আদিম লতাগুল্মময়

আদিম লতাগুল্মময় (রচনা ১৯৭০-৭১। প্রকাশ ১৯৭২)

পাথর

পাথর, নিজেই আমি দিনে দিনে তুলেছি এ বুকে
আজ আর নামাতে পারি না!

আজ অভিশাপ দিই, বলি, ভুল নেমে যা নেমে যা
আবার প্রথম থেকে চাই
দাঁড়াবার মতো চাই যেভাবে দাঁড়ায় মানুষেরা

মাথায় উধাও দিন হাতের কোটরে লিপ্ত রাত
কী ভাবে বা আশা করো মন বুঝে নেবে অন্য লোকে
সমস্ত শরীর জুড়ে নবীনতা জাগেনি কখনো

মুহূর্ত মুহূর্ত শুধু জন্মহীন মহাশূন্যে ঘেরা
কার পূজা ছিল এতদিন?
একা হও একা হও একা হও একা হও একা

আজ খুব নিচু করে বলি, তুই নেমে যা নেমে যা
পাথর, দেবতা ভেবে বুকে তুলেছিলাম, এখন
আমি তোর সব কথা জানি!

*

অবিমৃশ্য বালি

পথে এসে মনে পড়ে বন্ধু বলেছিল এই সবই।

 বলেছিল, যা, কিন্তু সমস্ত লাবণ্য তোর হেলায় হারাবি।
 দুপুরের বিষ লেগে নষ্ট হয়ে যাবে দুই চোখ
বিকেলের মতো খুব নিরাশ্বাস হয়ে যাবে মাথা
গায়ের কলঙ্ক যেন নিশীথের হাজার তারার
দাহ নিয়ে জ্বলে যায়, আর
নিজেই নিজেকে খুঁড়ে দিন-দিন পাবি অন্তহীন
অবিমৃশ্য বালি–

আমাকে ঠকালি যদি, নিজেকে তো এতটা নামালি!

*

বিষ

হাত খুলে দেখা গেল হাতে কিছু নেই
এবার তাহলে খোলো পা

খোলা হলো পা
 তাও নেই! তাহলে কি মাথা? খোল মাথা

তার পরে একে একে খোলা হলো মাথা ঘাড় বুক পিঠ উরু
কোনোখানে নেই কোনো বিষ।

কিন্তু যেই জুড়ে দিই, দুই চোখ হয়ে ওঠে ঈষৎ কপিশ
গোল হয়ে ফুলে ওঠে হলুদ শরীর, ঝুল হয়ে
খুলে পড়ে নিরেট আঙুল

মাথা ঘাড় বুক পিঠ হাত পা বা উরু
একযোগে কেঁদে ওঠে, বিষ বিষ বিষ
 ঢেলে দাও সমস্ত অগুরু- ঢালো- খোলো

খোলা হলো হাত। না, হাতে কিছু নেই
এবার তাহলে খোলো গা।

*

পুতুলনাচ

এই কি তবে ঠিক হলো যে দশ আঙুলের সুতোয় তুমি
ঝুলিয়ে নেবে আমায়
আর আমাকে গাইতে হবে হুকুমমতো গান?

এই কি তবে ঠিক হলো যে বৃষ্টিভেজা রথের মেলায়
সবার সামনে বলবে ডেকে, ‘এসো
মরণকূপে ঝাঁপাও’?

আমার ছিল পায়ে পায়ে মুক্তি, আমার সহজ যাওয়া
এ গলি ওই গলি

আমার ছিল পথশ্রমের নিশানতোলা শহরতলি
 উত্তরে-দক্ষিণে

আমার চলা ছিল আমার নিজস্ব, তাই কেউ কখনো
 নেয়নি আমায় কিনে

এমন সময় তুমি আবিল হাত বাড়িয়ে যা পাও
স্বাধীনতায় দিচ্ছ গোপন টান–

এই কি তবে ঠিক হলো যে আমার মুখেও জাগিয়ে দেবে
 আদিমতার নগ্ন প্রতিমান?

*

দল

এই খোলা দুপুরে তোমার মুখে ধরেছি বিষের ভাঁড় তুমি খেয়ে নাও
এই খোলা দুপুরে তোমার মুখে ধরেছি বিষের ভাঁড় তুমি খেয়ে নাও
আমার চোখের সামনে তোমার পতন হোক আদিম, লতাগুল্মময়

আমার চারদিকে দল মাথার ভিতরে বা ধমনীতে বিঁধে যায় দল
দু-হাতে পেষণ করি দু-চোখ বন্ধ করে বিষের ভাঁড় তুমি খেয়ে নাও
তোমার শব নিয়ে বানাই দুর্গের প্রাকার

তোমাকে আদর করে তোমার শরীর ভরে জাগিয়ে দিয়েছি সব নীল ফল
এখন আমার তুমি নষ্ট হও তুমি ধ্বংস হও তুমি বিষ খাও
আমি যা বলি আজ হও তাই।

সব চুল খুলে দাও তোমার চুলে বেঁধে কণ্ঠনালি এসো ছিঁড়ে দিই
এই খোলা দুপুরে নিজের শরীরের আগুনে সব চুল জ্বেলে নাও
 ধ্বংস হও তুমি চেতনাহীন হও আমার হাতে তোলা বিষ খাও

বিষের ভাঁড় তুমি খেয়ে নাও

*

ক্রমাগত

এইভাবে হতে থাকে ক্রমাগত
 কেউ মারে কেউ মার খায়
ভিতরে সবাই খুব স্বাভাবিক কথা বলে
জ্ঞানদান করে

এই দিকে ওই দিকে তিন চার পাঁচ দিকে
 টেনে নেয় গোপন আখড়ায়  
কিছু-বা গলির কোণে কিছু অ্যাসফল্ট রাজপথে
সোনার ছেলেরা ছারখার

অল্প দু-চারজন বাকি থাকে যারা
তেল দেয় নিজের চরকায়
 মাঝে মাঝে খড়খড়ি তুলে দেখে নেয়
 বিপ্লব এসেছে কতদূর

এইভাবে, ক্রমাগত
এইভাবে, এইভাবে
ক্রমাগত

*

বিকেলবেলা

সারাদিনের পর অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি আজ বিকেলবেলা
আর স্বপ্ন দেখছি যে-স্বপ্ন দেখার কোনো কথা ছিল না আমার
যে, একটা নয় দুটো নয় তিন-তিনটে রুপোলি গোলক ঝকঝক করছে
ঢালু আকাশে
তার নিশ্বাস যতদূর পৌঁছয় ততদূরে টলে পড়ছে মানুষ।

 সবার মুখ তাই থমথমে আমি জিজ্ঞেস করি ওখানে কী, কী হয়েছে ওখানে
শুনে একজন বলে ও কিছু নয়, মা বলল জলের রঙে আগুন
 অনেকদিন আগে এ-রকমই হয়েছিল একবার, ঘরদুয়োর সব বন্ধ করে দাও
সেবার আর বাঁচেনি কেউ মড়কে ছেয়ে গিয়েছিল দেশ।

রুপোলি আলো পারদের মতো ঘন হয়ে এগিয়ে আসে আমার মুখের ওপর
যেন জল থেকে গাঢ়তর জলে ডুবে যায় সমস্ত শরীর
 কাগজে তৈরি আমার ভাইয়ের মুখ ঝুলে পড়ে কার্নিশ থেকে বাইরের হাওয়ায়
আর দেখতে দেখতে অবেলার ঘুম ভেঙে যায়, দু-চোখ ভার।

*

নিগ্রো বন্ধুকে চিঠি

রিচার্ড, তোমার নাম আমার শব্দের মধ্যে আছে
 রিচার্ড রিচার্ড।
কে রিচার্ড? কেউ নয় রিচার্ড আমার শব্দ নয়।

রিচার্ড, তোমার নাম আমার স্বপ্নের মধ্যে আছে
 রিচার্ড রিচার্ড।
কে রিচার্ড? কেউ নয় রিচার্ড আমার স্বপ্ন নয়।

রিচার্ড, তোমার নাম আমার দুঃখের মধ্যে আছে
 রিচার্ড রিচার্ড।
কে রিচার্ড? কেউ নয় রিচার্ড আমার দুঃখ নয়।

*

কলকাতা

বাপজান হে
কইলকাত্তায় গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে
আমিই কিছু জানি না

আমারে কেউ পুছত না
কইলকাত্তার পথে ঘাটে অন্য সবাই দুষ্ট বটে
 নিজে তো কেউ দুষ্ট না

কইলকাত্তার লাশে
যার দিকে চাই তারই মুখে আদ্যিকালের মজা পুকুর
শ্যাওলাপচা ভাসে

অ সোনাবৌ আমিনা
 আমারে তুই বাইন্দা রাখিস, জীবন ভইরা আমি তো আর
কইলকাত্তায় যামু না।

*

বোকা

আমি খুব ভালো বেঁচে আছি
 ছদ্মের সংসারে কানামাছি।

যাকে পাই তাকে ছুঁই, বলি
‘কেন যাস এ-গলি ও-গলি?

বরং একবার অকপট
 উদাসীন খুব হেসে ওঠ—’

শুনে ওরা বলে, ‘এটা কে রে
 তলে তলে চর হয়ে ফেরে?’

এমনকী সেদিনের খোকা
আঙুল নাচিয়ে বলে, ‘বোকা’!

সেই থেকে বোকা হয়ে আছি
শ্যামবাজারের কাছাকাছি।

*

সত্য

আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল যুবা
সদ্যপ্রেমে ঝাপসা, বিক্ষত।
পথের ভিড়ে মুখ লুকিয়ে কাল এক
 ভিখারি তাকে বলে গিয়েছে ডেকে :
 ‘দিনের বেলা একলা ঘুরি পথে
রাতদুপুরে সঙ্ঘে যাই ফিরে
সঙ্ঘে আমি একলা থাকি বটে
একার পথে সঙ্ঘ টের পাই।
 তোর কি আছি এমন যাওয়া-আসা?
 কর্মী, তোর জ্ঞানের বহু বাকি–
 আমাকে তুই যা দিতে চাস ভুল
 ফিরিয়ে নিই আমার ভাঙা থালা।
তা ছাড়া এই অবিমৃশ্য ঝড়ে
স্পষ্ট স্বরে বলতে চাই তোকে
 সত্য থেকে সঙ্ঘ হতে পারে
 সঙ্ঘ তবু পাবে না সত্যকে।’

*

চিতা

আজ সকাল থেকে কেউ আমাকে সত্যি কথা বলেনি
কেউ না
 চিতা, জ্বলে ওঠো

সকলেরই চোখ ছিল লোভে লোভে মণিময়
মুখে ফোটে খই
 চিতা, জ্বলে ওঠো

যা, পালিয়ে যা
বলতে বলতে বেঁকে যায় শরীর
 চিতা

একা একা এসেছি গঙ্গায়
জ্বলে ওঠো

অথবা চণ্ডাল
দেখাও যেভাবে চাও সমীচীন ছাইমাখা নাচ।

*

বিরলতা

তুমি আজ এমন করে কথা বলে মনে হয় শব্দ যেন শব্দের
সন্ন্যাসিনী

নীল বনপটভূমি ফলভরে নিয়ে যায় সৌরস্বভাবের দিকে
 দায়হীন

পাশে আছো না কি নেই বোঝা যায় না পদধ্বনি থাকা-না-থাকার খুব
মাঝখানে

কমণ্ডলু হাতে নিয়ে অনায়াসে সরে যাওয়া হাওয়ায় যেমন জল
ধ্বনিময়

টলটল চলে যায় তোমার আপন স্বর, বিরল, বিরল হ্রদে
ভাসমান

বিরলতা আনন্দের বিরলতা পূর্ণতার, তবু যদি একবার
 কথা বলো।

*

বৃষ্টিধারা

আমার মেয়েকে নিয়ে বুকজলে
যাবার সময়ে আজ বলে যাব :
 এত দম্ভ কোরো না পৃথিবী
রয়ে গেল ঘরের কাঠামো।

ঝাপটা ঝাপসা করে চোখ
হাহাকার উঠেছে, তা হোক
 রয়ে গেল মাটির প্রতিভা
 ফিরে এসে ঠিক বুঝে নেব।

ভয় দেয় উদাসীন জল
 মানুষের স্মৃতিও তরল
ঘোর রাতে আমাদেরই শুধু
বারে বারে করো ভিৎহারা?
সকলেই আছে বুকজলে
 কেউ জানে কেউ বা জানে না
আমাকে যে সহজে বোঝালে
প্রণাম তোমাকে বৃষ্টিধারা।

*

যৌবন

দিন আর রাত্রির মাঝখানে পাখিওড়া ছায়া
 মাঝে মাঝে মনে পড়ে আমাদের শেষ দেখাশোনা।

*

ত্যাগ

আমি খুব ভুল করে এ-রকম বৃষ্টিময় দিনে
 ঘর ছেড়ে পথে যাই, পথ ছেড়ে আনন্দ নদীর
নদী চায় আরো ত্যাগ পৃথিবীর সীমানা অবধি
ধারাময় হয়ে যায় আমাদের নির্ভার জীবন
যা-কিছু কলঙ্ক ছিল শূন্যে শূন্যে ধুয়ে যায় যেন
 কেবল জলের ভারে মাথা নিচু করে বলে জবা :
ও কি তবে ভুল করে ঘরের বিষাদ গেল ভুলে?

*

প্রেমিক

বহু অপমান নিয়ে কিছু-বা সম্মান নিয়ে আজ
শরীরসর্বস্ব হয়ে এসেছি বপনহীন নিশা–
ভোলাও ভোলাও তুমি মুছে নাও ধাতুমুখ, ক্ষত
ভোলাও শৈবাল এই ক্লীব আবরণ অপব্যয়
শব্দ নয় কথা নয় জলের ঘূর্ণিতে ব্যথা নয়
ভোলাও এ আত্মময় পাতালপ্রোথিত শল্যপাত
ভোলাও লুণ্ঠন, আমি ফিরে আসি, একবার বলো
তোমার দেবতা নেই তোমার প্রেমিক শুধু আছে!

*

ঠাকুরদার মঠ

এইখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি ডোবা পেরিয়ে ঝুমকাফুলের মাঝখানে
 ঠাকুরদার মঠ
চতুর্দশীর অন্ধকারে বুকের পাশে বাতি জ্বালিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি
একা
সবাই সব বুঝতে পারে কোন্ শেয়ালের কোথায় পথ পতনমুখে কীভাবে কে
হামলে দেয় গা
নিজের হাতে জ্বালিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি ছিল আমার তাই এখানে চুপ করে
দাঁড়াই
সবাই আমার মুখ দেখে না আমি সবার মুখ দেখি না
 তবু তোমার মঠ ছেড়ে যাই না
চতুর্দশীর অন্ধকারে তোমার বুকে আগুন দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি
একা
এইখানে চুপ করে এইখানে ডোবা পেরিয়ে ঝুমকাফুলের মাঝখানে
 ঠাকুরদার মঠ।

*

অঞ্জলি

ঘর যায় পথ যায় প্রিয় যায় পরিচিত যায়
সমস্ত মিলায়
এমন মুহূর্ত আসে যেন তুমি একা
দাঁড়িয়েছ মুহূর্তের টিলার উপরে, আর জল
সব ধারে ধাবমান জল
 প্লাবন করেছে সত্তা ঘরহীন পথহীন প্রিয়হীন পরিচিতহীন
আর, তুমি একা
এত ছোটো দুটি হাত স্তব্ধ করে ধরেছ করোটি
 মহাসময়ের শূন্যতলে–

জানো না কখন দেবে কাকে দেবে কতদূরে দেবে?

*

রেড রোড

খোলা আকাশের নীচে শুয়ে আছি ময়দানের গভীর তলদেশে
 যেন নক্ষত্র তুলে নেয় আমার নিভৃত নিশ্বাস

এই অন্ধকার মণ্ডলের গহন থেকে আমার শব্দহীন স্তব
যেন পুঞ্জে পুঞ্জে উঠে যায় স্বর্গীয় ঈথারে

আমাকে ভুল বুঝো না বলে দু-হাত ছড়িয়ে দিতে টের পাই
চোখের ঢালু বেয়ে নম্র ঘাসের মতো ক্ষীণ জলরেখা

 অল্পে অল্পে প্রাণ পেয়ে কেঁপে ওঠে হাওয়ায়
 জানি না বুকের কত নীচে নেমে যায় এর সর্বপায়ী শেকড়

কপালে হালকা পালক ছুঁয়ে বলে যায় রাত্রি :
এই মাটি তোমার শরীর, একে স্পর্শ করো, জানো–

আর অমনি দশ দিগন্ত ভেসে যায় উপচে পড়ে দু-চোখ
স্ফুরিত আনন্দে না কি দিশাহীন জলে

তারই পাশে রুল হাতে এগিয়ে আসে পুলিশ, বলে : ওঠো
অবৈধ তোমার এই একলা অসামাজিক শুয়ে থাকা–

আবার আমি নিচু হয়ে পায়ে পায়ে চলতে থাকি শহরের দিকে
 সামনেই ঝকঝকে রেড রোড।