লবঙ্গীর জঙ্গলে – ৩

আমি বসে বসে ভাবছিলাম, দশ বছর বয়স থেকে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কত- কত জঙ্গল দেখলাম, কত শিকারি দেখলাম, রাজা-মহারাজ, গরিব-গুর্ব্বা, শিক্ষিত- অশিক্ষিত কিন্তু চন্দ্রকান্তর মতো আশ্চর্য একটা চরিত্র দেখলাম না কখনও। এমন নিষ্ঠুরতা এবং এমন দয়াও দেখলাম না কারো মধ্যে। এমন শিক্ষা ও অশিক্ষাও। চন্দ্রকান্ত আমার জীবনে এক দুর্মর অভিজ্ঞতা। বনে-জঙ্গলে আমার ঘুরে বেড়ানো সার্থক। চন্দ্রকান্তর মতো একটি চরিত্র খুঁজে পেয়েছি। এ জীবনে, এই-ই তো যথেষ্ট।

মহানদী থেকে হাওয়া আসছে হু হু করে। চন্দনীর উঠোনের সজনে গাছের পাতায় ঝিঝির্ শব্দ উঠছে। আশে-পাশে কারো উঠোনে চাঁপা গাছ আছে। তার গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। কেরোসিনের কুপীটা নিয়ে গেছে চন্দনী ওঘরে। এ ঘর অন্ধকার। প্রথমে অন্ধকার লাগছিল। এখন চোখে সয়ে গেছে। জানলা দিয়ে চাঁদের আবছা আলো এসে মাটির মেঝেতে পড়েছে। বেড়ার গায়ে তক্ষক ডাকছে ঠক্ ঠক্‌ করে। ঘরের ঠিক পিছনেই ইঁদুর তাড়া করেছে সাপ, কি সাপ কে জানে? দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে ইঁদুরগুলো। ঘরের মধ্যে ছুঁচো আছে। খড়ের চালের উপরে দৌড়াদৌড়ি করছে তারাও। ঘরের বাইরের ভয়ে। মঝে মাঝে ডাকছে, চিক্‌- চিক্ করে।

চন্দনী ওঘর থেকে ডাকল। বলল, এসো।

একটা জিনিস লক্ষ করছি। আসার পর থেকে একবার-দুবার ভাই বলেছিল চন্দনী। তারপর আমাকে আর কোনো সম্বোধনই করছে না। ও কি আবারও ভুল করতে চায়? এক ভুলেই তো জীবনের বাকি নেই কিছু। তাছাড়া চন্দনী জানে না যে, আমি গুণে না হলেও দোষে চন্দ্ৰকান্তই। ঘরে আমার আসক্তি নেই, কখনও ছিল না। বিশ্বাস নেই সমাজে, সংসারে। মাঝে-মাঝে যে বড় একা লাগে না, তা নয়। যৌবনের শরীর যে কাঁকড়ার মতো কামড়ায় না আমাকে এও সত্যি নয়। মনের মধ্যে বড় শীতও লাগে কখনও কখনও। কিন্তু তবুও সংসারের উপরে কোনো দাবিও রাখিনি আমি, সব অধিকারই আমার বিনা লড়াইতে ছেড়ে দিয়েছি। দায়িত্বও নিইনি তেমন, নেবোও না।

তফাৎ-এর মধ্যে এইটুকুই যে চন্দ্রকান্তর চারধারে কোনো খাঁচা নেই। কিন্তু আমার একটা খাঁচার প্রহসন আছে। কিন্তু সেই খাঁচাটা, ইঁদুরে কাটা মশারির মতো শতছিন্ন। তার ফাঁক দিয়ে যখন-তখন আমি গলে আসি। সমাজ-সংসার ভালোবাসার স্বরূপ আমি এক চর্মচোখে দেখেছি, এককালীন নরম হৃদয়ে তা অনুভব করেছি, তারপর নরম মাটিতে হাতীর পায়ের ওজনে যেমন গর্তর সৃষ্টি হয়, পরে সে গর্ত যেমন শুকিয়ে উঠে শক্ত লোহার মতো হয়ে যায়, সে জায়গা মানুষের চলার অযোগ্য হয়ে ওঠে যেমন, আমার হৃদয়ও তাই হয়ে গেছে। বিস্মৃতির নীল অপরাজিতা লতায় সেই শুকনো, কুদৃশ্য গর্তগুলো হয়তো ছেয়ে গেছে সময়ের ব্যবধানে, কিন্তু এই হৃদয়ের আর নম্রতা নেই। কাউকে আর ভালোবাসা দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নেই ভালোবাসা গ্রহণের ক্ষমতাও।

বেচারী চন্দনী! ও বড় সরল। এখনও সরল? শরীরটাকে নীলামে তুললেও কি মনটা বেঁচে থাকে? থাকে তো দেখছি। বড় আশ্চর্য মানুষের মন। এতে বড় সহজে ময়লা লাগে, আবার বড় নোংরামির মধ্যে থেকেও নোংরা লাগে না।

ঘরে এক কোণায় একটা মেঝে-খোঁড়া উনুন। কাঠ রাখা আছে অন্য কোণায়। দেওয়ালে ঝোলানো আয়না। আয়নার সামনে দড়ি ঝোলানো এক টুকরো কাঠ। তার উপর প্রসাধনের সামগ্রী। এ দেওয়াল ও দেওয়ালের মাঝে নারকোল দড়ি দিয়ে ঝোলানো আনা। তাতে চন্দনীর জামা-কাপড় ঝুলছে। লাল গোলাপ ফুল আঁকা একটি নীল টিনের ছোট্ট তোরঙ্গ। জলের কুঁজো, রান্না করার মাটির হাঁড়ি, এ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস। কলাই করা সাদা থালা।

কাঁঠাল কাঠের একটা পিঁড়ি পেতে মাটি নিকিয়ে চন্দনী আমাকে বসতে বলল। শুধোলাম, তুমি খাবে না?

—তুমি খাও না। পরে খাবো। ও বলল।

মনে হল, আদরের ধমক দিল আমায় চন্দনী। আমার মনে সজনে পাতার মতো দোলা লাগল। কাউকে ভালোবেসেই শুধু মেয়েরা এমন করে বলতে পারে। আমার ভয় করতে লাগল।

মোটা চালের লাল ভাত। একটু লাউয়ের তরকারি। আর মাছের কাঁটা দিয়ে তেঁতুলের টক্।

ক্ষিদে পায়নি যে অমন নয়। কিন্তু ও তো একজনেরই রান্না করেছে। সেই ভয়ে ইচ্ছে করেই কম খাবো ঠিক করলাম।

চন্দনী কুপীর সামনে আসন-পিঁড়ি হয়ে আমার দিকে মুখ করে বসল। আমার খাওয়া দেখতে লাগল। কম্পমান কুপীর আলোটা ওর চিকন মুখের উপর নেচে যাচ্ছিল। ও বলল, লজ্জা করছে আমার। তোমরা কত কি ভালো খাও।

আমার কিন্তু বড় ভালো লাগছিল। কতদিন যে আমার খাওয়ার সামনে কেউ এমন করে বসেনি, পাতের দিকে চেয়ে দেখেনি কি লাগবে না লাগবে। বড় অভিমানী ছিলাম একদিন। সংসারে আজকে আমার মতো নিরভিমানী লোক নেই। কোনো পাওনা নেই কারো কাছে। পাওয়ার বাসনাও নেই। তাই হঠাৎ যা পাওয়ার নয় তা পেয়ে চোখে জল এসে যাওয়ার মতো হল। কষ্টে সংযত করলাম নিজেকে

চন্দনী বলল, হাঁড়িতে কিন্তু ভাত অনেক আছে। তরকারিও আছে। তুমি কিন্তু আমার কথা ভেবে আধ-পেটা খেয়ে থেকো না। যদি ফুরিয়েও যায়, তাহলে আবার রেঁধে নেবো। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার শরীর-বেচা পয়সায় কেনা ভাত খেতে তোমার ঘেন্না হচ্ছে বুঝি?

আমি বললাম, আর একটু ভাত দাও।

চন্দনী খুশি হল। হাসল। হাসলে চন্দনীকে বড় ভলো দেখায়। ও বিড়িগড়ে না জন্মালে রাজরানী হতে পারত। হয়তো হয়েও ছিল। চন্দ্রাকান্তর মতো রাজা ক-জন হয়? কিন্তু কপালে সইল না।

খেতে খেতে আমি বললাম, চন্দ্রকান্তর সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার।

–কেন? বলল চন্দনী। ওকে খুব উত্তেজিত দেখাল।

–এমনিই

–না। ওর সঙ্গে দেখা করতে হবে না তোমার। গিয়ে বুঝি বলবে যে, আমি কি হয়েছি। দারিয়ানি চন্দনীর গল্প করবে বুঝি? যাকে পাঁচ টাকায় যে কোনো হাড়গিলে সারারাত ধরে পেতে পারে?

বুঝলাম, পনেরো টাকার দশ টাকা মাউসীই নেয়।

বললাম, তা না। ওকে খুঁজে বের করে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে ওকে কেউ ধরতে পারবে না। তোমার সঙ্গে বাকি জীবন শান্তিতে কাটাতে পারবে। ভালো তো ও তোমাকেই বাসে।

—ভা-লো-বা-সা!

বড় ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করল চন্দনী কথাটা।

তারপর বলল, ভালোবাসা না ছাই। আমি ওর মুখ দেখতে চাই না। ও মরে গেছে। তোমাকে আমি ওর জন্যে ডাকিনি। ও লোকটাও তোমাকে ডাকেনি। আমি ডেকেছি। আমাকে যে করে হোক উদ্ধার করো, এখান থেকে নিয়ে যাও। সম্মানের সঙ্গে আমাকে বাঁচতে দাও বাকি জীবন। সব সাধই তো পূর্ণ হল। নিজের ঘর, নিজের স্বামী, গরু-বাছুর, ছেলে-মেয়ে, সব, সব। এখন আমাকে দয়া করো।

আমি বললাম, চন্দ্ৰকান্তকে তো তুমি জানো। উনি কখনও নিজের সাহায্যের জন্যে কাউকে ডেকেছেন, না ডাকবেন?

চন্দনী এবারে কঠিন হল।

বলল, ওর কথা শুনতেই চাই না।

বললাম, ঠিক আছে। কিন্তু উনি কোন জঙ্গলে লুকিয়ে আছেন, জানো?

চন্দনী কি ভাবল একটুক্ষণ, তারপর বলল, এখন কোথায় আছে জানি না। কিন্তু জানি যে, লবঙ্গীর জঙ্গলে পালিয়েছে। ঠিকাদার ছবি নায়েকের যে মুহুরী ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে আমাকে এনেছিল এখানে, সে আমার কাছে এসে রাত কাটায় সপ্তাহের একদিন। ওর মুখে শুনেছিলাম যে, দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে, রাতের বেলা মূল খুঁড়ে খায়, ফল পেড়ে খায়, যে কোনোদিন বাঘের পেটে কি বাইসনের গুঁতোয় শেষ হয়ে যাবে। শরীরের যা অবস্থা ছিল তাতে এমনিতেই শেষ, হওয়ার কথা এতদিনে। এমনিতে শেষ না হলে যা করে বেঁচে আছে তাতে আর ক’দিন বাঁচবে?

–লবঙ্গীর জঙ্গলে হাতী নেই? আমি শুধোলাম।

—শুনেছি, এ সময়ে নেই। তবে যেতে কতক্ষণ? জংলী হাতী তো আর বাঁধা থাকে না।

আমি বললাম, সৌমেনবাবুদের কাজ হচ্ছে এখন জুকু ক্যুপে। চলো, তোমাকে নিয়ে আমি সেখানে যাই কাল। জুকু তো লবঙ্গীর কাছেই। ওদের ক্যাম্পে থেকে, চন্দ্রকান্তর খোঁজও করব আর তোমার কি করা যায় তাও ঠিক করব।

চন্দনী বলল, তুমি কি পাগল হলে? টিকড়পাড়ার পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে যে কোনো ঠিকাদারদের ক্যাম্প আছে তার মুহুরীরা সকলে আমার কথা জানে। কেউ কেউ আমার কাছে আসেও। আমি এখন নামকরা নতুন দারিয়ানী। আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে তোমার মুখে থুথু দেবে সকলে। তোমার তো মান-সম্মান বলে একটা কথা আছে। তোমার এতবড় অসম্মান আমি হতে দেব না।

আমি বললাম, আমার কথা তোমায় ভাবতে হবে না।

চন্দনী চটে উঠে ভুরু তুলে তাকাল আমার চোখে! বলল, হবে না কেন? আমি দারিয়ানী হয়েছি বলে কি আমার সব গেছে? কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তাও কি আমি বুঝি না, তাও কি বলার অধিকার নেই আমার?

আমি একটু চুপ করে থাকলাম।

তারপর বললাম, তাহলে চলো, তোমাকে নিয়ে নদী পেরিয়ে বিড়িগড়ে যাই বড়মূল, রিডসিলিঙা হয়ে। তোমাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার আপনজনদের কাছে।

–না, না, না, আমার আপনজন কেউ নেই। বলে, চেঁচিয়ে উঠল প্রায় চন্দনী। বলল, ওরা আমাকে টাঙ্গী দিয়ে কেটে ফেলবে। বিড়িগড়ের কোনো মেয়ে আজ পর্যন্ত আমার মতো দারিয়ানী হয়নি। ওরা, আমার ভাই-বোন; আমার গ্রামের লোকেরা গরিব হতে পারে, কিন্তু আমি ওদের যোগ্য নই। আমি মরে গেলেও ওখানে যেতে পারব না। ওদের কাছে আমি মরে গেছি চিরদিনের মতো।

এবারে আমি রেগে গেলাম।

বললাম, তাহলে আমাকে কি করতে বল? কি আমি করতে পারি তোমার জন্যে?

চন্দনী মুখ তুলল। ওর দু-চোখে জল।

পরক্ষণেই মুখ নামিয়ে নিল।

আমি ডাকলাম, চন্দনী।

চন্দনী খুব আস্তে আস্তে মুখ তুলল।

অনেকদিন আগে এক চাঁদনী রাতে মহুয়া গাছতলায় একটা চিত্রল হরিণীকে মেরেছিলাম। দূর থেকে তার শিং আছে কি নেই বুঝিনি। কাছে গিয়ে দেখি, হরিণী! তখনও তার প্রাণ ছিল। টর্চের আলো ফেলতেই দেখি তার চোখ-ভরা জল। চোখের নীচে কাজলরেখার মতো রেখা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। চন্দনীর চোখের সঙ্গে সেই হরিণীর চোখের বড় মিল। অনেক পাপ আমার

আরো অনেক কথা মনে হল। বাঁ হাত দিয়ে চন্দনীর গাল টিপে দিলাম। হাসলাম। বললাম, অত ভাবছ কেন? কিছু একটা করবই। দেখি, কি করা যায়!

চন্দনী, আমি ওর গাল ছোঁয়ায় খুব খুশি হল; হাসল। বুঝলাম, ওর সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল।

আশ্চর্য! কত পুরুষ সন্ধে থেকে রাতভর ওকে ময়াম-দেওয়া ময়দার মতো চায়, অথচ ওর গালে আমার আঙুল লাগতে এখনও সেই চন্দনীই শিউরে ওঠে।

আমরা বড়া বোকা! মেয়েদের আমরা এতটুকু বুঝলাম না; আদম-ইভের দিন থেকে এত হাজার বছর একসঙ্গে থেকেও কিছু মাত্র বুঝলাম না।

আমার খাওয়া হয়ে গেলে আমি আবার এঘরে এসে বসলাম, খাটে উঠে দেওয়ালে হেলান দিয়ে।

চন্দনী বলল, খেয়ে আসছি এক্ষুনি আমি, তুমি ওঘরে বোসো।

আমি এঘরে আসতেই চন্দনী পান সেজে দিয়ে গেল আমায়। বিড়িগড়ের পাহাড়ের খন্দ্রা পান খায় না। কিন্তু সমতলে নেমে এসে এদের সঙ্গে মিশে ও পান খাওয়া শিখেছে। ওর কাছে যারা আসে তারাই শিখিয়েছে হয়তো।

গুণ্ডী খাই না আমি, ও-ও রাখে না। এমনি পান, খয়ের, চুন আর সুপুরী দিয়ে বানিয়ে এনেছিল।

চন্দনী খেয়ে এলে বললাম, রাতারাতি এখান থেকে পালিয়ে গেলে কি হয়? ও ভয় পেল! বলল, রাতে আমাকে নিয়ে পালালে তোমার নামে থানা পুলিশ হবে। তুমিও কি ফেরারি হতে চাও?

কথাটায় আমার মজা লাগল। শহরে বসে, কাগজের সম্পাদকীয় দপ্তরে দু- একটা চিঠি লিখে,( তাও যদি সব চিঠি প্রকাশিত হত!) আমরা আমাদের চতুর্দিকের কত শত অন্যায়ের প্রতিবিধান করি বলে মনে করি। জেলে যেতে আমাদের বড় ভয়। বিবেকের নির্দেশে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে সারা জীবন প্রতিকারহীণ ন্যক্কারজনক ভীরুতায় আমরা কাটিয়ে দিই, অথচ জেলের প্রাচীরের ভিতরে ঢুকতে ভয়ে মরি। আমাদের রুজি-রোজগার স্ত্রী-পুত্র বিষয়-সম্পত্তি আমাদের হীন স্বার্থ এসে সব সময় বিবেকের পথ আগলে দাঁড়ায়। চন্দনীর জন্যে না হয় থানা-পুলিশ হলই একটু। আমার মতো নিষ্ক্রিয় লোকের জীবনটাতো ঘোলা জলের ডোবাই—তাতে না হয় একটু জলোচ্ছ্বাস জাগলোই—বিবেকের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে না হয় পুলিশের জেলে গেলামই।

—কিন্তু, চন্দনী বলল, আমি চলে যাওয়ার আগে এদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিতে হবে। নইলে বিপদ আছে।

তারপরই বলল, কিন্তু আমাকে নিয়ে যাবে কোথায়? কোলকাতা

আমি ভয়ে নীল হয়ে গেলাম। আমার কি সে সাহস আছে? কোলকাতায় কি চন্দনী গিয়ে থাকতে পারবে? এর সামাজিক মর্যাদা সেখানে কি হবে? কোন সম্মান দেবে তাকে আমার আত্মীয়রা, আমার শিক্ষিত উচ্চম্মন্য পরিচিতরা? তাছাড়া এই খোলা বনের মেয়ে তো ডিজেলের ধোঁয়ায়, অপমানে শুকিয়ে যাবে। ওকে কি ভাবে, কোন পরিচয়ে নিয়ে যাব আমার সঙ্গে? আমি যে মজ্জায় মজ্জায় ভীরু। কনভেনশান ভাঙার জোর যে আমার বুকে নেই। বহুবছরের মধ্যবিত্ত জীবনের সাধারণত্ব আমাকে নীচ, সাধারণ, লোকভীত করে তুলেছে। না! আমার সে সাহস নেই। তাছাড়া চন্দনীকে নিয়ে গিয়ে ঝি করে রাখা যায় না। ওকে যা করে রাখা যায়, তা করে রাখতে পারব না। সেটা ওর অথবা আমার কারো পক্ষেই সুস্থ বন্দোবস্ত নয়।

চন্দনী আবারও বলল, নিয়ে যাবে কোলকাতায়?

আমি বললাম, না। আমরা এখন লবঙ্গীতে যাবো। তুমি এখনও চন্দ্রকান্তর বিবাহিতা স্ত্রী। চন্দ্রকান্তর সঙ্গে দেখা না করে, কথা না বলে কিছুই ঠিক করতে পারব না আমি। তুমি যাই-ই বল না কেন!

চন্দনী মুষড়ে পড়ে অধৈর্য গলায় বলল, কিন্তু আমার পরিচয় কি দেবে? জুকু ক্যুপে তোমাকে চিনবে কত লোক। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি বলবে?

আমি বললাম, আমার জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না।

–একশোবার ভাবতে হবে। এবার চেঁচিয়ে বলল চন্দনী।

তারপর বলল, তোমাকে ডেকে এনে ভুল করেছি। তারপর ভুরু উঁচিয়ে বলল, ঠিক আছে, তুমি রাতটা আমার ঘরে থাকো। টাকা দিয়েছ যখন থাকার জন্যে তুমি তো রাতের জন্যে কিনেই রেখেছ আমায়। এ রাতে তুমি আমাকে নিয়ে যা-খুশি তাই করতেও পারো, কিন্তু কাল ভোরে উঠেই চলে যেও এখান থেকে। টাকা উশুল করে চলে যেও। আমার জন্যে তোমার কিছুই করতে হবে না।

হঠাৎ আমার ভীষণ রাগ হয়ে গেল। সামনে দাঁড়ান চন্দনীকে ঠাস্ করে এক চড় মারলাম।

চড় খেয়েই চন্দনী চুপ করে গেল। দু-হাতে মুখ ঢেকে বিছানায় মুখ গুঁজে শব্দ না করে ফুলে-ফুলে কাঁদতে লাগল। ওর হাত থেকে পানটা মাটিতে পড়ে গেল।

কয়েক মুহূর্ত আমি কি করব এবং কি করলাম বুঝতে পারলাম না। তারপর ওকে হাত ধরে তুলতেই ও আমার বুকের উপর আছড়ে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, তুমি আমার কে? আমাকে মারবার তুমি কে? আজ চন্দ্ৰকান্ত থাকলে তোমাকে গুলি করে মারত, তুমি কোন অধিকারে মারলে আমাকে? চলে যাও, এক্ষুনি চলে যাও আমার ঘর থেকে।

আমি একটুক্ষণ ওর দিকে চেয়ে রইলাম, তরপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। কুকুরটা ভুক্ ভুক্ শব্দ করে ডেকে উঠল। আমি সোজা নদীর ঘাটে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন অনেক রাত। জিপটা তেমনি দাঁড়িয়ে ছিল। জিপের মধ্যে ঢুকে বসলাম। এখান থেকে এক্ষুনি চলে যাব ভাবলাম। কিন্তু পারলাম না। কোথায় যাবো, তাও ভেবে পেলাম না।

চাঁদের আলোয় দারুণ দেখাচ্ছে সাতকোশীয়া গণ্ডের মহানদীকে। ওপারের পাহাড়ের উপর থেকে শম্বর ডাকল হঠাৎ। তারপর আবার সব চুপচাপ। যেখানে কুমীরের চাষ করছে ওড়িষ্যার বন-বিভাগ, সেখান থেকে কতকগুলো কুকুর ডাকতে লাগল। নদীর উপরে নৌকোর আলো। কে যেন পাটাতনের উপরে কি ফেলল। কাঠে কাঠে ধাক্কা লেগে একটা শুকনো ভোঁতা আওয়াজ হল।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন ভোর হয়ে গেছে। চায়ের দোকানি ঝাঁপ খুলেছে। এক কাপ গরম চা খেয়ে আবার চন্দনীর ঘরের দিকে গেলাম।

দোর ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। ধাক্কা দিতে অনেকক্ষণ পর চন্দনী দরজা খুলল। খুলেই আবার দড়াম্ করে দরজা বন্ধ করে দিল।

মাউসী এসে আমার পাশে দাঁড়াল। মুখে-চোখে কুটিল হাসি। বলল, কি ব্যাপার বাবু? রাতে ছিলে না? চন্দনীকে পছন্দ হল না? তোমাদের ব্যাপার আলাদা। শহরে কত ভালো ভালো জিনিস দেখো।

মাউসীকে বললাম, আমি চন্দনীকে নিয়ে যেতে চাই?

মাউসী বলল, ক’দিনের জন্যে?

আমি বললাম, চিরদিনের জন্যে।

-কোথায়?

-তা জানি না।

—তুমি যদি মেয়েটাকে মেরে ফেলো? যদি বিক্রি করে দাও কারো কাছে? মাউসী নিরুত্তাপে বলল।

বললাম, তাতে তোমার কি? তুমি কি চাও বলো?

মাউসী বলল, ও চলে গেলে ক্ষতি হবে আমার!

—ক্ষতি হবে বলেই তো তোমাকে এত কথা বলছি!

এমন সময় চন্দনী দরজা খুলল।

মাউসী বল, কি রে ছুঁড়ি? রাতের বেলা বাবুকে খুশি করতে পারলি না? বাবু রাত কাটালো বাইরে! শিখলি কি এতদিনে?

চন্দনী কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কথা বলল না কোনো। একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমি মাউসীকে বললাম, আমার তাড়া আছে; বল, তুমি কি চাও?

তারপর চন্দনীকে বললাম, পনেরো মিনিটের মধ্যে তোমার জামা-কাপড় গুছিয়ে নাও। আমরা এক্ষুনি যাবো।

মাউসী বলল, তিনশো টাকা চাই।

চন্দনী আঁতকে উঠে বলল, তিনশো টাকা? মাউসী, আমার রোজগারের দুগুণ তো তুমি রোজই নিয়ে যাও!

—তুই চুপ কর। বেশি কথা বললে ভীমকে ডাকব। তোদের দুজনকেই শায়েস্তা করে দেবে।

আমি মাউসীর দিকে চেয়ে বললাম, ভালো করে কথা বল চন্দনীর সঙ্গে। আর ডাকো তোমার ভীমকে। ভালোভাবে মেটালে মেটাও, নইলে এক পয়সাও দেবো না। ওকে জোর করেই নিয়ে যাবো। দেখি, তুমি কি করতে পারো?

বলতেই, মাউসী দৌড়ে চলে গেল। যেতে যেতে বলল, বড় পিরিত দেখছি।

আমি বললাম, চন্দনী তাড়াতাড়ি করো।

চন্দনীর চোখে এবারে ভয় দেখলাম। আমার বিপদ দেখে ও নিজের বিপদের কথা ভুলে গেল। ও বলল, তুমি পালাও, আমার যা হয়, তা হবে। বাকি জীবন এখানেই থাকব। ভীমরা এসে পড়লে তোমার খুব বিপদ হবে।

আমি বললাম, সময় নষ্ট কোরো না, শীগগির তোমার তোরঙ্গে জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে এসো।

চন্দনী কিছুক্ষণের মধ্যেই তোরঙ্গ আর পুঁটলি হাতে করে বেরোল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাউসীর সঙ্গে চারজন লোক লাঠি হাতে এসে দাঁড়াল বেড়ার দরজা আগলে। তাদের চোখ মুখের ভাব ভালো না। ওদের পক্ষে আমাকে খুন করা তো বটেই, চন্দনীকেও খুন করা কিছু নয়।

কোমরে হাত দিয়ে চট করে পিস্তলটা বের করলাম আমি। বের করে, মাউসীকে বললাম, কি চাও? টাকা চাও? না গুলি খেতে চাও?

আমার কাছে পিস্তল থাকবে তা ওরা অনুমান করেনি। যে লোকের কাছে লাইসেন্সড্ পিস্তল থাকে তার মাথায় লাঠি মারলে তার পরেও নানা বিপদ তাদের হতে পারে এই বোধটুকু গুণ্ডাগুলোর ছিল।

ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি চন্দনীকে বললাম, হিপ্‌পকেট থেকে আমার মানিব্যাগ বের করে মাউসীকে তিনশো টাকা দিতে।

চন্দনী কখনো একশো টাকার নোট দেখেনি মনে হল। মাউসীও দেখেনি। তিনটে একশো টাকার নোট হাতে পেয়ে মাউসীর মুখে হাসি ফুটল।

আমি বললাম, ভীমদের বলো যে, আমাকে আর চন্দনীকে জিপ অবধি পৌঁছে দেবে, যাতে পথে আর কেউ ঝামেলা না করে।

ভীমরা তাই-ই করল।

অত ভোরে পুরো বস্তি জাগেনি। কিন্তু যারাই জেগেছে তারাই সকলে রীতিমত শোভাযাত্রা করে আমাদের পেছন-পেছন এলো। চন্দনীর তোরঙ্গটা আমি বাঁ হাতে নিলাম। থালা-বাসন ক’টা একটা শাড়ির পুঁটলি করে নিয়ে নিয়েছিল ও।

দোকানিরাও সকলে দোকান ছেড়ে পথে এসে ভিড় করল। টিকড়পাড়া শান্ত আবহাওয়ায় এত বড় একটা উত্তেজনার ঘটনা বোধহয় বহুদিন ঘটেনি। ঘটেছিল একবার বহু বছর আগে, যখন কুমীর শিকারে এসে, এক সাহেব ও তার ছেলেকে কুমীরে ধরেছিল। মেমসাহেব কুমীর দুটোকেই মেরেছিলেন। কিন্তু কুমীর মারার পর হুডখোলা ফোর্ড গাড়িতে স্বামী ও ছোটছেলের রক্তাক্ত মৃতদেহ পিছনের সিটে রেখে, আঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে তিনি একা গাড়ি চালিয়ে এই ঘাট থেকে অংগুলের পথে যাচ্ছিলেন। তখনও এই ঘাটে খুব উত্তেজনা হয়েছিল।

পূর্ণাকোটের আগে পথের বাঁ পাশ দিয়ে একটা বড় সুন্দর নদী গেছে। মহানদীতে গিয়ে পড়েছে বোধহয় অনেক নীচে বিন্‌কেই-এর কাছাকাছি। সেই নদীর পাশে জিপ থামিয়ে, আমরা চোখ মুখ ধুয়ে নিলাম। একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে চন্দনী একটু সেজেগুজে নিল। আয়নাটা আনতে ভোলেনি ও। বিড়িগড়ে ও অন্যরকম ছিল। চন্দনী অনেক বদলে গেছে!

তারপর পূর্ণাকোটে এসে চা-এর দোকানে গুগুলা নিমকি এসব দিয়ে চা খেলাম আমরা।

পম্পাশরে এসে যখন ডাইনে মোড় নিলাম লবঙ্গীর ধূলিধূসরিত পথে, তখন চন্দনী শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করল, কোথায় চললে? এ-রাস্তা কোথায় গেছে?

আমি বললাম, লবঙ্গী, জুকুব্।

আমার দৃঢ় চোয়ালের দিকে চেয়ে আর চন্দনী কোনো কথা বলার সাহস করল না।

বাকি পথ একেবারে চুপ করে রইল।

মাঠিয়াকুদু নালার পাশে সৌমেনবাবুদের ক্যাম্প পড়েছে। ক্যাম্প মানে নালার পাশে পাতার তৈরি একটি বড় ঘর। উপরে পাতা, চতুর্দিকে পাতা! পাতাগুলো শুকিয়ে এসেছে। ঘরের একপাশটা খোলা। সেই পাশটাতে রান্না-বান্না হয়। নারায়ণ রাঁধে। গেরুয়া-রঙা লুঙ্গি পরা সিঁটিয়ে-যাওয়া নারায়ণ। আমার বহুদিনের চেনা। এক পুরোনো মুহুরীর ভাইপো রত্নাকর এই ক্যাম্পের ম্যানেজার। খুব বিদ্বান রত্নাকর। একাদশ ফেল। মানে একাদশ ক্লাসে উঠে ফেল করেছিল। বছর কুড়ি বয়স। এক ছেলে, এক মেয়ে। হাতে হাতঘড়ি। বিদ্বান ছেলে বলে বিয়েতে সাইকেল পেয়েছিল পণ হিসেবে। নীল রঙা লুঙ্গি ও হলুদ রঙা শার্ট পরেছিল ও। মুখের মধ্যে একটা গর্ব ও কর্তৃত্বের ছাপ।

জিপের শব্দ শুনে তখন ক্যাম্পে যারাই ছিল, তারাই ঘর ছেড়ে বাইরে এল। আমাকে দেখে নমস্কার করল। খুশি হল ওরা সকলে।

চন্দনীকে দেখে ওরা অবাক হল। চুপ করে রইল। আমি বললাম, আর একটা পাতার ঘর বানাও। আমি থাকব। চন্দনীও থাকবে এখানে।

—কোথায় থাকবে? আপনার ঘরেই? রত্নাকর শুধোলো।

ওর গলায় শ্লেষের সুর বাজল।

চন্দনী মুখ নিচু করে থাকল, পুঁটলি হাতে করে

আমি বললাম, তেমন দরকার হলে তাই-ই থাকবে, তবে এখন কামীদের ঘরেই থাকবে।

—কোনো কামীন্ নেই আমাদের। রত্নাকর আবার বলল।

নারাণ বলল, কেন? চন্দনী কম্ফুর সঙ্গে থাকতে পারে, ওর বউ ছেলের সঙ্গে।

–কম্ফু কে? আমি শুধোলাম।

–কম্ফু জড়ি-বুটির বদ্যি।

জঙ্গলের কবিরাজ। রত্নাকর বলল।

আমি বললাম, দরকার নেই। এখানেই চন্দনীর জন্যে আরেকটা ঘর বানিয়ে দে, দুজন লোক লাগা। আমি পয়সা দিয়ে দেবো।

রত্নাকর চন্দনীর এরকম প্রাধান্যটা ভালো চোখে দেখল না।

আমি বললাম, চন্দনী এখানে আমার অতিথি হয়ে থাকবে। খাবে দাবে, বিশ্রাম করবে; বেড়াবে। যখন ট্রাক আসবে আমি সৌমেনবাবুকে চিঠি লিখে দেব। আমাদের সঙ্গে যা-যা জিনিস আছে নামিয়ে নে। খাওয়ার দাওয়ার সব।

তারপর নারাণকে বললাম, নারাণ আমাদের রান্না কিন্তু তুই-ই করবি।

নারায়ণ গড় হয়ে বলল, আঁইগা।

সেদিন পুরো গেল পর্ণকুটির বানাতে। দুপুরে আলু ভাজা, ডাল ও কুমড়োর তরকারি রেঁধেছিল নারাণ। খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। রাতে ভালো ঘুম হয়নি।

বিকেলে, ক্যাম্পের সামনে নালার পাশে একটা বড় কালো পাথরের উপর বসে রত্নাকরের কাছে চন্দ্রকান্তর খোঁজ খবর নিলাম খুঁটিয়ে। ও যে খোঁজ জানে না তাই নয়, ফেরারি চন্দ্রকান্তর সঙ্গে ও নিজেকে জড়াতে চাইল না। বলল, আমরা বনে বাস করে বনবিভাগের শত্রুকে প্রশ্রয় দিতে পারি না। এখন রাতে মোবাইল ইউনিট ঘুরে বেড়ায় জিপে করে রাইফেল ও আলো নিয়ে, এত গভীর জঙ্গলে আসে না যদিও তারা, কিন্তু আসতে কতক্ষণ? ইতিমধ্যে একবার দারোগা হিলজার্স কোম্পানির জিপ নিয়ে দিন পনেরো আগে আমাদের ক্যাম্পে এবং ভালুধরিয়া নালার পাশে মাইল চারেক দূরে ছবি নায়েকের ক্যাম্পেও ঘুরে গেছে। চন্দ্রকান্তকে ওরা খুঁজে বের করবেই। ওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে, আপনারও বিপদ, আমাদেরও বিপদ সৌমেনবাবুকে আপনি চিঠি লিখতে পারেন, কিন্তু আমরা বনবিভাগের ঠিকাদার সৌমেনবাবু এসব জিনিস পছন্দ করবেন না। আপনি দেখবেন। তাছাড়া……।

তাছাড়া বলেই, ও চুপ করে গেল।

আমি বললাম, তাছাড়া কি?

রত্নাকর একটু দ্বিধা করে বলল, চন্দনীকে এনে আপনি ভাল করেননি। আপনাকে লোকে যা-তা বলবে। আপনি কেন একজন দারিয়ানীর জন্যে এই ঝামেলা জড়াচ্ছেন? পুলিশও এসে পড়তে পারে ওর খোঁজে। তখন আমাদের সকলেরই বিপদ।

আমি বললাম, তোদের কোনো বিপদে ফেলব না। ওর দায়িত্ব আমার। পুলিশ এলে তোরা বলবি, তোরা কেউ জানিস না, আমাকে চিনিস না পর্যন্ত। আমি চন্দনীকে নিয়ে এসে এই নালার পাশে জলের সুবিধার জন্যে ঘর বানিয়ে আছি।

তারপর বললাম, তোরা নিশ্চিন্ত থাক। তবে এখানের সকলকে বলে দিস যে চন্দনীর সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার না করে, ওকে কেউ পুরোনো কথা না তুলে কষ্ট দেয়।—ও আমার অতিথি।

রত্নাকর আমার কথাতে আশ্চর্য হল। কিন্তু বুঝতে পারল না আমার সঙ্গে চন্দনীর সম্পর্কটা কি? কিন্তু বোঝাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠল।

রত্নাকরকে আরও শুধোলাম, চন্দ্রকান্তর কোনো খোঁজ জানিস না? সত্যি কথা বলছিস?

-না। রত্নাকর বলল, সত্যিই বলছি।

বললাম, তুই জানিস না তো কে জানে? সারা জুকু ক্যুপ চষে বেড়াচ্ছিস, তোর লোকেরা কোথায় না কোথায় যাচ্ছে এই জঙ্গলে? আর একটা মানুষকে কেউ দেখেনি, একথা বিশ্বাস করি না। সত্যি কথা বল্

রত্নাকর আমার চোখে কি দেখল জানি না। ও আমাকে ক্যাম্প থেকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গেল।

তারপর বলল, আমি জানি না, কম্ফু ওর খবর জানে। বুনো পাতা ফলের খোঁজে ও বন-পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় জড়ি-বুটি বানাবে বলে, ওর সঙ্গে নাকি দেখা হয় মাঝে-মাঝে।

তারপরই বলল, বাবু একথা বলবেন না যেন কাউকে। কম্ফুকেও না।

আমি বললাম, কম্ফু কোথায়?

-জঙ্গলে গেছে, ফেরার সময় হল।

রত্নাকর তারপর ফিরে গিয়ে তার ঘরে কাঠের হিসাব করতে বসল।

চন্দনী ঘুমিয়ে ছিল তখনও। একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। বোধহয় অনেক- অনেকদিন পর আজকের সন্ধেয় বড় করে টিপ পরবে না চন্দনী, চোখে কাজল দেবে না, পয়সার প্রেমিককে দেহ দান করার জন্যে, ভাতের গন্ধের লোভে সেজেগুজে বসে থাকবে না। ভাতের গন্ধ বড় মিষ্টি। একমুঠো ভাতের জন্যে কত কী-ই না করে মানুষে। অথবা কে জানে? অনেকদিন পর আজ সন্ধেবেলা ওর শরীরের কোনো দাবিদার নেই বলে কি ওর ফাঁকা লাগবে?

বেলা পড়ে এসেছে। নেপালী ইঁদুরগুলো বড় বড় তেঁত্রা গাছের পাতায় পাতায় ঝাঁপাঝাঁপি করে বেড়াচ্ছে। ডালগুলো নড়ছে, পাতা কাঁপছে তিরতির করে, শেষ সূর্যের লাল আলো পাতায় পাতায় ঠিকরে এসে চোখে লাগছে।

এ জঙ্গলে ময়ূর বোধহয় কম। কিংবা থাকলেও এদিকটাতে কম। ডাক শোনা যায় না। ধনেশ পাখি অনেক। বড়কি ধনেশ। এরা বলে কুচিলা-খাঁই। ছোট্‌কি ধনেশকে এরা বলে ভালিয়া-খাঁই। কুচিলা গাছে আর ভালিয়া গাছে এদের বেশি দেখা যায় বলে এই নাম। জংলী মোরগ ডাকছে। কোট্রার আওয়াজ আসছে পাহাড়ের উপর থেকে। এ সময় পলাশের সময়। পলাশ শিমুলে, নবজন্মপিয়াসী পাতাগুলোর লাল ও হলুদ রঙে জঙ্গল এক দারুণ সাজে সেজেছে। লাল অথবা হলুদের রঙে যে কত বিভিন্নতা, কত নরম ও গাঢ় যে তাদের বৈচিত্র্য, তা এই চৈত্রের জঙ্গলে না এলে বোঝা যায় না।

শিমুলফুল খেতে বড় ভালোবাসে কোট্রা হরিণ। ফুলটা ঠিক খায় না। ফুলের বোঁটা ও ভিতরে অংশটা খুব শখ করে খায়। খেয়ে দেখেছি; কষ কষ লাগে। কষায়ও তো একটা স্বাদ। ওদের হয়তো খেতে ভালো লাগে।

আসন্ন সন্ধ্যায় পাহাড় বেয়ে চাঁদ উঠেছে। একদিকে উদীয়মান চাঁদ, অন্যদিকে অস্তমান সূর্য, পশ্চিমাকাশে নীল উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, ঘরে-ফেরা বিভিন্ন পাখির ডাক সব মিলিয়ে কেমন নেশা নেশা লাগছে।

হঠাৎ দেখলাম, একজন বেঁটে-খাটো শক্ত চেহারার লোক, মাথার চুল আধ- কাঁচা, কাঁধে টাঙ্গী ঝোলানো, হাতে কিছু গাছ-গাছড়া নিয়ে পাহাড়ের যে দিক থেকে কোট্রা ডাকছিল সেদিকের পাকদণ্ডী দিয়ে নেমে আসছে। লোকটার হুঁশ ছিল না কোনোদিকে। নিজের মনে এঁকে-বেঁকে পাথরের উপর পা ফেলে ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে আসছিল।

ছোটবেলা থেকে জঙ্গলে বেড়ে উঠেছে, জঙ্গলেই জন্ম নেবার পর। ওর কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য সব জঙ্গলের সঙ্গে এক সুরে বাঁধা। তফাৎ এইটুকুই যে, ওর জরা আছে; জঙ্গলের জরা নেই। প্রকৃতি নিজের বুকের কোরকে নিজেকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করার মন্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন, যে মন্ত্র মানুষকে দেননি। প্রতি বছর নতুন করে ফুল ফোটে তার বুকে, নতুন প্রজাপতি ওড়ে, হরিণের শিং খসে গিয়ে নতুন শিং গজায় কিছুদিন পরে, সাপ তার পুরোনো খোলস ছেড়ে নতুন চিকনতার খোলসে ঢেকে নেয় নিজেকে। হতভাগা মানুষরাই শুধু নিজের এক খোলসের মধ্যে বন্দী থাকে আমৃত্যু। মৃত্যু এসে তাকে আবার প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। একদিকে নদীর পারে চিতার ধুঁয়ো নিভে আসে, অন্যদিকে নবজাত শিশুর কান্না ভাসে পাতার কুঁড়ে থেকে। সেই শিশু বড় হয় একদিন। এক ফুল থেকে প্রজাপতি অন্য ফুলে গিয়ে বসে। তার পায়ে-মাখা পরাগ মাখামাখি হয়ে যায়, অন্য ফুলে ফল জন্মায়।

লোকটা প্রায় আমার কাছে এসে গেল।

পাকদণ্ডীর নীচে সমতলে নেমেই হঠাৎ আমাকে দেখে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর সন্দিগ্ধ চোখে একমুহূর্ত তাকিয়েই, আমাকে নমস্কার করল।

এটা প্রীতির নমস্কার নয়। ভয়ের নমস্কার। আমরা চিরদিন ওদের ভয়ের নমস্কার নিয়েই খুশি থেকেছি। ওরা আমাদের বিশ্বাস করে না। আমরা ওদের চিরদিন ঠকিয়ে এসেছি।

কখন কম্ফু নমস্কার করে চলে গেছিল খেয়াল করিনি। অন্ধকার হয়ে গেছে। ঝিরঝির করে হাওয়া দিয়েছে পাতায় পাতায়। কট্-কটি আওয়াজ হচ্ছে শালি বাঁশের বনে বনে। অর্জুন গাছের পাতা নড়ছে হাওয়ায়। ক্যাম্পের মধ্যে আগুনের শিখা কাঁপছে। বলদগুলো মাথা নাড়ছে তাদের। গলার ঘণ্টা সন্ধ্যার নির্লিপ্ত অন্ধকার মথিত করে টুং-টাং বেজে উঠছে। একটি বাচ্চা ছেলে কেঁদে উঠল। কম্ফুর ছেলে বোধহয়। কম্ফু সবে ফিরল। খাওয়া-দাওয়া করুক।

তারপর ওর কাছে যাব।

আবছা চাঁদের আলোর বুটিকাটা গালচেতে নরম পা ফেলে ফেলে কে যেন এগিয়ে আসছে এদিকে।

কাছে এসে বলল, আসব?

মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, চন্দনী।

বললাম, এসো, এসো। ঘুম হল? বোসো।

ও বলল, আমাকে কিছু কাজ দাও। তোমাদের রান্নাটা করি আমি। বসে থেকে বড় খারাপ লাগবে।

আমি নারাণকে ডাকলাম।

নারাণ এসে দাঁড়াল। এই নারাণ সেই ধরনের লোক, যারা সংসারে অনেক কিছু পেয়েও ধরে রাখতে পারে না। সবাই, সবই ছেড়ে যায় তাদের।

পূর্ণাকোটে বাড়ি ছিল নারাণের, ছিল চাষের জমি, ডাগর বউ ছিল, ছেলে ছিল একটা ফর্সা। কিন্তু পূর্ণাকোটে মদের দোকানও ছিল একটা সর্পগাছের নীচে। পানমৌরী এবং অন্যান্য মদ বিক্রি হত সেখানে। তার বৌকে নিয়ে গেল তার এক বন্ধু। বড় ধাক্কা খেয়েছিল নারাণ। কিসের টানে কে জানে, বৌটা ছেলেটাকে পর্যন্ত ছেড়ে গেল. তারপর বর্ষার দিনে গোখরো সাপের কামড়ে মারা গেল ছেলেটাও। ভিটে গেল, জমি গেল; যা ছিল থাকার, সবই ছেড়ে গেল নারাণকে একে একে। কিন্তু নেশা ছাড়েনি! এখন অন্য কোনো নেশার পয়সা জোটে না। সকালে বিকেলে আফিং খায়।

একদিন একটা কাঁকড়া বিছে কামড়েছিল নারাণকে—বিছেটা মরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ওর শরীরে এত বিষ জমেছে। নারাণ হাসে আর বলে, আরও কিছুদিন যাক আমাকে কামড়াতে গিয়ে যেদিন নাগসাপ মরবে, সেদিন আমার ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবো আমি।

বড় সুন্দর হাসে নারাণ। ওর স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে একটা গামছা, একটা খাটো ধুতি আর একটা ছেঁড়া হাফ-শার্ট। অস্থাবর সম্পত্তি কিছুই নেই আর। কিন্ত এমন সুন্দর উজ্জ্বল হাসি আমি বড় কম দেখেছি। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ, অনুযোগ নেই। কাজ করছে, আফিং খাচ্ছে, কাজের শেষে রাতে বসে ভগবানের গান গাইছে। নারাণ যখন গান গায়, তখন ওর সামনে বসে থেকেছি আমি অনেকদিন। দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে নারাণের। সেই মুহূর্তে ও যেন আমাদের ছেড়ে, ওর এই পরিবেশ ছেড়ে কোথায় কোন ঊর্দ্ধলোকে পৌঁছে যায়—যেখানে কষ্ট নেই, ক্ষিদে নেই, যেখানে মৃত পুত্রের শোক নেই; বিশ্বাসঘাতিকা স্ত্রীর অস্তিত্ব নেই নারাণের মধ্যে ওর দীনবন্ধুর কোনো এক কণা যেন প্রোথিত হয়ে গেছে। ও সাধারণ হয়েও বড় অসাধারণ।

নারাণকে বললাম, চন্দনী বলছে যে, কাল থেকে ও আমাদের সকলের রান্না করবে।

নারাণের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল, আমার রোজ তাহলে কে দেবে বাবু? আমার আফিং?

আমি হাসলাম। বললাম, আফিং না হয় খাওয়া বন্ধই করলি!

নারাণ চমকে উঠল। বলল, ও কথা বোলো না বাবু। আমি একদিনও বাঁচবো না তাহলে। আমার কে আছে এই ভব সংসারে? দীনবন্ধু আর আফিং ছাড়া?

আমি বললাম, আমি যে ক-দিন আছি, তুই আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবি। তোর রোজ আমি দেব। তুই চন্দনীকে রান্না করতে দে।

ও খুশি হয়ে ফিরে গেল।

হাওয়াটা জোর হচ্ছে বনের ভিতর। পাহাড়ের ধাক্কা খেয়ে নীচে নেমে আসছে হাওয়াটা। জ্যোৎস্নও জোর হচ্ছে আস্তে আস্তে।

চন্দনী পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় সুন্দর শরীরের গড়ন চন্দনীর। কি যেন মেখেছে মুখে, করৌঞ্জের তেল-টেল হবে। বনের ফুলের গন্ধ ছাপিয়ে সে গন্ধ নাকে এসে লাগছে আমার।

চন্দনী বলল, আমাকে নিয়ে খুব ভাবনায় পড়েছ না?

আমি বললাম, অন্য কথা বলো।

এমন সময় রত্নাকর এসে দাঁড়াল আমার কাছে।

বললাম, কিরে রত্নাকর? কম্ফুকে আমার কথা বলেছিস?

—বলেছি। ওর খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে ও-ই আপনার কাছে আসবে। তারপর একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, নারাণকে আপনি বলেছেন যে, চন্দনী আমাদের রান্না করবে কাল থেকে? তারপর আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই বলল, তাতে অসুবিধে আছে।

আমি হেসে বললাম, কিসের অসুবিধা?

রত্নাকর চন্দনীর চোখে তাকিয়ে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বলল, ও দারিয়ানী! ওর হাতে আমরা কেউ খাবো না। আপনি যদি জোর করেন তাহলে কিন্তু এই ক্যাম্পের কাজ চালানো মুশকিল হবে।

এতটা আমি আশা করিনি। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। এটা সৌমেনবাবুর ক্যাম্প। আমার জন্যে তার ব্যবসার ক্ষতি হয় এ আমি চাই না। অনেক চেষ্টায় নিজেকে সংযত করলাম আমি।

বললাম, ঠিক আছে। কাল সকালে আমরা এ জায়গা ছেড়ে চলে যাব।

রত্নাকর ভয় পেয়ে গেল। বলল, আমি তো তা বলিনি বাবু। আপনি চলে গেলে সৌমেনবাবু জানতে পারলে আমার চাকরি থাকবে না। আমি তো আপনাকে চলে যেতে বলিনি।

আমি বললাম, ঠিক আছে। আর কোনো কথা নেই।

রত্নাকর চলে গেল।

এই একাদশ-ফেল, হাতে রিস্টওয়াট পরা লোকগুলোই এই জঙ্গল পাহাড়ের লোকগুলোর সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাদের চেয়েও বড় শত্রু ওরা ওদের স্বজনদের। ওদেরও দোষ নেই। ওরা আমাদের দেখেই প্রভুত্ব করতে শিখেছে। আমরাই টাকার লোভ, ক্ষমতার লোভ ওদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছি প্রতিদিন। এই প্রত্যেকটা অল্পবিদ্যা-ভয়ঙ্করী, গর্বিত, ক্ষমতালোভী লোকগুলোর মধ্যে অত্যাচারীর বীজ লুকোনো আছে। এদের অনেক ভয়। চাকরি হারানোর, সম্পত্তি নাশের। রত্নাকরটা দেখতে দেখতে অমানুষ হয়ে উঠেছে চোখের সামনে! কুড়ি বছরেই যদি এই, তো ষাট বছরে এই রত্নাকর কি মহীরুহতেই না রূপান্তরিত হবে!

আমি চুপ করে রইলাম।

চন্দনী আমার কাছে এল। বলল, সাধ মিটেছে? এত করে বললাম, আমাকে এনো না। তা না, আমাকে মেরে ধরে নিয়ে এলে। দেখেছো তো, কত বড় গলার কাঁটা আমি।

আমি বললাম, তুমি চুপ করো তো! কাল আমরা নিজেরা আরো উপরে গিয়ে এই নালার পাশেই ঘর বানিয়ে নেবো। আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকবো। তুমি রাঁধবে বাড়বে কাল থেকে। আর আমি চন্দ্রকান্তকে খুঁজব।

চন্দনী অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বলল, তুমি এই এতলোকের সামনে আমার সঙ্গে এক ঘরে থাকবে?

আমি বললাম, কেন, তোমার আপত্তি আছে?

চন্দনী মুখ নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। বলল, আমার …..

বলেই, চুপ করে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *