রক্তাক্ত প্রান্তর – প্রথম অঙ্ক

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

(বাগপথের মুসলিম শিবির)

[চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে-ওখানে দু’একটা লণ্ঠন বাতাসের ঝাপটায় দুলতে থাকে, দু’ একটা মশালের উদ্‌গত শিখা কেঁপে উঠে। অস্থির আলোর আভায় ছায়াবাজির মত নজরে পড়ে পশ্চাতের সারি সারি তাঁবু। সামনে দু’জন সঙ্গীনধারী সাধারণ সৈনিক টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। একবার ডান প্রান্ত থেকে বাম প্রান্তে আবার বাম প্রান্ত থেকে ডানপ্রান্তে। দু’জনের মুখ দু’দিকে ঘোরানো। মাঝে মাঝে থামে, এক–আধটা কথা বলে, আবার টহল দিতে থাকে। পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার সময়েও ওরা পারতপক্ষে একে অন্যের দিকে তাকায় না।]

১ম সৈঃ। (বাম প্রান্তে পৌঁছে থামবে। সজোরে নিজ গালে চড় মেরে) খুন পিয়ে পিয়ে ঢোল হয়েছেন, শালা ডাকু, বাঘ, ডালকুত্তা।

২য় সৈঃ। (ডান প্রান্ত থেকে) ঝুট বাত! মানুষকে খুন করে মানুষ। মানুষের রক্তে পিয়াস মেটায় মানুষ। জানোয়ার চাটে জানোয়ারের রক্ত।

১ম সৈঃ। (ভ্রুক্ষেপ না করে) খাচ্ছে, খাচ্ছে। রক্ত খেয়েই চলেছে। সকালে সন্ধ্যায় রাতে এক লহ্‌মা বিরাম নেই। শরীরের চামড়া ফুটো করে নল ঢুকিয়ে, চোঁ-চোঁ-চোঁ করে কেবল রক্ত টেনে চলেছে। কিছুতেই যেন পিয়াস মেটে না। পেট ভরে না।

২য় সৈঃ। ভরতো, যদি রক্ত হোতো।

১ম সৈঃ। অত অহংকারের কথা বোলো না রহিম খান। তুমিও যেমন মানুষ আমিও তেমনি মানুষ। কেবল তোমার শরীরের মধ্য দিয়ে রক্তের নহর বইছে আর আমাদের শরীরে কেবল পানির নালী এমন নাক কথা বলা তোমার উচিত নয়।

রহিম। সারাক্ষণ শুনছি তোমার জান পানি করে দিয়েছে হিন্দুস্থানের বাঘা মশা। ওদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করে দেখো, তোমার শরীর ফুটো করে ওরা কী পায়, খুন না পানি।

১ম সৈঃ। আলবত খুন। (শরীরের অন্যত্র চপেটাঘাত করে সেই হাত নিজের চোখের সামনে মেলে ধরে) এই যে আরেক দজ্জালকে বধ করেছি। পেট ফেটে রক্ত ছিটকে বেরিয়েছে। আমার রক্ত লাল কি-না দেখে যাও এসে।

রহিম। লাল না নীল, সাদা না কালো, এই অন্ধকারে তা কী করে মালুম করবে।

১ম সৈঃ। হিন্দুস্থানে এসেছি মারাঠার থোতা মুখ ভোঁতা করে দিতে। আর তুমি কিনা বলছো আমার রক্ত সাদা না কালো, ঠাহর করা যায় না।

[মাঝ রঙ্গ-মঞ্চে দু’জন দু’জনকে পেরিয়ে যাবার মুহূর্তে ১ম সৈনিক রহিম খানের মুখের সামনে হাত ঠেলে দেয়। রহিম খান এক নজর দেখে এগিয়ে চলে যায়।]

রহিম। যদি লাল হয়ে থাকে তবে ওটুকু তোমার রক্ত নয়। অন্য কোনোখানে যা পান করেছিল তার উচ্ছিষ্ট তোমার হাতের ওপর গড়িয়ে পড়েছে। হয়তো মারাঠা শিবিরের কারো রক্ত। ধুয়ে ফেল। ভালো করে ধুয়ে ফেল গে।

১ম সৈঃ। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কুঞ্জরপুরের লড়াইয়ে হেরে গিয়ে তোমার বুদ্ধিবিবেচনা বেবাক লোপ পেয়েছে। এতদিনের পুরোনো সৈনিক তুমি, আর এত সহজে আজ মুষড়ে পড়েছো? মারাঠাদের কাছে কুঞ্জরপুরের দুর্গ হারিয়েছি, তাতেই কি হিন্দুস্থানে মুসলমানদের নাম মিটে গেল?

রহিম। তার আগে উদয়গড়ে জিতেছিল কারা?

১ম সৈঃ। মারাঠারা। তবু ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে হপ্তার পর হপ্তা আমরা এই বিরান পাথারে তাঁবু গেড়ে পড়ে আছি। কোনো একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে।

রহিম। উদ্দেশ্য মশার বংশের পোষ্টাই যোগানো। রক্ত দিয়ে। পানি দিয়ে।

(দু’জনে নীরবে টহল দেয়)

রহিম। বশির খাঁ!

বশির। শুনতে পাচ্ছি। বলো।

রহিম। কুঞ্জরপুর দুর্গের দ্বাররক্ষায় তুমিও নিযুক্ত ছিলে?

বশির। ছিলাম।

রহিম। দুশমনের আক্রমণের বিরুদ্ধে শির উঁচিয়ে তোমার পাশে আরো একজন নওজোয়ান এসে দাঁড়িয়েছিল?

বশির। দাঁড়িয়েছিল।

রহিম। লাল টকটকে চেহারা। বাচ্চা ছেলের মতো কচি মুখ। কিন্তু কী তেজ, কী সাহস!

বশির। আমার মনে আছে।

রহিম। এখন কোথায় সে?

বশির। নেই।

রহিম। তার রক্ত লাল ছিল।

বশির। আমি দেখেছি। বন্দুকের গুলিটা এসে বিধেছিল ঠিক বুকের মাঝখানে।

রহিম। আমার ছোট ভাই। আমার দিলের টুকরো! ওরা ওকে খুন করেছে।

বশির। আমরা তার বদলা নেবোই। মারাঠাদের মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে তবে ঘরে ফিরব।

রহিম। আমি আর একজনের জন্য অপেক্ষা করবো।

বশির। কার জন্য?

রহিম। ইব্রাহিম কার্দির জন্য! বেঈমান! মুসলমান হয়ে গোলামী করছে দস্যু পেশবার। কুঞ্জরপুর দুর্গ ওরা জয় করেছে ইব্রাহিম কার্দির রণকৌশলের জোরে। মারাঠা সৈন্যদের কামান-বন্দুক চালাতে শিখিয়েছে ইব্রাহিম কার্দি। আমর সোনা ভাইয়ের জীবনের খোয়াব তোপ দেগে উড়িয়ে দিয়েছে কার্দি। যদি সুযোগ পাই এই নাঙ্গা হাত দিয়ে ওর বুকের পাঁজর উপড়ে ফেলবো। চুমুক দিয়ে ওর বুকের রক্ত পান করবো। তারপর শান্ত হবো। তারপর ঘুমুতে যাবো।

[পিছনের তাঁবু থেকে কে যেন নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে এবং অন্ধকারের অলক্ষে প্রহরীদের পেরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়।]

বশির। কে? কে যায়? খবরদার, এক পা-ও এগুবে না আর।

রহিম। কে তুমি? আমাদের দিকে মুখ ঘোরাও।

[দর্শকদের দিকে পেছন দিয়ে লোকটা প্রহরীদের দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়াবে। বশির মশালটা একটু তুলে ধরে।]

বশির। একি! মন্নু বেগ? এত রাত্রে শিবিরের বাইরে?

রহিম। নিশ্চয়ই বিশেষ কোন প্রয়োজন আছে। কিন্তু ছাড়পত্র না দেখালে আপনাকে এক পা-ও এগুতে দেবো না।

[মন্নু বেগ বস্ত্রাবরণ থেকে কী একটা বার করে দেখায়। ধাতব বর্ম, তরবারি কোষ, শিরস্ত্রাণ মশালের কম্পিত আলোতে ঝলমল করে ওঠে। উভয় প্রহরী কুর্ণিশ করে পথ ছেড়ে দেয়। মন্নু বেগ চলে যাবে। রহিম ও বশির আবার টহল দিতে থাকে। তবে দু’জনেই একটা বিশেষ জায়গায় এসে থামবে, দেখতে চেষ্টা করবে মন্নু বেগ কোথায় যায়, কী করে।]

রহিম। একেবারে ছেলেমানুষের মতো মুখখানা। এত কচি কিন্তু কী তেজ, কী সাহস! দেখলেই আরেক জনের কথা মনে পড়ে।

বশির। একেবারে বেশি কচি। বেশি টুকটুকে। চোখ মুখ ভুরু ঠোঁট সব একেবারে আওরতের বাড়া। আমি তো একবার তাকালে আর নজর ফেরাতে পারি না। মশালের আলোতে মুখখানা দেখে আমারই দিল পুড়ে যাচ্ছিলো।

রহিম। আর বিউলির প্রান্তরে যারা মন্নু বেগকে লড়াই করতে দেখেছে তারাও ভুলতে পারবে না। যে সব মারাঠাদের মাথা তলোয়ারের এক এক খোঁচায় মন্নু বেগ মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছে তাদের মরা চোখও মন্নু বেগের রূপকে ভুলবে না।

বশির। কিন্তু মন্নু বেগ ওদিকে কোথায় যাচ্ছে? বুকের পাটা তো কম নয়!

রহিম। কোন্ দিকে যাচ্ছে?

বশির। ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে কুঞ্জরপুরের দুর্গের দিকেই ঘোড়া ছুটিয়েছে।

রহিম। অন্ধকারের মধ্যে মিশে গেছে। কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। মরুক গে! আমাদের কী? সেনাপতির পাঞ্জা যখন দেখিয়েছে তখন যেদিকে খুশি ও যাক।

রহিম। কুঞ্জরপুরের দুর্গে কতো আলো জ্বলছে দেখছো?

বশির। খুব জোর উৎসব চলছে।

রহিম। রক্ত। মানুষের রক্ত মানুষে খায়। খেয়ে মাতাল হয়। মাতাল হয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। আমার ভাইয়ের রক্ত ঢেলে প্রদীপ জ্বেলেছে। নইলে ওর আলো এত লাল হবে কেন?

বশির। যাক, চলে এসো। ও-সব দেখে কাজ নেই। উহ্! কী ঘুটঘুটে অন্ধকার। মশালগুলো আর একটু উস্কে দিলে হোতো না?

রহিম। না। হুকুম নেই।

বশির। তা থাকবে কেন। আলো জ্বলবে কেবল কুঞ্জরপুরের দুর্গে এখানে শুধু অন্ধকার। আঁধারের মধ্যে চুপ মেরে বসে থাকা আর ভালো লাগে না।

রহিম। আমি তো বরাবরই তাই চেয়েছি। হয় এস্পার না হয় ওস্পার। কিন্তু এই এন্তেজারি ভালো লাগে না।

বশির। আজকের অন্ধকারটা দেখেছো, কী মিশমিশে কালো! মশালের আলোতে নিজের ছায়াটা দাপাদাপি করে, দেখে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে। মনে হয় যেন ভোজালি হাতে কোনো মারাঠা ডাকাত সড়াৎ করে শিবিরের মধ্যে ঢুকে পড়লো।

রহিম। বেটারা বজ্জাতের হাড়ি। ওদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। (হঠাৎ হাঁক দিয়ে ওঠে) হুঁশিয়ার! তুমি কে?

বশির। কে? কোথায়? কাকে বলছো?

রহিম। মনে হলো আমাদের পেছন দিক থেকে একটা লোক এগিয়ে আসছিল। আমি ভালো করে দেখবার আগেই ঐ তাঁবুটার আড়ালে লুকিয়ে গেল।

বশির। ওহ! তাই বলো। নিশ্চয়ই আপনা লোক হবে। কোনো কাজে এক তাঁবু থেকে বেরিয়ে অন্য তাঁবুতে ঢুকেছে।

রহিম। যে ভাবে এগিয়ে আসছিল তাতে সে রকম মনে হয়নি।

বশির। তুমিও যেমন! যা নয় তাই ভাবো।

রহিম। লোকটার পরণের পোশাক আমাদের মতো নয়।

বশির। কাদের মতো?

রহিম। মারাঠা।

বশির। অসম্ভব।–একলা আমাদের শিবিরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এত বড় বুকের পাটা! বিশ্বাস করি না।

রহিম। হয়তো একলা নয়।

বশির। মানে?

রহিম। আমি দেখেছি শুধু একটাকে। হয়তো সঙ্গে আরো অনেক আছে, তাঁবুর আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ঘোরাফেরা করছে সুযোগের সন্ধানে। যতোবার তোমার ছায়া দুলে উঠেছে হয়তো ততোবারই একজন করে কালো মারাঠা আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে শিবিরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

বশির। এখন কী করবো?

রহিম। টহল দিতে থাকো। এক জায়গায় খুঁটি গেড়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। ভাব দেখিও যেন কিছুই লক্ষ করোনি। পিছনের দিকে বারবার তাকিও না। ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-দূরে চারিদিকে নজর ছড়িয়ে দাও। যেন কিছু হয়নি।

বশির। হয়নি। কেন হবে। কী করে হবে। হতে পারে না। কুছ পরোয়া নেই। নিশ্চয়ই কিছু হয়নি। (আচমকা প্রবলবেগে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েই লাফিয়ে পড়ে পেছনের অন্ধকারে ঘাটি মেরে যে লোকটা সন্তর্পণে এগিয়ে আসছিল তার ওপর।) পাকড়েছি রহিম ভাই। বল্‌, বল্ কে তুই? (রহিম শেখ মশালের আলো উঁচু করে ধরে) তাইতো! এ দেখছি মারাঠা সৈনিক! (রহিম শেখ অন্য হাতে তলোয়ারটা খুলে ধরে)

রহিম। তুমি ছেড়ে দাও। আমি কথা বলছি।

মারাঠা। (বশিরকে) না ভাই। তুমি ছেড়ো না আমাকে। দোহাই তোমার ছেড়ে দিও না। জাপটে ধরে রাখো।

রহিম। ওকে ছেড়ে দাও, বশির।

বশির। ছাড়াতে পারছি না যে। আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

মারাঠা। কিছুতে ছাড়বে না আমাকে। তোমার সঙ্গীটি বড় সুবিধের লোক নয়। আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

রহিম। তুমি কে?

মারাঠা। আলাপ করতে চাও করো। কিন্তু তার জন্যে নাঙ্গা তলোয়ার মুঠ করে ধরবে কেন? গলাটা যদি কেটে ফেল তাহলে স্বর বেরুবে কোথা দিয়ে?

রহিম। তুমি বেশি কথা বলো।

মারাঠা। তুমি বলতে বলে, তাই বল্‌লাম। নইলে তো আমি কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিলাম?

বশির। কোথায় যাচ্ছিলে?

মারাঠা। কাজে।

বশির। কী কাজে?

মারাঠা। গুপ্তচরের কাজে।

রহিম। ফের মিছে কথা বলছো তো এক কোপে দু’টুকরো করে ফেলবো।

মারাঠা। তাতে কী ফায়দা হবে? আমার মধ্যে যা গুপ্ত আছে সে কি আমাকে কেটে দু’ফাঁক করলেই বেরিয়ে পড়বে? তলোয়ারটা খাপের মধ্যে ভরে রাখো। যা বলতে হয় জিব্‌ নেড়ে বলো।

রহিম। এত রাতে কী করতে বেরিয়েছো?

মারাঠা। গুপ্তচর কি দিনের বেলায় বেরুবে?

রহিম। বজ্জাতি রাখো, তুমি গুপ্তচরের কাজে আমাদের শিবিরে ঢুকেছো মারাঠা সৈনিকের পোশাক পরে, ভাঁওতা দেয়ার আর জায়গা পেলে না।

মারাঠা। মিয়া সাহেবের মাথা একটু গরম হয়ে গেছে, তাই সোজা কথাটা বুঝতে পারছে না। আমি তোমাদের শিবিরে ঢুকিনি। তোমাদের শিবির থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম।

বশির। সে গুড়ে বালি। সবুর করো! কী দশা করি দেখবে।

মারাঠা। আর আমার পরণে মারাঠা পোশাক, কারণ আমি মারাঠা শিবিরে ঢুকবো পণ করে বেরিয়েছি। আমি তোমাদের গুপ্তচর। চলেছি ওদের খোঁজ নিতে। তোমার ঐ ঝোলা দাড়ি আর খাড়া পাগড়ী লাগিয়ে রওনা হলে মাঝপথেই অক্কা পেতে হোতো।

বশির। তুমি আমাদের গুপ্তচর?

মারাঠা। জ্বী। আসল নাম আতা খাঁ। এখন অমরেন্দ্রনাথ বাপ্‌পাজী।

বশির। প্ৰমাণ কী?

আতা খাঁ। একটু সরে দাঁড়াও। খুঁজে বের করছি।

[বস্ত্রাবরণ থেকে কী একটা বার করে দেখে, আবার তাড়াতাড়ি সরিয়ে রাখে।]

বশির। ওটা কী সরিয়ে রাখলে দেখতে দাও।

আতা খাঁ। গুপ্তচর তার সবকিছু দেখাতে বাধ্য নয়। তোমাদের যাতে প্রয়োজন শুধু তাই দেখতে পাবে। নাও এই দেখো, ভালো করে দেখো। সেনাপতির নিজ হাতের স্বাক্ষরযুক্ত ছাড়পত্র।

রহিম। (মশালের আলোতে উল্টে পাল্টে পাঞ্জাখানা দেখে) ঠিক আছে আপনাকে খামাখা তকলিফ দিলাম। আপনি যেদিকে খুশি যেতে পারেন।

(বশির ও রহিম আবার টহল দিতে শুরু করে)

আতা খাঁ। যেদিকে খুশি। কিন্তু খুশিমতো চলে কি শেষে আরো কঠিন মুসিবতের মধ্যে পড়বো? দরকার নেই বাবা। তার চেয়ে যে পথে অন্যেরা চলে সে পথ দিয়ে এগুনোই ভালো। তা, সেপাই বাবাজীরা, একটু রাস্তা বাংলে দাও না। মানে মানে সরে পড়ি?

রহিম। আপনার কাজ, আপনার পথ। আমরা তার হদিস রাখি না।

আতা খাঁ। একদম না?

রহিম। না।

আতা খাঁ। বড় ঈমানদার সেপাই দেখছি। সেনাপতি আহমদ শাহ্ দুররানীর খোশ নসিবের অন্ত নেই।

বশির। নিজেদের শিবিরের সকল পথের সন্ধান ভালো করে রাখি। কিন্তু শিবিরের বাইরে অন্ধকারে কোন্ পথ কাকে কোথায় নিয়ে যায় তার ধার ধারি না।

আতা খাঁ। নিজে না রাখলে। কিন্তু অন্য যারা সে পথে আনাগোনা করে তাদের সংবাদও কি রাখো না?–চুপ করে রইলে যে?

বশির। একটু আগে আরেকজনকে দেখেছিলাম।

আতা খাঁ। কচি মুখ টুকটুকে চেহারা। বিউলীর বীর সৈনিক। মন্নু বেগ। কোন্ দিকে গেছে?

রহিম। ঐ দক্ষিণের প্রান্তরে পড়ে নদীর পাড় থেকে সরে গেছে। তারপর মনে হলে ঘোড়া ছুটিয়েছে ঐ উত্তর-পশ্চিম কোণে। তারপর তাকিয়ে থেকে কুঞ্জরপুরের প্রদীপগুলোকে জ্বলতে দেখেছি। কোনো মানুষের আকার আর দেখতে পাইনি।

আতা খাঁ। খোদা হাফেজ। আমি চল্লাম। ঐ পথেই, আমারও কিছু কাজ আছে।

[তড়িৎ গতিতে অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রহরী দু’জন টহল দিতে থাকে।]

রহিম। কেউ অপেক্ষা করে না। আসে আর চলে যায়। কোথায় যায়? কুঞ্জরপুর দুর্গে। কেন? জানবার জো নেই।

বিশর। আমরা শুধু এন্তেজার করবো। শুধু টহল দিয়ে বেড়াবো ডান থেকে বাঁয়ে, বাঁ থেকে ডাইনে। আমরা হচ্ছি পাহারাদার। ঠুলি-পরা কলুর বলদ। ঘুরবো আর ঘুরবো। মাঝে মাঝে হেঁকে উঠবো-খবরদার! কোন্ হ্যায়? তারপর সালাম ঠুকে বলবো, ঠিক হ্যায়। আবার টহল দিয়ে বেড়াবো। ডান থেকে বাঁয়ে, বাঁ থেকে ডাইনে। বৃষ্টিতে ভিজবো, রোদে পুড়ে মরবো, অন্ধকারে ডুবে যাবো–তবু টহল দেবো, টহল দেবো–(থমকে গালে ঠাস করে চড় মেরে) শালা ডাকু, খুনেরা! খুন পিয়ে পিয়ে ঢোল হয়েছেন। এবার মজা বোঝো!

[আস্তে আস্তে পর্দা পড়বে]

দ্বিতীয় দৃশ্য

(স্থান: কুঞ্জরপুর দুর্গ)

[নেপথ্যে উৎসবমুখর রাত্রির উতরোল কোলাহল, নানা গীত ও নৃত্যের আনুষঙ্গিক বিবিধ বাদ্যযন্ত্রে তরঙ্গোচ্ছ্বাস। ইব্রাহিম কার্দির কক্ষ। ঝালর-কাটা মখমলের পশ্চাৎপটে একই মহিলার দু’টো তৈলচিত্র। দু’টোরই পাদদেশে ফুলের স্তূপ এবং তার পাশে একটি করে প্রদীপ জ্বলছে। ইব্রাহিম কার্দি প্রবেশ করতেই পেছনের কোলাহল ও নৃত্যগীত ধ্বনি মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে আসবে।]

কার্দি। (চিত্রের দিকে তাকিয়ে) একি! তোমাকে অনাবৃত করেছে কে? জোহরা! জোহরা! এই প্রদীপ, এই ফুল, এ কার দান? এ তুমি কোথায় পেলে? কেন এসেছো? কে তোমাকে আসতে বলেছে? দীপশিখায় রক্তাক্ত হয়ে সর্বাঙ্গে ফুলের সৌরভ মেখে তুমি বিজয়িনীর হাসি হাসছো। বীণার তারের ওপর তোমার নরম লকলকে আঙুলের নৃত্য, তোমার বজ্রমুষ্টি-ধৃত নিষ্কোষিত তরবারি–ঐ মধুর হাসির অন্তরালে গৰ্বকে, দৰ্পকে, আত্মবিকারকে একটুও আড়াল করে রাখতে পারেনি। কিন্তু ভুল করেছো জোহরা বেগম। মর্মান্তিক ভুল করেছো। আজকের এই দশোহরার উৎসবে প্রমত্ত উল্লাসে মেতে আমার এই নির্জন ঘরে তোমার ঐ ছবির আবরণকে যে উন্মোচিত করেছে সে আমি নই। দুর্বল আবেগের বিহ্বলতায় যে চঞ্চল–চিত্ত তোমার চিত্রের পাদমূলে ফুলের স্তূপ রচনা করে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলেছে তার নাম ইব্রাহিম কার্দি নয়। বড় ভুল করেছো জোহরা বেগম। বড় ভুল করেছো তুমি। যদি পার তবে চিত্র থেকে ঐ হাসি উপড়ে ফেলো। আজকে আমি জয়ী, তুমি নও। দর্পের কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়বার অধিকার আজ আমার। তোমার নয়। তুমি আজ সত্যি পরাজিত, বিস্মৃত, বিসর্জিত। একবার সমস্ত দুর্গটা ঘুরে এসো। দেখবে সকল অন্ধকার বিদীর্ণ করে সহস্র আলোর রশ্মি শুধু একটা সত্যই ঘোষণা করছে–ইব্রাহিম কার্দি বেঈমান নয়, অকৃতজ্ঞ নয়। ইব্রাহিম কার্দি অঙ্গনার কণ্ঠলগ্ন হয়ে কর্তব্যপরায়ণতাকে পরিহার করেনি। ইব্রাহিম কার্দি রণকুশলী সত্যনিষ্ঠ বীর সৈনিক। এক ফুৎকারে নিবিয়ে দই তোমার এই প্রদীপের আলো? দু’হাতে কচলে তছনছ করে ছড়িয়ে দেই এই ফুলের স্তূপগুলো?

[হাতে একটি থালা, তাতে কিছু ফুল ও একটা প্রদীপ জ্বলছে, নিঃশব্দে ঘরে এসে ঢুকেছে এক মারাঠা তরুণী।]

তরুণী। না, তা তুমি পারো না, ভাই, ঐ প্রদীপ আমি জ্বেলেছি। ঐ ফুল আমি কুড়িয়ে এনেছি।

[কার্দি ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকে। দু’ হাতে কপাল রগড়ায়।]

কার্দি। (তরুণীর দিকে চোখ না ঘুরিয়েই) এ-কাজ তুমি কেন করতে গেলে?

তরুণী। আমি তোমার বোন, সেই জন্যে।

কার্দি। কিন্তু তবু তুমি হিন্দু, মারাঠা মেয়ে। আমি মুসলমান, পাঠান। আমার বেদনা তুমি বুঝবে কী করে?

তরুণী। বোন বলে ডেকেছো, তাই কিছু বুঝি। বাকিটুকুও বুঝতে পারি, কারণ আমি মেয়ে।

কার্দি। আজ এই ছবি কেন তুমি এমন ক’রে অনাবৃত করলে?

তরুণী। যে থাকলে এই উৎসবের রাত তোমার জন্য মহোৎসবে পরিণত হতে পারতো, তাকে চুপে চুপে ডেকে আনতে চেয়েছিলাম।

কার্দি। যাকে আমি চাইনে, তাকে তুমি ডাকতে গেলে কেন? দেয়ালের গায়ে কালো পর্দা দিয়ে এই ছবি আমি ঢেকে রেখে দিয়েছিলাম।

তরুণী। কালো পর্দা না ছাই। ঐ রূপের আগুন অত সহজে ঢাকা পড়ে?

কার্দি। তুমি সব কথা জানো না।

তরুণী। কী জানি না?

কার্দি। সাধারণ সৈনিকের কাজ করেছি ফরাসিদের সৈন্যবাহিনীতে আধুনিক রণবিদ্যা তারাই আমাকে শিখিয়েছে। যৌবনে চাকরির সন্ধানে সকল জাতের শিবিরেই হানা দিয়েছি। উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে কেউ নিযুক্ত করতে চায়নি। সেদিন সসম্মানে সৈন্যাধ্যক্ষের পদে যোগদান করার জন্য যিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানান, তিনি হলেন মারাঠাধিপতি পেশবা। তারপর এই পানিপথের প্রান্তরে শুরু হয়েছে হিন্দুস্থানের মুসলিম শক্তির সঙ্গে মারাঠার সংঘর্ষ। মুসলিম শক্তির জয় হোক আমিও মনেপ্রাণে কামনা করি। কিন্তু যারা আমার আশ্রয়দাতা, পালনকর্তা, আমার রক্তের শেষ বিন্দু ঢেলে তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য লড়াই করে যাবো। জোহরা বেগম তা মানতে চায়নি।

তরুণী। কী বলেছে?

কার্দি। বলেছে, মেহ্‌দী বেগ তার কন্যার জন্য লাহোরে যে সম্পত্তি রেখে গেছে, জামাতা হিসেবে তার ওপর আমার অধিকার নাকি ষোলআনা। মারাঠাদের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, নিজের পত্নীর সম্পত্তিকে নিজ সম্পদ বিবেচনা করে তার সাহায্যে যেন স্বাধীন জীবন নির্বাহ করি।

তরুণী। কেন করলে না?

কার্দি। তুমি মেয়ে, তাই সে কথা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।

তরুণী। আমাকে না হয় না পারলে? কিন্তু যাকে ভালোবাসো, তাকেও বোঝাতে পারলে না? অমন ভালোবাসার নাম মুখে এনো না।

কার্দি। মেহ্‌দী বেগের কন্যা ভালোবাসার মূল্য বোঝে না। আমাকে ধিক্কার দিয়ে বলে উঠেছে, আমি নাকি বিশ্বাসঘাতক, স্বধর্মদ্রোহী, পরান্নভোগী, হীনচেতা, কাপুরুষ।

তরুণী। অন্তরে অমৃত না থাকলে মুখ দিয়ে এত গরল উগরে দিতে পারতো না।

কার্দি। গৃহত্যাগ করে যাবার সময় বলে গেছে, আমার সান্নিধ্য তার কাছে অসহ্য। আমার পাপের কলঙ্ক সে স্বতন্ত্র জীবনে নিজের কর্মের দ্বারা ঢেকে রাখতে চেষ্টা করবে, তাকে মুছে ফেলতে উদ্যোগী হবে। উহ্! চোখে মুখে সে কী দুঃসহ ঘৃণার বহ্নিশিখা। তার তুলনায় আমার আজকের ক্ষোভ আর ঘৃণা নিতান্ত তুচ্ছ বস্তু। তুমি হাসছো?

তরুণী। বাঃ, তুমি এত কাণ্ড করতে পারবে আর আমি হাসতে পারবো না?

কার্দি। তোমার সব সহস্য আমি বুঝি না, হিরণবালা। আমার কোন্ কাণ্ড দেখে হাসলে?

হিরণ। তোমার ঘৃণার বহর দেখে। তোমরা পুরুষরা বড় প্রবঞ্চক, অন্যের সঙ্গে তো করোই, নিজেকেও প্রবঞ্চনা করো। যদি মনে এতই ঘৃণা জমে উঠেছিলো তবে সেদিনই তুমি তাকে চিরতরে বিদায় করে দিলে না কেন?

কার্দি। তাই দিয়েছি।

হিরণ। মিছে কথা। তাহলে মারাঠা শিবিরে অবাধে প্রবেশ করবার (থালার ওপরে পুষ্পগুচ্ছের নিচে থেকে বার করতে করতে) এই মহামূল্য ছাড়পত্র তাকে কেন দিয়েছিলে? কিসের আশায়?

কার্দি। একি! (ছাড়পত্রটা নিজের হাত তুলে নিয়ে) এ ছাড়পত্র তুমি কোথায় পেলে? কে? কে এসেছে এই ছাড়পত্র নিয়ে? কোথায়? সে কোথায়?

হিরণ। কী ঘৃণা!

কার্দি। এ ছাড়পত্র তুমি কোথায় পেলে?

হিরণ। এক নওজোয়ান পাঠান সৈনিকের কাছে।

কার্দি। অসম্ভব! কোথায় সে?

হিরণ। আমার ঘরে।

কার্দি। তোমার ঘরে?

হিরণ। কেন নয়? তোমার কাছে গুপ্তচর এসেছে। আমি তাকে আশ্রয় না দিয়ে এই মারাঠা শিবিরে তাকে রক্ষা করবে কে?

কার্দি। ওহ্! কী চায় সে?

হিরণ। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

কার্দি। হুম! জোহরা বেগম দূত পাঠিয়েছে। স্বচক্ষে দেখে যেতে এসেছে, ইব্রাহিম কার্দির দ্বিখণ্ডিত হৃৎপিণ্ডে এখনও কোনো স্পন্দন বাকি আছে কিনা। পাঠিয়ে দাও তাকে। দেখে যাক কার্দির জয়, কার্দির উল্লাস।

হিরণ। যাচ্ছি। সে হয়তো এখনো ছদ্মবেশ পরিবর্তন করছে। শেষ হলেই তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো।

[প্রস্থান]

[কার্দি ধীরে ধীরে দেয়ালের তৈলচিত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত পেছনে মুঠ করা। চোখ চিত্রে স্থির নিবন্দ। পেছন থেকে সন্তর্পণে ঘরে প্রবেশ করে মারাঠা–বেশি অমরেন্দ্রনাথ। কার্দির কাছে এগিয়ে আসে। কার্দি টের পায় না। অমর চিত্র দেখে চমকে ওঠে। একবার একটা, আরেকবার অন্যটা দেখে। ভাবে কী যেন সিদ্ধান্ত করে। দূরে সরে দাঁড়ায়। গলা খাকারি দিয়ে কার্দির মনোযোগ আকর্ষণ করে।]

কার্দি। কী চাও তুমি, আমার কাছে কেন এসেছো?

অমর। জ্বী?

কার্দি। এটা শত্রু শিবির। বিলম্ব না করে তোমার বক্তব্য পেশ করো। (ঘুরে) একী! তুমি? অমরেন্দ্র? তুমি গুপ্তচর?

অমর। এ্যাঁ? গুপ্তচর, ছিঃ ছিঃ! এ আপনি কী বলছেন? আমি অমরেন্দ্রনাথ বাপ্‌পাজী, মারাঠা সৈনিক। আপনার অনুগত দাস। গুপ্তচর হতে যাবো কেন?

কার্দি। তোমাকে কে পাঠিয়েছে?

অমর। আমাকে?

কার্দি। মুসলিম শিবির থেকে এইমাত্র যে এসেছে সে তুমি নও?

অমর। মুসলিম শিবির থেকে কে, কে এসেছে?

কার্দি। ওহ্! আমি ভুল করেছি। হিরণ তাহলে তোমার কথা বলেনি।

অমর। হিরণ? কী বলেছে সে? কিছু বলবার জন্য আমিও তো তাকে খুঁজছি।

কার্দি। আমারই ভুল হয়েছে।

অমর। এ ছবি দু’টো কার?

কার্দি। তুমি চিনবে না।

অমর। দু’টো ছবি একই মহিলার?

কার্দি। হ্যাঁ।

অমর। এই ছবিটা এত কোমল, আর এটা এত কঠিন যে, না বলে দিলে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না যে একই রমনীর চিত্র।

কার্দি। তোমার বোঝার কথা নয়।

অমর। এই শেষের ছবিটার কথা বলছি জনাব। অশ্বপৃষ্ঠে আসীন, কোষমুক্ত তরবারি হাতে রমণীরূপের এই বীরাঙ্গনা মূর্তি মারাঠা শিবিরে কখনো দেখিনি জনাব।

কার্দি। তুমি বাচাল। হিরণবালাকে খুঁজছিলে, খোঁজ গিয়ে।

অমর। তার ঘর দেখলাম ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি করলাম, কেউ সাড়া দিলো না।

কার্দি। বন্ধ!

অমর। জ্বী, জী

[ছবি দু’টো দেখতে দেখতে প্রস্থান]

[নির্জন ঘরে কার্দি আবার চিত্রের কাছে এগিয়ে যায়। হাতের ধাক্কা দিয়ে ফুলগুলো ফেলে দেয়। ফুৎকারে প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। তারপর ছবি দু’টোর ওপর টেনে দেয় একটি কালো পর্দা। এমনি সময় ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করলো জোহরা বেগম।]

জোহরা। আমি এসেছি।

কার্দি। কে! জোহরা! তুমি, জোহরা, জোহরা!!

জোহরা। আমি ফিরে এসেছি।

কার্দি। তুমি এসেছো, জোহরা? আমি জানতাম তুমি আসবে। আমার প্রতীক্ষা ব্যর্থ হতে পারে না।

জোহরা। আমিও জানতাম, আমি আসবো।

কার্দি। কতোদিন তোমাকে দেখিনি। তৃষ্ণায় দু’চোখ আমার পুড়ে খাক হয়ে গেছে। কতোকাল তোমার এই রূপ আমি দেখিনি অশ্ব পৃষ্ঠে নয়, মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে তুমি। রক্তাক্ত তরবারি নয়, হাতে তোমার মেহদিপাতার রং। ঐ আনত মুখ, ঐ নির্মিলিত চোখ–এত রূপ তোমার, একবার মুখ তুলে তাকাও আমার দিকে।

জোহরা। তুমি এতো ভালোবাসো আমাকে?

কার্দি। আরো পরীক্ষা করে দেখতে চাও?

জোহরা। আমি পরীক্ষা করতে আসিনি, গ্রহণ করতে এসেছি।

কার্দি। আমি তো কবে থেকেই দেউলিয়া। দান করবো কোত্থেকে?

জোহরা। সে আমি শুনবো না–আমার পাওনা আমি আদায় করবোই।

কার্দি। যুদ্ধ-শিবিরের অনিয়ম এবং শ্রম তোমাকে এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি। তোমার চোখে সেই আগের জ্যোতি, গায়ের রঙে সেই আলোর ঝলকানি, সারা শরীরে তোমার রূপের সেই মাতামাতি। তোমার শরীর আগের চেয়ে ভালো হয়েছে জোহরা।

জোহরা। পোড়া শরীর। মনের মানা মানে না।

কার্দি। পথে কোন কষ্ট হয়নি তো?

জোহরা। মুসলিম শিবির থেকে বেরিয়েছি পাঠান সৈনিকের বেশে। এখানে এসে ভর করেছি হিরনবালার ওপর। বাকিটুকু তুমি জানো।

কার্দি। তোমার হাতে যেদিন প্রথম তলোয়ার তুলে দিয়ে বলেছিলাম, ‘আঘাত করো’ সেদিন কী কামনা করেছিলাম জানো?

জোহরা। জানি। তুমি আমার নারীত্বকে পূর্ণতা দান করতে চেয়েছিলে। তুমি স্বামীর উপযুক্ত কাজ করেছিলে। আমি অযোগ্যা। তাই তার মান রাখতে পারিনি।

কার্দি। ভেবেছিলাম তোমার রূপের ঐশ্বর্যের সঙ্গে যুদি শক্তির সুশিক্ষা যুক্ত হয় তাহলে তুমি সত্যি বাদশার বাদশা বনে যাবে। ক্ষমতাও তোমার ছিল। মাস না পেরোতে অসি চালনায় ওস্তাদকে হার মানালে। অশ্বারোহণের কৌশলে আর ক্ষিপ্রতায় তুমি আমাকে স্তম্ভিত করে দিলে। তারপর একদিন এই নব সত্তার জয়ধ্বজা উড়িয়ে আমাকে সত্যি আঘাত করলে, আমাকে ত্যাগ করলে। আমার বুকে মুখে মাটি চাপা দিয়ে চলে গেলে।

জোহরা। এ অভিযোগ সত্য নয়। তুমি জানো আমাদের দু’টুকরো করে আলাদা করেছে কোন্ শক্তি। কেন তুমি মুসলিম শিবিরে নও, কেন মারাঠা শিবিরে?

কার্দি। মিছে কথা। যদি সেটাই সবচেয়ে বড় সত্য হতো তাহলে আজ কী করে তা মিথ্যে হয়ে গেল? আজ কী করে তুমি সকল দ্বন্দ্ব-সংশয় চূর্ণ করে এই গভীর রাতে, মারাঠা শিবিরে আমার ঘরে ছুটে এলে?

জোহরা। তোমাকে নিয়ে যেতে।

[কার্দি হেসে উঠে]

কার্দি। তুমি উন্মাদিনী। তুমি রমণী এবং উন্মাদিনী। তোমার সঙ্গে সঙ্গত ও শোভন আচরণ করা নিরর্থক।

জোহরা। কী বলতে চাও তুমি?

কার্দি। অপেক্ষা করো। পুরুষের পরাক্রম হৃদয়হীনা নারীর দম্ভকে কী করে পরাভূত করে এখনি প্রত্যক্ষ করবে। আমি জোর করে তোমাকে শিবিরে আটকে রাখবো। (একটা ঘণ্টায় মৃদু আঘাত করে।) একবার ভুল করেছি বলে কি বারবার সেই একই ভুল করতে হবে? রাত্রি শেষ হবার আগেই কুঞ্জরপুর দুর্গের এই দশোহরার উৎসব তোমার আমার পুনর্মিলনের সোহাগে কলকল করে হেসে উঠবে। কোনো পাঠান সৈনিক বা রমণী যেন আজ রাতে এই মারাঠা শিবির ত্যাগ করতে না পারে তার পাকা ব্যবস্থা করে রাখবো।

জোহরা। শক্তির যে সুশিক্ষা তোমার কাছ থেকে লাভ করেছি তার ক্ষমতাকে অত অবহেলা করো না। জোহরা বেগমকে জীবন্ত আটকে রাখবে এমন শক্তি তোমার প্রহরীর নেই। রাত্রি শেষ হবার আগেই দেখবে হয় তোমার প্রহরীর নয় তোমার পত্নীর রক্তে তোমার মারাঠা শিবির রঞ্জিত।

কার্দি। জোহরা।

জোহরা। আড়াল থেকে তোমার প্রহরীকে চলে যেতে বলো।

[কার্দি ঘণ্টায় মৃদুভাবে দু’টো আঘাত করে।]

কার্দি। কেউ নেই।

জোহরা। তুমি জানো কুঞ্জরপুরের দুর্গকে আমরা দিল্লী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। তোমাদের শিবিরে রসদ প্রবেশের সকল রাস্তা আহমদ শাহ্ দুররানীর চরেরা পাহারা দিচ্ছে। কুঞ্জরপুর থেকে নড়ে বড়জোর তোমরা পানিপথ পর্যন্ত এগুতে পারবে। কিন্তু তারপর আর নয়। সমস্ত হিন্দুস্থানের মুসলমান বাগপথে সম্মিলিত হয়ে অপেক্ষা করছে। যমুনার পানি তাদের রক্তে লাল হয়ে যাবে, কিন্তু হিন্দু মারাঠাকে উচিত শিক্ষা না দিয়ে তারা কেউ জীবন্ত ফিরে যাবে না।

কার্দি। আমি জানি।

জোহরা। আর একদিন কি দু’দিন। তারপরই সে ঘোর সময় শুরু হবে। তুমি ফিরে এসো। আমার সঙ্গে ফিরে চলো।

কার্দি। যে ফিরে যাবে সে আমি হবো না। সে হবে বিশ্বাসঘাতক। সে হবে ইব্রাহিম কার্দির লাশ। তাকে দিয়ে তুমি কী করবে?–তুমি কাঁদছো। ভারতে মুসলিম শক্তি জয়যুক্ত হোক, তার পূর্ব গৌরব সে ফিরে পাক-বিশ্বাস করো এ কামনা আমার মনে অহরহ জ্বলছে। কিন্তু ভাগ্য আমাকে প্রতারিত করেছে। সে গৌরবে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে। আমার সংকটের দিনে যারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে কর্মে নিযুক্ত করেছে, ঐশ্বর্য দান করেছে সে মারাঠাদের বিপদের দিনে আমি চুপ করে বসে থাকবো? পদত্যাগ করবো? দলত্যাগ করবো? সে হয় না, জোহরা। আমি নিশ্চিত জানি, জয়-পরাজয় যাই আসুক, মৃত্যু ভিন্ন আমার মুক্তির অন্য কোন পথ নেই। এ সময়ে তুমি আমার কাছ থেকে চলে যেও না, জোহরা! চারদিকে বড় অন্ধকার! মাঝে মাঝে রক্তের লাল ছোপ মাখানো! বাদবাকি সব কালো–কালো ঘোর অন্ধকার! জোহরা, আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো। যখন অন্ধকারে শ্বাসরোধ হয়ে আসবে তখন যেন অনুভব করতে পারি তোমার মেহেদি পরা হাত আমার রক্তহীন দেহ আঁকড়ে ধরে রেখেছে। জোহরা!

জোহরা। আমাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা করো। এই মারাঠা শিবিরে তোমাকে আমি স্পর্শ করতে পারবো না। আমি মেহেদি বেগের কন্যা। মারাঠা দস্যুরা আমার পিতাকে হত্যা করেছে। এই শিবিরে তোমার আমার মাঝখানে আমার পিতার লাশ শুয়ে আছে। আমি তোমার কাছে এগুবো কী করে? তোমার হাতে হাত রাখবো কী করে? আমাকে ক্ষমা করো।

কার্দি। জোহরা।

জোহরা। আমাকে আর ডেকো না। আমি যাই।

[যাবার জন্যে পা বাড়ায়।]

কার্দি। জোহরা! একটা কথা শুনে যাও।

জোহরা। বলো।

কার্দি। হয়তো ভুলে ফেলে যাচ্ছিলে। (ঝুঁকে পড়ে মাটি থেকে মারাঠা শিবিরে প্রবেশ করার ছাড়পত্রটা হাতে তুলে নেয়) এটা তোমার জিনিস। নিয়ে যাও। যদি কোনদিন কখনো হঠাৎ কারো জন্য কষ্ট হয়, ইচ্ছা হয় মারাঠা শিবিরে ছুটে আসতে–এই ছাড়পত্রটা তখন যদি তুমি খুঁজে না পাও-নিয়ে যাও।

জোহরা। (আবেগরুদ্ধ অশ্রুপ্লাবিত বিকৃত মুখে) না! না!! না!!!

(ছুটে বেরিয়ে যায়) [ধীরে ধীরে পর্দা পড়বে]

তৃতীয় দৃশ্য

[হিরণবালার কক্ষ। খাটিয়ায় ও মেঝের ওপর কোনো সৈনিকের পরিত্যক্ত তলোয়ার, পাগড়ি, কোট, বুট সব ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। হিরণবালা একটি একটি করে গুছিয়ে তুলে রাখছে, এমন সময় দরজায় ঘা পড়ে। হিরণ কান পেতে শোনে। মৃদু হাসে। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে চমকে সভয়ে পেছনে হটে আসে।]

হিরণ। একী! দিলীপ! তুমি? এত রাতে তুমি এখানে কী চাও?

[গেরুয়া পোশাক পরা মারাঠা যুবক দিলীপ ঢুকবে]

দিলীপ। তোমার সর্বস্ব। ধনদৌলত যা আছে সব।

হিরণ। তুমি নেশা করেছো।

দিলীপ। সে কি আজ নাকি? যেদিন থেকে তোমার রূপ দেখে মজেছি, সেদিন থেকেই তো নেশায় চুরচুর। সে আজ কতো বছরের কথা মনে আছে? বিন্ধ্যগিরির গুরুদেবের আশ্রমে দশ বছর এক সঙ্গে বিদ্যাভ্যাস করেছি। যবন বধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে অস্ত্রশিক্ষা করেছি। কঠোর ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করেছি। তুমিও আমিও।

হিরণ। তুমি নরাধম। আশ্রমের শিক্ষা তোমার জন্য ব্যর্থ।

দিলীপ। আর তোমার বেলায়? ব্রহ্মচারী অমরেন্দ্রনাথ যখন মাঝরাতে তোমাকে ডাকাডাকি করতো সে কি আশ্রমের প্রাকৃতিক শোভা নিরীক্ষণ করবার জন্য, না যুগলে দেবারাধনা করবে বলে?

হিরণ। সে-সব কথা আলোচনা করার জন্য এই দুপুর রাতে এখানে ছুটে এসেছো?

দিলীপ। কেন, তাতে কি দোষ হয়েছে। আলোচনা বলো, আরাধনা বলো, এ রকম নির্জন রাতের জন্য অতি প্রশস্ত।

হিরণ। আর কী বলতে চাও?

দিলীপ। এত তাড়াতাড়ি কিসের? আস্তে আস্তে বলছি? এসেছি যখন তখন সব কথা না বলে চলে যাবো মনে করেছো?

হিরণ। তাড়াতাড়ি করো।

দিলীপ। কেন, আর কেউ আসবে নাকি? আসুক। দোরটা ভালো করে দিয়ে রাখো, সে বাইরে অপেক্ষা করবে। আমি করিনি? অপেক্ষা করতে করতে যখন একেবারে থ’ হয়ে গেলাম তখনই না একবার ঘুরে একটু নেশা করে এসেছি। আর থাকতে না পেরে মরিয়া হয়ে, যা থাকে কপালে, ঝাঁপিয়ে পড়লাম তোমার ঘরের মধ্যে। এসে দেখি কেয়া মজা! মন্দির নির্জন, দেবী একা, বে-আক্কেল পূজারি বেটা বিদায় নিয়েছে।

হিরণ। তোমার বাক্য, তোমার চিন্তা, তোমার আচরণ বরাবরের মতোই কুৎসিত, কদর্য।

আর অমরেন্দ্রনাথ বাপ্‌পাজীর কণ্ঠ, স্পর্শ, ঘ্রাণ সবই বুঝি বিশুদ্ধ, পবিত্র? কী করে স্থির করলে? তুলনা করলে কী করে? আমি তো বরাবরই বলেছি যে, রায় একতরফা হওয়া উচিত নয়। সকল দিক জেনে, বুঝে, দেখে তারপর একদিক বেছে নেয়া উচিত। এখন আমি এসেছি আমাকে নাও। তারপর বিচার করে দেখো কে বেশি আরাধনার যোগ্য আমি না অমর।

হিরণ। তুমি পশু, সে দেবতা।

দিলীপ। আমি হিন্দু, সে যবন।

হিরণ। কী বললে?

দিলীপ। আমি হিন্দু আর তোমার দেবতাটি যবন। যে দেবতাটি তোমার পতি, দেবতার বাড়া, সে আদ্যোপান্ত যবন। যদি ভুল দেখে না থাকি তবে তোমার উপ-পতিদেবতাও যবনাধম যবন। কেবল আমি, যে অদ্য রজনীতে অবশ্যই তোমার উপ–উপপতি দেবতা হবার অভিলাষী, কেবল সে-ই নির্ভেজাল হিন্দু।

হিরণ। কাল সকালে যখন তোমার নেশা কেটে যাবে তখন এসব কথা উচ্চারণ করতেও ভুলে যাবে।

দিলীপ। তোমার অনুরোধে পড়ে সব করতে রাজি আছি। অমরেন্দ্রনাথ যে আসলে যবন, তোমার খাতিরে কাল সকাল থেকে সে-কথা ভুলে যেতে আলবৎ রাজি আছি।

হিরণ। এ-সব কথা কে বলেছে তোমাকে?

দিলীপ। সে গোমর ফাঁক করবো না। তবে তোমার এতদিনের পেয়ারের আদমী, তার পুরো পরিচয়টা তোমার কাছে না বলে পারলাম না। ওর আসল নাম আতা খাঁ। ছোটকালে মারাঠা সৈন্যরা ওকে লুট করে নিয়ে এসে বিন্ধ্যগিরির আশ্রমে ফেলে রেখে যায়। বড় হয়ে ঐ সব জানতে পেরেছে। কিন্তু বজ্জাতের হাড়ি, জেনে-শুনেও সব চেপে রেখেছে যায়। তা রাখবে না কেন! শেষে কি যবন বনে তোমাকে খোয়াবে?

হিরণ। তোমার সংবাদ পরিবেশন করা শেষ হয়েছে?

[হিরণ মাটিতে পড়ে থাকা খাপে-ঢাকা তলোয়ারটার দিকে বারবার তাকায় এবং একটু একটু করে তার কাছে এগিয়ে যায়।]

দিলীপ। মনে হচ্ছে যেন আদৌ বিচলিত হলে না।

হিরণ। নিশ্চয়ই বিচলিত হয়েছি। এত বিচলিত হয়েছি যে, সমগ্র মন চাইছে যে, এক্ষুণি এর একটা প্রতিকার করি। তুমি আমার এত বড় উপকার করেছো যে, হাতে হাতে একটা প্রতিদান তোমার পাওয়া উচিত।

[হিরণ ক্ষিপ্রগতিতে ঝুঁকে পড়ে তলোয়ারটা ধরতে যাবে আর অমনি তার চেয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাফিয়ে পড়ে পা দিয়ে সেটা চেপে ধরে রাখে দিলীপ।]

দিলীপ। আহ্! কী ছেলেমানুষি করছো! আমি জানি যে, তুমি অসি চালনায় সুপটু। কিন্তু তাই বলে এই অসময়ে তোমার তলোয়ারের খেলা কে দেখতে চেয়েছে? আমি অল্পবিস্তর মাতাল হয়েছি বটে, কিন্তু মাথা একেবারে খারাপ হয়ে যায়নি। তাল–বেতাল জ্ঞান বিলকুল ঠিক আছে। (বসে পড়ে দু’হাতে চেপে ধরে তালোয়ারের খাপটা দেখতে থাকে) বাঃ! বড় খাসা তলোয়ার দেখছি। এমন বাহারের নক্সা করা অস্ত্র মারাঠা শিবিরে কোনো মর্দ ব্যবহার করে বলে মনে হয় না।

হিরণ। নেশার ঘোরে কী দেখছো। আর কী বকছো তুমিই জানো। নেশার নিকুচি করি।

দিলীপ। আমার চোখে ধুলো দিতে চেষ্টা কোরো না হিরণ। এ তলোয়ার এখানে কোত্থেকে এলো? এ অস্ত্র দেখছি মুসলমানের, মারাঠা শিবিরে কী করে প্রবেশ করলো? জবাব দাও?

হিরণ। প্রশ্ন তুমি করেছো, জবাবও তুমিই দাও।

দিলীপ। দেবো, দেবো! অবশ্য দেবো। (উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্তের মতো ঘরের চারধারে খোঁজে) এই যে পেয়েছি। উষ্ণীষ মুসলমানের শিরস্ত্রাণ। (শুঁকে দেখে) কোনো মারাঠা পুরুষ মাথায় এত সুগন্ধী তেল মাখে না। এই যে, এই তার জুতো, এই বিনামা, এইতো, এইতো তার আংরাখা, ইজার। আমার একটুও ভুল হয়নি। একটু আগে তোমার সঙ্গে সঙ্গে যে যবন তোমার ঘরে ঢুকেছে আমি দূর থেকে তাকে ঠিকই দেখেছিলাম। এখন কোথায় সে?

(দিলীপ ঘরের আনাচে-কানাচে দৃষ্টি ঘোরায়।)

হিরণ। এখানে নেই।

দিলীপ। ঝুট্। তার অসি-উষ্ণীষ, ইজার–কোর্তা সব এখানে পড়ে রয়েছে, কেবল আসল আদমীটাই অদৃশ্য!

হিরণ। এখানে ছিল। কিন্তু এখন নেই। তুমি আসার একটু আগে চলে গেছে।

দিলীপ। এইতো একটু একটু করে মুখ দিয়ে বুলি বেরুচ্ছে। এতদিন তোমার সন্নোসীপনার ঘটা দেখে রাত-বিরাতে এখনও ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে সাহস পাইনি। তখন কি জানতাম আমার সতী সীতা ভেতরে ভেতরে এত রসবতী।

হিরণ। এখন কী জেনেছো?

দিলীপ। এইটুকু জেনেছি যে, তোমার এই শয্যাগৃহে উপযুক্ত যবনও অসময়ে প্রবেশ করতে পারে এবং প্রয়োজনবোধে এই কক্ষেই পরিধেয় বস্ত্রাদি অসঙ্কোচে ত্যাগ করতে পারে।

হিরণ। এই জ্ঞানলাভে তোমার স্বার্থ?

দিলীপ। বাঃ, জ্ঞানলাভ কি কখনো বিফলে যায়। এই যেমন ধরো, বাহুল্য বোধে আমিও প্রথমে আমার এই মহামূল্যবান উত্তরীয় বর্জন করলাম।

হিরণ। অত মূল্যবান উত্তরীয়খানা মাটির ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিলে?

দিলীপ। কোলে তুলে নাও তারপর ধরো, সেই যবন সেনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, আমিও আমার পাদুকা পরিত্যাগপূর্বক তোমার পালঙ্কে আসন গ্রহণ করলাম। (দিলীপ খাটের ওপর পা তুলে জাঁকিয়ে বসেছে। হিরণ চাদরটা তুলবার সময়ে সুকৌশলে তার আড়ালে তলোয়ারখানা হাতে তুলে নেয়) তা বাবা মেঝের ওপর যার পাগড়ী-পাজামা গড়াগড়ি খাচ্ছে সে বান্দা খাটের নিচে কোথাও লুকিয়ে নেই তো?

হিরণ। না!

দিলীপ। বেশ বেশ। এই ঘরের মধ্যে থেকে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে উৎপাত শুরু না করলেই হলো! আজ রাতে ব্যাটা শিবিরের স্বাধীনতা ভোগ করুক, কাল সকালে টুটি চেপে ধরবো। গুপ্তচরবৃত্তি করতে এসে রঙ্গ জনমের মত ঘুচিয়ে দেবো।

হিরণ। তাকে চিনবে কী করে?

দিলীপ। সে আমি ঠিক চিনে নেবো। তোমার এ ঘরে বায়ু চলাচল এত কম যে, ঘেমে নেয়ে উঠলাম। অতএব তোমার অনুমতি নিয়ে আমার পূর্বগামী যবন সেনার মতো আমিও এবার গায়ের জামাটা খুলে ফেলতে চাই।

[মাথা নিচু করে দিলীপ জামা খুলতে উদ্যত, এমন সময় হিরণ এক ঝটকায় তরবারি কোষমুক্ত করে নেয়। ]

হিরণ। খবরদার জামা গায়ে রাখো! আর একটি অসদাচরণ করেছ কি বিনা দ্বিধায় তোমাকে দু’টুকরো করে ফেলবো।

দিলীপ। তুমি সত্যি রহস্যময়ী, হিরণবালা। পতি, উপপতি সবই গোপনে যবনকুল থেকে নির্বাচন করতে তোমার কোনো দ্বিধা বোধ হয় না, রাগ কেবল স্বধর্মের একটি হৃদয়বান তরুণের প্রতি।

হিরণ। এই তোমার উত্তরীয়। যেমন করে পরে এসেছিলে তেমনি করে সর্বাঙ্গে পেচিয়ে নাও। কোনো কথা বলো না। তোমার কথা শুনলেই আমার ইচ্ছা হয় তোমার বুকের ওপর হাঁটু চেপে বসে গলায় চাপ দিয়ে জিহ্বাটা টেনে উপড়ে ফেলে দি।

দিলীপ। আর মধ্যরাতে অপরিচিত যবন–সেনা ঘরে ঢুকে বস্ত্র পরিত্যাগ করতে চাইলেও মনে কোনো ক্ষোভ হয় না, না?

হিরণ। তিনি আমার অপরিচিত নন।

দিলীপ। চমৎকার! অমরও কি এই সংবাদ রাখে নাকি?

হিরণ। জানে।

দিলীপ। অমর তোমার এতই বশ?

হিরণ। না হবে কেন? এই মুহূর্তে তুমি আমার বশ নও? খাট থেকে নেমে পাদুকা পরো। আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোও। দশোহরার রাতে তোমার মতো দুরাচারের রক্তে আমার গৃহ রঞ্জিত হোক, এ আমি চাই না।

দিলীপ। না থাক, রক্তপাতের প্রয়োজন নেই। আমি স্বেচ্ছায় বিদায় নিচ্ছি। শুধু একটা কথা তোমার কাছ থেকে শুনে যেতে চাই। আজকের এই যবন-সেনাটিকে তুমি কতোদিন থেকে জানো?

হিরণ। যতোদিন থেকে অমরকে জানি।

দিলীপ। বিশ্বাস করি না। খোঁজ করে দেখবো।

হিরণ। খোঁজ আমিই তোমাকে দিচ্ছি। আমার ঘরে এসে যে যবন সেনা এই যবন–বেশ বর্জন করেছে তাকে তুমি চেনো। তার আসল নাম আতা খাঁ। এই পোশাক-পরিচ্ছদ ত্যাগ করে সে যখন মারাঠা সৈনিকের পোশাক পরে এ-ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তখন তোমরা অমর বলে সম্ভাষণ জানাও।

দিলীপ। ওহ্ কী আশ্চর্য! আমার চোখে সবটা ধরা পড়লো না।

হিরণ। অমর বলো, আতা খাঁ বলো, মনে মনে তাকে আমি স্বামী বলে গ্রহণ করেছি। তাকে আমি ভালোবাসি। এ-ঘরে তার প্রবেশ অধিকার আছে। কিন্তু-তুমি-আর কোনোদিন যদি নেশার ঝোঁকেও অসময়ে এ-ঘরে ঢুকে পড়ো, নিশ্চিত জেনো সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে না।

[দিলীপ বেরিয়ে যায়। হিরণ দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে। আবার দরজার বার থেকে কয়েকটা আঘাত। হিরণ ভ্রূ কুঁচকে শোনে। অপরিসীম ঘৃণা ও রোষ নিয়ে হিরণ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে কুলদেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায় এবং ঐ একই প্রণামবদ্ধ মুঠোর মধ্যে তালোয়ারটা খাড়া উঁচু করে চেপে ধরে রাখে। যে প্রবেশ করবে তার কাঁধে খড়গাঘাতের মতো নেমে আসবে। উত্তেজনায় হিরণ কাঁপছে এবং চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।]

হিরণ। এসো, ঘরের মধ্যে এসো। (হস্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে অমর) অমর!

[হিরণবালার হাত থেকে তালোয়ার পড়ে যায়। নিজেও পড়ে যাবার উপক্রম হতেই অমর ধরাধরি করে তাকে খাটে নিয়ে বসিয়ে দেয়।]

অমর। হিরণ! হিরণ! কী হয়েছে?

হিরণ। কিছু হয়নি। তুমি অস্থির হয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দেরি করলে চলবে না।

অমর। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য তুমি তলোয়ার উঁচিয়ে অপেক্ষা করছিলে?

হিরণ। আমি ভেবেছিলাম দিলীপই বুঝি আবার ফিরে এসেছে, তাই হাতে তলোয়ার তুলে নিয়েছিলাম।

অমর। আবার ফিরে এসেছে মানে কী? আরেকবার এসেছিলো নাকি? কেন এসেছিলো? কতোক্ষণ ছিলো? তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি তো? দোহাই তোমার, একটু তাড়াতাড়ি জবাব দাও।

হিরণ। তুমি অস্থির হয়ো না। আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। এই তলোয়ারটা হাতের কাছে পাওয়াতে বড় বেঁচে গেছি।

অমর। সে কী? এ তলোয়ার তোমার ঘরে এলো কী করে? এ তো মুসলিম শিবিরের অস্ত্র। আর এগুলো-এ পাগড়ি, পাজামা, এসব তোমার ঘরে কোত্থেকে এলো?

হিরণ। এগুলো মন্নু বেগের। এই ঘরে বেশ পরিবর্তন করেছে।

অমর। মন্নু বেগের? মন্নু বেগ তোমার ঘরে এসে বেশ পরিবর্তন করেছে? ওহ্! বুঝেছি।

হিরণ। দিলীপ ঘরে ঢুকেই এগুলো দেখে নানা রকম প্রশ্ন করতে শুরু করলো।

অমর। সর্বনাশ! কী জবাব দিলে?

হিরণ। অনেকক্ষণ ধরে ভেবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারিনি। শেষে মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম এগুলো তোমার।

অমর। দিলীপ বিশ্বাস করলো?

হিরণ। তাকে বুঝিয়ে বললাম যে তুমি আসলে গুপ্তচর। সব সময়েই তোমার সঙ্গে দু’টো পোশাক থাকে। একটা পরে তুমি অমর হও, অন্যটা আতা খাঁ বনে যাও।

অমর। কী সর্বনাশ! তুমি তাকে এসব কথা বললে?

হিরণ। না বলে উপায় ছিল না। এর চেয়ে কম লোমহর্ষক কিছু বললে ও বিশ্বাস করতো না।

অমর। তুমি জানো না, তুমি কী সর্বনাশ করেছো। তুমি দিলীপকে একথা বলতে গেলে কেন?

হিরণ। দিলীপ সবই জানতো। কেমন করে আতা খাঁ অমরেন্দ্রনাথের রূপ নেয়, নেশার ঘোরে সে গল্প শোনাতেই দিলীপ আমার ঘরে ছুটে এসেছিল।

অমর। দিলীপ বললো আর অমনি তুমি বিশ্বাস করলে যে, আমি হিন্দু অমর নই। আমি মুসলিম আতা খাঁ।

হিরণ। দিলীপের কাছ থেকে শোনার অনেক আগে থেকেই আমি সব জানতাম। সে সব কথা থাক। হাতে সময় খুব কম। তোমাকে অনেক কাজ করতে হবে।

অমর। তোমাকে ভালোবাসি হিরণ।

হিরণ। থাক। এখন যা বলি শোনো। দিলীপের নেশার ঘোর পুরোপুরি কাটবার আগেই মন্নু বেগকে মানে জোহরা বেগমকে এ শিবির থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

অমর। তার জন্য চিন্তা করো না। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

হিরণ। আর-আর-আরেকটা কথা, বলতে কষ্ট হচ্ছে।

অমর। কী দরকার, নাই-বা বললে।

হিরণ। তোমাকে ভালোবাসি আতা খাঁ।

অমর। সব তো বলেই ফেলেছো। কিছু তো বাকি রাখলে না।

হিরণ। মন্নু বেগের সঙ্গে তুমিও শিবির পরিত্যাগ করে চলে যাও।

অমর। রাত শেষ হলেই দিলীপ তোমাকে তন্ন তন্ন করে সমস্ত মারাঠা শিবির খুঁজে বেড়াবে। দেরি করোনা, চলে যাও।

হিরণ। আর তুমি?

অমর। আমার জন্য চিন্তা করো না। ইব্রাহিম কার্দি যাকে বোন বলে ডেকেছে, অন্তত এই যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মারাঠা শিবিরে কেউ তাকে অপমান করতে সাহস করবে না।

হিরণ। এ তো হল নিরাপদে থাকার কথা, কিন্তু তোমাতে-আমাতে কি এই শেষ দেখা?

হিরণ। দুই শিবিরের মাঝখানে মস্ত বড় প্রান্তর। দু’দিন পর যুদ্ধ যখন শুরু হবে তখন রোজই সেখানে লক্ষ লক্ষ মুসলিম লক্ষ লক্ষ হিন্দুর মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে। মিলবে-লড়বে, মারবে–মরবে। কেবল আমাদের দু’জনেরই আর কখনো দেখা হবে না, এও কি সম্ভব? আর দেরি করো না। আমি ঘণ্টা শুনতে পেয়েছি। জোহরা বেগম হয়তো এক্ষুণি ফিরবে। সব ব্যবস্থা ঠিক করে রেখো।

অমর। আমি আসি হিরণ।

[প্রস্থান]

হিরণ। আতা খাঁ! আতা খাঁ! আতা খাঁ!

[পর্দা নেমে আসে]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *