অন্য ঘরে অন্য স্বর

অন্য ঘরে অন্য স্বর

‘আমা পানে চাও, ফিরিয়া দাঁড়াও, নয়ন ভরিয়া দেখি।‘ শীতকালের জুড়িয়ে যাওয়া পদ্মানদীতে কোন চরের কুলগাছ থেকে ঝরে পড়ছিলো আধপাকা কুল। সেই শব্দে চোখ মেললে প্রদীপের ঘুমের পাতলা সরের ওপর টুপটাপ ঝরে পড়ে পিসীমার মৃদুস্বরে গাইতে থাকা গানের কথা। প্রদীপের ঘুম ভেঙে যায়। তখন মনে পড়ে, অনেকরাত্রি পর্যন্ত তার ঘুম হয়নি। এপাশ ওপাশ করতে করতে এইতো আধঘন্টাও হয়নি সে ঘুমিয়েছে। ঘুমিয়েছিলো সারাটা বিকাল জুড়ে, তাই রাত্রে শুয়ে শুয়ে ঘুম আর আসে না। এর আগের রাত্রি গোটাটাই কেটেছে জেগে। ইদ্রিসের ঘরে বসে গল্প করতে করতে একেকবার বড্ডো ঘুম পাচ্ছিলো তার, ইদ্রিস বার তিনেক চা করে খাওয়ালো। সকালবেলা এদিক ওদিক ঘুরে গুলিস্তান থেকে বাস ধরে প্রদীপ এসেছে নারায়ণগঞ্জ। ফের নারায়ণগঞ্জে খানিকটা ঘোরা হলো একা একা। লঞ্চে এখানে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা এগারোটা হয়ে গেলো। তখন ইচ্ছে করে শহরটা ঘুরে দেখলে হতো।

শহর সেরকমই আছে। রাস্তা বলতে গেলে একটাই, ১২/১৩ বছর আগে ১৬/১৭ বছর বয়সে যেমন দেখেছিলো, ঠিক তেমনি রাস্তা। রাস্তার দুই দিকে কোনো কোনো মাঠে কি অফিসের সামনে খালি জায়গার এখন নোংরা বস্তি, বস্তিগুলো আগে ছিলো না। বস্তির কালো ন্যাংটো ছেলে-মেয়ে চলন্ত রিকশার বস্তা থেকে গড়িয়ে-পড়া আটা তুলে নিচ্ছে হাতের তেলোয়, নাকের কালচে নোনতা সিকনি সহযোগে তাই গিলছে গোগ্রাসে –এরকম দৃশ্য আগে কেবল বড়ো বড়ো শহরেই কল্পনা করা যেতো। তবে কি এদের সবেধন নীলমণি ঢাকা শহর এক্সটেও করতে করতে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী অতিক্রম করে যাবে?

আড়তে ননীদা নেই। তাকে নতুন দেখে সবাই তৎপর হয়ে উঠবে—এই ভেবে প্রদীপের বাধো বাধো ঠেকছিলো। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।

একজন কর্মচারী বললো, ‘বাবু নাই।’

প্রদীপের কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগ। দেখেই বোঝা যায় ব্যাগের ভেতর কাপড়চোপড়, টুথব্রাশ, শেভিং রেজার, ২/১টা বই। সেই কর্মচারী শালা তবু ‘বাবু নাই’ এই মিতভাষণের পর অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে মাথা নিচু করে হিসাব মেলায়। প্রদীপ ভাবছে তবে এবার ননীদার বাড়িতেই বরং যাই, এমন সময় ১টা রিকশা

এসে দাঁড়ালো আড়তের সামনে। রিকশা থামতে না থামতেই লাফিয়ে নেমে ১৮/১৯ বছরের ২টো ছেলে; না, ১ জনের বোধ হয় আরো কম, গেঁ রেখা দেখে মনে হয় জল খেয়ে মুখ মোছেনি বলে পাতলা সর পড়ে রয়েছে। ওরা ঢুকতেই তোলপাড় পড়ে যায়। হিসাব মেলানো স্বল্পবাক কর্মচারী গদি থেকে উঠে দাঁড়ালো, আসেন আসেন, বসেন।’

‘নাই?’

‘বাবু এট্টু এস.ডু. সায়েবের অপিস গেছে। অক্ষণ আইবো, বসেন।’ গোঁফে-জলের রেখা ছেলেটি বলে, ‘বইসা লাভ? কখন আসে কিছু ঠিক আছে।

‘আমি লোক পাঠাই, বাবুরে ডাইকা আনুক। আপনাগো কথা কইয়া গেছে। বসেন। সে তখন ‘ন্যাপাল ন্যাপাল’ বলে আর্তস্বরে চিৎকার করে এবং নেপাল এলে তাকে পাঠিয়ে দেয় এস.ডি.ওর অফিসে। নেপালচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ক্যাশবাক্সের আড়াল থেকে ‘ডানহিল’ সিগ্রেটের প্যাকেট এগিয়ে ধরে মুখটা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকে। ছোকরা ২টোরই চুল খুব লম্বা ও ফাঁপানো। দীর্ঘ জুলফি। ১টার জাপার্টা গোঁফ আর জুলফির সীমা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন কাজ। আরেকটার গোঁফ এখনো বলতে গেলে গজায়নি। ২জনেরই বেল বটম প্যান্ট; ১টার প্যান্ট নীল রঙের, সামনে পেছনে জোড়া জোড়া পকেট। তার পরনে কারুকাজ করা গলা উঁচু পাঞ্জাবি। গোঁফওয়ালার অজস্র বোতাম খচিত, পকেটে-ফ্ল্যাপ পুরু কাপড়ের শার্ট ও খয়েরি রঙের সিনথেটিক কাপড়ের প্যান্ট। কথাবার্তা যাই বলুক, বাঙাল ছোকরাদের কাপড়ের খুব বাহার। প্রদীপ বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। প্রদীপের দিকে ১বার তাকিয়ে সেই কর্মচারী বললো, ‘বসেন, বাবু আইবো।’

অনেক উঁচুতে কাঠের সিলিঙ, চারদিকে টিনের বেড়া, বেশ মজবুত টিন, টিনের সঙ্গেই কি কায়দা করে কাঠের তাক ঝোলানো হয়েছে। তাকে গণেশের ছোটো মূর্তি; ক্যালেণ্ডারেও গনেশ, গণেশের নিচে কলকাতার কোন ইণ্ডেন্টিং ফার্মের নাম ঠিকানা। এখানকার হার্ডওয়ার ফার্মের নাম লেখা ক্যালেণ্ডারে রবীন্দ্রনাথের ছবি। ছবি তো খুব একটা দিয়ে রেখেছে, জানে নাকি কার ছবি? আরেক দিকে দামী ফ্রেমে বাঁধানো শেখ মুজিবুর রহমান। মাঝামাঝি বাঁশের বেড়া, তার ওপারে মশলার আড়ত, এই ঘরের গন্ধ খুব ভারি, মাঝে মাঝে মিষ্টি ঝাঁঝালো গন্ধওলা বাতাস এসে ঠাসবুনুনী এই গন্ধকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।

পনেরো মিনিটের মধ্যেই ননীদা এলো।

‘আরে কামাল ভাই, আইছ! আমি এট্টু এস.ডু. সায়েবের অফিস গেছিলাম। কহন আইছ?’

ননীদা প্রদীপকে খেয়ালই করেনি।

‘আমি কই আমাগো আইতে কইয়া ননীদা কাইটা পড়লো!’

কামালের কথায় নদীদা হাঁ হাঁ করে ওঠে ‘কি যে কও! কি যে কও! আমি কই তোমরা ব্যস্ত মানুষ, কনফারেন্স লইয়া দৌড়াদৌড়ি করো, কহন আইতে পারো কিছু ঠিক আছে নি?’

প্রদীপের দিকে চোখ পড়তেই ননীদা অবাক হয়ে গেলো, আরে তুই? তুই কহন আইলি?’ একই নিশ্বাসে ননীদা ফের ওদের দিকে তাকায়, ‘কামাল, তোমরা চা খাও।’ তারপর নেপালচন্দ্রকে ধমকায়, ‘চা না দিয়াই আমারে ডাকতে গেলি?

নেপালচন্দ্রের হাতে ১০ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে একই সুরে বলে, ‘অন্নপূর্ণা থাইকা রসমালাই লইয়া আয়।’

দুপুরবেলা রোদে দাঁড়িয়ে টিউবওয়েলের জলে স্নান করে বেগুন ভাজা, পাবদা মাছের দোপেঁয়াজি, আলু বেগুন ট্যাংরা মাছের চচ্চড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা, ইলিশ মাছের সরষেবাটা পাতুড়ি, নতুন আলু দিয়ে রাঁধা কৈ মাছের ঝোল, আলু কপির ডালনা ও ঘন করে রাধা মুগের ডাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে আর নড়াচড়া করা যায় না। বাঙালরা শালা এখনো এতো খায়! বারান্দায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে বৌদির সঙ্গে গল্প করতে করতে প্রদীপের খালি হাই উঠতে লাগলো। কলকাতার গল্প শুনতে বৌদির খুব সখ। গোলমালের সময় সবাই পালালো কলকাতা, ননীদা গেলো আগরতলা। এজন্য বৌদির আক্ষেপের আর শেষ নেই। বারান্দার রোদে বড়ি দিতে এসে পিসীমা ধমক দিলো প্রদীপকে, খালি হাই তোলোস! যা না, আমার ঘরে গিয়া গড়াইয়া ল।

তো একবার গড়াতেই সাড়ে ৬টা পার হয়ে গেলো।

রাত্রে খাওয়ার পর গল্প করতে করতে ননীদা বলে, ‘কিসের বিজনেস? এই দ্যাশে ক্যামনে থাকি? বিজনেস এট্টু যদি ভালো হইছে তো চান্দা লইয়া লইয়া ব্যাকটি পয়সা খসাইয়া লইবো। এই তো একখান টাউন, আধা ঘন্টা হাঁইটা গেলে এই মাথা ঐ মাথা ফালা ফালা কইরা ফালান যায়! আর দ্যাখ, সপ্তার মধ্যে তিনখান চাইরখান কনফারেন্স, সম্মেলন, সমাবেশ লাইগাই রইছে। পয়সা আদায়ের ফন্দি, বুঝলি না? এই ভাই আইবো, ঐ ভাই আইবো, বাপে আইবো, বন্ধু আইবো! আর কি? ছাড়ো, মালপানি ছাড়ো।

কলকাতাতেও তো এরাই, এদেরই রাজত্ব ওখানে। তবে এখানে সবই বড়ো খোলাখুলি, কোনো রাখো ঢাকো নেই। এরাও অবশ্য শিখবে; একটু ভদ্রভাবে চুরি ডাকাতি করা, মানুষ মারা—এখানকার বাঙালিরাও শিখবে, একটা জেনারেশন অন্তত যাক, ঠিক শিখে নেবে। ইদ্রিসও কাল সারারাত ধরে এসব নিয়েই বকবক করলো। গোলমালের সময় ইদ্রিস কলকাতা গিয়েছিলো, তখন থেকে প্রদীপের সঙ্গে আলাপ। লোকটা বড়ো বকবক করে। বেশ তোতলা—’ম’, ‘ব,’ ‘ল,’ ‘র’—এই সব অক্ষর দিয়ে শুরু কোনো শব্দ বলতে চোখে জল এসে পড়ে। তবু শালা যা কথাটা বলে! তোতলা না হলে ঐ সময়ের মধ্যে আরো কয়েক হাজার শব্দ নামিয়ে ফেলতো।

বৌদি বললো, ‘ইণ্ডিয়ায় কিছুই করলা না। আত্মীয়স্বজন বাড়ি-ঘর বানাইয়া জমাইয়া বইলা, তোমারে লড়াইবো কেডা?’

প্রদীপ একটু নিচের দিকে তাকায়, ওরাও সব কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা।

‘আরে যাই কইলেই যাওন যায়, না?’ ননীদা হাই তুলতে তুলতে কথা বললে শেষ শব্দগুলো হঠাৎ খুব জোরে উচ্চারিত হয়। ‘ইণ্ডিয়ায় গেলে ব্যবসা বাণিজ্য হইবো? ইণ্ডিয়া গিয়া খাইবা কি? বৌদি এবার সোজা হয়ে বসে, ‘তো এহানে খালি খাও দাও আর ঘুম পাড়ো। মাইয়াগো পার করতে হইবো না? মাইয়ারে কলেজে পাঠাইতে পারি না, বিয়া দিবা ক্যামনে?’

তারপর প্রদীপের দিকে তাকিয়ে বৌদি অভিযোগ করে, ‘গোলমালের আগে মেট্রিক পাস করলো। তহন তোমার দাদায় কয়, ‘না, পাকিস্তানে ভর্তি করুম না, কলকাতা পাঠাইয়া দেই, দিদির বাড়ি থাইকা কলেজে পড়বো।’ নয়টা মাস আগরতলা থাকলাম; দিদি না, জামাইবাবু না, কেউরো ছায়াও দ্যাখলাম না। পাকিস্তান তো গেলো গিয়া। দ্যাশে আইয়া কলেজে ভর্তিও তো হইলো! কি হইলো? টাকাগুলিন হুদা-হুদি জলে ভাসাইলা। পোলার বয়সের ছ্যামরাগুলিরে তোয়াজ করো, আবার হেইগুলির ডরে মাইয়ায় বারাইতে পারে না। আর কলেজ যাইতে পারবো?’ ননীদার মেয়ের কলেজে যাওয়ার অসুবিধাগুলো দুপুরবেলাই বিস্তৃত শোনা হয়েছে।

ননীদা হাই তুলতে শুরু করলে সবাই গল্প শেষ করে শুতে গেলো।

প্রদীপের শোবার ব্যবস্থা হলো পুরনো দালানে। পুরনো দালানে ৩টে ঘর। ১টা পিসিমার। মাঝখানটা ভাঁড়ার ঘর। এর পরের ঘরে নদীদার ছেলে অমিত, এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে, সে থাকে। অমিত ঢাকার গেছে ক্রিকেট খেলতে। প্রদীপের শোবার ব্যবস্থা হলো অমিতের বিছানায়। নতুন দালানে ননীদা, বৌদি, ননীদার কলেজে ভর্তি হওয়া কিন্তু কলেজে যেতে না পারা মেয়ে ইন্দিরা, ক্লাস এইটে ২বার ফেল করা ছেলে প্রবীর, ক্লাস ফাইভে পড়া মন্দিরা এবং সচচেয়ে ছোটো মেয়ে মীনাক্ষী থাকে! এই নতুন দালান তৈরি হওয়ার পুরনোটা আড়ালে পড়ে গেছে। তা’ বয়সে বয়সে পিসীমাও একটু আড়াল, পিসীমা এখানেই থাকে।

ফর্সা চাদর পেতে দিয়ে গেছে বৌদি। নতুন কাচা মশারি টাঙানো। শীতের সারা বিকাল ঘুমিয়ে উঠে চারদিকে বড়ো ফিনফিনে ঠেকছিলো, তার রেশ এখনো কাটেনি। চাঁদ ওঠা টাইপের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এদের সোনার বাঙলায় ঘরের ভেতরেও চাঁদ ওঠে নাকি? মশারির ফাঁক দিয়ে হাওয়া লাগে এসে। ধোয়া চাদরের জলে-ধোয়া ও রোদে পোড়া সাবানের গন্ধে গলা শুকিয়ে যায়। মাথার কাছে জানলাটা খোলা। জানলার নিচে বারান্দা। পিসিমার ঘরেও বারান্দার দিকের জানলা খোলা। সেখানে থেকে পিসীমার জেগে থাকবার ধ্বনি কানে আসে। শীতের রাতেও ঘরের জানলা খুলে ঘুমানো – এই অভ্যাস ছিলো বাবার। ঠাকুরদারও ছিলো নাকি? নইলে ভাইবোন দুজনেই এই অভ্যাস রপ্ত করলো কোত্থেকে? পিসীমা বাবার মতোই বড়ো জেদী। বাবাও বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়নি। গলায় ক্যান্সার হয়ে মারা গেলো, তবু অনেকদিন পর্যন্ত কথা বলতো জোরে জোরে, একা একা থাকলেই সন্ধেবেলা রুগ্ন কণ্ঠে কীর্তন গাইতো। অসুখ খুব বাড়াবাড়ি হয়ে পড়লে মেজদা এসে এই পিসীমাকে ধরেই রাজী করিয়ে বাবাকে কলকাতা নিয়ে গিয়েছিলো।

সে একটা সময় গেছে প্রদীপের। রাত্রে বাবার সঙ্গে হাসপাতালে থাকা, সারাদিন পায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়া, একটু ভয় পেলেই নার্স ডেকে আনা, বাবাকে পায়খানা পেচ্ছাব করানো— দিনরাত জুড়ে একনাগাড় জড়াজড়ি, লেপ্টালেপ্টি। বাবার মৃত্যুর পর ঝামেলা হয়েছিলো আরো বেশি। শ্লথগতি রক্তের স্রোত উজানে বয়, না ভাটায়, – কিসের অনুকূলে ও কাদের প্রতিকূলে—কিছুই ঠাহর করা যায়নি। বাবার মৃত্যুর পরেকার সেই আড়ষ্ট বুকের খরা স্মৃতিতে প্রদীপের বড়ো তেষ্টা পায়। সে তখন বিছানা থেকে উঠে অমিতের পড়ার টেবিলে পিরিচ দিয়ে ঢাকা গ্লাস ভরা জল ঢকঢক করে খেয়ে শুয়ে পড়ে।

কিন্তু এবার শুয়েছে ধপাশ করে। গুছিয়ে না শোবার ফলে বালিশটা সরে গেলো একটু। বালিশের পাশে, কাঁধের নিচে উঁচু হয়ে থাকা ১টি বস্তু তার শরীরে অস্বস্তি ঘটায়। ভালো করে লেপ টেনে নেওয়ার পরও রেহাই পাওয়া যায় না; কখনো কাঁধের নিচে, একটু সরে এলে শিরদাঁড়ার নিচে সেই বস্তু কেবল আস্তে করে ভোঁতা ভোঁতা খোঁচা দেয়। একবার মনে হলো শরীরের ভেতরেই কোনো রোগ ১টি চারকোণা মাংসের জীব হয়ে একাধ ওকাঁধ করছে।

কিন্তু ব্যাপারটা ভেতরের নয়। প্রদীপ উঠে বসে বিছানা হাতড়ালো। বালিশের ধার ঘেঁষে চাদরের নিচে, তোষকের নিচে হাতড়ে দেখলো টিউমার জাতীয় কিছু নয়, পাতলা একটা বই কুঁকড়ে পড়ে রয়েছে তোষকের নিচে। জানলা দিয়ে বাইরের আলো এসে পড়েছে বালিশের ওপর। ফের শুয়ে স্তিমিত আলোতে চোখের সামনে বইটা মেলে ধরলে নীল রঙের আর্ট পেপারের ওপর ১টি মেয়েমানুষের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১ হাতে তার বেঢপ বড়ো গোলাপী রঙের ব্রামুক্ত স্তনজোড়া মেলে ধরে রূপসী আরেক হাতে তার পেটিকোট সামলাতে ব্যস্ত। পেটিকোটের দড়ি ছিঁড়ে গেছে, পেটিকোট অনেকটা নিচে নেমে যাওয়ায় ফাঁপা থামের মতো উরু বেশ খানিকটা দ্যাখা যায়, কিন্তু আশ্চর্য কোনো নিয়মে পেটিকোটের কোমর থেকে ঝোলানো ছেঁড়া ১ টুকরা ন্যাকড়ার কল্যাণে তার যোনী অদৃশ্য। সবুজ ও গোলাপী রঙের মহিলার পেটিকোটের রঙ হলদে। কিন্তু কাপড়ের ভাঁজ টাজ বোঝাবার জন্য কোথাও কোথাও খয়েরি রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ভাঁজ স্পষ্ট হয়নি, বহুবর্ণ ১টি পেটিকোট সেলাই করা হয়েছে। জানলার কাছে তুলে ধরলে ওপরের লেখা পড়া যায় : জলভরা তালশাঁস’। নিচে ব্র্যাকেটে লেখা ‘নাজমা ভাবীর প্রেমের শাঁস’। শেষ মলাট একেবারে শাদা। আদ্যোপান্ত প্রত্যেকটি পৃষ্ঠার তীরে দুটো ছিদ্র থেকে বোঝা যায় বইটা পিন দিয়ে বন্ধ করা ছিলো। শ্রীমান অমিতকুমারের নিয়মিত ব্যবহারের ফলে পাতাগুলো মলিন। এই অল্প আলোতে ভেতরের লেখা পড়া যায় না। এ বইতে আরো গোটা তিনেক ছবি আছে, ৮/১০ পৃষ্ঠা পর পর ১টি করে ছবি, এগুলো কালো শাদা; কালি ঠিকমতো পড়েনি বলে অস্পষ্ট। একেকটি ছবিতে একেক জোড়া পুরুষ ও মহিলা বেশ জটিল ও অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে যৌন সঙ্গম করে। আলো থাকলে হয়তো আরো স্পষ্ট বোঝা যেতো। যাই হোক, এইসব দেখে প্রদীপ বেশ কাম বোধ করলো। হয় এই কামের বেগে কিম্বা দুপুরবেলা ঐ মস্তান টাইপের ছোকরা দুটো দ্যাখার পর সলিড কিছু পাওয়া গেলো – এই শিহরণে তার সর্বাঙ্গে ছোটো ছোটো ইট পাটকেল ছিটকে পড়ে। আলো জ্বেলে বইটা পড়ে ফেলবে। পড়তে পড়তে বইটার ঠিক ঠিক ব্যবহার করা দরকার। প্রদীপ তাই আলো জ্বালবে বলে নিচে নামবার পথে বিছানায় উঠে বসলো। উঠে বসলো তো নামবে বলেই। কিন্তু নামবার চেষ্টা না করে ভুল করে সে লেপটাকেই আরো জড়িয়ে নিলো। এর ফলে হলো কি, বিছানা থেকে নেমে আলোটা যে জ্বালাবে সে শক্তিটুকু আর রইলো না। ঘাড়ের ওপর খানিকটা ফাঁক রয়ে গেছে সেদিন থেকে সরু শীষের মতো ঠাণ্ডা ঢোকে। পেট, পিঠ, উরুর ওম ও হিম মিশে লেপের ভেতর কি প্রতিক্রিয়া ঘটায়, প্রদীপের একটু একটু ঘুম পায়। ফের ইচ্ছা করে, নেমে আলো জ্বেলে পর্নোগ্রাফিটা পড়ে ফেলি। এরকম দ্বিধার মধ্যে দুলতে দুলতে সে শুয়ে পড়লো। তারপর শীতের থিতিয়ে পড়া পদ্মায় কোন চরের কুলগাছ থেকে আধপাকা কুল ঝরে পড়লে সে বিছানায় উঠে বসে। স্বপ্নের রেশ, ঘুমের রেশ কেটে গেলে বারান্দার আলো বোঝা যায়, পিসীমার গুন-গুন করা ধ্বনি আস্তে আস্তে শব্দ ও সুরে বেজে ওঠে, চাঁচের কেশের চিকন চূড়া সে কেন বুকের মাঝে? পিসীমার গলা এতো মিষ্টি, কৈ কথা বলার সময় তো বোঝা যায় না। ‘সিন্দুরের দাগ আছে সর্বদাই মোরা হলে মরি লাজে।’ এই লাইনটা গাইবার সময় পিসীমা অনেক কারুকাজ বাদ দিয়ে দিলো; ‘সিন্দুরের দাগ’ দুবার বললো না, কিম্বা এই কথাটার পর বঁধু হে’ বললো না। তবু পিসীমার গান ঠিকঠাক গেঁথে যাচ্ছে। যদি গোকুলচন্দ্র ব্রজে না এলো, সখীগো, যদি গোকুলচন্দ্র’—এক গান শেষ হতে না হতেই পিসীমা উৎরে যাচ্ছে অন্য গানে। ‘জীবন আমার বিফলে গেলো, জীবন আমার বিফলে গেলো, কেনো কাজেই লাগলো না গো, জীবন আমার বিফলে গেলো গোকুলচন্দ্র।’ পিসীমার গলা বড়ো ওঠানামা করে, কখনো কখনো কোনো ধ্বনিই কানে আসে না। এইসব উঁচু নিচু শব্দমালা প্রদীপের চোখে টুপটাপ ঝড়ে পড়লে চোখজোড়া হঠাৎ খুব বড়ো ও টাটকা মনে হয়। তার শরীর খুব হাল্কা ঠেকে, পদ্মার জলরাশিতে ভাসমান বাতাবিনেবুর খোসার মতো প্রদীপ কেবল টলমল করে। এরকম হলে ঘরে থাকা বড়ো অসুবিধা হয়। দরজার ছিটকিনি খুলে সে তাই বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

না, বাইরে চাঁদ নেই, বারান্দায় বাল্বের আলো শীতে একটু রোগা। কুয়াশায় ঝাপশা উঠান। উঠানের ওপারে নতুন দালানে ইচ্ছা করলে লঞ্চের কিম্বা জাহাজের কিম্বা আরো ইচ্ছা করলে তিমিমাছের আকৃতি নিয়ে আসা যায়। কিন্তু পিসীমার গান তখন কুয়াশার স্রোতে ও ঢেউয়ে অস্পষ্ট ও অপরিচিত কোনো মাছের মতো ঘাই দিয়ে বেড়ায়; বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই মাছের ঘাই দেখতে বড়ো ভালো লাগছে প্রদীপের।

‘আমি মথুরা নগরে, প্রতি ঘরে ঘরে যাইব যোগিনী হয়ে। হঠাৎ করে গান থেমে গেলে তার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে পিসীমা।

‘প্রদীপ? বারান্দায় খাড়াইয়া তুই কি করস বাবা? তর শীত করে না?’

প্রদীপ কিছুই না বলে পিসীমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

পিসীমা বলে, ‘আয়, আমার ঘরে আয়।’

পিসীমার ঘরে ধুপধুনো ও কর্পূরের গন্ধ।

‘তর ঘুম নাই? রাইতে এহানে খাড়াইয়া রইছস? মন খারাপ করছে?’

‘না পিসীমা, ঘুম আসছে না।’

‘ক্যান? ঘুম আসে না ক্যান?’

‘দুপুরে খুব ঘুমিয়েছি তো।’

‘কৈ ঘুমাইলি? তর বাপেরে দেখছি যহন খুশি ঘুমাইতে পারতো।‘

‘আবার মন হইলেই বিছনা ছাইড়া উইঠা পড়ছে।’

তারপর পিসীমা ফের বলে, ‘তুই কয়দিন থাকবি না? না কাইলই আবার কইলকাতা ছুটবি?’

‘না পিসীমা। পরশু যাবো, আগরতলা যাবো পরশু, আগরতলায় কাজকর্ম যদি ঠিকঠাক চলে তো দুদিন পর যাবো শিলং। কয়েকটা দিন ডিব্ৰুগড়, গৌহাটি এদিক ওদিক করে তারপর কলকাতা।’

‘খালি ঘুইরা ঘুইরা জনম কাটাস! এই না ননী কইলো, তুই কয়দিন আগে দিল্লী আগ্রা বেড়াইয়া আসছস!’

প্রদীপ কাজের নাম করেই অবশ্য ঘোরে। বাবা মারা গেলে মেজদা অনেক খেটে খুটে এখানকার ব্যবসার একটা অংশ গুটিয়ে নিয়ে গেলো। বাবার কন্ট্রাকটারি ছিলো, সেটা আর রাখা যায়নি। ভূষিমালের আড়ত, মশলাপাতির আড়ত, আগরতলায় কাপড়ের দোকান, কিছু ইন্ডেন্টিং—এইসব করে বড়দা, মেজদার সংসার চলে দুধেভাতে, তার নিজেরও দিব্যি চলে যাচ্ছে। আর এমাথা ওমাথা ঘোরাঘুরি—এসব কেউ গছিয়ে দেয়নি তার ওপর, একনাগাড়ে বেশিদিন কোথাও থাকতে ওর অস্বস্তি লাগে। এখন এমন হয়েছে যে কোথাও গেলে পরিচিত লোকজন দ্যাখ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিগ্যেস করে, প্রদীপ, যাচ্ছো করে? আগরতলা এবার না গেলেও চলতো। প্রদীপ নিজেই বললো, ‘মেজদা, আগরতলার এ্যাকাউন্টস খুব ক্লিয়ার নেই। আমি নিজেই বরং একবার যাই। এবার বাংলাদেশ হয়ে যাবো এই চান্সে দেশটাও দ্যাখা হবে।’

পিসীমা বলে, ‘তর খিদা লাগে নারে? রাইতে প্যাট ভইরা খাইলি না ক্যান?’

‘না পিসীমা অনেক খেয়েছি।’

‘অনেক খাইছস?’ পিসীমা ধমকে ওঠে, ‘আমি দেহি নাই, না? জুয়ান মরদ হইছস একখান, খাইবি পক্ষীর আধার। খিদা লাগবো না?’

তারপর পিসীমা মগ্নস্বরে গুনগুন করতে শুরু করে।

ঘরের এদিকে ছোটো কাঠের সিংহাসনে শালগ্রামশিলা। সেদিকে দেখতে দেখতে পিসীমা প্রদীপের দিকে কোনো মনোযোগ দেয় না। কিন্তু তার গুঞ্জন ভালো করে শুনলে বোঝা যায় পিসীমা ঠিক গান করছে না, প্রদীপকে লক্ষ কিম্বা উপলক্ষ করে এলোমেলো বাক্য বুনে যাচ্ছে।

‘তর বাবায় তগো বয়সে কি খাইতে পারতো! তিন সের দুধ না জ্বাল দিয়া মাইরা এক সের বানাইয়া, রামপাল থাইকা কলা আসতো, এই বড়ো বড়ো সাগর কলা, বৌদি আমসত্ত্ব রাখছে সর্বদা, বুঝলি, বৌদির আছিলো লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সেই আমসত্ত্ব দিয়া দুধে কলার মাইখা এই এতোটি ভাত খাইছে।’

পিসীমার ঘরে চন্দনের গন্ধে পাকা কলা ও শশার গন্ধ লুকোচুরি খেলে, এই একবার পাওয়া গেলো তো ফের অনেকক্ষণ কোনো পাত্তা নেই; আবার কোত্থেকে এসে নাকের সামনে খেল দেখিয়ে উধাও হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্যে।

‘প্রদীপ মুড়ি খাইবি?’

প্রদীপ জবাব দেওয়ার আগেই পিসীমা বলে, ‘দাদায় খাইতো, খাটতেও পারতো খুব। বাবায় দ্যাহ রাখছে, আমার বয়স তহন সাত আট বছর; দাদাই তো আমাগো বাপ হইছে। কতো খাইটা খাইটা ব্যবসা করছে, বাবার ঋণ শোধ করছে, কমলাঘাটে আড়ত দিলো, রামপালের জমি ছাড়াইয়া লইলো; দিদিরে, আমারে বিয়া দিছে। দিদি মরলে জামাইবাবু বিয়া করছে পর সবিতারে নিজে গিয়া লইয়া আইছে। ক্যান?-না, সত্মায় যাতনা করবো। মেট্রিক পাস করাইয়া সবিতারে বিয়া দিছে। আমার কপাল পুড়ছে পরে নিজে গিয়া আমারে হাধলো, ‘সাবিত্রি, ল দিদি, তর পোলারে মাইয়ারে লইয়া তর নিজের বাড়িত চল। ঘরে তর রাধাকিষ্ট তরে ডাকছে, ল, বাড়ি চল।’ কিন্তু বাক্য সম্পূর্ণ করবার আগেই পিসীমা কেঁদে ফেলে। কয়েক ঢোক কেঁদে মুখ চোখ একটু গুছিয়ে নিয়ে বলে, ‘দাদায় যে আমার কি আছিলো ক্যামনে কই? আমারে দ্যাখতো, ভাইগ্না ভাগ্নীরে দ্যাখতো আর চক্ষের জল ফালাইতো। দাদার কাছে রইছি, মনে লইছে কি মায়ের কোলে আইছি। আমার কপাল পুড়ছে পর দাদায় মাছ ছাড়লো। কত কইছি, হুনছে না।’

একটানা গদ্যের গুঞ্জরণে প্রদীপ নিজেই একবার তার বাবার কোলে কখনো বা পিসীমার কোলে দোল খায়। এরকম একটানা দুলুনির ফলে চারদিকের রাত্রিকাল লুপ্ত হয়ে যায়, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত শালগ্রামশিলা পাহাড়ের স্মৃতিতে কাঁপে; ছোটো মঞ্চে অষ্টধাতুর রাধাশ্যাম নিজেদের অস্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে পরস্পরকে দ্যাখে। কৃষ্ণের দুষ্টু ঠোঁট ফেটে বেরিয়ে আসে লুকোনো হাসি।

‘চল ঐ ঘরে গিয়া মুড়ি লইয়া আহি।‘

পিসীমার এই আহ্বান বা দরজা খুলে পিসীমার বারান্দায় চলে যাওয়া – প্রদীপ এসব কিচ্ছু লক্ষ করেনি। রাধাকৃষ্ণের নিস্তরঙ্গ ও বিলাসী নয়নের মুগ্ধ তৎপরতায় সে তার মাথার ওপরের ছাদ, পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণের দেওয়াল এবং নিচের মেঝেকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে কেবল দাঁড়িয়েই থাকে। তার টাটকা সদ্যোজাত চোখে কাজলের মতো জমেছে পাতলা এক পরত স্বপ্ন, প্রদীপ এমনকি তাও টের পায়নি।

‘প্রদীপ!’

চমকে উঠে চারদিকের দেওয়াল, ছাদ ও মেঝে যেখানকার যা ঠিকঠাক সাজিয়ে দিয়ে, সমস্ত ঘরময় রাত্রিকাল টাঙিয়ে প্রদীপ বাইরে তাকালো।

বারান্দায় পিসীমা।

‘কি পিসীমা?’

পিসীমা পাশের ঘরের তালা খোলবার জন্য চাবি ঘোরাচ্ছে।

‘ঘরের মধ্যে একলা খাড়াইয়া কি করস? ঘি দিয়া মুড়ি ভাইজা দেই, বইয়া খাইবি আয়।

‘আমার তো খিদে পায়নি পিসীমা। আচ্ছা ভাজো, না হয় একটু খাবো। তুমি খাবে না?’

‘খামু না?’

পিসীমা ফের চাবি ঘোরায়, তালা খুলছে না।

প্রদীপ এগিয়ে এসে বলে, ‘পিসীমা, চাবিটা দাও, আমি দেখছি।’

‘তুই?’ পিসীমার চোখে অবিশ্বাস। ঠিক অবিশ্বাস নয়, অনাস্থা। বাবারও তাই ছিলো। বাবা সকলের জন্যেই খুব করতো, কিন্তু ভরসা ছিলো না কারো ওপর।

‘তুই পারবি ক্যান?’

‘দেখি না!’

‘দ্যাখ!’

অনিচ্ছুক হাতে পিসীমা চাবি তুলে দিলো প্রদীপের হাতে। বাবা হলে কিছুতেই দিতো না। প্রদীপ পিসীমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ারের তালা খোলে। ঘোলাটে আলোতে পিসীমার শাদা ধুতি তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘিয়ে রঙের মনে হয়। পিসীমার শরীরে ধূপ ও শশার মিলিত গন্ধ, মাথায় চন্দনের ড্যাম্প হয়ে যাওয়া লুকোনো সুবাস।

অল্প চেষ্টাতেই তালা খুলে ফেললে পিসীমা বলে, ‘পারলি?’ বলতে বলতে একটু হেসে ফেলে পিসীমা, ‘পারবি না? সইত্য রায়ের পোলায় পারবো না?’

ভাঁড়ার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পিসীমা বলে, ‘কথা যখন উঠাইলি তো কই।’

কথা যে কে ওঠায়!

‘দাদায় কোনো কাম ধরছে তো না সাইরা থামে নাই।‘ আলো জ্বলে উঠতেই তিন চারটে ইঁদুর এদিক ওদিক ছিটকে গেলো। কয়েকটা আরশোলা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করলো। ঘরে পুরোনো ভ্যাপসা গন্ধ। সমস্ত ঘরে ছাই রঙের দাপট।

‘মুড়ির টিন আবার কে রাখছে? একটা জিনিস লইবো, তো রাখনের সময় উল্টাপাল্টা কইরা রাখবো। কি সবাব।’ পুত্রবধূর উদ্দেশ্যে গজগজ করতে করতে পিসীমা মুড়ির টিন উদ্ধার করে। ঘিয়ের শিশি হাতে নিয়ে বলে, ‘তুই চুলাটা ল তো। আমার ঘরে গিয়া মুড়ি ভাজুম, চল।’ প্রদীপের হাতে কেরোসিন স্টোভ, পিসীমার দুই হাতে মুড়ির টিন ও ঘি। দুজনেই ঘরের বারান্দায় এলে পিসীমা বলে, ‘তালাটা লাগাইয়া দে।’

এ্যালুমিনিয়ামের কড়াই ছিলো পিসীমার ঘরেই। কড়াই গরম হলে ঘিয়ের আবদেরে কান্না আস্তে আস্তে ফোঁৎ ফোঁৎ করে ওঠে। বুঝলি, দাদার কুনো কাম ধরছে তো না সাইরা ছাড়ে নাই।’ পিসীমা এখনো তার গল্প ভোলেনি, ‘বুঝলি?’ দেওয়ালের নিচু তাক থেকে চিনির কৌটো পেড়ে পিসীমা পিঁড়িতে বসলো। ‘বুঝলি? একবার, একবার, ঐ ঐহানে এটা কুয়া আছিলো না? কি শীতল জল, জল বড়ো মিষ্টি আছিলো রে, নতুন দালানটা বানাইতে গিয়া ননী কুয়াটা নষ্ট করছে। চাপকলের জল খালি কষটা লাগে।’ ছেলেকে একচোট বকে নিয়ে পিসীমা ফের বলে, ‘আমার হাতে একজোড়া মকরমুইখা বালা আছিলো, একেকটার মইদ্যে দুই ভরি কইরা সোনা, হেই জিনিস অহন তরা কৈ দেখবি? তয়, একখানা বালা তেঁতুল দিয়া মাইজা আমি হাতে লইয়া জল তুলতে গেছি, ওমা! বালা পইড়া গেলো কুয়ার মদ্যে। আমি তহন ছুটো মাইয়া, কাইন্দা মরি। আমাগো সমাও আছিলো তো। হে মায় আবার বাবারে কইবো, বাবায় যদি মারে! দাদায় তহন ইস্কুল থন আইছে, আংটা দড়ি লইয়া ছুইটা না আইসা ফাল দিয়া নামছে কুয়ার জলে। আমারে খালি ধামকি দিয়া কইলো, ‘কান্দিস না, চুপ থাক!’ বালা তুইলা উইঠা সান কইরা খাইতে খাইতে এক্কেরে বেলা পইড়া গেছে।’

মুড়ির রঙ আস্তে আস্তে লালচে হয়। পিসীমা খুন্তি দিয়ে মুড়ি নাড়া-চাড়া করে। প্রদীপ চুপচাপ, সিংহাসনের শালগ্রামশিলা চুপচাপ, নিজেরা নিজেরাই মুগ্ধ রাধাকৃষ্ণ চুপচাপ। দেওয়ালের উঁচু তাকে ফ্রেমের কাঁচের সঙ্গে সেঁটে থাকা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আসন পেতে বসে মৌন হয়ে পিসীমার মুড়ি ভাজা দেখছে। পরমহংসদেবের গা ঘেঁষে নিজের ছাই রঙের ছোটো ছোটো রোমে নিজেই অভিভূত নেংটি ইঁদুর তার পুঁতির মতো চোখ দুটো দিয়ে চারদিকের জগৎ দ্যাখে। ওর ছোট্টো চোখের রেঞ্জে দেওয়াল আসে না, মেঝেও বোধহয় আসে না। নেংটি ইঁদুর পরম তৃপ্তিতে ধান কাটা হয়ে যাওয়া মাঠ থেকে কুয়াশার সঙ্গে উড়ে আসা মুড়ি ভাজার সৌরভে ছটফট করে।

এদিকে পিসীমা গুনগুন করে, ‘যদি গোকুলচন্দ্র ব্রজে না এলো, সখী গো।’ পরমহংসদেবের পোষা নেংটি ইঁদুরের পেছনে পেছনে প্রদীপও মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে।

‘মুড়ি ভাজলে রঙ হইবো এই রহম, তাইলে সেন মুড়ি ভাজা ঠিক হইলো!’ মাঠের ওপার থেকে পিসীমা কথা বললো, ‘বৌমায় দিনরাইত কাম করে, ঝির লগে চিল্লাইবো, ঠাকুররে বকা দিবো। বৌমার কামের ঢকডিল নাই। তহন তগো মুড়ি ভাইজা দিছে, পুড়াইয়া ফালাইছে।’ তাক থেকে রূপোর একটা রেকাবী বার করে মুড়ি ঢেলে পিসীমা প্রদীপের দিকে এগিয়ে দিলো।

‘ল খা।‘

‘তুমি খাবে না?’

‘তুই খা না!’

প্রদীপ জেদ করে, ‘তুমিও খাও!’

‘পাগলা। আমি ক্যামনে খাই? আমার দাঁত আছে নি? মাড়ির দাঁত পইড়া গেছে কুনদিন।’

পিসীমা বসে বসে প্রদীপের মুড়ি খাওয়া দ্যাখে

প্রদীপ, শরীলের কি হাল করছস, ক দেহি। প্রদীপ কোনো জবাব না দিলে পিসীমা বলে, ‘তুই এমুন সাধুর মতো থাকস ক্যামনে প্রদীপ? নাক, মুখ, চোখ এলোমেলো করে প্রদীপ পিসীমার দিকে তাকালো। পিসীমা আপন মনে ফের গুন গুন করে। মুড়ি খাওয়া বন্ধ করে প্রদীপ স্তব্ধ চোখে পিসীমাকে দেখতে থাকে। গুনগুন করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে পিসীমা রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির সামনে ঘুরে ঘুরে হাঁটছে। আবার দ্যাখো, রাধাকৃষ্ণের মূর্তি পেছনে রেখে পিসীমা এখন রামকৃষ্ণদেবের ছবি দেখছে। দেখতে দেখতে পিসীমার মুখ গলে গিয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। মাংস কি জলে পরিণত হলো? জল থেকে কি ধোঁয়া বেরুবে? রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি এদিক ওদিক তাকিয়ে ফাজিল যুবক যুবতীর মতো দরজা দিয়ে কোথায় পালাচ্ছে? শালগ্রামশিলা উড়ে গেলো সিংহাসনে চড়ে, না কোথাও কোনোভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হয়নি, সুন্দর ফ্লাইট। তাকের ওপর পরমহংস বেরিয়ে গেছে তার পোষা নেংটি ইঁদুরটি নিয়ে। মস্ত বড়ো অপরিচিত একটি শূন্যতায় শরীরমুক্ত তরল পিসীমা তার ধোঁয়াচ্ছন্ন কেশরাশি এলিয়ে দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রদীপ একটার পর একটা ঢোক গেলে। মুড়ি খেয়ে জিভ তার শুকনো, গলায় একফোঁটা জল নেই। সেইসব শুকনো ঢোক কণ্ঠ বেয়ে শূন্য বুকে কাঁটার মতো বেঁধে। প্রদীপ চিৎকার করে ডাকে, ‘মা!’

পিসীমা চমকে উঠে বলে, ‘কি হইলো প্রদীপ? কি? ডরাইলি? কি হইছে?’

ইঁটের ভিত্তিতে ফের ফিরে আসে দেওয়াল, দেওয়ালের ওপর চেপে বসে ছাদ। না পিসীমা!’

মঞ্চে আসীন রাধাকৃষ্ণ মুগ্ধ দৃষ্টি প্র্যাকটিস করে। রামকৃষ্ণদেব আসন পেতে বসে খোঁজ করে, পোষা ইঁদুরটা কোথায় গেলো? পিসীমা ঠিক পিসীমা হয়েছে। ঘরের ভেতরে ফিরে এসেছে ঘর, মেঝের জায়গায় মেঝে।

পিসীমা আস্তে আস্তে প্রদীপের মুখে, ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দেয়।

প্রদীপ কেবল পিসীমার ফর্সা গালের কোঁচকানো আঁকিবুকিতে নোনা জলের জোয়ার দ্যাখে।

‘তর ভঙ্গি আছে প্রদীপ, তর ভঙ্গি আছে। আমার ঠাকুরদায় সাধুগো লগে বারাইয়া গেছিলো, মৃদঙ্গ বাজাইয়া খালি হরিনাম লইতো, হরির নাম করতে করতেই পুরীতে গিয়া দ্যাহ রাখছে।’ পিসীমার গলা থেকে গেরুয়া রঙের নোনতা শব্দ বেরিয়ে আসে, ‘তর ভক্তি আছে। তর ভক্তি আছে। তরে লইয়া আমি কি করি?’

‘না পিসীমা, আমার কিছুই হয়নি। যাই শুয়ে পড়ি।’

‘চল, তরে ঘুম পাড়াইয়া দেই।

‘না পিসীমা। হঠাৎ খুব ঘুম পাচ্ছে ভয়

তো। ঘুমের ঝোকে বোধহয়। পেয়েছিলাম।

‘ঘুম পাইছিলো? কি দেখলি? প্রদীপ, কি দেখলি? কইবি?’

পিসীমার আগ্রহ বড়ো তীব্র। প্রদীপ কি দেখলো তাই জানার জন্যে পিসিমার এত লোভ কেন?

কিন্তু প্রদীপ তো কিছুই দ্যাখেনি। পিসীমাকে সে কি বলবে?

অমিতের ঘরের দরজায় এসে প্রদীপ বলে, ‘পিসীমা, তুমি যাও। আমি শুয়ে পড়ি। ভোর বোধ হয় হয়েই গেলো। তুমি যাও।’

ঘরের দরজা থেকে পিসীমা চলে যাওয়ার সময় চন্দনের, শশার, কলার ও কর্পূরের ঝাপশা গন্ধ প্রদীপের নাকের সামনে একবার তুড়ি বাজিয়ে পিসীমার চুলের মধ্যে ডাইভ দিয়ে পিসীমার সঙ্গেই ফিরে গেলো।

.

অমিতের ঘরে খাট, খাটে টাঙানো নোতুন কাচা মশারি, মশারির ভেতর ঢুকলে চারদিকে কেবল মশারির দেওয়াল। বালিশের পাশে রাখা সেই জলভরা তালশাঁশ’ বা ‘নাজমা ভাবীর প্রেমের শাঁস’ কাঁধে ঠেকে গেলে প্রদীপ একটু সরে যায়, আব্বে স্লা তুই আছিস এখনো?’ বইটা ফের খিচাং করলো। তার চেয়ে অমিতের টেবিল থেকে পুরনো কাগজ টাগজ এনে তার ওপর মাষ্টারবেশন করে দিলেই বইটাকে একেবারে ঝেড়ে ফেলা যায়।

কিন্তু এখন বিছানা থেকে নামা অসম্ভব। লেপটা কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে পায়ের কাছে। শালার শীতও গায়ে ঠিকমতো লাগছে না। পাজামার দড়ি খুলে ভেতরে নাড়াচাড়া করতে গেলে কুঁকড়ে থাকা ঠাণ্ডা শিশু হাতে ঠেকে মরা বিছের মতো; সমস্ত গা ঘিনঘিন, ছিনছিল করে ওঠে। তখন ডান হাতটা এনে মাথার কাছে রেখে দেওয়া ছাড়া সে আর কি করতে পারে? বাম হাতটা কোথায় রাখলে ভালো হয়—কিছুতেই বোঝা যায় না। এমন সময় পিসীমার গুঞ্জন বারান্দা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে এসে এ ঘরেও উঁকি দিয়ে যায়, ‘পাগলা, মনটারে তুই বাঁধ। এখন বোধহয় পায়ে এসে এ ঘরেও উঁকি দিয়ে যায়, ‘পাগলা, ভোর হচ্ছে, এই গান যদি ঘরে ভালো করে একবার ঢুকে পড়তে পারে তো তোলপাড় শুরু হবে—এই ভাবনায় কাতর হয়ে নেভবার আগেকার প্রদীপের মতো এই প্রদীপও লাফ দিয়ে উঠে বসলো। খাটে বসেই জানলা বন্ধ করা যায়। এই নিয়মটা ভালো। আবার নামতে হলো না বলে খুশি হয়ে জানলাগুলো সটাসট বন্ধ করে দিলো। জানলার কপাটের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পিসীমার গান ল্যাজ গুটিয়ে বাইরে চলে যায়।

মধ্যরাত্রির এইসব ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে প্রদীপ বিছানার ওপর একেবারে টানটান শুয়ে পড়লো। জানলা বন্ধ করে দেওয়ায় ঘরে এখন নিভৃত বর্গক্ষেত্রে। ঘরের ৪ দেওয়ালের মধ্যে মশারি। মশারির ভেতর চতুষ্কোণ অন্ধকার। তার ৫’ ৪” শরীরের ভেতর থেকে নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের পরিচিত ধ্বনি এসে অন্ধকারে দানা বাঁধতে শুরু করলে প্রদীপ আস্তে আস্তে থিতিয়ে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *