দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
(স্থান: মুসলিম শিবির কাল: পরের দিন।)
[মঞ্চের একধারে টেবিলের ওপর দাবার ছক পেতে দু’জন খেলোয়াড় তন্ময় হয়ে চাল ভাবছে। প্রায় পুরোপুরি দর্শকদের দিকে মুখ দিয়ে যিনি খেলছেন তাঁর নাম সুজাউদ্দৌলা। অন্যজন মন্নু বেগ, দর্শকদের দিকে পিঠ দিয়ে খেলছেন, কেবল কখনো কখনো পাশ থেকে মুখের আদল দেখা যাবে। তৃতীয় ব্যক্তি নজীবদ্দৌলা পদচারণা করেন, এক–আধবার থেমে খেলা দেখেন। সকলেই পরিপূর্ণ সমরসাজে সজ্জিত।]
নজীব। (একদৃষ্টিতে কতোক্ষণ দুই স্তব্ধ খেলোয়াড়কে দেখে) অসহ্য! এই অর্থহীন প্রতীক্ষা, অসহ্য।
সুজা। কোনো কিছুই নিরর্থক নয়। আক্রমণ করার মধ্যে যদি মস্ত কোনো কারণ থাকতে পারে, তাহলে না করার মধ্যেও নিশ্চয়ই কোনো কারণ লুকিয়ে রয়েছে (মন্নু বেগকে) পিলটা বাগে পেয়েও খেলে না কেন তাই ভাবছি।
নজীব। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা মারাঠা শিবির আক্রমণ করা নিরর্থক মনে করেন। অযোধ্যার লুণ্ঠনকারীদের উচ্ছেদ করার কোনো সার্থকতা অনুভব করেন না। নিষ্ক্রিয় ঘরে বসে বুদ্ধির রকমারি খেলা অভ্যাস করাটাকেই বড় কাজ বলে মনে করেন।
সুজা। করি। (মন্নু বেগকে) তোমার সঙ্গে হুঁশিয়ার হয়ে খেলতে হচ্ছে। তুমি সোজা লোক নও।
নজীব। আমার পক্ষে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত উদাসীন থাকা সম্ভব নয়।
সুজা। কেন?
নজীব। কেন? কারণ, আমি নজীবদ্দৌলা রোহিলা পাঠান। হিন্দু মারাঠা দস্যুরা আমার দেশ লুট করেছে। আমাকে দেশচ্যুত করেছে। আমার কাছ থেকে দিল্লীর সিংহাসন কেড়ে নিয়ে গেছে। পেশবা আর তার ঘৃণ্য অনুচরদের সমুচিত শিক্ষা না দিয়ে ক্রীড়াকৌতুকে মন সাজাবো না।
সুজা। সাবাস! উত্তম! অতি উত্তম। আমি ধরতে পারিনি যে, তুমি আমার দুর্গের পাহারাদার ঘোড়াটাকে ঘায়েল করবার ফিকিরে ছিলে। সাবাস! (নজীবকে) মারাঠা শক্তির সঙ্গে লড়াই করবার জন্যই যমুনা তীরে দেড়মাস ধরে প্রহর গুণছি। কিন্তু তাই বলে এক্ষুণি যখন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ছি না তখন আর বিস্তর ক্রীড়াকৌতুকে মন দিতে দোষ কী?
নজীব। অল্প থেকে বিস্তর হয়, দোষ সেই জন্য। একদিন নয়। প্রতীক্ষা করছি দেড়মাস ধরে। প্রতীক্ষা করতে করতে এখন এমন হয়েছে যে, ভুলে যেতে বসেছি যে, শত্রকে আক্রমণ করবার জন্য একত্রিত হয়েছিলাম।
সুজা। এবার তোমার পিলটাকে কাটবোই। ছাড়বো না। (নজীবকে) কেবল আক্রমণের দ্বারা জয়পরাজয় সুসিদ্ধ হয়, বিশ্বাস করি না। মন্নু বেগ, কী বলো?
মন্নু। জানি না।
নজীব। জানো না মানে কী? বিউলীর প্রান্তরে তোমার যে মূর্তি দেখেছি, তার সঙ্গে তোমার আজকের এই উক্তির কোনো সঙ্গতি নেই। তোমার চোখে চেতনায় সর্বাঙ্গে আজ যে শৈথিল্য, যে ঔদাসীন্য, যে নির্বিকারত্ব প্রত্যক্ষ করছি তা সত্যি অপ্রত্যাশিত। গতকাল বিকেলেও তুমি অন্য মানুষ ছিলে।
সুজা। নবাব নজীবদ্দৌলা, মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়। বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে–অকারণে বদলায়। সকালে—বিকেলে বদলায়। এতে অবাক হবো কেন? (মন্নু বেগকে) তোমার দান চালো।
মন্নু। এবার ছাড়বো না। আপনার পিলটা নিলাম।
সুজা। কী সাংঘাতিক কথা! এত ঘন ঘন গোটা খেলার নক্সা পাল্টাচ্ছে যে তোমার তল পাওয়া ভার।
নজীব। নবাব সুজাউদ্দৌলার বর্তমান তন্ময়তা দেখে মনে হচ্ছে তাঁর বিচারে রণক্ষেত্র আর দাবার ছক দুই–ই সমান।
সুজা। নবাব নজীবদ্দৌলার এ সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য।
নজীব। কেন?
সুজা। রণে জয়ী হওয়ার চেয়ে দাবায় মাৎ করা দুরূহতর। মন্নু বেগকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
মন্নু। কোনো সন্দেহ নেই।
নজীব। গতকালও তোমার কাছ থেকে বিপরীত কথা শুনেছি।
মন্নু। জ্বী।
সুজা। নবাব নজীবদ্দৌলা বলতে চাইছেন যে, গতকাল পর্যন্ত তুমি মারাঠাদের নিরতিশয় পাষণ্ড বলে জানতে। গতকালও তুমি চাইছিলে তাদের রক্ত দিয়ে হোলি খেলতে, পদতলে তাদের অস্থি চূর্ণ করতে, মাটির নিচে তাদের শব পুঁতে ফেলতে অথচ দেখা যাচ্ছে যে, আজ সকাল থেকে তোমার চিত্ত কোনো অজ্ঞাত কারণে বিকল হয়েছে। পরিচিত অভ্যস্ত পথ বর্জন করে নানা অভাবিত আচরণে উদ্যোগী। (দাবার ছকটা ভালো করে দেখে) তোমার কোনো চালই আজ ধরতে পারছি না। বেড়ে খেলছো। কী লক্ষ্য করে এগুচ্ছো, কোন্ মতলবে ফাঁদ পেতেছো, কিছুরই কূলকিনারা করতে পারছি না।
মন্নু। আমাকে মাফ করবেন। খেলার ঝোঁকে আপনার সব কথা শুনতে পাইনি।
নজীব। এ যুক্তিটা তবু মন্দের ভালো।
সুজা। তোমার নৌকা আটক করেছি, মন্নু বেগ! দেখো কোনো মতে বাঁচাতে পারো কি–না?
মন্নু। কী হবে বাঁচয়ে। তার চেয়ে মরণপণ লড়াই ভালো। আপনার বাকি পিলটাও তুলে নিলাম।
সুজা। মরলে! একেবারে নেহাত মরলে! শা–আ–হ্!
মন্নু। শাহ্?
সুজা। শাহ্। একেবারে আষ্টে–পিষ্ঠে বাঁধা পড়েছো শাহ্। মুক্তির কোনো পথ খোলা নেই। শাহ হেরে গেলে! মন্নু বেগ এত করেও পারলে না, হেরে গেলে শেষটায়।
[মাথা নিচু করে মন্নু বেগ দেখে ও ভাবে]
নজীব। বেশি ভাবনার আমি ধার ধারি না। আমি জানি শত্রু কে। জানি শত্রু কোথায়। জানি তাকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার উপায়। আপনি আমাকে সাহায্য করুন।
সুজা। শত্রু কে, শত্রু কোথায়, কে জানে?
নজীব। ভারতে মুসলমানদের শত্রু মহারাষ্ট্র শক্তি। শত্রু পেশবা। পানিপথ পেরিয়ে আর এক পা–ও অগ্রসর হবে এমন ক্ষমতা তাদের নেই।
মন্নু। মেনে নিলাম। হেরে গেছি।
[দাবার ছক ছেড়ে মঞ্চের পেছনে চলে যায়। সেখানে সাজিয়ে রাখা অস্ত্রশস্ত্র নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করবে।]
নজীব। আঘাত করার এই হলো উপযুক্ত সময়। যমুনার পার ধরে কাতার ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের সৈন্যবাহিনী। ঐ ব্যূহ ভেদ করে শত্রুসেনা কোনোদিন যমুনার পানি স্পর্শ করতে পারবে না।
মন্নু। (চিৎকার করে) আমরা অপেক্ষা করছি কেন?
নজীব। নিজেকে জিজ্ঞেস করো। জবাব পাবে। নবাব সুজাউদ্দৌলাকে জিজ্ঞেস করো। অবশ্যই জবাব পাবে।
মন্নু। আমি জানি না।
সুজা। আমি জানি না। যা জানার সব আহমদ শাহ্ আবদালী জানেন। এই মহাযুদ্ধের আয়োজনে যেদিন থেকে অংশ নিতে শুরু করেছি সেদিন থেকেই আবদালীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছি।
নজীব। সে কি মুসলিম শক্তিকে হীনবল করে তুলবার জন্যে, না তার বাহুতে নতুন শক্তি সঞ্চার করবেন বলে?
সুজা। আত্মশক্তি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে।
নজীব। সেজন্য সচেষ্ট নন কেন? তাকে সফল করবার জন্য একটু উৎসাহ–একটু উদ্যম, একটু আগ্রহ প্রকাশ করুন।
সুজা। প্রধান সেনাপতি নির্দেশ পেলেই করবো।
নজীব। সে নির্দেশকে ত্বরান্বিত করবার জন্যও আপনার কিছু দায়িত্ব রয়েছে।
সুজা। যেমন?
নজীব। আমি রোহিলাখণ্ডের, আপনি অযোধ্যার প্রতিনিধি। আমদ শাহ্ আবদালী হিন্দুস্থানের কেউ নন, তিতি কাবুলেশ্বর। আগামীদিনে হিন্দুস্থানের সমগ্র মুসলমানকে পরিচালনার ভার গ্রহণ করতে হবে আমাকে বা আপনাকে-আবদালীকে নয়।
সুজা। আগামী দিনের কথা কে বলতে পারে। একজন মানুষের জীবনেও কোনো দু’টো মুহূর্ত এক রকম নয়। এই মুহূর্তের নিশ্চিত আশ্বাস পরের মুহূর্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। যা একেবারে চোখের সামনে অবধারিতরূপে বিদ্যমান, সেটা পর্যন্ত সকল সময় দেখতে পাই না। যা দেখি তা হয়তো ভুল দেখি। কতো সময় মনে হয় ঠিকই দেখছি, কিন্তু আদৌ দেখতে পাইনি। (মন্নু বেগকে) তোমার চোখের সামনে সব গুঁটি সাজানো ছিল। সব দেখে শুনে, নিশ্চিন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে আবার দ্বিতীয় পিলটাও গ্রাস করলে। সঙ্গে সঙ্গে তোমার নিজের বাদশার মরণও ঘনিয়ে এলো।
মন্নু। অন্ধ। একেবারে অন্ধের মতো খেলেছি। খেলে হেরে গেছি।
নজীব। আমি অন্ধ নই বরং পরাজয় বরণ করেও আমি স্বস্তি পাই না। নিজের নিয়তিকে আমি নিজে হাতে গড়ে নেওয়ার পক্ষপাতী। আমার নিজের এবং সমগ্র হিন্দুস্থানের মুসলমানদের গ্লানি মোচন না করে আমি ক্ষান্ত হবো না। যে আঘাত ওরা আমাকে হেনেছে, ওদেরকে আমি তা শতগুণ ভয়ঙ্কর তেজে ফেরত দিতে চাই। আমদ শাহ্ দুররানীকে এই জন্য সালাম করি যে, তিনিই হতভাগা বহু–বিভক্ত মুসলিম ভারতকে ঐক্য এবং শৃঙ্খলা দান করেছেন। তাঁর নেতৃত্বের প্রভাব ভিন্ন হয়তো আমি আপনার পাশে, আপনি আমার পাশে এসে এক কাতারে দাঁড়িয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে পারতাম না।
সুজা। আপনার পাশে আসন লাভ করাটাকে আমি চিরদিনই সৌভাগ্যের বিষয় বিবেচনা করেছি। আমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্ব স্বীকার করেছি এইজন্য যে, তাঁর মতো রণকুশলী বীর এদেশে নেই। যেমন সাহসী তেমনি বিচক্ষণ। পক্ষের বিপক্ষের প্রতিটি সৈনিকের প্রতি মুহূর্তের নড়া–চড়া সর্বক্ষণ এত জাজ্জ্বল্যমানরূপে প্রত্যক্ষ করেন যে, মনে হয় যেন গোটা যুদ্ধটাই তাঁর একক রচনা। লড়াই করা স্থির করলে এমন লোকের হুকুম মেনে চলাই শ্রেয়ঃ।
নজীব। কিন্তু শ্রেষ্ঠ সেনাপতিও বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন, যদি তাঁর সাক্ষাৎ সাহায্যকারীরা ফলাফল সম্পর্কে উদাসীন হয়ে ওঠে।
সুজা। তৎপরতা প্রকাশ করবার জন্য কী করা উচিত?
মন্নু। আমাদের উচিত অবিলম্বে, এক্ষুণি, এই মুহূর্তে, মারাঠা শিবির আক্রমণ করা।
সুজা। এই প্রকাশ্য দিবালোকে? আদ শাহ্ আবদালীর হুকুম ছাড়া?
নজীব সেই হুকুম যেন আসে তার জন্য তদ্বীর করতে হবে।
সুজা। আমাকে?
নজীব। হ্যাঁ, আপনাকেও। আপনার বীরত্ব ও ধীরতার ওপর আমদ শাহ্ আবদালীর অপরিসীম শ্রদ্ধা।
সুজা। সে তাঁর মেহেরবানি।
নজীব। আমরা আজ তাঁর সঙ্গে এই কক্ষে মিলিত হবার আয়োজন করেছি।
সুজা। উদ্দেশ্য?
নজীব। তাঁকে আমরা সম্মিলিতভাবে জানাতে চাই যে, আমাদের মতে আর একদিনও বিলম্ব করা উচিত নয়। সম্ভব হলে আজ রাতেই আক্রমণ শুরু করা উচিত। আমাদের প্রার্থনা যে, আপনিও যেন আমাদের এই অভিপ্রায়কে অনুমোদন করেন।
সুজা। অত্যাচারী, লুন্ঠনকারী, উচ্ছৃঙ্খল মারাঠা বাহিনীকে আমিও ভালো রকম শিক্ষা দিতে চাই। বছরের পর বছর একটা উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুণেছি। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই ঠিক আজ রাতেই সে সুযোগ আমাদের জন্য প্রশস্ত হয়ে দেখা দেবে, এ সংবাদ আপনি কোত্থেকে পেলেন তা আমাকে এখনও জানান নি।
নজীব। আমরা জেনেছি। ঠিক জেনেছি।
সুজা। কী করে?
নজীব। মারাঠা শিবির তালাশ করে খবর এনেছি।
সুজা। কবে?
নজীব। গতরাতে।
সুজা। গতরাতে?
নজীব। গত রাতেও মারাঠা শিবিরে আমাদের লোক গিয়েছে।
সুজা। কে?
নজীব। সে আপনার চর নয়।
সুজা। গতরাতে আমি কোনো চর পাঠাইনি। আর, চরের কথায় বিশ্বাস কী! ঘরে থেকে বলে দূরে গিয়েছিলাম। না গিয়ে বলে ঘুরে এলাম। দিনকে বলে রাত। আলোকে বলে অন্ধকার।
নজীব। এ লোক সে রকম নয়।
সুজা। কে?
নজীব। আমাদের মধ্যেই একজন।
সুজা। নিজের কথা জানি। এ শিবির ত্যাগ করে গতরাতে আমি অন্য কোথাও যাইনি। নবাব নজীবদ্দৌলা কি গতরাতে মারাঠা শিবিরে বেড়াতে গিয়েছিলেন?
নজীব। সে সুযোগ পাইনি।
সুজা। তাহলে কে? মন্নু বেগ?
মন্নু। আমি!
সুজা। মারাঠা শিবিরে গিয়েছিলে?
মন্নু। আমি?
সুজা। তাহলে, কে, কে গিয়েছিলো?
[মন্নু বেগের পিছনে থেকে বেরিয়ে আসে অমর ওরফে আতা খাঁ।]
আতা খাঁ। জ্বি আমি। আমি গিয়েছিলাম
সুজা। তুমি!
নজীব। তুমি আবার কোত্থেকে এলে?
মন্নু। এখানে এসেছো কতক্ষণ হলো?
আতা খাঁ। তা কিছুক্ষণ হবে।
নজীব। কেন এসেছো?
আতা খাঁ। একটা সংবাদ ছিলো।
সুজা। তুমি কে?
আতা খাঁ। জ্বি। চর। আমি গুপ্তচর।
সুজা। গতরাতে কোথায় ছিলে?
আতা খাঁ। মারাঠা শিবিরে।
সুজা। তার আগের রাতে কোথায় ছিলে?
আতা খাঁ। আমাদের শিবিরে।
সুজা। তার আগের রাতে কোথায় ছিলে?
আতা খাঁ। মারাঠা শিবিরে।
সুজা। তুমি কি আমাদের শিবির থেকে মারাঠা শিবিরে যাও, না মারাঠা শিবির থেকে আমাদের শিবিরে আসো, তোমার গমনাগমন বিচার করে তো বোঝবার যো নেই। তুমি কাদের গুপ্তচর?
আতা খাঁ। জ্বি!
সুজা। সে সব তল্লাশ চুলোয় যাক। তুমি কী সংবাদ এনেছো সেইটি আরেকবার সংক্ষেপে বলো।
আতা খাঁ। মারাঠা শিবির থেকে গতরাতে যে সংবাদ এনেছি সেই খবর?
সুজা। আরো অন্য খবর আছে কি?
আতা খাঁ। জ্বি আছে।
সুজা। আগে গতরাতেরটা বলো। পরে, পরেরটা শোনা যাবে।
আতা খাঁ। ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। বুঝতে পেরেছে যে, একটা চূড়ান্ত লড়াই ছাড়া ওদের নিস্তার নেই। রসদের অভাব, যোগাযোগের অভাব, লোকজনের অভাব। বুঝতে পেরেছে যে, চুপচাপ বসে থেকে ওরা দিন দিন আরো হতবল হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ওরাই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দু’চার দিনের মধ্যেই হয়তো ওদের কামান গর্জে উঠবে। কে কোন সৈন্যবাহিনীকে কোন্ এলাকায় আমাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করবে তা পর্যন্ত স্থির হয়ে গেছে।
নজীব। তোমার দ্বিতীয় সংবাদটা বলো।
আতা খাঁ। মানে, আমি খবর দিতে এসেছিলাম। তা এত দেরি হয়ে গেল যে এখন সেটা দেওয়ার হয়তো কোনো সার্থকতা নেই। বাদশাহ্ আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য এক্ষুণি এই ঘরে আসবেন।
মন্নু। কে? কে আসবেন এখানে?
আতা খাঁ। এসে পড়েছেন। সসাগরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর, মর্ত্যভূমির স্বর্গর্খও কাবুলের অধিপতি, ভারতে মুসলিম রাজশক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার অগ্রদূত বাদশাহ্ আহ্মদ শাহ্ আবদালী দুররানী।
[সবাই সসম্ভ্রমে মঞ্চের একপাশে কাতার দিয়ে দাঁড়ায়। আবদালী প্রবেশ করেন।]
আবদালী। আল্লাহ আপনাদের আয়ু দীর্ঘ করুক, যুদ্ধে জয়ী করুক, জীবনে সুখী করুক।
মন্নু। আপনি রণে অপরাজেয়, দানে মুক্তহস্ত, দোয়ায় উদার!
নজীব। আপনার শুভেচ্ছা যেন আমাদের গাফিলতিতে বিফলে না যায় তার জন্য আমরা হুঁশিয়ার থাকবো।
সুজা। বাদশাহর শুভেচ্ছা, বান্দার চেষ্টা আর আল্লাহ্র মেহেরবানি এই তিন এক হলে কী–না হয়? না হলে বুঝতে হবে তা হওয়ার নয়। বাদশার দোয়ার জন্য বাদশাহকে ধন্যবাদ।
আবদালী। মনে মনে স্থির করেছি যে, আর আমরা প্রতীক্ষা করবো না। এবার আক্রমণ শুরু করবো। প্রবল ভয়ঙ্কর প্রচণ্ড আক্রমণ। মায়ামমতাশূন্য কঠিন হিংস্র আঘাত হানবো। সমগ্র সৈন্যবাহিনীকে চূড়ান্ত নির্দেশ দান করবার আগে আমি আপনাদের মতামত একবার জেনে নিতে চাই।
মন্নু। আমাকে জিজ্ঞেস করা বাদশার অপরিসীম বদান্যতা বা রহস্য। প্রিয়তার আর একটা প্রকাশ মাত্র। আমাদের কোন নতুন বক্তব্য নেই। রাজনীতির জটিলতা সম্পর্কে আমি অজ্ঞ। তবে এটুকু জানি যে, যতোদিন মারাঠা শক্তির দম্ভ ধূলিসাৎ না হবে, ততোদিন ভারতের মুসলমানগণ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। তারা নিগৃহীত হবে, নিপীড়িত হবে, নিশ্চিহ্ন হবে। ইসলামের জ্যোতি এদেশে নিভে যাবে। আমি অস্ত্রধারী সৈনিক, আক্রমণ ভিন্ন অন্য ভাষা আমার কাছে দুর্বোধ্য। আমি বাদশার সঙ্গে একমত।
আবদালী। সাবাস! সাবাস! মন্নু বেগ। তোমার তেজ, তোমার তারুণ্য, তোমার শক্তি পানিপথে আমাকে পদে পদে নতুন অনুপ্রেরণা যোগাবে।
মন্নু। আমাকে আর শর্মিন্দা করবেন না।
নজীব। আপনার হুকুমের জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। শত্রুসেনা নিধনের জন্য সকল সৈনিক অধীর। নানা সংবাদ বিচার করে আমাদেরও মনে হয়েছে আক্রমণের জন্য এইটেই সর্বোৎকৃষ্ট মুহূর্ত। আপনার নির্দেশসহ পূর্ণ পরিকল্পনা জানতে পারলে আমরা আজ রাতেই–একাধিক বাহিনীকে নিয়ে অতর্কিতে মারাঠা শিবির আক্রমণ করতে পারি।
আবদালী। নবাব সুজাউদ্দৌলাও কি আমাকে এই আশ্বাস দেন?
সুজা। সেনাপতি, সহ–সেনাপতি, অশ্বারোহী, পদাতিক—জয়—পরাজয় কারো ইচ্ছাধীন নয়। তবে রণনীতির নিয়মকানুনে আপনি যতো পারদর্শী ও বিচক্ষণ আমি ততোটা নই। আমি অবশ্যই আপনার সিদ্ধান্তকে শিরোধার্য বলে মানি এবং রণক্ষেত্রে সে নির্দেশ শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও পালন করে যাবো।
আবদালী। শেষ সংবাদ অনুযায়ী ওরাও আক্রমণের তোড়জোড় করছে। আমাদের ব্যুহ ভেদ করবার জন্য এক বিরাটকায় ত্রিশূল বাহিনী অন্ধকারে সরীসৃপের মতো ধীরে ধীরে বাহু বিস্তার করে এগুতে শুরু করেছে। অতর্কিতে হানা দাও তাদের ডেরায়। আঘাত করো। সরীসৃপ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলো।
নজীব। বাজুক রণভেরী। জেগে উঠুক সবাই। আজ মুসলিম বাহিনীর গতিরোধ করে এমন শক্তি কার?
আবদালী। আজ রাত বিশ্রামের এবং পরামর্শের। কাল রাত আমরা ঝাঁপ দেবো। অন্ধকারে। প্রবল বেগে। কিন্তু সম্পূর্ণ শৃঙ্খলার সঙ্গে। আজকে শেষরাতে আমরা আর একবার এই ঘরে মিলিত হবো। কারো ঘুমের বিশেষ প্রয়োজন হলে নিকটেই শয্যা গ্রহণ করবেন।
মন্নু। আজ রাতে ঘুমুবে কে?
নজীব। আমি একবার আমার সৈন্যবাহিনীর তদারকে বেরুবো।
সুজা। কত রাত অকারণে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি আর আজ তো তবু মহৎ কর্মের আহ্বান এসেছে। নিশ্চিয়ই ঘুম আসবে না।
আবদালী। যতোটুকু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হয় মারাঠাদের ঐ ত্রিশূলবাহিনী পরিচালনার ভার নিয়েছে রঘুনাথ রাও, সদাশিব রাও এবং ইব্রাহিম কার্দি। ত্রিশূলের তিন শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করে এরা সমগ্র রণক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করবে। শৌর্যেবীর্যে কৌশলে এরা কেউ অবহেলা করবার মতো নয়।
নজীব। সে ভয়ে আমরা আতঙ্কিত নই।
আবদালী। আমাদের অগ্রগতির যে পরিকল্পনা আমি রচনা করেছি তা ঐ শত্রু আক্রমণ রীতির বিপরীত প্রতিকৃতি মাত্র। আপনারা তিনজন ত্রিফলক বর্ণার মতো শত্রুসৈন্যের শৃঙ্খলা ছিন্নভিন্ন করে সম্মুখে এগিয়ে যাবেন। আপনি, নজীবদ্দৌলা, আপনার দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে বেষ্টনী বিস্তার করবেন দক্ষিণ প্রান্ত থেকে। তুমি, মন্নু বেগ, ওদের আচ্ছন্ন করে ফেলবে উত্তর দিক থেকে। আর আপনি, সুজাউদ্দৌলা, মধ্যভাগে গজারোহী ও পদাতিক দলের অভেদ্য সচল দুর্গ নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে যাবেন একেবারে সরাসরি ওদের বক্ষ ভেদ করে।
নজীব। দক্ষিণ প্রান্তে আমার মুখোমুখি যেন ইব্রাহিম কার্দি থাকেন, এই কামনা করি।
মন্নু। কে? উত্তর প্রান্তে মারাঠা বাহিনীর নেতৃত্ব করবেন কে?
সুজা। ইব্রাহিম কার্দি, রঘুনাথ রাও, সদাশিব রাও যেই হোক, কিছু এসে যায় না। সবাই সমান বস্তু।
আবদালী। শেষরাতে আবার বিস্তৃত আলোচনা হবে। ওদের ত্রিশূল বাহিনীর কোন বিন্দুতে কে অবস্থিত থাকবেন, সে সংবাদ পুরোপুরি পাইনি। তবে নবাব সুজাউদ্দৌলা যেমন বললেন, আমিও তেমনি বলি, যেই–ই হোন তাঁর বাহিনী যেন নিশ্চিহ্ন হয়, তিনি নিজে যেন জীবিত রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে না পারেন! খোদা হাফেজ!
[প্রস্থান]
নজীব। (আতা খাঁকে) তুমি জানো মারাঠা শিবির থেকে কোন্ সেনাপতি কোন্ এলাকার ভার গ্রহণ করবেন। তুমি নিশ্চিয়ই জানো ত্রিশূল বাহিনীর কোন সন্ধিস্থলে ইব্রাহিম কার্দি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আতা খাঁ। আমি, দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে কে অগ্রসর হবেন, আমি এখনও ঠিক স্পষ্ট উদ্ধার করতে পারিনি।
মন্নু। বঞ্চনা ছাড়ো। তোমার সঙ্গে কারুকার্য করে নানা ফিকিরের কথা বলার অবসর নেই। উত্তর প্রান্তে কে থাকবেন?
আতা খাঁ। উত্তর প্রান্তে, উত্তর প্রান্তে? মানে সে ঠিক এখনও বোধ হয় স্থিরীকৃত হয়নি।
সুজা। উত্তর–দক্ষিণ সম্পর্কেই যখন তোমার কোন ধারণা নেই তখন তোমাকে কোনো প্রশ্ন করা অর্থহীন।
আতা খাঁ। জ্বি।
সুজা। তুমি যেতে পারো। হয়তো এই শেষ রজনীতে তোমাকেও অনেক কাজ সেরে নিতে হবে। সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পড়ো।
আতা খাঁ। জ্বি, আপনার মেহেরবানি। খোদা হাফেজ।
[পর্দা নামবে]
দ্বিতীয় দৃশ্য
[জরিনা সেতার কোলে নিয়ে রঙ্গমঞ্চের একপাশে বসে আছে। বিষণ্ণ উদাসীন। নজীব সৈনিকের সংক্ষিপ্ত ঘুম সেরে সদ্য উঠেছে, পোশাক সম্পূর্ণ অবিন্যস্ত। কথোপকথনের মাঝে মাঝে পোশাক ঠিক করে নিচ্ছে।]
নজীব। একী, তুমি শুতে যাওনি?
জরিনা। না।
নজীব। রাত কত হলো।
জরিনা। সবে শুরু। এখনো সাঁঝের তারা নেভেনি। অযথা ব্যস্ত হচ্ছেন।
নজীব। বাইরে কি গাঢ় অন্ধকার!
জরিনা। নাই বা বেরুলেন।
নজীব। সে হয় না।
জরিনা। কেন?
নজীব। তুমি বরাবরের মতোই অবুঝ! আর কি ফেরবার জো আছে, জরিনা? ঘরে বসে থাকবো কী করে? আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি।
জরিনা। যুদ্ধ শুরু হবে কাল রাতে। আপনি আজ বেরুচ্ছেন কেন?
নজীব। আবদালীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।
জরিনা। সে তো শেষ রাতে। আপনি এখন বেরুচ্ছেন কেন?
নজীব। আমার নিজস্ব বাহিনীর একটু তদারকি করা দরকার।
জরিনা। তারা ঘুমুচ্ছে ঘুমাক। কাল থেকে ঘুমের পালা কখন আসবে কে জানে। আজ ভালো করে ঘুমিয়ে নিতে দিন।
নজীব। এরা জাত সৈনিক। সহজে জেগে উঠে সহজে ঘুমিয়ে পড়ে। একবার দেখে আসি।
জরিনা। অন্য কেউ যাক। আপনি আমার তদারক করুন। আমাকে জাগিয়ে রাখুন। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে যান। আমি তো জাত সৈনিক নই। আমার জেগে থাকতে কষ্ট হয়। ঘুমিয়ে পড়তে আরো কষ্ট হয়।
নজীব। তুমি নিজে চেষ্টা না করলে আমি তোমাকে সাহায্য করবো কী করে?
জরিনা। আমার উভয় দিকে বিপদ। আপনি এত অল্প সময় ঘরে থাকেন যে, কখন চলে যান এ ভয়ে চোখের পাতা এক করতে পারি না। যখন চলে যান তখন সকল ঘুম কেড়ে নিয়ে চলে যান।
নজীব। কী করতে বলো?
জরিনা। আমার কাছে থাকুন। আমার সামনে ঘুমোন। আমি বসে বসে দেখি।
নজীব। আর বাইরে যে কাজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে তার ব্যবস্থা করবে কে?
জরিনা। অন্য কেউ যাবে।
নজীব। আমি না গেলে নয়।
জরিনা। এতবড় যুদ্ধ। লাখ লাখ লোক সেখানে শরীর উজাড় করে রক্ত ঢেলে দেবে। আপনি না গেলেও দেবে।
নজীব। সে জন্যে আমি যাবো না? এ তোমার অদ্ভুত যুক্তি!
জরিনা। অদ্ভুত কেন হবে! আপনি যুদ্ধে জয়ী হতে চান। আপনি অপেক্ষা করুন। আমদ শাহ্ আবদালী সে জয়ের মুকুট আপনার মাথায় নিজ হাতে এসে পরিয়ে দিয়ে যাবেন। এ যুদ্ধের পরিকল্পনা তাঁর, নিয়ন্ত্রণাধিকার তাঁর, সাফল্যে তাঁর গর্ব সর্বাধিক, পরাজয়ে তাঁর গ্লানি সবচেয়ে মর্মান্তিক। জয়লাভের উদ্যোগে তাঁকে প্রধান হতে দিন। আপনি আমাকে জয় করুন, আমাকে অধিকার করুন।
নজীব। অনিদ্রায় তোমার স্নায়ু বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তোমার কামনা. তোমার চিন্তা, তোমার ভাষা সব অসুস্থ বক্রপথে চালিত হয়ে তোমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমাকেও আচ্ছন্ন করতে চাইছে। রাত আরো গভীর হবার আগেই বের হয়ে পড়তে চাই।
জরিনা। কোন্ মহৎকর্ম সাধনের জন্যে?
নজীব। যদি সে সত্য এখনও তোমার কাছে স্পষ্ট না হয়ে থাকে তবে আবার বলছি। রোহিলাখণ্ডের লুণ্ডনকারী মারাঠাদের স্বহস্তে কণ্ঠরোধ করে হত্যা করতে চাই। একটি একটি করে উৎপাটিত করে ভারতের বুক থেকে মারাঠাদের নাম মুছে ফেলতে চাই।
জরিনা। শুনেছি আহমদ শাহ্ আবদালীর রোষ আরো প্রচণ্ড–আরো বহ্নিময়। আর এও শুনেছি একবার যে কোনো রকমে হোক মারাঠাদের পদতলে পিষ্ঠ করতে পারলেই হয়! তাহলেই তাঁর চিত্তদাহ নিভবে। সেই আগুন নেভাতে গিয়ে মারাঠাদের সঙ্গে সঙ্গে যদি রোহিলাখণ্ড কি অযোধ্য, দিল্লী কি আগ্রা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় যাক। তাতে তিনি বা তাঁর সৈন্যবাহিনী বিন্দুমাত্র বিচলিত হবেন না। আন্দোৎসব করতে করতে কাবুল ফিরে যাবেন।
নজীব। এসব কথা তোমাকে কে শিখিয়েছে!
জরিনা। সত্য কি মিথ্যা আগে তাই বলুন।
নজীব। এসব কথা যে বলেছে সে খুব পাকা লোক। বুঝতে পেরেছিলো যে, একটি ব্যাকুল নারীহৃদয় তার ব্যক্তিগত ধ্যান–ধারণার গণ্ডিবদ্ধ তীব্রতা নিয়ে কিছুই অবিশ্বাস করবে না। অন্য কারো সামনে এসব কথা বলতে সাহস করো না। কে বলেছে?
জরিনা। আপনার আবদালীর মুসলিম শিবিরের সকলের বিশ্বাসভাজন সংবাদদাতা আতা খাঁ।
নজীব। আতা খাঁ? আতা খাঁ এখানে এসেও হানা দেয়? এখন সন্দেহ হচ্ছে নবাব সুজাউদ্দৌলা যখন প্রশ্ন করেছিলেন, আতা খাঁ, তুমি কার গুপ্তচর, সে প্রশ্নের গুরুত্ব অবহেলা করে ভুল করেছি। তখন তার একটা মীমাংসা করে নেয়া উচিত ছিলো।
জরিনা। আপনি অন্ধ। চরিতার্থতা লাভের একটা অলীক মোহে মত্ত হয়ে আপনি আপনার পৌরুষ, আপনার সাহস, আপনার শোভা, আপনার শক্তি, আপনার প্রাণ মাঠে–প্রান্তরে ছড়িয়ে ফেলে দিতে উদ্যত হয়েছেন। সেখানে শুধু লাশ, শুধু রক্ত। আপনার দামের কদর সেখানে কে করবে? আমি উষ্ণ, আমি জীবন্ত। কেন আমাকে ত্যাগ করবেন? আমাকে দান করুন। প্রতিকণা ভালোবাসা শতগুণ প্রাণবন্ত করে ফিরিয়ে দেবো। যুদ্ধ পড়ে থাক।
নজীব। আমি হয়তো সত্যি অন্ধ। কিন্তু তুমি আমার চেয়েও অন্ধ। এত অন্ধ যে তোমার চরাচর বিলুপ্তকারী ভালোবাসার প্রবলতায় তুমি যে কখন আমার সমগ্র জীবনটাকেও একটা ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আটক করে রাখতে চাইছো তা তুমি নিজেও জানো না। যদি জানতে তাহলে শিউরে উঠতে। আমার চেহারা চিনতে পারতে না। নবাব নজীবদ্দৌলার যে বিরাট প্রকাণ্ড মূর্তি তোমার ভালোবাসার স্পর্শে আরো বিস্তৃত স্ফীতকায় হয়ে ওঠে সেটাই কুঁকড়ে কুঁকড়ে এত নগণ্য বিবর্ণ হয়ে যেতো যে, তখন তুমি তাকে ছুঁতে চাইতে না।
জরিনা। আপনার যে বিস্তার ও দীপ্তি আমাকে অতিক্রম করে আপনাকে দূরে টেনে নিয়ে যায় আমি তাকে স্বীকার করি না। মানি না।
নজীব। মারাঠারা একজোট হয়ে মুসলিম রাজ্য আক্রমণ করেছে। মুসলমানদের পদানত করে তারা চায় গোটা হিন্দুস্থান একা শাসন করতে। অপমানিত ও লাঞ্চিত ইসলামের মৃতদেহের ওপর ওরা ওড়াতে চায় ত্রিশূল আঁকা রক্ত পাতাকা। আমি যদি এমন দিনে নির্বিকার হয়ে ঘরে বসে থাকি, তুমি রোহিলা রাজপুরীর, রমনীরত্ন তুমি কি আমাকে ঘৃণা করবে না? তুমি আমায় হৃষ্টচিত্তে বিদায় দাও, জরিনা।
জরিনা। আপনি ইসলামের জন্য প্রাণ দিতে চান, কারণ আপনি মহৎ, আপনি উদার, আপনি কর্তব্যপরায়ণ। আমি সামান্য নারী। ইসলামের সঙ্গে নিজের তুলনা করবো এমন দুঃসাহস আমার নেই। আল্লাহ্ আমার গুণাহ্ মাফ করুন। তবু একবার স্মরণ করে দেখুন—একদিন ছিল, যখন সমস্ত বিশ্ব লোপ পেলেও আমি কিছুতেই গৌণ বিবেচিত হতাম না। আমি ছিলাম অদ্বিতীয়। আজ আপনার সিংহাসন, আপনার সাম্রাজ্য, আপনার যশ, আপনার বিশ্বাস, আপনার হিংসা, লোভ, দর্প সব আমাকে অতিক্রম করে দশ দিকে বিক্ষিপ্ত। কিন্তু আপনি নির্দয়, আপনি অসরল, আপনি আত্ম–বঞ্চনাকারী।
নজীব। বিদায়ের পর্বটাকে আর কিছুতেই অমলিন থাকতে দিলে না। হয়তো এতোটা আশা করা অনুচিত হয়েছে। হয়তো নারী মাত্রেই এ দুর্বলতার শিকার। স্নেহকে শৃঙ্খলে পরিণত করে, ভালোবাসাকে মোহে, বন্ধনকে বিকারে। তুমি আমাকে ক্ষমা করো, জরিনা!
জরিনা। আপনাকে নয়, আদালীকে নয়, সুজাউদ্দৌলাকে নয়। কাউকে কোনদিন আমি ক্ষমা করবো না।
নজীব। হায় খোদা! জরিনা! তুমি অসুস্থ! তুমি অপ্রকৃতিস্থ।
জরিনা। আপনারা সব, স–ব আত্মসুখকাতর, সব আত্ম–বঞ্চনাকারী। কে আত্ম–স্বার্থ না খুঁজছে? কাবুল থেকে আদালী ভারতে ছুটে এসেছেন কেন? আপনার হৃত সিংহাসন উদ্ধার করে দেবার জন্য? হিন্দুস্থানে চন্দ্রতারকা খচিত পতাকা তুলে ধরবার জন্য? সে এসেছে তাঁর পিতৃ হৃদয়ের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। তাঁর সন্তান লাহোর অধিপতি তিমুর শাহকে যে মারাঠারা বিতাড়িত করেছে তাদের রক্ত শোষণ করতে চায় আবদালী। আবদালীর সৈন্যবাহিনীর স্বার্থ লুটতরাজ, উৎসব–উল্লাস। ভারত উদ্ধার, ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় চিন্তায় উদ্ভাসিত পোশাকী জৌলুস মাত্র। সুজাউদ্দৌলা উদ্বেগহীন, কারণ কোনো বিষধর সর্প তাকে এখনও পর্যন্ত ছোবল দেয়নি। দিলে সেও পাগল হয়ে উঠতো।
নজীব। হয়তো এ–সবই তোমার নিজের চিন্তার দ্বারা উদ্ভাসিত হয়তো এর পেছনে অন্য কারো শিক্ষা তোমার রক্তাক্ত হৃদয়ের ওপর বিষ ঢেলে দিয়েছে। হয়তো এ কাজ আতা খাঁর। কে জানে? আর দেরি করা সম্ভব নয় জরিনা। আমি চলি।
জরিনা। এক্ষুণি চলে যাবেন?
নজীব। কয়েক ঘন্টা শিবিরের আশপাশ পরীক্ষা করে কাটাবো। সবার খোঁজ–খবর নেবো। তারপর হয়তো রাত অল্প বাকি থাকবে। হয়তো এখানে ফেরার সময় আর পাবো না। প্রধান সেনাপতির সঙ্গে মন্ত্রণায় যোগ দিতে হবে। চলি জরিনা।
জরিনা। আপনাকে রুখবে কেহ্ যে পারতো সে নারী আমি নই। একদিন হয়তো আমি পারতাম। আজ সে ক্ষমতা অন্য কারো।
নজীব। এ কথার অর্থ?
জরিনা। যার সান্নিধ্য লাভ করে আমার মন তার চেতনা শক্তিকে আবিষ্কার করেছে, যার প্রতিকৃতি ধ্যান করে আমার দৃষ্টিশক্তিতে তীব্রতা এসেছে, সেই নবাব নজীবদ্দৌলা আমার চোখকে ফাঁকি দেবেন কী করে?
নজীব। কী বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো।
জরিনা। দেশ নয়, জাতি নয়, যশ নয়—যা আপনাকে এই অন্ধকার রাতে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে অন্য কোনো নারী। অন্য কোন নতুন জ্যোতির্ময়ী রমণী। হয়তো আমার মধ্যে আস্বাদিত পরিচিত রূপের সে সম্পূর্ণ বিপরীত। হয়তো সে কঠিন, প্রখর। আমি যা নই হয়তো সে ঠিক তাই। অসিধৃতা, অশ্বারোহিণী, রণনিপুণা।
নজীব। জরিনা!
জরিনা। আপনার নিদ্রাহীন চোখে, অস্থির পদচারণায়, মুখের কঠিন তৃষাতুর রেখায় রেখায় আমি সে রমণীর ছায়ামূর্তি ভেসে বেড়াতে দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে চিৎকার করে তাকে ডাকি, তার নাম ঘোষণা করি। সবাই তাকে দেখুক। তার ছদ্মবেশ ঘুচে যাক। সবাইকে আঙুল দিয়ে দেখাই যে, সে পতি–বিদ্রোহী, পতি–ত্যাগিনী, পতি–বধে উদ্যোগী।
নজীব। তুমি এখন যে সব কথা বলছো তা কুৎসিত, অতি অলীক এসব গর্হিত কথা কান পেতে শোনাও অপরাধ। যাঁর পুণ্য নামের প্রতি ইঙ্গিত করছো তাঁকে জানলে এ–কথা তুমি উচ্চারণ করতে পারতে না।
জরিনা। আমারও সেই ক্ষোভ রয়ে গেলো। অনেক অনুসন্ধান করেও তার নাগাল পাইনি। কেবল এইটুকু জেনেছি যে, সে এই শিবিরেই থাকে, আর নবাব নজীবদ্দৌলা তার আশ্রয়দাতা, তার ত্রাণকর্তা, তার দুঃখ–মোচনকারী।
নজীব। তুমি যাঁর কথা বলছো তিনি আশ্রয়ের ভিখারী নন। কাজেই আমি তাঁর আশ্রয়দাতা নই। আত্মরক্ষায় তিনি অতিশয় সমর্থ। আমি কী করে তাঁর ত্রাণকর্তা হবো! তাঁর দুঃখ মোচন করা আমার সাধ্যাতীত, নইলে অবশ্যই তাঁর কষ্ট হরণ করে নিতাম। তোমার আর কিছু বলার আছে?
জরিনা। না।
নজীব। আমি তাহলে চলি। আবার কবে তোমাকে দেখতে পাবো। জানি না।
[দু’জন দু’জনকে অপলক চোখে দেখে। নজীব শেষ বারের মতো নিজের যুদ্ধের পোশাক টেনে নেড়ে ঠিক করে নেয়। ধীর দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে যায়। জরিনা নজীবের পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।]
[পর্দা পড়বে]
তৃতীয় দৃশ্য
[মধ্যরাত। উন্মুক্ত প্রান্তর। মন্নু বেগ একদৃষ্টিতে দূরে আঁধার ভেদ করে কুঞ্জরপুর দুর্গ দেখছে। মারাঠা সৈনিকের পোশাক পরা অমররূপী আতা খাঁ এসে পিছনে দাঁড়ায়।]
মন্নু। তুমি আবার যাচ্ছো?
আতা খাঁ। জ্বি।
মন্নু। এখন যাওয়াটা কি নিরাপদ মনে করো?
আতা খাঁ। না।
মন্নু। তাহলে যাচ্ছো কেন?
আতা খাঁ। যেতেই হবে। মারাঠা শিবির নড়তে শুরু করেছে। আলোগুলো দুলে দুলে লাফিয়ে লাফিয়ে অন্ধকারে এদিকে–ওদিকে হারিয়ে যাচ্ছে। একটু ভালো করে খোঁজ নিতে হবে।
মন্নু। যে আলো হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজে বার করবে কী করে?
আতা খাঁ। আমি হয়তো পারবো। আমি অন্ধকারের জীব। অদৃশ্য আলোর হাতছানি আমি ঠিকই দেখতে পাবো।
মন্নু। আমি অন্ধকারে কিছু দেখতে পাই না।
আতা খাঁ। আমি আলো থেকে হঠাৎ অনেক অন্ধকারে এসে পড়েছেন তাই। সময়ে সয়ে যাবে।
মন্নু। সময় বড় কম। মাত্র বাকি রাতটুকু। তারপর সারাদিন নিষ্ক্রিয়তার ভান করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকবো। তারপর যেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে, দীন দীন হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো শত্রু—সেনার মধ্যে। যতো অন্ধকার হয় ততোই ভালো।
আতা খাঁ। হাতে একদম সময় নেই। আমি যাই।
মন্নু। আল্লাহ্ তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন।
আতা খাঁ। কোনক্রমে একবার দেখা পেলে হয়। আজ নির্ঘাত একটা এস্পার কি ওস্পার হয়ে যাবে। যদি কথার অবাধ্য হয় তাহলে হয় নিজের জান ঐখানে রেখে আসবো, না হয় ওর জান খতম করে দেবো।
মন্নু। মনের কথার ভাষা জনে জনে আলাদা। তার পরতে পরতে নানা রকম অর্থ অনর্থ লুকিয়ে থাকে। অন্যের কথা দূরে থাক, যে বলে সে–ই কি সব সময় বুঝতে পারে কী বলছে? তুমি যাও।
আতা খাঁ। বিনা ওজরে সঙ্গে আসে ভালো। নইলে সোজা হাত–পা বেঁধে কাঁধে ফেলে রওনা দেবো। কপালে যদি তাই লেখা থাকে খণ্ডাবে কে? আমার বোঝা আমাকেই বহন করতে হবে।
মন্নু। তার জন্য তাড়াতাড়ি করা দরকার, আতা খাঁ। এখানে আর সময় নষ্ট করা উচিত হচ্ছে না।
আতা খাঁ। ঠিক বলেছেন। তবে মানে এই ভাবছিলাম –। আরেকটু অপেক্ষা করে দেখবো কি–না ভাবছিলাম।
মন্নু। নিতান্ত এলোমেলো কথা বলছো। অপেক্ষা করবে কেন? কার জন্যে অপেক্ষা করবে?
আতা খাঁ। মানে, আমি একাই যাবো?
মন্নু। একা নয়তো দোসর পাবে কোথায়? কে যাবে সঙ্গে?
আতা খাঁ। একসঙ্গে যেতাম। আপদে–বিপদে পরস্পরকে রক্ষা করতে পারতাম। কিছু ঝুঁকি কমতো।
মন্নু। এই পথে কেউ কাউকে রক্ষা করে না। তুমি একা যাও।
আতা খাঁ। আমি পথ চিনি। নিরাপদে পারাপার করতে পারি। ভোর হবার আগেই ফিরবো।
মন্নু। আমি অপারগ। তুমি যাও। এখন ইচ্ছে করলেও আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার পথ রুদ্ধ। মারাঠা শিবিরে প্রবেশের অধিকার হারিয়ে ফেলেছি।
আতা খাঁ। সে আমি বার করে দেবো।
মন্নু। তুমি বিদায় হও।
আতা খাঁ। আমার সঙ্গেই আছে। সেদিন আপনি ভুলে মারাঠা শিবিরে ফেলে এসেছিলেন, পাঞ্জাখানা আমি আসবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
মন্নু। ফেলে দাও। ছিঁড়া ফেলো। পুড়িয়ে ফেলো। তুমি দূর হও; দূর হও। (আতা খাঁ চলে যায়) আল্লাহ্ তোমার কল্যাণ করুন। তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ হোক। আল্লাহ্, বিপদের হাত থেক তুমি সকলকে রক্ষা করো! (আতা খাঁ কী মনে করে ফিরে এসেছে) আবার ফিরে এলে কেন?
আতা খাঁ। পথে নেমে গা’টা কেমন ছমছম করতে লাগলো। আগে এ রকম কখনো হয়নি। পেছনে ফিরে মনে হলো আপনি যেন মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেছেন।
মন্নু। আমার কিছু হয়নি।
আতা খাঁ। আপনি আরো কিছুক্ষণ এদিকে থাকবেন কি?
মন্নু। শেষ রাত পর্যন্ত আছি।
আতা খাঁ। আমিও এই উত্তরাঞ্চলে থাকবো। কতোদূর যেতে পারবো জানি না। যদি বিপদে পড়ি সংকেত পাঠাবো।
মন্নু। যতোক্ষণ আছি লক্ষ রাখবো।
আতা খাঁ। আসি।
মন্নু। খোদা হাফেজ!
[চলে যাবে, মন্নু বেগ এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। দূরে চলে গেলে কপালে হাত ঠেকিয়ে অন্ধকার ভেদ করে দেখতে চেষ্টা করে। নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ান নবাব নজীবদ্দৌলা। মন্নু বেগের দৃষ্টি অনুসরণ করে তিনিও দেখতে চেষ্টা করেন কে যায়, কোথায় যায়।]
নজীব। কে গেলো?
মন্নু। আতা খাঁ।
নজীব। তুমি পাঠিয়েছো?
মন্নু। না।
নজীব। কোথায় গেলো?
মন্নু। যেখানে ও যেতে চেয়েছে।
নজীব। তুমি যেতে চাওনি।
মন্নু। এরকম করে নয়।
নজীব। কী রকম করে যেতে চাও?
মন্নু। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নয়। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আগে শত্রুকে শেষ করবো। তারপর শত্রু–শিবিরে প্রবেশ করবো।
নজীব। শত্রু যদি অবধ্য হয়?
মন্নু। যে অবধ্য সে শত্রু নয়!
নজীব। কোন্টা বেশি সত্য? গত দেড়মাস ধরে নিশাচর পাখির মতো, তোমার মনের চারধারে ডানা ঝটপট করে উড়ে মরছি। এ মুহূর্তের জন্যও একটা নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে স্থির হতে পারিনি। শত্রু–সৈন্যকে আঘাত করবার জন্য যখন উদ্যত অসি হাতে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছো তখন কতোবার তোমার পৌরুষ, তোমার কাঠিন্য, তোমার হিংস্রতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু তার পরই চোখ মেলে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি তুমি ভেতরে ভেতরে কতো শ্রান্ত, কতো অসহায়, কতো অশান্ত।
মন্নু। এত সহজে ধরা পড়ে যাবো ভাবিনি। কী লজ্জা, কী দুঃসহ লজ্জা! আমার মতো সামান্য লোকের বুক চিরে কেউ আড়াল থেকে তার সত্যাসত্য পরীক্ষা করছে, কখনো ভাবিনি।
নজীব। এ–সব কথা কখনো তোমার কাছে প্রকাশ করতে চাইনি আমার কোনো আচরণে তোমার লজ্জা ও গ্লানি বাড়ুক এ আমি কোনো দিন চাইনি। আমার নিজের জীবনের গোপন অভিশাপ এই দুপুর রাতের অন্ধকার প্রান্তরে আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। অতর্কিতে আক্রমণ করে আমার বুদ্ধি—বিবেক সব হরণ করে নিয়েছে। আমার মুখে যে কথা অশোভন, তোমার কানে যে উক্তি অশ্রাব্য বা সর্বকালের জন্য অপ্রকাশ্য ও অনুচ্চারণীয়, সে সব কথাই যেন আজ দুর্বার হয়ে উঠতে চাইছে।
মন্নু। কেন? যা কোনোদিন বলেননি আজ তা কেন বলবেন? উপকার ছাড়া আপনার কাছ থেকে কোনো অপকার পাইনি। আজ কেন তার ব্যতিক্রম হবে?
নজীব। তোমার সব কথা খুলে বলা সম্ভব নয়। এক কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়ে কিছুক্ষণ আগে, আমার চেতনার শান্তি, শৃঙ্খলা, সংযম সব দলে তছনছ করে দিয়ে গেছে। তোমার কাছে ছুটে এসেছি আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে রুদ্ধ করবার আশা নিয়ে। কৃপা করো।
মন্নু। এ আপনার অন্যায় প্রার্থনা! অন্যায়, অসঙ্গত এবং নির্মম। একটুখানি স্থিরতা, একটুখানি দৃঢ়তা, একটুখানি নিশ্চয়তার মোহে উন্মাদের মতো রণক্ষেত্রে বীরত্ব প্রকাশ করেছি। বীরপুরুষের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ফিরেছি। আমার কাছে কাতরতা প্রকাশ করা মানে আমাকে আঘাত করা। আচমকা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়া।
নজীব। আমি অমানুষ নই। কিন্তু ভয় পেয়ে গেছি। কেমন যেন মনে হচ্ছে সময় আর বাকি নেই। শেষ হয়ে গেছে। কী হবে বাণী অব্যক্ত রেখে? মাঝখানে মাত্র কয়েক ঘন্টা স্তব্ধ কালো রাত। তারপরই আকাশ–পাতাল–পৃথিবী তোলপাড় করে ফেটে পড়বে প্রলয়। রণহুঙ্কার, বারুদ বিস্ফোরণ, অগ্নিশিখা আর রক্তস্রোতের লাল আভায় মন্নু বেগ, ইব্রাহিম কার্দি, নবাব নজীবদ্দৌলা কোথায় হারিয়ে যাবে কে জানে!
[এখান থেকে একটা বিপদ সংকেতের শিঙ্গা মাঝে মাঝে শোনা যাবে।]
মন্নু। আমি হারিয়ে যাবো না। আমি নিজেকে জয় করেছি। আজ আমি জয়ী। আপনি যদি সত্যিই আমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হন তবে আমার এই প্রতিষ্ঠা থেকে আপনি আমায় আসনচ্যুত করতে চাইবেন না। আমাকে আমার স্বধর্ম থেকে বিচলিত করে আপনার কী লাভ?
নজীব। তুমি জয়ী। সত্যি জয়ী। তোমাকে শ্রদ্ধা করি। ভালোবাসি। হিংসা করি। ও কিসের সঙ্কেত?
মন্নু। হয়তো আতা খাঁ বিপদাপন্ন। আমি যাই।
নজীব। আমি গেলে অপরাধ হবে?
মন্নু। না।
নজীব। শব্দটা দক্ষিণ প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছে। যদি এখনো এদিকেই থাকে আমি খোঁজ নিয়ে বার করতে পারবো। তুমি এদিকে লক্ষ রাখো।
মন্নু। আপনি কি এদিকে আবার ফিরে আসবেন?
নজীব। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে নয়।
মন্নু। খোদা আপনার মঙ্গল করুন।
[নজীবের প্রস্থান)
[মন্নু বেগ এদিকে–ওদিকে দেখতে চেষ্টা করে। চারদিকে দেখার চেষ্টা করতে করতে মঞ্চে ঢোকে সুজাউদ্দৌলা]
সুজা। কিছু বুঝতে পারলে?
মন্নু। জ্বি।
সুজা। শব্দটা একবার মনে হয় উত্তর দিক থেকে আসছে; আবার মনে হয় দক্ষিণ দিক থেকে আসছে। কিছুতেই জায়গাটা ঠাহর করতে পারছি না। তবে কেউ যে একটা সংকেত পাঠাবার চেষ্টা করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কোন্ পক্ষের লোক, কাকে কী সংবাদ পাঠাচ্ছে, কে জানে?
মন্নু। খুব সম্ভব আতা খাঁ।
সুজা। ওহ্।
মন্নু। আমাকে সংকেত পাঠাতে চেষ্টা করছে হয়তো।
সুজা। ওহ, আমি খামোখা উদ্বিগ্ন হচ্ছিলাম।
মন্নু। উদ্বেগের কারণ হয়তো মিথ্যে নয়। ঐ যে আবার বেজে উঠলো। আমাকে বলে গিয়েছিলো যে, বিপদে পড়লে সংকেত পাঠাবে।
সুজা। তাহলে ত আর কোনো কথাই নেই। বোঝা যাচ্ছে যে, কেউ তোমার সঙ্গে পরামর্শ করে বিপদে পড়েছে। এর মধ্যে আমি নেই।
মন্নু। একটু আগে নবাজ নজীবদ্দৌলা ঐ সংকেতের ধ্বনি অনুসরণ করে ওর খোঁজে বেরিয়ে গেছেন।
সুজা। কোন্ দিকে গেলেন?
মন্নু। দক্ষিণ দিকে।
সুজা। তা উনি যেতে পারেন। ছদ্মবেশধারীদের সম্পর্কে নবাব নজীবদ্দৌলার কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা অপরিসীম।
মন্নু। ছদ্মবেশধারীরা যতো কৌতুকের পাত্র তার চেয়ে বেশি করুণার যোগ্য।
সুজা। কিছুই অসম্ভব নয়। তবে এই যে তোমাদের আতা খাঁ। রোজ কতোবার করে যে পোশাক বদলায় আর শিবির পাল্টায় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমার তো সন্দেহ হয়, কেবল মাত্র মজা করবার জন্যে ও মাঝে মাঝে ভোল বদলায়। ওর একটু শিক্ষা হওয়া মন্দ নয়।
মন্নু। আর আমার?
সুজা। তোমাকে আমি কী বলবো? তোমার ত্রাণকর্তা তুমি নিজে। তুমি তোমার বিবেককে জিজ্ঞেস করো।
মন্নু। আমার মনে আর কোনো সংশয় নেই। আমি মুক্ত। এই ছদ্মবেশ, এই অন্তরাল আমাকে সর্বক্ষণ অপমানের মতো বিঁধছে।
সুজা। নিজেকে বেশি শাস্তি দিও না। মুখোশ না পরে কে? মন উদ্যম করে চলে এমন বীর দুনিয়ায় কয়জন আছে? আমি তুমি কেউ তার ব্যতিক্রম নয়। তবুও তুমি মহৎ এই জন্য যে, তোমার আবরণ মনে হয়, পোশাকে। তোমার ছদ্মবেশ অন্তরে নয়, বহিরঙ্গে। তোমার রূপ, তোমার ভালোবাসা, তোমার জ্বালা কিছুই তার আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে না।
মন্নু। ঐ যে আবার সংকেত বেজে উঠলো।
সুজা। সংকেত কাকে ডাকছে? তোমাকে, না আমাকে?
মন্নু। আপনি যতো সন্দেহ করছেন ততো পরামর্শ আমার সঙ্গে হয়নি।
সুজা। আমি কিছুই সন্দেহ করিনি। কেবল তোমার অনুমতি চাইছিলাম, আমি খোঁজ করবো কিনা।
মন্নু। সে আপনার মেহেরবানি।
সুজা। একটু আগে শব্দটা দক্ষিণ কোণ থেকে আসছিলো। এখন মনে হচ্ছে অনেক উত্তরে সরে এসে ডাকছে। কাকে কেন ডাকছে কে জানে। দেখি খোঁজ নিতে পারি কি–না।
[প্রস্থান]
[মন্নু বেগও উদ্বেগের সঙ্গে অন্য দ্বার দিয়ে বেরিয়ে যায়। উত্তেজিত ও উৎকণ্ঠিত চেহারা নিয়ে ঢোকে মারাঠাবেশী আতা খাঁ। কাউকে না দেখে আবার বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। আতা খাঁ হঠাৎ লক্ষ করে মন্নু বেগ ফের মঞ্চে প্রবেশ করেছে। মন্নু বেগ আতা খাঁকে দেখে চমকে উঠে।]
মন্নু। এ–কী? এরি মধ্যে তুমি ফিরে এসেছো?
আতা খাঁ। না, এখন পর্যন্ত যেতে পারিনি। মাঝপথে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।
মন্নু। বাঁশি বাজাচ্ছিলো কে?
আতা খাঁ। আমি।
মন্নু। ছিলে তো নিজেদের আঙ্গিনার মধ্যেই। বিপদ এলো কোত্থেকে?
আতা খাঁ। আমি কোনো বিপদে পড়িনি।
মন্নু। বাঁশি বাজাচ্ছিলে কেন তাহলে?
আতা খাঁ। আপনাকে ডাকছিলাম। কিন্তু যিনি এগিয়ে আসছিলেন তাকে এড়াতে আবার আমাকে সরে অন্যদিকে চলে যেতে হচ্ছিলো।
মন্নু। এড়াতে চাইছিলে কেন? আমায় ডাকছিলে কেন? মাঝপথ থেকে ফিরে এলে কেন? তোমার কোন কথারই অর্থ স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না।
আতা খাঁ। আমি এড়াতে চাইবো কেন? আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি এড়াতে চাইছিলেন।
মন্নু। কেন?
আতা খাঁ। তিনি আর কাউকে চাননি। শুধু আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চেয়েছেন।
মন্নু। কে?
আতা খাঁ। এই খানেই তো দাঁড়িয়েছিলেন। ঐ যে। ঐ আসছেন। উনি নিজেই আসছেন। আমি আশেপাশেই থাকবো। আল্লাহ্ না করুন যদি বিপদ বুঝি সংকেত জানাবো। খুব হুঁশিয়ার থাকবেন।
[প্রস্থান]
[মঞ্চে প্রবেশ করবে ইব্রাহিম কার্দি।]
মন্নু। কে?
কার্দি। আমি।
মন্নু। তুমি? কী চাও? কেন এসেছো?
কার্দি। বলছি। আর কাছে এগুবো না। এখান থেকেই বলছি।
মন্নু। কাছে আসবে না কেন? কে তোমাকে রুখতে পারে?
কার্দি। জানি, তুমি ভীরু নও। কিন্তু আমি ভিরু। আমি কাপুরুষ। নিজেকে এবার চিনে ফেলেছি। আর সাহসের বড়াই করি না। যা বলার এখান থেকেই বলছি।
মন্নু। বলা শেষ হলে চলে যাবে?
কার্দি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
মন্নু। আর কিছু নয়? শুধু এইটুকুর জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে এখানে ছুটে এসেছো?
কার্দি। এইটুকুই এখন আমার কাছে অসীম অনন্ত। তোমার কোনো ভয় নেই। আজ তোমার কাছে আমি কিছুই চাইতে আসিনি।
মন্নু। কেন নয়? কেন চাইবে না?
কার্দি। সেদিন আমার অশান্ত অপূর্ণ হৃদয় নিজের মত্ততায় অস্থির হয়ে তোমাকে আক্রমণ করে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আজ সে তোমার ধৈর্য, তোমার প্রশান্তি, তোমার সমগ্র সত্তার শক্তি ও সুষমা প্রত্যক্ষ করে মুগ্ধ।
মন্নু। ছদ্মবেশ। সব ছদ্মবেশ। বিশ্বাস করো, সব ছদ্মবেশ।
কার্দি। আজ তুমি আমায় ঠকাতে পারবে না। আজ আমি পরিপূর্ণ, আজ আমি সত্যি জয়ী। তোমাকে চিনেছি, নিজেকেও চিনেছি। তোমার সঙ্গে আমার আর কোনো বিরোধ নেই।
মন্নু। কী কঠিন! কী পাষাণ তুমি! তুমি আরো ভীরু, আরো দুর্বল, আরো সামান্য হলে না কেন? এতই যদি দিগ্বিজয়ী হয়ে থাকো তাহলে আজ এলে কেন, এখানে এলে কেন?
কার্দি। প্রথমে ভেবেছিলাম আসবো না। রণক্ষেত্রে যতোটুকু দেখতে পাবো তা দিয়েই মনের পিয়াস মিটাবো। তারপর হঠাৎ এক সময়ে মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেলো। যদি সেখানে তোমার সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা না হয়, হয়তো এমন এক সময় এসে তুমি আমার সামনে দাঁড়াবে যখন রক্তের বন্যায় এক প্রান্তর ডুবে গেছে। ঢেউয়ের দোলায় আমি কেবলই নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে দেখবো বলে যতোবারই চোখ খুলতে চাইছি ততোবারই রক্তের ঝাপটায় সব গুলিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
[বাইরে বিপদ সংকেত ধ্বনিত হবে ও মাঝে মাঝে বাজবে]
মন্নু। তুমি মায়া–মমতাশূন্য। তুমি ভয়াবহ! তোমাকে আমি চিনি না?
কার্দি। তোমাকে নয়ন ভরে দেখে নিলাম। আসুক ভরা, আসুক মৃত্যু, আর ভয় করি না। তুমি আমার জন্য মিছেমিছি উৎকণ্ঠিত হয়ো না। সকল জ্বালা আমি মন থেকে মুছে ফেলে দিয়েছি। পেরেছি যে সেও তোমারি দান। আজকে তোমার যে রূপ আমি আমার মনের মধ্যে এঁকে নিয়ে গেলাম, রক্তের উচ্ছ্বাসে আমার চোখ যদি ঢেকেও যায়, তবু সে আলো নিভবে না, থাকবে। তুমি আমার শক্তি, আমার গর্ব, আমার রাণী T [বাঁশি বেজে ওঠে জোরে। কার্দি বেরিয়ে যায়। অশ্রুবিকৃত মুখে মন্নু বেগ এদিক–ওদিক দেখে।]
[পর্দা পড়বে]