বহুবিঘ্ননি
বৌভাতের ভোজ শেষ হইয়া বাড়ির লোকের খাওয়া-দাওয়া চুকিতে রাত্রি সাড়ে এগারোটা বাজিয়া গেল। আজই আবার ফুলশয্যা।
ফাল্গুন মাস;— অর্ধ-বিস্মৃত সুদূর জনশ্রুতির মতো বাতাসে এখনও শীতের আমেজ লাগিয়া আছে। তেতলার দক্ষিণ দিকের কোণের ঘরটাই নিখিলের শয়নকক্ষ— সেই ঘরেই আজ ফুলশয্যা হইবে। ঘরটি আগাগোড়া ফুল দিয়া সাজানো হইয়াছে। বিছানায় রাশি রাশি শাদা ফুল, মশারির চারিধারে ফুলের মালার ঝালর, খাটের চারিটি ডাণ্ডায় গোলাপ ফুলের মালা লতার মতো জড়াইয়া উঠিয়াছে। ঘরে দুটি ইলেক্ট্রিক বাতি আছে— একটা শাদা, অন্যটাতে লাল বাল্ব। দুটিতেই ফুলের দুল দুলিতেছে।
শাদা আলোটা জ্বালিয়া নিখিল দক্ষিণের খোলা জানালার পাশে আরাম-কেদারায় বসিয়া ছিল। চোখের সম্মুখে একটা খবরের কাগজ ধরা ছিল— বাহির হইতে কেহ আসিয়া হঠাৎ দেখিলে মনে করিত সে বুঝি পড়ায় একেবারে ডুবিয়া গিয়াছে। কিন্তু যিনি রসিক, চব্বিশ বছর বয়সে একদা ফাগুনের রাতে যিনি নব-বধূর চরণধ্বনির আশায় উৎকর্ণ হইয়া প্রতীক্ষা করিয়াছেন, তিনি নিখিলের মনের অবস্থা বুঝিবেন। চক্ষুই কাগজে নিবদ্ধ, কিন্তু মন?— হায় চব্বিশ বছরের মন।
অধিকন্তু, বধূটি নিখিলের সম্পূর্ণ অপরিচিতা নয়; চোখে চোখে হাসিতে হাসিতে একটু আলাপ বহুপূর্বেই হইয়া গিয়াছিল। তিন বছর আগে নিখিলের ছোট বোনের বিবাহের রাত্রে সে প্রথম ললিতাকে দেখিয়াছিল, সেই অবধি—
যে জিনিস তিন বছর ধরিয়া অহরহ কামনা করা যায়, পরিপূর্ণ প্রাপ্তির শুভলগ্ন যতই নিকটবর্তী হইতে থাকে, মুহূর্তগুলি ততই যেন অসহ্য দীর্ঘ বলিয়া মনে হয়। নিখিল কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া জানালার বাহিরে তাকাইল; দখিনা বাতাস ক্রমেই যেন উন্মাদ হইয়া উঠিতেছে, আর যেন শান্ত হইয়া থাকিতে পারিতেছে না। একটা পাপিয়ার কণ্ঠ পর্দায় পর্দায় ঊর্ধ্বে উঠিয়া রঙীন আতসবাজীর মতো ভাঙিয়া ঝরিয়া পড়িল। পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা!
