রাধাকৃষ্ণ

রাধাকৃষ্ণ

আহা, বসন্তকাল। শিমুল তুলো উড়ছে ফাটা বালিশ থেকে, ফ্যানের হাওয়ায়। প্লাসটিকের বালতি উপছে পড়ছে লাল লাল তুলো আর ব্যান্ডেজের কাপড়ে। রক্তমাখা। হোলিতে রং দেওয়া নিয়ে মারপিটের জের। নার্স, ওয়ার্ডবয়, গ্রুপ ডি-দের ঘাড়, গলা, মাথায় পোস্ট-রং খেলা ছোপ। কে জানে কোন ওয়ার্ড-এর ছাত থেকে ভাঙা গলায় চিল্লাচ্ছে ই এন টি পেশেন্ট কোন কোকিল। ‘হাসপাতালে রেডিয়ো চালিয়ো না’ বলা সত্ত্বেও কার্ড লেখার ঘরে রেডিয়ো চলছে। বসন্তের গান দিয়েছে কোন এফ এম চ্যানেলে—

আজি এ বসন্ত দিনে।

বাড়ি ফেরো মাংস কিনে…

গতকাল দোল গেছে। আজ বোধহয় হোলি। হিন্দি বেল্টে আজই ফেস্ট। এইমাত্র লাল সাবানে হাত ধুয়ে ডক্টরস রুমে গেলাম। এক তৃণমূল নেতার সাদা পাঞ্জাবিতে লাল রং দেওয়া নিয়েই কেলো। বোধহয়, হোলিতে সবুজ রং দিলে এই আনহোলি রক্তপাতটা ঘটত না।

লাইজল-লাইজল গন্ধমাখা ঘরে একটু বসলাম। নতুন কোনও পেশেন্ট এলেই আবার উঠে যেতে হবে। অনেকেই ছুটি নেওয়ায় আমার একটু টানা ডিউটি পড়েছে। মিউচুয়ালি। ভুল ফ্রিকোয়েন্সিতে কোকিল ডেকেই চলেছে।

এমন বসন্ত দিন, নাই রং খেলিবার সিন

একটানা দুই দিন চলিছে ডিউটি।

ডিউটির সঙ্গে কী মেলে? বিউটি। বিউটি হলেই পিয়ালিকে জুড়তে হবে। এমন সময় বুক পকেটে পিং পিং। পিয়ালি কলিং। একটা এস এম এস পাঠিয়েছে পিয়ালি।

এনি wrong যদি খেলি রং উইথ সুতনু?

একটা জুতসই জবাব খুঁজছি। চিন্তা করলেই আমি মাথার চুল পাকাই। তখনই এমার্জেন্সিতে নতুন পেশেন্ট। আমি পেশেন্ট অ্যাটেন্ড করার আগেই পিকপিক করে লিখলাম—অং বং চং কেন এত ঢং বলো মুনু? ঠিক পছন্দ হল না। আবার নতুন করে লিখব ভাবছি, এমন সময় জগদীশ ডাকল। ‘জলদি আসুন, বাঘে কামড়ানো কেস।’

আমি আমার এই ইনটার্নিশিপ-হাউসস্টাফশিপে সাপে কাটা পেশেন্ট পেয়েছি, বিছে, কুকুর, বেড়াল, এমনকী বউ কামড়ানো পেশেন্টও পেয়েছি। কিন্তু বাঘে কামড়ানো কেস কখনও পাইনি। গিয়ে দেখি, পা-জামা আর হাওয়াই শার্ট পরা একটি লোক শুয়ে আছে ট্রলিতে। ওর ডান হাত থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। কব্জির উপরে বেশ খানিকটা চামড়া ফাঁকা। মাংস বেরিয়ে পড়েছে, আর্টারিটাও ছিঁড়ে গেছে। জামা-পাজামায় রক্ত। গলায় তুলসী মালা। বৈষ্ণবদের যেমন থাকে। লোকটা কাতরাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করি, কী করে হল?

বাঘ।

বাঘে কামড়েছে?

আজ্ঞে।

বাঘ কী করে কামড়াল?

আদর করতেছিলাম…

বাঘকে আদর করতে গিয়েছিলে? কোথায়?

চিড়িয়াখানায়।

বাঘ তো খাঁচায় ছিল। তা, তুমি আদর করলে কী করে?

হাত ঢুকিয়ে।

তারপর?

খপ করে কামড়ে দিল।

ও। সঙ্গে কেউ আছে?

না।

চিড়িয়াখানা থেকে এলে কী করে?

একটা টিক্‌সি করে চিড়িয়াখানার লোক হাসপাতালে ছেড়ে দিল।

ওরা কোথায়?

ছেড়ে দিয়ে, হাসপাতালে কী বইলতে হবে শিখিয়ে দিয়ে ওরা পলায়ে গেল।

দেখি কী, হাতের উপর সবুজ সবুজ কী যেন। জিজ্ঞাসা করি এসব কী? লোকটা বলল, গ্যাঁদা পাতা চিবিয়ে থুপে দিয়েছিলাম।

দেখলাম রেডিয়াল আর্টারিটা ছিঁড়ে গেছে। মনে হল আলনার হাড় আর কারপাস-এর হাড়গুলো ভেঙে গেছে। ক্ষতস্থান ধুয়ে, কয়েকটা সেলাই দিয়ে, ব্যান্ডেজ করে এক্সরে করার জন্য লিখে দিলাম। এক্ষুনি ইলেকট্রোলাইট এবং কিছুটা রক্ত দেওয়াও দরকার।

আবার জিজ্ঞাসা করি, সঙ্গে কে আছে?

কেউ নাই।

নাম?

কানাইচন্দ্র সাফুই

বয়স?

পঁচিশ-তিরিশ হয়ে যাবে।

ঠিক বয়েসটা বলো।

মনে নাই।

কত লিখব, সাতাশ লিখি?

লিখেন যা খুশি।

ঠিকানা বলো।

খিদিরপুরের পেয়ারা বাগান।

কার্ডটা লিখলাম নিজেই। দুটো জরুরি ইনজেকশনও দিয়ে দিলাম। বললাম, বাইরে থেকে কয়েকটা ওষুধ আনাতে হবে। বাড়ির লোককে খবর দিতে হবে। লোকটা জিজ্ঞাসা করল, দোকানের ওষুধ? অনেক দাম?

তা একটু দাম তো আছেই। তিনশো টাকার কম নয়। এরপর তো আরও খরচ আছে। বাঘকে আদর করতে গিয়েছিলে কেন খামোকা? লোকটার চোখ স্থির হয়ে যায়। চোখ বুজে ফেলে। আমি ওর ভাল হাতটার কবজিতে আঙুল রাখি। পাল্‌স রেট কম মনে হয়। ব্ল্যাক আউট হয়ে গেছে। লোকটার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে বলি জগদীশকে। গায়ে ঠেলা দি। কোনও লাভ হয় না। ভাবছি ডেকাড্রন টেকাড্রন চালিয়ে দেব কি না, একটু আগেই তো দিব্যি কথা বলছিল। হঠাৎ কী হল রে বাবা? টাকা খরচার কথা শুনেই অজ্ঞান হয়ে গেল? মিনিট দুয়েক পরে চোখ খুলল কানাই সাফুই। চোখ খুলেই জড়ানো গলায় বলল, আমাকে ছেড়ে দ্যান ডাক্তারবাবু।

আমি ইতিমধ্যেই ব্লাড সুগার দেখার কিট্‌স বার করে ফেলেছি। ব্লাড সুগার নেমে গেলেও এরকম ব্ল্যাক আউট হয়। রক্তপাতও অনেক হয়েছে। সেটাও কারণ হতে পারে। লোকটার ছেড়ে দেবার আবেদন শুনে ওকে বলি, ছেড়ে দিলে এবার কাকে আদর করবে বাবা? গণ্ডারকে? গণ্ডারকে সুড়সুড়ি দেবে? ও তত তিন দিন পরে হাসবে।

লোকটা মাথা নাড়ে।

তবে কাকে!

আরতিকে আজ্ঞে।

গলাটা জড়ানো জড়ানো। পোস্ট ফিট্‌ ডেলিরিয়ামের মধ্যে, আরতি, রাধারানি রাধারানি বলে বিড়বিড় করে। আরতি শব্দটার ‘র’ ও একটু জোর দিচ্ছিল বলে শব্দটা আর্তির মতো শোনায়। আমি লোকটার কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করি, আরতি কে হয় তোমার?

রাধা হয়। সাধ্যসাধন।

এখন আর বকিয়ে কাজ নেই, আমি ভাবি। লোকটা একটু বিশ্রাম পাক, বডিতে একটু ইলেকট্রোলাইট পড়ুক, পটাশিয়াম কমে গেলে এরকম বকে। ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে। হাতের অবস্থা জন্ডিস। আজ কিছু হবার সিন নেই। কাল হাড্ডি ঘোষ, মানে আমার স্যার ড. তমাল ঘোষ আসবেন, তাকে ভাল করে দেখিয়ে নিতে হবে। কিন্তু কাল আমার অফ। পিয়ালির সঙ্গে প্রোগ্রামও ফিট করে রেখেছি নলবনে। পিয়ালি বলছিল সকালবেলাই বেরুবে। ওর নাকি সল্টলেকে রিকশা করে উলটো পালটা ঘুরতে খুব ভাল লাগে। দুপুরে ট্যাংরায় চাইনিজ খেয়ে নলবন।

ভালই খসবে কাল। হাউসস্টাফশিপে কতইবা পাই। পিয়ালি মাঝে মাঝে কনট্রিবিউট করতে চায়। আমি বলি ছেড়ে দে। আসলে পিয়ালি তো সবে এম এস সি পাশ করেছে। এখনও কিছু পায়নি। কাল সকালের প্রোগ্রামটা অফ করাতে পারলে হয়। খামোকা এক গুচ্ছ রিকশা ভাড়া। মস্তিটা তো হবে বিকেলে নলবনে। একটা ঢপ দেব। জরুরি পেশেন্ট পড়ে গেছে রে, সকালে হচ্ছে না। সত্যি বলতে কী, আজ বিকেল পর্যন্ত ডিউটি করে আবার কাল সকালে বেরুনোটা একটু স্টেরয়েড হয়ে যাচ্ছে। এমনিতে অবশ্যি কাল হাসপাতালে আসার সিন নেই। কার্ডে সব লিখে দেওয়া আছে। যা করার ওরা করবে। এনটার্নিগুলো আছে। কাল সকালে অনেকক্ষণ গড়াব। মোবাইলে ফোন করে পিয়ালিকে বলব হাসপাতালে আছি রে…। এর আগে কেসটাকে তৈরি করে নিতে হবে। আমি পিয়ালিকে ফোন করলাম।

পিলু, তোর ঘিলু নড়ে যাবে যদি একটা আজব কেস বলি। বাঘকে আদর করতে গিয়েছিল এক পাবলিক, বাঘ হাত কামড়ে হাতের হাড্ডি চানাচুর করে দিয়েছে।

ভ্যাট।

স্যোয়ার। না হলে বলছি কেন? চিড়িয়াখানার খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে বাঘকে আদর করতে গিয়েছিল।

বোঝ তবে, আদর করার কত রিস্ক।

সে তো বাঘকে আদর করতে গেলে হবেই।

তবে মানুষ যদি বাঘ হয়ে যায়, শুনেছি কামড়ে ফামড়ে দেয়। অ্যাই, তুই একটু বাঘ হ’ না মাইরি।

সামলাতে পারবি? সাঁতার জানো তো তুমি ছেলে?

হয়েই দেখ না।

আচ্ছা, বলছিস যখন, হব। আপাতত সুতনুর সঙ্গে রং খেলগে যা।

তুই এটা রং নিচ্ছিস, না ভড়ং করছিস?

আমি আবার রং নেব কেন?

নিজে কত লিবারাল প্রমাণ করতে চাস, সেই রং।

ধুর, রাখিরে, পেশেন্ট এসেছে।

আবার কানাই সাফুইয়ের কাছে গেলাম। ওর খুব ব্যথা হচ্ছে। কাতরাচ্ছে। এবার ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ার কথা। ব্যথা কমাবার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়েছে যদিও, তাতে কতটা কমবে? এবার একটা সিডেটিভ ইনজেকশন করা উচিত। এখন কোনও স্যার নেই। আমাকেই ডিসিশন নিতে হবে। ঘুম পাড়িয়ে দেবার আগে কতগুলো ব্যাপার জেনে নেওয়া উচিত। অন্তত বাড়ির লোককে তো খবর দিতে হবে। আমি কানাইয়ের কাছে যাই। বলি,

খুব ব্যথা হচ্ছে?

আজ্ঞে।

তুমি কী করো?

কীর্তন করি।

এসব করে সংসার চলে?

সংসার নাই।

তবে আরতির কথা বলছিলে যে? কে ও?

কানাই চুপ। আবার জিজ্ঞাসা করি, কিছু বলে না। স্যালাইনের ফোঁটা পড়ছে, ওদিকে তাকিয়ে থাকে।

বলো, আরতি কে তবে?

রাধা।

ওই রাধা ছাড়া তোমার আর কে আছে?

ভগবান।

মা, বাবা, ভাই, বোন…

কেউ নাই।

তোমার কীর্তন কি রোজ হয়?

না।

কীরকম হয়?

মাসে দু-চার দিন। অষ্টপ্রহর হলে বেশি।

অন্যসময় কী করো?

জন খাটি।

কোথায় জন খাটো!

গোয়ালার। গো-সেবা করি। কৃষ্ণ করতেন।

ব্বাবা। তোমার নাম কানাই ঠিকই আছে। তবে সাফুই না হয়ে যাদব হওয়া উচিত ছিল। লালুপ্রসাদ যাদবের নাম শুনেছ?

না আজ্ঞে।

পড়াশুনো?

উহু।

কীর্তনের গান পড়ো কী করে?

আমি গান করি না। ধুয়া দি। হরিবোল করি। আর বাঁশি বাজাই। কৃষ্ণযাত্রাতে কৃষ্ণ যখন বাঁশি বাজাচ্ছে দেকছেন, তখন কৃষ্ণ মিছামিছি ফুঁ মারে। আসল বাঁশিটা আমিই বাজাই।

তোমার বাঁশিটা কই!

উখানেই পড়ে আছে। লেয়া হয়নি।

কোথায় পড়ে আছে!

বাঘের খাচার সামনে।

চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলে কেন?

ঘাস কাটতে।

ঘাস কী হবে?

গোরু খাবে।

কোন গোরু!

গোয়ালার।

যেখানে কাজ করো?

হুঁ।

ওর কথা বলার ধরন দেখে বুঝতে পারছি ও বেশি কথা বলতে চাইছে না। কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারছি। তবু মনে হল কথাগুলো জানা দরকার, এতে চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হবে।

সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা বাইরের ওষুধ। একবার তো খরচাপাতির কথা তুলে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করি—

রাধা কী করে?

ময়লা ফেলে।

মানে?

মানে ডেরেন। নোংরা। নদ্দমা।

তোমার খরচাপাতি ও দিতে পারবে তো?

ও কী করে দেবে, নিজেরই ঠিকমতো খাওয়া জোটে না…

তুলসী মালার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গলার ক্যারোটিভ আর্টারিটা যতটা ফুলে উঠল বলার সময়, গলার স্বরে ততটা জোর না থাকলেও আমি ওর প্রতিবাদটা বুঝলাম। ওই আরতি ওরফে রাধার কাছ থেকে কোনও পয়সা নেওয়া যাবে না। সুতরাং বাইরের ওষুধ লেখা চলবে না। দেখতে হবে হাসপাতালে কী আছে। নইলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের কাছ থেকে পাওয়া স্যামপেল ফাইলগুলোর পাত্তা লাগাতে হবে। হাতের যা অবস্থা। যদি অপারেশন করতে হয়, আন্ডারটেকিং লাগবে। পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার দরকার হবে। আয়া রাখার পয়সা নেই, সুতরাং রাধার পাত্তা করা দরকার।

আমি বলি, তোমার রাধাকে খবর দেওয়া যাবে?

কানাই সাফুইয়ের মুখের কেমন একটা পরিবর্তন হল। আনন্দ হলে মুখের যে মাস্‌লগুলো হাসি ফোটায়, সেই মাস্‌লগুলোই কান্নার মুখ তৈরি করে। কানাই সাফুইয়ের কষ্টভরা মুখটা কেমন পালটে গেল। শুধু একটা নাম এভাবে পালটে দিতে পারে ফেসিয়াল মাস্‌ল?

বলো, রাধাকে কী ভাবে খবর দেব।

ওর উপরের ঠোঁটের উপর তলার ঠোঁটটা উঠে গেল। এর মানেটা হচ্ছে ‘কে জানে’।

রাধাকে ফোনে খবর দেওয়া যায়!

ফোন?

মানে আশেপাশে কারুর…

নাই।

তো, কোথায় থাকে? লোক পাঠিয়ে খবর দেব।

চার নম্বর গেট।

কোথায় ওটা!

খিদিরপুর। মেথরপট্টি।

এবার কানাই সাফুইয়ের রক্তে ঘুম মিশিয়ে দি। সুচের ভিতর দিয়ে।

এসব কেসে পেশেন্ট পার্টির বাড়ি আমরা টেলিফোনে খবর দেবার চেষ্টা করি। অনেক সময় অ্যাকসিডেন্ট কেস আসে, পেশেন্ট অজ্ঞান, রাস্তার পাবলিক নিয়ে এসেছে, পকেট হাতড়ে হয়তো কোনও চোতা-কাগজে কোনও ফোন নম্বর পাওয়া গেলে ফোনে যোগাযোগ করে লোকটার হদিশ নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি কোনও ঠিকানা পাওয়া যায়, পুলিশকে জানাই, পুলিশ সেই ঠিকানার সূত্র ধরে থানা থেকে লোক পাঠিয়ে বাড়িতে খবর দেয়। এটাই নিয়ম।

এদিকে আর একটা প্রশ্ন আসে মাথায়। কেসটা যদি চিড়িয়াখানাতেই হবে, চিড়িয়াখানার কোনও লোক এল না কেন? ঝামেলা এড়ানোর জন্য? পুলিশে ডায়রি হয়েছে কি? যতদূর জানা আছে চিড়িয়াখানার খাঁচার ভিতরে হাত-টাত ঢোকানো বেআইনি। এসব করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশ কেস হয়। থাকগে, ইট ইজ নট মাই হেডেক। শুধু পেশেন্ট পার্টির বাড়িতে খবর দেওয়া আমাদের ডিউটি।

থানায় জানাই। খিদিরপুর চার নম্বর গেট, মেথরপট্টির আরতি। ওরা আরতির পুরো নাম চায়, বিবাহিতা না কুমারী, স্বামী, বাবার নাম, বয়স এসবও চাইল। আমি বলি এসব জানি না। পেশেন্টকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া আছে, নর্দমা-টর্দমা পরিষ্কার করে, এমন কোনও আরতি। থানা থেকে বলে মেথরপট্টিতে সবাই নর্দমা পরিষ্কার করে, আর ওদের মধ্যে আরতি নামটা খুব কমন। আমি বলি, কানাই সাফুই, যে পেশেন্ট, সে আরতির খুব ক্লোজ। যে-আরতি কানাইকে চেনে, সে-ই হচ্ছে ঠিক আরতি। থানা থেকে জিজ্ঞাসা করে, কানাইয়ের সঙ্গে আরতির রিলেশন? আমি বলি, ফিয়াসে। তখন ফোনের ওধার থেকে—‘এ্যা?’ শুনেই বলি, লাভার লাভার। তখন হো হো হাসি শুনি।

পরদিন পিয়ালির সঙ্গে দেখাটেখা সব হল। কানাইয়ের গল্প করলাম। পিয়ালি বলল লোকটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি বললাম, ঠিক আছে, দেখাব।

অফ ডে কাটিয়ে ডিউটিতে গেছি, দেখলাম এমার্জেন্সি থেকে সরিয়ে কানাইকে বেডে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগারোটা নাগাদ ওর বেড়ে গেলাম। বেডের পাশে টুলের উপর সবুজ শাড়িতে লাল-হলুদ রং লাগা একজন মহিলা কানাইয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। মহিলাটির রং শ্যামলা, তীক্ষ্ণ নাক, রোগা হাতে কাচের চুড়ি, চুল লালচে এবং রুক্ষ। আমি বুঝি এই হল কানুর রাধা। কানাই চোখ বুজে রয়েছে। আমি এসেছি ও জানে না। কানাই ওই মহিলাকে বলছে— তুই এলি বলে হাসপাতালটা বৃন্দাবন হয়ে গেল।

একী ডায়লগ দিচ্ছে রে ভাই। একদম পোস্ট মডার্ন। ভাঙা র‍্যাক-টুল-সিলিন্ডার-বেডপ্যান-বেড়াল শোভিত কুঞ্জবনে রাধা বলছে, আর কভি ইসব করবে না, হাঁ। কানু বলে, ও-সব ছাড়। মৃণাল তুলিবে যদি লাগিবেই কাঁটা।

রাধা বলে, মিনাল কি মছলি আছে কুছি? কানাই বলে, ধুর বোকা মেয়ে। মৃণাল মানে পদ্ম, যেমন তুই।

পদ্ম দেখতে চোখ খুলল কানাই, আমায় দেখে ফেলল। কানাই লজ্জা পেয়েছে।

জিজ্ঞাসা করি, কী খবর, কেমন অবস্থা!

ও বলে বড় ব্যথা। দেখলাম বেশ ফুলেছে হাত। কাগজপত্র দেখলাম। গতকাল এক্সরে হয়েছে। রিপোর্ট আজই পেয়ে যাব। স্যার আজ দেখবেন। মনে হল গা একটু গরম।

আমার এই ওয়ার্ডে যারা শুয়ে আছে, তাঁদের অধিকাংশরই হাতে বা পায়ে প্লাস্টার। কারুর ট্রাকশন চলছে, অধিকাংশ পেশেন্টের কমন সমস্যা হল, ডাক্তারবাবু, প্লাস্টারের ভিতরে বড় চুলকায়। এক্ষেত্রে আমার কিচ্ছু করার নেই। শুধু একটা ব্যান্ডের গান হতে পারে, যদি চুলকায় প্লাস্টার ভিতরে কী হবে উপর থেকে চুলকে। চুলকের সঙ্গে মেলে না কিছু। মূলকে হতে পারে। কী হবে উপরে কেটে বিষ গাছ, যদি যত্নে ভিতরে রাখো মূলকে।

স্যার রাউন্ডে আসার আগে এক্সরেটা আসেনি। আমিই উদ্যোগী হয়ে নিয়ে এলাম। তবু সবাই বলবে সরকারি ডাক্তাররা কাজ করে না। এক্সরেটা দেখে আমি তাজ্জব। কারপাস, লুনেট এসব তো গেছেই, আলনা-টাও ফেটে গেছে। এসব কি এমনি এমনি জুড়বে? স্যার দেখে বললেন, সব দেখছি কিমা হয়ে গেছে। কানাইকে বললেন— কী বাবা, হরিণ-টরিণকে আদর করলে হত না? এক্কেবারে বাঘকে। খুব অ্যামবিশাস প্রেমিক মানুষ তুমি। মানেকা গান্ধী জানলে তোমায় মেডেল দেবে। স্যার আমায় বললেন, খুলে সেট করতে হবে।

মানে অপারেশন। কবজিতে সাতটা হাড় থাকে। ওগুলো এধার ওধার হয়ে গেছে। বাঘের দাঁতের কী জোর। অপারেশন করতে হবে বললেই তো হয় না, কিছু নিয়মকানুন আছে। ফ্রি বেডে ভরতি হলেও কিছু খরচাপাতির ব্যাপার আছে। এম এল এ বা কাউন্সিলারকে দিয়ে লিখিয়ে আনলে কিছু সুবিধে আছে। রাধা যদি ওসব করতে পারে…।

কানাইকে বলি তোমার রাধাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে। তখনই খোপ খোপ ট্রেতে দুপুরের খাবার এল। দেখি মাংস। কমই দেয়। কানাই মাংসের দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তারবাবু, আরতি বাইরেই আছে। আজ ও কাজে যাবে না, দিনভর এখানেই থাকবে। ওকে ওরা হাটিয়ে দিয়েছে। ওকে একটু ভিতরে আসতে দিন, খুব দরকার আছে।

বাইরে সেই মহিলাটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ওর চোখের দিকে তাকালাম। বেশ অ্যানিমিক, ওকে বললাম, কানাই ডাকছে। ও বলে, উরা হাটিয়ে দিয়েছে, আপনি ঘুসিয়ে দেন।

আমি ওকে ওয়ার্ডে পৌঁছে দি। বলি, একটা কার্ড দিয়ে দেব, অপারেশনের পর ওর কাছে থেকো, টাকাপয়সা জোগাড় করার কথাও বলি। কাউন্সিলারের একটা সার্টিফিকেটের কথাও বুঝিয়ে বলে দি৷

পরদিন পাশের বেডের লোকটার কাছে শুনলাম কানাই আমাকে দিয়ে আরতিকে ভিতরে ডাকিয়েছিল মাংসটুকু ওকে খাওয়াবার জন্য। শুধু তাই নয়, সকালের ডিমসেদ্ধটাও খাইয়ে দিয়েছে আরতিকে।

আজি এ বসন্ত হেম

মাংস খাইয়ে করো প্রেম।

কানাইকে জিজ্ঞাসা করি, কী হল, তুমি মেয়েটাকে সব খাইয়ে দিচ্ছ কেন? কানাই বলে, আমি যে আঁশ খাই না। বোষ্টম কিনা।

হ্যাট্‌স অফ। এক্কেবারে রিয়েল বোষ্টম। ওই জয়দেব আর রজকিনীর কথা শুনেছিলাম, এবার কানাই সাফুই আর মেথরিনী।

হাসপাতালে যে কতরকম আসে। যদি গল্প লিখতে পারতাম, তো অনেক লেখা যেত। কত প্লট। ক’দিন আগে এক জটাওলা সাধু এল, ওর গলায় মাছের কাঁটা আটকেছে। একবার এক মহিলা এল, ওর মাথার উকুন ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে বেছে দিত যে, সে নাকি সেই মহিলার গুরুদেব। একটা গল্প লেখার চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়? তা হলে তো আরও একটু মশলা জোগাড় করতে হয়।

চিড়িয়াখানায় ফোন করলাম একদিন। সোজা ডিরেক্টারকেই চাইলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, অমুক তারিখে কানাই সাফুইনামে একজন আমাদের হাসপাতালে ভরতি হয়েছে, ও বলছে ও নাকি বাঘের খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে বাঘকে আদর করছিল, তখন বাঘ ওকে বাইট করে। কেসটা একটু ডিটেল বলবেন?

ডিরেক্টার বললেন, অ্যাঁ? আমি রিপিট করি।

ডিরেক্টার অবাক হলেন। বললেন, তাই নাকি? আমি তো কিছুই জানি না। এরপর ডেপুটি ডিরেক্টারকে ধরলাম। শুনেই বলে উঠলেন, না—না—না। এসব কিছু এখানে হয়নি। বাজে কথা, বাজে কথা। কী, প্রেসকে জানিয়ে দিয়েছেন নাকি?

আমার বেশ রহস্য রহস্য লাগল। ‘বাজে কথা’-টা দু’বার বললেন কেন? একবার বললেই কি যথেষ্ট হত না? তার উপর ‘প্রেস’-কে জানানো নিয়ে মাথা ব্যথাটা কেন?

আমি বলি, প্রেসকে জানাতে যাব কেন খামোকা? আপনিই বা প্রেসের কথা তুললেন কেন?

উনি বললেন— না, মানে কাগজে একবার ছাপা হয়ে গেলেই আমাদের খুব ঝামেলা ফেস করতে হয়। কাগজওয়ালারা সব কনফার্ম না করেই ছেপে দেয় কিনা, তা ছাড়া এসব গুজবে মশলা আছে কিনা…

আমি বলি— এ জন্যই তো আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি। পেশেন্ট তো নিজেই বলছে ও বাঘের খাঁচায়…

আমার কথা শেষ হবার আগেই উনি বললেন, না—না—না, আপনাদের পেশেন্টের মাথায় তাইলে গণ্ডগোল আছে।

আমি বলি, না—না, মাথায় কেন গণ্ডগোল থাকবে। আমরা ডাক্তার কিনা, ওই ব্যাপারটা বুঝতে পারি। ঘটনাটা সত্যি।

তাই নাকি? আমার নলেজে কিন্তু নেই। নমস্কার। বুঝতে পারি চেপে যাওয়ার চেষ্টা রয়েছে। পুলিশ কেসে জড়াতে চাইছেন না হয়তো।

সন্ধেবেলা, ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গেছে, আমি কানাই সাফুইয়ের কাছে যাই। প্রথমেই চোখে পড়ল লোহার খাটের রডে আটকে আছে একটা লাল টিপ। বিছানায় কাচের চুড়ি ভাঙা দু-এক টুকরো। আমি বলি তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে। তুমি চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলে কেন?

ঘাস কাটতে।

তুমি কি মাঝে মাঝেই ঘাস কাটতে যাও?

আজ্ঞে।

ঘাস কাটার জন্য ওদের পয়সাকড়ি দাও?

না।

ওরা তোমায় কিছু দেয়?

না। গোয়ালা দেয়।

কত দেয়?

এক বস্তা বিশ টাকা।

ঘাস যে কাটতে যাও, টিকিট লাগে?

না। চিনাজানা।

কী করে চেনাজানা হল?

একদিন গড়ের মাঠে ঘাস কাটতেছিলাম, মাঠে তো ঘাস নাই বেশি, তবু কাটছি, শহরে কোথা পাব ঘাস? তখন এক বাবু দেখল। বলল— শোন, চিড়িয়াখানা যাবি? মেলা ঘাস আছে। তারপর সেই বাবু আমাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় ঢুকিয়ে দিল।

এজন্য তোমায় কোনও পয়সাকড়ি দিতে হল?

মিথ্যা বলব কেন, একটা পয়সাও দিতে হয়নি।

তারপর?

তারপর মাঝেমধ্যে সেখানে ঘাস কাটি। কাস্তে দিয়েও কাটি, মিশিন ঠেলেও কাটি। ওদের ঘাস কাটার ঠেলা মিশিন আছে। কুঁচি কুঁচি ঘাস পাওয়া যায়। যে রোজদিন মিশিন ঠেলে, সে বলে, নে, মিশিন ঠেল। আমি ঠেলি। ঠেলি মানে টানি। টানতে হয় উটা। সে বসে বসে বিড়ি খায়। তারপর কুঁচো ঘাস বস্তায় ভরে নিয়ে আসি। আর মাঝেমধ্যে একজন স্যার কাগজে টিপ সই করিয়ে লেয়।

এবার বোধহয় ব্যাপারটা একটু বোঝা গেল। ঘাস কাটার জন্য একটা বাজেট থাকে। আমাদের হাসপাতালেও আছে শুনেছি। বিনে পয়সায় ঘাস কাটিয়ে একটা ভাউচার করা হয়। উপরের মহল হয়তো এসব জানে না, কিংবা জানলেও এসব ছোটখাটো ব্যাপারে চুপচাপ থাকতে হয়। বা চুপচাপ না থেকে উপায় থাকে না। এসব হয়তো আমাকেও একদিন ফেস করতে হবে।

ঠিক আছে। ঘাস তো কাটতে যেতে। তখন কি মাঝেমধ্যেই তোমার আদর পেত? খাঁচার ভিতরে হাত ঢোঁকাতে?

সম্মতির মাথা নাড়ে কানাই।

কেউ কিছু বলত না?

না।

খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে কী করতে?

এদিক ওদিক তাকিয়ে, মাথা চুলকে ও বলল, ননা ননা।

কাকে কাকে ননা ননা করেছ?

ও চুপ।

হাতিকে?

হ্যাঁ।

হনুমানকে?

হ্যাঁ।

আরতিকে ননা ননা করোনি?

ফিক করে হেসে জিভ কাটল কানাই।

কুমিরকে ননা ননা করেছ?

ওখানে নামা যায় না।

সিংহকে?

না।

তবে বাঘকে করতে গেলে কেন?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নিচু করে ও বলল, বাঘের বড় কষ্ট।

এই ডায়লগে আমি ফিদা হয়ে যাই। তবু বলি, আচ্ছা, বাঘের বেশি কষ্ট, নাকি তোমার?

আমার আর তেমন কী কষ্ট। কত জায়গায় ঘুরি, বাঁশি বাজাই, কীর্তন করি।

তা তো ঠিকই। তোমার রাধার সঙ্গে ঘোরো টোরো…

কানাই গত শতাব্দীর সায়গলমার্কা লাজুক হাসি হেসে মাথা নিচু করল।

ওই রাধা, মানে আরতিকে জোটালে কোথায়?

ভগবান জুটিয়ে দিল।

নকশা ছাড়ো তো, কী করে তুললে বলো।

আপনি এমন কথা বলেন না, ডাক্তারবাবু…

যা জিজ্ঞাসা করছি বলো।

আমার কাছে ক’টা বাতাসা চেয়েছিল। কীর্তনে হরির লুট হয় না, সেইসময়। ও দুবলা কিনা, বাতাসা পায়নি। কাছে এসে বলল, বাচ্চার জন্য ক’টা দাও। তো, দিলাম। আবার পরের দিন…

বুঝেছি। পুরো পরকীয়া। ক’টা বাচ্চা ওর?

দুইটা।

ওর স্বামী কী করে?

জমাদারের কাজ। করপোরেশনে। কিন্তু কাজে মন নাই। বড় মদ খায়। সংসারে মন নাই। আরতির বুকের কাঠিতে পোকা ধৱল, ডাক্তার বলেছে ভাল খাওয়া-দাওয়া দিতে, ওর স্বামীর কোনও হুঁস আছে?

বুঝলাম। পড়েছে গ্যাঁড়াকলে, পিরিতি ফেবিকলে।

চলে যাচ্ছি, এমন সময় কানাই বলল, স্যার, একটা কথা শুধাই, বাঘের এঁটো খেলে শুনেছি যক্ষ্মা সারে, সত্যি?

আমি বলি, কে বলেছে?

শুনেছি।

স্যার আমাকে এক্সরে প্লেটটা দেখালেন। বললেন, দ্যাখো কীরকম ভেঙেছে।

শুধু সেটিং করলে কি হবে? ডেলিকেট ব্যাপার। স্ক্রু-টু মারতে হবে। এখানে ওসব হবে না। কোনও ভাল জায়গায়…

আমি বলি, কোথায় আর যাবে ও। এখানেই যা হয়…

হাসপাতালে একদিন পিয়ালি এসেছিল। আমি ওকে কানাই সাফুইয়ের কাছে নিয়ে গেলাম। সে-দিন আরতিও এসেছিল। আরতি একটা নতুন বাঁশি নিয়ে এসেছিল কানাইয়ের জন্য। কানাই নাকি নিয়ে আসতে বলেছিল। অনেকদিন বাঁশি বাজাতে পারেনি ও, তাই ওর অম্বল অম্বল লাগছে। হাতের আঙুলগুলো ভাল করে নাড়াতে পারছিল না কানাই, তবু তারই মধ্যে একটু সুর তুলল। এই হাসপাতালে ওয়ার্ডের ভিতর এর আগে কোনওদিন কি বাঁশি বেজেছিল?

পিয়ালি বলল তুমি ভাল হয়ে নাও, তোমার বাঁশি শুনব। আরতি ওর অ্যানিমিক চোখে জিন্‌স পরা এম এস সি পাশ পিয়ালির দিকে অবাক তাকায়। পিয়ালি বলে, ভাল হয়ে গেলে আবার যাবে নাকি চিড়িয়াখানায়?

কানাই মাথা নাড়ে। বলে, ওখানে আর যাওয়া হবে না। চিড়িয়াখানার লোক বলে দিয়েছে আর কখুনও আসবি না। এলে ঠ্যাং…

থাক। দরকার নেই, পিয়ালি হাসে। পিয়ালি ওর ব্যাগ খুলে দুটো চকলেট বার করে। একটা কানাইকে আর একটা আরতিকে দেয়। আরতি চকলেটটা ওর পলিথিন ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, বাচ্চার জন্য লিচ্ছি। কানাইও আস্তে করে ওর চকলেটটা পলিথিনে ছেড়ে দেয়। পিয়ালি আবার দুটো বের করে। মোড়ক খুলে একটা কানাইয়ের মুখে আর একটা আরতির মুখে গুঁজে দেয়। ওরা তিনজনেই হেসে ওঠে। হাসপাতালে হাঁসও থাকে না, হাসিও নয়। কিন্তু সেদিন হাসির সঙ্গে একটু বাঁশি মিশে ওয়ার্ডটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল।

অপারেশনের দিন ঠিক হল। এরকম অনেক পেশেন্টেরই হয়। নতুন রোগী এল, নতুন সব কেস। হাসপাতালে যা হয়। আমার যিনি স্যার, যাঁর আন্ডারে কানাই ভরতি ছিল, ডা. সান্যাল, চলে গেলেন চণ্ডীগড়। ওখানে বোন গ্রাফটিং অ্যান্ড ইমপ্ল্যানটেশন অফ মেটাল ডিভাইস সম্পর্কিত একটা সেমিনারে লেকচার আছে তাঁর। এক্সপার্ট কিনা। এটার উদ্যোক্তা একটি বিদেশি কোম্পানি, যাঁরা হাড়ের অপারেশনের যন্ত্রপাতি, হাড়ের স্ক্রু, পেরেক, ক্লিপ, বাইন্ডার, এসব তৈরি করে। স্যার পুরো ফ্যামিলি নিয়ে গেছেন, ওখান থেকে ওরাই কুলু-মানালি ঘুরিয়ে দেবে। এসব অফার আমিও একদিন পাব।

যাই হোক, ওইসব ঘ্যাম সেমিনারের জন্য এইসব অপারেশন-টপারেশন থেমে থাকে না। অন্য একজন করে দিলেন। আমিও ছিলাম। হাতটা খুলে দেখি সত্যি যা-তা অবস্থা। বাঘের চোয়ালের জোর আছে বটে। উনি ও টি-তে মোবাইলটা অফ রাখেননি। কানাই সাফুই মার্কা অপারেশনে মোবাইল অফ রাখার দরকার হয় না।

কানাই জিজ্ঞাসা করছে, কবে ছাড়া পাব? আমি বলি, আর দিন দশেকের মধ্যেই ছেড়ে দেব।

ইতিমধ্যে হাসপাতালের কোকিলটা টায়ার্ড হয়ে পড়েছে। রেডিয়োতে ‘মরি হায় বসন্তের দিন চলে যায়’ শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় পড়ে থাকা শিমুল-টিমুল পিষে টাটা সুমো-মারুতিরা চলে গেছে। পিয়ালিকে একদিন বললাম, স্প্রিং তো শেষ, তেমন সেলিব্রেট করা হল না। ও বলল, চল স্প্রিং চিকেন রোল খাই। স্প্রিং রোল খেতে খেতে বলল, তোর জন্য একটা গুড নিউজ। সুতনু ভিসা পেয়ে গেছে। আমি এখন ফুললি ইয়োরস্‌। এরপর থেকে এস এম এস-এ আমি লিখতাম Fooly Yours.

আবার ফুলেছে কানাইয়ের হাত। বলছে ভীষণ যন্ত্রণা। বোঝাই যাচ্ছে ভিতরে পুঁজ হয়েছে। এক্সরে হল। বুঝলাম কেলো হয়েছে। ডিটেইল আর নাই বা বললাম। এক্সরে দেখে স্যার মাথা চুলকোতে লাগলেন। আমাদেরও বকাবকি করলেন। বললেন, ঢ্যাঁড়শ বেচো গে যাও। বললেন, এখন অ্যাম্পুট ছাড়া কিছু করার নেই। কবজির উপর থেকে বাদ দিতে হবে।

এটা খুব সেফ কেস। পেশেন্ট পার্টির ঝামেলা হবে না। পেশেন্ট পার্টিই নেই। ওই তো অ্যানিমিক আরতি। জানলাম ওর একটু টি-বি-ও হয়েছিল। খিদিরপুরে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারিতে দেখায়। ওদের তো বলতে হবে। বলার আগে মুখটা গম্ভীর করলাম। কখনও কানাইবাবু বলিনি। আজ সন্ধ্যায় বললাম, কানাইবাবু, অনেক চেষ্টা করলাম, পারলাম না। আপনার ভাই, হাতটা না, কবজির উপর থেকে, ইয়ে, কেটে বাদ দিতে হবে।

বলার সময় আমার গলাটা যেন কেঁপে উঠল। কানাই কিছুক্ষণ স্তব্ধ। তারপর শূন্যতার কাছে বলল ও, তা হলে তো আর বাঁশি বাজানো হবে না, আঁ?

কথাটা শুনেই আমার মতো একটা মাকড়ার চোখ থেকে ঝপ করে দু-এক ড্রপ আনস্মার্ট জল লিক করে গেল। ওঃ, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, পান্নালাল ঘোষ, অলোকনাথ দে… কিংবা সেই সুদাম সখা তোমরা তো জানতেও পারছ না তোমাদের ওই সাধের বাঁশি…

কানাই বিছানায় শুয়ে পড়ল একটা বাতিল রবার টিউবের মতো। দেওয়ালে ঝোলানো জন্ডিস আলোয় ওর মুখ ফাঁকা স্যালাইন বোতলের মতো। কানাই ওর ডান হাতটাকে দেখতে থাকে মমতায়। আমি ব্যাপারটা একটু হালকা করার চেষ্টা করি। বলি, বলে না, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, তাই হল। এমন গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়েছে যে… অপারেশন তো করলাম। চেষ্টা তো কম হল না। এখন যা অবস্থা, পুরো হাতটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাই জন্যই একটু ইয়ে করে নিলে…

ইয়ে মানে কি কেটে ফেলা? কানাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে। আমি ওর চোখে চোখ রাখতে পারি না। কানাই ওর ডান হাতটির ফোলা ফোলা আঙুল দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে। ওর আঙুলে কোনও জোরই নেই, তবু মনে হচ্ছে ওর আঙুল বড়শির মতো আমার শরীরের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমি হাত ছাড়িয়ে নিই। কানাইয়ের বিছানার পাশে বাঁশিটা অনাথের মতো পড়ে আছে।

আরতির সেই সবুজ শাড়িটা থেকে হোলির রং ততদিনে মুছে গেছে। আরতি আমায় বলল, ডাগতারবাবু, উয়ার হাতটা লিয়ে লিবেন? আমি গলার স্টেথোটা আঁকড়ে ধরি। কোনও কথা বলতে পারি না। আরতি বলে, উ তবে কী কাম করবে? কে খিলাবে ওকে? আমি দ্রুত পাশের বেডে চলে যাই।

বাড়িতে আমার মা অনেকগুলো পুরনো শাড়ি জড়ো করেছিল বাসন নেবে বলে। আমি বেছে দুটো ভাল শাড়ি তুলে নিই। খবর কাগজে মুড়ে কানাইকে দিই। বলি, আরতিকে দিয়ো। কানাই খুশি হল। কানাইকে মাঝেমধ্যে বিস্কুটের প্যাকেট, আঙুর, এসব দিই। ও বলে, আপনার উপর শ্রীরাধার কৃপা আছে। ও বলে, হাসপাতালে তবু যা হোক ভালমন্দ পাচ্ছি। এরপর খাব কী? হাত নাই তো ভাত নাই। আমি বলি, আরতি তোমায় দেখবে না?

কানাই একটু গম্ভীর হয়। মাথা নাড়ায়। বলে, কিছু ফিরত নিবার আশা করতে নাই। তারপর বলে, আমার ভাবটা হল অহৈতুকি। মানে বুঝলেন কি না, এমনি এমনি। ম্যাঘ যেমন জল দিচ্ছে পিরথিবীর মাটিকে। মাটির কাছে ম্যাঘের কিছু পাওনা নাই। আমার হল রাধা ভাব। রাধা যেমন কিছু চায়নি কৃষ্ণের কাছে। খালি কৃষ্ণ প্রীতি লাগি বেঁচেছিল। আমি আরতিকে কৃষ্ণ ভাবি। সবার মধ্যেই রাধারানি বাস করেন। নইলে আপনি কেন বিস্কুট দেন? আঙুর?

কোন বায়োকেমিষ্ট্রি বা সাইকোপ্যাথলজিতে এসব কথা বলছে ও, আমি বুঝি না। ফিলোজফির কি কোনও প্যাথলজি হয়? কে জানে? আমি আর ওকে বকাই না। আমার মধ্যে রাধা ভাব আছে। শুনলে পিয়ালি খুব প্যাঁক দেবে। বরং আমি ব্যান্ডের গান ভাবি।

অ্যাম্পুটটা করে ফেলতে হল। নইলে গ্যাংগ্রিন হয়ে যেত। যে-আঙুলগুলো বাঁশির শরীরে ঘুরে ঘুরে সুর তুলত, সেগুলো রক্তমাখা তুলো-ব্যান্ডেজ-গজ কাপড়ের সঙ্গে প্লাস্টিকের নীল বালতিতে হসপিটাল ওয়েস্ট হিসেবে পড়ে রইল। মাছিও এসে গেল দু-একটা।

আর কয়েকদিন পরই ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ও থাকলে একটু চাপ পড়ে মনে। সবারই কি এমন হয়? নাকি আমার মধ্যে একটু রাধা ভাব বেশি বলে এরকম হয়।

এসব অপারেশনে ভালরকম অ্যানাসথেশিয়া দেওয়া হয়। স্যালাইন, অক্সিজেন সবই চলে। যখন ওর আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরছে, সে সময় আমি ছিলাম। শুনি, বিড়বিড় করছে হরি বাঘ হরি বাঘ বাঘ বাঘ হরি হরি। জিজ্ঞাসা করি, কেমন লাগছে? ও একবার তাকিয়েই চোখ বুজল। কথা বন্ধ করল। ঘণ্টা দুয়েক পর আর একবার গেলাম। দেখলাম গায়ে বেশ জ্বর আছে। আমি ওর মাথায় হাত দিলাম। কপালে হাত বুলালাম। ওর চোখের পাতা খুলল। বলল, বাঘ এসেছিল?

আমি বলি—না, আসেনি এখনও। আসবার কথা আছে নাকি?

কানাই জড়ানো গলায় বলল— যদি আসে আমার কাটা হাতটা ওকে খাইয়ে দিয়ো। দিয়ে বলবে শোধ-বোধ হয়ে গেল।

ওর ডেলিরিয়ামের মধ্যে, কী তত্ত্বকথা লুকিয়ে আছে কে জানে? আমি ওর কপালে হাত বুলোতে বুলোতে বলি কীসের শোধ-বোধ কানাই?

কানাই বলল— বাঘের অন্ন নিলাম হরি, শাস্তি দিলেন আমায় হরি।

বাঘের অন্ন কী কানাই?

বাঘের অন্ন মাংস।

বাঘের অন্ন হরণ করেছিলে?

বাঘের খাঁচায় কত খাবার। আর আরতির বুকের খাঁচায় পোকা। তখন কী করাটা উচিত? অ্যাঁ!

এইটুকু বলে কানাই পাশ ফেরার চেষ্টা করল। পারল না। আবার চুপচাপ হয়ে গেল।

ও যেদিন ছাড়া পেল, আমি ছিলাম। ও কাটা হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বলল, অনেক করলেন, কোনওদিন ভুলব না। আমিও আমার হাত কিছুটা বাড়ালাম। দুই হাতের মাঝের শূন্যতায় স্তব্ধ হয়ে রইল কথা ও কাহিনি।

কেসটা শেষ। ওই বেডে আবার নতুন রোগী, শিমুল গাছ নতুন পাতা, মোবাইলে নতুন টিউন, পিয়ালির নতুন বয়ফ্রেন্ড, নতুন পে স্কেলের দাবিতে পোস্টার, আমার হাউসস্টাফশিপ শেষ হবার মুখে। নতুন চাকরির চেষ্টা…। এগোতে হবে না আমাকে?

একদিন হাওড়া থেকে একটা ট্যাক্সিতে উঠেছি, পার্ক সার্কাসের একটা নার্সিংহোমে যাব। এক্কেবারে ফ্লাইওভার সফর। একটা ফ্লাইওভার থেকে নেমে আর একটা নতুন ফ্লাইওভারে উঠেছি, হঠাৎ দেখলাম নীচের ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে রাধাকৃষ্ণ। কৃষ্ণের মাথায় রাংতার মুকুট, গায়ে ব্যান্ডপার্টির কোট। রাধার গলায় কাগজের মালা। এই দৃশ্য ছাড়িয়ে আমার ট্যাক্সি দ্রুত উঠে যাচ্ছে ফ্লাইওভারে। ফ্লাইওভারে উঠে গেলে আর পিছনে ফেরা যায় না। আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আর একবার রাধাকৃষ্ণ দর্শনের চেষ্টা করি। তারপর পিছনের কাচের ভিতর দিয়ে ব্যাকুল তাকাই। দৃশ্যটা হারিয়ে গেছে। রাধাকৃষ্ণকে দেখি না আর। জানি, তবু আছে নীচে কোনওখানে। দেখি, কী আশ্চর্য! একটা কাটা হাত উড়ে আসছে ট্যাক্সির পিছন পিছন।

না না, ওটা হাত নয়, কাক।

শারদীয় বর্তমান, ২০০৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *