পেপসি আনে গাঁয়ের আলো

পেপসি আনে গাঁয়ের আলো

মুসুর ডাল আড়াইশো।

আর?

হলুদ গুঁড়ো ধনে গুঁড়োর প্যাকিট পঞ্চাশ পঞ্চাশ দ্যান। জিরে গুঁড়ো আছে, জিরে?

হ৷ আছে।

পঞ্চাশ গ্রাম দিবেন।

ভানুবাবু গলা চড়িয়ে বলে—জিরে একশো কুড়ি টাকা কিলো।

পঁচিশ গ্রাম দেন তা হলে।

ভানুবাবু হলুদের প্যাকেট বার করতে করতে বলে, তো বউয়ের কী হল রে খ্যাংড়া। গুঁড়ো মশলা লিস্টিস যে বড়, বউ কয়েচে বুঝি, বাটনা বাটা লাইরব?

খ্যাংড়া বলল, কলির বউ…।

ভানুবাবু বলল, বললেই শুনতে হব্যে? মাথায় উঠোচ্ছিস। হলুদ জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে। ঠিক কথা বইল্লেন।

তা কী দেব? গুঁড়ো হলুদই দেব নাকি গোটা?

গুঁড়ো, জরি প্যাকিটের।

আচ্ছা, তাই নে, ভানুবাবু ভাবল—আমার কী, আমার তো ব্যবসা। খা।

এটা কী ঠাকুরমশাই? হরলিস?

ভানুবাবু একটু কটমট করে তাকিয়ে বলল—হ্যাঁ।

দাম কত?

বাহাত্তর টাকা। সেভেনটি টু। বুইজলি?

কমাটা নাই? কমা?

কমা মানে হচ্ছে দু’ নম্বরিটা।

এসব জায়গায় নকল বোরোলিন, সানলাইট, লাক্স, রকমারি পাউডার এসব পাওয়া যায়। ফেরিওয়ালারা ঝুড়ি করে নিয়ে এসে ফেরি করে। ভানুবাবুও রাখে। এখানে কমা মালের ডিমান্ড আছে। তবে ভানুবাবু ফেরিওয়ালার কাছ থেকে নিতে যাবে কেন? খোদ বাঁকুড়ার মাল রাখে। বোরোলিনের কমা মালের নাম বোরোনিল ল্যাকমের নাম লাইক মি… এরকম। এ ছাড়া হুবহু লাক্স আছে, রেকসোনা-লাইফবয়-সানলাইট আছে। প্যাকেটটা সেম সেম। এসব মালে সেন্ট খুব জব্বর হয়।

হরলিস কমাটা নাই আইজ্ঞা?

হরলিক্‌স কমা হয় না। ভানুবাবু একটু খিঁচিয়ে ওঠে। সেদিনও খেতিস আটা গোলা। এখন হরলিক্স মারাচ্ছিস—মনে মনে বলে।

হামহাম সাবান দ্যান একটা।

কমাটা? নাকি আবার অরজিনাল কোম্পানির মাল চাই?

কমাটা।

খ্যাংড়া সমস্ত বাতাস সাবানটায় মাখিয়ে বুকের ভিতরে নিয়ে বললে, দেন একটা।

ভানুর অবাক অবাক লাগে।

পেট ডিগ ডিগ খ্যাংড়া ঘুরত মাঠে বিলে৷ খ্যাংড়ার মা কাজ করত ভানুবাবুর খুড়তুতো ভাইদের বাড়িতে। ঢেঁকিতে ধান ভানত, বাসন মাজত। খ্যাংড়ার পরনে এখন জঙ্গলছাপ জামা, ফুলপ্যান্ট। হাওয়াই চটি।

এই জঙ্গলছাপ জামা আর ফুল প্যান্ট গ্যাট চুক্তি মানছি না মানব না করতে গিয়ে কলকাতার ফুটপাত থেকে নিয়ে আসা। এগুলোও কমা মাল। সেকেন্ড হ্যান্ড। পরা জামাপ্যান্ট। অনেকে বলে মরা সাহেবের।

জিনিসগুলো বড় ঠোঙায় দিতেই খ্যাংড়া বলল, পেলাস্টিকে দ্যান না কেনে, জরি পেলাস্টিক।

ভানু ওকে মালগুলো পলিথিনে পুরে দেয়। খ্যাংড়া একটা গানের সুর ভাঁজছে, ভানু চিনতে পারে। সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম।

এই গ্রামে ইলেকট্রিক লাইন এসেছে পাঁচ-ছ বছর হল। ভানুবাবু টিভি কিনেছে বছর দুই। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট চোদ্দ ইঞ্চি। এদিকে গাঁয়ের ষোলো আনা থেকেও টিভি কেনা হল গত বছর। একুশ ইঞ্চি। মনসা মন্দিরের ভিতরে টিভিটা রাত্রে মা মনসার পাশে থাকে, বাইরে ডবল তালা। সন্ধেবেলা টিভিটা তুলে এনে বাইরের চাতালে রাখা হয়। এই চাতালে সাক্ষরতার ক্লাস হত। এখন ওসব হয় না আর। বংকু, শুকনো, কাকড়া, রুপো, যারা অ-আ-ক-খ শিখেছিল, ভয় ও–কারে ট-ভোট পড়তে শিখেছিল। নাম সই করতে পারত। এখন চর্চা নাই বলে অনেকেরই খরচা হয়ে গেছে। এরকম কেসও নাকি হয়েছে, লোন নেবার সময় সই করে নিয়েছে, ফেরত দেবার সময় সই পারছে না। কোন ‘প্রহ্লাদ’ হয়তো অভ্যাস বশে হাত ঘুরিয়ে ওরকম কঠিন নামটা এখনও লিখে ফেলে, কিন্তু ভয়ে আকার ত ভাত লিখতে পারে না। ক খ গ ঘ হাঁকতে পারে, কিন্তু কোনটা ক কোনটা খ শুধোলে ভ্যাতরাবে। সাক্ষরতা স্লোগানগুলি মুখে নিয়ে ছোটরা এখন ছোটে। বাঁকুড়া জেলা দিল ডাক, নিক্ষরতা নিপাত যাক—বলে এখন জলে ঝাঁপ দেয় কিংবা শিরতোলা চালতাপাতা কিংবা আস্ত কোনও পেঁপে পাতার ডাঁটিটা নিশানের মতো উঁচিয়ে হাঁকে—সাক্ষরতার পেপসি ভাল/পেপসি আনে গাঁয়ের আলো। আসলে এটা আদতে ছিল সাক্ষরতার পিপাসা ভাল/পিপাসা আনে জ্ঞানের আলো। এই স্লোগানটা এই গাঁয়েরই অনিল স্যারের তৈরি। এই সৃষ্টির ক’দিন আগেই টিভিতে আলোর পিপাসা সিনেমাটা দেখানো হয়েছিল যারা খেলার ছলে সাক্ষরতার পেপসি ভাল চেঁচায়, তারা সত্যিকারের পেপসি দেখেনি এখনও, মনসাতলার শালখুঁটির পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বরফের খাঁজে খাঁজে ছড়িয়ে পড়া পেপসি-ফেনা দেখেছে টিভি-তে।

ভানুবাবু পৈতেটা দু’ হাতে ধরে নামা-ওঠা করিয়ে পিঠটা চুলকে নেয়। ঘাম। পলাশগুলো শুকিয়ে গেছে, শিমুল ফুল ঝরে পড়েছে ভুঁয়ে, লাল লাল নিম পাতাগুলি সবুজ হয়ে গেল, শিমের দানাগুলো শক্ত। একটা ফ্যান কিনে নিলে হয়। ঝালর লাগানো পাখাটা মৃদু মৃদু নাড়াচ্ছেন ভানুবাবু। দোকানের নাম দিয়ে একটা সাইনবোর্ড লাগাবেন নাকি? লাগালে হয়। সবকিছু স্টোর্স। বিষ্ণুপুরে দেখে এসেছে এই নামের একটা দোকান। বেশ রং চং করা সাইনবোর্ড ঝুলবে, প্রোঃ ভানুদেব চক্রবর্তী, লাওই। গ্রামটার নাম লাওই। আদিনাম লাকি লাবণ্যবতী। এখন লাওই নামটাও চলে না আর। লাউই হয়ে গেছে। রাস্তাটা পিচের হয়ে যাবার পর দুটো বাস নেমেছে লাইনে। রাজীব আর জ্যোতি। একই মালিকের দুটো বাস৷ বিষ্ণুপুর-দুর্গাপুর, ভায়া সোনামুখি, লাউই–বড়জোড়া।

বাঁকড়া ভাষায় ন–ল এর বাপ মা নেই। নাপিত এখানে লাপিত, নাতি লাতি, কিন্তু লাল হয়ে যায় নাল। লাওই হয়ে গেছে নাউই। ভানু চক্রবর্তীরা বাঁকুড়ার আদি লোক নন। আদি নিবাস পূর্বস্থলী, বর্ধমান জেলা। ভরদ্বাজ গোত্রীয় সদবিপ্র। বিষ্ণুপুরের রাজা আনিয়েছিলেন ভানুবাবুর প্রপিতামহকে।

মুড দেখি মুড, এক প্যাকেট। সাইকেল থামিয়ে একটা ছেলে চাইল। ঠোঙায় মুড়ে প্যাকেটটি দিল ভানুবাবু। ছেলেটি এ গাঁয়ে থাকে না। বোধহয় স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের লোক, নাকি বেসিক ট্রেনিং কলেজ? ওখানে আবার ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ে। ছেলেটার বে’ হয়েছে কি না কে জানে?

ভানুবাবু সবকিছু রাখে এই দোকানে। এসব জিনিসও। ভানুবাবুর বন্ধুস্থানীয়রা কেউ কেউ নেয়। নিলে এই সবই নেয়। চার আনায় তিনটির জিনিস নেয় না। বাউরি-বাগদি-সাঁওতালরা কোনওদিন চায়নি এসব। ভয়ে কিংবা লজ্জায় ল্যাদা। তবু সব জিনিসই গাবা করতেই হয়। এ থলকুলে একটিই দোকান যেখানে সবকিছু পাওয়া যায়। মুদি-মশলা, স্নো-পাউডার, খাতা কলম। সারিডন, জেলুসিল, সিগ্রেট, বই— কী যেন এক মেয়েছেলেদের লেখা বই লজ্জাও রেখেছিল পাঁচ কপি, এক কপি এখনও আছে। ডুম আছে, হিটার আছে। সবই রাখতে হয়।

জমি জায়গা আর তেমন কোথায়। ছিল, তখন চার আনায় তিনটি পাওয়া যেত না। ভানুবাবুরা সাত ভাই। ভানুবাবুর ঠাকুরদার দুই স্ত্রীর গর্ভে মোট এগারোটি ব্রাহ্মণ পুত্র। ফলে রাজার দেওয়া জমিজমা ছতিচ্ছিন্নি। যজমানিতে ঠাটমান বজায় রাখা যায় না। ফলে এই বৈশ্যগিরি। এখন যজমানির চেয়ে দোকানদারিই আসল হয়ে গেছে। তবু যজমানি ছাড়া যায়নি। দোকানদার হলেও ঠাকুরমশাই বলে সবাই। দূর গ্রামে যেতে হয় পুজো-বিয়ে-শ্রাদ্ধ শান্তিতে। একটা মোপেড কিনতে হয়েছে। দূরে গেলে বড়ছেলেকে বসানো যায় না দোকানে, পড়াশুনোর হ্যাম্ফার হয়। এলেবেনে পড়ে। ছোট শ্যালকটি এখানেই থাকে, ওই শ্যালকটিকেই দোকানে বসিয়ে যজমান বাড়ি যায় ভানুবাবু মোপেডে। দোকান বন্ধ রাখা চলে না। দোকানই লক্ষ্মী। সোনামুখীতে গিয়ে বেশ খাসা একটা সাইনবোর্ডের অর্ডার দিতে হবে। সবকিছু স্টোর্স। স্টোর্স না, ভাণ্ডার।

দুই

হিট্টার আছে বামুন মশায়, হিট্টার?

হিটার কী হবে রে খ্যাংড়া?

বুড়িটা খালি বাখনা করছে যে থাকতে লারছি বাবু, গরম ওম লাগা বাপু…

তো?

ওম দিব্যে, কাঠ কুথা? জঙ্গল কমিটি হয়েছে, আমি নিজেও তার মেম্বর বটি। তা বাদে ওম দিব্যেক কে? আমার ইস্তিরি তো দিবালিশি বেলবালা করছে আর মেঁয়াটা শুঁটি ঝুলায়ে ইস্কুলকে যাঁইছে। তাই মন করছি ঘরে একটা হিট্টার কিনে দুব।

হিটার কিনবি? আমার কী? ভানুবাবু ভাবে, আঘন মাসে চুঁটিয়ার ও সাত বউ। শালা, হঠাৎ পয়সার মুখ দেখেছে। এখন যা অবস্থা ছেলের চেয়ে নাদ লম্বা। ষাট টাকায় যা বিক্রি করে, পঁচাত্তর চাইল।

দ্যান আজ্ঞে ঠাকুরমশাই।

খুব তেল হয়েছে তোর— বলতে গিয়ে ভানুবাবু বলে— খুব দেখি শখ তোর, ভাল। আর জঙ্গল পোড়ানো তো খুব খারাপ কথা। পরিবেশ অশুদ্ধ হয়। কারবোন ছাই হয়, সবই তো কঁয়েছে রেডিয়ো টিভিতে।

হিটারের বাক্সটা বগলে নিয়ে খ্যাংড়া বাউরি হাঁটছে। ধরাটা যেন সরা। পায়ের ইস্টেপিং দ্যাখো— য্যানো থানার দারোগা— এমন ধারা পারত ক’বছর আগে? খ্যাংড়াদের গায়ে জামা উঠেছে। পায়ে হাওয়াই চটি। ঘরটা তো তেমনই আছে এখন। দাওয়া এক হাতও উঁচু নয়। খড়ের চালা। খড় কি পালটেছে? কে জানে! এই গাঁয়ের বাউরি পাড়ায় যাওয়া হয়নি বহুদিন। তবে পলাশডাঙা-ছাতিমটাড়ের বাউরি ঘরগুলোতে সব ভানুবাবুরই যজমান। পলাশডাঙা গাঁয়ে ৩৬ ঘর কায়েত, ৮ ঘর পোদ, ১২ ঘর বাউরি। বামুন নেই। ভানুবাবুর বাবার যজমান গাঁ গুলি সব সাত ভাইয়ের মধ্যে বন্দোবস্ত হয়েছে। ভানুবাবুর ভাগে ওই গাঁ দুটো পড়েছে। ওখানে বাউরিরাও কায়েত বাড়ির দেখাদেখি নিজেদের পুজো-আচ্চা শ্রাদ্ধ-শান্তি ব্রাহ্মণ ডেকে করায়। ওই গাঁয়ে বাউরি বামুন আর নেই এখন। যেমন নেই পটের গান, যেমন নেই দিশি সরপুঁটি। সবই তো জাপানি পুঁটি। বাউরি বামুন বললেই মনে হয় না জাঙিয়ার বুক পকেট? বোঝো, বাউরি, অথচ বামুন। এই যে ব্যাটা খ্যাংড়া, সে-ও কিন্তু বাউরি বামুনের বংশ। বাউরিরা নিজেদের ঘরের কাজকর্মের জন্য নিজেদের লোকই রাখে। বাউরিদের মধ্যে যাঁরা বাউরিদের পুজো-আচ্চা শ্রাদ্ধ-শান্তি করে, তারাই বাউরি বামুন। মনু বলে গিয়েছিলেন শূদ্রদের দশকর্মাদি করার দরকার নেই। তা শুদ্দুররা শুনল কই? ওরা অন্নপ্রাশন করে। অন্নপ্রাশনের নাম দিয়েছে ভূজনা। শজারুর কাঁটা চুলে ঠেকায়, পায়েস খাওয়ার, মন্ত্র বলে আবার, সব্ব মঙ্গল শিবশিব সাধি…। বলতে চাইছে সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে। পায়েস খাওয়ার সময় শিবপ্রণাম মন্ত্র কোন শাস্তরে লেখা আছে ওদের মনসাই জানে। আসলে সদবিপ্ররা শূদ্র বাড়িতে কাজ করতে যান না। মনুর নিষেধ। যে ব্রাহ্মণ এসব করে, তারা নীচে নেমে যায়। ভানু চক্রবর্তীর বাবার নাম পি এম বাগচির অনুমোদক মণ্ডলীর লিস্টে, বাঁকুড়া জেলার মধ্যে ছিল। পরে কেটে যায়। কে জানে কেন? কেউ চুকলি করেছিল? নিকুচি করেছে উপরে ওঠার। যস্মিন দেশে দ্রুম নাস্তি এড়গুপি দ্রুমায়তে। বেশ করছে। শুদ্দুররা বুঝি ইয়ে নয়?

ভানুবাবু যখন ওই গাঁয়ে যজমানি শুরু করেছিলেন, তখনও বাউরি বামুন ছিল। কাশ্যপ গোত্রের। কাশ্যপ না ছাই। আসলে কচ্ছপ। বামুনদের মতো জেতে উঠবার জন্য কচ্ছপকে কাশ্যপ বানিয়েছে। তা, ওই বাউরি বামুনটা নিজেদের কাজ করত টুকটাক। নিজেদের জাতের কেউ মারা গেলে শ্রাদ্ধকৰ্ম করত নিজেদেরই মতো করে। তরিতরকারি দিয়ে মেখে বাপ-ঠাকুরদার নাম করে শালপাতে রেখে দিত। মাংসও দিত। আরে… মাংস তো মাস্ট। পূর্বপুরুষকে ভাল জিনিসটা দেবে না? এখন তো ওরা ভানু চক্রবর্তীকে ডেকেই কাজকর্ম করায়। ভানু চক্রবর্তীর বাবাই শুরু করেছিলেন। এখন এক ঘর দু’ঘর করে সবাই ভানুবাবুকেই পুরোহিত করেছে। এটা যখন একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। ‘আমাদের ঘরের কাজকম্মে চক্রবর্তী বামুন ডাকি’— এই কথাটার মধ্যে কোথায় যেন অহংকার। পলাশডাঙার দেখাদেখি ছাতিমটাঁরের বাউরিরাও নিজেদের কাজকর্ম ভানুবাবুকে দিয়ে করাচ্ছেন। ভানুবাবু পিন্ডিতে মাংস নিবেদন নিষেধ করেছেন। বরং তিল-মধুতে আতপচালের পিণ্ড মেখে মধুবাতা ঋতায়তে মন্ত্র পড়ান। ওদের দিয়ে ওঁ শব্দের উচ্চারণ করান না, ওটা পবিত্র প্রণব। উটা লস্টো করা চলবে নাই। পিণ্ডে জল দেবার পর— অত্র পিতরো মাদয়ধ্বং মন্ত্রটন্ত্র করিয়ে ভানু চক্রবর্তী যখন পিণ্ডসূত্রটি সরিয়ে ওঁ পিণ্ডং গয়াং গচ্ছত বলে পিণ্ডটাকে ঠেলে সরিয়ে বলেন তোর বাপরে পিন্ডি গয়াকে চইলল, তখন কাঁকড়া, পিংলারা হাতজোড় করে নমস্কার করে, বেশ লাগে দু’হাত যেন নমস্কার মার্কা ডিটারজেন্ট সাবানের প্যাকেটের ছবি।

ওরা দক্ষিণা যা দেয়, এমন কিছু না। মোপেডের তেল খরচটাও ওঠে না। এখন আর এসবে পড়তা পোষায় না, তবু করতে হয়। করতে বাধ্য।

গত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে অভ্যাস পালটেছে। বিশ্বাসও। ওদের মধ্যে পুরোহিত নেই আর। পলাশডাঙার ইচ্ছাই বাউরি মরে যেতেই সব শেষ। ভানু চক্রবর্তীর বাবা কলাটা মুলোটা দক্ষিণা পেত। এখন আর এতে পোষায়? তিরিশ বছর আগে কলাটা মুলোটা, গুড় চিঁড়ের ফলার আর ঢেঁকিছাঁটা লাল চালের ছোট্ট পুঁটুলিতেই খুশি। স্বপাকে পেট ভরা ডাল ভাত একটু পোস্ত, রাত্রে টুকচাক দুধ, ব্যাস। এতেই জগদীশ্বরকে মঙ্গলময় বলতে মন করত। এখন ফ্যান লাগে, টেরিকটন লাগে, কেক লাগে, হরলিকস লাগে…। উঠোনের মাটির তুলসীমঞ্চগুলিও সব ইটের হয়ে গেল। ঠাকুরের সিংহাসনে ক্রমশ ফিট হয়ে গেল প্লাগ, ডুম জ্বলে। এখন ভদ্দলোকের বাড়িতে কাজে গেলে দক্ষিণা বাড়ানোর কথা বলা যায়। শাস্ত্র অনুযায়ী যেখানে খড়ম দান করার কথা, বলা যায়— খড়ম আজকাল পরছে কে, বাটার কিংবা অজন্তার হাউই দিওগ জোড়াক। ছাতার ক্ষেত্রেও বলা যায়— ফোলডিং বুঝ? তবে ওই জিনিসটিও দিয়ো। বাউরি–বাগদিদের কি এসব বলা যায়? গত তিরিশ বছরে ভদ্রলোকদের তুলনায় ওদের তেমন কিছু হয়নি। ওদের চ্যাংড়া-চোটারা এখন ফুলপ্যান্ট পরে বটে, জংলাছাপ জামা পরে বটে, কিন্তু কাঁসার বাসনগুলি সব অ্যালুমনিয়াম হয়ে গেছে। ওরা অমিতাভকাট, মিঠুনকাট চুল ছাঁটছে। কেবল জেতে ওঠার ইচ্ছে। তাই ওদের দেহারীর নাম করেছে বামুন। সাঁওতালদের ঘরে কেন গণেশের ছবি? গণেশ ওদের কে? এই গাঁয়ের লখাই বাউরি, যুগল বাউরি পকেটে ঝুলিয়েছে সাঁইবাবা। সাঁইবাবা কি যুগলকে পাত্তা দেবে? ওরা মনসার কাছে ধর্মরাজের কাছে মানত করলেও ভানুবাবুদের নারায়ণের কাছেও পুজো দেবে। ছেলেরা সি পি এম-এর মিছিলে যাবে আবার বিয়েতেও পণ নেবে বাবুদের দেখাদেখি। হিটার নিয়ে গেল খ্যাংড়া— বাবুদের দেখাদেখি।

খ্যাংড়ারা সব বেলমালার কাজ করে। খ্যাংড়ার পরিবারই শুধু নয়, এই লাউই গাঁয়ের বাউরি ঘরের অনেকেই এই কাজে মেতেছে আজকাল। ওন্দা, বড়জোড়া, জয়পুর, সোনামুখির মুসলমান ঘরের মেয়েরাই এই বেলমালার কাজ করত। বেলের খোলা থেকে সাইকেলের স্পোকের মতো লোহা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বেলের খোলার থেকে ছোট ছোট গোল গোল কুঁচি বার করা হয়। মাঝখানে থাকে ছোট্ট একটা ছ্যাঁদা। এর ভিতর দিয়ে সুতো গলিয়ে দিয়ে মালা হয়। ওই মালা বোষ্টম বোষ্টমিরা পরে। কণ্ঠী বদল হয়। মুসলমানদের হাতে বোনা ওই মালা হরি মন্দিরে যায়। শ্রীকৃষ্ণ পরেন, পরেন শ্রীরাধিকা। ওই মালা মঞ্জুষায় যায়। মঞ্জুশ্রীতেও যায়। যায় দক্ষিণাপনে। মালবিকা তমালিকারা পরে। একদিন দেখা গেল টিভি-তে খবর পড়ছে সংযুক্তা সিংহ, গলায় বেলমালা। শহরে গিয়ে এইসব বেলমালায় লকেট ঝোলে। রং হয়,-নকশা হয়। এই বেলমালার ডিমান্ড বেড়েছে খুব। টিভি-তে যেসব অচেনা অচেনা ঘর দেখা যায়, সেইসব ঘরে চেনা বেলমালার পর্দাও দেখা যায় ফ্যানের হাওয়ায় নড়ছে, ওগুলো কনক লক্ষ্মী-পদিদেরই করা। ছান্দারের অভিব্যক্তিতে ট্রেনিং দেওয়া হয়। কাজ শেখায়। খ্যাংড়া বাউরি ট্রেনিং পেয়ে এসেছে। ও বেশ মালা গেঁথে গণেশের শুঁড় বানাতে পারে, পর্দা পারে, বাহারের মালা পারে, একটা একটা বেলমালা কুঁচি কাগজের মধ্যে সেঁটে ছবি তৈরি করতে শিখেছে। খ্যাংড়া ওর বিদ্যা ওর পরিবার আর পাড়াকে দিয়েছে। বেলমালা–কুঁচি ছান্দারে দিয়ে এলে পয়সা পাওয়া যায়। ছান্দারে ব্যবসায়ী আসে, ফড়ে আসে, বলে শুধু বেলমালা–কুঁচি কেন, ডিজাইন করো, ডিজাইনের মালা করো, পর্দা করো, নকশা করো, আমরা নেব। খ্যাংড়াদের বাউরি ঘর এখন এইসব করে। খ্যাংড়াই কাজ শিখিয়েছে। শহরের ফড়েরা লাউই গাঁয়ে এলে খ্যাংড়ার সঙ্গেই যোগাযোগ করে। মালবিকা তমালিকাদের জন্য এসব কিনে নিয়ে যায়। খ্যাংড়া কমিশন পায়। খ্যাংড়া জংলাছাপ কেনে, হামহাম সাবান কেনে, হিটার কেনে, খ্যাংড়ার বউ গ্যাঁদা কনক লক্ষ্মী পদিদের সঙ্গে কুরচা নদীতে টুসু ভাসাতে গিয়ে গায়—

আমার টুসু গাঁথে বেলমালা গ

বারো টাকা ড্যাজন পাবে।

সিনেমার বিটিছিলার মতন গ।

চ্যাপটা পানা নজেন খাবে।

বাউরি বউরা বারো টাকা ডজন কেন, বারো টাকা শ’ও পায় না। বারো টাকা ডজন স্বপ্নে থাকে, তাই গানেও থাকে। কমা বোরোলিনের টিউবের মধ্যে ফরসা হবার স্বপ্ন থাকে যেমন, তবু যা পায় ওরা, তাতেই বছরে একটা অন্তত সিঁথির শাড়ি কিনতে পারে। সিঁথির শাড়ি মানে সিনথেটিক শাড়ি। খ্যাংড়া আগে চাষের কাজ করত। এখন আর করে না। কমিশনের টাকা আছে, তা ছাড়া মেয়েছেলেদের দিয়ে বেলমালার কুঁচি করিয়ে নিজেই করে গণেশের শুঁড় বা অন্যান্য নকশা। এইসব কাজের সময় রেডিয়ো চালিয়ে রাখে। বিবিধ ভারতী এত দূরে আসে না। একটা টেপরেকট কিনতে হবে। না হয় উঠানের অর্জুনগাছটা বেচে দেবে। হবে। একে একে সব হবে। এখন হিটারটা হল যেমন।

গলায় একটু ঢেলে এসেছিল খ্যাংড়া।

হিটারের বাক্সটা ঘরের সামনের দাওয়ায় রাখে। বাঁকুড়া বাস স্ট্যান্ডের ম্যাজিশিয়ানদের মতো বাক্সটার দড়ি খুলল। বাক্স ঘিরে খ্যাংড়ার বোন, বউ, ঠাকুমা। খ্যাংড়া অবাক করে দেবে বলে আগে কাউকে বলেনি। আস্তে আস্তে খুলল বাক্সটা।

কন্দ আলুর পানা সাদা ইটা কী বটে?

লাইনে ইলেকটিরিক দিলেই আংরা উগালবে ইটা। ইটা হিট্টার বটে হিট্টার। রান্না হবেক, সব হবেক। কেরোসিনি লাইগবেক নাই, কাঠ-কুঠা কিছো লাইগবেক নাই।

হ?

তবে বইলছি কী?

ঘরে প্লাগ পয়েন্ট ছিল না। এইটিই মাত্র বাল্ব জ্বলার ব্যবস্থা ছিল ঘরে, আর একটি মাত্র সুইচ। ক’দিন আগেই খ্যাংড়া ছান্দার থেকে মিস্ত্রি আনিয়ে একটা পয়েন্ট করে রেখেছিল। ওখানে প্লাগ ঢুকিয়ে দিতেই আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠল তার। আর খ্যাংড়ার বউ উলু দিল৷

খ্যাংড়া দাওয়ায় দাঁড়িয়ে চ্যাঁচায়, এসো, সব দেখে যাও কেনে, হিট্টার।

হিটার দেখতে জড়ো হল খ্যাংড়ার জ্ঞাতি, বউদিরা, পিসি, প্রতিবেশী।

গনগন করে লাল বেরুচ্ছে।

বেগুন পোড়াটা ইটায় খুব ডাহিডুলা হবে।

খ্যাংড়া বলল, তুমাদের সব্বায়রে চা খিয়াব। সব্বায়েরে। যাও— যে যার ঘর থেকে কাপ লিয়ে আস গা।

গলায় কেমন যেন জোর। কথাটা বলার সময় মনে হল আদেশ। হাতটা সামনের দিকে এগোনো, স্টেজে যেমন নেতাদের হাত।

বেশি চিনি দিয়ে চা হল। জড়ো হয়েছে কানাভাঙা কাপ, অ্যালুমিনিয়াম বাটি, গ্লাস। খ্যাংড়া ওর বউকে বলল, ঢাল। খলখল দুলে উঠল খ্যাংড়ার বউয়ের প্লাস্টিকের দুল। খ্যাংড়ার মনে হল ওর বউ দয়া ঢালছে কানাভাঙা কাপে। খ্যাংড়ার মনে হল, ও কীরকম ভদ্রলোক হয়ে উঠছে।

খ্যাংড়া হঠাৎ বুকে চাপড় মেরে বলল, সব আমার উপর নিভভর রাখ। তুয়াদের ভাল হবে। শোন বলি, কেউ আর কলকাতার বাবুদের বেলমালা দিবেক নাই। সব মাল আমাকে দিবে, আমি পয়সা দুব।

বেলমালাকে মাল বলল খ্যাংড়া। খুব সহজে। বেলমালার রেট বেড়েছে। ওরা জানে না এখন। খ্যাংড়া সোজাসুজি বাবুদের কাছে মাল বেচবে। সাপ্লাই বলে এটাকে, সাপ্লাই। এদের থেকে কম দামে কিনে বেশি দামে ওদের বেচবে। ওরা আরও বেশি দামে অন্য কোথাও, তারপর ওরা আরও বেশি দামে…

খ্যাংড়ার জ্ঞাতি খুড়ো আন্নন। আন্দোলনের সময় জন্ম। লবণ সত্যাগ্রহের সময় জমিদার বাড়িতে ইংরেজদের পুলিশ এসেছিল। ধরপাকড় হয়েছিল, জমিদারের ছোটছেলের মাথা ফেটে গেছিল পুলিশের লাঠিতে, সেটাই হল আন্ননের বছর। ওই সময়ে জন্ম ওর। উনিই বাউরিদের বামুন। উনিই পঞ্চায়েতের মেম্বার। বাউরিদের ৬০ ঘরের প্রতিনিধি। শ্রাদ্ধ-শান্তি-ভূজনা-দোষ কাটানো-মনসাপুজো উনিই করেন। এবার বাউরি পাড়ায় সরস্বতী পুজো হল, খ্যাংড়াই লিডার। বাউরি পাড়ায় সরস্বতী পুজো এই প্রথম সাক্ষরতা আন্দোলনের রেজাল্ট বলা যায়। আন্নন বাউরি কিন্তু সরস্বতী পুজো করল না। কিছুতেই না। ভয়ে। ভানুবাবুকেও বলেনি খ্যাংড়া। সরস্বতী পুজো এমনি-এমনিই হল। ঢাক পেটা হল। মাইক বাজানো হল। ভাসানে লাচালাচি হল, ব্যাস। আন্নন বাউরি নিষেধ করেছিল। বলেছিল সরস্বতী হল বাবুদের ঠাকুরানি— ওসবে যাসনি বাবারা। কেউ শোনেনি। শোনা যাচ্ছে আন্নন বাউরি পঞ্চায়েতের আসছে ভোটে টিকিট পাবে না। বয়স হয়েছে। আন্ননের বড়ছেলে শঙ্কর বাপের কাছে পুজো-আচ্চার কাজকর্ম শিখেছে কিছু কিছু। কিন্তু বড় বোকা বোকা ভাব। গেনু নামে যে মেয়েটার মনসার ভর হয়, তার পেটে হয়ে গেল। কার দোষ কার দোষ নিকেশের সময় শঙ্করা স্বীকার গেল। ও কী করে নেতা হবে?

চা খেয়েছ সব? আর একদিন খাওয়ার সঙ্গে কড়মড়িয়া বিস্কুট।

তিন

সাইনবোর্ড ঝকঝক। সবকিছু ভাণ্ডার।

ধূপকাঠি।

আর?

অগরু চন্ন

আর?

আর যা যা লাগে। আপনিই তো বইলবেন।

আমাদের যা যা লাগে, তোদের কি তার সব লাইগবেক তাই? আমাদের সোনা লাগে, রুপা লাগে, মধু লাগে, ঘি লাগে নতুন কাপড় লাগে, কুশ, কড়ি, সরা… তুই বরং আন্ননকে শুধিয়ে আয়।

আন্নন খুড়ো থাক। আপনিই বলেন না কেনে, দিয়া দ্যান যা যা লাগে। সোনাটা রুপাটা বাদ। ভানুবাবু ফর্দ করতে থাকেন। কাপড় আর কড়ি এ দোকানে নাই। বৈঠকখানার ঘি-টা নাই। ডেয়ারি ঘি, খরচটা বেশি।

ডালডা দেন কেনে।

তা কি হয়। গব্য ঘৃত লাগে। খ্যাংড়া মাথা নাড়ায়। গ-য়ে গোরু। ঘ-এ ঘি।

অপঘাত মৃত্যু। লয়? প্রায়চিত্তির, টুয়া প্রায়শ্চিত্য করিস। করতে হয়।

বলেন, আপনিই করে দ্যান কী করতে হব্যেক। মায়ের কাজটা ভাল করে করব।

ভানুবাবু একটু মাথা চুলকে নিল। বলল, কী করে কী হল ব্যাপারটা টুকচু বল কেনে, শুনি। তোর মা’র মৃত্যু কথা শুনা অবধি মনে অহিবিকলি চইলছে।

কী আর বইলব। যা হইল তার কিছছা থলকুল নাই। কত কইরে নামতা পড়া কইরলাম তুমি এই জিনিসটায় মোটে হাত দিওনি। যা দরকার মুখফুটে হাঁকবে খালি।

চা দরকার, গরম জল দরকার— বউ দিব্যেক। আর বউটাও বলিহারি। কলির বউয়ের গতর লড়ে না। হুক করা ইলেকটিরি, য্যাত পারছে জ্বালছে। হিট্টারে মাছ, ভাত, সব পাক কইরছে। রেতে…।

এইভাবে খ্যাংড়া জানাতে লাগল ওর ঘরে চা হয়, চায়ে দুধ থাকে, মাছ হয়, রাত্রে রান্না হয়…।

এসব ছাড়াও ভানুবাবু যে গল্পটি পেলেন এবং যে গল্পটি শুনতে শুনতে জিভ এবং টাকরার ঘর্ষণে চুক চুক শব্দ করছিলেন তা হল খ্যাংড়ার মা হিটার অফ হয়ে যাবার পর গোবর ন্যাকড়া দিয়ে হিটারটা মুছত।

হিটার হলেও ওটা উনুন বটে তো। রান্না হল শকড়ি। বাউরি বাগদিদের আবার শকড়ি কী? কিন্তু খ্যাংড়ার মা বামুনবাড়ি কাজ করেছে, দেখেছে রান্নার পর উনুন লেপা পোছা হয়। খ্যাংড়ারাও বাউরি বামুনের বংশ। লেপা পোছা হবে না?

তো কাল রাতে রান্নাবান্নার পর খ্যাংড়ার বউ বাসন ধুচ্ছিল বাইরে। খ্যাংড়ার মা তখন গোবর ন্যাকড়ায় লেপাপোছা করতে গিয়েছিল হিটার। জল ন্যাকড়া হিটারে ছোঁয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার। কেমন একটা শব্দ, লাইট নিভে গেল। খ্যাংড়ার বউ দৌড়ে এসে ঘরে শুধু গোঙানি শুনল। কুপি জ্বালিয়ে দেখল কালিবর্ণ। খ্যাংড়া তখন বড়জোড়া, মিটিং। ব্লকে একজিবিশন হবে।

ভানুবাবু বলল, বুঝলি, আসলে হিটারটা অফই হয়নি। ডালটাল উপচে পড়ে ফিলামেন্টে কারেন্ট আসছিল না। কিন্তু বডি কারেন্ট হয়ে গেছিল। কেন হিটারে করতে যাস। সবার সব পোষায়?

কুকুরের পেটে ঘি হজম না হবার প্রবাদ বাক্যটা বলতে গিয়েও থেমে যায়।

খ্যাংড়া বলে আপনার উটা কমা মাল ছিল কিনা, কী আর কইরব।

ভানুবাবু লক্ষ্য করল কী আর কইরবর পর আইজ্ঞা শব্দটা থাকার কথা ছিল। কিন্তু নেই। আর হিটারকে বলল মাল। হিটারটা সত্যিই কমা মাল ছিল। ষাট টাকার জিনিস পঁচাত্তরে বিক্রি করেছে। ভিতরে ভিতরে একটু খচখচ করছে ভানুবাবুর। কিন্তু এটা তো ব্যবসা। এটাও ধর্ম। ব্যবসার ধর্ম এটা। বাজার। দামে না পোষালে খ্যাংড়ার উচিত ছিল না এটা নেওয়ার। নিয়তি যদি এভাবেই আসে কী করা যাবে।

ভানুবাবুর দোকানের সামনে, সবকিছু ভাণ্ডারের সামনে খাটিয়াটা থামল।

খ্যাংড়া বলল— এক টাকার খই দ্যান ঠাকুরমশাই। তারপর বলল, একটু মন্তর পড়ে গঙ্গা জল ছিটা করে দ্যান। আসল বামুনের মন্তরে মায়ের সগ্নবাস হব্যেক।

তখন ভানুবাবু–রাঢ়ী ব্রাহ্মণ, ভরদ্বাজ গোত্র, রাজ ব্রাহ্মণ, ভানু চক্রবর্তী হয়ে ভাবলেন এ গাঁয়ে বাউরি ঘরে কাজ করবেন কি না। কমা ব্রাহ্মণ হয়ে যাবেন না তো। খ্যাংড়া বলল, খাটিয়া নামাও। ভানু চক্রবর্তীর সামনে, তখন খ্যাংড়া বাউরি একা দাড়িয়ে নেই, বেলমালার কাজ করা বাউরির বসত, আলো উজলিছে ওদের ঘরে। গুঁড়ো মশলা কেনা, কমা বোরোলিন কেনা বাউরি বাজার।

ভানুবাবু দেখলেন, খ্যাংড়ার মায়ের শুকনো শরীর কালো, কালো, ব্ল্যাক হয়ে গেছে ইলেকট্রিক লেগে। দেহ নয়, বডি। ভানুবাবু জল ছেটালেন ও গয়া গঙ্গা পুষ্করানি চ…

খ্যাংড়া বলল— মায়ের আসল কাজটা কিন্তু আপনাকেই কইরতে হব্যেক, কুন নিষেধ শুনব নাই।

আন্নন বাউরি লাঠি হাতে একা একা হেঁটে যাচ্ছে। ওর অনেক পিছনে মাটিতে, ঘাসে, কচুপাতায় লাগছে মুঠো থেকে পড়া কুচি কুচি ভদ্রলোক ভদ্রলোক সাদা সাদা খই।

শারদীয় অমৃতলোক, ১৯৯৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *