যোগাযোগ

যোগাযোগ

‘রোকেয়া, অ রোকেয়া, আর কতো ঘুমাইবি? কাইন্দা কাইন্দা পোলার তর শ্বাস বন্দ হয়। উঠলি? অ রোকেয়া!’

খোকনের একটানা কান্নার সঙ্গে মায়ের ডাক শুনে রোকেয়ার স্বপ্ন ও ঘুম সব ছিঁড়ে বড়ো এলোমেলো হয়ে গেলো : হায়রে কি কালঘুমেই না পাইছিলো আমারে! পোলায় না জানি কখন থাইকা কান্দে।

দুই চোখ খুব টান টান করে খুলে সোজা হয়ে বসলে তন্দ্রার সঙ্গে ৩ বছর আগে মৃত মা-ও জানলা দিয়ে বাইরে গড়িয়ে পড়ে। বাইরে কখনো কখনো ঘন কালো অন্ধকার, কখনো ফ্যাকাশে অন্ধকার খুব দ্রুতবেগে ছুটে যায় এদিকে থেকে ওদিকে; কিছুক্ষণ পর পর ঝিমিয়ে পড়া হলদে রঙের স্টেশন হাই তুলতে না তুলতে ঘুমিয়ে পড়ে কালো অন্ধকারে। খটখটে গলায় কষাটে ঢোঁক কাঁটার মতো বিধলে তবে স্পষ্ট দ্যাখা যায়। সামনের সীটে অল্প বয়সী একজন মায়ের কোলে ৭/৮ মাসের শিশু নিজের ছোট্ট শরীরকে ভেদ করে, রোকেয়ার করোটি ও মগজ ভেদ করে কেবল কেঁদেই চলেছে। এই কান্না তবে খোকনের নয়, এভাবে কাঁদার বয়স তার খোকন পার হয়ে এসেছে অন্তত ৬ বছর আগে; এ কান্না অন্য কারো ছেলের—এইসব মনে করে নিশ্চিন্ত হলে এই ছেলেটার জন্য রোকেয়ার বেশ মন খারাপ হলো; ইস! বৌটার কি কষ্ট! পোলায় এই কান্দে তো দুধ দ্যাও, এতগুলি বেটা বইস্যা দ্যাখতাছে, হাগো সামনেই ব্লাউজের বুতাম খোলো, দুধ খাইতে খাইতে ঘুমাইয়া পড়ছে তো মায় যদি এট্টু সিধা হইয়া বইছে—পোলায় একখান চিকুর ছাড়বো, আল্লারে আল্লা, মাথার মধ্যে গিয়া ব্যাবাকটি মগজরে টাইনা ধইর‍্যা চুখের মইদ্যে ফালাইয়া দিবো।

‘ইস! সারাটা রাইত খুব কান্দছে! আপনার লগে গ্রাইপ ওয়াটার নাই?’ সারারাত্রি একই কম্পার্টমেন্টে কাটাবার পর রোকেয়ার এই যেচে পড়া সহানুভূতিতে রোগা ফর্সা মেয়েটা কোনো জবাব দেয় না। অসহায় ও বিরক্ত চোখে সে উল্টোদিকে ওপরের বাঙ্কে বারবার তাকায়। সেখানে কালো রঙের ১টা মোটসোটা লোক তেলতেলে চুলওয়ালা মাথার নিচে ১ হাত রেখে, আরেকটা হাত ২ হাঁটুর মাঝখানে, অঘোরে ঘুমায়। তরুণী মা তখন শিশুকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াবার জন্য ‘ওওও বাবু ঘুমায়! ওও ধ্বনি করে।

কোলে লইয়া খাড়াইলেই তো পোলাটা ঘুমাইয়া পড়ে। বইস্যা রইলে রাইত ভইরা যতোই না আদর করো, পোলায় কি আর ঘুমাইবো? – রোকেয়া তো ছেলেকে নিয়ে খুব একটা বাইরে যায়নি। খোকনের বয়স তখন বছরখানেক হয়েছে কি হয়নি, সেই ১ বার মুন্সীগঞ্জ গিয়েছিলো লঞ্চে। রোকেয়ার ননদ সিতারার তখন নোতুন বিয়ে হয়েছে, বর মুন্সিগঞ্জে এস. ডি. ও অফিসে টাইপিস্ট। সদরঘাটে উঠেছিলো, ঘণ্টা দেড়েক বোধহয় লঞ্চে ছিলো। লঞ্চের নিচে পানির ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ কি ভালো যে লেগেছিলো! রোকেয়ার কোলে একটুও কাঁদেনি খোকন। কাদলেই ওর বাবা খুব রাগ করতো, ‘পোলায় চিল্লায় ক্যান?’ রোকেয়া সঙ্গে সঙ্গে দুধ দিয়ে কি কোলে নিয়ে এঘর ওঘর করে খোকনকে থামিয়ে দিতো। খোকনকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলো সেই ১ বারই। ঐটুকু খোকন, সারাটা পথ তার খুশি কী! খোকন নদী দেখে হাসে, পানির ঘোলা স্রোত দেখে হাসে, নৌকা দেখে হাসে; নৌকার মানুষ, পাখি, মাছ ধরার জাল, কচুরিপানার বেগুনী ফুল —সবই তার কাছে হাসির সামগ্রী। এমনি হেসে হেসে, দুটো দাঁত ওঠা ছোট্ট মুখে নানারকম গুরুত্বপূর্ণ ধ্বনি তৈরি করে অবশেষে সে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। মুন্সিগঞ্জ ঘাটে লঞ্চ যখন ভেড়ে, ছেলে ঘুমে নেতিয়ে পড়েছে। লোকজনের এতো ছোটাছুটি, কুলিদের হৈ চৈ, পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ; কিন্তু দ্যাখো, রোকেয়ার বুকে খোকন নিশ্চিন্তে ঘুমায়।

রোকেয়ার বুকটা খালি খালি লাগে, শরীর নিসপিস করে। সামনের ছেলেটাকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত দুটো সামনে চলে যেতে পারে, সে ২ হাতের আঙুলে আঙুলে তালা লাগিয়ে দিলো। তারপর ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘বাচ্চাটা খুব কষ্ট পাইছে।’

সোলায়মান আলী কোনো কথা না বলে সংক্ষিপ্ত হাই তোলে। শোবার জায়গা না পেলেও শেষরাতের দিকে কোন এক স্টেশনে দুজন লোক নেমে যাওয়ায় দিব্যি পা ছড়িয়ে বসা গিয়েছিলো। পেছনের কাঁচের জানলাটা টেনে দিয়ে মাথা রেখে যেই একটু ঘুমোতে যাবে তো এই শিশুর চিৎকারে মাথার সমস্ত ভেতরটা চোখ দিয়ে বেরিয়ে চোখের মণিতে ঝুলে পড়ে। সোলায়মান আলীর চোখ দুটো করকর করে, নিশ্বাস টেনে নেওয়ার সময় মনে হয়, রাস্তায় পাঁচ পোড়ানো আগুনের খুব ঘন ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে মগজটা ঝাপশা করে দিলো।

কিন্তু রোকেয়ার চোখে কি মাথায় কোথাও একটুও ঘুম নেই। তার দুই চোখের নিচে কালো রঙের দুটো একাদশীর চাঁদ। হাই তুলতে তুলতে সোলায়মান আলী মেয়ের দিকে তাকায়, ভাঙা ভাঙা গলায় জিগ্যেস করে, ফজরের ওকতো হইছে?’ বলে নিজেই ফের বাঁ হাতে ঘড়ি দ্যাখে, না অখনও দশ পনরো মিনিট!’ তারপর খুব বিরক্ত চোখে বাইরে তাকায়। তার বিরক্তি বড়ো স্পষ্ট। দুই ভ্রূর মাঝখানে একটা পার্মানেন্ট গেরো দিয়ে উল্টোদিকের জানলার ওপারে সে ঝাপশা গাছপালা, কালচে গোলাপী আকাশ, অক্টোবর মাসের পাতলা কুয়াশা, কুয়াশায় ভিজে একটু টক টক হয়ে-যাওয়া টেলিগ্রাফের তার প্রভৃতি দ্যাখে।

শিশুর কান্না থামাবার জন্য তরুণী মায়ের বিচিত্র ধ্বনি, শিশুর এক টানা এঁএঁ এ এ কান্না, ট্রেনের ঝকঝক আওয়াজ, ভেতরের যাত্রীদের ভারী নিশ্বাসপতন, একটিমাত্র পাখা বেজে চলে ভোঁ ভোঁ করে—এই সমবেত গুঞ্জন রোকেয়ার বুকে ঠকঠক বাড়ি মারে : খোকনের আমার কি না জানি হইলো। কিসে যে পাইলো আমারে, আল্লা রে, কি যে হইলো, সাত বছরের পোলারে ঘরে রাইখ্যা বুইড়া মাগীটা আমি যাই মামুগো বাড়ি বেড়াইতে। আমি ঘরে থাকলে খোকনের এ্যাক্সিডেন্ট কি হইতে পারে?

সপ্তাহখানেক আগে সোলায়মান আলী নিজেই ওদের বাসায় গিয়ে বললো, ‘রোকেয়া, তর বড়োমামুর য্যান খুব ব্যারাম শুনছিলাম, বহুত কঠিন ব্যারাম, মনে হয় ক্যান্সার হইতে পারে।’

রোকেয়া তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে এসে সোলায়মান আলীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো, ‘কেঠায় কইলো আব্বা?’

‘তর মামুগো দ্যাশের কাদের মিরধা আইছিলো আমার দুকানে, মাল লইয়া গেলো।

‘কাদের মিরধা যানি ক্যাঠা?’

‘কাদের মিরধারে তুই চিনবি ক্যান? তর বড়োমামুর সম্মুন্দির কেমুন ভায়রা লাগে। আমি তর মামুর কথা জিগাইলাম তো কয়, ‘হায় হায়, হ্যার তো বহুত কঠিন বিমার হইছে।’ মনে লয় একবার গিয়া দেইখা আহি। বুধবার দিন স্বরূপখালির হাট আছে, হাটটাও দ্যাখতাম, দুইটা দিন তর মামুগো তালাশ লইয়া আহি।’

‘আব্বা, আমারে লইবা?’ তোমার লগে আমিও যাই? লইবা?’

‘তুই যাস ক্যামনে?’ সোলায়মান আলী হাসে, ‘তর পিচ্চিটা কই থাকবো? লগে না লইলে হ্যায় ছাড়বো ক্যান?’

‘না আব্বা, খোকনরে সেতারার লগে রাইখা যামু। সেতারারা তো কাগজীটোলা আইয়া পড়বো, নিজেগো বাড়ি খালি হইছে অগো, কাগজীটোলা আইলে কাছেই থাকবো; ফুফুও দ্যাখবো, বাপেও গিয়া গিয়া দেইখা আইবো।’ কিন্তু হান্নান বললো, ‘মাগো বাড়ি যাওনের হাউস হইছে তো যাও গিয়া পোলারে আবার কৈ থুইয়া যাইবা? খোকনরে আমি রাখতে পারি না?’

যাওয়ার সময় বুকটা খচখচ করছিলো। কিন্তু মামাবাড়ি পৌছবার আগেই, স্বরূপখালি স্টেশনে নেমে যখন নৌকায় ওঠে তারো আগে থেকে শৈশবের অল্প অল্প চেনা গোরুবাছুর, সবুজ ও ধূসর গাছপালা, ন্যাংটা কালো রাখাল বালক, পুকুরপাড়ে পচা ঘাসের ঘন সুবাস, খড়ের হলদে গাদা, গেরস্থ বাড়ির ঈশান কোণে গোয়ালঘরের গন্ধ, হাল্কা মিষ্টি গন্ধের খোলা শাদা রোদ – কতোকাল পর এদের দ্যাখা পেয়ে রোকেয়ার সমস্ত বুক, পিঠ, মুখ, চোখ কানায় কানায় ভরে গিয়েছিলো। কেবল একটি মাছরাঙা চোখে পড়ার পর থেকে যা দ্যাখে শুধু মনে হয়, আহা খোকনটারে দ্যাখাইতে পারতাম! স্বরূপখালি ঘাটে নৌকায় উঠতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিলো, ঠিকঠাক সামলে নিয়ে ভেতরে বসতে বসতে খোকনের জন্য মন খারাপ করে।

মামার শরীর সত্যি বেশ খারাপ। কিন্তু ক্যান্সার হয়নি। মাঝে মাঝে পেটে মোচড় দেয়, টক ও তেতো জলের জোয়ার ভাটা শুরু হয় বুকে ও পেটে। পূর্ণিমা অমাবস্যায় শরীরটা আর নিজের থাকে না, তখন না যাওয়া যায় দোকানে, না করা যায় হাটবাজার। বড়োমামার কোনো ছেলে নেই, তিনটেই মেয়ে, তিন মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে, কে কি করে? কেবল মেজো মেয়েটা কাছে থাকে বলে প্রায়ই আসে। ঐ জামাইটা ভালো, সময় পেলেই শ্বশুরের খবর নেয়। সে বললো, স্বরূপখালির নারায়ণ ডাক্তার বলে যে ঢাকায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে পেট কাটলে সেরে যেতে পারে। সোলায়মান আলী চুপ করে থাকে। তারা মিয়ার কেবল শ্বশুরকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার কথা! সোলায়মান আলী দুপুরে খেয়ে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে গলায় নানারকম ধ্বনিতরঙ্গ তুলে মুখ ধোয়, তারপর হাত ধোয়ার ফাঁকে ফাঁকে বলে, ‘মেডিকলের কথা কও বাবাজি, হ, তোমরা গেরামে থাকো, তোমরা কইবা না ক্যান? তোমাগো ক্যামনে কই, ঢাকার হাসপাতালগুলি মানুষ মারণের ফ্যাক্টরি।’

রোকেয়া কখনো ওর মামীর সঙ্গে, কখনো একাই এবাড়ি ওবাড়ি করে বেড়ায়। কতো মামীর সঙ্গে, কতো খালার সঙ্গে জীবনে প্রথম দ্যাখা হলো। রোকেয়ার মা মারা গেছে চার পাঁচ বছর আগে, অনেকে জানেই না। আরো অনেক আগে ঢাকার আর্মানিটোলার সোলায়মান আলী ভালো তাঁতের শাড়ি কিনবে বলে স্বরূপখালি এসে চকলোকমান গ্রামের নুরুন্নেসাকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিলো; প্রথম কয়েক বছর একটু যোগাযোগ ছিলো, পরে কোনো খোঁজখবরই রাখতো না। সোলায়মান আলী আজ বিশ বাইশ বছর পর বেড়াতে এসেছে শ্বশুরবাড়ি। ভালোই কাটিয়ে দিলো। তিনদিন, চারদিন, দেখতে দেখতে পাঁচদিন কেটে গেলো। সোলায়মান আলী সম্বন্ধীর সঙ্গে যায় স্বরূপখালি, তাঁতের শাড়ি খোঁজ করে। বছরখানেক হলো সে ফের কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছে, এবার যাওয়ার সময় এক বেল কাপড় নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো!

রোকেয়ার ভারি সুন্দর কাটলো, ভারি সুন্দর। এই জায়গা সত্যি ভালো। ছেলের কথা মনে হলে একটুও খারাপ লাগেনি, বরং এতদূর এসে খোকনের কথা ভাবতে বড়ো সুখ, খোকনের বাপের কথা ভাবতেও সুখ। কেউ ছেলের কথা জিগ্যেস করলে রোকেয়ার বড়ো ভালো লাগে। মামানীগো, কি কই, হেইডা একটা বিচ্ছু হইছে। এক্কেরে বিচ্ছু। লগে লইয়া আইতাম তো দ্যাখতেন, তামামটা দিন কি পোংটামি কইরা বেড়াইতো। আমারে বাড়ি থাইকা বারাইতে দেইখা খালি ফাল পাড়ে, ‘আম্মা আমিও যামু।’ তো হ্যার বাপে কয়, ‘না, এক মাস বাদে পরীক্ষা অহন পোলায় ক্যামনে যায়?’

সন্ধ্যাবেলা বাড়ির পেছনে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। বাড়ির পেছনে একটা পাতকুয়ো, তারপর ছোটো এক টুকরো বেগুনখেত, বেগুনখেত পার হলে বাঁশঝাড়, বাঁশঝাড়ের পেছনেই জোড়াপুকুর— পাশাপাশি দুটো বড়ো পুকুর, কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে পানি। পুকুরপাড়ে একটা মস্ত সজনে গাছ; বড়োমামী বলে, রোকেয়ার মা বিয়ের আগে লাগিয়েছিলো। রোকেয়ার মা সজনে ডাঁটা খেতে ভালোবাসতো, পুকুরপাড়ে গোটা চারেক গাছ পুঁতে দিয়েছিলো, শেষ পর্যন্ত টিকলো একটা। সন্ধ্যার পর সজনেতলায় কোনো কোনো দিন শাদা শাড়ি পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রোকেয়া ভালো করে দেখবার আগেই কোথায় চলে যায়। রোকেয়া এদিক ওদিক তাকায়, চোখ কচলায়, কোথাও পাওয়া যায় না। একদিন সন্ধ্যায় রোকেয়া পুকুরপাড় থেকে ফিরছে, বাঁশঝাড়ে তখনো পৌঁছয়নি সজনেতলায় শাদাকালো মাটিতে লম্বা লম্বা আঙুলের মতো সজনের ছায়া অল্প বাতাসে একবার ছড়িয়ে পড়ে, একবার গুটিয়ে নেয়। সেই অচেনা জন্তুর হাত মাড়িয়ে যেতে একটু ভয় ভয় করছিলো। হঠাৎ দ্যাখে, অন্যদিক থেকে শাদা শাড়ি পরা অল্প বয়সী একটি মেয়ে বেগুনখেত পার হয়ে বাঁশঝাড়ের পথ ধরলো। রোকেয়ার বুকের মধ্যে শিরশির করে ওঠে। ঠায় দাঁড়িয়েই রইলো সে। বাঁশঝাড়ে চাঁদের ময়লা রঙ আলো। বাঁশঝাড় পার হয়েও মেয়েটা একটুও থামে না। এ কে? খুব কাছাকাছি চলে এলে রোকেয়া শুনলো মেয়েটা বলছে, ‘রোকেয়া, তর পোলায় কেমন আছে?’মায়ের কণ্ঠস্বরে খুব চমকে উঠে ও তখন চারদিকে তাকিয়ে দ্যাখে। না, কোথাও কেউ নেই। সামনে পুকুর, পুকুরের ওপারে মাঠ, মাঠভরা পাকা ধানে হলদে জ্যোৎস্না অলস গা এলিয়ে ঘুম ঘুম চোখে শূন্যতা দ্যাখে। ডান দিকে কালচে সবুজ গ্রাম, বাঁ দিকে সুপারি বাগান। ওর মা তবে কোথায় গেলো?

নিজের শরীরকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে রোকেয়া ঘরে ফিরে শুনলো হান্নানের টেলিগ্রাম এসেছে। দোতলার কার্নিশ থেকে পড়ে গিয়ে খোকন শরীরে আঘাত পেয়েছে।

রোকেয়ার সমস্ত সময়টা, এমন কি গত কয়েকটা দিনও বড়ো ফাঁকা হয়ে গেলো। ওর মেজোমামার খুব ইচ্ছা – রোকেয়া একটা দিন ওদের ঘরে কাটিয়ে যাক। চার পাঁচদিন হলো এসেছে, মেয়েটাকে এক সন্ধ্যা ভালো করে খাওয়ানো গেলো না, আবার করে আসে, আদৌ আসে কিনা কে জানে? একটা দিন থাকলে কি আর এসে যায়? ওর মেজোমামা স্বরূপখালি গিয়ে টেলিফোনে আলাপ করবে হান্নানের সঙ্গে, হোক না। নে আঘাত সম্বন্ধে আরো বিস্তৃত জেনেই রোকেয়া রওয়ানা কে বোঝায় সে কথা?’

‘না মামু, আমারে যাইতে হইবো।’

বড়োমামীও তাই বলে। ওর যাওয়াই ভালো। মায়েরে না দ্যাখলে পোলায় সারবো ক্যান?’ রওয়ানা হওয়ার ঠিক আগে মেজোমামী এসে আলগোছে ওর পিঠে হাত রাখে, ‘তরে দেইখ্যাই পোলায় তর ঠিক ভালা হইয়া যাইবো, দেহিস!’

পশ্চিম দিকে মুখ করে বসে নামাজ পড়ে নিচ্ছে সোলায়মান আলী। জানলার বাইরে সমস্ত ভূবনজোড়া খোসাটা আস্তে আস্তে ভেঙে পড়েছে। আকাশ এখন বেশ স্পষ্ট : গোলাপী রঙের, নীল রঙের, ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দু বেশ স্পষ্ট : সবুজ চোখের মাথায় একটি শাদা মণি; টেলিগ্রাফের তারের রেখা বেশ স্পষ্ট : শিশিরে ধুয়ে খুব ধারালো ও নির্লিপ্ত। এই একটু সবুজ, একটু কালো মাঠে, রোদের নিচে, শিশিরের নিচে, চাপড়া চাপড়া ঘাসেরও নিচে একটা নোতুন কবর, টাটকা শোকে উঁচু। কার কবর? রোকেয়ার চোখের সামনে কোটি কোটি ছোটো বিন্দু শূন্যে ভাসতে থাকে। ‘রোকেয়া, তুমি আসছো? সুবে সাদেকের আগে খোকন যে আমাগো ছাইড়া চইলা গেলো। কে বলছে? ভালো করে লক্ষ্য করতে না করতেই ট্রেন চলে যায়।

‘খোকন নাই?’

‘না রোকেয়া, স্যায় নাই! রাইত ভইরা খালি আম্মাআম্মা করছে।’

এবার চেনা যায়। টেলিগ্রাফের পোস্টে দাঁড়িয়ে আছে ওর মা, রোকেয়ারে, মারে মা, আইছস তুই? এতো দেরি করলি মা? চাইরটা ঘন্টা আগে আইলেও তো পোলাডার মুখে পানি দিবার পারতি।’

সকালবেলায় ট্রেনের কি স্পীড! একটার পর একটা টেলিগ্রাফের পোস্ট পার হয়ে যায় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই। এইতো একটি পোস্টের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলো ওর মা, আবার দ্যাখো আরেকটা পোস্টের ওপারে উবু হয়ে মাটি খুঁড়ছে রোকেয়ার স্বামী। ট্রেন চলছেই। হান্নান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পেছনে মুখ ফিরিয়ে দেখলো রোকেয়া। ট্রেন চলে যায়। টেলিগ্রাফের আরেক পোস্টে দাঁড়িয়ে ওর স্বামী ট্রেন দ্যাখে; রোকেয়ার মুখোমুখি হলে দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে আস্তে আস্তে বসে পড়ে।

‘রোকেয়া তুমি! খোকনের মাও, তুমি আইছো? খোকন যে আমার সারাটা রাইত খালি তোমার কথাই কয়। খালি আম্মাআম্মা করছে, রাইত ভইরা স্যায় কেবল তোমারে ডাকছে। আমাগো সোনার টুকরাটারে মাটি চাপা দিয়া অহন আমি কেমনে বাড়ি যাই? খোকনের মা-ও, আমাগো ঘরবাড়ি এক্কেরে খালি হইয়া গেলো, এই খালি বাড়ির মইদ্যে আমরা কেমনে থাকুম, কও! ট্রেন চলে যায়, টেলিগ্রাফের পরের পোস্টে দাঁড়িয়ে বিলাপ করে হান্নান।

সম্পূর্ণ সকাল হলো; গোলাপী ও নীলাচে আভা কেটে গিয়ে মাঠে এখন শাদা ও নিরাভরণ রোদ, ঘাসের মাথায় শুকনো শিশির বিন্দু শূন্য চোখের কোটর থেকে কেবল তাকিয়ে থাকে, কিছুই দ্যাখে না।

মোনাজাত শেষ হলে সোলায়মান আলী জোড় হাতে মুখ-চোখ মুছে দুই হাতের আঙুলের ডগায় চুমু খায়। তারপর সোজা হয়ে বসে পাশে তাকিয়ে দ্যাখে রোকেয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছছে।

সারা রাত বড়ো অশান্তিতে কাটলো মেয়েটার। আহা, এইতো একটুখানি মেয়ে, এতো কষ্ট সে কিভাবে সহ্য করে? ডান হাতটা আস্তে করে রোকেয়ার পিঠে রেখে সোলায়মান আলী আঙুল বুলিয়ে দেয়। একটু আগে মোনাজাত করা আঙুলগুলো রোকেয়ার পিঠে তিরতির করে কাঁপে।

‘রোকেয়া, এতো চিন্তা করস ক্যান মা? পোলার তর তেমন কিছু হইলে কি আর হ্যার বাপে জানাইতো না?’

রোকেয়া স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তার চোখ এখন শুকনো, সে ছোটো ছোটো নিশ্বাস ফেলে : আমি থাকলে কি আর খোকনের এ্যাক্সিডেন্ট হইতে পারে? আমি তাড়াতাড়ি পোলার কাছে গিয়ে খাড়াইতে পারলেই হ্যার ব্যাবাকটি বিষ মুইচ্ছা ফালাইতে পারতাম।

সোলায়মান আলীর আঙুল কাঁপতেই থাকে। ছেলেবেলা থেকেই তার মেয়ে বড়ো আদুরে, একটা কিছু হলো তো কিছুতেই সামলানো যায় না। খুব ছোটোবেলাতেই মেয়ে খুব বাপঘেঁষা ছিলো, সুযোগ পেলেই খালি বাপের পিছু পিছু ঘুরতো। কিন্তু একবার কিছু হলো তো এই বাপও কিছু করতে পারতো না।

সোলায়মান আলীর তখন হোটেলের ব্যবসা। আলুবাজারে হাজী ওসমান গনি রোডে জমজমাট হোটেল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সোলায়মান আলী সোজা চলে যেতো হোটেলে, সঙ্গে রোকেয়া থাকতোই। হোটেলে ঢোকার মুখে মস্ত ডেকচিতে রাঁধা তেহারি, ডেকচির ওপর ঢাকনি, খুললেই ভেতর থেকে খশরু

মা মাকে বেরিয়ে সমস্ত হোটেল, হোটেলের সামনের রাস্তাটুকু কি সুন্দর ম’ম’ করতো। রোকেয়ার বসবার জায়গা ছিলো ক্যাশেই, বাপের কোল ঘেঁষে। সে মাত্র কিছুক্ষণের জন্য। মিনিট দশেক পার হলে সে নিজেই উঠে গিয়ে একবার রান্নাঘর, একবার কাউন্টার এমনি কেবল ঘুরঘুর করতো। মাঝে মাঝে ফালু এসে একটা এনামেলের থালা দিয়ে তেহারি তুলছে আরেকটা থালায়, ছোটো ছোটো গোশতের টুকরো সাজিয়ে দিচ্ছে থালার ওপরে, থালা সাজানো হয়ে গেলে সোজা নিয়ে যাচ্ছে কাস্টমারের সামনে; খুব কায়দা করে মাথাটা ঘুরিয়ে মগ দিয়ে ড্রাম থেকে পানি তুলে ঘোলাটে রঙের গ্লাস ঠক করে রেখে দিচ্ছে টেবিলে – রোকেয়া কি গভীর আগ্রহ নিয়েই না সব দেখতো। রান্নাঘরে মতিমিয়া বাবুর্চির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখে নিতো বিরাট হাঁড়ির গহ্বর। একদিন শীতের সকালে হোটেলের রান্নাঘরে ঢুকে রোকেয়া দ্যাখে চুলার ওপর মস্ত ডেকচি চাপানো, ডেকচিতে ঢাকনির ওপর একটা কালো ন্যাকড়া ও বড়ো একটা হাতা।

‘আউজকা কি পাকাও?’ এই কথা বলে রোকেয়া ন্যাকড়ায় হাত দিয়ে ঢাকনাটা একটু সরিয়েছে, অমনি ফুটন্ত পায়ার ঝোল থেকে গরম ধোঁয়া বেরিয়ে ওর কণ্ঠার হাড়ের নিচে অনেকটা জায়গা ঝলসে গেলো! মতিমিয়া বাবুর্চি পেছনের দরজায় কয়লার স্তূপের সামনে বসে বিড়ি টানছিলো। রোকেয়ার চিৎকার শুনেই পেছন ফিরে রোকেয়াকে টেনে নিলো কোলের মধ্যে। রোকেয়া তখন আরো জোরে চিৎকার করে। সোলায়মান আলী হোটেলের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেই তেহারির পরিমাণ দেখে নিচ্ছিলো, দৌড়ে এসে কোলে তুলে নিলো মেয়েকে। বাপের কোলে গিয়ে রোকেয়া একটুখানির জন্য থামে, সে এক পলক, তারপর ফের সেই চিৎকার সোলায়মান আলী রোকেয়ার গলায় চুমু খায়, কপালে, গালে, বালসানো চামড়ায় আদর করে, কতো চুমু খায়; কিন্তু রোকেয়ার কান্না কিছুতে থামে না। এমন কিছু ঝলসায়নি, একটু আঁচ লেগেছে কেবল। তবু সোলায়মান আলীর এতো আদর এতো ভালোবাসায় ওর কষ্ট কি একটুও কমে না? সোলায়মান আলী একটু বিরক্তই হয়ে গিয়েছিলো, মেয়েটা ভীষণ জেদী। তবে বড়ো মায়া, বাপের জন্যে, স্বামীর জন্যে, ছেলের জন্য বড়ো মায়া তার মেয়েটার। তাই একটুতেই এতো ভেঙে পড়ে। কতো সখ করে মামাবাড়ি গেলো, কি সুন্দর হাসিখুশি ছিলো সেখানে; দ্যাখো, এক রাতে শরীরটার কি দশা হলো। খুব মিনতিমাখা গলায় সোলায়মান আলী বলে, ‘রোকেয়া, আমি তরে কই,তর পোলার কিছুই হইবো না। তুই হুদাহুদি ভাইবা মরস রে পাগলি!’ রোকেয়ার পিঠে সোলায়মান আলীর ডান হাতের আঙুলগুলো খুব অধীর হয়ে ওঠানামা করে। একবার তর্জনী দিয়ে একটু চাপ দেয়, ফের মধ্যমা, ফের অনামিকা – এরকম করে তার আঙুলসমূহ মেয়ের পিঠে কেবল কেঁপে কেঁপে চলে।

কিন্তু রোকেয়ার স্তব্ধ কাতর মুখে কোনো পরিবর্তন নেই; তার চোখের কোণে জলের দাগ শুকিয়ে এক টুকরো মেঘের মতো দ্যাখায়। মেয়ের অপরিবর্তিত মেঘলা মুখ দেখে সোলায়মান আলীর মুখটাও করুণ হয়ে যায়। সে তার ছানি পড়বে পড়বে চোখ দুটো নিচের দিকে রেখে আস্তে আস্তে তার সমস্ত হাতখানা টেনে নেয়।

কমলাপুর স্টেশন থেকে যখন ওরা রোকনপুর পৌঁছলো হান্নান তখন গোসল করে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।

‘তোমরা আইছ?’

‘তুমি কই যাও?’

‘হাসপাতাল যাইতাছি। তুমিও চলো আমার লগে’, হান্নান সোলায়মান আলীকে বললো, ‘আপনেও চলেন।’

‘চলো, চলো,’ রোকেয়ার অস্থিরতায় হান্নান একটু হাসে, ‘যাওনা, চোখে মুখে পানি দ্যাও, সারা রাইত জাগনা আছিলা, চোখে মুখে পানি দিয়া নাশতা কইরা লও!’ সোলায়মান আলীকে বসিয়ে রেখে হান্নান বাইরে গেলো ডালপুরি কিনতে।

হাত মুখ ধোয়ার জন্য রোকেয়া কলপাড়ে চলে যায়। ডালপুরির ঠোঙা হাতে হান্নান ফিরে এলে সোলায়মান আলী বলে, ‘কি মনে হয় অহন?’

‘অহনও কিছু কওন যায় না। ডাক্তারে আগে কইছিলো একটা পাও বাদ দেওন লাগবো। আউজকা বড়ো ডাক্তারে কইলো, না কাটলেও চলতে পারে।’

‘তুমি কখন আইছ হাসপাতাল থাইকা?’

‘অখখন! সেতারা আর সেতারার জামাইরে রাইখা আইছি। রোকেয়া, লও নাশতা কইরা লও।

কিন্তু রোকেয়া কিছুই খাবে না। সোলায়মান আলী ক্লান্ত ঠোঁটে হাসে, ‘অখন আর তর চিন্তা কিরে পাগলি? হায় হায়, সারাটা রাইত কি কষ্ট করছে। অখন তরে দ্যাখলেই তর পিচ্চিডা ফাল পাইরা উঠবো!’ রোকেয়া কোনো কথাই বলে না। শাড়িটাও সে পাল্টায়নি, মলিন কাপড়ের এক প্রান্ত আঙুলে জড়াতে জড়াতে তার বুক শিরশির করে। আমারে দ্যাখলে পর খোকন আমার কি না জানি করে।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দোতলায় উঠে করিডোর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে রোকেয়া খুব ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। করিডোরের দুই দিকের বিছানাগুলোতে শোয়া, আধশোয়া, রোগাটে, মোটাসোটা, ফর্সা, কালো, কাশতে-থাকা, থুথু ফেলছে, হাঁপাচ্ছে, আজকেই মারা যাবে—না, স্পষ্ট করে কেউ তার চোখে পড়ে না। ডেটলের, স্পিরিটের, ফিনাইলের গন্ধ—কিছুই কি ওর নাকে লাগে না? রোগীদের নোংরা শরীরের গন্ধ, পায়ের ঘায়ে বাঁধা হলদেটে ব্যান্ডেজের গন্ধ মেঝে থেকে উঠে আসছে একই সঙ্গে ফিনাইল ও মেঝের ভ্যাপসা গন্ধ, নার্সের ধরধবে এ্যাপ্রন থেকে আসা রোদের টাটকা গন্ধ—সবই তার ফর্সা টিকলো নাকের এদিক দিয়ে ওদিক দিয়ে চলে যায়, কৈ তাকে তো স্পর্শও করে না। শিশুদের ওয়ার্ডে সারি সারি খোকন শুয়ে আছে নানা ভঙ্গিতে। রোকেয়ার বুকে ও মাথায় জট পাকায়, এর মধ্যে তার খোকনটাকে সে চিনে নেবে কি করে? হান্নানের পেছনে পেছনে একটা খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে ওর চোখের ঘোরটা কাটে; প্রথমেই চোখে পড়ে সিতারাকে, সিতারার স্বামী আহমদউল্লা বৌকে কি বলছিলো, ওদের দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। খোকন শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। তার শাদা প্লাস্টার করা ডান পা দেওয়ালের দিকে একটা রডের সঙ্গে ঝোলানো। ডান হাতে প্লাস্টার, গলা থেকে ব্যাণ্ডেজের কাপড় দিয়েই ঝোলানো সেই হাতটা এখন ওর বুকের ওপর ফেলে রাখা। বিছানার পাশে একটা লোহার স্ট্যাণ্ড, স্ট্যাণ্ডে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে স্যালাইন ওয়াটারের স্বচ্ছ ব্যাগ, সরু শাদা নল দিয়ে স্যালাইন জল এসে খোকনের ডান হাতের রগ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে ওর শরীরের অলিতে গলিতে।

ওরা দাঁড়াতে না দাঁড়াতে শাদা এ্যাপ্রন পরা, মাথায় শাদা রুমাল জড়ানো একজন নার্স এসে স্যালাইন ওয়াটার ব্যাগ, পাইপ, খোকনের নাড়ি, তাপ প্রভৃতি দেখে নেয়। নার্সের গায়ের রঙ ফর্সার ধার ঘেঁষে, সামনের দুটো দাঁত একটু উঁচু, ডান চোখের নিচে একটা কাটা চিহ্ন। আহমদউল্লা বলে, ‘সিস্টার, ছেলে খুব কষ্ট পাচ্ছে।

‘কষ্ট তো আজ হবেই, ‘ সিস্টার ঠাণ্ডা গলায় কথা বলে, ‘কষ্ট হবে না? কাল এ্যানাসথিসিয়া করা ছিলো, কিছু বুঝতেই পারেনি। আজ খুব ব্যথা হবে। রোকেয়াকে দেখে নার্স সিতারার দিকে প্রশ্নবোধক ভ্রূ নাচায়, ‘মা তো,

না?’ সিতারা ঘাড় নাড়লে নার্স একটু হাসে; দাঁত দুটো উঁচু, তবু নার্সের হাসিটা মিষ্টি, ‘এখন আর কি? মা এসে পড়লো, এখন আর কি? কষ্ট কি আর থাকে?’

নার্স অন্য বিছানার দিকে চলে গেলে আহমদউল্লা বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, ‘আমি যাই। অফিসে একটু হাজিরা দিতে হইবো। কাইলও যাইতে পারি নাই। যাই।’ সোলায়মান আলী ও হান্নানও কথা বলতে বলতে আহমদউল্লার সঙ্গে বাইরে গেলো।

খোকন শুয়ে থাকে চিৎ হয়ে। খোকন কি বাড়িতে চিৎ হয়ে শোয় কখনো? চিৎ হয়ে শুতে পারে না সে কতো ছোটো থেকে। এক বৎসর দেড় বৎসর বয়সেও কেবল এপাশ ওপাশ করতো। পশ্চিমদিকে মাথা রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছো, কিন্তু আধ ঘন্টা পর এসে দ্যাখো মাথা সরে গেছে উত্তরদিকে। ছেলেটা রাতভর শুধু চর্কির মতো ঘোরে, কখনো স্থির হয়ে ঘুমোবে না। আজ এভাবে শুয়ে থেকে খোকন কিভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নেবে? খোকন মুখটা কাৎ করে রোকেয়াকে দ্যাখে। মুখ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায় তার শরীরের কোথাও না কোথাও খুব কষ্ট। হয়তো খুব ক্লান্ত কিম্বা কয়েকবার নানা ধরনের ইঞ্জেকশন দেওয়ায় তার স্পর্শকাতরতা এখন একটু ভোঁতা, সে চিৎকার করে না, কাঁদেও না, ওর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে কেবল ক্ষীণ ধ্বনির কারানি।

খোকন দ্যাখছ, তোমার আম্মায় আইসা পড়ছে। অখন আমাগো খোকন মিয়ারে হাসপাতালে বাইন্দা রাখে ক্যাঠায়?’ সিতারা কথা বলে আর খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এই মেয়েটার এই এক গুণ, শিশুদের সঙ্গে অবিরাম বকে যেতে পারে। তার একটানা কথা বলার ফলে খোকনের গোঙানি পেছনে পড়ে গেছে। আমার বাপজানের হাসপাতালে পইড়া থাকলে চলবো ক্যান? মহল্লার ব্যাবাকটি কাম পইড়া রইলো, বাবা, তোমারে জলদি যাইতে হইবো না?’

রোকেয়া আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে জড়াতে একটু তৈরি হয়ে বিছানার প্রান্তে এসে দাঁড়ালো।

খোকনের বিছানার ধার ঘেঁষে রোকেয়া খুব সোজা হয়ে দাঁড়ায়। একেবারে সোজা, ঋজু; ওর বুকটা এখন খুব চওড়া, – এই বুকের ভেতরে, ওপরে সমস্ত জায়গা খালি পড়ে খোকনকে বুকের রয়েছে। সে ইচ্ছা করলে ব্যান্ডেজ, প্লাস্টার, স্যালাইন ব্যাগ শুদ্ধ, খোকনকে বুকের ভেতর নিতে পারে। এই খালি বুকে ঢোঁক গিললে কেবল ঢক ঢক আওয়াজ হয় : খোকন আমারে পাইয়া কি না জানি করে! আমার পাগলাটা!

ছেলের কপালে একটা হাত রেখে ঝুঁকে রোকেয়া ওর ছেলের মুখ লক্ষ্য করে। খোকনের বেশ জ্বর, গরম ভাপ আসছে কপাল থেকে। চুল ওর বড়ো অগোছালো। কখনো ঠিকমতো আঁচড়ানো যায় না। তপ্ত কপালে লেপ্টে থাকে এলোমেলো কালো চুল, রোকেয়া আস্তে আস্তে কপাল থেকে চুল ঠেলে দেয় পেছনদিকে।

বড়ো বড়ো দুটো চোখে খোকন এক দৃষ্টিতে মায়ের মুখ দ্যাখে। অনেকক্ষণ ধরে দ্যাখে।—খোকন আমারে দেইখা কি না জানি করে! ছেলের চোখজোড়ার একেবারে ভেতরটা দেখে নেওয়ার জন্য রোকেয়া ওর মুখের সামনে অনেকটা ঝুঁকে পড়ে। একটানা গোঙানির মধ্যে খোকন ওর চোখজোড়া পাঠিয়ে দিলো স্ট্যাণ্ডে ঝোলানো স্যালাইন জলের ব্যাগে। হাত কি পায়ের ব্যথায় কিম্বা শরীরের জন্য কোনো জায়গার কষ্টে তার চোখের মণি তিরতির করে কাঁপে। এখন ওর চোখ জোড়া গাঁথা রয়েছে সামনের শাদা দেওয়ালে। শাদা শূন্য দেওয়াল। এতো শূন্য দেওয়াল রোকেয়ার একটুও পছন্দ নয়। বোবা দেওয়াল, শরীরে আর কিছু না হোক এক গাছা টিকটিকিও কি পরতে নেই? এক মিনিট সেই নিরাভরণ দেওয়াল চেখে নিয়ে খোকনের চোখ চলে যায় নিজের প্লাস্টার করা পায়ে, সেখানে তিন সেকেণ্ড, তারপর সেই অপরিবর্তিত চোখজোড়া উড়াল দিলো উল্টোদিকের শেষ কোণের বিছানায়, সেখানে সাত আট বছরের একটি ছেলেকে অক্সিজেন দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

‘খোকন, আব্বা, খোকন।’ রোকেয়ার গলা একেবারে বুক পর্যন্ত খাঁখাঁ করে। জিভে অনেক কসরৎ করবার পর গলাটা একটু ভিজলে সে খসখসে আওয়াজ করে, ‘খোকন, খুব ব্যাদনা করে বাবা?’

জবাবে খোকন কিছুই করে না। তার একটানা চাপা গোঙানিতে মনে হয় ওর শরীরের ভেতরে দারুণ চাপা গলি, নোনাধরা উঁচু নিচু দেওয়াল, যন্ত্র বিগড়ে যাওয়া ট্রাক ও নারিন্দার নিয়মিত ট্রাফিক জ্যাম পার হতে হতে বেরিয়ে আসছে ঠেলাগাড়ি ভর্তি হাওয়ার চাপ। এতো কষ্ট কিসের বাবা? কই ব্যাদনা করে আমারে কওনা।’

এবার খোকন ফের মার চোখে তাকালো। ঠোঁটের কোণে একটুখানি ঈদের চাঁদ খেলিয়ে দিলো, সে দ্যাখা যায় কি যায় না। সে হাসি আর কতোক্ষণ! নতুন কোনো উপসর্গ শুরু হলো বোধহয়, মুখ বাঁকা করে সে একটু জোরে আঁ করে ওঠে। তারপর ফের একটানা চাপা গোঙানি। এবার আওয়াজটা বেশি। খোকনের চোখের কোণে ঘন নীল ছাপ, কোঁচকানো কপাল, অল্প ফাঁক হয়ে থাকে ফ্যাকাশে ফর্সা ঠোঁট। ভেতর থেকে উকি দিচ্ছে এলোমেলো গঠনের দাঁতের শাদা টুকরো। খোকনের চোখ ফের অক্সিজেন দেওয়া রোগীর বিছানায় গিয়ে থেমে যায়। গোঙানি আরো বাড়ে।

‘খোকন, সোনা, এই যে আমি আইছি, দ্যাখছো, আমি আইয়া পড়ছি তো!’ খোকনের কেবল একটানা কারানি। মাঝে মাঝে শরীরটা ঝাঁকাচ্ছে। একটানা গোঙানির মধ্যেই খোকন এবার সিতারার মুখে তাকায়। সিতারা বলে ‘খোকন, তোমার মায়ে আইয়া পড়ছে, দ্যাখো বাবা, তোমার আম্মায় আইছে। দ্যাখছো? রোকেয়ার দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘ভাবী, আমি ম্যাট্রনরে লইয়া আহি। পোলায় কেমন করে!’ কিন্তু রোকেয়া কিছু না বলে খোকনের কপাল আরো নিবিড় করে চেপে ধরে। খোকন দেওয়াল দ্যাখে, স্যালাইন ওয়াটারের ব্যাগ দ্যাখে, অক্সিজেন দেওয়া মেয়েটাকে দ্যাখে, দুটো বিছানার পর একটা খাটে শান্ত হয়ে ঘুমায় একটি শিশু, তাকেও দ্যাখে, আর এর সঙ্গে চলে ক্রমাগত গোঙানির আওয়াজ। এদিকে সেতারাটা যে সেই কাকে ডাকতে গেলো তো এখনো তার ফেরবার নাম নেই। হান্নান, সোলায়মান আলী কোথায় গেলো? চারদিকে সব শিশু রোগী, দু’জন বাইরের লোক, ওয়ার্ডের ঐ প্রান্তে দুতিনজন নার্স। ফিনাইল জলের বালতি হাতে ঢুকলো গোঁফওয়ালা মেথর। নিজের সমস্ত মনোযোগ দিয়ে খোকনের কপাল টিপতে টিপতে রোকেয়া এসব ভুলে যায়। খোকনের একটানা গোঙানি হঠাৎ মনে হয় বহু দূর থেকে আসছে। এই গোঙানিতে অকস্মাৎ পরশু সন্ধ্যার হলদে ধানজমি, চাঁদের ময়লা আলোর নিচে বাঁশবন এবং সজনেতলায় গাছের ছায়ায় হু হু করে বাতাস বইতে শুরু করে। এরকম হাওয়ায় চুল উড় উড় হয়ে যায়, এই হাওয়ায় খোকনের কষ্ট কেবল বাড়ে। ‘খোকন, বাবা!’ রোকেয়ার আঙুলগুলো খোকনের তপ্ত কপালে খুব দ্রুত নাচে। খোকনের গোঙানি কি আরো বাড়লো? রোকেয়া একটু জোরেই ডাকে, ‘খোকন!’ কয়েকজন শিশু রোগী তার দিকে দেখে আবার নিজেদের পূর্ব মনোযোগে ফিরে যায়।

রোকেয়ার হাতের তালুর নিচে খোকনের জ্বরের তাপ শুধু বাড়ে। হায়রে, এ্যামনে তো পোলার তামাম শরীরটা ফালা ফালা করছে, অহন জ্বর বাড়বো তো লগে লগে মাথা বিষাইবো, পোলায় আমার ক্যামনে বাঁচে? জলদে পৌঁছানো সেতারীর হাতের আঙুলের মতো রোকেয়ার দীর্ঘ ও ফর্সা আঙুলগুলো খোকনের কপালে খুব দ্রুত কাঁপে। কিন্তু ১০৪° জ্বর খোকনের শরীরে কম্বলের মতো বিছানো, রোকেয়ার আঙুল এই কম্বল ভেদ করে কি করে খোকনকে ঠিক ঠিক স্পর্শ করে?

‘খোকন!’ খোকন তখন বিড়বিড় করে কি বকছে।

‘খোকন।’ রোকেয়া ফের চিৎকার করে উঠলো। খোকন ওর মাকে এক নজর দেখে নিয়ে পাশের রোগীর টেবিলে রাখা ভাঙা কমলালেবু, এক হালি কলা ও এক গ্লাস হর্লিক্স দেখতে থাকে।

মেট্রনকে নিয়ে সিতারা ফিরে এলো। খোকনের গোঙানি এখন খুব স্পষ্ট। গলা থেকে মাঝে মাঝে এ্যা এ্যা ধ্বনি বেরিয়ে একটা নিয়মিত তাল সৃষ্টি করে। মেট্রন বললো ‘আপনি বেডে বসবেন না, সরে আসুন।’ কিন্তু রোকেয়া সরে বসলে কি চলে? খোকনের এখন চোখের রঙ লাল, লাল রঙের বোবা চোখে সে শাদা রঙের শূন্য দেওয়াল দেখছে। ‘খোকন’ রোকেয়া তার গোটা বুকের সব শক্তি উজাড় করে হামলায় ‘খোকন! বাবা আমি আইছি তো! দ্যাখস না? বাবা!’

শূন্য দেওয়াল ছেড়ে খোকন এবার ওর লাল রঙের বোবা চোখ রোকেয়ার মুখে একবার ছুঁইয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিলো পশ্চিমদিকের দরজার ওপারে, ঐ দরজার পর বারান্দা, বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে দুতিনজন আয়া।

.

সিতারা তাড়াতাড়ি কাছে এসে রোকেয়ার হাত ধরে, ‘ভাবী তুমি খালি খালি অস্থির হইছ? খোকনের কি হইছে? কাউলকাও এমনু টাইমে বিছনার উপর খালি ফাল পাইরা উঠছে। এইতো সিস্টার আইছে একটা সুঁই দিবো ঠিক হইয়া যাইবো।’

খোকনের কপাল থেকে রোকেয়ার হাত তুলে নিয়ে মেট্রন বললো, ‘আপনি এখান থেকে সরে বসুন।’

রোকেয়া তবু বিছানায় বসেই থাকে। এবার মেট্রন বিরক্ত হয়, ‘আপনি এখানে বসে কি করবেন?

সিতারাও সায় দিলো, ‘তুমি আর কি করবা ভাবী? এই টুলে বহ।’

সিতারা রোকেয়ার হাত ধরে তুলে নিয়ে তাকে বসিয়ে দেয় একটা টুলে। টুলে বসে খোকনের সমস্ত বিছানাটা আরো স্পষ্ট চোখে পড়ে। এদিকে টুলের ওপর রোকেয়া, মাঝখানে সরু ঠাণ্ডা মেঝে, তারপর বিছানার ওপর তার ব্যাণ্ডেজ নিয়ে, প্লাস্টার নিয়ে, স্যালাইন ওয়াটার ব্যাগ থেকে প্রবাহিত পাইপ নিয়ে খোকন একটানা গোঙায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *