রবিন হুড – ১২

বারো  

লন্ডন শহরের কাছে একটি ময়দান ছিল, তার নাম ফিন্সবারি ফিল্ড। এই ময়দানেই রাজা টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ টুর্নামেন্টের দিন, শহরের সমস্ত লোকজন ভোর হতে না হতেই যেন উৎসাহে মেতে উঠল। দলে-দলে লোক এসে, ফিন্সবারি ফিল্ডে হাজির হতে লাগল। ময়দানের তিনদিক ঘিরে সার্কাসের মতো গ্যালারি, সেখানে বসবার জায়গা। গ্যালারির ঠিক মাঝখানে রাজারানির আসন।

ময়দানের চারদিকে রাজার ভিন্ন-ভিন্ন তিরন্দাজ দলের জন্য তাঁবু খাটানো ছিল। এক-এক দলের পতাকা এক-এক রঙের। রঙ্গভূমিতে প্রথম আসল বেগুনি-রং এর পতাকা নিয়ে টিপাসের দল। এই টিপাসই রাজার সবচেয়ে সেরা তিরন্দাজ। টিপাসের দলের পর হলুদ রঙের পতাকা নিয়ে ক্লিফটনের দল এল। ক্লিফটনের পর নীল রঙের পতাকা নিয়ে গিলবার্টের দল, তারপর সবুজ পতাকা নিয়ে এলউইনের দল। এলউইনের দলের পর সাদা পতাকা নিয়ে রবার্টের দল এসে হাজির হল। এরপর আরও পাঁচজন প্রসিদ্ধ তিরন্দাজ এল। রাজা সকলের কাছেই এইসব তিরন্দাজের বড়াই করতেন। তাদের আশ্চর্য কৌশল দেখিয়ে সকলকে অবাক করে দেওয়ার জন্যই, তিনি এই টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন।

নির্দিষ্ট সময়ে সদর দরজা খুলে, বিগল বাজাতে-বাজাতে একজন দূত প্রবেশ করল। তার পিছনে রাজপতাকাধারী ছয়জন ঘোড়সওয়ার তার পর রাজা দেখা দিলেন। রাজার সঙ্গে রানি ইলিনর, দুইজন রাজকুমার এবং অনেক সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা এলেন। রাজারানি ঘোড়া থেকে নেমে নির্দিষ্ট সিংহাসনে বসলেন। তারপর সকলে নিজের-নিজের আসনে বসলেন।

তারপর রাজা তাঁর প্রিয় তিরন্দাজ টিপাসকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,—’ ‘টিপাস! বলো দেখি টার্গেট কত দূরে রাখা যাবে?’

এই সময়ে রানি রাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন—’মহারাজ! কী পুরস্কার দেবেন ঠিক করা হয়েছে কি?

রাজা বললেন,—’প্রথম পুরস্কার হল চল্লিশটি সোনার মোহর ভরা একটি ব্যাগ; দ্বিতীয় পুরস্কার চল্লিশটি রূপোর মুদ্রায় ভরা ব্যাগ; তৃতীয় পুরস্কার একটা রূপোর বিউগল।’

রানির কথার উত্তর দিয়ে রাজা টিপাসকে আবার বললেন,–’টিপাস! এক কাজ করো, টার্গেটগুলো একশো গজ দূরে রাখো।’

রাজার আদেশ মতো টিপাস দশটি টার্গেট একশো গজ দূরে রাখল। তিরন্দাজদের দশটি দল। প্রত্যেক তিরন্দাজ তাদের জন্য নির্দিষ্ট টার্গেট লক্ষ করে তির ছুড়বে। যার সবচেয়ে বেশি তির কেন্দ্ৰস্থানে (বুলস আই) বিদ্ধ হবে, সে-ই প্রথম। তারপর কেন্দ্রে বিদ্ধ তিরের সংখ্যা অনুসারে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যক্তি নির্দিষ্ট হইবে। দূত এই সব নিয়ম ঘোষণা করার পর, পরীক্ষা শুরু হল। এই পরীক্ষায় টিপাস সর্বপ্রথম, গিলবার্ট দ্বিতীয় এবং ক্লিফটন তৃতীয় স্থান অধিকার করল।

এবার টার্গেট একশো বিশ গজ দূরে। এই পরীক্ষা কেবল মাত্র রাজার তিরন্দাজদের জন্য নয়, যে-কোনও তিরন্দাজ এই পরীক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু এবার ব্যাপার বড় সহজ নয়। কেবল মাত্র দশ বারো জন বাইরের লোক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হল।

তাদেরকে দেখে রাজা বললেন—’এদের তো দেখছি আস্পর্ধা কম নয়! আমার তিরন্দাজদের সঙ্গে পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা!’

