যাচ্ছ কোথায় পিঁপড়েরা (১৯৮৮)

যাচ্ছ কোথায় পিঁপড়েরা (১৯৮৮)
ইউরি মেদভেদেভ। প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮ অনুবাদ: নন্দিনী
দাসচট্টোপাধ্যায়

টিউলিপের বুকে শিশির জমেছিল। লার্কা একটা টিউলিপ নিয়ে তার মধ্যে জমে থাকা শিশিরটাকে জিভের আগায় নাচাতে নাচাতে বলল, “জানো তো, আগে কিন্তু টিউলিপ ফুটত মে মাসে, এখনকার মতো জুলাইতে নয়!” তারপরে বলল, “আরে! দেখো দেখো, একটা ছোট্ট জলের স্রোত এদিকে নেমে আসছে না? মনে হচ্ছে বুঝি আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যই আসছে!”

পাহাড়ের যে খাড়াই দেওয়ালের কোলে আমরা ছিলাম, তার গায়ের ফাটলগুলোর মধ্যে থেকে জলের ধারা বেরিয়ে আসছিল। সূর্য এখন মাথার উপর। ফাটলের খাঁজে জমাট বরফ এখন সূর্যের তাপে গলে গিয়েই ছোটো ছোটো জলের ধারা তৈরি করেছে।

তারই মধ্যে একটা শীর্ণ, লাজুক ধারা কাঁপতে কাঁপতে আগের বছরের ঘাসের ঝোঁপের পাশ কাটিয়ে আমাদের দিকে আসতে আসতে টিউলিপের গোড়ায় একটা গর্ত পেয়ে থমকে গেল। থমকে গেল, কিন্তু থেমে গেল না। খানিকক্ষণ দাঁড়াল বোধ হয় শক্তি সঞ্চয় করার জন্য। তারপরে সোজা আমাদের পেরিয়ে চলে গেল নাচতে নাচতে।

পিঁপড়েদের একটা দল সরু রেখা বরাবর চলছিল। জলের এই চলমান ধারা সেটা খেয়াল না করেই এগিয়ে গেল। কাজেই পিঁপড়েদের একটু ঝামেলাই হল, কারণ দলের বেশ কিছু সদস্য ওপারে রয়ে গেছে। আর ওদের বাসা এপারে একটা গাছের গুঁড়িতে।

পিঁপড়েদের বাসা যেদিকে, লার্কা আর আমি সেদিকেই ছিলাম, আর আন্দ্রোজিন ওপারে।

“টিউলিপ কেন জুলাইতে ফুটত বলো তো! জানো কেউ?” লার্কা মিষ্টি হাসল।

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। দেখছিলাম ওই পিঁপড়ের দলটাকে। পিঁপড়ের সারিটা এখন ভেঙে গেছে। ওরা যেন কারো নির্দেশমতো জলের ধারা বরাবর রওনা হল, কিন্তু দল বেঁধে নয়, একা একা। বোঝাই যাচ্ছিল, স্রোতটা পেরোনোর মতো কোনো জায়গা খুঁজছে ওরা।

“তবে তুমিও সবটা ঠিক জানো না। অনেক অনেকদিন আগে তোমার ওই টিউলিপ ফুটত ডিসেম্বরে।” আন্দ্রোজিন বলল, “তাছাড়া সে কি এরকম এক পাপড়ির! মোটেই না! দু-সারি পাপড়ি ছিল! আর শুধুই কি তাই? ম্যামথদের প্রিয় খাদ্যই ছিল ওটা! আন্দ্রোজিন তার পিঠের রুকস্যাকটা মাটিতে নামিয়ে রেখে তার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোথা থেকে একটা বুনো রসুনের ডাঁটা জুটিয়েছিল, সেটা চিবোতে চিবোতে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “হুমম, তারপর যা বলছিলাম, অন্য গ্রহের প্রাণীরা এল। এই আমাদেরই মতন খানিকটা, তবে ওদের মস্ত বড়ো দুটো গঁড় ছিল শিরদাঁড়া বরাবর, বুঝলে ডার্লিং! সে যে কী বিশাল, ভাবতেও পারবে না! তার এক-একটাই একটা মহাদেশের সমান! এই যেমন ধরো, দক্ষিণ আমেরিকা।” কেন কে জানে ও আমার দিকে চকিতে একবার তাকাল। তারপর আবার আগের কথায় ফিরে এল, “ওরা পৃথিবীটাকে বেড় দিয়ে ধরে এমন মোচড় দিল যে, সে-বেচারা একদিকে হেলে ওইভাবেই ঘুরতে লাগল। ব্যস! পৃথিবীর আবহাওয়াটাও গেল পালটে, আর টিউলিপেরাও ঠিক করল তারা এবার থেকে জুলাইতেই ফুটবে-একেবারে তোমার জন্মদিনের সময়টাতে। ম্যামথগুলো সেই দুঃখে মরেই গেল। আমি মোটেই বানিয়ে বানিয়ে বলছি না, এখনও কত ম্যামথের ফসিল পাওয়া যায় যাদের পেটে গোছা গোছা টিউলিপ।” আন্দ্রোজিনের ঘন পাতায় ঘেরা বড়ো বড়ো কালো চোখদুটো যেন ম্যামথদের দুঃখে কাতর।

লার্কা পাত্তা দিল না। বরং বলল, “তিম, তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবো, তাই না? মজা করতে গিয়ে এই যে কথাগুলো বললে সেটা বেশ বোকা বোকা –বুঝতে পারোনি, বলো! মন দিয়ে শোনো, ‘টিউল-ইপ –জুল-আই– টিউল-জুল– টিউল-জুল! কত মিল! ঠিক বুলবুলির ডাকের মতো টিউল-জুল! টিউল-জুল!” লার্কা ঘাড়টা বেঁকিয়ে তাকাল। তারপর বড়ো করে দম নিল, “নিজের ভাষার যে মিষ্টত্ব, তার স্বাদ নেওয়ার জন্যে আমার মতো ভাষাবিদ হওয়ার তো দরকার নেই। হতে পারে তুমি কেমিস্ট্রিতে পি.এইচ.ডি, পিটের স্বাভাবিক দাহ্যতার বিষয়ে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তোমার ভালো কাজ আছে। কিন্তু নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রত্যেকের থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। বুঝলে মশাই!” ওর হাতের ফুলটা দিয়ে তিমের নাকে টুকটুক করে ক’ বার ঠুকে দিল। শেষের বার অবশ্য তিম খপ করে টিউলিপের পাপড়ি মুখে পুরে দিল, তারপর থু থু করে সেগুলো পিঁপড়ের ঢিবির দিকে ছিটিয়ে দিল।

আলটপকা মন্তব্যে তিমের জুড়ি নেই। লার্কার দিকে তাকিয়ে ফস করে বলে বসল, “কিন্তু একটা ব্যাপারে বিজ্ঞান তোমাকে কখনোই ক্ষমা করবে না।”

লার্কা ভ্রূ কুঞ্চিত করে তিমের দিকে তাকাল। “মানে?”

“মানে এই যে তুমি তোমার বিয়ের আগের পদবিটা এখনো রেখে দিয়েছ, কখনোই আমার এত সুন্দর আন্দ্রোজিন পদবিটা নামের সঙ্গে লাগালে না।”

আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি লাগল দু’ জনে! অবশ্য লার্কা সেদিকে গেলই না, হেসে বলল, “তাই! আমার তো মনে হয় তোমার ওই পদবির ভার বুঝি আমার সইবে না! ওটা তোমাদের পরিবারের সম্পত্তিই থাকুক না হয়! কিন্তু তিম, তোমাদের এই পদবির উৎস কী বলো তো? ‘আন্দো’ কথাটা শ্লোভেনিয়ার প্রাচীন ভাষায় চলত, যার মানে, ‘আকস্মিক’।”

যদিও আমার সন্দেহ, আন্দ্রোজিনের বংশলতিকার ব্যাপারে এই গবেষণা ওর নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত, ওই ঘাড়ে-গর্দানে ভাঁড়টাকে নিয়ে একটু মজা করা আর কী! লার্কা যে কেন তিমের পদবি ব্যবহার করে না, সে বিষয়ে আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।

জলের ধারাটা পিঁপড়েদের তুলনায় বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। চওড়ায় আমাদের তিন চার কদমের মতো তো হবেই। জলের ঠিক পাশেই একটা মাটির ছোটো ঢিবির উপর পিঁপড়েরা জড়ো হয়েছে এবার। ওরা খুঁড়ে খুঁড় ঠেকিয়ে বোধ হয় নিজেদের মধ্যে কোনো খবর দেওয়া নেওয়া করছিল, কিংবা জাতভাইদের কিছু সংকেত পাঠাচ্ছিল। শুনেছি মৌমাছিদের মতো এরাও বাঁচার পথ খুঁজে না পেলে সবাই মিলে মরণকে বরণ করে নেয়।

আন্দ্রোজিন বলল, “ছাড়ো তো তোমার ওই শব্দতত্ত্বের কচকচি আর যত্তসব আদ্দিকেলে ধ্যানধারণা! এই তুমিই না বলেছিলে সোনা, পশুপাখির আচরণ থেকে সেকালের লোকজন ভবিষ্যতের আন্দাজ পেত?”

“পশুপাখির আচরণ, বিদ্যুতের ঝলক, নদীর কলতান, ধূমকেতুর যাওয়া-আসা, সব কিছুর থেকে।” লার্কা হাসল।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে, এদের মনের কথা থেকে ভবিষ্যৎ পরে দেখো, এখন তোমার ওই বাল্য বন্ধুটির পদবির অর্থ বলো দেখি!”

লার্কার আঙুলগুলো জলের মধ্যে খেলা করছিল। আন্দ্রোজিনের কথা শেষ হতে ভিজে আঙুলগুলো নিয়ে নিজের কপালে বুলোল, তারপর বলল, “এ আর এমন কী! ‘তালানভ’ শব্দটা ‘তালান’ থেকে এসেছে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। তালান মানে অনেক কিছু হতে পারে। প্রতিভা, সাফল্য, সৌভাগ্য…”।

“তা তো বটেই। এই যে তালানভ, তুমি তো ভাগ্যবান লোক হে! একেবারে ভাগ্য সঙ্গে নিয়ে এসেছ! সাফল্যের জিন তোমার মধ্যে একেবারে সেঁধিয়ে বসে আছে।”

মনে হল আন্দ্রোজিন ভিতরে ভিতরে বেশ রেগেছে।

আমি একথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না।

শীতকালে বরফ জমে ছিল এসব জায়গায়। এখন বরফের চাদর সরে গিয়ে আবার ঘাস আর ছোটো ছোটো গাছপালা বেরিয়ে এসেছে। এদের দেখলে মনে হয় না যে এরা এতদিন চাপা পড়েছিল বরফের নীচে। রীতিমতন সতেজ। আমি লম্বা দেখে ঘাসের একটা ফলা ছিঁড়ে নিলাম। দেখি, পিঁপড়ের দলের কোনো উপকারে লাগতে পারি কি না।

আন্দ্রোজিনের কথার উত্তর লার্কাই দিল। আমাকে দেখিয়ে বলল, “তিমচিক, কথাটা তুমি একদম ঠিক বলেছ। ভাগ্য ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। জীবনে সফল বলতে আমার তো ওর নামই প্রথম মাথায় আসে। আর ওর সবচেয়ে ভালো লাগে কী জানো? জল, মাটি, হাওয়া, পাহাড়, নদী, ঝরনা… এমনকি পোকামাকড়, পিঁপড়ে এ সবকিছুর উপর ওর ভালোবাসা। এই তো দেখো না, তিন-চার বছরে একবার হলেও ও ঠিক আমাদের সেই ছোটবেলার জায়গায় ঘুরে আসবেই, সবসময় বেশিদিন থাকতে পারে না কিন্তু চেষ্টা করে।”

“তোমার মতো একজন বন্ধু থাকলে তার সুখের কি আর কমতি থাকে? তোমার কথায় এখানে এসে বেচারা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কী হে তালানভ, বলো সেটা!”

আমি আর কী উত্তর দেব একথার? ওদের এই খুনশুটি লেগেই থাকে।

আন্দ্রোজিনের কথা তখনো শেষ হয়নি। বলল, “একটা লজঝড়ে বাসে নাচতে নাচতে চিলিক, তারপর সেখান থেকে লরির পিছনে ঝাঁকুনি খেতে খেতে আসা… ভাবছিলাম দেহের হাড় ক’ খানা বুঝি-বা আস্ত থাকবে না। আর লরির থেকে নামার পর এই একমনি বোঝা পিঠে নিয়ে হাঁটা! আহা! কী মধুর যাত্রাপথ! এই না হলে সুখ!”

এর পরে চুপচাপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। লার্কার কথা বলার আদল নকল করে আন্দ্রোজিন তাই বলল, “না বাবা, চুপ থাকাই ভালো, আমি আর কথা বলব না!”

“ইউরোপের একজন সেরা রেসারকে নিয়ে তোমার এইসব খেলো ইয়ার্কি শোভা পায় না তিম।” লার্কা ঘাসের একটা গোছা নিয়ে আনমনে খেলছিল। বলল, “ওকে গত শীতে দেখেছিলাম, কার রেসিংয়ের উপর কী একটা ফিল্মের শুটিং হচ্ছিল। মেক্সিকোতে… না না, বোধ হয় কলম্বিয়া… ঠিক মনে পড়ছে না। এই জায়গাগুলো আমি না, বড্ড গুলিয়ে ফেলি। উহ! ঘটনাটা ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়! একটা বাঁকের মুখে এসে ওর গাড়িটা তিন-তিনবার ডিগবাজি খেল, ঠিক একটা ডলফিনের মতো। তারপরেই ঝাঁপ দিল কোন অতলে সেটা দেখতে পেলাম না। ধুলোবালির একটা ঝড় উঠল। ভাবলাম, গাড়িটা বুঝি চুরমার হয়ে গেল। ভয়ে চোখ বুজলাম। ওমা! একটু বাদে চোখ খুলে দেখি তিনি ধীরেসুস্থে গাড়ি থেকে নামছেন! দেখে মনে হল, গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। হাতে একটা হারপুনের মতো কিছু একটা যন্ত্র আর একটা তির। তিরের সঙ্গে আবার একটা লম্বা দড়ি আটকানো। তিরটা সাঁ করে ছুঁড়ে দিল সামনের পাহাড়ের দিকে, সেটা কোন পাথরের খাঁজে গিয়ে আটকে গেল। তারপর সেই দড়ি ধরে চোখের পলকে তরতর করে পাহাড় বেয়ে উঠে গেল ও-ই উপরে। দুঃখ শুধু একটাই, ওর মুখটা দেখতে পাইনি। আর দেখবই বা কী করে? ওদের সবারই তো মুখ হেলমেটে ঢাকা ছিল! একেবারে মহাকাশচারীদের মতো।”

লার্কা থামলে পরে আমি ওর ভুলগুলো ধরিয়ে দিলাম। বললাম, “তথ্যে কিঞ্চিৎ ভুল আছে যে লার্কা! প্রথমত, আমি দু-বার ডিগবাজি দিয়েছিলাম। তিনবার নয়। দ্বিতীয়ত, কোনো অতল খাদে ঝাঁপ দিইনি, পাশের একটা নাবাল জমিতে নেমে গিয়েছিলাম। আর জায়গাটা মেক্সিকোও নয়, কলম্বিয়াও নয়, ওটা ছিল পেরু। সেই ইনকা সভ্যতার পেরু। শোনা যায়, ওরা নাকি লোকজনকে সম্মোহিত করে ভবিষ্যৎ জানতে পারত।”

তা না হয় জানুক, কিন্তু এই পিঁপড়েগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে? আমি কি পারব এই ঘাসের ফলা দিয়ে ওদের এই বিশাল জলধি পেরোনোর সেতু বানিয়ে দিতে? শুনেছি, পিঁপড়েরা নাকি চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে।

ঘাসের ফলাটা এমনভাবে জলের উপর রাখলাম, পিঁপড়েগুলো সহজেই যাতে ওর উপর দিয়ে এপারে চলে আসতে পারে। চরম হতাশার মধ্যে এত সুন্দর একটা আলোর রেখা দেখে পিঁপড়েদের কীরকম আনন্দ হতে পারে তাই কল্পনা করছিলাম।

কিন্তু সেরকম কিছু হল না। ওরা এদিকে এলই না।

“এই যে ভাগ্যবান!”

পিঁপড়ের দলকে নিয়ে আমি একেবারে আত্মমগ্ন ছিলাম, তাই আন্দ্রোজিনের কথা শুনে একটু চমকে তাকালাম ওর দিকে।

এক-একটা বাচ্চা আছে না, একবার যেটা মাথায় ঢুকবে সেটা নিয়েই ঘ্যানঘ্যান করতে থাকবে! আন্দ্রোজিনের স্বভাবটা সেরকম। ও বলতেই লাগল, “পৃথিবীর বহু জায়গায় তো ঘোরা হল। নিউ ইয়র্ক, রিও-ডি-জেনেইরো, সিঙ্গাপুর, বাগদাদ, কলকাতা, জেরুজালেম কত শহর! তা সেসব জায়গার যত সুন্দরীদের দেখেছ, তাদের কারো কারো সঙ্গে একটু আধটু হেঁ হেঁ হেঁ…”

আন্দ্রোজিন তার পুরুষ্টু গোঁফজোড়ায় চাড়া দিয়ে এমন একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করল যে আমার পিত্তি জ্বলে গেল।

ওর বক্তব্য অবশ্য তখনো শেষ হয়নি। “ভাগ্যটা তোমার সত্যিই ভালো হে! দেশবিদেশের কত ভালো ভালো জিনিস তোমার ভাঁড়ারে বলো ঠিক কি না? আর টাকা! তোমাদের টাকার থলের পেট তো সবসময় মোটাই থাকে। হুঁ হুঁ বাবা! আমাকে বোকা বোঝাতে এসো না! বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে, আর ঘরে বসে তুমি ঝনঝন করে টাকা গুনছ। উহ! ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়!”

ঝনঝন সত্যিই হচ্ছিল, তবে তা আমার টাকার থলেতে নয়, আমার মাথার ভিতর। উহ! লার্কা একে সহ্য করে কী করে? আমার কাজটা যে কতটা ঝুঁকির, সেটা বোঝার ক্ষমতা এই মহাশয়ের অন্তত নেই। অসহ্য লাগছিল লোকটাকে। ও কী করে জানবে, রাতের পর রাত ঘুমোতে পারি না, পিঠের ফিক ব্যথার জন্যে। বিশেষ করে ওর ওই ‘রোমাঞ্চকর বর্ষার রাতে ব্যথাটা বার বার মনে করায় শিরদাঁড়ার পুরোনো চোটের কথা।

একটা দুর্ঘটনায় পাঁচ নম্বর ভার্টিব্রা ভেঙে গিয়েছিল। দুর্ঘটনা আমাদের জীবনসঙ্গী। এই তো, এবছরই হিমালয়ান কার র‍্যালিতে চার-চারজনের গাড়ি ক্র্যাশ করেছিল। দ্য ব্রায়ান, ওমেগিও, তু হারা আর ভিক্টর গোলোসেয়েভের গাড়ি। কাকে বলব এসব কথা! এই লোকটাকে? লোকটার মুখ দেখলে মনে হয় গোটা শতাব্দীর সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা ওর মুখে বাসা বেঁধেছে। তাকাতে ইচ্ছা করে না। নেহাত লার্কার স্বামী, না হলে…

রাগে গা রি রি করছিল। তবুও বললাম, “এক্কেবারে ঠিক বলেছ শ্রীযুক্ত তিমচিক আন্দ্রোজিন!” এত বছরের মধ্যে এই প্রথম একেবারে ওর পোশাকি নাম ধরে কথা বললাম, “একটা আধটা নাকি? অনেক কিছু নিয়ে ফিরেছি। এই যেমন ধরো, পিঁপড়েদের উদ্ধার করার অভ্যাস।”

পিঁপড়ের দল এখনো ঘাসের ফলাটার উদ্দেশ্য ধরতে পারেনি, কাজেই ওরা এদিকে এলই না। ভাবলাম, একটা কাঠি দিয়ে ওদের ওই ঘাসের ফলার সেতুর পথটা দেখিয়ে দিই। একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে সেই চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাহ, এবারও কোনো ইতর বিশেষ হল না। বরং ওরা ভয় পেয়ে একটা মরা পাতার নীচে গিয়ে ঢুকল।

“পিঁপড়েরা নিজেদের তুলনায় বহুগুণ ভারী জিনিস বইতে পারে। কিন্তু তার মর্যাদা কেউ দেয়? মোটেই না।”

লার্কা ঠিক কী বলতে চাইল কে জানে?

যাই হোক, পিঁপড়েদের পার করার জন্যে কিছু একটা করতেই হবে।

আমার পকেটে একটা ছোটো ছুরি থাকেই। দেশলাই কাঠিটাকে ছুরি দিয়ে দু-ভাগ করলাম। তার একটা ভাগ দিয়ে একটা পিঁপড়েকে তুলে পিঁপড়েসুদ্ধ কাঠিটাকে ঘাসের গোড়ার দিকে রাখলাম আর অন্যটা দিয়ে ওকে ঠেলতে লাগলাম যাতে ও ঘাসের উপর দিয়ে এগোতে থাকে। কিন্তু ও কাঠিটা প্রাণপণে আঁকড়ে ঝুলতে লাগল। ওর ভয় কাটাতে হবে। আমি আস্তে আস্তে ওকে খোঁচাতে লাগলাম। ওইটুকু প্রাণীর কী জোর! ও আমাকে আপ্রাণ বাধা দিচ্ছিল, আঙুলে বেশ টের পাচ্ছিলাম সেটা।

যাক! শেষপর্যন্ত ও এগোনো শুরু করল। প্রথমদিকে খুব ধীরেসুস্থে, গুঁড়জোড়াকে এদিক ওদিক নাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগল। এতক্ষণ ও ছিল কাঠিটার নীচের দিকে, এবার সাহস সঞ্চয় করে ঘুরে গেল উপরদিকে, তারপর বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে এগোতে লাগল। এখন আর ও ভয় পাচ্ছে না তা ওর চলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

নজরে এল, লার্কা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কাজকর্ম দেখছে।

সূর্য এখন ঠিক মাথার উপরে। তার প্রখর তেজ টের পাচ্ছি বেশ। লার্কা বসে ছিল আমার পাশে। প্রায় বছর চারেক বাদে ওকে এত কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখলাম। অনেক পরিবর্তন হয়েছে ওর। চোখের কোলে, কপালে আবছা বলিরেখা দেখতে পাচ্ছি। আগে ওকে কোনোদিন জ প্লাক করতে দেখিনি। এখন প্লাক করা জর নীচে চোখদুটোকে সরু দেখাচ্ছে। ওর চেহারার সেই অমলিন সারল্য আর নেই। চোখে বিদ্যুৎ, গালে এক অদ্ভুত লালিমা–এ লাকাকে আমি চিনি না।

হয়তো ঐ পেট মোটা, গাল ফোলা, কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো মোটা গোঁফওয়ালা বকচ্ছপ আন্দ্রোজিনের বোকা বোকা চুটকি আর মাথামুণ্ডুহীন কথায় ও আপ্লুত হওয়ার ভান করছে। লার্কার মতো মেয়ে! আন্দ্রোজিনের উপর হিংসে হওয়া কি খুবই অস্বাভাবিক?

‘তবে তুমি কিনা কার রেসিংয়ে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন, ওই তিমচিক আন্দ্রোজিনকে হিংসে করা কি তোমায় সাজে!’ খুব করে বোঝালাম নিজেকে। না, মাথা গরম করা মোটেই উচিত নয়।

লম্বা শ্বাস নিয়ে আমি আবার পিঁপড়েদের দিকে নজর দিলাম।

ন’ টা পিঁপড়ে জলের ওপারে আটকা পড়েছিল, একে একে সব ক’ জনই এপারে এসে পৌঁছেছে দেখছি। আচ্ছা, আবার যদি ওদের জলের ওপারে রেখে আসি ওরা কি পথ চিনে আসতে পারবে? দেখা যাক!

এই না ভেবে একটা পিঁপড়েকে ধরে ওইদিকের মাটির ঢিবিটার উপরে রেখে এলাম। পিঁপড়েটা কিন্তু সহজেই পথ চিনে কাঠিটার কাছে এসে প্রথমে শুড় বাড়িয়ে ওটা চুল, তারপর তরতরিয়ে কাঠি পেরিয়ে ঘাসের ফলার উপর দিয়ে দিব্যি চলে এল ওর দলের কাছে, একবারও থমকাল না কোথাও। দেখে আশ্চর্য লাগল। ওইটুকু একটা প্রাণী কত সহজে কায়দাটা শিখে নিল! ও সত্যি সত্যি শিখেছে, না ব্যাপারটা কাকতালীয়? আমি পরীক্ষা করার জন্য আরও দু’বার বেচারাকে ওইদিকে রেখে দিলাম। দু-বারই ও দৌড়ে চলে এল এদিকে! শুধু তাই নয়, এতটাই দৃঢ়তার সঙ্গে এদিকে এল যে দেখে মনে হল, সেতুটা ওর পরিকল্পনায়ই তৈরি হয়েছে।

“সেকালের গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো তোমার মনে কোনো দয়ামায়া নেই তালানভ।” আমার কাজকর্ম দেখতে দেখতে লার্কা হঠাৎ বলে উঠল, “পেট্রোল আর ইঞ্জিন এছাড়া তুমি আর কিছু বোঝ না। গাড়ি, পিঁপড়ে, মানুষ সব তোমার কাছে এক। সবই নিছক বস্তু। হুবহু একরকম, পরমাণুর অনুভূতিহীন কতগুলো কম্পন ছাড়া কিছু নয়।”

বললাম, “আমি মানুষ অবশ্যই ভালোবাসি, তবে…” লার্কা তেরছা চোখে আমার দিকে তাকাল। “তবে সত্যি বলতে কী, যারা খাড়া পাহাড়ের বিপজ্জনক কিনারা ধরে চলাচল করে তাদের উপর আমার কিঞ্চিৎ দুর্বলতা আছে। জানোই তো ঝুঁকি নিতে আমি নিজেও পছন্দ করি, তাই আমার কাছে এসব লোকের মূল্য অন্যরকম।”

কথাটা মুখ থেকে বেরোনো মাত্রই বুঝতে পারলাম, ভুল হয়ে গেল। আসলে নিজের কানেই কথাটা কেমন অহংকারী ঠেকল। লার্কার মুখ দেখে বুঝলাম ও মনে মনে আহত হয়েছে।

“শ্রীমতীর এই ‘পর্বত অভিযান’–এর আসল কারণটা তুমি আদৌ বোঝোনি হে তালানভ! উদ্দেশ্যটা খুব পরিষ্কার। একটু চোখ কান খোলা রাখলেই টের পাবে।” তিমচিক আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল। আকাশের সীমা এখানে পাহাড়চূড়ায় গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে। একটা সাংঘাতিক কিছু আবিষ্কারের উত্তেজনায় তার গোঁফজোড়া কাঁপছিল তিরতির করে। বলল, “ও আমাদের দু’ জনকে এই জাইলাস্কি আলাউ পাহাড়ের গোলকধাঁধায় টেনে এনেছে। কেন? দু’ জনেই যাতে ধ্বসে চাপা পড়ি। এই আমি, লার্কার স্বামী, খুব ভালো করে জানি, আমাকে ও সহ্য করতে পারে না। আর তুমি তালানভ। ওর ‘প্রাক্তন’। দেশবিদেশের কত ভালো ভালো মেয়ের পর কি আর ওকে মনে ধরে! তাই দু’জনের থেকেই মুক্তি পেতে চায় ও।”

আমি যে ভুলটা করেছিলাম, তাকে কাজে লাগাতে তিমচিক এক মুহূর্ত দেরি করল না। ওর সাধের পি.এইচ.ডি করতে গিয়ে সমস্ত শুভ বুদ্ধিশুদ্ধিগুলোকে সিন্দুকে বন্দি করে ফেলেছে তিমচিক। অথচ ছোকরা মন্দ নয়। কিন্তু ওর পক্ষে রেসিং ড্রাইভার হওয়া সম্ভব নয়।

লার্কার চোখেমুখে ভাবান্তর দেখলাম না। বরং সে শান্ত স্বরে বলল, “ঠিক বলেছ তিমচিক, তোমাদের অন্তত একজনের অবশ্যই ধ্বসে আটকে পড়া উচিত। একটা নতুন অভিজ্ঞতা বৈ তো নয়! কিন্তু কী জানো? সেরকম কিছু ঘটবে না। আমার কথা না-ই মানতে পারো, কিন্তু আমি জানি, তোমাদের যে জায়গাটা দেখাতে চাই, কোনোরকম দুর্ঘটনা ছাড়াই সেটা হয়ে যাবে। পথ অনেকটাই, তবে সূর্যাস্তের আগে ঠিক পৌঁছে যাব। এখন এইবেলা অবশ্য হাঁটা শুরু না করলে মুশকিল হবে। চলো, চলো, এগোই।”

আন্দ্রোজিন এত সহজে প্রসঙ্গ ছেড়ে নড়ার লোক নয়। সে গদগদ স্বরে বলল, “কিন্তু সুন্দরী, একটা কথা তোমার ওই রেসিং বীরকে জিজ্ঞেস করো তো, ওই যারা খাড়া পাহাড়ে চড়তে যায় বা বিপজ্জনক পথ বেয়ে গাড়ি নিয়ে ওঠে তাদের প্রতি ওর এত ভক্তি কীসে?”

যদিও সে অত্যন্ত মিষ্টি স্বরে বলল, কিন্তু চলার পথে এমন বাক্য বিনিময় কাম্য নয়। কিন্তু ওর কথায় আমার অন্তরের পবিত্র ভাবনাগুলো যেন ছিটকে বেরিয়ে এল। বললাম, “আন্দিজ পর্বতের একটু উপরের দিকে, যেখানে মোটামুটি তুষার রাজত্ব শুরু হয়, শুনেছি সেখানে একরকম ফুল পাওয়া যায়। ওখানকার স্থানীয় লোকজন গ্রেভারস,

গ্রেভাইরস, এরকম কছু একটা নামে ডাকে ওই ফুলটাকে। আমি দেখিনি, তবে যা বর্ণনা শুনেছি তাতে মনে হয় সেটা দেখতে পপির মতো, তবে আকারে বড়ো।” আগের প্রসঙ্গের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য না থাকলেও আমার কথা ওরা শুনছিল। মনের মধ্যে বিক্ষোভ চললে আমার গলার স্বরে সেটা বোঝা যায়। বললাম, “এর নির্যাস দিয়ে বানানো শরবত খেলে নাকি লোকজন খানিকক্ষণের জন্যে উন্মাদ হয়ে যায়। পুরোহিতেরা বছরের পর বছর, হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী ওই গ্রেভাইরস খেয়ে রাতের অন্ধকারে বিপজ্জনক পাহাড়ের খাড়াই রিজগুলো অক্লেশে পার হত গোষ্ঠীর বাকি লোকগুলোকে চমকে রাখার জন্য, বিশেষ গুল্ম থেকে তৈরি টানটান দড়ির উপর দিয়ে। তোমরা এখনো পেরুতে ওইরকম দড়িতে তৈরি ব্রিজ দেখতে পাবে।”

.

চাঁদের দেবী

বললাম বটে, ওই গ্রেভাইরসের গল্পে আমি নিজেই বিশ্বাস করতাম না। এমনিতে দক্ষিণ আমেরিকার এসব দিকে হাজার রকমের কুসংস্কার বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। আর শুধু এখানেই নয়, আরও বহু জায়গায়ই নানারকম কুসংস্কারের ছড়াছড়ি দেখেছি।

কিন্তু গতবছরের আগের বছর ইনকা সান কাপ র‍্যালি হয়েছিল কারাবায়ো পাহাড়ে। জায়গাটা পুরোনো ইনকা রাজধানী কাসকোর পুবদিকে। সেবারের প্রতিযোগিতাটা খুবই শক্ত ছিল, কারণ এই গিরিখাতের মধ্য দিয়ে চলা তো তার পরেই খাড়া পাহাড় চড়া। রাস্তাগুলোও সাংঘাতিক প্যাঁচানো। মনে আছে, টানা দু-সপ্তাহ প্রতিযোগিতা চলার পর যখন শুনলাম দু-রাত একদিন বিশ্রাম পাওয়া যাবে, আমি আর ভিক্টর দু’জনেই খুব খুশি হলাম।

ভিক্টর আমার সহযোগী চালক। আমার মতো ও-ও বিশ্রামের জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল। সেদিন ঘুম ভাঙল প্রায় দুপুরের খাওয়ার সময়ে। খাওয়াদাওয়ার পর ঠিক হল মাছ ধরতে যাওয়া হবে। ওখানকার নদী আমাদের এই তিয়েনশানের মতো খরস্রোতা, ফেনিল উচ্ছ্বাসে বয়ে চলেছে। তাছাড়া মাছ ধরার পক্ষেও ভালো। ছিপ ফেললেই ট্রাউট ওঠে।

ছোট্ট শহর লা পাকুয়া। আমরা আমাদের ছিপ আর মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে শহরের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম ডঙ্কো স্ট্যামাটভকে। স্ট্যামাটভ বুলগেরিয়ার দলের প্রতিযোগী।

“আরে স্ট্যমাটিখ যে!”

আমার গলা শুনে ও তাকাল। এবার রসেত্তিকে ও দারুণভাবে বিট করেছে। সেকথাই বললাম ওকে, “আরে ভায়া, রসেত্তিকে যা দিলে! ও ভাবতে পারেনি! দেখো, এবার ও ওদের নেপলসের বিখ্যাত গানই ভুলে না যায়!”

“তখন না হয় আমাদের স্লাভ ভাষার গান শিখিয়ে দেব!” ডঙ্কো মুচকি হেসে বলল, “কিন্তু বাপু মৎসশিকারী, অন্ধকার নামার আগে ফিরে এস হে! বিকেলে একটা বিশেষ জায়গায় যাওয়ার আছে। পাহাড়ের অনেকটা উপরে, যেখান থেকে বরফ পাওয়া যায়, তারও খানিকটা উপরে রেড ইন্ডিয়ান উপজাতিদের একটা গ্রাম আছে। সেখানকার লোকজন এখনো বিশেষ একটা সভ্য হয়ে ওঠেনি। অমাবস্যার পর প্রথম যে চাঁদ ওঠে, সেই চাঁদের উদ্দেশ্যে ওদের কী একটা বড় অনুষ্ঠান হয়, আজ সেই অনুষ্ঠান। আর এই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, একজন রেড ইন্ডিয়ান সুন্দরী পাহাড়চূড়ার উপর থেকে ভেসে ভেসে নিচে আসবে শুনেছি, বিশাল কোনো জন্তুর থাবায় বসে অথবা পিঠে ডানা লাগিয়ে। সে যাই হোক, এরকম অভিজ্ঞতা আমার অন্তত আগে হয়নি। তুমি শুনেছ কখনো? আমিও অবশ্য এরকম কোনো অনুষ্ঠানের কথা আগে শুনিনি। তোমরা শুনে থাকতেও পারো।”

ডঙ্কোর কাছেই শুনলাম, “মেয়র নিজে আমাদের নেমন্তন্ন করেছেন, ভাবতে পারো! আসলে, ভদ্রলোকের গাড়ির উপর একটা দুর্বলতা আছে, যেমন আমাদের রসেত্তির কথাই ভাবো না! ওর দুর্বলতা অবশ্য মেয়েদের উপর।”

আবার রসেত্তির কথা ঘুরে ফিরে এসে গেল। কতগুলো ব্যাপার ডঙ্কো জানিয়ে দিল, “হ্যাঁ, তবে একটা ব্যাপারে মেয়র বার বার অনুরোধ করেছেন, কেউ যেন কোনোরকম ক্যামেরা ব্যবহার না করে। আমার অবশ্য অনুরোধ না বলে আদেশ বলেই মনে হয়েছে।”

এ ব্যাপারে অবশ্য একজনকে নিয়েই আমার ভয়। সেটা গোলোসেয়েভকে নিয়ে।

আমরা রাত্তির আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলাম। যে যার গাড়ি নিয়ে যাব।

পাহাড়ে অন্ধকার তাড়াতাড়ি নামে। শেষ পাঁচ কিলোমিটার আমাদের পাঁচটা গাড়ি সারি বেঁধে ক্রমশ চড়াইতে উঠছে। ইঞ্জিনের একটানা গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। আমরা যে পথ দিয়ে উঠছি, এ পথে সাধারণত গাড়ি চলে না। মালবোঝাই লামাদের চলাচলের রাস্তা এটা। এখানে মাল বওয়ার জন্য গরু, ঘোড়া, গাধা বা খচ্চর এসবের ব্যবহার নেই, তার জায়গা নিয়েছে এই লামারা।

রাস্তাটা পাহাড়ের গা বেয়ে সরু সুতোর মতো উঠে গেছে। আর অন্যদিকে গভীর খাদ। মেয়র ছিলেন স্ট্যামাটভের গাড়িতে। একটা তীক্ষ্ণ বাঁক ঘুরে গাড়িটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়র বাইরে এসে দু-হাত তুলে নাচের ভঙ্গিমায় আমাদেরও থামতে ইঙ্গিত করলেন। মেয়রের অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসি পাচ্ছিল। যাই হোক, ভদ্রলোক জানালেন, “গাড়িতে আর যাওয়া যাবে না, রাস্তা বড়োই সরু। আর তাছাড়া, আপনাদের ভালোমন্দের দায় তো আমার উপরেই। ওই রাস্তায় গাড়িতে যেতে গেলে যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়! তার জবাবদিহি কে করবে বলুন? তার চেয়ে চলুন, পায়ে হেঁটে এগোনো যাক। না না, বেশিদূর নয়। হেঁটে গেলে বড়োজোর ঘণ্টা খানেকের পথ।”

মেয়রের কথা শেষ হওয়ার আগেই রসেত্তি তার গাড়ির অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিল। গোঁ গোঁ করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে সামনের চড়াই বেয়ে উঠতে লাগল তার ভিসুভিয়াস। খানিকক্ষণ বাদেই আমাদের ঠিক মাথার উপরের রাস্তায় ওর গাড়ির লম্বা হয়ে ছড়িয়ে পড়া আলোটা আর তার ঠিক পিছনেই ওর কোঁকড়া চুলে ভরা মাথার স্যিলুয়েট দেখা গেল, সঙ্গে ওর তীক্ষ্ণ গলার গানও কানে এল–

‘চাঁদের আলোয় দেখেছিলাম।
সুন্দরী সে, জ্যোৎস্না মেয়ে।
গোলাপরঙা চুলের বাহার
শ্রেষ্ঠ কে আর তোমার চেয়ে
লা-লা-লা-লা—’

রসেত্তি আমাকে আর গোলোয়েসেভকেও খুব করে বুঝিয়েছিল।

সে যাই হোক, মেয়র প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু হাজার হলেও তিনি লা পাকুয়ার সর্বাধিনায়ক, কাজেই সামলেও নিলেন চট করে। রাসেত্তির পথের দিকে দু-চারবার নজর দিয়ে যেন কিছুই হয়নি এভাবে আগের কথার খেই ধরল।

রসেত্তির গাড়িটা এবার নেমে এল; স্ট্যামাটভের গাড়ির সামনে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে ও বেরিয়ে এল বাইরে। মেয়র একটু চড়াই ভেঙে ওর পাশে গিয়ে পিঠে হাত দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন। ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেল। আমরাও আবার এগোলাম। হ্যাঁ, গাড়িতেই।

শেষপর্যন্ত দশটা নাগাদ আমরা সেই রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রামে পৌঁছে গেলাম।

গ্রামে পৌঁছনোর খানিক আগে থেকেই বেশ কয়েকটা আগুনের শিখা নজরে আসছিল। এরকম অদ্ভুত রঙের আগুন আগে কখনো দেখিনি। বেগুনি আগুনের শিখা, তার মধ্যে। থেকে নানাধরনের হলুদের আভা উঁকি দিচ্ছিল।

গ্রামের মধ্যে দিয়ে গাড়িতে যেতে যেতে ছোটো ছোটো বাড়ি নজরে আসছিল। বাড়িগুলো বেশ শক্তপোক্ত, ঢালাই ছাদের। আগুন জ্বালানো হয়েছে এখান থেকে খানিক দূরে, একটা পাথরের মিনারের গোড়ায়। মিনারের আকৃতিটা বেশ নজর টানে। এর মধ্যে তিনটে অগ্নিকুণ্ডের উপর বিশাল বিশাল আকারের তিনটে কড়াই ঝোলানো হয়েছে।

গাড়ি যেখানে রাখা হল, সেখান থেকে কিছুটা চড়াই উঠলেই এই পাহাড়টার চূড়ো। আর সেখানেই মিনারের চারদিকে আগুনের বেষ্টনী।

এই পাহাড়টার পিছন দিয়ে আরেকটা খাড়া চড়াই। সে চড়াইটা সোজা উঠে গেছে আরেকটা চূড়ায়। তার মাথায় একইরকম একটা অদ্ভুত আকৃতির মিনার দেখতে পেলাম, যার গোড়ায় একটামাত্র আগুনের কুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। তবে এই দুটো পাহাড়ের মধ্যে বেশ গভীর খাদ। নীচে বোধ হয় একটা নদী আছে, কেননা অবিরাম একটা জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

এবার চড়াই ভেঙে ওই আগুনের কুণ্ডগুলোর কাছে পৌঁছতে হবে। আমরা হাঁটা শুরু করলাম।

অনেকে যাচ্ছে এ পথে। এখানকার লোকজনের টুপি আর উজ্জ্বল রঙের পোশাক চোখে পড়ে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার! যারা যাচ্ছে, সবাই পুরুষ, একজন মহিলাকেও দেখলাম না!

আমরা প্রায় পৌঁছে গিয়েছি, সেই সময়ে মেয়র হঠাৎ ফিসফিস করে বললেন, “ওই যে পাটাতনের উপর লাল কাপড় পরে বয়স্ক মানুষটি বসে আছেন, উনি মোড়ল। একেবারে মাটি ছুঁয়ে ওঁকে সম্মান জানাবেন সবাই। ওঁর বাঁদিকে দেখুন তিনজন আছে, তার মধ্যে দু’জন গুনিন আর ওই যে মাথায় ঈগলের পালক গুঁজেছে, ও-ই পুরোহিত। আরেকটা কথা মনে রাখবেন, এখানে বিদেশিদের কথা বলা নিষেধ। কোনোরকম গান টান গাইবেন না যেন। সেনুর রসেত্তি, কথাটা খেয়াল রাখবেন।”

খেয়াল করলাম, মোড়ল বসেছেন একটা চিতাবাঘের ছালের উপর। মেয়রই প্রথমে খুব ঘটা করে নীচু হয়ে মোড়লকে অভিবাদন করলেন। আমরাও একে একে সেই চেষ্টা করলাম, তবে বেশ নাকানিচোবানি খেতে হল সেটা করতে গিয়ে।

মোড়ল উঠে দাঁড়িয়ে একইভাবে আমাদের সামনে মাথা নোয়ালেন। তারপর খুব দ্রুত কতগুলো শব্দ উচ্চারণ করে আমাদের এগিয়ে আসতে ইশারা করলেন, তা বেশ বুঝতে পারলাম। তবে মোড়লের কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারলাম না।

মেয়র দোভাষীর কাজটা করে দিলেন। “চন্দ্রদেবের যোদ্ধাদের অধিনায়ক, যিনি তাঁর রথের সিংহাসনে আসীন, তাঁর রাজ্যে আপনাদের স্বাগত। তাঁর তেজ আপনাদের সমস্ত অশুভ থেকে রক্ষা করুক।”

মোড়লকে দেখে মনে হল বয়স কম করে আশি তো হবেই। ঝুপো জ্বর নীচে তাঁর তীব্র দৃষ্টিতে যদিও তারুণ্যের ছোঁয়া। চারজন মুশকো জোয়ান মোড়লের দেহরক্ষী। তির-ধনুক, বর্শা ছাড়া একটা উইনচেস্টার রাইফেলও রয়েছে তাদের সঙ্গে।

উইনচেস্টারওয়ালা এবার ওই চিতাবাঘের ছালটাকে আর একটু ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের বসতে ইঙ্গিত করল। বসা মাত্র অতিথিসেবার আয়োজন হল। সাদা রঙের পানীয় ভর্তি পোড়ামাটির পানপাত্র আমাদের সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। পাত্রগুলো একেবারে কানায় কানায় ভর্তি। তার সঙ্গে এল সোনার থালায় গরম গরম সুগন্ধি ভাজা মাংস। মাংসটা এ অঞ্চলের এক বিশেষ ধরনের প্রাণী, কেভির। কেভির মাংসের এই পদটা আন্দিজের একটা ঐতিহ্য।

এটাই এদের অতিথিসকারের রীতি। আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, এই মাংস আর পানীয় না খেলে এদের অসম্মান করা হবে।

খুব সন্তর্পণে ভয়ে ভয়ে একটু মাংস মুখে দিলাম। মাংসের মধ্যে নানারকম মশলা আর পাতার পুর ঠাসা।

মেয়র মোড়লের সঙ্গে খুব সহজভাবে কথা বলছিলেন। একবার দেখলাম আমাদের গাড়িগুলোকে দেখিয়ে কিছু বললেন, তারপর আমাদের নাম শুনতে পেলাম ওঁর কথার মধ্যে। যদিও কী বলছেন, সেটা বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল আমাদের পরিচয় দিচ্ছেন।

আমাদের যে পানীয় দিয়েছিল, কয়েকবার তাতে চুমুক দিলাম। বেশ টক-মিষ্টি খেতে। সামনেই সেই উঁচু স্তম্ভটা আকাশ ছুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার নীচে সেই বেগুনি রঙের আগুনের কয়েকটা কুণ্ড জ্বলছে। আর সেই আগুন ঘিরে অবিশ্বাসে স্তব্ধ হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মানুষ, তাদের মুখে একটাও শব্দ নেই। দেখলে মনে হতে পারে যে, ওরা কথা বলতেই জানে না। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল।

কালের ফিরতি স্রোতে ভেসে আমি যেন পৌঁছে গেলাম সুদূর অতীতে। ভেসে বেড়াতে লাগলাম কাল থেকে কালান্তরে। কখনো রাজা সভাতোস্লাভের কোনো বিশ্বস্ত অনুচর আমি, আবার সময়ের অন্য ফ্রেমে আমি তাতারদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়েছি বীর নাইট ইয়েভপাতির সঙ্গী হয়ে, অতীতের কোনো কুয়াশামাখা ভোরের আধফোঁটা আলোয় ওই তো দেখতে পাচ্ছি নেপ্রিয়াদভা নদীর তীরে ওকগাছের জঙ্গলের মধ্যে অশ্বারোহী দু’জন নাইট মুখোমুখি। একজনের মাথায় বাহারি শিয়ালের লোমের টুপি, আরেকজনের পোশাক একেবারেই সাদামাটা। গ্রামের সাধারণ চাষির মতো একটা দোমড়ানো শার্ট পরনে, বুকের কাছে ব্রোঞ্জের ঐশ আঁটা। শিয়াল-লোমের টুপিধারীর চোখে মুখে খুনে ক্রোধ জ্বলজ্বল করছে। দু’জনেই দু’ জনের দিকে বর্শা ছুড়ল একইসঙ্গে আর তারপর… তারপর আহত দুই যোদ্ধা ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেল।

ডম-ডম-ডম-ডম… দামামার জোরালো আওয়াজে বাস্তবে ফিরে এলাম। আওয়াজটা মনে হয় আসছিল ওদিককার চূড়ার উপরের বিচ্ছিন্ন মিনারটার উপর থেকে।

পুরোহিত এতক্ষণ মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। ওই আওয়াজটায় যেন প্রাণ ফিরে পেল। দু-হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। খেয়াল করলাম, প্রসারিত হাতদুটোতে পাখির পালক বাঁধা রয়েছে। এবার সে এগিয়ে গিয়ে মিনারের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

দুই গুনিন পুরোহিতকে সাহায্য করছিল। শুরু হল মন্ত্রোচ্চারণ। একটানা একঘেয়ে সুর।

আগুনের কুণ্ডগুলো ক্রমশ একটু একটু করে কমে আসতে লাগল। ধোঁয়ার চাদরে সবকিছু ঢেকে গেল। আগুনও ছোটো হতে হতে একসময় পুরোপুরি নিভে গেল। শুধু এদিককার কুণ্ডগুলো নয়, চড়াইয়ের ওপাশের চূড়ায় যে আগুনটা জ্বলছিল, সেটাও নিভে গেল। অমাবস্যার নিবিড় অন্ধকার সমস্ত চরাচর গ্রাস করে নিল। শুধুমাত্র রসেত্তির মুখের জ্বলন্ত সিগারেটের লাল বিন্দু তারার মতো মিটমিট করছিল। একসময় সেটাও অদৃশ্য হয়ে গেল।

ভিক্টর আর আমি মেয়রের কাছাকাছি বসে ছিলাম। অন্ধকারের আড়াল নিয়ে আমি মেয়রের আরও কাছে ঘেঁষে এলাম। কীসের মন্ত্র বলা হচ্ছে জানতে আমার খুব কৌতূহল হচ্ছিল, আর সেটা একমাত্র এঁর কাছ থেকেই জানা সম্ভব। তাই মেয়রের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, “কিছু মনে করবেন না, ওরা কী বলছে একটু বলবেন?”

“ওরা চন্দ্রলোকের আত্মাকে আহ্বান করছে। যতক্ষণ না স্তম্ভের উপর পৌঁছবে, ততক্ষণ এই মন্ত্র চলতেই থাকবে। আমি আপনাকে মন্ত্রের অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছি, আপনি পরে আপনার বন্ধুদের বলে দেবেন।” মেয়রও আমার মতোই ফিসফিস করে বললেন।

“অসংখ্য ধন্যবাদ!”

সেইমতো ওদের মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মেয়রের অনুবাদও চলতে লাগল। মন্ত্রগুলো ছিল প্রশ্ন-উত্তরের ঢঙে।

“আলোর খবর সঙ্গে করে শিখর পেরোয় কোন জনা?” পুরোহিতের উচ্ছ্বসিত গলা যেন মিনারের চূড়া থেকে ভেসে এল।

এর উত্তরে সামনের চড়াইয়ের ওপার থেকে অপেক্ষাকৃত তরুণ গলা শোনা গেল, “দীপ্তিময়ী চাঁদের দেবী।”

“পিঠের ডানায় দেবীর চিহ্ন বহন করেন কোন জনা?”

“চাঁদের দয়ার আধার যিনি।”

“তাঁর চুলের জালে আলোর ছটা,
যেন কচি চারার দোলা
যেন তরুণ স্রোতের চলা
কোন সে দেবী, কোন জনা?”

“দীপ্তিময়ী চাঁদের দেবী।”

“যার চোখের ধারা আশিস হয়ে বৃষ্টি নামায় ধরার বুকে–
কোন সে দেবী, কোন জনা?”

“চাঁদের দয়ার আধার তিনি।”

“যিনি তফাত করেন জনম-মরণ
মন্দ-ভালো
আঁধার-আলো
কোন সে দেবী, কোন জনা?”

“দীপ্তিময়ী চাঁদের দেবী।”

এই প্রশ্ন-উত্তর আরও অনেক লম্বা ছিল। আমার পক্ষে কেন, কারো পক্ষেই সব মনে রাখা সম্ভব নয়। আর তাছাড়া মেয়রের অনুবাদের ভাষা! অনেক কথাই বুঝতে পারছিলাম না।

শেষপর্যন্ত খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর মিনারের মাথা থেকে পুরোহিতের গলা শোনা গেল, যেন চাপা গলায় কাউকে ডাকছে

“আলোক-কুমারী তুমি
দরশন দাও দেবী
তোমার সেনানী-দলে।
আছি মোরা পথ চেয়ে।
নভোগামী দেবী এস,
আকাশেতে ভেসে এস….”

দামামা বাজতে লাগল দ্রুত তালে।

হঠাৎ আমাদের মাথার ঠিক উপরে নতুন এবং অদ্ভুত কিছু দেখতে পেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঠিক দেখছি তো! চোখ কচলে আবার তাকালাম। স্বপ্ন দেখছি না তো? নিজের গায়ে চিমটি কাটলাম। যা দেখছি তার সঙ্গে আমার বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতার মিল নেই!

সত্যিই একজন উড়ন্ত নারী, যার গা দিয়ে আলোর ছটা বেরোচ্ছে! ওদিককার পাহাড়ের উপরের মিনারের দিক থেকে অন্ধকার ভেদ করে ধীরে ধীরে আমাদের দিকে উড়ে এল! আলোকোজ্জ্বল হাতদুটো ডানার মতো নাড়ছিল উপর-নীচে। আলখাল্লার মতো একটা পোশাক ওর দুই ডানা কিংবা হাত, যাই বলি না কেন, তার মধ্যিখানে ঝকমক করছে। মুখটা চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ সাদা, দুই চোখ ঘিরে নীল রঙের বৃত্ত, মাথার উপর সরু কাস্তের মতো একফালি বাঁকা চাঁদের মুকুট শোভা পাচ্ছে।

অবিশ্বাস্য!

ভিক্টর, যে কোনোরকম অলৌকিকে বিশ্বাস করে না, চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখার পর সে এবার কী বলবে!

আমি ভিক্টর যেদিকে ছিল অন্ধকারের মধ্যে, আন্দাজে সেদিকে সরে গেলাম। কিন্তু ভিক্টর ওখানে ছিল না! নিশ্চয়ই স্ট্যামাটিখের কাছে গেছে।

চারদিক নিস্তব্ধ। কোনো শব্দ নেই, শুধুমাত্র অনেক নীচ দিয়ে যে নদীটা বয়ে যাচ্ছে, তার মৃদু কুলুকুলু ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

উড়ন্ত চাঁদের দেবীকে দেখার পর থেকে এক, দুই করে মনে মনে গুনছিলাম। ঠিক যেই একশো পঞ্চাশ গোনা শেষ হল, উড়ন্ত মূর্তিও আমাদের সামনের মিনারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল!

আকাশে এখন চাঁদ উঠেছে দেবীর মাথার উপর যেমনটি দেখেছিলাম ঠিক সেরকমই সরু একফালি চাঁদ।

এখানকার অধিবাসীরা নিজেদের চন্দ্রসেনা বলে। চাঁদের দেবীর সেনানী।

ওরা এবার ওদের ভাষায় কোনো গান গাইছিল, আর সেই সঙ্গে মন্ত্র বলাও চলছিল আগের মতো। দামামার শব্দ আর কানে আসছে না। বোধ হয় থেমে গেছে। বেশ অনেকক্ষণ মন্ত্র বলার পর এদিককার কুণ্ডগুলোর নিভন্ত আগুন আবার দপ করে জ্বলে উঠল। কিন্তু এবার দূরের কুণ্ডটার আগুন জ্বলল না।

আমি মিনার দুটোর মাঝের আকাশের দিকে তাকালাম নতুন কিছু দেখবার আশায়। এখানে আসার পর যে শরবত দিয়েছিল তার মধ্যে সম্ভবত গ্রেভাইরসের রস মেশানো ছিল। এতক্ষণে তার প্রভাব কেটে গেছে টের পাচ্ছি। এখন আমার মাথা অনেক পরিষ্কার। ভেবেছিলাম ওই ‘দীপ্তিময়ী চাঁদের দেবী’ কে আবার দেখতে পাব, কিন্তু শেষপর্যন্ত নতুন আর কিছুই ঘটল না।

এবার মিনারের সিঁড়ির মুখে পুরোহিতের অবয়ব আবার দেখা গেল। সঙ্গে গুনিন দু’ জন ছিল না। ভারী পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। ডানহাতে একটা চকচকে ছোরা আর বাঁহাতে ঝুলছে একটা ছিন্নমুণ্ড মোরগ! আমার বিস্মিত চোখের সামনে সে নেমে এসে মোড়লের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রথামতো কোমর ভেঙে নীচু হয়ে অভিবাদন জানাল। তারপর যেটা ঘটল, তা দেখে আমি শিউরে উঠলাম।

পুরোহিত মোরগটার পেট চিরে সটান তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল, তারপর টেনে ছিঁড়ে বের করে নিল মোরগের কলিজা এবং… এবং ওখানে দাঁড়িয়ে কচকচ করে চিবিয়ে খেল সেটা!

চাঁদের সেনানীর দল আনন্দে চিৎকার করে উঠল, কেউ কেউ শুরু করল উদ্দাম নৃত্য, সেই সঙ্গে দামামা আবার বাজতে লাগল আদিম ছন্দে! যেন সটান বুকের মাঝে এসে অনুরণন তোলে সে শব্দ।

অগ্নিকুণ্ডের উপরের ঝোলানো কড়াইগুলো থেকে কোন সুরুয়া এখন অনেকের হাতেই চলে এসেছে। কীসের সুরুয়া ওটা জানি না।

ভিক্টর গোলোয়েসেভকে কাছাকাছি দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হে ভিক্টর, কী বুঝছ?

ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা উঁচিয়ে ও বোঝাল ওর ভালো লাগার পরিমাণ। তারপর যেটা বলল তার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। বলল, “ফাটাফাটি! কেভির মাংসে না জানি ওরা কী মশলা দিয়েছে! আমি তো চেটেপুটে খেয়েছি। আবার যদি কেউ নিয়ে আসে আবারো খাব। স্বাদটা যেন মুখে লেগে রয়েছে।”

যা বাবা! কী আশ্চর্য! শুধুই কেভি! ওই উজ্জ্বল মানব-পাখি সম্বন্ধে একটা শব্দও নয়!

ওকে কিছু বলার আগেই আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। মনে হল, আমার দেহটা ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছে। যেন আমাকে এবার চড়তে হবে এই মিনারের উপর। পা বাড়াতে হবে ওই চড়াইয়ের দিকে। দু-বাহু নাড়াব ডানার ছন্দে। আর তখন আমায় পায় কে? আকাশে উড়তে থাকব বাঁধনহারা!

সত্যি কথা বলতে কী, এরকম অনুভূতি এই প্রথম হল, তা নয়। যখন ছোটো ছিলাম, আমাদের ইয়েলতলোভকা গ্রাম লাগোয়া ব্যাকওয়াটারে, গ্রামের মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতাম পাখির মতো, তখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এরকম স্বপ্ন বহুবার দেখেছি। তার প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি এখনো আমার মনে আছে। অনেক উপর থেকে পাখির চোখে দেখা বাড়ির লাগোয়া তরিতরকারির বাগান, পাহাড়ের গা বেয়ে ছাগলেরা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। এমনকি স্বপ্নে বোধ হয় চোখের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যার অতীত কিছু ক্ষমতা এসে যায়। তাই হয়তো দেখতে পেতাম ক্ষেতের মাচায় কুমড়ো ফলে রয়েছে, অগভীর জলায় ছোটো ছোটো মাছ খেলে বেড়াচ্ছে, গতবছরের জমানো খড়ের গাদার মধ্যে মেঠো ইঁদুরের ছুটোছুটি, এমনকি বেড়ার ধারে কালো জামের গাছের ফলগুলো পর্যন্ত! সেগুলোতে সবে পাক ধরছে।

বড়ো হয়ে ভর্তি হলাম অটোমোবাইল একাঁদেমিতে। ওখানে একটা দেওয়ালজোড়া মস্ত ছবি ছিল। ছবির বিষয়বস্তু কল্পবিজ্ঞানের। ইভান ইয়েফ্রেমভের ফিকশনে যেমন আছে তেমন একটা যান ছাড়া হচ্ছে স্তেপ অঞ্চল থেকে শনিগ্রহের উদ্দেশ্যে। যেন কয়েকশো কিলোমিটার উপরে পাক খাওয়া উপগ্রহ ছবিটা তুলে পাঠিয়েছে। পুরো জায়গাটার খুঁটিনাটি এত সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে যে সত্যি বলে মনে হয়। উৎক্ষেপণ স্থানের কয়েকশো মিটারের মধ্যে টিউলিপের লাল রঙের পাপড়ি, পাথরের খাঁজে সাপের শীতঘুমের প্রস্তুতি, গর্ত থেকে মেঠো ইঁদুরের উঁকিঝুঁকি, সমস্ত পরিষ্কার বোঝা যায়।

আমার সেই বহুবার দেখা স্বপ্নটাই যেন ছবিতে রূপ পেয়েছে। আমার খুব অবাক লাগত। বার বার মনে হত, ছোটবেলার স্বপ্নটা বুঝি কোনদিন সত্যি হবে!

মেয়রের কথায় সম্বিত ফিরল। মেয়র আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, “এ আর কী দেখছেন! দেখার মতো উৎসব হয় বসন্তকালে। একবার আসুন সেই সময়ে, মিলিয়ে নেবেন আমার কথা।”

মেয়রের ঢুলু ঢুলু দৃষ্টি একবার চাঁদের পিঠ ছুঁয়ে আমাদের দিকে ফিরল। বললেন, “দেখছেন তো, এই উৎসবে মেয়েরা নেই। কারণ এটায় ওদের যোগ দেওয়া বারণ। কিন্তু বসন্তকালের উৎসবে মেয়ে-পুরুষ সবাই আসতে পারে। খুব জাঁকজমক হয়। আরও মজা! কারণ মহিলা চন্দ্রসেনাদের সঙ্গেও উৎসবে মিলতে পারবেন। ভাবুন একবার! সূর্যোদয়ের আগে একটা জাল বিছানো হয় দুটো মিনারের মাঝে। এমনভাবে সেটা থাকে যেন ভোরের সূর্যের প্রথম আলোটা ওই জালের উপর এসে পড়ে।”

রসেত্তি মোড়লের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর একেবারে মাখনের মতো মোলায়েম স্বরে, বিনয়ে গদগদ হয়ে মোড়লকে ধন্যবাদ জানাল উড়ন্ত ‘চাঁদের দেবীর এত সুন্দর একটা প্রদর্শনীতে থাকতে দিয়েছেন বলে। তারপর বলল, “আমার আরেকটা প্রার্থনা ছিল আপনার কাছে। দয়া করে ওই দেবীর সঙ্গে যদি একবার আলাপ করিয়ে দেন। আমি কথা দিচ্ছি, আমার এই রথে চড়িয়ে ওঁকে নিজে সঙ্গে করে লা পাকুয়ার দুর্দান্ত নৃত্যশালায় নিয়ে যাব।”

মোড়ল একবার ঝটিতি তার উইনচেস্টারওয়ালা দেহরক্ষীর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “এই যে রথওয়ালা, আপনার কথা শুনলাম। কিন্তু আপনার ইচ্ছা পূরণ করা আমার সাধ্যের বাইরে। দেবী তাঁর স্বর্গীয় সুষমা বাইরের জগতের কারো কাছে প্রকাশ করেন না। আর কখনো যদি কেউ তাঁকে দেখেও ফেলে, সেই রূপ সহ্য করতে পারে না। তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। চন্দ্রগ্রহণের রাতে, যখন আলোয় কালোয় একাকার হয়ে যায়, ঠিক তখনই মৃত্যুর করাল ছায়া তার উপরে পড়বেই!

মোড়লের বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যে গা-টা শিরশির করে উঠল। রসেত্তিও ভয় পেয়েছে বুঝলাম ওর আওয়াজে। ফিসফিস করে মোড়লের কথারই পুনরাবৃত্তি করল, “চন্দ্রগ্রহণের রাতে, যখন আলোয় কালোয় একাকার হয়ে যায়, ঠিক তখনই…”

“আপনাদের ওই রথে দেবীকে চড়াবেন! ছোঃ!”

এই প্রথমবার পুরোহিতকে কথা বলতে দেখলাম। প্রথমবার এবং শেষবার। এর আগে সে মন্ত্র বলেছে, কিন্তু তাছাড়া একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। মোড়লকে নীচু হয়ে অভিবাদন করে সে বলল, “আপনাদের এই রথের ক্ষমতা কতটুকু! চাঁদের আলোয় আমাদের এই খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল বেয়ে উঠতে পারবে ওই রথ? দেবী আপনাদের অজ্ঞতা মার্জনা করুন!”

কথা ক’টা বলেই অত্যন্ত রাজকীয় ঢঙে পুরোহিত আবার মিনারের দিকে ফিরল, তারপর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল মিনারের অন্ধকারে।

সবাই বিব্রত বোধ করছিলাম এই কথোপকথনে। তাই একটু স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, “চাঁদের দেবী কতদিন বাদে বাদে চন্দ্রসেনাদের দেখা দেন?”

“উনি বছরে একবারই আসেন। চন্দ্রের মৃত্যু মিনার থেকে নিয়ে আসেন চন্দ্রের তেজ, নিয়ে আসেন জীবনের দোলন মিনারে। আর সেই রাতে দেবীকে তুষ্ট না করলে গোটা পৃথিবীর মানবজাতির উপর নেমে আসে তাঁর ক্রোধ, আর তাই সেই দৈবদুর্বিপাক এড়াতে দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে তাঁর পুজো করতে হয়। অনেক পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় ছোটোখাটো বিড়ম্বনা ঘটতে পারে। এগুলো দেবীর ইঙ্গিত। আর তখন অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে তাতে শুকনো কাশফুল জ্বালাতে হয়, দামামা বাজিয়ে বলি দিতে হয় আর সেই প্রাণীর কলজে কাঁচা খেতে হয়।”

মেয়রের কাছে আরও জানলাম, যবে থেকে চন্দ্রসেনারা প্রথম পৃথিবীতে এসেছিল, তখন থেকেই এই প্রথা একইভাবে পালিত হচ্ছে। তা সে আজ বাষট্টি হাজার চাঁদ আগের ঘটনা।

‘বাষট্টি হাজার চাঁদ’ মানে বাষট্টি হাজার চান্দ্রমাস, হিসেব করে দেখলাম প্রায় পাঁচ হাজার বছর।

অর্থাৎ, এদের কাহিনি অনুযায়ী ওরা পাঁচ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল, হোমারের সময়েরও আগে।

ভিক্টর একটু বাঁকা হেসে বলল, “আর তাই, যে রাতে শ্রীমতী চন্দ্রদেবী আপনাদের মধ্যে আসেন, সেদিন মোরগের কলজে খেতে হয়?”

মোড়ল হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিলেন। তারপর অতি শান্তভাবে বললেন, “শুধু মোরগের কলজে বললে ভুল হবে, যে-কোনো জীবিত প্রাণীর কলজে। আমাদের এই পুরোহিতের ঠাকুরদা যখন পুরোহিত ছিলেন, তখন অবশ্য মোরগ চলত না। সে অন্য কিছু ছিল, অন্যরকম প্রাণী।”

ক্রমশ রাত্রি বাড়ছে। চাঁদ এখন মধ্যগগনে। নিস্তব্ধ সেই রাতে এক আকাশ তারার নীচে আমরা ক’ জন নির্বাক দাঁড়িয়ে আছি। ওই সরু একফালি চাঁদের আলো দূরের পাহাড়গুলোর মাথার জমাট বরফের উপর পড়ে এক অদ্ভুত মায়ার সৃষ্টি করেছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। আমাদের শহরে ফিরতে হবে। প্রতিযোগিতা থেকে বিশ্রামের মেয়াদ আজ রাত পর্যন্ত। কাজেই এবার রওনা হওয়া উচিত।

মোড়ল আমাদের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। লক্ষ করলাম, দেহরক্ষীও এল সঙ্গে সঙ্গে। মেয়র তাঁকে অনেক কিছু উপহার দিলেন কয়েক বাক্স ওয়াইন, নানারকম খাবার, একটা কুড়ুল আর করাত। করাতটা বড়ো, দু’ জনে দু-দিকে ধরে ব্যবহার করতে হয়।

মোড়ল আর মেয়রের মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু কথা হল। তারপরেই দেখলাম দু’জনে কোলাকুলি করলেন আর মোড়ল কাঁদতে লাগলেন। কিছুই বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

রসেত্তি জিজ্ঞেস করল, “কী হল, উনি কাঁদছেন কেন? উনি কি আমার কথায় দুঃখ পেয়েছেন? কীসব আবোলতাবোল বকলাম! দেবীকে নৃত্যশালায় নিয়ে যাব! ছি ছি! আমি ওঁকে যদি আঘাত করে থাকি তবে যেন আমার মাথায় বজ্রপাত হয়।”

“না না, সেজন্য নয়। তিন বছর আগে চাঁদের দেবী ওঁর নাতিকে নিয়ে নিয়েছেন। বাচ্চাটা ওই ওপাশের চড়াই বেয়ে উঠছিল, তারপর কী করে যেন পা পিছলে খাদে পড়ে যায়। তার আগের বছর ওঁর ছেলে মারা যায়।” মেয়র বললেন।

খুবই দুঃখজনক ঘটনা। কার জীবনে যে কী লুকোনো থাকে, বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝারই উপায় থাকে না।

“এই চন্দ্রসেনাদের মোড়ল নির্বাচনের একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। বর্তমানের মোড়ল তার বংশের কোনো উত্তরসূরিকে নির্বাচন করেন, তাঁর মৃত্যুর পর সেই হয় পরবর্তী মোড়ল। সেটাই নিয়ম। কিন্তু মুশকিল হল, উনি আমাকে সেই দায়িত্ব দিতে চাইছেন! আমি তো জানি যে আমি কতটা দুর্বল চিত্ত, তার উপর আবার ‘রুলের জুয়া ছাড়া থাকতে পারি না। এই দায়িত্ব কি আমায় সাজে!” মেয়র কাঁচুমাচু মুখে জানালেন।

শেষপর্যন্ত জানা গেল মেয়র আদতে মোড়লের ভাইপো।

আমার গাড়ির বুটে সেলোফেনে মোড়া পেরুনের একটা ছোটো প্রতিকৃতি ছিল। খুবই ছোটো, আসল গাড়ির দশ ভাগের একভাগ হবে কি হবে না। সৌর প্যানেল লাগানো, রিমোট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মোড়কটা মোড়লের পায়ের কাছে রেখে বললাম, “আমাদের সকলের তরফ থেকে চন্দ্র সেনানীদের অধিপতির জন্যে এই সামান্য উপহার। মোড়কটা খুলে জিনিসটা দেখালাম।

মোড়ল মৃদু হেসে গাড়িটা নিলেন, তারপর কপাল কুঁচকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন সেটা। মনে হল, এরকম জিনিস আগে কখনো দেখেননি। শেষপর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে বললেন, “সে অনেকদিন আগের কথা। আমার বাপ-ঠাকুরদার আমলের কথা বলছি। তখনকার পুরোহিতের ছিল প্রখর দূরদৃষ্টি। উনি বলেছিলেন, যত বড়ো রথই হোক

কেন, আমাদের এই আঁকাবাঁকা চড়াইতে ওঠার সাধ্য কারো নেই। তাই এই রথ শিশুকে খামোখা চালিয়ে কষ্ট দেওয়ার দরকার নেই। অনেক অনেক চাঁদ আগে, আমাদের পরদাদাদের সময় স্বর্গ থেকে পবিত্র পাথর এসে পড়েছিল। তার ধারে আমার সিংহাসন, আর সিংহাসনের পাশে এই রথের জায়গা হবে। তাহলে সকলেই দেখতে পাবে।”

এই সামান্য জিনিসে একজন প্রাজ্ঞ মানুষ এত খুশি হতে পারেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

তবে তাঁর অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। যখন মোড়লকে রিমোট দিয়ে কীভাবে গাড়ি চলে তা হাতেকলমে দেখিয়ে দিলাম, মোড়ল শিশুর মতো হেসে উঠল।

রিমোটটা দেখিয়ে বললাম, “দেখুন মোড়লমশাই, এই রথ-শিশু চড়াই বেয়েও উঠতে পারে। এই যে, এই চৌকো বোর্ডটা দেখুন, এখানে চারটে পাপড়ি দেখতে পাচ্ছেন তো! এগুলো দিয়েই এই রথ-শিশুকে চালাতে হয়।” মোড়লকে রিমোটটা দেখিয়ে বোঝাতে থাকলাম কী করে গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। “এই যে লাল পাপড়িটা দেখছেন, এটা টিপলে রথ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, আবার সবুজটা টিপলে পিছনের দিকে চলতে থাকবে। আর ডাইনে-বাঁয়ে সরাতে হলে এই নীল আর কমলা পাপড়ি দুটো লাগবে। কমলা পাপড়ি টিপলে বাঁদিকে, আর নীলটা দিয়ে ডানদিকে। আর এই যে মাঝখানে এই গোলটা দেখছেন, এটা এই যন্ত্রের চোখ। রথ-শিশু কোথায় যাচ্ছে এখানটায় দেখতে পাবেন সেটা। ধরুন ও নীচে নদীর দিকে গেলে এখানে নদীর ছবি ফুটে উঠবে, আবার ও যদি পাহাড় বেয়ে চড়তে থাকে, এখানে সেটাই দেখা যাবে।”

মহা উৎসাহে মোড়ল মেয়রের সাহায্য নিয়ে রিমোট দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে দেখলেন। কী আনন্দ তাঁর! মোড়লকে এত খুশি হতে এর আগে দেখিনি।

মোড়ল জিজ্ঞেস করলেন, “এই রথ-শিশু কি খুব বেশি দূর যেতে পারে?”

“তা পারে বৈকি! সারারাত ধরে একটানা ছুটতে তো পারবেই। আর হ্যাঁ, এই পাপড়িওয়ালা বোর্ডটাকে দুপুরবেলা রোদ্দুরে রাখলে রথ-শিশু সবসময়েই টগবগে থাকবে, কক্ষনো ঝিমিয়ে যাবে না। তবে একটা ব্যাপারে সাবধান, এই বোর্ডটা যেন কখনোই উপর থেকে পড়ে না যায়, তাহলে কিন্তু রথ-শিশু আর চলতে পারবে না।”

“এ বোর্ডটাকে গুনিনদের কাছে রাখতে দেব, ওরাই সাবধানে রাখতে পারবে। বলে দেব, রোজ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একে রোদে রাখতে, আর আমি যতদিন বেঁচে আছি। কোনোমতে যেন এই বোর্ড উপর থেকে না পড়ে খেয়াল রাখতে বলব। তবে, রথে চড়লেও আপনারা লোক ভালো। এর আগে কোনো বিদেশি আপনাদের মতো চন্দ্রসেনাদের অধিপতিকে এত আনন্দ দিতে পারেনি। পুরস্কার পাওনা আছে আপনাদের। বলুন, কী পেলে আপনারা খুশি হবেন?”

মোড়ল ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন যেদিকে পাহাড়ের মাথায় চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। তারপর হেসে বললেন, “বলুন, আমাদের এই চাঁদের আলোর জগৎ থেকে অন্ধকারের পথে কী নিয়ে যেতে চান?”

রসেত্তি উত্তেজিত! আমার কানে কানে বলল, “সুযোগটা কোনোমতেই হাতছাড়া করা যাবে না, সেনর তালানভ! আমি বলি কী, যে থালায় করে আমাদের ভাজা মাংস দিয়েছিল, তার অন্তত একটা দিতে বললে হয়। ওগুলো যে বিশুদ্ধ সোনার, তা আমি সেন্ট

জানুয়ারিয়াসের নামে দিব্যি দিয়ে বলতে পারি। আর এক-একটার ওজন দেখেছ?”

আমার ইচ্ছে ছিল গ্রেভাইরসের। আদৌ যদি ওর কোনো অস্তিত্ব থাকে, তবে সেটা একান্তই এদের নিজস্ব জিনিস। ওই জিনিসটা পাওয়ার ক্ষেত্রে এর থেকে বড় সুযোগ আর আসবে না।

আমি মেয়রকে চুপিচুপি জানালামও সেকথা। মেয়র কোনো জবাব দিলেন না। বরং ব্যথিত দৃষ্টিতে উদাস হয়ে কী ভাবতে লাগলেন।

আমি বললাম, “অসুবিধা থাকলে দিতে হবে না, আমরা কিছু মনে করব না। আপনার এই চাউনি সঙ্গে নিয়েই আমি আমার আঁধারের দেশে ফিরে যাব। মনে করব এটাই আমার পুরস্কার।”

মেয়র হাসতে চেষ্টা করলেন। তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন, “এমন কিছু পুরস্কার আছে যা জীবদ্দশায় পাওয়া যায় না, বুঝলেন! বাবার কাছে শুনেছি, একবার একজন বিদেশি এরকম অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তাকে আর সে পুরস্কার পেতে হয়নি, তার আগেই এক ধাক্কায় তাকে খাদে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।”

আমি তখনও আশা ছাড়তে পারিনি। তাই বললাম, “হ্যাঁ, ব্যাপারটা গুরুতর, তা বুঝলাম। তাহলেও একটা কথা ভাবুন, তখন কিন্তু এরকম রথ-শিশু ছিল না যে এদিক ওদিক চলতে পারে। তাই না?” আমি পেরুনটাকে দেখালাম। “আর তাছাড়া লা পাকুয়াতে এরকম আরেকটা শিশু আপনার জন্যেও রয়েছে।”

ভাইপোও দেখলাম কথাটা শুনে কাকার মতোই খুশি হয়ে উঠলেন।

মোড়ল মেয়রের সঙ্গে কোথায় গেলেন, আবার একটু বাদে চলেও এলেন। ফিরে এসে ঘোষণা করলেন, “আপনি যা চেয়েছেন তাই পাবেন। ওই আঁধারেই পাবেন আপনার পুরস্কার।”

রসেত্তিও অবশ্য তার পুরস্কারটা হাতে হাতেই পেল। একখানা নীলচে পাথর, যার মাঝখানে একটা ঘেঁদা। তা নাকি চন্দ্রদেবীর চোখের জল পড়ে তৈরি। আর একটা কাঠের খাঁচায় দুটো জ্যান্ত কেভি।

.

তোমার জায়গা কখনো শূন্য নয়

পরের দিন থেকে আবার সেই আঁটোসাঁটো কর্মসূচি। প্রতিযোগিতার ক্ষণিক অবসরে কখনো কখনো মনে পড়ে সেই রহস্যময় রাতের কথা। উপহার পাওয়া সেই পোড়ামাটির পাত্রটাকে বের করি, ওটার কাঠের ছিপি সরিয়ে গন্ধ টেনে নিই বুক ভরে। কাটা খড়, মৌরি ফুল আর সোমরাজের মিলিত গন্ধের মতো লাগে। আর তখনই মনে হয় এই উন্মত্ত রেসিংয়ের জন্যে এ-দেশ ও-দেশ ঘুরে বেড়ানো, সাক্ষাৎকার দেওয়া, নানাজনের সঙ্গে রকমারি বৈঠক, বক্তৃতা, লিডারদের হলুদ হেলমেট, পদে পদে দুর্ঘটনার কুটি, আঁকাবাঁকা পথ… সব অর্থহীন। নিজের বাড়ি, গ্রামের মাঠ-ঘাট, কুয়াশা-মোড়া নদীর বুকে খড় বোঝাই নৌকোর ভেসে যাওয়া, পাইনের পাতার ফাঁকে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শন শন… সবকিছু যেন কোন অমোঘ টানে টানতে থাকে।

কিন্তু তা সাময়িক, আবারো ফিরে আসতে হয় বর্তমানে।

এ বছরের ইনকা গোল্ড কাপ আমরাই জিতলাম। আমি আর ভিক্টর গোলোয়েসেভ। কিন্তু আমাদের এই টিমের এটাই ছিল শেষ জয়।

পেরুর ক্যালাও বন্দরে আমাদের রেসিং কার পেরুনকে নিয়ে জাহাজে উঠলাম। জাহাজের সামনের দিকের ডেকে আমাদের বাহনের জায়গা হল। তারপর কেবিনে ফিরে নিশ্চিন্তে লম্বা ঘুম দিলাম। দু-চারদিনের মধ্যেই জাহাজ রওনা দেবে।

একদিন সময় কাটাতে কাছের একটা সিনেমা হলে একটা ফিল্ম দেখে এলাম দু’জনে। ‘দ্য সিজ অফ মার্স’। খুব বিজ্ঞাপন দেখেছি এই ফিল্মটার।

ফেরার সময় ভিক্টর বলল, “কিছু মনে কোরো না, আমার একটা ছোট্ট কাজ আছে। তুমি জাহাজে ফেরো, আমি আধঘণ্টার মধ্যেই আসছি।” তারপর চোখ টিপে খুব একটা ষড়যন্ত্র করছে এমন ভঙ্গিতে বলল, “হুঁ হুঁ বাবা, কী আনতে যাচ্ছি, সেটা দেখলে হাঁ হয়ে যাবে, বুঝলে শ্রীযুক্ত স্বপ্নদর্শী!

ও ফিরল তাড়াতাড়িই। হাতে একটা টিনের কন্টেনার, যার মধ্যে সিনেমার ফিল্ম রাখে, সেরকম। সেটা নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এর মধ্যে কী রোমাঞ্চকর জিনিস লুকিয়ে আছে, তা কল্পনাও করতে পারবে না!”

“কী আর হবে? মহাসমাপ্তির উপর কোনো ফিল্ম, যেখানে তোমাকে আর আমাকে আকাশে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে আর তুমি চোখ মটকে হাসছ, ঠিক অ্যালিসের চেশায়ার বিড়ালের মতো! তোমার পকেটে নিয়েছ ক্রু ড্রাইভার, রিলে আর ক্রু। তাও আবার পকেট থেকে পড়তে পড়তে যাচ্ছে! আর আমি! তুমি যে কাপটা সামোভার থেকে তৈরি বলে থাকো, সেটাকে অজগরের মতো জাপটে ধরে ভেসে চলেছি।”

“তোমার পক্ষে অবশ্য বলা সম্ভব নয়। আমিই বলে দিই, এটাকে একটা বিজ্ঞানভিত্তিক অভিযোগপত্র বলতে পার। মানুষের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে ওই পুরোহিতরা কীভাবে তাদের বোকা বানায় সেটা দেখো। কিছু লোক ঠকানো হাতসাফাই আর রূপকথার গল্পের উপর ভিত্তি করে কেমন উড়ন্ত চাঁদের দেবীর সৃষ্টি হয়, তোমার তা অবশ্যই দেখা দরকার হে স্বপ্নদর্শী!”

ভিক্টর হো হো করে হেসে উঠল। যদিও আমার কাছে ব্যাপারটা এখনো পরিষ্কার নয়, তাই জিজ্ঞেস করলাম, “পুরোহিতরা শক্ত করে দড়ি টাঙিয়ে তার উপর হাঁটছে আর তুমি তার ছবি তুলেছ তা নিশ্চয়ই বলবে না?”

“তাদের ছবি না হলেও অনেক গোপন তথ্য এখন আমার কাছে পরিষ্কার।” ভিক্টর জ্ব নাচিয়ে বলল, “তুমি তো জানো অবলোহিত আলোর কামাল। আমাদের খালি চোখে যা দেখা যায় না, ওই আলোয় তা একেবারে দিনের মতো পরিষ্কার।”

আমি অবাক হলাম, এত কাণ্ড ঘটল কখন! জিজ্ঞেস করলাম, “এসব জোগাড় করলে কী করে?”

ভিক্টর হাসল। তারপর বলল ওর তদন্তের গল্প।

সেই রাতে ওদিকের পাহাড়ের মিনার, ওরা যেটাকে মৃত্যু-মিনার বলে, সেদিক থেকে যখন ওই আলোকিত ‘চাঁদের দেবী’ কে দেখা গেল, ও সঙ্গে সঙ্গে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সরে যায় যাতে ওকে কেউ দেখতে না পায়। তারপর আমাদের পেরুনের উপর ক্যামেরাটাকে এমনভাবে নিয়ে বসে যাতে করে লেন্সের আওতায় দুটো মিনারই চলে আসে। ক্যামেরাটাকে পনেরো মিনিটমতো অটোমেটিক মোডে রেখে দেয়। ফলে দুটো মিনারের মধ্যে ভাসমান মূর্তির পুরো ছবিই উঠেছে।

আমি সেই সময় উত্তেজিত ছিলাম সেই উড়ন্ত নারীকে দেখে, যার আলোকোজ্জ্বল হাতদুটো ডানার মতো নড়ছিল উপর-নীচে, আলখাল্লার মতো একটা পোশাক যার দুই ডানা কিম্বা হাত… যাই বলি না কেন, তার মধ্যিখানে ঝকমক করছিল, যার মুখটা চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ সাদা, দুই চোখ ঘিরে নীল রঙের বৃত্ত… বুঝলাম সেইজন্যই তখন গোলোয়েসেভকে আমার আশেপাশে খুঁজে পাইনি।

“তাহলে আমার দুঃসাহসী বন্ধু, তোমার ফিল্মে কী দেখিয়েছ?” ভিক্টর গোলোয়েসেভকে জিজ্ঞেস করলাম।

“আমি দেখাব কেন? আরে বাবা, তোমার মতো না হলেও আমারও তো কিছু আবেগ টাবেগ আছে! যা দেখিয়েছে তা ওই আবেগহীন ক্যামেরা, আমি এখানে নিমিত্তমাত্র। এটুকু বলতে পারি, আমার যুক্তিকে আমার ক্যামেরা প্রমাণসহ সিলমোহর দিয়েছে। তবে আমাদের ভালোমানুষীর সুযোগ নিয়ে ওরা বোকা বানিয়েছে তার জন্য খারাপ লাগার কিছু নেই। আরেকটা জিনিসও পরিষ্কার হল। ওই গ্রেভাইরস বা যাই হোক, তার ব্যাপারে যেসব গল্প চালু আছে তা পুরোপুরি বাজে কথা।

ভিক্টর ওর ফিল্ম রাখা বাক্সটাকে এমনভাবে নাড়াল, যেন কোনো রাজা তার হাতির দাঁতের রাজদণ্ডটা নাড়াচ্ছে! তারপর বলল, “গতকালই ফিল্মটা ডেভেলপ করে পর্দায়। দেখলাম। আমি বার বার বলি অলৌকিক বলে কিছু হয় না। কোনো রঙ করা পাখি টান টান তারের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে, ব্যাপারটা তা নয়। মেয়েটি একটা রিঙের সঙ্গে বাঁধা ছিল। এক মিনার থেকে আরেক মিনার পর্যন্ত রিঙের মধ্যে দিয়ে দড়ি একটা গলানো ছিল, যেটা দিয়ে ওকে টানা হচ্ছিল। দড়ির ফাঁসটা এমনভাবে বাঁধা ছিল, যা দরকারমতো ছোটোবড়ো করা যায় যাতে ওই রিঙটা পাক না খায়। মেয়েটা এদিকের মিনারে যেই পৌঁছে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ওদিকের মিনারের কোনো অদৃশ্য শক্তি দড়িটাকে খাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলে। তারপর যথারীতি আমাকে চিমটি কাটল। “তোমার মতো স্বপ্নালু লোককে বোকা বানানো বড়োই সহজ।”

“সব কথায় ঠেস না দিলে তোমার চলে না, তাই না? তবে এবার তুমি ছাড়ান পাচ্ছ না, বুঝলে হে কেভি-ভুক!”

“তোমার বোঝাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। একবার নিজের চোখে দেখো পর্দার উপর কী ঘটছে, তখন বুঝবে কে কাকে কীভাবে বোকা বানিয়েছে। এস এ ঘরে।” গোলোয়েসেভ বিনয়ে একেবারে গলে গিয়ে নীচু হয়ে দরজা দেখাল। বলল, “ফিল্মটা টেলিভিশনের পর্দায় দেখানোর বন্দোবস্ত করেছি। আমার চেনাশোনা আরও কয়েকজনকেও বলেছি। ওহ! কী সাংঘাতিক ব্যাপার যে হতে চলেছে! একটা হইচই পড়ে যাবে।”

“তুমি বড়ো চালাক হে গোলোয়েসেভ, একেবারে জন্ম-বৈজ্ঞানিক! একদল বিজ্ঞানী আছে না, যারা জ্যান্ত ব্যাঙের গায়ের ছাল ছাড়িয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হয় তা পরীক্ষা করে, তোমার অনুসন্ধিৎসাও সেরকম। এখন কথা হল, জীবনের রহস্যময়তার মধ্যে কতদূর পর্যন্ত উঁকি মারা উচিত? তুমি এই রহস্যের ব্যবচ্ছেদ করতেই পারো। খুব ভালো কথা, করো! কিন্তু মাথায় রেখো, প্রকৃতি তার গোপন রাজত্বের মধ্যে নাক গলানো পছন্দ করে না, একদিন তার প্রতিশোধ নেমে আসবেই। যারা দুর্গম পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়, তারাও কিন্তু প্রকৃতির কাছে মাথা নুইয়েই সেখানে যায়, তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নয়।” আমি উপর উপর শান্ত থাকলেও মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হচ্ছিলাম।

ভিক্টর আমার দিকে একটা বাঁকা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “তোমার কথাগুলো বেশ সুন্দর। কিন্তু তোমার প্রকৃতি-রানি কি শুধুমাত্র পুরোহিতদের ওইসব গালভরা মন্ত্রতন্ত্রের বদলেই মানুষজনকে উৎসাহ দেন? মানে, আমি বলতে চাইছি, ওই পুরোহিতরা কি মধ্যস্থতাকারী?”

“আঁধার-আলোর মাঝে যে মৃত্যুর কথা আসছিল ঘুরেফিরে, তাকে কি তোমার উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছিল? তোমার মনে হওয়ার উপরে আমার কোনো হাত নেই। কিন্তু যারা চাঁদের দেবীর রহস্যভেদ করতে চেষ্টা করেছে, তাদের পরিণতির কথা ভুলে যেও না। তারা কেউ বেঁচে ফেরেনি।”

ভিক্টর হেসে বলল, “স্বপ্নদর্শী! ওই মায়ামূর্তিকে তুমি বুঝতে পারোনি! আর ওদের কথার মধ্যেকার মারপ্যাঁচও ধরতে পারোনি। সমতলবাসী লোকজন ওদের ওই ‘সনাতন দৃশ্য’–এর রহস্যভেদ করতে চেষ্টা করলেই যে শাস্তি পাবে, তা নয়! শাস্তি দেওয়া হয়। চন্দ্রগ্রহণের রাতে। ভেবে দেখো, ব্যাপারটা কিন্তু খুব স্বাভাবিক নয়। সেদিন ওই অশীতিপর মোড়লের পদকে কীভাবে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে দেখানো হচ্ছিল, সেটা খুব ভালোভাবে লক্ষ করেছিলাম। হয়তো-বা একটু ঝুঁকিই নিয়ে ফেলেছিলাম।”

“তোমার যা ইচ্ছে তাই করো, আমি কিছু বলতে যাব না। তবে একটা অনুরোধ, আমি একা ফিল্মটা দেখতে চাই, একদম একা, তুমিও থাকবে না। আরেকটা কথা, আমাকে স্বপ্নদর্শী বলা বন্ধ করো, বিরক্ত লাগছে।”

গোলোয়েসেভ ফিল্মের কন্টেনারটা টেবিলে রেখে কাঁধ ঝাঁকাল, তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

কেবিনের মধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে, যেন কেউ কালি ঢেলে দিয়েছে। পোর্ট হোল দিয়ে দূরের দ্বীপ দুটোয় মিটমিটে আলো দেখা যাচ্ছে। এই দ্বীপ দুটো ক্যালাও বন্দরকে খোলা সমুদ্রের থেকে আলাদা করে তার ঝাঁপটা থেকে বাঁচাচ্ছে।

আমি কন্টেনারটাকে নিয়েই ডেকে উঠলাম। ওই তো দাঁড়িয়ে আছে আমার লৌহ শকট। আমার আদরের পেরুন। মোটা কাছিতে বাঁধা। একেবারে সুরক্ষিত। ওর চকচকে গায়ে হাত বোলালাম পরম মমতায়।

নীচে নেমে কেবিনে ঢুকে আগে শার্সিগুলো বন্ধ করলাম কেউ যেন উঁকিঝুঁকি না মারতে পারে। এখন বন্ধ কেবিনে আমি আর ওই রহস্যময় কন্টেনারটা। যার মধ্যে আছে ভিক্টরের রহস্যন্মোচনের চাবিকাঠি।

ভিক্টরের কাহিনি আমার কৌতূহল জাগাতে পারেনি। বরং অস্বস্তি লাগছিল। এমন একটা অনুভূতি, যেন প্রতিযোগিতা শুরুর আগে পেরুনকে জেতানোর জন্য আমি আড়ি পেতে শুনে নিয়েছি প্রতিপক্ষের শলাপরামর্শ।

অবশ্য কৌতূহল যে একেবারে হচ্ছিল না, তা নয়। আবার লজ্জাও লাগছিল। আমি কি চুপিচুপি গ্রিনরুমের পর্দা সরিয়ে উঁকি মারতে চলেছি? অভিনয় শেষে পর্দা পড়ে গেছে, কুশীলব যে যার রঙ মুছে ফেলেছে, দর্শকহীন থিয়েটারে শুধু ইঁদুরদের কুটুর কুটুর।

ফিল্মটা প্লেয়ারে চাপালাম। এবার সুইচ অন করলেই, ব্যস! সমস্ত রহস্যের ইতি। হাতটা বাড়ালাম, কিন্তু সুইচ পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই কে যেন ভিতর থেকে বলে উঠল, “কী দেখতে চাও, গোললায়েসেভ ঠিক, না ভুল? কীসের রহস্যভেদ করবে? সেদিন যে রহস্যে তুমি মজেছিলে, তার পিছনে পার্থিব কোন সূত্র আছে জেনে কী লাভ?”

সত্যিই তো, প্রকৃতিতে কত ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত, আপাত দৃষ্টিতে তার না আছে কূল, না কিনারা।

এই যে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক, প্রতিবছর নিয়ম করে উড়ে যায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাহাড়, সমুদ্র ডিঙিয়ে, আবার ফিরেও আসে। কই, তাদের তো দিক ভুল হয় না! সে রহস্যের উত্তর কোথায়?

আমার জীবনেও এমন ঘটনা ঘটেছে তার কার্য-কারণ আজও আমার অজানা।

আমি তখন বেশ ছোটো। আমাদের পরিবার সেই সময় গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। গ্রামে আমাদের কুকুর ছিল নার্কা, তাকে ওখানেই ছেড়ে আসা হয়। সাতদিন বাদে সাড়ে ছশো কিলোমিটার রাস্তা উজিয়ে শরতের তাইগা তৃণভূমি পেরিয়ে কীভাবে সে চলে এসেছিল আমাদের শহরের নতুন বাড়িতে।

আরেকটা ঘটনার কথা বলি। তখন কিছুটা বড়ো হয়েছি। অটোমোবাইল অ্যাকাঁদেমিতে ভর্তির যে শেষ পরীক্ষাটা ছিল, তার ঠিক আগের রাতের ঘটনা। সেদিনের পেপারটার উপর নির্ভর করছে আমি ভর্তি হতে পারব কি পারব না। স্বপ্নে যেন পুরো প্রশ্নপত্রটা দেখতে পেলাম! আর পরীক্ষা দিতে গিয়ে যখন প্রশ্নপত্র হাতে পেলাম, তখন অবাক হয়ে দেখলাম, সেখানে জ্বলজ্বল করছে স্বপ্নে দেখা তিনটে প্রশ্ন–একেবারে হুবহু যেমনটি দেখেছিলাম!

আমার একটা ক্ষমতা অনেকবার টের পেয়েছি, বিশেষ করে জ্যোৎস্না রাতে গাড়ি চালানোর সময় সমস্ত অদেখা বাঁক, চড়াই-উত্রাই, পথে কোনো ধরনের বাধা আছে কি না, দুর থেকে আসা গাড়ি বা ট্রাক… যেগুলো বাঁকের আড়াল থেকে দেখতে পাওয়ার কথাই নয়, আমি সব আগে থেকে টের পাই। আমি জানি না, কী করে এটা হয়!

আসলে এই পৃথিবীতে আমাদের চলার পথে এমন অনেক রহস্য, এমন অনেক ব্যাখ্যার অতীত ঘটনা আছে, যা হয়তো জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রহস্যের ওড়নার আড়ালে একটু আধটু পরিচয়ের মধ্যেই তাদের সৌন্দর্য।

এই মহাবিশ্বে অনেক সভ্যতা জন্ম নিয়েছে, আবার অনেক সভ্যতা শেষ হয়ে গেছে। তার একটা কারণ অবশ্যই পারমাণবিক ঘূর্ণি, যার সবটার নাগাল আমরা এখনো পাইনি। আর আমার ধারণা, আরেকটা কারণ অবশ্যই নিষ্ফলা যুক্তিজাল, যা পৃথিবীর শেষ রহস্যটাকেও গলা টিপে মেরে ফেলে। গ্রামের বাড়ির সবাই যদি একে একে চলে যায়, কী হয় তবে? ধীরে ধীরে সেই বাড়ির মৃত্যু ঘটে। যে মানুষের মনে কোনো আবেগ নেই, ভালোবাসা নেই, মনোজগৎ শুধুই শুকনো যুক্তিতে ঠাসা, তাকে কি আদৌ জীবিত বলা চলে?

আমি ফিল্মটা আবার কন্টেনারে ঢুকিয়ে ফেললাম। কেবিন থেকে বেরিয়ে ওটাকে নিয়ে ধীরেসুস্থে চলে গেলাম জাহাজের পিছন দিকে। রেলিংয়ের উপর একটু ঝুঁকে হাতটা সামনে বাড়ালাম। তারপর মুঠো আলগা করে দিলাম। আর দাঁড়ালাম না। পিছন ফিরে সোজা চলে এলাম আমার কেবিনে। ‘ঝপাং’ শব্দটা কানে এসেছিল সঙ্গে সঙ্গেই। চাঁদের দেবীর কলুষিত ছায়া–এবার শান্তিতে ঘুমোও তুমি প্রশান্ত মহাসাগরের জলের নিচের নিশ্চিন্ত বিছানায়।

চাঁদের দেবী খাদ পেরিয়ে আলোর রথে চেপে আসতে থাকুক যুগযুগান্তর ধরে… মানবসভ্যতা বয়ে চলুক কাল থেকে কালান্তরে…

আমি আর দেরী করলাম না, পরেরদিনই কিউবার প্রথম প্লেন ধরলাম। তারপর ফিরে এলাম মস্কোতে।

গোলোয়েসেভ অবশ্য আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করেনি যে, ফিল্মটা একবারও না দেখেই আমি সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম।

একবার একটা পুরোনো ম্যাগাজিন থেকে একটা প্রবন্ধ অনুবাদ করেছিলাম। চলে আসার সময় সেটা ওকে দিয়ে এলাম। আমার যুক্তিশীল বন্ধুটি মহাসমুদ্রের এই বিশাল পটভূমিকায় এবার রাতের বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উপর দিয়ে ভেসে চলা সঙ্গীহীন অ্যালবাট্রোসের কথা ভাবার বদলে নতুন কিছু ভাবতে থাকুক।

প্রবন্ধটা নিচে তুলে দিলাম।

.

চন্দ্রের রহস্যময় বল

ভরের দিক থেকে বিবেচনা করলে চাঁদ আর পৃথিবী এই দুই জ্যোতিষ্কের কেউই ফেলনা নয়। তাছাড়া মহাজাগতিক দূরত্বের নিরিখে এরা একে অপরের বড়োই কাছাকাছি। কাজেই এদের মধ্যেকার মহাকর্ষীয় বল যথেষ্ট প্রবল, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চুম্বক যেমন লোহাকে নিজের দিকে টানে; তেমনি চাঁদও সাগর, মহাসাগরের বিপুল জলরাশিকে নিজের দিকে টানতে থাকে। ফলে কী হয়? সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে ওঠে।

জোয়ারের সময় অনেক উপকূলেই বিশাপ বিশাল ঢেউ ওঠে। যেমন আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমের দিকে যে খাঁড়িগুলো আছে, জোয়ারের সময় কখনো-সখনো কুড়ি ফুট পর্যন্তও ঢেউ ওঠে! ফ্রান্সের ব্রিটানিতে জোয়ার আর ভাটায় জলস্তরের এতটাই পার্থক্য থাকে, যে জোয়ার-ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সেখানে বিরাট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে।

তবে শুধুমাত্র সমুদ্রের কথা বললে ভুল হবে। চাঁদের মহাকর্ষীয় টান মহাদেশের উপরেও পড়ে। চাঁদের টানে মহাদেশের স্থলভাগ ২৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে।

পৃথিবীর স্থলভূমি সব জায়গায় কিন্তু সমান পুরু নয়। যেসব জায়গায় পৃথিবীর মাটির আবরণ কম পুরু, চাঁদের টানে সেসব জায়গার মাটি ফেটে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

এমনকি আমাদের পৃথিবীকে জড়িয়ে আছে যে বায়ুমণ্ডল, ওই একই কারণে সেখানেও জোয়ার-ভাটা খেলে। দেখা গেছে অন্য সময়ের থেকে পূর্ণিমা অমাবস্যায় বায়ুর চাপ প্রায় তিন মিলিবার কম থাকে।

এবার আরেকটা তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যাক।

সূর্য থেকে পৃথিবীতে যে পরিমাণ আলো এসে পড়ে, তার একশো হাজার ভাগের এক ভাগ চাঁদের পিঠ থেকে প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে আসে। এই পরিমাণ সূর্যালোকে পৃথিবীর তাপমাত্রা এক ডিগ্রির দু-হাজার ভাগের একভাগ বাড়তে পারে।

মনে হতে পারে, এই সামান্য পরিবর্তন পৃথিবীর আবহাওয়ার উপর আর কী প্রভাব ফেলবে?

আমরা এবার পিছিয়ে যাই প্রথম খ্রিস্টাব্দে। তঙ্কালীন ইতিহাসবেত্তা এবং প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্লিনির মতে, পূর্ণিমায় বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায়, আর সেজন্য বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে। তাঁর এই পর্যবেক্ষণ কি শুধুই বিভ্রম? যুগ যুগ ধরে বহু মানুষ বিশ্বাস করেছে, চাঁদের কলার সঙ্গে আবহাওয়ার একটা যোগাযোগ আছে। কলা যত বাড়তে থাকে, আবহাওয়াও তত ভালো হয়। তারা কি সবাই ভুল?

দীর্ঘ সময় যাবৎ আবহাওয়াবিদরা এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন। শেষপর্যন্ত আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী বিগত পঞ্চাশ বছরের পনেরোশো চুয়াল্লিশটা জায়গার মোলো হাজার আবহাওয়ার রিপোর্ট নিয়ে পর্যালোচনা করেন। তাঁদের গবেষণা ছিল মূলত বৃষ্টিপাতের উপর। তাঁরা যে সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছোন, তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তাঁরা দেখেন পূর্ণিমা বা অমাবস্যার তিন থেকে পাঁচদিনের মধ্যেই বেশিরভাগ বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে।

তাঁদের এই গবেষণা নিয়ে সারা বিশ্বেই একটা সংশয় তৈরি হয়। শেষে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা আমেরিকার বিজ্ঞানীদের তত্ত্বের সঙ্গে একমত হলেন। তাঁরাও বললেন, পূর্ণিমা বা অমাবস্যার পরপরই সাধারণত বৃষ্টিপাত হয়।

আরেকদল বিজ্ঞানী কাজ করছিলেন ঘূর্ণিঝড় নিয়ে। তাঁরা দুশো ঊনসত্তরটি আবহাওয়া স্টেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটা মজার সিদ্ধান্তে পৌঁছন। তাঁরা দেখান, পূর্ণিমা বা অমাবস্যার সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা অন্যান্য সময়ের তুলনায় পঁচিশ শতাংশ বেশি থাকে।

ঘটনা হল, পৃথিবীর আবহাওয়ার উপর চাঁদের প্রভাব সম্পর্কে এখনো আমরা অন্ধকারে।

এ সম্বন্ধে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতটি এইরকম:

মহাবিশ্বের ফাঁকা স্থান বলতে যাকে বোঝায়, তা আদৌ ফাঁকা নয়, বরং সেখানে রয়েছে মহাজাগতিক ধুলো, উল্কার ধ্বংসাবশেষ আর মৃত গ্রহ। হতে পারে, এইসব মহাজাগতীয় বস্তুর কিছু অংশ চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে প্রথমে চাঁদের দিকে ধেয়ে আসে, তারপর পৃথিবীর অভিকর্ষের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। কারণ, চাঁদের তুলনায় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ অনেক প্রবল।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর এইসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার সংস্পর্শে আর্দ্র বায়ু ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে এবং মেঘের সৃষ্টি হয় ও বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে।

আগেই বলা হয়েছে মহাসাগর, মাটির শক্ত আবরণ, বায়ুর চাপ, এমনকি তাপমাত্রাও চাঁদের টানে প্রভাবিত হয় এবং সম্ভবত মানুষ এবং পশুপাখির আচরণও।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

শামুক-জাতীয় প্রাণীরা জোয়ার আসার সময় তাদের খোলক ফাঁক করে রাখে আর জোয়ার নামার সময় খোলক বন্ধ করে। এইভাবে ওরা একদিনে প্রায় পঁয়ষট্টি লিটার জল হেঁকে ফেলতে পারে আর তার সঙ্গে প্রায় সাত কোটি কুড়ি লক্ষ অণুজীব জলের সঙ্গে ওদের দেহে ঢোকে, যেটা ওদের খাদ্য।

প্রথমে ভাবা হয়েছিল, ওদের খোলকের এই গতিবিধি বোধ হয় জোয়ার-ভাটায় জলের চাপের পার্থক্যের জন্যে হয়।

এবার একটা পরীক্ষার কথা বলি।

ষোলোশো ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত থেকে শামুক সংগ্রহ করে অন্ধকার কাঁচের পাত্রে রাখা হয়েছিল। কৃত্রিমভাবে সেখানে সমুদ্রের চাপ এবং তাপমাত্রা তৈরি করা হয়েছিল। শামুকের খোলকের নড়াচড়া পর্যবেক্ষণের জন্য একটা যন্ত্র ওই পাত্রে রাখা হল।

ওই পাত্রে জোয়ার-ভাটার কোনো ব্যাপারই ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও শামুকের খোলক খোলা আর বন্ধ নির্দিষ্ট ছন্দ মেনেই হচ্ছিল।

চোদ্দ দিন বাদে একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার ঘটল। শামুকদের খোলক খোলা-বন্ধের ছন্দটা ঠিক তিন ঘণ্টা পরিবর্তিত হয়ে গেল।

এই পরীক্ষা থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়।

শামুকেরা তাদের এই নতুন বাসস্থানেও জোয়ার-ভাটার ছন্দের সঙ্গে তাদের খোলক খোলা-বন্ধের ছন্দকে মিলিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ বলা যায়, শামুকের খোলক খোলা-বন্ধের ছন্দ চন্দ্রকলার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

কিছু কিছু স্তন্যপায়ীর আচরণও চাঁদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

দেখা গেছে, গবেষণাগারের পরিবেশে ধেড়ে ইঁদুর পূর্ণিমা-অমাবস্যায় চঞ্চল হয়ে ওঠে, আর নেংটি ইঁদুরের মধ্যে চঞ্চলতা দেখা যায় পূর্ণিমায়।

পূর্ণিমা-অমাবস্যায় নয় লক্ষ প্রাণ ধ্বংস হয়েছে তা কি কাকতালীয়, না অন্য কিছু?

***

১৯৭৮ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর। সন্ধে ৭টা ২৮ মিনিট। সাত থেকে আট মাত্রার একটা প্রবল ভূমিকম্প স্রেফ তিন মিনিটে আটটা জমজমাট শহরকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিয়েছিল।

সেই সময় চাঁদ, সূর্য আর পৃথিবী এক অক্ষরেখায় অবস্থান করছিল। অর্থাৎ এটা বলা খুব কি ভুল হবে যে চাঁদ এবং সূর্যের মিলিত প্রভাবে পৃথিবীর যে অংশের আবরণ কম পুরু, তা প্রভাবিত হয়েছিল?

একটা পুরোনো কথা আছে, সংস্কারও বলতে পারি। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় নাকি ভূমিকম্প হয়। এ-সংক্রান্ত কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই। কারণ, আজ পর্যন্ত কোনো ভূ-পদার্থবিদ এ ব্যাপারটা খতিয়ে দেখেননি। কিন্তু এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাকে শুধুমাত্র কাকতালীয় বলাটা হয়তো ঠিক হবে না।

বিগত কয়েক দশকের কিছু ভয়াবহ ভূমিকম্পের দিকে নজর দেওয়া যাক।

২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬০: মরোক্কোর শহর আগাদিরে একটা বড়ো মাপের ভূমিকম্প হয়। যেখানে প্রায় বারো হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান। সেদিনটা ছিল অমাবস্যা।

২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২: ইরানের ভয়াবহ ভূমিকম্পে চার মিনিটে প্রায় বারো হাজার মানুষ মারা যান। পূর্ণিমা।

২২ মে ১৯৭০: সাংঘাতিক ভূমিকম্পে পেরুর ল্যান্ডস্কেপ বদলে যায়। এই বিপর্যয়ের বলি হন অন্তত ষাট হাজার মানুষ। পূর্ণিমা।

২৮ জুলাই ১৯৭৬: চিনে ভূমিকম্পের পর প্রায় আট লাখ মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা যান। পূর্ণিমা।

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮: সকাল ৬টা ০৮ মিনিট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প হয়েছিল জার্মানির বাডেন-উয়োটেমবার্গে। এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ব্যাপক, মোটর রাস্তা বলে প্রায় কিছুই আর ছিল না। অমাবস্যা।

১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮: ভয়াবহ ভূমিকম্পে ইরানের তাবাস শহর আর তার সংলগ্ন চল্লিশটারও বেশি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পূর্ণিমা তো বটেই, সেদিন ছিল চন্দ্রগ্রহণও।

সমাপতন, না কুসংস্কার? কী বলব? নাকি পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে ক্রিয়াশীল বলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে?

প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, স্মরণাতীত কাল থেকে চাঁদের সঙ্গে একটা রহস্যময়তা জড়িয়ে আছে। চাঁদের অধীশ্বরী দেবী সেলিনা মৃত্যুর দেবী শুধু নয়, উর্বরতার দেবী হিসাবেও পূজিত হন।

চাঁদের কলার এক অন্য তাৎপর্য আছে। এক অমাবস্যার পর থেকে পরের অমাবস্যা পর্যন্ত চন্দ্রকলার ক্রমশ বৃদ্ধি ও হ্রাস যথাক্রমে জন্ম, বৃদ্ধি, মৃত্যু এবং শেষপর্যন্ত অন্তর্ধানের প্রতীক।

প্রাচীনকালে রোমানরা বিশ্বাস করত, পূর্ণিমা বৃষ্টির লক্ষ্মণ বয়ে আনে, আবার স্পার্টানরা সবসময় পূর্ণিমায় যুদ্ধযাত্রা করত।

বর্তমানে যে ক্যালেন্ডার চালু আছে তা মূলত সৌর বৎসরের উপর ভিত্তি করে তৈরি। ইতিহাসে প্রথম যে ক্যালেন্ডারের খোঁজ পাওয়া যায় তা কিন্তু ছিল চান্দ্র ক্যালেন্ডার।

এমন অনেকেই আছেন পূর্ণিমা রাত যাদের চোখ থেকে ঘুম কেড়ে নেয়। প্রাচীন যুগে তো বটেই, এমনকি মধ্যযুগেও মানুষের বিশ্বাস ছিল চাঁদের প্রভাবে মাথাখারাপ হয়ে যায়। যে কারণে পাগল হয়ে যাওয়াকে চন্দ্রাহত হওয়াও বলা হয়। পাগলের ইংরাজি প্রতিশব্দ ‘লুনাটিক’ কথারও উৎস সেই চাঁদ, কারণ ল্যাটিনে চাঁদকে বলা হয় ‘লুনা’।

মানুষের আচরণের উপর চাঁদের প্রভাব–এ বিষয়েও একটা গবেষণা হয়েছিল।

পঞ্চাশ জন ছাত্রের একটা দলকে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন যাবৎ পর্যবেক্ষণে রাখেন। প্রতি দু-সপ্তাহ বাদে বাদে তাদের মেজাজের অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। দেখা যায়, প্রতি পূর্ণিমায় তাদের মেজাজ চরমে ওঠে, তারপর ক্রমশ শান্ত হতে হতে অমাবস্যায় একেবারে ঠান্ডা! ঠিক সেই ছন্দেই তাদের আভ্যন্তরীণ তড়িৎ বিভবও পালটাতে থাকে।

গোলোয়েসেভের মহামূল্যবান কন্টেনারের বদলে এই প্রবন্ধটা ওর কেবিনে রেখে এলাম। ওহ! ওর মেজাজের সঙ্গে একেবারে খাপে খাপে মিলে যাবে। প্রথমে আমার উদ্দেশ্য ছিল ওর পেছনে লাগা, কিন্তু তারপরে মনে হল, এই ভর্ৎসনাটা ওর পাওয়া উচিত। যেভাবে ও মহাজাগতিক চন্দ্রযোদ্ধাদের নিজস্ব জগতে নাক গলানোর চেষ্টা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য।

কিন্তু এখন ওইভাবে কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ চলে আসার জন্য অনুতাপ হয়। সেদিন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ নিশ্চিত জানি, ওই যে মিনারগুলো দেখে এসেছিলাম –তারা তাদের আকার দরকার মতো পালটে নেয়, আর বাইরের জগৎ থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে। ওই অসামান্য রহস্যময় জগৎকে রক্ষা করার জন্য কারো কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

.

বাগানের দর্পণ

আমি খুব ভালো গল্প-বলিয়ে নই। সেই তিরতিরে শীর্ণ জলের ধারাটার পাশে বসে লার্কাকে চন্দ্রযোদ্ধাদের গল্প বলছিলাম। অবশ্য খুব যে গুছিয়ে বলতে পারছিলাম তা নয়, অনেক খুঁটিনাটিই বাদ চলে যাচ্ছিল। আমার ইচ্ছে ছিল শুধুমাত্র লার্কাই এই গল্প শুনুক। কারণ, জানতাম আমার প্রতিটি কথাই ও খুব সহজভাবে নেবে।

“তোমার এই বীররসের গল্পটি খাসা। কিন্তু মুশকিল হল, তার প্রমাণ হিসেবে তোমার কাছে কি নেই।” তিমচিক একটা ধূর্ত হাসি দিয়ে বিড়ালের মতো টানটান হয়ে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর আবার শুরু করল, “হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ফিল্মটা প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে আর এটাও নিশ্চয়ই বলবে, ওই ‘ভালোবাসার মিশ্রণ ভর্তি পাত্রটার গতিও একই হয়েছে! তবে এটা তুমি বলতেই পারো, ওটা সমুদ্রের নীচে মাছেদের খেলার জন্য ওখানে পাঠিয়েছ! ওর উপরটা চাটলেই টের পাবে ওরা এখন বাতাসেও ডিগবাজি খেতে পারছে। কেউ কেউ তো আবার উড়ন্ত পাখিদের সঙ্গেও দেখা করে ফেলবে! তবে হ্যাঁ, এসব ঘটবে শুধুমাত্র পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যায়! হা হা হা…”

লার্কা এমনভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল যেন মাথাটা ধরেছে। ওর রকম-সকম দেখে বুঝতে পারছিলাম আন্দ্রোজিনকে কিছু বলতে চলেছে। ওকে সে সুযোগ না দিয়েই আমি বললাম, “কথাটা অবশ্য একদিকে ঠিকই। আমি ওই পোড়ামাটির পাত্রটাকে ক্যালাওতে জাহাজের কেবিনে রেখেই চলে এসেছিলাম।”

আন্দ্রোজিন বেশ কায়দা করে লার্কার দিকে তাকিয়ে বলল, “এরপরেও তুমি তোমার এই অধম স্বামীটির দিব্যদৃষ্টির কথা স্বীকার করবে না লার্কা!”

“কিন্তু গোলোয়েসেভের সঙ্গে তোমার ঝামেলা মিটেছে?” লার্কা এমনভাবে জিজ্ঞেস করল যেন আন্দ্রোজিনের কথা ও শুনতেই পায়নি।

“ঝামেলা তো কিছু হয়নি।” আমি খুব সহজভাবে বললাম, “একমাস বাদে আমার পেরুনকে সঙ্গে নিয়ে ও ফিরে এল। আর মজার ব্যাপার, ও দিব্যি গেলে বলল, আমি নাকি ওর সঙ্গেই ছিলাম! ওই ফিল্মে ইনকা গোল্ড কাপের শেষভাগ আর পুরস্কার বিতরণী ছাড়া আর কিছুই ছিল না–এটাও শুনলাম ওর কাছে। আমি পাত্তা দিলাম না। সেই সময় আমি পিরেনে নেকলেস কাপের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এবার আমার সঙ্গী অ্যাশট মেলকোয়েন। আর এবার গাড়িটাও আলাদা। সিলভার ফক্স।”

আন্দ্রোজিন হঠাৎ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গান ধরল, “তাই তাই তাই… আমার সিলভার ফক্স চাই…”

তারপর যেন বিদ্রূপ করে বলল, “এখানে বসে থেকে কী হবে? এগোনো যাক লার্কার গোপন রহস্যের দিকে! হে হে… তবে যাই বলো বাপু, এইসব পাণ্ডববর্জিত জায়গার রহস্যের তুলনায় আমাদের রাশিয়ান রহস্য ঢের ঢের ভালো। তবে সেসব রহস্যের তো কোনো ভুল প্রমাণ নেই!” মুখচোখের বিশেষ ভঙ্গি করে আন্দ্রোজিন তার মহামূল্যবান বক্তব্য শেষ করল।

আন্দ্রোজিনের সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকলে মাথা ঠান্ডা রাখা দায় হয়ে ওঠে। কিন্তু মেজাজ হারানো চলবে না। তাই নিজেকে বার বার বোঝাতে লাগলাম, ‘তিমচিকের কথায় কিছুতেই রেগে গেলে চলবে না। অন্যকে ব্যঙ্গ করা, তাদের কাজ নিয়ে মজা করা শুধু ওর শখ নয়, বরং বলা যায় এসব না করলে ওর পক্ষে বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়। যেন এটাই ওকে জল হাওয়া যোগায়। এবার যদি ওকে বলি যে পত্রিকার জন্যে বেশ গুছিয় একখানা অভিযানের গল্প লেখো তো, তবেই বাছাধনের সব জারিজুরি বেরিয়ে যাবে। অন্যের ধারণা থেকে সাহায্য না নিলে তো এক কলম লেখা বেরোবে না! তবে হ্যাঁ, ‘রসায়ন বিজ্ঞানের অবিনশ্বরতা…’ এছাড়া ওর জীবনে আর কিছু রহস্যের জায়গা নেই।’

***

যাই হোক, আমরা আবার এগোনো শুরু করলাম।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর আমরা একটা সালফার প্রস্রবণের কাছে এসে পৌঁছলাম। ফিনকি দিয়ে গরম জলের ধারা বেরিয়ে আসছে মাটির তলা থেকে। এতটাই তেজে বেরোচ্ছে যে, সটান এক মানুষেরও বেশি উঁচু ফোয়ারা হয়ে বৃষ্টির মতো নীচে নামছে। এই জলের নীচে দাঁড়ালে শরীর জুড়িয়ে যায়, সব ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যায়।

তিমচিক অবশ্য স্নান করল না। একটা খাতায় খুব গম্ভীরভাবে কিছু লিখতে লাগল, যদিও লেখার মধ্যে খুব একটা যত্ন ছিল বলে মনে হয় না।

এখানেই দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারা হল। এবার তাস-আক্সু গিরিখাতের মধ্য দিয়ে পথ। সাদা পাথরের মধ্যে দিয়ে পথ কেটে তাস-আক্সু নদী এঁকে বেঁকে চলেছে। যেন পাথরেরই নদী! লার্কা বলল, “নদীর নাম সাদা-পাথুরে।”

লার্কার কথা অনুযায়ী এখান থেকে গন্তব্যে পৌঁছতে কম করে আরো দু-ঘণ্টা লাগবে। কাজেই এখন তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে, যেন অন্ধকার গম্ভীর হওয়ার আগে পৌঁছতে পারি।

পাথরের উপর পা ফেলে ফেলে এগিয়ে চলা।

আমি লার্কার ঠিক পিছনে ছিলাম। পাথরগুলো সমতল, কিন্তু বেশ পিছল। নদীটা আমাদের অনেক নীচে। তার মিষ্টি কুলুকুলু আওয়াজ কানে আসছে। নদীতে যেখানে স্রোত কম, সেখানে বেশ কয়েকবার মাছ দেখতে পেয়েছি। কাল মাছ ধরা যাবে।

আমি যেদিন এখানে এলাম, সেদিনই লার্কা আমাকে ওর একটা লাল রঙের খাতা দিয়েছিল পড়ে দেখার জন্য। আমাকে ও বলেছিল এই খাতাটার জন্যই আমাকে আলমা আটায় ডেকে পাঠিয়েছে। এটা পড়ে ওকে সাহায্য করতে হবে। খাতায় যা লেখা ছিল তা এখানে হুবহু তুলে দিলাম।

এখন এপ্রিল মাস চলছে। আজ, এই বসন্তকালে যে ঘটনার কথা লিখতে বসেছি তা সোজাসুজি গত আগস্টেই লিখে ফেলতে পারতাম। কারণ সেটা তখনই ঘটেছিল।

গবেষণা বলে, কোনো ঘটনা ঘটার এক সপ্তাহের মধ্যে মানুষ তার খুঁটিনাটিগুলোর অর্ধেক জিনিসই মনে করতে পারে না। কিন্তু এ ঘটনাটা আমি সঙ্গে সঙ্গে লিখতে চাইনি। একটু সময়ের দূরত্ব থেকে সেদিনের ঘটনাটা ব্যাখ্যা করব ভেবেছিলাম। যাই হোক, এত দিন পরেও সে ঘটনার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি এখনও আমার মনে উজ্জ্বল। শুধু এখন কেন, আমি বোধ হয় জীবনেও ভুলতে পারব না।

তিমচিকের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। আমাদের দু’জনেরই মনে হয় ওটা যেন স্বপ্ন ছিল, কিংবা হয়তো-বা স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন!

কবি লারমন্টভের ‘স্বপ্ন’ কবিতার কথা মনে পড়ে। যেখানে দেগিস্তান উপত্যকায় নিঝুম মধ্যাহ্নে ক্লান্ত নায়ক আধো তন্দ্রায় নিজেকে দেখতে পায়, যেন মারাত্মক জখম সে। স্বপ্নের মধ্যেই সে একটি অল্পবয়সী ঘুমন্ত মেয়েকেও দেখে। মেয়েটির স্বপ্নে আসে তার পরিচিত কারো মৃতদেহ… দেগিস্তান উপত্যকায় শুয়ে আছে নিঃস্পন্দ… তার বুকের ক্ষত থেকে কালচে রক্ত বেরিয়ে জমাট হয়ে আছে।

তাহলে এখানে নায়কের স্বপ্নের তিনটে স্তর, অথবা বলা ভালো, স্বপ্লত্রয়ী।

তিমচিক যথারীতি আমার পিছনে লেগেছিল, তবে ও একটা ব্যাপারে যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছিল সেটা বলতেই হয়। ঘটনাটা কাউকেই বলেনি। কারণ, আমি ঠিক এটাই চেয়েছিলাম। ঘটনাটা আড়ালেই থাকুক, এমনকি বাবাকেও বলব না। কিন্তু নিজের মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। একটা অস্থিরতা ছিলই।

নভেম্বরে তিমচিক হাঙ্গেরি গেল। আমি ওর সঙ্গে গেলাম না। বরং ঠিক করলাম, আমি যা দেখেছি তার উপর একটা গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখব। আর সেজন্য শীতকালটা লাইব্রেরিতেই কাটাতে হবে। তবে প্রচুর ঘাম ঝরিয়েও ত্রিশ পাতার বেশি এগোতে পারলাম না।

শুনেছি, পুবের দেশে নাকি একটা রোগ আছে। অতীতের দিকে অমোঘ টান। এমনকি অতীতের কিছু ঘটনা মনের মধ্যে থাকতে থাকতে এমন অবসাদ তৈরি করে যে, তার থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে মৃত্যু পর্যন্ত হওয়াও আশ্চর্য নয়। যেমন হয়তো এমন কেউ, যার সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়ার স্মৃতি জীবনভর পিছু ছাড়ল না।

আমি লিখে রাখতে চাইছি, কারণ তথ্যটা রাখা দরকার।

একেবারে গোড়ার থেকে শুরু করি।

সময়টা ছিল আগস্টের মাঝামাঝি। পর্বতারোহণের একটা শিবিরে ছিলাম সে সময়ে। দিব্যি চলছিল সবকিছু। পরের দিন তিনটে চূড়ায় সামিট করার কথা, যার একটা মাউন্ট আভিসেনা।

আমাদের ট্রেনার জুমাগেলদিনভ ট্রেনিংয়ের সময় আমার উপর খুশিই ছিলেন। কাজেই আমি নিশ্চিত ছিলাম পরের দিনের সামিট দলে আমি থাকবই।

কিন্তু আমার ইচ্ছা পূর্ণ হল না।

ঠিক আগেরদিন সন্ধেবেলায় ঠান্ডা লেগে একটু সর্দি মতন হল। ব্যস, আমি বাদ পড়লাম।

অবশ্য দোষ আমারই ছিল। কেউ জানত না, আগেরদিন দুপুরে, সূর্য যখন একেবারে মাথার উপরে গনগন করে আগুন ছড়াচ্ছে, সেই সময়ে চুপিচুপি নদীর বরফগলা জলে স্নান করেছিলাম।

খুব রাগ হল, খারাপ তো লাগছিলই। এই যদি মারাত নোকেন্তিয়েভিচ হত, এই সামান্য সর্দিকাশিকে পাত্তাই দিত না।

আর ওই সিসিলা আরকাদিয়েভনা, মোটা সাপের মতো চেহারা, আবার জামায় রেড ক্রস লাগিয়েছে! আহা! চেহারার কী বাহার খুলেছে! স্বভাবও তিরিক্ষি।

আসলে আমার উপর ওর রাগ আছে। আমার জন্মদিনে ইয়াকভ বরিশোভিচ প্রায় দুশোটা ডেইজি ফুলের এক মস্ত বড়ো তোড়া পাঠিয়েছিল আর তিমচিকও ওর স্বভাবমতো ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়িয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে ও সেটা ভালোভাবে নেয়নি।

সুতরাং পরদিন ভোরবেলা ওরা সাতজন আমাকে ছাড়াই বেরিয়ে গেল। আমার খুব অভিমান হল। নদীর পাশে বসে খানিক কাঁদলাম। আরও একবার স্নান করলাম। তারপর মনে মনে ঠিকই করে ফেললাম, পর্বতারোহণ থেকে একেবারে সরে যাব। আর সেটাই হবে এই অবিচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো প্রতিশোধ।

এক সপ্তাহ বাদে ওরা বিজয়ীর আনন্দে ফিরবে, আর আমি বসে থাকব ওদের ফেরার পথ চেয়ে এই ভাবনাটাই আমার মনে চরম বিতৃষ্ণা তৈরি করল।

ভেবে দেখলাম, এখান থেকে থ্রি লেপার্ড পাসে নেমে যেতে আমার চব্বিশ ঘণ্টার বেশি লাগবে না। এই নামার পথটা যথেষ্ট নিরাপদ, তাছাড়া খুব একটা কঠিনও নয়। এই নদীটা যেখানে তাস-আক্সুতে গিয়ে মিলেছে, রাতে দিব্যি সেখানে তাঁবু ফেলা যাবে। জায়গাটা সালফার প্রস্রবণের থেকে একটু উপরে। ওখান থেকে আর একটু নামলে গাড়ি পেয়ে যাব। দিনে একটা লরি ওখানকার মেষপালকদের কাছে আসে।

.

আমি জিনিসপত্র রুকস্যাকে গুছিয়ে নিলাম।

একজনের থাকার উপযোগী একটা তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ আর কিছু খাবার। দুটো মাংসের টিন, এক টিন কন্ডেনসড মিল্ক আর কিছু রুটি ব্যস, আর কী দরকার!

একটা চিরকুট রেখে গেলাম ওদের জন্য। লিখে রাখলাম, জরুরি দরকারে লেপার্ড পাসের রাস্তা ধরে আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেমে যেতে হচ্ছে।

এই রাস্তায় আমি বহুবার এসেছি। বিশেষ করে আমার ভাষাতত্ত্বের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা পর্বতারোহণের ব্যাজ টেস্ট দিতে এসেছে, তাদের নিয়ে।

আবহাওয়াটা সেদিন ছিল চমৎকার, আমার রুকস্যাকটাও তেমন কিছু ভারী নয়। সূর্য ডোবার যথেষ্ট আগেই রাত্তিরে যেখানে তাঁবু ফেলব বলে ঠিক করেছি, সেখানে পৌঁছে গেলাম।

সাধারণত এইধরনের গিরিখাতের বাঁদিকের ঢালে তাঁবু ফেলা হয়। এখানেও চড়াইয়ের ঢালে আন্দাজ ষাট বর্গ মিটারের একটা প্রায় সমতল তাকের মতো ঘাসে ছাওয়া জায়গা খুঁজে বের করলাম।

জায়গাটা বড়ো সুন্দর। যেখানে তাঁবুটা লাগিয়েছি, তার পিছন থেকেই চড়াই শুরু হয়েছে। এখানে কুয়াশামোড়া ভোরবেলায় প্রথম সূর্যের রশ্মি বাঁকাভাবে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা উপত্যকায়। নাচতে নাচতে বয়ে চলা নদীটার ফেনায় ফেনায় এসে পড়ে সূর্যের কিরণ। নদীখাতের গোপনতম খাঁজেও তার ছোঁয়া লাগে। সেই সৌন্দর্যে মনের কোনার সমস্ত দুঃখগুলো ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে যায়!

তাস-আক্সুকে আমি ‘নদী’ বললেও আদতে এখানে এটা একটা পাহাড়ি নালার থেকে বড়ো নয়। পাথরে পাথরে পা ফেলে দিব্যি এদিক থেকে ওদিকে চলে যাওয়া যায়।

টিন থেকে খাবার বের করে আর গরম করার ঝামেলায় গেলাম না, ওই ঠান্ডা খাবার খেয়েই শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসতেও দেরি হল না।

রাত্তির তখন ক টা জানি না, বোধ হয় মাঝরাত হবে, সাংঘাতিক একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। যেন কোন জন্তু গুমরে গুমরে গজরাচ্ছে! আমি যেখানে শুয়েছিলাম, সেই মাটিটা কাঁপতে লাগল ভীষণভাবে! গুম গুম করে পাথর গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম আশপাশ থেকে।

এ তাণ্ডব অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। খানিকক্ষণ বাদে আবার সব চুপচাপ।

পাহাড়ের সঙ্গে যাদেরই একটু আধটু প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে, তাদেরই ধ্বস সম্বন্ধে ধারণা তৈরি হয়ে যায়। ধ্বসের আওয়াজ তারা প্রায় সবাই শুনেছে। কেউ কেউ ধ্বস নামতে দেখেছেও বটে।

আসলে দিনরাতের তাপমাত্রার বাড়া-কমার সঙ্গে পাথরেও সংকোচন প্রসারণ হয়। আর সেজন্যেই মাঝরাতে অন্তত পাথরের আচরণকে বিশ্বাস করতে নেই।

তবে ধ্বস একবার নামার পর সাধারণত ওই জায়গায় দ্বিতীয়বার আর বিপদের ভয় থাকে না। কাজেই আমি আবার নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সে রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম।

আমি যেন পৃথিবীর বাইরে থেকে পৃথিবীকে দেখছি, অন্যান্য গ্রহের মধ্যে একটা উজ্জ্বল ফুলের মতোই ফুটে রয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে একটা স্পন্দন রয়েছে… যেমন থাকে জীবিত প্রাণীর মধ্যে। আমি যত কাছে আসতে লাগলাম, দেখলাম… না, কী দেখলাম আগে বলব না। আগে বলি স্বপ্নে ঠিক কেমন করে আমি আস্তে আস্তে পথিবীর দিকে আসছিলাম।

আমি বসেছিলাম একটা আরাম-কেদারাতে, ওতে আবার দোলও খাওয়া যায়! আমার চারপাশে অনেকরকমের নাম না জানা ফুল ফুটে রয়েছে। ফুল শুধু নয়, এইধরনের গাছও আগে দেখিনি। এদের ডালপালা, কুঁড়ি, পাপড়ি সবকিছু আমার অচেনা। ফুলগুলো এমন মিলেমিশে আছে, দেখে মনে হচ্ছে একটাই মস্ত বড়ো ফুল ফুটে রয়েছে!

গাছগুলোর মাথা আমার অনেক উপরে। যেন একটা বিরাট গামলার মেঝেতে বসে আছি! দেখতে পাচ্ছি, গাছেদের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে নানা রঙের ঢেউ মাথার উপর দিয়ে খেলে যাচ্ছে। উজ্জ্বল রঙে রাঙানো গহ্বরের মধ্যে বসে দেখছি সেই ঢেউ ক্রমশ মিশে যাচ্ছে দিগন্তে।

পৃথিবীতে দিগন্তকে আমরা উত্তলই দেখি, কিন্তু এখান থেকে দেখছি ঠিক উলটো। অবতল দিগন্ত।

আমি যেখানে বসে ছিলাম, আগেই বলেছি, সেটা একটা গামলার মতো। গামলার কিনারায় মৃদু ঔজ্জ্বল্য দেখা যাচ্ছে, অনেকটা ফসফরাসের মতো। সেই উজ্জ্বলতা বিনুনির মতো পাক খেতে খেতে কোন রহস্যময় জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বলতার সঙ্গে ক্রমশ মিশে যাচ্ছিল।

সে আশ্চর্য বাগান ধীরে ধীরে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছিল। যেন ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বসে পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছি। যে মুহূর্তে মহাদেশের খাঁজ কাটা উপকূল আর দুই মহাদেশের মধ্যে ধরে রাখা মহাসমুদ্র নজরে এল, কেমন অস্থির লাগতে লাগল। মনে হল আমি আগুনের লেলিহান শিখা, আমার চারপাশ দিয়ে শোঁ শোঁ করে ব্রহ্মাণ্ডের ওলোট পালোট বাতাস বয়ে চলেছে…

আমার অস্থিরতা বেড়েই চলল, যখন দেখতে পেলাম শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে বিষাক্ত তীব্র নীল আলো পৃথিবীর বুকে ছোবল মারছে, এমনকি পৃথিবীর মাথায় সাদা বরফের টুপি পরা মেরু দুটোও রেহাই পাচ্ছে না। উহ, কী তীব্র, কঠিন সে আলো! সে আলোয় কোনো মাধুর্য নেই, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। জ্যোতিষ্কের কেন্দ্র থেকে বেরোনো যে তীব্র আলো কল্পনা করা যায়, এ আলো বোধ হয় সেরকমই।

হঠাৎ স্মরণে এল, যুগ যুগ ধরে আমার এই যাত্রা চলছে। সমস্ত জীবিত গ্রহের উদেশ্যে বিভিন্ন সময়ে আমার এই যাত্রা অনন্ত। কিন্তু যতবারই ওই সাংঘাতিক আলোর মুখোমুখি হয়েছি, এর পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গিয়েছি। এই আলোর বিপত্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কী করতে হয় সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। অথচ বেশ মনে আছে কিছু একটা পদ্ধতি আছে এই আলোর বিপদ থেকে বাঁচার জন্য।

ঘূর্ণির গায়ে এখন বাদামি ছিট ছিট দাগ ফুটে উঠেছে। দাগগুলো একটু বাদেই কালো হয়ে গেল। আর আমার বাগানটা ঢেকে গেল এক ঝিলিমিলি আঁধারে।

এরপরেই ঘুমটা ভেঙে গেল। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। আমার স্লিপিং ব্যাগের চেনটা একটু খুললাম।

বেলা হয়ে গেছে। যদিও ঘন মেঘে আকাশ ছাওয়া, তাই বোঝা যাচ্ছে না। বাজ পড়ছে মুহূর্মুহূ। অথচ আজকের পূর্বাভাসে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনাই ছিল না! অবশ্য আবহাওয়া দপ্তরের সেটাই দস্তুর, এতে আর আশ্চর্য কী!

এবার বেরোনোর জন্য তৈরি হতে হবে। তবে এই বৃষ্টি মাথায় করে বেরোনোর অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয়, এর আগেও হয়েছে।

আমার বর্ষাতি যথেষ্ট ভালো, আর তার উপর পেরেক আঁটা বুট পরে নিয়েছি, কাজেই পা পিছলানোর ভয় কম। তবে দুঃখ একটাই। ভেবেছিলাম ব্রেকফাস্টের আগে একবার সালফার প্রস্রবণে স্নান করে নেব। কিন্তু এই আবহাওয়ায় সেটা হবে না। লোকে বলে, ওই প্রস্রবণে স্নান করলে অন্তত দু-কিলো ওজন তো ঝরবেই! আমার অবশ্য সেজন্য স্নান করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ওই বেচারাদের কী যে হবে! যারা আমাকে ফেলে দিব্যি ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল পিক ক্লাইম্ব করতে! আবহাওয়ার যা অবস্থা, উপরে তো নির্ঘাত তুষার-ঝড় শুরু হয়েছে। আর একবার তুষার-ঝড় শুরু হলে কম করে দিন তিনেকের জন্যে আটকে যাবে তা একেবারে নিশ্চিত বলা যায়। এদিকের পাহাড়ে আগস্টে সাধারণত ঝড়বৃষ্টি হয় না, কিন্তু একবার শুরু হলে…

একটু দূরে কিছু কাঁটাঝোঁপ, তারপরেই রাস্তাটা সোজা নদীর দিকে নেমে গেছে। অনেকখানি উত্রাই এখানে।

কিন্তু কাঁটাঝোঁপ পর্যন্ত গিয়েই হতভম্ব হয়ে গেলাম। পথ কোথায়? সামনে একদম ফাঁকা! পথটাকে দুমড়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। বুঝলাম, গতকাল রাতের ভূমিকম্পই এর জন্যে দায়ী।

নীচে তাকিয়ে দেখলাম পাথর পড়ে নদী আটকা পড়েছে। একটা বেশ বড়সড় জলাধার তৈরি হয়েছে ওখানে। তবে ঘন মেঘ থাকায় বুঝতে পারলাম না জলাধারটা ঠিক কতটা বড়ো।

কিন্তু আমি জানি আমার ‘সাদা-পাথুরে’ ঠিক ওর রাস্তা বের করে নেবে। মনে মনে বললাম, ওকে বাধা দেওয়া অত সোজা নয়। আর তারপরেই আমার বর্তমান অবস্থাটা আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। এবার নীচে নামব কী করে? আমি এই জায়গায় আটকা পড়ে গিয়েছি! নদীখাত প্রায় সত্তর মিটার নীচে। ওখানে নামার রাস্তাটা আর নেই, অন্যদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে খালি হাতে ওঠা সম্ভব নয়। চড়াইটা প্রায় দেড়শো মিটার উঁচু আর এমন খাড়া যে পর্বতারোহণের সরঞ্জাম ছাড়া বেয়ে ওঠা অসম্ভব। কোনোভাবে নীচে নামার চেষ্টা করতেই হবে।

রুকস্যাকটাকে নামিয়ে ওর উপর বসলাম। এখন মাথা ঠান্ডা রাখতেই হবে।

আচ্ছা, মারাত ইন্নোকেন্তিয়েভিচের মতো নামকরা পর্বতারোহী এরকম অবস্থায় পড়লে কী করতেন? মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে চেষ্টা করলাম।

প্রথমত, ধৈর্য রাখো, সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করো। সাহায্য নিশ্চয়ই আসবে।’ জুমাগেলদিনভের গলা নকল করে নিজেকে বললাম।

‘কিন্তু এমনও তো হতে পারে, এক সপ্তাহ কেটে গেল, কোনো সাহায্য এল না?’ আমি নিজের গলায় বললাম।

অনুপস্থিত জুমাগেলদিনভের সঙ্গে আমার কথোপকথন চলতে লাগল, ‘হ্যাঁ, আপনারা পিক জয় করে আনন্দ করতে করতে ফিরে এলেন, ওয়াকিটকিতে শহরে সেই জয়ের খবরটা দিলেন, তখন হয়তো আমার খবর পেয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করলেন। আর এসে দেখতে পেলেন খাবার, জল কিচ্ছু না পেয়ে আমি ওই কাঁটাঝোঁপের নীচে মরে পড়ে রয়েছি। কারণ আমার কাছে অতদিনের খাবার নেই, আর একফোঁটা জল পাওয়ার আশাই বা কী করে করব?”

এবার আসরে এলেন মারাত ইন্নোকেন্তিয়েভিচ, অর্থাৎ এবার আমি তাঁর ভূমিকায় নামলাম। তাঁর কণ্ঠ আমায় ভরসা জোগানোর চেষ্টা করল, ‘অত হতাশ হওয়ার কী আছে? সামনেই কাঁটাঝোঁপ আছে, তার ফল খাবে, আর পাথরের গা চাটলে তোমার তেষ্টা মিটে যাবে। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই, আর তা যদি নাও হয়, ভোরবেলায় শিশির জমে না! কাজেই পাথরের গা ভিজে থাকবেই। গা গরম রাখার জন্য শুকনো ঘাস, কাঠকুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বালো। সাহায্য না আসা পর্যন্ত এইভাবে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়। এ এমন কী কঠিন কাজ? এমনও তো হতে পারে যে, থ্রি লেপার্ডের দিক থেকে কোনো ট্রেনিদের দল এই পথ দিয়ে নদীর খাত বরাবর উপরে যাচ্ছে!

‘কোনো আশা নেই।’ আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘এত খারাপ আবহাওয়ায় কেউ কি উপরে আসে? আবহাওয়া খারাপ হওয়া মাত্রই সবাই নেমে গিয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরবে।’

‘ঠিক আছে, না হয় ধরেই নিলাম ওদিক থেকে কোনো আশা নেই। কিন্তু তাহলেও তোমার কাছে তাঁবু, তোমার স্লিপিং ব্যাগ, রুকস্যাক এগুলো তো আছে! নেহাত কোনোদিক থেকেই সাহায্য যদি না আসে, তবে ওগুলো ফালা ফালা করে কেটে ফেলল। জোড়া দিয়ে দিয়ে লম্বা দড়ি বানাও। সুবিধাজনক কোনো পাথরে রিফ নট দিয়ে দড়ির একমাথা বাঁধো, তারপর দড়ি বেয়ে সিধে নেমে যাও নীচে।’

কিন্তু মারাত ইন্নোকেন্তিয়েভিচ স্যার, উপস্থিত আমার কাছে টিন ওপেনার ছাড়া আর কিছু নেই। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না যে তাই দিয়ে তাঁবুর কাপড় কাটা যায়। আচ্ছা না হয় আমি দাঁত দিয়ে তাঁবুর মোটা ক্যাম্বিস কাপড় ছিড়লাম, তা দিয়ে লম্বা দড়িও বানালাম। কিন্তু এইরকম ছেঁড়া কাপড় জুড়ে দড়ি বানিয়ে আমি কখনো দশ মিটারও ক্লাইম্ব করিনি, তো একেবারে সত্তর মিটার! অসম্ভব।’

‘তাহলে চুপচাপ অপেক্ষা করো। তোমার কাছে ওয়াটার প্রুফ তাঁবু আছে। কাজেই থাকার চিন্তা নেই। শুধু একটাই কথা, ভরসা হারিয়ে কান্নাকাটি কোরো না।’

আজ যত সহজে একথা লিখছি, সেই সময় ব্যাপারটা তত সোজা ছিল না।

কাঁটাগাছের একটা বেশ বড়সড় ঝাড়কে সাবধানে পাকড়ে ধরে খাদের দিকে ঝুঁকে দেখতে গেলাম কোনো সরু ফাটল পাই কি না। সেরকম যদি কিছু পাই, তবে কোনোরকমে ঠিক টিকটিকির মতো নেমে যাব। নিদেনপক্ষে হামাগুড়ি দিয়েও নামতে পারব। কিন্তু রুকস্যাক সঙ্গে নিয়ে এভাবে নামা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে রুকস্যাকটাকে উপর থেকে ঠেলে নীচে ফেলব। তারপর একবার নেমে গেলে ওখান থেকে নিয়ে নেব আমার সম্পত্তি!

কথায় আছে, নরকের পথ মসৃণ। আমার পায়ের তলার পথটাও একেবারে মসৃণ। নীচে যা দেখতে পাচ্ছি তা হল নিছক চকচকে পিছল পাথুরে গা। পা রাখা অসম্ভব।

আমার ডানদিকে একটা অদ্ভুত আকৃতির বোল্ডার পাহাড়ের গা থেকে প্রক্ষিপ্ত হয়ে বেরিয়ে আছে। বোল্ডারটা অন্য পাথরের মতো নয়, যেন একটা বিরাট স্ফটিকের অংশ। যার একটা দিক সেই আগেকার দিনের গ্রামোফোনের চোঙার মতো। এইদিকে পাথরের একটা কোনা পাহাড়ের গায়ে ঢুকে আছে। তাই আমি যেখানে আছি, ঠিক তার নীচে একটা অর্ধবৃত্তাকার জায়গা তৈরি হয়েছে।

এখানে পাহাড়ের রঙ উজ্জ্বল ধূসর, কিন্তু স্ফটিকটা সেরকম নয়। ওটা পাথুরে কয়লার মতো অনুজ্জ্বল কালো রঙের।

আমার ছোটবেলাটা কেটেছে কাবাসের ওসিনিকিতে। যেহেতু ওটা খনি অঞ্চল, কাজেই অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে আমিও এখানে ওখানে জমা হওয়া ধাতু-মলের স্কুপে চড়তাম। ওটা আমাদের একটা প্রিয় খেলা ছিল।

আচ্ছা! এমনও তো হতে পারে, এখানে আমাকে সপ্তাহভর আটকে থাকতে হল, আর সেই ফাঁকে কয়লার একটা মস্ত ভাণ্ডার আবিষ্কার করে ফেললাম!

এই বোল্ডারটা মাটির ভিতর কতটা সেঁধিয়ে রয়েছে কে জানে! হয়তো ওর নীচেই কয়লার স্তূপ, যুগ যুগ ধরে মাটির গহ্বরে লুকিয়ে আছে!

আমার একটা বদ অভ্যেস হল বাথরুমের আলো না নেভানো। তাই তো তিমচিক তো সবসময়ই মনে করায়, আমাদের জ্বালানির ভাণ্ডার ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে, কাজেই শক্তি নষ্ট করা একেবারেই অনুচিত। সভ্যতা যেদিকে যাচ্ছে, তাতে প্রত্যেক টন কয়লা বা পিট মূল্যবান। বরং যে খনিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পারলে সেগুলো আবারো খোলা উচিত।

যাই হোক, আমি যতদূর সম্ভব হাত বাড়ালাম। দেখি ওই স্ফটিক বোল্ডার পর্যন্ত হাত পৌঁছয় কি না। কিন্তু পারলাম না। বরং একটা আশ্চর্য ব্যাপার টের পেলাম। বোল্ডারটার একেবারে গায়ে, বলতে গেলে প্রায় এক সেন্টিমিটার দূরে একটা অদৃশ্য দেওয়ালে আমার বাড়ানো হাতটা বাধা পেল! আমি ঘটনাটার কোনো কার্য-কারণ খুঁজে পেলাম না। কীসের দেওয়াল ওটা? আমার আর ওই বোল্ডারটার মাঝে তো একটা মাকড়সার জাল পর্যন্ত নেই, তবে কীসে বাধা পেলাম? ভালো করে তাকিয়ে দেখি, পাথরটার গা একেবারে খটখটে শুকনো, সামান্য জলের দাগও নেই। অথচ খানিক আগে তুমুল বৃষ্টি হয়ে গেছে। যার রেশ এখনো চলছে। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের গা বেয়ে জল ঝরছে টুপটুপ করে। এমনকি ওই রহস্যময় বোল্ডারটার আশেপাশেও সবকিছু ভিজে।

আমার কথাগুলো অনেকেই বিশ্বাস করবে না। তবে এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, যা দেখেছি, তাই লিখছি। হ্যাঁ, আবারো বলছি, এর একটা বর্ণও বানানো নয়।

হঠাৎ টের পেলাম, কারা আমাকে লক্ষ করছে। চোখ কচলে ভালো করে তাকালাম বোল্ডারের দিকে। সত্যি সত্যি একটা সোনালি রঙের বিস্ফারিত চোখ নজরে এল, বোল্ডারের কিনারা থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

রুকস্যাকটা আঁকড়ে ধরে পালাতে গেলাম। কিন্তু কোথায় পালাব, এখানে না আছে লুকোবার জায়গা, না পালানোর।

চোখটা ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। এখন ওটা প্রায় প্যারাস্যুটের মাথার মতো বড়ো। চোখের ভিতর থেকে গভীর সমুদ্রে ডাইভিংয়ের সময় যেরকম পোশাক পরে, সেরকম দেখতে মস্ত বড়ো একটা স্যুট ধীরেসুস্থে বাইরে এল। স্যুটটা ওই বোল্ডারের মতোই অনুজ্জ্বল কালো।

পা-দুটো প্রায় পাঁচ মিটার লম্বা, আর মাথার ব্যাস? এক মিটার তো হবেই!

এখন যতটা সহজে প্যারাস্যুটের মাথার মতো’, ‘এক মিটার, পাঁচ মিটার’ এসব কথাগুলো বলছি, সেই মুহূর্তে এতসব সুস্থভাবে ভাবার মতো অবস্থায় ছিলাম না। একটা অসহায় ভয় আমাকে তাড়া করছিল। আমার তালিমারা উইন্ডচিটারের আড়ালে মনে হচ্ছিল আমি ক্রমশ পাথরে পরিণত হচ্ছি!

ওই দৈত্যাকার স্যুট এবার পুরোপুরি চোখের বাইরে বেরিয়ে এল, চোখটাও ছোটো হয়ে এল। স্যুটের মধ্যে কে বা কী আছে তখনো বুঝতে পারিনি। ওর পিছন পিছন একটা মোটা দড়ি বেরিয়ে এল। সেটার রঙও ওই একইরকম–অনুজ্জ্বল কালো। আর একটু কাছে এলে দেখলাম, দড়ি নয়, খুব ঘন করে প্যাঁচানো স্প্রিং। স্প্রিংটা যেমন-তেমনভাবে বাতাসে পাক খাচ্ছিল।

ওই দৈত্যাকার অবয়বটা স্ফটিক বোল্ডার বরাবর ভেসে এল। আর ভাসতে ভাসতে আমার চোখের সামনেই পাহাড়ের গায়ে মিলিয়ে গেল! প্রথমে একটা হাত, তারপর মাথা, আরেকটা হাত, ধীরে ধীরে পাসুদ্ধ গোটা দেহ পাহাড়ের গায়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু আগে কিছু যে ছিল, তার কোনো চিহ্নই রইল না, শুধুমাত্র ওই স্পিংটা ছাড়া। সেটা বাতাসে ভাসতেই লাগল। ও এত সহজে পাহাড়ের গায়ে ঝাঁপ দিয়ে মিলিয়ে গেল, যেমন আমরা সমুদ্রের উষ্ণতায় ঝাঁপ দিই।

একইভাবে আরো দু’ জন ওই চোখের মধ্যে থেকে বেরোল, তারপর ভেসে এসে মিলিয়ে গেল পাহাড়ের গায়ে। যদিও প্রত্যেকের মিলিয়ে যাওয়ার জায়গা আলাদা আলাদা।

এদের মধ্যে একজন বেরিয়ে এসে আবার চোখের মধ্যে ঢুকে গেল।

এরপর ওই ঢোকা বেরোনো চলতেই লাগল। অন্তত তিন ঘণ্টা ধরে এই কার্যকলাপ চলল। গোটা সময়টা আমি ভিজতে ভিজতে দেখে গেলাম ওদের কাজকর্ম। আমার মাথা কাজ করছিল না। নিজেকে বলছিলাম, এরকম হতে পারে না, যা দেখছি সব মনের ভুল! আর মনে মনে অদৃষ্টকে গাল পাড়ছিলাম।

ওই দৈত্যগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল অ্যানথ্রাসাইট কয়লা দিয়ে তৈরি। ওদের দেখে যত না আশ্চর্য লাগল, তার থেকেও বেশি অবাক হলাম। ওরা আমাকে খেয়ালই করল না! কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা তো দুরস্থান, মনে হল ওরা যেন আমাকে দেখতেই পায়নি!

আশ্চর্য! আমি কোনো পোকামাকড় কিংবা বুকে হেঁটে চলা গা ঘিনঘিনে সরীসৃপ নই! বরং তিমচিক যেমন ওর ভারী ভারী প্রবন্ধে লেখে, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী’, আমি তার একজন প্রতিনিধি। আর আমাকেই কোনো পাত্তা দিচ্ছে না! আমি যেন ওদের কাছে এই পাথর, নদী অথবা ওই কাঁটাঝোঁপের থেকে আলাদা কিছু নই।

আমার খুব রাগ হল। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, “এই যে কয়লা স্যুটওয়ালা ডাইভারেরা, তোমরা পৃথিবীর পেটের ভিতর থেকে, না মহাকাশ থেকে এসেছ, তা জানার একটুও কৌতূহল নেই আমার। কেমন করে তোমরা তোমাদের ওই স্ফটিক নিয়ে এখানে এসে থানা গেড়েছ, তাও জানতে চাই না। কিন্তু তোমরা যেখান থেকে এসেছ, সেখানে ফেরত যাও তো বাপু। এখানে তোমাদের কীসের দরকার?”

ওদের তরফ থেকে কোনো উত্তর পেলাম না।

প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল, পেটের মধ্যে যেন ছুঁচোর ডনবৈঠক চলছিল। খানিকটা ধাতস্থ হয়েছি, এখন আর তত ভয় লাগছে না।

তাঁবুটা লাগালাম, তারপর টিন খুলে মাংস বের করলাম। খুব হিসেব করে চলতে হবে এখন। তাই মেপে ঠিক অর্ধেক মাংস বের করলাম। তারপর রুটি দিয়ে গপগপ করে গিলে নিলাম। এত খিদে পেয়েছিল, যে আর চিবিয়ে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করছিল না। রুকস্যাকের একটা খাঁজে বৃষ্টির জল জমেছিল, তাই দিয়ে তেষ্টা নিবারণ করলাম।

বৃষ্টি তখনও টিপটিপ করে পড়ছে, আকাশ মেঘে কালো হয়ে রয়েছে। নীচের রোগা সোগা নদী এখন ফুলে ফেঁপে উঠে গর্জন করছে, পাথর পড়ে তার চলার পথ বাধা পেয়েছে, তাই বোধ হয় এত রাগ। এবার কী করা যায়। ভেবে ঠিক করলাম, এদের নামকরণ করব।

এদিকে ওই গ্রামোফোনের চোঙার মধ্যে থেকে ওদের যাতায়াত সমানে চলছে। কখনো কখনো ওদের হাতে প্যাঁচানো দড়ি, কখনো-বা ফিগার অফ এইটের মতো হাতলওয়ালা রুপোলী ত্রিশূল। কখনো ওদের হাতে বেলুন। তার মধ্যে আরও বেলুন। বেশিরভাগ বেলুনই কালো রঙের কোনো পদার্থ দিয়ে ভর্তি, তবে সেটা ঠিক কী বুঝতে পারলাম না।

বিকেল হল। দিনের আলো এবার ধীরে ধীরে মরে আসছে। আমার গা ভিজে চুপচুপ করছে, যদিও তাঁবুর ভিতর কিংবা স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে জল ঢোকেনি। টিনের বাকি অর্ধেক মাংস দিয়ে আমার রাতের খাওয়া সেরে নিলাম। এবার ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে শোওয়ার তোড়জোড় করতে হবে। যদিও এই পরিস্থিতিতে ঘুম আসা অসম্ভব।

আমি নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, ‘হয়তো ওরা অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছে। হতে পারে এখন ওরা খুব ব্যস্ত। যেমন… আচ্ছা! কোনো দুর্ঘটনায় ওদের যান খারাপ হয়ে গেছে, তাই ওরা সেটা সারানোর চেষ্টা করছে, তাও তো সম্ভব? তবে, এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে যাতায়াতের যানবাহন যারা বানাতে পারে, তারা অবশ্যই রীতিমতন বুদ্ধিমান। তা আমার এই ভিনগ্রহী বুদ্ধিমান ভাইসকলের কি এটা খুব ভালো কাজ হচ্ছে? পৃথিবীর বুদ্ধিমান মানব প্রজাতির একজন প্রতিনিধি বিপদে পড়েছে। তোমাদের বুদ্ধিমত্তা কী বলে, তাকে সাহায্য করা উচিত কি না? তার উপর সে একজন কমবয়সী মহিলা বৈ তো নয়! এই গিরিখাতের মধ্যে সে আটকে পড়েছে। এমনও নয় যে পৃথিবীর অভিকর্ষ তোমাদের বাধা দিতে পারে, তোমরা তার আয়ত্বেই নেই। তবে কীসের ভয় তোমাদের? শুধুই কি আমাদের পৃথিবীবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে কী অনর্থ ঘটতে পারে সেই ভয়?’ এসব সাতপাঁচ কথা নিজের মনে ভাবতে ভাবতে কখন তন্দ্রা মতন এসে গেল।

চোখে সূর্যের আলো এসে পড়ায় তন্দ্রা কেটে গেল। বাইরে মুহূর্মুহূ বাজ পড়ছে। কী ভয়ংকর আওয়াজ! কানে তালা লেগে যায়। ভীষণ গরম লাগছে। দুপুরবেলায় সমুদ্রতটের বালির মতো তেতে রয়েছে তাঁবুর ভিতরটা। হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালাম। এ কী! এখন সবে আড়াইটে, এসময় সূর্য!

তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখতে হবে কী ব্যাপার। গত প্রায় চব্বিশ ঘণ্টায় আমার বিশ্রাম হয়নি। যাই ঘটুক, এরপরে ঘুমের আশাও আর করি না।

বাইরে এলাম। আলোটা সূর্যের নয়, রাত এখনো শেষ হয়নি। আলোটা আসছে একটা সোনালি রঙের পেল্লায় গম্বুজের মতো জিনিস থেকে। ওটা রয়েছে আমি যে গিরিশিরার নীচে আছি, তার উপর দিকে। উলটনো বাটির মতো জিনিসটা এত উজ্জ্বল, যে মনে হচ্ছে ওটা বুঝি সূর্যরশ্মি দিয়ে বোনা। এমনকি ওর ধার দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটাও নামতে দেখলাম, যদিও তা ওটার মধ্যে ঢুকছিল না।

এই মুহূর্তে বৃষ্টি পড়ছে না। তবুও তিয়েন শান পর্বতমালার গা বেয়ে জলের ধারা নামছে, রাতের আকাশকে এফোঁড়ওফোঁড় করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তার সঙ্গে বাজের গর্জন।

যেখানে একটা ছোটো ধারা আমার ওই ‘সাদা-পাথুরে’ তে গিয়ে মিশেছে, সেখানে একটা অতি ক্ষুদ্র সূর্য উঠেছে দেখছি! মুহূর্তে আমার ভিজে তাঁবু, উইন্ডচিটার, এমনকি জুতোটা–সব শুকিয়ে গেল।

স্ফটিকের রঙ এখন রুপোলী, তার মধ্যে মৃদু ঔজ্জ্বল্য, অনেকটা ফসফরাসের মতো। এর মসৃণ বাঁকানো প্রান্ত এখন বেশ স্বচ্ছ। সেই স্বচ্ছ অঞ্চল দিয়ে ভিতরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ভিতরে অনেকরকমের নাম না জানা ফুল ফুটে রয়েছে। ফুল শুধু নয়, এইধরনের গাছও আগে দেখিনি। এদের ডালপালা, কুঁড়ি, পাপড়ি সব কিছু আমার অচেনা। ফুলগুলো এমন মিলেমিশে আছে, দেখে মনে হচ্ছে একটাই মস্ত বড় ফুল ফুটে রয়েছে! ভিতরে না আছে ছাদ, না মেঝে। এমনকি একটা তলা থেকে আরেকটা তলা, কিংবা একটা কক্ষ থেকে আরেকটা কক্ষকে আলাদা করার মতো কোনো ছাদ বা দেওয়ালের পার্টিশন নেই। সে ভাগটা হছে বিভিন্ন-রঙা বক্ষশীর্ষের সাহায্যে। সে গাছগুলোর দোলায় নানা রঙের ঢেউ খেলে যাচ্ছে, সেই ঢেউই বিভিন্ন স্তরকে ভাগ করছে। সবচেয়ে আশ্চর্য হল, স্ফটিকের মধ্যের গভীরতা। তার মধ্যে উপর বা নীচে তাকালে কোনো তল দেখা যায় না, যেন তার কোনো সীমানা নেই, অসীম পর্যন্তই তার বিস্তৃতি।

আমি চমকে উঠলাম। আরে! এ তো আমার স্বপ্নে দেখা সেই আশ্চর্য বাগান! সেই অচেনা গাছ, অচেনা ফুল-পাতা-কুঁড়ি… কোনোভাবে সেই আশ্চর্য বাগান এখন আমার চোখের সামনে, যদিও তা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

দেখতে পাচ্ছি তিনজন স্পেস স্যুট পরা লোক, যেমনটি আগে দেখেছিলাম তেমনই, কিন্তু এদেরও রঙ পালটে এখন রুপোলী হয়ে গেছে। ফুলগাছের জঙ্গলে ভেসে ভেসে বেলুন, তার মধ্যের বেলুন, ত্রিশূল, প্যাঁচানো দড়ি সেগুলো নিয়ে কী যেন করছে।

আমি কাঁটাঝোঁপের তোয়াক্কা না করে ঘাসের জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে জন্তুর মতো চার হাতে পায়ে গুঁড়ি মেরে ওই স্ফটিকের দিকে এগোতে লাগলাম। ঝোঁপের কাঁটায় আমার হাত-পা-মুখ সর্বত্র ছড়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। যাই হোক, আমাকে আরও কাছে যেতেই হবে।

ওরা ওই মিষ্টি, ঘুম ঘুম বাগানে একমনে কাজ করেই যাচ্ছিল, কিন্তু কাজটা যে কী বুঝতে পারলাম না। স্ফটিকের মহাজাগতিক গভীরতায় একটা ডিম্বাকৃতি আকার দেখা যাচ্ছে, আর সেখানেই বেশিরভাগ গাছের মাথা জড়াজড়ি করে দোল খাচ্ছে। আমার মনের মধ্যে কে বলে উঠল, পৃথিবীর আকাশে তারার ঝাঁক যেমন সযত্নে ধ্রুবতারার নিশ্চলতাকে রক্ষা করে, তেমনই গাছের দঙ্গলের শীর্ষভাগ আয়নার মতো কিছুকে রক্ষা করছে।’ মনে হল আয়নার মধ্যে চাপ চাপ কুয়াশা, তার মধ্যে অদ্ভুত একটা জগৎ পাক। খাচ্ছে, জোড়ায় জোড়ায় অথবা এয়ী তারার দল ঘুরপাক খাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে গ্রহ সেই তারা-মণ্ডলীর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। আর এই মহাজাগতিক বিশৃঙ্খলার ঠিক মাঝখানে আছে মসৃণ রুপোলী ঘূর্ণি।

পরক্ষণেই অবাক লাগল। এই অদ্ভুত ভাবনা আমার মনে এল কী করে? এটা কি আদৌ আমার নিজের চিন্তা?

“এই আশ্চর্য বাগান ওই ঘূর্ণি-যানের ইঞ্জিন।” কথাগুলো যেন দৈববাণীর মতো আমার মাথার মধ্যে ভেসে এল। “ইঞ্জিনে কিছু গোলমাল হয়েছে, ওরা সেটা সারানোর চেষ্টা করছে।”

আমি স্পষ্ট টের পেলাম। কিন্তু আমি কীভাবে ওদের সাহায্য করতে পারি?

এই মধ্যরাতে সূর্যের মতো আলোয় চারদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘাসের আড়ালে আমি লুকিয়ে রয়েছি। অবশ্য কার কাছ থেকে লুকোতে চাইছি জানি না, কারণ এই প্রান্তর জনমানবহীন। কথাগুলো আমার মনের মধ্যে যেভাবে আপনাআপনি চলে আসছে, তা আমার কাছে বিশাল রহস্য।

যেই মুহূর্তে আশ্চর্য বাগানটাকে ইঞ্জিন বলে মনে হল, তার পরেই আমাদের চেনা জগতের চেনা বেশ কিছু ঘটনা আমাকে অবাক করল। মনে হল, শীতের শূন্যতার ঠিক আগেই শরতে কেন গাছপালা এত জীবন্ত হয়ে ওঠে? কেন আপেলের মধ্যেটা রসে টইটম্বুর হয়ে ওঠে, ফল তার পূর্ণতা পায়, মাঠ-ঘাট সতেজ সবুজে ছেয়ে যায়? তারপরেই মনে হল, গাছপালার এই স্পন্দন পৃথিবীর স্পন্দনেরই প্রতীক।

একটা অন্যরকম বোধ আমার মধ্যে জন্ম নিল। মনে হল, পৃথিবীর প্রাণ-মণ্ডলী মহাবিশ্বের সার্বজনীন প্রাণ-প্রবাহের ক্ষুদ্র অংশ বৈ নয়।

ব্রহ্মাণ্ডের অসীম বিস্তার আমার অনুভবে এসে ধরা দিল। সূর্যের আলোর স্পর্শে যেমন কুঁড়ি পাপড়ি মেলে, তেমনি বিশ্বের স্বরূপ ধীরে ধীরে আমার সামনে উন্মোচিত হল।

মানবদেহ হোক অথবা বিশ্বপ্রকৃতি, স্বাধীন কেউই নয়। ক্ষুদ্র অংশগুলো প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে যুক্ত। এই যে পারস্পরিক সম্পর্ক তা সর্বাঙ্গীন, দেশকালের অতীত। একের মধ্যে বহু আর বহুর মধ্যে একের প্রকাশ…।

ওই যে অসীম ব্রহ্মাণ্ড, আমি তো তার একটা অংশ, আবার সেই সীমাহীন ব্রহ্মাণ্ডকে আমারই অংশ বলতে পারি।

অকল্পনীয় কোনো সৌন্দর্যের জগতের দূত ওই স্ফটিক পাথরটা। কিন্তু আমাদের সঙ্গে ওদের স্থান-কাল কিছুই বোধ হয় মেলে না। এই দুই জগৎ পরস্পরের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ওদের আভাস পাচ্ছি। কিন্তু যোগাযোগের কোনো উপায় আমার জানা নেই। যেন পরস্পরকে ছেদ না করা দুটো সমান্তরাল স্তর, যারা কখনোই মেলে না।

কতক্ষণ ওই ঘাস-পাতা-ফার্নের আড়ালে শুয়ে এইসব ভাবছিলাম কে জানে? তবে এখন মনে হয় সেই সময়টুকু আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়।

কখন আকাশ কালো করে এসেছে টের পাইনি। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। তাড়াতাড়ি দৌড়ে তাঁবুর নীচে ঢুকলাম।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা ভাঙল বেশ বেলায়।

মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, কপালের দু-পাশের রগ দপদপ করছে। তাঁবুর কাপড়ে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার রুকস্যাক, বুট আর উইন্ডচিটারের কী হাল কে জানে!

তাড়াতাড়ি উঠে সেগুলোর খোঁজ নিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, তারা একেবারে শুকিয়ে গেছে, সামান্য স্যাঁতস্যাঁতে ভাবও নেই –সেগুলো যে আদৌ ভিজেছিল বলেই মনে হচ্ছে না! তাহলে প্রমাণ হল যে রাতের সূর্য শুধুমাত্র আমার কল্পনা নয়!

স্ফটিকের ‘চোখ’ খুলছে, বন্ধ হচ্ছে, আবার খুলছে… সমানে এই খোলা-বন্ধ চলছেই। আর ভিতরে ওরা ব্যস্তসমস্তভাবে কাজ করছে।

যৎসামান্য যা খাবার ছিল, তাই দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলাম। যেভাবেই হোক ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে?

ভাবতে ভাবতে একটা মতলব মাথায় এল। ভাবলাম, পর্বত যদি মহম্মদের কাছে না যায়, তবে মহম্মদকেই পর্বতের কাছে যেতে হবে।

ওই স্পেস-স্যুটওয়ালারা তো এটাও জানে না যে আমারও বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। ওদের বোঝাতে হবে যে আমিও নেহাত ফেলনা নই।

চোখটা এখন ক্রমশ বিস্ফারিত হচ্ছে। এটাই সঠিক সময়। আমি ছুটে গেলাম খোলা চোখ বরাবর। যদিও ভয়ে তখন এত জোরে বুক ঢিপঢিপ করছে যে মনে হচ্ছিল বুঝি এই মুহূর্তে তা দেহ থেকে বেরিয়ে যাবে!

একটু সামলে নিয়ে আমি চেঁচিয়ে বললাম, “এই যে নক্ষত্রলোকের ভ্ৰাতাসকল! তোমাদের অভিবাদন! এই যে শুনছ আমার…” ঠিক উপর দিয়ে একজন ভেসে যাচ্ছিল, তার দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে বললাম, “আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবে? বড়ো বিপদে পড়ে গিয়েছি।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা? লোকটা আমার দিকে তাকাল না পর্যন্ত! সামান্য দুলতে দুলতে বাতাসে ভেসে বেরিয়ে গেল। তারপর ভূতের মতো পাহাড়ের গায়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘আচ্ছা! ওহে ভিনগ্রহী বন্ধুরা! আমি এত সহজে হার মানার লোক নই।’ মনে মনে বললাম। কিন্তু তারপর আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। ওদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলাম, “ভেবেছটা কী? আমি ডানাভাঙা পাখি? আমাকে অত দুর্বল ভেবো না। আমাদের পরম্পরা সম্বন্ধে কোনো ধারণা আছে তোমাদের? কত মহান সাহিত্যিক আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন! সেসব সাহিত্যের একটারও নাম জানা আছে? সেই দ্বাদশ শতকের ‘দ্য লে অফ ইগরস হোস্ট’, নিকোলাই গোগোলের ‘তারাস বুলবা’, মিখাইল বুলগানভের ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’, শোকোলভের ‘কোয়ায়েট ক্লোজ দ্য ডন’, আর কত নাম করব! প্রাচীনকালে যখন পুবদিক থেকে যাযাবর লুঠেরার দল আর পশ্চিম থেকে যুদ্ধবাজেরা আমাদের দেশকে আক্রমণ করত, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তখন বাঁধ তৈরি করে দেশকে বাঁচিয়েছিলেন। স্পেনের আক্রমণকারী পিসারো, কর্টেস দক্ষিণ আমেরিকা জয় করতে যাওয়ার পথে সবকিছু শেষ করে দিয়েছিল, মানুষের দুঃখের সীমা ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশের পুরোনো মানুষেরা জানতেন বন্ধুত্বের মূল্য। একটা পুরোনো প্রবাদ আছে, ‘ভুল পথে পা বাড়ালে কখনোই ফেরত আসা যায় না। এর থেকেই বোঝো, তাঁরা কতটা নীতিপরায়ণ ছিলেন।”

পরিস্থিতি কিছুমাত্র পালটাল না। আমি তাঁবুতে ফিরে এলাম। এবার কী করি?

কিচ্ছু করার নেই। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য নোটবইয়ের কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে পেনসিল নিয়ে আঁকিবুকি করাই ঠিক করলাম।

প্রথম পাতায় আঁকলাম সৌরজগতের ছবি, যদিও সবকটা গ্রহকে ঠিকঠাক বসাতে পারলাম না। পরের পাতাটায় স্কুলে শেখা পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ছবি আর বিবৃতিটা লিখলাম। যত্ন করে একটা সমকোণী ত্রিভুজ আঁকলাম, উপপাদ্যে যেমন আছে তেমনভাবে প্রত্যেকটা বাহুর উপর বর্গক্ষেত্র আঁকলাম। পাতার বাদবাকি জায়গায় আঁকলাম পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ছবি। তিন নম্বর পাতায় রকেটের ছবি আঁকা গেল। ভিতরে একটা মানুষের ছবিও দিলাম। এই ছবিটা বেশ ভাবনাচিন্তা করে আঁকলাম, একদম প্রথম চাঁদে পাঠানো রকেটটার মতোই দেখতে হল। চার নম্বর পাতায় ভাবলাম উত্তর আর দক্ষিণ গোলার্ধ আঁকব। কিন্তু এইটুকু পাতায় দুটো গোলার্ধকে খুব কষ্টেসৃষ্টে ধরাতে হল, তবে অস্ট্রেলিয়া আর আফ্রিকাকে খুব ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল। আমার বিদেশি দামি আইশ্যাডো দিয়ে দুই গোলার্ধকেই নীল আলোময় করে দিলাম। একবারের

জন্যও মনে হল না, ওটা এভাবে খরচ করার জন্য নয়।

এবার কী করি? আমি নিজের মনেই বিড়বিড় করলাম, ‘তোমরা আবার পরামাণু বোমার স্বপ্ন দেখতেই পারো, হয়তো সেটাই তোমাদের মতলব। কিন্তু এ ভাবনা মনের কোনায়ও ঠাঁই দিও না, তোমাদের ওই জাদু-বাগান আমার এই লোহা বাঁধানো লাঠি দিয়ে তছনছ করে দেব। নিষ্ঠুর পুতুলের দল!

আর একটা ছেঁড়া পাতা বেঁচে ছিল। কী আর করি, তার উপর গোটা গোটা ল্যাটিন অক্ষরে একটা রাশিয়ান প্রবাদ লিখে ফেললাম। তবে তার মধ্যে দু-চারটে ভুল থাকলে আশ্চর্য হব না।

NEPRAVDOJ VES SVET PROJDEJOSH DA NASAD NE VERNJOSHSJA (মিথ্যে যতই চকচকে হোক, তা আপনাকে সুখ দিতে পারে না।)

ওরা বুদ্ধিমান হলে ঠিক এর মানে উদ্ধার করবে।

জামাকাপড় নোংরা, খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়িসুষ্ঠু জ্বলছে, আমার অবস্থা আর কী বলব। একহাতে আমার ওই লোহার খুর লাগানো লাঠি, আর আরেক হাতে ছেঁড়া কাগজগুলো নিয়ে বাইরে এলাম। ওদের সঙ্গে যেভাবেই হোক আমাকে যোগাযোগ করতেই হবে।

ধীরেসুস্থে হেঁটে এলাম স্ফটিক পাথরের যে দিকটা গ্রামোফোনের চোঙার মতো, সেদিকটায়। আগের মতোই, কেউই আমায় লক্ষ করল না। উপায় নেই, আমার দিকে ওদের নজর ফেরাতেই হবে।

সামনে যে লোকটা ছিল, তার পা লক্ষ করে হাত চালালাম। বেশ জোরেই চালিয়েছিলাম। দুম করে হাতটা গিয়ে ওর পায়ে লাগল।

আর হ্যাঁ! আমার উদ্দেশ্যও সফল হল।

লোকটা নিজের পায়ের দিকে তাকাতে আমার উপর নজর পড়ল। তারপর নেমে এল অনেকটা নীচে। এখন আমার মাথার ঠিক উপরে ভাসছে ও। ওর হাতদুটো আমার মাথার থেকে বড়োজোর দু-মিটার উপরে। স্পেস-স্যুটের হেলমেটের আড়ালে ওর মাথাটা অন্ধকারের মতো লাগছে। আমি সেদিকে লক্ষ করে হাতের কাগজগুলো ছুঁড়ে দিলাম।

অবাক হয়ে দেখলাম, কাগজগুলো হেলমেটের অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল! লোকটাও সেই জ্বলন্ত চোখের মধ্যে ঢুকে গেল। গেল তো গেলই! আমি হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম ওই চোখের দিকে, প্রায় একঘণ্টা কেটে গেল। কেউ বেরোলো না।

তখন রীতিমতো হতাশ লাগছে, আমার হাতে আর কোনো উপায় নেই। আর কী করতে পারি?

শেষপর্যন্ত একজনকে বেরোতে দেখলাম চোখ থেকে। দেখা যাক, আমার দুঃসাহসী পরীক্ষার কী ফল হয়।

লোকটার হাতে একটা কোদালের মতো জিনিস। অবশ্য কোদাল না বলে জিনিসটাকে বেশ বড়োসড়ো কেকের স্লাইস বললে আরও ঠিক বলা হয়, তিন মিটার-মতো লম্বা।

লোকটা আমাকে ওই ওটা দিয়ে স্ফটিকটার দিকে ঠেলতে লাগল।

“এই যে স্পেস-স্যুট দাদা! ঠেলার দরকার নেই, আমি নিজেই যেতে চাই!” আমি বললাম, “তোমাদের মতো যদি ভেসে যেতে পারতাম আমিই যেতাম, দরকার হলে ঝাঁটার কাঠিতে চেপেই যেতাম। এখান থেকে মুক্তি পেতে হলে তোমাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা বিশেষ দরকার।”

আমি আমার মতো বকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ খেয়াল করলাম, লোকটা মোটেই আমাকে স্ফটিকের দিকে ঠেলছে না, আসলে ঠেলছে খাদের দিকে!

“আরে আরে! করছ কী ভিনগ্রহী জানোয়ার! আমি তোমাদের মতো উড়তে পারি না। নীচে পড়ে ছাতু হয়ে যাব! আমার যদি কিছু হয়, তোমরাও কিন্তু পার পাবে না!” আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম।

আশেপাশে যেসব বড়ো বড়ো ঝোঁপঝাড় ছিল সেগুলো আঁকড়ে কোনোমতে নেমেই দৌড় লাগালাম তাঁবুর দিকে। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। জানি না কেন ওরা আমার পেছনে লেগেছে। যেন আমাকে শেষ করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে ওরা! দেখলাম, তাঁবুর পেরেক-টেরেক উপড়ে সবসুষ্টু হাওয়ায় ভাসছে!

ওই ভিনগ্রহী আমার পেছন ছাড়ল না, গরু খেদানোর মতো করে তাড়াতে তাড়াতে আবার একেবারে খাদের ধারে এনে ফেলল। হাত-পা নেড়ে ইশারায় বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ধ্বসের ওপারে যেতে চাই ঠিকই, কিন্তু আমি তো বাতাস কেটে হেঁটে যেতে পারব না। এই খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল বেয়ে দড়িদড়া, মই, পিটন, ক্যারাবিনার এসব ছাড়া খালি হাতে নামতে চেষ্টা করলে বিশেষ কিছুই হবে না, স্রেফ আমার পশুপাখিতে খুবলানো, থেঁতলানো দেহটা ক’ দিন বাদে হয়তো কেউ খুঁজে পাবে ওই নীচে।

স্পেস-স্যুটধারী স্বচ্ছন্দে আমার উদ্যত আঙুলটা ধরে ফেলল, তারপর সযত্নে আবার বসিয়ে দিল সেই কালো রঙের কেকের স্লাইসের মতো আসনটায়। ওটা ক্রমশ সেই কাঁটাঝোঁপ পেরিয়ে খাদের দিকে এগিয়ে চলল। আমি তখন কাঁটাঝোঁপ পেরিয়ে পাহাড়ের খাড়া দেওয়ালের দিকে আরও প্রায় তিন মিটার চলে এসেছি। আমার নীচে সেই খাড়াই খাদ! ও আমাকে কেক স্লাইস আসনটাকে এমনভাবে হেলাচ্ছিল যেন আমি গড়িয়ে পড়ে যাই। ওর মতলব ভালো নয়, বেশ বুঝতে পারছি।

আটকাতে পারলাম না শেষপর্যন্ত। আমি গড়াতে শুরু করলাম। বেশ বুঝতে পারছি আর রক্ষা নেই। ভয়ে, আতঙ্কে ওকে অভিসম্পাত দিতে থাকলাম, “অসভ্য আগন্তুকের দল, বার বার তিনবার অভিশাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মর…”

কিন্তু আমি খাদে পড়লাম না।

আমার নীচে একটা অদৃশ্য রবারের মতো স্তর, অল্প অল্প ঝাঁকুনি লাগছে।

না, ভয় আমি পাইনি, কিন্তু একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন কীভাবে নাকাল হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি সাজানো গোছানো একটা সভায় উপস্থিত হয়েছি একেবারে উলঙ্গ অবস্থায়। সভার মান্যগণ্য অদৃশ্য নারী ও পুরুষবৃন্দ আমাকে দেখে হাসছে। তাদের হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে আমার প্রতি একরাশ ঘৃণা।

আমি হাত বাড়িয়ে কেক-স্লাইসটাকে ধরতে গেলাম। ওর একটা কোন ধরতে পারলেও আমি ঝুলে পড়ব, কিন্তু সে হতভাগা ততক্ষণে আমার নাগালের বাইরে। যেন দূর থেকে আমার অপমান দেখে মজা পাচ্ছে।

এরপরে যে কাজটা করলাম তা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে। তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো আমি চার হাতে পায়ে… একেবারেই চার হাতে পায়ে হামাগুড়ি দিতে লাগলাম। কোনদিকে গেলে নিরাপদে থাকব সেটা ভাবছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, আগের জায়গাটায় ফিরে যাই। আমি তাই যেখানে ছিলাম, সেই গিরিশিরার দিকেই হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিলাম। ওটা খুব দুরেও নেই, আর একটু গেলেই হাত পৌঁছে যাবে।

আমার নীচের অদৃশ্য বস্তুটার কম্পন হাতে টের পাচ্ছিলাম। চেষ্টা করছিলাম কোনোভাবেই যেন নীচের খাদের দিকে নজর না যায়।

কিন্তু আমার পথ আটকে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াল সেই দৈত্যাকার কালো কেক-স্লাইস! শুধু তাই নয়, আমাকে পিছন দিকে ঠেলতে লাগল।

চোখ ঠেলে কান্না বেরিয়ে এল। আমি উলটোদিকে হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করলাম।

পাগলের মতো নিজের সঙ্গে নিজেই বিড়বিড় করছিলাম, “কথা বলা কুকুর, হামাগুড়ি দে! কতদূর এগোবি? এক্ষুনি ওরা সুইচ বন্ধ করে দেবে আর তোর পায়ের নীচের অদৃশ্য আস্তরণও সরে যাবে মুহূর্তে। তুই নীচে পড়তে থাকবি। সোজা তাস-আক্সুর দিকে, যেখানে উন্মত্ত নদী গর্জাচ্ছে, পাথরের উপর আছড়ে পড়ছে। ওরা মজা পাবে তোর দুর্গতি দেখে। তা ও আরও গর্জাক, আরও জোরে আছড়ে পড়ুক পাথরের গায়ে। একসময়ে ওর পথের আগল ভেঙে ও দুরন্ত গতিতে ছুটে যাবে নীচের উপত্যকায়। ওর তীব্র স্রোতে কাদা-মাটি, পাথর, গাছের গুঁড়ি–সব খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। তাই হোক! আমার দেহটা সেই কাদা-জলের স্রোতে পাক খেতে খেতে স্রোতের টানে ভেসে যাক, পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে আমার শরীরের সব ক’টা হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাক…”

আমি হামাগুড়ি দিয়ে ক্রমশ উঠতে থাকলাম, পড়ে গেলাম না। পোকা যেমন অমসৃণ তলের উপর দিয়ে এলোমেলো পা ফেলে এগোয়, তেমন করে আমি হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম। টের পেলাম, আমার দু-দিকের তল বাঁকাভাবে উঠে গেছে। যেন একটা অদৃশ্য টিউবের মধ্য দিয়ে আমি এগোচ্ছি। হাল্কা গোলাপি একটা আলোর আভা আসছিল আমাকে ঘিরে।

আর কিছুদূর গেলেই পাহাড়ের ওপাশে পৌঁছে যাব। সামনে চূড়া দেখতে পাচ্ছি একেবারে চোখের সামনে।

কিন্তু আমি কেন হামাগুড়ি দিচ্ছি? আমি, ভ্যালেরিয়া মারশেঙ্কো, কেন অন্যের আনন্দের জন্যে হামাগুড়ি দেব? আমি কি ওদের খেলার পুতুল? পৃথিবীর উন্নত সভ্যতার একজন প্রতিনিধি! এই আমার কি না জানি কাদের সামনে নিজেকে ছোটো করার অধিকার আছে, না আদৌ তা থাকা উচিত? মহাবিশ্বের কোন অন্ধকারের জীব এরা কে জানে। হতে পারে কোনো অজানা নক্ষত্রমণ্ডলীর অপরাধী, এখানে পালিয়ে এসে লুকিয়ে রয়েছে! কেন ওরা ওদের ওই কালো যান এই পাহাড় পর্বতের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে? কী করেই বা খোঁজ পেল? ওরা কাদের কাছ থেকে লুকোচ্ছে? সবচেয়ে বড়ো কথা, ওরা মুখ দেখায় না কেন? কেনই বা আমার মাত্র পাঁচটা ছেঁড়া পাতায় সামান্য কিছু তথ্যের ভিত্তিতে সাততাড়াতাড়ি আমাকে বেলচায় তুলে আমাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিল কেন? কী উদ্দেশ্য ওদের?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। তারপর টলোমলো পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কোনো শক্ত জমি আমার পায়ের নীচে নেই, আমি বাতাসে হাঁটছি! আমার হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে লাব ডুব শুরু করল, মনে হল সেই কম্পনে পায়ের নীচের অদৃশ্য পথটাও বুঝি কাঁপছে। তাহলে নক্ষত্রজগতের অদ্ভুত প্রাণীকুল! আমার কাছ থেকে তোমরা এটাই চাও?

শেষের কয়েক মিটার ছিল সবচেয়ে কঠিন। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল ওই অত্যাচারীর দল পায়ের তলার অদৃশ্য আস্তরণটা সরিয়ে দিয়ে আমাকে শেষ করে দেবে।

কিন্তু সত্যি সত্যি তেমন কিছু ঘটল না।

হালকা গোলাপি আভা যেখানে খাড়া পাথরের দেওয়ালের গায়ে মিশে গেছে, সেখানেই মনে হয় পথের শেষ। কাছাকাছি এসে আমি সামনে ঝাঁপ দিলাম। পাহাড়ের গায়ে গজিয়ে ওঠা ঝোঁপঝাড় ধরে কোনোমতে ভারসাম্য রেখে দাঁড়ালাম পাহাড়ের গায়ে। আমার পায়ের নীচে এখন শক্ত মাটি। আর ভয় নেই। হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পড়লাম। এই তো সামনেই চেনা পথ!

উবু হয়ে ভিজে ঘাসে মুখ ডুবিয়ে দিলাম। নিশ্চিন্ত! আর ভয় নেই। দুঃস্বপ্নের থেকে মুক্তির কান্না আমার শরীর কাঁপিয়ে দু-চোখের কোল ভাসিয়ে বেরিয়ে এল।

একটু সামলে নিয়ে যখন মাথা তুললাম, সামনেই দেখলাম আমার রক্ষাকর্তাকে। সঙ্গে সেই কেক-স্লাইস আসন, তার উপর আমার তাঁবু, রুকস্যাক আর যা কিছু টুকিটাকি ছিল। যথারীতি কালো হেলমেটে মাথা ঢাকা। একটা পা মাটিতে, বাকি দেহটা বাতাসে ভাসছিল।

কেক-স্লাইসটাকে আমার দিকে ঠেলে দিল, আমার জিনিসগুলোও আমার কাছে চলে এল।

উঠে দাঁড়ালাম। ভিনগ্রহীকে বললাম, “তোমাকে কীভাবে ধন্যবাদ জানাব জানি না। আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। তবে কোনো ভালো কাজের প্রতিদান দেওয়া উচিত আরেকটা ভালো কাজ দিয়ে।” বলে আমি এগিয়ে গেলাম। দয়ালু ভিনগ্রহী কোনো উত্তর দিল না।

একটা ছোট্ট গাছে একটা ফুল ফুটে ছিল। রঙটা টকটকে লাল, তার মধ্যে হলুদের ছিটে। আমি শেকড়সুষ্ঠু গাছটাকে টেনে তুললাম, তারপর সেটা রেখে দিলাম সেই কেক স্লাইসের উপর। চুম্বকের মতো ফুলসুষ্ঠু গাছটা ওই আসনটতে আটকে গেল।

বললাম, “এই লাল-হলুদ ফুলটার গন্ধ যখনই পাবে, আমার কথা মনে কোরো। তোমাদের আশ্চর্য বাগানে শিশিরবিন্দুর মতো ও ফুটে উঠবে-পৃথিবীর এক ছোট্টো প্রাণ। তবে চেষ্টা করলেও তোমাদের বাগানের ফুল আমাকে দিতে পারবে না। তোমাদের ফুল তো ফুলদানিতে ধরবে না, আস্ত চৌবাচ্চা লাগবে ফুল সাজাতে। আবার দেখা হবে আমাদের। যাবার আগে একটা অনুরোধ করি, তোমাদের ওই গ্রামোফোন লাউড স্পিকারে নক্ষত্রজগতের একটা সুর শোনাবে?”

বৃষ্টি একেবারে ধরে গিয়েছিল। আমার রক্ষাকর্তা আমার দেওয়া উপহার নিয়ে খাদের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল ওদের স্ফটিকের দিকে।

গ্রামোফোনের চোঙার মতো প্রান্ত-বিশিষ্ট অনুজ্জ্বল কালো স্ফটিকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মনে হল ঠিক কীসের সঙ্গে ওটার মিল রয়েছে! ওটা হুবহু টর্নেডোর মতো দেখতে। ঘূর্ণিঝড়ের চেহারাটা যেমন উপরে চওড়া, ক্রমশ সরু হয়ে নীচে নামে, ওটা একদম সেই চেহারার! ঠিক কেন তা জানি না, বেশিরভাগ টর্নেডোই ওরকম নীচে থেকে খাড়া ওপরে ওঠে। ছবিতে যেমন দেখেছি, একদম সেই চেহারাটা আমি চিনতে পারলাম।

খুব জলতেষ্টা পেয়েছিল। ছোটো ছোটো গাছের পাতায় বৃষ্টির জল জমে ছিল, সূর্যের আলো পড়ে তা চকচক করছিল। প্রাণভরে সেই জল চেটে তেষ্টা দূর করলাম। মনে হল জীবন ফিরে পেলাম!

হঠাৎ একটা প্রচণ্ড গুমগুম আওয়াজে চারদিক কেঁপে উঠল, যেন সমস্ত পাহাড়টাই ধ্বসে গেল! সেই কালো ঘূর্ণিঝড়ের মতো স্ফটিক পাথর মুহূর্তে অদৃশ্য হল। নিজের মনেই মুচকি হেসে বললাম, ‘নক্ষত্রজগতের উপযুক্ত সঙ্গীতই বটে!

পাথরটা যেখানে ছিল সেদিকে তাকিয়ে মনে হল কোনো কালেই ওখানে কিছু ছিল না। শুধু পাহাড়ের চড়াইয়ের মাঝবরাবর একটা মস্ত বড়ো খোঁদল রয়ে গেল। স্ফটিকটার লাগোয়া যে বোল্ডারগুলো ছিল, তারা ছিটকে নীচে পড়ল।

সেই গুমগুম শব্দটা ক্রমশ নীচে নামতে নামতে নদীখাতে পৌঁছে গেল। তাকিয়ে দেখলাম, আমার ‘সাদা-পাথুরে’ ও মুক্তি পেয়েছে। কাদা-মাটির স্রোত হুড়মুড় করে বয়ে চলেছে।

আর দু-দিন বাদে আমি শহরে পৌঁছে গেলাম।

লার্কার ডায়েরি এখানেই শেষ।

.

আকাশছোঁয়া

তাস-আক্সুর ডান তীর ধরে হাঁটছিলাম আমরা। নদীখাত থেকে প্রায় ত্রিশ মিটার উপরে পাহাড়ের গা-টা এত মসৃণ, দেখে মনে হয় মস্ত নিড়ানি দিয়ে কেউ চেঁছে দিয়েছে। ওই জায়গায় না কোনো গাছ, না ঝোঁপঝাড়। কেবল এখানে ওখানে সদ্য গজিয়ে ওঠা কয়েকটা ঘাসের চাপড়া। আর কিছু বাঁকাচোরা ফার গাছের গুঁড়ি, তাদের গায়ের ছাল বাকল নেই, উঁচিয়ে রয়েছে মাঝেমধ্যে।

পথে একটা বোল্ডার পড়ল। আকারে বড়সড় একটা খড়ের গাদার মতো তো হবেই, কোনো সময় নদীর স্রোতে ভেসে এখানে এসে আটকেছে।

আমাদের সমতলের বন্ধুরা ভাবতেই পারবে না একটা নিরীহ নদী কত ক্ষমতা ধরতে পারে!

যখন ছোটো ছিলাম, আমাদের বাড়ির কাছেই একটা মিউজিয়াম ছিল। সেখানে একটা ছবি দেখেছিলাম। ছবিটা বিংশ শতকের প্রথমদিকের, আবছা হয়ে এসেছে। নদী কীভাবে ফুলেফেঁপে মুহূর্তের মধ্যে একটা গোটা শহরকে মুছে ফেলেছিল, ছবিটা তার। একমাত্র অক্ষত ছিল সেই শহরের কাঠের গির্জা। গির্জায় অনেকগুলো গম্বুজ ছিল। গির্জার বৈশিষ্ট্য হল, তার কোনো জায়গায় পেরেক ব্যবহার করা হয়নি। সেকালের নামকরা স্থপতি জেনকভের তৈরি এই আশ্চর্য স্থাপত্য। সেন্ট বেসিল গির্জার মতো এই গির্জাও খুব উজ্জ্বল রঙে রাঙানো আর তেমনই সাজানো। পরে এই গির্জাকে মিউজিয়াম বানানো হয়েছিল, এখানেই ছিল সেই ছবিটা।

এক সপ্তাহ আগে লার্কার নোটবইটা দেখে মনে হয়েছিল খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে। হাতের লেখা মাঝেমধ্যে রীতিমতো খারাপ, এখানে ওখানে কাটা হয়েছে। তবে কাটাগুলো বেশ যত্ন করে করা। লেখাগুলো আমাকে ভাবাচ্ছিল। তবে ওর এই বিশৃঙ্খল স্বীকারোক্তি থেকে ঠিক কী মনে হচ্ছিল, সেটাও আমি গুছিয়ে বলতে পারব না।

আমার যেটা মনে হয়, লার্কাও দ্বিধায় আছে। ওর নিজের মধ্যেও প্রশ্ন আছে। ঘটনাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আদৌ কি সেরকম কিছু ঘটেছিল? কিংবা এটা যদি কোনো খেলা হয়, তবে বলব সেটা বাস্তবের থেকেও বাস্তব।

উঁহু, এটা বোধ হয় খেলা নয়। যাই হোক, কথাগুলো আমাকে ভাবাচ্ছে।

‘ধরা যাক, দেশ-কালের কোনো পথিক নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আমি ভাবছিলাম, ‘রাশিয়ান দার্শনিক ফিয়েদোরভের মতে, তা যদি হয় তবে সেই নিরুদ্দেশ পথিকের পথ পূর্বনির্ধারিত হবে না।’ ফিয়েদোরভ, যিনি বিখ্যাত রাশিয়ান মহাকাশ বিজ্ঞানী সিয়োল্কোভস্কির শিক্ষক…

‘হ্যাঁ, যা ভাবছিলাম সেরকম হলে দেশ-কালের হিসাবের সামান্য একটু গণ্ডগোলের জন্যে অবতরণের জায়গার আমূল ওলটপালট হয়ে যাবে। হয়তো দেখা গেল স্পেস-শিপ গিয়ে নামল জীবন্ত আগ্নেয়গিরির হাঁ করা মুখে, অথবা একেবারে খাড়াই পাহাড়ের গায়ে যেখানে পা রাখারই জায়গা নেই। এমনও তো হতে পারে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আর তার কঠিন ভূমি… তাদের কাছে দুটোই সমান অচেনা? গ্যাসীয় বা কঠিন পদার্থ, তাদের কাছে দুই-ই সমান?

কারণ, তাদের পরিবেশটাই আলাদারকমের। তাহলে তারা কী করবে? পৃথিবীর পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সবসময়ে স্পেস-স্যুট পরেই থাকবে! হু-ম-ম! এতক্ষণে কিছুটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। তবে লার্কা যেরকম বলেছে, ওই স্ফটিক-যান… তার মধ্যে বাগান… স্ফটিকের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা… সেটা আসলে একটা মোটর, কিন্তু জীবন্ত… ওর ভাবনার মধ্যেই একটা কোথাও একটা আপাত বিরোধিতা আছে।

লার্কার বর্ণনা থেকে ওই স্ফটিক-যানের কলকজা সম্বন্ধে একটুও ধারণা করতে পারিনি। তা যেমনভাবেই ওরা সেটা চালাক, কিংবা যে পরিবেশ থেকেই আসুক না কেন, ওরা যে বেশ সংগঠিত, সেটা পরিষ্কার। কিন্তু এত অমিশুক কেন?

ঠিক এই প্রশ্নটাই আমাকে বার বার খোঁচাচ্ছিল। ওরা কোনোরকম যোগাযোগ করতে চায় না কেন? আমরা একেবারে আদিম যুগে পড়ে রয়েছি এটা ভাবার নিশ্চয়ই কোনো কারণ নেই!

আমার মনে পড়ল সেই পেরুর ঘটনা। ভাবছিলাম, ‘চন্দ্রযোদ্ধাদের সঙ্গে এদের কোনো যোগসূত্র আছে কি? মেয়র, যে কিনা নিজেও ওই উপজাতির লোক, সে অবশ্য আমাদের বুঝিয়েছিল, এসব ওই অশিক্ষিত, বর্বর আদিম লোকজনের কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। মেয়র বলেছিল বটে, ওদের মোড়লের জরাজীর্ণ প্রাসাদের মধ্যে একটা মস্ত পাথরের দেওয়াল আছে যার গায়ে গত হাজার বছরের এবং আগামী হাজার বছরের সমস্ত সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের হিসাব আছে। আবার ওই ক্যালেন্ডার থেকে সৌরজগতের গ্রহদের গতিবিধি, এমনকি নেপচুনেরও গতিবিধিও হিসেব করা যায়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এটাই যে, উনবিংশ শতকের আগে নেপচুনের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই কারো জানা ছিল না! শুনেছি যেদিন চাঁদের দেবী ভেসে আসেন, সেদিন সন্ধেয় পুরোহিত একটা কাঠের বারকোশের উপর একটা তামার বল রেখে ঘোরাতে থাকে, আর তার মধ্যে চাঁদের সমস্ত সমুদ্রের ছবি ফুটে ওঠে! এমনকি চাঁদের যেদিকে আলো পড়ে না, সেদিকেরও। এটাও শুনেছি, ওদের কবরখানায় এমন অনেক পুরোনো পাথরের মূর্তি আছে, যাদের চোখ আর নাভি চুম্বক দিয়ে তৈরি। এটা যদি সত্যি হয় তবে চিনের আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই এরা চুম্বকের কথা জানত। ডানাওয়ালা যানে চড়ে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে বিপজ্জনক অভিযানের গল্প পৌরাণিক কাহিনিতে অনেক আছে। হতে পারে সেরকম যান হয়তো সত্যিই ছিল, যার ভিতরে ভরা থাকত পারদ আর অদ্ভুত কোনো তরল চুম্বক! এসব গল্পে কারো ক্যান্সার বা এরকম কোনো মারাত্মক রোগের কথাই নেই-ব্যাপারটা ভাবার নয়? অথচ সেটা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়েছে বলে শুনিনি। মোদ্দা কথা, তাদের সঙ্গে কাদের যোগাযোগ ছিল? মহাজাগতিক ঘূর্ণির মধ্যেকার অনন্ত ছায়াপথের সঙ্গে আমাদের পার্থিব পূর্বপুরুষদের বিস্মৃতি ঘটাল কে? এ ব্যাপারে কেন আমরা এত উদাসীন?’

নদীর বুকে ধীরে ধীরে সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছিল।

“রথের রাজা, এবার কিন্তু তাড়াতাড়ি পা চালানো দরকার!” লার্কা তাড়া দিল, “তিমচিক, বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা। প্রবন্ধ লেখা এর চেয়ে সোজা, তাই না?” লার্কা মুচকি হাসল, “প্রায় এসে গিয়েছি! সামনের ওই বাঁকটা ঘুরে নদী পেরোব, তারপর একটুখানি চড়াই পার হলেই সেই জায়গা। কাল সকালে উঠে টের পাবে কোন অপূর্ব জায়গায় এসে পৌঁছেছ।”

“হুম, বেশ জানা আছে যত সুন্দর জায়গাই হোক, আমরা তো একা নই। আমাদের আগে কেউ না কেউ সেই সৌন্দর্য উপভোগ করে গেছে।” তিমচিক ঘোঁত ঘোঁত করে বলল।

শেষপর্যন্ত ন’টা নাগাদ আমরা তাঁবু ফেলার মতো একটা জায়গা বেছে নিলাম। অন্ধকার বেশ ঘন। আমরা আশপাশ থেকে শুকনো কাঠকুটো জোগাড় করে আগুন জ্বালালাম। লার্কা ঝটপট রান্নায় বসে গেল; আমি আর তিমচিক ওদের তাঁবুটাকে একটা বিরাট ফারগাছের নীচে আর আমারটাকে ওদেরটার প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে খাঁটিয়ে ফেললাম। আমার তাঁবুটা যেখানে লাগালাম, সেখানে ছোটোখাটো ঝোঁপঝাড় রয়েছে।

তাঁবু খাটানো হলে আমার সোয়েটারটা বের করে পরে নিলাম। বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। আগুনের পাশে বসে আরাম হল।

তারাদের ভিড়ে ভিড়াক্কার আকাশটা যেন নীচু হয়ে নাগালের মধ্যে এসে গেছে। নীচে পাথরের উপর দিয়ে তাস-আক্সুর বয়ে চলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু দেখা যাচ্ছিল না।

“তাহলে, আমাদের বুদ্ধিমান ভ্ৰাতাসকল! এই পবিত্র জায়গায় তীর্থযাত্রা শেষ করার আনন্দ আমরা বরং ব্র্যান্ডি দিয়ে উদযাপন করি!” সবসময়ে বিদ্রূপ করাই আন্দ্রোজিনের স্বভাব, এবারও তার অন্যথা হল না। ব্রান্ডির বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে লার্কার দিকে ফিরে বলল, “তোমার ওই এলিয়েনের দল পাহাড়ের গায়ে যে খোঁদল বানিয়েছিল সে তো একেবারে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, কী বলো ডার্লিং? তবে আমার আন্দাজ, খোঁদলের মধ্যে ফেলতে হলে… তা, প্রায় তিনশো মিটার দূরে তো টিপ করতেই হবে।”

“ধরো যদি এখান থেকে একটা কাক ওড়া শুরু করে, তিনবার ডানা ঝাঁপটালেই ওখানে পৌঁছে যাবে। তবে তোমার একটা ভুল হচ্ছে। আমরা আছি নদীর ডানদিকে, আর সে জায়গাটা বাঁদিকে। ঘুমকাতুরে বাবু! ঘুমিয়ে পড়ো! কাল সকালে সূর্যোদয়ের সময় তুলে দেব, তখন নিজের চোখেই মিলিয়ে নিয়ো।” লার্কা হেসে আন্দ্রোজিনের চুলগুলো ঘেঁটে দিল। ওর ধৈর্য দেখে আমার যে হিংসা হচ্ছিল না, তা বললে নেহাতই মিথ্যে কথা বলা হবে।

“হুঁ হুঁ বাবা! সূর্য উঠলে শিশির শুকিয়ে যায়, এই প্রবাদটা শুনেছ তো আগে, আমার ভাষাবিদ দেবী? এরকম বহু প্রবাদ আমার ঝুলিতে আছে। তুমি তো জানোই, নানাধরণের জ্ঞান সংগ্রহ আমার শখ। আর তাছাড়া দু-দাগ ‘ফাইভ-স্টার’ পেটে পড়লে আমার অতুল জ্ঞান ভুরভুর করে বেরিয়ে আসে। কারো আপত্তি আছে?”

আন্দ্রোজিন এমনভাবে চোখদুটোকে চারদিকে ঘুরিয়ে আনল যেন অসংখ্য শ্রোতার সামনে ও তার জ্ঞান বিতরণ করছে। তারপর আর কোনো উত্তর না পেয়ে নিজেই সিদ্ধান্তে এল, “তাহলে দেখা যাচ্ছে, সবাই মেনে নিয়েছে। ভালো। খুব ভালো। আজ নেহাত আমি বেজায় ক্লান্ত, এক পা চলারও ক্ষমতা নেই আর, তাই তো গাড়ির মালিক হওয়া দরকার।”

প্রায় ভর্তি গ্লাসটাকে ঠক করে নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি খানিকটা মাংস মুখে ফেলে গাউ গাউ করে চিবোতে লাগল, তাও কথায় কোনো ছেদ নেই। যেমন করে মোটর লঞ্চের তলা থেকে ফেনা ছিটকে বেরোয়, তেমনি ওর কথাগুলোও ঝুপো গোঁফের জঙ্গলের তলা দিয়ে বেরোতে লাগল।

আরও আধঘণ্টা পরে আর এক পাত্তর গলায় ঢালার পর তিমচিকের আর জ্ঞান বিতরণের মুরোদ রইল না। আমার চিন্তা হল ওর বুঝি হেঁটে তাঁবু পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতাও হবে না। হয়তো কোনোমতে হেঁচড়ে হেঁচড়ে তাঁবুতে ঢুকবে আর মাতালের প্রলাপ বকবে।

তার বদলে ও সটান আমাদের দিকে ফিরে খুব কেটে কেটে বলে গেল, “ঘুমোতে চললাম। স্কুলের বন্ধুযুগল, তোমরা গল্প করো, মজা করো, মুখে মুখে খুনসুটি কর, জাহান্নামে যাও, আর… আর যা খুশি করো, কিন্তু পাহাড়ের ধারের দিকে যেও না। তখন তোমাদেরই আবার উদ্ধার করতে হবে।”

তারপর সটান তাঁবুতে গিয়ে ঢুকল। এর কয়েক সেকেন্ড বাদেই তিমচিকের সুখী সুখী নাসিকা গর্জনে রাতের নির্জনতা ভেঙে গেল।

অনেকক্ষণ দু’ জনেই চুপ করে রইলাম। ধিমি ধিমি আগুনটা জ্বলছিল, আমি আরও কিছু শুকনো ডালপালা ওর মধ্যে ফেললাম।

“ওর কথায় কিছু মনে কোরো না।” শেষপর্যন্ত লার্কা নৈঃশব্দ্য ভেঙে বলল, “ও কথা বলতে ভালোবাসে, তাছাড়া ও সবসময়ে যে-কোনো আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে চায়। ওর কথায় মাথা ঘামানোর দরকার নেই।”

“হু-ম-ম… ও সবধরনের জিনিসই ভালোবাসে।” আমার কথায় বোধ হয় একটু ঝাঁঝ ফুটে উঠেছিল।

“তবে আমাকে ও পাগলের মতো ভালোবাসে। ওর মতো আর কেউ আমাকে কোনোদিন অত ভালোবাসেনি, কোনোদিনও নয়।” লার্কার কথায় এমন একটা জোর ছিল, যা আমাকে যথেষ্ট খোঁচা দিল।

তাই বললাম, “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, কোনোদিনও নয়। আর তিমচিক এককথার মানুষ। কথা দিলে কথা রাখতে জানে, তাই না? এধরনের মানুষজন আমিও খুব পছন্দ করি।”

“এমন অনেক লোক আছে যারা অন্যের থেকে কথা আদায় করে, তারপর একদিন আচমকা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে স্রেফ অন্ধ সন্দেহের বশে নিজের বাড়িঘর, স্কুল, পুরোনো বন্ধুবান্ধব সবকিছু ছেড়ে উধাও হয়ে যায়। করুণা হয় তাদের জন্যে আমার। করুণা! কোনো যোগাযোগ নয়, কোনো কথা নয়, হঠাৎ একদিন ফিরে এসে সে যদি ভাবে তার প্রিয় গাছটার সব ডাল আগের মতোই আছে, কী বলার আছে তাকে?” কথা বলতে বলতে লার্কা চোখ বুজল।

“এমন বাজে লোকের জন্য তোমার করুণা হওয়াও উচিত নয়। ধরো, এমনই একজনের সঙ্গে তোমার দেখা হয়ে গেল রাস্তায়। সে তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে হয়তো আচ্ছা মারছে তখন। তা তুমি কী করবে? প্রথমেই টেনে এক চড় কষাবে, চুল টেনে ছিঁড়ে দেবে, মুখে যা আসবে তাই বলে গাল পাড়বে, তারপর গায়ের ঝাল মিটিয়ে কোনো চলন্ত গাড়িতে উঠে পড়বে। যেতে যেতে গাড়ির জানালার বাইরে মুখ বের করে তোমার যা মনে হবে, এমন চিৎকার করে সেটা বলবে যেন গোটা গ্রাম শুনতে পায়।” লাকাকে পরামর্শ দিলাম।

“ছাড়ো তালানভ, কী লাভ পুরোনো ঘা খুঁচিয়ে? আমার মাথা কাজ করছে না। তার চেয়ে আরেক চুমুক করে গলায় ঢালা যাক। জানো তো, বছরে দু-বার, বড়োজোর তিনবার আমি মদ খাই।” লার্কা তার কড়ে আঙুলটা দিয়ে ব্র্যান্ডির খোলা বোতলটা দেখাল।

আমি অর্থপূর্ণভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমিও কিন্তু সেই অভ্যাসই বজায় রেখেছি।”

ব্র্যান্ডি ঢেলে আমরা দু’জনে দু’জনের গ্লাসে ছোঁয়ালাম। ঠুং করে একটা মিষ্টি আওয়াজ হল।

লার্কা বলল, “সবকিছুরই একটা লুকোনো মানে থাকে, এমনকি দুঃখেরও। আজ হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, এমনও তো হতে পারে আমরা একটা রূপকথার জগতে আছি যেখানে সব ভালো যার শেষ ভালো! তুমিও তোমার ওই চন্দ্রযোদ্ধাদের দেখোনি, আর আমিও উড়ন্ত জাদু-বাগান দেখতে পাইনি। আফসোস একটাই, কী একটা ফুলের শরবতের কথা বলছিলে না, যেটা তোমাকে চন্দ্রযোদ্ধারা দিয়েছিল, সেই ফ্লাস্কটা বোধ হয় ফেলে এসেছ।”

“গ্রেভেইরসের কথা বলছ?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, গ্রেভেইরসের শরবত। তিমচিক সবসময় বলে, প্রমাণ ছাড়া কিছু মেনে নেওয়া যায় না। ও একেবারেই যুক্তিবাদী তো! বড়ো বেশি যুক্তিবাদী, এটাই ওর ক্রটি। ওই শরবতটা তোমার কথার মস্ত প্রমাণ হতে পারত। তাছাড়া ওটা থাকলে আমি খেতাম, তারপর স্বপ্নে তোমার সুন্দরী চাঁদের দেবীকে দেখতে পেতাম।” লার্কা হালকা চালে বলল।

কিছু না বলে আমি আমার তাঁবু থেকে একটা মাটির ফ্লাস্ক এনে ওর হাতে দিলাম।

“এটা আমার চাঁদের দেবীর জন্যে, তোমার কাছেই রাখো। অবশ্য তুমি এই গ্রেভেইরস ছাড়াই খাদের উপর শূন্যে হেঁটেছ।”

ও ফ্লাস্কটা নিয়ে আগুনের কাছে ধরল। অনেকক্ষণ ধরে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে কী দেখল কে জানে। একসময় মুখের ঢাকনাটা সরিয়ে জিভের উপর ফোঁটা ফোঁটা ঢেলে চেটে নিয়ে মুখটা কোঁচকাল, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে গুছিয়ে বসল।

কারো মুখে কোনো কথা নেই। সময় বয়ে চলল আপন গতিতে।

অনেক পরে এবারও লার্কাই কথা বলল। অবশ্য আপন মনেই, “হুমম, সেই খাদ… সেটাই।” তারপর গভীর স্বরে বলল, “তালানভ, মনে করো সেই জায়গাটার কথা, যেখানে আটকা পড়ে আমি ওদের দেখেছিলাম, ভাবছিলাম ওরা মহাবিশ্বের অজানা কোনো সুন্দর জায়গা থেকে আসা আগন্তুক, যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চিন্তাটাও অসম্ভব। সেদিন অনেকদিন আগে পড়া একটা কথা মনে হয়েছিল, ‘তোমাদের আর আমাদের মধ্যে রয়েছে বিশাল খাদ। এতই বিশাল যে কেউ কোনোদিন তা পেরিয়ে তোমাদের কাছে যেতে পারবে না, অথবা তোমরাও আমাদের কাছে পৌঁছতে পারবে না।’ কোন বইতে পড়েছিলাম তা মনে নেই, তবে… যাক সে কথা, আমার লাল নোটবই পড়ে তোমার কী মনে হল বলো। যেভাবে প্রথম থেকে শেষ অবধি সাজিয়েছি, তার মধ্যে অনেক জায়গায়ই ফাঁক আছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই ওখানে। তুমি কী ভাবলে। সেগুলো সম্পর্কে?”

আমি যা ভেবেছি তা যতদূর সম্ভব গুছিয়ে বললাম ওকে। তার মধ্যে পৃথিবীর পরিবেশ তাদের পরিবেশ থেকে একেবারেই আলাদা, তাই আমাদের গ্রহের চেনা নিয়মকানুনগুলো ওদের উপর খাটে না–এই তত্ত্বটা ওর বেশ মনে ধরল।

“আমার বদলে যদি তুমি সেদিন এখানে থাকতে আর সেই অমাবস্যার রাতটাতে আমি ওই চন্দ্রযোদ্ধাদের ওখানে, তাহলে বেশ হত! লার্কা হঠাৎ ঘোষণা করে গ্রেভেইরসের মাটির পাত্রটার ঢাকনা সরিয়ে লম্বা শ্বাস টানল, “আহ!” আগুনের আভায় ওর ঘন বাদামি চুলের গোছা তামার মতো চকচক করছিল। “গন্ধটা ঠিক যেন তায়াকসু হিমবাহের সেই জমাট বরফের মতো।”

সে অনেককাল আগের কথা। প্রথম যখন তায়াক্স হিমবাহে গিয়েছিলাম দম বেরিয়ে গিয়েছিল। ওখানে ভূগর্ভস্থ গবেষণাগারে লার্কা আর আমি কাজ করতাম। বেশ কিছুদিন ছিলাম ওখানে। প্রায় চল্লিশ মিটার লম্বা সরু সরু বরফের থামগুলোকে লক্ষ করতাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছের কাণ্ডে যেমন গোল গোল দাগ তৈরি হয়, বরফের থামগুলোতেও তেমনটিই ছিল। এই দাগগুলোতে শত শত বলা ভুল, হাজার হাজার বছরের কালানুক্রম লুকিয়ে আছে। ল্যাবের এখানে ওখানে পাতলা পাতলা কাঠের উপর ছোটো ছোটো কাগজ আটকানো। কাগজে ইন্ডিয়ান কালি দিয়ে হাতে লেখা কিছু বাক্য।

গ্রীকদের সঙ্গে ওলেগের সন্ধি খাজার কাসানাতের পরাজয় কুলিকোভোর যুদ্ধ গোলযোগের সময় –সুভোরোভের আল্পস অতিক্রম বোরোদিনো —পুশকিনের মৃত্যু –সেভাস্তোপোলের প্রতিরক্ষা –প্রযেভালস্কির অভিযান –সুসিমার যুদ্ধ –জর্জি সেদোভের সমুদ্রযাত্রা –চকালোভের উত্তরমেরুর উদ্দেশ্যে অবিরাম উড়ান গ্যাগারিনের মহাকাশযাত্রা –’

ওখানে একজন বয়স্ক মানুষ থাকতেন, শুনেছি ত্রিশ বছর ধরে উনি ওই বরফের রাজত্বে পড়ে রয়েছেন। তিনি জলরঙে আঁকতেন নীল আকাশ, তারা, হিমবাহ আর অ্যাভালাঞ্চের ছবি। ভদ্রলোককে দেখতে ছিল গুনিনের মতো। আমাদের মনে হত ঠিকমতো হাঁটাচলা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ ওঁর পা ছিল একটা। কিন্তু সেই এক পায়েই ওখানে তিনি দিব্যি স্কি পর্যন্ত করতেন, নিজেকে বলতেন ‘হিমবাহ বিশারদ’। লেখাগুলো ওঁরই।

লার্কা আর আমি, দু’ জনেই খুব চেষ্টা করতাম আমাদের জন্মের বছরের সঙ্গে কোন দাগটা মেলে তা আবিষ্কার করার। এই প্রথম বুঝতে পারলাম, কিছু কিছু জিনিসকে সময় সযত্নে রক্ষা করে –বরফ গলে যায়, ঝরনা বয়ে চলে, গাছে গাছে ফুল আসে –বাতাস তার পাপড়িগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়, শুকনো পাতা মাটিতে ঝরে যায় –নিরবধি এ খেলা চলতেই থাকে। যা চলে যায়, তা হারায় না, আবার নতুনভাবে সে ফিরে ফিরে আসে–এ যেন এক অনন্তচক্র! তবে সবকিছুর ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব খাটে না। এই যেমন, আমি গাছের আড়াল থেকে একটা বরফের গোলা বানিয়ে তোমার দিকে ছুড়লাম লার্কা। তো সেটা আলো-আঁধারির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে আবার বরফের সাম্রাজ্যেই মিলিয়ে গেল, সামান্যতম রেশ না রেখে। সেই পিরামিডের আকৃতির গাছটা যার নীচে আমরা প্রথমবার চুম্বন করেছিলাম, হয়তো তার একটা পাতা তুমি সযত্নে রেখে দিয়েছ তোমার অ্যালবামের পাতার ভাঁজে। সেই যে জুলাই মাসের এক বর্ষার দিনে যখন আকাশজোড়া রামধনু উঠেছে আর তুমি একগোছা ডেইজি ফুল নিয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছিলে, আজ সেই দিনটা কেউ ফিরিয়ে দিলে তাকে আমি সব, স-অ-ব কিছু দিয়ে দিতে পারি।

আমার চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল লার্কার কথায়, “তোমার জন্যেও একটা জিনিস আছে। দাঁড়াও রুকস্যাক থেকে বের করে নিয়ে আসি।”

ও তাঁবু থেকে জিনিসটা এনে আমার হাতে দিল।

কালো রঙের ডাম্বেল আকৃতির পাকানো জিনিসটা, গোড়ার দিকটা কন্দের মতো ফোলা, আর একেবারে হালকা, যেন কোনো ওজনই নেই। আমার চেনা কোনো কিছুর সঙ্গে একেবারেই মিল নেই।

“ভালো করে দেখো, এটার চেহারা ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণির মতো, তাই না?” লার্কা বলল, “যেদিন হুড়মুড় করে কাদা-মাটিসুষ্ঠু সাদা-পাথুরে মুক্তি পেয়ে বয়ে গেল, তার পরের দিন আমার রুকস্যাকের মধ্যে এটা পেলাম। একে আমি কী নাম দিয়েছি জানো? ঘূর্ণি-ছানা! আমার মনে হয়েছিল, এটা ওই স্পেস-স্যুটরাই আমাকে উপহার হিসাবে দিয়ে গেছে না হলে এমন অদ্ভুত জিনিস আমার স্যাকে এল কোথা থেকে? হয়তো এটা ওদের স্মারক। আমি কখনো কাউকে দেখাইনি। তিমচিককেও নয়, ও এর আগে আমার যথেষ্ট পিছনে লেগেছে। ‘রথের নায়ক’! জিনিসটা তোমার কাছেই রাখো।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “গোটা শীতকাল এটা তোমার স্যাকে রেখে দিয়েছ! কাউকে জানতে দাওনি? তোমার ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়। বুঝতে পারছি কাজটা কত কঠিন।”

লার্কা মিষ্টি হাসল। “ইয়ার্কি মেরো না তালানভ। জিনিসটা অনেক অত্যাচার সয়েছে। ওটা আমি অনেকভাবে নাড়াচাড়া করেছি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছি, প্লায়ার দিয়ে চাপার চেষ্টা করেছি, এমনকি গ্যাস জ্বালিয়ে তার উপরও ধরেছি সামান্য আঁচড়টুকুও পড়েনি। এটা জলে ডোবে না, আগুনে পোড়ে না…”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, “হাতুড়ি প্লায়ার দিয়ে কী করতে চেয়েছিলে আমি বোধ হয় কিছুটা অনুমান করতে পারছি।”

“কী বলতে চাইছ তুমি? এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো গোপন ব্যাপার আছে, এর কোনো অজানা ব্যবহার। কারণ, একটা…” কিছু একটা বলতে লার্কা ইতস্তত করতে লাগল।

লার্কাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “এর ব্যবহার নিয়ে কেন মাথা ঘামাচ্ছ? সবকিছুর ব্যবহার জানা কি স্বস্তিদায়ক?”

লার্কা বোধ হয় ঠিক ধরতে পারল না আমি কী ভেবে কথাটা বললাম। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল আমার দিকে।

পরমাণুর অন্দরের গোপন রহস্য আবিষ্কারের ফল হিরোশিমার জনগণ কীভাবে পেল? পরমাণু বোমার কল্যাণে ওখানকার সবকিছু স্রেফ গলে গিয়েছিল। সাহারা মরুভূমিতে থার্মো নিউক্লিয়ার ঘূর্ণির জন্য কত পশুপাখি অন্ধের মতো ছুটে পালাতে চাইছিল, এই আমি তার সাক্ষী। কী ভয়ানক সে অভিজ্ঞতা!”

লার্কা আচমকা দু-হাতে কানদুটো চেপে ধরে অস্ফুটে বলে উঠল, “থামা! থামো তালানভ!”

কিন্তু আমি তখন উত্তেজিত, থামার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। বলতেই থাকলাম, “এমনও কেউ কেউ আছে, যারা ভালোবাসাকেও কাঁটা ছেঁড়া করে তার মধ্যের রহস্য জানতে চায়! চামড়া খুলে তার মাংস বের করে দেখতে চায়! হাতুড়ি ঠুকে, প্লায়ার দিয়ে টেনে, গ্যাস বার্নারের উপর ধরে পরীক্ষা করতে চায় ভালোবাসা ঠিক কী, কোথায় থাকে তা! দান্তে তাঁর ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’তে বলেছেন, ভালোবাসাই সমস্ত জগৎকে ঘোরাচ্ছে। সূর্য, মহাজাগতিক সংস্থা… সবাই ভালোবাসার অধীন…”

লার্কা হঠাৎ আমার হাঁটুর উপর ওর মাথা গুঁজে নিঃশব্দে ফোঁপাতে শুরু করল।

“এ কী করলে তুমি তালানভ?” ওর নিঃশব্দ কান্না ক্রমে ভাষায় রূপ নিল, “আমার বদলে তুমি ওই প্রাণহীন সিলভার ফক্স’ কেই বেছে নিলে! তাদের নিয়ে সারা পৃথিবী অর্থহীন দৌড়ে বেড়ালে! রাস্তার দু-ধারে বুভুক্ষু শিশুদের দিকে তাকালে না, জঙ্গলের পশুপাখির হাড়, জলার কচ্ছপের খোলা, সবকিছু মড়মড়িয়ে তোমাদের গাড়ির চাকা এগিয়ে গেল। তোমাদের জন্যে, শুধুমাত্র তোমাদের জন্যে আমাদের সুন্দর পৃথিবীর মাটি মুখ ঢেকেছে অ্যাসফল্টে। আর কী? কিছুদিন বাদে পোড়ো গির্জার হাতায়, আর মানুষের অগম্য ঢালগুলো বাদ দিয়ে আর কোথাও গাছের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। উন্নয়ন হবে যে! তোমরা রোবট হয়ে গেছ। সমস্ত জীবিত প্রাণ তোমরা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতে চাও। দিনে দিনে গ্রামগুলো সব মরুভূমি হয়ে যাবে, নদীতে মাছ খেলবে না, দিকে দিকে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেবে। কিন্তু তোমাদের রথ ছুটে চলবে উদ্দাম গতিতে! সেই গতির সামনে এসব কিছু অদৃশ্য। কিচ্ছু দেখতে চেষ্টাই করবে না তোমরা!”

লার্কা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ওকে শান্ত করা দরকার। সেই চেষ্টাতেই ওর কাঁধে আলতো চাপড় দিয়ে বললাম, “শান্ত হও, শান্ত হও লাকা।”

কিন্তু লার্কা থামল না। ও বলতে লাগল, “একটা কথা তুমি বুঝবে না। আমাদের সেই সুন্দর মিষ্টি শহরটার কথা মনে পড়ে? আজ তার আকাশ ঢেকে রয়েছে বিষাক্ত ধোঁয়াশায়। এখন পাহাড় থেকে সেদিকে তাকালে উঁচু টিভি টাওয়ার ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ে না। অথচ সেখানে আমাদের ফলের বাগান থেকে কতদিন আমরা নদীর হলদে বালি দেখতাম! যে নদী ওখান থেকে কম করে সত্তর কিলোমিটার দূরে। সেই টিউলিপের ঝাড় ওখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে উঠে গেছে আরও উপরের দিকে। ফলের গাছগুলোয় যখন ফুল ফুটত, আমার মনে হত অন্য গ্রহ থেকেও তা দেখা যাচ্ছে। সেই বাগানের কী হয়েছে জানো? কেটে ফেলা হয়েছে! মনে পড়ে সেই বাগানের কথা? তালানভ, স্কুলের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্র, যে কিনা পুশকিনের ‘ইউজিন ওনেজিন’ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিল, যে ছিল সাদসিধে, তখনও আমার সঙ্গে কিংবা হয়তো নিজের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। মনে পড়ে? কী করছ তুমি, তালানভ!”

“কিচ্ছু না লাকা, কিছুই না।” আমি অস্ফুটে স্বীকার করলাম।

বসন্তকালে যখন আমাদের ছোটো শহরের ফলের বাগানে ফুল ফুটত, তখন যেন রঙের আগুন জ্বলতে থাকত। সে এমন রঙের বন্যা, তা বোধ হয় অন্য গ্রহ থেকেও নজরে আসত। আমাদের স্কুল ছিল ওখান থেকে মাত্র পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা পড়ার নাম করে হাজির হত ওই বাগানে।

এপ্রিলের শেষে, ঘাস তখন প্রায় কোমর সমান উঁচু। দুপুরবেলায় আপেলগাছের ছায়া যখন গুঁড়ির আড়ালে লুকোত, মৌমাছির দল গরম বাতাসে বোঁ বোঁ করে এমন ঘুরপাক খেত যেন ওখানে গুড়ের ভাণ্ড রয়েছে। তখন সেই ঘন ঘাসের জঙ্গলে পড়ার নামে ছেলেদের আড্ডা বসত। ছেলেরা এমনভাবে থাকত, যেন নিতান্ত অসাবধানে আন্ডার প্যান্ট বেরিয়ে গেছে, চোখে পড়লে মেয়েরা লজ্জায় লাল হয়ে উঠত।

সাধারণ পোশাকেও আমরা তখন এক-একজন অসাধারণ হয়ে উঠতাম অতি সহজেই।

বেলা পড়ে এলে এক এক করে সবাই বাড়ির পথ ধরতাম। তবে সকলেই জানতাম নাদিয়া শখোয়ারোস্তোভা বাড়ির পথ ধরল তো মিনিট খানেকের মধ্যেই ভোভকা ইরানভকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরতে দেখা যাবে। যেন হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যেত, বাবা তাকে বাগানে জল দেওয়ার জন্য একটা ড্রাম ভরে রাখতে বলেছে, তাই তার এত তাড়া।

সেদিন একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। দূরের নদীটার বালিতে তখন সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের দিক থেকে রান্নার সুগন্ধ ভেসে আসছে। আমাদের এই জায়গাটাকে শহর না বলে শহরতলি বললে বেশি মানায়। আগে এর নাম ছিল স্তানিস্তা। আমাদের সিমেরচান্সক কসাক পূর্বপুরুষরা এখানে এসে বসতি তৈরি করেছিলেন। পাহাড়তলিতে বড়ো বড়ো খোলামেলা ঘর আর নানা রঙে রাঙানো দরজা, এই ছিল তাঁদের কালের বাড়ির বৈশিষ্ট্য।

লার্কা আর আমি ছাড়া বাকি সবাইই ফিরে গিয়েছিল। আমি তাড়াহুড়ো করে বই-পত্তর গুছোচ্ছিলাম, এমন সময় উপর থেকে আর্কার গলা শুনলাম, “ওই পাহাড়গুলোকে দেখ! ঠিক মনে হচ্ছে ওরা যেন সূর্যের পিছনে পিছনে যেতে চাইছে।”

তাকিয়ে দেখি ও একটা ফুলে ছাওয়া আপেলগাছের একদম মগডালে চড়ে বসেছে। আমি ওই গাছের গোড়ায় এসে উপরদিকে তাকালাম। আমার চোখ বুঝি অনধিকার প্রবেশ করে ফেলল।

আমি দেখলাম ওর গোলাপিরঙা লম্বা পা, সরু সরু পায়ের আঙুল… রেনেসাঁ শিল্পীদের আঁকা কোনো চিত্র যেন!

গোড়ালির কাছটায় পায়ের ডিমে আলো পড়ে অ্যাম্বারের মতো ঝকমক করছিল। ওর সুগঠিত হাঁটু, তারও উপরে সুগোল থাইয়ের ভাঁজে সাদা প্যান্টির আভাস, নির্মেদ পেটের ওঠানামা… অস্বস্তি হচ্ছিল।

আমি চেঁচিয়ে বললাম, “আরে পড়ে যাবি যে! নেমে আয়!”

ও হাঁটু দিয়ে জামাটা চেপে ধরল, কিছু বলল না। আমার বুকে যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছিল, ডালপালা সরিয়ে আমিও গাছে চড়লাম।

ও বাঁহাতে গাছের কাণ্ড ধরে ডানহাত দিয়ে সামনের পাহাড়ের দিকে দেখাচ্ছিল। ওর কনুইয়ের দিক বরাবর সূর্য তখন সবে অস্ত গেছে। যেদিকে হাত বাড়িয়েছিল, সেদিকে মাউন্ট আবাইয়ের জমাট বরফ তখনও তার লাল আভায় উজ্জ্বল।

আমাকে সেদিকে দেখিয়ে ও বলল, “এই সাদা চাদর মুড়ি দেওয়া পাথুরে দৈত্যরা সবসময় তারাদের দিকে চেয়ে থাকে দেখবি! ধর, কোনোদিন পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসী পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে পাড়ি জমাল, এ বেচারারা তখনো পড়ে থাকবে চিরস্থায়ী হয়ে। এরা অমর, কিন্তু এই অমরত্বের জন্যে এদের কত বড়ো মূল্য চোকাতে হয়!”

ওর কপাল ঘিরে থাকা বাদামি কোঁকড়া চুলের ঝালরে লেগে থাকা ঘাস সরাতে সরাতে মরিয়া হয়ে ওর নাম ধরে ডাকলাম। তবে তাতে ও খুব একটা পাত্তা দিল না। নিজের ছন্দেই বলতে লাগল, “এরা নড়তে চড়তে পারে না, তাও একরকম, কিন্তু যাওয়ার ইচ্ছে আছে ষোলো আনা। অথচ চলার ক্ষমতা নেই। সে দুর্ভাগ্য মেনে নেওয়া অনেক বেশি কঠিন।”

কথা বলতে বলতে আমার দিকে ফিরে চেঁচিয়ে উঠল, “এ কি! তোর গলার কাছ থেকে তো রক্ত বেরোচ্ছে! দাঁড়া! আমি ওষুধ দিচ্ছি।”

আমার চোখে পড়ল ওর সাদা দাঁতের ফাঁকে ভিজে গোলাপি জিভের ডগা। আঙুলের ডগায় একফোঁটা থুতু নিয়ে আমার কাটা জায়গায় চেপে ধরল। আমার শরীরে যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই লার্কা যে ডালটার উপর দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা মড়মড় করে ভেঙে পড়তে শুরু করল। আমি একহাতে ডাল ধরে আরেক হাতে ওকে জড়িয়ে নিজের দিকে হ্যাঁচকা টান মারলাম। টাল সামলাতে না পেরে ও আমার গায়ের উপর এসে পড়ল। ওর বুকের কাঁপুনি আমি টের পাচ্ছিলাম। সেই প্রথম আমি ওকে চুমু খেলাম। ওর কাঁধে, কানের নীচের তিলে, কোঁকড়া চুলে ঘেরা কপালে, তিরতির করে কাঁপতে থাকা নাকের ডগায়…

সমস্ত ফলের বাগান জুড়ে যেন এক অপার্থিব সঙ্গীত বেজে উঠল। তার মধ্যে আমাদের আপেলগাছটা দু-হাত মেলে দাঁড়িয়েছিল। অমৃতময় আকাশের বুকে সদ্য জন্মানো গ্রহের মতো যেন কাঁপতে কাঁপতে ভাসছিল।

আর বাতাস কেটে আসা চাঁদের আলোর বর্ষা ভাসিয়ে দিচ্ছিল পৃথিবীর বুক।

আর বিশ্বজুড়ে পাগলের মতো দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল।

আর সেই উজ্জ্বলতায় আমার ধাঁধানো দু-চোখ আমি খুলতে পারছিলাম না।

“কী করছ তুমি, তালানভ!”

“কিচ্ছু না, লার্কা কিছুই না।” আমি অস্ফুটে বললাম।

আগুনটা আস্তে আস্তে নিভে গেল।

তিয়েন শান পাহাড়ের বুকের মধ্যে, মধ্যরাতের নির্জনতায় আমি সেই মেয়েটির থেকে মাত্র ত্রিশ কদম দূরে শুয়ে ছিলাম, একদিন আপেল বাগানে যে মেয়েটি আমাকে আলিঙ্গন করেছিল।

তার পতিদেবের নাকের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম হয়তো তার অস্বস্তি হত, কিন্তু এখন আর অসুবিধে হয় না, অভ্যেস হয়ে গেছে। সে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তার গর্জনশীল স্বামীর পাশে আর ভাবছে অন্য এক পুরুষের কথা।

সেই পুরুষ, যে তার বিশ্বাস গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সে কি শুধু তার বিশ্বাসেরই দাম দেয়নি? সেই হারিয়ে যাওয়া আপেল বাগান, সেই যে নদী, যার জলধারা আজ ক্ষীয়মাণ, স্তানিস্তায় ছেড়ে আসা বাড়িটা… যেখানে গরুর হাম্বা, মোরগের কোঁকর-কোঁ… সব আজ স্মৃতির পাতায়। সেই বাড়িটার কাছে যুদ্ধের সময় বানানো নালার ধারের ছোটো দোকানঘরটা, যেখানে কোনো ক্লান্ত পথিক আর জিরিয়ে নেওয়ার জন্য থামে না, সবার বিশ্বাস সে পায়ে দলে চলে গেছে।

সেই ছোটো দোকানটা আজ আর নেই, সেই নালা বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই যারা সেখানে জিরিয়ে নিতে আসত, তারা আজ অনন্ত বিশ্রামে…

সেই ছেলেটা তার মায়ের প্রতিও কি অবিচার করেনি? তার তো ধারণা ছিল যে মা কোনোদিন তাকে ছেড়ে যাবে না, যেতেই পারে না! কিন্তু সেই জুলাই মাসের অন্ধকার দিনে সূর্য জ্বলছিল মাথার উপর… মাকে যখন শেষবারের মতো নিয়ে যাওয়া হল শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে, শুইয়ে দেওয়া হল মাটির বুকে, তখন সে জন্তুর মতো আর্তনাদ করছিল, পাগলের মতো প্রার্থনা করছিল অলৌকিক কোনো পথে যেন সব আবার আগের মতো হয়ে যায়।

কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না, সে মায়ের স্মৃতির কাছে চিরকালের জন্যে অবিশ্বাসী হয়েই রয়ে গেল। বদলে পেল অস্ট্রেলিয়ান র‍্যালিতে কতগুলো রূপোর পদক, টুপিতে কিছু খ্যাতির পালক জুড়ল নতুন করে, দেশবিদেশে ঘুরে বেড়াল খ্যাপার মতো, সময়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আর তার নিজের বলতে যা কিছু ছিল, সবার কাছে, সবকিছুর কাছে রয়ে গেল চির-অবিশ্বাসী। এমনকি প্রত্যেক বছর মায়ের সমাধির কাছে মাথা নোয়াতে যেতেও তার ভুল হয়ে যায়।

বার বার একই ঘটনাস্রোত তাকে বিস্মিত করে। কোথায় সে দৌড়চ্ছে? কার কাছ থেকে সে পালাতে চাইছে? সব তালগোল পাকিয়ে যায়। কার থেকে? বাড়ির ওম, না পূর্বপুরুষদের সমাধি, অথবা উত্তরের নদীর বাঁকের মুখের সেই উজ্জ্বল সবুজ বনানী, নাকি তাদের সেই প্রাচীন পবিত্র শহর?

যদি নদী ক্রমশ সরু হতে থাকে, যদি বনের প্রাণী ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়, যদি গ্রামের পথে হঠাৎ কোনো মেয়ের হাসির কাঁকন বেজে না ওঠে… এই সবকিছু তোমার জন্যে তালানভ? তুমি তালানভ, একমাত্র তুমিই সবকিছুর জন্যে দায়ী। তোমাকে ছাড়া আকাশ, মাটি সমস্তই মৃত। তুমি যদি এখানেই থাকতে সেই মেয়েটির পাশে, যে একদিন আপেল বাগানে তোমাকে আলিঙ্গন করেছিল, হয়তো শহরের নীল আকাশ ধূসর ধোঁয়াশায় ঢেকে যেত না, হয়তো পাহাড়তলিতে তোমার ছোটো শহরের কোল জুড়ে ফুটত টিউলিপ, স্কুলের ছাদে আগের মতোই নাচত ফেজেন্ট, আর বসন্তকালে আপেল বাগানের রঙের আগুন দেখা যেত হয়তো অন্য গ্রহ থেকে।

কিন্তু আর নয়। চন্দ্ৰযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, পৃথিবীর রক্ষকদেরও। বাঁচাতেই হবে।

তিয়েন শান পাহাড়ের বুকের মধ্যে, মধ্যরাতের নির্জনতায় দেখতে পেলাম আকাশ আর পাহাড়চূড়াগুলো যেখানে এক হয়ে মিলে গেছে, সেখানটা একটু একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। চাঁদ উঠেছে। যেখানে একটা ধারা এসে তাস-আক্সুতে মিলেছে, তার থেকে খানিকটা পিছনে পাথরের খাঁজের আড়ালে একটা লিঙ্কস তার বাসা থেকে মুখ বাড়িয়ে ইতিউতি চাইতে লাগল, নদীর তীরে একটা কস্তুরী মৃগ একটা সিলভার ফার গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল, হঠাৎ বুঝি তার নজর পড়ল লিঙ্কসের মার্বেলের গুলির মতো জ্বলজ্বলে চোখদুটোয়। সে দুটো এইদিকেই চেয়ে আছে যেন! তিরের মতো সে চড়াই বেয়ে উঠে এল যেখানে পাশাপাশি দুটো তাঁবুতে তিনজন মানুষ শুয়ে ছিল। আসলে তাদের মধ্যে একজন এত সরবে ঘুমোচ্ছিল যে লিঙ্কসটা আর ভয়ে এ-পথে পা বাড়ায়নি।

বুড়ো সিলভার ফার তার বিস্মৃতির অন্ধকার সরিয়ে জেগে উঠল। চাঁদের নরম আলো তার শিকড় থেকে ডালপালা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। তার মনে পড়ল, পাঁচশো সাতাত্তর চাঁদ আগে সাদা দাড়িওলা একজন তার নীচে তাঁবু গেড়েছিল। লোকটা প্রায় অর্ধেক চাঁদ সেই তাঁবুতে কাটিয়েও ছিল। দিব্যি মনে পড়ে, দিনের বেলা সে পড়ে পড়ে ঘুমোত, আর যেই রাত হত চাঁদের মায়াবী আলো যখন ছড়িয়ে পড়ত, দাড়িওলাও আলো ফেলত তার গায়ে। আর তা যেন তার গুঁড়িতে, ডালপালায় আদর করে সুড়সুড়ি দিত। চাঁদের ভাইও পাহাড়ের মাথায় উঁকি মারত। চাঁদের মতোই সে গোলগাল, কিন্তু তার থেকে আকারে ছোটো আর রঙটা লাল। তার আলোও বড়ো শান্ত। চোখ জুড়িয়ে যায়। চাঁদের ভাইয়ের ওখানে যেসব পাহাড় আছে, সেখানে যে সিলভার ফারেরা থাকে, তাদের ঠান্ডা শীর্ষ থেকে তারা সেই আলো পাঠাত।

আর দুরের সেই ছোট্টো শহরটায় অনেকগুলো গম্বুজওয়ালা গির্জা বানিয়েছিলেন মহান স্থপতি জেনকভ, সেখান থেকে চারশো আঠারো মিটার দূরে তাঁর বানানো আরেকটা দোতলা বাড়িতে আরেকজন জেগে ছিলেন। সেখানেও চাঁদ পাহাড়ের মাথায় উঠেছে, আর আন্দ্রেই পাভলোভিচ জেনকভের প্রপৌত্রী, আরেকজন বিশিষ্ট পণ্ডিতের বড়ো ভাইঝির চোখেও ঘুম নেই। এই পণ্ডিত সিলভার ফার থেকে প্রতিফলিত আলো আর অন্য গ্রহের আলোর বর্ণালীর মধ্যে কী পার্থক্য, আজীবন তাই খুঁজে গেল। সেই পণ্ডিতের বড়ো ভাইঝি এখন নিজেও একজন ঠানদিদি। তিনি বিগত আশি বছর ধরে বিন্দু বিন্দু করে যা সঞ্চয় করেছেন, তা তাঁর ‘সঙ্গীতে, কিংবদন্তীতে এবং সংস্কারে সমিরেচেঙ্কস কত্সকদের ইতিহাস’ বইতে লিপিবদ্ধ করছেন। সে কাজ শেষ না হলে তাঁর তো জীবন থেকে ছুটি নেওয়া চলবে না! তিনি নিজে ইতিহাসের পোকা। তাঁর সেই প্রাক্তন ছাত্র, যে সম্পূর্ণ ইউজিন ওনেজিন’ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিল, তার জন্য এখনও তাঁর মনে প্রচ্ছন্ন গর্ব রয়েছে। যদিও তা অনেককাল আগের কথা। সেদিনের সেই ছাত্রের নাম আজ গোটা দুনিয়া জানে, তবুও সে তার ছোটোবেলার ইতিহাসের দিদিমণিকে বিভিন্ন দেশের পোস্ট কার্ড, স্যুভেনির বা বই পাঠাতে ভোলে না। আর এটাও ঘটনা, তাঁর আট ভলমের ‘সঙ্গীতে, কিংবদন্তীতে এবং সংস্কারে সমিরেচেঙ্কস কসাকদের ইতিহাস’ বইটা, কিংবা তাঁর নিজের হাতে বানানো টীকা সমৃদ্ধ তেত্রিশ হাজার একচল্লিশটা ইনডেক্স কার্ড –একমাত্র তাঁর সেই প্রিয় ছাত্রের হাতে তুলে দিতে একমুহূর্তও ভাববেন না।

অথচ আজ কত বছর হয়ে গেল, সেই ছাত্রটি তাঁর সামনে গিয়ে সশরীরে দাঁড়ায়নি। হয়তো কখনো, যখন মাউন্ট আবাইয়ের উপর চাঁদ ওঠে আর সমস্ত শহর সেই মায়াবী আলোয় স্নান করে, তখন অর্ধ গোলাকার সেকেলে জানালার সামনে বসে তাঁর মনে হয় কেন তিনি আশাই করতে পারেন না যে সেই প্রিয় ছাত্রটি পরের বিষুদবার হঠাৎ এসে তাঁকে চমকে দেবে। আর সঙ্গে নিয়ে আসবে তাঁর প্রিয় বাদাম দেওয়া কেক আর সিকোয়া কাঠে তৈরি খাঁচায় দুটো গিনিপিগ। সেদিন হয়তো তিনি যত্ন করে চুলে ডাই করতেন, কেননা তাঁর প্রিয় ছাত্র আসছে বলে কথা!

আর জেনকভের প্রপৌত্রী, বিশিষ্ট পণ্ডিতের বড় ভাইঝি সেই ঠানদিদির পৃথিবী বিখ্যাত প্রিয় ছাত্রটি, তিয়েন শান পর্বতের বুকের মধ্যে, মধ্যরাতের নির্জনতায় তাঁবুতে শুয়ে দেখছিল চাঁদের আলো মাখা চূড়াগুলো কীভাবে আকাশকে ছুঁয়ে রয়েছে! অতীতের ধূসর পাতা থেকে উঠে আসা একটার পর একটা ভাবনা আগস্টের রাতের আকাশের তারা খসার মতো পর পর চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছিল। লিঙ্কস, হরিণ, সিলভার ফার কিম্বা তার দিদিমণি জোয়া ইভনোভনা… কোনো ভাবনাই যে তার মনে খুব ছাপ রেখে যাচ্ছিল তা নয়। মনে মনে সে এক অনন্ত ভুলের সমুদ্রের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, আর সেখান থেকে পরিত্রাণের জন্যই ছবিগুলো পর পর সারিবদ্ধভাবে সামনে দাঁড়াচ্ছে। আগেকার দিন হলে বলত, দিব্যদৃষ্টি। আর এখনকার ভাষায়, শুধুই অসাধারণ ঘটনা।

‘অসাধারণ ঘটনা মানেই যে বিস্ময়কর তা মোটেও নয়।’ আমি ভাবছিলাম, ‘অথবা বলা যায় সেভাবে দেখতে গেলে তো বিশ্বটাই একটা বিস্ময়। আমরা যে বলি মহাবিশ্বের কোনো সীমানা নেই! আসলে বলা উচিত, সম্ভব এবং অসম্ভবের মধ্যে কোনো সীমারেখা টানা যায় না। আমাদের দুর্বল মেধা একটা সীমারেখা টানে বটে, কিন্তু সেই লাইনটাকে যদি অনাদিকাল ধরে বাড়াতেই থাকি, একটা সময় আর সেই বিভেদটাই মুছে যায়। আসলে নানারকম শর্তে আবদ্ধ সসীমের সঙ্গে মুক্ত অসীমের কোনো তুলনাই টানা যায় না একথাটা বোঝে খুব কম লোক।’

পাহাড়ের খাঁজ কাটা চূড়াগুলোর উপর গোল চাঁদখানাকে দেখা গেল।

আর আমি আবার ভাবছিলাম… ভাবছিলাম? না দেখতে পেলাম? সঠিক বলতে পারব না…।

…স্ফটিক পাথরের ঘূর্ণির মধ্যে থেকে বেরোনো অ্যানথ্রাসাইট আগন্তুকরা কেবলমাত্র দেখতে এসেছে তা আদৌ নয়। ওরা সাধারণ নক্ষত্র-পথিক, কিংবা রেসিংয়ের প্রতিযোগী। গ্রহে তারায় অনাবশ্যক ছুটে বেড়ানোই ওদের কাজ। লার্কা ঠিকই বলে, ওরা কোনোরকম যোগাযোগ করতে চায় না। ওদের দরকার নেই। আমাদের জ্ঞান, আমাদের ইতিহাস, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ, আমাদের দায়িত্ব, যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পাওয়া সাফল্য, কোনো কিছুতেই ওদের কৌতূহল নেই। বিশ্বজোড়া দৌড়ের মধ্য দিয়ে ওরা ওদের নেতার মঙ্গল করতে চায়, সে হলুদ বা যে রঙের স্পেস-সুটওলাই হোক না কেন, তাকে জয়ী করাই ওদের লক্ষ্য।

দুপুরবেলা সূর্য তখন মাথার উপর গনগন করছিল। একটা ফুলেফেঁপে ওঠা পাহাড়ি নদীর ধারে পাথরের উপর উবু হয়ে বুড়ো মতন একজন বসেছিল। দেখে মনে হয় ক্রেওল জাতের লোক (বিশেষ একটি উপজাতি)। আমাদের দেখে আঙুল দিয়ে নদীর বিপরীত পাড়টা দেখাল। ওইদিকে যেতে চায় তা বুঝলাম।

“ওকে তুলে নেওয়া যাক।” গোলোয়েসেভকে বললাম, “তাড়াহুড়ো চলবে না। একেবারে শামুকের গতিতে নদীখাতে নামতে হবে।”

যাই হোক, সে বুড়োকে গাড়িতে তুলে নীচে নামলাম। আমাদের গাড়ি পেরুন নদীতে নামল। গাড়ির গতি প্রায় নেই বললেই চলে। স্রোতের সঙ্গে বয়ে আসা পাথর গাড়ির গায়ে এসে লাগছিল, ঘোলা জল জানালার নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। সে বুড়ো প্রথমে ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করল, তারপর অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র পড়া শুরু করল। অবশ্য তার একটি বর্ণও আমরা বুঝতে পারলাম না। তবে এটা বুঝলাম কোনো অশুভ আত্মাকে তাড়ানোর জন্যই মন্ত্র পড়া হচ্ছে।

নদী পেরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলাম। বললাম, “যত্তসব কুসংস্কারের ডিপো! কার কাছে প্রার্থনা করলে শুনি? ওই ‘সাদা দেবতা’র কাছে? ( খ্রিস্টধর্ম রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার আগে স্লাভদের উপাস্য দেবতা –সূর্য ও আলোর দেবতা)। একবারও তো আমাদের ধন্যবাদ জানালে না। যাক গে, চলি এবার।”

লোকটা কী একটা জিনিস হাতে গুঁজে দিল।

“কী এটা? ও, বই দেখছি। কী হে, এটা কি প্যাপিরাসের নাকি! স্মারক? ঠিক আছে বুড়ো খোকা, ধন্যবাদ!”

“চলো চলো তালানভ। দেড় মিনিট তো এখানেই নষ্ট হল!” গোলোয়েসেভ তাড়া লাগাল।

“ঠিক আছে, ধন্যবাদ। তোমার বইয়ের জন্যে। এই দেখো, আমাদের গাড়িটা দেখছ? খুব নাম এ গাড়ির। এর নাম পেরুন। এর মতো দেখতে এই খেলনাটা রাখো। তোমার নাতি-পুতিদের দিয়ো। ওরা খেলবে। না না, এটা ইলেক্ট্রিকে চলে না। এ যে-কোনো সাধারণ খেলনার দোকানেই পাওয়া যায়।

“ও কী! ও দাদু! তুমি অমন হাঁটু গেড়ে বসছ কেন? নাও, এখানে পা রাখো হে! এবার… এবার ওই পেপেরুদাস, ভেসুভিয়াস সব কটাকে দেখাচ্ছি মজা! চল হে সাবধানে। সামনের বাঁকের দিকে খেয়াল রেখো। চাকা না পিছলায়। বাহ! একেবারে ঠিকঠাক পেরোনো গেছে।

“আরে! ওই দেখো! এই ল্যাপে আমরা দু-নম্বরে আছি। হুররে! এখনও সুযোগ আছে।

“আচ্ছা, ওই বুড়ো লোকটা যে বইটা দিয়েছিল সেটা একটু দেখো না কোথায়। কী বললে? চোখে পড়েনি? হারিয়ে গেছে? কোথাও পড়ে গেছে? দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি যেন ওটা কালকেই দেখলাম। একটু দোমড়ানো, পাতাগুলো উড়ছিল… ওর মধ্যে চাঁদের কলার মতো কোনো ছবি দেখলাম। আর কী যেন একটা অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপারও নজরে পড়েছিল… কী ছিল সেটা? অভিকর্ষের কোনো গোপন রহস্য? কী বললে? ওই লোকটার ট্রাউজার লামার চামড়া দিয়ে তৈরি? ওরা সেটা শিখল কেমন করে? যাহ! তুমি আমার সঙ্গে মশকরা করছ।

“কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না। ওরা ওই মস্ত বড়ো মসৃণ পাথরটাকে পাহাড়ের মাথায় তুলল কেমন করে? ভাবো একবার। তুমি লগারিদম দিয়ে হিসেবনিকেশ তো করেছিলে! কী বেরিয়েছিল সেখানে? পাথরটার ওজন কম করে পনেরোশো টন তো হবেই!”

এরপরের কয়েকটা দিন রেসের কিছু বিড়ম্বনার মধ্যে দিয়েই কাটার কথা। তবে আগে এর চাইতেও খারাপ অবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। আবার পরের বার অসুবিধাগুলোর ব্যাপারে আর একটু ভালো জানব।

হুর-রে! এবারের রেসেও আমরাই জিতলাম। ওহ, বন্ধু! দুর্দান্ত খেল দেখালে! এবার বিশ্রামের পালা। এই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালানো কি চাট্টিখানি কথা!

আর এই অভিকর্ষের গোপন রহস্যের মধ্য দিয়ে যানটাকে ঠিকঠাক চালানো… পা

হাড়ের অজানা এবড়োখেবড়ো পথে আমাদের গাড়ি চালানো আর ওই স্পেস স্যুটদের এই অজানা অভিকর্ষের রহস্যের মধ্য দিয়ে যান চালানো, দুটোই একরকম। ওরা ওদের যান সারিয়ে আবার চোখের নিমেষে ওই চোখ ধাঁধানো নক্ষত্রলোকে রওনা দিয়েছে।

***

চাঁদ তার সমস্ত প্রভা মেলে দিয়েছে। আর সেই মধ্যরাতের নির্জনতায়, তিয়েনশান পর্বতের বুকের মধ্যে আমি তখন এপাশ ওপাশ করছিলাম, কারণ লার্কার দেওয়া সেই ঘূর্ণি-ছানার শক্ত দেহটা আমার গায়ের সঙ্গে এঁটে ছিল। কোনো একটা ফাঁক দিয়ে সরু একফালি চাঁদের আলো তাঁবুর মধ্যে এসে পড়েছিল। সেই আলোয় ওই জিনিসটা রুপোর মতো চকচক করছিল। আমি ওটাকে দুই আঙুলে তুলে নিলাম। আগেই দেখেছিলাম, জিনিসটা ভীষণ হালকা, কিন্তু এখন অবাক হয়ে দেখলাম, হালকা শুধু নয়, এর সামান্য ওজনও নেই! এটা কী করে সম্ভব? আমি তাঁবু থেকে বেরিয়ে চাঁদের আলোয় বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

চাঁদের আলোয় ঘূর্ণি-ছানার গায়ে কুয়াশা জড়িয়ে ছিল আর তার মধ্যে থেকে আলোর আভা বেরোচ্ছিল। আর সেই হালকা আলোয় ঘূর্ণির মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলাম খুব ধীরে ধীরে কতকগুলো সর্পিল ঘূর্ণি ঘুরপাক খাচ্ছে, কোথাও দুটো, কোথাও তিনটে তারার জটলা; আর দেখতে পেলাম গ্রহের সারি।

যেন একটা গম্বুজের নীচে এক অদ্ভুত নক্ষত্রজগৎ, আকারে যেটা আপেলগাছের ডগার মতো। আমার মাথার উপরে এক কুয়াশামোড়া গোলকের মধ্যে আরও একইরকম অনেক ঘূর্ণি-ছানা। মনে হল, তারা সবাই মিলে এক অজানা গন্তব্যের পথ দেখাতে চাইছে।

হঠাৎ কী একটা মনে হওয়ায় আমি দু-হাত দিয়ে ঘূর্ণি-ছানাকে ঢেকে দিলাম। গম্বুজের নীচের সেই আশ্চর্য নক্ষত্রজগৎও অদৃশ্য হল! আমি দু-আঙুলে ওটাকে আলতো করে তুলে নিলাম, যেন একটা খেলনা জাহাজকে জলে ভাসাচ্ছি। হাতটা বাড়িয়ে ছেড়ে দিলাম বাতাসে।

কী আশ্চর্য! ওটা বাতাসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, পড়ে গেল না!

একদম স্থির! একটু কাঁপলও না!

চন্দ্রালোকে অনেকগুলো রহস্যময় পরিবর্তন আমার চোখে ধরা পড়ল। প্রথমে আমার আশেপাশের ঝোঁপঝাড়গুলো, তারপর নদী আর তার লাগোয়া পাহাড়, তারও পরে অনেক দূরের উঁচু উঁচু চূড়াগুলো আর যেন ততটা জমাট লাগছে না। ওরা ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে… স্ফটিকের মতো… আমার চোখ ঝলসে গেল, আপনাআপনি দু-চোখ বুজে গেল। আবার যখন চোখ খুললাম তখন পৃথিবীর গোলকটাও স্বচ্ছ লাগল। পৃথিবীর স্বচ্ছ গায়ের ভিতর দিয়ে আমি একদম বিপরীত গোলার্ধের আকাশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। দক্ষিণ গোলার্ধের বাকি সব তারাদের পাশ কাটিয়ে আমাদের উত্তর গোলার্ধের ধ্রুবতারার জুড়ি সাদার্ন ক্রসকেও দেখতে পেলাম। আমাদের উত্তর গোলার্ধের রাতের শহরগুলোকে দেখতে লাগছিল জেলিফিশের মতো, যেন তাদের ভিতর থেকে আলো বেরোচ্ছে। আর তার মধ্যে এরোপ্লেন, ট্রেন আর নদীতে নৌকোর আলোগুলো পারদের ফোঁটার মতো চকচক করছিল। কোন একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে সাদা আলোর শিখা আর জ্বলন্ত ম্যাগমার স্রোত গলগল করে বেরিয়ে আসছিল।

সূর্যস্নাত পৃথিবীর পেয়ালা থেকে জলরঙা নীলচে আলো নিঃসৃত হচ্ছিল, ঠিক যেমন মায়াবী আলো আমার অর্ধ-বিস্মৃত শৈশবের স্বপ্নে ঘুরেফিরে আসত। আমি একটা ছোট্টো লার্কের মতোই যেন উড়তে উড়তে উপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম সমস্ত খুঁটিনাটি।

গভীর সমুদ্রে তিমির দল আপন ছন্দে ভাসছে, মরুভূমির বালিয়াড়ির মাঝে বুকে হেঁটে যাচ্ছে সাপ।

কারাবায়ো পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আলো-আঁধারির খেলা।

আর ঢেউয়ের মাথায় সারি সারি আলোর ফোঁটা। সাগরের ফেনার চাদরের ওম মেখে অমলিন বুড়ো শহরটা ঘুমোচ্ছে কী নিশ্চিন্তে!

ওই যে গভীর কালো খাদ, তার দু-পাশের পাহাড় বুঝি হাতে হাত রেখে সেতু বেঁধেছে।

যুদ্ধ-ক্লান্ত মাঠ এখন অনাদিকালের সোনালি শস্যের স্বপ্নে বিভোর।

ফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে থাকা রকেট-বন্দর পাশের বাঁধের বাঁককে এমন জড়িয়ে রয়েছে যেন একটা মস্ত বীণা, বেজে উঠবে বুঝি এক্ষুনি!

শুষ্ক প্রান্তর টিউলিপের রঙে রঙিন, প্রেমিক যুগলের খুশিই আজ বাগানজুড়ে ফুটেছে! শিশুর দলের কলরব শুনতে পাচ্ছি ওরা কথা বলছে মেঘের সঙ্গে, ধূধূ প্রান্তর জুড়ে বয়ে চলা হাওয়ার সঙ্গে, জলের বুকে ভেসে চলা রাজহাঁসের সঙ্গে, রকেট-বন্দরের সঙ্গে, এমনকি ড্রাগন আর কামানের সঙ্গেও।

ওরা সবাই মানুষ–আর আমি, এক ছোট্টো লার্ক-নাচি, গাই, দেখি অনন্ত প্রাণের পরিপূর্ণতা।

কিন্তু চারদিকে কারা ওরা ঘিরে ধরছে? ডাইনে, বাঁয়ে, ওপরে, নীচে? সমুদ্রের গভীর থেকে, গিরিখাত থেকে, মরুভূমির বুক চিরে লকলকে জিভ বের করে কারা এগিয়ে আসছে? সিকোয়া, ফার, লরেল, তাল যাবতীয় গাছের আড়ালে গুঁড়ি মেরে, ডুবোজাহাজের আড়াল থেকে ওরা উঁকি মারছে। এমনকি মরু তুষার, তাকেও ছাড়েনি! সংকেত পেলেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। জমাট বাঁধা বিষাক্ত তীব্র নীল আলো অপেক্ষা। করছে কার অঙ্গুলিহেলনের? এ আলোর একমাত্র উৎস নক্ষত্রের অন্তঃস্থল!

হঠাৎই সবকিছু চোখের সামনে থেকে মুছে গেল। একটা অর্ধবৃত্তাকার মেঘ আস্তে আস্তে চাঁদটাকে পুরো ঢেকে দিল। অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল।

ঘূর্ণি-ছানারও উজ্জ্বলতা আর নেই, একটা ছোটো কালো গুলির মতো ঘাসের উপর টুপ করে খসে পড়ল। ও বাতাসে নিরালম্ব দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়েছে। কুড়িয়ে নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এলাম। যত্ন করে রেখে দিলাম রুকস্যাকে।

‘তুমি আর আমি আবারো জ্যোৎস্না তরঙ্গে ভাসব… তুমি আসলে একটা ছোটো ঘূর্ণিযান। তাই না? তোমাকে ওই নক্ষত্র-অভিযাত্রীরা উপহার হিসাবে দিয়ে গেছে, নাকি ঘটনাচক্রে তুমি লার্কার হাতে পড়েছ?’

আমার ভাবনাগুলো নিয়ে নিজের সঙ্গে নাড়াচাড়া করছিলাম। চোখটা আপনিই চলে গেল পাহড়ের গায়ে, যেখানে ওদের যান স্বল্প সময়ের জন্য নেমেছিল। হয়তো পথ ভুল করে, কিংবা লার্কার যেমন মনে হয়েছিল, ওদের জীবন্ত উজ্জ্বল রঙের ইঞ্জিনটা খারাপ হওয়ায় নামতে ওরা বাধ্য হয়েছিল, তারপর তা সারিয়ে আবার ওরা চলে গিয়েছিল নিজের পথে।

মেঘ সরে গেছে, জ্যোৎস্না এসে পড়েছে বরফমোড়া পাহাড়চূড়ায়। কয়েক কদম দূরে তিমচিকের নাকের গর্জন যেন একটু কম।

সত্যি সত্যিই নদীখাতের ওই পাড়ের পাহাড়ের গায়ে একটা মস্ত কালো খোঁদল। লার্কার ডায়েরিতে যেমন বর্ণনা ছিল।

একটা হালকা গোলাপি আলোর সরণি নদীর এপাড় ও-পাড় জুড়ে বিছিয়ে রয়েছে। খুব হালকা রঙের, কিন্তু দিব্যি বোঝা যাচ্ছে, কেউ যেন টর্চের আলো ফেলছে। একটু কাঁপা কাঁপা আলোটা। আমার মনে পড়ে গেল, লার্কা এরকম একটা আলোর পথের কথা বলেছিল, যে পথ পাহাড়ের গায়ে গিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল। স্পেসে ঘনত্ব কি সত্যিই এত বেশি হতে পারে?

কে বলতে পারে, আজ যা অসম্ভব মনে হচ্ছে তা হয়তো আদৌ অসম্ভব নয়!

এই বিংশ শতকের শুরুর দিকে প্যারিসে যখন প্রথমবার ওয়ার্ল্ড ফেয়ার হয়েছিল তখন জনতা একটা বিশাল বেলুনকে বাতাসে কোনো অবলম্বন ছাড়া ঝুলে থাকতে দেখে অবাক হয়েছিল। আসলে ওটা ছিল একটা শক্তিশালী চুম্বকের কামাল, আর কোনো রহস্য ওতে ছিল না।

খাদের প্রান্তে ওই আলোর সরণি বরাবর একটা রাতচরা পাখি উড়ছে। গোলাপি। আলোটা এখন আর খুব একটা কাঁপছে না। আলোর স্রোতে ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। উড়ন্ত দেহটা। এ কী! কী দেখছি আমি! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

পাখি নয়। আলোর পথ বেয়ে আসছে লার্কা!

লার্কা! অবিশ্বাস্য! চোখ কচলে তাকালাম।

লার্কা হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে নদীখাতের উপরের আলোর সেতু ধরে আমার থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে, দু-হাত মেলে দিয়েছে পাখির মতো, মুখ তুলে রয়েছে চাঁদের দিকে। চাঁদকেই দেখছে বুঝি। চাঁদের আলো খেলা করছে ঝরনার মতো নেমে আসা ওর তামাটে চুলের রাশিতে।

মুগ্ধ আমি দু-চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। না, ওর দৃষ্টি চাঁদের গায়ে আটকে নেই, চাঁদ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে, আকাশগঙ্গা ছায়াপথের দিকে। ওই যেখানে প্রাচীনের মধ্য থেকে জেগে উঠছে নতুন বিশ্ব।

চাঁদের দেবী, নাকি চন্দ্রকন্যা লাকার ছায়া ছুঁয়েছে সদ্য জন্মানো বিশ্বের দোরগোড়া! ওর দু-হাত ছড়িয়ে গেছে দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে।

ধোঁয়াশা মাখা সর্পিল আলোর ঘূর্ণি, দুটো কিংবা তিনটে তারার জটলা, আর গ্রহের সারি।

প্রসববেদনা আর মৃত্যুযন্ত্রণার দোলাচল। দুই যন্ত্রণার মাঝে বিস্তর ফারাক, অথবা একই অঙ্গে দুই রূপ।

অনন্ত বাগানে ফলভারনত বৃক্ষশাখায়, পাতায় মর্মরধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তারায় তারায় রথ প্রস্তুত হচ্ছে নতুন অভিযানের জন্য। তার মধ্যে যে সর্বোৎকৃষ্ট, সে তার পথ করে নেবে।

সময়ের সীমা ছেড়ে
অসীমের খোঁজে
তারার প্রান্তরে বোনা
অনন্ত বসন্তদিন।

এতদিনকার অর্থহীন দৌড় আর অকেজো পুরস্কারের স্তূপ আমাকে লজ্জা দিচ্ছিল। এই অসীমের মাঝে কত ক্ষুদ্র সেগুলো!

তিয়েন শান পাহাড়ের নির্জনতায় পৃথিবীর আত্মজা… অজানা বিশ্ব তার অপেক্ষায়। আর্কিমিডিস সাইরাকিউসে তাঁর শেষ শয্যায় শুয়ে তাকে পাঠিয়েছেন আগামীর আশীর্বাদ– বৃত্তটাকে ধ্বংস কোরো না। নেদ্ভা যেমন ডন নদীর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে, লার্কাও তেমনই কোন বিশালত্বের শরিক। রাতের গোলকধাঁধায় পথ হারানো কুকুরটা যেখানে তার ধনুর্ধর প্রভুকে খুঁজছে, সিলভার ফার যেদিকে তার নাক্ষত্রিক জুড়িদের টানে হাত বাড়িয়েছে… সেই সবকিছু ছাড়িয়ে ওর পথ চলা।

আমারও পথচলা এবার শুরু হবে। সাইবেরিয়ার ইয়েলতলোভস্কা শহরে যে শিশু একদিন পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিল, তাকে তার দায় মেটাতে হবে। ‘সঙ্গীতে, কিংবদন্তীতে এবং সংস্কারে সমিরেচেঙ্কস কসাকদের ইতিহাস’ শেষ করার দায়িত্ব তো এখন তারই উপর।

গরিবের কুঁড়ে, রক্তচোষা বণিকের প্রাসাদ, আকাশছোঁয়া বহুতল, রকেট-বন্দর, পরমাণু কেন্দ্র, এমনকি বিশ্বের মহান স্থাপত্য… সবাই এখন একই স্তরে।

কারাবায়ের কোলে সেই গ্রাম, যেখানে আমাদের দেওয়া ছোটো পেরুন চন্দ্রযোদ্ধাদের বুড়ো মোড়লের কাছে যত্নে আছে। কিন্তু মোড়লের একমাত্র নাতি আর নেই। চাঁদের দেবী তাকে নিয়ে গেছে খাদের ধার থেকে।

সেই চাঁদের দেবী
অথবা আপেল বাগানের সেই মেয়েটি
সেই মেয়েটি যে আমাকে প্রথম চুম্বন করেছিল
আমি তাকে নাম ধরে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু
কিন্তু ও চলে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে
আমার নাগাল ছাড়িয়ে…

ওর পথে আমাকেও যেতে হবে… আমাকেও…