রবিন হুড – ১৭

সতেরো  

এতটা সহজে হারফোর্ডের বিশপকে জব্দ করে রবিন হুড একটু অসতর্ক হলেন। মনে-মনে ভাবলেন, ‘কাপুরুষ পাদরি শীঘ্র আর সারউডে আসতে সাহস পাবে না। এই ঘটনার একদিন পরেই সকাল বেলা রবিন হুড আবার সদর রাস্তায় বেড়াচ্ছিলেন। খানিক দূরে গেলে পরে রাস্তার মোড়। মোড় পার হয়েই হঠাৎ দেখেন, সামনে একেবারে বিশপ মহাশয় সশরীরে হাজির।

অপদস্থ ও অপমানিত হয়ে বিশপের মনে প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠেছিল। তাই তিনি শেরিফের কিছু সৈন্য সংগ্রহ করে সারউড বনে এসে হাজির হয়েছেন। রবিন হুডকে জব্দ করতেই হবে। এমন সময় হঠাৎ সামনে রবিন হুডকে দেখতে পেয়ে, তিনি প্রথমটা থতমত খেয়ে গেলেন কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার লোকজন নিয়ে তাঁকে তাড়া করলেন।

রবিন মহা মুশকিল দেখে, রাস্তা ছেড়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করলেন। পাদরি মহাশয়ও তাঁর পেছনে ছুটলেন বটে, কিন্তু দেখতে–দেখতে রবিন হুড যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে পড়লেন, কিছুতেই তা ঠিক করতে পারলেন না। রবিন হুড যেন মন্ত্রবলে হঠাৎ বনের মধ্যে মিশে গেলেন।

বিশপের চিন্তা হল, শিকার বুঝি বা পালিয়ে যায়। তখন চিৎকার করে সৈন্যদেরকে বললেন,—’ শয়তানটার পিছন-পিছন যাও। খবরদার! পালায় না যেন। তোমরা জনা কয়েক মিলে এখানকার জঙ্গলটা উলটপালট করে খুঁজে দ্যাখো, আমি বাকি লোকদের নিয়ে সদর রাস্তায় এগিয়ে গিয়ে, ওর পথ বন্ধ করে দিই।’

বিশপ মহাশয়ের মনে ভয়, বনের ভিতরে থাকলে আবার কোনও বিপদ হাজির হবে। তাই তিনি চালাকি করে সদর রাস্তায় বের হয়ে আসলেন।

সেখান থেকে প্রায় এক মাইল দূরে জঙ্গলের পাশে একটি পুরোনো জীর্ণ কুটির ছিল। এই কুটিরে সেই বৃদ্ধা বিধবা স্ত্রীলোকটি থাকত। বনে প্রবেশ করেই রবিন হুড ভাবলেন, এই বিধবার কুটিরই পালানোর একমাত্র জায়গা। তখন খুব সাবধানে সেই কুটিরের কাছে এসে, একটি ছোট জানলা দিয়ে তাঁর মাথা ঢুকিয়ে দিলেন।

বৃদ্ধা চরকায় সুতা কাটছিল, হঠাৎ জানলা দিয়ে একটা মাথা ঢুকল দেখে, ভয়ে চিৎকার করে উঠল। রবিন বললেন,—’চুপ-চুপ বুড়িমা। ভয় নেই, আমি রবিন হুড! তোমার ছেলেরা কোথায়?

‘আমার ছেলেরা তো তোমারই কাছে বাবা!’

‘তাহলে বুড়িমা, আজ আমার একটু উপকার করো, আমি বড় বিপদে পড়েছি। বিশপ মহাশয় লোকজন নিয়ে আমাকে তাড়া করেছেন। এখন তুমি একটা কিছু ফন্দি করে আমায় বাঁচাও।’

‘নিশ্চয়ই বাবা! এতে আর কথা আছে? এক কাজ করো— আমার কাপড়চোপড় তুমি পরো, তোমার কাপড় আমাকে দাও—দেখা যাবে ব্যাটারা বুড়িকে চিনতে পারে কি না।’

‘ঠিক বলেছ বুড়িমা। তাহলে জানলা দিয়ে তোমার কাপড়গুলি দাও, চরকাটাও দিও, আমি আমার লিঙ্কান গ্রিন পোশাক, তিরধনুক সবই তোমাকে দিচ্ছি।’

চোখের নিমেষে রবিন হুড বুড়ির সঙ্গে পোশাক বদল করে, তার চরকা হাতে দিব্যি বুড়িটি সাজলেন। সেই সময় বিশপ ও লোকজন নিয়ে এসে হাজির। বৃদ্ধা অতি কষ্টে এক হাতে লাঠি ভর করে চলেছে, অন্য হাতে চরকা। বিশপ একজন লোককে বললেন, ‘ওহে! বুড়িকে জিজ্ঞাসা করো দেখি, রবিন হুডকে দেখেছে কি না?‘

একজন সৈন্য এগিয়ে এসে বৃদ্ধার কাঁধে হাত দিল। বৃদ্ধা রেগে বলল,–’আ মলো যা! ছাড় বলছি শিগগির! নইলে এক্ষুনি শাপ দেব।’

মূর্খ সৈনিক, শাপকে তার ভয়। বৃদ্ধার কথা শুনে তাড়াতাড়ি তাকে ছেড়ে বলল,–চটো কেন বুড়িমা! আমি তোমাকে কিছু বলব না। হারফোর্ডের বিশপ মশাই জিজ্ঞাসা করছেন, তুমি কি ডাকাত রবিন হুডকে দেখেছ?’

‘কেন দেখব না? রবিন হুড আমাকে দেখতে আসেন, গরিব বুড়িকে খাবার এনে দেন, কাপড়চোপড় দেন। কেন বাপু, সেটা কি বেআইনি কাজ? কেউ কি তাঁকে বারণ করতে পারে? তোমার পাদরি মশাইও বোধ করি বুড়ির জন্য এতটা করবেন না।’

বিশপ অতি কর্কশ স্বরে বললেন—’থাম বুড়ি থাম! তোকে বক্তৃতা করতে হবে না। শিগগির বল রবিন হুডকে কখন দেখেছিস, তা নইলে এক্ষুনি ডাইনি বলে ধরে নিয়ে গিয়ে তোকে বার্নস ডেল শহরে পুড়িয়ে মারব।’

ভয়ে জড়সড়ো হয়ে বুড়ি জোড়হাত করে বলল,–’দোহাই হুজুর! রক্ষা করুন! রবিন এই আমার ঘরেই আছে। কিন্তু তাকে জ্যান্ত ধরতে পারবেন না।’

‘সেটা দেখা যাবে এখন।’ বিশপের ভারী স্ফূর্তি। লোকদের বললেন,—’ যাও এখনই ঘরে। দরকার হলে ঘরে আগুন দেবে! কিন্তু যে রবিন হুডকে জ্যান্ত ধরতে পারবে, তাকে বকশিশের ওপর আরও এক থলে মোহর দেব।’

এদিকে বৃদ্ধা সুযোগ বুঝে ধীরে-ধীরে এগোল। কিন্তু মনোযোগ দিলে দেখতে পাওয়া যেত যে, সে যতই বনের কাছ হতে লাগল, ততই তার গতি যেন দ্রুত হল। তারপর বনে প্রবেশ করে একেবারে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়!

লিটল জন কাছেই বনের মধ্যে ছিল। বৃদ্ধাকে এরকম ছুটতে দেখে বলে উঠল,–’বাবা! এ আবার কে আসছে? স্ত্রীলোকই হোক আর ডাইনিই হোক, এমন ছুটতে তো কাউকে দেখিনি! দেখা যাক, মাথার ওপর দিয়ে একটা তির চালিয়ে দিই।’

নারীবেশী রবিন হুড বলে উঠলেন,–’না, না, খবরদার তির মেরো না, আমি রবিন হুড। এখন তাড়াতাড়ি লোকজন ডাকো জন, আমার সঙ্গে এসো, হারফোর্ডের বিশপের সঙ্গে আবার একটা গোল বেধেছে।

লিটল জন অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে করে শিঙা বাজাল। দেখতে–দেখতে দস্যুদল এসে হাজির। তখন জন হেসে বলল,—’চলুন মিসেস রবিন! পথ দেখিয়ে চলুন, আমরাও পিছন-পিছন যাচ্ছি।’

এদিকে বিশপ কুটিরের কাছে দাঁড়িয়ে রেগে অস্থির! মুখে যতই বলুন না কেন, কুটির জ্বালিয়ে দিতে সাহস পেলেন না। তাঁর লোকজন প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু কিছুতেই দরজা খুলতে পারল না। তখন বিশপ হুকুম করলেন,—’ দরজা ভেঙে ফ্যালো।’

অনেক চেষ্টার পর দরজা ভেঙে গেল। ভয়ে ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে চায় না, পাছে তির খেয়ে প্রাণটা যায়। তাদের মধ্যে একজন লোক ছিল, চোখ তার খুবই পরিষ্কার। ঘরের ভেতর খানিক উঁকিঝুঁকি মেরে সে বলে উঠল—’ওই যে ব্যাটাকে দেখতে পাচ্ছি। এক কোণে বসে আছে। মারি বল্লমের খোঁচা?’

বিশপ বললেন,–’দ্যাখো, যেন মেরে ফেলো না। জ্যান্ত ধরবার চেষ্টা করো। বেটাকে নিয়ে নটিংহামে খুব ঘটা করে ফাঁসি দেওয়া যাবে।’

কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিশপ মশাইয়ের রবিন হুড ধরার আনন্দ শেষ হয়ে গেল। সেই বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি ফিরে এসে হাজির। কুটিরের দরজা ভাঙা দেখে তার মহা রাগ! সিপাইদেরকে বলল,–সরে যা হতভাগা ব্যাটারা! আমি গরিব বুড়ি, আমার কুঁড়ের দরজা তোরা কার হুকুমে ভাঙলি?’

বিশপ বললেন,–’চুপ কর ডাইনি! এরা সব আমার লোক। আমি হুকুম করেছি তাই তোর দরজা ভেঙেছে।’

বৃদ্ধা বলল,–’তা তো দেখতে পাচ্ছি। আজকাল লোকের বাড়িঘর রাখবার জো নেই। আপনার এতগুলো লোক! একটা ডাকাতকে ধরবার ক্ষমতা হল না? শেষকালে কি না ভাঙ বুড়ির দরজা? পাজি, পোড়ামুখোরা! বেরো ঘরের ভেতর থেকে, নইলে এখনই শাপ দেব।’

‘ধর তো হে বুড়িটাকে! বেটিকে রবিন হুডের পাশাপাশি ফাঁসি দেব।’

তখন হাততালি দিয়ে বৃদ্ধা বলল,—’আজ্ঞে না হুজুর! বুড়িকে ধরাটা সহজ হবে না।‘

হাততালির সংকেত হতেই, কুটিরের চারদিক থেকে রবিন হুডের লোকজন, একেবারে তির বাগিয়ে এসে হাজির হল। বিশপ মহা ফাঁপরে পড়লেন, তিরের ভয়ে তাঁর সিপাইরাও নড়তে সাহস পেল না। বিশপ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সহজে ছাড়বেন না। দস্যুদের বললেন,–’দ্যাখ ব্যাটারা! যদি আর এক ইঞ্চিও আমার দিকে এগুবি, তাহলে সর্দার রবিন হুডের মরণ নিশ্চিত। দেখছিস না, আমার লোকেরা বল্লম বাগিয়ে রয়েছে? এখনি হুকুম করব, আর তার দফা নিকেশ হবে।’ বৃদ্ধার ছদ্মবেশের ভিতর থেকে এবার পরিষ্কার গলায় উত্তর হল,—’ বিশপ মশাই! আপনি বলেছেন ভালো। আচ্ছা, কোন রবিন হুডকে ধরেছেন বলুন দেখি, এই যে আমি এক রবিন হুড।’ এই বলে মাথার ঢাকা খুলে হাসতে-হাসতে রবিন হুড আবার বললেন,–’এই যে আমি হুজুর! আপনি লোকজন নিয়ে এতক্ষণ কাকে পাহারা দিচ্ছেন?’

ঘরের মধ্যে রবিন হুডের লিঙ্কান গ্রিন পরে বৃদ্ধা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। রবিনের কথায় কুটিরের দরজায় এসে, বিশপ মশাইকে নমস্কার করে বলল,—’আসতে আজ্ঞা হোক হুজুর! গরিব বুড়ির বাড়িতে আপনার পায়ের ধুলো কেন পড়েছে? তবে বুঝি আমাকে আশীর্বাদ করে ভিক্ষা দিতে এসেছেন? ‘

রবিন হুড বললেন,–’তা বিশপ মশাই তোমাকে ভিক্ষা দেবেন বইকি! দাঁড়াও। আগে দেখি তাঁর থলেতে টাকাকড়ি আছে কি না, তোমার দরজার দামটা অন্তত তুলে দেওয়া চাই তো?’

বিশপ বললেন,–’পাজি শয়তান—’

রবিন হুড আর বলতে দিলেন না। বিশপকে বাধা দিয়ে বললেন,–’খবরদার মশাই! আমার লোকদের গালাগাল দেবেন না। এখন আমার মাথার জন্য যে বকশিশের টাকাটা এনেছিলেন, সে টাকাটা দিন দেখি?’

টাকা দেব বইকি রে বেটা! তোকে আগে ফাঁসি দেব, তারপর টাকা।’ এই বলে বিশপ সিপাইদের হুকুম করলেন,—’ ‘মারো ব্যাটাদের! একেবারে টুকরো-টুকরো করে কেটে ফেলো!’

রবিন বললেন,–’সবুর করুন মহাশয়! অত ব্যস্ত হলে চলবে কেন?’ এই বলে চট করে রবিন হুড একটি তির ছাড়লেন। তির বিশপের মাথা ঘেঁষে তাঁর টুপিটা উড়িয়ে দিল—টাক-পড়া মাথাটা টুপির ভেতর থেকে বের হয়ে পড়ল। বিশপ ভয়ে জড়সড়ো! দু-হাতে কান দুটি চেপে ধরে ভাবলেন, তিনি মরেই গেছেন।

তারপর চিৎকার করে বলে উঠলেন,–’খুন করলে বাবা, খুন করলে! আর তির মেরো না, এই নাও বাপু, মোহরের থলেটি নাও।’ আর বাক্যব্যয় না করে বিশপ ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন। দলপতি হারিয়ে তাঁর সিপাই সান্ত্রী আর কী করে, তারাও তাঁর পিছন–পিছন ছুটে পালাল।

সারউড বনে রবিন হুডকে ধরতে এসে বিশপ নিজে ধরা পড়ে আক্কেল সেলামি দিয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *