রোদ আর বৃষ্টি
কয়েকদিন হল রোদ আর বৃষ্টির মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ঝগড়া লেগেছে।
দুজনের ঝগড়া নতুন নয়। মাঝে মাঝেই হয়। তবে এবারের ঝগড়া মনে হচ্ছে গুরুতর। কিছুতেই মিটছে না। রোদ বৃষ্টির মুখ দেখছে না, বৃষ্টিও রোদের মুখ দেখছে না। দুজন দুজনের মুখোমুখি হয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে, পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এমন একটা ভান করছে। যেন কেউ কাউকে চেনে না।
ঝগড়ার সময় যখন কথা ‘বন্ধ’ থাকে তখন কথা বলবার নানা কায়দা আছে। ঘুরিয়ে কথা, ঠারেঠোরে কথা, মাঝখানে কাউকে রেখে কথা, লিখে কথা। ‘ঘুরিয়ে কথা’র একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, এক নম্বর আর দু-নম্বর বন্ধুর ঝগড়া লেগেছে।
এক নম্বর বন্ধু—’বইটা এবার ফেরত দেওয়া হোক।’
দুই নম্বর বন্ধু—’খাতাটা ওখানে রাখা হোক।’
এক নম্বর বন্ধু—’টিফিন এগিয়ে দেবার দরকার নেই। আমি অন্যের টিফিন খাই না।’
দুই নম্বর বন্ধু—’বয়ে গেছে আমার টিফিন এগোতে। আমার টিফিন খাবার অনেক লোক আছে।’
ঝগড়ার সময়ে ‘ঘুরিয়ে কথা’ কায়দাটা খুব কাজে দেয়। এতে কথা বলা হয়, আবার কথা বলা হলও না। ঝগড়া চালু রইল। মাঝখানে কাউকে নিয়ে কথা বলবার পদ্ধতিও কাজের। এই সময় দুই ঝগড়ু বন্ধুর মাঝখানে একজন থাকে।
এক নম্বর বন্ধু—’গুলতি, ওকে বলে দে কাল স্কুলে আসবার সময় যেন মনে করে ব্যাটটা নিয়ে আসে।’
দু’ নম্বর বন্ধু—’পিনু, তাকে জানিয়ে দিস আমার ব্যাটটার হাতল গোলমাল করছে।’
এক নম্বর বন্ধু—’গুলতি ওকে জিগ্যেস কর তাহলে কি ক্লাস সেভেনের সঙ্গে ম্যাচ ক্যানসেল হবে?’
দু’ নম্বর বন্ধু—’পিনু, তাকে জানিয়ে দে, শিবুর ব্যাট নিয়েও খেলা যেতে পারে।’
এক নম্বর বন্ধু—’গুলতি, ওকে বলে দে, শিবু যে ব্যাট দিতে চায় না সেটা কি ও ভুলে মেরেছে?’
দু’ নম্বর বন্ধু—’পিনু, তাকে বল, শিবু যাতে ব্যাট আনে সে ব্যবস্থা আমি করব। একটা কাঠি আইসক্রিম খাওয়ালেই রাজি হয়ে যাবে।’
আমাদের রোদ আর বৃষ্টি কিন্তু কোনও ফর্মুলাই মানছে না। কোনওভাবেই কথা বলছে না। ঝগড়া তার মানে জমজমাট। ঝগড়ার ইস্যু কী। খেলা? বই? মারপিট? না, ঝগড়ার ইস্যু হল সময়। কে কোন সময় থাকবে তাই নিয়ে ঝগড়া। গোলমাল হয়েছিল সেদিন সকালে। বৃষ্টি বলল, ‘অ্যাই রোদ একটা কথা শুনবি? আমাকে একটা জিনিস দিবি?’
রোদ বলল, ‘কী জিনিস? হোমটাস্কের খাতা? দেখে দেখে টুকলি করবি তো? নারে, দিতে পারব না। আমার অঙ্ক হয়নি।’
বৃষ্টি বলল, ‘না, হোমটাস্কের খাতা নয়।’
রোদ বলল, ‘তাহলে? মার্বেল দিতে হবে? সরি। আমার মার্বেল নেই।’
বৃষ্টি বলল, ‘না, মার্বেলও নয়। আমাকে ক’দিন সকালটা দিবি?’
রোদ চোখ বড় করে বলল, ‘সকাল! সকাল নিয়ে কী করবি?’
বৃষ্টি উদাস গলায় বলল, ‘সকালবেলায় একটু ঝমঝমিয়ে পড়ব। কতদিন সকালবেলা বৃষ্টি হয় না। তুই যদি ক’টা দিন মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিস আমি একটু নাচানাচি করে নিতে পারি।’
রোদ চোখ পাকিয়ে বলল, ‘কখনওই না। কোনওদিনই না। একেবারেই নয়। সকালটা আমার। এই সময় সূর্য ওঠে। সকালের মিঠে, নরম রোদে আমি ভাসব। তোর কোনও জায়গা নেই। তাছাড়া সকালে মানুষের কত কাজ। তোর জন্য সব পণ্ড হবে? জল, কাদা এ-মা! না, না, সকালে হবে না। তুমি যেমন বিকেল, রাতে যাও বাপু।’
বৃষ্টি রেগে গিয়ে বলল, ‘কেন! সকাল কি তোর একার সময়?’
রোদ তেড়েফুড়ে বলল, ‘আমি তো তোমার সন্ধে বা রাতে নাক গলাই না। তাহলে?
বৃষ্টি ফিক করে গা জ্বালানো হেসে বলল, ‘সে তুই পারিস না তাই। রাতে আর উঠবি কী করে বল? আমি সব সময় ঝরে পড়তে পারি। সব সময় আমার সময়।’
রোদ এতে গেল আরও রেগে। বলল, ‘যখন তখন হামলে পড়ে সবার কেমন গালমন্দ খাস সেটা কী জানিস? কানে যায় সেসব কথা? বলা নেই কওয়া নেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি হলে সবাই বিরক্ত হয়। স্কুলে যাওয়ার ছেলেমেয়ে, অফিসে ছোটা বাবা, কাপড় শুকোতে দেওয়া মা। কেউ খুশি হয় না। গালমন্দে তো তোর লজ্জা নেই। ভাবিস ঝরঝরিয়ে পড়লেই হল। খবরদার বৃষ্টি, সকালবেলা যেন তোকে ধারেকাছে না দেখি। মনে থাকবে?’
ব্যস। এরপর থেকেই মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কিন্তু এই ঝগড়া চলবে কতদিন? সবাই চিন্তিত। রোদ আর বৃষ্টি দুটোই দরকারি। রোদ না হলে পৃথিবীটা যাবে বরফ হয়ে। চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ দেখা যাবে। বৃষ্টি ছাড়াও একই কাণ্ড হবে। সব হয়ে যাবে শুকনো খটখটে। একেবারে মরুভূমি। শ্যামবাজার থেকে শিলিগুড়ি—সবজায়গায় উট চড়বে। তাই দুজনকেই দরকার। একটানা, একঘেয়ে বৃষ্টি একসময় থেমে গিয়ে রোদকে ডাকবে, রোদও তেমন একসময় গা ঢাকা দিতে দিতে বৃষ্টিকে বলবে—আয়, এবার তোর পালা। আকাশ কালো মেঘে যাবে ঢেকে।
কিন্তু এভাবে যদি ঝগড়া চলে, কে কাকে ডাকবে?
এই ঝগড়া দুম করে একদিন শেষ হল। শেষ করে দিল শরতের আকাশ।
পুজোর মুখে। বৃষ্টি ধোয়া রোদ ঝলমলে আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎই ঝমঝমিয়ে নামল বৃষ্টি। রোদ আর বৃষ্টি একসঙ্গে! নরম আলতো রোদে ঝিলমিল করে উঠল বৃষ্টির ফোঁটা। যেন অসংখ্য মুক্তো ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। সে যে কী সুন্দর দেখতে লাগল! ঠিক যেন ছবি। সবাই খুব খুশি। এক মায়াময় আলোয় ভরে গেল চারপাশ।
রোদ আর বৃষ্টির ভাব হল।