রবীন্দ্রকাব্যে মানুষ ও নৈতিকতা
উত্তরাধিকার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ এক অস্তিত্বমূলক ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করেন। কিন্তু কেমন সে ঈশ্বর? কী তাঁর অভিপ্রায়? রবীন্দ্রনাথের ধ্যানের ঈশ্বর সুন্দর, দয়াময়, সর্বশক্তিমান ও সর্বদর্শী। এই বিশ্বাসের হাত ধরে যে সৃষ্টিতত্ত্ব নির্মিত হয় সেখানে প্রকৃতির মহত্তম সৃষ্টি মানুষ, জগতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে আবির্ভূত। মানুষের নৈতিক কর্তব্য হল এই স্বাভাবিক শুভ মহাজাগতিক সংকল্পনাকে বিকশিত করা এবং তার পূর্ণতা সাধন করা। কিন্তু মানুষের বুদ্ধিগত সীমাবদ্ধতা, নৈতিক অন্ধতা, আত্মিক জড়তা এবং বিধ্বংসী প্রবণতা তার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে। ফলস্বরূপ, মানুষ তার সেই নৈতিক দায়িত্ব পালন— ঈশ্বরে মহাজাগতিক লক্ষ্যের অনুবর্তী হওয়ার প্রচেষ্টাটিতে ব্যর্থ হয়। প্রাথমিক ভাবে মানুষের কাছে সেই উদ্দেশ্যটি থাকে নিতান্তই আকর্ষণজাত। কিন্তু সে যদি তার মেধা, ইচ্ছাশক্তি ও অনুভূতি ঈশ্বরে নিবেদন করে তাঁর ধ্যানে নিমগ্ন হয় তবে ঈশ্বরের অভীষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতনতার উদয় হবে এবং নিজ জীবনে মানুষ তা সফল করে তুলতে সচেষ্ট হবে।
প্রথম পর্বের রচনা কবি কাহিনী (১৮৭৮) থেকে গীতালি (১৯১৪) পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর ও মানুষের জন্য তাঁর রচিত পরিকল্পনা তথা মানুষের ভবিতব্য সম্পর্কে নিবিড় ভাবে সচেতন ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর মনোভাবে নানা সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে এবং আস্তিত্ববাদী বিশ্বাস-উদ্ভুত নৈতিকতা ও ধর্মসম্পর্কিত অস্থির অবস্থানের উপর তার বেশ কিছু প্রভাব পড়ে। কিন্তু তাঁর বিশ্বাসের কাঠামোয় ঈশ্বরই কেন্দ্রবিন্দু— এক অবিসম্বাদী বাস্তব উপস্থিতি। তিনি তাঁর যাবতীয় কর্মের জন্য ঈশ্বরের কাছে নৈতিক ভাবে দায়বদ্ধ। যেহেতু ঈশ্বর মানুষের প্রতি সদয় এবং তার সচেতনতা বৃদ্ধি ও অজ্ঞতা দূর করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত, কবিও এ জগতে ঈশ্বরের সহায়ক হিসাবে সকল মানুষকে ভালবাসা, বাণী ও কর্মের মাধ্যমে তাদের ঈশ্বর-সান্নিধ্য লাভের পথে পরিচালিত করা এবং মানুষের তন্নিষ্ঠ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার আহ্বান শুনতে পান। এমনকী দেশপ্রেমী কর্মকাণ্ডও তাঁর কাছে হয়ে ওঠে ঈশ্বর উপাসনার নামান্তর। তাঁর প্রতি নৈবেদ্য, লৌকিক প্রেম হয়ে ওঠে স্বর্গীয় প্রেমের প্রতিরূপ— প্রথম যুগের চিত্রা (১৮৯৬) ও কল্পনা (১৮৯৮) কাব্যগ্রন্থ দুটি তার স্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করে। কবির ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-তে রাধাকৃষ্ণের ইহজাগতিক প্রেম পরিবর্তিত হয় আদি স্বর্গীয় প্রেমের মূল্যরূপে। প্রাচীন ভারতীয় জীবন ও সমাজের রোমান্টিক পুননির্মাণেও আমরা এই অন্তঃপ্রবাহী সুরের অনুরণন শুনি: সুদুর অতীতে আত্মিক ভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে ছিল মানুষের নিবিড়তর সান্নিধ্য। বিবিধ প্রসঙ্গ (১৮৮৩) থেকে পঞ্চভূত(১৮৮৭) প্রবন্ধাবলীতেও কবির কল্পনায় ছিল এক আস্তিকতা কেন্দ্রিক বিশ্ব, যেখানে ঈশ্বর চালকের আসনে আসীন এবং মানুষ সহকারী দাঁড়ি হিসাবে তাঁর সহায়কের ভূমিকা পালন করে। নৈবেদ্য (১৮৮১) কাব্যগ্রন্থে এই রূপরেখা সুস্পষ্ট হয় এবং সম্ভবত সেই কারণেই কাব্যগুণের নিরিখে বিচার করলে কিছুটা দুর্বলতাও এই কবিতাগুলিতে লক্ষ্য করা যায়। বক্তব্য পরিস্ফুট হয়, পরবর্তী কালের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকলন সমূহতে: এগুলি হল আত্মশক্তি (১৯০৫), ভারতবর্ষ (১৯০৬), চরিত্রপূজা (১৯০৭), রাজা ও প্রজা, সমূহ, স্বদেশ ও সমাজ(সব কটি সংকলনই প্রকাশিত ১৯০৮ সালে কিন্তু প্রবন্ধগুলির রচিত হয় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পরবর্তী দু’ তিন বছরে। কবি তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে মিলে বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রয়াস করেছিলেন)। এগুলির পশ্চাদপটে আমরা এক সর্বশক্তিমান ও স্নেহশীল ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করি, জগতে মানুষ যাঁর সহকারী হিসাবে কর্ম সম্পাদন করে। বিখ্যাত আনুশাসনিক প্রবন্ধমালা শান্তিনিকেতন-এ (১৯০৯ থেকে ১৯৯৬-র মধ্যে সতেরোটি পর্বে প্রকাশিত) ঈশ্বর ও মানুষ সম্পর্কে কবির আত্মিক অবস্থান সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যাত হয়।
গীতাঞ্জলি (১৯১০) এবং বিশেষত গীতিমালা ও গীতালি (দু’টিরই প্রকাশকাল ১৯১৪ সাল) কাব্যগ্রন্থ সমূহ উপরোক্ত বিষয়বস্তুর ভিন্নতর পরিবেশনা মাত্র। এমনকী আত্মজীবনী জীবনস্মৃতি-তেও কবি বলেছেন যে, ঈশ্বর কাণ্ডারী হয়ে তাঁর জীবন পরিচালনা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে পাশ্চাত্য, জাভা, জাপান, পারস্য এবং রাশিয়া পরিভ্রমণের বৃত্তান্ত ব্যতিরেকে (১৯২৯ থেকে ১৯৩৬ এর মধ্যে প্রকাশিত) বিশুদ্ধ অর্থে কোনও প্রবন্ধ গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি। মানুষের ধর্ম (১৯৩৩), কালান্তর (১৯৩৭), সভ্যতার সংকট (১৯৪১), এবং আত্মপরিচয় (প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পরবর্তী কালে ১৯৪৩ সালে) প্রবন্ধগুলি এবং বহু সংখ্যক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্রই ১৯১৮ সালের পরে তাঁর গদ্য রচনার নিদর্শন।
দয়াময় ঈশ্বরে ছিল তাঁর প্রাথমিক বিশ্বাস। এ জগৎ তাঁরই পরিকল্পিত এবং সে জগৎ এক সুখকর দিকে অগ্রসরমান, যা থেকে উৎপন্ন হয় নিরাপত্তার বোধ এবং জন্ম নেয় ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস ও নির্ভরতা তথা মানুষের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতে আস্থা। মৃত্যুর আগে এই পরিমণ্ডল থেকে কবি অনেক দূর সরে এসেছিলেন। বেশ কিছু পারিপার্শ্বিক ঘটনা কয়েক দশক জুড়ে কবির মনোজগতে বিপুল আলোড়ন তোলে এবং তা থেকে সঞ্জাত হয় কবির নিজস্ব প্রতিক্রিয়া, যা তাঁর প্রাথমিক বিশ্বাসের সুদৃঢ় ভিত্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এবং, শেষ পর্যন্ত তিনি আর পূর্বেকার নিশ্চয়তাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারেন না। জীবনের শেষ পনেরো বছরে তিনি মঙ্গলময় ভবিতব্যে বিশ্বাসের আবরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন— বাধ্য হন বিশ্বাসের এক নতুন কাঠামো নির্মাণে। এবং সার্থক ভাবেই তিনি এই নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন। এই নতুন নির্মাণকে মানবকেন্দ্রিক বিশ্ববীক্ষা বলা যেতে পারে। এই বিশ্বে যেহেতু ঈশ্বর মানুষের বন্ধন ছিন্ন হয়েছে, সেহেতু তাঁর নৈতিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে
কিন্তু এই অনুসন্ধান শুরু করার আগে কবির পূর্বেকার বিশ্বাসের ভিত্তিকে স্মরণ করে নেওয়া যাক। আমরা জানি যে তাঁর ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণাগুলি গড়ে উঠেছিল নানান মতের প্রভাবে। এদের মধ্যে মুখ্যত উপনিষদের ব্রহ্মে বিশ্বাস উল্লেখ্য (অস্তিত্বমূলক ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে সংগঠিত রাখার স্বার্থে ব্রাহ্ম ধর্মে এই ধারণার সামান্য হেরফের ঘটানো হয়েছে)। এর পরেই উল্লেখ করতে হয় ঈশ্বরের ধারণা ও তাঁর প্রতি মনোভাবের ক্ষেত্রে কবির ওপর বৈষ্ণব ধর্ম চিন্তার গভীর প্রভাবের কথা। খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবও কবির ঈশ্বরের ধারণা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। এবং সবশেষে অবশ্যই বলতে হয় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবের কথা। যদিও বৌদ্ধ ধর্ম মূলত নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু অহিংসা, করুণা, প্রশান্তি, তিতিক্ষার ওপর বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বাস কবিকে আকৃষ্ট করে। উল্লেখ্য যে, কবি ইউরোপ ভ্রমণে যান মাত্র সতেরো বছরের কাঁচা মন নিয়ে। সেই সময়, এমনকী তার আগেও, পাশ্চাত্যের রেনেসাঁস উদ্ভূত মানবতাবাদের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটে এবং তিনি তা আত্মস্থ করেন। এই সমস্ত প্রভাব মানুষের নৈতিক দায়বদ্ধতার ধারণায় স্পষ্টতই ছাপ ফেলেছিল। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম ও পাশ্চাত্যের মানবতাবাদই সব থেকে শক্তিশালী প্রভাব। কবি নিজে বৈষ্ণব ও ঔপনিষদিক মতগুলিকে মানবতাবাদী দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ঈশ্বর যতক্ষণ প্রকৃত আশ্রয় ততক্ষণ দ্বিধাবিভক্ত দায়বদ্ধতা ও নৈতিক দোদুল্যমানতার রেশ থেকেই যায়; এমনকী কিছুটা দ্ব্যর্থকতাও। কারণ, ধর্মমতানুসারে বৈরাগ্য এক উচ্চতর আত্মিক ও নৈতিক অবস্থান নির্দেশ করে। এ কথা সত্য যে, অনেক আগেই কবি ঘোষণা করেছিলেন, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’, তথাপি সংসার পরিত্যাগী মানুষের জীবনচর্যাকে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর জ্ঞানে তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত থাকার রেশ তাঁর সমস্ত রচনায় থেকে যায় (বিশেষত পরের দিকের নাটকগুলিতে)— একমাত্র অন্তিম পর্যায়ের রচনা ব্যতিরেকে।
এই শেষ পর্বকে সাধারণ ভাবে মোহমুক্তির পর্ব বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ভারতবর্ষ, বিশেষত প্রাচীন ভারতবর্ষের সঙ্গে তথাকথিত আধ্যাত্মিকতার যে সম্পর্কের কথা প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে গতানুগতিক ভাবে উচ্চারিত হয়, তা আর একই রকম আকর্ষণীয় এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন হিসাবে রইল না। এবং, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পর্বে মনে হয় যেন তাঁর চোখের আবরণ খসে পড়েছিল। পাশ্চাত্যের মানবতাবাদের প্রকৃত স্বরূপ তাঁর সামনে উন্মোচিত হল এবং সাধারণ ভাবে তিনি পশ্চিমী সভ্যতার সমালোচনা ও মূল্যায়নে সমর্থ হলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্থূল জড়বাদ এবং ধনতন্ত্র, বিশেষত ফ্যাসীবাদ ও নাৎসীবাদের চূড়ান্ত রূপে যা রাজনৈতিক চেহারা নেয়, তা কবির কাছে রক্তমাখা দাঁত-নখের বীভৎসতা নিয়ে উপস্থিত হয়: ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের উলঙ্গ লড়াই প্রত্যক্ষ করে কবির মন বিদ্রোহ করে ওঠে।
প্রায় অবশ্যম্ভাবী ভাবেই, ১৯১৪ সালে এবং তিরিশের দশকের মধ্যেকার আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি তাঁকে নৈতিক মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য করে। মানুষ যদি ঈশ্বরের সহকারী বা সেবক এমনকী ‘পৃথিবীতে তাঁর প্রেমিক’ হিসেবে কাজ করে এবং ঈশ্বর নিজে যদি মানুষের শুভার্থী হন, তা হলে কেন এই দারিদ্র্য, কষ্ট আর উৎপীড়ন? কেন এই অর্থহীন মারণযজ্ঞ? কেন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী অথবা বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলিতে একই রকম উৎপীড়ন আর ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে? অথচ এই রাষ্ট্রগুলি তো অহিংসা ধর্মে বিশ্বাসী। আবারও নিজের দেশে কংগ্রেসের অনেক কার্যকলাপে শঠতা, দ্বিচারিতা এবং অসাধু সুবিধাবাদের প্রকাশে কবি বিরক্ত বোধ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, তথাকথিত আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্য মোটেও মানুষের কোনও উন্নতিসাধন করেনি। আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক সংস্কৃতি ব্যর্থ হয়েছে এবং তা হয়েছে চূড়ান্ত ভাবে। অতএব, ‘ঈশ্বর আছেন স্বর্গে/এবং জগৎ চলছে ঠিকঠাক’ অনুমানটি আর সমর্থনযোগ্য নয়।
ঠিক এই সময়েই বিশেষত গত শতাব্দীর বিশের দশকের শেষের দিক থেকে বর্ষীয়ান, অসুস্থ কবি জীবনের মূল্যের পুনর্মূল্যায়নে ব্রতী হন। বিখ্যাত কবিতা ‘প্রশ্ন’ (১৯৩১) শেষ হয় এক অমীমাংসিত সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বলা বাহুল্য এটি একটি আলঙ্কারিক প্রশ্ন যাতে নিহিত থাকে এক নেতিবাচক উত্তর। এ থেকে আমরা এই উপসিদ্ধান্ত (Corrolary)-তে পৌঁছতে পারি যে ঈশ্বর তাঁর মঙ্গলময় উদ্দেশ্যসাধনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর অস্তিত্ব এবং তাঁর মহাজাগতিক পরিকল্পনার উপস্থিতি সত্ত্বেও অশুভ বিদ্যমান এবং অশুভের শক্তি ক্রমবর্ধমান।
আমরা এই সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, মানুষকে এক কার্যকর পরিবর্তনের সন্ধান করতে হবে এবং সেই পরিবর্তনকে অবশ্যই হতে হবে ঈশ্বর নিরপেক্ষ। এক বর্ষীয়ান, অসুস্থ মানুষ, যিনি মঙ্গলময় ঈশ্বরের প্রতি লালন করেছেন এক সুদৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর কাছে এই সন্ধানের তাৎপর্য কী? এক রোমান্টিক আদর্শবাদী কবির জীবনে যখন স্পষ্টতই শেষ লগ্ন উপস্থিত, তখনই বা এই সন্ধানে কোন অর্থ খুঁজে বেড়ান তিনি? এ সবই আমাদের কাছে অচিন্তনীয় রয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তিনি অকুতোভয় এক কার্যকর নৈতিক সংহিতার সন্ধানে নিয়োজিত হন। এবং তিনি তা আবিষ্কারও করেন।
আমরা অবশ্যই এ কথা স্মরণে রাখব যে, জীবনের এই শেষ কয়েক বছরেও তিনি বারবার ফিরে গেছেন তাঁর পুরনো ঈশ্বরবাদী চেতনায়— খুঁজেছেন স্বস্তি, খুঁজেছেন সান্ত্বনা। পুরনো অভ্যেসের মৃত্যু সহজে হয় না, পুরনো মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়া কঠিনতর। এবং তাঁর অন্তরের গভীরে ক্রমে এ সবের এক চরম যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু ঘটেছিল— অতি ধীর লয়ে, কিন্তু নিশ্চিত ভাবে।
ঈশ্বরের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো সৃষ্টিতত্ত্বও উধাও হয়। তিনি এ বার অসাধারণ মানসিক প্রত্যুৎপন্ন এবং উদ্যম নিয়ে বিজ্ঞান, বিশেষত, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার অনুশীলনে নিয়োজিত হন। আর সেখানে তিনি আবিষ্কার করেন যে, এ জগতের কোনও সহৃদয় পিতৃসম শাসক বা নিয়ন্ত্রক নেই। জগৎ এক অপরিবর্তনীয় প্রাকল্পিক নিয়মের নিগড়ে বাঁধা যা মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে উদাসীন। অর্থাৎ জীবনের কোনও অন্তর্নিহিত অর্থ নেই। জীবনকে অর্থবহ করে তোলাই মানুষের মহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। এবং মানুষের জীবনের সফলতা ও সার্থকতা ব্যক্তি-মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তোলার ক্ষমতার সমানুপাতী। এবং, এই অর্থবহতা শুধু তাৎক্ষণিক ও ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও মানবতার পরিপ্রেক্ষিতেও তাকে হতে হবে অর্থপূর্ণ। শ্যামলী (১৯৩৮)-র ‘আমি’ কবিতায় শাশ্বত সৌন্দর্য্যের বাণীতে এ সত্য উচ্চারিত হয়।
প্রকৃতির পরিকল্পনায়— যদি আদৌ সে রকম কোনও পরিকল্পনা কখনও থেকে থাকে— মানুষ সম্পূর্ণত ভূমিকা বর্জিত এবং এক অতলান্ত রহস্যময় ও রাজসিক ঐশ্বর্যশালী মানুষের ধারণা আমাদের অনুভবে আসে। কেননা, মানুষের মহৎ ও নিঃস্বার্থ কর্ম তার কাছে মোক্ষ, মুক্তি বা স্বর্গের পুরস্কার নিয়ে আসে না, আনে না কোনও উৎকৃষ্টতর পরজন্মের প্রতিশ্রুতিও। পরিস্থিতির দাবি মেটাতে সে আত্মবলিদান করে কোনও নির্দিষ্ট আদর্শ বা ধারণার প্রণোদনে, যা থেকে তার নিজস্ব কোনও প্রাপ্তিই নেই।
দুই বিশ্বযুদ্ধের নরসংহারের কালে তিনি বেঁচেছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বার্থে হাজারো মানুষের আত্মত্যাগ এবং তার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন অবিনশ্বর মহিমামণ্ডিত এক স্বর্গীয় গৌরবের দীপ্তি যা মানুষের ভঙ্গুর নশ্বর দেহ-কাঠামো অবলম্বন করে বিচ্ছুরিত হয়।
দুটি বিশ্বযুদ্ধ কবির চক্ষু উন্মীলিত করে। ‘কেন তেমনি করে অসংখ্য যুবক-যুবতী যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছিল?’ কোনও আদর্শের কারণে? শেষ বিচারে আদর্শ কোন প্রয়োজন সাধন করে? কবি এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বীথিকা (১৯৩৭) কাব্যগ্রন্থের ‘দেবতা’ কবিতায়:
