1 of 2

রাজসিংহ – ৬.৮

অষ্টম পরিচ্ছেদ : সব সমান

রঙ‍মহালের সকল সংবাদই আসে–সকল সংবাদই জেব-উন্নিসা নিয়া থাকেন–তিনি নায়েবে বাদশাহ। মবারকের বধসংবাদও আসিয়া পৌঁছিল।
জেব-উন্নিসা প্রত্যাশা করিয়াছিলেন যে, তিনি এই সংবাদে অত্যন্ত সুখী হইবেন। সহসা দেখিলেন যে, ঠিক বিপরীত ঘটিল। সংবাদ আসিবামাত্র সহসা তাঁহার চক্ষু জলে ভরিয়া বাহিয়া ধারায় ধারায় সে জল গড়াইতে লাগিল। শেষ দেখিলেন, চীৎকার করিয়া কাঁদিতে ইচ্ছা করিতেছে। জেব-উন্নিসা দ্বার রুদ্ধ করিয়া হস্তিদন্তনির্‍মিত রত্নখচিত পালঙ্কে শয়ন করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
কৈ শাহজাদী? হস্তিদন্তনির্‍মিত রত্নদণ্ডভূষিত পালঙ্কে শুইলেও ত চক্ষুর জল থামে না! তুমি যদি বাহিরে গিয়া দিল্লীর সহরতলীর ভগ্ন কুটীরমধ্যে প্রবেশ করিতে, তাহা হইলে দেখিতে পাইতে, কত লোক ছেঁড়া কাঁথায় শুইয়া কত হাসিতেছে। তোমার মত কান্না কেহই কাঁদিতেছে না।
জেব-উন্নিসার প্রথমে কিছু বোধ হইল যে, তাঁহার আপনার সুখের হানি তিনি আপনিই করিয়াছেন। ক্রমশ: বোধ হইল যে, সব সমান নহে–বাদশাহজাদীরাও ভালবাসে; জানিয়া হউক, না জানিয়া হউক, নারীদেহ ধারণ করিলেই ঐ পাপকে হৃদয়ে আশ্রয় দিতে হয়। জেব-উন্নিসা আপনা আপনি জিজ্ঞাসা করিল, “আমি তাকে এত ভালবাসিতাম, সে কথা এত দিন জানিতে পার নাই কেন?” কেহ তাহাকে বলিয়া দিল না যে, ঐশ্বর্‍যমদে তুমি অন্ধ হইয়াছিলে, রূপের গর্‍বে তুমি অন্ধ হইয়াছিলে, ইন্দ্রিয়ের দাসী হইয়া তুমি ভালবাসাকে চিনিতে পার নাই। তোমার উপযুক্ত দণ্ড হইয়াছে–কেহ যেন তোমাকে দয়া না করে।
কেহ বলিয়া বলিয়া না দিক –তার নিজের মনে এ সকল কথা কিছু কিছু আপনা আপনি উদয় হইতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে এমনও মনে হইল, ধর্‍মাধর্‍ম বুঝি আছে। যদি থাকে, তবে বড় অধর্‍মের কাজ হইয়াছে। শেষ ভয় হইল, ধর্‍মাধর্‍মের পুরস্কার দণ্ড যদি থাকে? তাহার পাপের যদি দণ্ডদাতা কেউ থাকেন? তিনি বাদশাহজাদী বলিয়া জেব-উন্নিসাকে মার্‍জনা করিবেন কি? সম্ভব নয়। জেব-উন্নিসার মনে ভয়ও হইল।
দু:খে, শোকে, ভয়ে জেব-উন্নিসা দ্বার খুলিয়া তাহার বিশ্বাসী খোজা আসিরদ্দীনকে ডাকাইল। সে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “সাপের বিষে মানুষ মরিলে তার কি চিকিৎসা আছে?”
আসিরদ্দীন বলিল, “মরিলে আবার চিকিৎসা কি?”
জেব। কখনও শুন নাই?
আসি। হাতেম মাল এমনই একটা চিকিৎসা করিয়াছিল, কাণে শুনিয়াচি চক্ষে দেখি নাই।
জেব-উন্নিসা একটু হাঁপ ছাড়িল। বলিল, “হাতেম মালকে চেন?”
আ। চিনি।
জে। সে কোথায় থাকে?
আ। দিল্লীতে থাকে।
জে। বাড়ী চেন?
আ। চিনি।
জে। এখন সেখানে যাইতে পারিবে?
আ। হুকুম দিলেই যাইতে পারি।
জে। আজ মবারক আলি (একটু গলা কাঁপিল) সর্পাঘাতে মরিয়াছে জান?
আ। জানি।
জে। কোথায় তাহাকে গোর দিয়াছে, জান?
আ। দেখি নাই, কিন্তু যে গোরস্থানে গোর দিবে, তাহা আমি জানি। নূতন গোর, ঠিকানা করিয়া লইতে পারিব।
জে। আমি তোমাকে দুই শত আশরফি দিতেছি। একশ হাতেম মালকে দিবে, একশ আপনি লইবে। মবারক আলির গোর খুঁড়িয়া মোরদা বাহির করিয়া, চিকিৎসা করিয়া তাহাকে বাঁচাইবে। যদি বাঁচে, তাহাকে আমার কাছে লইয়া আসিবে। এখনই যাও।
আশরফি লইয়া খোজা আসিরদ্দীন তখনই বিদায় লইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *