অমৃতের পথে: রবীন্দ্রকাব্যে মৃত্যু-প্রসঙ্গ

অমৃতের পথে: রবীন্দ্রকাব্যে মৃত্যু-প্রসঙ্গ

বালকবয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্রাহ্ম পিতার শিক্ষায় পরিণত হতে থাকেন। এক মঙ্গলময় বিধাতার অর্থপূর্ণ, সুসমঞ্জস জগতে স্থাপিত হয় তাঁর বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে মৃত্যুর পর আত্মা অসীমের অঙ্গীভূত হয়। এই মনের কাছে মৃত্যু ভীতিজনক নয়, কারণ তাতে মানুষের চূড়ান্ত বিনাশ। কিন্তু অভিজ্ঞতা এই বিশ্বাসের ভূমিতে আঘাত হানে এবং তা ততদিন পর্যন্ত ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে, যতদিন না তিনি তাঁর নতুন আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণার্থে এক দর্শন গড়ে তুলতে বাধ্য হন। এই দর্শন গতিশূন্য কিছু নয় বরং বার বার তার রদবদল ঘটে; কারণ, কবির অন্তর্গত চাহিদা নতুন থেকে নতুনতর গতিময় সূত্রবদ্ধতার দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়, যা কখনও কখনও পূর্বেকার অবস্থানের মৌলিক অস্বীকৃতি হয়ে দাঁড়ায়।

১৮৭৫ সালে চোদ্দো বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু। এর পর তেইশ বছর বয়সে ১৮৮৪ সালে তিনি পরম ভালবাসার জন ভ্রাতৃবধূকে হারান। এই সময়কালে আমরা এমন কোনও কবিতার সাক্ষাৎ পাই না যা গভীর ভাবে মৃত্যু বিষয়টিকে ছুঁয়ে যায়। বিখ্যাত কবিতা ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান’, কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যায় কবির হৃদয় নিঙড়ানো বেদনার্ত প্রতিক্রিয়া। ১৮৮৬ সালের আর একটি বিখ্যাত কবিতা— ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’— মানুষের পৃথিবীই একমাত্র জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে, এই বোধের অনুক্ত স্বীকৃতি। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু কবির মনে যে আঘাত হানে তা এতই আকস্মিক এবং মর্মন্তুদ যে কবিতায় আমরা তার গুটি কয়েক সরাসরি প্রতিফলন মাত্ৰ লক্ষ্য করি। তিনি ভিতরে ভিতরে এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুঝেছেন এবং এর পর যখন মৃত্যু বিষয়টিকে অবলম্বন করে ‘মৃত্যু স্বপ্ন’ (১৯৮০) রচনা করেন তখন মৃত্যু এক সুখকর, প্রায় মনোহারী রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি যেন এক রাজহংসের পৃষ্ঠারূঢ় হয়ে উড়ে চলেছেন। তার নিস্পন্দ আঁখিপাতে মৃত্যু নেমে আসে ঘুম হয়ে, স্বপ্ন হয়ে।

মৃত্যুর রূপ

এর পর সমষ্টিগত মৃত্যুর অভিঘাত আসে: পুরীর অদূরে এক জাহাজ দুর্ঘটনায় কিছু যাত্রীর মৃত্যু হয়। তথাকথিত দয়াময় ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কারে তিনি বলেন যে, বাস্তবে এক অন্ধশক্তি নির্বিকারে প্রাণনাশ করে এবং সেই শক্তির কাছে আর্জি জানানো নিরর্থক; জীবনে একমাত্র শুভশক্তি হল ভালবাসা। ভালবাসা ও মৃত্যু, জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক শক্তি পারস্পরিক যুদ্ধে লিপ্ত: মৃত্যু সম্পর্কিত তাঁর পরবর্তী কালের মনোভাবের মূল সুর আমরা এখান থেকেই পেয়ে যাই।

সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় (‘যেতে নাহি দিব’, ১৮৯৪) প্ৰেম মৃত্যুকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়, প্রেমাষ্পদ বিদায় নেয়। মানুষের পৃথিবীতে মৃত্যু নিষ্ঠুর, যা বলপূর্বক স্নেহের বন্ধন ছিন্ন করে। কিন্তু মহাজাগতিক সহকল্পনায় তা অনুমোদিত এবং মানুষ এক অপূরণীয় ক্ষতির বোধ নিয়ে বেঁচে থাকে। অন্য একটি কবিতায় মৃত্যু এক আকর্ষণীয় ঘটনা হিসাবে প্রকাশিত হয়, যা ঐশ্বর্য্যশালী, গভীর ও সুরভিত। কবি মৃত্যুকে আলিঙ্গনে জড়াতে চান, কিন্তু এই জগৎ জীবনে ক্লান্তি অনুভব করা অবধি আরও কয়েক বছর সময় ভিক্ষা করেন (‘প্রতীক্ষা’)। এ যেন এক ক্লান্ত পথিকের রূপকল্প- ক্লান্তির শেষে স্বাভাবিক সহানুভূতিপূর্ণ পরিসমাপ্তি, আঘাত জর্জরিত আত্মার যন্ত্রণা উপশমের প্রলেপ। সোনার তরী কাব্যগ্রন্থে প্রথম মৃত্যুর প্রতিমা উপস্থিত হয় বিয়ের পাত্র হিসাবে (‘মরণ’), এক পরিপূর্ণতার চিত্রকল্পে: মৃত্যু জীবনকে পরিপূর্ণ করে। এক বিপরীত রূপকল্প আমরা প্রত্যক্ষ করি ‘মানব সুন্দরী’ কবিতায় যেখানে মৃত্যু প্রেমিক রূপে আবির্ভূত; যা অশুভ ও অনাকর্ষণীয় মৃত্যুকে প্রেমাষ্পদ হিসাবে গ্রহণ করার প্রচেষ্টা। ‘ঝুলন’ কবিতায় শুনতে পাই এক নতুন সুর, যেখানে কবির সত্ত্বা ও জীবন এক দোলনায় দোদুল্যমান: পরিশেষে অনিবার্য মৃত্যু— শেষের দোলায়। এই মরণ খেলার উত্তেজনা ও শিহরণ প্রকাশে বেপরোয়া; ভয়ংকর রাত্রিকালের দ্যোতনা আমাদের সম্মোহিত করে।

চিত্রা কাব্যগ্রন্থে (১৮৯৬) পাই এক নতুন ভঙ্গি, নতুন মেজাজ। এক সুপরিচিত কবিতায় (‘এবার ফিরাও মোরে’) কবি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন দেশপ্রেমিকদের প্রতি, যারা যুগে যুগে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছে— যে মৃত্যু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রাতিনিধিক এবং অন্যের মঙ্গলার্থে।

‘মৃত্যুর পরে’ কবিতায় তিনি বিষয়বস্তু হিসাবে ব্যক্তির মৃত্যুকে বেছে নেন। স্পষ্টত, এটি কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া, তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা। ব্যক্তির মৃত্যু চূড়ান্ত; লোকান্তরিত আত্মার কাছে তা এক আনন্দদায়ক পরিসমাপ্তি হতে পারে, কিন্তু তা জীবন্ত মানুষের মনে এক বেদনাদায়ক শূন্যতা রেখে যায়। এ ধরনের মৃত্যু কোনও পরিপূর্ণতা নয়। অতএব, সার্বিক অস্তিত্বের সংকল্পনায় তা বিচ্যুতি। অন্ধের মতো অর্থের সন্ধানে ফিরে কবি লেখেন:

হেথায় যে অসম্পূর্ণ,
সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত,
কোথাও কি একবার
সম্পূর্নতা আছে তার
জীবিত কি মৃত।

‘মৃত্যুর পরে’

এটি ব্রাউনিং এর ‘broken arcs’ এর মতো কোনও ব্যবস্থা সূত্র নয়, এ এক উত্তরহীন প্রশ্ন যা স্পন্দমান প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।

চৈতালী (১৮৯৬) কাব্যগ্রন্থের মৃত্যুবিষয়ক কবিতাগুলিতেও একই রহস্যবোধ কাজ করে। সেখানেও মানুষের অন্তিম গন্তব্য নিয়ে ‘কী’ও ‘কেন’-র একই ধুয়ো শুনতে পাই। এই বস্তু জগৎকে তীব্র বিদ্রুপে জর্জরিত করে কবি বলে ওঠেন, ‘মা বলিয়া ভুলাইব তোমারে, পিশাচী।’ (‘ভয়ের দুরাশা’) এতদ্ সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক কবিতায় মৃত্যুর ভয়ংকর রূপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যু সেখানে যেন স্নেহময় নববিবাহিত পুরুষ, যার প্রথম আহ্বানে নম্র, লাজুক নবপরিণীতা অপরিচিতের ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এই ভীতি অন্তর্হিত হয় যখন সে মৃত্যুকে তার পূর্ণতায় অর্থাৎ মহাজাগতিক সংকল্পনার অঙ্গ হিসাবে দেখে।

কণিকা (১৮৯৯) কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় এক বিপরীত ন্যায় রূপ (syllogism)-এ কবির মর্মস্পর্শী প্রচেষ্টার প্রকাশ ঘটে:

ওগো মৃত্যু, তুমি যদি হতে শূন্যময়
মুহূর্তে নিখিল তব হয়ে যেত লয়।

আদতে কবি স্বপ্নচারিতার মাধ্যমে অজানার শূন্যতা পূরণে প্রয়াসী; এক সমন্বয় সাধনের অভিলাষ, যা মৃত্যুর শূন্যতায় তাৎপর্যের মাত্রা যুক্ত করবে।

কল্পনা (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে মৃত্যু সম্পর্কে বাজে অন্য এক সুর— নির্ভার, চপল :

আমরা দোঁহে ঘেঁষাঘেঁষি
চিরদিনের প্রতিবেশী,
বন্ধুভাবে কণ্ঠে সে মোর
জড়িয়ে দেবে বাহুপাশ,
বিদায়-কালে অদৃষ্টেরে
করে যাব পরিহাস।

‘হতভাগ্যের গান’

এই তাচ্ছিল্য, উপহাস, অবাধ্যতা, মৃত্যুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বেশ নতুন। জীবনে যা কিছু দুর্বল, যা বিশুষ্ক, মূল্যহীন এবং তাকে ঘিরে জমে ওঠা যে লজ্জা ও অপমান, তার অবসানকল্পেও মৃত্যু আবির্ভূত হতে পারে। মৃত্যুর এ এক নতুন ধারণা যা পরিশুদ্ধ করে, পুনরুদ্ধার করে।

নৈবেদ্য (১৯০১) কাব্যগ্রন্থে খুঁজে পাই ঈশ্বরে দৃঢ়বিশ্বাসী কবিকে, একমাত্র সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই যাঁর রাজকীয় উপলব্ধি :

মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ,
দুঃখ সে হয় দুঃখের কূপ,
তোমা হতে যাব স্বতন্ত্র হয়ে
আপনার পানে চাই।

১৪ নং কবিতা

মৃত্যু আসতে পারে ঈশ্বরের বাণী হয়েও:

তোমার সেবার মহৎ প্রয়াস
সহিবারে দাও ভকতি
….জীবনে মরণ করিয়া বহন
প্রাণ পাই যেন মরণে।

২০ নং কবিতা

অথবা,

স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে,
মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।

৯০ নং কবিতা

মাতৃরূপের কল্পনা, অজ্ঞতাপ্রসূত সাময়িক দুঃখকষ্ট, ত্রাণ ও আশ্রয়ের অনুষঙ্গ যা এক মহত্তর প্রজ্ঞা ও ভালবাসা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত-এ সবই কবির পরজন্ম ও এক স্নেহশীল ঈশ্বরে বিশ্বাসের ইঙ্গিত। তাঁর স্ত্রী বিয়োগের এক বছর পর প্রকাশিত হয় একটি গভীর আন্তরিক ক্ষুদ্র কাব্যগ্রন্থ— স্মরণ (১৮৯৩)। এখানে প্রিয়তমার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে মৃত্যু স্বয়ং হয়ে ওঠে পরম প্রিয়, যা জীবিত ও মৃতের মধ্যেকার ব্যবধান কমায় মাত্ৰ।

শিশু কাব্যগ্রন্থে (১৯০৩) মৃত্যুর একটিই মাত্র অনন্য কাব্য প্রতিমা আছে :

ঝঞ্ঝা ফিরে জগত্তলে,
তরণী ডুবে সুদূর জলে,
মরণ-দূত উড়িয়া চলে,
ছেলেরা করে খেলা।

আমাদের স্মরণে আছে যে, শিশু রচিত হয় তাঁর মাতৃহারা অসুস্থ সন্তানদের জন্য, যাদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয় তাদের মাতৃ-বিয়োগের অব্যবহিত পরে। কবি তখন যেন দিন যাপন করছিলেন এক মৃত্যু ছায়াময় উপত্যকায়। খেলায় মগ্ন নিষ্পাপ শিশুর দল জানেনি, অতি নিকটেই ছিল মৃত্যুর আনাগোনা। শর বিদ্ধ হন কবি। মৃত্যুর অবিশ্রান্ত নির্মমতায় কবি উপনীত হন হৃদয় নিঙড়ানো উপলব্ধিতে। কাদম্বরী দেবীর প্রয়াণের পর এই সব মৃত্যুই তাঁকে মৃত্যু নামক কঠোর বাস্তবের সবচেয়ে কাছে নিয়ে আসে।

উৎসর্গ (১৯০২-০৩) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত এক স্মরণীয় কবিতায় (‘মরণ’) মরণজনিত আঘাত লাঘবের জন্য মৃত্যুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার এক মরিয়া প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যুকে তিনি আবাহন করেন প্রেমিক রূপে, শিব রূপে, যার জন্য পার্বতী বহু বছর ব্যাপী কঠোর আত্মনিপীড়ন স্বীকার করেন এবং অবশেষে তাঁকে পতি হিসাবে লাভ করেন। মৃত্যুর এই সন্তর্পণী অভিযানে কবি বিপর্যস্ত বোধ করেন এবং চূড়ান্ত হিংস্র আঘাতে তাঁর জীবন নিঃশেষিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় বলে মনে হয়। পরিবর্তে, তিনি মৃত্যুকে বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হতে অনুনয় করেন— তা হলে কবি ছুটে যাবেন তাকে স্বাগত জানাতে। পর্যায়ক্রমে দুটি চলনের পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়: মৃত্যুকে তার প্রকৃত স্বরূপে দেখা এবং মৃত্যুর কাম্য রূপে তাকে দেখার প্রচেষ্টা, অর্থাৎ জীবনের জবরদস্তিমূলক ছেদ নয়; রাজকীয়, সমারোহপূর্ণ, বিজয়দীপ্ত অবসান। দ্বিতীয় চলনে এক অতি প্রতীক্ষিত বিবাহের পাত্রের রূপকল্প দেখতে পাই।

অন্য একটি কবিতায় (৪৬নং) তিনি বলেন:

কে চাহে সংকীর্ন অন্ধ অমরতাকূপে
এক ধরাতলমাঝে শুধু একরূপে
বাঁচিয়া থাকিতে। নব নব মৃত্যুপথে
তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে।

গীতাঞ্জলি (১৯১০)-র আগে পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুবিষয়ক কবিতায় কোনও প্রকৃত গভীরতা বা তাৎপর্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। আগেকার যৌন অনুষঙ্গযুক্ত মিথ এবং কল্প-প্রতিমার ব্যবহার এখানেও অব্যাহত, যা আরও বিশদ ও সৃজনী সম্পদ সমৃদ্ধ। এক পরিপূর্ণ সমৃদ্ধ জীবনই মৃত্যুর কাছে যোগ্যতম অৰ্ঘ্য:

মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে
সেদিন তুমি কী ধন দিবে উহারে।
ভরা আমার পরানখানি
সমুখে তার দিব আনি,
শূন্য বিদায় করব না তো উহারে—

১১৪ নং কবিতা

একটি গানে শুনি:

আছ তুমি এই জানা তো জানি
যাব ধরি সেই ভরসার তরী।
খেদ রবে না এখন যদি মরি।

অস্বীকারের ভিত্তি

স্পষ্টত, সমস্ত অনুভূতি ও সংকল্পবৃত্তি নিয়ে তিনি নিরন্তর এক বিশ্বাস নির্মাণে ব্রতী যা মৃত্যুর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে সক্ষম। নির্বাপণ হিসাবে মৃত্যুর ধারণার সঙ্গে জগতের সাধারণ দার্শনিক সংকল্পনার সামঞ্জস্য সাধনও এই প্রয়োগের অঙ্গ। কবি এখন এক ‘অখণ্ড’-র স্বপ্নপিয়াসী, একমাত্র সে-ই সার্থক ভাবে ধ্বংস-ভীতিজনিত অসাড়তা বা পঙ্গুতার সঙ্গে যুঝতে এবং তাকে প্রতিহত করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করতে চেষ্টা করেন যে, এই ভীতি বাস্তবের স্বরূপ সম্পর্কিত মানুষের আংশিক খণ্ডিত উপলব্ধির ফসল, যেখানে মৃত্যু চূড়ান্ত রূপে উপস্থিত হয়। তিনি প্রেমকে সম্বল করে তার বিরুদ্ধাচরণ করেন; সেই প্রেম যা দৃশ্যমান জগতের অতীত অজানা প্রেম সম্পদের জন্য উৎসর্গীকৃত। গীতাঞ্জলি-র গানগুলির জোর ও প্রাণবন্ততার মূলে আছে অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত সম্পর্কের রূপকল্প— প্রেমসম্পদের জন্য আকুল অবসন্ন প্রতীক্ষা, সাক্ষাৎ, সমর্পন, মিলন এবং অবশেষে পরম প্রাপ্তি। কবি চৈতালি-র অবস্থান থেকে সরে এসেছেন; এখন তিনি দুর্বিষহ বিরহে যন্ত্রণাদগ্ধ অনেক পরিণত প্রেমিক, অতএব তাঁর সমর্পণ ও পূর্ণতা আরও ঐশ্বর্যময় ও সম্পূর্ণ।

গীতিমাল্য (১৯১৪) একই মেজাজের ধারাবাহিকতা। পথিককে জিজ্ঞাসা করা হয়:

ওগো পথিক দিনের শেষে
যাত্রা তোমার সে কোন্ দেশে,

সে উত্তর দেয়,

কে জানে ভাই কে জানে।

১১ নং কবিতা

উঠে আসে জিজ্ঞাসা :

মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে,
সত্য যদি নাহি মেলে দুঃখ সাথে যুঝে,
…তবে ঘরছাড়া সবে
অন্তরের কী আশ্বাস-রবে
মরিতে ছুটিছে শত শত
প্রভাত-আলোর পানে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মতো।
…নিদারুণ দুঃখরাতে
মৃত্যুঘাতে
মানুষ চুর্নিল যবে নিজ মর্ত সীমা
তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?

আমরা লক্ষ্য করি, এর উত্তর যে দেওয়া হয়নি সেটি এটি একটি আলংকারিক প্রশ্ন বলে নয়; উত্তর নেই, কারণ দুঃখকষ্ট এবং মৃত্যুর কোনও যথার্থ বা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা কবির কাছে নেই।

পলাতকা (১৯১৮) কাব্যগ্রন্থে ‘মুক্তি’ শীর্ষক একটি কবিতায় এক হতদরিদ্র, কলঙ্কময়, তাৎপর্যহীন জীবনে মৃত্যু আসে মুক্তি হয়ে। মৃত্যু জীবনকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাকে প্রেরণ করে এক বৃহত্তর জগতে। এখানে মৃত্যু ক্ষুদ্রতা ও আত্মিক অকিঞ্চনত্ত্বের অবসান ঘটায়।

এই মনোভাব পুরবী (১৯২৫)-তেও পরিলক্ষিত হয়। সেখানে বয়ঃকনিষ্ঠ স্নেহভাজন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যু উপলক্ষে তিনি লেখেন:

…ধরিত্রীর রাত্রি আর দিন
তোমা হতে গেল খসি, সর্ব আবরণ করি লীন
চিরন্তন হলে তুমি, মর্ত কবি, মুহূর্তের মাঝে

‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’

শোভন মৃত্যুর স্বপ্ন ঘুরে ফিরে আসে কবির মনে:

ফুলের মতন সাঁঝে পড়ি যেন ঝরে,
হাওয়ার মতন বনের গন্ধ হ’রে…
চলে যাই গান হাঁকি।

‘বকুল বনের পাখী’

বারংবার কবিকে মৃত্যুর চূড়ান্ত শূন্যতা অস্বীকার করতে হয়:

ভেবেছি জেনেছি যাহা, বলেছি শুনেছি যাহা কানে,
সহসা গেয়েছি যাহা গানে,
ধরেনি তা মরণের বেড়া-ঘেরা প্রাণে
আমার মনের নৃত্য কতবার জীবন-মৃত্যুরে
লঙ্ঘিয়া চলিয়া গেছে চিরসুন্দরের সুরপুরে।

‘কঙ্কাল’

অতএব, শিল্পী তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে এবং শৈল্পিক প্রকাশের মাধ্যমে মৃত্যুকে জয় করেন, কারণ, তাঁর সৃষ্টি সময় ও মৃত্যুর দাস নয়, তা জীবন ও শাশ্বতের অঙ্গ। পরবর্তী কালে তিনি নিজে এই দাবির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন:

তুই হেথা কবি
এ বিশ্বের মৃত্যুর নিশ্বাস
আপন বাঁশিতে ভরি গানে তারে বাঁচাইতে চাস।

‘ছবি’

কবির কাছে একমাত্র প্রশ্নহীন সমাধান হল মৃত্যুর তুলনায় প্রেমের মহত্ত্বরতা:

ভালোবাসা, তোমারে তাই
মরণ দিয়ে বরিতে চাই।

‘চঞ্চল’

পুরুষোচিত ভাবে জীবনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে এবং তাকে জয় করে জীবনের পূর্ণ উপভোগের পরই একমাত্র মৃত্যুকে পরাস্ত করা সম্ভব। দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবিতায় লেখা এক চিঠিতে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করেন:

মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মৃত্যু তারেই টানে
মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে

‘চিঠি’

দু’টি বিবৃতিতে এক বচন ও বহুবচনের স্থান পরিবর্তন লক্ষণীয়: ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ অনিবার্য পরিণতি থেকে পলায়নের চেষ্টায় তার অসহায়, করুণ শিকার হয়, কিন্তু বীরপুরুষেরা স্পর্ধা সহকারে এই ভীতির মোকাবিলা করে, মৃত্যু বিজয়ে অর্জনে ব্যর্থ হয়।

মূলত প্রেম ও নারী বিষয়ক কাব্য সংকলন মহুয়া (১৯২৯) প্রেম ও মৃত্যুর বিপরীত অবস্থানের পুনরাবৃত্তি করে :

মৃত্যুর স্নানে কালিমা মুছায়,
চিরপুরাতনে করে উজ্জ্বল।

‘বোধন’

মৃত্যুর ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জের সামনে প্রেমই একমাত্র যথার্থ প্রতিকার:

মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব—
তুমি আছ, আমি আছি।

‘নিৰ্ভয়’

নির্দয় সংগ্রাম—অন্তে মৃত্যু যদি আসি
দেয় ভালে অমৃতের টিকা,
জানি যেন, সে তিলকে উঠিল প্রকাশি
আমারও জয় জীবন লিখা।

‘মুক্তরূপ’

বনবাণী (১৯৩১) কাব্যগ্রন্থে নানা ঋতুতে প্রকৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর যে লেখালেখি, সেখানেও প্রকৃতির মধ্য দিয়ে একই বিষয়বস্তু প্রকাশিত হয়। একটি নদীর বর্ণনায় এক সুর শুনতে পাই :

…দেখেছি অম্লান তারে তীব্র রৌদ্রদাহে
শুষ্ক শীর্ণ দৈন্যদিনে বহি যায় অক্লান্ত প্রবাহে
সৈকতিনী, রক্তচক্ষু বৈশাখেরে নিঃশঙ্ক কৌতুকে
কটাক্ষিয়া—অফুরান হাস্যধারা মৃত্যুর সম্মুখে

‘হাসির পাথেয়’

রূপকল্পটির বিশ্লেষণে ক্ষয় এবং মৃত্যুর সামনে প্রাণশক্তির অসীম স্থৈর্য্য ও আত্মবিশ্বাস আমাদের নজরে আসে। যদিও পরিশেষ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে, এর বেশির ভাগ কবিতাই ১৯২৭ এবং ১৯৩১ এর সময়সীমায় রচিত। এই সময়ই প্রেম এবং মৃত্যুর ক্ষমতার তুল্যমূল্যতার ধারণায় কবির স্থির নিশ্চয়তা জন্মায়। এবং তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন যে, মৃত্যুর চ্যালেঞ্জের সামনে প্রেমই একমাত্র কার্যকরী ও যথাযথ প্রতিক্রিয়া। তিনি নিজের পূর্বতন বিশ্বাসের দিকে আঙুল তোলেন এবং তখন থেকে মৃত্যু-বিষয়ক কবিতার পর কবিতায় এক গভীর অস্থিরতা ও উদ্বেগ স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়।

আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে, তিনি তাঁর নিজের মৃত্যুর সময় থেকে মাত্র দশ বছর দূরে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তাঁর সাম্প্রতিক ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণের পর পৃথিবীতে মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে তাঁর মনে গভীর সংশয় ও আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতিকালে তাঁর অনেক প্রিয়জন— আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের মৃত্যু ঘটেছে এবং তাঁর নিজের শরীর স্বাস্থ্যও ভাল যাচ্ছিল না। ছিল কাজের চাপ। শান্তিনিকেতনে প্রশাসনিক ও আর্থিক সমস্যা সংকটজনক হয়ে উঠেছিল এবং জাতীয় আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের ভুল ব্যাখ্যা আরও জোরালো এবং মুখর হয়ে উঠছিল। কেবলমাত্র অলস বা সারস্বত ঔৎসুক্য নয়, তাঁর নতুন অনিশ্চিত খোঁজ বা অনুসন্ধানের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল কবির বিজ্ঞান এবং মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে এই নব-লব্ধ উৎসাহ। তিনি এখন মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর পূর্বেকার অবস্থানের অপর্যাপ্ততা সম্পর্কে যন্ত্রণাদগ্ধ সচেতনতায় উপনীত। তাঁকে একটি কাঠামো নির্মাণ করতেই হবে, যেখানে, মৃত্যু অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি নয়, বরং অর্থপূর্ণ অবসান। অন্যথায় সমগ্র সৃষ্টি সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। শিল্পী হিসাবে তিনি কি মৃত্যুকে জয় করার আশা করেছিলেন এবং তিনি কি সে প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন?— কবি নিজেকে প্রশ্ন করেন। আত্মবিভাজন এবং উজ্জ্বল জীবন্ত কল্পনার সাহায্যে সংশয়ের গর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পৌনঃপুনিক প্রচেষ্টা এই সময়ের কবিতায় স্পষ্ট অনুভব করা যায়। অবশ্য অতি প্রিয় মোহাবরণগুলি একটি একটি করে খসে পড়ছিল। শুধু দু’টি আশ্বাস ছাড়া: প্রেম এবং মানবিক মনোবল, অর্থাৎ, কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা। মৃত্যুকে জীবনের কাছে ঋণী করে তুলতে হবে, এবং তা তখনই হতে পারে যদি মৃত্যুর আগমনে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত না হয় বরং পুরুষোচিত দৃপ্ত ভঙ্গিতে তার মোকাবিলা করে। জীবন যদি না তার অন্তঃস্থ গৌরব দিয়ে মৃত্যুর শূন্যতাকে পূর্ণ করে তবে মৃত্যু শূন্য নিরাশা মাত্র।

তাঁর কবিতার বুনটে এক নতুন ধারণার প্রবেশ ঘটে, সমষ্টিগত মৃত্যুর প্রতি এক নতুন প্রতিক্রিয়া। ১৯৩১ সালে বক্সা শিবিরের রাজনৈতিক বন্দিদের উদ্দেশে তিনি লেখেন, ‘মৃত্যু দিয়ে বিরচিল অর্মত্য নরের রাজধানী’। জীবন এক অন্তহীন স্রোত, আনুক্রমিক মৃত্যু শুধু তার চপল পদচিহ্ন। জীবনের চরমতম আশঙ্কার উদ্দেশে তিনি বলেন:

যত বড়ো হও,
তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।
আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে।

‘মৃত্যুঞ্জয়’

১৯৩০ সালে কবি যখন শেষবার ইউরোপ পরিভ্রমণে যান তখন তাঁর সুযোগ ঘটে ওবেরামেরগউ-তে ‘Passion Play’ নাটকটি দেখার। এই অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তাকে নতুন পথে চালিত করে: খ্রিস্টের প্রাতিনিধিক মৃত্যু যেন সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে এক নিষ্পাপ মানুষের পাপের নৈবেদ্য, জীবনের উদ্ধারকল্পে সেচ্ছায় আত্মবলিদান। তাঁর মৃত্যুবিষয়ক কবিতায় গুণগত পরিবর্তন আসে। আমাদের ভুললে চলবে না যে, এই ভ্রমণকালে তিনি জায়মান ফ্যাসিবাদ এবং নাৎসীবাদের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিলেন, দেখেছিলেন এক ভয়ংকর আতঙ্কের ছায়ায় বাঁচা ইউরোপকে।

পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ পুনশ্চ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। কবিকে এখানে পাই প্রশ্ন উত্থাপনের পুরনো মেজাতে। এই ‘আমি’ হঠাৎ বিলুপ্ত হয়— এই ধারণা তাঁকে সার্বিক ভাবে বিদ্রোহী করে তোলে:

এমন কি অণুমাত্র ছিদ্র আছে কোনোখানে।
সে ছিদ্র কি এতদিনে
ডুবাতো না নিখিলতরণী
মৃত্যু যদি শূন্য হত,
যদি হত মহাসমগ্রের
রূঢ় প্রতিবাদ…

‘মৃত্যু’

কিন্তু এই সময়ের প্রকৃত তাৎপর্যপূর্ণ মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায় খ্রিস্টের সম্পর্কে, লেখা ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটিতে: …মৃত্যুর দ্বারা যে আমাদের সকলের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত, সেই মহামৃত্যুঞ্জয়।

এখানে ভাষার বুনটের সচেতনতা লক্ষ্য করার মতো, তা যেন জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে ভাবগম্ভীর ও শ্বাশত বাণীর প্রতিধ্বনি। তাঁর বোধ জাগে— এক বা কয়েকজন মহৎ স্বপ্নদ্রষ্টাকে নির্ভয়ে অতিক্রম করে যেতে হবে মৃত্যুকে, যাতে, জীবিতদের কাছে জীবনের সত্যতার,

সার্থকতার আরও গৌরবময় প্রতিপাদন ঘটে। যদিও এখনও পর্যন্ত তা এই এক আবছা পূর্বানুভব হয়েই থেকে যায় যে, অবশিষ্ট মানুষের সন্ত্রাসের থাবা থেকে মুক্তির জন্য অস্তিত্বের নৃশংসতা প্রাতিনিধিক বলিদান দাবি করে। অসামরিক মানুষকে বাঁচাতে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের মৃত্যু, দেশপ্রেমিক বা খ্রিস্টের মৃত্যু— এই ধরনেরই মৃত্যু।

রুগ্ন স্বাস্থ্য বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং যখন তিনি পরবর্তী সংকলন প্রকাশ করেন, তার নাম রাখেন শেষ সপ্তক (১৯৩৫)। এখানে তুলনামূলক ভাবে নিষ্ক্রিয় মেজাজে তিনি লেখেন:

এর আলো-ছায়ার উপর দিয়ে
ভাসতে ভাসতে চলে যাক আমার চেতনা
চিন্তাহীন, তর্কহীন, শাস্ত্ৰহীন
মৃত্যু-মহাসাগর সংগমে।

৪ নং কবিতা

কিন্তু,

যখন প্রাণে জাগে তার প্রেম,
যখন দুঃখকে পারে সে গলার হার করতে,
যখন দৈন্যকে দেয় সে মহিমা,
যখন মৃত্যুতে ঘটে না তার অসমাপ্তি।

৫ নং কবিতা

মৃত্যু এখনও পরিশোধক:

সেখানে নিগূঢ় নিবিড় কালিমা
অপেক্ষা করছে মৃত্যুর হাতের মার্জনা।

৯ নং কবিতা

প্রশ্ন এখনও তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে :

এই অপরিণত অপ্রকাশিত আমি,
এ কার জন্যে, এ কিসের জন্যে?
যা নিয়ে এল কত সূচনা, কত ব্যঞ্জনা,
বহু বেদনায় বাঁধা হতে চলল যার ভাষা,
পৌঁছল না যা বাণীতে,
তার ধ্বংস হবে অকস্মাৎ নিরর্থকতার অতলে,
সইবে না সৃষ্টির এই ছেলেমানুষি।

৯ নং কবিতা

এখানে অস্তিত্বের চরম অর্থহীনতা সম্পর্কে তাঁর প্রথম স্পষ্ট ধারণা জন্মায়; তিনি তাঁর এতদিনের বিশ্বাস ও বাস্তবতার মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান টের পান কিন্তু এখনও জানেন না কী তাঁর করণীয়, কেননা, তিনি না পারেন তা মেনে নিতে, না অস্বীকার করতে; এতই গুরুতর এবং অসম্ভব এই যে বোধ তা কি করে বাস্তবতা হয়? ২২ নম্বর কবিতায় আমরা আত্মা এবং দেহের সম্পর্ককে অদ্ভুত উপায়ে ব্যক্ত হতে দেখি:

শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে,
ওই একটা অনেক কালের বুড়ো,
আমাতে মিশিয়ে আছে এক হয়ে।
….তাই ওকে যখন মরণ ধরে
ভয় লাগে আমার
যে-আমি মৃত্যুহীন।
….আমি দেখব ওকে জানলায় ব’সে,
ওই দূরপথের পথিককে,
দীর্ঘকাল ধরে যে এসেছে
বহু দেহমনের নানা পথের বাঁকে বাঁকে
মৃত্যুর নানা খেয়া পার হয়ে।

ভাবতে অবাক লাগে, কবি কি পুনর্জন্মের সাবেকী বিশ্বাসে সান্ত্বনা খুঁজছেন!

সহমরণের বধূ
বুঝি এমনি ক’রেই দেখতে পায়
মৃত্যুর ছিন্নপর্দার ভিতর দিয়ে
নতুন চোখে
চিরজীবনের অম্লান স্বরূপ।

২৩ নং কবিতা

আবারও,
আমি মৃত্যু-রাখাল
সৃষ্টিকে চরিয়ে চরিয়ে নিয়ে চলেছি
যুগ হতে যুগান্তরে
নব নব চারণ-ক্ষেত্রে…
বর্তমান চায় বর্তিয়ে থাকতে।
…এই অন্তত অচঞ্চল বর্তমানের হাত থেকে
আমি সৃষ্টিকে পরিত্রাণ করতে এসেছি,
অন্তহীন নব নব অনাগতে।

৩৯ নং কবিতা

এখানে ভাষার ব্যবহার তাৎপর্যপূর্ণ: ‘বর্তমান’, যা কবির ভাষায় ‘চায় বর্তিয়ে থাকতে’, তার জন্য তিনি গতানুগতিক, বৈশিষ্ট্যহীন শব্দাবলী প্রয়োগ করেন। বিশাল অদেখা, মনে হয়, অজানা অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাকে হাতছানি দেয়। এক বৃদ্ধ মানুষের কাছ থেকে, যার জীবনের প্রায় সবটাই তিনি পিছনে ফেলে এসেছেন, এ রকমটাই হয়তো আশা করা যেতে পারে। এ এক অব্যাহত আত্মাভিভাবন। স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মধ্য দিয়ে এক গলিত গতানুগতিকতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়:

আজ নেব মুক্তি
সামনে দেখছি সমুদ্র পেরিয়ে
নতুন পার।
তাকে জড়াতে যাব না
এ পারে বোঝার সঙ্গে
এ নৌকায় মাল নেব না কিছুই
যাব একলা
নতুন হয়ে নতুনের কাছে।

৪৬ নং কবিতা

উত্তম পুরুষে বার বার ক্রিয়াপদের ব্যবহার— সিদ্ধান্ত ও কর্মমূলক ক্রিয়াপদগুলি তিনি যে জীবনের পুনর্নবীকরণের স্বার্থে মৃত্যুকে এক স্বেচ্ছা-পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য করেন তার ইঙ্গিতবাহী। একজন অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষ জীবনভর তাঁর প্রিয় বিশ্বাসগুলি নিয়ে বেঁচেছেন, বিশেষত, মঙ্গলময় বিধাতায় বিশ্বাস। কিন্তু এখন তা রূঢ় ভাবে ধাক্কা খেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁর অসাধারণ মনোবলের প্রকাশ দেখতে পাই যখন তিনি বাস্তবের আরও এক নতুন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যার সন্ধান করেন: মৃত্যু অর্থপূর্ণ ভাবে যার অঙ্গীভূত হবে। মৃত্যুর প্রতি সন্তোষজনক মনোভাব গড়ে তোলার সমস্যাটি আদতে জীবনের প্রতি যুক্তিগ্রাহ্য, অর্থাৎ তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান। তা না হলে মৃত্যু আসবে শুধুমাত্র অস্তিত্বের এক আকস্মিক রূঢ় এবং হিংস্র সমাপ্তি হয়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে কিছু নতুন উপাদানের কথা, যা এই সময়কালে তাঁর সচেতনতায় পরিবর্তন এনেছিল। এই পর্বে বৈজ্ঞানিক সৃষ্টি ও বিবর্তন তত্ত্ব, পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব এবং এই গ্রহে তার সম্ভাব্য বিলোপের প্রশ্নগুলি ছাড়াও তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি সাহসিকতার সঙ্গে, বিশ্ব-রাজনীতির সমস্যাগুলির মোকাবিলা করেছিলেন। ১৯৩০ সালের রাশিয়া ভ্রমণের পর থেকেই মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে তাঁর মনে এক নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। চির অতৃপ্ত লালসা, ধারাবাহিক নিপীড়ন এবং হিংস্রতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকল্প যুক্তিগ্রাহ্য অন্য এক সমাজব্যবস্থার দরজা তাঁর সামনে খুলে গিয়েছিল। রাশিয়া থেকে ফিরে আসার কিছু দিন পরেই হিটলার জার্মানির ক্ষমতা দখল করেন। স্পেন দেশে চলছিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ইউরোপে উত্তেজনা ও আশঙ্কার পারদ চড়ছিল। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের দমন নীতি, সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্নিবদ্ধ পাশবিকতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি খুলে দেয়। তরুণ সত্যসন্ধানী দেশপ্রেমিকদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল মৃত্যুর অন্ধকারে। তাঁর নিজের বয়স এবং নিরাপদ জীবন নিশ্চয়ই তাঁকে লজ্জা দিয়েছিল, যা অনেক তির্যক উল্লেখ থেকে স্পষ্ট। তিনি খোলাখুলি দেশ এবং বিদেশের দমনরাজের তীব্র নিন্দা করেন এবং নিজেদের বিশ্বাসের বেদিমূলে আত্মোৎসর্গের জন্য দেশ প্রেমিকদের প্রতি দ্বিধাহীন প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করেন।

বিথীকা (১৯৩৫) কাব্যগ্রন্থে এই জটিল মেজাজের প্রতিফলন শুধু অব্যাহতই থাকে না, তিনি তাকে এক নতুনতর জটিল অর্ন্তদৃষ্টি ও প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে চলেন :

মনে জেনো, মৃত্যুর মুল্যেই করি ক্রয়
এ জীবনে দুর্মূল্য যা, অমর্ত্য যা, যা কিছু অক্ষয়

‘বিরোধ’

নিজের মৃত্যু সম্পর্কে তিনি এখন বলতে পারেন:

সহজে আমি মানিব অবসান,
ভাবী শিশুর জনমমাঝে নিজেরে দিব দান

‘মরণমাতা’

এখন বোঝা যায় যে, এ কোনও পুনর্জন্মের অলস স্বপ্ন নয়, বরং যা কিছু তাঁর জীবনকে মূল্যবান করেছে, সে সব কিছু ভাবিকালের মানুষকে দান করে যাওয়ার স্বপ্ন। স্পষ্টতই তাঁর দৃষ্টি এখন অন্যখানে নিবদ্ধ। যেখানে পূর্বেকার কবিতাগুলিতে এই উপহার মৃত্যুর পরপারে তাঁর জীবন দেবতার প্রতি উৎসর্গীকৃত, এখন তা এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিবেদিত। কেননা, ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও জীবন অব্যাহত থাকে, মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে মেনে নেওয়াই উৎকৃষ্টতম উপায়। এই অবসান আপেক্ষিক মাত্র, কেননা মানুষের স্রোত নিরন্তর বয়ে যায়। সৃষ্টি কর্তাকে সম্বোধন করে তিনি বলেন :

সৃষ্টিতে তব আনন্দ আছে
মমত্ব নাই তবু,
ভাঙায় গড়ায় সমান তোমার লীলা।

‘নমস্কার’

বিনাশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বারবার এসেছে মানবিক প্রেমের কথা:

প্রেয়সীর প্রেমে
প্রত্যহের ধূলি-আবরণ যায় নেমে
দৃষ্টি হতে, শ্রুতি হতে…

‘দেবতা’

সময়ে সময়ে তিনি এখনও মৃত্যুর ওপারের জীবনের মনোরম কল্পনাকে আঁকড়ে ধরেন:

পিছনের ডাক
আসিতেছে শীর্ণ হয়ে; সম্মুখেতে নিস্তব্ধ নির্বাক
ভবিষ্যৎ জ্যোতির্ময়
অশোক অভয়,
স্বাক্ষর লিখিল তাহে সূর্য অস্তগামী।
যে মন্ত্র উদাত্ত সুরে উঠে শূন্যে সেই মন্ত্ৰ— ‘আমি’।

‘শেষ’

বাস্তবের অন্য এক ক্ষেত্রে জেগে ওঠার সম্ভাবনা, অন্য কোনও স্তরে অব্যাহত জীবন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে আশা আর সংশয় এখনও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়, হাতছানি দেয়। এটা হতেই পারে যে, তিনি ভাবছিলেন হয়তো অবসানের প্রকৃত অর্থে এক অন্য স্তরে বা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে, যেখানে তা জীবনের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে মাত্র। হতে পারে, এই প্রাচীর ঘেরা জীবনের সীমাবদ্ধ উপলব্ধি, সুপ্রচুর সংশয় ও ভীতি থেকে মৃত্যু মুক্তি দেয়। একটি কবিতায় তিনি বলেন:

দেবতা যেখানে ছিল সেথা জ্বালাইতে গেলে ধুপ,
সেখানে বিদ্রুপ।
সর্ব শূন্যতার ধারে
জীবনের পোড়ো ঘরে অবরুদ্ধ দ্বারে
দাও নাড়া;
ভিতরে কে দিবে সাড়া?
মূর্ছাতুর আঁধারের উঠিছে নিশ্বাস।
ভাঙা বিশ্বে পড়ে আছে ভেঙে পড়া বিপুল বিশ্বাস।
তার কাছে নত হয় শির
চরম বেদনাশৈলে ঊর্ধ্বচূড় যাহার মন্দির।

‘দুর্ভাগিনী’

এ সমস্ত পংক্তি স্পষ্টত ইঙ্গিত করে যে, তিনি ক্রমে ক্রমে জগৎ-নিয়ন্ত্রক কোনও মঙ্গলময় শক্তির উপর বিশ্বাস হারাচ্ছিলেন।

অমৃতের পথে

১৯৩৬ থেকে ১৯৪১– এই শেষের বছরগুলিতে অসাধারণ সব কবিতায় কবি শেষ অবধি সাহস করে তাঁর অন্তিম উপলব্ধির কথা স্বীকার করেন। এই পর্বের কবিতায় কবি ক্ৰমে ক্রমে মানবতাবাদের এক নতুন স্তরে পৌঁছনোর রাস্তা ধরে এগোতে থাকেন। পুরনো ঘরানার কিছু বিক্ষিপ্ত কবিতা ব্যতিরেকে তিনি এখন অকপটে স্বীকার করেন যে, দেবতার মন্দিরে প্রবেশের আগে তিনি সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান মেনে প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করে দেখলেন কোথাও কেউ নেই, শুধু নিজের জীর্ণ কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ছাড়া। মানুষ বিপদে পড়ে ভগবানকে ডাকে, কিন্তু ভগবান সাড়া দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না। এই আর্তনাদ তাঁর কানে পৌঁছয় না। কেন তিনি তাকে ত্যাগ করেছেন? কবির কাছে এই সময়টা তিক্ত, যন্ত্রণাকর: ষাট বছর ব্যাপী লালিত আস্তিক্যবাদী বিশ্বাসকে তিনি পরিত্যাগ করতে পারেন না, আর তা স্বীকার করা আরও কঠিন হয়। এই বিশ্বাস তাঁকে মানসিক এবং আধ্যাত্মিক আশ্রয় জুগিয়েছিল, বাস্তব থেকে নিষ্কৃতি পেতে। কিন্তু, তিনি দেখেন সবই সার-বস্তুহীন। যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ে তিনি নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে মুক্তি খোঁজার প্রলোভনকে প্রতিরোধ করেন। এই কৃতিত্ব অর্জন করা যে কোনও মানুষের জন্যই এক বীরত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু, সমস্ত বিশ্বাসের ভিত ভেঙে-পড়া এক ভগ্ন স্বাস্থ্য আশি বছরের মানুষের পক্ষে এই কৃতিত্ব অর্জন বিস্ময়কর বললে কম বলা হয়: তিনি তিক্ততা বা নিরাশা নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে যাননি। উদ্ধারকর্তা মানুষে’ বিশ্বাস নিয়ে তাকে স্বাগত জানিয়ে বিদায় নিয়েছেন।

তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় মৃত্যু আসে জীবনের সব জটিলতা ও বিশৃঙ্খলার এক শান্তিপূর্ণ পরিসমাপ্তি হয়ে। এ সবই সহজ-সরল কবিতা, যাদের মধ্যে কোনও গভীর ব্যক্তিগত উপলব্ধির ছাপ নেই। পরে যখন আরও বেশি গভীরতা নিয়ে তিনি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হন, তখন মৃত্যু আর শুধু জীবনের সমাপ্তি ঘোষণার মধ্য দিয়ে আসে না, তা মহাজাগতিক সংকল্পনার এক অসমঞ্জস পরস্পর বিরোধিতা হিসাবে আসে। আর ঠিক তখনই তাঁর অন্যান্য বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক সমাধান খোঁজার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। তার পর আরও এক পর্ব আসে, যেখানে মৃত্যুকে তিনি দেখেছিলেন মাত্র এক সীমা অতিক্রমণ হিসাবে।

কিন্তু, একেবারে শেষ সময়ে সমষ্টিগত মৃত্যু— নিষ্ঠুর, অসংখ্য তরুণের অকাল, অন্যায্য, পূর্বপরিকল্পিত হত্যা বর্ষীয়ান মানুষটির মনে এক নতুন জোরালো প্রভাব ফেলে। এ এক অপচয়ী মৃত্যু, যেন এক উন্মাদ, ভয়ানক দৈত্য দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মৃত্যুর সামনাসামনি দাঁড়াতে কবিকে তাঁর মনোভঙ্গি বদল করতে হয়। বেদনা থেকে নিঃসৃত হয় অপরূপ সৃষ্টি— কথায়, সুরে। বোধহীন অবিশ্রান্ত এই নৃশংসতা এতটাই প্ররোচনামূলক যে, কোনও মামুলি কথায় প্রতিবাদ জানিয়ে তাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই সর্বগ্রাসী সন্ত্রাসের সম্মুখীন হয়ে কবি ভীতিকে জয় করতে সক্ষম হন। ততদিনই সন্ত্রাস তাঁর উপর পূর্ণকর্তৃত্ব আরোপে সক্ষম হয়েছিল, যতদিন তিনি ভয়ে গুটিয়ে ছিলেন। কিন্তু, এখন তিনি নিজ-কর্তব্যে অবিচল থেকে যথাসময়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করার কাজটি সম্পন্ন করতে পারার গভীর সন্তোষ নিয়ে নিজের মৃত্যুকে স্বীকার করে নেন। শেষের বছরগুলিতে পৃথিবীর এই যন্ত্রণাকাতর হাহাকারে তাঁর মনের নিভৃত-গভীর আকুল আকাঙ্ক্ষাগুলি ভেঙে চুরমার হয় বারংবার। এবং এই শোকাহত অভিজ্ঞতার বেদনা ব্যবহৃত উৎসর্গের রূপকল্পের।

পত্রপুট (১৯৩৬) কাব্যসংকলনে আমরা বেদ ও উপনিষদের সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি শুনতে পাই; যে সুর বারবার বেজে ওঠে তা এক বিষণ্ণ কিন্তু গভীর প্রত্যাশার। জীবনকে যা মূল্যবান করে তোলে তার অনেক কিছুকেই যদিও ব্যাধি, জরা এবং মৃত্যু বিনষ্ট করে, যদিও যৌবন, স্বাস্থ্য, সুখ এমনকী জীবনও ক্ষণস্থায়ী, তবু মানুষের অন্তঃস্থ শক্তি আরও চিরন্তন, আরও মূল্যবান কিছু আহরণ করে— মৃত্যুর পরও যার অবশেষ থেকে যায়। কবি ক্রমে ক্রমে আরও বেশি করে এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন যে, এই ‘কিছু’কে শুধু দুঃখ-যন্ত্রণার মূল্যেই কেনা যায়। মানুষ জীবনের অর্থকে পুনরুদ্ধারের বাসনায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে এবং তা সর্বকালে, সর্বযুগে; তিনিও মহাজাগতিক এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের পুনর্মূল্যায়নে নিয়োজিত ছিলেন:

জীবনের কোনো একটি ফলবান খণ্ডকে
যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে
তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে…

৩ নং কবিতা

রূপকল্পটি জটিল কিন্তু মাটির তিলকের দ্যোতনা সম্ভবত এই পার্থিব জীবনযোগ্যতার সঙ্গে নির্বাহ করার সত্যতার অন্তিম স্বীকৃতি:

আজ বঞ্চিত জীবনকে বলি সার্থক—
নিঃশেষ হয়ে এল তার দুঃখের সঞ্চয়
মৃত্যুর অর্ঘ্যপাত্রে,
তার দক্ষিণা রয়ে গেল কালের বেদীপ্রান্তে।

১২ নং কবিতা

এখানে বেদীপ্রান্তে দগ্ধ অর্ঘ্য, ঋণ পরিশোধ এবং যন্ত্রণা ভোগের মধ্য দিয়ে জীবন পবিত্ৰ হয়ে ওঠার স্মৃতিচারণা করা হয়েছে, যা মৃত্যুর কাছে নিবেদন যোগ্য একমাত্র যথার্থ অৰ্ঘ্য:

মৃত্যুর গ্রন্থি থেকে ছিনিয়ে ছিনিয়ে
যে উদ্ধার করে জীবনকে
সেই রুদ্র মানবের আত্মপরিচয়ে বঞ্চিত
ক্ষীণ পাণ্ডুর আমি
অপরিস্ফুটতার অসম্মান নিয়ে যাচ্ছি চলে।

১২ নং কবিতা

শুধু রেখে যাচ্ছেন,
… নতমস্তকের প্রণাম
মানবের হৃদয়াসীন সেই বীরের উদ্দেশে—
মর্ত্যের অমরাবতী যাঁর সৃষ্টি
মৃত্যুর মূল্যে, দুঃখের দীপ্তিতে।

১২ নং কবিতা

মানুষের প্রতি এই নতুন ও ক্রমবর্ধমান বিশ্বাসের ভর করে তাঁর দৃষ্টি ঈশ্বর থেকে সরে এসে মানুষের উপর নিবদ্ধ হয় :

আজ আপন মনে ভাবি,
“কে আমার দেবতা,
কার করেছি পূজা”।
শুনেছি যাঁর নাম মুখে মুখে,
পড়েছি যাঁর কথা নানা ভাষায় নানা শাস্ত্রে,
কল্পনা করেছি তাঁকেই বুঝি মানি।
তিনিই আমার বরনীয় প্রমাণ করব বলে
পূজার প্রয়াস করেছি নিরন্তর।
আজ দেখেছি প্রমাণ হয় নি আমার জীবনে।
কেননা, আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন।
…আমার গানের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে দিনে দিনে
সৃষ্টির প্রথম রহস্য, আলোকের প্রকাশ—
আর সৃষ্টির শেষ রহস্য, ভালোবাসার অমৃত।
আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন,
সকল মন্দিরের বাহিরে
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল
দেবলোক থেকে
মানবলোকে…

১৫ নং কবিতা

এই কবিতাটিকে তাঁর উপলব্ধির অন্তিম দলিল হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে, কারণ, শেষের দিন পর্যন্ত তিনি এই অবস্থানে অবিচল ছিলেন।

১৯৩৭ সালে কবি আকস্মিক ভাবে চৈতন্য হারান এবং লুপ্তচেতনে দু’দিন অতিবাহিত করেন। এই প্রথম তিনি নিজের শরীরে মৃত্যুর শীতল স্পর্শ অনুভব করেন। প্রান্তিক(১৯৩৮) কাব্যগ্রন্থটি এই অভিজ্ঞতায় কবির প্রতিক্রিয়ার সাক্ষ্য বহন করে। এই কাব্যগ্রন্থের সুর যেন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গাম্ভীর্যের, যেখানে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের পুর্নমূল্যায়নের এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। কবিতার নির্মেদ শরীর রূপকালঙ্কারের সীমিত প্রয়োগ, ব্যর্থতা ও নৈতিক অসম্পূর্ণতার অকপট স্বীকৃতি এবং তাকে পরিত্যাগ না করার জন্য মৃত্যুর কাছে করুণ মিনতি— এ সবই আপেক্ষিকার্থে নতুন এবং গভীর ভাবে মর্মস্পর্শী :

প্রকাশের যে আনন্দ রূপ নিল আমার সত্তায়
আজ ধূলিমগ্ন তাহা, নিদ্রাহারা রুগ্‌ণ বুভুক্ষার
দীপধূমে কলঙ্কিত। তারে ফিরে নিয়ে চলিয়াছি
মৃত্যুস্নানতীর্থতটে সেই আদি নির্ঝরতলায়।

৪ নং কবিতা

হে সংসার,
আমাকে বারেক ফিরে চাও; পশ্চিমে যাবার মুখে
বর্জন কোরো না মোরে উপেক্ষিত ভিক্ষুকের মতো।
জীবনের শেষপাত্র উচ্ছলিয়া দাও পূর্ণ করি…

৬ নং কবিতা

আবার,

মৃত্যুদূত এসেছিল হে প্রলয়ংকর, অকস্মাৎ
… দেখি নি অদৃশ্য আলো
আঁধারের স্তরে স্তরে
… দৃষ্টি মোর ছিল আচ্ছাদিয়া
আমার আপন ছায়া।

১০ নং কবিতা

কবি হিসাবে এখন তিনি এক নতুন ব্রত পালনের ডাকে সাড়া দিতে উদ্‌যোগী হয়ে ওঠেন। সমষ্টিগত যন্ত্রণাভোগ এবং মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করা এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীব্যাপী মারণযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে এই ব্যাখ্যার যথার্থতা প্রতিপাদন তাঁর কাছে জরুরি কর্তব্য হয়ে ওঠে। তাঁর আহ্বান শুনি, যখন তিনি লেখেন:

নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির লালিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।

১৮ নং কবিতা

সেঁজুতি (১৯৩৮) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত নিজের জন্মদিন উপলক্ষে লেখা এক দীর্ঘ কবিতায় তিনি বলেন:

হেথা আমি যাত্রী শুধু, অপেক্ষা করিব, লব টিকা
মৃত্যুর দক্ষিণ হস্ত হতে,
…তবু
…প্রতিমা অক্ষুণ্ণ রবে সগৌরবে,
…আজি মর্ত্যের অপর তীরে বুঝি
চলিতে ফিরানু মুখ
…আর রবে খেয়াতরীহারা
এপারের ভালবাসা—

‘জন্মদিনে’

আর একটি কবিতায় তিনি বলেন:

কী আছে জানি না দিন-অবসানে মৃত্যুর অবশেষে;
এ প্রাণের কোনো ছায়া
শেষ আলো দিয়ে ফেলিবে কি রঙ অস্তরবির দেশে,
রচিবে কি কোনো মায়া।

‘পত্রোত্তর’

সন্দেহের কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শোনা যায়। উত্তরহীন প্রশ্নরাজি তাঁর সমস্ত অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তা নিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। আমরা বুঝতে পারি— ‘নৈবেদ্য’-র বিশ্বাস এবং নিশ্চয়তার মনোরম, স্বস্তির জগৎ থেকে কবি অনেক দূর সরে এসেছেন।

যাক এ জীবন,
যাক নিয়ে যাহা টুটে যায়
… মৃত্যুই যার অন্তরে, যাহা
রেখে যায় শুধু ফাঁকা।
…অসীম জীবনে এ ক্ষীণ জীবন শেষ রেখা এঁকে যাক,
মৃত্যুতে ঠেকে যাক।

‘যাবার মুখে’

সহসা যে শরীরকে তিনি কিছুদিনের মধ্যেই বিদায় জানাবেন, সেই শরীর এক নতুন তাৎপর্য্যে মণ্ডিত হয় :

যে দেহেতে রূপ নিয়েছে অনির্বচনীয়
… পেরিয়ে মরণ সে মোর সঙ্গে যাবে—
কেবল রসে, কেবল সুরে, কেবল অনুভবে।

‘অমর্ত্য’

কবির উচ্চারণ এখন দ্বিধাহীন :

মানুষের মুখ্যভয়
মৃত্যু ভয়,
কেমন করিবে তারে জয়
নাহি জানে;
তাই সে হেরিছে ধ্যানে,
… গম্ভীর অভয়মূর্তি মরণের

‘ভাগীরথী’

কখনও কখনও এক ক্ষুধার্ত নেকড়ের চেহারায় হাজির হয় মৃত্যু।

মৃত্যুর উৎসাহ সেও অফুরন্ত বুঝি
জীবনের বিত্তনাশ করে পদে পদে।
…আনন্দিত ঔদাসীন্যে;

‘প্রাণের দান’

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার প্রক্রিয়া বর্ণনায় ব্যবহৃত বহু রূপকল্প এবং মৃত্যুর পরপারের কাল্পনিক অভিজ্ঞতার বর্ণনা তমসা, অনিশ্চয়তা, উদ্দেশ্যহীনতা, অজানা নিস্তব্ধতার লোকে বিসর্জিত হওয়া এবং এক বিপুল অন্তহীন অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রের কথা মনে আনে। প্রথম দিককার মৃত্যু-বিষয়ক কবিতায় ছিল মনোরম বিলীয়মান আলো ও সৌন্দর্য্যের যৌন-আবেদন মূলক রূপ-প্রতিমার ব্যবহার, যা মৃত্যু সম্পর্কে তখনকার মনোভাবের সঙ্গে এখনকার মনোভঙ্গির সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করে।

১৯৩৮ সালের শেষে অব্যাহত অজস্র প্রাণহানি ও হত্যা, সাময়িক ভাবে অক্ষশক্তির দিকে বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে পড়া যুদ্ধের গতি প্রকৃতি স্পষ্টতই দুশ্চিন্তা ও অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ইউরোপে লোভ ও উষ্মার উন্মাদনা ছাড়াও ভারতবর্ষের বুকে ব্রিটিশ শাসনের নিপীড়ন রুখতে প্রয়োজন ছিল খোলাখুলি নিন্দাবাদের। ‘ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান’-এ লেখা এক চিঠিতে তিনি মানুষের অববর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের জন্য শক্তিশালী, লোলুপ-ইউরোপীয় দেশগুলিকে দায়ী করেন এবং জোরালো ভাষায় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসননীতির নিন্দা করেন।

আকাশপ্রদীপ (১৯৩৯) কাব্যগ্রন্থে ব্যক্তির মৃত্যুর শোকাবহতা এবং মৃত্যুর ছায়াসঙ্গী ভীতির ঊর্ধ্বে ওঠার এক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আমাদের নজরে আসে। তাঁর নিজস্ব সৃজনী শিল্পকর্ম তাঁর এক দ্বিতীয় রূপ, যা এক স্থায়ী রূপ প্রতিমাকে পিছনে ফেলে রেখে যাওয়ার দাবি জানায়। যদি মৃত্যু এ দাবিকে নস্যাত্ত করে কবি তা জানবেন না, শুনবেন না। তিনি তখন সব কোলাহলের ওপারে:

আমার আপন-রচা কল্পরূপ ব্যাপ্ত দেশে কালে,
এ কথা বিলয়দিনে নিজে নাহি জানি
আর কেহ যদি জানে তাহারেই বাঁচা বলে মানি।

‘ভূমিকা’

ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে’ শীর্ষক এক বিখ্যাত কবিতায় তিনি নৃশংস ভাবে নিগৃহিতা এক মহিলার বর্ণনা দিয়ে বলেন:

শাস্ত্রমানা আস্তিকতা ধুলোতে যায় উড়ে
উপায় নাইরে, নাই প্রতিকার বাজে আকাশ জুড়ে।

অস্তিত্বের বুনিয়াদী বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে জমে ওঠা অভিযোগের পরিশীলিত প্রকাশ এক বিষণ্ন, আশাহীন সুরে বারবার ফিরে আসে।

বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অধ্যয়ন থেকে তাঁর উপলব্ধি জন্মায় যে, এ জগতে প্রাণ এই গ্রহে ক্রিয়াশীল অন্ধশক্তি-উদ্ভুত আকস্মিকতা মাত্র। আগেকার আদর্শবাদী অবস্থানটি ছিল, জগতের অন্তঃস্থ পরিকল্পনার অঙ্গ এই জীবন এবং মানুষের ব্রত হল বিশ্বাসী মনের নিষ্ঠা নিয়ে তা আবিষ্কার করা এবং কর্মের মাধ্যমে এই সংকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি আনা, এ পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে মহাজাগতিক নকশা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। এখান থেকে তিনি ধীরে ধীরে সরে আসছিলেন। বিজ্ঞানের কাছে এখন তিনি এই পাঠ নিচ্ছিলেন যে, এমনকী সৃষ্টির চূড়ান্ত প্রকাশ ও মহত্তম গৌরব যে মানবিক সচেতনতার উন্মেষ তাও প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফসল ছাড়া আর কিছুই নয়। আলোচ্য পর্বে আমরা এই বিষয়-নির্ভর কিছু সুন্দর কবিতার দেখা পাই। তাঁর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন ঋষি এখন জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত কোনও স্বপ্নবিলাসী গাথায় আর আস্থা রাখতে পারেন না; কিন্তু তা সত্ত্বেও, তিনি প্রাণের অভ্যন্তরে এক অসীম সৌন্দর্য ও গৌরবের অস্তিত্ব অনুভব করেন। আজ সেই সময় উপস্থিত যখন তিনি উপলব্ধি করেন যে বিশৃঙ্খল বাস্তবই শেষ কথা; আর কিছু নেই, কোথাও নেই।

কিন্তু এই বোধ তাঁকে অবসন্ন করে না, তিনি তাঁর সজীবতাকে বিসর্জন দিতে অপরাগ। এই যুদ্ধের বছরগুলিতে তিনি প্রত্যক্ষ করেন মানুষের নৃশংসতার বিপুল বিস্তার। বিজ্ঞান থেকে তিনি শেখেন, জীবন এক মননহীন দুর্ঘটনা, নেহাৎই এই গ্রহে দৈবাৎ ঘটে যাওয়া এক ঘটনা। ইতিহাস ও পৃথিবীর পরিস্থিতি তাঁকে জানান দেয় যে, মানুষের নৃশংসতা নতুন কিছু নয়, এ তার চিরকালীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সে সময় গভীর উৎসাহ নিয়ে তিনি মনস্তত্ত্বের চর্চা করছিলেন। তা থেকে তাঁর এই বোধ জন্ম নেয় যে নৃশংসতা, আত্মসর্বস্বতা এবং লোলুপতা মানুষে অন্তঃপ্রবাহী। জীবন আদতে অসমঞ্জস, বেসুরো। এবং আরও বলার কথা হল যে, মানুষের প্রতি মৃত্যুর কোনও নিজস্ব শত্রুতা বা নৃশসংতা নেই, সে শুধুই উদাসীন। কিন্তু মানুষের মনে কেন যেন তা বেসুরো বাজে, সে যেন এক ঐকতান খোঁজে, এক সুসমঞ্জস ব্যবস্থার সন্ধানে ফেরে। কিন্তু পৃথিবীতে এই যে প্রাণের অস্তিত্ব, এই যে মানুষের জীবন— এ সবই তো এক অন্ধশক্তির খেয়ালের আকস্মিকতা এবং এক দিন সহসা যে সব কিছুর অবসান ঘটবে না তাই বা কে বলতে পারে? এরই সঙ্গে যুক্ত হয় মানুষের অন্ধ, বিধ্বংসী উন্মাদনা, চির অতৃপ্ত লালসা, অত্যাচারিতের কান্না, যা মিশে যায় শক্তিমত্তার বিজয় ঘোষণার উন্মাদ উৎকট চিৎকারে। কবির শান্ত, স্নিগ্ধ পৃথিবী ভেঙে পড়ে। চারিদিকে শুধুই বোধশূন্য বিশৃঙ্খলা এখন— শারীরিক ও নৈতিক নাস্তিবাদের বিশৃঙ্খলা, অস্তিত্বের যাতনায় দৈত্যাকার চাকার তলায় পিষ্ট হয় পৃথিবী। দুর্বল চিত্তের মানুষের কাছে জীবন এখন অন্তঃসারশূন্যতায় পর্যবসিত হতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে তা নতুন গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়, কেননা ঈশ্বরে নয়, এখন তিনি অর্থ খোঁজেন মানুষে। কোনও স্বপ্নবিলাস বা আদর্শবাদিতা নয়, তিনি অর্থের সন্ধান খোঁজেন অসীম যন্ত্রণা সহ্য করেও মানুষ যে মোকাবিলা করে মৃত্যুর তীব্র দংশনী ক্ষমতা কেড়ে নিতে সফল হয়, সেই জয়ে। এখন অন্তত তিনি মানুষের মধ্যে তাঁর ঈশ্বরকে খুঁজে পান এবং বিজয়ীর বেশে ‘মহামানবের’ আবির্ভাবের প্রশস্তি করেন।

অমৃত বিশ্বাস

অবিশ্রান্ত হত্যালীলার মধ্যে দাঁড়িয়ে মানুষের বিশ্বাস ধরে রাখা দ্বিগুণ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছিল এবং যুদ্ধের নিন্দায় তিনি ক্রমে সরব হচ্ছিলেন। এই পর্বের লেখার বিশাল অংশ জুড়ে আছে উষ্মা আর ক্ষোভ। এক উন্মত্ত দৈত্যের প্রলয় নাচনের দুঃস্বপ্ন এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর পিছু ছাড়েনি। যদি আমরা বিষণ্ণতার আভাস পাই, যা এখন প্রায়শই পাওয়া যায়, তবে সে বিষণ্ণতা জীবন ভর বিশ্বাসের অপমৃত্যুজনিত। অতএব নবজাতক (১৯৩৯)-এ দেখতে পাই তিনি লিখছেন :

মানুষের চিত্ত নিয়ে সারাবেলা
মহাকাল করিতেছে দ্যুতখেলা
বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে যেন—
কিন্তু, কেন
আবার কি ছিন্ন হয়ে যাবে সূত্র তার।
রূপহারা গতিবেগ প্রেতের জগতে
চলে যাবে বহু কোটি বৎসরের শূন্য যাত্রাপথে?
উজাড় করিয়া দিবে তার
পান্থের পাথেয়পাত্র আপন স্বল্পায়ু বেদনার
ভোজশেষে উচ্ছিষ্টের ভাঙা ভাণ্ড হেন?
কিন্তু, কেন।

‘কেন’

শেষের দু’বছরে লেখা কবিতায় এই ‘কেন’ বারবার ফিরে আসে, কিন্তু এখন কবি আর এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সামান্য প্রচেষ্টাও করেন না:

দেবতা যেথায় পাতিছে আসনখানি
যদি তার ঠাঁই কোনোখানে নাই
তবে, হে বজ্রপাণি,
এ ইতিহাসের শেষ অধ্যায়তলে
রুদ্রের বাণী দিক দাঁড়ি টানি
প্রলয়ের রোষানলে।

‘পল্লীমানব’

অনিশ্চয়তা, সন্দিগ্ধতা এবং বিশ্বাসভঙ্গের রূপকল্প আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় অনেক ঘনঘন ফিরে ফিরে আসে:

এ অজ্ঞেয় সৃষ্টি ‘আমি
অজ্ঞেয় অদৃশ্যে যাবে নামি
তখনো সুদূরে ওই নক্ষত্রের দূত
ছুটাবে অসংখ্য তার দীপ্ত পরমাণুর বিদ্যুৎ
অপার আকাশ-মাঝে,
কিছুই জানি না কোন্ কাজে
বাজিতে থাকিবে শূন্যে প্রশ্নের সুতীব্র আর্তস্বর,
ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর।

‘প্রশ্ন’

অথবা,

এই তবু শেষ অভিসারে ধরণীর পারে
মিলন ঘটায়ে যাও অজানার সাথে
অন্তহীন রাতে।

আরো এগিয়ে,

ব্যক্ত কর, হে মোর কর্ণধার,
আঁধারহীন অচিন্ত্য সে
অসীম অন্ধকার।

‘কর্ণধার’

এবং,

মৃত্যু অন্ধকারময়
পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে আসন্ন তাহার পরিচয়।
‘শেষ অভিসার’

এর কয়েক মাস পরে প্রকাশিত হয় রোগশয্যায়। এই শেষ অসুখের সময় মৃত্যু সম্পর্কিত নতুন উৎকণ্ঠার বোধ আগের তুলনায় অনেক তীব্র, স্পষ্ট হয়ে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এটাই ছিল শেষ বছর। ভাগিনেয় সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে এ জগতের নিতান্ত আপতিক স্বরূপ তাঁর কাছে প্রকাশিত হয় এবং তাঁর মনকে তিক্ত করে তোলে। সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে পড়ার ভীতির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগজীর্ণ বর্ষীয়ান কবি-মন যুদ্ধের খবরে আরও অশান্ত হয়ে ওঠে। তাঁর আগেকার বিশ্বাসের অবশেষ ধরে রাখার জন্য তিনি প্রাণপণ সংগ্রাম করেছিলেন, কেননা, মানুষের আত্মিক বিকাশ কদাচিৎ সরলরৈখিক পথ ধরে চলে, অথবা মুহূর্তে সম্পূর্ণ হয়। ঘটনাচক্রে তাঁর নিজের জীবনের নানা দুর্দশা— অসুস্থতা, প্রিয়জন বিয়োগের শোক, বয়স, আসন্ন মৃত্যুর পদধ্বনি— বড় প্রেক্ষাপটে যা ঘটছিল, তারই প্রতীকি রূপ নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয় এবং সমস্যাটা ছিল সংগ্রামের ফলাফলের উপর বিশ্বাস ধরে রাখার। তাঁর শেষ পর্বের কবিতায় তুলনামূলক ভাবে নতুন ও বলিষ্ঠ এক অশুভের ধারণার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই ‘অশুভ’ অক্ষশক্তির মধ্য দিয়ে সভ্যতার বিপক্ষে দাঁড়ায়। কিন্তু মানুষের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে তার চ্যালেঞ্জ আরও ব্যাপক। বেদনাহত চিত্তে বর্ষীয়ান কবি এই দুর্জয় বিনাশী শক্তির স্বরূপ উপলব্ধি করেন। তিনি এই ক্ষমতার বিপক্ষে সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন এই বিশ্বাসে যে, পরিশেষে অশুভের পরাজয় অবধারিত। তিনি বুঝতে পারছিলেন পৃথিবীতে তাঁর নিজের দিন ফুরিয়ে আসছে এবং মৃত্যু-ভীতির সঙ্গে যোঝার সমস্যায় নিজেও জর্জরিত হচ্ছিলেন। প্রেমাস্পদের সঙ্গে এক অন্ধকার ঘরে সাক্ষাৎ হওয়া এবং তাকে সুন্দর প্রেমোপহার নিয়ে সম্ভাষণ করার কল্পনায় সান্ত্বনা লাভের দিন আর নেই। মৃত্যু এখন এতটাই নিকটবর্তী যে, সে আরও বাস্তব চেহারা নিয়ে কবির কাছে আবির্ভূত হয়। অবশ্য তিনি মানুষের সমষ্টিগত প্রচেষ্টায় আস্থা রেখে ব্যক্তিগত ভীতি জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন:

অনিঃশেষ প্রাণ
অনিঃশেষ মরণের স্রোতে ভাসমান,
… পদে পদে আপনারে শেষ করি দিয়া
পদে পদে তবু রহে জিয়া।

২ নং কবিতা

‘যদি’ ও ‘হয়ত’ এখনও অনন্ত অস্তিত্বের স্বপ্ন দেখায় :

মনে হয়, যেন
আকাশে অগণ্য গ্রহতারা
অন্তহীন কালে
আমারি প্রাণের দায় করিছে স্বীকার।

৭ নং কবিতা

নশ্বর-দেহ-বন্ধন থেকে মুক্ত পুনরুজ্জীবিত আত্মার কল্পনা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ভবিষ্যৎ থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাড়া অনিস্তার্য অতীত সম্পর্কে তাঁর কোনও খেদ নেই। সেই ভবিষ্যৎ,

যারে কোনো কালে পাই নাই,
যার মধ্যে আকাঙ্ক্ষা আমার
… দীর্ঘরাত্রি স্বপ্ন দেখেছিল
অনাগত আলোকের লাগি।

২২ নং কবিতা

যা এখনও দীপ্তিময়তায় জেগে থাকে তা পৃথিবী আর মানুষের প্রতি ভালবাসা :

বিদায় নেবার কালে
এ সত্য প্রেম অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।

আরোগ্য (১৯৪১) তাঁর শেষ সময়ের বন্ধুদের প্রতি উৎসর্গীকৃত, যারা,

… পথিক বন্ধু,
যেমন রাত্রির তারা
অন্ধকারে লুপ্তপথ যাত্রীর শেষের ক্লিষ্ট ক্ষণে।

এখন সত্য-মিথ্যা, জীবন-মরণ, আলো-অন্ধকার, সর্বজনীন-বিশেষ, অন্তহীন ধারা-আকস্মিক অন্ত, মহানন্দ-চরম কষ্ট, এই সমস্ত কিছুর বৈপরীত্যের বোধ তাঁর মনে তীব্র হয়ে বাজে। কেননা তারা ক্রমাগত পাশাপাশি অবস্থান গ্রহণ করে। স্পষ্টতই এই অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি শেষ বারের মতো নিজের তথা এই পৃথিবীর সামগ্রিক মানবিক অভিজ্ঞতার পুনর্মূল্যায়নে প্রয়াসী। উপনিষদের অন্তর্গত আনন্দ, অনন্ত, অমর্ত্য শব্দগুলির প্রতিধ্বনি শোনা যায় বারে বারে, কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন, কারণ এখন এসব শব্দ ব্যবহৃত হয় মানুষের ক্ষেত্রে। প্রেম ও মৃত্যুর প্রতি বিরোধী অবস্থানের ধারণা আবারও ফিরে আসে:

সব মূল্য ফুরাইলে যে দৈন্যপ্রেমের অর্ঘ্য আনে
অসীমের স্বাক্ষর সেখানে।

১৫ নং কবিতা

কঠিন পরীক্ষার অন্ধকার মূহূর্তে মানুষ তার অন্তরের সম্পদ সম্পর্কে সচেতন হয়।

দুঃসহ দুঃখের দিনে
অক্ষত অপরাজিত আত্মারে লয়েছি আমি চিনে।
আসন্ন মৃত্যুর ছায়া যেদিন করেছি অনুভব
সেদিন ভয়ের হাতে হয় নি দুর্বল পরাভব।

২৯ নং কবিতা

এ বিশ্বাস বৃদ্ধ কবিকে আশ্বস্ত করে যে, মানুষের অন্তরে দেবলুসভ গুণ বর্তমান। (১৯৪১ সালের শেষ ভাগে রচিত) জন্মদিনে-র অন্তর্গত একটি কবিতায় তিনি লেখেন,

ধরনীর দেবালয়ে রেখে যাব আমার প্রণাম
দিয়ে যাব জীবনের যে নৈবেদ্যগুলি
মূল্য যার মৃত্যুর অতীত।

১৩ নং কবিতা

এবং,

হে সবিতা, তোমার কল্যাণতম রূপ
করো অপাবৃত
সেই দিব্য আবির্ভাবে
হেরি আমি আপন আত্মারে মৃত্যুর অতীত।

২৩ নং কবিতা

বৈদিক ভাষাভঙ্গি, রূপকল্প এবং ধারণার প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। কিন্তু এখন তা শুধু মানুষের মধ্যকার ঐশ্বরিক গুণ সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়। কবির অসামান্য কবিত্ব হল, যখন উলঙ্গ হিংসা মানুষের অন্তরের পাশবিক রূপের উন্মোচন ঘটাচ্ছিল, তখন তিনি মানুষের সত্যকার মর্যাদা ও তার অন্তঃস্থ ঐশ্বরিক গুণাবলীর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন; পাশবিক শক্তির কাছে তিনি মাথা নত করতে প্রস্তুত ছিলেন না। এই প্রক্রিয়ায় তিনি তাঁর ভীতি এবং পুরাতন মোহের গ্রাস থেকে মুক্ত হন, কেননা, এখন আঁকড়ে ধরার মতো এক আশার আলো তিনি দেখতে পেয়েছেন, যা মানুষকে এই সর্বনাশ থেকে উদ্ধার করে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

মানুষের উজ্জ্বল উদ্ধারের সম্ভাবনা অবলোকন করার পর এখন তিনি বলতে পারেন, মৃত্যুর পর প্রকাশিত শেষ লেখা (১৯৪১) সংকলনটিতে মূলত শেষের দিনগুলিতে লেখা কবিতাগুলি সংগৃহীত হয়েছে। দৃষ্টি বিভ্রম, মানসিক আঘাতজনিত স্নায়বিক বিকার এবং ভয়ংকর অলীক কল্পনার রূপকল্পের বারংবার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভয়ানক সব শত্রু ভিড় জন্মায়, যাদের শেষ অবধি যুদ্ধে পরাজয় ঘটে। এখন তিনি সব মৌলিক প্রশ্নের উত্তরদানে সক্ষম এক সরল, পরিপাটি অধিবিদ্যা নির্মাণের সারা জীবনের স্বপ্নকে বিসর্জন দেন। বিখ্যাত গান— ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার’ (১ নং) শান্তিকে স্বাগত জানায়। সেই শান্তি, যা জীবনব্যাপী মিথ্যা ভয়ের সঙ্গে সংগ্রামের চড়া মূল্যে কিনতে হয়েছে তাঁকে।

রাহুর মতন মৃত্যু
শুধু ফেলে ছায়া,
পারে না করিতে গ্রাস জীবনের স্বর্গীয় অমৃত
… এ কথা নিশ্চিত মনে জানি।
প্রেমের অসীম মূল্য
সম্পূর্ণ বঞ্চনা করি লবে
হেন দস্যু নাই গুপ্ত
নিখিলের গুহাগহ্বরেতে।

২ নং কবিতা

অথবা,

আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।

১১ নং কবিতা

অতএব, মৃত্যুর কাছে জীবনের কিছু ঋণ থেকে যায়, অর্থাৎ মিথ্যা ভীতির কাছে নতিস্বীকার না করে বাঁচতে হবে পুরুষোচিত দৃপ্ততায়। লোভ নৃশংসতা অথবা পাশবিক শক্তি এগুলির মধ্যে যে শ্রেষ্ঠত্ব বা অপরাজেয়তার বড়াই করুক না কেন মানুষেরে চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাস বজায় রাখতে হবে।

অন্তিম ক্ষণ উপস্থিত হওয়ার দিন কয়েক আগে লেখা একটি কবিতায় তিনি অবশেষে মৃত্যু ও দুঃখ ভোগের ব্যাপারটির পুনর্বিচার করেন :

দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে
এসেছে আমার দ্বারে;
একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছি
কষ্টের বিকৃত ভাণ, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত—
অন্ধকারে ছলনার ভূমিকা তাহার।

যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস
ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।
…শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা,
দুঃখের পরিহাসে ভরা।
ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি—
মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।

১৪ নং কবিতা

কিন্তু কবি নিশ্চিত জানেন মৃত্যু ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু মানুষকে দমিয়ে রাখতে সে পারবে না। জীবনের শেষ মোড়ে তিনি যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেন এবং অসহ্য যন্ত্রণাভোগের মূল্যে অমূল্য সত্যের নাগাল পেতে সক্ষম হন। তাঁর বিশ্বাস ন্যস্ত মানুষের নির্ভীক প্রাণবন্ত সত্ত্বায়, যা দুঃখ কষ্ট ও মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে। তাঁর শেষ কয়েকটি চমকপ্রদ কবিতায় তিনি এই উপলব্ধি ব্যক্ত করেন এবং ভাবী প্রজন্মের জন্য রেখে যান এক ঐশ্বৰ্য্যময় উত্তরাধিকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *