প্রতিদ্বন্দ্বী

প্রতিদ্বন্দ্বী

নারী ও পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শাশ্বত। কিন্তু বহুলাংশে উহা ফল্গু নদীর মতো অন্তঃপ্রবাহিণী বলিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করিতে পারি না। সাধারণত নরনারীর মধ্যে প্রেমটাই চোখে পড়ে।

বিবাহ নামক সংস্কারটা উক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতারই পূর্ণ বিকাশ। তাই কাব্য ও রোমান্সে দুইটি নরনারীকে বিবাহ বন্ধনে বাঁধিয়া দিয়া লেখক লেখনী সম্বরণ করেন। অর্থাৎ দুইটি যুদ্ধোদ্যত প্রতিদ্বন্দ্বীকে আখড়ায় ঢুকাইয়া দিয়া সরিয়া পড়েন। অতঃপর যে কেলেঙ্কারি আরম্ভ হইবে, তাহা স্বচক্ষে দর্শন করিবার সাহস তাঁহার নাই।

নৃসিংহবাবুর অন্তরে কাব্য বা রোমান্সের বাষ্পটুকু ছিল না বলিয়াই বোধ হয় তিনি এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের ফলাফল শেষ পর্যন্ত দেখিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। তাঁহার দুর্দম সাহস ছিল এবং লোকে বলিত, তিনি একজন বড় বৈজ্ঞানিক। তিনি নাকি Natural Selection নামক জৈব আইনকে সমূলে উৎপাটিত করিয়া দূরে নিক্ষেপ করিবার মতলব করিয়াছিলেন। অসম্ভব নয়; আমরা যতদূর জানি, লোকটি অতিশয় ধূর্ত ও ফন্দিবাজ।

কোনও বৈজ্ঞানিক দুরভিসন্ধিবশত নৃসিংহবাবু এক ঝাঁক পায়রা ও এক পাল খরগোস পুষিয়াছিলেন। উপরন্তু তাঁহার এক শ্যালীর পুত্র ও ভগিনীর কন্যাও তাঁহার গৃহে প্রতিপালিত হইত। ইহারা সকলেই অনাথ; নৃসিংহবাবু ছাড়া ইহাদের আর কেহ ছিল না।

নৃসিংহবাবুরও ইহারা ছাড়া আর কেহ ছিল না। স্ত্রী বহুকাল পূর্বে Survival of the Fittest নামক আইন শিরোধার্য করিয়া বিগত হইয়াছিলেন। সন্তানাদিও কস্মিন্ কালে হয় নাই। সুতরাং তাঁহার সংসারে পারাবত, শশক, শ্যালীর পুত্র ও ভাগিনেয়ী ব্যতীত অন্য কেহ ছিল না। নৃসিংহবাবু ছিলেন ইহাদের ভাগ্যবিধাতা।

নৃসিংহবাবুর বয়স ছাপ্পান্ন। তাঁহার মস্তকের মধ্যস্থলে একটিমাত্র কেশ ছিল; প্রাতঃকালে স্নান করিয়া তিনি সেটিকে চিরুনি দিয়া আঁচড়াইতেন, তারপর বুরুশ দিয়া মস্তকের উপর শোয়াইয়া দিতেন। অতঃপর এক বাটি দুগ্ধ পান করিয়া তিনি ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করিতেন। বাড়িতে থাকিয়া যাইত নীরেন ও মিলু। নৃসিংহবাবু অন্তর্হিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে ইহারা ঝগড়া আরম্ভ করিত।

ঝগড়ার কোনও হেতু ছিল না, নিতান্ত অকারণেই পরস্পরের ছুতা ধরিয়া ইহারা ঝগড়া করিত। নীরেন মিলু অপেক্ষা ছয় সাত বৎসরের বড়, কিন্তু সেজন্য তাহাদের বাধিত না। বছর আষ্টেক আগে যখন এই বাড়িতে তাহাদের প্রথম দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তখনই এই কলহের সূত্রপাত হইয়াছিল। নবাগত নীরেন মিলুকে। দেখিবামাত্র বলিয়াছিল, ‘এই ছুঁড়ি, তুই বুঝি এই বাড়ির ঝি? আমার জুতো ভাল করে বুরুশ করে দে তো।’

দশমবর্ষীয়া মিলু কিছুক্ষণ ঘৃণাপূর্ণ চক্ষে চাহিয়া থাকিয়া বলিয়াছিল, ‘মামা একটা বাঁদর পুষবেন বলেছিলেন; তুমি বুঝি সেই বাঁদরটা!’

আড়াল হইতে নৃসিংহবাবু এই কথোপকথন শুনিয়া অতিশয় হৃষ্ট হইয়াছিলেন এবং তদ্দণ্ডেই তাঁহার মনে একটা কুটিল অভিসন্ধি জাগিয়াছিল।

অতঃপর নীরেন ও মিলু একত্র বড় হইয়াছে; দু’জনেই এখন কলেজে পড়ে। কিন্তু তাহাদের বিরোধ কিছুমাত্র কমে নাই। চোখাচোখি হইলেই তাহারা ঝগড়া করে; এমন কি বেশিক্ষণ চোখাচোখি না হইলে দু’জনেরই মন ছটফট করিতে থাকে। তখন একজন আর একজনকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া সাড়ম্বরে কলহ আরম্ভ করিয়া দেয়।

তাহাদের মনোভাব লক্ষ্য করিয়া বাড়ির ঝি অন্নদা ছড়া কাটিয়া মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিল—

‘মরি কি ভাবের হুলোহুলি

না দেখলে প্রাণে মরি, দেখলে চুলোচুলি৷’

নৃসিংহবাবু অবশ্য বিজ্ঞানে মগ্ন আছেন; তাঁহার ভাব দেখিয়া মনে হয় না যে তিনি এসব কিছু লক্ষ্য করেন। পায়রা ও খরগোসের মতো ইহারা দু’জনেও যেন তাঁহার জীবন যাত্রার আনুষঙ্গিক অভ্যাস হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

নীরেন ও মিলুর কলহের ক্রমবিকাশ আনুপূর্বিক বর্ণনা করা ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়। প্রথম কিছুদিন তাহারা নির্লজ্জভাবে মারামারি করিয়াছিল। একবার নীরেন মিলুর ঊরুতে ছুরির এক কোপ বসাইয়া দিয়াছিল; পরিবর্তে মিলু নীরেনের হাত কামড়াইয়া রক্তারক্তি করিয়া দেয়; দু’জনের দেহেই সে ক্ষতচিহ্ন এখনও বর্তমান আছে। কিন্তু যতই তাহাদের বয়স বাড়িতে লাগিল, যুদ্ধের রীতিতেও ক্রমশ পরিবর্তন দেখা দিল। এখন আর কেহ কাহাকেও দৈহিক আক্রমণ করে না, যুদ্ধের অস্ত্রগুলি অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম আকার ধারণ করিয়াছে। মনের প্রগতির ইহাই ইতিহাস।

সেদিন সকালে নৃসিংহবাবু তাঁহার একটিমাত্র কেশ যথারীতি প্রসাধনপূর্বক ল্যাবরেটরিতে প্রস্থান করিবার পর, মিলু নীরেনের ঘরে গিয়া দেখিল নীরেন তখনও ঘুমাইতেছে। মিলু কিয়ৎকাল চিন্তিত ভাবে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল। একটা খরগোস আনিয়া তাহার বিছানায় ছাড়িয়া দিবে? না, সেটা নূতন কিছু হইবে না, কারণ কিছু দিন পূর্বে নীরেনই ঐ কার্যটি করিয়াছিল। তাহার অনুকরণ করিলে নীরেন খুশিই হইবে।

সহসা মাথায় কোনও বুদ্ধি গজাইল না। তখন মিলু নীরেনের নাকে একটি খড্‌কে কাঠি প্রবেশ করাইয়া দিয়া বলিল, ‘কুম্ভকর্ণ, ওঠো— আটটা বেজে গেছে।’—বলিয়া প্রস্থান করিল।

নীরেন ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল, নিদ্রাকষায় নেত্রে দ্বারের দিকে চাহিয়া অর্ধস্ফুট স্বরে বলিল, ‘রাক্ষুসী—’ বলিয়াই প্রচণ্ড বেগে হাঁচিয়া ফেলিল।

মুখ-হাত ধুইয়া সে টেবিলের সম্মুখে বসিল এবং গভীর মনঃসংযোগে কি লিখিতে আরম্ভ করিল।

কয়েক মিনিট পরে মিলু আসিয়া জলখাবারের রেকাবি টেবিলের উপর রাখিতেই নীরেন অসম্পূর্ণ লেখাটি লুকাইয়া ফেলিল। মিলু কিন্তু এক নজর লেখাটা দেখিয়া লইয়াছিল, বলিল, ‘কি লেখা হচ্ছিল? পদ্য? আ মরে যাই! কার নামে পদ্য লেখা হচ্ছে?’

নীরেন বলিল, ‘যার নামেই লিখি না—’

মিলু ফস্ করিয়া কাগজখানা কাড়িয়া লইয়া পড়িল—

‘একটি বালিকা—নামটি তার মিলু।

মস্তকে তার নাই এক ফোঁটা ঘিলু—’

নীরেনের নাকে কাঠি দিয়া মিলু যে বিজয়গর্ব অনুভব করিতেছিল তাহা লুপ্ত হইয়া গেল, সে দু’হাতে কাগজখানা ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে ক্রোধ-অবরুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘আচ্ছা, আমিও জানি। মাথায় ঘিলু আছে কিনা দেখিয়ে দেব।’

তখনকার মতো বিজয়ী নীরেন দন্ত বাহির করিয়া হাসিল এবং পরম পরিতৃপ্তি সহকারে জলযোগ আরম্ভ করিল।

দু’জনেই যথাসময়ে কলেজে গেল; নীরেন যাইবার সময় মিলুর দিকে চাহিয়া একটু মুচকি হাসিয়া গেল। মিলু নিদ্রালু বিড়ালীর মতো কেবল চক্ষু কুঞ্চিত করিল।

নীরেন বৈকালে কলেজ হইতে ফিরিয়া দেখিল তাহার টেবিলের উপর একটি ছয় পংক্তির কবিতা শোভা পাইতেছে।—

‘একটি যুবক— নামটি তাহার নীরু,

ক্যাবলার রাজা, চাষা, অসভ্য, ভীরু,

মহিলাগণের সম্মান নাহি জানে;

বুদ্ধি ও শিক্ষার দোষ— মানে—

মানুষ না হয়ে ভাল্লুক হত যদি

নাচ দেখিতাম আনন্দে নিরবধি।’

নীরেন কবিতা পাঠ শেষ করিয়াছে, এমন সময় মিলু প্রবেশ করিয়া বলিল, ‘কেমন কবিতা?’

নীরেন দাঁত কড়মড় করিয়া বলিল, ‘আমার ছন্দ চুরি করেছিস।’

মিলু বিদ্রূপপূর্ণ ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিল, ‘ইঃ— ওঁর ছন্দ! বাজার থেকে উনি কিনে এনেছেন!’

নীরেন উত্তপ্ত স্বরে বলিল, ‘তুই একটা চোর।’

মিলু ততোধিক উত্তপ্ত স্বরে বলিল, ‘তুমি একটা ডাকাত।’

নীরেন চেয়ারে বসিয়া বলিল, ‘তুই প্যাঁচা।’

মিলু তাহার সম্মুখে আর একটা চেয়ারে বসিয়া বলল, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা।’

দু’জনেরই রক্ত গরম হইয়া উঠিল।

‘তুই ইঁদুর।’

‘তুমি টিকটিকি।’

‘তুই ক্যাঙারু।’

‘তুমি গণ্ডার।’

এইভাবে কিছুক্ষণ চলিল। ক্রমে পশুপক্ষীর নাম ফুরাইয়া আসিতে লাগিল, তখন মিলু জিভ বাহির করিয়া নীরেনকে ভ্যাংচাইয়া দিল। নীরেন প্রথমটা থতমত খাইয়া গেল, তারপর সেও দীর্ঘ জিহ্বা বাহির করিয়া দিল। বিরোধ এতটা চরমে অনেকদিন উঠে নাই।

এই সময় নৃসিংহবাবু কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, মিলু ও নীরেন চক্ষু দৃঢ়ভাবে বন্ধ এবং জিহ্বা নিষ্ক্রান্ত করিয়া মুখোমুখি বসিয়া আছে! তিনি ধূর্ত বৈজ্ঞানিক, চট্‌ করিয়া ব্যাপারটা বুঝিয়া লইলেন। আনন্দে তাঁহার মস্তকের একটিমাত্র কেশ কণ্টকিত হইয়া উঠিল।

তিনি হর্ষোৎফুল্ল স্বরে ডাকিলেন, ‘মিলু, নীরেন!’

উভয়ে জিহ্বা সম্বরণ করিয়া চক্ষু মেলিল।

নৃসিংহবাবু বলিলেন, ‘বড় খুশি হয়েছি। তোমরাই আমার থিয়োরি প্রমাণ করতে পারবে। আমি তোমাদের দু’জনের বিয়ে দেব— পরস্পরের সঙ্গে। হাঃ হাঃ হাঃ।’—তিনি প্রস্থান করিলেন।

মিলু ও নীরেন পরস্পরের দিকে চাহিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল। প্রস্তাবটা আকস্মিক বটে, কিন্তু সেজন্য কেহ বিস্মিত হইল না। নৃসিংহবাবুর সকল কার্যই অপ্রত্যাশিত, কিন্তু তাই বলিয়া তাহা অমান্য করিবার কল্পনাও কখনও ইহাদের মাথায় আসে নাই। তিনি ইচ্ছামত পায়রা ও খরগোসের বিবাহ দিতেন, কেহ আপত্তি করে নাই, এক্ষেত্রেও কেহ আপত্তি করিল না। বরং সারাজীবন ধরিয়া দু’জনে দু’জনকে জ্বালাতন করিতে পারিবে এই আনন্দেই আত্মহারা হইয়া পড়িল। উভয়েই একই সঙ্গে বলিয়া উঠিল, ‘এবার মজা টের পাবে।’

ফুলশয্যার রাত্রে নীরেন খাটে বসিয়া পা দুলাইতেছিল, মিলু প্রবেশ করিতেই গম্ভীর স্বরে বলিল, ‘আমি হচ্ছি তোমার স্বামী, শিগগির প্রণাম কর।’ —বলিয়া নিজের পায়ের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করিল।

মিলু তৎক্ষণাৎ ভালমানুষের মতো গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিল; তারপর উঠিবার সময় নীরেনের পায়ে চিমটি কাটিয়া দিল। নীরেন লাফাইয়া উঠিল, ‘উঃ!’ তারপর দুই বাহুর দ্বারা পলায়নপরা মিলুকে চাপিয়া গাঢ় স্বরে বলিল, ‘তবে রে—’

দু’জনের দাম্পত্য জীবন আরম্ভ হইয়া গেল।

আশা করিতেছি ইহাদের দাম্পত্য জীবন অন্যান্য সাধারণ দাম্পত্য জীবন হইতে পৃথক হইবে না। কারণ নারী ও পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রকট বা প্রচ্ছন্ন যাহাই হোক— সার্বজনিক; মিলু ও নীরেন সাধারণ পাঁচজনের মতোই ঝগড়া করিয়া, ভালবাসিয়া, পরস্পরকে জয় করিবার চেষ্টা করিয়া জৈব ধর্ম পালন করিবে।

আমরা অবশ্য বিবাহ দিয়াই সরিয়া পড়িলাম।

১৪ ফাল্গুন ১৩৪২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *