যেখানে দেখিবে ছাই

।।যেখানে দেখিবে ছাই।।

মেস বাড়িতে বেল বাজাতে আকাশ দরজা খুলল। উপমন্যু ঘরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে বললেন “জেলা?”

আকাশ বলল “হ্যাঁ”।

উপমন্যু বললেন “কোন জেলা?”

আকাশ বলল “হুগলী”।

উপমন্যু বললেন “গুড। ইন্টারেস্টিং। তা তোমার বন্ধুরা তোমায় খুব প্র্যাঙ্ক করে বুঝি?”

আকাশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল “ওই আর কী”।

উপমন্যু বললেন “তোমার খাট কোনটা?”

আকাশ একটা খাট দেখাল। উপমন্যু একটা চেয়ার টেনে খাটের সামনে বসে মোবাইল বের করে বললেন “রেকর্ড করতে পারি?”

আকাশ বলল “শিওর”।

“তুমি মিউজিশিয়ান?”

আকাশ বলল “হ্যাঁ স্যার”।

“কিছু হয় রোজগার গান বাজনা করে?”

আকাশ বলল “খুব বেশি না”।

উপমন্যু বললেন “বেশ। আচ্ছা সরাসরি ভনিতা ছেড়ে কাজের কথাতেই আসি। ওই মেয়েটি, কী যেন নাম… হু, জয়িতা, দেখা করেছিলে?”

আকাশের মুখ কালো হল। সে একটু ভেবে বলল “হ্যাঁ স্যার। একদিন”।

উপমন্যু বললেন “কোথায়? চ্যাট শুরু করার ক’দিন পরে?”

আকাশ বলল “ফোরামে”। একটু ভেবে বলল “দু তিন দিন পরেই। কবে ভুলে গেছি”।

উপমন্যু বললেন “তারপরে আর দেখা হয় নি?”

আকাশ মাথা নাড়ল “না”।

উপমন্যু বললেন “কেন? তুমি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। দেখা না হওয়ার কারণ নেই অন্তত মেয়ের পক্ষ থেকে”।

আকাশ বলল “আমরা যেদিন দেখা করলাম সেদিন শুরু থেকেই জয়িতা অন্যমনস্ক ছিল। অন্য কিছু ভাবছিল। আমি যখন বললাম সিনেমা দেখবে, তখন আমাকে কাচু মাচু মুখে “সরি, আমার অন্য কাজ আছে” বলে চলে গেল। আমি নিজেও বুঝতে পারি নি ঠিক কী হয়েছিল ওর। ফোন করেছিলাম, ধরে নি, হোয়াটস অ্যাপ ফেসবুকেও ব্লক করে দিয়েছিল। আমি এখনও জানি না, ঠিক কেন সেদিন ওইরকম অদ্ভুত বিহেভিয়ার করেছিল”।

উপমন্যু বললেন “তারপর?”

আকাশ মাথা নাড়ল “তার আর পর নেই। ওই শেষ”।

উপমন্যু বললেন “এরকম তো হতে পারে, ঘটনাটার পরে তোমার মেয়েটার ওপর এক ধরণের আক্রোশ তৈরী হয়, তুমি মেয়েটাকে স্টক করতে শুরু কর এবং রাগের মাথায় খুন কর”।

আকাশ বলল “না স্যার। আমার এত ক্রাইসিস নেই। আপনি চাইলে আমার হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক চেক করতে পারেন। জয়িতা ওয়াজ বিউটিফুল আনডাউটেডলি, বাট এরকম কোন ক্রাইসিস তৈরি হয় নি আমার মধ্যে যার জন্য জয়িতাকে খুন করতে হবে। ইনফ্যাক্ট সে ঘটনার কিছুদিন পরে আমি একটা স্টেডি রিলেশনেও গেছিলাম। কালিপুজো অবধি টিকেছিল সে সম্পর্কটা”।

উপমন্যু বললেন “তারপর কী হল?”

আকাশ হেসে বলল “ব্রেক আপ। আমার মত লক্ষীছাড়াদের প্রথম প্রথম খুব ইন্টারেস্টিং লাগে, গীটার, গান, জ্যামিং, কিন্তু মেয়েরা অন্য কিছু চায় লাইফ থেকে। তারা চায় আমি সব ছেড়ে ছুঁড়ে তাকেই সময় দিই। এর সঙ্গে না মিশে তার সঙ্গে মিশি। এবং সব শেষে গান টান চুলোয় রেখে একটা সরকারি চাকরি খুঁজি যাতে সে তার বাবার কাছে বুক চিতিয়ে বলতে পারে দেখো বাবা তোমার জন্য একটা ভাল জামাই এনেছি”।

উপমন্যুও হাসলেন। বললেন “তুমি নারীবিদ্বেষী?”

আকাশ বলল “তা নয়, নারীবিদ্বেষী কেন হতে যাব স্যার, নারীরা হল ফাইনেস্ট ক্রিয়েশন অফ গড উইথ আ লিটল ছিট। সমস্যাটা হল আমাকে ওই ছিটটাই টানে”।

উপমন্যু বললেন “জয়িতার খুন হবার কথা শুনে তোমার খারাপ লাগে নি?”

আকাশ বলল “ডেফিনিটলি। শি ওয়াজ এ নাইস গার্ল”।

উপমন্যু বললেন “জয়িতা তোমাকে তার যে ছবি পাঠিয়েছিল সেটা তোমার মোবাইলে এখনও আছে?”

আকাশ বলল “না স্যার। ডিলিট করে দিয়েছি”।

উপমন্যু আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন “ঠিক আছে। আমার কার্ড রাখো। কোন কিছু মনে পড়লে ফোন করব”।

.

উপমন্যু কেষ্টপুরে পৌঁছলেন দুপুর নাগাদ। বাড়িটা চিনতে একটু অসুবিধে হল কিন্তু শেষমুহূর্তে পেয়ে গেলেন। একটা দোতলা বাড়ি। উপমন্যু কলিং বেল বাজালে এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন।

উপমন্যু বললেন “বিনয়বাবু আছেন?”

ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনি?”

উপমন্যু আইডি বের করে দেখালেন “পুলিশ ইনভেস্টিগেটর”।

ভদ্রলোক দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললেন “আসুন। ওঁরা এই খেয়ে উঠলেন”।

দরজার পাশেই সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় গেলেন উপমন্যু। ভদ্রলোক পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। উপমন্যু বললেন “আপনারই বাড়ি?”

ভদ্রলোক বললেন “হ্যাঁ। আমার শালা হন বিনয়”।

উপমন্যু আর কিছু বললেন না। বসার ঘরে একটা চেয়ারে বসিয়ে ভদ্রলোক ভেতরের ঘরে গেলেন। খানিকক্ষণ পরে এক লম্বা ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটা ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর। উপমন্যু উঠে হাত জোর করে বললেন “বিনয়বাবু আমি উপমন্যু। আপনার মেয়ের কেসটা আমিই দেখছি। আপনাকে বেশি বিরক্ত করব না। প্লিজ বসুন”।

বিনয়বাবু খানিকটা বিহ্বল চোখে তার দিকে তাকিয়ে তইলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর সোফায় মাথা নিচু করে বসলেন। উপমন্যু বললেন “আমি অত্যন্ত দুঃখিত এই পরিস্থিতিতে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এলাম। কিন্তু আশা করি আপনিও বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তে সব চেয়ে জরুরি আপনার মেয়ের খুনিকে খুঁজে বের করে তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া”।

বিনয়বাবু কয়েক সেকেন্ড মেঝের দিকে তাকিয়ে বললেন “এনি প্রোগ্রেস অফিসার?”

উপমন্যু বললেন “এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটা সূত্র ধরে আমরা এগোচ্ছি। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি কোন না কোন একটা ক্লু পেয়ে যাব যাতে খুব শিগগিরি কেসটার কিনারা করে ফেলতে পারি”।

বিনয়বাবু উপমন্যুর দিকে তাকালেন এবার। স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন “আপনাদের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আমি জানি, নিশ্চয়ই আপনি কেসটার কিনারা করবেন অফিসার”। বিনয়বাবুর কথা থেমে থেমে আসছিল। বোঝাই যাচ্ছিল ভদ্রলোকের ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে।

উপমন্যু বললেন “শুনলাম আপনি ব্যবসায়ী”।

বিনয়বাবু মাথা নাড়লেন “রঙের ব্যবসায়ী। কিন্তু বিশ্বাস করুন খুব বেশি টাকা আপনাদের দেওয়ার মত আমার নেই। জমানো টাকা যা ছিল, আগের মাসেই…”

উপমন্যু বললেন “না না, আপনি যেটা ভাবছেন সেটা নয়। কলকাতা পুলিশ এখনও এতটা হৃদয়হীন হয়ে যায় নি যে একজন কন্যাহারা বাবার থেকে তাদের টাকা নিয়ে সে কেসের কিনারা করতে হবে। আমি শুধু আপনার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম”।

বিনয়বাবু ঘোলাটে চোখে উপমন্যুর দিকে তাকিয়ে বললেন “ছোট ব্যবসা আমার। মেয়ের চাকরিটা যে কী দরকার ছিল স্যার, তা আর কী বলব। ভাবতেও পারবেন না আমাদের মত ছোট ছোট পরিবারে একজন আরনিং মেম্বার বাড়লে কতখানি লাভ হয়”।

বিনয়বাবু চুপ করে গেলেন।

উপমন্যু বললেন “আপনার স্ত্রী”।

বিনয়বাবু বললেন “ওর সঙ্গে আর কথা বলে কী করবেন। সারাক্ষণ কেঁদে যাচ্ছেন”।

উপমন্যু কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। বললেন “জয়িতা যখন প্রথম কলকাতায় পড়তে এল টাকা জোগাতে সমস্যা হয় নি?”

বিনয়বাবু বললেন “হয়েছিল। ধারদেনা করে পড়তে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়ে নিজেই চাকরি পেয়ে সে সব দেনা শোধ করে দিয়েছিল”।

উপমন্যু বললেন “ওর কোন সম্পর্কের কথা আপনাকে বা আপনার স্ত্রীকে কোন দিন বলেছিল জয়িতা?”

বিনয়বাবু ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

উপমন্যু বললেন “আপনারা হয়ত জানেন না, খুনের কিছুদিন আগে জয়িতার অ্যাবরশন হয়েছিল”।

বিনয়বাবু উপমন্যুর দিকে খানিকটা চমকে তাকিয়েই শান্ত হয়ে গেলেন।

বললেন “ও”।

উপমন্যু বললেন “ওর কোন ছেলে বন্ধু সম্পর্কে কোন দিন আপনাদের কিছু বলেছিল জয়িতা?”

বিনয় মাথা নাড়লেন “না, কলকাতায় আসার পরে আমাদের সঙ্গে ওর খুব বেশি কথা হত না। মাকে ফোন করত বেশি, টাকার দরকার ছাড়া আমার সঙ্গে বেশি কথা হত না”।

উপমন্যু বললেন “বেশ। আপনারা কতদিন থাকবেন এখানে?”

বিনয়বাবু বললেন “যত তাড়াতাড়ি কেসটার সুরাহা হবে”।

উপমন্যু বললেন “সেক্ষেত্রে আমাকে আপনার স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলতে হবে বিনয়বাবু”।

বিনয়বাবু মাথা নিচু করে সোফা থেকে উঠে পাশের ঘরে গেলেন।

.

খানিকক্ষণ পরে বিনয়বাবু তার স্ত্রী কৃষ্ণাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন।

কৃষ্ণাদেবীর চোখমুখে স্বামীর থেকেও বেশি শোকের ছাপ।

চোখের তলায় কালি, চোখ ফুলে গেছে।

উপমন্যু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “আমি ভীষণ দুঃখিত ম্যাডাম এই সময়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসতে হল, কিন্তু আমি নিরূপায়। আশা করি আমার অসহায়তাটা আপনি বোঝার চেষ্টা করবেন”।

কৃষ্ণাদেবী কোন কথা না বলে বসলেন। বিনয়বাবু বললেন “বুঝতেই পারছেন অফিসার ব্যাপারটা যত সংক্ষিপ্ত করা যায়, তত ভাল”।

উপমন্যু মাথা নাড়লেন, “ডেফিনিটলি। আমি নিজেও একজন মেয়ের বাবা বিনয়বাবু। আপনাদের মানসিক অবস্থা একটু হলেও বোঝার ক্ষমতা আমার আছে”।

বিনয়বাবু স্ত্রীর দিকে তাকালেন। কৃষ্ণাদেবী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বললেন “বলুন আপনার কী জানার আছে”।

উপমন্যু একটু থেমে বললেন “মেয়ের সঙ্গে আপনার কেমন কথা হত?”

কৃষ্ণা বললেন “রোজ রোজ হত না তবে এক দু দিন পর পর হত”।

উপমন্যু বললেন “মেয়েকে শেষ কবে দেখেছিলেন?”

কৃষ্ণা বললেন “মাস তিনেক আগে বাড়ি এসেছিল। তখনই”।

উপমন্যু বিনয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন “জয়িতা যে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকত সে বাড়ির কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?”

বিনয়বাবু মাথা নাড়লেন “না”।

উপমন্যু বললেন “আপনারা দুজন কাউকে সন্দেহ করেন?”

বিনয়বাবু বললেন “জয়িতা যখন শিলিগুড়িতে ছিল, ক্লাস ইলেভেনে একটা ছেলে ওকে অ্যাসিড বাল্ব ছুঁড়ে মারার হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু সে ছেলে এখনও শিলিগুড়িতেই থাকে। বিয়ে থা করেছে। কলকাতায় আমি ওর কোন বন্ধুকেই তেমন চিনতাম না। তাই সেভাবে বলতে পারব না”।

কৃষ্ণা বললেন “আমাদের কোন কথা বললে তো। মেয়ে চিরকালই বড্ড চাপা। আমাকে ফোন করলেও খুব বেশি কথা কোন দিনই বলত না’।

উপমন্যু চিন্তিত মুখে বিনয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন “জয়িতার ফোনের সব ডেটা মুছে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তার অনেক খানি রিকভার করেছি। গত সাত আটদিনে কোন উড়ো ফোন বা চিঠি পেয়ে ছিলেন আপনারা?”

দুজনেই মাথা নাড়লেন।

উপমন্যু বললেন “আপনাদের যদি আমাকে কিছু বলার থাকে তবে বলতে পারেন। মনে রাখবেন যত বেশি কিছু আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবেন, জয়িতার খুনীকে ধরতে আমাদের তত বেশি দেরী হবে”।

বিনয়বাবু বললেন “তা কেন অফিসার? আপনার কনট্যাক্ট নাম্বার তো আমাদের কাছে থাকবে, যদি পরে মনেও কিছু পড়ে তবে আপনাদের অবশ্যই ফোন করে বলব”।

উপমন্যু বললেন “জয়িতার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে আপনাদের কখনো কথা বা দেখা হয়েছে?”

কৃষ্ণা বললেন “আমি আপনাকে বললাম না, মেয়ে আমাদের ভীষণ চাপা। ও যদি মনে করত কোন কথা আমাদের বলবে না, তাহলে শতবার জানতে চাইলেও কিচ্ছু বলত না”।

কৃষ্ণা কাঁদতে শুরু করলেন, “আমি জানি কোন ছেলেই ওর এই হাল করেছে। চিরটাকাল মেয়েটার উপর অনেকের নজর। সবাই বলত তোমার মেয়েটা কত সুন্দর। সেই সুন্দর হওয়াটাই কাল হল…”

বিনয়বাবু ক্লান্ত গলায় বললেন “কাগজে খবর বেরিয়েছে। আমাদের এলাকায় সবাই বারবার ফোন করছে। এত সহানুভূতিও আমি আর নিতে পারছি না। একটাই মেয়ে আমাদের। জোর করল কলকাতায় গিয়ে পড়াশুনো করবে। আগে পিছে না ভেবে ধার করে পাঠালাম। চাকরি পেল যখন তখন মনে হল আমাদের পরিশ্রম সার্থক। কিন্তু এ ঘটনা আমাদের সব কিছু ওলট পালট করে দিয়ে গেল। আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বনই যে চলে গেল। খবরটা পেয়ে কীভাবে যে কলকাতায় ছুটে এলাম আমরা দুজন তা আমরাই জানি। আপনিই বলুন, মেয়ের বাবা মা হওয়া কি আজকের দিনে অপরাধ অফিসার?”

উপমন্যু অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরালেন। বললেন “এই বাড়িতেও তো জয়িতা থাকতে পারত। তা না করে পেয়িং গেস্টে থাকতে গেল কেন?”

বিনয়বাবু চারদিকে তাকিয়ে বললেন “ও কিছু সমস্যা ছিল। আমার দিদির ছেলে…”

উপমন্যু বললেন “ওহ। বুঝলাম। আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার মেয়ে আপনাকে জানিয়েছিল সে প্রেগন্যান্ট”?

কৃষ্ণাদেবী মাথা নিচু করে দুদিকে মাথা নাড়ালেন।

বিনয়বাবু বললেন “প্লিজ অফিসার, এসব প্রশ্ন এখন থাক”।

উপমন্যু উঠলেন “ঠিক আছে। কোন কথা মনে পড়লে আমায় ফোন করবেন প্লিজ। আমি এলাম”।

.

উপমন্যু কেষ্টপুর থেকে যখন বেরোলেন দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়েছে। ড্রাইভার দেবু বলল “অফিসে যাব?”

উপমন্যু বললেন “নাহ। ধাপার মাঠের দিকে চ একবার”।

দেবু অবাক হয়ে বলল “ধাপার মাঠ?”

উপমন্যু অন্যমনস্ক গলায় বললেন “হ্যাঁ। চিংড়িহাটা পেরিয়ে স্পিড কম করবি, আমি বলে দেব কোন জায়গা থেকে লেফট টার্ন নিতে হবে”।

দেবু আর কোন প্রশ্ন না করে গাড়ি স্টার্ট দিল। উপমন্যু মোবাইলের নোটপ্যাড বের করে নিজের মনে বেশ কয়েকটা নাম লিখে আবার কেটে দিলেন।

অফিস ছুটি হবার সময়। রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ছে। উপমন্যু গাড়ির জানলার বাইরে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বললেন “এই সময়ে জয়িতা কল সেন্টারে ঢুকত। ঘটনার দিন কোথায় ছিল? আসিফ এখনও ফোন করল না তো আমাকে?”

উপমন্যু আসিফের নম্বরে ফোন করলেন। ফোনটা বেশ কয়েকটা রিং হবার পর ফোন তুলল আসিফ “হ্যালো”।

উপমন্যু বললেন “তোমার সকালে ফোন করার কথা ছিল আসিফ”।

“হ্যাঁ স্যার, অ্যাকচুয়ালি অফিস থেকে ফিরে এত টায়ার্ড থাকি যে…”

“ওকে। তোমাকে বেনিফিট অফ ডাউট দেওয়া যায়। আজ তোমার কী ডিউটি”?

“আজকেও নাইট স্যার”।

“বেশ। এক কাজ কর, তুমি সোনার বাংলা হোটেলের কাছে চলে এসো। কসবা থেকে তো বেশি দূর হবে না”।

“ইয়ে মানে… কেন স্যার”?

“এমনি, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে। চলে এসো। চিন্তা কোর না, বেশিক্ষণ আটকে রাখব না। ইজিলি নাইট ডিউটি ধরতে পারবে। জলদি এসো। আমি লেক টাউন ক্রস করছি”।

আসিফকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলেন উপমন্যু।

জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। শহর বদলাচ্ছে। ক্রাইমের প্রকৃতিও। এই প্রজন্ম বড় দ্রুত আত্মীকরণ করে নিচ্ছে নতুন পদ্ধতি। এর সঙ্গে যদি তাদের তদন্ত পদ্ধতি না বদলায় তবে অপরাধী সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে প্রচুর সমস্যা তৈরী করবে।

কন্ট্যাক্ট লিস্ট ঘেঁটে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন উপমন্যু। একটা রিং হতেই ওপ্রান্ত থেকে ফোন তুলল “হ্যাঁ স্যার। ভাল আছেন?” গলাটা তেলতেলে। উপমন্যু হাসলেন। বললেন “তুমি কেমন আছো বিল্টু?”

“ভাল না স্যার। অনেকদিন আপনি কোন কাজ দিচ্ছেন না। কী করে ভাল থাকি বলুন তো?”

“তা ঠিক। তা বিল্টুবাবু, তোমাকে যে এক খান কাজ করতে হবে”।

“নিশ্চয়ই স্যার। এতো ভারি ভাল কথা বললেন স্যার। কাকে ফলো করতে হবে?”

“আপাতত একটা বাড়ির ওপর নজর রাখতে হবে। ঢাকুরিয়ায়। দিন রাত, চব্বিশ ঘন্টা। কে আসছে, কে যাচ্ছে সব ছবি তুলে আমাকে হোয়াটস অ্যাপ করতে হবে। পারবে?”

“হ্যাঁ স্যার। কেন পারব না? আপনি ব্যাস আমাকে বাড়ির ঠিকানা পাঠিয়ে দিন। আর ইয়ে স্যার…”

“বলে ফেল”।

“পেমেন্ট আজকাল পেটিএমেও নিচ্ছি”। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল।

উপমন্যুও হাসলেন, “আমি প্রাচীনপন্থী। পেমেন্ট ক্যাশেই করব। তিন দিন আগে নজর রাখো, তারপর দেখছি”।

“ওকে স্যার। আপনি যেমন বলবেন। কোন জোরাজুরি নেই স্যার”।

ফোনটা রেখে ঢাকুরিয়ার বাড়ির ঠিকানা বিল্টুকে হোয়াটস অ্যাপে পাঠালেন উপমন্যু। দেখলেন আসিফ ফোন করছে তাকে। ধরলেন “বল আসিফ”।

“স্যার, ইয়ে মানে বলছি আজকে না গেলে হত না? একটু কাজ ছিল আজ”।

উপমন্যু বললেন “কেন বল তো? রুহি বারণ করল তোমাকে?”

আসিফ ঘাবড়ে গিয়ে বলল “না না সেরকম কিছু না স্যার। আসলে বুঝতেই তো পারছেন, রুহী বাচ্চা মেয়ে, একটু ভয় পেয়ে যাচ্ছে”।

উপমন্যু বললেন “রুহী বাচ্চা মেয়ে, তুমি বাচ্চা ছেলে, কিন্তু তোমরা যেটা বুঝতে পারছ না, সমস্যা যদি কিছু থেকেও থাকে, আর তোমরা নির্দোষ হও, তাহলে যত তাড়াতাড়ি আমার কাছে উগড়াতে পারবে, তত তোমরা নিশ্চিন্তে থাকবে। নইলে সমস্যা দুজনের ক্ষেত্রেই বাড়বে। বুঝতে পারছ আমি ঠিক কী বলতে চাইছি”?

আসিফ বলল “হ্যাঁ স্যার, বুঝতে পারছি, আমি বেরচ্ছি এখনই। বেশি দেরী হবে না স্যার”।

উপমন্যু ফোন রাখলেন। উল্টোডাঙা পেরিয়ে গাড়ি ধীর গতিতে এগোচ্ছে। ই এম বাইপাসে জ্যাম আছে। উপমন্যু বিরক্ত মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

#

আসিফ সুপুরুষ। চোখে মুখে একই সঙ্গে ক্লান্তি এবং ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। উপমন্যু আসিফকে ফোন করে ধাপার রাস্তার মুখে আসতে বলেছিলেন। আসিফকে অনেকটা হেঁটে আসতে হল।

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নামছে চারদিকে। শহরের বুকে অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত।

উপমন্যু বললেন “তোমাকে খানিকটা হাটালাম। কিছু মনে করলে না তো?”

আসিফ বলল “না স্যার। ঠিক আছে”।

উপমন্যু বললেন “এখানে এসেছ আগে?”

আসিফ বলল “না স্যার”।

উপমন্যু বললেন “ঠিক তো?”

আসিফ বলল “হ্যাঁ স্যার। আসি নি”।

উপমন্যু বললেন “চল, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাক। ক্রাইম সীনটা ডিসকাস করি”।

আসিফ একটু চমকাল। তবে উপমন্যুর সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল।

.

“আসিফ”।

“হ্যাঁ স্যার”।

“খুনটা এই জায়গার কাছে পিঠেই হয়েছিল”।

উপমন্যু একটা সিগারেট ধরালেন। আসিফ কোন কথা বলল না।

উপমন্যু বললেন “জয়িতা তোমার কেমন বন্ধু ছিল আসিফ?”

“ভাল বন্ধু স্যার”।

“তুমি জানতে জয়িতা প্রেগন্যান্ট ছিল?”

কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর আসিফ বলল “হ্যাঁ স্যার”।

উপমন্যু বললেন “কে ছিল এর পেছনে, সেটা জানতে?”

আসিফ বলল “না স্যার”।

উপমন্যু সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন “কিছুই জানতে না অথচ জয়িতাকে তুমি আর রুহি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে অ্যাবর্ট করাতে?”

আসিফ বলল “সব কথা আমাকে রুহি বলে না স্যার”।

উপমন্যু বললেন “তুমি রুহিকে ভালোবাসো?”

আসিফ আবার একটু থমকে বলল “হ্যাঁ”।

উপমন্যু বললেন “রুহির বাড়ি থেকে মানবে?”

আসিফ বলল “মানবে না। স্বাভাবিক”।

উপমন্যু বললেন “তোমার বাড়ি থেকে?”

আসিফ বলল “সমস্যা হবে”।

উপমন্যু বললেন “তোমরা ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলে আসিফ। আমি তোমার থেকে অনেক বেশি ইনফরমেশন এক্সপেক্ট করি জয়িতা সম্পর্কে। কী লুকোচ্ছ বলতো? কে প্রেগন্যান্ট করেছিল জয়িতাকে? অনীশ?”

আসিফ বলল “জানি না স্যার। বিশ্বাস করুন”।

উপমন্যু বললেন “রুহি জানে? সেক্ষেত্রে রুহিকে থানায় ডাকতে হবে”।

আসিফ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল “দেখুন স্যার, কাজের ক্ষেত্রে জয়িতা আমাদের বন্ধু ছিল বটে কিন্তু জয়িতার মেলামেশা শুধু আমাদের সঙ্গেই ছিল না। অনেকের সঙ্গেই ওর সম্পর্ক ছিল। ইনফ্যাক্ট জয়িতা ঠিক আমাদের মত ছিল না”।

উপমন্যু উৎসুক হয়ে বললেন “সেটাই তো জানতে চাইছি। কেমন ছিল জয়িতা?”

আসিফ খানিকটা কুঁকড়ে গিয়ে বলল “জয়িতা একটু ছেলেঘেষা টাইপ ছিল। মাঝে মাঝে একটা পাগলামি গ্রাস করত ওকে। ইনফ্যাক্ট… ওকে নিয়ে আমার আর রুহির মধ্যেও একবার ভুল বোঝাবুঝি তৈরী হয়েছিল”।

উপমন্যু বললেন “আচ্ছা? কেমন ভুল বোঝাবুঝি?”

আসিফ অস্বস্তি মাখা গলায় বলল “জয়িতা মাঝে মাঝেই কারণে অকারণে আমাকে জড়িয়ে ধরত। রুহি সেটা নিতে পারত না। ওর ধারণা ছিল জয়িতা ইচ্ছা করেই করে। আমি জয়িতাকে একবার আলাদা করে বোঝাতেও গেছিলাম, কিন্তু জয়িতা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল বন্ধুদের মধ্যে এসব হতেই পারে। এতে এত চাপ নেবার কিছু নেই”।

উপমন্যু বললেন “জয়িতা সুন্দরী ছিল। তোমাকে জড়িয়ে ধরলে তোমার শরীর জাগত না আসিফ?”

আসিফ খানিকটা ঝাঁঝ দেখিয়ে বলল “এ কেমন কথা বলছেন স্যার”?

উপমন্যু ঠান্ডা গলায় বললেন “কাম অন আসিফ, তুমিও পুরুষ মানুষ আমিও পুরুষ মানুষ। একজন সুন্দরী নারীর সাহচর্য তোমার পৌরুষকে জাগাত না, আমাকে বিশ্বাস করতে বোল না”।

আসিফ গোঁ ধরা গলায় বলল “ওসব আপনার হতে পারে, আমার হয় না। আমি রুহিকে ছাড়া কারো কথা ভাবতে পারি না”।

উপমন্যু সিগারেটটা ফেলে পায়ের তলায় পিষতে পিষতে বললেন “ভালোবাসা আজকের দিনে আছে? স্ট্রেঞ্জ। ক’টা বাজে এখন আসিফ?”

আসিফ খানিকটা রাগী গলায় জবাব দিল “সাড়ে ছ’টা। আমি কি এখন ছুটি পেতে পারি?”

উপমন্যু বললেন “ছুটি আমরা সবাই চাই আসিফ। কিন্তু ছুটি পাওয়া কি এতই সহজ? দেখো না, প্রতিটা ক্রাইমের পর আমরা প্রার্থনা করি, এটাই শেষ ক্রাইম হোক। কিন্তু হয় কি? হয় না? মানুষ যতদিন আছে, ততদিন ক্রাইম থাকবে। যতদিন ক্রাইম থাকবে, ততদিন কারো ছুটি হবে না। আচ্ছা, অনীশ সম্পর্কে তোমার কী মতামত?”

আসিফ বিরক্ত গলায় বলল “বড়লোকের বখাটে ছেলে। জয়িতাকে বিরক্ত করত। জয়িতা ওকে একেবারেই পাত্তা দিত না”।

উপমন্যু শিষ দিতে দিতে বললেন “জয়িতার চাকরিটা অনীশ ব্যবস্থা করে দিয়েছিল জানো?”

আসিফ বলল “জানি। তবে জয়িতা যথেষ্ট ডিজারভিং ছিল। অনীশ ব্যবস্থা না করলেও জয়িতা চাকরিটা নিজের যোগ্যতাতেই পাওয়ার ক্ষমতা রাখত”।

উপমন্যু বললেন “অনীশ কীভাবে বিরক্ত করত জয়িতাকে?”

আসিফ বলল “অফিসেও চলে আসত মাঝে মাঝে। জয়িতাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অবান্তর কথা বার্তা বলত”।

উপমন্যু বললেন “তোমাদের শিফট ইনচার্জ কিছু বলতেন না?”

আসিফ বাঁকা হেসে বলল “অফিসের মালিকের ছেলেকে বলবে, কার ঘাড়ে দুটো মাথা আছে?”

উপমন্যু চিন্তিত গলায় বললেন “হু… চল তোমাকে তোমার মেসে ছেড়ে দিয়ে আসি”।

আসিফ বলল “তার দরকার হবে না। আমি চলে যাব”।

উপমন্যু বললেন “আহ। চলই না। কোন সমস্যা নেই। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি ঢাকুরিয়া যাব”।

.

গাড়ি রুবির কাছে পৌঁছতে আসিফ একটু ইতস্তত করে বলল “আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন স্যার”।

উপমন্যু বললেন “কেন? তোমার মেসে গেলে প্রবলেম আছে কোন?”

আসিফ বলল “মানে স্যার পুলিশের গাড়ি দেখলে পাড়ার লোক একটু অন্য রকম কিছু ভাবতে পারে আর কী”।

উপমন্যু মাথা নাড়লেন “রাইট। দেবু, ওকে নামিয়ে দিস রুবির মোড়ে। আচ্ছা আসিফ, আমি ভুলে গেছি, তোমার কি রোজ নাইট থাকে?”

আসিফ মাথা নাড়ল “না, এই তো নেক্সট ফ্রাইডে থেকে বি শিফট আছে”।

উপমন্যু বললেন “বাড়িতে কে কে আছে তোমার?”

আসিফ বলল “তিন ভাই, দুই বোন”।

উপমন্যু বললেন “কী করে তিন ভাই”?

আসিফ বলল “ছোট ভাই স্কুলে পড়ে। বড় দুজনের একজন একটা রাবার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে, আরেকজন টোটো চালায়”।

উপমন্যু বললেন “রুহিকে বিয়ে করার পরে রুহি তোমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে?”

আসিফ মাথা নিচু করল। উত্তর দিল না।

উপমন্যু বললেন “প্রবলেম হল লাভ স্টোরিগুলো যখন শুরু হয় তখন কেউ সামনে পিছনে ডাইনে বায়ে দেখে না। সমস্যা শুরু হয় এর পরে। আশা করি তোমার গল্পটা ঠিক ঠাক হবে”।

আসিফ এবারেও উত্তর দিল না। উপমন্যু বললেন “রুহির ফ্ল্যাটে তুমি গেলে ওর অ্যাপার্টমেন্টের বাকি লোকজন আপত্তি করে না?”

আসিফ খানিকটা চমকে উঠেই বলল “আমি যাই না সেভাবে স্যার”।

উপমন্যু বললেন “সেভাবে তো যাও না, কোন ভাবে তো যাও। গেলে কিছু বলে না”।

আসিফ বলল “না, সেরকম কোন সমস্যা এখনও হয় নি”।

রুবির মোড় এসে গিয়েছিল। দেবু গাড়ি সাইড করল। উপমন্যু বললেন “সাবধানে যেও। কোন রকম কোন কথা মনে পড়লে আমাকে ফোন করবে। মনে রেখো, সাপ্রেশন অফ ফ্যাক্ট কিন্তু তুমি নির্দোষ হলেও সন্দেহের তীর তোমার দিকেই নিয়ে যাবে। আশা করছি তুমি যথেষ্ট ইন্টেলিজেন্ট সেটা বোঝার জন্য”।

আসিফ বলল “মনে থাকবে স্যার”।

আসিফ নেমে গেল গাড়ি থেকে। উপমন্যু বললেন “ঢাকুরিয়া চ দেবু। দেখি ওখানে আবার নতুন কোন আপডেট এল নাকি”।

#

আধঘন্টা লাগল ঢাকুরিয়া পৌঁছতে। উপমন্যু গাড়ি থেকে নেমে কলিঙ বেল বাজালে বিশ্বজিৎবাবু দরজা খুলে দিলেন।

উপমন্যু হাসিমুখে বললেন “ওহ আপনি এসে গেছেন? যাক ভালই হল”।

বিশ্বজিৎ দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন “হ্যাঁ। এই মাত্র এলাম। চা চলবে তো অফিসার?”

উপমন্যু বললেন “হ্যাঁ। তা চলবে। আচ্ছা নীলম ফিরেছে?”

বিশ্বজিৎ বললেন “হ্যাঁ। ফিরেছে ঘরে আছে”।

উপমন্যু বললেন “আমার নীলমের সঙ্গে একটু দরকার ছিল। ওকে ডাকা যাবে?”

বিশ্বজিৎ বললেন “শিওর স্যার। ডেকে দিচ্ছি। আপনি বসুন”।

উপমন্যু ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখলেন সুশান্তবাবু কাগজ পড়ছেন। বললেন “কী খবর আপনার? শরীর টরীর ঠিক আছে তো?”

সুশান্তবাবু বললেন “তা ভাল, কিন্তু মানসিকভাবে ভাল নেই বুঝতেই পারছেন। যে বাড়িতে এমন কান্ড হয়, সে বাড়ির মালিক ভাল থাকে কী করে?জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এ কেমন একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে গেল বলুন তো?”

উপমন্যু হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বললেন “ওসব নিয়ে একবারেই চিন্তা করবেন না আপনি। এত বড় শহরে এসব অনেক জায়গাতেই হয়। আর জীবনের শেষপ্রান্ত কী বলছেন? বিদেশীরা আপনার বয়সে জীবন শুরু করে বুঝলেন?”

সুশান্তবাবু হেসে বললেন “তা ঠিক বলেছেন। তবে কী জানেন তো, বয়স হয়েছে তো, শরীরের কলকব্জাগুলি মাঝে মাঝেই বিদ্রোহ করে ওঠে। সব সামলে সুমলে ওঠা বড়ই সমস্যা আর কী”।

উপমন্যু বললেন “ডাক্তার দেখান আপনি নিয়মিত?”

সুশান্তবাবু বললেন “বার্ধক্যের সব সমস্যা কি আর ডাক্তার ঠিক করতে পারে বলুন?”

উপমন্যু বললেন “তা ঠিক”।

নীলমকে নিয়ে বিশ্বজিৎ ঘরে ঢুকলেন। উপমন্যু বললেন “আমি নীলমের সঙ্গে আলাদা করে একটু কথা বলতে চাই। কোন ঘর পাওয়া যাবে?”

বিশ্বজিৎ বললেন “আমাদের ঘরেই কথা বলতে পারেন। আসুন না”।

উপমন্যু নীলমের দিকে তাকালেন। নীলমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল।

উপমন্যু বললেন “ভয়ের কিছু নেই মা। রুটিন দুটো প্রশ্ন করেই আমি চলে যাব। তুমি চিন্তা কোর না”।

নীলম আর কিছু বলল না।

বিশ্বজিতের ঘরে তমালিকা টিভি দেখছিলেন। বিশ্বজিৎ বলতে বাইরে চলে গেলেন। নীলম আর উপমন্যু ঘরে ঢুকলেন। উপমন্যু বললেন “প্রশ্নটা তোমাকে থানায় ডেকেও করা যেত কিন্তু তোমাকে বিব্রত করতে চাই নি। বস।”

নীলম খাটের ওপর বসল। উপমন্যু একটা চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন “স্কুল গেছিলে আজ?”

নীলম মাথা নাড়ল।

উপমন্যু বললেন “দেখো নীলম, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি বাচ্চা মেয়ে, আমার মেয়েরই কাছাকাছি বয়স তোমার, তুমি হয়ত জানো না, পুলিশের কাছে তথ্য লুকোলে ঠিক কী কী সমস্যা হতে পারে”।

নীলম মাথা নিচু করল।

উপমন্যু বললেন “তুমি কালকে বললে জয়িতার সঙ্গে তোমার খুব বেশি বন্ধুত্ব ছিল না, অথচ তোমাদের মধ্যে এত কম বন্ধুত্ব ছিল যে তোমরা গড়পঞ্চকোট চলে গেলে?”

নীলম একটু চুপ করে থেকে বলল “আমার কিছু করার ছিল না স্যার। জয়িতা এক রাতে এসে খানিকটা জোর করেই আমাকে নিয়ে যেতে চায়। অনীশ বলে একটা ছেলে ওকে খুব ডিস্টার্ব করছিল। ও একা যেতে চায় নি, তাই আমার সাহায্য চায়”।

উপমন্যু বললেন “সেটা আমাকে আগে বললে না কেন?”

নীলম বলল “এসব কথা কী করে বলি স্যার”?

উপমন্যু বললেন “হু। ডিটেলসে বল সেদিন কী হয়েছিল”।

.

নীলম একটু চুপ করে থেকে বলল “এই বাড়িতে আমি আর জয়িতা এক সঙ্গেই পিজি হিসেবে এসেছিলাম। আমি শুরুতেই কারো সঙ্গে সব কথা খোলাখুলি বলতে পারি না। জয়িতাও যথেষ্ট রিজার্ভ ছিল প্রথম দিকে। দেখা সাক্ষাৎ হলে সামান্য হাসি এবং প্রত্যুত্তরে হাসি ছাড়া আর কিছুই হত না। তবে যেহেতু দুজনেই উত্তরবঙ্গের, তাই খানিকটা নিজেদের প্রয়োজনেই কথা বলতে হত। জয়িতার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে কারোরই আমার খুব বেশি পরিচয় ছিল না বা আমি সেসব জানার জায়গাতেও যাই নি কোন দিন। কলকাতায় আমি খানিকটা একাই ছিলাম, যতদিন না আমার আর রোহিতের সম্পর্কটা শুরু হয়”।

উপমন্যু বললেন “রোহিত? তোমার বিশেষ বন্ধু?”

নীলম উপমন্যুর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল “হ্যাঁ। আমার বিশেষ বন্ধু। রোহিত মিশ্র। আমার স্কুলের অ্যাকাউন্টান্ট। রোহিত অবাঙালি”।

উপমন্যু বললেন “বেশ। বলে যাও”।

নীলম বলল “মাস তিন চার আগে রোহিত আর আমি এক রবিবারে এক রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করছিলাম। সে সময়ে জয়িতা এক ছেলেকে নিয়ে সেখানে আসে। আমার সঙ্গে ওখানে খুব বেশি কথা হয় নি তবে এ বাড়িতে ফেরার পর রাতের দিকে জয়িতা আমার ঘরে নক করে। আমি অবাক হলেও কিছু বলি নি। জয়িতার মেয়েলি কৌতূহল ছিল বলতে পারেন। কত দিনের প্রেম, ছেলে কী করে ইত্যাদি জানতে চায়। আমিও ওর সঙ্গে আসা ছেলেটির ব্যাপারে জানতে চাই। জয়িতা জানায় সেরকম কেউ নয়, ওরা বন্ধু, এই পর্যন্তই”।

উপমন্যু বললেন “ছেলেটার নাম কী মনে আছে তোমার?”

নীলম একটু ভেবে বলল “মনে পড়ছে না স্যার”।

উপমন্যু মোবাইলটা বের করে একটা ছবি বের করে নীলমের দিকে দেখিয়ে বললেন “এই ছেলেটা?”

নীলম মাথা নাড়ল “না”।

উপমন্যু বললেন “বেশ। বল তার পরে?”

নীলম বলল “এরপরে একটু একটু করে জয়িতা আমার ঘরে আসা শুরু করল। বেশ কিছুদিন পরে আমার কাছে এসে এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিল”।

উপমন্যু বললেন “গড়পঞ্চকোট যাবার?”

নীলম উপমন্যুর দিকে তাকিয়ে বলল “হ্যাঁ। আমাকে বলল একটা ছেলে যে নাকি খুবই পাওয়ারফুল, সে জয়িতার সঙ্গে…”

নীলম চুপ করে গেল।

উপমন্যু বললেন “তোমাদের দুজনকে নিয়ে যেতে চাইল যাতে ও ওখান থেকে এসকেপ করতে পারে?”

নীলম মাথা নাড়ল।

উপমন্যু বললেন “রোহিতও রাজি হল ওখানে যেতে? কোন প্রশ্ন করল না?”

নীলম খানিকটা ইতস্তত করে চুপ করে রইল।

উপমন্যু বললেন “আচ্ছা থাক এর উত্তর দিতে হবে না। আমি বুঝে নিলাম দুজনে নিভৃতে থাকতে পারবে এরকম কোন জায়গার খোঁজ আগে থেকেই করছিলে। জয়িতার প্রস্তাব তোমাদের কাছে হাতের চাঁদ হয়ে আসে”।

নীলম এবারেও নীরব রইল।

উপমন্যু বললেন “সেখানে গিয়ে কি তুমিও জানতে পারলে জয়িতা প্রেগন্যান্ট ছিল?”

নীলম বলল “হ্যাঁ”।

“আসতে পারি?”

চায়ের কাপ হাতে দরজায় তমালিকা দাঁড়িয়ে। উপমন্যু বললেন “অবশ্যই। আসুন আসুন। চায়ের আগমন। এ তো ভারি ভাল কথা”।

তমালিকা ঘরের মধ্যে ঢুকে একবার নীলমের দিকে তাকিয়ে উপমন্যুর দিকে তাকিয়ে বললেন “কোন সমস্যা নেই তো?”

উপমন্যু তমালিকাকে বললেন “বসুন প্লিজ। আপনি এলেন ভালই হল”।

তমালিকা নীলমের পাশে বসলেন। বললেন “বলুন”।

উপমন্যু বললেন “আপনি জানতেন জয়িতা প্রেগন্যান্ট ছিল”?

তমালিকা এক মুহূর্তের জন্য চমকে স্বাভাবিক হয়ে বললেন “না।”।

উপমন্যু একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন “আপনার সঙ্গে জয়িতার বেশ হৃদ্যতা ছিল শুনেছি”।

তমালিকা বললেন “ছিল। তবে এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলে নি কোন দিন। আমি এটা শুনে বেশ অবাক হলাম বলতে পারেন”।

উপমন্যু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন “অবাক হবার মতই ব্যাপার। আপনার অফিসের খবর কী ম্যাডাম?”

তমালিকা অবাক হয়ে বললেন “কেন বলুন তো?”

উপমন্যু বললেন “এমনিই জানতে চাইলাম। সৌজন্য বলতে পারেন”।

তমালিকা বললেন “ঠিক আছে। সেরকম কোন সমস্যা নেই আর কী”।

উপমন্যু বললেন “আচ্ছা জয়িতার সম্পর্কে এমন কোন তথ্য আপনাদের কারো মনে পড়ছে যেটা আমাকে বলা প্রয়োজন বলে মনে করেন?”

তমালিকা নীলম মুখ চাওয়া চাউয়ি করল চকিতে। উপমন্যু বললেন “এখনই বলতে হবে বলছি না, তবে ফোন করতে পারবেন। আমি হয়ত কালও আসব এখানে”।

তমালিকা বললেন “হ্যাঁ নিশ্চয়ই”।

উপমন্যু চুপ করে চা খেয়ে যেতে লাগলেন। তার ফোন বেজে উঠল। দেখলেন শংকরবাবু ফোন করছেন। উপমন্যু চায়ের কাপ সামনে রাখা টেবিলের ওপর রেখে ফোনটা ধরলেন “হ্যাঁ বলুন শঙ্করবাবু”।

“আপনি ব্যস্ত আছেন? একটু কথা বলা যাবে?”

“সেরকম কিছু নই। বলতে পারেন”।

“বলছি আজ একবার দেখা হতে পারে অফিসার?”

“শিওর। বলুন কোথায় দেখা করতে চান”।

“আমাদের একটা ক্লাব আছে। নাম শুনেছেন হয়ত। আমি লোকেশনটা আপনার মোবাইলে পাঠাচ্ছি। আপনি এলে ভাল হত”।

“অবশ্যই। আপনি ডেকেছেন আমি যাব না তা কি হয় শংকরবাবু। আমি ঠিক চলে যাব”।

“অনেক ধন্যবাদ অফিসার। রাখছি”।

“শিওর”।

ফোনটা কেটে গেল।

উপমন্যু চিন্তিত মুখে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *