লাইনেই ছিলাম বাবা

লাইনেই ছিলাম বাবা (রচনা ১৯৯০-৯৩। প্রকাশ ১৯৯৩)

স্তব

তুমিই আবর্ত, তুমি পিণ্ড, তুমি লূতাতন্তুজাল
নিশ্বাসপরিধি, তুমি মজ্জাভুক বোধেন্দুবিনাশ

তুমিই নৈবেদ্য, তুমি ফুলজল, বিগ্রহও তুমি
তোমারই বিশাল শবে আমাদের জন্মনীল ভূমি

তুমি যা রচনা করো তা-ই একমাত্র সত্য জানি
তাছাড়া, অন্ধের কাছে কীবা রাত্রি কীবা দিন, তাই

তোমার ধ্বনির ঝড়ে ভুলে যাই নিজেদের নাম
বানানো কাঠের হাত সবধারে অগাধ অটুট

তোমার ইশারামাত্র সুতোটানা সালাম সালাম
তোমার ইশারামাত্রে দশচক্রে ভগবান ভূত

তুমিই আবর্ত, তুমি পিণ্ড, তুমি চমৎকার চিতা!

*

মত

এতদিন কী শিখেছি একে একে বলি, গুনে নাও।
 মত কাকে বলে, শোনো। মত তা-ই যা আমার মত।
 সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ,
জ্ঞানীও সে, এমনকী আপনলোক, প্রিয়। তার চাই
 দু-পাঁচটি পালকলাগানো টুপি, ছড়ি, কেননা সে
আমার কাছেই থাকে আমার মতের পাশে পাশে।
না-ই যদি থাকে তত? যদি তার ভিন্ন কোনো মতি
জেগে ওঠে মাঝে মাঝে অন্য কোনো দুষ্টু হাওয়া লেগে?
তবে সেই মতিচ্ছন্ন তোমার শরীর ঘেঁষে যাতে
না আসে তা দেখতে হবে। জানবে-বা কীভাবে তাকে লোকে?
সব পথ বন্ধ করে রেখে দেব- হাঙ্গামায় নয়–
চৌষট্টি কলায়। আমি কত কলা শিখেছি তা জানো?

*

চরিত্র

কিছুটা গুলিয়ে গেছে। ঘোড়ার সামনেই গাড়ি জোতা।
অবশ্য নতুনও নয়, এ-রকমই সনাতন প্রথা–
 বুঝতে একটু দেরি হয়, কোনটা পথ, কোথায় বা যাব
আসলে যাওয়াই কথা, হোক-না সে যাওয়া জাহান্নামে।
ধরো কেউ নিজে থেকে দিতে চায় সব, তা বলে কি
বসে থাকা সাজে? তার টুটি ছিঁড়ে নিয়ে এসো কাছে।
 আমাকেই বলতে পারো ঈশ্বরের প্রথম শরিক
করতে পারি সব যদি সঙ্গে থাকে সপ্রেম বুলেট।
 ক্ষমতার উৎস থেকে ক্ষমতার মোহনা- যা বলো–
সে কেবল ক্ষমতাকে দাপিয়ে বেড়ানো ক্ষমতায়।
 এত ছোটোখাটো কাণ্ডে কেঁদেকেটে মাথা হবে হেঁট?
 চরিত্রই নেই যার তার আবার ধর্ষণ কোথায়?

*

লাইন

লাইনেই ছিলাম বাবা, লহমার জন্য ছিটকে গিয়ে
খুঁজেই পাই না আর নিজেকে– কী মুশকিলে পড়েছি!
এটা তো আমারই টিন? আমার না? এটাই আপনার?
সবই দেখি একাকার। আমি তবে কোথায় রয়েছি!
এ কী হচ্ছে? সরে যান-না! আরে আরে– আমরা কি আলাদা?
দেখছেন তো সবকটা এই একসঙ্গে জাপটানো দড়ি বাঁধা।
 থামুন না! তুমি কে হে? আমি? হেই। হোই হেই হাট।
প্রতিবাদ? না না বাপু- কিছুই করছি না প্রতিবাদ।
 কোনোমতে ফিরে যাব ফাঁকা টিন বাজিয়ে সহজে–
 আগুনই কোথাও নেই- কী হবে-বা জ্বালানির খোঁজে।

*

বোঝা

হঠাৎ কখনো যদি বোকা হয়ে যায় কেউ, সে তো নিজে আর
বুঝতেও পারে না সেটা। যদি বুঝতই তাহলে তো বুঝদারই
বলা যেত তাকে। তাই যদি, তবে
তুমিও যে বোকা নও কীভাবে তা বুঝলে বলো তো?

*

বেলেঘাটার গলি

যা দেখি সব চমকপ্রদ, মুন্ডু আছে মাথায়
 চৌরাস্তায় চিৎ হয়েছি ছেঁড়া জরির কাঁথায়

চক্ষুও নেই কর্ণও নেই হাত নেই নেই পা-ও
একটাদুটো পয়সা পেলে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাও

পিঠের নীচে ইটের খোঁচা বুকের উপর ফলা
আকাশ তবু পালিশ তবু নদী রজস্বলা

হুকুম দিলে খুলতে পারি বুকের কটা পাঁজর
বলতে পারি, বাজো বাঁশি, আপন মনে বাজো–

আর তাছাড়া সবটা কথা কেমন করে বলি
বাইরে লেনিন ভিতরে শিব বেলেঘাটার গলি!

*

ন্যায়-অন্যায় জানিনে

তিন রাউন্ড গুলি খেলে তেইশজন মরে যায় লোকে এত বজ্জাত হয়েছে!
 স্কুলের যে ছেলেগুলি চৌকাঠেই ধ্বসে গেল অবশ্যই তারা ছিল সমাজবিরোধী।

ওদিকে তাকিয়ে দেখো ধোয়া তুলসীপাতা
উলটেও পারে না খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়
আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছুই জানে না বুলেটেরা
 দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দেখে মাঝে মাঝে।

পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।

*

তুমি কোন্ দলে

বাসের হাতল কেউ দ্রুত পায়ে ছুঁতে এলে আগে তাকে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দলে
ভুখা মুখে ভরা গ্রাস তুলে ধরবার আগে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দলে
পুলিশের গুলিতে যে পাথরে লুটোয় তাকে টেনে তুলবার আগে জেনে নাও দল
তোমার দুহাতে মাখা রক্ত কিন্তু বলো এর কোন্ হাতে রং আছে কোন্ হাতে নেই
 টানেলে মশালহাতে একে ওকে তাকে দেখো কার মুখে উলকি আছে কার মুখে নেই
কী কাজ কী কথা সেটা তত বড় কথা নয় আগে বলো তুমি কোন্ দল
কে মরেছে ভিলাইতে ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে কে ছুটেছে কার মাথা নয় তত দামি
ঝন্‌ঝন্ ঝনঝন্ নাচ হবে কোন্ পথে কোন্ পথ হতে পারে আরো লঘুগামী
বিচার দেবার আগে জেনে নাও দেগে দাও প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল
 আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল
 রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন্ দল তুমি কোন্ দল