যখন মরণপণে হানি অমঙ্গল।
ত্যাগের বিপুল বল
কোথা হতে বক্ষে আসে;
অনায়াসে দাঁড়াই উপেক্ষা করি প্রচন্ড অন্যায়ে।
অকুণ্ঠিত সর্বস্বের ব্যয়ে।
তখন মৃত্যুর বক্ষ হতে
দেবতা বাহিরি আসে অমৃত-আলোতে
এখন আমরা ঈশ্বরের ধারণায় নতুন ব্যঞ্জনার সম্মুখীন হব। পত্রপুটে কবি বলেন :
আজ আপন মনে ভাবি,
“কে আমার দেবতা,
কার করেছি— পূজা”।
শুনেছি যাঁর নাম মুখে মুখে,
…আজ দেখছি প্রমাণ হয় নি আমার জীবনে,
কেননা, আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন।
…দলের উপেক্ষিত আমি,
মানুষের মিলন—ক্ষুধায় ফিরেছি,
যে মানুষের অতিথিশালায়, তার,
প্রাচীর নেই, পাহারা নেই।
–তাকে বলেছি হাত জোড় করে
হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ,
পরিত্রাণ করো
ভেদচিহ্নের-তিলক-পরাও
সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।
…সকল মন্দিরের বাহিরে
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল
দেবলোক থেকে
মানবলোকে।
১৫ নং কবিতা
অন্য এক কবিতায় তিনি পৃথিবীকে বিদায় জানান :
শুধু রেখে গেলাম নতমস্তকের প্রণাম
মানবের হৃদয়াসীন সেই বীরের উদ্দেশ্যে—
মর্ত্যের অমরাবতী যাঁর সৃষ্টি
মৃত্যুর মূল্যে, দুঃখের দীপ্তিতে।
১২ নং কবিতা
এই উদ্দেশ্যহীন প্রাণসংহারে কোনও ঈশ্বরের অনুমতি নেই, কোনও ঈশ্বর কোনও দিন তা অনুমোদন করতে পারেন না। প্রান্তিক-এ এক প্রার্থনায় তিনি বলেন:
মহাকালসিংহাসনে—
সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,
কণ্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী
কুৎসিত বীভৎসা ‘পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন
নিত্যকাল রবে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের
হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধকণ্ঠ ভয়ার্ত এ শৃংখলিত যুগ যবে
নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভষ্মতলে।
১৭ নং কবিতা
মানুষের দিগন্ত থেকে ঈশ্বর অপসারিত হলে তার কাজ কঠিনতর হয়: তাকে নৈতিক উৎকর্ষের চূড়া ছুঁতে হবে। কিন্তু তা ঈশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নয়, মানুষ ও পৃথিবীতে তার অগ্রগতি এবং অনুগত উত্তরসূরীদের জন্য ব্যক্তিমানুষের এই সাধনা। অতীতের আত্মত্যাগী বীরেদের কাছেও তার ঋণ থেকে যায় এবং থাকে প্রতিশ্রুতি পালনের দায়বদ্ধতা। ইতিহাসের এই ক্ষণে এখনও থেকে যায় অনেক পথ অতিক্রম করার ভার, থেকে যায় অঙ্গীকার মোচনের দায়। মানুষকে আদেশ করা, শাস্তি প্রদান করা অথবা পুরস্কৃত করার জন্য কোনও বহিঃস্থ, অতিপ্রাকৃতিক, মঙ্গলময় বিধাতা আর নেই: শুধু মানুষের স্বার্থেই তাকে সত্যিকারের নৈতিক প্রতিনিধি হয়ে উঠতে হবে।
লক্ষ্যণীয়, এই সময়কালেই কবি পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি নতুন করে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। বিজ্ঞানের এই দুই শাখার অধ্যয়ন থেকে তাঁর মনে হয়, সৃষ্টিজগৎ মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে নিতান্তই উদাসীন; এই বিজ্ঞান লব্ধ জ্ঞান সৌরজগতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যানের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি উপলব্ধি করেন যে, বুনিয়াদী অধিবিদ্যামূলক প্রশ্নাবলীর কোনও সদুত্তর নেই। নবজাতক কাব্যগ্রন্থের ‘প্রশ্ন’ কবিতায় তিনি বলেন:
অসমাপ্ত রেখে যাবে তার শেষকথা
আত্মার বারতা।
….বাজিতে থাকিবে শূন্যে প্রশ্নের সুতীব্র আর্তস্বর,
ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর।
বীথিকা (১৯৩২)-র অন্তর্গত অতি মর্মস্পর্শী এক কবিতায় তিনি প্রতীকি অর্থে এক ভাগ্যহীনা নারীর বর্ণনা করেন, যে দুঃখে কষ্টে, ‘দেবতা যেখানে ছিল সেখানে’,
জ্বালাইতে গেলে ধূপ,
সেখানে বিদ্রুপ।
সর্ব শূন্যতার ধারে
জীবনের পোড়ো ঘরে অবরুদ্ধ দ্বারে
দাও নাড়া;
ভিতরে কে দিবে সাড়া?
মূর্ছাতুর আঁধারে উঠিছে নিশ্বাস,
ভাঙা বিশ্বে পড়ে আছে ভেঙে-পড়া বিপুল বিশ্বাস।
মানুষের স্বপ্ন, লক্ষ্য, অভীষ্টের প্রতি উদাসীন এক জগৎ, যেখানে পথ প্রদর্শনকারী বা সাহায্যকারী কোনও ঈশ্বর অনুপস্থিত। মানুষ কী আকাঙ্ক্ষা করবে, কোন কাজই বা সে সম্পন্ন করবে? কী তার ব্রত? সে কি অসহায় এক জীব? উদ্দেশ্যহীন ইতস্তত পরিক্রমণই সে জীবনের শেষ কথা? ‘না, না’; আর্তনাদ করে ওঠেন কবি:
নহি নহি আমি নহি অপূর্ণ সৃষ্টির
সমুদ্রের পঙ্কলোকে অন্ধ তলচর
…আমি কর্তা, আমি মুক্ত দিবসের আলোতে দীক্ষিত,
কঠিন মাটির পরে
প্রতি পদক্ষেপ যার
আপনার জয় করে চলা।
ঈশ্বর হারিয়ে সৃষ্টি হল এক মহাজাগতিক ও অধিবিদ্যামূলক শূন্যতা, ছিন্ন হল নৈতিক বন্ধন। কিন্তু কবি নিজের বিশ্বাসের জন্য পরম নিষ্ঠাভরে গড়ে তুললেন এক নতুন অন্তিম আশ্রয়স্থল: পূর্বেকার মূল্যবোধ থেকে ক্রমাগত মোহমুক্তির পর্বে তিনি রোপণ করলেন নতুন কিছু মূল্যবোধের। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর উৎসাহ তাঁকে সাহায্য করে মানুষকে প্রকৃতি জয়ী হিসাবে দেখতে, যে মানুষ যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে নিজের ভাগ্যোন্নতিতে সচেষ্ট। ধনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গের পর আর এক বিশ্বাসের জন্ম হয়— সমাজতন্ত্র। ১৯১৮ সালে সোভিয়েত বিপ্লবের পরপর তিনি মর্ডান রিভিউ (জুন, ১৯৯৮)-তে লেখা একটি প্রবন্ধে দ্বিধাহীন চিত্তে বহু উপেক্ষিত এক বাস্তবকে স্বাগত জানান। একই বছরে যক্ষপুরী নাটিকায় লোভ এবং ক্রমাগত সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলায় আধারিত ধনতন্ত্রের অসারতা ও পতনের ছবি আঁকেন। ১৯২৬ সালে তিনি পূর্বেকার নাটিকার বিস্তৃততর পুনর্লেখন করেন রক্তকরবী নামে। ১৯২০ সালে তিনি রাশিয়া পরিভ্রমণ করেন। যদিও সোভিয়েত ব্যবস্থায় প্রথম দিককার কিছু বাড়াবাড়ি তাঁর মনঃপুত হয়নি এবং পরবর্তী কালেও তা সম্পর্কে কিছু আপত্তি থেকেই গিয়েছিল, তবুও এ কথা সত্যি যে সোভিয়েত রাষ্ট্রসংঘে তিনি ধনতন্ত্রের কার্যকরী পরিবর্তের সন্ধান পেয়েছিলেন। নিকট ও প্রিয়জনের কাছে লেখা চিঠির পর চিঠিতে তিনি মানুষের সমান অধিকারের স্বীকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত এই ব্যবস্থার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের উপর বারংবার তাঁর বিশ্বাস ব্যক্ত করেন। ইতিহাসের প্রতি নতুন উৎসাহ থেকে তাঁর মনে হয় ধনতন্ত্র আপন ফাঁদে আপনি পতিত, কেননা তা মানুষের হীনতম প্রবৃত্তিকে আশ্রয় করে সমৃদ্ধশালী হয়। এবং এখন কবির মনে এই বিশ্বাস জন্মায় যে মানুষের নৈতিক কর্তব্য হল তার মহত্তর প্রবৃত্তিগুলির ভিত্তিতে এক নতুন পৃথিবী গড়ে তোলা। সন্দেহ নেই, সুকঠিন এই কাজ। কিন্তু তাঁর সভ্যতার সংকট (১৯৪১)-এ অন্তিম উচ্চারণে তিনি মানুষের উপর তাঁর বিশ্বাস ব্যক্ত করেন এবং দ্বিধাহীন ভাবে ঘোষণা করেন, ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চয়িতা কাব্য সংগ্রহের জন্য কবিতা নির্বাচন করেন কবি নিজে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, তাঁর কবি জীবনের ষাট বছরের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ রচনা প্রথম পঞ্চাশ বছরের এবং এক তৃতীয়াংশ কবিতাই রচিত হয় মাত্র শেষ দশটি বছরে। এই অসমানুপাতিক চয়নের এক মাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে পরের দিককার কবিতার প্রতি তাঁর নিজস্ব পক্ষপাতিত্ব: তিনি সেগুলিকে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেছিলেন। এই কবিতাগুলিতে দেখতে পাই নৈতিক প্রতিনিধি হিসাবে মানুষ তার ঈশ্বরের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নয়, কারণ তাকে প্রশ্ন করার জন্য কোনও ঈশ্বর নেই। মানুষের জন্য বাঁচাই তার একমাত্র কর্তব্য। লৌকিক শিল্প সাহিত্যের ঐতিহ্য তাঁকে চিরকালই আকৃষ্ট করেছে, কিন্তু শেষ দশ বছরে তিনি নতুন উৎসাহে এই সংস্কৃতির অন্তঃজাগতিক ঐতিহ্যের প্রতি মনোনিবেশ করেন। এটি ঠিক এই কারণে যে, মধ্যযুগীয় কবিরা তাঁদের রচনায় সমস্ত রক্ষণশীল ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন এবং তাঁদের মরমিয়াবাদ ছিল সাধারণ ভাবে মানবকেন্দ্রিক। তিনি ক্রমাগত সেই বোধে উপনীত হচ্ছিলেন যে, মানুষের সেবাই মানুষের ব্রত। ঈশ্বরের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত, প্রতিকূল, বৈরী এই জগতে এক নতুন স্বর্গ ও এক নতুন মর্ত্য নির্মাণ করার কর্তব্য সাধনের ব্রত পালনের দীক্ষায় মানুষ এখন পূর্ণ মহিমায় আত্মপ্রকাশ করে।
কবির জীবনের অন্তিম পর্বে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়— সংশয় ও বিশ্বাস। জীবনের তথাকথিত অপরিবর্তনীয়, পবিত্র, শ্বাশত সত্য সমূহের অধিকাংশ, যা তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় জুড়ে আঁকড়ে থেকেছেন এবং এতদিন যা তাঁর জীবনকে অর্থপূর্ণ করেছে এখন তিনি তাদের সম্পর্কে সংশয়াপন্ন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ঈশ্বরের কাছে মানুষের কৈফিয়ৎ-যোগ্যতায় আস্থা হারিয়েছেন, কেননা, এখন তাঁর জগৎ পূর্বতন সৃষ্টি তত্ত্বের সঙ্গে খাপ খায় না। এ জগৎ মানুষের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এবং উদাসীন। তা হলে মানুষ কেন বাধ্য থাকবে এমন এক মহাজাগতিক সংকল্পনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে যা এখন তার কাছে নিতান্তই অর্থহীন? তা স্বস্তিকর এবং আরামদায়ক বলে কবি এই সহজ আত্মতুষ্টিকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করেন। তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে প্রকাশিত নবজাতক কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘কেন’ কবিতায় তিনি লেখেন:
মহাকাল করিতেছে দ্যুতখেলা
বাঁ হাতে দক্ষিণ হাতে যেন—
কিন্তু, কেন।
…প্রশ্ন মনে আসে আরবার,
আবার কি ছিন্ন হয়ে যাবে সূত্র তার—
রূপহারা গতিবেগ প্রেতের জগতে
চলে যাবে বহু কোটি বৎসরের শূন্য যাত্রাপথে?
উজাড় করিয়া দিবে তার
পান্থের পাথেয়পাত্র আপন স্বল্পায়ু বেদনার
ভোজশেষে উচ্ছিষ্টের ভাঙা ভান্ড হেন?
কিন্তু, কেন।
কবি এখন তাঁর এ সব প্রশ্নের কোনও মধুর সান্ত্বনাদায়ক উত্তর সাজাতে অস্বীকার করেন। তিনি এ প্রশ্নের বাস্তবতা স্বীকার করেন এবং অস্তিত্বের গভীর রহস্যময়তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখেন যে, এই উত্তরহীন অজানা তাঁর হৃদয়ে বসত করে। মৃত্যুর বারো দিন আগে তিনি বলেন :
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়—
কে তুমি
পেল না উত্তর।
শেষ লেখা— ১৩ নং কবিতা
অতএব, মানুষকে এই সমস্ত অনিশ্চয়তা ও উত্তরবিহীন প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। ঈশ্বরকেন্দ্রিক নিটোল সৃষ্টিতত্ত্বের কাঠামো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সংশয় মৃত্যু পথযাত্রী কবির সংকল্পকে সুদৃঢ় করে মাত্র। তিনি মানুষের জন্য এক প্রকৃতার্থে তাৎপর্যপূর্ণ উত্তরাধিকার রেখে যেতে চান, যা হবে সুস্থায়ী এবং তা তাঁকে আত্মিক বিপন্নতার দিনে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এই উত্তরাধিকার এক নতুন ‘বিশ্বাস’-এ প্রোথিত। মৃত্যুর তিন মাস আগে তিনি লেখেন:
মর্তের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীৰ্বাদ।
শেষ লেখা— ১০ নং কবিতা
তারও কিছুদিন আগে আমরা শুনতে পাই:
উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব
নব জীবনের আশ্বাসে
জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়,
মন্ত্রি উঠিল মহাকাশে।
শেষ লেখা— ৬ নং কবিতা
তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক বিবৃতিটি রূপ নেয় তাঁর শেষতম কবিতায়। সেখানে অত্যন্ত স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তিনি নানা শঠতার কথা উল্লেখ করেন, যা একজন সৎ ও নিষ্পাপ মানুষকে বিপথে চালিত করে। তিনি জীবনকে সম্বোধিত করেন:
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছে নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে-পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।
শেষ লেখা— ১৫ নং কবিতা
বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় যে, গোটা কবিতা জুড়ে জীবনকে ছলনাময়ী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু, কবিতার শেষে এই জীবনই মানুষের কাছে অক্ষয় প্রশান্তি নিয়ে আসে, কেননা, সে জীবন সম্পর্কে মোহমুক্ত। অতএব, কোনও সুবিচারের আশাতেও সে দিন গোনে না। জীবনের সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি সে মনুষ্যোচিত প্রশান্তি নিয়ে বহন করে।
কবি তাঁর জীবনের শেষের বছরগুলিতে এই নৈতিক, ঋজু মানুষের প্রশস্তি গেয়েছেন। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে মানুষই একমাত্র নৈতিক চয়নে সক্ষম। এখন কবির দৃষ্টিতে মানুষ স্বভাবতই মহৎ নৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে তথা মানুষের প্রগতির স্বার্থে অসীম ত্যাগ স্বীকারে সক্ষম। এই গ্রহে মানুষের ভবিষ্যৎ বিনষ্ট করতে উদ্যত দানবিক, বিধ্বংসী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল যে মানুষ, পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে কবি সেই মানুষের প্রতি উদীপ্ত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন যে, মানুষ দুর্বল এবং তার ক্ষমতা ও সাফল্য সীমাবদ্ধ। তা সত্ত্বেও, তিনি উপলব্ধি করেন যে, এই দুর্বল মানুষের মধ্যেই দেবত্ব অর্জনের সুপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এখন তিনি মানুষকে সেই গৌরবে ভূষিত করেন যা এতকাল ধারণাগত ভাবে শুধু ঈশ্বরেরই প্রাপ্য ছিল এবং এখন তিনি ঈশ্বর যে কাজে ব্যর্থ হয়েছেন তা সম্পন্ন করার ভার তুলে দেন মানুষের হাতে। এই মনোযোগের স্তর পরিবর্তন আসে অন্তত এক দশকের অবর্ণনীয় আত্মিক যন্ত্রণাভোগের মধ্য দিয়ে। প্রথমে এই বোধ আসে অন্ধকারাচ্ছন্ন রহস্যময়তা নিয়ে, যেন কোনও ঝাপসা কাচের ভিতর দিয়ে। কিন্তু শেষের দিকে তিনি সরাসরি এই বাস্তবের সম্মুখীন হয়ে তা প্রত্যক্ষ করেন। এবং একবার এই দীপ্ত সমুজ্জ্বল অন্তর্দৃষ্টি লাভ করার পর তিনি আর ফিরে তাকাননি। তিনি মানুষকে আশীর্বাদ করেন এবং মানুষের ভবিতব্য পরিবর্তনের দুরূহতম কাজ তার জন্য বরাদ্দ করেন; কেননা এটাই মহত্তম ব্রত এবং একমাত্র মানুষই তা সার্থক ভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম। মানুষকে ক্ষমতা ও গৌরবে মণ্ডিত করা- যে গুণ প্রথাগত ভাবে ঈশ্বরে আরোপিত হত— কবির শেষ উল্লেখযোগ্য কাজ। এটা কোনও আপতিক ঘটনা নয় যে তিনি এই অন্তিম পর্বে টি এস এলিয়টের ‘Journey of the Magi অনুবাদ করেন (কবির বাংলা অনুবাদের শিরোনাম ‘তীর্থযাত্রী’)। কবিতাটিতে বিপদ সংকুলতা ও হতাশার মধ্য দিয়ে মানুষের আধ্যাত্মিক যাত্রার বর্ণনা করা হয়েছে। এটাও কোনও আকস্মিক ঘটনা নয় যে ওবেরামেরগউ-এ Oberammergau Passion Play দেখার এত বছর পর তিনি তাঁর অমর কবিতা ‘শিশুতীর্থ’ রচনা করেন শিশুর জন্ম উদযাপনে। তিনি আধ্যাত্মিক ভাবে এক পুনর্জন্মের স্বপ্ন দেখছিলেন। অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মানবতার পুনরুজ্জীবনের আশায় দিন গুণছিলেন।
এক কবি বলেছিলেন, প্রাচীন ভারত হ’ল ‘যে তাৎক্ষণিকের সীমার বাইরে দেখতে পায়’ (তুলনীয়, কবি ক্রান্তদর্শী)। এই অর্থে রবীন্দ্রনাথ কবিদের কবি। তিনি মানুষ নিধনযজ্ঞ, অসংখ্য মৃত্যু এবং পৃথিবীব্যাপী ধ্বংসলীলার ওপারে মানুষের আয়ত্তাধীন মহত্তম নৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনার কথা উপলব্ধি করেছিলেন।