রাজার এরকম অহংকার রানি ইলিনরের সহ্য হল না, তিনি বললেন,—’ ‘মহারাজ! আপনি কি মনে করেন, আপনার এই দশজন তিরন্দাজই ইংল্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভালো?’

রাজা বললেন,—’হাঁ রানি। শুধু ইংল্যান্ডে কেন, সমস্ত পৃথিবীতে এদের সমান কেউ আছে কিনা সন্দেহ। আমার তিরন্দাজদের কেউ হারাতে পারবে না। আমি পাঁচশো পাউন্ড বাজি রাখতে পারি!’

রানি বললেন,–’বটে! আচ্ছা মহারাজ, আমিও বাজি রাখছি, আপনার লোকদের হারাবার মতো তিরন্দাজ এখানেই আমি জোগাড় করব। তবে কি না আপনাকে এক বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’

রাজা,—’ ‘কী প্রতিজ্ঞা করব রানি?’

রানি,—’—আমি পাঁচজন তিরন্দাজ আনব, তারা আপনার দশজন লোককে হারিয়ে দেবে। কিন্তু মহারাজ! আপনি প্রতিজ্ঞা করুন, তাদের কোনও শাস্তি দেবেন না।’

রানি ইলিনরের কথা শুনে রাজার বড় কৌতূহল হল। তিনি বললেন,–’ঠিক আছে রানি। তোমার লোকদের কোনও অনিষ্ট করব না, আমি অভয় দিলাম। কিন্তু তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, বাজি রাখলে ঠকতে হবে! আমার টিপাস, ক্লিফটন ও গিলবার্টের মতো তিরন্দাজ কোথাও নেই।’

রানি বললেন,–’সে দেখা যাবে! আগে আমি দেখি পাঁচজন লোক পাই কিনা।’ তখন রানি একজন বালক ভৃত্যকে বললেন, যাও তো ছোকরা! স্যার রিচার্ড অব-দি-লি এবং হারফোর্ডের বিশপ মহাশয় ওই যে বসে আছেন, তাঁদের ডেকে নিয়ে এসো তো!’

স্যার রিচার্ড ও বিশপ আসার পর রানি স্যার রিচার্ডকে জিগ্যেস করলেন,–আচ্ছা স্যার রিচার্ড! আমি রাজার সঙ্গে বাজি রাখতে চাই—টিপাস, ক্লিফটন ও গিলবার্টের মতো পাঁচজন তিরন্দাজ জোগাড় করব, আপনি কী বলেন?’

স্যার রিচার্ড রানিকে নমস্কার করে বললেন,–’না রানি! আমি বাজি রাখতে আপনাকে পরামর্শ দিই না, রাজার লোকদের সমান ওস্তাদ কেউ নেই।’ এই বলে চুপিচুপি বললেন,–’তবে কি না আমি শুনেছি, সারউড বনে না কি এমন সব লোক আছে, যারা অতি অদ্ভুত তিরের খেলা জানে।’

স্যার রিচার্ডের কথা শুনে রানি ইলিনর হাসলেন এবং তাঁকে বিদায় দিয়ে বিশপ মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলেন,–’আচ্ছা বিশপ মহাশয়! আমি রাজার সঙ্গে বাজি রাখতে চাই, আপনি কিছু টাকা ধার দিতে পারেন?’

বিশপ বললেন,–’না রানি! আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার বিশ্বাস রাজার তিরন্দাজদের মতো ওস্তাদ কোথাও নেই।

রানি বললেন,–’আচ্ছা বিশপ মহাশয়! মনে করুন, আমি যদি এমন লোক পাই, যাদের আপনিও খুব ভালো করে জানেন, তাহলে? আমি শুনেছি, নটিংহাম এবং প্লিম্পটন শহরে নাকি অনেক ভালো–ভালো তিরন্দাজ আছে।’

বিশপ বড়ই মুশকিলে পড়লেন। তাঁর ভয় হল, হয়তো বা রবিন হুড দলবল নিয়ে কাছেই আছে। আবার মনে-মনে ভাবলেন–’কী মুশকিল! প্লিম্পটন গির্জার হ্যাঙ্গাম দেখছি রানির কানেও এসেছে। যা হোক এখন ঘাবড়ালে চলবে না।’

মনে-মনে এরকম ঠিক করে বিশপ রানিকে বললেন,–’আমাকে ক্ষমা করবেন রানি! আপনি যা শুনেছেন, এসব বাজে গল্প! অনেক বাড়াবাড়ি। বাজি রাখতে তো আমি আপনাকে পরামর্শ দিই-ই না, বরং রাজা যা বাজি রেখেছেন, তার ওপর আমি আরও কিছু বাড়াতে পারি।’

রানি বললেন,—’—সে আপনার খুশি। আচ্ছা, আপনি কতটা বাড়াতে পারেন?’

বিশপ বললেন,–’কতটা বাড়াতে পারি? এই নিন আমার ব্যাগ—এতে একশোটা মোহর আছে।’

রানি বললেন—আচ্ছা তাই দিন।’ এই বলে ইলিনর বিশপের হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে, তাঁকে বিদায় দিলেন এবং রাজাকে বললেন,—’ ‘মহারাজ! আপনার সঙ্গে তাহলে আমি সত্যি-সত্যিই বাজি রাখলাম!’

রাজা হাসতে-হাসতে বললেন,–’তা বেশ! কিন্তু তোমার যে দেখছি হঠাৎ খেলার দিকে বড় ঝোঁক পড়ে গেল। ব্যাপারটা কী? ‘ রানি বললেন,–’ব্যাপার আর কী হবে? আমি পাঁচজন লোক পেয়েছি, আপনি যাদের সঙ্গে বলবেন তাদের সঙ্গেই তারা পরীক্ষা দিতে তৈরি।’

রাজা বললেন,–’সত্যি রানি? তাহলে তোমার পাঁচজন লোককে এখনই পরীক্ষা করে দেখব। আচ্ছা এই খেলাটা শেষ হতে দাও, এদের মধ্যে যে পাঁচজন সবচেয়ে ভালো হবে, তাদের সঙ্গেই তোমার পাঁচজনের পরীক্ষা করব।’

‘ঠিক আছে মহারাজ। তাই হোক।’—এই বলে রানি ইলিনর ম্যারিয়ানকে সংকেত করলেন। ম্যারিয়ান উঠে আসার পর, রানি তাঁর কানে-কানে কী বললেন। ম্যারিয়ান চলে গেলেন।

এবারের পরীক্ষায়, গিলবার্ট ও টিপাস সমান সমান হল; এলউইন তৃতীয় ও জিওফ্রে নামক একজন বাইরের তিরন্দাজ চতুর্থ ও ক্লিফটন পঞ্চম স্থান অধিকার করল।

এখন সর্বশেষ পরীক্ষা হবে। রাজা দর্শকদেরকে সম্বোধন করে বললেন,—’এবারে গিলবার্ট, টিপাস, এলউইন, জিওফ্রে ও ক্লিফটন এই পাঁচজনের সঙ্গে রানির পাঁচজন নতুন তিরন্দাজের তিরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হবে।

রাজার কথা শুনে চারদিকে সকলেই একেবারে অবাক হয়ে গেল। ‘রানির লোক কারা?’ সকলের মুখে এই কথা, সকলেই মহা উৎসুক। তখন দেখা গেল যে রঙ্গস্থলের অন্য দিকের দরজা দিয়ে পাঁচজন লোক প্রবেশ করল, তাদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে একজন মহিলা। মহিলাটিকে দেখে সকলেই চিনতে পারল তিনি ম্যারিয়ান। কিন্তু লোক পাঁচটিকে কেউই চিনতে পারল না।

তাদের চারজনের লিঙ্কান গ্রিন পরা এবং পঞ্চম ব্যক্তির (তাকে দেখলেই দলপতি বলে মনে হয়) পরিধানে লাল টুকটুকে পোশাক। প্রত্যেকের মাথায় লাল টুপি, তাতে সাদা ধপধপে পালক। সকলেরই হাতে ধনুক, পিঠে তুণ এবং পাশে শিকারিদের মতো ছুরি ঝোলানো।

এই ছোট্ট দল রাজাসনের সামনে এসে, টুপি খুলে রাজা-রানিকে নমস্কার করল। ম্যারিয়ান বললেন,–’মহারানি! আপনি যাদের আনতে পাঠিয়েছিলেন, এরাই তারা। আপনার হয়ে টুর্নামেন্টে তির ছুড়বে।’

রানি তখন তাদের প্রত্যেককে সোনালি এবং সবুজ রঙের এক একটি গলাবন্ধ দিয়ে মধুর স্বরে বললেন,–’লকলি! তোমরা যে আমার কাজ করতে রাজি হয়েছ, তার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। আমি কিন্তু রাজার সঙ্গে বাজি রেখেছি, তোমরা তাঁর সবচেয়ে ওস্তাদ তিরন্দাজ পাঁচ জনকে হারাবে। দেখো আমার যেন সম্মানটা থাকে।’ এই পাঁচজন তিরন্দাজকে দেখে, রাজা রানিকে জিজ্ঞাসা করলেন,–এঁরা কারা রানি?’

রানি রাজার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই হারফোর্ডের বিশপ মহাশয় বলে উঠলেন—দোহাই মহারাজ! এরা পাঁচজন সারউড বনের দস্যু! লাল পোশাক পরা লোকটা স্বয়ং রবিন হুড, আর ওরা হচ্ছে লিটল জন, উইল স্টাটলি, উইল স্কারলেট আর এলান-আ-ডেল। কুখ্যাত ডাকাত এরা মহারাজ! এদের উৎপাতে সমস্ত উত্তর দেশ অস্থির হয়ে পড়েছে।’

রানি ইলিনর ঠাট্টা করে বললেন,–হাঁ, ঠিক! বিশপ মহাশয় নিজেই এদের খুব ভালো করে জানেন।

রাজা কিন্তু বিশপের কথা শুনে মুখ গম্ভীর করলেন। রবিন হুডের কথা তিনিও তো শুনেছেন!

তখন রাজা ইলিনরকে জিজ্ঞাসা করলেন, রানি! এ কথা কি সত্যি?

রানি বললেন,—’মহারাজ! কথাটা ঠিকই, কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভুলবেন না। আপনি কথা দিয়েছেন এদের কোনও অনিষ্ট করবেন না।’

-সে জন্য তোমায় ভাবতে হবে না, কিন্তু মনে রেখো,—’আমার প্রতিজ্ঞা কেবল চল্লিশ দিনের জন্য, তারপর থেকে যেন তোমার এই অসমসাহসী দস্যুরা হুঁশিয়ার হয়।

রানি ইলিনরকে এই কথা বলে, রাজা তাঁর পাঁচজন তিরন্দাজকে বলল,–তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ, রানির সঙ্গে আমি বাজি রেখেছি। তিনি সারউড বনের পাঁচজন তিরন্দাজ জোগাড় করেছেন, তাদের সঙ্গে তোমাদের পরীক্ষা করা হবে। তোমরা হুঁশিয়ার হও। যদি তাদের হারাতে পারো, তবে তোমাদের টুপি বোঝাই করে টাকা দেব, এবং যে প্ৰথম হবে তাকে নাইট করে দেব।

তখন আগের মতো সেই একশো কুড়ি গজ দূরে একটি টার্গেট রাখা হল। দু-দলের প্রত্যেকে এই টার্গেট লক্ষ করে তির ছুড়বে। গিলবার্ট এবং রবিন লটারি করে ঠিক করলেন, রাজার লোকেরাই প্রথম শুরু করবে এবং সকলের আগে ক্লিফটনের পালা। ক্লিফটন আগের পরীক্ষায় পঞ্চম হওয়ায় একটু লজ্জিত হয়েছিল, তাই এবারে খুব হুঁশিয়ার হয়েই তির চালাল। তার দুটি তির কেন্দ্রে মধ্যস্থিত কালো রং-এর দাগে (বুলস আই) লাগল, অবশ্য ঠিক মাঝখানে না হলেও দাগের ভেতরে বটে। তার তৃতীয় তিরটি বেঁকে গিয়ে দুই আঙুল বাইরে লাগল। মোটের ওপর ফল মন্দ হল না।

ক্লিফটনের পর উইল স্কারলেটের পালা। রবিন হুড তাকে সর্তক করলেন,–’সাবধান ভাই উইল। ঠিক মাঝখানে কিন্তু তোমার তিনটি তিরের জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে কিন্তু দুঃখের বিষয়, রবিন হুড সাবধান করতে যাওয়ায় আরও খারাপ হল। উইলের প্রথম তির বুলস আইয়ের বাইরে ক্লিফটনের চেয়েও দূরে পড়ল। লজ্জায় রবিন হুডের মুখ লাল হয়ে উঠল! উইলকে বললেন,—’আমায় ক্ষমা করো ভাই, বেশি সাবধান করতে গিয়েই অন্যায় করেছি। আচ্ছা, এবারে ধনুর গুণটা বেশিক্ষণ টিপে রেখো না, আঙুলে আটকে যাওয়ার আগেই তিরটা ছেড়ে দিও।’

রবিনের এই সংকেতে ভালো ফল ফলল। উইল স্কারলেটের পরের দুটি তিরই একেবারে বুলস আই এ এবং একটি তির ক্লিফটনের চেয়েও সেন্টারের কাছে বিঁধল। কিন্তু তা হলে কী হবে, মোটের ওপর ক্লিফটনের জিত। লজ্জায় উইল স্কারলেটের মাথা নীচু হয়ে গেল।

এরপর পুরোনো টার্গেট বদলে আবার নতুন টার্গেট রাখা হল। এবারে জিওফ্রে এবং এলান-আ-ডেলের পালা। রানির আসনের পাশেই তাঁর সখীরা বসেছিল, তাঁদের সঙ্গে মিসেস এলানও ছিলেন। উত্তম গায়ক বলে এলান সকলেরই প্রিয়পাত্র। মিসেস এলানকে সখীরা বললেন,—’—তোমার স্বামীর যেমন চমৎকার বীণার হাত, তেমন যদি তিরের হাত হয় তবে তাঁর জিত কে রোখে।’

বাস্তবিক ফল তাই হইল। জিওফ্রে অবশ্য তির মন্দ চালায়নি, তার তিনটি তিরই বুলস আই-এর লাইনের ওপর তিনকোণা হয়ে বিধল। কিন্তু জিওফ্রের তিরের মধ্যস্থানে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা ছিল। এলানের পালা শেষ হলে দেখা গেল যে, তার তিনটি তিরই একেবারে সেই ফাঁকা জায়গার মধ্যে! চারদিক থেকে সকলে, এমনকী হাজির মহিলারা পর্যন্ত হাততালি দিয়ে উঠলেন।

তারপর উইল স্টার্টলি এবং এলউইনের পালা। এলউইনের পরীক্ষার ফল হল ঠিক জিওফ্রের মতো, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্টাটলির পরীক্ষা খারাপ হল। স্টাটলির একটা মস্ত দোষ ছিল, সে বড় অস্থিরমতি, একটু মনোযোগ দিয়ে যে তির চালাবে, তা যেন তার কোষ্ঠীতে লেখা নেই—গুণ টানল আর তির ছেড়ে দিল! ফলে তার প্রথম দুটি তিরই এলউইনের তিরের বাইরে পড়ল।

রবিন হুড ভারী লজ্জিত হয়ে বললেন,–’করো কী স্টাটলি! শেষকালটা কি রানির অপমান করবে, সারউডকে লজ্জা দেবে?’

স্টার্টলি বলল,—’আজ্ঞে, আমার বড় অন্যায় হয়েছে, আমায় মাপ করবেন। এই কথা শেষ হওয়ার আগেই শনশন শব্দে স্টাটলির তৃতীয় তির ছুটে চলল এবং একেবারে বুলস আই-এর ঠিক মাঝখানে। এমন পরিষ্কার লক্ষ সে পর্যন্ত কারও হয়নি। কিন্তু হলে কি হয়, মোটের ওপর এলউইনের জিত হল।

রাজা মহাখুশি; রানির দিকে ফিরে বললেন,—’—কী রানি। এখন খবর কী? তোমার তো তিনজনের মধ্যে দুজনেই হেরে গেল। বাকি দুজন যদি খুব ভালো করতে না পারে তো বাজি হেরে গেলে!

রানি বললেন, ‘হ্যাঁ মহারাজ! আপনি যা বলছেন তা ঠিক, কিন্তু এখনও তো দুজন আছে! আর সে দুজন স্বয়ং রবিন হুড আর লিটল জন।’

রাজাও বললেন,–’তোমার যেমন রবিন হুড আর লিটল জন আছে, আমারও তেমনিই টিপাস আর গিলবার্ট রয়েছে।’

এর পর সকলেই আবার টার্গেটের দিকে মন দিলেন। এবার টিপাসের পালা। কিন্তু বেচারি ঠিক উইল স্কারলেটের মতোই ভুল করল। ধনুকের গুণ অনেকক্ষণ টিপে রাখার দরুন, তার প্রথম দুটি তিরই খারাপ হয়ে গেল। তার মধ্যে একটি অবশ্য বুলস আই এর ভেতরেই লাগল। তৃতীয় তিরের বেলায় খুব সাবধান হওয়ায়, সেটি স্টাটলির তৃতীয় তিরের মতো বুলস আই-এর একেবারে সেন্টারে গিয়ে বিঁধল। তারপর লিটল জন—তার প্রথম দুটি তির টিপাসের প্রথম দুটির চেয়েও সেন্টারের কাছে বিঁধল। তৃতীয় তিরটির বেলায় জন, সারউডের এক অতি আশ্চর্য কায়দায় তিরটি ছাড়বার সময় কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে দিল আর বনবন শব্দে ঘুরপাক খেতে-খেতে, বুলস আই এর কেন্দ্রবিদ্ধ টিপাসের তিরটিকে টোক্কা মেরে তুলে ফেলল, সেই ছিদ্রে বিঁধল।

রাজা তো এই ব্যাপার দেখে একেবারে অবাক। তাঁর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল না। বিড়বিড় করে বলতে লাগলে,–’কী সর্বনাশ! এমন অসম্ভব ব্যাপার তো কখনও দেখিনি! এ লোকটা নিশ্চয়ই শয়তানের চেলা, মানুষ নয়

রানি ইলিনরের তখন অনেকটা ভরসা হল। রাজাকে বললেন,–’মহারাজ! এবারে কিন্তু দুই দলই সমান সমান; এখন দেখা যাক, গিলবার্ট আর রবিন হুড কী করে?’

গিলবার্ট ধীরে-ধীরে খুব লক্ষ করে পরপর তিনটি তিরই বুলস আই-এর ভিতরে লাগাল, কিন্তু একেবারে সেন্টারে নয়। সেন্টারে তখনও সামান্য জায়গা ফাঁকা থেকে গেল। রবিন হুড নিজেই গিলবার্টকে বাহবা দিয়ে বললেন, ‘শাবাশ গিলবার্ট! কিন্তু আর একটু মন দিয়ে যদি প্রথমটা এখানে—সঙ্গে-সঙ্গে নিজের প্রথম তির ছাড়লেন—দ্বিতীয়টি এখানে, তারও দ্বিতীয় তির ছুটল—আর একটা এখানে মারতে—সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর শেষ তির চলল,—’তা হলে রাজা নিশ্চয়ই তোমাকেই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় তিরন্দাজ বলতেন।’

রবিন হুডের শেষের কথাগুলি কিছুই শোনা গেল না। তাঁর অদ্ভুত শক্তি দেখে দর্শকবৃন্দ আনন্দধ্বনি করতে-করতে কানে তালা লাগিয়ে দিল। রবিন হুডের প্রথম দুটি তির গিলবার্টের তিরের মাঝখানে যে ফাঁকা ক্ষুদ্র জায়গাটুকু ছিল, ঠিক সেই জায়গাটিতে প্রায় ঘেঁসাঘেঁসি হয়ে গিয়ে বিঁধল। আর তৃতীয় তিরটি, তাঁর প্রথম দুটি তিরের খানিকটা করে চাকলা তুলে দুটির ঠিক মধ্যখানে বিঁধল। দূর থেকে মনে হল যেন, টার্গেটের ঠিক মাজখানে খুব মোটা একটি তিরই বিদ্ধ হয়েছে।

রাগে এবং বিস্ময়ে রাজা মশাই দাঁড়িয়ে উঠলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন,—’ গিলবার্ট এখনও হারেনি। তার তিনটি তিরই বুলস আই-এর ভিতরে পড়েছে এবং সেটাই সবচেয়ে ভালো তির চালানোর পরীক্ষা।’

রবিন হুড রাজাকে নমস্কার করে বললেন,–’মহারাজ! আপনার কথাই থাকুক। আপনি যখন বলছেন আমরা দুজন সমান সমান হয়েছি, তখন আমাদের আবার পরীক্ষা করুন! কিন্তু অনুগ্রহ করে এবারের টার্গেটটি আমার পছন্দমতো করতে দিন।’

রাজার হুকুমে রবিন হুড তখন সারউড বনের আর একটি কায়দা খেললেন। একটি উইলোর খুব সরু এবং সোজা ডাল এনে, ছুরি দিয়ে ছাল ছাড়ালেন এবং টার্গেটের জায়গায় ডালটিকে পুঁতে দিয়ে বললেন,–’গিলবার্ট! এই ডালটিকে কাটো দেখি, এইটেই আমার টার্গেট!’

গিলবার্ট,–’এ যে চোখেই ভালো করে দেখতে পাই না, তা আবার কাটব কী করে?’ মনে-মনে বলল,–’যা হোক, রাজার ইজ্জতটা তো রাখতে হবে, একবার না হয় চেষ্টা করেই দেখা যাক।’

এই শেষ পরীক্ষাতেই গিলবার্টের দফা রফা হয়ে গেল। তার তির ডাল স্পর্শও করতে পারল না, পাশ দিয়ে চলে গেল।

এবারে রবিন হুডের পালা। তিনি বেছে একটি তির নিয়ে ধনুকের গুণটি ভালো করে পরীক্ষা করলেন এবং কান পর্যন্ত গুণ টেনে তির ছেড়ে দিলেন। শনশন শব্দে তির ছুটে গিয়ে, দেখতে-দেখতে উইলোর ডালটিকে কেটে দু-ভাগ করে ফেলল!

গিলবার্ট রবিন হুডের এই অসাধারণ ক্ষমতা দেখে বলল,–নিশ্চয় তোমার ধনুকটি জাদু করা, তা নইলে তুমি যা করলে এ কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না।’

রাজা আর এক মুহূর্তেও সেখানে রইলেন না, রাগে তাঁর শরীর জ্বলে উঠল। বিচারকদের পুরস্কার বিতরণের হুকুম দিয়ে তখনই ঘোড়ায় চড়লেন! রানির সঙ্গে একটি কথাও বললেন না। রাজকুমার দুজনকে এবং তাঁর শরীররক্ষক যে কয়টি নাইট হাজির ছিলেন তাঁদেরকে নিয়ে রঙ্গভূমি পরিত্যাগ করে চলে গেলেন।

রাজা চলে গেলে পর রানি ইলিনর রবিন হুড প্রভৃতিকে তাঁর কাছে ডেকে বললেন,—’লকলি! আজ তোমরা আমার মান রেখেছ, আমি বড় খুশি হয়েছি। দুঃখের বিষয়, মহারাজ তাতে সন্তুষ্ট হননি। কিন্তু তা বলে তোমরা ভয় পেও না, রাজা যে অভয় দিয়েছেন, তার নড়চড় হতে পারে না। রাজার পুরস্কার তো তোমরা পেলেই, তার ওপর আমি বাজি জিতে যে টাকা পেয়েছি, তাও তোমাদের দিলাম। তোমরা এই টাকা দিয়ে লন্ডন শহরে খুব ভালো যে তলোয়ার পাওয়া যায়, দলের প্রত্যেকের জন্য সেই তলোয়ার এক একখানি কিনো। তলোয়ারগুলিকে ‘রানিকে তলোয়ার’ নাম দেবে এবং প্রতিজ্ঞা করো যে, তা দিয়ে চিরকাল গরিবদের এবং অসহায় স্ত্রীলোকদের রক্ষা করবে।’

রবিন হুড প্রমুখ সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন,–’হাঁ মহারানি, আমরা চিরকাল তাই করব, প্রতিজ্ঞা করলাম।’

রানি ইলিনর তখন সহচরীদেরকে নিয়ে চলে গেলেন।

রানি চলে গেলে পর টুর্নামেন্টের বিচারকরা রবিন হুডদের ডেকে তাদের প্রাপ্য পুরস্কার দিলেন। রাজা হেনরির টুর্নামেন্টের ব্যাপার শেষ হল। রবিন হুড প্রভৃতিও তখন রঙ্গভূমি ছেড়ে চলে আসলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *