আর্সেনিক ভূমি

আর্সেনিক ভূমি

অসুস্থ অবস্থায় বাবা বলেছিলেন দেশের জন্য কিছু করিস। এখানে ‘দেশ’ বলতে ভারতবর্ষকে বোঝাতে চাননি বাবা, একটা ফেলে আসা গ্রাম বোঝাতে চেয়েছিলেন, নাম বাকিলা, বাদুড়িয়া থেকে কাঁচা রাস্তায় চার মাইল, গোমতী নামে একটা বাঁওড় আছে, যেখানে ইছামতীর প্রাচীন জল আটকে রয়েছে। ইছামতী ওর ইচ্ছামতো সরে গেছে দূরে, পুরনো খাতে জল রয়ে গেছে কিছু, নোনা জল, খাওয়া যায় না, কিন্তু পাখি আসে। বাকিলা গ্রামেই আমার জন্ম, আমার বাল্য ও কৈশোর কেটেছে। বাকিলার গোমতী বাঁওড়ে সাঁতার শিখেছি, বাকিলার কাঁচা রাস্তায় সাইকেল চালিয়েছি, বাকিলার প্রাইমারি ইস্কুলে পড়েছি, হাইস্কুল ছিল না, সুন্দরপুরে যেতে হত। আম পেড়েছি, মাছ ধরেছি, ঢাক বাজিয়েছি, কত সুন্দর সব স্মৃতি, আবার অনেক অপমানও লেগে আছে। নমঃশুদ্দুর ছিলাম কিনা।

দেশের বাড়িতে যাইনি বহুকাল। মনে হয় গত তিরিশ বছর যাইনি। আমেরিকা থেকে প্রতিবছরই একবার আসি, কোনও কোনও বছর দু’বারও। এত টাইট স্কিডিউল থাকে যে বাকিলাতে যাওয়া হয় না। দেশের বাড়ির সঙ্গে বাবারও সম্পর্ক নেই বহুকাল। তবু দেশে এলে দেশের বাড়ির কথা হয়। বাবা খুশিতে বলেন—গ্রামে, বুইলি, ইলেকটিক এয়েলো। কিংবা, শুনিচিস, রোড হয়ে গেল, পাকা রোড। বাদুড়ে থেকে বাকিলা এখন পাকা রোড। শুনচি বাসও চলবে। বাবার খুব অনন্দ হয়। যদিও আমাদের ওখানে আর জমিজমা নেই বহুদিন। আমাদের আত্মীয়দের সঙ্গে খুব একটা সুসম্পর্কও নেই। আসলে আমরা হচ্ছি চাষি। আমাদর খুব বেশি জমিজমাও ছিল না। আমার বাবা নিজে হাতে জমি চাষ করতেন। আমার দাদুর নাম ছিল ভোলানাথ মণ্ডল, অন্যের জমিতে চাষ করতেন। উনি নাকি গাছ-লতা-পাতা-শেকড়ের নানারকম ইউজ জানতেন। বাড়িতে হার্বাল মেডিসিনের চাষও করতেন। বামুনকায়েতরা না এলেও অন্যরা মানে আমাদের মতো ছোট জাতের লোকেরা দাদুর কাছে আসত। দাদু নাকি খুব একটা পয়সাকড়ি নিতেন না। কোনও ডিম্যান্ড ছিল না। জামিদারের নায়েবের অর্শ সারিয়ে দিয়ে দু’বিঘা চাকরান জমি পেয়েছিলেন। তাতেই দাদুর খ্যাতি হয়ে যায়। অনেকেই দাদুকে ভোলা কোবেরেজ বলত। সবাই এটা ঠিকভাবে নিত না। কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি কালে কালে কী হল। চামচিকেও পাখি হল, ভোলাও কবিরাজ হল। আমার বাবা ছিলেন দাদুর জ্যেষ্ঠ পুত্র। দাদু এরপর আরও জমি বাড়িয়েছিলেন, জলপড়া-টলপড়া দিতেও শুরু করেছিলেন। বাঁজা গোরু-ছাগলের গাভীন হবার জন্য, স্বামী নেয় না এমন মেয়েছেলের স্বামী বশ করার জন্য নানারকম তুকতাকও শুরু করেছিলেন। ভোলা কবরেজ আস্তে আস্তে ভোলা ওঝা হয়ে ওঠে। স্বামী নেয় না, এমন এক মহিলা আমার দ্বিতীয় ঠাকুরমা হলেন। সেই ঠাকুরমাকে আমি দেখেছি, কিন্তু আসল ঠাকুরমা যিনি আমার বাবার মা, তাকে আমি দেখিনি কোনওদিন, যে আম গাছটায় ঠাকুরমা গলায় দড়ি লাগিয়ে ঝুলে পড়েছিলেন সে গাছটা আমি দেখেছি। ওই গাছের আম আমরা খেতাম না। গাছটাকে বলা হত ফাঁসের গাছ। ঠাকুরমা গলায় দড়ি দিয়েছিল ফাল্গুন মাসে। তখন নিশ্চয়ই আমগাছে বকুল ছিল, কোকিলও ডাকছিল…

আমার বাবার নাম নব মণ্ডল। ঠিক করে বলতে গেলে নবকুমার মণ্ডল। আমার পাসপোর্টে ওই নামই আছে। বাবার ডেথ সার্টিফিকেটেও। নব মণ্ডলের ছেলে আমি রামপ্রসাদ মণ্ডল। পাসপোর্টে তাই আছে, কিন্তু আমেরিকাতে আমি র‍্যাম মেনডাল। আমি সুন্দরপুর হাইস্কুল থেকে স্কুলফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করি। র‍্যাংকও করেছিলাম। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হই। স্কলারশিপ পাই। স্কলারশিপের টাকা ছাড়াও টিউশনির টাকা ছিল। হোস্টেলে থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে দেশে পাঠাতাম। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতাম। ওখানেই শুনি লব আজকাল লবাব।

আমার দাদুর ছিল ছয় ছেলে। প্রথম পক্ষের ছেলে আমার বাবা। দ্বিতীয় পক্ষের পাঁচ কাকা। তার মধ্যে একজন বোবা। দাদুর মৃত্যুর পর জলপড়ার ব্যাপারটা একমাত্র ওই বোবা কাকুরই ক্লিক করেছিল। আই এস সি পাশ করে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভরতি হই। আমার বাবার তখন খুব খারাপ অবস্থা। আমার আরও দুটো বোন, মা মিলে চারজনের সংসার। কিন্তু ইনকাম নেই। জমি অনেক ভাগ হয়ে গেছে, যেটুকু জমি বাবা ভাগে পেল তাতে চলে না। বাইরেও কাজ পায় না। কে কাজ দেবে, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হতে চলেছে না? হোস্টেলে যখন পেটপুরে খেতাম, বোনদের কথা ভাবতাম, মায়ের কথা ভাবতাম। হোস্টেলে থাকতে হত বাইরে টিউশনি করতে পারতাম না। স্কলারশিপের টাকায় আমার হয়তো চলে যেত, কিন্তু হবু ইঞ্জিনিয়ারের বাপ-মাকে না খেতে থাকতে হত। সে এক দিন গেছে বটে। একদিন মা বলেছিলেন— তোর তো অঙ্কে খুব মাথা। ওই সব ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিয়ে সুন্দরপুরের হাই স্কুলে একটা মাস্টারি নিয়ে নে। আমি বলতাম, আর অল্প ক’টা দিন অপেক্ষা করো মা। মা বলতেন, এখনও কতগুলো দিন…। হোস্টেল পালিয়ে টিউশনি করেছি। যা পেয়েছি বাড়িতে পাঠিয়েছি।

পাশ করেই চাকরি পাই। দুর্গাপুরে। কোয়ার্টার পেয়েছিলাম। আমার ফ্যামিলিকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসি আমার কোয়ার্টারে। কিন্তু মুশকিল হল স্কলারশিপ পাবার পর। ইলিনয় ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টারস ডিগ্রি করার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম। ওদের আবার দেশে পাঠিয়ে দেব? দেশে যাবার কথা উঠতেই বোনেরা কেমন ফিউজ হয়ে যেত। ওরা তো ততদিনে ইউনিফর্ম পরে ইস্কুলে যায়, মাখনকে বাটার বলে, ডিমভাজাকে ওমলেট। আমি যা হবার হবে ভেবে একটা বাড়ি ভাড়া করলাম। না, কলকাতায় নয়, দুর্গাপুরেই। বোনেরা ওখানেই পড়ছিল কিনা। বাবা হচ্ছেন চাষি মানুষ। হাতে খুরপি নিয়ে দিনে অন্তত ঘণ্টাখানেক মাটি নিড়োতে না পারলে বাবার মন ভাল থাকে না। আমার কোয়ার্টারের পিছনে এক চিলতে জমিতে বাবা ব্যস্ত থাকতেন। ঝিঙে-ঢ্যাঁড়শের গোটা দশেক গাছ, তারপর ওই গাছগুলো উঠিয়ে দিয়ে পালং, কপি, টমেটো। একবার বললেন, একটু পাট করব ভাবচি, বীজ আনিস তো…। আমি বলি, তিন ছটাক জমিতে পাট করবে? পঞ্চাশটা ডাঁটিও তো হবেনা…। বাবা বলেছিলেন, এখন পাটের সময় কিনা। ছোটবেলা থেকে করিচি, অব্যেস হয়ে গেছে। বাবা হচ্ছেন এই টাইপের লোক। দুর্গাপুরে ড্যামের কাছাকাছি সারদাপল্লিতে একটা ছোট বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। একটু জমিও ছিল। পরে ওই বাড়িটাই কিনে নিয়েছি। বাড়িটা বাড়িয়েছি, দোতলা করেছি। এখন দোলনা সমেত ব্যালকনি, দুটো ঘরে এসি বসিয়েছি। আমরা এলে গরমে কষ্ট হয়। কিন্তু আমাদের ঘরেই থাকবে, বাবা-মার ঘরে এসি থাকবে না, সেটা কী করে হয়! চারটে ঘরে এটাচ্‌ড টয়লেট তার মধ্যে একটায় বাথটাব। ফাঁকা জমিটায় সাইপ্রাস, ইউক্যালিপটাস, আর ট্রপিকাল পাইন লাগিয়েছি। বাবার ইচ্ছেয় কদম। আমাদের দেশের বাড়িতে কদম ছিল। যতদিন পেরেছেন, বাবা খুরপি হাতে, নিড়ানি হাতে, কাস্তে হাতে বাগানে নেমেছেন। বাবা সব কিছু কিনেছিলেন। শাবল, কোদাল, সব। বোধহয় একটা হাল লাঙল কিনে রাখারও ইচ্ছে ছিল মনে মনে। এই আট কাঠা জমিতে একটা ধানখেত, একটু পাটের জমি। একটু পাট পচাবার ডোবা, একটু গোবর গাদা, একটু গোমতীর বাঁওড় ঢুকিয়ে রাখার ইচ্ছে ছিল মনে মনে।

দেশের জমিজমা সামান্য যেটুকু ছিল, সেটা ছেড়ে দিয়েই আসতে হয়েছিল। দেশে গিয়ে একবার সৎ ভাইদের বলেছিল ওই জমিজমার বিনিময়ে কিছু পয়সাকড়ি দিতে। আমি তখন ইলিনয় ইউনির্ভাসিটির ছাত্র। স্কলারশিপের টাকা বাঁচিয়ে দুর্গাপুরে কিছু কিছু পাঠাচ্ছি। অভাবেই ছিল ওরা। বাবা কিন্তু সম্পত্তি পায়নি। শুধু শুনেছে লব তোলবাব হয়েছিস আজকাল।

বাবার অভিমান হয়েছিল। দেশের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে দেশের বাড়িটা বুকে করে বসে থাকতেন। কোনও মুড়িই দেশের বাড়ির মতো নয়। কোনও জলেই দেশে বাড়ির জলের স্বাদ নেই। এখানকার শিউলি ফুলের গন্ধ দেশের বাড়ির শিউলির গন্ধের মতো কিছুতেই নয়। দেশের পুকুরের পুঁটিমাছটিও অনেক বেশি রুপোলি।

আমারও হত আমেরিকায়। মেক্‌সিকান আম খেয়ে মনে হত ওগুলোকে কেন আম বলা হচ্ছে। মাছের কোনও স্বাদই লাগত না। কিন্তু আস্তে আস্তে আমেরিকা অভ্যেস হয়ে গেল। ওদের সব কিছুই ভাল লাগতে লাগল। এখন যখন দেশে আসি, পৃথা সুটকেস ভরে নিয়ে আসে সাবান, ক্রিম, ওষুধ, কুকিজ…। আমরা বিস্কুটকে কুকি বলি, লজেন্সকে ক্যান্ডি। পেট্রোলকে এখানে অনেক সময় গ্যাস বলে ফেলি। এখানে ওরা বোঝে না। পৃথা তো কয়েক লিটার জলও নিয়ে আসে। হট করে এখানকার মিনারেল ওয়াটার খেতে ও ভয় পায়। ইশ, কী যে হল আমাদের, জল ভীতি?

বাবা যখন অসুস্থ ছিলেন, এসেছিলাম। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কলকাতার নাম্বার ওয়ান নার্সিংহোমে বাইপাস সার্জারি করিয়ে দিলাম। ভালই ছিলেন, এরপর আবার নানা উপসর্গ। তিন মাস পর এলাম আবার। কিডনি, লিভার, লাং, কিছুরই ফাংশন ভাল নয়। ডেটোরিয়েট করছেন, ডাক্তাররা বলেই দিয়েছেন রিভাইব করার চান্‌স্‌ নেই। কিন্তু আমি কতদিন থাকব? আমার তো কাজকর্ম আছে। কিন্তু মুশকিলটা এমনই, যাব, হয়তো গিয়েই খবর পাব এক্‌স্‌পায়ার্ড। তখন আবার আসতে হবে। যাতায়াতের খরচার জন্য বলছি না, জেটল্যাগও তো আছে। তা ছাড়া স্কিডিউল র‍্যাপচার হয়ে যায়। বিছানার পাশে বসে থাকলে বাবা যখন বলতেন— এটাই আমার শেষ শয্যা, আমি বলতাম, না বাবা, ভাল হয়ে যাবে, কিন্তু বলতে লজ্জা করছে, আমি মনে মনে বলতাম, যা হবার হয়ে গেলেই তো হয়। বাবার মৃত্যু কামনাই তো ওটা! বাবার পাশে বসলে বাবা মাঝে মাঝে বলতেন, দেশের জন্য কিছু করিস।

বাবার মৃত্যুর সময় আমি ছিলাম না। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আসি। বাড়িতে যা পাঠাতাম, বাবা খরচ করতেন না, জমাতেন। বাবা কোনও বিলাসিতা করতেন না। কিছুতেই সিগারেট খাননি। বিড়িই খেতেন। প্রথম প্রথম বলতেন, লজ্জা করে। পরে বলতেন, পোষায় না। মোটা ধুতি পরতেন। চালটা সরু কিনতেন। সেটাই বিলাসিতা ছিল। বাড়িতে মাঝে মধ্যে কীর্তন বসাতেন। তাতেই কিছু খরচা-টরচা হত। একটা হরিসভা আছে বেনাচিতিতে। ওখানে নাকি বেশ কিছু টাকা ডোনেট করেছিলেন। মা আমাকে বেশ কিছু কাগজপত্র বের করে দেখাল। দেখলাম বেশ কয়েক লাখ টাকা রেখে গেছেন। মায়ের সঙ্গে, আমার সঙ্গেও কয়েকটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল। আমিই বা কী করব টাকা। আমার টাকার অভাব নেই। আমার বয়েস এখন ফিপটি নাইন প্লাস। পঁয়ত্রিশ বছরের উপর স্টেট্‌স-এ আছি। পঁচিশ বছর হয়ে গেল ওদেশের সিটিজেনশিপ নিয়েছি। গত বিশ বছর ধরে রোটারিয়ান। দুর্গাপুরের রোটারি ক্লাবকে আমরা প্রচুর হেল্প করি। ওরা কী সব আই হসপিটাল করেছে, ওদের দশ হাজার ডলার আমি পারসোনালি দিয়েছি। ওরা স্পাসটিক্‌স আর হ্যানডিক্যাপডদের জন্য কিছু একটা করতে চায়, প্রতিবন্ধী বিকাশ কেন্দ্র নাম দিয়েছে। ওখানেও আমি দশ হাজার ডলার আগেই দিয়েছি।

বাবার মৃত্যুর ছ’মাস পরে আবার এলাম। মাকে নিয়ে যাব ভাবছি। মা কিছুতেই যেতে চান না। একবারই নিতে পেরেছিলাম বাবা-মাকে। ওখানে ওদের একদমই ভাল লাগেনি। খুব অস্বস্তিকর অবস্থা। সেটা অন্য গল্প। এবার একটু বেশি ছুটি নিয়ে এসেছি। মায়ের ভিসা করাব নতুন করে। বাড়ির একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বাবার নামে কিছু চ্যারিটি করব। বাবার ইচ্ছে ছিল দেশের জন্য কিছু করা। ভাবছি দেশের বাড়িতেও যাব।

এদেশের গরম সহ্য হয় না আমার। দুর্গাপুরের বাড়িতে দুটো ঘরে এসি বসানো আছে। বাবা চালাতেন না। আমি এলেই চালাই। বাকিলা যাবার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া নিতে হবে। পৃথার বাপের বাড়ি সল্টলেক-এ। ওখানে আমার এক শ্যালক আছে এখন। ওখানেই গেলাম। একটা গাড়ি ভাড়া করে দিতে বললাম। এয়ার কন্ডিশন গাড়ি। ওরা একটা ইন্ডিকা ভাড়া করে দিল। দু’লিটার মিনারেল ওয়াটার নিলাম। আশা করি হয়ে যাবে। ফ্লাস্কে একটু চা-ও দিয়ে দিল অনুরাধা, মানে শ্যালকের বউ।

বহু বছর পর বারাসতের রাস্তায়। যশোর রোড একই রকম। পুরনো গাছগুলো মনে হচ্ছে কিছু কমে গেছে। রাস্তা একই রকম ভাঙাচোরা। রাস্তার দুপাশে একই রকম টালির চালের দোকান। রোগা রোগা গোরু। বারাসত পেরুতেই ধানখেত দেখলাম। আহা ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে মনে পড়ল। কোন কবিতায় ছিল? আগের লাইনটা কী ছিল— কিছুতেই মনে পড়ছে না। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি। একটা কোরাস। গাড়ির কাচ নামিয়ে দিই। হাওয়া আসুক। ধানখেত দাপিয়ে আসা হাওয়া। কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল, কোন দেশেতে চলতে গেলে দলতে হয়রে দুর্বা কোমল…। পরের লাইনটা কী? কিছুতেই মনে পড়ছে না। কোথায় নাচে দোয়েল শ্যামা চাতক বারি যাচেরে মনে পড়ছে। শেষ লাইনে ছিল সে আমাদের বাংলাদেশ আমাদেরই বাংলারে। সব ভুলে গিয়েছি। গাছেরা নুয়ে পড়েছে। আমগাছ, কাঁঠালগাছ, আর কী সব গাছ। এইসব গাছের নাম জানতাম একদিন। পাখিদের নাম মনে নেই। আকাশে মেঘ। ওগুলো কিউমুলাস আর অল্টোকিউমুলাস। পোস্ট রেইনি-সিজন্‌ ক্লাউড্‌স্‌। শরৎ! শরৎ! অগস্ট মাস তো শরৎ। এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে। সকালবেলায়…কী যেন…কী যেন…। জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলে। আমিও পারতাম, কত জাল ফেলেছি জলে। এই জলে এখন কি আমার এলার্জি হবে? গোরুর গাড়ি দেখলাম, ছাগলচরানি বালিকা দেখলাম, আলপথ দিয়ে আলতা রাঙা পায়ে হেঁটে যাওয়া ঘোমটা পরা বউ দেখলাম। সব কিউরিও দৃশ্য। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ভালবাসি? না, এই গান গাইব না। লজ্জা করে।

এই গান গাওয়া হয় ওদেশে। বাংলাদেশিরা মাঝে মধ্যে ফাংশন-টাংশন করে, এই গানটা খুব হয়। গানটাই হয়, স্কেল মেনে, কিছুটা স্বরলিপি মেনে পৃথাও গায়। সত্তরের গোড়ায় রবীন্দ্রসংগীত না জানলে বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়েদের বিয়ে হত না। এখন যেমন কম্পিউটার। পৃথা গাইলে আমার মেয়েরা কিছু বোঝে না। বলে ডোনট্‌ ক্রাই মাম্মি ইন দি নেইম অফ মিউজিক। আকাশ থেকে জরির ঝালর ঝুলছে। সোনা রোদ। সারা আকাশ-মাঠে যেন ঢাক বাজছে। পুজোর ঢাক। আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে।

আমাদের ওই গ্রামগুলি ঢাকিদের গ্রাম। পুজোপার্বণে ওরা পিঠে ঢাক নিয়ে শহরে চলে যায়। অনেক মুসলমানও হিন্দুদের পুজোয় ঢাক বাজাত। এখনও বাজায় কি না জানি না। আমার একটা বন্ধু ছিল জয়নাল। দুটো কাঠি দিয়ে ইস্কুলের বেঞ্চিতে ঢাক বাজাত, বড় বড় কচুপাতার উপরেও ঢাক বাজাত। ও বলত, তুই যা বলবি, আমি তাই বাজিয়ে দেব।আমি বলতাম, কই মাছ কানে হাঁটে পুঁটি মাছ ফরফর, ও বাজিয়ে দিত। ওর ঢাকের ভিতর থেকে এইভাবে স্পষ্ট শুনতে পেতাম বোঁদে খাব মণ্ডা খাব খাব আলুর দম। ফেল করেছি বেশ করেছি ঢাক বাজাব বিলে। একবার মিত্তির বাড়ির দুগ্‌গা পুজোর দিনে ভটচায্যি বামুনকে ছুয়ে দিয়েছিলাম বলে মিত্তিরদের ছেলে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল। ওর বাবার সঙ্গে ঢাক বাজাতে এসেছিল জয়নাল। বাবার হাত থেকে কাঠি টেনে নিয়ে জয়নাল ঢাক বাজিয়েছিল। আমি যেন স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম জয়নাল বাজাচ্ছে— একদিন আসবে একদিন আসবে আমাদের দিন।

জয়নাল, আমার কিন্তু দিন ফিরেছে। তুই কেমন আছিস জয়নাল?

বাদুড়িয়ার মোড় এল। গ্রামে ঢোকার রাস্তাটার মোড়ে বটগাছটা এখনও আছে। ঝুরি নেমেছে। গাছের গায়ে টিনের ফলকে হাজি বদরুদ্দিন ফকিরের বৈজ্ঞানিক তাবিজের বিজ্ঞাপন, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি দ্বারা নির্বিঘ্ন গর্ভপাতের জন্য ফতিমা ক্লিনিক, আর কম্পিউটার শিক্ষার নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠান রাধামাধব কম্পিউটার একাডেমি। গাছতলায় একটা শনি মন্দির হয়েছে দেখলাম। একটা নীল বোর্ডে লাল হরফে লেখা দেখলাম সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া নলকূপের জলে বিপদসীমার বেশি আর্সেনিক আছে। ওই জল পান করিবেন না।

তার মানে এদিককার জলে আর্সেনিক আছে বুঝি? আমি আমার মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা আঁকড়ে ধরি। ইনটারনেটে দেখেছিলাম বটে, এদিককার কতগুলো ব্লক যেন অ্যাফেকটেড। ব্রাজিল, মেক্সিকো, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়াকেও এই প্রবলেম। আমাদের দেশের বাড়ির জলেও কি আর্সেনিক আছে? গভর্নমেন্ট কি সারফেস ওয়াটার ট্রিট করে পাইপলাইনে পাঠাচ্ছে? ব্রাজিল কিংবা মেক্সিকোতে যা হচ্ছে। কয়েকটা আমেরিকান কোম্পানি এই কাজ করে, আর্সেনিক ফ্রি জল বিক্রি করে পয়সা নেয়। কোম্পানিগুলো মুখিয়ে আছে কোথায় নতুন করে আর্সেনিক দেখা দিল। আমি ওরকম একটা কোম্পানির কনসালটেন্ট ছিলাম কিছুদিন। এখানকার মানুষ আর্সেনিক জলের বদলে কী জল খায়?

এই রাস্তা দিয়েই তো বাদুড়িয়া আসতাম সার্কাস দেখতে, যাত্রা দেখতে। স্কুল জীবনে বাদুড়িয়াই ছিল আমাদের অবন্তীনগর। আমি টাটা ইন্ডিকার নীল নীল কাচের ভিতর দিয়ে ফেলে আসা রাস্তাটা দেখি। রাস্তার মানুষদের দেখি। বয়স্ক মানুষ যারা, তারা আমার সময়েরই লোক। ওদের দিকে ভাল করে দেখবার আগেই গাড়ি সামনের দিকে চলে যায়। ঘণ্টা শুনলাম, ঠিক বুঝতে পারলাম ওটা আমাদের স্কুলের ঘণ্টা। মদন বাজায়। ওই তো, সুন্দরপুর কৃপাসিন্ধু আদর্শ হাইস্কুল। আমাদের এস কে হাইস্কুল। খেলার মাঠটা এখানে আছে দুটো গোলপোস্ট সমেত। ধনঞ্জয় ছিল খুব ভাল গোলকিপার। খুব লম্বা। ওকে লঘু ডাকতাম। ও নিজেকে ভাবত সনৎ শেঠ। আমাদের স্কুল জীবনে ধনরাজ ছিল, আমেদ ছিল, উমরিগড়-মানকড়-পঙ্কজ রায় ছিল, সত্য চৌধুরী, বেচু দত্ত। হীরালাল সারভেলের গান ছিল, আর হেমন্ত মুখুজ্যে। কিশোরকুমারও। আমি যখন আমেরিকা যাই, সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম পৃথিবী আমারে চায় রেখো না বেঁধে আমায়। স্কুলের মাঠে গাড়িটা থামাই।

সিমেন্ট খোদাই করা সত্যমেব জয়তের মধ্যে অনেক নোংরা জমেছে। কলতলাটার টিউবয়েলটা একটা বস্তা দিয়ে ঢেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। যে ঘণ্টা বাজায়, সে মদন নয়। হেডমাস্টারমশাই নিশ্চই অন্য কেউ, কোনও পুরনো স্যারই নেই। হেডস্যারের ঘরটা একই জায়গায় আছে, ঘরের সামনে একটা ফ্রেম লাগানো কাঠের বোর্ড, সেখানে সাদা রং-এ লেখা আমাদের প্রতিষ্ঠানের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে যাহারা:

১। রামপ্রসাদ মণ্ডল। ১৯৫৮ দ্বাদশ স্থান

২। উত্তম মিত্র। ১৯৯৮ চতুর্দশ স্থান।

এই উত্তর মিত্র নিশ্চই মিত্তির বাড়ির কেউ। যে বাড়ির দুর্গাপুজোয় বামুন ছুঁয়ে দিয়েছিলাম বলে মার খেয়েছিলাম। ও বাড়ির ছেলে চল্লিশ বছর পরেও আমাকে বিট করতে পারেনি।

স্কুলটাকে দেখি। বাথরুমের বাজে গন্ধটা আসছে। চারিদিক মলিন। দেয়াল নোংরা, সিমেন্ট উঠে গেছে। ইটও বেরিয়ে পড়েছে। স্কুলটার জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করল। এক হাজার ডলার দিয়ে দিলে বোধহয় কিছুটা সংস্কার হয়। আমি হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। হেডমাস্টারের বয়েস আমার চেয়ে কম। আমি আমার পরিচয় দিতেই হেডস্যার দাঁড়িয়ে পড়লেন। হেডস্যারই উলটে আমাকে স্যার ডাকতে লাগলেন। বলছিলেন, আমি আগেকার স্যারদের কাছ থেকে আপনার কথা শুনেছি। আপনি এই স্কুলের শুধু নয়, এ তল্লাটের গৌরব। আমিও এই স্কুলেরই ছেলে। আপনি যেবার স্কুল ছাড়লেন, আমি সেবার ক্লাস ফাইবে ভরতি হলাম। আমার বাড়ি মহেশতলা। আপনার গাঁয়ের পাশেই। আপনি এসেছেন, আমাদের কী সৌভাগ্য! এখন তো ক্লাস হচ্ছে, টিচাররা সবাই ক্লাসে। আপনি কাউন্ডলি বসুন, আমি টিচারদের ডাকি, ছাত্রদেরও মাঠে ডাকছি। আপনি ওদের কিছু বলুন। ওরা উৎসাহ পাবে। ওরা নিজের চোখে দেখবে এই অঞ্চলের মানুষ এখন আমেরিকায় গিয়ে…

আমি বলি, ওসব করার দরকার নেই। তবে আমি এখনও আমার নিজের ঘরে যাইনি। ওখানে যাচ্ছি। চল্লিশ বছর পর বাড়ি যাচ্ছি। তবে বেশিক্ষণ থাকব না। ফেরার সময় স্কুলে নামব। কথা আছে।

হেডস্যার বললেন, চল্লিশ বছর প্রথম যাচ্ছেন? ইতিমধ্যে যাননি?

আমি মাথা নাড়াই।

— খবর-টবর রাখেন তো?

আমি বলি আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। এক কাকা মারা গিয়েছিলেন খবর পেয়েছি। খুড়তুতো ভাইদের খবর জানি না। আমি আমার ভিটেটা একটু দেখব, দেখতে ইচ্ছে করছে।

—তা হলে ওসব কিছু জানেন না।

—ওসব মানে?

—গেলেই দেখতে পাবেন।

একথা বলেই চুপ করে গেলেন হেডস্যার।

কীরকম একটা সাসপেন্স গায়ে মেখে গাড়িটার দিকে এগিয়ে যাই। হেডস্যারও আমার পিছন পিছন আসেন। সঙ্গে কেরানি, পিওন, আরও তিন-চারজন মাস্টারমশাই। ওরা বললেন, আপনার অপেক্ষায় থাকব। আমি গাড়িতে ওঠার আগে বস্তা জড়ানো টিউবওয়েলটা দেখি। হেডমাস্টারকে জিজ্ঞাসা করি, ছেলেরা কী জল খায় তা হলে? হেডস্যার বলেন, কেন এই জলই খায়। কী করবে! বস্তাটায় কলের মুখের কাছে ফুটো করে নিয়েছে স্যার। বাড়ি থেকে জল আনলেও তো ওই একই ব্যাপার। এ তল্লাটে সব টিউবওয়েলের জলেই তো আর্সেনিক।

একশো থেকে পাঁচশো ফুট পর্যন্ত জলে আর্সেনিক থাকতে পারে। এমনিতে মাটির তলায় আর্সেনিকের যে পিরাইট্‌স থাকে, সেটা জলের সঙ্গে থাকতে পারে না। অক্সিজেন মিশলে আস্তে আস্তে জলে মিশতে পারে। মাটির ভিতর থেকে জল তুলে নেয়া হচ্ছে বলে মাটি একটু করে ফোঁপড়া হচ্ছে, ফলে অক্সিজেন ঢুকছে। ঢুকে আর্সেনিক পিরাইট্‌স্‌কে ওয়াটার সল্যুবল করে দিচ্ছে। এ অঞ্চলে এটাই ফেনোমেনন। মাটির গভীর পিরাইটস লেয়ার অক্সিডাইসড হতে পারে না, তাই সাত-আটশো ফিট তলার জলে আর্সেনিক কনটামিনেশন হয় না। স্কুলে কি একটা লম্বা পাইপের টিউবওয়েল বসানো যায় না? টাকার অভাব? আমি দেব। কিন্তু স্কুলে নয় হল। বাড়িতে?

গাড়ি এগোচ্ছে। আর একটু এগোলেই বাঁ দিকে গোমতী বাঁওড়টা দেখা গেল। অফুরন্ত সারফেস ওয়াটারের সোর্স। যদিও কিছুটা স্যালাইন, কিন্তু আয়নিক এক্সচেঞ্জের রেজিন দিয়ে স্যালাইনিটি নষ্ট করে দিতে কি খুব খরচ হবে? মিড্‌ল ইস্টে, আরবে সমুদ্রজল ডিসটিল করে দিচ্ছে। অথচ আমাদের এত জল। হাটতলা এল। হাটতলায় রাস্তার ধারে ঝুপড়িইগুলোর সামনে ওরা কারা দাঁড়িয়ে? দিনদুপুরে সাজগোজ করে? এরা কী রকম মেয়ে? ব্রথেল?

মিত্তিরদের বাড়ি। মিত্তিরমশাই, আমি রামু। মিলিয়নিয়ার। আমাকে মেরেছিলেন একদিন। ভটচায্যিবাড়ি। আপনাদের বাড়িতে আমার পরিবারের লোকেরা কাজ করত। আমাদের তোলা জলে আপনারা পা ধুতেন, স্নানও করতেন, পান করতেন না। ওই বাড়ির সামনেই গাড়িটা দাঁড় করালাম।

ওখান থেকে আমাদের বাড়িটা একটুখানি হেঁটে। বাঁশঝাড়ের পিছনে।

গাড়িটা থামতেই কয়েকজন ছুটে এল। ওরা সবাই তিরিশের নীচে। আমায় দেখেনি। কী চাই? কাকে চাই জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, কবিরাজবাড়ি যাব।

—কবিরাজবাড়ি মানে?

কবিরাজবাড়ি নামেই পরিচিত ছিল। আমার দাদু চিকিৎসা করতেন কিনা… আমি বলি মণ্ডলবাড়ি।

একটি ছেলে একটু বেশি এগিয়ে এল। ভ্রু কুঁচকাল। কিন্তু ওর ভ্রুতে চুল নেই বললেই হয়। বলল— ওই কবরেজবাড়ি যাবেন? কী কেস্‌? ওই বাড়ি তো ডাকাতবাড়ি। শুধু বোবা মণ্ডলের ফ্যামিলি রয়েছে, আর খাঁদু মণ্ডল। বাকিরা চলে গেছে গ্রাম ছেড়ে। কেউ কেস খেয়ে জেলে আছে। আপনি কার সঙ্গে দেখা করবেন?

আমি একটু চুপ করে যাই। আমার পরিচয়টা দেয়া উচিত হবে কি না বুঝতে পারছি না। আমি শেষ অব্দি বলি— আমি ওদের আত্মীয়, বহুদিন পরে আসছি। ছেলেটি নিজের পরিচয় দেয়। ও নাকি মেম্বার। পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধি। ওর দেড় হাজার ভোটার আছে বলতে গিয়ে ডান হাতের আঙুলগুলো মেলে গ্রাম দেখাল। তখন দেখলাম ওর আঙুলগুলোয় কালচে ছোপ। আর্সেনিকোসিস হলে যেমন হয়। ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার য়ে ভ্রুর চুল পড়ে যাচ্ছে, নখের রং কালচে হয়ে যাচ্ছে, কেন জানেন তো?

ছেলেটা মাছি তাড়াবার মতো কালচে আঙুল সমেত হাতটা বাতাসে নাড়িয়ে বলল— জানি তো। এ অঞ্চলে অনেকেরই আছে। হাটবারে হাটে গেলি বোঝতেন।

—চিকিৎসা করানো হয় না?

—হাসপাতাল যাই। ওষুধ নিয়ে আসি৷ সেই কবে ইস্তক শোনছি কলকাতার মতো পাইপে জল সাপ্লাই হবে। টাকার অভাবে হয় না। টাকা চলে যায় কলকাতার ওভারব্রিজে, কিংবা ধরেন, কবিতা উৎসবে। শুনছি কী একটা ফিল্টার বসবে। বি ডি ও সাহেব বলছিল। জানি না কবে হবে। হবে না। এখানে কিছু হবে না। এখন এটা আমাদের জীবনের অঙ্গ। এজন্যই তো এ অঞ্চলের অনেকে ডাকাত হয়ে যাচ্ছে।

—আর্সেনিকের সঙ্গে ডাকাতের সম্পর্ক কী? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি।

ওই মেম্বার নয়, অন্য একটা ছেলে, অনেক কম বয়েস, বলল—কেন ডাকাতি করব না বলেন, এমনিও মরব, অমনিও মরব। কী দাম আছে জেবনের? ওই তো একটা নিরীহ ছেলে আটতিরিশ বছরে জলের বিষে মরে গেল। ডাকাতি করতে গেলে রিস্ক রয়িচে। লোকে পিটিয়ে মেরি দিতি পারে। কিন্তু কিছু দোষ না করে শুধু তেষ্টার পানি খেয়েও মিত্যু। তা কী করব?

ছেলেটার বয়স কত? আঠারো? আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ। স্পর্ধায় নেয় মাথা তুলবার ঝুঁকি।

—জানেন, আমাদের বে-থা হয় না। কে আমাদের গাঁয়ে মেয়ে দেবে মরার জন্য? আমাদের কিছু নেই। ঘর, সংসার, জেবন; খালি ভোট আছে। একটা করে ভোট আছে।

আমার কিছু বলার ছিল না। তবে মনে মনে একটা হিসেব করে ফেলেছি— দশ থেকে পনেরো লাখ খরচ করলে হাজার দশেক লোককে বাঁওড়ের জল ট্রিটমেন্ট করে সাপ্লাই করা যেতে পারে।

পঞ্চায়েতের মেম্বার বলল—তো কী করব বলুন। যারা চুরি ডাকাতি করছে, কী বলবেন আপনি ওদের? যেসব ইয়ং ইয়ং ছেলেরা, বে-থা করতে পারছে না, ওরা যদি হাটতলায় চুমকিদের ঘরে যায়, কী বলবেন ওদের!

ছেলেটা একটু থামে। বলে, স্যার, হাটতলায় আগে ওদের একটা-দুটো ঘর ছিল। কাদের কথা বলছি বুঝছেন নিশ্চয়ই, এখন ঘর বাড়ছে। বড় নেতারা এধারে এলে বলে ছি ছি, এসব কী, উঠায়ে দাও। আমরা বলি, আগে খাবার জল দাও, পরে উঠোচ্চি। এই মেয়েছেলেগুলান কিন্তু আমাদের গাঁয়ের কেউ নয়। দূর থেকে এসেছে। এই জলই খায়। খেতে বাধ্য। জেনেশুনেই খায়।

অন্য একটি ছেলে বলে, এই পানি খেলে সঙ্গে সঙ্গে কিছু বুঝা যায় না কিনা, আস্তে আস্তে মারে। আপনি স্যার কোথায় থাকেন, কলকাতা নিশ্চয়?

আমি মাথা নাড়াই।

—ডাকাতবাড়ির কেমন আত্মীয় আপনি, কিছুই জানি না। আপনি কি পুলিশের লোক?

আমি বলি-একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয়। বহুকাল আসিনি কিনা।

—সত্যি বলতেছেন?

—হ্যাঁ, সত্যি তো।

—ওদের বাড়ির একজন নাকি আমেরিকায় থাকে। সাইনটিস্ট। বোবা ওঝার সৎ ভাই-এর ছেলে। তার কুনো পাত্তা নাই। সে এলে নিচ্চই গাঁয়ের কিছু হত। ওরা আমার সঙ্গেই থাকে। ওদের হঠাতে পারি না। মেম্বার ছেলেটি বলে—বোবা ওঝা যে, জলপড়া দিত, তার হাত নাই, দুটা হাতই নাই। কবজি থেকে কাটা।

—কেন?

—ডাকাতি করার আগে বোবা মণ্ডলের কাছ থেকে বশীকরণ ধুলো নিয়ে যেত। অনেকের বিশ্বাস ওই ধুলো ছড়িয়ে দিলে ডাকাতিতে বিঘ্ন হয় না। একবার এক ডাকাতের দল বোবা মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে গেছিল। পাঁচ বছর আগে। ও নাকি আলসে খিলেন করতে পারত। মন্তর পড়ি দিলে ডাকাতদের কেউ ধরতে পারবে না। সেবারই ধরা পড়ল৷ খুব পিটুনি খেল স্বরূপনগরে। ওই দলে ওই মণ্ডলবাড়ির গনা মণ্ডলের একটা ছেলে ছিল। বাচ্চু। মরে গেল। আর বোবা মণ্ডলের দুই হাত কবজির তলা থেকে চপার দিয়ে কেটে দিল। হাসপাতাল, তারপর জেল। এখন বাড়িতেই আছে।

ফাঁসের গাছটা দেখলাম। আর সেই কদম গাছটাও। উঠোনের তিন দিকে ভাঙাচোরা ঘর। বোবা মণ্ডলের সামনে আমি দাঁড়াই। আমি দাঁড়াতেই আমার কাকার মুখ থেকে অদ্ভুত কিছু শব্দ বেরুতে থাকে। ওটা যে উচ্ছ্বাসের শব্দ, আমি বেশ বুঝতে পারি। সমুদ্রের ঢেউ পাড়ে এসে ভেঙে পড়লে এরকম শব্দ হয়। কাকার কবজি কাটা দু’হাত সামনে তোরণদ্বারের মতো। আমি কাকার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে বাইরের কদমগাছ থেকে বুলবুলির শিস শুনি। কাকার কবজি কাটা দু’হাত আমার দু’কাধে। চোখ থেকে জলের ধারা। তারপর হাত দুটো উঠে যায়। কখনও জয়ধ্বজার মতো উপরে ওঠে, কখনও নৌকোর বৈঠার মতো দু’পাশে নড়ে। আর মুখ থেকে অনর্গল শব্দ, নানা রকমের। চল্লিশ বছরের ইতিবৃত্ত বলে যাচ্ছেন কাকা। ওঁর আর্তি, অভিমান, অভিযোগ…।

অন্যান্য ঘর থেকেও সবাই এসে গেছে। বউ, ঝি, বাচ্চারা। ওরা সবাই আমার রক্তসম্পর্কের পরিজন, অথচ ওদের কারওরই নাম জানি না। আমি ওদের কারুর কারুর দাদা কারুর জেঠু। কারুর ভাসুর, কারুর দাদু। আমি কোনও বাচ্চার চুলে বিলি কিটে দিতে যাই, ওরা মাথা সরিয়ে নেয়। কোনও বাচ্চার থুতনি ধরে আদর করতে যাই, ওরা মুখ সরিয়ে নেয়। বোবাকাকু ওদের কিছু বলেই চলেছে। আমি বাচ্চাগুলোকে দেখি। ওদের নখগুলো এখনও সাদা। হাতগুলো এখনও নরম। চোখের ভ্রগুলো সুন্দর। বউ-ঝিরা সবাই মোটামুটি ভালই রয়েছে দেখলাম। একজনকে দেখলাম মুখ ফুলেছে। চোখের পাতায় চুল নেই, হাতগুলো খরখরে। ওর চক্ষুপলকহীন চোখের সঙ্গে আমার দৃষ্টি বিনিময় হয়। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে, রামুদা আপনি এলেন? আমি নীরবে মাথা নাড়ি।

লোকটা বলল—আপনি আমাকে বিয়োগ অঙ্ক শিখিয়েছিলেন। বোবাকাকুর মুখটা তখন হাসিতে ভরে উঠল। উনি ঠিক বুঝতে পেরেছেন আমাকে। ওদেরকেও চিনতে পেরেছে। ওকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ও গত ছ’ বছর ধরে ভুগছে। হালে ওর কিডনি দুটো গ্যাছে। আর্সেনিক কিডনি খারাপ করে দেয়। আমি জানি। ওর নামই খাঁদু। আমার কোনও এক কাকার ছেলে। ও নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বছর আট-দশের ছোট হবে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে আমার চেয়েও বুড়ো। ও আমাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল। ওর হাঁটতে কষ্ট হয়। কথা বলতেও। ও জিজ্ঞাসা করল, কী মনে করে এলেন। আমি বললাম, কিছু নয়, এমনিই দেখতে এসেছি।

ওর কাছ অনেক কথাই শুনলাম। দুই কাকার ছেলেরা কী ভাবে ডাকাতদলে ভিড়ে গেল, মার খেয়ে কী করে একজন মরে গেল, দুই কাকার মৃত্যু…অনেক কথা। কিচ্ছু চাইল না। টাকা পয়সা কিছু না। বউকে বলল চা করতে। চা খেলাম। আর্সেনিক আছে, তবে একদিন খেলে কী হবে?

খাঁদুর ভাল নাম বিলাস। ও বলল দেরিতে বাচ্চা হয়েছে। একটাই বাচ্চা। বাচ্চাটা দেখলাম। সাত-আট বছর বয়েস মনে হল। ঘাড়টা হেলে রয়েছে। মুখ দিয়ে লোল গড়াচ্ছে। হাত-পা দুটো সরু সরু। স্প্যাসটিক? খাঁদু বলল, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। বলছে সারবে না। বলছে প্লাসটিক বাচ্চা।

দুর্গাপুরের একটা সংস্থাকে আমি অলরেডি অনেক টাকা ডোনেট করেছি। ওরা বলেছিল আমি যদি কোনও স্প্যাসটিক ও প্রতিবন্ধী বাচ্চাকে রেকমেন্ড করি, ওরা নিয়ে নেবে। এই বাচ্চাটাকে ওখানে দিয়ে দিতে পারি।

আমি বলি, বাচ্চাটা আমাকে দিয়ে দাও। আমি স্প্যাসটিক সোসাইটিকে দিয়ে দেব। বাচ্চাটা ভাল থাকবে। চিকিৎসারও চেষ্টা হবে যতটা পারা যায়। বাচ্চাটার ভার আমি নিচ্ছি। বলেই মনে হল এতক্ষণে দেশের জন্য বোধহয় কিছু করতে পারলাম।

খাঁদু কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল—নারে দাদা। সেটা হবে না। আমি তো আর ক’দিন পরেই মরে যাব। তারপর বউ কী নিয়ে থাকবে। বাচ্চাটাকে খাওয়ানো হাগানো শোয়ানো…। আমার বাচ্চাটা তো বড় হবে না কখনও…বউটা আরও কিছুদিন বাচ্চা নিয়ে থাকতে পারবে।

ফিরব। গাড়িতে উঠলাম। কদমগাছটা বলল, আবার এসো। পাখিটা বলল, সি ইউ এগেইন। একটা প্রজেক্ট কি দেব? দশ বারো লাখ টাকার। তিরিশ হাজার ডলার। এতগুলো টাকা এই গ্রামের জন্য, যেখানে আর আসব না কোনওদিন। নাকি ইস্কুলটায় কিছু দিয়ে দি, একটা পাথরে ডোনার হিসেবে বাবার নাম থেকে যাবে…

সুন্দরপুর স্কুলের সামনে রাস্তার ধারে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। আমার গাড়িটার জন্য অপেক্ষা করছিল বোধহয়। এত কম সময়ের মধ্যে পাতা দিয়ে তোরণ তৈরি করে ফেলেছে। স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো ছেলে। কাগজে লাল কালি দিয়ে লিখেছে স্বাগতম।

মনে হল ড্রাইভারকে বলি চলে চলো। এখানে নামব না। এতগুলো বাচ্চার সামনে কী বলব? আমি কি বলতে পারব তোমাদের বিশুদ্ধ খাবার জলের ব্যবস্থা করে দেব আমি? আমি একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, জন্মভূমির জন্য দশ বারো লাখ টাকা খরচ করতে আমার দ্বিধা হচ্ছে কেন? আমার তো অনেক টাকা। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমি বিশুদ্ধ জল পান করছি। আর্সেনিক আস্তে আস্তে মারে। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বিশুদ্ধ জল, জীবাণুহীন জল কি আমার আত্মাকে আস্তে আস্তে মেরেছে?।

ড্রাইভারকে বলি গাড়ি থামাতে। শুনি ঢাক বাজছে।

জয়নাল জয়নাল ঢাক বাজাচ্ছে। জয়নালকে কোথায় পেল ওরা?

জয়নালের সামনে দাঁড়ালাম। ভাবা যায়? এত বছর পর। জয়লালের মুখে মুচকি হাসি। জয়নাল হাতের কাঠিটা ধরেছে মুঠো করে। যে ভাবে ঢাকিরা কাঠি ধরে ওরকম নয়। জয়নালের আঙুলগুলো ফুলে রয়েছে, চামড়া খড়খড়ে, কালচে।

আমায় দেখে জয়নাল বাজনা থামায় না। ও বাজিয়ে চলে। ওর মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছি জয়নাল জিজ্ঞাসা করছে আমায়, বল তো কী বাজাচ্ছি? জয়নাল বাজিয়ে চলেছে। আমি জয়নালের দিকে তাকিয়ে আছি। ও বাজাচ্ছে। কথা বেরিয়ে আসছে ওর ঢাক থেকে। নিবিড়, গভীর কোনও কথা। কিন্তু কী কথা বুঝতে পারছি না। এতদিনে কমিউনিকেশন গ্যাপ হয়ে গেছে অনেক। আমি ওর বাজনার বোল বুঝতে পারতাম, এখন পারছি না। তবে ওর প্রত্যেকটা শব্দ আমার বুকে এসে লাগছে। ওই শব্দের মধ্যে ভীষণ আর্তি টের পাই আমি।

ছেলেরা সব দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষায়। ময়লা আঁচল বিছিয়ে বসে আছে আমার আর্সেনিক ভূমি। কেন চেয়ে আছ গো মা…

শারদ পরিচয়, ২০০১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *