ষষ্ঠ দৃশ্য
[রমেশের বাটীর অন্তঃপুর। তাহার শয়নকক্ষে বসিয়া রমেশ গভীর রাত্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করিতেছিল। অকস্মাৎ নেপথ্যে কাহার ক্রন্দনের শব্দ শুনা গেল, এবং পরক্ষণে ভৈরব আচার্য গোপাল সরকারের গলা জড়াইয়া মড়াকান্না কাঁদিতে কাঁদিতে প্রবেশ করিল। রমেশ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল]
ভৈরব। (সরোদনে) বাবু, আমি ধনেপ্রাণে মারা গেছি।
রমেশ। ব্যাপার কি সরকারমশাই?
গোপাল সরকার। কাজ সেরে শুতে যাচ্ছিলেম বাবু, হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এসে আচায্যিমশাই গলা জড়িয়ে ধরেছে। গলাও ছাড়ে না, কান্নাও থামায় না।
রমেশ। কি হলো আচায্যিমশাই?
ভৈরব। বাবু গো, আমি এক্কেবারে গেছি! ছেলেপুলের হাত ধরে এবার গাছতলায় শুতে হবে।
রমেশ। গাছতলায় কেন? ঘর কি হলো?
ভৈরব। আর নেই,—নিলেম করে নিয়েচে।
রমেশ। এই ত সকালেও ছিল। এরই মধ্যে কে নিলেম করে নিলে?
ভৈরব। কে এক সনৎ মুখুয্যে বাবু, গোবিন্দ গাঙ্গুলীর খুড়শ্বশুর। (ক্রন্দন)
গোপাল। আরে, আমার গলা ছাড়ুন না। বাবুকে সমস্ত বুঝিয়ে বলুন,—কে নিলে, কেন নিলে, খামোকা আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে কি হবে? ছাড়ুন।
ভৈরব। (গলা ছাড়িয়া) এক হাজার সাতাশ টাকা পাঁচ আনা ছ’ পাই,—বাবু গো, ধনেপ্রাণে গেলাম।
গোপাল। টাকা কর্জ নিয়েছিলেন?
ভৈরব। না, এক পয়সা না সরকারমশাই। দেনা মিথ্যে, খত মিথ্যে―কবে নালিশ হলো, কবে সমন হলো, কবে ডিক্রি হয়ে বাড়ি-ঘরদোর নিলাম হয়ে গেল―কিছুই জানিনে বাবু। কাল কানাঘুষো খবর পেয়ে সদরে গিয়ে টের পেলাম—ছেলেপুলে নিয়ে আমাকে গাছতলায় শুতে হবে। এক হাজার সাতাশ টাকা পাঁচ আনা ছ’ পাই—
রমেশ। এমন ভয়ানক কথা ত কখনো শুনিনি সরকারমশাই?
গোপাল। পাড়াগাঁয়ে এমন অনেক হয় বাবু। যারা গরীব, বড়লোকের কোপে পড়ে তারা সত্যিই ধনেপ্রাণে মারা যায়, এ সমস্তই বেণীবাবু আর গাঙ্গুলীমশায়ের কাজ―আচায্যিমশাই বরাবর আমাদের দিকে আছেন বলেই তাঁর এই বিপদ।
ভৈরব। হাঁ বাবু, তাই। তাই আমার এই বিপদ।
রমেশ। কিন্তু এর উপায় সরকারমশাই?
গোপাল। অনেক টাকার ব্যাপার। এ ঋণ মিথ্যে, দলিল মিথ্যে, সাক্ষী মিথ্যে,—কে হয়ত ওঁর নাম লিখে সমন নিয়েচে, কে হয়ত আদালতে গিয়ে কবুল জবাব দিয়েচে, সদরে গিয়ে সমস্ত তদন্ত না করে ত কিছুই বলবার জো নেই।
রমেশ। তাই আপনি যান। সমস্ত খবর নিয়ে যত টাকা লাগে এর প্রতিকার করুন। এমন করুন যেন এতবড় অত্যাচার করতে আর কেউ না সাহস করে।
ভৈরব। (অকস্মাৎ রমেশের পা জড়াইয়া ধরিয়া) বাবু গো, আপনি চিরজীবী হোন। ধনেপুত্রে লক্ষ্মীলাভ করে আপনি রাজা হোন। ভগবান আপনাকে যেন—
রমেশ। (পা ছাড়াইয়া লইয়া) আপনি বাড়ি যান আচায্যিমশাই, যা করা উচিত আমি করব।
ভৈরব। ভগবান যেন আপনাকে―
রমেশ। রাত অনেক হলো আচায্যিমশাই, আজ আমি বড় শ্রান্ত।
ভৈরব। ভগবান যেন আপনাকে দীর্ঘজীবী করেন, ভগবান যেন আপনাকে রাজা করেন―
[ইত্যাদি বলিতে বলিতে ভৈরবের প্রস্থান]
রমেশ। (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া) সরকারমশাই, এই আমাদের গর্বের ধন। এই আমাদের শুদ্ধশান্ত ন্যায়নিষ্ঠ বাঙলার পল্লীসমাজ।
গোপাল। হাঁ, এই। সবাই জানবে এ কাজ বেণীবাবুর, সবাই গোপনে জল্পনা করে বেড়াবে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ এ অত্যাচারের প্রতিবাদ করবে না। সেবার গাঙ্গুলীমশাই বিধবা বড়ভাজকে মেরে বাড়ি থেকে বার করে দিলে, কিন্তু বেণীবাবু সহায় বলে সবাই চুপ করে রইল। সে কেঁদে সকলকে জানালে, সকলেই বললে, আমরা কি কোরব। ভগবানকে জানাও তিনিই এর বিচার করবেন।
রমেশ। তার পরে?
গোপাল। তার পরে সেই গাঙ্গুলীমশাই-ই সকলের জাত মেরে বেড়াচ্চেন। মৃত পল্লীসমাজ কথাটি বলবার সাহস রাখে না। অথচ, আমিই ছেলেবেলায় দেখেচি বাবু, এমন ধারা ছিল না। বিধবা বড়ভাজের গায়ে হাত দিয়ে কেউ সহজে নিস্তার পেত না। তখন সমাজ দণ্ড দিত, এবং সে দণ্ড অপরাধীকে মাথা পেতে নিতে হতো।
রমেশ। তবে কি পল্লীসমাজ বলে কিছুই আর নেই?
গোপাল। যা আছে সে ত এসে পর্যন্ত স্বচক্ষেই দেখচেন। যা আর্তকে রক্ষে করে না, দুঃখীকে শুধু দুঃখের পথেই ঠেলে দেয়, তাকেই সমাজ বলে কল্পনা করার মহাপাপ। আমাদের নিয়ত রসাতলের দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্চে।
রমেশ। (আশ্চর্য হইয়া) সরকারমশাই, এ-সকল কথা আপনি জানলেন কার কাছে?
গোপাল। আমার স্বর্গীয় মনিবের কাছে। এইমাত্র যে ভৈরবকে উদ্ধার করতে চাইলেন, এ শক্তি আপনি পেলেন কোথায়? এ তাঁরই দয়া। এমনি কোরে বিপন্নকে উদ্ধার করতে তাঁকে যে আমি বহুবার দেখেচি ছোটবাবু।
রমেশ। (দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া) বাবা—
গোপাল। রাত প্রায় শেষ হয়ে এল বাবু, আপনি একটু শোন।
রমেশ। হাঁ শুই। আপনি বাড়ি যান সরকারমশাই।
[গোপাল সরকার প্রস্থান করিলেন। রমেশ শয়নের আয়োজন করিতেছিল,
সহসা দ্বারের কাছে কি একটা দেখিতে পাইয়া চমকিয়া প্রশ্ন করিল—]
রমেশ। কে? কে দাঁড়িয়ে?
[যতীন দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া]
যতীন। ছোড়দা, আমি।
রমেশ। (কাছে গিয়া) যতীন? এত রাত্রে? আমায় ডাকচ?
যতীন। হাঁ, আপনাকে।
রমেশ। আমাকে ছোড়দা বলতে তোমাকে কে বলে দিলে?
যতীন। দিদি।
রমেশ। রমা! তিনি কি তোমাকে কিছু বলতে পাঠিয়েছেন?
যতীন। না। দিদি বললেন, আমাকে সঙ্গে কোরে তোর ছোড়দার বাড়িতে নিয়ে চল্। ঐ যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
[এই বলিয়া সে দরজার বাহিরে চাহিল]
রমেশ। (ব্যস্ত হইয়া সরিয়া আসিয়া) আজ আমার একি সৌভাগ্য! কিন্তু আমাকে ডেকে না পাঠিয়ে এত রাত্রে নিজে এলে কেন? এস, ঘরে এস।
[রমা অত্যন্ত দ্বিধাভরে ভিতরে প্রবেশ করিয়া দ্বারের অনতিদূরে মেঝের উপর বসিয়া পড়িল। যতীন দিদির কাছে আসিয়া বসিতে যাইতেছিল, কিন্তু রমেশ তাহাকে একটি আরাম-কেদারায় আনিয়া শোয়াইয়া দিল]
রমা। রাত আর নেই, ভোর হয়ে এসেছে, (অধোমুখে) শুধু একটি জিনিস আপনার কাছে ভিক্ষে চেয়ে নেবো বলে আপনার বাড়িতে এসেচি। দেবেন বলুন?
রমেশ। আমার কাছে ভিক্ষে চাইতে? আশ্চর্য! কি চাই বল?
রমা। (মুখ তুলিয়া ক্ষণকাল অপলক-চক্ষে রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল) আগে কথা দিন।
রমেশ। (মাথা নাড়িয়া) তা পারিনে। তোমাকে কোন প্রশ্ন না করেই কথা দেবার শক্তি যে তুমি নিজের হাতেই ভেঙ্গে দিয়েচ রমা।
রমা। আমি ভেঙ্গে দিয়েচি?
রমেশ। তুমিই। তুমি ছাড়া এ শক্তি সংসারে আর কারু ছিল না। রমা, আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলব।—ইচ্ছে হয় বিশ্বাস কোরো, ইচ্ছে না হয় কোরো না। কিন্তু জিনিসটা যদি না মরে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যেতো, হয়ত এ কথা তোমাকে কোনদিন শোনাতে পারতাম না। কিন্তু আজ নাকি আর কোন পক্ষেই লেশমাত্র ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, তাই আজ জানাচ্চি, সেদিন পর্যন্তও তোমাকে অদেয় আমার কিছুই ছিল না। কিন্তু কেন জানো?
রমা। (মাথা নাড়িয়া জানাইল) না।
রমেশ। কিন্তু শুনে রাগ কোরো না। লজ্জাও পেয়ো না। মনে করো এ কোন পুরাকালের একটা গল্প শুনচ মাত্র। তোমাকে ভালবাসতাম রমা। মনে হয়, তেমন ভালবাসা বোধ হয় কেউ কখনো বাসেনি। ছেলেবেলায় মা’র মুখে শুনেছিলাম আমাদের বিয়ে হবে। তারপরে, যেদিন সমস্ত ভেঙ্গে গেল, সেদিন—কত বছর কেটে গেল, তবু মনে হয় সে বুঝি কালকের কথা।
[রমা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া পলকের জন্য শিহরিয়া
আবার স্তব্ধ অধোমুখে নিশ্চল হইয়া রহিল]
রমেশ। তুমি ভাবছ তোমাকে এ-সব কাহিনী শোনানো অন্যায়। আমার মনেও এ সন্দেহ ছিল বোলেই সেদিন তারকেশ্বরে যখন একটি দিনের সমাদরে আমার সমস্ত জীবনের ধারা বদলে দিয়ে গেলে, সেদিনও চুপ করেই ছিলাম। চুপ করেই ছিলাম, কিন্তু সে নীরবতার ব্যথা মাপবার মানদণ্ড হয়ত শুধু অন্তর্যামীর হাতেই আছে।
রমা। (কিছুতেই যেন আর সহিতে পারিল না) যা তাঁর হাতে আছে তা তাঁর হাতেই থাক না রমেশদা।
রমেশ। তাই ত আছে রমা।
রমা। তবে—তবে, আজকেই বা বাড়িতে পেয়ে আমাকে অপমান করচেন কেন?
রমেশ। অপমান! কিছুমাত্র না। এর মধ্যে মান-অপমানের কথাই নেই। এ যাদের কাহিনী শুনচো, সে রমাও তুমি কোনদিন ছিলে না, সে রমেশও আর আমি নেই।
রমা। রমেশদা, আপনার নিজের কথাই বলুন। রমার কথা আমি আপনার চেয়ে বেশী জানি।
রমেশ। যাই হোক শোন। কেন জানিনে, সেদিন আমার অসংশয়ে বিশ্বাস হয়েছিল, তুমি যা ইচ্ছে বল, যা খুশি কর, কিন্তু আমার সত্যিকার অকল্যাণ তুমি কিছুতে সইতে পারবে না। বোধ করি ভেবেছিলাম, সেই যে ছেলেবেলায় একদিন ভালবেসেছিলে, সেই যে হাতে কোরে চোখ মুছিয়ে দিয়েছিলে, হয়ত তা আজও একেবারে ভুলতে পারনি। তাই মনে করেছিলাম কোন কথা তোমাকে না জানিয়ে তোমারি ছাওয়ায় বসে সমস্ত জীবনের কাজগুলো আমার ধীরে ধীরে কোরে যাব। কিন্তু সে রাত্রে আকবরের নিজের মুখে যখন শুনতে পেলাম তুমি নিজে—ও কি? বাইরে এত গোলমাল কিসের?
[দ্রুতবেগে গোপাল সরকারের প্রবেশ]
গোপাল। ছোটবাবু! (অকস্মাৎ রমাকে দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া থামিল)
রমেশ। কি হয়েচে সরকারমশাই?
গোপাল। পুলিশের লোক ভজুয়াকে গ্রেপ্তার করেচে।
রমেশ। ভজুয়াকে? কেন?
গোপাল। সেদিন রাধাপুরের ডাকাতিতে সে নাকি ছিল।
রমেশ। আচ্ছা, আমি যাচ্চি। আপনি বাইরে যান।
[গোপাল সরকার প্রস্থান করিল]
রমেশ। যতীন ঘুমিয়ে পড়েচে, সে থাক। কিন্তু তুমি আর একমুহূর্ত থেকো না রমা, খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যাও। পুলিশ খানাতল্লাশি করতে ছাড়বে না।
রমা। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া ভীতকণ্ঠে) তোমার নিজের ত কোন ভয় নেই?
রমেশ। বলতে পারিনে রমা। কতদূর কি দাঁড়িয়েচে সে ত এখনো জানিনে।
রমা। তোমাকেও ত গ্রেপ্তার করতে পারে?
রমেশ। তা পারে।
রমা। পীড়ন করতেও ত পারে?
রমেশ। অসম্ভব নয়।
রমা। (সহসা কাঁদিয়া উঠিয়া) আমি যাব না রমেশদা।
রমেশ। (সভয়ে) যাবে না কি-রকম?
রমা। তোমাকে অপমান করবে, তোমাকে পীড়ন করবে—আমি কিছুতেই যাব না রমেশদা।
রমেশ। (ব্যাকুল-কণ্ঠে) ছি ছি, এখানে থাকতে নেই। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে রানী!
[এই বলিয়া দুই হাত ধরিয়া জোর করিয়া তাহাকে বাহির করিয়া দিল।
ওদিকে বহু লোকের পদশব্দ ও গোলমাল স্পষ্টতর হইয়া উঠিতে লাগিল]