প্রতিশোধ
ইচ্ছা করলে ১০/১২ দিনের ছুটি নেওয়া যেতো। কিন্তু বাবা মারা না গেলে ছুটিগুলো মিছেমিছি নষ্ট হবে। ‘ফাদার সিরিয়াস, কাম শাপ’ মানেই কি আর অবধারিত মৃত্যু? আর ফাইন্যাল কিছু যদি ঘটেই যায় তো ঢাকা থেকেই ছুটি বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। এইসব বিবেচনা করে অসুস্থ পিতাকে দেখবে বলে ১ সপ্তাহের ছুটি নিয়ে ওসমান ঢাকা রওয়ানা হলো। বাবা যদি এর মধ্যে সেরে ওঠে তো সময়টা বরং বাড়ি মেরামতের কাজে লাগানো যাবে।
স্টেশনে এসে শোনা গেলো ট্রেনের এখনো ঢের দেরি। ট্রেন আজকাল বড়ো লেট করে, রোজ কোথাও না কোথাও গোলমাল লেগেই আছে। স্টেশনে শুধু লোক, চারদিকে লোক, ওসমানের চেনাশোনার মধ্যেই পাওয়া গেলো অন্তত ১০/১২ জন। এরা ওসমানের সঙ্গেই চাকরি করে, ৩/৪ জন আশেপাশের জুট মিলের লোক। ওসমানের অসুস্থ পিতার সম্ভাব্য মৃত্যুর কথা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার মাঝে মাঝে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করতে করতে সবাই মিলে খুব গল্প করলো। নানারকম দুশ্চিন্তায় সবাই কাতর : জিনিষপত্রের দাম কি ভীষণভাবে বেড়ে যাচ্ছে; প্রত্যেকটা দিনই কোথাও না কোথাও ব্যাঙ্ক লুট হচ্ছে; ঢাকার কোনো সিনেমা হলে ভালো ছবি চলছে না, কোলকাতার ছবি আসে না কেন? ফরমান আলী-নিয়াজীর ফাঁসি হওয়া উচিত; ঢাকায় সিমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না; ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা অধঃপতনে যাচ্ছে: সিমেন্ট না পেলে ওদের এই প্রজেক্টের কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে; এখন কতো সিমেন্ট দরকার, পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী দেশ জুড়ে সমস্ত পুল, ব্রীজ, রাস্তা, বাড়ি ধ্বংস করে দিলো, সিমেন্ট না পেলে এসব ঠিকঠাক হবে কি করে? এখন ইন্ডিয়া যদি দেয়! ইন্ডিয়া দেবে কি? ইন্ডিয়ার লোকজন এসে যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র, পাট, কাপড়-চোপড়, ধানচাল – সব নিয়ে যাচ্ছে ওপার, লোপাট করে দিলো দেশটা তো শালারা আবার দেবে কি?
প্রথমে পাকিস্তানের ওপর, পরে ইন্ডিয়ার ওপর ওসমানের খুব রাগ হলো। তবে এই সময় ট্রেন এসে পড়ায় ওর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে ট্রেনের ছাদে বসে থাকা, পাদানিতে ঝুলন্ত ও জানলায় জানলায় মুখ বাড়িয়ে দেওয়া, সমস্ত ট্রেনটার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো যাত্রীদের ওপর। ট্রেন দ্যাখা যায় না, ট্রেনের সমস্ত শরীরে কিলবিল করে লোক, শুধু লোক।
এর মধ্যেও ট্রেনে ওঠা গেলো। এয়ার কন্ডিশন্ড কামরার করিডোরে ভীড় করলেও ভেতরে ঢুকতে সাহস পায়নি লোকজন। ঐ কামরা থেকে বেরিয়ে এলো ওদের প্রজেক্টের ৩ নম্বর ডিভিশনের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার; নিশ্চয়ই চট্টগ্রাম থেকে আসছে। এ লোকটি ওসমানদের একজন বস, সুতরাং এর ওপর একটু রাগ হলো। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা করুণ করে মিনমিন করে উঠলো, ‘ঢাকায় যাচ্ছি স্যার, ফাদারের খুব অসুখ। ‘
ট্রেন ছেড়ে দিলে ওসমান চিৎকার করে ওঠে, ‘স্যার চিটাগাঙে কি সিমেন্ট এ্যাভেলেবল?’ স্টেশনের কোলাহল, ট্রেনের আওয়াজে ওর কথা বুঝতে না পেরে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে থাকে। বিপুল জনভারাক্রান্ত ট্রেন হেলেদুলে প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করে।
এয়ার কন্ডিশনড কামরায় মিষ্টি মিষ্টি ১টা গন্ধ পাওয়া যায়। ট্রেন এই চলে, আবার কোনো গ্রামের কাছাকাছি এলে কেউ না কেউ চেন টানে। চেন টানলে ট্রেন থামে, খুব জোরে সুদূর হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ফের চলে, আবার থামে। ১টা স্টেশনে ১জন লোক উঠলে ওসমান সোজা হয়ে বসে, চেকার টেকার নাকি? ওর টিকেট সেকেন্ড ক্লাসের, চেকার শালা আবার খারাপ কথাবার্তা বলবে না তো? লোকটাকে ভালো করে দেখবার পর নিশ্চিন্ত হয়ে সে বাইরে তাকায়। কাঁচের ওপারে গ্রাম, বিল, টেলিগ্রাফের তার, শালিক পাখি, কালো বালক, গোরু, বালসানো গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দগ্ধ বাড়িঘর। ভেতরের ঠাণ্ডা গন্ধটা চেনা চেনা ঠেকে এই গন্ধটা কোথায় পেয়েছে, কোথায় পেয়েছে তাই খুঁজতে খুঁজতে ওর ঘুম পায়। তন্দ্রা, ঘুম ও জাগরণের মধ্যে টলতে টলতে সে তখন ১টা স্বপ্ন দ্যাখে।
এই স্বপ্ন ওসমান প্রায়ই দ্যাখে, প্রায়ই। ওদের প্রজেক্টের যে এলাকা তার শেষ প্রান্তে নদীর ঠিক ধার ঘেঁষে ১টা মস্ত বড়ো ক্রেন। খুব উঁচু ক্রেন, লোহার মই দিয়ে দিয়ে তার একেবারে মাথায় ওঠা যায়। ওসমান এর ১০/১২টা ধাপও ওঠেনি, ৫/৬ ধাপ উঠলেই বড়ো অসহায় মনে হয়, মনে হয় কোনোদিন আর নিচে নামা যাবে না। কাজও ওর এ্যাকাউন্টসে, সুতরাং সখ করে না এলে ওকে এদিকটায় আসতে হয় না। স্বপ্নের ভেতরে ওসমান মই দিয়ে অনেকটা ওপরে উঠে যায়, আর কয়েকটা ধাপ কোনোরকমে ম্যানেজ করতে পারলেই একেবারে চূড়া স্পর্শ করা যাবে। কিন্তু উঠতে উঠতেই হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যায়। পড়তে পড়তে দ্যাখে নিচে মেঘনার পাতালমুখী কালো জল কেবলি নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। স্বপ্নেও না, বাস্তবেও না, ওসমান কোনোখানেই সাঁতার জানে না। ভীষণ ভয় পেয়ে আকণ্ঠ পিপাসায় কাঁটাবেঁধা ঢোঁক গিলতে গিলতে সে কেবল গভীর জলের অন্ধকার স্রোত দ্যাখে। জল দেখতে দেখতেই এখন তার ঘুম কিংবা তন্দ্রা ভেঙে গেলো। প্রতিবার এমনি হয়। পা হড়কে যাওয়ার ২/১ পলকের মধ্যে, মেঘনায় পৌঁছবার আগেই ঘুম ছিঁড়ে স্বপ্নটা ১ টুকরো তুলোর মতো কোথায় যে উড়াল দেয়, কিছুতেই ঠাহর করা যায় না। কোনো কোনোদিন গভীর ঘুমের মধ্যেই সে স্বপ্ন বদল করে।
এই স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের পরও অনেকক্ষণ ট্রেন চলে। কেউ চেন টানলে ট্রেন থামে, ১৫ মিনিট পর ফের চলে। ওসমানের চোখ জোড়া পালা করে করকর করে, একবার বাঁ চোখ, একবার ডান চোখ। বারবার হাই ওঠে, রেলের লোকদের ওপর রাগ হয়, ফের ঘুম ঘুম চোখে লোকজন ও বাইরের গাছপালা দ্যাখে।
জাপাটা গোঁফ, জুলফি ও লম্বা চুলের আড়ালে আনিসের ফর্সা মুখটাকে গাছপালাগুল্ম গজানো শ্বেত পাথর বলে ভুল হতে পারে। ২ চোখ ভরা তেতো আলো নিয়ে ১টা হোন্ডা ঠেলতে ঠেলতে আনিস বাইরে আসছে। এই হোন্ডাটা আগে কখনো দ্যাখা যায় নি, বোধহয় ইদানিং জোগাড় করেছে; তাহলে ওর ভেস্পা কোথায়? আর পুরানা পল্টনের ১ বোম্বেওয়ালার ফোক্সওয়াগন গাড়ি নিয়ে এসেছিলো, সেই গাড়ি কি লোপাট হয়ে গেলো? ওসমানকে দেখে আনিস বললো,
‘হ্যালো, ভাইয়া!’
‘কোথায় যাচ্ছিস?
‘আব্বার মেডিসিন নিয়ে আসি। তোমার ট্রেন কি লেট নাকি?’
‘হুঁ। কোথায় যাবি ওষুধ আনতে?’
‘গুলিস্তান তো যাই। গুলিস্তান বায়তুল মোকাররমে না পেলে মিটফোর্ডের দিকে যেতে হবে। হার্ডলি ওয়ান আওয়ার। তুমি যাও, ঘরে যাও।’
কিন্তু বাড়িতে পৌঁছে ওসমানের মনে হচ্ছে ঘরের চেয়ে বারান্দাই ভালো।
‘আব্বা এখন কেমন?’
‘অনেক বেটার। যাও, ঘরে যাও। ডিলিরিয়ামে আব্বা শুধু তোমার কথাই বলছিলো। যাও।’
ওসমানের তো আরো কথা বলতে ইচ্ছা করে। এতো সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানবার থাকে, কৈ ট্রেনে তো এসব কিছুই মনে পড়েনি।
‘কে দেখছে এখন?’
আনিস হোন্ডায় স্টার্ট দিলো, ‘চার পাঁচদিন আগে নুরুল ইসলামকে কল দেওয়া হলো। সিরাজ শালা ট্রিটমেন্ট ভালোই করে, সিম্পল এম. বি. বি. এস., তবু দ্য বাগার ইজ এ গুড ফিজিশিয়ান। কিন্তু শালা রাত সাড়ে দশটার পর কোথাও যাবে না; মাসখানেক আগে স্বামীবাগে করো হাইজ্যাক করে ওর টাকা পয়সা কেড়ে নিয়েছে, তারপর থেকে রাত্রিবেলা আর কোথাও বেরোয় না।’
আবদুল গনির ঘরের দরজায় পৌঁছলে স্পিরিট, ডেটল, কমলালেবু, ওষুধপত্র ও রোগের মিলিত গন্ধে ওসমানের ভয় ভয় করে। আবদুল গনির দীর্ঘ শরীর জুড়ে নীল রঙের পাতলা কম্বল ধীরে ধীরে ওঠে আর নামে। তার নিশ্বাস নেওয়ার ধ্বনি খুব মৃদু। সারারাত হয়তো তার ভালো ঘুম হয়নি, হয়তো কয়েক ঘণ্টা মাথাব্যথায় কষ্ট পেয়ে একটু আগে চোখ জোড়া বুজেছে। এখন ঘরে ঢুকলে তাকে বিরক্ত করা হবে, এই বিবেচনা করে ওসমান বাথরুমে গেলো।
বাথরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালে চোখে পড়ে বেসিনের ওপর নতুন ১টা তাক দেওয়া হয়েছে, এটা আগে ছিলো না। তাকের ওপর কলগেট টুথপেস্ট, বিদেশী দামী সাবান, শ্যাম্পু, শেভিং ক্রিম, ভাঙা একটা পেয়ালা, ডেটল। এই বোতলটা বোধ হয় আফটার শেভ লোশনের। এসব দামী দামী বিদেশী জিনিস এই বাথরুমে আগে কোনোদিন দ্যাখা যায়নি। বেসিনের সামনে তাকের ওপর এখন ১টা আয়না দেওয়া দরকার। হাসান আলী ওয়ালী ভাইয়ের দোকানটা তো আনিসের বন্ধুবান্ধবই দখল করেছে। ওখানে গিয়ে আলফাজ কি লিটনের সঙ্গে দ্যাখা করলেই একটু কম দামে ভালো বেলজিয়াম গ্লাস পাওয়া যাবে। ঐ সঙ্গে ফরাশগঞ্জে একবার সিমেন্টের খোঁজ করতে হবে। রড, ইঁট সব পড়ে রয়েছে মিছেমিছি, সিমেন্ট না পেলে বাথরুমটায় হাত দেওয়া যাচ্ছে না।
গোসল করলে যে রকম হবে ভাবা গিয়েছিলো সে রকম হলো না। শ্যাম্পু দেওয়ায় মাথার ভেতরটা নির্ভার মনে হয়, কিন্তু ঠিক ফ্রেশ লাগছে না, বরং ঘুম পাচ্ছে। গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে ওপরে নিজের ঘরে একটু গড়িয়ে নেবে—এই ভেবে গেঞ্জির গলায় হাতমুখমুণ্ডু গুঁজে দেওয়ার সময় হঠাৎ মনে পড়ে অসুস্থ বাপের সঙ্গে এখন পর্যন্ত দ্যাখাই করা হলো না।
কিন্তু ঐ ঘরে কারা যেনো এসেছে। আবদুল গনির ডিলিরিয়ামে বিধ্বস্ত কণ্ঠস্বর পুরোনো দরজা খোলার মতো ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ করে। বিছানার বিপরীত দিকে বেতের চেয়ারে আবুল হাশেমের মাথার পেছনটা উঁকি দেয়, আরেকটা চেয়ারে নার্গিস। হাশেমকে দেখে ওসমানের রাগ হলো, এই লোকটাকে কিছুতেই এড়ানো যাচ্ছে না। নার্গিস পরম যত্নের সঙ্গে শাড়ির আঁচলের প্রান্ত খুঁটছে দেখে ওসমানের বুকের লোম শিরশির করে ওঠে। নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে সে খুব যত্ন করে চুল আঁচড়ায়। ডান দিকের কয়েকটা চুল তার পাকা, ৩টে পাকা চুল ঠিকমতো ধরে তুলে ফেলতে লেগে গেলো পুরো ৪টে মিনিট।
চুল আঁচড়ানো ও পাকা চুল তোলার কাজ শেষ করে ওসমান ঘরে ঢুকলে আবদুল গনির কথা শুনতে শুনতেই হাশেম একটু হাসলো। ঢেউ-তোলা ঠোঁট এদিক ওদিক বিছিয়ে নার্গিস ফের গুটিয়ে নিলো। আর ওসমানের হাসি তো তৈরি করা ছিলো দরজার ওপার থেকেই। আবদুল গনির কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ওসমান বললো, ‘আব্বা।’
কিন্তু এইসব সৌজন্যমূলক হাসিতে কোনো ফল হয় না। ঘর যেমন আড়ষ্ট ছিলো, তেমনি রইলো। আবদুল গনির খাটের স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আনিসের ঠোঁটজোড়া একেবারে টাইট করে সাঁটা, কপালে কোঁচকানো রেখা মুণ্ডুর আঁচে তিরতির করে কাঁপে।
আবদুল গনি বড়ো উত্তেজিত, বাজে কথা বলো না, সে কেবল আবুল হাশেমের দিকে তাকিয়েই কথা বলে, ‘হেয়ার স্ট্রিটের বাড়ি আমার দরকার। এরা দুই ভাই বিয়ে-শাদি করলে কি একসঙ্গে থাকবে? আমি কখন আছি, কখন নাই। মরার আগে আমি সব ঠিকঠাক করে না দিলে এরা নিজেদের মধ্যে গোলমাল করবে না?’
‘বেশ তো, আপনার মেয়েকে থাকতে দিয়েছিলেন তো আপনিই। আপনার মেয়ের ছেলেমেয়েই সেই বাড়িতে থাকে; আপনার বাড়ি আপনি ফেরত নেবেন তো কার কি করার আছে?’ আবুল হাশেম নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে কথা বলে। সে বরাবরই স্বাভাবিক স্বরে বক্তব্য কি প্রতিবাদ ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারে।
‘বাড়ি দিয়েছিলাম আমার মেয়েকে, মেয়ের কষ্ট দেখে ভাড়াটে উঠিয়ে দিয়ে তোমাদের থাকতে দিলাম। সেই মেয়েকে তো তুমি মেরেই ফেললে। আমার একমাত্র মেয়ে।’ আবদুল গনির ফ্যাসফ্যাসে গলার ভেতর অসমাপ্ত বাক্য ক্রমে ঝাপশা হয়ে মিলিয়ে যায়।
আনিস খুব শান্ত ও কঠিন ধ্বনি সৃষ্টি করে হাশেমকে বলে, ‘আপনি কি আব্বাকে বিরক্ত করতে এসেছেন?’ তার এই কঠিন ভঙ্গিটি আবুল হাশেমের কাছেই শেখা।
আনিসকে সরাসরি অস্বীকার করে আবুল হাশেম আবদুল গনির চোখে তীক্ষ্ণ তাকায়, তার স্বাভাবিক স্বরে সে বলে, ‘আপনার মেয়েকে আমি মেরে ফেলিনি, আপনার মেয়ে মারা গেছে এ্যাক্সিডেন্টে। আপনার মেয়ে তো আমারও স্ত্রী ছিলো, তাকে আমি মারবো কেন?
ওসমান বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে খুব ঝাঁঝালো একটা জবাব দিলো, কিন্তু মনে মনে, ‘তুমি আমার বোনের মার্ডারার। ঐ নার্গিসকে বিয়ে করার লোভে গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট করিয়ে আমার বোনকে খুন করেছো।’ কিন্তু ওসমানের স্বগতোক্তি অন্যে শুনবে কি করে? প্রত্যেকের মনোযোগ আনিসের ক্ষিপ্ত সংলাপের দিকে, ‘ডোঞ্চু ফিল এ্যাশেমড টু টর্চার এ ডাইং ওল্ড ম্যান?’ আনিসের সাজানো ইংরেজি শুনে মনে হয় অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে এই বাক্যটি গঠন করেছে।
আবদুল গনির চোখের গভীর কোটরে জল জমে ওঠে। শোক কিংবা অপমানের টানে জোয়ার লেগে সেই জল বেড়ে উঠলে মনে হয় তার কপালের নিচে কেউ একজোড়া সমুদ্রের কার্টুন এঁকে রেখেছে। সে তখন একটু একটু ফোঁপায়, ‘আমার কপালের দোষ! আমার কপাল!’
তার এই ক্ষীণ ও ব্যর্থ বাক্যপ্রয়াসের মাঝখানে উঠে দাঁড়ালো আবুল হাশেম। ওসমানের মুখের মধ্যে জিভটা কুগুলি পাকিয়ে হাঁপায়। একটু ফাঁক করেই সে মুখটা বন্ধ করে, ফের ফাঁক করে, ফের বন্ধ করে। সে কেবল ভাবে, এতো উত্তেজিত কথাবার্তার পর লোকে কি করে এমন স্বাভাবিকভাবে উঠে দাঁড়ায়? আবুল হাশেম নার্গিসকে বলে, ‘চলো।‘
তারপর প্রত্যেকের দিকেই একেকবার তাকালো, হাসলো, একটু বিব্রত হাসি, বিব্রত হওয়াটাও ওজন করা, ‘চলি।’
নার্গিস উঠে দাঁড়ালে তার বেগুনী, শাদা ও সবুজ জামদানি শাড়ির খসখস আওয়াজ এবং তার কোনো অন্তর্বাস কি শরীরের মিষ্টি ও ঝাঁঝালো সুবাস ওসমানের নির্ভার করোটিতে ঢুকে শুয়ে থাকে মগজের এক কোণে।
এই নার্গিস হলো আবুল হাশেমের দ্বিতীয় স্ত্রী, প্রথম স্ত্রী রোকেয়ার ছেলেবেলার বন্ধু। ওসমানদের বাড়ির সকলেরই খুব ইচ্ছা ছিলো, এই মেয়েটিই ওসমানের বৌ হয়ে আসুক। ওসমানেরও ছিলো, তবে এজন্য সে সক্রিয়ভাবে কিছু করেনি। জীবনে একবার সে ওয়েস্ট পাকিস্তানে গিয়েছিলো। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ডিপার্টমেন্টের ছেলেদের সঙ্গে। ওসমান সেখান থেকে নার্গিসকে ১টা চিঠি লিখেছিলো সোয়াত কি দীরের বর্ণনা দিয়ে। ১টি মাত্র চিঠি, সেখানে নিজের কথা কিছুই লেখেনি। রোকেয়ার কল্যাণে সেই চিঠির কথা ফাঁস হয়ে গেলে দুই বাড়িতেই একটু হাসাহাসি হয়েছিলো। তো এসব ব্যাপার অনেক আগের।
খাবার ঘরে চা খেতে বসলে আনিসের কপালের স্থায়ী কোঁচকানো রেখাগুলো করোটির তাপে প্রায় বলকাতে শুরু করে।
‘এই লোকটা, এই বেটা হলো নাম্বারি শয়তান। কি অডাসিটি দেখলে? আব্বা নেহায়েৎ সিক, আদারওয়াইজ আই উড হাড গিভন দ্য বাগার এ থরো বিটিং!
এই সংকল্প ওসমানের বহুকালের, ‘টু গিভ দ্যা বাগার এ থরো বিটিং।’ যখন হাশেম আর ওসমানের বোন রোকেয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেরা বিয়ে করলো সেই সময়কার বাসনা। আবুল হাশেম তখন সাংবাদিক, বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও সেই সূত্রে একজন সংস্কৃতিসেবী। বাপ-মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রোকেয়া বিয়ে করলো, কিন্তু বেচারাকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কলতাবাজারের পেছনে নাসিরুদ্দিন সরদার লেনে ড্যাম্প একটা ঘরে বসবাস, ৩টে ছেলে হলো ২ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, বামপন্থী দৈনিক ঠিকমতো মাইনে দেয় না হাশেমকে; বড়ো টানটানি গেছে রোকেয়ার। আবুল হাশেমকে তখন মারতে ইচ্ছা করতো ওসমানের। কি ভণ্ড! এদিকে এলোমেলো পাজামা পাঞ্জাবি স্যাণ্ডেলে চষে বেড়াচ্ছে ঢাকার এমাথা ওমাথা, মুখে সর্বদা দুস্থ দুস্থ ভাব, মস্কো কোলকাতা ছাড়া কথা নেই শালার; সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চা; গণসঙ্গীত ছাড়া কোনো গানই কানে রোচেনা। আবার দ্যাখো, আমার নিরীহ বোনটাকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করলো পরে আবদুল গনি অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা মেনেই নিয়েছিলো, এমন কি নিজের একটা বাড়িও লিখে দিলো মেয়েকে। আবুল হাশেমও বিয়ের ৩/৪ বছর পরই সাংবাদিকতা ছেড়ে দেয়। সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্রের চর্চা করে, ব্যবসা করে সে এখন মস্ত বড়োলোক।
‘দ্যাখো না, শালাকে আমি কি করি! আব্বা একটু সেরে উঠুক, শালাকে আমি একেবারে সাফ করে দেবো, টোটাল এ্যানিহিলেশন!
আনিসের কথা শুনে ওসমানের শরীর জুড়ে সুড়সুড়ি লাগে। কিন্তু ঠিক এ ধরনের সুড়সুড়ি লাগাটা ওর স্বভাবে নেই এর প্রতিক্রিয়াও সে জানে না। তাড়াতাড়ি করে তাই বলে, ‘আব্বাও ঐ রকম না বললেই পারতো। কাউকে খুনী বললে তো তার চটবারই কথা।’
‘আব্বা কি বলেছে?’
আনিস খুব শান্ত হয়ে গেলো। তার কপালে কোনো বলকানো রেখা দ্যাখা যাচ্ছে না। মনে হয় সেখানে ঠাণ্ডা সর জমছে। এই শীতল কপাল দেখে ওসমান অসুবিধায় পড়ে যায়; সে কেবল মিনমিন করে, ‘রোকেয়া তো এ্যাক্সিডেন্টেই মারা গেছে।’
‘হাউ ড ইউ ফিল শিওর এ্যাবাউট ইট?’
উচ্ছ্বসিত পুলকে ওসমান প্রায় দিশেহারা হলেও সে কিছুই বললো না। তার খুব রাগ হলো হাশেমের ওপর। হাশেমকে ফের মারতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এখানে এসব বলা কি ঠিক? আনিস একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। ওকে আবুল হাশেমের ওপর ক্ষেপিয়ে তোলাটা কি উচিত হবে? এর ফলাফল কি খুব মারাত্মক হতে পারে না?
ওসমান তাই বললো, ‘কিন্তু হাশেম যে ইচ্ছা করেই এ্যাক্সিডেন্ট করলো তার প্রমাণ কি?’
‘ভেরি ক্লিয়ার! ভেরি ক্লিয়ার! বাস্টার্ড গাড়ি চালাচ্ছিলো, এ্যাক্সিডেন্ট হলো আর স্টুপিড শালা বেরিয়ে পড়লো গাড়ি থেকে আনহার্ট, আর রাস্তার নিচে পানির মধ্যে পড়ে মারা পড়লো আপা। এই শুওরের বাচ্চার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগলো না, এসবের মানে কি?’
ওসমান কোনো কথা না বলে কেবল ১টার পর ১টা রুটির স্লাইসে ১ বার জেলী ১ বার মাখন লাগিয়ে চালান করে দিচ্ছে পেটের মধ্যে। তার খুব খিদে পেয়েছে।
আনিস বলে, ‘আর এই নার্গিস, দিস হোর, শি ওয়াজ অলসো ইন দ্য কন্সপিরেসি। এই কিলিং এর ব্যাপারে তোমার নার্গিসেরও খুব ইম্পর্ট্যান্ট রোল ছিলো।
‘তোমার নার্গিস’ বলায় ওসমানের গলায় জেলী মাখানো কিন্তু শুকনো এক টুকরা রুটি আটকে গেলো। গলার মধ্যে দিয়ে, তেতো কি মিষ্টি ঠিক ঠাহর করা যায় না, একটি নতুন ধরনের স্বাদ গড়িয়ে পড়ে পেটে। সে খুব ব্যাকুল হয়ে ঢোক গিলে বললো, বলার সময় এক ঠোঁট হাসি খেলিয়ে দিলো, ‘আমার নার্গিস মানে?’
‘সে তো তুমিই ভালো জানো।’
আনিস কি বলছে এসব? নার্গিস একজন ভদ্রলোকের বিবাহিতা স্ত্রী। বিয়ের আগেও নার্গিসের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক ছিলো তাকে কি কোনোভাবেই প্রেম বলা যায়? নার্গিসের সঙ্গে ওসমানের উল্লেখযোগ্য যোগাযোগ সেই ১টি মাত্র চিঠি; সেই চিঠিতে সে শুদ্ধ ও শিথিল বাক্যবিন্যাসে পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের একটি নিসর্গচিত্রের বর্ণনা দিয়েছিলো। এর বেশি আর কি?
‘তুমি একটা এ-ক্লাস কাওয়ার্ড। তোমার সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে হবে, এভরিবড়ি নিউ ইট। তাই না? তোমার বৌকে আরেকজন লোক ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করবে, কিলিং ইওর সিস্টার, আর তুমি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে? এটা কি তোমার ম্যাগনানিমেটি? না কাওয়ার্ডলিনেস? এসব কি?’
ওসমান তখন পাতলা করে পনির কাটে। জানলা দিয়ে তাকালে বাইরে সন্ধ্যাবেলা দ্যাখা যায়, সন্ধ্যার মধ্যে উঠান, উঠানের প্রান্তে লোহার রডগুলো সুরকির স্তূপে মাথা রেখে কালচে রঙ ধারণ করে ঘুমোচ্ছে। বারান্দার লাইটটা জ্বালিয়ে দেওয়া দরকার। এই স্তূপ থেকে বেছে বেছে বেশ মোটাসোটা ১টা রড তুলে নিলে ভালো হয়। এই রডের ১টা আঘাতই যথেষ্ট। খুব জোরে ১টা বাড়ি মারো মাথার ঠিক মাঝখানটায়; করোটি, কোঁকড়ানো চুল সব ভেদ করে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোবে, মনে হবে কালো ঝোপের মধ্যে ১টা ফোয়ারা থেকে লাল রঙের জল বেরিয়ে অকালে সন্ধ্যাকাল ঘটিয়ে দিলো।
পনিরের নোনতা স্বাদে মগ্ন হয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্য, হঠাৎ আনিসের হাত থেকে টেবিলে একটু খয়েরি রঙের তরল রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে ওসমান বড়ো বিচলিত হয়ে পড়লো। মাথা ভালো করে ঝেড়ে সচেতন হয়ে সে চায়ের পটটা নিয়ে নেয় আনিসের হাত থেকে। পট থেকে ঢালতে গেলে তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে আনিস একটু চা ফেলবেই। ওর হাত থেকে পট চেয়ে নিয়ে ওসমান ধীরে সুস্থে ও নিপুণ হাতে চা ঢাললো ২টো পেয়ালায়, চামচ দিয়ে আস্তে আস্তে দুধ চিনি মিশিয়ে ১টা পেয়ালা এগিয়ে দিলো আনিসের দিকে। তারপর বললো, ‘কিন্তু আড়াই বছর হয়ে গেলো, এখন কোর্টে গিয়ে কি হবে?
দুটো কি আড়াইটে চুমুকে সবটা চা শেষ করে আনিস চলে গেলো। দরজার সামনে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে সে একটু টক হাসি ছুঁড়লো, হু বদারস ফর এ কোর্ট? ড্যাম ইট!’ তারপর বাইরে পা দিয়ে ফের পেছনে তাকালো, ‘তোমাকে এসব কথা বলা ইউজলেস। শালাকে সাফ না করা পর্যন্ত আমার রেস্ট নেই, দ্য বাগার মাষ্ট গেট এ্যানিহিলেটেড।’
আনিসের হোন্ডার আওয়াজ মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওসমান চুপ করে রইলো। আনিসের প্রস্থান কানে বাজলে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে ভাবে, ইচ্ছা করলে আনিস এই কাজটা তো আগেই সেরে ফেলতে পারতো; রোকেয়ার মৃত্যুর পর কিছু না করলেও অন্তত নার্গিসকে বিয়ে করবার সময় আবুল হাশেমের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথাটাও ওরা যদি ভাবতো! এই বিয়ের পর আবুল হাশেমের সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্ক প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কেবল এই আনিসটা! মিটিং করতো ইউনিভার্সিটিতে, স্ট্রাইক করতো, এখানে রবীন্দ্র সঙ্গীতের আসর করো, ওখানে আয়ুব খাঁর ছবি পোড়াও, রমনা পার্কে সুন্দরী মেয়েদের পিছে ঘুরে বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ করে বেড়াও—সব ব্যাপারে আবুল হাশেমের সঙ্গে বরাবরই ওর একটা সম্পর্ক ছিলোই। আবার ২৫শে মার্চের পর কোলকাতা পালালে সেখানেও ওর ৮/৯টা মাস কাটলো আবুল হাশেম-নার্গিসের সঙ্গেই। আনিসের কতো বন্ধু বান্ধব এফ্রন্টে ওফ্রন্টে ফাইট করে মারা পড়লো, ক্যাম্পে চাষাভুষার সঙ্গে শুয়ে এইসব ছোটোলোকের ঘাম পেচ্ছাব পায়খানার মধ্যে কি কষ্টই না করলো! কিন্তু আবুল হাশেমের কল্যাণে আনিস কটা মাস প্রতিবাদ সভা ও শোক সভায় যোগদান করে, এখানে কটা মাস লাঞ্চ ডিনার মেরে ও লাঞ্ছিতা মাতৃভূমির জন্য নিবেদিত অশ্রুর সঙ্গে পাঞ্চ করা হুইস্কি জিনের স্বাদে আপ্লুত হয়ে দেশে ফিরলো বিজয়ীর বেশে। গোলমালটা আর মাস তিনেক চললেই আবুল হাশেমের সঙ্গে কোনো ডেলিগেশনের মেম্বর হয়ে ইস্ট ইওরোপটা দিব্যি ঘুরে আসা যেতো।
ওসমানের বলতে গেলে খুবই রাগ হতে লাগলো। প্রতিশোধ নেওয়ার সখ যদি অতোই, তো দেশে ফিলে এসেই সাফ করে দিলি না কেন? সে সময় কে কার খবর রাখে? দূর! এদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না! আবুল হাশেমকে মারতে হলে তার নিজের হাতেই অস্ত্র তুলে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
তবে কোনো আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার তো তার জানা নেই, যা করবার করতে হবে ঐ রড দিয়েই। ওসমানের ডান হাতের ৫টা আঙুল শূন্যে কিসব এলোমেলো লিখলো। তার চোখের সামনে গাঁথা রয়েছে ১টা রড। বেশ বড়ো, ফ্যামিলি সাইজের লোহার রড! বাঃ! এইতো আবুল হাশেমের মাথা ফুঁড়ে দিব্যি ভেতরে ঢুকে গেলো। রুক্ত বেরুচ্ছে ফিনকি দিয়ে; সমস্ত ছাদ, পাখার ব্লেড, ছাদের সিলিং—সব লাল। ওসমান আস্তে আস্তে তার নিজের মাথার তালুতে হাত চাপা দিলো; ১ সেকেন্ড পর শুকনো হাতটা মাথার ওপর থেকে টেনে নিয়ে ঝুলিয়ে দিলো তার পাশে। না, হাত কেবল উঠবো উঠবো করে। বুদ্ধিমানের মতো ওসমান তখন হাতটা রেখে দিলো ওর প্যান্টের পকেটে।
আবুল হাশেম ও নার্গিস চলে যাওয়ার পর, যা হওয়ার কথা নয়, আবদুল গনির শরীর একটু ভালো। জ্বর প্রায় ১.৫০ ডিগ্রী কম, সন্ধ্যার পর খুব ঘুমোচ্ছে; চা টা খেয়ে ওসমান ওর বাবার ঘরেই ১টা ইজি চেয়ার পেতে বসে রইলো। ওর বাবার বুক থেকে মৃদু বাঁশি বেজে চলে একটানা। আবদুল গনি ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরে, তার মুখ থেকে বিড়বিড় শব্দ বেরিয়ে আসে, ‘রোকেয়া!’
‘রোকেয়া’ বলতে পারে, ‘পানি’ বলতে পারে, ‘আল্লা’ কিম্বা ‘ইয়াল্লা’ বলতে পারে। অথবা আবদুল গনির শ্লেষ্মাঘন কণ্ঠ থেকে অর্থহীন ধ্বনি বেরিয়ে এসে ওসমানের ফাঁকা করোটিতে অকারণ তোলপাড় তোলে : নিহত কন্যার শোকে আবদুল গনি নিদারুণ শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
বাপের গায়ের ওপর নীল কম্বল টান টান করে বিছিয়ে দিতে দিতে ওসমান ভাবলো, এখন হাশেমকে পাওয়া যায় কি করে? ওসমান অন্য কাউকে রাখতে চায় না মধ্যে, এসব ব্যাপারে কারো ওপর আস্থা কি রাখা উচিত? এমন কি আনিসকেও কিছু বলাটা ঠিক হবে না। কারণ ১. ডাঁট মারার জন্যে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কোনো অটোমেটিক ফায়ার আর্মস দিয়ে সে আবুল হাশেমকে সাফ করে দিতে পারে; এবং/অথবা ২. রড দিয়ে মানুষ হত্যা করবার সংকল্পের কথা শুনলে সে ওসমানকে ‘খ্যাত’ বলে ঠাট্টা করতে পারে।
সুতরাং : হাশেম, একটু ওপরে চলো তো, তোমার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলাপ করবো – এইসব কথা বলে হাশেমকে নিয়ে সে চলে যাবে ছাদে। রঙ টঙ্ সব আগে থেকে তৈরি থাকবে। সন্ধ্যার পর আকাশ কালো হয়ে সামনের শূন্য জায়গা অপরিচিত হয়ে গেলে ওসমান আবুল হাশেমের মাথায় ১টা বাড়ি দেবে। মারার পর মনে মনে বলবে, তুমি শালা আমার বোনকে মারো। গাড়ি চালিয়ে এ্যাক্সিডেন্ট করো, নিজে দিব্যি বেরিয়ে আসো গাড়ির ভেতর থেকে, গায়ে আঁচড় লাগে না কোথাও, আর নিজের বৌ তালগোল পাকিয়ে মরে। বৌ মরতে না মরতে বৌয়ের বন্ধুকে বিয়ে করে ফেলো।’
অনেক রাত্রি হলেও আনিস ঘরে ফিরলো না। ওসমানের খিদেও পেয়েছে; পাবদা মাছের ঝোল, খাসির গোশতের কালিয়া দিয়ে ভাত খেয়ে ফেললো অনেকটা
খাবার সময় একটুও মনে হয়নি, সিগ্রেট ধরাতেই বুকটা খচ করে ওঠে, তুমি শালা আমার বোনকে মারো!’ ওসমান দিনে ৪টে কি ৫টা সিগ্রেট খায়, কেউ অফার করলে সাধারণত না করতে পারে না। নিজেও কখনো কখনো অন্যদের সিগ্রেট খাওয়ায়। আজ অন্যমনস্কভাবে সে প্রায় ৭টা সিগ্রেট শেষ করেছে। এটা ঠিক নয়। সিগ্রেট ধরিয়ে সে দোতলায় গেলো। দোতলায় ঘর মোটে ২টো, ১টায় সে শোবে; সিমেন্ট পেলে বাথরুমটা কমপ্লিট করা যায়।
ছাদে উঠলে নিচের রডগুলো চোখে পড়ে। কাল সকালবেলা যে করে হোক ফরাশগঞ্জ যেতেই হবে। তারপর নিশ্চিত হয়ে ১টা রড দিয়ে ওর মাথাটা ঠিকমতো ভেঙে সোজা চলে যাবে আশুগঞ্জ। ছুটি শেষ হওয়ার আগেই কাজে জয়েন করলে ক্ষতি কি?
শুরকির উঁচু স্তূপ ও লোহার রডগুলো অন্ধকারে অন্যরকম শরীরে অবস্থান করে। উঠানের পাশে বড়ো চৌবাচ্চায় এখন জল আসছে, আওয়াজ উঠছে ছলছল। চৌবাচ্চার ওপর ঢেউ তোলা টিনের ঢাকনি। নইলে হয়তো চৌবাচ্চার জলে এই ঘরবাড়ি, মেঘ ও চাঁদের, এমন কি ওসমানের ছায়া দ্যাখা যেতো।
সিমেন্ট না পাওয়া যায় তো সন্ধ্যাবেলা কি একটু রাত্রি হলে আবুল হাশেমকে খতম করার কাজটা সেরে ফেলতে হবে এখানেই। সিমেন্ট পেলে কয়েকটা দিন দেরি হবে, বাথরুমটা সম্পূর্ণ করে নিতে ৩/৪ দিন, তারপরই ওকে ডেকে এনে কাজটা সেরে ফেলা চাই।
ছাদের তীরে দাঁড়িয়ে ওসমান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিচের দিকে দেখতে লাগলো নিচে উঠান, সমস্ত উঠান পাকা। বেশ পুরনো বাড়ি, পাকিস্তান হওয়ার পর কোলকাতা থেকে এসেই আবদুল গনি এই বাড়িটা কিনে ফেলে। পরে একতলার সার্ভিস পায়খানা ভেঙে ভালো বাথরুম হলো; উঠানটা আরো বড়ো ছিলো, একদিকে ৩টে ঘর করে সেটাকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, দোতলায় ১টা বাথরুম শুরু করা হয়েছে, সিমেন্টের অভাবে অর্ধেক হয়ে রয়েছে। আগেকার ও এখনকার গঠনে অনেক তফাৎ, নোতুন পুরনো সব নিয়ে বাড়িটাকে বড়ো বেঢপ মনে হয়। ছাদের এই তীরে দাঁড়ালে শুরকির স্তূপের পাশে উঠানকে মনে হয় উঁচু পাড়ওয়ালা পুকুর। এখান থেকে আবুল হাশেমকে ধাক্কা দিয়েও ফেলে দেওয়া যায়। আবুল হাশেম তাহলে ঠিক সুরকির স্তূপের ওপর পড়বে; সুরকির হৃদপিণ্ড স্পর্শ করবে বলে আবুল হাশেম ওর ফর্সা, মোটাসোটা, লম্বা শরীর নিয়ে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হবে।
আবুল হাশেমের এতো বড়ো শরীরটা পাতালমুখী নামে আর ওসমানের ছমছম ভয় করতে শুরু করে। কেবল এই ভয়ে সম্পূর্ণ মগ্ন থাকার ফলেও ওর নিজের পা জোড়া কখন আটকে গেছে চোরাবালির মধ্যে, বেচারা খেয়ালই করতে পারেনি। আস্তে আস্তে ডুবে যায় ওর সমস্ত শরীর, ওপরে তাকালে দ্যাখা যায় একটিমাত্র চাঁদ, সেও আবার তাকিয়ে রয়েছে অন্য দিকে, ঐ দিকে বোধহয় অন্য কোনো গ্রহ। সেই উদাসীন চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চাঁদের সঙ্গে ওর দূরত্ব কেবল বাড়ে। সে ভেতরেই গেঁথে যাচ্ছে কেবল। কিন্তু চাঁদ শালা মেঘহীন আকাশ পেয়ে নিজের অবস্থানের এক চুল পরিবর্তন ঘটাতে চায় না।
আবার দ্যাখো, চোরাবালিতে গেঁথে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ছাদের তীরে ঝুঁকে ফের চকচকে চোখে তারিয়ে তারিয়ে সুরকির স্তূপ দ্যাখে। হঠাৎ বুকের মধ্যে দিয়ে এক ঝুড়ি সুরকি গড়িয়ে পড়লো তার ফাঁকা এ্যাবডোমেনে। বুক, পেট, এ্যাবডোমেন, পাকস্থলী কাঁপিয়ে আওয়াজ ওঠে; ওসমান খুব স্মার্ট যুবকের ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে চলে গেলো পেছনে। আর একটু অসাবধান হলেই সে গড়িয়ে পড়তো ঠিক সুরকির গা ঘেঁষে, উঠানে, একেবারে নিচে। ওসমান তখন বিবেচনা করে দেখলো যে রাত্রিবেলা এই ছাদে না আসাই ভালো। সে জানে নিশীকাল ২য় কি ৩য় যামে পৌঁছলে বড়ো অপরিচিত হয়ে যায়। এরকম অপরিচিত সময়ে রেলিঙহীন ছাদে দাঁড়িয়ে থাকাটা কোনোরকমেই নিরাপদ নয়।
পরদিন সকালবেলা ওসমান বেরুলো সিমেন্টের খোঁজে। ফরাশগঞ্জ শ্যামবাজার চষে বেড়ালো, কোথাও সিমেন্ট নেই। বাথরুমের আয়নার খোঁজে হাসান আলী ওয়ালী ভাইয়ের দোকানে গিয়ে দ্যাখে দরজায় বড়ো বড়ো তালা। বোম্বেওয়ালার দোকান, স্বাধীনতার পর সে ব্যাটা ইন্ডিয়া ভাগলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দোকানটা চালাচ্ছিলো, এখন এদের মধ্যে গোলমাল, ৩টে গ্রুপে ভাগ হয়ে গিয়ে এরা সমস্ত মালপত্র এদিক ওদিক করে দোকানটাই বন্ধ করে ফেলেছে। থাক এখন আয়না না হলেও চলে, আগে সবচেয়ে দরকারী কাজটাই সেরে ফেলা যাক।
ফরাশগঞ্জ থেকে ঘরে ফেরার সময় দারুণ ট্রাফিক জাম। ভাগ্যিস রিকশা নেয়নি। নবাবপুরটা ওয়ান ওয়ে করে দেওয়ায় এই রাস্তার লোড বড়ো বেশি। রিকশাগুলো দাঁড়িয়ে থাকে ৩/৪টে লাইনে, মাঝে মাঝে একেকটা ট্রাক, ঠেলাগাড়ি — জড়োয়া গয়নায় একেকটি মূল্যবান পাথর। এ রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিস নেই, পাড়ার কয়েকজন মস্তান ট্রাফিক ক্লিয়ার করার ভার নিয়েছে। নারিন্দা পুল অতিক্রম করবার পর থেকে ট্রাফিক জাম কমে গেছে, গ্রন্থিটা খুলে যাওয়ায় রাস্তাটা নড়াচড়া করে। রেশন দোকানের সামনে লম্বা লাইন। ত্রিপলে মোড়ানো উঁচু ট্রাক আসছে ১টা, খুব ধীরগতিতে। মোড়ে মোরগ পোলাওয়ের দোকান, ছোটো সাইনবোর্ডে অস্বাভাবিক বড়ো করে লেখা ‘সালাউদ্দিন ভাই হোটেল এণ্ড রেষ্টুরেন্ট।’ সাইনবোর্ডের ওপরের দিকে এক কোণে ১টি মোরগের ছবি আঁকা; এক পায়ে দাঁড়িয়ে সেই মোরগ তার ঠোঁটের ফাঁকে সিগ্রেটের বদল পোলাও ভরা ১টি প্লেট ধরে রয়েছে। প্লেটের পোলাওয়ের ফাঁকে ফাঁকে মুরগীর রান, বুক প্রভৃতি লোভনীয়ভাবে ছড়ানো। হোটেলের সামনের দরজায় মস্ত ডেকচির ঢাকনিটা একটু ফাঁক করে এনামেলের থালায় করে প্লেটে প্লেটে পোলাও তোলা হচ্ছে। ওসমান এই ডেকচি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো। কি সুন্দর গন্ধ! এরই পাশে সস্তা ফলের দোকান। আবুল হাশেম সঙ্গে থাকলে বলা যেতো, দেখি, কলার দাম দেখি।’ তারপর কলা, কয়েতবেল, আতা, টুকরা করে কেটে রাখা নারকেল, বৈঁচি ফলের মালা – এসব দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হাশেমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতো ঠিক শেষ মুহূর্তে। ভালো করে কিছু বোঝার আগেই হাশেমের বড়ো বড়ো চোখজোড়ার ঘন খয়েরি মণিগুলো ঠিকরে বেরিয়ে এসে ওর ফর্সা গালে একজোড়া মার্বেলের মতো টলমল করতো। আবুল হাশেম ওসমানকে কোনো বাধাই দিতে পারতো না। ঐ ট্রাকটা এখনো আসছেই। ট্রাকের কপালে আরবি অক্ষরে ‘ইয়া আল্লাহ্’ ও ‘ইয়া মোহাম্মদ’ লেখা। যে চালায় সে বিরক্তিকররকম দৃঢ় হাতে স্টিয়ারিং ধরে থাকে। রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে ডালপুরি ভাজা হচ্ছে, সন্ধ্যাবেলা এখানে শিককাবাব পাওয়া যাবে। ঐ দোকানের পাশে সরু গলির মাথায় ১ রিকশাওয়ালা রাস্তার ভীড়, মিনিট দশেক আগেকার ট্রাফিক জাম – সমস্ত অগ্রাহ্য করে নিজের রিকশার সিটে বসে ড্রাইভারের সিটে পা রেখে ডালপুরি খাচ্ছে। ঐ ট্রাকটা আসছেই।
ওসমান নারিন্দার পুলের দিকে এগিয়ে গেলো। ট্রাকটা এগোয় বেশ ধীরে। এই ১টা ঠেলাগাড়ির জন্য আরেকটু স্লো করলো, ১টা স্কুটারকে জায়গা দেওয়ার জন্য একটু কাৎ হলো, এই দাঁড়িয়ে পড়লো বাকেরখানির দোকানের ঠিক সামনে। মুখ বার করে ট্রাক ড্রাইভার ১ রিকশাওয়ালাকে ‘আব্বে খানকির বাচ্চা, চোখ দুইটা কার হোগার মইদ্যে রাইখা আইছস বে?’—এই জরুরী প্রশ্ন করে ফের স্টার্ট দিলো। এবার অনেকটা ফাঁকা পাওয়া যায়। একেবারে পুল পর্যন্ত, না আরো বেশি, নন্দলাল দত্ত লেনের মাথা পর্যন্ত গোটা রাস্তায় কেবল ৬টা রিক্সা, ৩টে স্কুটার, ১টা হোণ্ডা, ৪টে সাইকেল, ১টা মেয়ে ও ১২টা লোক। সুতরাং ট্রাকের স্পীড একটু বাড়ে। এইতো সুযোগ! এই জায়গাটায় সিগ্রেট কিনবে বলে দাঁড়িয়ে, ‘পাঁচটা ক্যাপস্ট্যান দাও’—দোকানদারকে এই নির্দেশ দিয়ে আবুল হাশেমকে আলগোছে ১টা ধাক্কা দিলেই হারামির বাচ্চা পড়বে ট্রাকের সামনের ডানদিকের চাকার ঠিক তলায়। শালার একটু ইন্টেলেকচুয়াল, একটু পলিটিক্যাল, একটু কালচার্ড ও একটু কমার্শিয়াল মুক্ত ট্রাকের চাকায় চমৎকার ডিসেকটড হয়ে যাবে।
ওসমান দাঁড়ালো রাস্তার ঠিক মাঝখানে। কিন্তু বড়োজোর ও পলক কি ৪ পলক কি তার একটু কম কি বেশি ঠিক হিসাব করা সম্ভব নয়, কারণ অঙ্কে সে ভালো হলেও এসব ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। যাই হোক, তারপরই সে ছিটকে চলে এলো রাস্তার ধারে। ট্রাকটা তখনো কয়েক হাত দূরে। পুল পার হয়ে ট্রাক অতিক্রম করলে তবে ওসমান দাঁড়িয়ে পড়লো, তার আগে পর্যন্ত সে কিছুই দেখলো না। ডালপুরির দোকানের সামনে সেই রিকশাওয়ালা এখন ডান হাতে চায়ের পেয়ালা ধরে বাঁ হাত নেড়ে নেড়ে কার সঙ্গে সিনেমার গল্প করছে। পোলাওয়ের দোকানের সামনে ডেকচির ঢাকনি হঠাৎ করে অনেকটা খুলে ফেলায় গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে সাইনবোর্ডে আঁকা মোরগের ঠোঁটে ধরে রাখা প্লেটের পোলাও পর্যন্ত সুবাসিত করে দিচ্ছে।
ওসমান একটা রিকশায় উঠে বসলো; এবার সোজা বাড়ি চলো বাবা! এসব রাস্তায় যানবাহন থাকেই, ভীড়ও আছে বেশ, ট্রাকে চাপা পড়বার সম্ভাবনা কম। তবুও ভাবনা চিন্তা করে ও দেখলো যে সাবধান হওয়াই ভালো। কারণ কার মধ্যে কখন কি লোভ জেগে ওঠে কে বলতে পারে?
বাড়িতে ফিরে দ্যাখে বিরক্তি কেটে গিয়ে আনিসের মুখে চাঁদ উঠেছে। আবদুল গনির শরীর অনেকটা ভালো। ইজি চেয়ারে মাথা এলিয়ে ক্লান্ত সুখে সে দরজার বাইরে উঠানের রোদ দ্যাখে। হাতলওয়ালা চেয়ারে আনিস।
ঘোড়াশাল-টঙ্গি ট্রান্সমিশন লাইন তৈরির কাজ চলছে; সেখানে টেন্ডার সাবমিট করা যায় কি না—এই নিয়ে আবদুল গনি ও আনিস খুব সিরিয়াসলি পরামর্শ করছে। আনিস আবুল হাশেমের কথা বললো। আবুল হাশেম যদি মিনিস্টারের সঙ্গে একবার দ্যাখা করে, তাহলেই কাজটা পাওয়া যায়। আবদুল গনি সৌম্য মুখে হাসে। আজ রাত্রে আবুল হাশেমকে ডাকলে ভালো হয়, ওয়া দুই ভাই ওর সঙ্গে বসে একটু খাওয়া দাওয়া করতো, আবদুল গনির দেখেই সুখ। আবুল হাশেম তো বেয়াদব ছেলে নয়; বুড়ো মানুষ কাল জ্বরের ঘোরে কি বলতে কি বলেছে, তাই নিয়ে সে কি আর রাগ করে বসে থাকবে?
‘হাশেম ভাই ঐ টাইপের লোকই না। লেফটিস্ট তো, খুব স্ট্রেট ফরোয়ার্ড লোক। মাঝে মাঝে কথাবার্তা বলে একটু রাফ, কোনো রাখা ঢাকা নেই, যা মনে হয় বলে ফেলে। কিন্তু হার্টটা ভালো।
আনিসের কথায় আব্দুল গনি মাথা নাড়ে, ‘সে তো বটেই। তা না হলে কি আর এতোটা উন্নতি করতে পারে? গুণ আছে, গুণ আছে! কি অবস্থা থেকে স্ট্রাগল করে করে কোথায় উঠেছে, সে কি এমনি এমনি?’
এই লোকটিকে কিছুতেই বাদ দিতে পারে না এরা। কোনোভাবেই না! শুওরের বাচ্চাকে চিরকালের জন্য বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে ওসমানকেই। বড়ো একটি দায়িত্বভার গ্রহণের ভারে ঈষৎ বিনীত হয়ে সোজা উঠানে গিয়ে বেছে বেছে শক্ত দেখে বড়ো ১টা রড নিয়ে সে সোজা ছাদে চলে গেলো।
আবুল হাশেম এলে আনিস আজ নিশ্চয়ই তোয়াজ করবে খুব। টেন্ডারের ব্যাপারটা আছে বলে আবুল হাশেমের পার্টির বিরোধী নেতাদের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা উল্লেখ করে তাদের গুষ্টি উদ্ধার করবে। গল্প করতে করতে রাত হবে একটু। তারপর খাওয়া দাওয়া, খাওয়ার পর ফের একটু গল্প গুজব হবে। ওসমানও যোগ দেবে ওদের সঙ্গে। পলিটিক্সেক্স ওসমানের আগ্রহ কম। কালচার ফালচারও ওর ঠিক জমেনা। তবে করবে, গল্প করাটা কি আর কোনো সমস্যা? আশুগঞ্জের কথা, ওদের অফিসের কথা, সিমেন্ট পাওয়া যায় না, কোলকাতার ফিল্ম আসা উচিত, ফরমান আলী নিয়াজী – একথা সেকথার পর হাশেমকে নিয়ে চলে আসবে ছাদে। ‘একটা কথা আছে, ছাদে চলো, নিরিবিলি বলা দরকার।’ ‘কি ব্যাপার?’ ‘না, একটা সাইড বিজনেস শুরু করবো, একটু পরামর্শ ছিলো, ছাদে চলো।’ এইতো, এসব বললেই আবুল হাশেম সুরসুর করে উঠে আসবে।
ছাদের প্রান্তে ২জনে বসবে। এর আগে, রোকেয়া যখন বেঁচে ছিলো রোকেয়ার সঙ্গে হাশেম কখনো কখনো এখানে বসতো। রডটা হাতে নিয়ে ওসমান গল্প করবে। রড নিয়ে খেলতে খেলতে হঠাৎ, একেবারে অতর্কিতে হাশেমের মাথায় ১ টা লাগিয়ে দাও। অথবা রডের ১টা মাথা যদি ঠিকমতো সেঁধিয়ে দেওয়া যায় ওর মাথার ঠিক মাঝখানটায়, যাকে বলে ব্রহ্মতালু, ঠিক সেখানটায়, তাহলে মুহূর্তের মধ্যে শ্রীমানের অতীত ও ভবিষ্যৎ এসে মিলিত হবে ছোট্ট একটি বর্তমানে এবং শোচনীয়ভাবে স্বল্পায়ু সেই বর্তমান তার নিজেরই রক্তধারার সঙ্গে কোথায় উধাও হবে শালা একবার আঁচও করতে পারবে না।
রডটাকে ছোটোই বলা চলে, হাত দেড়েকের বেশি হবে না, তবে ওজন খুব। সেই রড হতে নিয়ে ওসমান একটু একটু ঘোরায়, কখনো খেলায় তার নিজের মাথার কাছে, কখনো এমনি এহাত ওহাত করে। ঠিকঠাক বসিয়ে দাও একবার। রক্ত উঠবে ফিনকি দিয়ে, হ্যাঁ; রক্ত উঠছে ৩/৪টে ধারায়।
ওসমান এই দৃশ্য কখনো চোখে দ্যাখেনি, সিনেমাতেও না। তবু বেশ বোঝা যায়, তীক্ষ্ণ ধারায় প্রবাহিত হয় রক্ত; মাথার ওপর ঘোলাটে শাদা পাখা লাল হয়ে গেলো। পাখার ঘুরন্ত ব্লেডের কল্যাণে রক্তাক্ত হলো চারদিকের দেওয়াল, গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলো ওসমানের লাশ। বুকের হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে যায় এই দৃশ্য দেখে, সে ওপরে তাকালো।
ওপরে ছাদ নেই, কোনো ছাদ নেই, কেবলি আকাশ। নীল ও নির্লিপ্ত আকাশ। অনেক দূরে দূরে চরে বেড়ায় সাদা মেঘের পাল। সমস্ত আকাশে কোথাও একবিন্দু রক্তচিহ্ন নেই। শরৎকালের নীলচে শাদা রোদে আকাশের নিচেকার নিরাবরণ শূন্যতার একেবারে ভিতটাও দ্যাখা যায়। কোথাও রক্ত নেই। ওসমানের বাঁ হাত চলে যায় ওর নিজের মাথায়। একেবারে শুকনো চুল, হাতটা চোখের সামনে তুলে ধরলে সেখানে হৃদয়, বুদ্ধি, আয়ু, প্রেম প্রভৃতির রেখা প্রখর দুপুর বেলার খরায় খটখট করে।
বিচলিত হয়ে ওসমান একটু ঝুঁকে নিচে দেখলো। খুব ব্যস্ত হাতে তাড়াতাড়ি করে সে ছুঁড়ে ফেললো লোহার রডটা। তারপর দ্রুত পদক্ষেপে নেমে এলো একেবারে নিচতলায়। না, না, এসব ব্যাপারে সাবধান হওয়া ভালো। কখনো কখনো লোভ সামলানো বড়ো কঠিন। কখন কি বাসনা হয় কে বলতে পারে?