বারোটা বাজিল। দ্বারের বাহিরে ফিস্ফিস্ গলার আওয়াজ ও চুড়ি-চাবির মৃদু শব্দ কানে যাইতেই নিখিল সচকিত ভাবে চোখ তুলিয়াই আবার সংবাদপত্রে নিবদ্ধ করিল।
বড় বৌদিদি বধূর হাত ধরিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন; বলিলেন, ‘এই নাও ভাই তোমার জিনিস।’
নিখিল কাগজ রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বড় বৌদিদি বয়সে তাহার জ্যেষ্ঠা; চিরদিনই নিখিল তাঁহাকে শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম করিয়া চলে। সে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।
বড় বৌদিদি হাসিয়া বধূর হাতটি নিখিলের হাতে ধরাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘নাও। এবার আমি চললুম।— একটু সাবধানে কথাবার্তা কোয়ো কিন্তু। সবাই আড়ি পাতবার জন্যে ওৎ পেতে আছে।’ বলিয়া দরজা ভেজাইয়া দিয়া প্রস্থান করিলেন।
বাহিরে অনেকগুলি চাপা গলার ফিস্ফিস্ ও তর্জন শুনা গেল— ‘কেন তুমি বলে দিলে—’ বৌদিদি বলিলেন, ‘নে, আর ওদের জ্বালাতন করিস্নি। অনেক রাত হয়ে গেছে; এখন যে-যার নিজের ঘরে গিয়ে ফুলশয্যা করগে যা।’
নিখিলের একটু দুর্ভাবনা হইল। বাড়িতে গুটি চারেক নবীনা বৌদিদি আছেন, তাঁহারা রেয়াৎ করিবেন না; দুটি কনিষ্ঠা ভগিনী— না, তাহারাও আজ কোনও বাধা মানিবে না। তাছাড়া একটি পঁয়তাল্লিশ বছরের শিশু ভগিনীপতি আছেন, তিনি তো আগে হইতেই শাসাইয়া রাখিয়াছেন।
কিন্তু বধূর হাতটি নিখিলের মুঠির মধ্যে। ললিতা কম্প্রবক্ষে সন্নতনয়নে দাঁড়াইয়া আছে,— মাথার অনভ্যস্ত ঘোমটা খসিয়া পড়িতেছে। কপালে, ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাহার টানাটানা চোখে কে সরু করিয়া কাজল পরাইয়া দিয়াছে। অপূর্ব হর্ষাবেশে নিখিলের বুকের ভিতরটা দুলিয়া উঠিল! এই নারীটি তাঁহার! সে ললিতার হাতে একটু টান দিয়া অস্ফুট স্বরে বলিল, ‘ললিতা!’
ললিতার চোখ দুটি একবার স্বামীর মুখের পানে উঠিয়াই আবার নামিয়া পড়িল; ঠোঁট দুটি একটু নড়িল, ‘আলো নিবিয়ে দাও।’
বধূর হাত ছাড়িয়া নিখিল উজ্জ্বল আলোটা নিবাইয়া লাল আলো জ্বালিয়া দিল। ঘরটি স্বপ্নময় হইয়া উঠিল। জানালা-পথে দখিনা বাতাস তখন আরও অশান্ত হইয়া উঠিয়াছে।
বধূর কাছে ফিরিয়া আসিতেই বধূ একটু হাসিয়া খাটের নীচে আঙুল দেখাইয়া দিল। নিখিল প্রথমটা বুঝিতে পারিল না, তারপর পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া খাটের নীচে উঁকি মারিল। খাটের নীচে বধূর দুটা বড় বড় তোরঙ্গ ছিল, তাহাদের মাঝখানে একটি বড় পুঁটুলির মতো বস্তু দেখিতে পাইল। টিপ করিয়া নিখিল পুঁটুলির গোলাকার স্থানটিতে প্রচণ্ড একটা চপেটাঘাত করিল। সঙ্গে সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়া ভগিনীপতি বাহির হইয়া আসিলেন। ‘উঃ, শালা বোম্বাই চড় জমিয়েছে রে!’ বলিতে বলিতে দ্রুতবেগে দরজা খুলিয়া পলায়ন করিলেন।
ললিতা হাসি চাপিতে না পারিয়া মুখে আঁচল দিল।
জামাইবাবুকে ঘরের বাইরে খেদাইয়া দিয়া, দ্বারে খিল দিয়া নিখিল ঘরটা ভাল করিয়া তদারক করিল। ওয়ার্ডরোবের দরজা হঠাৎ খুলিয়া দেখিল ভিতরে কেহ আছে কিনা। আর কাহাকেও না পাইয়া সে নিশ্চিত হইয়া বলিল, ‘আর কেউ নেই।’
ললিতার হাত ধরিয়া সে শয্যার পাশে লইয়া গিয়া বসাইল। ললিতার পা চলে চলে চলে না। ঐ পুষ্পাস্তীর্ণ শয্যাটি চিরজন্মের জন্য তাহার— আর এই লোকটি— জীবনে মরণে সেও তাহার। তবু পা চলে না— পায়ে পায়ে জড়াইয়া যায়। হায় ষোলো বছরের যৌবন। হায় প্রথম প্রণয়-ভীতি।
বধূর পাশে বসিয়া নিখিল চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিল, ‘শুভদৃষ্টির সময় অমন মুখ টিপে হেসেছিলে কেন বলো তো?’
বাহিরের অশান্ত দখিনা বাতাসটা আর শাসন মানিল না— হু হু করিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। মশারি উড়াইয়া, আল্নার কাপড়-চোপড় ছত্রাকার করিয়া, বধূর বসনাঞ্চল এলোমেলো করিয়া খবরের কাগজের কয়েকটা পাতা সঙ্গে লইয়া আকস্মিক দুরন্ত বিপ্লবের মতো উত্তরের জানালা দিয়া বাহির হইয়া গেল।— বসন্তের মাতাল বাতাস— নাহি লজ্জা নাহি ত্রাস— আকাশে ছড়ায় অট্টহাস—
পাগলা বাতাসটা চলিয়া গেল— গোলাপী ছায়াময় ঘরটি আবার নিস্তব্ধ হইল। আলোটা দোল্নার মতো দুলিতে রহিল।
হাওয়ার এই বিঘ্নকারী উৎপাতে নিখিল মনে মনে একটু বিরক্ত হইল। বধূকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ করে দেব নাকি?’
ললিতা মাথা নাড়িল, ‘না, থাক।’
নিখিল তখন ললিতার পাশে আরও একটু সরিয়া বসিয়া তাহাকে কাছে টানিয়া আনিয়া মৃদুস্বরে বলিল, ‘ললিতা!’
ললিতা তাহার বুকের উপর হাত রাখিয়া একটু ঠেলিয়া দিয়া বলিল, ‘ছাড়ো।’
নিখিল ডান হাতে তাহার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া বলিল, ‘না, ছাড়বো না।’
এই সময় খুব নিকট হইতে ভারি গলায় কে বলিয়া উঠিল, ‘খবরদার।’
চমকিয়া নিখিল ললিতাকে ছাড়িয়া দিল; ললিতাও জড়সড় হইয়া সরিয়া বসিল।
নিখিল আবার ঘরের চারিদিক ঘুরিয়া দেখিল, খাটের তলাটা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল— কিন্তু কেহ কোথাও নাই। তবে কে কথা কহিল? গলাটা ইচ্ছা করিয়া বিকৃত করিয়াছে— এ জামাইবাবু না হইয়া যায় না। কিংবা হয়তো সেজবৌদিদি— তিনি পরের গলা চমৎকার নকল করিতে পারেন। কিন্তু যিনিই হোন্— কোথায় তিনি? দুই জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল— কিন্তু সেখানে কাহাকেও চোখে পড়িল না। দরজায় কান পাতিয়া শুনিল— কাহারও সাড়া-শব্দ নাই। ব্যর্থ হইয়া সে ফিরিয়া আসিয়া ললিতার পাশে বসিল।
ঠং করিয়া সাড়ে বারোটা বাজিল।
নিখিল বলিল, ‘বোধ হয় শোনবার ভুল— কিন্তু ঠিক মনে হল কে যেন বললে— খবরদার— তুমি শুনেছিলে?
ললিতা বুকে ঘাড় গুঁজিয়া চুপ করিয়া রহিল। সেও ‘খবরদার’ শুনিয়াছিল— লজ্জায় লাল হইয়া ভাবিতে লাগিল, নিশ্চয় কেহ দেখিয়া ফেলিয়াছে।
নিখিল আবার তাহাকে কাছে টানিয়া আনিল, বলিল, ‘ও কিছু নয়।’
ললিতা তাহার হাত ছাড়াইয়া সরিয়া বসিয়া চাপা উৎকণ্ঠার স্বরে বলিল, ‘না না, এক্ষুনি কে দেখতে পাবে।’
নিখিল উঠিয়া গিয়া উত্তরের জানালাটা বন্ধ করিয়া দিল— সেদিকে ছাদ, সুতরাং আড়ি পাতিবার সুবিধা বেশি। দক্ষিণ দিক ফঁকা— সেদিক হইতে কোনও ভয় নাই— তাই সে জানালাটা খোলাই রহিল।
‘এবার আর কোনও ভয় নেই’ বলিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হইয়া নিখিল ললিতার পাশে আসিয়া বসিল। তাহার একটি হাত তুলিয়া লইয়া আঙুলের ডগায় একটা চুম্বন করিল। ললিতা হাত কাড়িয়া লইবার চেষ্টা করিল কিন্তু পারিল না। নিখিল হাত ধরিয়া তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ‘দুষ্টুমি কোরো না, লক্ষ্মী মেয়েটির মতো একটি—’ বলিয়া মুখের কাছে মুখ লইয়া গেল। ললিতার তপ্তনিশ্বাস তাহার অধরে লাগিল।
ঠিক এই সময় তেমনি ভারি গলায়—‘এই! ও কি হচ্ছে?’
তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিয়া নিখিল চারিদিকে চাহিল। শব্দটা কোন্ দিক হইতে আসিতেছে তাহা উৎকর্ণ হইয়া ধরিবার চেষ্টা করিল— কিন্তু আর কোনও শব্দ শুনা গেল না। নিখিলের মনে হইল শব্দটা যেন ঘরের ভিতর হইতেই আসিতেছে— অথচ ঘরের ভিতর কেহ নাই, সে বেশ ভাল করিয়া দেখিয়াছে।
নিখিলের বড় রাগ হইল। বার বার বাধা! কথা যে-ই বলুক, সে নিশ্চয় তাহাদের কার্যকলাপ দেখিতে পাইতেছে— নচেৎ ঠিক ঐ সময়েই—
একটি মলক্কা বেতের লাঠি হাতে শক্ত করিয়া ধরিয়া নিখিল সন্তর্পণে দ্বার খুলিল— ইচ্ছাটা, সম্মুখে যাহাকে দেখিবে তাহাকেই এক ঘা বসাইয়া দিবে। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! সেখানে কেহই নাই। তবু নিখিল বাহির হইল— কে বজ্জাতি করিতেছে তাহাকে ধরিতেই হইবে; রসিক লোকটিকে আজ ভাল করিয়া জব্দ করা চাই।
পনেরো মিনিট বাড়ির চারিদিকে ঘুরিয়া নিখিল হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিল। বাড়ি নিশুতি— ঘরে ঘরে দ্বার বন্ধ। চাকর দাসীরা পর্যন্ত সমস্ত দিনের ক্লান্তির পর যে যেখানে পাইয়াছে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বৌদিদি প্রভৃতিরা বোধ করি প্রথমে খানিকক্ষণ নিখিলের ঘরের আনাচে কানাচে ঘুরিয়া শেষে প্রবলতর আকর্ষণে স্ব স্ব শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়াছেন।
লাঠিটা ঘরের কোণে রাখিয়া দিয়া নিখিল বলিল, ‘নাঃ, কাউকে দেখতে পেলুম না, সবাই ঘুমিয়েছে।’ সে আশ্চর্য ও উদ্বিগ্ন হইয়া ভাবিতে লাগিল— কি এ! ভৌতিক ব্যাপার! ভেন্ট্রিলোকুইজ্ম?
ঘড়িতে একটা বাজিল।
তখন নিখিল আবার ললিতার হাতটি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া বসিল। তারপর, কি ভাবিয়া উঠিয়া গিয়া দক্ষিণের জানালাটাও বন্ধ করিয়া দিয়া আসিল।
ললিতা মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘শুয়ে পড়লে হত না?’
নিখিল কিন্তু এখনি ঘুমাইতে রাজী নয়। বধূর সহিত নব পরিচয়ের রাত্রে, যখন সবেমাত্র পরিচয়ের সূত্রপাত হইয়াছে— তখন ঘুম!
নিখিল ললিতার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিল, ‘এখনি ঘুমুবে? আচ্ছা, আগে একটা চুমু দাও, তারপর বিছানায় শুয়ে গল্প করব।’
‘আলো নিবিয়ে দাও।’
‘না— আলো থাক। ললিতা—’ বলিয়া ঠোঁটের কাছে ঠোঁট লইয়া গেল।
পুনরায় সেই গম্ভীর স্বর— ‘দাঁড়াও তো মজা দেখাচ্ছি।’
এবার নিখিলের মনটা সতর্ক ছিল। সে কিছুক্ষণ স্থির হইয়া রহিল, তারপর উঠিয়া গিয়া সুইচ টিপিল।
বড় আলোর আকস্মিক তীব্র দীপ্তিতে ঘর ভরিয়া যাইতেই কার্নিসের উপর হইতে শব্দ হইল, ‘রাধে কৃষ্ণ! রাধে কৃষ্ণ!’
কার্নিসের দিকে তাকাইয়া নিখিল হঠাৎ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। ললিতাও সেদিকে একবার তাকাইয়া বিছানায় উপুড় হইয়া পড়িয়া হাসিতে লাগিল।
একটা পাহাড়ী ময়না কার্নিসের উপর বসিয়া আছে এবং গম্ভীরভাবে ঘাড় বাঁকাইয়া তাহাদের নিরীক্ষণ করিতেছে।
নিখিল হাসিতে হাসিতে গিয়া ললিতাকে বিছানা হইতে ধরিয়া তুলিল। ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া বধূকে শক্ত করিয়া বুকে জড়াইয়া ধরিয়া পাখিটার দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিল, ‘হতভাগা পাখি! বোধ হয় ঝড়ের সময় কারুর খাঁচা থেকে পালিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। দাঁড়াও ওকে শায়েস্তা করছি।’
এক ঘর আলো— তাহার মাঝখানে স্বামীর একি কাণ্ড! ললিতা তাহার বাহুপাশ হইতে মুক্ত হইবার চেষ্টা করিতে করিতে বলিল, ‘ও কি করছ! ছেড়ে দাও— আলো নিবিয়ে দাও।’
নিখিল বলিল, ‘না— ও বেটা পাখিকে আমি আজ দেখিয়ে দেব যে ওকে আমি গ্রাহ্য করি না। এ যে আমার নিজের স্ত্রী তা বেটাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।’ বলিয়া ললিতার ঠোঁটে চোখে কপালে চার পাঁচটা চুম্বন করিল। ললিতাও বিবশা হইয়া স্বামীর বুকের উপর চক্ষু মুদিয়া পড়িয়া রহিল।
পাখিটা বলিল, ‘খবরদার! ও কি হচ্ছে! দাঁড়াও তো—’
নিখিল ললিতার নরম গলার মধ্যে মুখ গুঁজিয়া অর্ধরুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘ললিতা, এবার তুমি একটা।’
ললিতার অবশ অঙ্গে একটু সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল। সে বলিল, ‘আলো নিবিয়ে দাও। দুটোই।’
নিখিল বলিল, ‘কিন্তু পাখিটা যে দেখতে পাবে না।’
‘তা হোক।’
তখন যেখানে দাঁড়াইয়া ছিল সেখান হইতে হাত বাড়াইয়াই নিখিল সুইচ টিপিয়া দিল। ঘর একেবারে অন্ধকার হইয়া গেল।
‘ললিতা!’
‘কি?’
‘আলো নিবিয়ে দিয়েছি।’
মিনিটখানেক পরে একটি ভারি মিষ্টি ছোট্ট শব্দ হইল।
পাখিটা অন্ধকারে তাহা শুনিতে পাইয়া গম্ভীর স্বরে বলিল, ‘রাধে কৃষ্ণ!’
২৫ আশ্বিন ১৩৪০