রমা – ২.১

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

[তারকেশ্বরের গ্রাম্য পথ। প্রভাতবেলায় এই মাত্র সূর্যোদয় হইয়াছে। রমা নিকটস্থ কোন একটা পুষ্করিণী হইতে স্নান সারিয়া আর্দ্র-বস্ত্রে গৃহে ফিরিতেছিল, রমেশের সহিত তাহার একেবারে মুখোমুখি দেখা হইয়া গেল। একবার সে মাথায় আঁচল টানিয়া দিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ভিজা কাপড় টানা গেল না। তখন তাড়াতাড়ি হাতের জলপূর্ণ ঘটিটি নামাইয়া রাখিয়া সিক্ত বসনতলে দুই বাহু বুকের উপর জড় করিয়া হেঁট হইয়া দাঁড়াইল]

রমা। আপনি এখানে যে?

রমেশ। (একপাশে সরিয়া দাঁড়াইয়া) আপনি কি আমাকে চেনেন?

রমা। চিনি। আপনি কখন তারকেশ্বরে এলেন?

রমেশ। এইমাত্র গাড়ি থেকে নেমেচি। আমার মামার বাড়ির মেয়েদের আসবার কথা ছিল, কিন্তু তারা কেউ আসেন নি।

রমা। এখানে কোথায় আছেন?

রমেশ। কোথাও না। পূর্বে কখনো আসিনি, আজকের দিনটা কোনমতে কোথাও কাটাতে হবে। যা হোক একটা আশ্রয় খুঁজে নেবো।

রমা। সঙ্গে ভজুয়া আছে ত?

রমেশ। না, একাই এসেচি।

রমা। বেশ যা হোক! (এই বলিয়া রমা হাসিয়া হঠাৎ মুখ তুলিতেই আবার দু’জনের চোখাচোখি হইল। সে মুখ নীচু করিয়া মনে মনে একটু দ্বিধা করিয়া শেষে বলিল) তবে আমার সঙ্গেই আসুন। (এই বলিয়া সে ঘটিটা তুলিয়া লইয়া অগ্রসর হইতে উদ্যত হইল)

রমেশ ৷ আমি যেতে পারি, কারণ, এতে দোষ থাকলে আপনি কখনই ডাকতেন না। আপনাকে যে আমি চিনি না তাও নয়। কিন্তু কিছুতেই স্মরণ করতে পারচি নে। মনে হচ্ছে কখনো স্বপ্নে দেখে থাকব। আপনার পরিচয় দিন।

রমা। আসুন। পথে যেতে যেতে আমার পরিচয় দেব। স্বপ্ন কবেকার দেখা মনে পড়ে?

রমেশ। না। সঙ্গে আপনার আত্মীয় কেউ নেই?

রমা। না, দাসী আছে, সে বাসায় কাজ করচে, চাকরটা গেছে বাজারে। তা ছাড়া আমি ত প্রায়ই এখানে আসি,—সমস্তই চিনি।

রমেশ। কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্চেন কেন?

রমা। নইলে আপনার খাওয়া-দাওয়ার ভারী কষ্ট হবে।

রমেশ। হলই বা। তাতে আপনার কি?

রমা। পুরুষমানুষকে সব বুঝোন যায়, যায় না শুধু এই কথাটি। আমি রমা!

রমেশ। রমা?

রমা। হাঁ, যার সঙ্গে পরিচয় থাকাও আপনার ঘৃণার বস্তু—সেই।

রমেশ। কিন্তু আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

রমা। আমার বাসায়। সেখানে মাসী নেই, ভয় নেই, আসুন।

[উভয়ের প্রস্থান]

[পরক্ষণে নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণের প্রবেশ। নাপিত ও তাহাকে দ্রুতপদে অনুসরণ করিয়া
অপর এক ব্যক্তি। মুখে প্রচুর দাড়ি-গোঁফ ও মাথায় সুদীর্ঘ কেশ, খানিকটা ক্ষুর দিয়া কামানো। এই লোকটি মানত করিয়া ঠাকুরের কাছে চুল-দাড়ি দিতে আসিয়াছিল]

যাত্রী। (ব্যস্তভাবে) নাপিত, নাপিত, তুমি নাপিত নাকি হে? দাও ত দাদা এইটুকু কামিয়ে। খপ্‌ কোরে একটা ডুব দিয়ে বাবার পূজোটুকু সেরে দিয়ে আসি। বাবার থান, নইলে দুটো পয়সার মজুরি নয়,—এই সিকিটি নিয়ে দাও দাদা খপ্‌ করে। সাড়ে বারোটার গাড়ি ধরতে হবে,—ঘরে ছেলেটার আবার দু’দিন জ্বর। দাও দাও, এখানেই বসে যাবো নাকি?

নাপিত। (সিকিটি হাতে লইয়া বেশ করিয়া পরীক্ষা করিয়া পরে ট্যাঁকে গুঁজিয়া বারদুই তাহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিয়া) এই যে! দাড়ি-চুল কে এঁটো করে দিয়েচে দেখচি?

যাত্রী। এঁটো? এঁটো কি রকম? দেখচো বাবার দাড়ি-চুল, এ কি আমার? এঁটো কি রকম?

নাপিত। (হাত দিয়া দেখাইয়া) এই ত খাবলে দুই-ই এঁটো করে দিয়েচে।

যাত্রী। এঁটো হয়ে গেল? এক ব্যাটা নাপতে সিকিটি হাতে নিয়ে এইটুকু ক্ষুর বুলিয়ে দিয়ে বলে কর্তার সিকিটি অমনি দাও। বললুম, কর্তা আবার কে? এই তো গদিতে পাঁচ-সিকে জমা দিয়ে হুকুম নিয়ে আসচি। বলে, দেখ গে তবে আর কোথাও। সিকি ত গেছেই, রাগ করে উঠে এলুম। দাও দাদা, তোমার বাপ-মায়ের কল্যাণে—

নাপিত। আর গণ্ডা-আষ্টেক পয়সা বার কর দিকি। তার চার-আনা, কর্তার চার-আনা।

যাত্রী। আবার তার চার-আনা, কর্তার চার-আনা? মানুষ-জনকে কি পাগল করে দেবে নাকি? দাও তবে আমার সিকি ফিরিয়ে, আমি তার কাছে গিয়েই কামাব।

নাপিত। যাবে যাও না। আমি কি তোমাকে ধরে রেখেচি নাকি?

যাত্রী। (রাগতভাবে) সিকি ফিরিয়ে দাও বলচি।

নাপিত। কিসের সিকি শুনি? এতক্ষণ দর-দস্তুর করলি মাগ্‌না নাকি?

যাত্রী। আবার তুই- তোকারি?

নাপিত। ওঃ—গুরুঠাকুর এসেচেন! এ তারকেশ্বর থান, মনে রাখিস! চোখ রাঙাবি ত গলাধাক্কা খাবি। কোন্‌ বাবা তোকে কামিয়ে দেয় যা না।

[ছেলের হাত ধরিয়া একটি প্রৌঢ়াগোছের স্ত্রীলোক ও তাহার
আঁচল ধরিয়া মন্দিরের দুইজন কর্মচারীর দ্রুতপদে প্রবেশ]

১ম কর্মচারী। অ্যাঁ! বাবাকে ঠকানো! ঠকানোর আর জায়গা পাসনি মাগী? মোটে পাঁচসিকে মানোত?

প্রৌঢ়া। (কাতর-কণ্ঠে) না বাবা ঠকাই নি। যা মানোত করেছিলুম তাই জমা দিয়েচি।

১ম কর্মচারী। কবে মানোত করেছিলি, বল, বল, শুনি?

প্রৌঢ়া। বছর-তিনেক আগে, সেই বানের সময়। সত্যি বলচি বাবা—

২য় কর্মচারী। সত্যি বলচ? মিথ্যেবাদী কোথাকার। বছর-তিনের মধ্যে ঘরে আর ব্যারাম-স্যারাম হয়নি? আর মানত করবার দরকার হয়নি? কখখনো না। দে মাগী বুকে হাত দে। মনে করে দ্যাখ। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করিস—এ যে-সে দেবতা নয়, স্বয়ং তারকনাথ।

প্রৌঢ়া। (অত্যন্ত ভয় পাইয়া) শাপ-মন্যি দিও না বাবা, এই আর একটি টাকা নিয়ে—

১ম কর্মচারী। (হাত পাতিয়া গ্রহণ করিয়া) একটি টাকা? অন্ততঃ আরো পাঁচটি টাকা মানোত করেছিলি। দ্যাখ ভেবে। বাবার কৃপায় আমরা সব জানতে পারি, আমাদের ঠকান যায় না।

২য় কর্মচারী। দে না মা টাকা ক’টা ফেলে! ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করিস, কেন আর বাবার কোপে পড়বি? তোর ব্যাটার কল্যাণে দে, দিয়ে দে ফেলে।

প্রৌঢ়া। (কাঁদ-কাঁদ হইয়া) টাকা যে আর নেই বাবা। কোথায় পাব টাক।

১ম কর্মচারী। কেন ঐ ত তোর গলায় সোনার কবচ রয়েচে। ওটা পোদ্দারের দোকানে রেখে কি আর পাঁচটা টাকা পাবিনে? সঙ্গে না হয় লোক দিচ্ছি, দোকান দেখিয়ে দেবে, তার পরে একদিন ফিরে এসে খালাস করে নিয়ে যাবি।

[একজন স্ত্রীলোককে ঘিরিয়া পাঁচ-সাত জন ভিখারিণীর প্রবেশ]

১ম ভিখারিণী। দে মা তোর ব্যাটা-বেটীর কল্যাণে—

২য় ভিখারিণী। দে মা একটি পয়সা তোর মেয়ে-জামাইয়ের কল্যাণে—

৩য় ভিখারিণী। দে মা তোর বাপ-মায়ের—

৪র্থ ভিখারিণী। দে মা তোর স্বামী-পুত্তুরের—

[সকলে মহা ঠেলাঠেলি টানাটানি করিতে লাগিল]

চুলওয়ালা যাত্রী। চাইনে দাড়ি-চুল দিতে। চাইনে মানত শোধ করতে।

মানতওয়ালা প্রৌঢ়া। এ যে আমার ইষ্টি-কবচ বাবা! বাঁধা দেব কি করে?

ভিখারীতাড়িত স্ত্রীলোক। ওগো কি সর্বনাশ! কে আমার আঁচল কেটে নিলে?

ভিখারীর দল। তোর স্বামী-পুত্তুরের কল্যাণে দে একটা পয়সা। দে একটা আধলা—

১ম কর্মচারী। ব্যাটা-বেটী নিয়ে ঘর করিস বাছা! বাবার থান!

নাপিত। কামাবে যে গো?

যাত্রী। কামাবো? রইল তারকনাথ মাথায়। চললুম ঘরে ফিরে।

[প্রস্থান

ভিখারীতাড়িত স্ত্রীলোক। ঘরে ফিরব কি করে গো! কে আঁচল কেটে নিলে।

ভিখারীর দল। দে মা একটা পয়সা। দে মা একটা আধলা।

[বলিতে বলিতে ঠেলিয়া লইয়া গেল]

মানতওয়ালা প্রৌঢ়া। দোহাই বাবা তারকনাথ, আমার ইষ্টি-কবচটি আর নিয়ো না।

[ছেলের হাত ধরিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান]

১ম কর্মচারী। এক টাকার বেশী হোল না আদায়।

২য় কর্মচারী। নেই মাগীর আর কিছু।

[প্রস্থান

নাপিত। যাক চার গণ্ডা পয়সাই কোন্‌ মাথা খুঁড়লে মেলে?

[প্রস্থান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *