দ্বিতীয় দৃশ্য
[রমেশের বহির্বাটী। চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দার একধারে ভৈরব আচার্য থান ফাড়িয়া কাপড় পাট করিয়া গাদা দিতেছে। চণ্ডীমণ্ডপের অভ্যন্তরে বসিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলী ধূমপান করিতেছে এবং আড়চোখে চাহিয়া বস্ত্ররাশির মনে মনে সংখ্যা-নিরূপণ করিতেছে। কর্মবাড়ি। আসন্ন শ্রাদ্ধকৃত্যের বহুবিধ আয়োজন চারিদিকে বিক্ষিপ্ত। নানা লোক নানা কাজে ব্যস্ত। সময় অপরাহ্ণ]
[রমেশের প্রবেশ]
রমেশ। (গোবিন্দ গাঙ্গুলীর প্রতি সবিনয়ে) এই যে আপনি এসেচেন।
গোবিন্দ। আসবো বৈ কি বাবা, আসবো বৈ কি! এ যে আমার আপনার কাজ রমেশ।
[নেপথ্যে কাশির শব্দ। কাশিতে কাশিতে চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে লইয়া ধর্মদাস চাটুয্যের প্রবেশ। তাঁহার কাঁধের উপর মলিন উত্তরীয়, নাকের উপর একজোড়া ভাঁটার মত মস্ত চশমা পিছনে দড়ি দিয়া বাঁধা। সাদা চুল, সাদা গোঁফ তামাকের ধূঁয়ায় তাম্রবর্ণ। অগ্রসর হইয়া রমেশের মুখের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া কোন কথা না কহিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। রমেশ চিনিল না ইনি কে। কিন্তু যেই হোন, ব্যস্ত হইয়া হাত ধরিতেই—]
ধর্মদাস। (কাঁদিয়া) না বাবা রমেশ, তারিণী যে এমন করে ফাঁকি দিয়ে পালাবে তা স্বপ্নেও জানিনে। কিন্তু আমারও এমন চাটুয্যে-বংশে জন্ম নয় যে কারু ভয়ে মুখ দিয়ে মিথ্যে কথা বেরুবে। আসবার সময় তোমার আপন জাঠতুতো ভাই বেণী ঘোষালের মুখের উপর কি বলে এলাম জানো? বললাম, রমেশ যেমন শ্রাদ্ধের আয়োজন করচে, এমন করা চুলোয় যাক, এ-অঞ্চলে কেউ চোখেও দেখেনি। আমার নামে অনেক শালা অনেক রকম তোমার কাছে লাগিয়ে যাবে বাবা, কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনো, এই ধর্মেরই শুধু ধর্মেরই দাস, আর কারও নয়।
[এই বলিয়া গোবিন্দর হস্ত হইতে হুঁকোটা ছিনাইয়া লইয়া
এক টান্ দিয়াই প্রবল বেগে কাশিয়া ফেলিলেন]
রমেশ। না না, বলেন কি, বলেন কি—
[প্রত্যুত্তরে ধর্মদাস ঘড়ঘড় করিয়া কত কি বলিলেন, কিন্তু কাশির ধমকে তাহার একটা বর্ণও বুঝা গেল না। গোবিন্দ সর্বাগ্রে আসিয়াছিলেন, সুতরাং এই নবীন জমিদারটিকে ভাল ভাল কথা বলিবার সুযোগ তাঁহারই ছিল, অথচ নষ্ট হইতেছে বুঝিয়া তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইলেন]
গোবিন্দ। কাল সকালে, বুঝলে ধর্মদাসদা, এখানে আসবো বলে বেরিয়েও আসা হল না। বেণীর ডাকাডাকি—গোবিন্দখুড়ো তামাক খেয়ে যাও। একবার ভাবলেম কাজ নেই,—তার পরে মনে হল ভাবখানা বেণীর দেখেই যাইনে। বেণী কি বললে জানো বাবা রমেশ, বলে খুড়ো, তোমরা ত দেখচি হয়েচ রমেশের মুরুব্বি, বলি লোকজন খাবে-টাবে ত? আমিই বা ছাড়ি কেন,—তুমি বড়লোক আছো না-আছো, আমার রমেশও কারো চেয়ে খাটো নয়। তোমার ঘরে ত একমুঠো চিঁড়ের পিত্যেশ কারু নেই। বললাম, বেণীবাবু, এই ত পথ—দাঁড়িয়ে একবার কাঙ্গালী-বিদেয়ের ঘটাটা দেখো। কালকের ছেলে রমেশ, কিন্তু বুকের পাটা ত বলি একে। কিন্তু তাও বলি ধর্মদাসদা, আমাদের সাধ্যই বা কি! যাঁর কাজ তিনিই ওপরে থেকে করাচ্চেন। তারিণীদা শাপভ্রষ্ট দিকপাল ছিলেন বৈ ত নয়।
[ধর্মদাসের কিছুতেই কাশি থামে না, আর তাহারই সম্মুখে গোবিন্দ বেশ বেশ কথাগুলি এই অপরিপক্ক তরুণ জমিদারটিকে বলিয়া যাইতেছে দেখিয়া আরও ভাল বলিবার চেষ্টায় ধর্মদাস যেন আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল]
গোবিন্দ। তুমি ত আমার পর নও বাবা, নিতান্ত আপনার। তোমার মা ছিলেন আমার সাক্ষাৎ পিসতুত বোনের আপনার ভাগ্নী। রাধানগরের বাঁড়ুয্যে বাড়ি,—সে-সব তারিণীদা জানতেন। তাই যে-কোন কাজকর্মে—মামলা-মকর্দমা করতে, সাক্ষী দিতে—ডাক্ গোবিন্দকে—
ধর্মদাস। কেন বাজে বকিস গোবিন্দ? খক্ খক্ খক্—খ—আমি আজকের নই, না জানি কি? সে বছর সাক্ষী দেবার কথায় বললি আমার জুতো নেই, খালিপায়ে যাই কি করে? খক্ খক্—তারিণী অমনি আড়াই টাকা দিয়ে জুতো কিনে দিলে। তুই তাই পায়ে দিয়ে সাক্ষী দিয়ে এলি কিনা বেণীর হয়ে! খক্ খক্ খক—খ—
গোবিন্দ। (চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া) এলুম?
ধর্মদাস। এলিনে?
গোবিন্দ। দূর মিথ্যেবাদী!
ধর্মদাস। মিথ্যেবাদী তোর বাবা।
গোবিন্দ। (ভাঙ্গা ছাতি লইয়া লাফাইয়া উঠিল) তবে রে শালা!
ধর্মদাস। (বাঁশের লাঠি উঁচাইয়া) ও শালার আমি—খক খক খক—খ—ও শালার আমি সম্পর্কে বড়ভাই হই কিনা, তাই শালার আক্কেল দেখ! (কাশি)
গোবিন্দ। ওঃ—শালা আমার বড়ভাই!
[চারিদিকের লোক ছুটিয়া আসিল, ছেলে-মেয়েরা হাঁ করিয়া চাহিয়া
রহিল এবং রমেশ দ্রুতপদে তাহাদের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল]
রমেশ। এ কি এ! আপনারা উভয়েই প্রাচীন—ব্রাহ্মণ—এ কি কাণ্ড!
ভৈরব। (উঠিয়া আসিয়া রমেশের প্রতি) প্রায় শ’চারেক কাপড় ত হল, আরও চাই কি?
[রমেশ নিরুত্তর]
ভৈরব। ছিঃ গাঙ্গুলীমশাই, বাবু একেবারে অবাক হয়ে গেছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না বাবু, এমন ঢের হয়। বৃহৎ কাজকর্মের বাড়িতে কত ঠ্যাঙাঠেঙি রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়ে যায়—আবার যে কে সেই হয়। নিন চাটুয্যেমশাই, দেখুন দিকি আরও থান ফাড়বো কি না?
গোবিন্দ। হয়ই ত! হয়ই ত! ঢের হয়। নইলে বিরদ্ কর্ম বলেচে কেন। সে বছর তোমার মনে আছে ভৈরব, যদু মুখুয্যেমশাইয়ের কন্যা রমার গাছ-পিতিষ্ঠের দিন সিধে নিয়ে, রাঘব ভট্চায্যে আর হারান চাটুয্যেতে মাথা ফাটাফাটি হয়ে গেল! কিন্তু আমি বলি ভৈরব ভায়া, বাবাজীর এ কাজটা ভাল হচ্চে না। ছোটলোকদের কাপড় দেওয়া আর ভস্মে ঘি ঢালা এক কথা। তার চেয়ে বামুনদের একজোড়া আর ছেলেদের একখানা করে দিলে নাম হোতো। আমি বলি বাবাজী সেই যুক্তিই করুন, কি বল ধর্মদাসদা?
ধর্মদাস। গোবিন্দ মন্দ যুক্তি বলেনি বাবাজী। ওদের মিছে দেওয়া। নইলে আর শাস্তরে ব্যাটাদের ছোটলোক বলেচে কেন! বুঝলে না বাবা রমেশ?
রমেশ। হাঁ, বুঝেচি বৈ কি।
ভৈরব। তা হলে কি এই কাপড়েই হবে?
রমেশ। বোধ হয় হবে না। বলা যায় না কত কাঙ্গালী আসবে, আপনি বরঞ্চ আরও দু’শ কাপড় ঠিক করে রাখুন।
গোবিন্দ। তা নইলে কি হয়? তুমি একা আর কত পারবে ভায়া, চল আমিও যাই।
[বলিতে বলিতে গোবিন্দ বস্ত্ররাশির কাছে অগ্রসর হইয়া গেল, এবং উপবেশন করিয়া কাপড় গুছাইতে লাগিল। ধর্মদাস এই অবকাশে রমেশকে একধারে টানিয়া লইয়া গিয়া কানে কানে বলিতে লাগিল। ওদিকে গোবিন্দ উদ্গ্রীব হইয়া আড়চোখে চাহিয়া দেখিতে লাগিল]
ধর্মদাস। এ-দেশ বড় খারাপ বাবা, ভাঁড়ার-টাঁড়ার কাউকে দিয়ে বিশ্বেস কোরো না। তেল, নুন, ঘি, ময়দা অর্ধেক সরিয়ে ফেলবে। আমি এখুনি গিয়ে তোমার পিসীমাকে পাঠিয়ে দিচ্চি বাবা, একটি কুটো তোমার নষ্ট হবে না।
রমেশ। যে-আজ্ঞে—
[মুণ্ডিত-শ্মশ্রু শীর্ণকায় ও প্রাচীন দীননাথ ভট্টাচার্য প্রবেশ করিলেন। ইঁহার সঙ্গেও দুই-তিনটি ছেলে-মেয়ে। মেয়েটি সকলের বড়, পরনে একখানি শতচ্ছিন্ন ডুরে কাপড়]
দীননাথ। কৈ গো বাবাজী, কোথায় গো?
গোবিন্দ। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) এস দীনুদা, বোস। বড় ভাগ্যি আমাদের যে আজ তোমার পায়ের ধুলো পড়লো। ছেলেটা একা সারা হয়ে যায় তা তোমরা ত—
[ধর্মদাস কটমট করিয়া তাহার প্রতি চাহিল]
গোবিন্দ। তা তোমরা ত কেউ এদিক মাড়াবে না দাদা।
দীনু। আমি ত ছিলাম না ভায়া, তোমার বৌঠাকরুনকে আনতে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। বাবাজী কোথায়? শুনচি নাকি ভারী আয়োজন হচ্চে। পথে ও-গাঁয়ের হাটে শুনে এলাম খাইয়ে-দাইয়ে ছেলে-বুড়োর হাতে নাকি ষোল পাত লুচি আর চার জোড়া করে সন্দেশ দেওয়া হবে।
গোবিন্দ। (গলা খাটো করিয়া) তা ছাড়া হয়ত একখানা করে কাপড়ও—
[রমেশের প্রবেশ]
দীনুদা, এই আমার রমেশ। তা তোমাদের পাঁচজনের বাপ-মায়ের আশীর্বাদে যোগাড়-সোগাড় ত একরকম করচি, কিন্তু বেণী একেবারে উঠে পড়ে লেগেচে। এই আমার কাছেই দু’বার লোক পাঠিয়েচে। তা আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলে, রমেশের সঙ্গে আমার নাড়ীর টান রয়েচে, কিন্তু এই যে দীনুদা, ধর্মদাসদা, এঁরাই কি বাবা তোমাকে ফেলতে পারবেন? দীনুদা ত পথ থেকে শুনতে পেয়ে ছুটে আসচেন। ওরে ও ষষ্ঠীচরণ, তামাক দে না রে! বাবা রমেশ, একবার এদিকে এসো দিকি, একটা কথা বলে নিই।
[ভৃত্য আসিয়া দীনুর হাতে হুঁকা দিয়া গেল এবং গোবিন্দ
রমেশকে আর একদিকে সরাইয়া লইয়া গিয়া চাপা গলায়]
গোবিন্দ। ভেতরে বুঝি ধর্মদাস-গিন্নি আসচে? খবরদার বাবা, খবরদার—বিট্লে বামুন যতই ফোসলাক, কখনো তার হাতে ভাঁড়ার-টাড়ার দিও না, মাগী অর্ধেক ফাঁক করে দেবে। বলি, তোমার ভাবনা কি বাবা? তোমার যে আপনার মামী রয়েচে। আমি গিয়েই তাকে পাঠিয়ে দিচ্চি, নাড়ীর টানে সে যেমন করবে আর কি কেউ তেমন পারবে? না, কখনো পারে?
[শিশু-দু’টা ছুটিয়া আসিয়া দীনুর কাঁধের উপর ঝুলিয়া পড়িল]
শিশুরা। বাবা, সন্দেশ খাবো।
দীনু। (একবার রমেশ ও একবার গোবিন্দর প্রতি চাহিয়া) সন্দেশ কোথায় পাব রে? সন্দেশ কৈ?
[দীনুর মেয়ে অন্তরালে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া]
দীনুর মেয়ে। কেন, ঐ যে হচ্চে বাবা—
[বাকি ছেলে-মেয়েরা নাকে কাঁদিতে কাঁদিতে
আসিয়া ধর্মদাসকে ঘিরিয়া ধরিল]
ছেলে-মেয়েরা। আঁমরাও দাঁদামশাই—
রমেশ। (অগ্রসর হইয়া) বেশ ত, বেশ ত, ও আচার্যিমশাই, বিকেলবেলায় ছেলেরা সব বাড়ি থেকে বেরিয়েচে, খেয়ে ত আসেনি। (অন্তরালবর্তী ময়রার উদ্দেশে) ওহে ও, কি নাম তোমার? নিয়ে এস ত ঐ থালাটা এদিকে। আচার্যিমশাই, দেখুন ত যেন দেরি না হয়।
[ভৈরব আচার্য ভিতরে চলিয়া গেল এবং ক্ষণকাল পরেই ময়রা সন্দেশের থালা আনিতেই ছেলেরা উপুড় হইয়া পড়িল—বাঁটিয়া দিবার অবকাশ দেয় না এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল। ছেলেদের খাওয়া দেখিতে দেখিতে দীননাথের শুষ্কদৃষ্টি সজল ও তীব্র হইয়া উঠিল]
দীনু। ওরে ও খেঁদি, খাচ্ছিস ত খুব, সন্দেশ হয়েছে কেমন বল দিকি?
খেঁদি। বেশ বাবা—
[এই বলিয়া সে চিবাইতে লাগিল]
দীনু। (মৃদু হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ:—তোদের আবার পছন্দ! মিষ্টি হলেই হল। হাঁ হে কারিকর, এ কড়াটা কেমন নাবালে? কি বল গোবিন্দভায়া, এখনো রোদ একটু আছে বলে মনে হচ্চে না?
ময়রা। আজ্ঞে, আছে বৈ কি। এখনো ঢের বেলা আছে, এখনো সন্ধ্যে-আহ্নিকের—
দীনু। তবে কৈ দাও দিকি গোবিন্দভায়াকে একটা, চেকে দেখুক কেমন কলকাতার কারিকর তোমরা—
[ময়রা গোবিন্দ ও দীনু উভয়কেই সন্দেশ দিতে গেল]
দীনু। না না, আমাকে আবার কেন? তবে, আধখানা—আধখানার বেশী নয়। (হুঁকা রাখিয়া দিয়া) ওরে, ও ষষ্ঠীচরণ, একটু জল আন দিকি বাবা, হাতটা ধুয়ে ফেলি।
রমেশ। (ভিতরের দিকে চাহিয়া) ওরে, অমনি ভিতর থেকে গোটা-চারেক রেকাবী নিয়ে আসিস ষষ্ঠী।
গোবিন্দ। সন্দেশের চেহারা দেখেই বোধ হচ্চে হয়েছে ভাল। কি হে, ময়রার পো, পাকটা একটু নরমই রাখলে বুঝি?
ময়রা। আজ্ঞে হাঁ, এ কড়াটা একটু নরমই রেখেচি।
গোবিন্দ। (হাস্য করিয়া) আমরা বুঝি কিনা! তাকালেই ধরে দিতে পারি কোন্টা কেমন।
ময়রা। আজ্ঞে, আপনারা বুঝবেন না ত বুঝবে কারা!
[ষষ্ঠীচরণ ও আর একজন ভৃত্য রেকাবী, জলের গ্লাস প্রভৃতি আনিয়া উপস্থিত করিল, ময়রা সন্দেশের থালাটা সম্মুখে আনিয়া রাখিল, এবং ব্রাহ্মণদিগের পাত্রে তুলিয়া দিতে লাগিল। কাহারও মুখে কথা নাই, ছেলে-মেয়েরা এবং ধর্মদাস, গোবিন্দ ও দীনু গোগ্রাসে গিলিতেছে এবং দেখিতে দেখিতে সমস্ত থালাটাই নিঃশেষিত হইয়া গেল]
দীনু। হাঁ, কলকাতার কারিকর বটে! কি বল ধর্মদাসদা?
[ধর্মদাসের কণ্ঠস্বর সন্দেশের তাল ভেদ করিয়া বেশ স্পষ্ট
বাহির হইল না, কিন্তু বুঝা গেল মতের অনৈক্য নাই]
গোবিন্দ। (নিশ্বাস ফেলিয়া) হাঁ, ওস্তাদি হাত বটে!
ময়রা। যদি কষ্টই করলেন ঠাকুরমশাই, তা হলে মিহিদানাটাও অমনি পরখ করে দিন।
দীনু। মিহিদানা। কৈ আনো দিকি বাপু।
ময়রা। এই যে আনি।
[এই বলিয়া সে চক্ষের পলকে একথালা মিহিদানা আনিয়া হাজির করিল এবং ব্রাহ্মণদিগের পাত্রে উজাড় করিয়া দিল। মিহিদানা শেষ হইয়া আসিতে বিলম্ব হইল না]
দীনু। (হাত বাড়াইয়া মেয়ের প্রতি) ওরে ও খেঁদি, ধর দিকি মা, এই দুটো মিহিদানা।
খেঁদি। আমি আর খেতে পারবো না বাবা।
দীনু। পারবি পারবি। এক ঢোঁক জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নে দিকি, মুখ মেরে গেছে বৈ ত না। না পারিস আঁচলে একটা গেরো দিয়ে রাখ, কাল সকালে উঠে খাস।
[এই বলিয়া মেয়ের হাতে গুজিয়া দিল]
দীনু। (ময়রার প্রতি) হাঁ বাপু, খাওয়ালে বটে। যেন অমৃত। তা বেশ হয়েছে, মিষ্টি বুঝি দু’রকম করলে বাবাজী?
ময়রা। আজ্ঞে না, রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন—
দীনু। অ্যাঁ, ক্ষীরমোহন? কৈ, সে ত বার করলে না বাপু? (বিস্মিত রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া) হাঁ খেয়েছিলাম বটে রাধানগরের বোসেদের বাড়ি, আজও যেন মুখে লেগে রয়েচে। বললে বিশ্বাস করবে না বাবাজী, ক্ষীরমোহন খেতে আমি বড্ড ভালবাসি।
রমেশ। (হাসিয়া) আজ্ঞে না, অবিশ্বাস করবার কোন কারণ নেই। ওরে ষষ্ঠী, ভেতরে বোধ করি আচায্যিমশাই আছেন, যা ত কিছু ক্ষীরমোহন তাঁকে আনতে বলে আয় দিকি।
[ষষ্ঠীচরণের প্রস্থান]
গোবিন্দ। (উদ্বিগ্নকণ্ঠে) অ্যাঁ? মিষ্টি কি সব বাইরে পড়ে নাকি! না না, এ ত ভাল না।
ধর্মদাস। চাবি? চাবি? ভাঁড়ারের চাবি কার কাছে?
গোবিন্দ। বলি, ভৈরো আচায্যির হাতে নয় ত?
[ষষ্ঠীচরণের প্রবেশ]
ষষ্ঠী। এখন আর ভাঁড়ার-ঘর খোলা হবে না বাবু, ক্ষীরমোহন বার হবে না।
রমেশ। আঃ, বল গে যা আমি আনতে বলচি।
গোবিন্দ। দেখলে ধর্মদাসদা, আচায্যির আক্কেল। এ যে দেখি মায়ের চেয়ে মাসীর বেশী দরদ। সে জন্যেই আমি বলি—
ষষ্ঠী। আচায্যিমশায়ের দোষ কি? ও-বাড়ি থেকে গিন্নি-মা এসে ভাঁড়ার বন্ধ করে ফেলেচেন। এ তাঁরই হুকুম।
ধর্মদাস ও গোবিন্দ। কে? বেণীবাবুর মা? ও-বাড়ির বড়-গিন্নিঠাকরুন?
রমেশ। জ্যাঠাইমা এসেচেন নাকি?
ষষ্ঠী। হাঁ বাবু। তিনি এসেই ছোট-বড় দুটো ভাঁড়ারই তালা-বন্ধ করে ফেলেচেন। চাবি তাঁরই আঁচলে।
গোবিন্দ। দেখলে ধর্মদাসদা ব্যাপারখানা? বলি মতলবটা বুঝলে ত?
দীনু। এ মতলব বোঝা আর শক্ত কি ভায়া! তালা-বন্ধ করে চাবি নিজের কাছে রেখেচেন, তার মানে ভাঁড়ার আর কারো না হাতে পড়ে। তিনি সমস্তই ত জানেন।
গোবিন্দ। বোঝ না সোঝ না তুমি কথা কও কেন বল ত? তুমি এ-সব ব্যাপারের কি জানো যে হঠাৎ মানে করতে এসেচ?’
দীনু। আরে, এতে বোঝা-বুঝিটা আছে কোন্খানে? শুনচো না গিন্নী-মা স্বয়ং এসে তালা-বন্ধ করেছেন? এতে কথা কইবে আবার কে?
গোবিন্দ। ঘরে যাও না ভটচায। যে জন্যে ছুটে এলে, গুষ্টিবর্গ মিলে খেলে, বাঁধলে—আর কেন? ক্ষীরমোহন পরশু খেয়ো, আজ বাড়ি যাও, আমাদের ঢের কাজ।
রমেশ। আপনার হল কি গাঙ্গুলীমশাই? যাকে-তাকে এমন খামোকা অপমান করচেন কেন?
[ধমক খাইয়া গোবিন্দ লজ্জিত হইল। পরে শুষ্কহাস্য করিয়া]
গোবিন্দ। অপমান আবার কাকে করলাম বাবাজী। ভাল, ওকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ না ঠিক সত্যি কথাটি বলেচি কিনা? ও ডালে-ডালে বেড়ায় যদি, আমি পাতায়-পাতায় ঘুরি যে। দেখলে ধর্মদাসদা, দীনে বামনার আস্পর্ধা? আচ্ছা রমেশ। আচ্ছা কি?
দীনু। (রমেশের প্রতি) না বাবা, গোবিন্দ সত্য কথাই বলেচেন। আমি বড় গরীব সে এদিকের সবাই জানে। ওঁদের মত আমার জমি-জমা চাষ-বাস কিছুই নেই, একরকম চেয়েচিন্তে ভিক্ষে-শিক্ষে করেই আমাদের দিন চলে।—ভাল জিনিস ছেলেপিলেদের কিনে খাওয়াবার ক্ষমতা ত ভগবান দেননি, তাই বড়ঘরে কাজকর্ম হলে ওরা খেয়ে বাঁচে। কিছু মনে কোরো না বাবা, তারিণীদাদা বেঁচে থাকতে আমাদের তিনি খাওয়াতে বড় ভালবাসতেন।
[দীনুর দু’চক্ষু জলে ভরিয়া টপটপ করিয়া দু’ফোঁটা অশ্রু সকলের সম্মুখেই
ঝরিয়া পড়িল। দীনু মলিন ও ছিন্ন উত্তরীয়-প্রান্তে তাহা মুছিয়া ফেলিল]
গোবিন্দ। আহা! তারিণীদাদা শুধু তোমাকে খাওয়াতেই ভালবাসতেন। শুনলে ধর্মদাসদা, শুনলে কথা?
দীনু। আমি কি তাই বলচি গোবিন্দ? আমার মত গরীব-দুঃখী কেউ কখনো তারিণীদার কাছ থেকে খালি হাতে ফেরেনি।
রমেশ। ভটচায্যিমশাই, এই দুটো দিন আমার ওপরে একটু দয়া রাখবেন। আর যদি খাঁদুর মা এ-বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দিতে পারেন ত ভাগ্য বলে মানব।
দীনু। আমি বড় গরীব বাবা, আমি বড় দুঃখী। আমাকে এমন করে বললে যে আমি লজ্জায় মরে যাই—
[ভৃত্যের প্রবেশ]
ভৃত্য। বাবু, গিন্নি-মা একবার বাড়ির ভেতরে ডাকচেন।
রমেশ। যাই।
দীনু। বাবা, আমরা তা হলে এখন আসি।
রমেশ। আসুন, কিন্তু আমার প্রার্থনা যেন ভুলে যাবেন না।
দীনু। না বাবা, প্রার্থনা বলচ কেন, এ তোমার দয়া।
[ছেলেদের লইয়া দীনুর প্রস্থান]
গোবিন্দ। বাবা রমেশ, আমিও এখন তাহলে আসি। সন্ধ্যে-আহ্নিক, ঠাকুরের শীতল দেওয়া—রমেশ। কিন্তু গাঙ্গুলীমশাই—
গোবিন্দ। কিছু বলতে হবে না বাবা, এ আমার আপনার কাজ। তুমি না ডাকলেও আমাকে নিজে এসে সমস্ত করতে হতো। কাল সক্কালেই তোমার মামীকে পাঠিয়ে দিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হতে পারব।
ধর্মদাস। তুই বড় বাজে বকিস গোবিন্দ।
গোবিন্দ। কোন ভাবনা নেই রমেশ, ভাঁড়ার-টাড়ার যা কিছু—
ধর্মদাস। ভাঁড়ারের জন্যে তোর এত মাথাব্যথা কেন বল ত?
গোবিন্দ। এ আমাদের নিজের কাজ বাবা। আমি আর ধর্মদাসদা—আমরা দু’ভাই তোমার ডাকার অপেক্ষা রাখিনি,—আপনারাই এসে উপস্থিত হয়েচি। হয়েচি কিনা?
ধর্মদাস। বলি শোন রমেশ, আমরা বেণী ঘোষাল নই, আমাদের জন্মের ঠিক আছে।
রমেশ। আঃ—কি বলচেন আপনারা?
[জ্যাঠাইমা অন্তরাল হইতে একটুখানি মুখ বাহির করিয়া]
জ্যাঠাইমা। ওরা অমনিই বলে রমেশ! শিক্ষা আর সঙ্গদোষে জানেও না যে, কি ওরা বললে।
[গোবিন্দ ও ধর্মদাসের দ্রুতপদে প্রস্থান
রমেশ। জ্যাঠাইমা!
জ্যাঠাইমা। হাঁরে আমিই। বলি চিনতে পারিস ত?
[বলিতে বলিতে তিনি সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার বয়স পঞ্চাশের কম নয়, কিন্তু কিছুতেই চল্লিশের বেশী বলিয়া মনে হয় না। মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা, দুই-এক গাছি কুঞ্চিত হইয়া কপোলের উপর পড়িয়াছে। একদিন যে রূপের খ্যাতি এ-অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল, আজিও সেই অনিন্দ্যসৌন্দর্য তাঁহার নিটোল পরিপূর্ণ দেহটিকে বর্জন করিয়া দূরে যাইতে পারে নাই। দেখিয়া আজও মনে হয় তাঁহার সকল অবয়ব যেন শিল্পীর সাধনার ধন]
রমেশ। একদিন যে ছেলেকে তুমি মানুষ করেছিলে, আর একদিন বড় হয়ে ফিরে এসে সে-ই তোমাকে চিনতে পারবে না এই কি তোমার রমেশের কাছে আশা কর জ্যাঠাইমা?
জ্যাঠাইমা। না, সে আশঙ্কা করিনি রমেশ। তবুও ত তোরই মুখ থেকে না শুনে পারিনে বাবা, জ্যাঠাইমাকে তোর মনে আছে।
রমেশ। মনে আছে মা, খুব বড় করেই তোমাকে মনে আছে। কিন্তু যা পারতাম নিজেই করতাম, তুমি কেন আবার এ-বাড়িতে এলে?
জ্যাঠাইমা। তুই ত আমাকে ডেকে আনিস নি বাবা, যে তোর কাছে তার কৈফিয়ত দেব।
রমেশ। ডেকে আনব কি মা, মা বলে যে তোমার কোলেই সকলের আগে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ি নেই বলে ত তুমি দেখা করনি জ্যাঠাইমা!
জ্যাঠাইমা। সেই অভিমানেই বুঝি নিজের বাড়ি থেকে আজ আমাকে বিদায় করতে চাস রমেশ?
রমেশ। অভিমান! যার মা নেই, বাপ নেই, নিজের জন্মভূমিতে যে নিরাশ্রয়, বিদেশী,—বিনাদোষে যাকে প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন বাড়ি থেকে দূর করে দেয় তার অভিমানের দাম কি জ্যাঠাইমা?
জ্যাঠাইমা। আমার কাছেও তার দাম নেই রমেশ?
রমেশ। না নেই। আজ নিজের ছেলেকেই শুধু ছেলে বলে জেনে রেখেচ। কিন্তু আর একটা মা-মরা ছেলেকে যে একদিন ঠিক তেমনি কোরেই মানুষ করতে হয়েছিল সে কথা আজ ভুলে গেছ।
জ্যাঠাইমা। এমনি কোরে শূল বিঁধে তুই কথা বলবি রমেশ? ঘরে-বাইরে এই শাস্তি পাব বলেই কি তোদের দুজনকে মানুষ করেছিলাম রে?
রমেশ। ঘরে-বাইরে! তাই ত বটে! (হঠাৎ পায়ের কাছে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া) আমাকে ক্ষমা করো জ্যাঠাইমা, আমি প্রাণের জ্বালায় তোমার এই দিকটার পানে চেয়ে দেখিনি।
[জ্যাঠাইমা রমেশকে তুলিয়া ডান হাত
দিয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিলেন]
জ্যাঠাইমা। জানি বাবা।
রমেশ। কিন্তু আর তুমি এ-বাড়িতে এসো না। আমার সব সইবে, কিন্তু আমার জন্যে দুঃখ পাবে এ আমার সইবে না জ্যাঠাইমা।
জ্যাঠাইমা। এ তোর অন্যায় রমেশ। দুঃখ সওয়াই যদি দরকার হয় ত তোরও সইবে, আমারও সইবে। ফাঁকি দিয়ে আরামের চেষ্টা করলে, তার ফাঁক দিয়ে শুধু আরামই বার হয়ে যায় না বাবা, ঢের বেশি দুঃখ হুড়মুড় কোরে ঢুকে পড়ে। আমাকে বারণ করবার মতলব তুই করিস নে। তা ছাড়া তোর নিষেধ শুনবোই বা কেন?
রমেশ। তোমাকে ভুলেছিলাম জ্যাঠাইমা, তাই নিষেধ করবার স্পর্ধা করেচি। আমার কথা তুমি শুনো না—যা তোমার ভাল মনে হবে তাই করো।
জ্যাঠাইমা। তাইতো করবো।
রমেশ। কোরো। কত ঝড়-বাদল, কত দুর্যোগ তোমার মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে—দূর থেকে মাঝে মাঝে আমি তার খবর পেয়েচি। কিন্তু কিছুতেই তোমাকে বদলাতে পারেনি। তেমনি অনির্বাণ তেজের আগুন তোমার বুকের মধ্যে তেমনিই দপদপ করে জ্বলচে।
জ্যাঠাইমা। তুই থাম, ছেলে-মুখে বুড়ো-কথা বলিস নে।—তা শোন। তোর বড়দার কাছে একবার গিয়েছিলি?
[রমেশ অধোমুখে নীরব]
জ্যাঠাইমা। বাড়ি নেই বলে দেখা করেনি বুঝি?
[রমেশ তেমনি নিরুত্তর]
জ্যাঠাইমা। না-ই করুক, আর একবার যা। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) আমি জানি রে, সে তোদের ওপর প্রসন্ন নয়, কিন্তু তোর কাজ ত তোকে করা চাই। সে বড় ভাই—তার কাছে হেঁট হতে তোর লজ্জা নেই। তা ছাড়া এটা মানুষের এমনি দুঃসময় বাবা, যে-কোন লোকের হাতে-পায়ে ধরে মিটমাট করে নেওয়াই মনুষ্যত্ব। লক্ষ্মী মানিক আমার—যা আর একবার। এখন হয়ত সে বাড়িতেই আছে।
রমেশ। তুমি আদেশ করলেই যাব জ্যাঠাইমা।
জ্যাঠাইমা। আর দ্যাখ, রমাদের ওখানেও একবার যা।
রমেশ। গিয়েছিলাম।
জ্যাঠাইমা। গিয়েছিলি? তোকে সে চিনতে পেরেছিল ত?
রমেশ। বোধ হয় পেরেছিল। নইলে অপমান করে বাড়ি থেকে দূর করে দেবে কেন?
জ্যাঠাইমা। অপমান করে দূর করে দিলে? রমা?
রমেশ। অপমানটা বোধ করি তার তেমন মনঃপূত হয়নি। তাই বলে দিয়েচে এবার এলে দরোয়ান দিয়ে বার করে দেবে।
জ্যাঠাইমা। রমা বলেচে? এ যে নিজের কানে শুনলেও বিশ্বাস হয় না রমেশ!
রমেশ। বড়দা ছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করে দেখো জ্যাঠাইমা।
জ্যাঠাইমা। বেণী ছিল? তবে, হবেও বা। (একমুহূর্ত পরে) কিন্তু ঠিক বলচিস রমেশ, রমা বললে বাড়ি ঢুকলে দরোয়ান দিয়ে বার করে দেবে? আমাকে ভাঁড়াস নে বাবা, ঠিক করে বল।
রমেশ। হাঁ জ্যাঠাইমা, তাই। তবে, নিজে না বলে কে তার মাসী আছে তার মুখ দিয়েই বলিয়েচে।
জ্যাঠাইমা। (নিশ্বাস ফেলিয়া) ওঃ—তাই বল। নইলে রাতও মিথ্যে দিনও মিথ্যে রমেশ, এত বড় গর্হিত কথা তার গলায় ছুরি দিলেও সে তোকে বলতে পারত না। এ সেই মাসীর কথা, তার নয়।
রমেশ। তবে কি তাদের বাড়িতেও আমাকে যেতে হুকুম করো জ্যাঠাইমা? রমাকে কি তুমি এমনি করেই জান?
জ্যাঠাইমা। জানি। কিন্তু যেতে আর বলিনে। তোর বাপের সঙ্গে তাদের চিরদিন মামলা-মকদ্দমা চলেচে, তাদের শত্রু বললেও মিথ্যে বলা হয় না, তবুও আমি জানি ও কথা রমা বলেনি। অমন মেয়ে বাবা, লক্ষ কোটির মধ্যেও সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। ও আছে বলে তবুও এই গ্রামের মধ্যে একটুখানি ধর্ম বেঁচে আছে।
রমেশ। তাকে দেখে ত সে কথা মনেও হল না জ্যাঠাইমা।
জ্যাঠাইমা। হঠাৎ হয়ও না, তবুও এ কথা সত্যি রমেশ। তা সে যাই হোক, সেখানে যখন যাওয়াই হতে পারে না তখন তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। কিন্তু এতক্ষণ যাঁরা এখানে ছিলেন এবং আমি আসামাত্রই যাঁরা সরে গেলেন তাঁদের তুই বিশ্বেস করিস নে বাবা, তাঁদের আমি চিনি।
রমেশ। কিন্তু তাঁরাই ত এ বিপদে আমার সবচেয়ে আপনার লোক জ্যাঠাইমা। তাঁদের বিশ্বাস না করলে কাদের করবো?
জ্যাঠাইমা। তাই ত ভাবচি বাবা, এ কথার জবাব দেবই বা কি! হাঁ রে, তোর নেমন্তন্নর ফর্দ তৈরি হয়ে গেছে?
রমেশ। না, এখনো হয়নি।
জ্যাঠাইমা। সেইটে একটু বুঝে-সুঝে করিস রমেশ। এ গ্রামে, আর এই গ্রামেই বা বলি কেন, সব গাঁয়েই এই। এ ওর সঙ্গে খায় না, ও তার সঙ্গে কথা কয় না,—একটা কাজকর্ম পড়ে গেলে মানুষের আর দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখা যায়, এর চেয়ে শক্ত কাজ আর নেই।
রমেশ। কেন এ-রকম হয় জ্যাঠাইমা?
জ্যাঠাইমা। সে অনেক কথা বাবা। যদি থাকিস এখানে, আপনিই সব জানতে পারবি। কারুর সত্যিকার দোষ-অপরাধ আছে, কারুর মিথ্যে অপবাদ আছে, তা ছাড়া মামলা-মকদ্দমা, মিথ্যে সাক্ষী দেওয়া নিয়েও মস্ত দলাদলি। আমি যদি তোর এখানে দু’দিন আগে আসতাম রমেশ, এত উদ্যোগ-আয়োজন কিছুতে করতে দিতাম না। কি যে সেদিন হবে আমি তাই শুধু ভাবচি।
[এই বলিয়া তিনি নিশ্বাস মোচন করিলেন]
রমেশ। তোমার দীর্ঘনিশ্বাসের মর্ম বোঝা কঠিন জ্যাঠাইমা, কিন্তু আমার সঙ্গে ত এর কোন যোগ নেই। আমাকে বিদেশী বললেই হয়,—কারো সঙ্গে শত্রুতাও নেই, দলাদলিও নেই,—আমি কাউকে অপমান করতে পারব না, সকলকেই সসম্ভ্রমে আহ্বান করে আনব।
জ্যাঠাইমা। উচিত ত তাই। কিন্তু—যাই হোক, সকলের মত নিয়ে এ কাজটা করিস বাবা, নইলে ভারী গণ্ডগোল হবে। মা বিপদ-তারিণী।
রমেশ। তুমি কি এখুনি চলে যাচ্ছ?
জ্যাঠাইমা। না এখখুনি নয়! দু’একটা কাজ পড়ে আছে সেগুলো সেরে ফেলেই যাবো। কিন্তু চাবি আমার সঙ্গে রইলো রমেশ, কাল সক্কালেই আমি নিজে এসে ভাঁড়ার খুলব।
[প্রস্থান
[ধর্মদাস, গোবিন্দ ও পরাণ হালদারের প্রবেশ]
গোবিন্দ। (রমেশের প্রতি) বাবা, এই পরাণ-মামাকে ধরে নিয়ে এলাম। আসতে কি চায়! কিন্তু আমিও ছাড়নে-বালা নই! বলি, বেণীই জমিদার আর আমার ভাগ্নে রমেশ নয়? (উপরের দিকে মুখ তুলিয়া) তারিণীদা, স্বর্গে বসে সমস্তই দেখচো শুনচো, কিন্তু এই তোমার কাছে প্রতিজ্ঞে করচি আমি, এই উঠোনের ওপর বেণীর যদি না এমনি করে নাক রগড়াতে পারি ত আমার নামই গোবিন্দ গাঙ্গুলী নয়।
ধর্মদাস। আহা, তুই থাম না গোবিন্দ। (কাশিতে কাশিতে) সে আমি ঠিক করে নেব।
[অকস্মাৎ বেণী ঘোষাল প্রবেশ করিল]
বেণী। এই যে রমেশ, একবার এলাম—বড় জরুরী কাজ—মা এসেচেন নাকি?
গোবিন্দ। আসবে বৈ কি বাবা, একশ’বার আসবে। এ ত তোমারই বাড়ি। তাই ত আমি রমেশ বাবাজীকে সকাল থেকে বলচি, রমেশ, ঝগড়া-বিবাদ তারিণীদার সঙ্গেই যাক—আর কেন? তোমরা দু’ভাই এক হও, আমরা দেখে চোখ জুড়োই! তা ছাড়া বড় গিন্নীঠাকরুন যখন স্বয়ং এসে উপস্থিত হয়েচেন, তখন—
বেণী। মা এসেচেন?
গোবিন্দ। শুধু আসা কেন, ভাঁড়ার-টাঁড়ার, করা-কর্ম যা-কিছু তিনিই ত করচেন। আর তিনি না করলে করবেই বা কে?
[সকলেই নীরব হইয়া রহিল]
গোবিন্দ। (নিশ্বাস ফেলিয়া) নাঃ—গাঁয়ের মধ্যে বড়-গিন্নীঠাক্রুনের মত মানুষ কি আর আছে? না, হবে? না বেণীবাবু, সামনে বললে খোশামোদ করা হবে, কিন্তু যে যাই বলুক, গাঁয়ে যদি লক্ষ্মী থাকেন ত সে তোমার মা। এমন মা কারু হয়?
[এই বলিয়া পুনশ্চ একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন]
বেণী। আচ্ছা—
গোবিন্দ। শুধু আচ্ছা নয় বেণীবাবু। আসতে হবে, করতে হবে, সমস্ত ভার তোমার ওপর। ভাল কথা, সবাই আপনারা ত উপস্থিত আছেন, নেমন্তন্নটা কিরকম হবে একটা ফর্দ করে ফেলা হোক। কি বল রমেশ বাবাজী? ঠিক কি না হালদার মামা? ধর্মদাসদা চুপ করে থাকলে হবে না,—কাকে বলতে হবে, কাকে বাদ দিতে হবে জান ত সব।
রমেশ। বড়দা, একবার পায়ের ধুলো যদি দিতে পারেন—
বেণী। মা যখন এসেচেন তখন আমার আসা না-আসা—কি বলো গোবিন্দ খুড়ো?
রমেশ। আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি করতে চাইনে বড়দা, যদি অসুবিধে না হয় ত একবার দেখে-শুনে যাবেন।
বেণী। সে ত ঠিক। আমার মা যখন এসেচেন তখন আমার আসা না-আসা—কি বল হালদার-মামা? তা মাকে একটু শিগগির যেতে বোলো রমেশ, বিশেষ দরকারী কাজ, আমারও এখন দাঁড়াবার জো নেই—প্রজারা সব—
[বলিতে বলিতে বেণীর দ্রুতপদে প্রস্থান
গোবিন্দ। (নেপথ্যে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া লইয়া) আরে, বেণী ঘোষাল! তুই পাতায়-পাতায় বেড়াস ত আমি তার শিরে-শিরে ফিরি। আমার নাম গোবিন্দ গাঙ্গুলী। নিজের চোখে দেখতে এসেচে মা এসেচে কিনা! বুঝি না বটে! (রমেশের প্রতি) আর দেখলে বাবা রমেশ, কেমন তোফা মিষ্টি মোলায়েম কথাগুলি শুনিয়ে দিলাম! যেন মিছরির ছুরি! আর বলবার জো নেই যে কর্মবাড়িতে গিয়ে খাতির পাইনি। লোকের কাছে যে বলে বেড়াবে, রমেশ না হয় ছেলেমানুষ, কিন্তু তার মামা গোবিন্দ গাঙ্গুলী ত উপস্থিত ছিল। বৃহৎ কাজেকর্মে কর্মকর্তা হয়ে থাকা সহজ ব্যাপার নয় বাবা, এক-একটা চাল ভাবতে মাথা ঘুরে যায়!
ধর্মদাস। তুই বড় বাজে বকিস গোবিন্দ! থাম না!
[একদিক দিয়া সুকুমারী ও তাহার মা ক্ষান্ত প্রবেশ করিয়া বাটীর অন্তঃপুরে চলিয়া গেল। পরাণ হালদার কঠিন-চক্ষে তাহাদের নিরীক্ষণ করিলেন। মুহূর্তে ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ প্রবেশ করিল]
পরাণ। ওরা বাড়ির মধ্যে গেল কারা?
ষষ্ঠী। ক্ষান্ত বামুন-ঠাকরুন আর তাঁর মেয়ে।
পরাণ। যা ভেবেচি তাই। ওদের বাড়ি ঢুকতে দিলে কে?
ষষ্ঠী। আচায্যিমশাই ডেকে এনেচেন। দু’দিন ধরে সমস্ত কাজকর্ম করচেন।
পরাণ। ওরা যদি খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করে থাকে ত কোন ব্রাহ্মণই এখানে জলগ্রহণ করতে পারবে না।
[ক্ষান্ত আড়ালে দাঁড়াইয়া বোধ হয় শুনিতেছিল,
তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া আসিল]
ক্ষান্ত। কেন শুনি হালদার-ঠাকুরপো? (রমেশের প্রতি) হাঁ বাবা, তুমিও ত গাঁয়ের একজন জমিদার, বলি সমস্ত দোষই কি এই ক্ষেন্তি বামনীর মেয়ের? মাথার উপর আমাদের কেউ নেই বলে কি যতবার ইচ্ছে শাস্তি দেবে? (গোবিন্দকে দেখাইয়া) ঐ উনি মুখুয্যেবাড়ির গাছ-পিতষ্ঠের সময় জরিমানা বলে দশ টাকা আদায় করেন নি? গাঁয়ের ষোল-আনা মনসা-পূজোর নামে দু’জোড়া পাঁঠার দাম ধরে নেননি? তবে কতবার ঐ এককথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় শুনি?
গোবিন্দ। যদি আমার নামটাই করলে ক্ষান্তমাসী, তবে সত্যি কথা বলি বাছা, খাতিরে কথা কইবার লোক গোবিন্দ গাঙ্গুলী নয়, সে দেশসুদ্ধ লোকে জানে। তোমার মেয়ের প্রায়শ্চিত্তও হয়েচে, সামাজিক দণ্ডও করেচি,—সব মানি। কিন্তু যজ্ঞিতে কাঠি দিতে ত আমরা হুকুম দিইনি? মরলে ওকে পোড়াতে আমরা কাঁধ দেব, কিন্তু—
ক্ষান্ত। মলে তোমার নিজের মেয়েকে কাঁধে করে পোড়াতে যেয়ো বাছা, আমার মেয়ের ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। বলি, হাঁ গোবিন্দ, নিজের গায়ে হাত দিয়ে কি কথা কও না? তোমার ছোট-ভাজের কাশীবাসের কথা মনে পড়ে না! হালদার-ঠাকুরপোর বেয়ানের তাঁতী অপবাদ ছিল না? সে-সব বড়লোকের বড় কথা বুঝি?
গোবিন্দ। তবে রে হারামজাদা মাগী—
ক্ষান্ত। (অগ্রসর হইয়া) মারবি নাকি রে? ক্ষেন্তি বামনীকে ঘাঁটালে ঠগ বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে। বলি, এতেই হবে, না আরও বলবো?
[ভৈরব আচার্য দ্রুতপদে প্রবেশ করিয়া]
ভৈরব। এতেই হবে মাসী, আর কাজ নেই। (ভিতরের দিকে চাহিয়া) সুকুমারী, চল দিদি, এসো মাসী আমার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে গিয়ে বসবে চল।
[ভৈরব ও ক্ষান্তর প্রস্থান]
গোবিন্দ। দেখলে পরাণ-মামা, আমাদের অপমান করে ওদের বাড়ির ভেতরে বসাতে নিয়ে চলল। দেখলে ভৈরবের আস্পর্ধা! আচ্ছা—
পরাণ। আমাদের বিনা হুকুমে ঐ দুটো ভ্রষ্টা মাগীদের কেন বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হল, রমেশ তার কৈফিয়ত দিক। নইলে কেউ আমরা এখানে জলস্পর্শ করব না।
জ্যাঠাইমা। (দ্বারের নিকট হইতে) রমেশ!
রমেশ। তুমি কি এখনো আছ জ্যাঠাইমা?
জ্যাঠাইমা। আছি বৈ কি। গোবিন্দ গাঙ্গুলীকে বল যে ক্ষান্ত-ঠাকুরঝি আর সুকুমারীকে আদর করে আমি ডেকে আনিয়েচি, আচায্যিমশাই নয়। তাঁদের খামোকা অপমান করার কোন দরকার ছিল না।
পরাণ। কিন্তু ওদের দূর করে না দিলে আমরা কেউ জলগ্রহণ করতে পারব না।
জ্যাঠাইমা। সে পরশুর কথা। আজ আমার কর্ম-বাড়িতে চেঁচামেঁচি হাঁকাহাঁকি করতে আমি নিষেধ করচি। আমি সকলকেই নিমন্ত্রণ করব, কাউকে বাদ দিতে পারব না।
পরাণ। কিন্তু আমরা কেউ এখানে জলটুকু পর্যন্ত মুখে দিতে পারব না।
জ্যাঠাইমা। আমাকে ভয় দেখাতে বারণ কর রমেশ। দেশে অনাথ-আতুর কাঙালের অভাব নেই। আয়োজন আমার ব্যর্থ হবে না।
রমেশ। (ব্যাকুলকণ্ঠে) কিন্তু সমস্ত এঁরা পণ্ড কোরে দিতে চান। এর সকল দায় যে তোমার মাথায় পড়বে জ্যাঠাইমা!
জ্যাঠাইমা। এ তোর অন্যায় রমেশ। আমার বাড়ির কাজের দায়িত্ব আমার মাথায় পড়বে না ত কি পরের মাথায় পড়বে? এখন ওঁদের যেতে বলে দে। ঢের কাজ পড়ে আছে, নষ্ট করবার সময় নেই।
[জ্যাঠাইমা অন্তঃপুরে চলিয়া গেলেন। সদর দ্বার দিয়া গোবিন্দ, ধর্মদাস
ও পরাণ হালদার ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল]
রমেশ। ভেবেছিলাম বুঝি আমার কেউ নেই,—কিন্তু সবাই আছে যার তুমি আছ জ্যাঠাইমা।