লবঙ্গীর জঙ্গলে – ৫

সকাল হতে না হতে মেরামেণ্ডুলী থেকে ট্রাক এসে হাজির। জালকাঠ বোঝাই করে ভুবনেশ্বর ফিরবে ওরা। ট্রাকের ড্রাইভার বিষেণ সিং ও হেল্পার অশোককুমার ছবি ঠিকাদারের কাণ্ড শুনে চটেই অস্থির।

আমি হাতমুখ ধুয়ে আসতেই নারাণ চা দিল। বিষেণ সিং বলল, আমি বাবুকে গিয়ে বলব।

তারপর বলল, আপনি ওকে ছেড়ে দিলেন? বেঁধে রাখলেন না কেন?

আমি বললাম, মাতাল অবস্থায় মানুষ অসুস্থ থাকে, তখন সে মানুষ থাকে না। তাছাড়া ও তো আমার পায়েও পড়ল।

বিষেণ সিং হেসে বলল, ছবি নায়েক কখনই মানুষ থাকে না। চিজ একটি। আপনি ওকে চেনেন না বাবু। বিপদে পড়লে পায়ে পড়তে ওর এক সেকেণ্ড লাগে না, আবার বিপদ উদ্ধার হয়ে গেলে যার পায়ে পড়েছিল তার গলা টিপে ধরতেও এক সেকেণ্ড লাগে না। ও শালা জানোয়ারের চেয়েও ইতর।

ও শালা গাল-পোড়াকে আমি বহুদিন চিনি। শালা জাতহারামি। ওর আত্মসম্মান বলে কিছু নেই। ও গুয়ের পোকা।

বলেই, মাটিতে থুথু ফেলল, থুঃ করে।

তারপর উত্তেজনা প্রশমিত হলে বিষেণ সিং বলল, সারাদিন কাঠ লোড করে বিকেলের দিকে ওরা বেরিয়ে পড়বে। সন্ধের আগে পাহাড়ের ঘাঁটিটা পেরিয়ে যেতে চায়। ওর হেল্পারের বড় ভূতের ভয়।

আমি জানতাম, বিষেণ সিংরা ক্যাম্পে থাকতে ছবি নায়েক কোনো ঝামেলা পাকাতে পারবে না। তাছাড়া এসব লোকের স্বভাব সাপের মতোই হয়। বাঘের মতো নয়। এরা মুখোমুখি প্রতিশোধ নেয় না। অনেক দিন ধরে মতলব আঁটে। অপেক্ষা করে, তারপর সর্পিল গতিতে এগোয়। চোরা পথে।

চা খেয়ে চন্দনীকে বলে আমি বেরিয়ে পড়লাম। কম্ফু আমার ওঠার অনেক আগেই বেরিয়ে গেছিল।

ক্যাম্পটার সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে সেটা সৌমেনবাবুদেরই বানানো। তার সমান্তরালে আরও একটু উপর দিয়ে বনবিভাগের পথ চলে গেছে। বাঁ দিকে আঁকাবাঁকা পথে মাইল পাঁচেক গেলে লবঙ্গী ফরেস্ট রেস্ট-হাউস। বাঁ দিকে একটা মোড় পেরিয়ে সোজা গেলে, বরাবর গভীর খাদ বাঁদিকে রেখে পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে রাস্তাটা সেগুন প্ল্যানটেশানের ভিতরে। যেখানে বাইসনদের আড্ডা। আর ডানদিকে নেমে গেলে রাস্তাটা অনেক মাইলের চক্কর ঘুরে এসে আবার মিশেছে লবঙ্গীর রাস্তায়। এখান দিয়ে একটা পথ দিয়ে টুল্বকার জঙ্গলেও গিয়ে পড়া যায়।

বড় গাছের নীচে নীচে অর্গুন গাছ। কার্তিক মাঘ মাসে অর্গুনের ফল ধরে। সুপুরীর মতো দেখতে ফলসা-রঙা জলপাই-এর মতো স্বাদ! টক্ করে খায় জঙ্গলের লোকেরা। অর্গুনের পাতাগুলো ভারী সুন্দর দেখতে। চেরা-চেরা ঘন সবুজ পাতা। অর্গুনের কচি পাতাও বর্ষাকালে টক্ করে খায় জংলী লোকেরা! এই ফল বিছানায় রাখলে ছারপোকা হয় না।

এখন জঙ্গলে পত্রশূন্য গেণ্ডুলি গাছগুলোকে বড় সুন্দর দেখায়। এ অঞ্চলে গেণ্ডুলি গাছ হয়ও অজস্র। এই গেণ্ডুলির ডালের আঠা থেকে পলিস্টার ফাইবার হয়। প্রতি বছর তাই ইজারা হয় এই জঙ্গল। কুসুম গাছের লাল ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে চারিদিক। শিমুল, পলাশও ফুটেছে অনেক। বাঁশ-গাছে ফুল ফোটা শেষ। কিন্তু আমগাছে বোল এসেছে। তার মিষ্টি গন্ধে সকাল মন্থর হয়ে আছে। এখানে এত বড় বড় ও পুরোনো আমগাছ যে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না তারা কত পুরোনো। কত যে বয়স তাদের তা কে বলবে। সাদা সাদা ফুল ফুটেছে গাছে। আদিগন্ত লাল ফুলের মাঝে মাঝে এই সাদা ফুলগুলোকে ভারী ভালো দেখাচ্ছে।

কী দারুণ শান্ত, স্তব্ধ অথচ কী প্রাণবন্ত এই আদিগন্ত নিসর্গ ছবি। কোনোদিনও কোনো মানুষ শিল্পী, কোনো ভবিষ্যতের ক্যামেরা বা টি. ভি. এই ছবি আঁকতে পারবে না, ধরে রাখতে পারবে না। একমাত্র জীবন্ত মানুষের সমস্ত ইন্দ্ৰিয় দিয়েই এই চৈত্র-সকালের গন্ধ শব্দ রূপ অনুভব করা যায়। এই দেখা, শোনা, বা সুবাসের কোনোই বিকল্প নেই। আমি তো বুঁদ হয়ে যাই সব সময়।

কোনো নেশা, কোনো নারীর নৈকট্য, পৃথিবীর কোনো প্রার্থিত বস্তুই আমার কাছে প্রকৃতির কাছে থাকার চেয়ে বড় বলে মনে হয় না। কোনোদিনও।

চারধারে নজর করতে করতে চলেছি। চন্দ্রকান্ত নিশ্চয়ই কোনো গুহায় লুকিয়ে রয়েছেন। সামনের পাহাড়ের গুহাগুলো খুব উঁচুতে, তাছাড়া ওদিকে পাহাড় একেবারে খাড়া। ঐ গুহাতে ভালুক অথবা শম্বর ছাড়া আর কারো পৌঁছনো সম্ভব নয়। বাঘ কি চিতা পারে হয়তো। কিন্তু যে ফেরারি মানুষের বারবার জঙ্গলে আসতে হবে গুহা থেকে বেরিয়ে, সে কখনও ঐ গুহায় আশ্রয় নেবে না।

সামনে একটা নালা, পথ কেটে গেছে। নালার একদিক চলে গেছে পাহাড়ের দিকে—যেখান থেকে নেমেছে নালাটা। অন্যদিকে গভীর উপত্যকা। এ জায়গাটা আমাদের মাঠিয়াকুদু নালার ক্যাম্প থেকে মাইল খানেক দূরে হবে।

হঠাৎ নালার ভেজা বালিতে একটি রাবারের জুতোর ছাপ দেখলাম। এ-অঞ্চলে জুতো-পরা লোক বেশি আসে না। এদিকটায় কোনো ক্যুপও নেই যে কোনো মুহুরীরা আসবে এ দিকে। তবে আসতেও পারে। জঙ্গলে এক মাইল কোনো দূরত্বই নয়।

কি মনে হওয়াতে আমি ঐ জুতোর দাগ অনুসরণ করে উপত্যকায় নেমে গেলাম। গরমের দিনে গুহায় থাকার চেয়ে উপত্যকার ছায়ায় থাকাই হয়তো ঠিক করেছেন চন্দ্রাকন্ত।

একটা খবরে খুবই বিচলিত আছি সকাল থেকে। বিষেণ সিং বলছিল, অংগুলে, মেরামেণ্ডুলীতে, করপটায়, পূর্ণাগড়ে, পূর্ণাকোটে, এমনকি শম্পাশরের মোড়েও পোস্টার দিয়েছে বনবিভাগ যে, যে চন্দ্রকান্তকে ধরিয়ে দেবে সে পাঁচশো টাকা পাবে। পাঁচশো টাকা, এখানে অনেক টাকা। যেখানে পাঁচ-দশ টাকায় সারারাত একজন নারীকে পাওয়া যায়, দেড়-দু টাকায় প্রচণ্ড পরিশ্রম করে একজন লোক সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়, সেখানে পাঁচশো টাকার জন্য মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে।

চন্দ্রকান্তকে এখান থেকে কোনোক্রমে সরিয়ে নিতে না পারলে চন্দ্রকান্ত আজ কি কাল গ্রেপ্তার হবেনই। গ্রেপ্তার করতে পারলে উদাহরণের কারণে খুব দীর্ঘ দণ্ডাদেশ যে হবে তার সে বিষয়েও সন্দেহ নেই।

এতসব কথা ভাবতে ভাবতে নালা দিয়ে নামছিলাম, হঠাৎ একটা নুড়ি গড়িয়ে পড়ার শব্দে চমক ভাঙল! নুড়িটা নালার বাঁদিকে খাড়া পাড় থেকে গড়িয়ে পড়ল। জলে কতগুলো ছোট ছোট ঢেউ উঠল।

একটা গর্ত মতো হয়েছিল, তাতে জল জমেছিল। সেখানে কতগুলো ব্যাঙাচি ও ছোট পাহাড়ী মাছ খেলা করছিল। সেই গর্তের মধ্যে পড়ল নুড়িটা। ব্যাঙাচিগুলো জলছড়া দিয়ে এদিকে থেকে ওদিকে গেল, আবার ওদিক থেকে এদিক। মাছগুলো জলের গভীরে চলে গেল। রোদ পড়ে জলের তলায় তাদের সঞ্চরমাণ শরীরে রোদটা লাফিয়ে উঠল ইয়ো-ইয়োর মতো।

আমি মুখ তুলে তাকালাম ওদিকে। তাকাতেই দেখি, নালায় খাড়া পাড়ে একজন মানুষের পায়ের দাগ। সেটা জুতো পরা মানুষের, না খালি পায়ের বুঝলাম না; কারণ সে তাড়াতাড়িতে পাড়ে ওঠায় মাটি খসে গেছিল সেখান থেকে। নুড়িটা সেই মাটির ভেতর থেকেই গড়িয়ে এসেছে। একটু পরেই নালার ভিতরে নরম জল-ভেজা মাটিতে জুতোর গভীর দাগ দেখতে পেলাম।

আমি তাড়াতাড়ি ঐ দাগ অনুসরণ করে উপরে উঠলাম, যথাসম্ভব কম শব্দ করে। উঠেই, সামনে হাত তিরিশেক দূরে একজন মানুষকে একটা শিমুল গাছের আড়ালে বাঁক নিয়ে মিলিয়ে যেতে দেখলাম।

লোকটার পোশাক খাকি। বেশ শক্ত সমর্থ মাঝারি চেহারা। আমি তার পেছনটা মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম শুধু।

দেখেই আমি লুকিয়ে পড়লাম গাছের আড়ালে। খুব ভাবনা হল আমার। লোকটা কে হতে পারে? লোকটা চন্দ্রকান্ত হতেই পারে না। লোকটা কম্ফুও নয়। তবে কি লোকটা পুলিশের লোক। চন্দ্রকান্তকে ধরবার জন্যে কোনো লোক কি এই বিপদসঙ্কুল জঙ্গলে আমারই মতো তার খোঁজে এসেছে একা একা। কিন্তু যত বড় গোয়েন্দাই সে হোক না কেন, এ-জঙ্গলে যে শিকারি নয়, যে ছোটবেলা থেকে বনে জঙ্গলে না ঘুরেছে, তার পক্ষে শুধু পুলিশি বিদ্যা নিয়ে একা-একা চন্দ্রকান্তর পিছু নেওয়া সম্ভব নয়।

না কি লোকটা চন্দ্ৰকান্তই? আমি কি ভুল করলাম?

আমার অঙ্ক সব গোলমাল হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা এখন অনেক জটিল হয়ে পড়ল। চন্দ্রকান্ত, ছবি নায়েক, এই খাকি পোশাকের লোকটা, পুলিশ, বনবিভাগ—এ রীতিমত গোলকধাঁধায় পড়া গেল।

একবার মনে হল চন্দনী যাই-ই বলুক, আমি ওকে বিড়িগড়ে ওর আত্মীয়- স্বজনের কাছে পৌঁছে দিয়ে কোলকাতা ফিরে যাই। কে ঘরের খেয়ে অফিসের ছুটি নষ্ট করে এই গোলক-ধাঁধায় ঘুরে মরবে দিনের পর দিন? যে লোক নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে এমন করে অসহায় অসম্মানের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে, তার প্রতি অথবা তার স্ত্রীর প্রতিই বা আমার কর্তব্য কি? আমি তাদের কে যে এই অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপারের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলব?

আস্তে আস্তে বড় রাস্তায় ফিরে এলাম। এখানে আমি নিরাপদ। বড় রাস্তা দিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছি। কেউ যদি দেখেও ফেলে, সন্দেহের কিছু নেই।

এদিক ওদিক আরো কিছুটা ঘোরাঘুরি করে যখন ক্যাম্পে ফিরলাম, তখন অনেক বেলা।

ফিরে দেখলাম, চন্দনীকে রত্নাকরের দলবল আগের থেকে অনেক সহজ করে নিয়েছে। রত্নাকরকে দেখলাম না। ক্যাম্পের আঙিনা কাঁচা অর্গুন পাতার ঝ্যাঁটা দিয়ে ঝাড়ু দিচ্ছে চন্দনী। জলের ছিটে দিয়ে ধুলো মারছে চারদিকের।

দেখে খুব ভালো লাগল। নারাণকে আর এক কাপ চা খাওয়াতে বলে, একটা বড় প্রায় একশো বছরের পুরোনো আমগাছের হাতীর পেটের সমান মোটা গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে, মাথা থেকে ক্যাপটা খুলে ফেলে পাইপে তামাক ভরতে লাগলাম আমি। এখন অনেক অনেক ভাবার আছে আমার। ভেবে কোনো কূলকিনারা পাব কিনা জানি না, কিন্তু চন্দ্রকান্ত মহা ঝামেলায় ফেললেন!

নারাণ চা দিয়ে গেছে। গয়ে চুমুক দিচ্ছি, আর পাইপ খাচ্ছি আর ভাবছি। চায়ে বড় দুধ-চিনি দেয় এরা। নারাণরা দুধকে বলে ক্ষীর। গরুর দুধ নয়, টিনের দুধ। গরুর দুধ হয়তো পাওয়া যেত লবঙ্গী বস্তি গেলে, কিন্তু এখানে দুগ্ধ-পোষ্য এমন কেউ নেই যার গরুর দুধ না হলে চলে না। কম্ফুর ছেলে আছে অবশ্য, দেড় বছরের, কিন্তু এরা মায়ের বুকের দুধ ছাড়া অন্য কোনো দুধ খাওয়ার ভাগ্য করে আসেনি। ভগবান করুন, মায়ের বুকের দুধ খেয়েই যেন এরা মরদ হয়ে ওঠে।

হঠাৎ ঢিক্‌-চুঁই, ঢিক্ চুঁই-ই-ই-ই করে পর পর দুবার আওয়াজ হল রাইফেলের।

সামনের পাহাড়ের ওদিকে ঢালে হল আওয়াজটা। পাহাড়ে পাহাড়ে গাছ-পালায় ধাক্কা খেয়ে আওয়াজটা উপত্যকার গভীরে হারিয়ে গেল। তারপর আবার চুপচাপ

রত্নাকর কাজে গেছিল ক্যুপে। নারাণ কচি শিমুলের মূল আর লাল আলু দিয়ে একটা নতুন পদ রান্না করতে ব্যস্ত ছিল। চন্দনী আঙ্গিনা নিকোনো সেরে নালার নীচের দিকে, যেদিকে বড়-বড় পাথরের আড়াল আছে, সেখানে চান করতে গেছিল। কম্ফুর ছেলেটা হামাগুড়ি গিয়ে, হেঁটে ওদের ঝুপড়ির সামনে ধুলোর মধ্যে বসে একটা ফেলে দেওয়া এক-লিটারের মবিলের টিন নিয়ে খেলা করছিল। ওর মা ছিল না সেখানে। জঙ্গলে গেছিল কাঠ কুড়োতে। মূল খুঁড়তে।

গুলির আওয়াজে নারাণ দৌড়ে এল। ছেলেটা চমকে উঠে এক মুঠো ধুলো পুরে দিল মুখে।

আমি নারাণকে শুধোলাম, এখানে শিকারি এসেছে?

নারাণ বলল, শিকারি কোথায়? বাবু, দু-বছর মাংস খাইনি। শিকার হলে পাঁচ ক্রোশ দৌড়ে যাব মাংসের জন্যে। যদি শিকার হয় তো ভালোই।

বিষেণ সিং সর্দারজী কাছেই কোথাও ছিল। তাড়াতাড়ি লুঙ্গি এঁটে নাগরা পায় এল, বলল, কা বাত বাবু?

আমি বললাম, তুমি একটু থেকো বিষেণ সিং! আমি জিপটা নিয়ে একটু ঘুরে আসছি। যাব আর আসব।

জিপটার কারবরেটারে ময়লা এসেছে। স্টার্ট নিতে একটু গাঁইগুই করল। তারপর স্টার্ট নিতেই চড়াইটা উঠে এগিয়ে গেলাম। কোনো ঠিকাদার গত বছরে পাহাড়ের মাথায় যাওয়ার একটা পথ বানিয়েছিল কাঠ নামাবার জন্যে। এখন পথটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ঘাস পাতা ঝোপ-ঝাড় গজিয়েছে পথের মাঝে। কিন্তু জিপ চলে যায়।

ঐ পথ ধরে ফার্স্ট গিয়ারে আস্তে আস্তে উঠতে লাগলাম ঘুরে ঘুরে

পাহাড়ের উপরে জঙ্গল অপেক্ষাকৃত ফাঁকা—শুধুই মই গাছ আর কুসুম গাছ। মনে হয়, উপরে মালভূমির মতো আছে, অনেকখানি জায়গা সমতল। কাল বিকেলে কম্ফুকে ঐ দিক থেকেই আসতে দেখেছিলাম। কে ওখানে রাইফেল দিয়ে গুলি করল তা জানবার কৌতূহলও কম হল না।

পাহাড়ের মাঝামাঝি উঠেছি, এমন সময় আবার একবার গুলির আওয়াজ শুনলাম। এবারে ঢিক্-চুঁই-ই-ই নয় ঢপ্ করে আওয়াজটা হল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে রাইফেল ছুঁড়েছে এবার। আওয়াজটা দম বন্ধ হয়ে বেরুল গাছ-পালার গভীর থেকে।

জিপটা দাঁড় করিয়ে, জিপ থেকে নেমে যেদিক থেকে আওয়াজটা হল, সেদিকে চেয়ে রইলাম, জিপের আড়ালে শরীরটাকে লুকিয়ে রেখে।

হঠাৎ সামনের জঙ্গলে কাউকে দৌড়ে আসতে শুনলাম। ডালপাতা আন্দোলিত হচ্ছিল, আওয়াজটা এগিয়ে আসছিল, জিপের দিকে।

তাড়াতাড়ি জিপ ছেড়ে সরে গিয়ে একটা বড় শিমুল গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। লুকিয়ে পড়তে-পড়তে কোমর থেকে পিস্তলটা খুলে নিয়ে, সেফটি ক্যাচের উপরে আঙুলটা ছুঁইয়ে রাখলাম।

আওয়াজটা আরো কাছে এল। পরক্ষণেই দেখি, কম্ফু জঙ্গল ফুটে বেরুল। মুখে ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট।

ও জিপের কাছে এসে জিপের আরোহীর সন্ধান করল। কাউকে দেখতে না পেয়ে আরো ভয় পেয়ে গেল। কোনদিকে দৌড়বে এবার তা বুঝতে পারল না।

আমি ওকে চাপা গলায় ডাকলাম, কম্ফু।

কম্ফু আমাকে দেখতে পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

বলল, আলো-বাপ্পালো! তুমি! তাই বলো! আমি ভাবলাম, কার-না-কার জিপ বুঝি?

আমি বললাম, গুলি হল কিসের? কে গুলি করল?

-তা দিয়ে তোমার কি হবে বাবু? মাংস খাবে তো এসো।

আমি বললাম, জেলে যাবার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?

কম্ফু বলল, প্রাণে বাঁচলে, তারপর সব। কতদিন মাংস খাইনি, তা জানো?

আমি ওর পিছনে পিছনে জঙ্গলের ভিতরে গেলাম। অনেকখানি ভিতরে গিয়ে, কম্ফু দু-হাত দিয়ে ঝোপ-ঝাড় ফাঁক করে দেখাল।

দেখি একটা অতিকায় শম্বর ঘাড় নেতিয়ে পড়ে আছে। শিং দুটি প্রকাণ্ড। এতবড় শিঙাল খুব কম দেখেছি।

কম্ফু বলল, এবার চলো।

ক্যাম্পে এসে খবর দিল কম্ফু। তারপর নারাণকে বলল, তুই ক্যুপে খবর দে। আজ ভোজ।

নারাণ গেরুয়া গামছা পরে, এক হাতে খুন্তি নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। মাংসের কথায় ওর মুখ-চোখের ভাব এমন হল যে, তা না দেখলে বোঝানো যাবে না! মানুষ যে কত বুভুক্ষু, কত মাংসলোলুপ হতে পারে তা যারা নারাণদের মতো হতভাগা লোকদের স্বচক্ষে না দেখেছে তারা কখনও জানবে না। বড় কষ্ট হয় ওদের দেখলে।

নারাণ শুধোলো, কে মারল রে কম্ফু?

কম্ফু বলল, তাতে তোর দরকার কি রে শালা?

নারাণ বলল, ঠিক, ঠিক। আমার একটু মাংস পেলেই চলবে। আর কিছু জানতে চাই না আমি।

নারাণ কম্ফুর বউ আর চন্দনীকে রান্নার ভার দিয়ে নিমেষের মধ্যে জঙ্গলের পাকদণ্ডী দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ক্যুপে গিয়ে ক্যুপকাটা কুলিদের খবর দেবে।

আজ কাজ বন্ধ। সকলে মিলে শম্বরটাকে কাটাকুটি করবে মাংস ভাগ করবে। আজ বড় খুশির দিন ওদের। বেলা হয়েছে বেশ। একটা মন্থর, আলস্য-ছড়ানো হাওয়া উঠেছে বনে-বনে। বাঁশে বাঁশে কট্‌কটি আওয়াজ। ঝরা পাতার উসখুসানি। মৌটুসী পাখির ফিফিস্ আধো-আধো ডাক। হাওয়ায় গাছ-গাছালির পাতা দুলছে, রোদ কাঁপছে, পাতাগুলোয় প্রতিফলিত হচ্ছে দিকে দিকে। হলুদ বসন্ত ডাকছে নালার গভীর থেকে। একটা বাদামী রঙের বড় লেজঝোলা কুম্ভাটুয়া নালার ঐ পাড়ে জলের পাশে পাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে! তার গায়ে রোদ পড়ে এমন ঝকঝক করছে যে ওদিকে তাকালে চোখ বেঁধে যায়। উজানে নালার মধ্যে একটা বড় গর্ত আছে। বড়-বড় কালো-কালো পাথর সেখানে। একটা দহর মতো। পাহাড়ী পুঁটির ঝাঁক, যেখানে চন্দনী একটু আগে চান করতে গেছিল। কোথা থেকে খোঁজ পেয়ে একটা ঘন নীল আর লালে মেশা ছোট মাছরাঙা ছোঁ মেরে মেরে মাছ খাচ্ছে সেখানে। সামনের পথের উপরে একটা ফড়িং-খাওয়া পাখি লেজ দুলিয়ে উড়ে উড়ে খয়েরী রঙা ফড়িংগুলোকে কপাকপ্ গিলে খাচ্ছে।

কানের মধ্যে এতসব সুন্দর, সংযত সুসমঞ্জস শব্দ, চোখের তারায় এত রঙের প্রতিফলন, মস্তিষ্কের মধ্যে প্রগাঢ় প্রশান্তি, ভালোলাগা, সব মিলিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে আমারও

চন্দনী এসে সামনে বসল হাঁটু গেড়ে। ভারী সুন্দর করে হাঁটু গেড়ে জোড়া গোড়ালির উপর নিতম্ব রেখে বসে এই বনের মেয়েরা। এত নমনীয় ওদের বসার ভঙ্গিটি, যে দেখে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না।

চন্দনী মুখ নিচু করে আস্তে আস্তে বলল, কি করবে তুমি আমাকে নিয়ে? ঠিক করলে?

আমি কিছু বললাম, না। অনেকক্ষণ ওর ফিঙের মতো কালো চোখে তাকিয়ে রইলাম।

হেসে ফেলে, অনেক পরে বললাম, চন্দ্রকান্তটা বড় বোকা। তোমার মতো মেয়েকে ছেড়ে, হাতী মেরে ফেরারি হয়?

তারপর বললাম, তোমার দিকে সে ভালো করে কি চেয়ে দেখেনি কখনও!

চন্দনী হাসল। বলল, চাইলেই কি? সকলের চোখ কি ভগবান সমান দেন? সকলেরই তো চোখ আছে। সকলেই তো চোখ মেলে দেখে। কিন্তু চোখ মেললেই কি সকলে সব কিছু দেখতে পায়?

তারপর কথা ঘুরিয়ে ও বলল, আমার মন বড় খারাপ হচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার জন্যে আরো কি না কি হবে এখানে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা বলব? শুনবে?

-বল। কি কথা?

–চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই।

–কোথায়? আমি বললাম!

যেখানে হয়। তোমার যেখানে ইচ্ছে। যদি মনে করো আমি তোমার বোঝা, আমাকে যেখানে থেকে এনেছিলে সেখানেই ফেলে দিয়ে এসো। আমার যা হয় হবে। আমার জন্যে এতজনের বিপদ হোক তা আমি চাই না। সকলে বলছে যে ঐ গাল-পোড়া বেনে নাকি ভারী ইতর। ও করতে পারে না এমন কাজ নেই।

আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, একটা কথার সত্যি জবাব দেবে?

-বল। চন্দনী বলল।

—এত লোক থাকতে আমাকেই তুমি ডেকে পাঠালে কেন?

চন্দনী চমকে উঠল।

বলল, জানি না।

তারপর বলল, সব প্রশ্নের জবাব হয় না। এ প্রশ্ন তুমি শুধিয়ো না। আমি সত্যিই জানি না।

আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম।

ও চোখ নামিয়ে নিল।

তারপর উঠে চলে গেল ঘরের মধ্যে।

খাওয়া-দাওয়ার পরই আমি বেরোলাম। বিষেণ সিং সন্ধে অবধি থাকবে। কেন জানি না, এই লম্বা চওড়া দাড়ি গোঁফওয়ালা সর্দারজীর উপরে আমার খুব আস্থা। আজ বলে নয়। বহুদিন হল। নেশা নেই কোনো লোকটার। এক চায়ের নেশা ছাড়া। ট্রাকের স্টিয়ারিং-এর সামনে গুরু-গোবিন্দর ছবি। অসম সাহসী এই বিষেণ সিং। বহুবার তার সাহসের পরীক্ষা নিয়েছি আমি। কখনও কোনো পরীক্ষাতে ফেল তো করেইনি, পরীক্ষকের চেয়ে যে পরীক্ষার্থীর সাহস বেশি এ-কথাই প্রমাণ করেছে সে। বার বার।

যদিও ও বিষয়ে কোনো কথা বললাম না, কিন্তু আমি জানি যে ওর ট্রাকের ড্রাইভিং সিটের নীচে একটা লাইসেন্সবিহীন দোনলা বন্দুক আছে। বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় ও কোলকাতা থেকে জোগাড় করেছিল। গুলিও ওর কাছে আছে। তাও আমি জানি। মাঝে-মাঝে হরিণ শম্বর মেরে জালকাঠের পাহাড়ের নীচে ঢুকিয়ে নিয়ে সে চেক-পোস্ট পার হয়ে যায় ঠিকই। বিষেণ সিং-এর স্ত্রী প্রীতম বড় ভালো শাম্মী কাবাব বানায় হরিণের। এই একটা নেশা বা অপরাধ বিষেণ সিং-এর।

বিষেণ সিং বলল, আপ্ ইতামিনাসে যাইয়ে। যবতক্ আপ নেহি লোটিয়েগা, ম্যায় দেখভাল্ করংগা হিয়া।

সকালে যে লোকটাকে নালার কাছে দেখেছিলাম, সেই নালার দিকেই আবার চললাম আমি। কেন জানি না, আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল যে ঐদিকেই চন্দ্ৰকান্ত আছেন কোথাও।

আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যে, চন্দ্রকান্তর অন্তর্ধান শুধুমাত্র হাতী মারার অপরাধে ধরা পড়ার ভয়েই নয়। ছবি নায়েকের চন্দনীকে নিয়ে যেতে আসা, সেটাও নিছক মদদত্ত কাম নয়। এই সমস্ত ব্যাপারের পিছনে আরও গভীরতর কোনো ব্যাপার হয়তো আছে, যার সম্বন্ধে আমি অবহিত নই। এমন কি কম্ফুর কথাবার্তাও একজন সাধারণ বুনো বদ্যির মতো নয়। ওর প্রতিটি কথার পেছনে হেঁয়ালি আছে ও যেন নিজের কথা বলছে না, অন্য কারো কথা বলছে।

সকালে লোকটাকে যেখানে বাঁকের মুখে হারিয়ে যেতে দেখেছিলাম, সেইখানে পৌঁছে অত্যন্ত সাবধানে এগোতে থাকলাম। বন এখানে বড় গভীর। দুপুরবেলাও প্রায় অন্ধকার। সাহাজ, মিটকুনিয়া, তেঁত্রা, গাম্‌হারি, শিশু এসব গাছই এখানে বেশি। বুড়ো জংলী অশ্বত্থ ও বটও আছে। মাঝে মাঝে শালি বাঁশ। খুব সাবধানে পথ চলতে হয়। আমও আছে কিছু। মহীরুহ।

একটা অস্পষ্ট পাকদণ্ডীর মতো পথের রেখা পড়েছে চৈত্রের শুকিয়ে ওঠা লাল ঘাসে। একটু এগিয়ে গিয়েই নালাটাকে আবার পেলাম। অপূর্ব এক দৃশ্য দেখলাম এখানে। বোধহয় পাঁচ হাজার প্রজাপতি একসঙ্গে উড়ছে। আর বসছে। এক-এঞ্জিন বোমারু প্লেনের মতো গুনগুন শব্দ উঠছে জায়গাটা থেকে। সবুজ বনে হলুদ প্রজাপতির ঝাঁক হলুদ আগুন জ্বেলে দিয়েছে। এখানে নালায় জল বেশি নেই। ভেজা বালির উপর সামান্য জল। প্রজাপতিগুলো জল খাচ্ছে সেখানে। বালির উপর উড়ে উড়ে উঠছে আর বসছে। হঠাৎ চোখ পড়ল, বালির উপরে প্রজাপতিদের প্রায় পাশেই একটা প্রকাণ্ড ময়াল সাপ জলে এসেছে।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ে সেই দৃশ্য দেখলাম। তারপর আবার এগোলাম। এদিকটায় বড় বড় পাথর। কালো, সাদা নানারকম। কোনো ফেরারি লোকের আত্মগোপন করে থাকার আদর্শ জায়গা।

বড় বড় পাথরগুলো নজর করতে করতে চলেছি, এমন সময় আমার সামনে একটা নুড়ি এসে পড়ল। কোনো গাছ থেকে নুড়িটা ছুঁড়ল কেউ। সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতটা কোমরে চলে গেল পিস্তলের কাছে। এমন সময় কে যেন হেসে উঠল গাছের উপর থেকে।

উপরে তাকিয়ে দেখি, একটা বহু পুরোনো আমগাছ। উপরটা এত ঝাঁকড়া যে নজর চলে না। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি, একটা গাছের আড়াল নিয়ে, এমন সময় সেই গাছের গুঁড়ি বেয়ে ঝুপ্ করে কি একটা পড়ল। অবাক হয়ে দেখলাম, দড়ির সিঁড়ি একটা।

গাছের উপরের অন্ধকার থেকে একজন লোক দড়ির সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এল।

আমি যেমন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়েছিলাম পিস্তলের বাঁটে হাত দিয়ে তেমনিই দাঁড়িয়ে রইলাম।

দেখি চন্দ্ৰকান্ত। চন্দ্ৰকান্ত হাসছিলেন। বললেন, আসুন, আসুন। আমাকে না দেখে যখন থাকতেই পারলেন না, তখন আপনাকে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক মনে করলাম না।

উপরে উঠে দেখি গাছের গভীরে বিরাট এক মাচা। শুধু তাই নয়, সেই গাছ থেকে অন্যান্য গাছে যাওয়ার জন্যে ব্রিজ বানানো হয়েছে। প্রায় পাঁচশো মিটার জায়গা ছেয়ে মাচার পর মাচা।

চন্দ্রকান্ত হাসলেন। বললেন, জিম করবেটের ‘ট্রি-টপস’ বইটা পড়ে এই আইডিয়া পাই। যদি কেউ এই গাছের হদিস পায়ও তাহলে পাঁচশো গজ দূরে যে- কোনো দিকে গাছে-গাছে চলে যাবো নেপালী ইঁদুরের মতো। তারপর নেমে পড়ব যেদিকে খুশি! ঝুপ্ করে!

বললাম, যেরকম মৌরসী-পাট্টা গেড়ে বসেছেন, আপনার মতলবটা কি? জঙ্গলে যত হাতী আছে, সব সাবাড় করবেন নাকি?

চন্দ্রকান্ত হাসলেন। বললেন, লবঙ্গীতে এখন হাতী নেই-ই।

চন্দ্ৰকান্ত আমাকে শালপাতায় করে একটু মধু খেতে দিলেন। মধুটা খাচ্ছি, এমন সময় চন্দ্রকান্ত বললেন, চন্দনী এখানে এলো কেন?

আমি বললাম, চন্দনীর অপরাধটা কোথায়? বেচারীকে যে অবস্থায় দেখলাম, তা দেখলে আপনি যে কি করতেন জানি না।

—কি অবস্থা? চন্দ্ৰকান্ত শুধোলেন।

আমি বললাম, আপনি কি জানেন টিকড়পাড়াতে দারিয়ানী হয়ে পেট চালাচ্ছিল ও।

চন্দ্ৰকান্ত নৈর্ব্যক্তিক গলায় বললেন, হুঁ, শুনেছি তা।

তারপর হেসে বললেন, মেয়েদের কি সুবিধা না? চেহারা মোটামুটি সুন্দর হলে পেট চালানোটা একটা কোনো ব্যাপারই নয়।

আমি লোকটার নিষ্ঠুরতায় স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না।

বেশ অনেকক্ষণ পর শালপাতাটার দোনাটা নীচে ফেলতে যাব, অমনি চন্দ্ৰকান্ত আমার হাত থেকে দোনাটা নিয়ে নিলেন। বললেন, আমায় দিন। নীচে ফেললে চোখে পড়বে। আপনি শিকারি লোক হয়ে এই ভুল করতে যাচ্ছিলেন কি করে?

আমি ভাবছিলাম সবই ভুল। চন্দ্রকান্তর কাছে আসাও ভুল হয়েছে আমার। একটু পরে বললাম, আশ্চর্য! চন্দনী আপনার বিবাহিতা স্ত্রী, অথচ আপনি এরকমভাবে ব্যপারটাকে দেখবেন, ভাবা যায় না।

চন্দ্ৰকান্ত বললেন, স্ত্রীলোক কখনও কাউকে ভালোবাসে না। কর্তৃত্ব করতে চায় ওরা পুরুষের উপর। চন্দনী জেনেশুনে ভুল লোককে বিয়ে করেছিল। ও আমাকে খোঁটায় বেঁধে রাখতে চেয়েছিল, ওর ঘটিবাটির মতো সম্পত্তি বানাতে চেয়েছিল আমায়।

তারপর একটু থেমে বললেন, আপনি তো জানেন যে, আমি ওকে কখনও ভালোবাসিনি। ওকে কেন? কোনো স্ত্রীলোককেই কখনও ভালোবাসিনি আমি। চন্দনী আমার জীবনের পরিপন্থী। কখনোই পরিপূরক হয়নি। অবশ্য একথা অস্বীকার করি না যে, আমার জীবনের পরিপূরক হওয়া সহজ নয়।

আমি চুপ করে রইলাম।

বললাম, চন্দনীকে একবার আপনার কাছে নিয়ে আসব?

চন্দ্রাকান্তর চোখ দপ্ করে জ্বলে উঠল।

মাথা নেড়ে বললেন, না। একদম না।

—তাহলে, আমি ওকে নিয়ে কি করব? অসহায় গলায় আমি বললাম।

চন্দ্রকান্ত হেসে ফেললেন।

বললেন, যুগ-যুগান্ত ধরে পুরুষরা মেয়েদের নিয়ে যা করেছে তাই-ই করুন। আপনি তো আবার নরম মনের লোক। আপনি চান তো বিয়ে করেও ফেলতে পারেন। না চান তো যেখান থেকে তুলে এনেছিলেন, সেখানে ছেড়ে দিয়ে আসুন। আমার বলার বা করার কিছু নেই।

আমি চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম, ও কিন্তু এখনও আপনাকে ভালোবাসে।

চন্দ্রকান্ত বললেন এক কথা বারবার না বলাই ভালো। মেয়েদের ভালোবাসার স্বরূপটা আশ্চর্য। ওদের জলের মতো চরিত্র। যখন যার ঘরে থাকে, যার বুকে, তার দিকে বড় সহজে গড়িয়ে যায় ওরা। ওরা নিজের সুখ, নিজের স্বার্থ নিজের নিরাপত্তাকেই ভালোবাসে। শালাবাবু, দয়া করে চন্দনীর ভালোবাসার কথা আমাকে আর বলবেন না।

আমি বললাম, একদিনও কি ওকে নিয়ে এলে সত্যিই রাগ করবেন আপনি? ভেবে বলুন।

চন্দ্ৰকান্ত বললেন, না-ভেবেই বলছি, যদি আনেন, তাহলে এই গাছে বসেই গুলি করে মারব ওকে।

তারপর নিজের মনেই বলে উঠলেন :

পাকলা আম্ব সুরতি
তুহি চম্পাফুল মহি মালতী
রাতিরে হেব্ব পীরতি, সজনী লো ॥
কঁইথমূলে দোকান,
নুয়া দারিয়ানী বিকুছি পান।
পানরে না লাগে চুন!
কঁইথমূলে ম বাসা
বেল বুড়ি গল্বে, নেবু পয়সা
না ভাঙ্গ মোর আশা, সজনী লো।

বলেই, হাসতে লাগলেন।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।

বেলা পড়ে আসছিল। বিষেণ সিং আমি না-যাওয়া পর্যন্ত আটকে থাকবে। তাই আমি বললাম, আজকে যাই।

চন্দ্রকান্ত বললেন, আরেকদিন আসবেন। তবে খুব সাবধানে। কেউ যেন পিছু না নেয়। সম্ভব হলে রাতে আসবেন। একটু দেখে শুনে। নালায় একটা বড় বাঘ রোজ জল খেতে আসে সন্ধের পর।

আমি গাছে উঠে যেতেই কাছির সিঁড়িটা তুলে নিয়েছিলেন চন্দ্রকান্ত। এবারে সিঁড়িটা আবার ফেলে দিলেন।

সিঁড়িতে পা দিয়ে আমি বললাম, শরীর কেমন আছে এখন?

চন্দ্রকান্ত বললেন, প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি। দেখছেন না কেমন হৃষ্টপুষ্ট হয়েছি। সবই কম্ফুর দয়া। যা কোনো বিলেত ফেরত ডাক্তারে পারল না, সেই হাঁপানী প্রায় নিরাময় করে এনেছে ওর জড়িবুটি দিয়ে।

তারপর হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বললেন, কম্ফুর জন্যে আমি সব করতে পারি।

আমি বললাম, যেমন সকালবেলা শম্বরটা মারলেন।

চন্দ্রকান্ত হাসলেন।

বললেন, শুধু কম্ফুর জন্যে নয়।

তারপর বললেন, থার্ডক্লাস হাত হয়ে গেছে। প্রথম দুটো গুলিই মিস্ করলাম! ভাবা যায় না!

আমি নেমে যেতেই সিঁড়িটা আবার উঠে গেল সড় সড় করে। কে বুঝবে যে, ঘন পাতার আড়ালে অমন আরামে থাকার মাচা আছে?

ছবি নায়েক যে সেদিন রাতে চন্দনীর জন্যে এসেছিল ক্যাম্পে একথা আমি তাঁকে বলিনি। কিন্তু মনে হল, চন্দ্রকান্ত সব খোঁজই রাখেন।

নালায় নেমে আস্তে আস্তে এসে রাস্তাটায় উঠলাম। বেলা পড়ে গেছে। একটু পরে একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে। গাছ-গাছালির ছায়াও এখন আর দেখা যায় না। চারিদিকে সায়ান্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। হঠাৎ সামনে রাস্তার উপরে চোখ পড়তেই দেখি বড় একটা ময়ূর পঞ্চাশ গজ দূরে আমার দিকে পিছন ফিরে পথের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। ময়ূরটাকে লক্ষ করছি ঠিক এমন সময় ময়ূরটার পিছনের ও আমার সামনের জঙ্গল থেকে একটা চিতাবাঘ পথের বাঁদিক থেকে বেরিয়ে এক লাফে ময়ূরটাকে ধরল—ময়ূরটা একবার কেঁয়া করে ডেকে উঠেই থেমে গেল।

চিতাটা ময়ূরের গলা কামড়ে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল।

আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিতাটাকে জঙ্গলের গভীরে চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে আবার আস্তে আস্তে এগোলাম।

সন্ধের পর পর বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা একটা ভাব হয়। দূর থেকে ক্যাম্পের সামনে আগুন দেখা গেল। বিষেণ সিং কাঠের গুঁড়ির উপর বসে চা খাচ্ছিল। আমাকে দেখে আশ্বস্ত হল। বলল, আপহিকা ইন্তেজারীমে থা। আবূ মায় চলে।

চা খেয়ে, বিষেণ সিং হেল্পার অশোককুমারকে নিয়ে বন-পাহাড় কাঁপিয়ে তার মার্সিডিস স্টার্ট করে জঙ্গলের পথ আলোয় উদ্ভাসিত করে চলে গেল। অনেকক্ষণ অবধি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ট্রাকের শক্তিশালী এঞ্জিনের গোঙানি শোনা গেল। তারপর একসময় গোঙানিটা মিলিয়ে গেল। ঝিঁঝির ডাক সমস্ত পরিবেশকে মুড়ে দিয়ে চাঁদের আলোয় মাখামাখি করে রাতকে হাত ধরে বন-পাহাড়ে খেলাতে নামাল। লজ্জাবতী লতার মতো পাতাওয়ালা মানুষের মাথা-সমান দত্তারী গাছগুলোর পাতায় পাতায় চাঁদ পড়ে পাতাগুলো দেখতে দেখতে রুপোঝুরি হয়ে গেল।

আমাকে দেখতে পেয়েই চন্দনী কাছে এল। এ এক নতুন অনুভূতি আমার জীবনে। ও যদি শহুরে শিক্ষিত মেয়ে হত, তাহলে আমাদের সম্পর্কটা পারস্পরিক হত। সে যেমন আমাকে খুশি করার চেষ্টা করত, আমিও তাকে। তাহলে দুজনের মনের মধ্যেই সব সময় একটা টেনসান থাকত, দুজনে দুজনকে খুশি করতে পারছি কি পারছি না এটা জানার জন্যে। কিন্তু ও যে আমার কাছ থেকে কিছুই প্রত্যাশা করে না, শুধুই আমার আশ্রয় চায়, শুধু কাছে থাকতে চায়, শুধু নীরবে আকুতি জানায় যাতে আমি ওকে ছেড়ে না যাই। আশ্রম হরিণীর মতো ও আমার পায়ে পায়ে ঘোরে, বোবা চোখে প্রীতি ও শ্রদ্ধা জানায়। ওর ভাষা আমার ভাষায় কত তফাত, কত তফাত সবকিছুতে। কিন্তু ওর অন্তরের নম্র নারীসুলভ ঐশ্বর্যে ও আন্তরিকতায় ও আমাকে এই চাঁদের আলো দিগন্ত বিস্তৃত বনানীকে যেভাবে আপ্লুত করে, তেমনভাবে আপ্লুত করে রাখে।

হঠাৎই নিজের কাছে আমি বড় দামি হয়ে উঠেছি। আমা-হেন লোকেরও যে এত দাম, সে-ও যে কারো কাছ থেকে যত্ন, ভালোবাসা, প্রীতি পেতে পারে, তার সুখই যে অন্যজনের সুখ হতে পারে, এসব কথা এক সপ্তাহ আগেও আমার বিশ্বাস হত না। এই হঠাৎ, দুর্ঘটনাপ্রসূত, ঈশ্বর প্রেরিত প্রাপ্তি আমাকে বড় অভিভূত করে ফেলেছে।

নারাণ চা করছিল। চন্দনী দৌড়ে গেল সে চা আনতে। আমি ইতিমধ্যে জুতো- জামাকাপড় ছেড়ে, পায়জামা পাঞ্জাবি চটি পরে ফেললাম। এণ্ডীর চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। তারপর কাটা কাঠের গুঁড়িতে এসে বসলাম। উল্টোদিকে মুখ করে। আগুনটা চাঁদের আলোর রাতের শোভাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। কাল থেকে আগুনটাকে ক্যাম্পের পিছনে করতে বলব।

চন্দ্রকান্ত যে কবিতাটি বলেছিলেন তার কথা ভাবছিলাম। কবিতাটির মানে হচ্ছে, পাকা আমের মতো শরীর তোমার। তুমি চাঁপাফুল আর আমি মালতী ফুল। রাতের বেলা প্রেম হবে গো, আহা! কদবেল গাছের তলায় দোকান। সেই দোকানে বসে নবীন বেশ্যা পান বিক্রি করছে। দেখো, পানে চুন লাগিও না। আমার বাড়িও কদবেল গাছের তলায়। এখন পান দাও, সূর্য ডুবে গেলে পানের পয়সা পাবে। আমায় নিরাশ কোরা না যেন সজনী।

আমার চোখের সামনে চন্দনী ঘুরছিল, আর কেবলি আমার চন্দ্রকান্তর শীতল নিষ্ঠুরতার কথা মনে হচ্ছিল। মানুষ কি করে এত নিষ্ঠুর হতে পারে ভেবে পাচ্ছিলাম না।

চন্দনী চায়ের গ্লাস এনে আমাকে দিল।

আজ ও বিশেষ করে সেজেছে। পরিষ্কার সাদা শাড়ি পরেছে একটা। মাথায় ম‍ই ফুল গুঁজেছে, সাদা। ওর কালো রঙে, সাদা শাড়ি ও সাদা ফুল চাঁদের আলোয় ভারী ভালো দেখাচ্ছে।

চন্দনী আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার চা খাওয়া দেখছিল। কোমরের সামনে একহাতে অন্য হাত ধরে দাঁড়াবার ভঙ্গীটি ওদের এত মিষ্টি!

চা খাওয়া হয়ে গেলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ফিসফিস্ করে চন্দনী বলল, খোঁজ পেলে?

প্রায় সত্যি কথা বলে ফেলেছিলাম! কোনোক্রমে সামলে নিয়ে বললাম, না। বোধহয় ঐ জঙ্গল ছেড়ে চলে গেছে।

-চলে গেছে?

এই প্রশ্নর মধ্যে খুশি ছিল, না অখুশি বুঝলাম না। ওকে উদাসীন দেখলাম। আমি বললাম, কি করে বলব? ঐ জঙ্গলে তো হদিস্ পাওয়া যাচ্ছে না। দেখি আরো ক-দিন।

—দেখে লাভ কি? ও বলল।

তারপর বলল, লাভ নেই কোনো। চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই।

-কোথায়?

আমি বললাম।

ও হাসল। বলল, তুমি যেখানে যাবে, যেখানে তোমার খুশি।

আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, কম্ফু ফেরেনি এখনও?

চন্দনী একটুক্ষণ চুপ করে রইল জবাব দিল না। তারপর বলল, না। এখনও নাকি শম্বরটার মাংস ভাগ-বাটোয়ারা শেষ হয়নি। কত দূর দূর থেকে যে লোকে মাংস নিতে এসেছে কি বলব! নারাণদা গল্প করছিল।

তারপরই বলল, আচ্ছা! ছবি নায়েক যদি বনবাবুদের খবর দেয়? কি হবে?

আমি বললাম, অনেক কিছুই হতে পারে।

এমন সময় কম্ফু ফিরল। জামা-কাপড় রক্তে মাখা।

বলল, লোকগুলো একেবারে রক্তখিয়া। মাংস-মাংস করে কী কাড়াকাড়ি। বলেই, চান করতে চলে গেল নালায়।

যাওয়ার সময় বলল, আজ সারাদিন আমার রুগীর দেখাশোনা হল না। খাওয়াও হল না সারাদিন।

আমি বললাম, এখন ভাল করে শম্বরের মাংস খাও।

কম্ফু চেঁচিয়ে নারাণকে বলল, তোদের ভাল রান্নার মাংস আমাকে একটু চাখতে দিস নারাণ। আমাদের ঘরে তেল নেই। আমরা ঝসে বা সেদ্ধ করে খাব। বউ যা রাঁধবে।

চন্দনীকে শুধোলাম, রত্নাকরকে দেখছি না। ও ফেরেনি না কি?

চন্দনী বলল, না। বিষেণ দাদা বলছিল, ও নাকি বনতলায় গেছে, ক্যুপ থেকে সাইকেল নিয়ে।

—বনতলা কেন?

চন্দনী বলল, তা তো জানি না।

কম্ফু উবু হয়ে বসে বলদটার পায়ের স্লিলংটা ঠিক করছিল।

আমিও গিয়ে ওর পাশে উবু হয়ে বসলাম। যদিও চাঁদ আজ সন্ধ্যা থেকেই বেশ জোর, তবু ও মশাল জ্বেলেছে একটা। মশালের আলোটা ওর রোদে-পোড়া তামাটে মুখে, কাঁচা-পাকা চুলে পড়ে মুখটাকে, চুলগুলোকে এক সোনালি আভা দিয়েছে।

আমি ফিফিস্ করে বললাম চারদিক দেখে নিয়ে, চন্দ্রকান্তর হাঁপানি সারালে কি করে কম্ফু?

কফু হঠাৎ মুখ তুলে চোখের দিকে তাকাল।

তারপর বলল, তুমি গেছিলে বুঝি? দেখা হল? নিজেই খুঁজে পেলে?

—ঠিক নিজে নয়। তবে প্রায়।

বললাম, কি দিয়ে সারালে বল না?

ও বলল, বলে কি লাভ? তুমি কি বললে বুঝবে? তবুও শোনো। পাল্‌ধুয়া গাছের ছাল কেটে, তার সঙ্গে আরও অনেক জড়ি-বুটি দিয়ে বাবুর জন্যে একটা বিশেষ ওষুধ বানিয়ে ছিলাম।

-পাল্‌ধুয়া গাছ কোনটা? আমি বললাম। চিনি না তো?

কম্ফু হাসল। বলল, তুমি কি সব গাছ চেনো? বড় গাছ হয়তো চেনো কিছু কিছু। লতাপাতা কিছুই চেনো না। আমি এই নিয়ে জীবন কাটালাম। চুলগুলো কি এমনিই পাকল?

—তবে দুঃখ কি জানো? গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। যদি কেউ আমার পিছনে থাকত তবে আমি কর্কট রোগ সারাবার ধন্বন্তরী ওষুধ বানাতাম। বাবুরা বলে, আজকাল তোমাদের বড় বড় গাঁ-গঞ্জে নাকি অনেক লোক মরে এই রোগে।

আমি বললাম, হুঁ। ক্যানসারই তো এখন চিন্তা।

—সেটা কি জানোয়ার বাবু? কোনো সাপ কি? সেদিনও বলছিলে এর কথা।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, ঐ কর্কট রোগের ইংরিজি নাম ওটা।

কম্ফু খুশি হল। বলল, তাও তুমি একটা ইঞ্জিরি শেখালে। আরও একটা জানি।

আমি বললাম, কি?

কম্ফু বলল, ছবি ঠিকাদার আদর করে ডাকে আমাদের।

আমি শুধোলাম, কি কথা?

কম্ফু গর্বিত গলায় বলল, বাস্টার্ড।

তারপরই বলল, এ কথার মানে কি গো বাবু?

আমি বললাম, সে কথা থাক। পাপ্পুয়া গাছের কথা বল।

ও বলল, সাদা সাদা দেখতে গাছগুলো, গোল গোল পাতা হয়। এ জঙ্গলে অনেক আছে। লক্ষ করে দেখলে দেখতে পাবে।

তারপর আবার বলল, আচ্ছা আমি তোমাকে চিনিয়ে দেবো।

আমি বললাম, তা চেনাবে, কিন্তু সেই লোকটাকে কে চেনাবে?

—কোন লোকটাকে? কম্ফু অবাক হওয়ার ভান করে বলল।

আমি বললাম, যে লোকটা তোমাকে শম্বরটা মেরে দিয়ে গেল। সে কোন দয়ালু?

কফু সাবধান হয়ে গেল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। বলল, আমার মন ভালো নেই।

-কেন? আমি বললাম।

—রত্নাকর আজ সকাল থেকে উধাও, সাইকেল নিয়ে। ড্রাইবার সায়েব বলছিল যে, পাঁচশো টাকা নাকি পুরস্কার দেবে। সরকারে?

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি। তাতে রত্নাকরের কি?

কম্ফু বলল, কিছু না। ছেলেটা এই বয়সেই আমাদের থেকে অনেক বড়লোক হয়েছে তো। তাই-ই বড় লোভী।

তারপর বলল, আমার কাছে শরীরের সব অসুখের ওষুধ আছে, কিন্তু মনের অসুখের নেই। আমার বড় ভয় করে। তুমি ওকে চন্দ্রবাবুর কোনো কথা বলো না। চন্দনীকেও না।

—চন্দনীকেও না কেন? আমি শুধোলাম।

কম্ফু বলল, চন্দ্রবাবু ওকে মন থেকে মুছে ফেলেছে। মিছিমিছি মেয়েটাকে এর মধ্যে জড়ানো কেন?

আমি বললাম, ও।

তারপর বললাম, তুমি আমার কথাটা কিন্তু এড়িয়ে গেলে।

কফু হাসল। বলল, চন্দ্রবাবুকে পুরোপুরি সারিয়েছি ছ-মাসে। কোনো কিছু তো নিইনি বদলে। চন্দ্রবাবুর কিছু ঋণ জমেছে আমার কাছে। ঋণটা শুধতে দাও। তাকেই শুধতে দাও।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

তারপর বললাম, বেশ! তাহলে চন্দ্রকান্তই শম্বরটা মেরেছিল বলো?

—তা তো বটেই। তবে, ছবি নয়েককেও মারতে চায় চন্দ্রবাবু আমার জন্যে। কিন্তু ছবি নায়েকের সঙ্গে আমার হিসাব-নিকাশ। এর মধ্যে আমি কাউকে জড়াতে চাই না।

আমি বললাম, তোমার এত রাগ কেন।

কম্ফু অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর বলল, কেন তা বলব না।

-কেন? বলবে না কেন?

কম্ফু বলল, রাগ, জেদ এসব হচ্ছে কর্পূরের মতো। এগুলোকে মনের মধ্যে কৌটো-বন্দী করে না রেখে, তুমি যদি বলে ফেলো কারো কাছে, তাহলেই এরা উবে যায়।

কম্ফু তারপর লতা দিয়ে বাঁশের টুকরোটা বাঁধতে বাঁধতে বলল, তোমার ঐ ভালো বাসার তামাক একটু দাও তো আমাকে।

আমি পকেট থেকে টোব্যাকো পাউচ বের করে ওকে টোব্যাকো দিলাম।

কম্ফু বাঁশটা ছেড়ে খৈনীর মতো দু-হাতের তেলোয় মেরে নিয়ে জিভের নীচে দিল। বলল, বাটা ভারী ভালো। তারপর বলল, আমার সঙ্গেই তোমার দেখা হয়নি আগে, বলদটা বড় দেরী করে ঠ্যাং ভাঙল।

তারপর বলল, দেখছি এরা তোমাকে সবাই ভালোবাসে। তুমি কি সে কথা জানো?

আমি বললাম, জানি।

তারপরই বলল, এটাও একটা বড় কথা। কেউ কাউকে ভালোবাসলেই হয় না। সেটা অন্যরও জানা দরকার। যেমন চন্দ্ৰকান্ত জানে না, চন্দনী এখনও ওকে ভালোবাসে। ভালোবাসা কি এক রকম? এই জঙ্গলের লতার মতো কতরকম ভালোবাসা, কত রঙ, কত গন্ধ, কত গুণ, সব হরেক, হরেক।

তারপর একটু থেমে বলল, মেয়েটাকে আমি দেখছি ক-দিন হল। ওকে তুমিও আবার দাগা দিও না যেন। চুল তো পাকল, একটু একটু বুঝি। মানুষ বাঁচতে পারে বহুদিন। আশি, নব্বুই, একশো, দুশো বছর। কিন্তু ভালোবাসা একবার দুবারই জোটে।

আজকে খিচুড়ি রেঁধেছিল নারাণ। খিচুড়ি আলুভাজা। শুকনো লংকা ভাজা আর কাঁচা পেয়াজ। সঙ্গে শম্বরের মাংস কষা।

খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বাইরে বসে পাতার ঘরে এলাম। চন্দনী আগেই এসে শুয়েছিল। ও রোজ এক কোণায় ওর কাঁথা পেতে শোয়। কাঁথাটা এবং ওর জামা-কাপড় বড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ওরা মাটিতে কাচে, এক রকমের মাটি আর লতা দিয়ে গা পরিষ্কার করে। ধুধুঁলের খোসাও ব্যবহার করে। করৌঞ্জের তেল মাখে, নিমের তেল মাখে, বুনো চাঁপাফুল দিয়ে মাথায় দেওয়ার তেল তৈরি করে।

রোজই ঐরকম করে শোয়। আমি ডাকলে, তবে আমার কাছে আসে। আমার পাশেই শোয় জড়সড় হয়ে। অসাবধানে ওর পা আমার পায়ে লেগে যায়, হাত হাতে; বুক বুকে, কখনও।

ঘরের মাথায় যে পাতাগুলো দেওয়া ছিল সেগুলো শুকিয়ে গেছে এ ক-দিনে। পাশের পাতাগুলোও। ঘরময় শুকনো পাতার ফাঁকফোক দিয়ে পরিষ্কার জ্যোৎস্না এসে পড়েছে। একটা কুম্ভাটুয়া পাখি নালার পাশ থেকে ডেকে চলেছে ঢাব্‌-ঢাব্‌- ঢাব্‌-ঢাব্‌। কতকগুলো টি-টি পাখি পাহাড়ের উপরের মালভূমি থেকে ডাকছে। চমকে চমকে। ডিই-ইউ-ডু-ইট! ডিউ-উই-ডু-ইট করে ডেকে ডেকে কাকে যে কোন অপরাধের কথা শুধোচ্ছে, তা ওরাই জানে। চিতল হরিণের ঝাঁক জ্যোৎস্নার বনে চিতার তাড়া খেয়ে স্বরোদের ঝালার মতো লাফ মেরে মেরে ডাকছে টাঁউ-টাঁউ-টাঁউ : টাঁউ-টাঁউ।

নালাতে জল বওয়ার শব্দ ভেসে আসছে পাথরের উপর কুলকুল করে। একটা কুটুরে ব্যাঙ নালার পাশের পাথরের আড়াল থেকে কোয়া-কাঁও কোয়া-কাঁও করে অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠল।

চন্দনী আমার দিকে পিছন ফিরে শুয়ে আছে। ওর সরু কোমরে চাঁদের আলো এসে পড়েছে।

ও ঐদিকে মুখ ফিরিয়েই ফিফিস্ করে বলল, বৃষ্টি হবে।

আমি বললাম, পাগল নাকি? এখন ফুটফুটে জ্যোৎস্না। আর দু-তিন দিন বাদেই দোল। বৃষ্টি হবে কি?

চন্দনী বলল, তুমি দেখো, হয় কিনা। ছোটবেলা থেকে দেখছি ঐ ব্যাঙটা ডাকলে বৃষ্টি হয়।

আমি বললাম, বাজি?

চন্দনী হাসল। বলল, বেশ!

আমি বললাম, কি বাজি?

—তুমিই বলো।

আমি বললাম, না তুমি বলো!

ও বলল, যদি জিতি, একটা জিনিস চাইব তোমার কাছ থেকে, দেবে তো?

-দেবো। আমি বললাম।

কিছুক্ষণ পরে আমি বললাম, রত্নাকর এখনও ফেরেনি না?

—না। চন্দনী বলল। সন্ধের পর কি কেউ একা সাইকেলে এই জঙ্গলে এতখানি পথ আসতে পারে? কত ভয় আছে না পথে! আমি ওর সঙ্গে গল্প করার জন্যে বললাম, কি কি ভয়?

ও বলল, আহা! জানে না যেন।

বললাম, সব কি জানি? যেমন এই ব্যাঙ ডাকলে চাঁদনী রাতেও যে বৃষ্টি হয়, তা জানতাম না।

চন্দনী কপট রাগে বলল, সবটাতে ঠাট্টা, না? তুমি যে কত কিছু জানো আর আমি জানি না। এমন কি কিছু থাকতে পারে না যে, আমি জানি, আর তুমি জানো না?

নারাণ খাওয়া-দাওয়ার পর যথারীতি গান আরম্ভ করেছে :

দয়া করো দীনবন্ধু শুভে যাউ আজদিন
কলিযুগে জগন্নাথ আপে করুছ ভবন
কলিযুগে জগন্নাথ বিজে চক্ৰহস্ত
সাধিয়ে পউঠ অন্ন আপে করুছ ভবন
তুমে এ সংসারে সার আউ সব মায়া ঘর
কতাংত ডর উঠরো কহে দীন জনহীন।

নারাণের গানে এমন এক সমর্পণ-তন্ময়তা আছে যে সে বলার নয়। নারাণ যখন তার মৃত ছেলের কথা বলে, যখন বলে, নাগসাপে তাকে কামড়ালে ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে ও, তখন আমার কেবলই মনে হয় যে অপত্য স্নেহ বোধহয় প্রেমের চেয়ে অনেক গভীরতর বোধ।

হঠাৎ চন্দনী বলল, তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? আমাকে ফেলে?

—হঠাৎ একথা কেন? আমি বললাম।

চন্দনী বলল, আমার মন বলছে, চলে যাবে।

তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে রইল চন্দনী।

বাইরে হাওয়া দিয়েছে একটা জোর। বাঁশপাতা ও অন্যান্য পাতা মচ্‌মচানি তুলে গড়িয়ে যাচ্ছে পাথরের বুকে। ঝিঁঝির শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ সেই শব্দ সোচ্চার হচ্ছে।

চন্দনী হাওয়ার মতো ফিফিস্ করে বলল, যদি চলেই যাও, আমাকে একটা জিনিস দিয়ে যাবে? একটা ভিক্ষা আছে তোমার কাছে।

বড় করুণ শোনাল ওর গলা। যেন মিনতি করে বলল ও।

আমি উঠে বসলাম। ওর মুখের দিকে মুখ নামিয়ে বললাম, নিশ্চয়ই! বলো, কি তুমি চাও; কি তোমাকে দিতে পারি আমি?

চন্দনী হঠাৎ বড় উদাস গলায় বলল, তাহলে চলে যাবেই। জানতাম আমি। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না ও।

বাইরে ব্যাঙ আবার ডাকল, কোয়া-কাঁও। বাঁশবনে হাওয়া কট্‌কটি আওয়াজ তুলল। ঝিঁঝির একটানা ডাকের পটভূমিতে

তারপর হঠাৎ বলল, ঠিক আছে, যদি চলে যাও তবুও দিয়ে যাবে?

—কি চন্দনী? কি চাও তুমি?

চন্দনী এক মুহূর্ত দ্বিধা করল? তারপর বলল, না। এখন নয়। পরে বলব। বাজি জিতি।

আমি বললাম, এক্ষুনি বলো না।

চন্দনী বলল, বললাম না যে পরে বলব।

কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলাম। বাইরে চাঁদের রাত উড়ছে। এমন রাতে ঘুম আসে না। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, আমার ভাগ্য আমাকে কোথায় টেনে নিয়ে এল। চন্দনীর পাশে যার আজ শুয়ে থাকার কথা, যার কথা তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করার সে লোকটা এখন ঐ ঘন বনের মধ্যে মাচায় শুয়ে আছে কি? নাকি বন-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? চন্দনী যেভাবে আমার জীবনে এসে পড়ল, আমার ভারী ভয় করছে যে, এবার বুঝি ফেরা হল না আর শহরে।

খুব কি খারাপ হবে এই জীবন? সৌমেনবাবুকে বললেই একটা ক্যাম্পের ম্যানেজারির চাকরি জুটে যাবে এখানে অথবা অন্য কোনোখানে সহজেই। এই জীবনে চাহিদা নেই কোনো, তাই প্রয়োজনও কম।

অল্পতেই চলে যায়। সিনেমা নেই। থিয়েটার নেই, অতিথি অভ্যাগত, নেতা- নেমন্তন্ন, সামাজিক দায়-দায়িত্ব বলতে শহরে যা বুঝি, তার কিছুই নেই। ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল, ট্রাম বাসের বা মিনিবাস-ট্যাক্সির খরচাও নেই।

এমন কি খবরের কাগজও নেই। কী শান্তি!

সকালে উঠেই পরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও জানতে হবে না আলজেরিয়ায় কি হয়েছে, কার্টার বা পদগোর্নি কি বলেছেন, পড়তে হবে না প্রধানমন্ত্রীদের বাণী, বিরোধী পক্ষের চর্বিত-চর্বণ স্তোত্র।

কাগজে আমরা যা দেখি, যা পড়ি, যা নিয়ে ভাবি, চিন্তা করি তার সঙ্গে দেশের মোট জনসংখ্যার নিরানব্বুই ভাগেরই কোনো সম্পর্ক নেই। সেই একভাগের সঙ্গে সমস্ত আত্মীয়তা ছিন্ন করে না হয় নিরানব্বুই ভাগের এক ভাগ হয়ে গিয়ে বাকি জীবনটা এদেরই সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সফলতা ব্যর্থতার মধ্যে কাটাই না কেন? গর্বিতা, পণ্ডিতম্মন্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ মারা সফিসটিকেটেড্ জলবৎ- তরলং কোনো বালিগঞ্জী সুন্দরীকে নিয়ে ঘর এ-জন্মে নাই-ই বা করলাম। তার চেয়ে, এই চাঁদ-ওড়া বনের গভীরে আমার বংশধরের বীজ প্রোথিত করি চন্দনীর নিম-করৌঞ্জের গন্ধ মাখা স্নিগ্ধ শরীরে। তার সহজ সরল আন্তরিক অন্তরে আমার অন্তর ধন্য হোক। তারপর ধুলোর মধ্যে, রোদের মধ্যে, জলের মধ্যে, শীতের মধ্যে আমার উলঙ্গ সন্তান বেড়ে উঠুক জঙ্গলের গন্ধ গায়ে মেখে, গরুর গায়ের মিষ্টি গন্ধ আর ফুলের গন্ধে মাখামাখি হয়ে। সে শক্ত হোক, সে মাটিতে অর্গুন পাতার বিছানায় জন্মাক, মাটির রসে আর তার যুবতী মায়ের নিটোল স্তনের নির্ভেজাল দুধ খেয়ে বড় হয়ে উঠুক। দেশজ হোক সে, সম্পূর্ণ ভারতীয় হোক; তাকে আমরা সেন্ট- জেভিয়ার্স-লা মার্টিনিয়ারে না পাঠিয়েই, মেম সাহেবদের বাচ্চার মতো পোশাক না পরিয়েই, ইংরিজি কমিকস্ আর থ্রিলার না পড়িয়েই, মানুষ করে তুলি না হয়। তার অসুখ করলে বিদেশী বিদ্যার পারদর্শী বিদেশি ডিগ্রিধারী ডাক্তারের কাছে লাইন দিয়ে না-দাঁড়িয়ে দিশি কম্ফুর হাতেই না-হয় তাকে ছেড়ে দিই। ভয়ের কি? কিসের ভয়?

ভালো না-খাওয়ার ভয়? ভালো না-পরার ভয়, কভেনানটেড অফিসার না- হওয়ার ভয়? অচিকিৎসার ভয়?

আমার দেশের কোটি কোটি লোক তো এমনি করেই বেঁচে আছে হাসি মুখে। তারা আমাদের প্রত্যেকের চেয়ে, আমাদের সরকারি বিরোধীদলেরও বহু নেতাদের চেয়েও অনেক সৎ, অনেক খাঁটি। এরাই তো আসল ভারতবর্ষ! এরা শহুরে লোকদের চেয়ে অনেক ভালো। এদের মধ্যে বাস করে, শুধু ভঙ্গী দিয়ে নয়, ভালোবাসার গভীরতার বোধে এদের বুঝে, এদের জেনে, এদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে, এদের ন্যায্য সম্মানের আসনে না-হয় বসাবই ওদের। এটা কি একটা বেঁচে থাকা নয়? এটা কি করার মতো কিছুই নয়?

আমার বড় সাহেবের কাজে বোম্বে গিয়ে, ফাইভ-স্টার হোটেলে থেকে, ডিনার- লাঞ্চ খেয়ে, ইংরেজির তুবড়ি ছুটিয়ে কিছু চাটুকারিতা করে, কিছু ঘুষ দিয়ে কাজ জোগাড় করে এনে পিঠ-চাপড়ানি পাবার চেয়ে, চন্দনীর নরম শান্ত সমর্পণী চোখের ভালোবাসা, নারাণের নির্ভরতা, কম্ফুর বন্ধুত্বের দাম কি এতই কম? একটা ফ্রিজ বা একটা টি. ভি. দিয়ে কি মনের শান্তি কেনা যায়; পারব কিনতে? তার চেয়ে এই অভাবের জীবন অনেক ভাল। অনেক কিছু নেই এখানে, কিন্তু শান্তি আছে। নিবিড় নির্লিপ্ত শান্তি।

কিছুতেই ঘুম আসছিল না। উঠে বসলাম আমি।

চন্দনী পাশ ফিরে বলল, আমি কি তোমার বোঝা হলাম?

আমি হাসলাম। ওর খোঁপায় মৃদু চাপড় মেরে বললাম, না পাগলি; না।

চন্দনীকে যেন বিছে কামড়াল।

ও বলল, তুমি কখনও আমাকে পাগলি বলবে না।

-কেন?

আমি অবাক হয়ে শুধোলাম।

চন্দনী বলল, চন্দ্রকান্ত আমাক পাগলি বলত। তুমি বলবে না।

আমি হেসে ফেললাম, আচ্ছা! তাই-ই হবে।

তারপর আমি বললাম, তুমি শুয়ে থাকো! আমি একটু ঘুরে আসছি!

—কোথায়? বলে চন্দনী উঠে বসল।

বললাম, চাঁদের আলোয় কেমন দেখাচ্ছে চারধার ঘুরে দেখে আসি একবার। হাঁটতে হাঁটতে ভাবা যায় অনেক কিছু। তোমাকে বুকের এত কাছে নিয়ে শুয়ে কি

কোনো জোয়ান মানুষ ঘুমোতে পারে?

-আহা!

বলেই, চাপা হাসি হাসল চন্দনী।

আমি বললাম, মনে আছে, তোমাকে চন্দ্ৰকান্ত বলেছিলেন, বিড়িগড়ে সেদিন তুমি যখন আমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়েছিলে—বলেছিলেন, “তোরা খালি খিদে পাইয়ে দিয়েই যাস; খিদে মেটাতে না পারলে খিদে জাগানোটা অন্যায়।”

চন্দনী হাসছিল; বিছানায় উঠে বসে। ওর গ্রীবায় চাঁদের আলো এসে পড়েছিল।

চন্দনী বলল, যে এ কথা বলেছিল, সে যেন কত বোঝে এ-সব। ভূতের মুখে রামনাম!

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, দ্যাখো চন্দনী, সে তো ভূত না হয়ে ভগবানও হতে পারে। চন্দ্রকান্ত আমার তোমার বোঝাবুঝির বাইরে। তোমার সঙ্গে সে খারাপ ব্যবহার করছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা তার চরিত্রের দিক মাত্র। সে তোমার আমার মতো সাধারণ মানুষ নয় চন্দনী। তুমি যে তার কাছে-কাছে কিছু দিনও ছিলে এই জানাটাই তোমার গর্বের কারণ হবে; দেখো!

চন্দনী রেগে বলল, হলে হবে। কিন্তু তোমাকে তো আমি বলেছি, তুমি ওর কথা একবারও তুলবে না। যাকে মন থেকে মুছে ফেলেছি, যে পথে হেঁটে এসেছি, সেদিকে পিছন ফিরে চাইতে চাই না আমি। একবারও।

আমি বললাম, বেশ। আপাতত আমার পথের দিকে না তাকিয়ে শুয়ে থাকো লক্ষ্মী মেয়ের মতো। আমি একটু ঘুরে আসছি।

তারপর বললাম, তোমার কি ভয় করবে একা-একা?

চন্দনী বলল, জানোয়ারের ভয় কোনোদিন করিনি। ভয় মানুষকে। তোমাদের মতো মানুষকে।

-আমি আবার কি করলাম? বললাম আমি।

—ঐ হল। তুমি করোনি, কিন্তু তোমার জ্ঞাতি-গুষ্ঠিরা করে।

বললাম, এসব কথা থাক। সত্যি বলো ভয় করবে কি না!

—কিসের ভয়? তুমি যাও। নারাণদাদের একটু বলে যেও।

নারাণদের ঝুপড়ির কাছে গিয়ে দেখি বলব কাকে। শম্বরের মাংস খেয়ে আজ এরা এমনই বেহুঁশ যে লুঙ্গি একদিকে, শরীর অন্যদিকে করে সব অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কম্ফুর ঝুপড়িতেও সাড়া শব্দ নেই। বাইরে শুধু ছিপ্‌ ছিপ্‌ করে ঝিঁঝি ডাকছে, নালার জল বওয়ার কুলকুলানি, আর পিউকাঁহা, পিউ-কাঁহা ডাক।

আমি বললাম, ঘুমোও তুমি। আমি ঘুরে আসছি একটু।

এখন রাত গভীর। খাদের মধ্যে দূরের নালার পাশে ভারী জানোয়ারের চলা- ফেরার খস্থস্ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে দূর থেকে। শম্বর কি নীলগাই হবে। বাইসন ও হতে পারে। চাঁদের আলোয় পত্রহীন কোমল সাদা গেণ্ডুলি গাছগুলোকে সাদা মোমের মতো দেখাচ্ছে। সাদা সাদা মইফুলগুলোকে সাদা সিল্কের রিবনের ফুল বলে মনে হচ্ছে। রাতে কুসুম, শিমুল, পলাশকে কালো কালো মনে হয়। ওদের শোভা দিনে। খাদের ওপাশে একটা খুব উঁচু পাহাড়। উটের পিঠের কুঁজের মতো তার কুঁজ চাঁদটাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। তারার মালা আকাশময়। চাঁদের রাতে ওদের প্রভা মলিন; তবুও আছে।

চন্দ্রকান্তর সঙ্গে ভালো করে কথা হল না। উনি রাতে যেতে বলেছিলেন। এমন রাতে আর দিনে তফাৎ কি?

চারিদিকে চোখ রেখে নিঃশব্দ পায়ে হাঁটছি। যারা বনে জঙ্গলে ছোটবেলা থেকে ঘোরে, তাদের পা ফেলার কায়দাও শিকারি জানোয়ারের মতো হয়ে ওঠে। নিঃশব্দে, চুপিসারে ছায়ার মতো এগিয়ে যায় তারা। এক ছায়া থেকে অন্য ছায়ায়। ছায়ায় ছায়ায়।

একটা বাঁক নিয়েছি, নিতেই দেখি, সামনে দুজন লোক চলেছে আমার চেয়েও নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে। একজনের কাঁধে একটা দোনলা বন্দুক। চাঁদের আলোয় ব্যারেল চক্‌চক্‌ করছে। একটা লোক বেঁটে, চারকোণা দেখতে, অন্য লোকটা মাঝারি শিকারির মতো জামা-কাপড় পরা। একটু ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে হাঁটছে অন্য লোকটা। ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে।

আমি একটু দাঁড়িয়ে পড়ে ভাববার চেষ্টা করলাম। ঐ লোকগুলো কারা হতে পারে। মনে হল কোথায় যেন দেখেছি এদের।

এরা হয়তো চোরা শিকারি। কিন্তু এই বন-পাহাড়ে শিকারের অভাব নেই যে, অচেনা-অজানা লোক অন্যের সীমানায় না-বলেকয়ে রাতে বন্দুক নিয়ে ঢুকে পড়বে শিকার করতে।

খুব সাবধানে লোক দুটোর পিছু নিলাম আমি।

কিছুদূর গিয়েই লোক দুটো সেই নালাটার ডানদিকে মোড় নিল।

বুঝলাম ওরা চন্দ্রকান্তর ডেরার দিকে যাচ্ছে।

আমার খুব উত্তেজনা হতে লাগল। লোকগুলোর উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ভালো নয়। তারপর মনে হল, কি জানি, চন্দ্রকান্তর ব্যাপার। এরা হয়তো চন্দ্রকান্তর মিত্রই। কি কারণে তারা যে জঙ্গলে সন্ধের পর কোনো মানুষ ঝুপড়ি ছেড়ে বেরোয় না, সে- জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

ওরা নালায় নেমে ডানদিকে যেতেই, আমিও নালায় নামলাম। ওরা তখন বাঁকের ওপাশে চলে গেছে। ওদের দেখা যাচ্ছে না।

এমন সময় অতর্কিতে নালার সামনে থেকে প্রচণ্ড জোরে বাঘ ডেকে উঠল হয়তো বাঘ নালার গভীরে জল খাচ্ছিল। লোক দুটো মুখোমুখি পড়ে গেছে বোধহয়।

বাঘের গর্জনে সমস্ত বন-পাহাড় গমগম করে উঠল। আকাশের তারাগুলোও কেঁপে গেল যেন। সেই গর্জনে গভীর বিরক্তি ও খবরদার ধ্বনিত হচ্ছিল।

পরক্ষণেই নালা বেয়ে জোরে মানুষের ছুটে আসার আওয়াজ হল।

আমি তাড়াতাড়ি পথে উঠে ওরা যে-দিক দিয়ে এসেছিল তার বিপরীত দিকে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়লাম।

লোকগুলো মূর্খ। শিকারি তো নয়ই। বাঘের সামনে পড়ে যে ভুলেও দৌড়তে নেই তাও জানে না। কিন্তু বাঘের আর আওয়াজ শোনা গেল না। শুধু লোক দুটো দৌড়ে এল। এসে রাস্তার ওপরে উঠে হাঁপাতে লাগল। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটা বন্দুকটাকে শিকারের পোশাক-পরা লোকটাকে দিয়ে দিয়েছিল। দিয়ে রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। লোকটা নালার দিকে বন্দুকটা তাক করে দাঁড়িয়েছিল। ভাবটা, বাঘ যদি এত দূরে তাড়া করে আসেই, তবে গুলি করে ভূপাতিত করবে।

চাঁদের আলোয় ঐ শিকারের পোশাক-পরা লোকটাকে চিনতে পারলাম আমি। যে লোকটাকে চন্দ্রকান্তর মাচার কাছে সকালবেলা বাঁকের মুখে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছিলাম, এ লোকটা সেই-ই লোক।

ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটার মুখের একটা পাশ চাঁদের আলোয় চক্‌চক্‌ করে উঠল। হঠাৎ তাকে চিনলাম। এ সেই গাল-পোড়া জানোয়ার। ছবি ঠিকাদার।

লোকটা অনেকক্ষণ পর দম নিয়ে বলল, শালা বাঘ পুষে রেখেছে। বডিগার্ড! ঠিক আছে। সব জায়গায় তো বডিগার্ড সঙ্গে যাবে না। আজ ছাড়া পেলে বলে কি চিরদিনই পাবে?

ওরা এতাবৎ যে সাবধানতা অবলম্বন করে এসেছিল এতটা পথ, বাঘের ভয়ে সেই সাবধানতার কথা ভুলে গেল। জঙ্গলে ফিফিস্ করে বলা কথাও বহুদূর থেকে শোনা যায় এই সত্যটা ওরা জঙ্গলের লোক হয়েও বিস্মৃত হল।

গাল-পোড়া লোকটা বলল, চল্ খিটু, চন্দনীকে তুলে নিয়ে যাই ফেরার সময়।

খাকি পোশাক-পরা লোকটা বলল, না ছবিবাবু, চন্দ্রকান্তকে আগে সামলে না নিলে ও কাজ ভালো হবে না। ঝামেলা করবে লোকটা। খুবই ঝামেলা করবে।

ছবি নায়েক পাঞ্জাবির পকেট থেকে মদের বোতল বের করে চুচুক্ করে খেল। চাঁদের আলোয় সাদা বোতলটা চক্‌চক্‌ করে উঠল। লোকটার সমস্ত হাবভাব, এমনকি মদ খাওয়ার ভাবটাও কেমন চোর-চোর। লোকটা সারাজীবনে বোধহয় কখনও সোজা হয়ে দাঁড়ায়নি, সত্যি কথা বলেনি। এই চাঁদের আলোতেও জানোয়ারটার চারিত্রিক শঠতা যেন প্রাঞ্জলভাবে তার পোড়া গাল থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।

পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে মুখ মুছে ও বলল, না চল্‌, আমি এক্ষুনি যাবো। দরকার হলে চন্দনীর ঐ বাবুটাকেও আজ শিক্ষা দিয়ে দেবো। শালাকে মেরে নদীর বালিতে পুঁতে দেবে।

-ছবিবাবু, আস্তে। খিটু নামক অন্য লোকটা বলল।

ছবি বলল, চুপ্ কর শালা! আমি কি তোর মতো ভীতু? আমি কাউকে ভয় করি না। আমি এ তল্লাটের রাজা। থানার দারোগা, ফরেস্টার, পঞ্চায়েত সব আমার কেনা। কিসের ভয় রে আমার?

ওরা আবার সাবধান হয়ে এগোতে লাগল ফেরা পথে। কিন্তু ফেরার পথে ছবি ঠিকাদারের চামড়ার পাম্পশু পাথরে লেগে চটাস্-ফটাস্ করে শব্দ করছিল।

ওরা একটু এগোতে, আমি আবার ওদের পিছু নিলাম।

খুনোখুনি করার ইচ্ছা আমার ছিল না। করিওনি কখনও মানুষের সঙ্গে। তবে জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে প্রয়োজন হলে করেছি এবং করতেও পারি। তার উপর যখন নিজের প্রাণ খোয়ানোর প্রশ্ন ওঠে বা নিজের সম্মান বা প্রিয়জনের সম্মান খোয়ানোর, তখন খুনোখুনি না করে উপায় কি? কিন্তু পিস্তলটা যে বালিশের তলায় রেখে এসেছি!

সামনে আরেকটা বাঁক

ওরা বাঁকের মুখে অদৃশ্য হতেই, কার রাইফেলের নল যেন আমার পিঠে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা সংক্ষিপ্ত আওয়াজ, চুপ।

আমি ঐ অবস্থায় সাবধানে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি চন্দ্রকান্ত! মুখ-চোখ অস্বাভাবিক!

আমার সেই মুহূর্তে মনে হল চন্দ্ৰকান্ত বুঝি আমাকে এক্ষুনি গুলি করবেন। চন্দনী এখানে আমাকে আশ্রয় করেছে বলে অথবা আমি চন্দনীকে।

আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। মুহূর্তের মধ্যে ওঁর মুখের ভাব বদলে গেল। কিন্তু ঐভাবেই চুপ করে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে রইলেন উনি বেশ অনেকক্ষণ।

ছবি নায়েকদের দূরে চলে যাওয়ার সময় দিয়ে, চন্দ্রকান্ত বললেন, কার দলে আপনি

আমার লোকটার উপর হঠাৎ বড় ঘৃণা হল। এক ঝটকায় রাইফেলের নলটা সরিয়ে দিয়ে বললাম, আপনি একটা ইডিয়ট।

আমার কাছ থেকে ঐ কথা শোনার জন্যে চন্দ্রকান্ত তৈরি ছিলেন না।

কিন্তু আমার পিঠে ঐভাবে অতক্ষণ রাইফেলের নল ঠেকিয়ে রাখাতে আমি খুবই অপমানিত বোধ করেছিলাম। যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর।

চন্দ্রকান্ত ব্যাপারটা বুঝলেন সঙ্গে সঙ্গে। আমার পিঠে হাত ছুঁইয়ে বললেন, স্যরি।

এই পরিবেশে, এই জঙ্গলে, শহরে উঠতে-বসতে শোনা নিশ্বাসজাত এই ‘স্যরি’ কথাটা বড় বেমানান বলে মনে হল।

আমি ফিফিস্ করে চন্দ্রকান্তকে বললাম, ওরা বোধহয় চন্দনীর কাছে যাচ্ছে।

চন্দ্রকান্ত বললেন, যাক না তাতে আমার কি?

আমি আবার একটা ধাক্কা খেলাম।

বললাম, আপনার না হতে পারে; আমার হয়তো কিছু।

চন্দ্রকান্ত কথা ঘুরিয়ে বললেন, ওরা যাবে না। সে সাহস ওদের নেই। আমি বলছি; নেই। তাছাড়া গেলেও আপনার ভয় নেই, কম্ফু আছে। ও একাই একশো।

আমি বললাম, কম্ফু ঘুমোচ্ছে। তাছাড়া ওকি ঐ সাপমুখো লাঠি নিয়ে বন্দুকের সঙ্গে লড়বে।

চন্দ্ৰকান্ত এক অদ্ভুত হাসি হাসলেন।

তারপর বললেন, কম্ফু কখনো ঘুমোয় না।

আফিং-খাওয়া দিনে-ঘুমানো লোকগুলোর আত্মীয় হলেও, কম্ফু ওদের কেউ হয় না। ও সবসময় জেগে থাকে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আর লড়তেই যদি কেউ চায়, তাকে কি বন্দুক দিয়ে ঠেকানো যায়?

আমি বললাম, চলুন আমরা ওদের পিছু নিই। ওরা আপনাকে মারতে এসেছিল আর এমনি করে ওদের ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হল?

চন্দ্রকান্ত সে কথায় কান না দিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন, চলুন, আমার ডেরায় চলুন, অনেক গল্প করা যাবে।

তারপর বললেন, সব কিছুর সময় আছে। আপাতত আপনি ডা. ওয়াটসন হয়ে থাকুন, শার্লক হোমসের রোলটা আমাকেই দিন। কেমন?

আমি হাসলাম। বললাম, ঠিক আছে।

নালাটাতে নেমে, চন্দ্রকান্ত কয়েক পা এগিয়েই নালাটা ছেড়ে দিয়ে ডানদিকে উঠলেন। উঠে একটা শর্টকাটে ভিতরে ঢুকলেন জঙ্গলের।

আমি বললাম, বাঘটা কি নালার সব জলই খেয়ে নেবে নাকি আজ রাতে? এতক্ষণ তো এক জায়গায় থাকার কথা নয়।

চন্দ্রকান্ত বললেন, বাঘটা একটা বড় চিতল হরিণ মেরেছে কাল সন্ধেতে। নালার মুখেই, আজ ভোজ শেষ করে তারপরে যাবে।

—ওঃ। আমি হাসলাম। বললাম, ছবি নায়েক দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে কি বলছিল জানেন?

কি? চন্দ্রকান্ত শুধোলেন।

আমি বললাম, আপনি নাকি বাঘটা পুষে রেখেছেন বডিগার্ড হিসেবে।

চন্দ্রকান্ত হেসে উঠেলেন একথা শুনে। বললেন, ওর মতো ছুঁচোর জন্যে বেড়ালই যথেষ্ট, কুকুরেরও প্রয়োজন নেই, বাঘের মতো মহৎ ও পরাক্রমশালী জানোয়ারের কথাই ওঠে না।

আমি আর চন্দ্রকান্ত মাচার নীচে একটা বড় পাথরে বসলাম মুখোমুখি।

বসেই, চন্দ্রকান্তকে একটু চুপ করতে দেখে বললাম।

ওখানে বসে বাঘটার কড়মড়িয়ে চিতল-হরিণের হাড় ভেঙে খাওয়ার আওয়াজ শোন যাচ্ছিল।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, বাঘটা সত্যিই পোষা নাকি?

চন্দ্রকান্ত হাসলেন। বললেন, এক বাঘ অন্য বাঘের সীমানাকে সমীহ করে। আমি আমার সীমানাতে আছি।

তারপরেই বললেন, কিছু খাবেন?

—কি আছে?

চন্দ্রকান্ত বললেন, মুড়ি আছে, গুড় আছে, মধু আছে। খাবেন?

আমি বললাম, নাঃ। অনেক খেয়েছি আজ।

তারপর বললাম, আপনার প্ল্যান কি বলুন? এই জঙ্গলে বসে কি করতে চাইছেন আপনি? হাতীটা না মারলে তো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারতেন। এমনি করে পালিয়ে পালিয়ে কতদিন কাটাবেন?

চন্দ্রকান্ত হাসলেন। বললেন, বাকি জীবন। এখন হাতী মারার অপরাধে ফেরার, কয়েকদিন বাদে অন্য কোনো অপরাধে ফেরার। অপরাধের সংখ্যা বেড়েই যাবে একে একে—পালাতে হবে আরো গভীর জঙ্গলে। এই-ই তো মজা! একঘেয়ে নিশ্চিন্ত জীবন আমার ভালো লাগে না, জানেনই তো।

ভয় পেয়ে বললাম, ছবি নয়েককে নিয়ে কি করবেন আপনি? নিশ্চয়ই প্রাণে মারবেন না।

তারপর বললাম, প্রাণে না মেরে শিক্ষা দিলে হত না?

—শিক্ষা দিলেও শিখছে কে? গাল-পোড়া ছুঁচোর ঐ একমাত্র শিক্ষা।

আমার সত্যিই ভয় করছিল। খুনীর সাগরেদ হিসাবে আমাকেও টানাটানি না করে।

আমি বললাম, পুলিশ? যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হবে, কি ফাঁসী।

চন্দ্রকান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, হলে, হবে।

আমি বললাম, যাগে, হাতীটা কি করে মারলেন বলুন। কেন মারলেন? এটা কোন হাতী? সেই দাঁতালটা বিড়িগড়ের?

—না মশাই। বিড়িগড়ের দাঁতাল কি মহানদী সাঁতরে আমার পেছন পেছন এতদূরে এসেছিল। না! এ বলরামের হত্যাকারী নয়। তবে ও সেই হত্যাকারী শ্রেণীরই।

বলেই চন্দ্রকান্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন!

বললেন, আপনি এখনও প্রেমের গল্প লিখে যাচ্ছেন?

আমি বললাম, কেন? প্রেমে কি আপনার ঘেন্না?

—না, তা নয়। নর-নারীর প্রেম তো থাকবেই, চিরদিনই থাকবে। তা বলছি না, তবে প্রেম বলতে আপনারা যা বোঝেন আমি তার চেয়ে অনেক গভীরতর কিছু বুঝি। মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম।

আমার প্রেম এই কম্ফুদের প্রতি, নারাণদের প্রতি, এ-রকম লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি দিশী মানুষের প্রতি। এখানে ন্যাকা ডায়ালগের জায়গা নেই। এ প্রেম তরল নয়; সলিড। এ কারণেই চন্দনীর জায়গা হল না আমার জীবনে।

তারপর বললেন, লিখে যান, চালিয়ে যান আপনারা। ভালো রোজগার হচ্ছে। কি বলুন?

একটু থেমে বললেন, পঞ্জিকা কিন্তু আপনাদের বইয়ের চেয়েও বেশি বিক্রি হয়।

আমি আড়মোড়া ভাঙলাম। কিছু বললাম না।

কথা ঘুরিয়ে আমি বললাম, এসব খুনোখুনির ভাবনা ভালো নয়। আপনি বরং ছবি নায়েকের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করুন।

—কেস্? কোর্টে?

বলেই হাসলেন চন্দ্ৰকান্ত।

বললেন, তাহলে আপনি ঐ হাতীটার বিরুদ্ধেও কোর্টে কেস ফাইল করতে বলতেন বোধহয়। অতবড় জানোয়ারের বিরুদ্ধে কেস কি হাইকোর্ট নিত? হাতী কী সেন্ট্রাল সাবজেক্ট? তাহলে তো এখন সুপ্রীম কোর্টেই ফাইল করতে হবে। আমি না-হয় দিল্লি পৌঁছে যেতাম; কিন্তু হাতীটা? তারপর রায় বেরোলে অতবড় হাতীটাও কি সেই ভারী রায় বয়ে আনতে পারত?

আমি বললাম, সব কথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

চন্দ্রকান্ত বললেন, হ্যাঁ। হাতীটার কথাই বলি। ঐ হাতীটা বুঝলেন, সমস্ত এলাকাটাকে তার পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখেছিল। ঘর ভাঙছিল, ধান খাচ্ছিল, মানুষ মারছিল একেবারে ঠাণ্ডা মাথায়। গরু-মোষকেও আছড়ে পায়ের তলায় ফেলে মারছিল। তার চলার পথে যা-কিছু সে পাচ্ছিল, তাকেই সে সমূলে উৎপাটিত করছিল।

চন্দ্রকান্ত একটু থামলেন। কান খাড়া করে কি যেন শুনলেন। একবার।

তারপর আবার বলতে লাগলেন। সে যে কী ভয় কী বলব আপনাকে। লোকে ঘরের মধ্যে কথা কইতে ভয় পেত, পথে বেরোতে ভয় পেত, মাথা উঁচু করে হাঁটতে ভয় পেত, হাতীটা প্রত্যেকটা লোকের বুকের মধ্যে ভয় একেবারে সেঁধিয়ে দিয়েছিল, সবসময় ভয়, সবসময় হাতীর ভয়ে জবুথবু হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। গ্রামে ধান-কাটা বন্ধ, গান-গাওয়া বন্ধ, যাত্রা বন্ধ, সব কিছু, সব সাধারণ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে এসেছিল।

গ্রামের লোকগুলো বলত হাতী। কিন্তু আমি বলতাম, ওদের বুঝোতাম যে, আসলে ওদের শত্রু হাতীটা নয়। কারণ ঐ হাতীটা মরে গেলে, কি তাকে মেরে ফেললে, অন্য কোনো হাতী ওর জায়গা নিতই। আসলে ওরা বুঝতে পারেনি যে হাতীটার ছায়া ওদের প্রত্যেকের বুকের মধ্যে পড়েছে। সেই ছায়ার নাম ভয়। যারা সহজে ভয় পায়, তাদের ভয় পাওয়ানোর জন্যে সবসময়ই কোনো দৈত্য, দানো, জুজু অথবা এই হাতীর মতো হাতী থাকবেই থাকবে। আসল শত্রু ভয়টা, হাতীটা নয়।

আমি চুপ করে চন্দ্রালোকিত বন-পাহাড়ের দিকে চেয়েছিলাম। রাত-চরা পাখির ডাক ভেসে আসছিল পাহাড়ের উপরের মালভূমি থেকে। শিমুলবনের নীচের শিমুলফুল খেতে আসা কোট্রা হরিণের ডাকের শব্দে বিমুগ্ধ হয়ে চন্দ্রকান্তর কথা শুনছিলাম।

চন্দ্রকান্ত বললেন, বুকের মধ্যে ভয় নিয়ে বাঁচাকে কি বাঁচা বলে?

তারপরই বললেন, আপনি জিম করবেটের “জাঙ্গল-লোর” বইটা পড়েছেন?

বললাম, ও বই কে পড়েনি?

—ওখানে ‘চুরাইলের’ যে সেই ঝড়ের বিকেলের তীক্ষ্ণ বাঁশীর ভৌতিক স্বরের কথা উনি লিখেছেন এবং সেই ভয়ের রহস্য উদঘাটনের কথাও—তাতে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, আপনার মনে আছে কি?

—কি বলেছেন? আমি বোকার মতো শুধোলাম।

—মনে নেই? চন্দ্ৰকান্ত বললেন। বলেছেন, যা-কিছুই বিপজ্জনক, তার প্রতিই প্রত্যেকের এক অদম্য আকর্ষণ ও কৌতূহল থাকে, এমন কি ছোট ছেলেদেরও। এক ঝড়ের বিকেলে সেই ভয় বুকে করে ভয়কে জয় করার জন্যে উনি গিয়ে বাঁশীর রহস্য উদঘাটন করলেন। দেখলেন, ঝড়ে একটা মহীরুহ আর একটা মহীরুহর উপর পড়ে গেছিল অনেকদিন আগে। তখন দুটো গাছই শুকনো হয়ে গেছে। খুব জোরে ঝড় উঠলে সেই গাছটাকে হাওয়া ঠেলে তুলত কিছুটা, পরক্ষণেই হাওয়া সরে গেলে সে আবার পড়ত এসে শুকিয়ে-যাওয়া ছোট মহীরুহর উপরে। শুকনো কাঠের সঙ্গে শুকনো কাঠের ঘর্ষণে তা থেকে তীক্ষ্ণ বাঁশীর সুরের মতো আওয়াজ উঠত, তাতেই লোকে ভয় পেত। ভূত বলত। তাই-ই বলছিলাম, বুকের মধ্যের ভয়কে তাড়াতে পারলেই যে-কেউই দেখতে পাবে বেশীরভাগ ভয়ের বাঘ মাত্রই কাগুজে বাঘ, বেশীরভাগ ভূতই শুকনো কাঠ।

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম।

চন্দ্রকান্ত বললেন, একদিন আমি সন্ধের মুখে মুখে পূর্ণাকোট থেকে ফিরে আসছি টুল্বকায়। দুপুরে বেরিয়েছিলাম। অনেকখানি পথ। গ্রামের কাছাকাছি এসেছি। দেখি, হাতীটা পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে যদি যেতে হয় তাহলে ওর পাশ কাটিয়ে যেতে হত।

—আমি দাঁড়িয়ে আছি, ও-ও তাই। পথ ছাড়বার পাত্র আমি নই। কিন্তু আমার হাত খালি ছিল। ফোরসেভেন্টি ডালব্যারেল রাইফেল ও গুলি রাখা ছিল কুঁড়েতে ভীমধারার পাশে। চন্দনীর জিম্মায়।

তারপর বললেন, পরিষ্কার মনে পড়ে এখনও। বর্ষাকাল, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। সেগুন পাতা থেকে, শিয়াড়ী ও গিলিরী লতা থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠছিল। ভরা ভাদ্দর। পথের দুদিকে একেবারে নিশ্ছিদ্র জঙ্গল। হাতীটা বড় বড় গাছপালার ডালের সঙ্গে কাঁধ ছুঁইয়ে শুঁড় দোলাচ্ছে। হাতীটা যদি পথ ছেড়ে চলে যেত, অথবা আমাকে চলে যেতে দিত তাহলে ঐ কাণ্ড হত না।

সকলকেই ভয় দেখিয়ে, মেরে, জবুথবু করে একেবারে মেগালোমানিয়াক্ হয়ে উঠেছিল। ওর ধারণা হয়েছিল, যে ওকে ভয় না পাবে, ওর বশ্যতা স্বীকার না করবে এমন লোক বুঝি কোথাও নেই! ওর যা খুশি ও তা-ই করবে।

আমি যখন যেমনভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, তেমনই রইলাম, ওকে দেখে নড়লাম না, তখন ও আমার দিকে সোজা তেড়ে এলো—প্যা—এ-এ-এ-এ আওয়াজ করে। বিশ্বাস করুন। জীবনে ঐ প্রথমবার আমিও ভয় পেলাম। অত বড় দাঁতাল হাতীটা, তার শুঁড়-তোলা অবস্থায় সোজা আমাকে পিষ্ট করার জন্যে তেড়ে আসছিল। কালো আকাশ, ওর কালো শরীর, কালচে সবুজ বনের পটভূমিতে ওর সাদা দাঁতটা প্রকট হয়ে উঠেছিল।

আমি বললাম, তারপরে কি হল?

উনি বললেন, সেদিন প্রাণ বাঁচাতে বড় অপমানের সঙ্গে গ্লানির সঙ্গে এক-বুক ভয় নিয়ে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পথের পাশের ছোট নালায়-নালায় বুকে হেঁটে মাথাটা প্রায় মাটির মধ্যে লুটিয়ে কোনোক্রমে ভীমধারার পাশে ফিরে এলাম। বড় লজ্জায়। সত্যিই বড় লজ্জায়।

চন্দনী আমাকে দেখে দৌড়ে এল। বলল, কি হয়েছে, তোমার কি হয়েছে? আমি বললাম, কিছু না। কিন্তু আমার সমস্ত বুক তখনও ভয়ে ভর্তি ছিল। খেতে বসেও খেতে পারলাম না। সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না। এ-পাশ ও-পাশ করলাম বিছানাতে। তারপর শেষবার ভেবে ভেবে ঠিক করে ফেললাম যে, হয় আমার ভয় থাকবে না বুকে, নয় আমিই থাকব না। কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমি অথবা এই ভয়-দেখানো হাতীটার মধ্যে একজন থাকবে।

পরদিন সূর্য ওঠার আগে আগেই রাইফেলটা আর কার্তুজগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম টুল্বকা বস্তির একজন বুড়ো লোককে সঙ্গে নিয়ে।

চন্দ্ৰকান্ত অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে যেন সব পুরোনো কথা মনে আনছিলেন।

বললেন, প্রথমে আগের দিন বিকেলে যে জায়গায় হাতীটা আমার পথ আটকেছিল সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। বর্ষাকাল, তার উপর সন্ধে থেকে সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। মাটি নরম হয়ে ছিল। হাতীর ভারী পায়ের দাগ মাটিতে বসে গেছিল। তাই তাকে ট্র্যাক করতে অসুবিধে হল না।

আমাকে তাড়া করে জোরে দৌড়ে গিয়ে হাতীটা পথ ছেড়ে দিয়ে গতকাল গাঁয়ের দিকে গেছিল। সে-রাতেও দুটো ঘর ভেঙেছে দেখলাম, একটা সাদা বাছুর চালার নীচে বাঁধা ছিল। সেই বাছুরটার উপর প্রথমে চালাটাকে ভেঙে ফেলে দিয়ে তারপর চালার উপর পা তুলে দিয়ে, হাতীটা পায়ে চেপে চেপে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার মতো করে বাছুরটাকে মেরেছিল।

হাতে রাইফেল দেখে দুজন লোক দৌড়ে এসে আমার হাতে পায়ে ধরছিল হাতীটা মেরে দেওয়ার জন্যে। বলছিল, পুরো গ্রামের আমরা না খেয়ে মরে যাব। হয় না খেয়ে, নয়তো হাতীর পায়ে। এর একটা বিহিত করো বাবু। তোমার কাছে আমরা কেনা গোলাম হয়ে থাকব।

আমি জঙ্গলের পাশে বসে থেকে বুড়োকে পাঠিয়েছিলাম, খোঁজ খবর করতে। ও খোঁজ খবর নিয়ে এল হাতীটা গ্রাম ছেড়ে পুবে গেছে। আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে গিয়ে গ্রাম এড়িয়ে আবার হাতীর পায়ের চিহ্নে এসে পৌঁছলাম।

রাইফেল হাতে গ্রামের মধ্যে নিজে যেতে চাইনি। কারণ স্বজন ও আত্মীয়র মতো শত্রু আমাদের আর কেউই নেই। যাদের ভালো হবে হাতীটা মারলে, এই অত্যাচারটাকে শেষ করলে, তাদেরই মধ্যে কেউ বন-বিভাগে গিয়ে আমার নামে নালিশ করবে। ফরেস্ট গার্ডের চেয়ে ভালো আর কেউই জানবে না যে, হাতীটা মারা পড়ায় তার নিজের প্রাণও বেঁচেছে। কিন্তু যেই তার প্রাণ বাঁচবে, অমনি সে মানের জন্যে, ডি-এফ-ও সাহেবের পিঠ-চাপড়ানির জন্যে দৌড়ে গিয়ে সদরে আমার নামে লাগিয়ে আসবে। এ-এক আশ্চর্য দেশ! আশ্চর্য মানুষের দেশ! অথচ কী দারুণ দেশ!

আমি বললাম, আপনি যা বলছিলেন, তা থেকে সরে যাচ্ছেন বার বার।

—ওঃ? বলে, চন্দ্রকান্ত একটু থেমে আবার শুরু করলেন।

—ঝক ঝক করছিল রোদ। রাতভর বৃষ্টির পর। গাছে পাতায় পাহাড়ে পারে রোদ ঠিকরে যাচ্ছিল। জঙ্গলের গভীর থেকে গ্রামের ফসল লাগানো ক্ষেতগুলো ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল। ক্ষেতে-ক্ষেতে ধান লাগিয়েছে, ভুট্টা লাগিয়েছে, ছোট ছোট ছেলেরা পাখি তাড়াবার জন্যে ক্ষেতের মধ্যে বানানো মাচায় বসে বাঁশী বাজিয়ে মিষ্টি সুরের গান গাইছে। সেই সকালের শান্ত, সুন্দর উজ্জ্বল আবহাওয়ায় ওদের কচি গলার গান আর বাঁশীর সুর বহুদূর থেকে ভেসে আসছে হাওয়ায় হাওয়ায় তির্ তির্ করে।

হঠাৎ সামনে একদল হাতী চোখে পড়ল। হাতীগুলো খুব আস্তে আস্তে পাহাড়ের খোল বেয়ে গভীরতর জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিল। বোধহয় ধুলোয় কোথাও গড়াগড়ি দিয়েছিল, অথবা কাদায়। গায়ে লাল ধুলো মেখে, লাল মাটির কাদা লেপে ধীর গতিতে গজেন্দ্রগমনে চলতে-থাকা সারিবদ্ধ হাতীগুলোকে ঘন সবুজ জঙ্গলের আর নীল আকাশের পটভূমিতে পুঞ্জ-পুঞ্জ সিঁদুরে মেঘ বলে মনে হচ্ছিল।

অনেকক্ষণ সেদিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমি।

বুড়ো বলল, কি দেখছ বাবু?

আমি বললাম, দ্যাখ বুড়ো, কি সুন্দর দেখাচ্ছে!

বুড়ো বলল, সুন্দর না ছাই! ব্যাটাদের সবকটাকে মেরে ফেলতে পারো তো বুঝি। ফসল করার উপায় নেই। ক্ষেত করার উপায় নেই। গুণ্ডামির জ্বালায় প্রাণ বাঁচানো দায়।

আমি হাসলাম। বললাম,, তোরা বন কেটে ফসল করবি আর দোষ হবে ওদের। ঠেলতে ঠেলতে তোরা ওদের কতটুকু জায়গাতে কোণঠাসা করেছিস বলত?

বুড়ো বলল, ঠিক আছে। এমনি হাতীদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া নেই। যদিও ফসল নষ্ট করে সকলেই। যে গুণ্ডাটার সঙ্গে ঝগড়া তার পায়ে পায়ে চল।

জঙ্গল গভীর থেকে গভীরতর, গভীরতর থেকে গভীরতম হচ্ছে। ভালো করে দেখা যায় না চোখে; দিন-দুপুরেও। জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে নালা গেছে অনেক। বর্ষার জল চলেছে কুলকুল করে। হাতীটা পা দিয়ে নরম মাটি চেপে চেপে শক্ত করে নিয়ে তার উপরে পা ফেলে নালা পেরিয়েছে।

আমরা কতদূর চলে এসেছি খেয়াল নেই। হঠাৎ বুড়ো ফিসফিস্ করে বলল, বাবু সাবধান। আমরা তেঁতুলিডিহর কাছে এসে গেছি।

আমি বললাম, সেটা কি?

—হাতীর ঘর। এই জঙ্গলের মধ্যে কয়েক শ’ বছর আগে একটা গড় ছিল। কোল্হো রাজাদের। সেই গড়ের চারপাশে উঁচু জমি। বড় বড় তেঁতুল গাছ। এত বড় বড় তেঁতুল গাছ যে দিনের বেলাও রাতের অন্ধকার। কোনো ফরেস্ট গার্ড কখনও জীবনে এই ডিহর ধারে-কাছে আসে না। আমিও আসি না। এখানে হাতীদের ঘর। এখানে ওরা ওদের মেয়েদের ভালোবাসে—এখানে বাচ্চা হয় হাতীদের।

একটু থেকে চন্দ্রকান্ত বললেন, একে তো আমার বুকে ভয় সেঁধিয়ে দিয়েছে হাতিটা—তার উপর ঐ জায়গায় পৌঁছে এবং বুড়োর কথা শুনে ভয় আরো বেড়ে গেল। তখন হাঁপানীও তো পুরোমাত্রায় ছিল, ঐ অবধি হেঁটেই দম ফুরিয়ে গেছিল একবোরে।

বললাম, কথা বলিস্ না। গুণ্ডা হাতীটা কাছাকাছিই আছে। দেখছিস্ না কিরকম ছম্ ছম্ করছে চারধার?

এখন আর দাঁড়িয়ে চোখ চলে না। এত গাছপালা, লাতাপাতা। সমস্ত জায়গায় হাতী ছাড়া আর কোনো জানোয়ারেরই পদচিহ্ন নেই। তেঁতুলিডিহর চারপাশ নানারকম গর্ত হামানদিস্তার মতো। কতগুলো টাটকা, কতগুলো পুরোনো, শুকিয়ে গেছে। যেগুলো খুব পুরোনো সেগুলোর উপর লতিয়ে আছে বুনো লতা। না দেখে পা ফেললে, পা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা।

আমরা হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিলাম। আগে পরে নয়। দশ-বারো হাত দূরে পাশাপাশি, যাতে অনেকখানি জায়গায় নজর রাখতে পারি।

মনে হল আবার সামনেই একটা নালা। ঝর্ ঝর করে জল বওয়ার শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ বুড়ো স্তব্ধ হয়ে গেল দেখলাম। চার হাত-পায়ে মাটির উপর ব্যাঙের মতো বসে ও যেন মাটির সঙ্গে মিশে গেল। কাদামাখা অবস্থায় অদ্ভুত দেখাচ্ছিল ওকে—ও একবার আমার দিকে তাকাল, তারপরেই ওর চোখ ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল। সামনের দিকে বিস্ফারিত চোখে ও তাকিয়ে ছিল।

আমি সামান্য এগিয়ে যেতেই দেখলাম, গুণ্ডা হাতীটা নিথর পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে ডিহর পাশে। তবে শুঁড়ের ডগা চোখের পাতাটি পর্যন্ত এতটুকু কাঁপছে না। অতবড় জানোয়ার যে কী করে অমন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

হাতীটার চোখ দুটো নিষ্পলকে বুড়োটাকে দেখছে। বুড়োকে ও দেখে ফেলেছে, তাই বুড়োর দু-চোখ ভয়ে বিস্ফারিত।

আমি যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে হাতীর মগজে গুলি করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তক্ষুনি গুলি না করলে বুড়োকে বাঁচানো যেত না। আমাকেও।

আমি হাঁপাচ্ছিলাম, কোনো ক্রমে নিঃশ্বাস বন্ধ করে হাতীটার হৃদয় লক্ষ করে আধো শুয়ে আমি গুলি করলাম। হাতীটা আমার কাছ থেকে বড় জোর দশ-পনেরো হাত দূরে ছিল।

গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে ওর সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি খেলে গেল।

মনে হল ও এক দৌড়ে গিয়ে বুড়োর উপর পড়বে অথবা আমার উপরে। আমি বাঁ দিকের ট্রিগারে আঙুল ছুঁইয়ে শুয়েই রইলাম। কোনো নড়াচড়া বা শব্দ করছিলাম না যাতে আমাকেও দেখে ফেলতে পারে ও।

পুরো এক মিনিট হয়ে গেল, তখনও হাতীটা যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনিই দাঁড়িয়ে রইল। আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। তাহলে কি গুলি লাগেনি? দশ হাত দূর থেকে গুলি লাগল না? গুলি লাগলেও হয়তো ওর হৃদয়ে পৌঁছয়নি গুলি। পরমুহূর্তেই আর না-ভেবে ঐ একই জায়গায় আমি তাক করে বাঁ দিকের ব্যারেলও ফায়ার করলাম।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হল জঙ্গলের নালাটা হাতীর শরীর থেকে ঝর্ণা হয়ে পড়ছে। হাতীটার বুক থেকে ফোয়ারার মতো রক্ত বেরোতে লাগল মোটা ধারে। ছড় ছড় শব্দ করে সে রক্ত পড়তে লাগল। সেই গরম দুর্গন্ধ রক্ত ছিটকে আসতে লাগল আমাদের মুখে, চোখে, গায়ে।

হাতীটা তবুও দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না একটুও।

আমি এবার আস্তে আস্তে বুকে হেঁটে পৌঁছবার চেষ্টা করতে লাগলাম। রাইফেল খুলে গুলির-লোড করলেই শব্দ হবে। বুড়ো কি করছে তখন দেখার সময় ছিল না। পৌঁছোতে পৌঁছতেই দেখলাম যে, হাতীটার গা থরথর করে কাঁপছে। হঠাৎ হাতীটা সামনের একটা গাছের ডালকে শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে জোর পাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। গাছের পাতাগুলো ডালগুলো প্রচণ্ড জোরে ঝেঁকে উঠল, তারপর মড়াৎ করে ভেঙে গেল ডালটা। ডালটাকে শুঁড়ে জড়িয়ে ধরে হাতীটা হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল।

আমরা যখন তেঁতুলিডিহর ঘন অন্ধকার গা-ছমছম এলাকা পেরিয়ে আলোতে এলাম, তখন আমার বুকটা হাল্কা লাগতে লাগল। আমার বুকের ভয়, হাতীটার বুকে, তার রক্তের ফোয়ারার মধ্যে সেঁধিয়ে দিতে পেরেছি জেনে ভালো লাগল। হাতীটা বড় ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আমায়।

যখন ফিরে আসছিলাম, আবার ধান-ভুট্টার ক্ষেতের পাশ দিয়ে বিকেলের রোদের মধ্যে ফসল পাহারা দেওয়া ছেলেদের গানের মধ্যে তখন ভালো যেমন লাগছিল, হঠাৎ হঠাৎ বড় খারাপও লাগছিল। নিজেকে একবার ভীষণ গর্বিত, বড় শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছিল, আবার পরক্ষণেই বড় হীন, দুর্বল, বড়ই তুচ্ছ বলে। অন্যজনের বুকের রক্তে ফোয়ারা ছুটিয়ে নিজের বুকের ভয়কে উড়িয়ে দিলাম তবুও।

অনেকক্ষণ তারপর চুপ করে থাকলেন চন্দ্ৰকান্ত!

হঠাৎ বললেন, আচ্ছা, কেন এমন হয় বলুন, তো? আমরা সম্পূর্ণ ভাবে জানি না নিজেদের। নিজেদের বুঝতে পারি না কেন?

আমি হাসলাম একটু। হেঁয়ালীর মতো দেখালো বোধহয় আমার হাসিটা।

বললাম, কি জানি? বোধহয় আমরা মানুষ বলে।

চন্দ্রকান্ত বললেন, হয়তো। হয়তো তাই।

চন্দ্রকান্তর গল্প শুনতে শুনতে কখন যে আকাশে মেঘ জমেছে লক্ষ করিনি। ছেঁড়া-ছেঁড়া কালো মেঘ, ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে আকাশময় ওড়াউড়ি করছে। ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করছে। আবাহাওয়া সত্যিই দেখতে দেখতে বৃষ্টির মতোই হয়ে উঠল।

আমি নিজের মনেই হেসে উঠলাম।

চন্দ্রকান্ত বললেন, কি হল?

বললাম, ব্যাঙ ডাকছিল, চন্দনী কিন্তু তখনই বলেছিল যে, বৃষ্টি হবে। আমি বলেছিলাম, হতেই পারে না—দোল পূর্ণিমার দুদিন আগে বৃষ্টি হয়? আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। ও বলেছিল, হবেই! বাজী হারলাম দেখছি

চন্দ্রকান্ত হাসলেন।

বললেন, সত্যিই তো। হবে মনে হচ্ছে।

আমি বললাম, আমি চলি এবারে। বৃষ্টি সত্যিই এলে মুশকিল হবে। সব ভিজে যাবে।

চন্দ্রকান্ত বললেন, চলুন, আপনাকে নালাটা অবধি এগিয়ে দিই।

নালার দিকে চলতে চলতে চন্দ্ৰকান্ত হঠাৎ থেমে পড়ে বললেন : শহরে আপনাকে ফিরতেই হবে, না? থেকে গেলে হতো না? চন্দনী মেয়েটা কিন্তু বড় ভালো। মেয়ে হিসেবে। আসলে আমিই কোনো মেয়ের যোগ্য নই। মেয়েরা যা চায় আমার মধ্যে সেই বশংবদ মনোবৃত্তি নেই। আমার জীবনে ঘর-সংসার মানায় না। তারপর থেমে বললেন, থেকেই যান না। আমাদের বন-পাহাড়ের একজন হয়ে, চন্দনীর চিরদিনের মালিক হয়ে? আপনাকে পেলে ও বড় সুখী হবে। আপনিও। দেখবেন!

বললাম, দেখি। ভেবে দেখব।

—দেখুন ভেরে। চন্দ্রকান্ত বললেন।

মাঠিয়াকুদু নালার পাশে পৌঁছতে না পৌঁছতেই টুপটাপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। চাঁদনী রাত বলে টর্চ নিয়ে যাইনি সঙ্গে। সত্যিই যে বৃষ্টি নামবে, আকাশ অন্ধকার হবে ভাবিনি। এটুকু পথ অন্ধকারে হেঁটে আসতে বেশ অসুবিধা ও অস্বস্তি হচ্ছিল। গরম যদিও তেমন পড়েনি, তবুতো শীতও নেই। এই প্ৰথম বৃষ্টিতে সাপ ও বিছেরা বেরিয়ে পড়ে। জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার পথে এ সময়ে চলা উচিত নয়।

এখনও বোধহয় কারো ঘুম ভাঙেনি। জল গায়ে পড়লেই ঘুম ভাঙবে। ক্যাম্পের আশে-পাশের গাছ-গাছালির পাতা যতক্ষণ না ভিজে যাচ্ছে ততক্ষণই নীচে জল

পড়বে না।

আমি গিয়ে ঝুপড়ির সামনে দাঁড়ালাম।

ডাকলাম, চন্দনী।

—কে? কে? বলে, চন্দনী ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর দৌড়ে এসে আমার কাছে।

আমি ওকে দু হাতে ধরে থাকলাম।

ও আমার বুকে মুখ রেখে বলল, বড় ভয় পেয়েছিলাম। অন্ধকারে তোমায় প্রথমে চিনতে পারিনি। ভীষণই ভয় পেয়ে গেছিলাম।

আমি বললাম, তাতে কি হয়েছে।

ও অনেকক্ষণ অমনিভাবে রইল। তারপর বলল, জিপের পিছনে যে ত্রিপলটা আছে, এসো, দুজনে মিলে ধরাধরি করে ঝুপড়ির মাথায় দিয়ে দিই।

তাই-ই করলাম। ত্রিপল বিছোনো হলে, ঘড়ির দিকে তাকালাম। দেখি, পৌনে চারটে বাজে। একটু পর বনমোরগ, ময়ূর অন্যসব পাখিরা ডাকাডাকি শুরু করবে। কিংবা কি জানি আজ জলজ অন্ধকারে ওদের বোধহয় ভোর হল কি না হল বুঝতে ভুল হয়ে যাবে।

ভিতরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় শীত করছে। চন্দনীকে বললাম, এসো, আমার কাছে এসো, আমাকে গরম করে দাও।

চন্দনী আমার বুকের কাছে সরে এল। আমি বাঁহাত দিয়ে ওর লতানো হাত দুটি, ওর সরু কোমর জড়িয়ে রইলাম।

ও ফিফিস্ করে বলল, আমি কি তোমার লেপ না কম্বল?

আমি বলাম, দুই-ই।

তারপর বললাম, এখন ঘুমোও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *