রবীন্দ্রসাহিত্যে সংস্কৃত নাটক
নাট্যসৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটে ১৮৮১ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত, অর্থাৎ, আটান্ন বছর সময় জুড়ে। তিনি পঞ্চাশটিরও বেশি নাটক রচনা করেন এবং কতকগুলির পুনর্লিখন করেন। প্রারম্ভিক পর্বের কাব্য নাটক বাল্মীকি প্রতিভা, ভগ্নহৃদয়, রুদ্রচণ্ড, সব কটিই ১৮৮১ সালে লেখা), কালমৃগয়া (১৮৮২) ও নলিনী (১৮৮৪) তাঁর তরুণ বয়সের শিল্পকর্ম। এগুলির মধ্যে বাল্মীকি প্রতিভা ও কালমৃগয়া-র বিষয়বস্তু আহরণ করা হয়েছে রামায়ণ থেকে, অন্য তিনটি মূলত তীব্র আবেগোচ্ছল রোমান্টিক কাহিনি, যা কবির নিজ কল্পনা-সৃষ্ট। ১৮৮৪ সালে রচিত হয় প্রকৃতির পরিশোধ, যার কাহিনিসূত্র পৌরাণিক জড়ভরত-এর উপাখ্যান থেকে সংগৃহীত, কিন্তু তাতে কবি তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এক মহিলা সমিতির জন্য রচিত মায়ার খেলা তাঁর নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত একটি রোমান্টিক অপেরা, যার সবটাই সঙ্গীত আধারিত। রাজা ও রাণী (১৮৮৯) নাটকের হাত ধরে আমরা এক পর্বে প্রবেশ করি, যেখানে, তাঁর নাটকে নৈতিক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান বিশেষ গুরুত্ব পায়। নাটকটির অংশ বিশেষ গদ্যে রচিত এবং উল্লেখযোগ্য নাট্যক্রিয়ায় সমৃদ্ধ। পরের বছরের রচনা বিসর্জন একটি আধা-ঐতিহাসিক নাটক যেখােেন অনুভূতি ও ধারণার গুরুতর সংঘর্ষ সুপ্রচুর নাট্যক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২)র কাহিনিসূত্র মহাভারত থেকে আহরিত, যদিও রবীন্দ্রনাথ কাহিনির মূল কাঠামোটিকে কিছু প্রথাগত মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়নের কাজে ব্যবহার করেন। একই বছরে কবি গোড়ায় গলদ প্রকাশ করেন। এটি প্রেম ও বিবাহের রোমান্টিক ধারণা নিয়ে রচিত একটি মজাদার প্রহসন। দু’বছর পর প্রকাশিত হয় কাব্য নাটক বিদায় অভিশাপ। একটি পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত এই নাটকের উপজীব্য বিষয় প্রেম ও কর্তব্যের সংঘাত। ১৮৯৬ সালের মালিনী নাটকটি বৌদ্ধ জাতক কাহিনিগুচ্ছ থেকে নেওয়া একটি আখ্যানের উপর আধারিত। বৌদ্ধ মতবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের পারস্পরিক বৈরিতা এর মুখ্য বিষয়বস্তু। এর পর ১৮৯৭ সালে তিনি রচনা করেন একটি হাস্যশ্রয়ী নাটক, বৈকুণ্ঠের খাতা। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত কাহিনী দীর্ঘ কবিতার একটি সংকলন, যার অন্তর্গত কয়েকটি রচনা নাটকীয় গুণসম্পন্ন। ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘সতী’, ‘নরকবাস’, ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’, ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ ইত্যাদি শেষোক্ত শ্রেণিভুক্ত এবং এর প্রত্যেকটিই সাবেকী মূল্যবোধের পুনমূল্যায়নের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ‘সতী’ ঐতিহাসিক এবং ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ কাল্পনিক। ১৯০৭ সালে গদ্যে রচিত দুটি অনতিদীর্ঘ রম্যরচনা হাস্যকৌতুক এবং ব্যঙ্গকৌতুক প্রকাশিত হয়। এই সময়ের নিরিখে সেগুলিকে সেকেলে ঠেকলেও এই কৌতুকী দুটিতে কিছু ধরনের সামাজিক টাইপ চরিত্রের মূঢ়তার শ্লেষাত্মক চিত্রণ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯০৮ সালে শারদোৎসব প্রকাশিত হওয়ার মুহূর্তে রূপকাশ্রয়ী, প্রতীকি এবং ব্যঞ্জনাময় নাটকের এক নতুন জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। পরবর্তী চোদ্দো বছরে তাঁর কাছ থেকে আমরা এ জাতীয় আরও পাঁচটি নাটক উপহার পাই— রাজা (১৯১০), ডাকঘর (১৯১২), অচলায়তন (১৯১২), ফাল্গুনী (১৯১৬) এবং মুক্তধারা (১৯১২)। এই শ্রেণিভুক্ত শেষ নাটক তাসের দেশ রচিত হয় ১৯৩৩ সালে। সামাজিক বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি আধা ঐতিহাসিক নাটক মুকুট (১৯০৮) ও রচিত হয় এই সময়কালে। ঋতুচক্রকে বিষয়বস্তু করে লেখা তাঁর প্রথম নাটক বসন্ত। ঋতুচক্রের আবর্তনের মধ্য দিয়ে কবি প্রকৃতির অন্তর্লীন এক শাশ্বত নাটকের আস্বাদ লাভ করেন। এই শ্রেণিভুক্ত অন্য তিনটি নাটক হল— শেষ বর্ষণ (১৯২৬), নবীনা (১৯৩১) ও শ্রাবণগাথা (১৯৩৪)।
গৃহপ্রবেশ (১৯২৫) ও চিরকুমার সভা (১৯২৬)— দুটিই সামাজিক নাটক; প্রথমটি বিয়োগান্তক এবং দ্বিতীয়টি হাস্যরসাত্মক। নটীর পূজা (১৯২৬)-র বিষয়বস্তুতে আছে বৌদ্ধ এবং ঐতিহাসিক পটভূমি; বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যবাদের সংঘাত এর উপজীব্য। কালের যাত্রা-র অন্তর্গত রথের রশিও কবির দীক্ষা ১৯৩২ সালে পরপর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রচিত হয়। চণ্ডালিকা (১৯৩৩) নাটকে জাত-পাতের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ধ্বনিত হয়। একই বছরে সামাজিক নাটক বাঁশরী প্রকাশিত হয়। ১৯৩৬ সালে কবি পরিশোধ রচনা করেন (পরে ১৯৩৯ সালে তার রূপান্তর ঘটান শ্যামা নৃত্যনাট্যে), যদিও এর আগে থেকেই তিনি পূর্বেকার নাটকগুলির পুনর্লিখন শুরু করেছিলেন।
নাটক রচনার প্রায় ষাট বছর সময়কাল জুড়ে একান্নটি নাটক (অতি ক্ষুদ্রাকার হাস্যকৌতুক ও ব্যঙ্গকৌতুক-কে হিসাবে না আনলে) এবং ছয়টি পূর্ণাঙ্গ নৃত্যনাট্য কবি আমাদের উপহার দিয়েছেন। তিনি যদি শুধু নাটক রচনাতেই নিবদ্ধ থাকতেন তাহলেও এই অপর্যাপ্ত সৃষ্টির উৎসার বিস্ময় উদ্রেককারী; কিন্তু তিনি প্রাথমিক ভাবে কবি— নাট্যকার হিসাবে তাঁর পরিচিতি নেহাতই গৌণ।
নাটক রচনা তাঁর পেশাও নয়, যদিও বেশ কয়েকটি সার্থক রচনা তাঁর হাত থেকে বেরিয়েছে। আমরা পরে এ বিষয়ে আলোচনা করব। নাটক রচনার ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি বিশিষ্ট ঘরানার প্রভাব নজরে আসে: সংস্কৃত নাটক, পশ্চিমী নাটক এবং দেশীয় যাত্রাপালা। চতুর্থ প্রভাবটি বাংলা নাটকের, যা ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে রচিত ও অভিনীত হতে শুরু করে এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এক বিশেষ আদল পায়। সেখানে তাঁর পরিবারের সদস্যরা স্থূল যাত্রাপালা থেকে কিছুটা সরে এসে তুলনামূলক ভাবে পরিশীলিত বাংলা নাটক রচনা ও প্রযোজনায় অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই সব প্রভাবগুলির মধ্যে পাশ্চাত্যের নাট্য ঐতিহ্যের প্রভাবই সবচেয়ে কার্যকর ও রূপদায়ক। সংস্কৃত নাটকের একাধিক দুর্বলতা ছিল: বিয়োগান্তক নাটক ছিল প্রায় অশুভের প্রতীক; সংস্কৃত নাট্যকারদের মতে নাটক ছিল দর্শক-শ্রোতার চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম, শুধুমাত্র এক খেলার সামগ্রী। চরিত্রায়ণ হত দুই বিরোধী রঙে, যেমন, সাদা ও কালো, অর্থাৎ চরিত্রের অন্তর্বিরোধকে এমন ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হত যাতে চরিত্রগুলোকে সহজেই ধরাবাঁধা টাইপে পর্যবসিত করা যায় এবং নাট্যকাররা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে টাইপ চরিত্রগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। কালিদাস দ্বারা তিনি গভীর ভাবে প্রভাবান্বিত। শূদ্রক জীবনের সমস্যাকে প্রকৃতার্থেই বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, তাঁকে ছাড়া ভবভূতিই একমাত্র দ্বিতীয় নাট্যকার যিনি প্রচলিত মূল্যবোধকে প্রশ্ন করেছিলেন। কিন্তু তিনি উত্তর-প্রজন্মদের স্বীকৃতি ও প্রশংসার জন্য অনির্দিষ্টকাল প্রতীক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন, কেননা তাঁর দর্শক-শ্রোতাদের রুচি তাঁর তাৎক্ষণিক গ্রহণযোগ্যতার পথে অন্তরায় ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃত নাটক স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথের উপর কোনও রকম গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তিনি তা থেকে গ্রহণ করেছেন তার বাহিরের রূপ মাত্র।
সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর যে পরিচয় ছিল, তা বোঝা যায় নাটকে সরাসরি উদ্ধৃতি ও তির্যক উল্লেখ থেকে, তা ছাড়া আগের প্রবন্ধে যেমন উল্লিখিত হয়েছে, কাব্যচর্চায় তিনি সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এই ঐতিহ্য থেকে মুক্ত হয়ে নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার মধ্যেই তাঁর নাট্যকার সত্বার বিকাশ নিহিত ছিল। এমনকী তাঁর প্রথম যুগের নাটকগুলির মধ্যেও সংস্কৃত ঐতিহ্যের ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী কালে, কবি যখন কিছু প্রাচীন প্রথার কাছে ফিরে যান, সেগুলিতে নিজস্ব জরুরি প্রয়োজনের সঙ্গে মানানসই করে নেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবেই তিনি প্রথানুগতার অন্তর্বস্তু থেকে সরে আসেন।
যে নাটকটিতে সংস্কৃত নাটকের স্পষ্ট প্রভাব নজরে আসে, তা হ’ল তাঁর প্রথম গুরুগম্ভীর নাটক রাজা ও রাণী, যার মধ্যে কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয়-র ছাপ পরিষ্কার। সংস্কৃত নাটকের মতো এই নাটকে প্রথম গদ্য শৈলী ব্যবহৃত হয়। কালিদাসের প্রিয় বিষয় প্রেম। যখন প্ৰেম এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে যে, সামাজিক দায়িত্ব অবহেলিত হতে শুরু করে তখন বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। এই শাস্তির মেয়াদকালে প্রেম মলিনতা ও প্রেমাষ্পদের প্রতি অত্যধিক দায়িত্বজ্ঞানহীন অনুরাগ থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে এবং তার পর ঘটে প্রেমীযুগলের পুনর্মিলন। এই বিষয়বস্তু কালিদাসের মেঘদূতও রঘুবংশ-রও উপজীব্য। কবি এ বিষয়ে ‘প্রাচীন সাহিত্য’ শিরোনামে প্রবন্ধও রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের নাটকে বিক্রম সুন্দরী স্ত্রীর আসক্তিতে মত্ত এবং সারা সময় তারই সঙ্গতে অতিবাহিত করার অভিলাষ তার মনে। কিন্তু রাণী সুমিত্রার ইচ্ছা তিনি পুরুষোচিত ভাবে এই মোহশক্তি থেকে মুক্ত হয়ে সততার সঙ্গে রাজকার্য্য পরিচালনা করুন:
বিক্রম: যাক গৃহ, গৃহকাজ।
সংসারের কেহ নহ, অন্তরের তুমি।
অন্তরে তোমার গৃহ, আর গৃহ নাই
বাহিরে কাঁদুক পড়ে বাহিরের কাজ।
সুমিত্রা: কেবল অন্তরে তব! নহে নাথ, নহে–
রাজন, তোমার আমি অন্তরে বাহিরে।
অন্তরে প্রেয়সী তব, বাহিরে মহিষী।
বিরোধের মূল সুরটি এখান থেকেই পাওয়া যায়। রাজা পুরূরবা তাঁর পতিব্রতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে অপ্সরা ঊর্বশীকে বিবাহ করেন এবং নিজের পুত্র ও রাজ্যপাট সামলানোর কাজ সম্পূর্ণ অবহেলা করতে শুরু করেন। দুটি নাটকেই পথভ্রষ্ট রাজাকে অনেক দুঃখকষ্ট, বিচ্ছেদ ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সংস্কৃত নাটকের সারা চতুর্থ অঙ্ক জুড়ে থাকে কাতর প্রেমিকের বিরামহীন প্রলাপ। রবীন্দ্রনাথের নাটকে রাণীর বিদায়ের সংবাদে রাজার হৃদয়বিদায়ক সংলাপ :
তুমি জান, জীবনের সব অপরাধ
তারে ভালবাসা। পুণ্য গেল, স্বৰ্গ গেল,
রাজ্য যায়, অবশেষে সে ও চলে গেল।
এবং তার পর ‘স্বপ্ন ছুটে গেছে’। তিনি আক্রমণকারী ও জবরদখলকারীদের হাত থেকে রাজ্যপাট ও প্রজাদের রক্ষা করার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন, এবং অন্যায়ের প্রতিশোধার্থে সৈন্যদল নিয়ে এগিয়ে যান। কিন্তু, ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে; এর পর রাণীর সঙ্গে যখন তাঁর দেখা হয়, রাণী আর নেই। (সংস্কৃত নাটকে বিয়োগান্তক সমাপ্তির কোনও স্থান নেই। অতএব কালিদাসের নাটকের যবনিকা পতন হয় পুনর্মিলনে। কিন্তু শেষ অঙ্কের প্রস্তাবনায় বিদূষক এসে জানায় যে রাজা রাজধানীতে ফিরে এসেছেন এবং তিনি বিবেক ও বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজকার্য সম্পাদন করছেন, প্রজারাও পরম সন্তোষে তাঁর প্রতি অনুগত আছে।)
রবীন্দ্রনাথের আর কোনও নাটকই সাদৃশ্যে সংস্কৃত নাটকের এত কাছাকাছি নয়। কিন্তু তাঁর অনেক নাটকেই সংস্কৃত মহাকাব্য, কবিতা ও নাটকের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। বাল্মিকী প্রতিভা খোলাখুলি রামায়ণ থেকে তার বিষয়বস্তু আহরণ করে; আদতে ‘ক্রৌঞ্চ’ উপাখ্যানের এক সংক্ষিপ্ত আলোচনাও এই নাটকে পাওয়া যায়। কিন্তু তারও আগে দস্যু রত্নাকরের হৃদয়মথিত হয় দুটি ছোট্ট পাখিকে দেখে এবং সে তার অনুচরদের পাখি দুটিকে হত্যা করা থেকে বিরত করে। এখানে অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এর একটি কবিতার সরাসরি প্রতিধ্বনি শোনা যায়। প্রকৃতির প্রতিশোধ-এ কোনও সংস্কৃত নাটকের প্রতিনিধিত্ব দেখা যায় না, বরং নাটকের কাহিনি জনপ্রিয় পৌরাণিক আখ্যান জড়ভরত থেকে আহরিত। জড়ভরত পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান, কিন্তু সেখানে এক পোষা হরিণের স্নেহে জড়িয়ে পড়েন। অস্বীকৃতির কথা বারবার ফিরে আসে শুধু তার নিষ্ফলতা প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে। যদিও নাগানন্দ এবং প্রবোধচন্দ্রোদয়-এর মতো নাটকসহ বহু গ্রন্থে আত্ম-অস্বীকৃতির উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
মায়ার খেলা-তে ব্যর্থ ও সার্থক দুই ধরনের প্রণয়ের বিষয়ই উপস্থাপিত হয়েছে এবং এগুলি সংস্কৃত নাটকের বহু ব্যবহৃত বিষয়বস্তু। অভিজ্ঞানশকুন্তলম নাটকে দুষ্যন্ত হংসপাদিকার পরিচিতি দেন এমন এক জন হিসাবে ‘যে একবার দয়িতের প্রেমের স্বাদ পেয়েছে।’ এখানে আমাদের প্রতিজ্ঞায়ুগন্ধরায়ন নাটকে বাসবদত্তার কথা মনে পড়ে, যার স্বামী অপর এক নারীকে বিবাহ করেন; অথবা বিক্রমোবর্শীয় নাটকে ঔসীনরী, রাজা যার ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেন; মালবিকাগ্নিমিত্র নাটকে ইরাবতী ও ধারিণী, যারা এক সময় রাজার প্রেমের স্বাদ উপভোগ করেছিল, কিন্তু মালবিকার প্রেমে রাজা পরে তাদের পরিত্যাগ করেন। এরা সকলে ভার্যা হলেও মায়ার খেলা-র প্রমদা কিন্তু তা নয়। সংস্কৃত নাটকে যে অসংখ্য সখীর, অর্থাৎ নায়িকার সহচরীর দেখা পাওয়া যায় তাদের সঙ্গে আলোচ্য নাটকের সখীদের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অরূপরতনও রাজা নাটকের সুরঙ্গমার কথা মনে পড়ে— যে পেশাগত অর্থে পরিচারিকা হলেও আদতে দাসী তথা বিশ্বস্ত সহচরীর ভূমিকা পালন করে। মহিলা বার্তাবাহক হিসাবে দূতিও রবীন্দ্রনাটকে বিশেষ চরিত্র হিসাবে আবির্ভূত হয়। বিসর্জন-এর সংঘাত নতুন, জটিল এবং তা পুরোপুরি কবি কল্পিত। এখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অনুভূতির জগৎ নিয়ে নাড়াচাড়া করা হয়েছে। রাজা ও রাণী-র দেবদত্ত ও প্রায়শ্চিত্ত-র রমাই সংস্কৃত নাটকের বিদূষক চরিত্রের নিকট আত্মীয়। অবশ্য শিল্পী হিসাবে কবির সংবেদনশীলতা গতানুগতিক টাইপ-চরিত্র সৃষ্টির মধ্যে তাঁকে আবদ্ধ থাকতে দেয়নি। অতএব, রমাই চরিত্রটিকে এক অনুদ্ধারযোগ্য গাড়ল হিসাবেই আঁকা হয়, নির্বোধ-মোসাহেবি চাটুকারিতা এবং স্থূল কৌতুকেই যার আনন্দ। অপরপক্ষে দেবদত্তকে অনেক সংবেদনশীলতার সঙ্গে গড়ে তোলা হয়, যে প্রকৃতই এক ট্র্যাজিক চরিত্রে রূপান্তরিত হয় এবং তার দুর্ভাগা দর্শক-শ্রোতাকে স্পর্শ করে। যেহেতু, সংস্কৃত নাটকের সব নায়িকাই সুদর্শনা, কুদর্শনা চিত্রাঙ্গদার কোনও আদিরূপ নেই।
গোড়ায় গলদ একটি লঘু হাস্যরসময়ী নাটক। এখানে বহু সংস্কৃত রোমান্টিক মিলনাত্মক নাটকের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, যেখানে কোনও না কোনও চরিত্র রোমান্টিক প্রেমকে উপহাস করার দায়িত্ব নেয়। শ্রীহর্ষ-র নাগানন্দ-তে পরিচয় বিভ্রান্তির নিকট সাদৃশ্য পাওয়া যায়— নায়কের প্রেমাস্পদার ভাই তথা নায়কের বন্ধু মিত্রাবসু তার কাছে বোনের বিয়ের প্রস্তাব রাখে। কিন্তু যেহেতু নায়ক কন্যার পরিচিতি সম্পর্কে অনবহিত, সেই প্রস্তাব সে দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। দুটি নাটকেই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে জট ছাড়ানো হয়।
বিদায় অভিশাপ মূলত একটি কাব্যিক সংলাপ। এর কাহিনিসূত্র মহাকাব্যের পৌরাণিক আখ্যান। কিন্তু প্রেম ও কর্তব্যের সংঘাত ঘিরে গড়ে ওঠা নাটকের বিষয়বস্তুর উদাহরণ সংস্কৃত নাটকে প্রায় নেই বললেই চলে। এটি কবির একান্তই নিজস্ব উদ্ভাবন। মালিনীও সমগোত্রীয় নাটক— পুরনো ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং বৌদ্ধধর্মের নব্য জোয়ারের সংঘাত যার উপজীব্য। সম্ভবত একাদশ শতাব্দীতে রচিত কৃষ্ণমিশ্রের প্রবোধচন্দ্রদয় নাটকের সামান্য প্রভাব পড়েছে এই নাটকের উপর। সংস্কৃত নাটকটিতে বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের বিরোধ উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলা এবং সংস্কৃত দুটি নাটকেই সংঘাতের উপস্থাপনা বাস্তবানুগ। যদিও সংস্কৃত নাটকের প্রথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রবোধচন্দ্রদয় অশুভের উপর শুভের বিজয়ে সমাপ্ত হয়, রবীন্দ্রনাথের নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যু ও বিয়োগান্তক সুরে। মালিনী-র শেষের দিককার একটি অনুচ্ছেদে বৌদ্ধধর্মান্তরিত সুপ্রিয় তার রক্ষণশীল বন্ধু ক্ষেমঙ্করকে উদ্দেশ্য করে বলে:
ক্ষেমংকর, তুমি দিবে প্রাণ—
আমার ধর্মের লাগি করিয়াছি দান
প্রাণের অধিক প্রিয় তোমার প্রণয়,
তোমার বিশ্বাস। তার কাছে প্রাণভয় তুচ্ছ শতবার।
এখানে সংঘাত একান্তই আত্মস্থ রূপ নেয়, সংস্কৃত নাটকে যা অনুভূতির জগৎ বহির্ভূত নেহাৎই মননের অনুশীলন। বৈকুণ্ঠের খাতা একটি হাস্য রসাশ্রয়ী ক্ষুদ্র নাটিকা, কিন্তু তা শেষ হয় মোহভঙ্গ এবং বিষণ্ণতার সুরে। নাটকটির বিষয়বস্তু এক সদাশয় লেখককে ঘিরে, যিনি শ্রোতা ধরার প্রচেষ্টায় নিযুক্ত এবং যাঁকে প্রত্যেক শ্রোতাই নিজ উদ্দেশ্যসাধনে ব্যবহার করে। এটি কবির নিজস্ব উদ্ভাবন, কিন্তু এখানে সংস্কৃত নাটকের মধ্যান্তরের বহু হাস্যোদ্রেককারী ঘটনার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কাহিনী-র নাট্যধর্মী কবিতাগুলির অনেকগুলিতেই বিষয়বস্তু আহরিত হয়েছে সংস্কৃত মহাকাব্য থেকে, যদিও কবিতাগুলি এতটাই আধুনিক মনন সম্বলিত যে, সেখানে সংস্কৃত নাটকের প্রভাব অনুপস্থিত। সূক্ষ্মবিচার এবং হাস্যকৌতুক-এর মতো রচনা আমাদের মহেন্দ্রবিক্রমবর্মনের মত্তবিলাস-এ চিত্রিত বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিবাদে ব্যবহৃত শুষ্ক যুক্তির কূটকচালির কথা মনে করিয়ে দেয়। শারদোৎসব-এর বিষয়বস্তু সম্পূর্ণতই কবি নিজস্ব চিন্তাভাবনার ফসল। কিন্তু ছদ্মবেশে ভ্রমণরত রাজাকে সাধারণ মানুষ হিসাবে ধরে নেওয়ার যে মোটিফ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে (গুরুও অচলায়তন এর ক্ষেত্রেও যা প্রযোজ্য) তাতে অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এর প্রথম অঙ্কে বর্ণিত দুষ্যন্তকে রাজাধিকারী হিসাবে ভুল করার ঘটনার প্রতিরূপ খুঁজে পাওয়া যায়। মুকুট-এর বিষয়বস্তু রাজনৈতিক; এর ভীরু রাজপুত্রের অসদুপায়ে রাজমুকুট জয়ের মধ্যে মুদ্রারাক্ষস-এর চন্দ্রগুপ্ত চরিত্রের অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি শোনা যায়; যদিও এই সাদৃশ্য খুব ক্ষীণ।
প্রতীকি, রূপকাশ্রয়ী বা ব্যঞ্জনাত্মক নাটকে ব্যবহৃত বিষয়বস্তু এবং তার নির্মাণ ও উন্মোচনের ক্ষেত্রে এ দাবি নির্ভয়ে করা চলে যে, সেগুলি সম্পূর্ণ অন্য ধারাশ্রিত। অবশ্যই আমাদের কাছে প্রবোধচন্দ্রোদয়, মহারাজঅপরাজ্য এবং চৈতন্যচন্দ্রোদয়— এর মতো সংস্কৃত প্রতীকি নাটকের উদাহরণ আছে, যেখানে প্রতীকিত্বকে পুনর্জন্মের তত্ত্বের আবরণে মুড়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু দুটি ধারার মধ্যে তুলনা প্রায় অর্থহীন বললেই চলে।
একটি ব্যতিক্রম অবশ্য লক্ষ্য করা যায়— রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত রূপকধর্মী নাটক এবং রূপকধর্মী অথবা প্রতীকি বৈষ্ণব নাটক এক রহস্যকে ছুঁতে চায়: নাট্যকারদের গভীর বোধ দু’ক্ষেত্রেই এক অবগুণ্ঠিত ভাষায় প্রকাশ পায় যা প্রায় অতীন্দ্রিয়তার প্রান্তবর্তী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিতে নানা স্তরে বাস্তবের এত গভীর অনুশীলন রয়েছে যে, সে সমস্ত অস্বচ্ছ এবং সর্পিল অনুসন্ধানকে একটি নাটকের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে পুরে দেওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ নাটকগুলি কখনওই সে ভাবে মঞ্চসফল হয়নি, অবশ্য, যদি না মানুষের অন্তরাত্মাকেই মঞ্চ হিসাবে কল্পনা করা হয়, যেখানে, এই যন্ত্রণাদীর্ণ সংঘাত সংঘটিত হয়। মুক্তধারা নাটকে তুলনা মিলতে পারে নাগানন্দ-র আদর্শবাদী রাজকুমারের চরিত্রের, যে হাসিমুখে নিজের বহ্নুমান তীব্র আদর্শবাদী তাড়নার স্বার্থে সিংহাসনের উপর নিজের অধিকার ত্যাগ করে। রক্তকরবী-তে বৈষ্ণব পুরোহিতের কিছু কথা আমাদের বিভিন্ন সংস্কৃত নাটকের অন্তর্গত তুলনীয় চরিত্রের মুখোচ্চারিত কাপট্যপূর্ণ সংলাপের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের শ্রেণীর লোকের ‘পরে ভগবান দুঃসহ দায়িত্ব চাপিয়েছেন, সেটা বহন করতে গেলে, আমাদের ভাগে প্রাণের সারাংশ অনেকটা বেশি পরিমাণে পড়া চাই।’ সর্বশক্তিমান ভগবানের নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ‘আমরা গোঁসাইরা সেই প্রাণেরই রাস্তা দেখাতে এসেছি।’ পার্থক্যটি হল কবি যেখানে চরিত্রটিকে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত করেন, সেখানে সংস্কৃত নাটকে এ রকম কোনও অন্তঃপ্রবাহী কিছুর দেখা মেলে না।
ঋতুচক্র নির্ভর রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলির কোনও প্রতিরূপ সংস্কৃত সাহিত্যে নেই। কিন্তু সংস্কৃত কাব্যে অনেক পূর্বসুরীর দেখা পাওয়া যায় যেখানে ঋতুগুলিকে ব্যক্তিরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। এই সব নাটকগুলিতে ব্যবহৃত গানে যে সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়াবেদন এবং কাব্যিক সৌন্দর্য্যের প্রকাশ ঘটেছে তার সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্যের কোনও রকম তুলনা বাতুলতা মাত্র। শ্রোতা-দর্শকরা যদি না নাটকের পরিবর্তে গানের জলসার জন্য প্রস্তুত থাকে তবে নাটক হিসাবে এগুলি ব্যর্থ।
আবেগানুভূতির আবেদনে পরিপূর্ণ হলেও নাটক হিসাবে সামাজিক নাটক গৃহপ্রবেশ যথেষ্ট দুর্বল এবং রক্তশূন্য। চিরকুমার সভা কিন্তু আনন্দরসে টইটম্বুর এবং যথেষ্ট মঞ্চ সফল। যে কোনও সংস্কৃত নাটকের তুলনায় এই নাটকটির উপর শেক্সপীয়রের Love’s Labour Lost এর প্রভাব অনেক বেশি। সংস্কৃত নাটকে ছদ্মবেশে বিষয়বস্তুকে পেশ করা এক অতি প্রচলিত নাট্য কৌশল। প্রায়শই সংস্কৃত গীতিকবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া, রসিকের চরিত্রে উৎকৃষ্টতর বিদূষক চরিত্রের প্রায় সম্পূর্ণটাই আত্মসাৎ করা (নাটকের অন্তিম কাব্য সংলাপ), অনেক সংস্কৃত নাটকের অনুসরণে শেষ লগ্নে দুই জোড়া বিয়ে, সখী হিসাবে পুরবালা ও শৈলবালার ভূমিকা— এ সমস্তই রবীন্দ্রনাথের নাটককে সংস্কৃত নাটকের নানা অংশের কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু, মনোভঙ্গি, সামাজিক-প্রতিবেশ এবং বিষয়বস্তু সম্পূর্ণতই কবির নিজস্ব, সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে যার কোনও মিল নেই। চিরকুমার সভা-য় এক দিকে কৌমার্য ব্রত ধারণের দৃঢ় সংকল্প ক্রমে তরলায়িত হয়ে আসা, এবং অন্য দিকে দুই কুমারী-র দুর্বল প্রতিরোধ, আমাদের বররুচি উভয়াভিসারিকা-র ‘ভাণ’ এর কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে পরস্পর বিচ্ছিন্ন প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের কলহ ও সাময়িক বিচ্ছেদের কালে সহজাত প্রবৃত্তিবশে পরস্পরের কাছাকাছি আসছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না মধ্যস্থের ভূমিকা সম্পূর্ণ নিস্ফলতায় পর্যবসিত হয়। অবশ্য, কবি এই নাটকীয় স্বগতোক্তির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহের অবকাশ আছে।
চণ্ডালিকা-র সঙ্গে সম্ভবত শ্রীহর্ষের নাগানন্দ-র কষ্টকল্পিত তুলনা চলে। দুটি নাটকেই মুখ্য চরিত্ররা প্রাণের মূল্যে নিজেদের বিশ্বাসে অটল থাকে। কিন্তু সাদৃশ্য শুধু ওইটুকুই, কেননা, নাটক দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিক ও আদর্শগত জগতে বিচরণ করে এবং শ্রোতা-দর্শকমণ্ডলীর প্রতিক্রিয়াও সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে বয়।
যথেষ্ট দুর্বল সামাজিক নাটকটি এমন এক বায়বীয় আদর্শবাদের ভূমিতে কল্পিত হয় যে, শ্রোতা-দর্শকের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ছোট উপন্যাস চতুরঙ্গ-তে এর ঝাপসা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে এর কোনও রকম তুলনাই চলে না। অবশেষে, শ্যামা— বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে আহরিত এর বিষয় এতটাই নৈতিক প্রশ্নাবলী নিয়ে ব্যস্ত যে, তা পার্থিব স্তরের সংঘাতকে এড়িয়ে যায়, যদিও বেশির ভাগ সংস্কৃত নাটক সেই স্তরেই বিচরণ করে। ঈশ্বরের এবং/অথবা মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্নে এই সার্বক্ষণিক চিন্তার আচ্ছন্নতা বেশির ভাগ সংস্কৃত নাটকেরই আওতা বহির্ভূত, অবশ্যই, যদি না আমরা ভবভূতির উত্তররামচরিত-কে দৈব এবং সামাজিক সুবিচারের নিরিখে এবং শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক-কে সামাজিক ন্যায্যতার আলোতে পুনর্মূল্যায়ন করি। সেটা যে করা যায় না তা নয়— এবং অবশ্যই তা করা উচিত, যদিও সাবেকি চর্চায় তার প্রচেষ্টা হয়নি। হতেই পারে যে, রবীন্দ্রনাথ এই সংস্কৃত নাটকগুলির অন্তঃস্থ বৃহত্তর নৈতিক পটভূমি এবং গভীরতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের তাৎপর্য্য আবছা ভাবে হলেও টের পেয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি পাশ্চাত্য নাটকের— বিশেষত গ্রিক এবং শেক্সপীয়রের নাটকের মাধ্যমেই এই প্রশ্নগুলির সম্মুখীন হয়েছিলেন তাঁর উপর এই পাশ্চাত্য পূর্বসূরীদের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাই তুলনামূলক ভাবে বেশি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল যে, তাঁর নিজস্ব বোধবুদ্ধি তাঁকে শিখিয়েছিল জীবনকে ধীরস্থির এবং সার্বিক ভাবে দেখতে। আর এই দূরদৃষ্টিই রেখে গেছে এমন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ঐশ্বর্য্য।
পরের দিককার নাটকগুলিতে রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত নাটকে ব্যবহৃত দুটি কৌশলগত প্রথার আশ্রয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। প্রস্তাবনায় সূত্রধরের বন্দনা স্তর এবং নাটকের শেষে বর্ষীয়ান অথবা সম্মানিত ব্যক্তি দ্বারা উচ্চারিত আশীর্বাচনিক শ্লোকে। চিরকুমার সভা-য় কালিদাসের বিক্রমোর্বশীয়-র ভারতবাক্যের আক্ষরিক উদ্ধৃতি নজরে আসে। শ্যামা-র আদি রূপ নৃত্যনাট্য পরিশোধ-এ পর্দার আড়াল থেকে একটি বাংলা কবিতা উচ্চারিত হয় যা আদতে একই উদ্দেশ্য সাধন করে। গুরু-র শেষেও একই ধরনের একটি গান আছে। রাজা নাটকের পরবর্তী কালের রূপ অরূপরতন এর শুরুতেই একটি গান আছে যাকে কবি সংস্কৃত প্রথার অনুসরণে ‘প্রস্তাবনা’ বলে বর্ণনা করেছেন। শেষের গানটি এখানে ভরতবাক্য। আরও পরবর্তী কালের সংক্ষিপ্ততর রূপ শাপমোচন-এ প্রথমে ও শেষে ব্যবহৃত গান দুটি যথাক্রমে প্রস্তাবনা ও ভরতবাক্যেরই সমগোত্রীয়। এই গানগুলি হল বিষয়বস্তুর কাব্যিক নির্যাস সম্পর্কিত কবির মন্তব্য এবং সারাংশ। শারদোৎসব-এর পরবর্তী কালের সম্পাদিত রূপ ঋণশোধ-এ একটি মূলবিষয়সূচক গান আছে নাটকের প্রারম্ভে এবং শেষে। প্রায়শ্চিত্ত-র সংশোধিত রূপ পরিত্রাণ নাটকটি মূল সুরের উপর বেশ একটি উপযোগী গানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। রাজা ও রাণী-র পরবর্তী কালের সম্পাদিত রূপ তপতী মূল বিষয় নির্দেশক একটি গানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এবং শেষ হয় নায়িকা সুমিত্রার কণ্ঠোচ্চারিত ঋক্বেদের শ্লোকের মাধ্যমে; আরও একটি দীর্ঘতর ঋগ্বেদের অনুচ্ছেদ যথার্থ ভরতবাক্য হিসাবে আবৃত্তি করা হয়। অতএব, কবি সংস্কৃত নাটকের ধারা অনুসরণে প্রস্তাবনা ও অন্তিম সংলাপের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। কিছু নাটকে সংস্কৃত শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে, আবার অন্য কিছু নাটকে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলা কবিতা বা গান, যেগুলি মূলত একই উদ্দেশ্য সাধন করে।
সংস্কৃতে ব্যবহৃত নাট্যকৌশল অনুযায়ী নায়ককে অবশ্যই হতে হবে সুপরিচিত পরিবারে জন্ম নেওয়া এক পূতচরিত্র রাজা। রবীন্দ্রনাথের অনেক নাটকেই নায়ক এক রাজা, যেমন, মুকুট, রাজা ও রাণী, চিত্রাঙ্গদা, অরূপরতন, মুক্তধারা এবং বিসর্জন। সামাজিক নাটকে নায়কেরা সব সম্পদশালী সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য— যেমন, বৈকুণ্ঠের খাতা, গোড়ায় গলদ, বাঁশরী এবং চিরকুমার সভা। কিন্তু এ কথা ও মনে রাখতে হবে যে এই সমাজটাকেই কবি কাছ থেকে দেখেছেন, চিনেছেন, অতএব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার রূপ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন সুতরাং, সামাজিক নাটকে অন্য কোনও প্রভাবের সন্ধান করা নিরর্থক। অন্য সব নাটকে তিনি হয়তো ঐতিহ্য মেনে চলেছেন, সেই ঐতিহ্য শুধু বিশিষ্ট ভাবে ভারতীয় নয়, প্রতিটি দেশের ধ্রুপদী নাটকের ক্ষেত্রেই একই কথা বলা যায়
সংস্কৃত নাট্যকৌশলে বিষয়বস্তুকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়— আধিকারিক এবং প্রাসঙ্গিক, অর্থাৎ মূল কথাবস্তু এবং উপকাহিনি। কবি রাজা ও রাণী নাটকে পরবর্তী কালে যে রদবদল ঘটিয়েছিলেন সেই পরিবর্তিত রূপের ভূমিকায় তিনি স্বীকার করেছেন যে ইলা ও কুমারকে ঘিরে যে উপকাহিনি ব্যবহার করা হয়েছিল তা সঠিক নয়। সাধারণ ভাবে তাঁর নাটকে এর কোনও ভূমিকা নেই, বরং তাতে মধ্যান্তরিক কোরাসের ব্যবহার আছে। কিন্তু কাঠামোগত ভাবে সেগুলি একমাত্রিক, কিছু সামাজিক ও ঐতিহাসিক নাটক ব্যতিরেকে যেখানে মূল কাহিনি এবং উপকাহিনি পরিণতিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
সংস্কৃত মঞ্চরীতির প্রথা অনুসারে মঞ্চে মৃত্যুর প্রদর্শন নিষিদ্ধ। নটীর পূজা, মালিনী, রাজা ও রাণী এবং তপতী নাটকগুলির কথা বাদ দিলে অন্য নাটকে হত্যা প্রদর্শিত হয় না, কিন্তু মৃতদেহ মঞ্চে আসে: রক্তকরবী, বিসর্জন, প্রকৃতির প্রতিশোধ। মুক্তধারা-তে আমরা মৃত্যুর কথা শুনতে পাই:
রণজিৎ: এ যে সঞ্জয়! অভিজিৎ কোথায়?
সঞ্জয়: মুক্তধারার শ্রোত তাঁকে নিয়ে গেল, আমরা তাঁকে পেলুম না।
সংস্কৃত নাটকে প্রবেশক, বিয়কম্ভক, অঙ্কমুখ, অঙ্কাবতার চরিত্রগুলি নাটকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে দর্শক-শ্রোতাদের পরিচিত করায়। প্রস্তাবনা চরিত্ররা পূর্বের ঘটনার বিবরণ দেয়, আগামী ঘটনাপ্রবাহ প্রস্তাবনায় মধ্যান্তরের প্রকৃতি এবং দুই অঙ্কের মধ্যবর্তী বিরতি সম্পর্কে দর্শক-শ্রোতাদের প্রস্তুত করে। চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে মদন ও বসন্ত নামক দুটি পার্শ্বচরিত্র মুখ্য দৃশ্যগুলির মাঝখানে মাঝখানে চিত্রাঙ্গদার মানসিক বিক্ষেপ কখন কোন স্তরে আছে তার বর্ণনা দেয়। প্রকৃতির প্রতিশোধ-এ সাধারণ মানুষ ঘটনার বিবরণ দেয়, কাহিনির চলনে হস্তক্ষেপ করে এবং হাসি-কৌতুকের মধ্য দিয়ে মনোযোগ ভিন্নমুখী করে তোলে। রক্তকরবী-তে সাধারণ মানুষজনের নিজেদের মধ্যকার অথবা দাদাঠাকুরের সঙ্গে কথোপকথন প্রবেশক, ইত্যাদির উদ্দেশ্য পূরণ করে। আমাদের মনে পড়ে যে ভবভূতির মহাবীরচরিত-এর ষষ্ঠ অঙ্কে রামের কাছে পরশুরামের পরাজয়ের খবর আসে একটি অপ্রধান চরিত্রের মুখ থেকে। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-র ষষ্ঠ অঙ্কের প্রথম বিরতিতে এক ধীবরের হারানো আংটি খুঁজে পাওয়ার সংবাদটি নাটকটির পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়, এবং একই অঙ্কের দ্বিতীয় মধ্যস্তরে নায়কের অনুশোচনার বর্ণনা দেওয়া হয়। ভবভূতির মালতীমাধব-এর প্রথম অঙ্কে একই কৌশল ব্যবহার করা হয় যেখানে অবলতিকা ও কামন্দকী-র সংলাপের মধ্য দিয়ে ঘটনাপ্রবাহের প্রতিবেদন পেশ করা হয়। পূর্ববঙ্গে সংস্কৃত নাটকের বিস্তারিত প্রস্তাবনায় রঙিন কাপড়ে মোড়া একটি বাঁশকে আচার মেনে জর্জর নামে পুজোর রীতি আছে। নাটকের মূল ভাব প্রকাশিত হয় ব্যবহৃত কাপড়ের রঙের মাধ্যমে, কারণ প্রতিটি রস ও ভাব প্রথাগত ভাবে এক একটি রঙের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রবীন্দ্রনাথের ব্যঞ্জনাত্মক তথা প্রতীকি নাটকের বেশ কয়েকটিতে প্রারম্ভিক দৃশ্যে রাজা অথবা কোনও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে দিয়ে, নাটকটি কী বিষয়ে, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করানো হয়।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার নাটকে শুধু পদই ব্যবহৃত হয়েছে। পরবর্তী কালে ঋতু আবর্তনকে উপজীব্য করে লেখা নাটকগুলিতে অন্তঃস্থ রূপকাত্মকতা শুধু গানের মাধ্যমেই সার্থক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু, সাধারণ সংলাপের জন্য গদ্যই ব্যবহার করেছেন; তীব্র মানসিক ভাব প্রকাশের জন্য ইতস্তত গানের ব্যবহার রয়েছে। অবশ্যই মালিনী ও আরও কয়েকটি নাটকও ব্যতিক্রম। কিন্তু সেগুলিকে ঠিক নাটক না বলে নাট্যকাব্যই বলা ভাল। এখানে তিনি সংস্কৃত রীতির কাছাকাছি। শেষের পর্বের অবক্ষয়ী সংস্কৃত নাটক যখন মঞ্চ ছেড়ে শ্রব্যকাব্য বা শ্রুতিনাটকের দিকে মোড় নেয় তখন সেখানে শুধু কবিতাই ব্যবহার করা হয়, যেমন, মহানাটক। রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাটকগুলি অবশ্যই অবক্ষয়ী নয়, তারা এক ভিন্ন ঘরানার প্রতিনিধি। তীব্র অনুভূতি একমাত্র কবিতার অবিচ্ছিন্ন ব্যবহারের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করা যায়। নাট্যক্রিয়া এখানে সম্পূর্ণতই কাব্যিকতার অধীন। যে গান ও নাচ এক সময় সংস্কৃত নাটকের শরীরে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিল তাকে ধীরে ধীরে আঙ্গিকসর্বস্বতা (formalism)-র দোহাই পেড়ে বাতিল করা হল, শুরু হল অবক্ষয়। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে চলনটি বিপরীতমুখী; বয়সকালের আরও পরিণত বোধ নিয়ে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, তাঁর নাট্যকৃতিতে সত্যিকারের নাট্যক্রিয়াভিত্তিক সারবস্তুর বড়ই অভাব। তিনি আগের নাটকগুলিতে নৃত্যনাট্যের রূপ দেন যা কথা, ক্রিয়া, সাজপোশাক, কবিতা, গান, মুকাভিনয়, কোরিওগ্রাফি এবং প্রধানত নাচ অথবা নৃত্যভঙ্গিমার মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে। বোঝা যায় তিনি তাঁর ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা দুটির সম্পর্কেই সচেতন ছিলেন। তাই তিনি আগেকার নাটকগুলির পরিবর্তন ঘটিয়ে সেগুলিকে এক সমৃদ্ধতর ঐকতানে বাঁধলেন যা তাঁর মঞ্চ নাটকগুলির খামতিগুলিকে সার্থক ভাবে দূর করতে সমর্থ হবে।
সব কথা বলার পর বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথের উপর সংস্কৃত নাটকের প্রভাব নেহাৎই অকিঞ্চিৎকর। সংস্কৃত নাটকের কাঠামো বা রূপে তাঁর আধুনিক পরিশীলিত মন তথা নান্দনিক অনুরাগ তৃপ্ত করার মতো প্রায় কিছুই ছিল না। তাই তিনি সংস্কৃত নাটকের তুলনায় পাশ্চাত্য ও দেশী নাটকের প্রতি অনেক বেশি আকর্ষণ অনুভব করেন। নাট্যকার হিসাবে তাঁর বিকশিত হয়ে ওঠার সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে সমীক্ষা করলে বোঝা যায় যে, তিনি সংস্কৃত নাটকের রীতিনীতির ঐতিহ্য থেকে ক্রমাগত দূরে সরে আসছিলেন।