রনি আর বনি
রনি আর বনি খেলছে।
সুন্দর একটা দৃশ্য। দশ-এগারো বছরের দুটো ছেলে রংচঙে জামা-প্যান্ট পরে সবুজ লনে ছোটাছুটি করে খেলছে। মিঠে রোদ এসে পড়েছে। একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে। সব মিলিয়ে শীতের সকালটা দারুণ। রনি-বনি দুজনের গায়েই হাফ হাতা সোয়েটার। রনির সোয়েটারের রং লাল, বনিরটা নীল। ঘন নীল। মাথায় টুপি। কায়দা করা গলফ টুপি। রনি ব্যাট করছে, বল করছে বনি। বনি অফ স্ট্যাম্পের বাইরে একটা বল দিল। সেই বল এক পা বাড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে ফেলল রনি। বনি ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাঁচটা লুফে নিয়ে চিৎকার করে উঠল—
‘হাউজ দ্যাট!’
মুখ বেজার হয়ে গেল রনির। ইস, কেন যে বাইরের বলটা মারতে গেল, ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। এই জন্যই বলে, ক্রিকেট খেলায় জাজমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কোন বলটা মারব, কোনটা ছাড়ব, ঠিকমতো বুঝতে হয়। যাই হোক, বনি এবার ব্যাট করবে। রনি ব্যাটটা এগিয়ে দিল। বনি হেসে বলল, ‘আমাকে দিতে হবে না। তুমি আবার ব্যাট করো।’
রনি অবাক হয়ে বলল, ‘কেন এবার তো তোমার ব্যাট করবার কথা।’
বনি হাসিমুখে বলল, ‘কথা ঠিকই, কিন্তু তুমি তো ব্যাট করতে বেশি ভালোবাসো। তাই না?’
ঘটনা তাই। ক্রিকেট খেলবার সময় রনি ব্যাট করতে সবথেকে ভালোবাসে। বড় হয়ে সে শচীন তেন্ডুলকরের মতো ব্যাটসম্যান হতে চায়। কিন্তু তা বলে আউট হয়ে যাবার পরে তো আর ব্যাট করা যায় না। সে লজ্জা পাওয়া মুখে বলল, ‘খেলার তো নিয়ম আছে। আউট হয়ে যাওয়ার পর আমি ব্যাট করব কী করে!’
বনি বলল, ‘নিয়ম সবসময় খাটে না। আর তোমার আমার মধ্যে খেলা, এখানে কে এত নিয়ম দেখতে আসছে? যাও তুমি ব্যাট নিয়ে দাঁড়াও। আমি আবার বল শুরু করছি। এবার কিন্তু উইকেটের বাইরের বল সাবধানে খেলবে। ওটা বোলারদের ফাঁদ। ফাঁদে পা দিলে ক্যাচ উঠে যায়।’
রনি ব্যাট হাতে আবার গিয়ে দাঁড়াল ঠিকই, কিন্তু তার মনে হল, এ কেমন খেলা! আউট হওয়ার পরও সে কেন আবার ব্যাট করবে?
দুজনের বয়স এক হলেও রনি আর বনিকে কিন্তু একরকম দেখতে নয়। রনি একটু গোলগাল ধরনের। ফর্সা। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। বনিকে দেখতে চোখা চোখা। নাক-মুখ-চিবুক তীক্ষ্ণ। মাথার চুলগুলো ছোট আর খোঁচা খোঁচা। তবে চোখদুটো টানা টানা। মনে হয়, কোনও শিল্পী এঁকে দিয়েছে। রনির হাবভাবে কোমল একটা ভাব আছে, বনিরবেলায় সেটা কঠিন কঠিন। রনির ছোটাছুটি, ঝাঁপাঝাঁপির মধ্যে একটা এলোমেলো ভাব আছে। হোঁচট খেয়ে পড়েও যায়। বনির ছোটাছুটিতে এলোমেলো ভাবটা নেই। সে যেন পা মেপে মেপে ছুটছে। লাফ দিচ্ছে হিসেব করে। অনেকটা অ্যানিমেশন ছবির চরিত্রদের মতো। ছুটে এসে বল করার সময় কনুইটা পুরো ভাঙছে না।
সুবিনয়বাবু বাংলোর বারান্দায় বসে দুজনের খেলা দেখছেন। তার গায়ে একটা হালকা চাদর। হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ। কাপে চুমুক দিতেই তার ভুরুটা কুঁচকে গেলে। বনির এরকম মেপে, হিসেব করে নিখুঁত লাফালাফি পছন্দ হচ্ছে না। কেমন যেন যন্ত্রের মতো।
রনি আর বনির মধ্যে সম্পর্ক কী? ওরা কি দুজন ভাই? নাকি বন্ধু?
না, ভাই নয়, বন্ধুও নয়। সবে তিনদিন হল বনি এ-বাড়িতে এসেছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধু হওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত বনিকে রনির সঙ্গী বলাই ভালো। মঙ্গলবার অফিস থেকে ফেরবার পথে বনিকে নিয়ে এসেছেন সুবিনয়বাবু। সুবিনয়বাবু রনির বাবা। রনির জন্মের সময় তার মা মারা যায়। সুবিনয়বাবু ছেলেকে বড় করছেন। তিনি খুব বড় চাকরি করেন। বাড়িটাও খুব সুন্দর। নিরিবিলি জায়গায় একটা বাংলো। রনির জন্য সুবিনয়বাবু গভর্নেস, দিদিমণি, কাজের লোক, মালি, দারোয়ান, ড্রাইভার রেখে দিয়েছেন। তার পরেও রনির একা লাগে। স্কুলে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ অন্য ছেলেদের সঙ্গে মেতে থাকে, বাড়ি ফিরলেই মন খারাপ। সুবিনয়বাবু একবার ভেবেছিলেন, ছেলেকে বাইরের কোনও স্কুলে ভর্তি করে দেবেন। বোর্ডিং-এ থেকে পড়াশোনা করবে। দার্জিলিং, মুসৌরি, সিমলাতে ভালো ভালো স্কুল আছে। সেখানে থাকলে রনি যেমন লেখাপড়ায় ভালো হবে, সবসময় বন্ধুদেরও পাবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত ফাইনাল করেও পিছিয়ে গেছেন। মা মরা ছেলেকে একা ছেড়ে দিতে মন চায়নি। বরং বাড়িতে লোক বাড়িয়েছেন। খেলা, গান, সাঁতারের জন্য টিচার রেখেছেন। কিন্তু তাতেও সঙ্গীর অভাব ঘোচেনি রনির। মাসখানেক আগে এক বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে সুবিনয়বাবু দেখলেন ঘর অন্ধকার করে রনি বসে আছে।
সবিনয়বাবু উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে রনি?’
রনি বলল, ‘না, কিছু হয়নি।’
সুবিনয়বাবু ছেলের কথা বিশ্বাস করলেন না। পিঠে হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘কী সমস্যা হয়েছে?’
রনি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ‘আজ তুমি এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলে কেন? তোমার কি শরীর খারাপ বাবা?’
তার শরীর নিয়ে এইটুকু ছেলে চিন্তা করে জেনে সুবিনয়বাবু খুব খুশি হলেন। হেসে বললেন, ‘না রনি। কাল খুব ভোরের ফ্লাইটে বাইরে যাব। অফিসের কাজ আছে। তার আগে বাড়িতে বসে একটু হোমওয়ার্ক করে নিতে হবে। অফিসে থাকলে সবাই বড্ড বিরক্ত করে।’
রনি চোখ গোল গোল করে বলল, ‘তোমাকেও হোমওয়ার্ক করতে হয়! তোমাদের অফিসে বুঝি পরীক্ষা হয়?’
সুবিনয়বাবু রনির চুল ঘেঁটে দিয়ে বললেন, ‘হয় বই কী। তাই হোমওয়ার্ক করতে হয়। আগে থেকে লেখাপড়া না করলে যখন বাইরে মিটিং হবে তখন কিছুই বলতে পারব না।’
রনি বলল, ‘ও।’
সুবিনয়বাবু এবার ছেলের হাত ধরে বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, বাড়ি ফিরে দেখব তুমি লনে খেলছ। আজ তোমার গেম টিচার আসেননি?’
‘এসেছিলেন, আমি খেলব না বলে দিয়েছি।’
সুবিনয়বাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কেন? গেম টিচার কি তোমাকে বকাবকি করেন?’
রনি তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, না, উনি খুব ভালো মানুষ। আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমার আর বড়দের সঙ্গে খেলতে ভালো লাগে না।’
সুবিনয়বাবু গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রনির এই সমস্যাটা তিনি কয়েকদিন ধরেই আঁচ করছিলেন। ছেলেটা যত বড় হচ্ছে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। আউটডোর গেমসের ট্রেনার, কোচেরা আছেন, ঘরে বসে খেলবার নানা ধরনের সরঞ্জাম আছে, গাদা খানেক বই আছে, ল্যাপটপ, আই প্যাড, ট্যাবলেট আছে। তার পরেও সে যেন একা। আসলে রনি তার নিজের বয়সের একজন সঙ্গী চায়। সুবিনয়বাবু বুঝতে পারলেন, রনির মা বেঁচে থাকলে এই সমস্যাটা হত না। একটা বয়স পর্যন্ত মা সব ছেলেমেয়েরই সঙ্গী হতে পারে। বাবারাও খানিকটা পারে, কিন্তু তার জন্য সময় দিতে হয়। সুবিনয়বাবু সেটা পারবেন না। অফিসের কাজে তাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। বাইরের মাইনে করা লোক দিয়ে এই ফাঁক ভরাট করা যায় না। তাছাড়া তারা সবাই তো রনির থেকে বয়েসে অনেক বড়। ছোটদের মন বোঝা খুব কঠিন। সুবিনয়বাবু একবার ভেবেছিলেন, রনির বয়সি কোনও ছেলেকে এনে রাখবেন। পরে ভেবে দেখলেন, সেটা ঠিক হবে না। ভালোমন্দ না জেনে কারও সঙ্গে রনিকে চব্বিশ ঘণ্টা মিশতে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে কমবয়সি কাউকে তো নয়ই। সে হয়তো সারাদিন রনির সঙ্গে থাকবে হুটোপটি করবে কিন্তু খারাপ কিছু শিখিয়ে দেবে কিনা কে বলতে পারে? এই বয়েসে ছেলেমেয়েদের ওপর নজর রাখতে হয়। তারা কার সঙ্গে মেলামেশা করছে খেয়াল রাখতে হয়। রনির মা বেঁচে থাকলে সে এই দায়িত্ব নিতে পারত। রনির স্কুলের কোনও ভালো ছেলেকে এনে রাখলে ঠিক ছিল, কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা থাকবে কেন? এক-দুদিন বেড়াতে এলে ঠিক আছে। রনির জন্মদিনে অনেক বন্ধুদের ডাকা হয়। কিন্তু সে তো কয়েকঘণ্টার হইচই।
সুবিনয়বাবু স্নেহের গলায় বললেন, ‘রনি, তুমি যদি চাও আমি তোমাকে কোনও বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করতে পারি। সেখানে অনেক বন্ধু পাবে।’
রনি তার বাবার দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বলল, ‘আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না বাবা।’
সুবিনয়বাবুর খুব মায়া হল। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। পরদিন সকালে তিনি বাইরে যাবার জন্য প্লেন ধরলেন। প্লেনে তার অফিসের এক সহকর্মীকে রনির সমস্যার কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘আজকের দিনে এটা কোনও সমস্যাই নয় স্যার। সাতদিনের মধ্যে রনির জন্য সঙ্গী জোগাড় হয়ে যাবে।’
সুবিনয়বাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘মানে! সাতদিনের মধ্যে রনির সঙ্গী পাওয়া যাবে! কী করে?’
অফিসের সহকর্মী হেসে বলল, ‘আমি একটা ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। আপনি কালই স্যার ওদের ফোন করে দিন। আপনার ছেলের জন্য আপনি ঠিক কেমন সঙ্গী চাইছেন তার স্পেকিফিকেশন বলে দেবেন। ওরা তৈরি করে দেবে।’
সুবিনয়বাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘তৈরি করে দেবে।’
সহকর্মী বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার। আজকাল এটা খুব কমন ব্যাপার। খুব সহজও। আমি স্যার আপনাকে যে কম্পানির ফোন নম্বর দিচ্ছি, ওরা জাপানের সঙ্গে কোলাবরেশনে কাজ করে। জাপানের টেকনোলজির ব্যবহার করে। আপনি তো জানেন, রোবট তৈরির ব্যাপারে জাপানকে আজও কেউ টেক্কা দিতে পারেনি।’
সুবিনয়বাবু আরও অবাক হয়ে বললেন, ‘রোবট!’
সহকর্মী বললেন, ‘অবশ্যই স্যার। এখন তো সবাই তাই করছে। রোবট সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। একেবারে মানুষের মতো চেহারার। আলাদা করা যাবে না। মানুষের একা থাকবার সমস্যা এতে অনেকটাই মিটে যাচ্ছে। বিশেষ করে স্যার, বয়স্ক মানুষদের তো খুবই উপকার হচ্ছে। তারা রোবট সঙ্গী নিয়ে মর্নিংওয়াক করতে যান, বিকেলে পার্কে গিয়ে বসেন। অনেকে স্যার রোবট বডিগার্ড রেখেছেন। আপনি একেবারেই বুঝতে পারবেন না।’
সুবিনয়বাবু বললেন, ‘বিষয়টা সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না।
‘আজকাল ওরা পত্রপত্রিকায় খুব বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। আপনি হয়তো কোনও কারণে মিস করে গেছেন। আমার বিশ্বাস, এই ব্যবস্থাই সবথেকে ভালো। আপনি রনির জন্য এমন একজন রোবটের অর্ডার দিন যে তার উপযুক্ত এবং পছন্দের হবে। ওরা সেই মতো প্রাোগ্রাম করে দেবে। প্রাোগ্রাম অনুযায়ী সেই রোবট কাজ করবে।’
সুবিনয়বাবু খুশি হলেন। ইস, রোবটের কথা তার আগে জানা থাকলে বেচারি রনিকে এতদিন মন খারাপ করতে হত না। তিনি উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘এ তো খুব ভালো কথা। আমি রনির জন্য এমন একজন সঙ্গী খুঁজছি যে তাকে সবসময় আনন্দে, হাসিখুশির মধ্যে রাখবে। তার সঙ্গে খেলাধুলো করবে, লেখাপড়ায় সাহায্য করবে। মন খারাপ হলে মন ভালো করে দেবে।’
সহকর্মী বললেন, ‘নো প্রবলেম স্যার। আপনি অর্ডার করে দিন। ছোটছেলে বলে দামটা একটু বেশি পড়বে। অনেক যত্ন করে বানাতে হবে। পরে কোনও গোলমাল যাতে না করে।’
সুবিমলবাবু বললেন, ‘দামটা কোনও ব্যাপারই নয়। রনি খুশি থাকলেই হবে।’
সুবিনয়বাবু সেই মতো রোবট কম্পানিতে অর্ডার করে দিলেন। কম্পানির নামটা মজার। আই অ্যাম ইওর ফ্রেন্ড। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘আমি তোমার বন্ধু।’ কম্পানির ম্যানেজার ক্যাটালগ খুলে ছবি দেখাল। রোবট কেমন দেখতে হবে? সুবিনয়বাবু রনির চেহারার কাছাকাছি একজনকে বাছলেন। একই বয়স, একই হাইট, একই রকম ছিপছিপে। নাম কী হবে? রনির মতোই একটা নাম হলে ভালো হয় না? ডাকাডাকিতে রনির সুবিধে হবে। টনি বা বনি হলে কেমন হয়? শেষ পর্যন্ত রোবটের নাম হল বনি।
এক বিকেলে বনিকে গাড়ির পিছনের সিটে বসিয়ে সুবিনয়বাবু বাড়ি ফিরলেন। রনি খুশি, প্রায় পাগল হয়ে যাবার জোগাড়। বনি বলল, ‘আমার খুব ভালো লাগছে রনি। তোমার মতো একজন সঙ্গীর সঙ্গে আগামী দিনগুলো নিশ্চয় খুব ভালো কাটবে। তুমি কি তোমার গিটারটা আমাকে একটু দিতে পারো? আমি তোমাকে একটা সুর শোনাব, সেই সুর শুনে তুমি যদি আমার জন্য একটা ছড়া লিখে দাও তাহলে দারুণ হবে। সুর আর ছড়া মিলিয়ে আমরা একটা গান তৈরি করে ফেলতে পারব।’
রনি তাড়াতাড়ি তার গিটারটা এনে বনিকে দিল। তারপর খাতা পেন নিয়ে নিজেও বসে গেল। সে কখনও ছড়া লেখেনি, কিন্তু এখন খুব ইচ্ছে করছে। সুর শুনে শুনে ছড়া লেখা একটা দারুণ ব্যাপার হবে। সুবিনয়বাবু নিশ্চিন্ত হলেন।
কিন্তু আজ বনির ছোটাছুটি, লাফালাফির ধরন তার পছন্দ হচ্ছে না। কেমন যেন যন্ত্রের মতো মনে হচ্ছে। তিনি মোবাইলটা তুলে ‘অ্যাই অ্যাম ইওর ফ্রেন্ড’ কম্পানির ম্যানেজারকে ফোন করলেন। তার কথা শুনে ম্যানেজার হেসে ফেলল।
‘সুবিনয়বাবু, বনি তো মানুষ নয়, বনি যন্ত্র। রোবট। তার কিছু হাবভাব, আচরণ তো যন্ত্রের মতো হবে। তবে রোবটের ওপর যেভাবে গবেষণা চলছে, তাতে মনে হয় অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এই ক্রটি দূর হয়ে যাবে। তখন মানুষ আর রোবটকে কোনওভাবেই আর আলাদা করা যাবে না।’
সুবিনয়বাবু বুঝলেন যে তিনি একটু বেশি আশা করে ফেলেছেন। নীচু গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে।’
টেলিফোনের ওপাশ থেকে ম্যানেজার বলল, ‘সুবিনয়বাবু, আমরা চেয়েছিলাম, বনি যেন আসল কাজটা করতে পারে। আপনার ছেলেকে সবসময় খুশিতে রাখতে পারে। বনির ভিতর আমরা যে সার্কিটটা রেখেছি তার প্রাোগ্রামিং সেভাবেই করা। সেই কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে তো?’
সুবিনয়বাবু একটু চুপ করে রইলেন। রনিকে খুশি রাখবার কাজ অবশ্যই হচ্ছে। একটু আগেই তিনি দেখলেন, আউট হয়ে যাবার পরও রনিকে ব্যাট করতে দিচ্ছে বনি। এটা খুব ভালো। রনিকে আউট হবার দু:খ পেতে হল না। সুবিনয়বাবু ম্যানেজারকে বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই কাজ খুবই ভালো হচ্ছে। ধন্যবাদ।’
সুবিনয়বাবু অফিস যাবার জন্য তৈরি হতে গেলেন। লনে খেলা চলছে। আবার আউট হয়েছে রনি। এবার বোল্ড। মিডল স্ট্যাম্প উড়ে গেল। বনির বলটা যে খুব গোলমেলে ছিল এমন নয়। উঁচু হয়ে এসে হঠাৎ গড়িয়ে গেল বলেই ঝামেলা। রনি শুকনো মুখে ব্যাট এগিয়ে দিল। বনি আগেরবারের মতোই মুচকি হেসে বলল, ‘তুমিই ব্যাট করো রনি।’
‘আমিই আবার ব্যাট করব!’
বনি বলল, ‘সমস্যা কী? ব্যাট করতে যখন তোমার ভালো লাগে, তুমিই করো না।’
রনি খুব কঠিন গলায় বলল, ‘আমি আর ব্যাট করব না। দু-দুবার আউট হয়েছি, আর নয়। এভাবে খেলা হয় না।’
বনি একটুক্ষণ চুপ করে রইল তারপর এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা তাই হোক, তুমি যা চাইবে। ব্যাট আমাকে দাও।’
রনির কথায় ব্যাট ধরলেও বনি কিন্তু তিন বলের মাথায় আউট হয়ে গেল। খুব সহজ বলে লোপ্পা ক্যাচ তুলল। বল একেবারে রনির হাতে গিয়ে ধরা দিল। বিপক্ষের খেলোয়াড়কে আউট করলে খুশি হওয়ার কথা। রনি কিন্তু খুশি হতে পারল না। তার মনে হল, বনি এই ক্যাচটা ইচ্ছে করে তুলেছে। রনির মনের ভিতর খচখচানি শুরু হল। বনির এই আচরণ তার ভালো লাগল না।
তিনদিনে সেই খচখচানি আরও বাড়ল।
এতদিন টেবিল টেনিস খেলতে পারেনি রনি। একা একা তো আর টেবিল টেনিস খেলা যায় না। বাড়িতে বোর্ডটা পরেই ছিল। সেদিন বনিকে নিয়ে খেলতে শুরু করল। খেলা জমে উঠল। বনি যেন আগে থেকে বুঝতে পারছে বল কোথা থেকে আসবে। সব বলই সে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু কখনওই রনিকে বেকাদয়দায় ফেলছিল না। এমন ভাবে বল মারছিল, যাতে রনির সেই বল ফিরিয়ে দিতে কোনও অসুবিধে না হয়। একটা সময় পর্যন্ত খুব ভালো লাগছিল রনির, তারপর মনে হল খেলা জমছে না।
টেবিল টেনিসের মতো ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়েও একই ঘটনা। নেটের ওপাশ থেকে বনি এমন ভাবে শাটল কক ফেরত দিতে লাগল যাতে রনির পয়েন্ট নষ্ট না হয়। খানিকক্ষণ মজা পেলেও, একটা সময়ের পর খেলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল।
ক্যারাম খেলতে গিয়ে আরও বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটল। রনি ইচ্ছে করে লাইনের খানিকটা বাইরে স্ট্রাইকার রেখে রেড ফেলে দিল। ভেবেছিল বনি আপত্তি করবে। সেরকম হল না। বনি দেখল, মুচকি হাসল, কিন্তু কিছুই বলল না!
শুধু খেলা নয়, বই পড়বার সময়ও এক কাণ্ড। সেদিন একটা কমিকসের বই ওলটাচ্ছিল বনি। রনি গিয়ে ফট করে হাত থেকে তুলে নিল। এরকম বিচ্ছিরি আচরণ সে কখনও করে না। করে ক্লাসের অর্ক। অর্ক দুষ্ট ছেলে। সেই কারণে তাকে কেউ পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে মারপিটও হয়ে যায়। টিচাররা অর্ককে খুব বকাবকি করেন। বলেন, অন্যের হাত থেকে বই কেড়ে নেওয়া খুব বিশ্রী একটা অভ্যেস। সেই বিশ্রী কাজই করল রনি। ইচ্ছে করেই করল। ভেবেছিল, বনি ভয়ানক রেগে যাবে। বনি কিন্তু রাগল না। বরং হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি আগে পড়ে নাও।’ খুব অবাক হল রনি। এই ছেলেটা কেমন! এর রাগ নেই।
রনি অবাক হলেও কিছু করার নেই। বনিকে এভাবেই বানানো হয়েছে। রনিকে সঙ্গ দেবার জন্য সে চোখের সামনে বই খুলে বসে থাকতে পারে, কিন্তু সেই বই কাড়লে রেগে যেতে পারে। রনির ওপর রেগে যাবার প্রাোগ্রামিং তার সার্কিটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি।
রনি আড়ালে গিয়ে বাবাকে ফোন করল। সুবিনয়বাবু উবিগ্ন হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে রনি?’
‘বাবা, তুমি বনিকে ফেরত দিয়ে এসো।’
সুবিনয়বাবু বললেন, ‘কেন। সে কী করল।’
‘ওকে আমার ভালো লাগছে না।’
সুবিনয়বাবু বললেন, ‘সমস্যা কী রনি?’
রনি ক্রিকেটে আউট হবার পরও ব্যাট করতে দেওয়া থেকে শুরু করে, ক্যারামে নিয়ম ভেঙে রেড ফেলা, হাত থেকে দুম করে বই কেড়ে নেওয়া পর্যন্ত সবই বলল।
‘বাবা, এরকম বন্ধু আমার চাই না।’
সুবিনয়বাবু একটু চুপ থেকে বললেন, ‘রনি, তুমি তো জানো, বনি মানুষ নয়, সে একজন রোবট। তুমি তাকে একটু মানিয়ে নাও।’
রনি বলল, ‘আমি সব জানি বাবা, তারপরেও সরি। আমার বনির জন্য অসুবিধে হচ্ছে। ওকে তুমি ফিরিয়ে দাও। আমি একাই থাকব।’
সুবনিয়বাবু অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘তুমি আমাকে একটু সময় দাও রনি। দেখি যদি কিছু করতে পারি।’
সুবিনয়বাবু ‘আই অ্যাম ইওর ফ্রেন্ড’ কম্পানিতে ফোন করলেন। একচোট রাগারাগি করলেন। ম্যানেজার সমস্যা শুনে শান্ত ভাবে বললেন, ‘আপনিই তো স্যার এমনটাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, আপনার ছেলের এমন সঙ্গী চাই যে তাকে সবসময় খুশিতে, আনন্দে, হাসিতে রাখবে। আমরা বনির ভিতরে যে মাইক্রোচিপসগুলো রেখেছি সেখানে তো সে-ই প্রাোগ্রামই করা আছে। সেই কারণেই তো ক্রিকেট খেলায় আউট করে সে আপনার ছেলেকে আবার ব্যাট করতে দিয়েছে, টেবিল টেনিসে ম্যাচ জেতেনি, বই কেড়ে নিলেও ঝগড়া করেনি।’
সুবিনয়বাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘এটা কোনও বন্ধুত্ব হল? বন্ধুর সঙ্গে খেলায় হারজিত থাকবে না? বন্ধুতে বন্ধুতে ঝগড়া হবে না? আপনারা বন্ধু কাকে বলে জানেন না? এদিকে বন্ধু বানানোর কারখানা খুলে বসেছেন!’
ম্যানেজার বললেন, ‘আবার বলছি স্যার, আমরা অর্ডার মতো কাজ করি। এখানেও তাই করেছি। আপনি যেমন চেয়েছেন।’
সুবিনয়বাবু আরও রেগে গেলেন। বললেন, ‘অর্ডার মানে! আপনার আমার ছেলেবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় হারজিতের ঘটনা ঘটেনি? হেরে গিয়ে আমরা দু:খ পাইনি? ঝগড়া, মারপিট হয়নি? লুডোতে, ক্যারামে বন্ধু একটু এদিক-ওদিক করলেই চোট্টামি হচ্ছে বলে ঝাঁপিয়ে পড়িনি? সেটাই তো বন্ধুত্ব। আমি বনিকে আপনার কাছে ফেরত দিতে আসছি। আপনি ওকে মেরামত করে দিন।’
ম্যানেজার ফোনের ভিতরই অল্প হাসলেন।
‘সরি স্যার। আমরা হয় ভালো রোবট বানাই, নয় খারাপ রোবট বানাই। ভালো এবং খারাপ একসঙ্গে বানাতে পারব না। যে ভালোওবাসবে, সে-ই মারপিট করবে, এমন কোনও সফটওয়ার এখনও আবিষ্কার হয়নি। ওসব গল্প-উপন্যাসে থাকতে পারে। আপনারা কী বলেন যেন? হ্যাঁ, মনে পড়েছে কল্পবিজ্ঞান। বনি কোনও গল্প-উপন্যাসের রোবট নয়, সত্যিকারের রোবট। স্যার, আপনি যদি চান আমরা বনিকে মারুকুটে, ঝগড়ুটে, হিংসুটে বানিয়ে দিতে পারি। সেই মতো সার্কিট ওর ভিতর ঢুকিয়ে দেব। সে আপনার ছেলের সঙ্গে সর্বদাই ঝামেলা করবে। আপনার চলবে?’
সুবিনয়বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘থাক। আপনাদের সীমাবদ্ধতা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি বনিকে ফেরত দিয়ে আসব। ও থাকলে রনির আরও বেশি সমস্যা হচ্ছে।
পরদিন বনিকে নিয়ে যখন সুবিনয়বাবু গাড়িতে উঠছেন, রনি দাঁড়িয়েছিল দোতলার বারান্দায়। বনি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল। রনিও হাত নাড়ল।
রনি অতদূর থেকে স্পষ্ট দেখতে পেল, বনির চোখে জল।