দ্বিতীয়াঙ্ক
প্রথম গর্ভাঙ্ক
প্রতিষ্ঠানপুরী-রাজপথ।
(দুইজন নাগরিকের প্রবেশ।)
প্রথম। ভাল, মহাশয়, আপনার কি এ কথাটা বিশ্বাস হয়?
দ্বিতীয়। বিশ্বাস না করেই বা করি কি?—ফলে মহারাজ যে উন্মাদ প্রায় হয়েছেন, তার আর সংশয় নাই।
প্রথম। বলেন কি! আহা! মহাশয়, কি আক্ষেপের বিষয়! এত দিনের পর কি নিষ্কলঙ্ক চন্দ্রবংশের কলঙ্ক হলো?
দ্বিতী। ভাই! সে বিষয়ে তোমার আক্ষেপ করা বৃথা! এমন মহাতেজা: যশস্বী বংশের কি কখন কলঙ্ক বা ক্ষয় হতে পারে? দেখ, যেমন দুষ্ট রাহু এই বংশনিদান নিশানাথকে কিঞ্চিৎকাল মলিন করে পরিশেষে পরাভূত হয়, সেইরূপ এ বিপদও অতি ত্বরায় দূর হবে, সন্দেহ নাই।
প্রথ। আহা! পরমেশ্বর কৃপা করে যেন তাই করেন! মহাশয়, আমরা চিরকাল এই বিপুলবংশীয় রাজাদিগের অধীন, অতএব এর ধ্বংস হলে আমরাও একবারে সমূলে বিনষ্ট হবো। দেখুন, বজ্রাঘাতে যদি কোন বিশাল আশ্রয়-তরু জলে যায়, তবে তার আশ্রিত লতাদির কি দূরবস্থা না ঘটে!
দ্বিতী। হা, তা যথার্থ বটে, কিন্তু ভাই, তুমি এ বিষয়ে নিতান্ত ব্যাকুল হয়ো না।
প্রথ। মহাশয়, এ বিষয়ে ধৈর্য্য ধরা কোন মতেই সম্ভবে না; দেখুন, মহারাজ রাজকাৰ্য্যে একবারও দৃষ্টিপাত করেন না; রাজধৰ্ম্মে তার এককালে ঔদাস্ত হয়েছে। মহাশয়, আপনি একজন বহুদশী এবং সুবিজ্ঞ মনুষ্য, অতএব বিবেচনা করুন দেখি, যদ্যপি দিনকর সতত মেঘাচ্ছন্ন থাকেন, তবে কি পৃথিবীতে কোন শস্যাদি জন্মে? আর দেখুন, যদ্যপি কোন পতিপরায়ণ রমণীর প্রিয়তম তার প্রতি হতশ্রদ্ধা করে, তবে কি সে স্ত্রীর পূর্ববৎ রূপলাবণ্যাদি আর থাকে? রাজ-অবহেলায় রাজলক্ষ্মীও প্রতিদিন সেইরূপ শ্রীভ্রষ্টা হচ্যেন।
দ্বিতী। ভাই হে, তুমি যা বললে, তা সকলই সত্য, কিন্তু তুমি এ বিষয়ে নিতান্ত বিষণ্ণ হয়ে না। বোধ করি, কোন মহিলার প্রতি মহারাজের অনুরাগসঞ্চার হয়ে থাকবে, তাই তার চিত্ত সততই চঞ্চল। যা হউক, নরপতির এ চিত্তবিকার কিছু চিরস্থায়ী নয়, অতি শীঘ্রই তিনি সুস্থ হবেন। দেখ, সুরাপায়ী ব্যক্তি কিছু চিরকাল উন্মত্তভাবে থাকে না। আমাদের নরবর অধুনা আসক্তিরূপ সুরাপানে কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত হয়েছেন বটে, কিন্তু কিছু বিলম্বে যে তিনি স্বভাবস্থ হবেন, তার কোন সন্দেহ নাই।
প্রথ। মহাশয়। সে সকল ভাগ্য অপেক্ষা করে! আহা! নরপতি যে এরূপ অবস্থায় কালযাপন করেন, এ আমাদের স্বপ্নেরও অগোচর।
দ্বিতী। (সহাস্যবদনে) ভাই, ভোমার নিতান্ত শিশুবুদ্ধি। দেখ, এই বিপুলা পৃথিবী কামস্বরূপ কিরাতের মৃগয়াস্থান। তিনি ধনুৰ্ব্বাণ গ্রহণ পূর্ব্বক মৃগমিথুনরূপ নরনারী-লক্ষ্যভেদে অনবরতই পর্য্যটন কচ্যেন; অতএব এই ভূমণ্ডলে কোন্ ব্যক্তি এমত জিতেন্দ্রিয় আছে, যে তার শরপথ অতিক্রম করতে পারে? দৈত্যদেশের রমণীগণ অত্যন্ত মায়াবিনী, আর তারা নানাবিধ মোহন গুণে নিপুণ; সুতরাং, নরপতি যংকালে মৃগয়ার উপলক্ষে সে দেশে প্রবেশ করেছিলেন, বোধ করি, সে সময়ে কোন সুরূপ কামিনী তার দৃষ্টিপথে পড়ে কটাক্ষবাণে তার চিত্ত চঞ্চল করেছে। যা হউক, যদিও মহারাজ কোন বনকুসুমের আঘ্রাণে একান্ত লোভাসক্ত হয়ে থাকেন, তথাপি স্বীয় উদ্যানের সুরভি পুষ্পের মাধুর্য্যে যে ক্রমশঃ তাঁর সে লোভসংবরণ হবে, তার কোন সংশয় নাই। তুমি কি জান না ভাই, যে ব্ৰহ্ম-অস্ত্র ব্রহ্ম-অস্ত্রেই নিরস্ত হয়, আর বিষই বিষের পরমৌষধ।
প্রথ। আজ্ঞা হাঁ, তা যথার্থ। ফলতঃ এক্ষণে মহারাজ সুস্থ হলেই আমাদের পরম লাভ। দেখুন, এই চন্দ্রবংশীয় রাজগণ দেবসখা; আমি শুনেছি যে লোকেরা ঔষধ আর মন্ত্রবলে প্রাণিসমূহের প্রাণনাশ কতে পারে, অতএব পরমেশ্বর এই করুন, যেন কোন দুর্দ্দান্ত দানব দেবমিত্র বলে মহারাজকে সেইরূপ না করে থাকে।
দ্বিতী। ভাই, ঔষধ কি মন্ত্রবলে যে লোককে বিমোহিত করা, এ আমার কখনই বিশ্বাস হয় না, কিন্তু স্ত্রীলোকেরা যে পুরুষজাতিকে কটাক্ষস্বরূপ ঔষধ আর মধুর ভাষারূপ মন্ত্রে মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়, এ কথা অবশ্যই বিশ্বাস্য বটে। (দৃষ্টিপাত করিয়া) এ ব্যক্তিটে কে হে?
(কপিলের দূরে প্রবেশ।)
প্রথ। বোধ হয়, কোন তপস্বী, দুরাচার রাক্ষসেরা যজ্ঞভূমে উৎপাত করাতে বুঝি মহারাজের শরণাপন্ন হতে আসচেন।
দ্বিতী। কি কোন মহৰ্ষির শিষ্যই বা হবেন।
কপিল। (স্বগত) মহর্ষি শুক্রাচার্য্যের আদেশানুসারে এই ত মহারাজ ষযাতির রাজধানীতে অদ্য উপস্থিত হলেম। আঃ! কত দুস্তর নদ, নদী ও কান্তার অরণ্য প্রভৃতি যে অতিক্রম করেছি, তার আর পরিসীমা নাই। অধুনা মহৰ্ষিও স্বপরিবার সঙ্গে গোদাবরী-তীরে ভগবান্ পর্বতমুনির আশ্রমে আমার প্রত্যাগমন আশায় বাস করচেন। মহারাজ যযাতি সে আশ্রমে গমন কল্যে, তপোধন তাকে স্বীয় কন্যাধন সম্প্রদান করবেন। মহারাজকে আহ্বান করতেই আমার এ নগরীতে আগমন হয়েছে। আহা! নরাধিপের কি অতুল ঐশ্বৰ্য্য! স্থানে স্থানে কত শত প্রহরিগণ গজবাজি আরোহণপূর্ব্বক করতলে করাল করবাল ধারণ করে রক্ষা-কার্য্যে নিযুক্ত আছে; কোন স্থলে বা মন্দুরায় অশ্বগণ অতি প্রচণ্ড হ্ৰেষারব কচ্যে; কোথাও বা মদমত্ত করিরাজের ভীষণ বৃংহিতনিনাদ শ্রুতিগোচর হচ্যে; কোন স্থানে বা বিবিধ সমারোহে বিচিত্র উৎসবক্রিয়া সম্পাদনে জনগণ অনুরক্ত রয়েছে; স্থানে স্থানে ক্রয়-বিক্রয়ের বিপণি নানাবিধ সুখাদ্য ও সুদৃশ্য দ্রব্যজাতে পরিপূর্ণ; নানা স্থানে সুরম্য অট্টালিকা-সন্দর্শনে যে নয়নযুগল কি পৰ্য্যন্ত পরিতৃপ্ত হচ্যে, তা মুখে ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য। আমরা অরণ্যচারী মনুষ্য, এরূপ জনসমাকুল প্রদেশে প্রবেশ করায় আমাদের মনোবৃত্তির যে কত দূর পরিবর্তন হয়, তা অনুমান করা যায় না। কি আশ্চৰ্য্য! প্রাসাদসমূহের এতাদৃশ রমণীয়ত্ব ও সৌসাদৃশ্য, কোন্টি যে রাজভবন, তার নির্ণয় করা সুকঠিন! যাহা হউক, অদ্য পথপরিশ্রমে একান্ত পরিশ্রান্ত হয়েছি, কোন একটা নির্জ্জন স্থান পেলে, সেখানে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করি, পরে মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ করবো। (নাগরিকদ্বয়কে অবলোকন করিয়া) এই ত দুই জন অতি ভদ্রসন্তানের মত দেখছি, এদের নিকট জিজ্ঞাসা করলে, বোধ করি, বিশ্রামস্থানের অনুসন্ধান পেতে পারবো। (প্রকাশে) ওহে পৌরজনগণ! তোমাদের এ নগরীতে অতিথিশালা কোথায়?
প্রথ। মহাশয়! আপনি কে? এ নগরে কার অন্বেষণ করেন?
কপিল। আমি দৈত্যকুলগুরু মহর্ষি শুক্রাচার্য্যের শিষ্য। এই প্রতিষ্ঠান-নগরীতে রাজচক্ৰবৰ্ত্তী রাজা যযাতির নিকটে কোন বিশেষ কর্ম্মের উপলক্ষে এসেছি।
প্রথ। ভগবন্, তবে আপনার অতিথিশালায় যাবার প্রয়োজন কি? ঐ রাজনিকেতন, আপনি ওখানে পদার্পণ করবামাত্রেই যথোচিত সমাদৃত ও পূজিত হবেন এবং মহারাজের সহিত ও সাক্ষাৎ হতে পারবে।
কপিল। তবে আমি সেই স্থানেই গমন করি।
[ প্রস্থান।
প্রথ। এ আবার কি মহাশয়। দৈত্যগুরু যে মহারাজের নিকট দূত পাঠিয়েছেন? চলুন, রাজভবনের দিকে যাওয়া যাক। দেখিগে, ব্যাপারটাই বা কি।
দ্বিতী। চল না, হানি কি?
[ উভয়ের প্রস্থান।
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
প্রতিষ্ঠানপুরী–রাজপুরীস্থ নির্জ্জন গৃহ।
(রাজা যযাতি আসীন, নিকটে বিদূষক।)
বিদূ। (চিন্তা করিয়া) মহারাজ! আপনি হিমাচলের ন্যায় নিস্তব্ধ আর গতিহীন হলেন না কি!
রাজা। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) সখে মাধব্য, সুরপতি যদ্যপি বজ্রদ্বারা হিমাচলের পক্ষচ্ছেদ করেন, তবে সে সুতরাং গতিহীন হয়।
বিদূ। মহারাজ! কোন রোগস্বরূপ ইন্দ্র আপনার এতাদৃশী দূরবস্থার কারণ তা আপনি আমাকে স্পষ্ট করেই বলুন না।
রাজা। কি হে সখে মাধব্য, তুমি কি ধম্বন্তরি? তোমাকে আমার রোগের কথা বলে কি উপকার হবে?
বিদূ। (কৃতাঞ্জলিপুটে) হে রাজচক্রবর্ত্তিন্, আপনি কি শ্রুত নন, যে মুগরাজ কেশরী সময়-বিশেষে অতি ক্ষুদ্র মূষিক দ্বারাও উপকৃত হতে পারেন?
রাজা। (সহস্যবদনে) ভাই হে, আমি যে বিপজ্জালে বেষ্টিত, তা তোমার ন্যায় মুষিকের দন্তে কখনই ছিন্ন হতে পারে না।
বিদূ। মহারাজ! আপনি এখন হাস্য-পরিহাস পরিত্যাগ করুন, এবং আপনার মনের কথাটি আমাকে স্পষ্ট করে বলুন, আপনি এ প্রকার অস্থির ও অন্যমনঃ হলে রাজলক্ষ্মী কি আর এ রাজ্যে বাস করবেন?
রাজা। না কল্যেনই বা।
বিদূ। (কর্ণে হস্ত দিয়া) কি সৰ্ব্বনাশ! আপনার কি এ কথা মুখে আনা উচিত? কি সৰ্ব্বনাশ! মহারাজ, আপনি কি রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের ন্যায় ইন্দ্রতুল্য সম্পত্তি পরিত্যাগ করে তপস্যাধৰ্ম্ম অবলম্বন করতে ইচ্ছা করেন?
রাজা। রাজর্ষি বিশ্বামিত্র তপোবলে ব্রাহ্মণ্য প্রাপ্ত হন; সখে, আমার কি তেমন অদৃষ্ট?
বিদূ। মহারাজ, আপনি ব্রাহ্মণ হতে চান কি?
রাজা। সখে! আমি যদি এই জগত্রয়ের অধীশ্বর হতেম, আর ত্ৰিজগতের ধনদান দ্বারা অতিক্ষুদ্র ব্রাহ্মণও হতে পারতেম, তবে আর তা অপেক্ষ আমার সৌভাগ্য কি বল দেখি?
বিদূ। উঃ! আজ যে আপনার গাঢ় ভক্তি দেখতে পাচ্চি! লোকে বলে, যে দৈত্যদেশে সকলেই পাপাচার, দেবতা-ব্রাহ্মণকে কেউ শ্রদ্ধা করে না। কিন্তু আপনি যে ঐ দেশে কিঞ্চিৎকাল ভ্রমণ করে এত দ্বিজভক্ত হয়েছেন, এ ত সামান্য চমৎকারের বিষয় নয়। বয়স্য, আপনার কি মহর্ষি ভার্গবের সহিত গো-বিষয়ক কোন বিবাদ হয়েছে? বলুন দেখি, মহর্ষি শুক্রাচার্য্যের আশ্রমে কি কোন নন্দিনী-নামী কামধেনু আছে, না আপনি তার দেবযানী-নামী নন্দিনীর কটাক্ষশরে পতিত হয়েছেন? বয়স্য! বলুন দেখি, শুক্ৰকন্যা দেবযানীকে আপনি দেখেছেন না কি?
রাজা। (স্বগত) হা পরমেশ্বর! সে চন্দ্ৰানন কি আর এ জন্মে দর্শন করবো! আহা! ঋষিতনয়ার কি অপরূপ রূপলাবণ্য! (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) হা অন্তঃকরণ! তুমি কি সেই নির্জ্জন বন এবং সেই কূপতট হতে আর প্রত্যাগমন করবে না? হায়! হায়! সে কূপের অন্ধকার কি আর সে চন্দ্রের আভায় দূরীকৃত হবে?
বিদূ। (স্বগত) হরিবোল হরি। সব প্রতুল হয়েছে। সেই ঋষিকন্যাটাই সকল অনর্থের মূল দেখতে পাচ্চি। যা হউক, এখন রোগ নির্ণয় হয়েছে; কিন্তু এ বিকারের মকরধ্বজ ব্যতীত আর ঔযধ কি আছে? (প্রকাশে) কেমন, মহারাজ, আপনি কি আজ্ঞা করেন?
রাজা। সখে মাধব্য, তুমি কি বলছিলে?
বিদূ। বল্বো আর কি? মহাবাজ! আপনি প্রলাপ বক্ছেন তাই শুন্ছি।
রাজা। কেন, ভাই, প্রলাপ কেন? তুমিই বল দেখি, বিধাতার এ কি অদ্ভুত লীলা! দেখ, যে মহামূল্য মাণিক্য রাজচক্রবর্তীর মুকুটের উপযুক্ত, তমোময় গিরিগহবর কি তার প্রকৃত বাসস্থান? (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া)
স্থলোচনা মৃগী ভ্ৰমে নির্জ্জন কাননে;
গজমুক্তা শোভে গুপ্ত শুক্তির সদনে;
হীরকের ছটা বদ্ধ খনির ভিতর,
সদা ঘনাচ্ছন্ন হয় পূর্ণ শশধর;
পদ্মের মৃণাল থাকে সলিলে ডুবিয়া;
হয়, বিধি, এ কুবিধি কিসের লাগিয়া?
বিদূ। ও কি মহারাজ? যেরূপ ভাবোদয় দেখছি, আপনার স্কন্ধে দেবী সরস্বতী আবির্ভূতা হয়েছেন না কি? (উচ্চহাস্য)
রাজা। কি হে সখে, আমার প্রতি ভগবতী বাদেবীর কৃপাদৃষ্টি হলে দোষ কি?
বিদূ। (সহাস্যবদনে) এমন কিছু নয়; তবে তা হলে রাজলক্ষ্মীর নিকটে বিদায়হেীন, রাজদণ্ড পরিত্যাগ করে বীণা গ্রহণ করুন, আর রাজবৃত্তির পরিবৰ্ত্তে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করুন।
রাজা। কেন? কেন?
বিদূ। বয়স্য, আপনি কি জানেন না, লক্ষ্মী সরস্বতীর সপত্নী, অতএব ভূমণ্ডলে সপত্নী-প্রণয় কি সম্ভব?
রাজা। সখে মাধব্য! তুমি কবিকুলকে হেয়ঞ্জান করো না, তারা প্রকৃতিস্বরূপ বিশ্বব্যাপিনী জগন্মাতার বরপুত্র।
বিদূ। (সহাস্যবদনে) মহারাজ! এ কথা কবি-ভায়ারাই বলেন। আমার বিবেচনায়, তার বরঞ্চ উদরস্বরূপ বিশ্বব্যাপী দেবের বরপুত্র।
রাজা। (সহাস্যবদনে) সখে। তবে তুমিও ত একজন মহাকবি, কেন না, সেই উদরদেবের তুমি একজন প্রধান বরপুত্র।
বিদূ। বয়স্য! আপনি যা বলেন। সে যা হউক, এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, ভার্গবদুহিতা দেবযানীর সহিত আপনার কি প্রকারে, আর কোন্ স্থানে সাক্ষার হযেছিল, বলুন দেখি?
রাজা। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) সখে, তার সহিত দৈবযোগে এক নির্জ্জন কাননে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল।
বিদূ। কি আশ্চর্য্য! তা মহারাজ, আপনি এমন অমূল্য রত্ন নির্জ্জন স্থানে পেয়ে কি কল্যেন?
রাজা। আর কি করবো, ভাই! তার পবিচয় পেয়ে আমি আস্তেব্যস্তে সেখান থেকে প্রস্থান কল্যেম।
বিদূ। (সহস্যবদনে) সে কি মহারাজ! বিকশিত কমল দেখে কি মধুকর কখনও বিমুখ হয়?
রাজা। সখে, সত্য বটে! কিন্তু দেবযানী ব্রাহ্মণকন্যা, অতএব যেমন কোন ব্যক্তি দূর হতে সর্পমণির কান্তি দেখে তৎপ্রতি ধাবমান হয়, পরে নিকটবর্ত্তী হয়ে সৰ্প দর্শনে বেগে পলায়ন করে, আমিও সে নবযৌবনা অনুপমা রূপবতী ঋষিতনয়ার পরিচয় পেয়ে সেইরূপ কল্যেম।
বিদূ। মহারাজ, আপনি তা একপ্রকার উত্তমই করেছেন।
রাজা। না ভাই, কেমন করে আর উত্তম করেছি? দেখ, আমি যে প্রাণ ভযে ভীত হয়ে পলায়ন কল্যেম, এখন সেই প্রাণ আমার রক্ষণ করা দুষ্কর হয়েছে! (গাত্ৰোত্থান করিয়া) সখে! এ যাতনা আমার আর সহ হয় না! আগ্নেয়গিরি কি হুতাশনকে চিরকাল অভ্যন্তরে রাখতে পারে? (দীর্ঘনিশ্বাস)।
বিদূ। মহারাজ, আপনি এ বিষয়ে নিতান্তই হতাশ হবেন না।
রাজা। সখে মাধব্য! মরুভূমে তৃষ্ণাতুর মৃগবর, মায়াবিনী মরীচিকাকে দূর থেকে দর্শন করে, বারিলাভে ধাববান হলে, জীবন-উদ্দেশে কেবল তার জীবনেরই সংশয় হয়। এ বিষয়ে আশা কল্যে আমারও সেই দশা ঘটতে পারে। ঋষিকন্যা দেবযানী আমার পক্ষে মরীচিকাস্বরূপ, যেহেতুক তার ব্রাহ্মণকুলে জন্ম, সুতরাং তিনি ক্ষত্রিয়দুষ্প্রাপ্যা। হে পরমেশ্বর, আমি তোমার নিকট কি অপরাধ করেছি, যে তুমি এমন পরম রমণীয় বস্তুকে আমার প্রতি দুঃখকর কল্যে। কেবল আমাকে যাতনা দিবার জন্যেই কি এ পদ্ম আমার পক্ষে সকণ্টক মৃণালের উপর রেখেছ?
বিদূ। মহারাজ, আপনি এত চঞ্চল হবেন না। বয়স্য। বুদ্ধি থাকলে সকল কৰ্ম্মই কৌশলে সুসিদ্ধ হয়। দেখুন দেখি, আমি এমন সদুপায় করে দিচ্চি, যাতে এখনই আপনার মনের ব্যাকুলতা দূর হয়ে যাবে।
রাজা। (সহাস্যবদনে) সখে, তবে আর বিলম্ব কেন? এস তোমার এ উপায়ের দ্বার মুক্ত কর।
বিদূ। যে আজ্ঞা মহারাজ! আমি আগতপ্রায়।
[প্রস্থান।
রাজা। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়। (স্বগত) আহা! কি কুলগ্নেই বা দৈত্যদেশে পদার্পণ করেছিলেম। (চিন্তা করিয়া) হে রসনে! তোমার কি এ কথা বলা উচিত? দেখ, তোমার কথায় আমার নয়নযুগল ব্যথিত হয়, কেন না, দৈত্যদেশগমনে তার চরিতার্থ হয়েছে, যেহেতুক তারা সেখানে বিধাতার শিল্পনৈপুণ্যের সারপদার্থ দর্শন করেছে। (পরিক্রমণ) বাড়বানলে পরিতৃপ্ত হলে সাগর যেমন উৎকণ্ঠিত হন, আমিও কি অদ্য সেইরূপ হলেম? হে প্রভো অনঙ্গ, তুমি হরকোপানলে দগ্ধ হয়েছিলে বলে কি প্রতিহিংসার নিমিত্তে মানবজাতিকে কামাগ্নিতে সেইরূপ দগ্ধ কর? (দীর্ঘনিশ্বাস) কি আশ্চৰ্য্য! আমি কি মৃগয়া করতে গিয়ে স্বয়ং কামব্যাধের লক্ষ্য হয়ে এলাম! (উপবেশন) তা আমার এমন চঞ্চল হওয়ায় কি লাভ? (সচকিতে) এ আবার কি?
(এক জন নটীসহিত বিদূষকের পুনঃপ্রবেশ)
বিদূ। মহারাজ, এই দেখুন, ইনিই কাম-সরোবরের উপযুক্ত পদ্মিনী।
নটী। মহারাজের জয় হউক। (প্রণাম।)
রাজা। কল্যাণি, তুমি চিরকাল সধবা থাক। (বিদূষকের প্রতি) সখে, এ সুন্দরী কে?
বিদূ। মহারাজ, ইনি স্বয়ং উৰ্ব্বশী; ইন্দ্রপুরী অমরাবতীতে বসতি না করে আপনার এই মহানগরীতেই অবস্থিতি করেন।
রাজ। কি হে সখে মাধব্য, তুমি যে একবারে রসিকচুড়ামণি হয়ে উঠলে!
বিদূ। (কৃতাঞ্জলিপুটে) বয়স্য! না হয়ে করি কি? দেখুন, মলয়গিরির নিকটস্থ অতি সামান্য সামান্য তরুও চন্দন হয়ে যায়; তা এ দরিদ্র ব্রাহ্মণ আপনারই অনুচর; এ যে রসিক হবে তার আশ্চৰ্য্য কি?
রাজা। সে যা হোক, এ সুন্দরীকে এখানে আনা হয়েছে কেন, বল দেখি?
বিদূ। বয়স্য! আপনি সেই ঋষিকন্যাকে দেখে ভেবেছেন যে তার তুল্য রূপবতী বুঝি আর নাই, তা এখন একবার এর দিকে চেয়ে দেখুন দেখি!
রাজা। (জনান্তিকে) সখে, অমৃতাভিলাষী ব্যক্তির কি কখনও মধুতে তৃপ্তি জন্মে?
বিদূ। (জনান্তিকে) তা বটে, মহারাজ! কিন্তু চন্দ্রে অমৃত আছে বলে কি কেউ মধুপান ত্যাগ করে? বয়স্য! আপনি একবার এঁর একটি গান শুনুন। (নটীর প্রতি) অয়ি মৃগাক্ষি, তুমি একটি গান করে মহারাজের চিত্তবিনোদন কর।
নটী। আমি মহারাজের আজ্ঞাবৰ্ত্তিনী (উপবেশন।)
গীত
(রাগিণী বাহার—তাল জলদ-তেতালা)
উদয় হইল সখি, সরস বসন্ত।
মোদিত দশ দিক পুষ্পগণে,—
আর বহিছে সমীর সুশান্ত ॥
পিককুল-কূজিত, ভৃঙ্গ-বিগুঞ্জিত,
রঞ্জিত কুঞ্জ নিতান্ত।
যত বিরহিণীগণ, মন্মথতাড়ন,
তাপিত তনু বিনে কান্ত ॥
রাজা। আহা! কি মধুর স্বর! সুন্দরি! তোমার সঙ্গীত শ্রবণে যে আমার অন্তঃকরণ কি পৰ্য্যন্ত পরিতৃপ্ত হলো, তা বলতে পারি না।
(নেপথ্যে সরোষে) রে দুরাচার, পাষণ্ড দ্বারপাল! তুই কি মাদৃশ ব্যক্তিকে দ্বাররুদ্ধ কত্যে ইচ্ছা করিস?
রাজা। এ কি! বহির্দ্বারে দাম্ভিকের ন্যায় অতি প্ৰগলভতার সহিত কে একজন কথা কচ্যে হে?
বিদূ। বোধ করি, কোন তপস্বী হবে, তা না হলে আর এমন সুস্বর কার আছে।
(দৌবারিকের প্রবেশ)
দৌবা। মহারাজের জয় হউক! মহারাজ! মহর্ষি শুক্রাচার্য্য কোন বিশেষ কার্য্যোপলক্ষে আপনার নিকট স্বশিষ্য মুনিবর কপিলকে প্রেরণ করেছেন; অনুমতি হলে মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ করেন।
রাজা। (গান্ত্ৰোখান করিয়া সসন্ত্রমে) সে কি! মুনিবর কোথায়? আমাকে শীঘ্র তার নিকটে লয়ে চল।
[ রাজা এবং দৌবারিকের প্রস্থান।
নটী। (বিদূষকের প্রতি) মহাশয়, মহারাজ এত চঞ্চল হলেন কেন?
বিদূ। হে চারুহাসিনি, তোমার মত মধুমালতী বিকশিতা দেখলে, কার মন-অলি না অধীর হয়?
নটী। বাঃ! ঠাকুরের কি সূক্ষ্ম বুদ্ধি গা! অলি কি বিকশিত মধুমালতীর আঘ্রাণে পলায়ন করে? চল, দেখিগে মহারাজ কোথায় গেলেন।
বিদূ। হে সুন্দরি, তুমি অয়স্কান্ত মণি, আমি লৌহ! তুমি যেখানে যাবে, আমিও সেইখানে আছি। (হস্তধারণ) আহা, তোমার অধরে ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ অমৃতভাণ্ড গোপন করে রেখেছেন। হে মনোমোহিনি, তুমি একটি চুম্ব দিয়ে আমাকে অমর কর।
নটী। (স্বগত) এ মা! বামুন বেটা ত কম ষাঁড় নয়। (প্রকাশে) দূর হতভাগা!
[ বেগে পলায়ন।
বিদূ! এঃ! এ দুশ্চারিণীর রাজার উপরেই লোভ! কেবল অর্থই নিয়েছে, রসিকতা দেখে না। যাই, দেখিগে, বেটী কোথায় গেল।
[ প্রস্থান।
তৃতীয় গর্ভাঙ্ক
প্রতিষ্ঠানপুরী–রাজতোরণ।
(কতিপয় নাগরিক দণ্ডায়মান।)
প্রথ। আহা! কি সমারোহ! মহাশয়, ঐ দেখুন,—
দ্বিতী। আমার দৃষ্টিপথে সকল বস্তুই যেন ধুসরময় বোধ হচ্যে। ভাই হে, সৰ্ব্বচোর কাল সময় পেয়ে আমার দৃষ্টিপ্রসর প্রায়ই অপহরণ করেছে।
প্রথ। মহাশয়, ঐ দেখুন, কত শত হস্তিপকেরা মদমত্ত গজপৃষ্ঠে আরূঢ় হয়ে অগ্রভাগে গমন কচ্যে! অহো -এ কি মেঘাবলী, না পক্ষহীন আচলকুল আবার সপক্ষ হয়েছে? আহা! মধ্যভাগে নানা সজ্জায় সজ্জিত বাজিরাজীই বা কি মনোহর গতিতে যাচ্যে! মহাশয়, একবার রথ-সঙ্খ্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করুন! ঐ দেখুন, শত শত পতাকাশ্রেণী আকাশমণ্ডলে উড্ডীয়মান হচ্যে! কি চমৎকার। পদাতিক দলের বর্ষ সূর্য্যকিরণে মিশ্রিত হয়ে যেন বহ্নি উদিগরণ কচ্যে! আবার ঐ দেখুন, পশ্চাদ্ভাগে নটনটীরা নানা যন্ত্র সহকারে কি মধুর স্বরে সঙ্গীত কচ্যে! (নেপথ্যে মঙ্গলবাদ্য।) ঐ দেখুন, মহারাজ রথোপরি মহাবল বীরদলে পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েচেন। আহা! মহারাজের কি অপরূপ রূপলাবণ্য! বোধ হচ্যে, যেন অদ্য স্বয়ং পুরুষোত্তম বৈকুণ্ঠনিবাসী জনগণ সমভিব্যাহারে গরুড়ধ্বজ রথে আরোহণ করে কমলার স্বয়ম্বরে গমন কচ্যেন।
দ্বিতী। ভাই হে, নহুষপুত্র যযাতি রূপগুণে পুরুষোত্তমই বটেন। আর শ্রুত আছি, যে শুক্র কন্যা দেবযানীও কমলার ন্যায় রূপবতী! এখন পরমেশ্বর করুন, পুরুষোত্তমের কমলা-পরিণয়ে জগজ্জনগণ যেরূপ পরিতৃপ্ত হয়েছিল, অধুনা রাজর্ষি এবং দেবযানীর সমাগমেও যেন এ রাজ্য সেইরূপ অবিকল সুখসম্পত্তি লাভ করে।
তৃতী! মহাশয়! মহারাজের পরিণয়ক্রিয়া কি দৈত্যদেশেই সম্পন্ন হবে?
দ্বিতী। না, দৈত্যগুরু ভার্গব স্বকন্যাসহিত গোদাবরীতীরে পর্বতমুনির আশ্রমে অবস্থিত্তি কচ্যেন। সেই স্থলেই মহারাজের বিবাহকার্য্য নিৰ্ব্বাহ হবে।
তৃতী। মহাশয়, এ পরম আহ্বাদের বিযয়, কেন না, এই চন্দ্রবংশীয় রাজগণ চিরকাল দেবমিত্র, অতএব মহারাজ দৈত্য-দেশে প্রবেশ করলে বিবাদ হবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল।
দ্বিতী। বোধ হয়, ঋষিবর ভার্গব সেই নিমিত্তেই স্বীয় আশ্রম পরিত্যাগ করে পর্বত মুনির আশ্রমে কন্যাসহিত আগমন করেছেন। (নেপথ্যাভিমুখে। অবলোকন করিয়া) ও কে হে? রাজমন্ত্রী নয়?
তৃতী। আজ্ঞা হা, মন্ত্রী মহাশয়ই বটেন।
(মন্ত্রীর প্রবেশ।)
মন্ত্রী। (স্বগত) অন্য অনন্তদেব ত আমার স্কন্ধেই ধরাভার অর্পণ করে প্রস্থান কল্যেন।
প্রথ। (মন্ত্রীর প্রতি) হে মন্ত্রিবর, মহারাজ কতদিনের নিমিত্ত স্বদেশ পরিত্যাগ কল্যেন?
মন্ত্রী। মহাশয়, তা বলা সুকঠিন। শ্রুত আছি, যে গোদাবরীতীরস্থ প্রদেশসকল পরম রমণীয়। সে দেশে নানাবিধ কানন, গিরি, জলাশয় ও মহাতীর্থ আছে। মহারাজ একে ত মৃগয়াসক্ত, তাতে নূতন পরিণয় হলে মহিষীর সহিত সে দেশে কিঞ্চিৎ কাল সহবাস ও নানা তীর্থ পৰ্য্যটন না করে, বোধ হয়, স্বদেশে প্রত্যাগমন করবেন না।
দ্বিতী। এ কিছু অসম্ভব নয়। আর যখন আপনার তুল্য মন্ত্রিবরের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করেছেন, তখন রাজকাৰ্য্যেও নিশ্চিন্ত থাকবেন।
মন্ত্রী। সে আপনাদের অনুগ্রহ! আমি শক্ত্যনুসারে প্রজাপালনে কখনই ক্রটি করবো না। কিন্তু দেবেন্দ্রের অনুপস্থিতিতে কি স্বৰ্গপুরীর তেমন শোভা থাকে? চন্দ্র উদিত না হলে কি আকাশমণ্ডল নক্ষত্রসমূহে তাদৃশ শোভমান হয়? কুমার ব্যতিরেকে দেবসৈন্তের পরিচালনা কত্যে আর কে সমর্থ হয়?
দ্বিতী। তা বটে, কিন্তু আপনিও বুদ্ধিবলে দ্বিতীয় বৃহস্পতি। অতএব আমাদের মহীন্দ্রের প্রত্যাগমনকাল পর্য্যন্ত যে আপনার দ্বারা রাজকাৰ্য্য সুচারুরূপে পরিচালিত হবে, তার কোন সংশয়ই নাই। (কর্ণপাত করিয়া) আর যে কোন শব্দ শ্রুতিগোচর হচ্যে না? বোধ করি, মহারাজ অনেক দূরে গমন করেছেন। আমাদের আর এ স্থলে অপেক্ষা করার কি প্রয়োজন? চলুন, আমরাও স্ব স্ব গৃহে গমন করি।
মন্ত্রী। হা, তবে চলুন।
[ সকলের প্রস্থান।
ইতি দ্বিতীয়াঙ্ক।