসুন্ধরার অলঙ্কারস্বরূপ হয়ে রয়েছে। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ)

পূর্ণি। তবে দেখ দেখি, প্রিয়সখি! নিশানাথের এতাদৃশ মনোহারিণী প্রভায় তোমার চিত্তচকোরের কি নিরানন্দ হওয়া উচিত? দেখ, শৰ্ম্মিষ্ঠা তোমাকে যে সময় কূপমধ্যে নিক্ষেপ করেছিল, তদবধি তোমার তিলার্দ্ধের নিমিত্তেও মনঃস্থির নাই,–সততই তুমি অন্যমনস্ক আর মলিন বদনে দিনযামিনী যাপন কর। সখি, এর নিগূঢ় তত্ত্ব তুমি আমাকে অকপটে বল, আমি ত তোমার আর পর নই! বিবেচনা করলে সখীদের দেহমাত্রই ভিন্ন, কিন্তু মনের ভাব কখনও ভিন্ন নয়।

দেব। প্রিয়সখি! আমার অন্তঃকরণ যে একান্ত বিচলিত ও অধীর হয়েছে, তা বটে; কিন্তু তুমি যদি আমার চিত্তচঞ্চলতার কারণ শুন্‌তে উৎসুক হয়ে থাক, তবে বলি, শ্রবণ কর।

পূর্ণ। প্রিয়সখি! সে কথা শুনতে যে আমার কি পৰ্য্যন্ত লালসা, তা মুখে ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য।

দেব। শৰ্ম্মিষ্ঠা আমাকে কূপে নিক্ষেপ করলে পর আমি অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত অজ্ঞানাবস্থায় পতিতা ছিলেম, পরে কিঞ্চিৎ চেতন পেয়ে দেখলেম, যে চতুর্দিক কেবল অন্ধকারময়। অনন্তর আমি ভয়ে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে আরম্ভ করলেম। দৈবযোগে এক মহাত্মা সেই স্থান দিয়ে গমন কর্‌তেছিলেন, হঠাৎ কূপমধ্যে হাহাকার আর্তনাদ শুনে নিকটস্থ হয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে? আর কি জন্যেই বা কূপের ভিতর রোদন কচ্যো?” প্রিয়সখি! তৎকালে তার এরূপ মধুর বাক্য শুনে, আমার বোধ হলো, যেন বিধাতা আমাকে উদ্ধার করবার জন্য স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন। তিনি কে, আমি কিছুই নির্ণয় করতে পারলেম না, কেবল ক্ৰন্দন করতে করতে মুক্তকণ্ঠে এইমাত্র বললেম, “মহাশয়! আপনি দেবই হউন বা মানবই হউন, আমাকে এই বিপজ্জাল হতে শীঘ্ৰ বিমুক্ত করুন ” এই কথা শুনিবামাত্র, সেই দয়ালু মহাশয় তৎক্ষণাৎ কূপমধ্যে অবতীর্ণ হয়ে আমাকে হস্তধারণপূর্ব্বক উত্তোলন করলেন। আমি উপরিস্থা হয়ে তার অলৌকিক রূপলাবণ্য দর্শনে একবারে বিমোহিতা হলেম। সখি! বললে প্রত্যয় করবে না, বোধ হয়, তেমন রূপ এ ভূমণ্ডলে নাই। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ।)

পুর্ণি। কি আশ্চর্য্য! তার পর, তার পর?

দেব। তার পর তিনি আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করে এই কথা জিজ্ঞাসা করলেন, “হে ললনে, তুমি দেবী কি মানবী? কার অভিশাপে তোমার এ দুর্দশা ঘটেছিল? সবিশেষ শ্রবণে অতিশয় কৌতুহল জন্মেছে, বিবরণ করলে আমি যৎপরোনাস্তি পরিতৃপ্ত হই।” তাঁর এ কথা শুনে আমি সবিনয়ে বল্‌লেম, “হে মহাভাগ! আমি দেবকন্যা নই—আমার ঋষিকুলে জন্ম-আমি ভগবান্‌ মহৰ্ষি ভার্গবের দুহিতা, আমার নাম দেবযানী।” প্রিয়সখি! আমার এই উত্তর শুনেই সেই মহাত্মা কিঞ্চিৎ অন্তরে দণ্ডায়মান হয়ে বললেন, “ভদ্রে। আপনি ভগবান্‌ ভার্গবের দুহিতা? আমি ঋষিবরকে বিলক্ষণ জানি, তিনি একজন ত্ৰিভূবনপূজ্য পরম দয়ালু ব্যক্তি; আপনি তাকে আমার শত সহস্র প্রণাম জানাবেন; আমার নাম যযাতি—আমার চন্দ্রবংশে জন্ম। এক্ষণে অনুমতি করুন, আমি বিদায় হই!” এই কথা বলে তিনি সহসা প্রস্থান করলেন। প্রিয়সখি! যেমন কোন দেবতা কোন পরম ভক্তের প্রতি সদয় হয়ে, তার অভিলষিত বর প্রদানপূর্ব্বক অন্তর্হিত হলে, সেই ভক্তজন মুহূৰ্ত্তকাল আনন্দরসে পুলকিত ও মুদিতনয়ন হয়ে, আপন ইষ্টদেবকে সম্মুখে আবিভূতি দেখে, এবং বোধ করে, যেন তিনি বারম্বার মধুরভাষে তার শ্রুতিমুখ প্রদান কর্চেন, আমিও সেই মহোদয়ের গমনান্তর ক্ষণকাল তদ্রূপ সুখসাগরে নিমগ্ন ছিলেম। আহা! সখি! সেই মোহনমূর্ত্তি অদ্যাপি আমার হৃদপদ্মে জাগরূক রয়েছে। প্রিয়সখি! সে চন্দ্ৰানন কি আমি আর এজন্মে দর্শন করবো? (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ) সেই অমৃতবষিণী মধুরভাষা কি আর কখন আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে? প্রিয়সখি! শৰ্ম্মিষ্ঠা যখন আমাকে কূপে নিক্ষিপ্ত করেছিল, তখন আমার মৃত্যু হলে আর কোন যন্ত্রণাই ভোগ করতে হতো না। (রোদন।)

পুর্ণি। প্রিয়সখি! তুমি কেন এ সমুদয় বৃত্তান্ত ভগবান্‌ মহৰ্ষিকে অবগত করাও না?

দেব। (সত্ৰাসে) কি সৰ্ব্বনাশ! সখি! তাও কি হয়? এ কথা ভগবান্‌ মহর্ষি জনককে কি প্রকারে জ্ঞাত করান যায়? রাজচক্ৰবৰ্ত্তী যযাতি ক্ষত্রিয়—আমি হলেম ব্রাহ্মণ কন্যা।

পুর্ণি। সখি, আমার বিবেচনায় এ কথা মহৰ্ষির কর্ণগোচর করা আবশ্যক।

দেব। (সত্রাসে) কি সৰ্ব্বনাশ! সখি, তুমি কি উন্মত্তা হয়েছ? এ কথা মহযি জনকের কর্ণগোচর করা অপেক্ষা মুত্যুও শ্রেয়:।

পূণি। প্রিয়সখি! ঐ দেখ, ভগবানু মহৰ্ষির নাম গ্রহণমাত্রেই তিনি এ দিকে আসচেন। এও একটা সৌভাগ্য বা কাৰ্য্যসিদ্ধির লক্ষণ।

দেব। (সত্রাসে) প্রিয়সখি! তুমি এ কথা ভগবান্‌ পিতার নিকটে যেন কোন প্রকারেই ব্যক্ত করো না। হে সখি! তুমি আমার এই অনুরোধটি রক্ষা কর।

পূর্ণি। সখি! যেমন অন্ধ ব্যক্তির স্থপথে গমন করা দুঃসাধ্য, জ্ঞানহীন জনের পক্ষে সদসদ-বিবেচনা তদ্রূপ সুকঠিন।

দেব। (সত্রাসে) প্রিয়সখি! তুমি কি একবারে আমার প্রাণনাশ করতে উদ্যত হয়েছ? কি সৰ্ব্বনাশ! তোমার কি প্রজ্বলিত হুতাশনে আমাকে আহুতি প্রদানের ইচ্ছা হয়েছে। ভগবান্‌ পিতা স্বভাবতঃ উগ্রস্বভাব, এতাদৃশ বাক্য তার কর্ণগোচর হলে আর কি নিস্তার আছে?

পুর্ণি। প্রিয়সখি! আমি তোমার অপকারিণী নই। তা তুমি এ স্থান হতে প্রস্থান কর; ঐ দেখ ভগবান্‌ মহর্ষি এই দিকেই আগমন কচ্যেন।

দেব। (সত্রাসে) প্রিয়সখি! এক্ষণে আমার জীবনমরণে তোমারই সম্পূর্ণ প্রভূত; কিন্তু আমি জীবনাশায় জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার নিকট হতে বিদায় হলেম।

পূর্ণ। প্রিয়লধি! এতে চিন্তা কি? আমি কৌশলক্রমে মহর্ষির নিকট এ সকল বৃত্তান্ত নিবেদন করবো, তার ভয় কি?

দেব। প্রিয়সখি! তোমার যা ইচ্ছা তাই কর। হয় ত এ জন্মের মত এই সাক্ষাৎ হলো।

[ বিষন্নভাবে দেবযানীর প্রস্থান।

(মহর্ষি শুক্রাচার্য্যের প্রবেশ।)

পূর্ণি। তাত! প্রিয়সখা দেবযানীর মনোগত কথা অদ্য জ্ঞাত হয়েছি, অনুমতি হলে নিবেদন করি।

শুক্র। (নিকটবর্ত্তী হইয়া) বংসে পূর্ণিকে! কি সংবাদ?

পূর্ণি। ভগবন্‌! সকলই সুসংবাদ, আপনি যা অনুভব করেছিলেন, তাই যথার্থ।

শুক্র। (সহাস্যবদনে) বংসে! সমাধিনির্ণীত বিষয় কি মিথ্যা হওয়া সম্ভব? তবে দুহিতার মনোগত ব্যক্তির নাম কি?

পুর্ণি। ভগবন্‌! তার নাম যযাতি।

শুক্র। (সহাস্যবদনে) শ্রীনিবাসের বক্ষঃস্থলকে অলঙ্কৃত করবার নিমিত্তেই কৌস্তুভমণির সৃজন। হে বংসে! এই রাজর্ষি যযাতি চন্দ্রবংশাবতংস। যদ্যপিও তিনি ক্ষত্ৰকুলজাত, তত্ৰাচ বেদবিদ্যাবলে তিনিই আমার কন্যারত্বের অনুরূপ পাত্র। অতএব হে বৎসে পূর্ণিকে! তুমি তোমার প্রিয়সখী দেবযানীকে আশ্বাস প্রদান কর। আমি অনতিবিলম্বেই সুবিজ্ঞতম প্রধান শিষ্য কপিলকে রাজর্ষিসান্নিধ্যে প্রেরণ করবো। সুচতুর কপিল একবারে রাজর্ষি চন্দ্রবংশচুড়ামণি যযাতিকে সমভিব্যাহারে আনয়ন করবেন। তদনন্তর আমি তোমার প্রিয়সখীর অভীষ্ট সিদ্ধি করবো। তার চিন্তা কি?

পূর্ণি। ভগবন্‌! যথা আজ্ঞা, আমি তবে এখন বিদায় হই।

শুক্র। বংসে। কল্যাণমস্তু তে।

[ পূর্ণিকার প্রস্থান।

শুক্র। (স্বগত) আমার চিরকাল এই বাসনা, যে আমি অনুরূপ পাত্রে কন্যা সম্প্রদান করি; কিন্তু ইদানীং বিধি আনুকূল্য প্রকাশপূৰ্ব্বক মদীয় মনস্কামনা পরিপূর্ণ করলেন। এক্ষণে কন্যাদায়ে নিশ্চিন্ত হলেম। সুপাত্রে প্রদত্ত কন্যা পিতামাতার অনুশোচনীয়া হয় না।

[ প্রস্থান।

ইতি প্রথমাঙ্ক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *