রূপকথা
চায়ের দোকানের অভ্যন্তর। ঘরটি বেশ বড়। কয়েকটি মার্বেল্টপ্ টেবিল ও তদুপযোগী চেয়ার ঘরের মধ্যে ইতস্তত সাজানো। ঘরের অপর প্রান্তে একটি রান্নাঘর— খোলা দ্বারপথে কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। রান্নাঘরের দেওয়ালে টাঙানো সারি সারি সস্প্যান ও কাঠের টেবিলের উপর কেট্লি পিরিচ পেয়ালা ইত্যাদি আংশিকভাবে দৃষ্টিগোচর হইতেছে।
দোকানের নাম ‘ত্রিবেণী-সঙ্গম’। কলিকাতার শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের চা ও অনুরূপ খাদ্যপানীয় সরবরাহ করিয়া ইহার সর্বজনপ্রিয় স্বত্বাধিকারী অল্পকালের মধ্যেই প্রভূত যশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন। ত্রিবেণী-সঙ্গমের একটি বিশেষ আভিজাত্য আছে— সকল দ্রব্যেরই দাম প্রায় ডবল। সুতরাং সাধারণ চা-খোরদের পক্ষে এস্থান অনধিগম্য, বিত্তবান তরুণ-তরুণীরাই এই ‘ত্রিবেণী-সঙ্গমে’ সঙ্গত হইয়া থাকেন।
বেলা দুটা বাজিয়া গিয়াছে— দোকানের এবং সেই সঙ্গে একটি বিরাট উদরের স্বত্বাধিকারী বেণীখুড়ো ওরফে বেণীমাধব চক্রবর্তী একটি লম্বা টেবিলের উপর শয়ন করিয়া পিরান ও কাপড়ের ফাঁকে নাভিমণ্ডল উদ্ঘাটিত করিয়া নিদ্রা যাইতেছেন। তাঁহার নাসিকার উদাত্ত-অনুদাত্ত স্বর একটানা করাতের মতো ঘরের স্তব্ধতাকে কর্তন করিতেছে।
দোকানের একমাত্র ভৃত্য বিদ্যাধর— একাধারে পাচক এবং পরিবেশক—অন্য একটা টেবিলের উপর পা তুলিয়া দিয়া, চেয়ারের পিছনের পায়া-যুগলের উপর দেহের সমস্ত ভার অর্পণ করিয়া দিয়া মৃদু-মন্দ দুলিতেছে ও একমনে একটি বহুব্যবহারে মলিন ও ছিন্নপ্রায় পত্র পাঠ করিতেছে। বিদ্যাধর যুবাবয়স্ক— দেখিতে সুশ্রী, তাহার গায়ে সস্তা ছিটের পিরান, কাপড়ের কোঁচার অংশটা দুপাট করিয়া কোমরে জড়ানো।
বিদ্যাধর চিঠিখানার আঘ্রাণ গ্রহণ করিয়া বিড় বিড় করিয়া বলিল,— গন্ধ ছিল এখন প্রায় উবে গেছে। জাসমীনের গন্ধ। গুরুমা হলে কি হয়, প্রাণে সখ আছে। (পত্র খুলিয়া পাঠ) ‘বন্ধুবর!’ ইঃ, যেন বন্ধুবরের জন্য বুক ফেটে যাচ্ছিল। বন্ধুবর না লিখে শুধু বর লিখলেই তো ন্যাটা চুকে যেত। (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া) না, তা লিখবে কেমন করে? সে তো আর আমি নই, সে যে আর একজন। লিক্লিকে চেহারা, ঘাড়ছাঁটা চুল, কোট-সোয়েটার পরা, মেয়েলি মেয়েলি গড়ন— দেখলেই জুতো-পেটা করতে ইচ্ছে করে। মুখখানা পেছন থেকে দেখতে পেলুম না। দেখিনি ভালই হয়েছে! ঘাড়ের চুলগুলো যেন মুর্গীর বাচ্চার মতো, মুখখানাও নিশ্চয় প্যাঁচার বাচ্চার মতো হবে। দূর হোক গে! (পত্রপাঠ) ‘আমি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী, ষাট টাকা মাহিনা পাই। তার উপর সম্পূর্ণ আত্মীয়স্বজনহীনা— বংশমর্যাদাও কিছু নাই। যিনি আমার স্বামী হইবেন তাঁহাকে দিবার মতো আমার কিছুই নাই। রূপ ক’দিনের? গুণও নাই। তাই স্থির করিয়াছি ইহজীবনে বিবাহ করিব না। নিঃস্ব ভাবে রিক্ত হস্তে কাহারও গলগ্রহ হইতে চাহি না। ছোট ছোট মেয়েদের গুরুমা হইয়াই আমার জীবন কাটাইতে হইবে। তবে যদি দৈবক্রমে কোনও দিন অর্থশালিনী হই, তবেই যাঁহাকে ভালবাসি তাঁহার চরণে নিজেকে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে পারিব। ইতি
বিনীতা— মঞ্জুষা।
—হুঁ! এতদিনে তাঁহার চরণে নিজেকে উৎসর্গ করা হয়ে গিয়েছে। এখন তো আর ষাট টাকা মাইনের গুরুমাটি নয়— লক্ষপতি। সে বেটাচ্ছেলে নিশ্চয় আরও দু’খানা মোটর কিনেছে। এতদিন হয়তো ছেলেপুলে—। দূর! এই তো মোটে তিন মাস! কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তিনশ’ বছর। চুলোয় যাক গে, আমি তো বেশ আছি। নিজে রোজগার করে খাচ্ছি, কোনও ভাবনা নেই। বেঁচে থাক বেণীখুড়ো আর তার রেস্তোরাঁ! (কিছুক্ষণ নিদ্রিত বেণীকে নিরীক্ষণ করিয়া) খুড়োর নাকে রসুনচৌকী বাজছে। ওর পেটে বোধ হয় একটা ব্যাগপাইপ লুকোনো আছে— ঘুমলেই বাজতে আরম্ভ করে। (সস্নেহে) খুড়োর আমার ভেতরে-বাইরে সমান— পেটেও ব্যাগপাইপ প্রাণেও ব্যাগপাইপ! অথচ সারাটা জীবন হোটেল করে কাটিয়ে দিলে। এই দুনিয়া! (কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকিয়া) কোথায় দিল্লী আর কোথায় কলকাতা! খুব লম্বা পাড়ি জমানো গেছে, এখানে চেনা লোকের সঙ্গে খামকা মাথা ঠোকাঠুকি হবার ভয় নেই। তার ওপর যে রকম গোঁফ আর জুলপি গজানো গেছে, দেখা হলেও কেউ সহজে চিনতে পারবে না। উপরন্তু গোদের উপর বিষ-ফোড়া আছে—ইউনিফর্ম। ছদ্মবেশ দিব্যি পাকা রকম হয়েছে। (চিঠিখানা মুড়িতে মুড়িতে) আমি তো খাসা আছি— কিন্তু আর কিছু নয়, মঞ্জুষারানী কেমন আছেন, কি করছেন তাই জানতে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়। হয়তো সে বেটা মাতাল— আমার টাকাগুলো নাহক শুঁড়ির বাড়ি পাঠাচ্ছে— ওকে হয়তো যন্ত্রণা দিচ্ছে! যাক গে। যেমন কর্ম তেমনি ফল, আমি আর কি করব? মাতালের শ্রীচরণে যখন নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তখন মাঝে মাঝে লাথিঝাঁটা খেতে হবে বৈ কি! টাকাগুলো হয়তো এর মধ্যে সব ফুঁকে দিয়েছে, মঞ্জুষারানী আবার যে গুরুমা সেই গুরুমা। না, অতটা পারবে না। দু’লাখ টাকা তিন মাসের মধ্যে উড়িয়ে দেওয়া সহজ মাতালের কর্ম নয়।—
দেওয়ালে টাঙানো জাপানী ঘড়িতে ঠং করিয়া আড়াইটা বাজিতেই বেণীমাধবের নাসিকাধ্বনি অর্ধপথে হোঁচট খাইয়া থামিয়া গেল। চক্ষু রগড়াইতে রগড়াইতে উঠিয়া বসিয়া দিগন্তপ্রসারী একটি হাই তুলিয়া তিনি বলিলেন, বিদ্যে ওঠ্ বাবা ওঠ্— আর দেরি করিসনে, আড়াইটে বেজে গেল, উননে আগুন দে। এখুনি ছোঁড়াছুঁড়িরা— কি বলে ভাল— ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলারা আসতে আরম্ভ করবে।
বিদ্যা: তার এখনও ঢের দেরি আছে খুড়ো।
বেণী: না না, তুই ওঠ্, মাণিক আমার, উননে আগুন দিয়ে চায়ের জলটা চড়িয়ে দে। আমার একটু চোখ লেগে গিছল। বলি হ্যাঁরে, আইস্ক্রীমটা ঠিক করেছিস তো? কাটলেটের মাছ আর মাংস দিয়ে গেছে তো—?
বিদ্যা: হ্যাঁ—
বেণী: তাহলে আর আলস্যি করিসনে বাবা আমার, উঠে পড়্। এই বেলা গোটাকতক ভেজে রাখ্, তখন গরম করে দিলেই হবে। নইলে ভিড়ের সময় যুগিয়ে উঠতে পারবিনে। ঢাকাই পরটাগুলো—?
বিদ্যা: যাচ্ছি খুড়ো, অত তাড়া কিসের? আজ তোমার বেশি খদ্দের হবে না!
বেণী: (বিরক্ত হইয়া) ঐ তোর ভারি দোষ বিদ্যে, বড় কথা কাটিস। হোটেল করে করে আমার দাড়ি পেকে গেল, তুই আমাকে শেখাতে এসেছিস আজ খদ্দের হবে কিনা। বলি, আজ শনিবার সেটা খেয়াল আছে?
বিদ্যা: আছে, কিন্তু আজ ব্যারাকপুরে রেস আছে সেটাও যে ভুলতে পারছি না খুড়ো।
বেণী: হাত্তোর রেসের নিকুচি করেছে— রোজ রেস রোজ রেস!— আচ্ছা, রেসের দিন ছোঁড়াছুঁড়িরা আসে না কেন বলতে পারিস?
বিদ্যা: রেসে হেরে গিয়ে ভয়ানক মনমরা হয়ে পড়ে কিনা খুড়ো, তাই আসে না। তখন আমার কাটলেটও আর মুখে রোচে না।
বেণী: ভাগ্যিস মনে করিয়ে দিলি। তা মাছ মাংস কম করে নিয়েছিস তো?
বিদ্যা: হাঁ— সেজন্য ভেবো না—
বেণী: (উঠিয়া আসিয়া বিদ্যাধরের চিবুক স্পর্শ করতঃ চুম্বন করিয়া) ভ্যালা মোর বাপ রে। সোনারচাঁদ ছেলে। তোর কাছে মিথ্যা বলব না বিদ্যে, হোটেল আমি ঢের করেছি কিন্তু কপাল খুলল আমার তোর পয়ে। আজকাল তোর তৈরি কাটলেট আর ঢাকাই পরটা খেতে ছোঁড়াছুঁড়ির ভিড় দেখি আর ভাবি, এমন দিনও আমার গেছে যখন কারখানার ওড়িয়া মিস্তিরিদের ভাত বেঁধে খাইয়ে আমার দিন কেটেছে। তখন দিনান্তে পাঁচ গণ্ডা পয়সা আমার বাঁচত। ঝাড়া-হাত-পা রাঁড় মনিষ্যি বলেই পেরেছিলুম, নইলে মাগছেলে নিয়ে ন্যাঞ্জাল্ হয়ে পড়লে কি পারতুম, না এই বুড়ো বয়সে তোর কল্যাণে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পেতুম?
বিদ্যা: (পা নামাইয়া বসিয়া) তবেই বলো খুড়ো, আমি না হলে তোমার কিছুই হত না?
বেণী: কিছু না রে বাবা, কিছু না। এই যে সব ভাল ভাল চেয়ার, টেবিল, আসবাব, এত টাকা ভাড়া দিয়ে শহরের মাঝখানে দোকান— এসব স্বপ্নই রয়ে যেত। ‘ত্রিবেণী-সঙ্গম’ কেবল তোর পয়ে।
বিদ্যা: খুড়ো, এই জন্যেই তো তোমায় এত ভালবাসি। অন্য মনিব হলে আমাকেই বোঝাতে চেষ্টা করত যে তার পয়ে আমার কপাল খুলেছে। ভুলেও মানত না যে আমার কোনও কৃতিত্ব আছে, পাছে আমার দেমাক বেড়ে যায়, বেশি মাইনে চেয়ে বসি।
বেণী: দূর পাগল! ভুল বোঝালে কি ভবি ভোলে রে? তোর আমার কাছে যতদিন থাকবার ততদিন থাকবি, তারপর যেদিন কাজ ফুরুবে সেদিন কারণে-অকারণে আপনিই চলে যাবি। তোকে আমি ধরেও আনিনি, ধরে রাখতেও পারব না। কেউ কি তা পারে? দুনিয়ার এই নিয়ম।
বিদ্যা: রসো খুড়ো, তোমার দর্শনশাস্ত্র পরে শুনব। এইবার চট করে একটা উননে আগুন দিয়ে আসি।
বিদ্যাধর প্রস্থান করিল। ঘরের এককোণে একটি কাঠের ছোট টেবিল ও টুল রাখা ছিল। টেবিলের ওপর বেণীমাধবের ক্যাশবাক্স। এইখানে বসিয়া তিনি খদ্দেরের নিকট পয়সা গ্রহণ করেন। কসি হইতে চাবি বাহির করিয়া ক্যাশবাক্স খুলিয়া একটি পুস্তক বাহির করিলেন, তারপর টুলের উপর বসিয়া পাঠ করিতে লাগিলেন।
থেলো হুঁকার উপর কলিকা বসাইয়া ফুঁ দিতে দিতে বিদ্যাধর প্রবেশ করিল।
বিদ্যা: (হুঁকা বেণীমাধবকে দিয়া) এই নাও টানো— আবার সেই ‘শিহরণ-সিরিজ’ বার করেছ? এটা কি দেখি—ওঃ এক্কেবারে ‘গুদামে গুমখুন’ (উচ্চহাস্য)। আচ্ছা খুড়ো, এগুলো পড়তে তোমার ভাল লাগে?
বেণী: তা লাগে বাবা, মিথ্যে বলব না। তোর মতো পেটে বিদ্যে নেই, ইংরেজী খবরের কাগজটা পর্যন্ত পড়তে পারি না। তাই এই সব বইয়ে বিলিতী মেমসাহেবদের কেচ্ছা পড়ে একটু আনন্দ পাই।
বিদ্যা: আমার পেটে বিদ্যে আছে তুমি জানলে কোত্থেকে খুড়ো?
বেণী: জানি রে বাবা জানি, ওকি আর চেপে রাখা যায়। আজকাল লেখাপড়া শিখে গেরস্তর ছেলেদের এই দুর্দশাই তো হয়েছে। আমি কত সোনারচাঁদ ছেলেকে রাস্তায় রাস্তায় আলুর চপ, গরম ফুলুরি ফেরি করতে দেখেছি। লজ্জায় ভদ্দরলোকের ছেলে বলে পরিচয় দিতে চায় না, হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে পিরান গায়ে দিয়ে ছোটলোক সেজে বেড়ায়। তুইও সেই দলের। কিন্তু এত লেখাপড়া শিখেও এমন রাঁধতে শিখলি কোত্থেকে সেইটেই বুঝতে পারি না!
বিদ্যা: তা জানো না খুড়ো? ভারতবিখ্যাত পীরু বাবুর্চির নাম শোনোনি কখনও? দেড়শ’ টাকা তাঁর মাইনে, রাজা-রাজড়া তাঁর হাতের হোসেনী কাবাব খাবার জন্যে লালায়িত। এহেন পীরু মিঞা হচ্ছেন আমার গুরু। দুটি বছর তাঁকে মাইনে দিয়ে রেখে— ওর নাম কি— তাঁর পায়ের কাছে বসে রান্না শিখেছি।
রান্নার এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা তিনি— শুক্তুনি থেকে পেঁয়াজের পরমান্ন পর্যন্ত সব রান্নার হুনরী— সকালবেলা তাঁর নাম স্মরণ করলে পুণ্য হয়। (উদ্দেশে প্রণাম) ভাগ্যে তাঁর কাছে শিখেছিলুম, নইলে আজ আমার কি দুর্দশাই না হত খুড়ো?
বেণী: আচ্ছা বিদ্যে, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। এই তিনমাস আমার কাছে আছিস, একদিনের তরেও তো তোকে বাড়ি যেতে দেখলুম না। তোর বাড়ি কোথায়— বাপ, মা, ভাইবোন সব আছে তো? তাদের একবার খোঁজখবর নিস না কেন? খালি দেখতে পাই, মাঝে মাঝে একখানা চিঠি বার করে বিড় বিড় করে পড়িস। বলি, বাড়ি থেকে ঝগড়াঝাঁটি করে পালিয়ে আসিসনি তো?
বিদ্যা: ওসব কথা ছাড়ান দাও খুড়ো। আমার তিনকুলে কেউ নেই, তোমার মতো ঝাড়া-হাত-পা লোক। তাই তো তোমার সঙ্গে জুটে গেছি। রতনেই রতন চেনে কি না। তুমি এখন তোমার ‘গুদামে গুমখুন’ আরম্ভ করো, আমি একবার ওদিকটা দেখি। এখনি হয়তো লোক এসে পড়বে।
বিদ্যাধর রান্নাঘরের ভিতর প্রস্থান করিল। বেণী হুঁকা টানিতে টানিতে পুস্তকে মনোনিবেশ করিলেন। কিছুক্ষণ পরই বিদ্যাধর ফিরিয়া আসিয়া হঠাৎ বলিল— খুড়ো, একটা গল্প শুনবে? তোমার শিহরণ সিরিজের চেয়ে ভাল গল্প।
বেণী: (বই মুড়িয়া) বলবি? আচ্ছা, তবে তাই বল্। অনেক ভাল ভাল ইংরিজী বই পড়েছিস সেই থেকে একটা বল্ শুনি। এমন গল্প বলিস বিদ্যে, যেন শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বিদ্যা: আচ্ছা বেশ। (গলা সাফ করিয়া) এক রাজপুত্তুর ছিল— অর্থাৎ কিনা—
বেণী: (করুণ ভাবে) ওরে, এ যে রূপকথা আরম্ভ করলি বিদ্যে! আমার কি আর রাজপুত্তুর, কোটালপুত্তুরের গল্প শোনবার বয়স আছে!
বিদ্যা: রূপকথা নয়, তবে কতকটা আরব্য উপন্যাসের মতো বটে। আচ্ছা, রাজপুত্তুরকে না হয় ছেড়ে দিলুম— ধরো, এক মস্ত বড়মানুষের ছেলে।
বেণী: নাম কি?
বিদ্যা: (মাথা চুলকাইয়া) নাম? মনে করো—রণেন্দ্র সিংহ? কেমন, জমকালো নাম কিনা? তোমার ‘গুদামে গুমখুন’-এ এমন নাম আছে?
বেণী: না— তারপর—বল্—
বিদ্যা: কি আশ্চর্য খুড়ো, এতদিন লক্ষ্য করিনি! কিন্তু আমাদের সাধারণ বাঙালীর ঘরে সময় সময় এমন এক একটা নাম বেরিয়ে পড়ে যা ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ‘জীবনপ্রভাত’ খুঁজলেও পাওয়া যায় না। ‘রণেন্দ্র সিংহ’ শুনলে মনে হয় না যে, নামটা একখানা আনকোরা ঐতিহাসিক উপন্যাস থেকে পেড়ে এনেছে? অথচ— সে যাক, এখন গল্পটা শোনো। এই রণেন্দ্র সিংহের অনেক টাকা; বাপ-মা ভাই-বোন কেউ নেই। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ— চেহারা মোটের উপর মন্দ নয়, অন্তত ছেলেপুলে অন্ধকারে দেখলে ডরিয়ে ওঠে না। তার বিয়ে হয়নি, কারণ বাপ বিয়ে দেবার আগেই মারা গেছেন। রাজধানীতে সাতমহল বাড়িতে একলা থাকে, কারুর তোয়াক্কা রাখে না। যেন একটি ছোটখাটো নবাব।
এহেন রণেন্দ্র সিংহ একদিন এক মেয়ে-ইস্কুলের গুরুমার সঙ্গে — থুড়ি— এক ঘুঁটেকুড়ুনী মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়ে গেল। ঘুঁটেকুড়ুনি মেয়ে দেখতে ঠিক একটি রজনীগন্ধার কুঁড়ির মতো। বলি, রজনীগন্ধার কুঁড়ি দেখেছ তো?
বেণী: দেখেছি রে বাপু, হগ সাহেবের বাজারে ফুলের দোকানে। তুই বলে যা না।
বিদ্যা: রণেন্দ্র সিংহ সেই রজনীগন্ধার কুঁড়ির প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগল; শেষে তার এমন অবস্থা হল যে, মেয়ে-ইস্কুল না হয়ে যদি ছেলে-ইস্কুল হত তাহলে পোড়ো সেজে ইস্কুলে ভর্তি হয়ে পড়তেও সে দ্বিধা করতে না— ঐঃ যা। কি বলতে কি বলে ফেল্ছি খুড়ো, আমার মাথাটা গুলিয়ে গেছে। ঘুঁটেকুড়ুনী মেয়ের কথা বলতে কেবলি গুরুমা’র কথা বলে ফেলছি—
বেণী: তা হোক, আমার বুঝতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। তুই বলে যা।
বিদ্যা: যা হোক, অনেক বুদ্ধি খেলিয়ে রণেন্দ্র সিংহ শেষে মেয়েটির সঙ্গে ভাব করলে। মেয়েটির নাম— ধরো, মঞ্জুষা। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব হল। ক্রমে রোজ সন্ধ্যাবেলা মেয়েটির কুঁড়ে ঘরে দুজনের দেখা হতে লাগল। হাসি-গল্প, গান, চা-চকোলেটের ভিতর দিয়ে বন্ধুত্ব বেশ প্রগাঢ় হয়ে উঠল। দূর থেকে দেখেই রণেন্দ্র সিংহ যাকে ভালবেসেছিল, এত কাছে পেয়ে তার প্রেমে একেবারে ডুবে গেল। নিজের বলে তার আর কিছু রইল না।
এমনি ভাবে মাস দুই কাটবার পর রণেন্দ্র সিংহ একদিন মঞ্জুষার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করলে। মঞ্জুষারানীর মুখখানি লাল হয়ে উঠল,— এক মুহূর্তে রজনীগন্ধার কুঁড়ি ডালিমফুলের কুঁড়িতে পরিণত হল। তারপর কিছুক্ষণ মাথা হেঁট করে থেকে বললে— ‘না।’ রণেন্দ্র সিংহের বুকের রক্ত থেমে গেল, সে জিজ্ঞেস করলে— ‘কারণ জানতে পারি কি?’
মঞ্জুষা বললে— ‘চিঠিতে জানাব।’
খালি বুক নিয়ে রণেন্দ্র সিংহ তার সাতমহল বাড়িতে ফিরে এল।
পরদিন মঞ্জুষার চিঠি এল। সে লিখেছে— সে গরিবের মেয়ে, বড়মানুষের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। এমন কি, বিয়ে করতেই তার ঘোর আপত্তি। তবে যদি ভগবান কখনও তাকে টাকা দেন তখন সে যাকে ভালবাসে তাকে বিয়ে করবে— নচেৎ বিয়ে-থাওয়ার কথা ঐ পর্যন্ত!
চিঠি পড়ে আহ্লাদে রণেন্দ্র সিংহের বুক নেচে উঠল; সে তখনি ছুটল উকিলের বাড়ি। উকিলকে দিয়ে এক দলিল তৈরি করালে। নিজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, নগদ টাকাকড়ি যা ছিল সব ঐ ঘুঁটেকুড়ুনী মেয়ের নামে দানপত্র করে দিল। তারপর দানপত্র হাতে করে সন্ধ্যেবেলা মেয়েটির বাড়ি গিয়ে হাজির হল।
বাড়িতে ঢোকবার আগেই রণেন্দ্র সিংহ দেখতে পেলে, দোতলার জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জুষাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কে একজন তাকে চুমু খাচ্ছে। জানলা দিয়ে তাদের কোমর পর্যন্ত দেখা গেল। যে লোকটা চুমু খাচ্ছে তার সরু লিক্লিকে চেহারা, ঘাড়ে ছাঁটা চুল, গায়ে কোট-সোয়েটার। রণেন্দ্র সিংহ তার মুখ দেখতে পেলে না। পা টিপে টিপে চোরের মতো বাড়ি ফিরে গেল।
সে রাত্তিরটা রণেন্দ্র সিংহ ঘুমোতে পারলে না। পরদিন সকালে উঠে রেজিস্ট্রি করে দানপত্রটা ঘুঁটেকুড়ুনী মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়ে সে দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়ল।
বেণী: সব দিয়ে দিল? দানপত্রটা ছিঁড়ে ফেলল না? দূর আহাম্মক।
বিদ্যা: রণেন্দ্র সিংহটা ঐ রকম আহাম্মক ছিল, সব দিয়ে দিলে। ভাবলে টাকা পেলেই যখন মেয়েটা যাকে ভালবাসে তাকে বিয়ে করতে পারবে তখন তাই করুক।
বেণী: হাঁদাগোবিন্দ রণেন্দ্র সিংগির কি দশা হল?
বিদ্যা: কি জানি। হাঁদাগোবিন্দদের যা হয়ে থাকে তাই হয়েছে বোধ হয়? পথে পথে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বেণী: আর মেয়েটা?
বিদ্যা: সে এখন বিয়ে-থা করে সুখে-স্বচ্ছন্দে ঘরকন্না করছে আর মাতালটার লাথি ঝ্যাঁটা খাচ্ছে। এতদিনে রণেন্দ্র সিংহের টাকাগুলো প্রায় শেষ করে এনেছে।
বেণী: মাতাল, টাকা উড়িয়ে দিয়েছে,— এত খবর তুই জানলি কি করে?
বিদ্যা: এর আর জানাজানি কি? এ তো দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।
বেণী: (বহুক্ষণ হুঁকায় টান দিয়া শেষে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া) তোর গল্প একদম বাজে, শেষের দিকে মন একেবারে খিঁচড়ে যায়। তার চেয়ে আমার শিহরণ-সিরিজ ঢের ভাল; শেষ পাতায় নায়ক-নায়িকা চুমু খেয়ে মনের সুখে ঘরকন্না করে। (সহসা হুঁকা রাখিয়া উঠিয়া বিদ্যাধরের স্কন্ধে হাত রাখিয়া) তবে কি জানিস রে বাবা, মরদের বাচ্চা— কিছুতেই দমতে নেই। কোথাকার ঘুঁটেকুড়ুনী মেয়ে নিজের মাথা খেয়ে ফিরে চাইল না বলে কি প্রাণটাকে তাচ্ছিল্য করে নষ্ট করে ফেলতে হবে? আবার দেখবি, কত রাজার মেয়ে ঐ রণেন্দ্র সিংগির জন্যে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইস্কুলের মাস্টারনী কদর বুঝলে না বলে কি মণিমুক্তোর দাম কমে যাবে! দেখিস, ঐ রণেন্দ্র সিংগির একদিন রাজকন্যের সঙ্গে বিয়ে হবে।
বিদ্যা: তা যদি হতে পারত খুড়ো তাহলে তো কোনও কথাই ছিল না। কিন্তু দুঃখের কথা কি বলব তোমাকে, রণেন্দ্র সিংহটা এমনি আহাম্মক যে ঐ ঘুঁটেকুড়ুনী মেয়ে ছাড়া আর কাউকে চায় না। রাজকন্যার ওপর তার একটুও নজর নেই।
বেণী: বিদ্যে, যা বাবা তুই কাটলেট ভাজগে যা। আর বুড়ো মানুষকে দুঃখ দিসনে। তোর গল্প আর আমি শুনতে চাই না।
এই সময় দোকানের সামনে একটি মোটর আসিয়া থামিল। বেণী উঁকি মারিয়া দেখিয়া তাড়াতাড়ি দেয়ালে টাঙানো একটি কালো রঙের গলাবন্ধ কোট পরিধান করিতে করিতে বলিলেন,— ‘বিদ্যে, শিগ্গির যা ইউনিফর্ম পরে নে। খদ্দের আসতে শুরু করেছে।’
বিদ্যাধর রান্নাঘরের ভিতর প্রস্থান করিল।
বহির্দ্বার দিয়া একটি তরুণীর প্রবেশ। সুন্দরী তন্বী, চোখে বিষাদের ছায়া। পায়ে হাই-হীল সোয়েড জুতা, পরিধানে দামী সিল্কের বেগুনি রঙের শাড়ি ও ব্লাউজ। হাতে একগাছি করিয়া সোনার চুড়ি। বাম কব্জীতে একটি গিনির মতো পাতলা ক্ষুদ্র ঘড়ি। গলায় প্লাটিনামের সরু হারে একটি হীরার লকেট ঝুলিতেছে। কানে কোনও অলঙ্কার নাই। মাথার চুল ঈষৎ রুক্ষু, এলো খোঁপার আকারে জড়ানো।
বেণী: (সহর্ষে হাত ঘষিতে ঘষিতে) আসুন মা লক্ষ্মী আসুন, এই চেয়ারটিতে বসুন।— এখনও ফাগুন মাস শেষ হয়নি, এরি মধ্যে কি রকম গরম পড়ে গেছে দেখছেন? পাখাটা খুলে দেব কি?
তরুণী ক্লান্ত ভাবে চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন; বেণী পাখা খুলিয়া দিলেন।
বেণী: (হাত ঘষিতে ঘষিতে) তা আপনার জন্য কি ফরমাস দেব বলুন তো? চা? কোকো? না, এ গরমে চা কোকো চলবে না। ঘোলের সরবৎ? চকোলেট ড্রিঙ্ক? আইস্ক্ৰীম? যা চাইবেন তাই তৈরি আছে। আমি বলি, এক গেলাস বরফ দেওয়া ঘোলের সরবৎ খেয়ে শরীর ঠাণ্ডা করে নিন, তারপর দুখানা ক্রীম কেক— কিংবা যদি ইচ্ছা করেন দুটো চিংড়ি মাছের কাটলেট—
তরুণী: চা দিন এক পেয়ালা—
বেণী: চা? যে আজ্ঞে, তাই দিচ্ছি। এ সময়ে চায়ে খুব তেষ্টা নাশ করে বটে। ওরে বিদ্যে, অর্ডার নিয়ে যা—
অদ্ভুত ইউনিফর্ম পরিয়া বিদ্যাধরের প্রবেশ।
নিম্নাঙ্গে চুড়িদার পায়জামা, ঊর্ধ্বাঙ্গে জরীর কাজকরা নীল রঙের ফতুয়া, মাথায় হাঁড়ির মতো আকৃতি-বিশিষ্ট এক টুপি। এই ইউনিফর্ম বিদ্যাধরের স্বকল্পিত সৃষ্টি।
তরুণীর সম্মুখবর্তী হইয়াই বিদ্যাধর ভীষণ মুখবিকৃতি করিতে আরম্ভ করিল।
তরুণী অন্যমনস্ক ভাবে হাতের উপর চিবুক ও টেবিলের উপর কনুই রাখিয়া বসিয়া ছিলেন— কিছু লক্ষ্য করিলেন না।
বেণী: (বিদ্যাধরকে একটা গুপ্ত ঠেলা দিয়া নিম্নস্বরে) ও কি, অমন করে দাঁত মুখ খিঁচুচ্ছিস কেন? অর্ডার নে।
বিদ্যা: (বিকট স্বরে) কি চাই?
তরুণী চমকিয়া উঠিলেন; অবাক হইয়া কিছুক্ষণ বিদ্যাধরের দিকে তাকাইয়া রহিলেন। বিদ্যাধর পূর্ববৎ মুখভঙ্গি করিতে লাগিল।
তরুণী: (অধর দংশন করিয়া) চা চাই— একটু তাড়াতাড়ি। আমাকে এখনি ব্যারাকপুর রেসে যেতে হবে।
বিদ্যাধর পিছু হটিয়া প্রস্থান করিল।
বেণী: দু’মিনিটের মধ্যে এসে পড়বে— সব তৈরি আছে। তা শুধু চা কি ঠিক হবে? সেই সঙ্গে দুটো কাটলেট— বিদ্যের হাতের কাটলেট এ অঞ্চলে বিখ্যাত— একবার মুখে দিলে আর ভুলতে পারবেন না।
তরুণী: (ঈষৎ হাসিয়া) আচ্ছা, আনতে বলুন—
বেণী: (নেপথ্যের উদ্দেশে) এক পেয়ালা চা, দুখানা কাটলেট, জলদি। (তরুণীর দিকে ফিরিয়া) মা-ঠাক্রুন এর আগে কখনও ‘ত্রিবেণী-সঙ্গমে’ পায়ের ধুলো দেননি, নইলে আগেই বিদ্যের কাটলেট অর্ডার দিতেন। কলকাতায় যত ভাল-ভাল তরুণী আছেন সবাই এখানে পায়ের ধুলো দিয়ে থাকেন। অন্তত হপ্তায় একবার বেণী খুড়োর হোটেলে আসাই চাই। তাঁদেরই দয়ায় বেঁচে আছি।
তরুণী: আমি কলকাতায় থাকি না। কখনও কখনও আসি।
বেণী: রেস খেলতে এসেছেন বুঝি? আজকাল অনেক মেয়েরা বাইরে থেকে আসেন—
তরুণী: না, রেস খেলতে নয়, রেসে যাচ্ছিলুম অন্য কাজে,— আপনিই বুঝি এই রেস্তোরাঁর মালিক?
বেণী: আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি মালিক বটে তবে বিদ্যেই সব করে; আমি শুধু পয়সা কুড়োই।
তরুণী: আপনার ঐ চাকরটির নাম বিদ্যে? ও কি বাঙালী?
বেণী: বাঙালী বই কি, আসল বাঙালী। কায়েতের ছেলে। কিন্তু ওর নাম বিদ্যে নয়, (গলা খাটো করিয়া) ও মস্ত বড়মানুষ ছিল— নানান্ ফেরে পড়ে এমন গরিব হয়ে গেছে, তাই হোটেলে চাকরি করছে। ওর বাড়ি বোধ হয়—
চা ও কাটলেটের প্লেট লইয়া বিদ্যাধর প্রবেশ করিল এবং হঠাৎ প্রচণ্ড ভাবে উপর্যুপরি হাঁচিতে আরম্ভ করিল। বেণী ফিরিয়া দেখিলেন বিদ্যাধর গলা ও মাথার চারিপাশে একটা কম্ফর্টার জড়াইয়া আরও অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করিয়াছে।
বেণী: (কাছে গিয়া ক্রুদ্ধ ও বিরক্তভাবে) এসব তোর কি হচ্ছে বিদ্যে? গলায় কম্ফর্টার জড়িয়েছিস কেন, অত হাঁচ্ছিস কেন?
বিদ্যা: (বেণীর কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া) খবরদার খুড়ো, একটি কথা বলেছ কি এক কামড়ে তোমার কানটি কেটে নেব, এক্কেবারে ভুবনের মাসী হয়ে যাবে। যা করছি করতে দাও— কথাটি কোয়ো না।
বেণী বিহ্বল হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। বিদ্যা চা ও কাটলেট তরুণীর সম্মুখে রাখিল।
বিদ্যা: আমি বিদ্যে, আমার সর্দি হয়েছে— হাঁচ্ছি— হাঁ— চ্ছি—
তরুণী: সর্বনাশ। আমার চায়ে হেঁচে দাওনি তো?
বিদ্যা: না— না— চায়ে আমি হাঁচি না— হাঁ— চ্ছি—
তরুণী: কিন্তু চা একেবারে তৈরি করে নিয়ে এলে কেন? আমি যে চায়ে চিনি খাই না।
বিদ্যা: খেয়ে দেখুন, চায়ে চিনি নেই—
(হাঁচিতে হাঁচিতে প্রস্থান)
(তরুণী এক চুমুক চা পান করিয়া অঙ্গুলি সঙ্কেতে বেণীকে ডাকিলেন, বেণী নিকটে আসিলেন।)
তরুণী: দেখুন, আপনার এই চাকরটি বোধ হয় পাগল।
বেণী: (মাথা নাড়িয়া) না, পাগল তো ছিল না তবে আজ হঠাৎ কেমন ধারা হয়ে গেছে। (গলা খাটো করিয়া) আমার কান কামড়ে নেবে বলে ভয় দেখাচ্ছিল।
তরুণী: সে কি! তবে তো একেবারে উন্মাদ!
বেণী: না, উন্মাদ নয়, এই খানিকক্ষণ আগে পর্যন্ত বেশ সহজ ভাবে কথা কইছিল? ওর কিছু একটা হয়েছে—
তরুণী: যদি উন্মাদ না হয় তাহলে নিশ্চয় অন্তর্যামী, নইলে আমি চায়ে চিনি খাই না জান্লে কি করে?
বেণী: (চিন্তিতভাবে) সত্যিই তো? জান্লে কি করে? বিদ্যে, এদিকে আয়—
তরুণী: থাক, ওকে ডাকবার দরকার নেই। ভাল ‘ওয়েটার’রা সাধারণত অন্তর্যামী হয়ে থাকে— ওতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। (চা পান করিতে করিতে) আচ্ছা, আপনার দোকানে তো অনেক লোক আসে যায়, আমি একজন লোককে খুঁজে বেড়াচ্ছি, তার সন্ধান দিতে পারেন? তারি খোঁজে আজ রেসকোর্সে যাচ্ছিলুম, সেখানে অনেক লোক যায়, যদি তার দেখা পাই।
বেণী: (সম্মুখের চেয়ারে উপবেশন করিয়া) কি রকম লোক তুমি খুঁজছ মা-ঠাক্রুন, তার বর্ণনাটা একবার দাও তো শুনি। তার নাম ধাম চেহারার একটা আন্দাজ দাও, দেখি, যদি বেরিয়ে পড়ে।
তরুণী: নাম জেনে বিশেষ সুবিধে হবে না, কারণ সম্ভবত সে ছদ্মনামে বেড়াচ্ছে। যা হোক, কাজ চালানোর জন্যে ধরে নেওয়া যাক যে তার নাম— রণেন্দ্র সিংহ।
বেণী: কি নাম? রণেন্দ্র সিংহ?
তরুণী: মনে করুন রণেন্দ্র সিংহ। কেন, এ ধরনের নাম কি আপনি পূর্বে শুনেছেন নাকি?
বেণী: হুঁ, শুনেছি বলেই মনে হচ্ছে, তবে লোকটাকে যে চিনি সে কথা এখনও জোর করে বলতে পারছি না। লোকটির আর সব পরিচয়?
তরুণী: দেখুন, লোকটির পুরো পরিচয় দিতে গেলে একটা গল্প বলতে হয়। আপনার ঐ চাকরটির মতো তারো একটু পাগলামির ছিট আছে।
ইতিমধ্যে বিদ্যাধর হামাগুড়ি দিয়া আসিয়া তরুণীর চেয়ারের পিছনে বসিয়াছিল এবং একাগ্ৰমনে কথাবার্তা শুনিতেছিল।
বেণী: বলো মা লক্ষ্মী তোমার গল্প, আজ দেখছি আমার রূপকথা শোনবার পালা।
তরুণী: রূপকথা? হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আমার গল্প রূপকথার মতোই আশ্চর্য। তবে শুনুন,— একটি গরিবের মেয়ে ছিল। ধরুন, তার নাম— মঞ্জুষা—
বেণী: হুঁ ধরেছি, বলে যাও মা লক্ষ্মী—
তরুণী: মঞ্জুষা গরিবের মেয়ে, পরের গলগ্রহ হয়ে অনেক দুঃখ পেয়ে সে মানুষ হয়েছিল। তাই যখন সে বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখলে তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলে আর কখনও কারুর গলগ্রহ হবে না; যদি কোনওদিন অনেক টাকা পায় তবেই বিয়ে করবে নচেৎ চিরদিন কুমারী থাকবে। কিন্তু অনেক টাকা পাবার কোনও আশাই তার ছিল না, কারণ ছোট ছোট মেয়েদের ক খ শিখিয়ে সে নিজের গ্রাসাচ্ছাদন উপার্জন করত। তাই চিরদিন মিসি-বাবা হয়ে থাকবার সম্ভাবনাই ছিল তার বেশি।
কিন্তু হঠাৎ একদিন এক রাজপুত্তুর কোথা থেকে এসে মঞ্জুষার সঙ্গে ভাব করতে আরম্ভ করে দিলে— তার নাম রণেন্দ্র সিংহ। এরই কথা আপনাকে বলেছিলুম। বাইরে থেকে লোকটিকে সহজ মানুষ বলে মনে হয় কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে পাগল। মঞ্জুষার সঙ্গে তার খুব ভাব হয়ে গেল, দুজনের রোজই দেখা হতে লাগল। তার সম্বন্ধে মঞ্জুষার মনের ভাব কি রকম হয়েছিল তা আমি বলতে পারি না, কিন্তু মনের ভাব যাই হোক, কোনও অবস্থাতেই যে সে তার প্রতিজ্ঞা ভুলবে না তাতে তিলমাত্র সন্দেহ ছিল না। তাই রণেন্দ্র সিংহ যেদিন তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেদিন সে রাজী হল না। পরদিন মঞ্জুষা রাজপুত্রকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলে কেন সে তাকে বিয়ে করতে পারবে না। চিঠি পেয়ে এই রাজপুত্র এক অদ্ভুত কাজ করলে, নিজের ধনরত্ন রাজ্যপাট সমস্ত মঞ্জুষার নামে দানপত্র করে দিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
বেণী: তারপর?
তরুণী: তারপর আর কি? মঞ্জুষা পাগলা রাজপুত্রকে দেশ-দেশান্তরে খুঁজে বেড়াচ্ছে—
বেণী: হুঁ। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, মেয়েটা রাজপুত্তুরের টাকাকড়ি সব নিলে?
তরুণী: হ্যাঁ নিলে।
বেণী: নিতে তার একটুও বাধ্ল না? হাত পুড়ে গেল না?
তরুণী: না, হাত পুড়ে গেল না। তার অধিকার ছিল বলে সে নিয়েছিল, নইলে নিত না।
বেণী: কি অধিকার?
তরুণী: (কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া হেঁট মুখে) বোধ হয় ভালবাসার অধিকার।
বেণী: বুঝলুম না।
তরুণী: (মুখ তুলিয়া) যাঁকে মঞ্জুষা ভালবাসে, যাঁকে মনে মনে স্বামী বলে বরণ করেছে তাঁর সম্পত্তিতে তার অধিকার নেই কি?
বেণী: (কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া থাকিয়া) কিন্তু— কিন্তু— আর একটা কথা, মেয়েটি কি আর একজনকে বিয়ে করেনি? একটা মাতাল লম্পট বদমায়েসকে—
তরুণী: মিথ্যে কথা। মঞ্জুষা তার কুমারী-হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা নিয়ে তার রাজপুত্রকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভগবান তাকে অনেক টাকা দিয়েছেন, সে এখন ইচ্ছে করলেই বিয়ে করতে পারে। কিন্তু সে তার রাজপুত্র ছাড়া আর কাউকে চায় না।
বিদ্যা: (সহসা সম্মুখে আসিয়া) কিন্তু যে লিক্লিকে চেহারা, ঘাড়ছাঁটা-চুল, সোয়েটার-পরা লোকটাকে মঞ্জুষা দোতলার সামনে দাঁড়িয়ে চুমু খাচ্ছিল, সে লোকটা তবে কে?
তরুণী: মিথ্যে কথা, মঞ্জুষা আজ পর্যন্ত কোনও পুরুষকে চুমু খায়নি—
বিদ্যা: তবে সে কে?
তরুণী: সে আমার বন্ধু রমলা। আমরা দুজনে এক ইস্কুলে পড়াতুম। রমলার চুল শিঙ্গল করা—
বিদ্যা: আঁ! (ললাটে করাঘাত করিয়া) উঃ, মঞ্জু— (তরুণীর হস্তধারণের চেষ্টা করিল)।
তরুণী: (বেণীকে) আপনার চাকর তো ভারি অসভ্য— মেয়েমানুষের হাত ধরে!
বেণী: (হুঙ্কার করিয়া) বিদ্যে, শিগ্গির হাত ছেড়ে দে বেয়াদব—
বিদ্যা: (কম্ফর্টার ও টুপি খুলিতে খুলিতে) খুড়ো, জলদি ভাগো, রান্নাঘরে গিয়ে ঘোলের সরবৎ খাও গে, নইলে দুটো কানই তোমার কাম্ড়ে শেষ করে দেব— কিছু থাকবে না (খুড়ো পশ্চাৎপদ) মঞ্জু, কখন চিনতে পারলে?
মঞ্জু: (বাষ্পচ্ছন্ন চোখে হাসিয়া) দেখবামাত্রই। মুখবিকৃতি করে কি আমাকে ফাঁকি দিতে পারো? জানো না, দাঁত খিঁচিয়ে কেউ কেউ নিজের সত্যিকার পরিচয় দিয়ে ফেলে!
রণেন্দ্র: মঞ্জু, বড্ড ভুল করে ফেলেছি— সত্যিই আমি পাগল—
মঞ্জু: কি বলে বিশ্বাস করলে? এতটুকু আস্থা নেই? এই ভালবাসা?
রণেন্দ্র: মঞ্জু, এইবারটি মাপ করো। বলো তো খুড়োর টেবিলের ওপর দুশো বার নাকখৎ দিচ্ছি।
মঞ্জু: থাক। একে তো পাগল, তার ওপর যদি নাকটাও ঘষে মুছে যায়, (চুপি চুপি) তাহলে আমি কি নিয়ে ঘর করব?
রণেন্দ্র: (মঞ্জুকে নিকটে টানিয়া) মঞ্জু, এখনি বলছিলে আজ পর্যন্ত কোনও পুরুষকে চুমু খাওনি। তা— সে ত্রুটি এইবেলা সংশোধন করে নিলে হত না?
বেণী: এই খবরদার! বুড়ো মানুষের সামনে বেয়াদবি করো না, আমাকে আগে রান্নাঘরে যেতে দাও। (যাইতে যাইতে ফিরিয়া) কিন্তু বিদ্যে, তুই তো তোর রাজকন্যে নিয়ে আজ নয় কাল চলে যাবি, এ বুড়োর কি দশা হবে?
রণেন্দ্র: (বেণীর পিঠ চাপড়াইয়া) ভেবো না খুড়ো, আমিও যে পথে তুমিও সেই পথে। মঞ্জুর অনেক টাকা, আমাদের দু’জনকে অনায়াসে পুষতে পারবে।
বাহিরে বহু মোটর আগমনের শব্দ শোনা গেল।
বেণী: (উঁকি মারিয়া দেখিয়া) ঐ রে! সব ছোঁড়াছুঁড়িগুলো একসঙ্গে এসে পড়েছে। কিছু যে তৈরি নেই— কি হবে বিদ্যে?
রণেন্দ্র: কুছ্ পরোয়া নেই খুড়ো, আজ আমরা দুজনে কাজ করব,— মঞ্জু তৈরি করবে আমি পরিবেশন করব। কি বলো মঞ্জু— অ্যাঁ! মনে করো এটা তোমার আইবুড়ো ভাতের ভোজ।
মঞ্জু সলজ্জে ঘাড় নাড়িল।
একদল তরুণ-তরুণীর কল-কোলাহল করিতে করিতে প্রবেশ। সকলের উপবেশন ও খাদ্যপানীয়ের ফরমাস দান।
হঠাৎ একজন তরুণ এক হাতে এক গোছা নোট তুলিয়া ধরিয়া আন্দোলিত করিতে করিতে গান ধরিল। আর সকলে, কেহ গলা মিলাইয়া কেহ বা হাতে তাল দিয়া যোগ দিল:—
বেরালের ভাগ্যে ছিঁড়েছে আজ সিকে
—ট্রা— লা—
খুড়ো ডিয়ার খুড়ো!
ইচ্ছে হচ্ছে নাচি দিক্বিদিকে— ট্রা— লা—
খুড়ো ডিয়ার খুড়ো!
বিদ্যে কোথায়, নিয়ে আয় সরবৎ—
খুড়ো, বসে থেকো না জড়বৎ,
ঘোড়দৌড়ে জিতেছি আজ পাঁচ কড়া
পাঁচ সিকে—
খুড়ো ডিয়ার খুড়ো!
খেয়ে বেদম চিংড়ির কাটলেট
আইস্ক্রীমে ভরিয়ে নিয়ে পেট
বিয়ে করবো আজ রাত্তিরেই প্রাণের
প্রেয়সীকে
খুড়ো ডিয়ার খুড়ো!
যবনিকা!!
১৩৩৯