পর্ব ১ – একুশ বছর বোধ হয়।।

।।পর্ব ১ – একুশ বছর বোধ হয়।।

“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে ভারী কোন কিছু দিয়ে অতর্কিতে মাথার পিছনে মারা হয়েছে। কী দিয়ে মারা হয়েছে সেটা এখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি, তবে অনুমান করা হচ্ছে পাথর জাতীয় কিছু। খুন হওয়া মহিলার ওজন সাতচল্লিশ থেকে আটচল্লিশের মধ্যে ছিল। উচ্চতা পাঁচ ফুট আড়াই ইঞ্চি। খুনীর উচ্চতা মৃতার উচ্চতার থেকে বেশি। অন্তত প্রাথমিকভাবে তাই মনে হচ্ছে”।

রিপোর্টটা পড়ে শোনালেন ইন্সপেক্টর রায়।

উপমন্যু চোখ বন্ধ করে শুনছিলেন। বললেন “বয়স কত?”

ইন্সপেক্টর রায় বললেন “আই কার্ড উদ্ধার হয়েছে। জন্ম সাল সাতানব্বই”।

উপমন্যু বললেন “একুশ বছর বোধ হয়?”

ইন্সপেক্টর হাসলেন “হ্যাঁ”।

উপমন্যু বললেন “মোবাইল উদ্ধার হয়েছে? কার কার সঙ্গে কথা বলেছে দেখেছেন?”

ইন্সপেক্টর বললেন “উদ্ধারের পর দেখা গেছে রিসেট করা হয়েছে মোবাইলটা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় নি কোন”।

উপমন্যু হাসলেন, “বাহ, শাইনিং এন্ড ডিজিটাল ইন্ডিয়া। ইন্টারেস্টিং। আই কার্ডে আশা করি ঠিকানা দেওয়া আছে। কোথাকার লোক ইনি?”

ইন্সপেক্টর বললেন “শিলিগুড়ির মেয়ে। কলকাতায় পিজিতে ছিল ঢাকুরিয়ায়। সাউথ কলকাতার একটা কলেজে থার্ড ইয়ার পড়ছিল। একই সঙ্গে একটা কল সেন্টারে চাকরিও করছিল। ঢাকুরিয়ার বাড়িতেই যাব এবার। আপনি যাবেন?”

উপমন্যু বললেন “যাব। আমাকেই যখন দেখতে হবে কেসটা তখন যেতে তো হবেই। চলুন”।

ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরোলেন দুজনে। উপমন্যু বললেন “আপনি মনে হয় না বেশি সময় দিতে পারবেন বলে। থানার অন্যান্য কাজও তো আছে”।

রায় হাসলেন “হ্যাঁ। আপনারা হ্যান্ড ওভার নিয়ে নিলে তারপরে আমার কাজ শেষ”।

উপমন্যু গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের পাশে বসে একটা সিগারেট ধরালেন।

রায় ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিলেন। গাড়ি স্টার্ট নিল।

উপমন্যু বললেন “সময় বদলেছে বুঝলেন? আজকালকার দিনে একটা মোবাইলের থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হয় না। মেয়েটির মোবাইলে যা ছিল সব চাই আমার। আমাদের সাইবার ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিন যন্তরটি”।

রায় বললেন “সে আগেই দিয়ে দিয়েছি। পেয়ে যাব আজ রাত অথবা কাল সকালের মধ্যে”।

উপমন্যু বললেন “গুড। এখন সব দপ্তরের থেকে এই দপ্তরেই জোর দিতে হবে যা দিনকাল আসছে। মানুষ তো মোবাইলটাকেই নিজের ধ্যান জ্ঞান করে রেখে দিয়েছে। কোন দিকে যাবেন”?

রায় বললেন “তা বটে। তবে দাগী লোকেরাও কম যায় না। কাল বি এম জুয়েলারসে ডাকাতি করতে গিয়ে দ্য গ্রেট লক্ষণ প্রামাণিক ধরা পড়েছে। ব্যাটাকে গাঁজা কেস দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি আপাতত”।

উপমন্যু বললেন “বটে? ধরলেন কী করে?”

রায় বললেন “ব্যাটার ভাগ্য খারাপ ছিল আর আমাদের কপাল ভাল ছিল বলতে পারেন। টহলদারী জিপটার ওই সময় ওই অঞ্চলে যাওয়ার কথা ছিল না। একটা পেটি কেসে বস্তিতে ঝামেলা মিটিয়ে ফেরার পথে গাড়ি পাংচার হয়ে যায় দোকানটার সামনেই। শাটার যেমন নামানো থাকে তেমনই ছিল। ড্রিল মেশিনের শব্দ পেয়ে সন্দেহ হওয়ায় আমাদের সেকেন্ড অফিসার বর্মণ ফোরস নিয়ে শাটার তুলতেই দেখে এক্কেবারে জলজ্যান্ত লক্ষণ প্রামাণিক। বিন্দুমাত্র প্রতিরোধটুকুও করে নি। ব্যাটা ভাবতেই পারে নি”।

উপমন্যু বললেন “সে কী! দোকানের সিকিউরিটিগুলো কোথায় ছিল?”

রায় বললেন “লক্ষণেরই লোক ছিল। দু মাস আগে সে দোকানে ঢুকেছিল। খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিল। অনেক প্ল্যান করেছিল বেচারা। শেষ পর্যন্ত কপাল মন্দ…”

উপমন্যু বললেন “কপাল মন্দ বলে মন্দ? ড্রিল মেশিনের শব্দ কে পেয়েছিলেন? বর্মণ?”

রায় বললেন “হ্যাঁ। বর্মণের একেবারে কুকুরের কান”।

উপমন্যু খুশি হলেন “এই তো চাই। পুলিশের নাক কান কুকুরের মত না হলে চলে নাকি?”

রায় বললেন “তবে রাত বলেই ড্রিলের শব্দটা পেয়েছিল স্যার। চারপাশে শব্দ থাকলে বেঁচে যেত লক্ষণ”।

উপমন্যু বললেন “তা বটে। সবটাই তো লাক ফ্যাক্টার ভাই। মানুষের জীবনটাই তো নির্ভর করে আছে এর ওপরে”।

গাড়ি একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। উপমন্যু বললেন “এই কি সেই বাড়ি নাকি?”

রায় বললেন “হ্যাঁ চলুন”।

দোতলা একটা বাড়ি। বাড়ির অবস্থা বিরাট কিছু নয়। তবে এককালে ভাল অবস্থা ছিল সেটা বোঝা যায়। রং শেষ কবে করা হয়েছিল বোঝা সম্ভব নয়।

রায় কলিং বেল টিপলেন।

মিনিট দুয়েক পরে এক দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে বললেন “থানা থেকে এসেছেন তো? আসুন”।

দুজনে বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন।

বৃদ্ধ বসার ঘরে এসে একটা সোফায় বসে বললেন “বসুন। আমি শারীরিকভাবে খুব বেশি সক্ষম নই। আগে বসে পড়লাম। মার্জনা করবেন আমায়”।

উপমন্যু হাসলেন “না না। ঠিক আছে। এই বাড়িতে আপনি একা থাকেন না নিশ্চয়ই?”

বৃদ্ধ বললেন “আমি নিচের ঘরে থাকি। পাশের ঘরে আমার ছোট ছেলে আর ছেলের বউ। দোতলায় একটা ঘরে জয়িতা, আরেকটা ঘরে নীলম বলে একটা মেয়ে থাকে। অবশ্য জয়িতাকে এখন আর থাকে বলাটা…”

রায় বললেন “আপনার ছেলে আর তার স্ত্রী?নীলমই বা কোথায়?”

বৃদ্ধ বললেন “ছেলে আর ছেলের বউ দুজনে চাকরি করে। আসবে হয়ত ঘন্টাখানেক বাদে। নীলম যাদবপুরের এক স্কুলে পড়ায়। ফিরে আসবে যে কোন সময়”।

উপমন্যু বললেন “আমাকে একটু জয়িতার সম্পর্কে বলবেন? যতটা জানেন”।

বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন। কিছু কথা একবারে বলবেন বলে মনঃসংযোগ করলেন হয়ত।

.

।।পর্ব ১- একুশ বছর বোধ হয়।।

২।

“আমার নাম সুশান্ত হালদার। এ বাড়ি আমারই বানানো। আমি কাজ করতাম সেলস ট্যাক্সে। কেরাণি ছিলাম। পৈতৃক বাড়ি। ছিল কুড়েঘরের মত। আমি পাই পয়সা জুড়ে বাড়িটা করি। ধান ভানতে শিবের গীত শুনতে সমস্যা নেই তো অফিসার?” বৃদ্ধ উপমন্যুর দিকে তাকালেন।

উপমন্যু বললেন “একেবারেই নয়। আমার হাতে অঢেল সময়। তবে রায় চাইলে চলে যেতে পারো”।

ইন্সপেক্টর রায় বললেন “না না স্যার। আপাতত কোন ইমারজেন্সী নেই। থাকলে আমি চলে যাব না হয়”।

উপমন্যু বৃদ্ধের দিকে তাকালেন “আপনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন”।

সুশান্তবাবু বললেন “আমার দুই ছেলে। বড় রাজেন্দ্র হালদার বছর দশেক আগে দিল্লিতে পাড়ি দেয়। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। আমাদের সঙ্গে বিশেষ কোন যোগাযোগও নেই। ছোট, মানে যে এ বাড়িতে থাকে, বিশ্বজিৎ হালদার, সে কাজ করে হাওড়ার এক সরকারি অফিসে। আমার বউমাও একই অফিসে চাকরি করেন। ওরা নিঃসন্তান। দুজনে একসঙ্গে যায়, আসে। বছর তিনেক আগে আমার প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী জয়ন্ত জানাল তার ছেলে তার বাড়িতে এরকম পিজির ব্যবস্থা করেছে। দুজন ছাত্রী থাকবে, খাবে, টাকাও দেবে। শুনে আমি বিশ্বজিৎ এবং আমার বউমা তমালিকার সঙ্গে কথা বলি। দুজনেই সানন্দে রাজি হয়ে যায়। দোতলার ঘর দুখানি খালিই পড়েছিল, আমরা সে দুটি ঘরের কথা এক স্থানীয় দালালকে জানাই। তারা এই নীলম আর জয়িতাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে। আমাদের কথা বার্তা হয়। দুজনকেই ভাল পরিবারের মেয়ে বলে মনে হয়েছিল। দুজনেরই বাবা মা আসেন এই বাড়িতে একদিন পরে…”

উপমন্যু বললেন “এই নীলম মেয়েটি কোথাকার?”

সুশান্তবাবু বললেন “কুচবিহারের। জয়িতার থেকে বড়। স্কুল শিক্ষিকা”।

উপমন্যু বললেন “আচ্ছা দুজনেই উত্তরবঙ্গ তবে। জয়িতার সঙ্গে নীলমের বন্ধুত্ব কেমন?”

সুশান্তবাবু বললেন “সেরকম দেখি না। দুজনেই সারাক্ষণ মোবাইল দেখে যাচ্ছে। এমনকি খেতে বসেও সেই মোবাইল। আজকাল তো জানেনই মোবাইলের দৌরাত্ম্য”।

উপমন্যু ইন্সপেক্টর রায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। প্রত্যুত্তরে ইন্সপেক্টর রায়ও হাসলেন।

সুশান্তবাবু বললেন “আমি মাঝে মাঝে একটু আধটু বকেছি দুজনকেই। বুঝতেই পারেন, বয়সের অ্যাডভান্টেজ নিয়েছি আর কী। তখন দুজনেই শুনত অবশ্য। পরে আবার শুরু করে দিত”।

উপমন্যু বললেন “ও কিছু করার নেই সুশান্তবাবু। আমার মেয়েও একই কেস। কত আর বকব। যাক গে, আপনি জয়িতার কথা বলুন”।

সুশান্তবাবু বললেন “জয়িতা শিলিগুড়ির মেয়ে। ওর বাবা ব্যবসায়ী। মা গৃহবধূ। বাবা মায়ের খুব আদরের মেয়ে”।

উপমন্যু ইন্সপেক্টর রায়ের দিকে তাকালেন “এঁরা দুজন এসে গেছেন?”

রায় বললেন “হ্যাঁ। কাল এসেছেন। ওদের এক আত্মীয়ের বাড়ি আছে কেষ্টপুরে। সেখানে উঠেছেন”।

উপমন্যু বললেন “এ বাড়িতে আসেন নি তারা?”

সুশান্তবাবু বললেন “ফোন করেছিলেন সকালে জয়িতার বাবা। খুব ভেঙে পড়েছেন ভদ্রলোক। নিজেই বললেন এখন আর যাব না আপনার ওখানে। গেলেই মেয়ের কথা মনে পড়ে যাবে”।

ঘরে একটা নিস্তব্ধতা তৈরী হল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

উপমন্যু ইন্সপেক্টর রায়কে বললেন “কী দুর্ভাগ্যজনক আমাদের চাকরি বলুন। একজন মেয়ের বাবা হয়ে আরেকজন বাবার কথা শুনতে হচ্ছে এভাবে। যাই হোক। সুশান্তবাবু, আপনি বলুন। এ বাড়িতে জয়িতার সঙ্গে দেখা করতে কে কে আসত?”

সুশান্তবাবু বললেন “কেউ আসত না। জয়িতা সকাল দশটায় বেরোত। অনেক রাত করে বাড়ি ফিরত”।

উপমন্যু বললেন “গেট খুলে দিত কে? অত রাতে কে জেগে থাকত?”

সুশান্তবাবু বললেন “আমার বউমা। জয়িতা এই বছরেই চাকরিটা পেয়েছে। আমার বউমা খুশি হয়েছিল খুব। বলেছিল মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা ও খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করে। যত রাতই হোক, বউমা দরজা খুলে দিত”।

উপমন্যু বললেন “জয়িতা কোথায় চাকরি করত?”

সুশান্তবাবু বললেন “একটা কলসেন্টারে। কলেজ থেকে বেরিয়ে ছ সাত ঘন্টা কাজ করত। বেশ হেকটিক জব”।

উপমন্যু গম্ভীর হয়ে রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন “কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ করা হয়েছে?”

রায় বললেন “হ্যাঁ। ভেরিফাই করা হয়েছে”।

উপমন্যু বললেন “ওখানে যাব এখান থেকে বেরিয়ে”।

রায় মাথা নাড়লেন “আচ্ছা”।

উপমন্যু সুশান্তবাবুর দিকে তাকালেন “আমি জয়িতার রুমটা দেখতে চাই। সম্ভব?”

সুশান্তবাবু বললেন “তালা দেওয়া আছে যে ঘরটা”।

উপমন্যু ইন্সপেক্টর রায়ের দিকে তাকালেন। রায় সুশান্তবাবুকে বললেন “তালা ভাঙলে আপনার কোন আপত্তি আছে সুশান্তবাবু?”

সুশান্তবাবু হাসলেন “নাহ। তবে দেখবেন দরজার কোন ক্ষতি হয় না যেন। মাস্টার কী না কী যেন বলে, চোরেরা যা দিয়ে দরজা খোলে, সেসব দিয়ে দরজা খোলা যায় না?”

রায় বললেন “ভাঙা ছাড়া গতি নেই। আমার কাছে এই মুহূর্তে সে জিনিস নেই”।

উপমন্যু ইন্সপেক্টর রায়কে বললেন “গালা আছে তো?”

রায় বললেন “হ্যাঁ”।

উপমন্যু সুশান্তবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন “ঘরটা আপাতত কিছুদিনের জন্য সীল করা থাকবে”।

সুশান্তবাবু ম্লান হাসলেন “বেশিদিন যাতে না হয় একটু দেখবেন অনুগ্রহ করে। বুঝতেই পারছেন, খুনটা তো এ বাড়িতে হয় নি। আর নীলম উপরের ঘরে একা থাকে”।

কলিং বেল বেজে উঠল। সুশান্তবাবু উঠে বললেন “ওই বুঝি নীলম এল”।

।।পর্ব ১- একুশ বছর বোধ হয়।।

৩।

নীলমের বয়স চব্বিশ পঁচিশের মধ্যে। তাদের দেখে খানিকটা থমকাল।

উপমন্যু বললেন “তুমিই নীলম, তাই তো?”

নীলম মাথা নেড়ে বলল “হ্যাঁ”।

উপমন্যু বললেন “বোস। ঘাবড়ে যেও না, আমরা বাঘ ভল্লুক নই”।

নীলম বসল একটা চেয়ারে।

সুশান্তবাবু ঘরে ঢুকলেন। নীলমকে বললেন “ওঁরা একটু কথা বলবেন এখন তোমার সঙ্গে। তুমি কি ফ্রেশ হয়ে আসবে না আগে কথা বলে নেবে?”

নীলম ফ্যাকাশে হাসল “না, কথা বলে নি। নো প্রবলেম”।

উপমন্যু বললেন “তোমার সঙ্গে জয়িতার বন্ধুত্ব ছিল?”

নীলম বলল “খুব বেশি ছিল না। আমি স্কুল থেকে ফিরে নিজের ঘরে চলে যেতাম। ওর এমনিতেই ফিরতে অনেক রাত হত। তবে কোন কোন রবিবার সিনেমা দেখতে যেতাম। টুকটাক আড্ডা হত”।

উপমন্যু নিজের মোবাইল বের করলেন, “আমি রেকর্ড করতে পারি তোমার বয়ান?”

নীলম বলল “সিওর স্যার”।

উপমন্যু মোবাইলের রেকর্ডার অন করে বললেন “দেখো নীলম, আমি তোমাকে এখন যে প্রশ্ন করব তুমি চাইলে সব প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পারো, কিংবা যদি মনে কর ল ইয়ার কন্সাল্ট করবে করতে পারো। তুমি স্বেচ্ছায় উত্তর দিতে চাইছ তো?”

নীলম বলল “হ্যাঁ স্যার। আপনি যা জানতে চাইছেন জয়িতার ব্যাপারে আমি বলতে প্রস্তুত”।

উপমন্যু খুশি হলেন “ফাইন। আমি শুধু জয়িতা সম্পর্কে কয়েকটা প্রয়োজনীয় তথ্য তোমার থেকে জানব। জয়িতা খুন হয়েছে সেটা তুমি কখন জানলে?”

নীলম বলল “পরশু মাঝরাতে। জয়িতার ফিরতে রোজই একটু রাত হয়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। পরশু আমি টায়ার্ড ছিলাম বেশ। খাতা দেখা ছিল অনেকগুলো। সাড়ে দশটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ মাঝরাতে আমার দরজায় বিশ্বজিত আঙ্কেল নক করেন। আমি একটু অবাকই হই কারণ অত রাতে কোন দিন আমাকে ডাকেন নি আঙ্কেল। উঠে দরজা খুলে জানতে পারি…”

উপমন্যু সুশান্তবাবুর দিকে তাকালেন “আপনিও কি সেদিনই জানতে পারি?”

সুশান্তবাবু ক্লান্ত মুখে মাথা নাড়লেন “না, আমাকে রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হয়। আমি পরের দিন ঘুম থেকে উঠে জানতে পারি”।

উপমন্যু রায়ের দিকে তাকালেন “ডেথ টাইমটা জানিয়েছে রিপোর্ট?”

রায় বললেন “গত পরশু, মানে ফিফথ নভেম্বর, সন্ধ্যে সাতটা”।

উপমন্যু বললেন “তার মানে পরশু মেয়েটা কলেজ থেকে কল সেন্টারে যায় নি। নীলম, জয়িতার কোন বয়ফ্রেন্ড, প্রেমিক, ছেলেবন্ধুর কথা জানো?”

নীলম একটু ইতস্তত করে বলল “আছে, মানে কয়েকজন…”

উপমন্যু অবাক হয়ে বললেন “কয়েকজন মানে?”

নীলম সুশান্তবাবুর দিকে তাকাল খানিকটা সংকুচিত হয়ে। সুশান্তবাবু উঠলেন “আমি অন্য ঘরে যাই”।

উপমন্যু হাসলেন “সাচ আ নাইস জেন্টলম্যান ইউ আর স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ”।

সুশান্তবাবুও প্রত্যুত্তরে হাসলেন “মধুবালার সময়ের মানুষ কিনা, জেনারেশন গ্যাপ নিতে পারি না ঠিক”।

উপমন্যু হেসে বললেন “আমার চাকরি। কী করব বলুন। শুনতেই হবে”।

সুশান্তবাবু পাশের ঘরে গেলে উপমন্যু নীলমের দিকে তাকিয়ে বললেন “কয়েকজন মানে বিশেষবন্ধু কয়েকজন বলতে চাইছ?”

নীলম মাটির দিকে তাকিয়ে বলল “অ্যাকচুয়ালি রবিবারগুলো জয়িতার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেলে আমি খানিকটা অবাকই হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝেই ওর ছেলেবন্ধুর মুখ গুলো আলাদা হয়ে যেত। ওরা আলাদা বসত আমি আলাদা”।

উপমন্যু অবাক হয়ে বললেন “তাহলে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার কারণ কী? ও তো একাই যেতে পারত”!

নীলম বলল “আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে একই কথা। জয়িতা জানিয়েছিল ও নাকি একা যেতে ভয় পায়। এদিকে সিনেমা শেষে দেখতাম প্রায় প্রতিদিনই…”

নীলম চুপ করে গেল।

উপমন্যু ইন্সপেক্টর রায়ের দিকে তাকালেন “আমার মনে হয় মালবিকাম্যামকেও এই কেসে ইনভল্ভ করা প্রয়োজন। সবাই আমাদের সামনে সহজ নাও হতে পারে”।

রায় বললেন “কাল আসবেন আবার?”

উপমন্যু নীলমের দিকে তাকিয়ে বললেন “দেখ মা, আমার মেয়ে তোমার থেকে খানিকটা ছোট হবে। তবে আমার মনে হয় তুমি আমার সামনে ঠিক কমফরটেবল হতে পারছ না। কোন অসুবিধা হলে আমাদের লেডি অফিসার আছেন। তার সামনে ইন্টারোগেশন করলে সুবিধা হয় তোমার?”

নীলম বলল “না স্যার। আমি বলতে পারব। ইটস ওকে”।

উপমন্যু বললেন “ফাইন। তোমার কথা শুনে যা বুঝলাম জয়িতার সিনেমা দেখার একাধিক বন্ধু ছিল। ঠিক আছে। অন্য কথায় আসি। সাম্প্রতিক সময়ে জয়িতা কোন ব্যাপারে খুব টেন্সড ছিল বা কারো সঙ্গে ওর কোন ঝগড়া হয়েছিল কিনা বলতে পারবে?”

নীলম বলল “না, অতটা খেয়াল করি নি স্যার। তবে জয়িতা কাজের ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস ছিল। অফিসে খুব কম কামাই করত”।

উপমন্যু বললেন “এ বাড়িতে কখনও কোন ছেলেকে নিয়ে এসেছে?”

নীলম বলল “না স্যার”।

উপমন্যু চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললেন “জয়িতার বাবা মার সঙ্গে তোমার কেমন সম্পর্ক ছিল?”

নীলম বলত “তেমন কিছু না। ওরা এলে কথা বলতাম এই যা”।

উপমন্যু বললেন “তোমাদের দুজনের জীবন খানিকটা সমান্তরাল আবার খানিকটা না। তাই না নীলম? সমান্তরাল এই সেন্সে যে মুখোমুখি দুটো ঘরে তোমরা থাকতে অথচ দুজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ খুব কম হত। আবার রবিবারগুলো দুটো রেখার মিল হত। তবুও হত না”।

নীলম বলল “খানিকটা সেরকমই”।

উপমন্যু বললেন “এই বাড়ির সবার সঙ্গে জয়িতার বা তোমার সম্পর্ক কেমন?”

নীলম বলল “খুবই ভাল। এঁরা কেউই আমাদের কোন ব্যাপারে নাক গলান নি কোন দিন। বরং তমালিকাআন্টি জয়িতাকে মানসিক সাপোর্ট দিতেন খুবই। জয়িতার খবরে আন্টি বেশ ভেঙে পড়েছেন। আজ খানিকটা জোর করেই ওকে অফিস নিয়ে গেছেন আঙ্কেল। ছেলে মেয়ে নেই তো। খানিকটা ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট তৈরি হয়ে গেছিল আর কী…”

উপমন্যু বললেন “হু। কখন আসবেন ওরা?”

উপমন্যুর কথাটা শেষ হল না কলিং বেল বেজে উঠল।

উপমন্যু হাসলেন “সাচ আ কোইন্সিডেন্স। দেখো তো। মনে হয় বিশ্বজিৎবাবু এবং তমালিকাদেবী এসে পড়েছেন”।

.

।।পূর্ব কথা- অলির কথা শুনে বকুল হাসে।।

মহাষষ্ঠী ছিল সেদিন।

তমালিকা বোনের বাড়ি গেছিল। নীলম বাড়ি। বাবা শুয়ে পড়েছিল একটু আগেই।

রাত আটটা নাগাদ যখন জয়িতা এল বিশ্বজিৎই দরজা খুলেছিলেন।

তাকে দেখে জয়িতা হাসল।

বিশ্বজিৎ দরজা বন্ধ করে ঘরে গিয়ে বসেছিলেন।

কিছুক্ষণ পরে দোতলা থেকে একটা আওয়াজ।

বিশ্বজিৎ তড়িঘড়ি দোতলা গিয়ে দেখলেন জয়িতা আরশোলার ভয়ে খাটে উঠে দাঁড়িয়ে আছে।

তাকে দেখে বলল “আঙ্কেল প্লিজ, এটাকে তাড়ান”।

বিশ্বজিৎ এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা ঝাঁটা দেখতে পেলেন। আরশোলাটাকে ঝাটা দিয়ে সরাতে গিয়ে সেটা জয়িতার গায়েই গিয়ে পড়ল।

জয়িতা আর্তনাদ করে তাকে জড়িয়ে ধরল।

তাকে জাপটে থাকা জয়িতার শরীর, নিঃশ্বাস… সব কিছু তাকে উত্তেজিত করে তুলছিল। আরশোলাটাকে অবশ্য জব্দ করতে বেশিক্ষণ লাগল না।

জয়িতা তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল “সরি”।

বিশ্বজিৎ নিচে নেমে এলেন।

গায়ে জয়িতার গন্ধ মেখে।

মেয়েটা অদ্ভুত একটা পারফিউম ব্যবহার করে। তার জামায় লেগে গেছে সেটা। জামায় লেগে গেছে জয়িতার হাইলাইট করা একটা চুলও।

বিশ্বজিতের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তমালিকা তাকে বঞ্চিত করে রেখেছেন সারাজীবন। এক অদ্ভুত ফ্রিজিডনেস আছে তার। কিছুতেই ইচ্ছা করে না।

বলেছেন অবশ্য কয়েকবার “তোমরা ইচ্ছা করলে তুমি কাউকে জুটিয়ে একটা কিছু করতে পারো। আমি বাঁধা দেব না”।

বিশ্বজিৎ হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন বরাবর “ধুস! কী যে বল। মুখে যা আসে বলে দিলেই হল নাকি?”

তমালিকাও হেসেছেন। ঠাট্টা করে বলেছে “নাহ, এমনি এমনি বলছি না। যেটা তোমার বউ দিতে পারে না, অন্য কেউ দিলে ক্ষতি কী?”

বিশ্বজিৎ বলেছেন “দরকার নেই বলেছি তো। আমার কিছু হলে কি তুমি রাস্তা ঘাটে শুয়ে বেড়াতে নাকি”!

শুনে মনে মনে খুশি হলেও তমালিকা মুখে রাগ দেখিয়ে বলেছেন “ঈশ, কী সব কথা! যত উল্টোপালটা কথা বলতে শিখেছে লোকটা। বাবাকে বলতে হবে”।

বিশ্বজিতের বারে বারেই মনে হয়েছে বাড়িতে তো কেউ নেই আর, দোতলায় গেলেই তো হল। মেয়েটা যদি রাজি হয়ে যায়! পরক্ষণেই মনে হয়েছে, এসব কী ভাবছেন তিনি! এতো ধর্ষণেচ্ছা জাগল কীভাবে কখন? ভাবলেন কী করে এমন কথা? একই বাড়িতে থাকে সবাই। যদি তমালিকা বুঝে যায়? তমালিকা যদি সন্তান নিতে পারত, তাহলে তাদের মেয়ের বয়স তো জয়িতার কাছাকাছিই হত! মাথায় আসল কী করে এসব কথা? নাকি অফিস বাড়ি আর বাড়ি অফিস করে করে মাথার ভেতরে কোথাও একটা লুকিয়ে ছিল সবকিছু! সময় করে বেরিয়ে এসেছে! এত ভয়ংকর হয় অবচেতন? নিজের মধ্যে অদ্ভুত টানাপোড়েনে রাতে আর ঘুমাতে পারেন নি বিশ্বজিৎ। ঘুম এসেছিল শেষ রাতের দিকে।

সকালে উঠে মায়া মাসী এসে ঘুম ভাঙিয়ে জানাল বাজার আনতে হবে।

বিশ্বজিৎ বাজার সেরে এসে দেখলেন বাবা বাইরের ঘরে বসে আছেন।

তাকে দেখে বললেন “বউমা কবে আসবে যেন?”

বিশ্বজিৎ বাবার সামনের চেয়ারে বসে বললেন “নবমীর দিন”।

সুশান্ত বললেন “তুইও গিয়ে থেকে আসতে পারতিস তো”!

বিশ্বজিৎ বললেন “থাক না। এতদিন পর দুই বোন একসঙ্গে ঘুরবে। আমি গিয়ে খামোখা কী করব”?

সুশান্ত হাসলেন “তা ঠিক। এবারে একটা ভাল জিনিস দেখেছিস? পাড়ার পুজোর মাইক কিন্তু খুব বেশি জ্বালাচ্ছে না”।

বিশ্বজিৎ বললেন “রাত হলে দেখো কী করে। এদের কোন ভরসা নেই তো”।

সুশান্ত বললেন “তা ঠিক। এবার পুজোর চাঁদা নিয়ে গেছে?”

বিশ্বজিৎ বললেন “হ্যাঁ। নিয়ে যাবে না? ছাড়বে নাকি?”

ব্রেকফাস্ট খেতে নেমে এসেছিল জয়িতা। বিশ্বজিৎ খানিকটা কুঁকড়ে গেলেন জয়িতাকে দেখে। নিজের প্রতি ঘেন্না হল হঠাৎ করে।

জয়িতা ডাইনিং রুমে বসে বলল “উফ আংকেল, কাল আপনি না থাকলে যে কী হত”!

সুশান্ত অবাক চোখে জয়িতার দিকে তাকিয়ে বললেন “কেন? কী হয়েছিল কালকে?”

জয়িতা বলল “আর বোল না দাদু, কাল একটা আরশোলা ঢুকে পড়েছিল আমার ঘরে। আমি তো ভাবলাম গেল সব বোধ হয়। আংকেল ছিল বলে বেঁচে গেলাম”।

সুশান্ত হো হো করে হেসে উঠলেন। বিশ্বজিৎ হাসলেন। হাসতে গিয়ে নিজের অজান্তেই বুঝতে পারলেন জয়িতার শরীরটা আবার টানছে তাকে।

নিজের অজান্তেই সিঁটিয়ে গেলেন মনে মনে।

.

।।পূর্ব কথা- অলির কথা শুনে বকুল হাসে।।

২।

গড়পঞ্চকোটে সন্ধ্যে নামে তাড়াতাড়ি। বন বাংলোয় যারা আসে তাদের ব্যস্ততা থাকে না। এসে খেয়ে দেয়ে ঘরে ঢুকে কেউ বসে বোতল খুলে, কেউ বা বন্ধুদের সঙ্গে এলে তাস নিয়ে বসে।

দুটো ঘর বুক করেছিল অনীশ আর রোহিত। আসানসোল পেরোতেই ভয়টা জাঁকিয়ে বসেছিল নীলমের, যদি বাংলোয় আনম্যারেড কাপল অ্যালাউ না করে সেক্ষেত্রে কী হবে।

বাস্তবে দেখা গেল সেসব কোন সমস্যাই হল না। মসৃণ চেক ইন হয়ে গেল। একটা বাংলোর নীচের তলায় জয়িতা – অনীশ, ওপরের তলায় নীলম আর রোহিত।

অন্ধকার ঘিরে ধরেছে চারপাশ থেকে, নীলমকে যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিল রোহিত ঘরে ঢোকার পরেই। নীলম বাঁধা দিতে পারে নি। একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত শরীর চেনার নেশার মধ্যে রোহিতে ডুবে যেতে যেতে সে সব চিন্তা বিসর্জন দিয়েছিল।

বাড়িতে বলেছে স্কুল থেকে পুরুলিয়া নিয়ে যাচ্ছে। পিজিতেও তাই। জয়িতা অবশ্য বাড়ি যাবার নাম করে এসেছে।

জয়িতার বাড়ি থেকে পিজিতে ফোন করে না। জয়িতাকেই ফোন করে।

রোহিত তার অনাবৃত শরীরে চুমু খেতে খেতে বলেছিল “ইউ আর বিউটিফুল নীলম”।

নীলম অন্যকিছু ভাবতে পারে নি। ভালবাসায় ভেসে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সম্ভবও ছিল না।

প্রথমবারের পরে অবশ্য একটু অপরাধবোধ গ্রাস করল তাকে। বাবা মার মুখটা মনে পড়ে গেছিল। মনে হয়েছিল তার বিয়ের জন্য কত উত্তেজিত তার বাবা মা, যদি জানতে পারেন সে এই কাজটা করেছে তখন কি তাকে ক্ষমা করে দিতে পারবে? পরক্ষণেই রোহিত তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে সব কিছু। নরম বিছানায়, আবছা অন্ধকারে রোহিতের পৌরুষ আর কিছু মনে পড়তেই দিচ্ছিল না।

বৃষ্টি নেমেছে অসময়ের, জানলা থেকে জলের ছিটে আসছে তাদের শরীরে।

রোহিত তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। অস্ফূটে বলল “ইট ওয়াজ অসাম”।

নীলম বলল “কথা বোল না। ভাল লাগছে না কিছু শুনতে”।

রোহিত বলল “তোমার বাবা মা অবাঙালি জামাই মানবেন তো?”

নীলম রোহিতের গালে একটা টোকা মেরে বলল “বিয়েটা বাবা মার সঙ্গে করবে বুঝি তুমি? এসব কথা এখন ভাবার দরকারই বা কী?”

রোহিত বলল “জানো তো, এখন আমার টপ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ফিল হচ্ছে। মনে হচ্ছে তোমাকে নিয়ে আরও দূরে কোথাও চলে যাই। আচ্ছা, তোমার বন্ধুটাকে আনার কি খুব দরকার ছিল?”

নীলম বলল “কী করব? এরকম এক্সপেরিয়েন্স তো আগে হয় নি। ওর এক্সপেরিয়েন্স আছে। ওই জন্যই তো ওকে আনা”।

রোহিত অবাক হয়ে বলল “মানে? ওই অনীশকে নিয়ে?”

নীলম হেসে বলল “ধুস।শুধু অনীশ? ওরকম কত অনীশ আছে!”

রোহিত বলল “রিয়েলি? ওর যদি এইডস হয়?”

নীলম বলল “হলে হবে। আমার কী?”

রোহিত বলল “না না সিরিয়াসলি। দেখো, ভুলেও ওর সঙ্গে লেসবিয়ান কিছু করতে চেও না”।

নীলম খাটে উঠে রোহিতের দিকে বড় বড় চোখ করে বলল “কী বললে তুমি? আরেকবার বল”।

রোহিত হো হো করে হেসে ফেলল। নীলম রোহিতের পেটে একটা ঘুষি মেরে বলল “অসভ্য কোথাকার! সারাক্ষণ শুধু সব রিলেশনে সেক্স ছাড়া কিছু ভাবতে পারো না, না?”

রোহিত বলল “সেটা কখন বললাম? শুধু বলছি, ওই দুটো মেয়ে পাশাপাশি ঘরে থাকো, না মানে হতেই তো পারে, কোন কোন দিন এরকম রোম্যান্টিক ওয়েদারে দুজনেরই ক্যান্ডেল ইউজ করার ইচ্ছে হল। সেলফ হেল্প আর কী!”

নীলম রোহিতের পেটে জোরে একটা চিমটি কাটল। রোহিত “মর গয়া, ছোড় দো, ফির নেহী বলুঙ্গা” বলে অনুনয় করতে থাকল।

নীলম বলল “শুধু যত ফালতু কথা। একদম ভাল লাগে না আমার এসব। আর যদি বলেছ, তাহলে তোমার খবর আছে”।

রোহিত প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় তাদের ঘরের কলিং বেল বেজে উঠল। নীলম অবাক হয়ে একটু জোরে বলল ‘কে?”

বাইরে থেকে জয়িতার গলা ভেসে এল “আমি। একটু খোল। কথা আছে”।

নীলম অবাক হল। জয়িতার গলাটা গম্ভীর লাগছে। তাছাড়া এই বৃষ্টিতে কি মেয়েটা ভিজে এল নাকি দোতলায়? সিড়ি তো বাইরে থেকে আছে।

রোহিতকে টিশার্ট আর শর্টস পরে নিয়ে বলে, দ্রুত হাতে নাইটি পরে দরজা খুলল নীলম। দেখল জয়িতা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই জয়িতা ঘরে ঢুকে খাটের ওপর বসে পড়ল।

রোহিত অবাক গলায় বলল “কী হয়েছে?”

জয়িতা ভাঙ্গা গলায় বলল “আমি এখানে থাকব না। এখনই কলকাতা ফিরে যাব”।

দুজনে অবাক হয়ে জয়িতার দিকে তাকিয়ে রইল।

।।পর্ব ১- একুশ বছর বোধ হয়।।

৪ ।

বিশ্বজিৎ এবং তমালিকা ঘরে ঢুকে উপমন্যু এবং ইন্সপেক্টর রায়কে দেখে অবাক হলেন। উপমন্যু বললেন “আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বজিৎবাবু, এবং আপনি তমালিকা দেবী?”

তমালিকা বললেন “হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন”।

উপমন্যু বললেন “জানি আপনারা দুজনেই ক্লান্ত, তবু যদি একটু বসতেন ভাল হত”।

বিশ্বজিৎ একটা চেয়ার টেনে বসলেন “নিশ্চয়ই”।

তমালিকা বললেন “আপনাদের কিছু দেওয়া হয় নি দেখছি। চা বা কফি কিছু দেব?”

উপমন্যু খুশি হয়ে বললেন “তাহলে তো খুবই ভাল হয়। কিন্তু আপনার কষ্ট হবে না?”

তমালিকা হাসলেন “না না। কী যে বলেন। সত্যি কথা বলতে কী জয়িতাকে আমি নিজের মেয়ের মত দেখতাম। গোটা ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না স্যার। যদি দোষী ধরা পড়ে, আমার থেকে খুশি কেউ হবে না”।

উপমন্যু বললেন “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে তমালিকাদেবী। আমাদের চাকরিতে তো এরকম আপ্যায়ন সহজে জোটে না, সবাই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে পারলেই খুশি হন। আপনি যে আমাদের কথাটা ভেবেছেন, তাতেই আমি ভীষণ খুশি। আমি চিনি ছাড়া চা খাব। রায় চিনি দিয়েই খাবে”।

রায় বললেন “আমাকেও এক চামচের বেশি দেবেন না”।

তমালিকা নীলমের দিকে তাকালেন “তুমি খাবে?”

নীলম ঘাড় নাড়ল “হ্যাঁ আন্টি”।

তমালিকা রান্নাঘরে রওনা হলেন।

উপমন্যু বিশ্বজিৎকে বললেন “একদিকে ভালই আপনাদের বলুন? স্বামী স্ত্রী একই অফিসে চাকরি করেন। আমার মিসেস অবশ্য কলেজে পড়ান। দুজনের শিডিউলও আলাদা। মেয়েটার দিকে সময় দেওয়া হয় না তেমন”।

বিশ্বজিৎ বললেন “ওই আর কী। একই অফিস হলেও কাজের ক্ষেত্রে আমাদের মুখোমুখি হতে হয় না”।

উপমন্যু বিশ্বজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনার দাদার সঙ্গে বোধ হয় খুব বেশি যোগাযোগ নেই মিস্টার হালদার, তাই না?”

বিশ্বজিৎ উপমন্যুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন “বাবা বলেছেন বুঝি দাদার কথা?”

উপমন্যু বললেন “হ্যাঁ। তাছাড়া আর কোথা থেকে জানব?”

বিশ্বজিৎ বললেন “আসলে দাদাই তেমন যোগাযোগ রাখে না আর কী। ফোন করলে সেভাবে রেস্পন্সিভও না”।

উপমন্যু বললেন “এতটা বিকর্ষণ কেন?”

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়লেন, “বলতে পারব না”।

উপমন্যু বললেন “ভদ্রলোকের ফোন নাম্বার দিতে পারবেন?”

বিশ্বজিৎ অবাক হয়ে বললেন “পারব, কিন্তু এই কেসের সঙ্গে কি সেটার কোন সম্পর্ক আছে?”

উপমন্যু বললেন “দিয়ে রাখবেন। কখন কী প্রয়োজন পড়ে কে জানে বলুন। গুরুদেব তো বলেইছেন ছাই উড়িয়ে দেখতে। অমূল্যরতন যদি পাওয়া যায়”।

নীলম একটু উশখুশ করছিল, উপমন্যু নীলমের দিকে তাকিয়ে বললেন “তুমি কি ফ্রেশ হবে? যেতে পারো, অসুবিধে নেই”।

নীলম বলল “আমি রান্নাঘরে যেতে পারি?”

উপমন্যু বললেন “নিশ্চয়ই। কেন পারবে না? যাও”।

নীলম থ্যাঙ্ক ইউ বলে রান্নাঘরে গেল।

উপমন্যু বিশ্বজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন “জয়িতা সম্পর্কে আপনার ওপিনিয়ন কী বিশ্বজিৎবাবু?”

বিশ্বজিৎ একটু ভেবে বললেন “দেখুন, আমরা তো এই সময়ে অফিস থেকে ফিরি। সকালে সাড়ে আটটা পৌনে ন’টার মধ্যে আমাদের বেরিয়ে যেতে হয়। এবারে নীলম বা জয়িতা কারো সঙ্গেই সেভাবে কথা হত না আমার খাবার সময় ছাড়া। পরে তো জয়িতা চাকরি পেয়ে গেল। আমার সঙ্গে কথাই হত না বলতে পারেন। তবে তমালিকা ওকে খুব স্নেহ করে। ওদের দুজনের মধ্যে একটা বন্ডিং ছিল”।

উপমন্যু বললেন “খুনের দিন আপনি কোথায় ছিলেন বিশ্বজিৎবাবু?”

বিশ্বজিৎ বললেন “বাড়িতেই ছিলাম। যেরকম অফিস থেকে এখন এলাম, সেরকমই। দুজনে এসেছিলাম এক সঙ্গে”।

উপমন্যু বললেন “আপনার কাউকে সন্দেহ হয় এই ব্যাপারে?”

বিশ্বজিৎ হাসলেন “আমার সঙ্গে জয়িতার সেভাবে দেখাই হত না স্যার। ও কাদের সঙ্গে মিশত, কোথায় যেত, কী করত, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। এ বাড়িতেও কোন দিন কোন বন্ধু বা বান্ধবীকে নিয়ে এসে হাজির হয় নি যাতে আমি বা বাবা এমব্যারাস হই। সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না আর কী”।

উপমন্যু বললেন “তা ঠিক। আচ্ছা আপনাকে আরেকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি? আপনি ইচ্ছা না হলে জবাব দেবেন না”।

বিশ্বজিৎ বললেন “হ্যাঁ বলুন”।

উপমন্যু একটু থমকে বললেন “আপনারা যে নিঃসন্তান, এর জন্য কে দায়ী? আপনি না মিসেস হালদার?”

বিশ্বজিৎ গম্ভীর হলেন, চুপ করে নিয়ে বললেন “প্রশ্নটা একটু বেশিই ব্যক্তিগত হয়ে গেল না অফিসার?”

উপমন্যু হাত তুললেন “হ্যাঁ, সেটা আমিও জানি। আপনি না চাইলে উত্তর দেবেন না। কোন সমস্যা নেই”।

বিশ্বজিৎ গম্ভীর মুখেই বললেন “সমস্যাটা ওর। কিন্তু দয়া করে ওকে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করবেন না। এই ব্যাপারে ওর একটা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে। কোন ভাবে সে প্রশ্নটা উঠে গেলে ওকে সামলানো একটু কঠিন হয়ে যায়। অদ্ভুত ডিপ্রেশনে চলে যায়। আপনি প্লিজ…”

উপমন্যু বললেন “নিশ্চয়ই। আমি কথাটা মাথায় রাখব। সরি মিস্টার হালদার। মাঝে তদন্তের স্বার্থে এমন সব প্রশ্ন বেরিয়ে আসে। তার মানে আপনি যৌনতায় সক্ষম তাই তো?”

বিশ্বজিৎ এবারে রাগী চোখে উপমন্যুর দিকে তাকালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *