লবঙ্গীর জঙ্গলে – ২

সৌমেনবাবুরা এবার জুকু ক্যুপে ক্যাম্প করেছেন। সেখানেই কাঠ কাটা হচ্ছে।. টুল্বকার কাছে ভীম্‌দ্ধারার পুরানো ক্যাম্পটাও আছে। কিন্তু এবার কি আর ক্যাম্পে থেকে জঙ্গল দেখার সৌভাগ্য হবে আমার? চন্দনীর বিপদটা কি কে জানে?

সৌমেনবাবু দুপুরে খাওয়ার সময় বললেন, উনি কোনো খবরই জানেন না চন্দনীর এবং একটু অভিমানমিশ্রিত বিরক্তিও দেখালেন। কটকে এত লোক থাকতে, ভুবনেশ্বরে সৌমেনবাবু নিজে থাকতে তবু চন্দনী হঠাৎ কোলকাতা থেকে আমাকে তলব করেছে বলে।

তারপর হেসে বললেন, যারা ঝুটঝামেলা ভালোবাসে ঝামেলা-ঝক্কি তাদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। বুঝলেন।

আমি হেসে বললাম, যা বলেছেন।

সবজীমণ্ডীতে গিয়ে কিছু কাঁচা বাজার করে নিয়েছিলাম। চাল, ডাল, তেল, ঘিও। কোথায় থাকব, কি খাব কিছু ঠিক নেই। তাঁবু থাকলে ভালো হত। ত্রিপল চেয়ে নিলাম একটা। আমার পয়সা থাকলে পুরোনো স্টেশন-ওয়াগন কিনে ডিজেল এঞ্জিন বসিয়ে ক্যারাভান বানিয়ে নিতাম একটা। যে কোনো জঙ্গলে যেখানে সেখানে যখন ইচ্ছে থাকা যেত তাহলে।

এ জীবনে অনেক সাধই অপূর্ণ রইল, তার মধ্যে এও একটা বড় সাধ। হিন্দোলের পর ঢেন্‌কানল্ ‘ পেরোলাম। গরম এখনও তেমন পড়েনি। সামনেই দোল। ঢেন্‌কানলে এক কাপ চা আর পোড়াপিঠে খেয়ে শেষ বিকেলে অংগুলে এসে পৌঁছলাম। অংগুল থেকে টিকড়পাড়া যাব। কৰ্তৃপটা-পূর্ণাগড়-পম্পাশর- পূর্ণাকোট হয়ে। গহন জঙ্গল পথের দুপাশে। অন্য জানোয়ারের ভয় করি না। পথে হাতী পড়লে মুশকিল করতে পারে।

পূর্ণাকাটে যখন এসে পৌঁছলাম তখন অন্ধকার ঘন। এখানে আরেক কাপ চা খেয়ে টিকড়পাড়ার দিকে চললাম। টিকড়পাড়ার ঘাটে গিয়ে জিপ থামালাম প্রায় দেড়শ মাইল এসে। জিপটা একটা দোকানের সামনে পার্ক করিয়ে, দোকানিকে জিপ দেখতে বলে, ঘাটের মুখে শেষ যে দোকান সেখানে গিয়ে শুধোলাম ওড়িয়াতে, চন্দনী বলে কোনো মেয়ের খোঁজ জানো? টিকড়পাড়ায় থাকে?

এই দোকানদারদের অনেকেই আমাকে চেনে। বৌধ ও ফুলবানী যাতায়াতের পথে অথবা জঙ্গল থেকে এসে অনেক সময় আমরা টিকড়পাড়ায় ঘাট থেকে মাছ কিনে এইসব দোকানে ভেজে নিয়ে খেতাম। এখানকার মহানদীর সাতকোশীয়া গণ্ডের মাছের স্বাদই আলাদা।

দোকানি অবাক হয়ে বলল, কে চন্দনী?

আমি চন্দনী চন্দ্ৰকান্ত দুজনের কথাই বললাম।

লোকটা চিনল বলে মনে হল না।

তারপর বলল, আপনি বসুন, আমি খোঁজ করছি।

আমি ওর দোকানের সামনে বাঁশের বেঞ্চে বসে পাইপটা ধরালাম।

সামনে মহানদীর সাতকোশীয়া গণ্ড। আবছা চাঁদের আলোয় ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। শীতলপানির উল্টোদিকে বাঁক নিয়েছে নদীটা। ওপারে পদ্মতলা, শীতলপানি, মাথা উঁচু ঘন অরণ্যানীবেষ্টিত পাহাড়। বন, পাহাড়, এই নদী, নদীর পাড়ে বেঁধে রাখা ছোট-ছোট জেলে নৌকো, হিলজার্স কোম্পানির মোটর বোটটা, সবই যেন চাঁদনী রাতে কেমন মোহময় অপার্থিব বলে মনে হচ্ছে।

খুব জোরে নিশ্বাস নিলাম আমি। ফুসফুস সাফ হয়ে গেল। অনেক—অনেকদিন পর আমি আমার একমাত্র বিশ্বস্ত প্রেমিকার কাছে এসেছি—এই বন, পাহাড়, নদী, এই জঙ্গলের গন্ধ, খোলা বাতাসের এলোমেলা চুলের স্বস্তি : সব সব। কী ভালো যে লাগে তা কি বলব। কোলকাতার খাঁচায় বন্দী একটা দু-পেয়ে জানায়োর বহুদিন পর আবার চারপেয়েদের রাজ্যে ফিরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

অনেকক্ষণ পর দোকানী ফিরে এল, সঙ্গে মোটাসোটা একজন হস্তিনী মেয়ে। দোকানি গম্ভীর মুখে বলল, মাউসী। অর্থাৎ মাসী খবর জানে।

মাউসী পাকা ব্যবসাদারের মতো মুখ করে শুধোল, আমি কি চাই; কোন বয়সের মেয়ে চাই?

থতমত খেয়ে দোকানির দিকে চাইলাম আমি।

দোকানি আমার চাউনী আমাকে ফেরৎ দিয়ে, মাউসীকে বলল, চন্দনী। বাবু চন্দনীকেই চায়।

মাউসী তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, চন্দনীর ঘরে লোক আছে। তোমাকে একটু দাঁড়াতে হবে।

তারপর আবার জিপগাড়ি ও আমার ভদ্র পোশাক তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিয়ে বলল, সারারাত থাকবে?

কি বলব ভেবে না পেয়ে বললাম, হুঁ।

–তবে দশ টাকা লাগবে। আর আমার পাঁচ টাকা। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল মাসী।

বললাম, ঠিক আছে।

দোকানি আমার চোখের দিকে চেয়ে বুঝল কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। তারপর বলল, চা বানাই?

বললাম, বানাও।

মাউসী অগ্রিম পনেরো টাকা নিয়ে চলে গেল।

বলল, ঘর খালি হলে তোমাকে এখান থেকে ডেকে নিয়ে যাব।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। এই ঘাটে বহুবার এসেছি, গেছি। থেমেছি। এক- দুবার খিচুড়ি রাঁধিয়েও খেয়েছি। কিন্তু কখনও জানিনি যে, প্রকৃতির এই আশ্চর্য উদার প্রসন্নতার নীচে পৃথিবীর আদিমতম অন্ধকার বাসা বেঁধে আছে। বিড়িগড়ের চন্দনীকে এইভাবে আবিষ্কার করব বলে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। এখন বুঝলাম যে, কেন ও স্থানীয় মুরুব্বীদের কাছে সাহায্য চায়নি। ও হয়তো যে কারণেই হোক আমাকেই ওর সবচেয়ে আপনজন ভেবেছিল। এটা সৌভাগ্য ভেবেছিলাম। এখন দেখছি দুৰ্ভাগ্য।

দোকানি মুখ নিচু করে চা বানাচ্ছিল।

আমি বললাম, চিনি কম দিও।

ও স্বগতোক্তির মতো বলল, ঘাসিয়ানী মেয়েদের কেউ কেউ এরকম; সবাই নয়। আপনি অবাক হলেন বাবু? এ তো গত পঞ্চাশ বছর ধরে চলেছে। তারপর বলল, ভাগ্যিস চলছে, নইলে আমরা তো না খেয়ে মরতাম। ওদের জন্যেই অনেকখানি কেনাবেচা, বাবুদের আসা-যাওয়া।

কেউ, কেউ? ঘাসিয়ানী মেয়েরা! আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।

অল্প বয়সী চিকণ মেয়েগুলো। চক্‌চকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চেহারা। তেল দিয়ে পাটি করে চুল আঁচড়ায়, মাথায় লাল-নীল-হলুদ ফুলের মতো ফিতে বাঁধে, বড় বড় পেতলের ঘড়া কোমরে বসিয়ে মহানদী থেকে জল আনে, চান করে সেখানে। কখনও সখনও নৌকায় জিপ বসিয়ে নদী পেরোবার সময় হঠাৎ তাদের কারো কারো অনাবৃত সুডৌল বুকে চোখ পড়ে ভালো লাগায় এবং লজ্জাতেও চমকে উঠেছি। ওদের সুন্দর শরীর, ওদের অবসরের ধীর জীবন, ওদের চটুল সরল তারল্য এ সবকিছুকেই ঐ দারুণ পটভূমির এক অঙ্গাঙ্গী টুকরো বলে মেনে নিয়েই ভালো লাগায় বিবশ হয়েছি।

মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। কেন যে মানুষ ফুল দেখেই খুশি থাকে না, দু-হাতে ফুলের পাপড়ি ছেঁড়ে, পদ্ম বনে হাতীর মতো ঢুকে পড়ে সুন্দরকে অসুন্দর করে, সারল্যকে কদর্য করে! সবচেয়ে লজ্জা লাগে একথা ভাবলে যে, যারা তা করে তারা আমাদেরই মতো অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ও শহুরে মানুষ। এত বছর পরে, আজ হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে, এই অর্ধনগ্ন গামছা পরা দোকানদাররা, এই অশিক্ষিত ঘাসিয়ানি ছোট ছোট মেয়েগুলো, আমাদের মতো গাড়িচড়া, ইংরিজি-বলা বাবুদের কী চোখে দেখে, কী ভেবে হাসে ওরা। কী ভেবে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে!

দোকানি চা এগিয়ে দিল।

মুখ নিচু করে চা খেতে খেতে বড় আপনমনে, গ্লানিতে আমার মুখ লাল হয়ে উঠল।

অনেকক্ষণ পরে মাউসী এল। পিছনে পিছনে ছায়ার মতো খাকি হাফ-প্যান্ট আর খাকি-হাফ-শার্ট পরা একজন মাঝবয়সী লোক। এই-ই তাহলে এতক্ষণ চন্দনীর ঘরে ছিল? লোকটা কাছাকাছি কোনো জঙ্গলে ফরেস্ট গার্ড হবে হয়তো অথবা কোনো কাঠের বা বাঁশের ঠিকাদারের মুহুরী-টুহুরী! লোকটা ঘাটের দিকে নেমে গেল কোনোদিকে না চেয়ে।

চন্দনীর উপর আমার খুব রাগ হতে লাগল। তার চেয়েও বেশি চন্দ্রকান্তর উপর। বিড়িগড়ের মুক্ত উদার নির্মল আবহাওয়া থেকে চন্দ্রকান্ত চন্দনীকে এ কোথায় নামিয়ে আনল? চন্দনীর অপরাধ কি? এটাই একমাত্র অপরাধ যে, চন্দ্রাকান্তকে ও ওর সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছিল?

পরক্ষণেই আবার মনে হল, বলরাম কি এই মেয়ের জন্যই পাগল হয়ে গেছিল। এইরকম একজন কন্যার জন্যেই কি সে গুণ্ডা হাতীর পায়ের তলায় পড়ে প্রাণ হারাল?

কেন জানি না, সমস্ত মেয়ে জাতটার উপর আমার বড় ঘেন্না জন্মে গেছে। কী শহরে কী জঙ্গলে এরা পারে না এমন জিনিস নেই। ওদের স্বার্থপরতার, ওদের সুখের লোভের, ওদের নির্লজ্জ সাধের শেষ নেই কোনো। বড় ইতর; বড় ইতর এরা। যে ভালোবাসে, তাকে এরা পায়ে মাড়ায়, পায়ে মাড়িয়ে এদের সুনামের জন্যে অথবা দুর্নামেয় ভয় এড়ানোর জন্যে, শরীরের সুখের জন্যে, গয়নার জন্যে, ভালো খাওয়া পরার জন্যে এরা যাকে তাকে জড়িয়ে ধরে; যার তার কাছে তার যা পরম ধন তা বিকোয়।

কিন্তু কেন? শরীরের কোনো নিভৃত কেন্দ্রবিন্দুই কি তাদের পরম ধন? তাদের মন বলে কি কোনো পদার্থই নেই, কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ, প্রেমের বোধ কিছুই কি নেই? দুটি সুন্দর পায়ের মধুর মধ্যস্থলেই কি এদের সমস্ত বাঙ্ময় ব্যক্তিত্ব নিভৃত নম্রতায় স্থির হয়ে থাকে? লজ্জা; লজ্জা; এ বড় লজ্জার।

যেখানে জিপ রেখেছিলাম, সেই দোকানিকে দুটো টাকা দিয়ে রাতে জিপটাকে দেখতে বললাম।

ও বলল, গরমের দিন। ওর এক ছেলেকে গাড়িতে শুয়ে থাকতে বলবে সারারাত, কিছু চুরি যাওয়ার ভয় নেই।

ও কি জানবে? যা চুরি হওয়ার তা চুরি হয়ে গেছে এই রাতেই। বুকের মধ্যে দারুণ এক গর্বময় স্নিগ্ধ সরলতার বোধই চুরি হয়ে গেছে। কোন পাহারাদার সেই চুরি রুখবে?

গলিটা সরু। এদিকে ওদিকে মাটির দেওয়ালের খড়ের ঘর। বাঁশের কঞ্চির বা ফালি বাঁশের বেড়া তোলা। বেড়ায় বেড়ায় নানান লতা লতিয়ে আছে। কোনো ঘরে কেরোসিনের কুপী জ্বলছে। বাচ্চার গলা শোনা যাচ্ছে। কুকুরের ভুক্-ভুক্। শুয়োরের ঘোঁৎ-ঘোঁৎ, বিড়ালের মিউ-মিউ।

মাউসীর পিছনে চলেছি তো চলেইছি। বস্তির প্রায় শেষে এসে মাউসী থামল। বেড়ার মধ্যের দরজা দিয়ে আমাকে নিয়ে গেল। উঠোনে একটা সজনে গাছ, তুলসী মঞ্চ। একটা কালো রোগা কুকুর সামনের দু-পায়ের উপরে মাথা রেখে শুয়েছিল। আমাকে দেখে একবার চোখ খুলল, অস্ফুটে একটা আওয়াজ করল, তারপর আবার চোখ বুজে ফেলল। বুঝি ঘেন্নায় আমার দিকে তাকাল না।

মাউসী দরজা দেখিয়ে ফিরে গেল। বলল, দরজা খুলো না, সারারাত। কতরকম লোক আসে যায়।

সারারাত তাহলে এই ঘাটে নানান সরীসৃপের আসা-যাওয়া? কত কী-ই জানিনি এতদিন?

দরজা ঠেলে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম ভিতর থেকে। তখন ওঘরে কেউ ছিল না।

ঘরের মধ্যে একটা বাঁশের মাচা তার ওপর শতছিন্ন তোশক। উপরে একটা কুঁচকানো নীল রঙা কী বেডকভার। তালগোল পাকানো তেলচিটে বালিশ একটা। কত লোক যুদ্ধ করে এর উপর কে জানে? ঘেন্নায় আমার গা রি-রি করতে লাগল। ঘরের কোণায় কটক-চন্ডীর পট। সিঁদুর লেপা। বলরাম ও জগন্নাথের পটও আছে। চারপাশেই মাটির দেওয়ালে বনের কাঁটায় লটকানো অভব্য ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো প্রায় বিবসনা একটি মেয়ের ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার। দু-ঘরের মাঝের চৌকাঠে কুপী জ্বলছে কেরোসিনের।

ভিতর থেকে চন্দনী ওড়িয়াতে বলল, বসো বাবু, আসছি এক্ষুনি। লক্ষ্মীটি বোস। গলার স্বর এখনো মৌটুসী পাখির মতোই মিষ্টি আছে, কিন্তু মনে হল সেই সারল্য নেই স্বরে। বেসাতির স্থূল ঘর্ষণে ঘর্ষণে পসারিনীর ধূর্ততা লেগেছে গলায় হায়! চন্দনী!

একেই কি দেখেছিলাম বিড়িগড়ের দুর্গ থেকে নেমে আসার সময়? একেই কি অনবধানে মনের গোপন কোণে ভালোবেসেছিলাম? চন্দ্রকান্তর বিয়েতে আমি কি সত্যিই খুশি হয়েছিলাম? সেই পরিবেশে দাঁড়িয়ে, সেই হতবাক্-আমাকে শুধোলাম আমি। চন্দনী কি আমার কাছে শুধুমাত্র একটি জংলী মেয়েই? তাই-ই যদি হবে, তাহলে কোলকাতা থেকে এতদূরে অন্যের হাতে লেখানো চিঠি পেয়ে কেন এত কষ্ট করে, নিবিড় গভীর বনের ধূলি-ধূসরিত বিপদসংকুল পথ ঠেলে এত দূরে এলাম? চন্দনীকে এই পরিবেশে আবিষ্কার করার জন্যেই কি?

যাকে পনেরো টাকায় এক রাতের জন্যে পাওয়া যায়, তাকে সারাজীবনের জন্যে পাওয়ার দাম কত? পাঁচ হাজার? দশ হাজার? ব্যস্?

চন্দনী, তুমি এতই সস্তা! সব মেয়েই কি এত সস্তা? তাই-ই বোধহয়। নইলে ‘পারিধীর’ বলরামরা কেন মরে গিয়েও বেঁচে যায়! কেন তারা তোমাদের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েও অমর হয়?

ঘেন্না, ঘেন্না, থুথু ফেলতে ইচ্ছা করল আমার।

চন্দনী আমাকে চিনতে পারল না। ঘরে এসে সেই খাটে বসল। দেখতে আরো সুন্দরী হয়েছে ও। কোমরের কাছটা একটু ভারী হয়েছে। মুখটা ভরেছে। কুমারীর কুমারীত্ব ঘুচলে কুমারীর সৌন্দর্য ছাপিয়ে যে এক ঢল নামে সেই ঢল নেমেছে ওর সারা অঙ্গে।

চেহারায় গভীরতা এসেছে, মনে না আসলেও।

চন্দনী প্রথমে আমাকে চিনতে পারেনি। কেন চিনতে পারেনি তা ওই-ই জানে। হয়তো আমি সত্যিই আসব একথা ও বিশ্বাস করেনি। হয়তো আমারও চেহারার পরিবর্তন হয়েছে এই তিন বছরে।

ও হাত ধরে আমাকে যখন ওর খাটে বসাতে যাবে, তখুনি ও হঠাৎ আমায় চিনতে পারল। চিনতে পেরেই স্তব্ধ হয়ে গেল।

বিড়িগড়ে কখনও সে জামা বা শায়া পরেনি। এখানে জামা, শায়া সব পরেছিল। কিন্তু স্তন-সন্ধির অনেকখানি যাতে দেখা যায়, যাতে নারী মাংস লোভীরা আকৃষ্ট হয় ওর নরম উজ্জ্বল কালো সৌন্দর্যে তাই জামার অনেকখানি উৎসাহে উন্মুক্ত।

আমাকে চিনতে পেরে চন্দনী বুকে আঁচল টেনে দিয়েছিল। তারপর এমন সময় দরজার কাছে গিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। কোনো কথা বলল না। বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে চেয়ে রইল। ওর দু-চোখের পাতা বেয়ে ঝর্ ঝর্ করে জল পড়তে লাগল।

আমি খাটের এক কোণায় বসে পড়ে পাইপ খোঁচাবার ভান করে মুখ নিচু করে রইলাম।

কাঁদুক। অনেক না কাঁদলে ও সত্য-মিথ্যা কিছুই আমাকে বলতে পারবে না। ওর কি বলার আছে আমাকে শুনতে হবে। সেই কারণেই এতদূরে আসা।

কিছুক্ষণ পর ও একবার ফুঁপিয়ে উঠেই নীচের ঠোট দিয়ে উপরের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল।

আমি আস্তে ডাকলাম, চন্দনী!

ও সাড়া দিল না।

আবার বললাম, কথা বলবে না তুমি? তাহলে ওতদূর থেকে আমাকে ডেকে পাঠালে কেন? তোমার জন্যে কি করতে পারি, বলবে না?

চন্দনীর খুব কষ্ট হতে লাগল। যন্ত্রণায় ও মাথাটা এদিক ওদিক করতে লাগল। চোখের জলে ওর গাল, বুকের জামা, শাড়ির আঁচল সব ভিজে যেতে লাগল।

আমি উঠে গিয়ে ওকে হাতে ধরে নিয়ে এসে খাটে বসালাম।

কী যেন হয়ে গেল আমার। যা আগের মুহূর্তেও করব বলে ভাবিনি, তাই-ই করলাম। থর্ থর্ করে কাঁপতে থাকা চন্দনীকে ডান হাতে জড়িয়ে আমার বুকের কাছে নিয়ে এলাম। ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলাম।

কিছুক্ষণ আগে যে ঘরকে, যে মানুষকে ঘৃণা ছাড়া দেওয়ার কিছু আমার ছিল না, তাকে এই মুহূর্তে সমবেদনা জানালাম আমি।

আমাদের প্রত্যেকের বুকের মধ্যে কত বিভিন্নমুখী মানুষ থাকে আমরা কি অনি? কোন মানুষটা এসে যে আমাদের উপর দখল নেয়, তা আগে থেকে কেউই ল:৩ পারি না। এই মুহূর্তের আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগের মানুষটার কোনোই মিল। নেং আমি ইতিমধ্যেই চন্দনীকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ওর জবাবদিহি না শুনেই।

চন্দনী প্রথম কথা বলল : আমার কাছে অংগুল থেকে এক বাবু এসেছিল। তাকে তোমার ঠিকানা দিয়ে একটা চিঠি লিখতে বলেছিলাম। সেও লিখবে বলে ভাবিনি, লিখলেও সে চিঠি তুমি পাবে বলে জানিনি; পেলেও তুমি যে আমার চিঠি পেয়ে সত্যিই এতদূরে আসবে একথা বিশ্বাসও করতে পারিনি।

আমি চুপ করে রইলাম।

ও বলল, খিদে পেয়েছে? তুমি কি কিছু খাবে?

আমি বললাম, পরে।

তারপর বললাম, তোমার কথা বলো। চন্দ্রকান্ত কোথায়?

চন্দনীর মুখে ঘৃণা ফুটে উঠল।

বলল, ও একটা মানুষ নয়। ওর জন্যেই আমার এই অবস্থা। কি কষ্ট যে করেছি কোনোরকমে বেঁচে থাকার জন্যে গত দু-মাস, তা আমিই জানি। হাঁপানীর রুগী —মাসের মধ্যে অর্ধেক দিন অসুস্থ থেকেছে, আর অর্ধেক দিন বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। একটা আকাট পাষণ্ড। বলেই, চন্দনী ডুকরে কেঁদে উঠল।

বাইরে থেকে একটা কর্কশ পুরুষকণ্ঠ বলে উঠল, তোকে মারধোর করছে নাকি? চন্দনী তাড়াতাড়ি বলল, না, না। আমার স্বামীর কথা বলছি।

লোকটা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, স্বামী ঘণ্টায় একটা করে পাবি, গাড়ি চড়ে আসা শাঁসালো খদ্দের বিগড়ে গেলে সব গেল।

লোকটা ভেবেছিল, আমি ওড়িয়া বুঝি না বা ওড়িয়াতে কথা বলতে পারি না।

চন্দনী বলল, ঠিক আছে, তুমি যাও।

আমি বললাম, বলো, বলে ওর গা থেকে হাত নামিয়ে নিলাম।

চন্দনী নিজে আমার হাতটা টেনে নিয়ে নিজের হাতে ধরে নিজের কোলে রাখল। বিছানায় উঠে দেওয়ালে হেলান দিয়ে আসন করে বসল। আমাকে সামনে বসাল। বলল, চন্দ্রকান্ত একটা জোচ্চোর, খুনী। তুমি আমাকে এখানে ফেলে যেও না। আমাকে কোলকাতায় নিয়ে চলো। তোমার ঝি হয়ে থাকব আমি। তাও ভালো। তবু তুমি আমাকে বাঁচাও।

আমি বললাম, বলো, যা বলছিলে।

চন্দনী লজ্জা পেল। তারপর বলল, ও একটা হাতী মেরেছে টুল্বকায় চুরি করে। ফরেস্ট অফিসের লোকরা, পুলিশের লোকরা সব ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে চারদিকে। হিলজার্স কোম্পানির বাংলোতে অনেক সাহেবরা এসে আছেন। এখন পাখি মারা পর্যন্ত বন্ধ। আর ও হাতী মেরে দিল।

আমি বললাম, উনি তো বরাবরই এরকম। আইন মানা তো ওঁর রক্তে নেই। কিন্তু হাতী মারলেন কেন? দাঁত কি খুব বড় ছিল? অনেক টাকা পেয়েছিল?

চন্দনী হাসলও। তখনও ওর চোখ ভিজে ছিল। ওর হাসিটা বড় মিষ্টি দেখাল। বলল, তাহলেও তো বুঝতাম! লোকে গরিব হলে, কষ্টে পড়লে অনেক কিছু খারাপ কাজ করে ফেলে পেটের দায়ে। বউকে, প্রেমিকাকে খুশি রাখবার জন্যে, তাদের শাড়ি গয়না দেওয়ার জন্যেও অনেকে চুরি ডাকাতি করে, তারও একটা মানে বুঝি। ওসব কিছু না! ঐ হাতীটা নাকি ওকে অপমান করেছিল। ওর মধ্যে নাকি ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ও নাকি বুকের মধ্যে ভয় নিয়ে বাঁচতে চায়নি কখনও। আচ্ছা এমন কে আছে যার ভয় নিয়ে বেঁচে না থাকতে হয়? তুমি যে শহরে চাকরি করো তোমার যে মালিক তাকে তুমি ভয় করো না? আমি চন্দ্রকান্তকে ভয় করিনি? কোনো-না-কোনো ভয় বুকে নিয়ে সকলকেই যে বাঁচতে হয় একথা কখনও মানলো না গোঁয়ার লোকটা। পায়ে হেঁটে-হেঁটে গত বর্ষায় হাতীটাকে মেরেছিল ও। হাতী মেরে লুকোনো যায় না। হৈ হৈ পড়ে গেল চারদিকে। দিল্লি থেকে কোলকাতা থেকে ওয়াইল্ড-লাইফ না কি বলে তার সব বড়কর্তারা এল। জঙ্গলে ছুঁচ খোঁজার মতো করে ওকে খুঁজল। কিন্তু পেল না। এদিকে হাতী মারল ও, আর সেই হাতীর দাঁত পা কেটে নিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে অন্য লোকে। যখন ধরা পড়ল, তখন বলল, চন্দ্রকান্ত বলেছিল কেটে নিয়ে তাকে পৌঁছে দিতে ওগুলো। তারা ছাড়া পেল ঠিকই, কিন্তু তাদের অপরাধটা পড়ল ওর ঘাড়ে। ওর নির্ঘাৎ জেল হবে ধরা পড়লে। আর জেল না হলে সারাজীবন জঙ্গলে জঙ্গলে জংলী জানোয়ারের মতো ঘুরে বেড়াবে।

তারপর বলল, মরুক ও। মরলে বাঁচি। কাকে ভুল করে ভালোবেসেছিলাম ভাই? এমন ভুল কেউ কি করে?

আমি চুপ করে রইলাম।

আমি বললাম, তুমি তো জানতে। চন্দ্ৰকান্ত তো তোমাকে বলেছিলেন যে, ঘর বাঁধার লোক তিনি নন। তবু তুমি জেদ করে বিয়ে করতে গেলে কেন তাঁকে। পারলে কি ধরে রাখতে? এই তো হাল হল তোমার?

—পারলাম না, পারলাম না। বলে চন্দনী মাথা নাড়ল।

চন্দনীর হার স্বীকার ও হার স্বীকারের করুণ ভঙ্গী দেখে আমার বড় দুঃখ হল।

চন্দনী বলল, কিন্তু আর যে কাউকে ভালোবাসতেও পারলাম না। এমন কি ভালো লাগাতেও পারলাম না। এক তোমাকে ছাড়া।

আমি চমকে উঠলাম!

বললাম, আমি কে? আমি তোমার কেউ না।

চন্দনী মলিন হাসল। বলল, তা তো বটেই। নইলে কেউ কি আর পরের লেখা চিঠি পেয়ে চারদিনের মধ্যে সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে এই নরকে এসে পৌঁছয়?

একটু থেমে চন্দনী বলল, জানো, আমাদের শরীরের দাম পুরুষদের কাছে অনেক, এ ক-দিনে বড় ঘৃণার সঙ্গে তা জেনেছি। কিন্তু আমাদের নিজেদের কাছে কিছুমাত্র নয়। গত দু-মাসে কত পুরুষ এই শরীরটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলল, কিন্তু মনটাকে ছুঁতে পারল না একজনও। ভারী অবাক লাগে ভাবলে। শরীরের নোংরা তো মহানদীতে চান করলেই ধুয়ে যায়, মনের ময়লা যে ধোয়া যায় না কিছুতেই।

তারপর বলল, চন্দ্রকান্তকে আমি কী-ই না দিয়েছি। কিন্তু ওকে আমি ঘৃণা করি। যে পুরুষ মেয়েদের ভালোবাসার মর্যাদা দেয় না, সে পুরুষ নয়। চন্দ্রকান্তও একটা জানোয়ার। বন জঙ্গলেই ও ফেরারি হয়ে থাকুক আজীবন। ওর মুখ দেখতে চাই না আমি।

আমি বললাম, আর মনে হয় হাতীদের সঙ্গে চন্দ্রকান্তর একটা গভীর ঝগড়া ছিল। এটা ঠিক সাধারণ ঝগড়া নয়। হাতীটাকে না মারলে তিনি বোধহয় নিজের কাছে হেরে যেতেন। নিজের কাছে হেরে যাওয়ার, হেরে থাকার লোক চন্দ্রকান্ত নয়। এই হার-জিৎ ওঁর কাছে বাঁচা-মরার চেয়েও বড়। তুমি হয়তো বুঝবে না। বললেও বুঝবে না।

তারপর বললাম, তোমার মনে নেই বিড়িগড়ের হাতীদের কথা? আমার মনে আছে। যেদিন আমাদের ক্যাম্পের পাশের কুয়োতলায় হাতীগুলো এল, যেদিন পারিধীতে-যাওয়া সেই ছেলেটিকে পায়ের তলায় ফেলে দিল হাতী, যেদিন বলরামকে মারল, সেইসব দিনের কথা মনে আছে আমার। এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে, সেই রাতে হাতীগুলোর পায়ের নখে ছররা মেরে যখন তাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমি, তখন চন্দ্রকান্ত আমাকে বলেছিলেন, “আপনি বুঝবেন না এদের অসহায়তা। অসহায়, দুর্বল, নিরস্ত্র এইসব লোকগুলোর এত বড় পাহাড়ের মতো সবল ও বদমাইস হাতীর সামনে পড়ে নিরুপায়ভাবে প্রতিদিন মার খাওয়া যে কি অসম্মান ও লজ্জার তা আপনি, আপনার মতো শহুরে শিকারিরা হয়তো বুঝবেন না।”

চন্দনী বলল, তুমি যাই-ই বল, লোকটা বড় স্বার্থপর। জীবনে নিজেরটাই বুঝল। নিজের জেদ, নিজের খুশি, নিজের স্বাধীনতা, তার জন্যে অন্যের যে কি দাম দিতে হল তা একবারও বুঝল না। এমনই যদি হবে, তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন?

আমি বললাম, একথা বলা তোমার অন্যায় চন্দনী। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, যেদিন তুমি আমি আর চন্দ্রকান্ত বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, যেদিন সন্ধ্যার পর ঘাসের বনে গিয়ে তোমাকে আদর করলেন চন্দ্রকান্ত চাঁদের রাতে, সেদিন আমার সামনেই উনি তোমাকে বলেছিলেন, “তুই এত বোকা কেন রে চন্দনী? তুই ঘর বাড়ি, গরু বাছুর, নিশ্চিন্তি সব ছেড়ে আমার মতো পথের লোককে বিয়ে করছিস কেন? তোকে আমি একটা ঘর পর্যন্ত দিতে পারবো না। যা তুই নিকিয়ে, পরিষ্কার করে, তোর মনের মতো করে সাজিয়ে রাখবি। নিজের ঘুরে ‘নইলে, নিজের স্বামীর ঘরে নইলে, কোনো মেয়েকে কি মানায়? বল?”

চন্দনী বলল, হ্যাঁ। মনে আছে। কিন্তু আমি এ-কথার জবাবে কি বলেছিলাম সেই বলেছিলাম যে, তুমি আমার পাশে পাশে থেকো। আমাকে ছেড়ে যেও না কখনো। তোমার কাছে আমি আর কিছুই চাইব না।

তারপর বলল, বল, বলেছিলাম কি না?

আমি বললাম, হ্যাঁ, বলেছিলে।

চন্দনী হঠাৎ বলল, এবার তুমি কিছু খাও। আমার ঘরে কী-ই বা আছে। যা রেঁধেছিলাম বিকেলে তাই-ই খাও।

খাট থেকে নেমে যাবার সময় হঠাৎ আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, এই ঘরে আমার হাতে খাবে তো তুমি?

ভারী সুন্দর দেখাল চন্দনীকে, যদিও ওকে আমি সবসময়েই সুন্দর দেখছি। ওর হাঁটা, ওর কথা বলা, ওর চোখের চাউনি

আমি হাসলাম, তারপর ঠাট্টা করে বললাম, না খাবো না।

—না খাওয়াই উচিত তোমার। চন্দনীও হেসে বলল।

তারপর পাশের ঘরে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *