মেফিস্টো (১৯৭২)

মেফিস্টো (১৯৭২)
অসকোলড ইয়াকুববাভস্কি। অনুবাদ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়

০১.

আবার দৈত্যাকার স্কুইডটা। কোনোই সন্দেহ নেই তাতে।

উনি খবরের কাগজটা দলা-মোচড়া করে জলে ছুঁড়ে দিলেন। ওটা কাগজের নৌকোর মতো ভেসে রইল খানিক তারপর হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল; সাগরের জলে ছোট্ট একটা ঘূর্ণি কাগজটাকে টেনে নিল।

এবারে ওটা সাগরের একেবারে তলায় চলে যাবে এবং অনির্দিষ্টকাল পড়ে থাকবে। ওর সাদাটে তথ্যের পাখনা ছড়িয়ে: বিশাল সমুদ্র এবং বিশাল স্কুইড…

সমুদ্র… চারদিকেই তার গর্জন শোনা যাচ্ছে। চকচকে পাথরগুলোর ওপর ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢেউ, পাথরের ফাঁকে আটকা পড়ে ছোটো ছোটো অসংখ্য ঢেউয়ের ছলাৎ ছল উঠছে। একেবারে শেষের ঢেউগুলো পায়রার বাসার বাদামি খড়কুটো আর সবজেটে শিরাওয়ালা গিরগিটির ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে।

বেশ মনোযোগ দিয়ে যদি কেউ শোনে তো বলতে পারবে ঢেউগুলোর দু-রকম দশা, দুটোই ধীর এবং একঘেয়ে: সময়ের ধাতব পেন্ডুলামটা অনেকটা বিস্তার নিয়ে দুলেই চলছিল।

ঢেউটা ঘুমপাড়ানি গান গাইছিল, মনে হচ্ছিল একটানা একই সুরে বারবার, ‘ঘুমোতে যাও, ঘুমোও, ঘুমোও… তুমি এখন স্থির ও প্রশান্ত হয়ে আছ…’।

ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে সূর্যের আলো জলতল ছুঁয়ে যাচ্ছে। পেন্ডুলাম দুলছে, বাধাহীন, কোনো তাড়া নেই, আর এসময় স্ফটিক ঢেউগুলো ছুটে যাচ্ছে পাড়ে (সমুদ্র-ঝাঁঝিগুলো ভেসে ভেসে পাথরের গায়ে, ঠিক চিকচিকে লাল লাল ফোঁটার মতো)। গতিটা আবার বিপরীতমুখী হচ্ছে, পেন্ডুলাম উলটোমুখে দুলে ফিরে আসায়, সমুদ্রের গভীরে একটা সাদা পাথর বেরিয়ে পড়ছে।

খবরের কাগজের লোকগুলো… কেন ডাকল? ওরা কি কখনো কেবিনের মধ্যে জাহাজের লোকজনসুদ্ধ ডুবছে এরকম ভেঙে পড়া পালতোলা জাহাজ –স্কুনার, দেখেনি?

অথবা ওরা বোধ হয় ভেবেছিল… না না, সেটা অসম্ভব। “এটা কি দানব-স্কুইডটার কাজ?” ওরা জিজ্ঞেস করেছিল। ভাঙাচোরা মাস্তুলের দড়িদড়া আর একপাশ তুবড়ে যাওয়া দেখে এটা অবশ্য করে ভেবে নেওয়া যায় যে স্কুইডটাই মাস্তুল ভাঙা আর স্কুনারটার উলটে যাওয়ার জন্য দায়ী।

দানব স্কুইডটা বোধ হয় ওর গুঁড়গুলো ছড়িয়ে মাস্তুল আঁকড়ে ধরে এক ঝটকায় স্কুনারটা উলটে দিয়েছিল।

..বেঞ্চটা বেশ গরম, দুপুরের রোদে বেশ সুখকর, কিন্তু তবুও, জল এই গরম ভাবটার ওপর দিয়ে টেক্কা দিতে পারেনি। ঠান্ডা আর গরম, চরম এই দুটো জিনিসের সঙ্গেই মানুষ আজীবন লড়াই করে গেল, কেবলমাত্র বুড়ো হবার পরই সোনালি ফসলটা হাসিল হল। যাকে বলে প্রজ্ঞা, কিন্তু সম্ভবত এটা একটা ক্রমশ ফুরিয়ে আসা শক্তি।

সবুজ খাঁড়িটার দৃশ্য দারুণ, একফালি সমুদ্র তীরভূমির মধ্যে ঢুকে এসেছে। প্রজাপতিদের নরম ছায়া, গোল গোল, সূর্যের মতো। ওগুলো সত্যিই প্রজাপতির পিছু পিছু ঘোরা সূর্যের ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়, শুধু একটা উত্তপ্ত পাথরের দেওয়াল বরাবর আবছা মরীচিকা সরে সরে যায়। দেওয়ালের ওপরে একটা বেড়াল ঝিমোচ্ছে, ওর নাক থেকে খুব হালকা শিসের আওয়াজ আসছিল। মাঝে মাঝে ও মাথা তুলে, কান খাড়া করে, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে ওর সতর্ক চোখদুটোকে ছোটো করে নিয়ে কী দেখছিল।

“আমি মাঝরাতে আসব। মেফিস্টো।”

“এই যে, শোনো। তোমরা বেড়ালেরা তো আবার ভবিষ্যৎ দেখতে পাও। রাতচরা। বলে তোমরা সবকিছুই দেখো আর জানো। ও কি সত্যিই রাত্তিরে আসবে? রাত্তিরে ওকে দেখতে পাবো কীভাবে? ওহো হো, আচ্ছা আচ্ছা, পূর্ণিমা তো, শেষমেশ সম্ভবত ওকে দেখতে পাব। যদি না গভীর সমুদ্রের তলা থেকে পাঠানো টেলিগ্রামগুলো সব তড়িতের কণার জটলা হয়ে তারের মধ্যেই না হারিয়ে যায়। প্রশ্নটা ছিল জ্ঞানপিপাসাটা কোথায় থামে আর সর্বশক্তিমানের স্বপ্নটা কোথায় শুরু হয়। এই দ্যাখো বুড়ো হেনরি কী দারুণ আইস-টি নিয়ে আসছে, হাঁটু থেকে পা-টাও প্রায় ভাঁজ হয় না বেচারার। ধন্যবাদ বুড়ো খোকা, অসংখ্য ধন্যবাদ। তুমি কি অদৃষ্টে বিশ্বাস করো? ওরাই আমাকে ‘ম্যারিয়েন’– কে দেখিয়ে দিয়েছে, জানো তো। ওটা এমন পরিশ্রমী জাহাজ, পাপুয়া নিউগিনি থেকে মালপত্র ফেরি করত আর গ্রেট বেরিয়ার রিফ থেকে সমুদ্র-শশা তুলে আনত।”

ওখান থেকে অস্ট্রেলিয়ার তটরেখা দেখা যায়।

স্কুনারটা অগভীর জলে উলটে পড়ে ছিল। তার মানে বিশাল স্কুইডটা আশেপাশেই আছে।

এক্কেবারে ওর কায়দা: রাত্তিরে যখন জাহাজের সবাই ঘুমন্ত, নজরদার লোকটা বিশাল স্কুইডের জ্বলজ্বলে প্রকাণ্ড শরীরটা দেখে চিৎকার করছিল। বেচারা প্রাণের ভয়ে মাস্তুল আঁকড়ে ধরে ঝুলে ছিল, উথালপাতাল ছিরানো মালপত্রের মতো।

সবসময় একইরকম: রাত্তির আর ছোটো জাহাজ… অথবা মাঝে মধ্যে ইয়ট।

পরপর এই নৈশকালীন আক্রমণ সারা পৃথিবী জুড়েই হচ্ছিল যদ্দিন না শেষমেশ এই বিশেষ জায়গাটাতে পৌঁছোয়। আর খবরের কাগজওয়ালারা চেঁচাচ্ছিল, “শোনো, শোনো! দানব স্কুইডটাকে দেখা গেছে!”

তো আমার কী করার আছে এতে? গভীর সমুদ্রের প্রাণীদের মধ্যে ১১১৫-খানা নতুন প্রজাতি আছে আর চূড়ান্ত বিশ্লেষণের পর সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

গ্রন্থাগার… নিস্তব্ধতা, অনেকগুলো হাতের এবং তার সঙ্গে বই-বাঁধানো চামড়ার সোঁদা গন্ধ।

সমুদ্রের ভিজে ভিজে ভাবটা প্রতিটা কোনায় ঢুকে গেছে। নোনা আর ভেজা ভেজা আবহাওয়ায় সমস্ত বই, কাগজপত্র, কেমন ফুলো ফুলো, পাতাগুলো ঢেউ খেলে গেছে।

আহ, হা– মিলটন… “স্বর্গে দাসত্ব করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা ভালো!” ওই লাইনটা এমন অসীম শয়তানি গর্বে ভরা, যেন, যেন মেফিস্টোরও হয়তো তাইই। যাই হোক, জানা আছে কি, একটা দানব-স্কুইড কতটা বাড়তে পারে, কী তার সীমা? আদৌ কোনো সীমা আছে, নাকি সীমাহীন সাগরের গভীরতার মতোই তার পরিমাপ? এটাকে জ্ঞানের লোভের সঙ্গেও তুলনা করা যেতে পারে: যত তুমি জানবে তত আগ্রাসী আর ক্ষমাহীন হয়ে উঠবে… তাই নয় কি?

শয়তান সবসময় একটা শর্ত আরোপ করে রাখে, আর সেটা হল যে বিদ্যা তুমি পাবে তার জন্য মূল্য চোকাতে হবে এবং ওরা দু’জনেই সেটা দিয়েছে, দেয়নি কি? উনি ওঁর কষ্ট দিয়ে আর জো তার ত্রাস দিয়ে।

নাকি এটা প্রতিশোধ? আর তাই যদি হয় তাহলে এত দীর্ঘ অপেক্ষার পর কেন, ও তো বহু আগে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

…সূর্যের আলো জানালার রঙিন কাঁচ ভেদ করে এসে পড়েছিল, কত শতাব্দী আগের তৈরি জানালা। সূর্যের রশ্মি পড়ে ঘরটাকে জীবন্ত করে তুলেছে, রঙবেরঙের মাছেদের মতো রঙে, যেন প্রবালের ফাঁকে ফাঁকে তোতাপাখি বেঁধে রাখা আছে। কেবল এই বছরেই ধ্বংস হওয়া পালতোলা জাহাজ আর ইয়টের তালিকাটা এইরকম।

ভারত মহাসাগরঃ দ্য সাগা, দ্য শিপসিয়ার, দ্য ডেয়ার ডেভিল এবং দ্য কাটলফিশ।

প্রশান্ত মহাসাগরঃ দ্য জেমিনি, দ্য পার্ল, দ্য হিন্দু, দ্য ফুর এবং দ্য মেরিপোজ।

অতলান্তিক মহাসাগরঃ দ্য মোগল, দ্য আর্থার, দ্য ডেভি ক্ৰকেট, দ্য পিগি এবং দ্য অ্যাভেঞ্জার।

…সময়ের হাতে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া শয়ে শয়ে কিংবা হয়তো হাজারে হাজারে হলদে কাগজের স্তূপ, টেলিগ্রামের, মেফিস্টোর জীবনের যা কিছু জানা যায়, ওগুলোর মধ্যেই। কীভাবে ভাবনা, জ্ঞান আর কাজ একত্রিত হতে পারে। বরাত জোরে ছোট্ট জো সৈন্যদলের টেলিগ্রাফ অপারেটর ছিল। আর তারপরেই সমস্যাটা এসে আছড়ে পড়ল বা। ছারখার করে দিল; সারকোমা, ক্যান্সার। শিগগিরই ছেলেটা শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে যেতে লাগল, বিরাট খাঁচা, বড়ো বড়ো হাত আর পা, শুকিয়ে আসা এইটুকু ছোট্ট মাথা। ও বলেছিল মৃত্যুর চেয়ে এইই ভালো।

টেলিগ্রাফের ব্যাপারে মেফিস্টো দারুণ দক্ষ ছিল: এই যে এখানে, ওর প্রথম বার্তাটা, কাগজটা প্রায় ধুলো হয়ে গেছে। কতগুলো ড্যাশ আর ডট, ডট আর ড্যাশ, আর এমনিই পরপর, এই হিজিবিজিটার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়ঃ

‘…আমি খুব দুর্বল বাবা, নড়তেই পারছি না প্রায়। আমি এখনো তোমার দেয়া ওষুধের প্রভাবে আছি। আমি একটা গুহায় বসে আছি, আর সারারাত, কেউ একটা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে আগুনে জ্বলজ্বলে চোখে, তার চোখ এতটাই উজ্জ্বল যে একটা অদ্ভুত ভয়াল আকার বেরিয়ে আসছে। আমার ভয় করছে। মেফিস্টো।’ (ওটাই ওর ছদ্মনাম হবার কথা ছিল। ও নিজেই এটা পছন্দ করেছিল।)

পেন্সিলে একটা মন্তব্য লেখা ছিল ওতে, ‘অভিযোজন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’

কিছু মনে করিস না, খোকা, ভয়টা কিন্তু আমার ইদানীং জন্মেছিল। এই যে গোটা একটা লম্বা টেলিগ্রামের সারি, যার প্রত্যেকটার মধ্যে ভয় ঠাসা।

জুলাই ৬ ’…আমি কত ছোটো আর পলকা। ওই আগুনচোখো জন্তুটার কী করেছি আমি?’

জুলাই ৭ ‘…দেখা গেল জন্তুটা আয়নায় প্রতিফলিত একটা প্রতিবিম্ব মাত্র, নিজেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আয়নাটা এখানে রাখা হয়েছে। এই দেহটা আমার নিজস্ব নয়, সর্বক্ষণ সেটা মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকিয়ে রেখেছে। এই দেহটা আমায় নিংড়ে নিয়েছে। আমি এর মধ্যে নড়তে চড়তে পারি না। এর মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছি আমি, ঠেসেঠুসে এরই ভেতর, পুরোটা। আমার কাছে এটা একেবারেই অপরিচিত, এমনটা আর কখনো কোনো কিছুই হতে পারে না। এর ভেতর আমার গলা আটকে আসছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে…’

জুলাই ৮ ‘…বেশ ঠিক আছে, বাবা। দয়া করে ভেবো না, একদম ভেবো না। এটা আমারই সিদ্ধান্ত ছিল। আমি এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠব। আমার চারপাশে যে কী এক অন্য জগত! রাত্রে, সবটাই কালো আর জ্বলজ্বল করছে; আর দিনে পুরোটাই আলোয় আলো। আর বিরামহীন গতি।’

জুলাই ১০ ‘… মাছ, মাছ, মাছ। সব্বাই আমার পেছনে লেগেছে। আমায় খুঁজে খুঁজে বেড়ায়, অনুসরণ করে যাতে আমায় গিলে খেতে পারে। গপ করে খেয়ে নেবে। তাও এখানে থাকা আমার পক্ষে খুব শক্ত। আমি বড়ো দুর্বল আর থপথপে।’

জুলাই ২১ ‘…আজকে আমার জন্য একটা শুভদিন। মোটামুটি ভালোই লাগছে, প্রবালের ঝাড়ের মধ্যে আলোর খেলা অসাধারণ। একটু হাঁটতে যাচ্ছি।’

আগস্ট ১৮ ‘…আজ খুব বাঁচা বেঁচেছি। কোনোমতে পালিয়েছি। আমি এখনো ওই লোভী বিচ্ছিরি লুটেরাগুলোকে দেখতে পাচ্ছি, লম্বা ঝকঝকে দাঁতের সারি আমার দিকেই বাগানো, আর ওদের গোল গোল রাগী চোখ। আমায় ফিরিয়ে নাও। প্রচণ্ড ভয় লাগছে।’

আগস্ট ১৯ ‘… ফিরিয়ে নাও, বাবা।’

আগের সত্ত্বাটা মনে পড়ছিল ওঁর: বৈজ্ঞানিক সাফল্য ওঁকে খটখটে শুকনো করে তুলেছিল, আর উনি বস্তুনিষ্ঠ, যুক্তিবাদী আর নিজের বা অন্যান্যদের সঙ্গে ব্যবহারের সময় অত্যন্ত জেদি হয়ে উঠেছিলেন।

অতি সচেতনতা ওঁর হৃদয়টাকে শুকনো কাঠ কাঠ করে তুলেছিল, কেবল ওর জিজ্ঞাসু মনটাই পড়ে ছিল।

সেদিনটা ওঁর স্মৃতিতে দাগ কেটে বসে আছে। উনি পাথরের ওপরে বসেছিলেন, ঠিক যেখানে মোটা কেবলটা সমুদ্রে নামানো হয়েছে ঠিক সেই জায়গাটায়, ভাবছিলেন ওটাকে কীভাবে ঢেকে রাখা যায়। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে পাথরের ওপর জল বুড়বুড়ি কাটছিল, আর এসময় হঠাৎ করে উনি মেফিস্টোকে দেখতে পেয়েছিলেন। চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, “কোন সাহসে তুমি!”

মেফিস্টো গুটিগুটি ওঁর কাছে আসছিল, হাতগুলো বাড়িয়ে, ড্যাবড্যাব করে ওঁর দিকে চেয়ে, কালো ঠেলে আসা চোখদুটো সম্পূর্ণই দুশ্চিন্তায় বিভিন্ন দিকে ঘুরছিল। ওর মাথার চারপাশে কাটা দাগ বরাবর বড়ো বড়ো সেলাইয়ের দাগ।

লম্বা চ্যাটচেটে দেহটা যেটা জো-র আত্মা আর মগজ বহন করছে, সেটা ওঁর মধ্যে ভয় আর বিতৃষ্ণা ছাড়া কিছুই জাগাল না। উনি পিছিয়ে এসেছিলেন, সাবধানেই; একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন প্রায়… তখুনি ভেতর থেকে ওই বেগুনি রঙের রাক্ষসটার প্রতি একটা অসম্ভব রাগ উঠে এল।

আগস্ট ২০ ‘…আমার মনে হয়, আমি তোমায় বুঝতে পেরেছি বাবা, আর এটা আমায় ভীষণ দুঃখ দিয়েছে। আমি আগে কখনো তোমায় বুঝতে পারিনি, আর তোমার জন্য খুব গর্ব হত আমার। আমি তোমায় আর অনেকদিন বিরক্ত করব না, অনেক, অনেকদিন…’

তারপর সেই প্রথমবার অনেকদিনের নীরবতা।

সেপ্টেম্বর ২০ ‘…আমি অসুস্থ ছিলাম আর সপ্তাহ দু-এক কিছুই খেতে পারিনি। উপোস অবশ্য আমার জন্য ভালোই। আমার শক্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। আমি বাইরে একদমই যাই না। জলে আলোর খেলা দেখেই বুঝতে পারি রাত থেকে কখন দিন। হল। দিনের বেলা জলটা সবজেটে, যত সন্ধের দিকে এগোয়, রঙটা গাঢ় হয়, পরপর রঙের বদল হতে থাকে, গাঢ় সবুজ, নীল, লাল, শেষমেশ পুরোপুরি কালো।’

সেপ্টেম্বর ২১ ‘…হেনরি আমার জন্য একটা বড়ো, সুস্বাদু ট্রাউট সুতো বেঁধে নামিয়ে দিয়েছিল। আমি দেখতে পেয়েছিলাম ওর দয়ালু মুখটা জলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। আমি খুউব চাইছিলাম জলের ওপরে উঠে আসি। মাছটা নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গিয়েছিলাম আর পুরোটাই খেয়ে ফেলেছিলাম। কাঁচা খাবার খেতে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, কিন্তু তবুও আপনা থেকেই মনে এল, ‘এটা ভাজা নয় কেন?’ পেট ভরে গিয়েছিল তাই খাবার পর ঘুমোতে গেলাম (এখন আমি বেশ আরামে ঘুমোই, আর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই ঘুমোই, কিন্তু এই ঘুমটা অনেকটাই ঝিমুনি বা তন্দ্রার মতো।)। হঠাৎ করে জলের মধ্যে কিছু একটা সন্দেহজনক নড়াচড়া আমায় ছুঁয়ে দিল। দেখলাম, কয়েকটা ইল মাছ। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, পাখনাগুলো নড়ছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে পালাব ভাবলাম, কিন্তু নিজেকে সংযত করলাম। ইলগুলো বেশ। মোটাসোটা, হিলহিলে, আর কুকুরের মতো বড়ো বড়ো দাঁত। তার ওপর সাংঘাতিক বিশ্রী গন্ধ। সারারাত ধরে আমি ওদের স্বপ্নে দেখলাম।’

সেপ্টেম্বর ২২ ‘…আমার আর কোনো পার্থিব স্বপ্ন নেই। মনে হয় আমার মগজ এই ক’ দিন অজানা জগতে মানিয়ে নিতে নিতে একেবারে নিঃশেষিত হয়ে গেছে, আর এখন কেবলমাত্র স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিনির্ভর হয়ে কাজ করতে পারছে। আমি তোমায় ভালোবাসি, মনে রেখো।’

তাহলে মানুষটির ভেতরে ও কী দেখেছিল? কেবলমাত্র বাবা নয়, ওর নিজের গর্ব করার মতো কেউ, ‘বাবা, যদি সবকিছু ঠিকঠাক হয়, আমি সমুদ্রে তোমার চোখ হয়ে উঠব।’ নিজেকে বোঝাতে ও এটাই বলত বারবার, স্রেফ মরে যাওয়ার থেকে এমন জীবন কাটানো ঢের বেশি ভালো।

অস্ত্রোপচার ঠিকঠাক সাফল্য পাবেই এমন কোনো লক্ষণ ছিল নাঃ তখন আমার জানার কোনো উপায়ই ছিল না যে সমুদ্রের জল বা সামুদ্রিক খাদ্য দেহের মধ্যে প্রতিস্থাপিত কোষকে প্রত্যাখ্যান থেকে ঠেকাতে পারে।

সেপ্টেম্বর ২৫ ‘…আমি জানি তুমি মাকে ঘৃণা করতে। ওর মেয়েলি চাহিদা আর তোমার জ্ঞানপিপাসার মধ্যে বিবাদ লেগেই ছিল। আমি বিমর্ষ ছিলাম, তাই মায়ের কথা মনে করতাম, একটু ভালোলাগার জন্য। নিজেকে ছোট্ট ছেলে বলে ভেবে নিতাম, ভাবতাম হাফপ্যান্ট পড়ে চাকা নিয়ে খেলছি, সঙ্গে একটা কুকুর। খুব শক্ত ছিল এই ব্যাপারটা কারণ ছোটোখাটো এক-একটা জেলিফিশ চুপিসারে আমার কাছে চলে আসত। (আমাদের এলাকার জলে এদের অস্তিত্ব তুমি উপেক্ষা করেছিলে।)। সাংঘাতিকভাবে আমায় হুল ফুটিয়ে দিত ওরা। শেষমেশ আমি মায়ের মুখটা দেখতে পেতাম, ভেসে ভেসে। যাচ্ছে, কিন্তু মুখটার রঙ সবুজ।’

সেপ্টেম্বর ৩০ ‘…মাছেদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ আবিষ্কার করেছি। গতকাল কতগুলো সি-অ্যানিমোন দেখতে পেয়েছি যেগুলো আমাদের বাগানের বেগুনি-গোলাপি কারনেশন ফুলের মতো। আমি ওদের আমার গুহার কাছে পাথরের ওপর রেখে দিয়েছি আর সবচেয়ে বড়ো দু-খানা হাতে করে নিয়ে এসেছি। আজ সকালে ইল মাছগুলো আবার এসেছিল, আর আমি ওদের চোখে সি-অ্যানিমোনগুলো ঠেসে ধরেছিলাম। ওরা অমনি গুটিয়ে গিয়ে পালিয়ে গেল। জীবন, যা হোক, সহনীয় হয়ে উঠছে।’

এপ্রিল ১১ ‘…আমার একটা পর্যবেক্ষণঃ এখানে সব্বাই সবাইকে খায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীদের খায় তাদের চেয়ে যেগুলো বড়ো, তারা –যেমন ছোট্ট কাঁকড়া বা ছোটো ছোটো মাছ, এগুলোকে আবার খায় বড়ো প্রাণীরা। শেষে এদের খায় আরো বড়ো, বিশাল প্রাণীরা। বড়ো হাঁ আর ধারালো দাঁত থাকলেই খাবার জুটবে।’

এপ্রিল ১৮ ‘আমি একটা তিমি-হাঙর দেখেছিলাম, যে ছোটো ছোটো কাঁকড়া আর প্ল্যাঙ্কটন খায়। একেবারে মুখোমুখি দেখা হয়েছিল, কিন্তু আমি ভয় পাইনি। ছোটো মুখের বিরাট প্রাণী এখানে তত পাত্তা-টাত্তা পায় না।’

বেচারা ছেলেটা! ও এখনও মজা করতে পারছে। আমি প্রতিদিন ওর শিকারের ব্যবস্থা করতাম। ও যা কিছু ধরত, একটা বয়ার সঙ্গে আটকানো তারের থলেতে এনে জমা করত।

এপ্রিল ২৯ ‘আমায় কিছু রঙের তালিকা পাঠাবে, প্লিজ। নইলে সমুদ্রের গভীরে থাকা ছোটো ছোটো জীবন্ত প্রাণীগুলোর বর্ণনা দিতে ভুল করে ফেলতে পারি। আজ দুপুরে কেউ একজন একটা ম্যাকারেল সুতোয় ঝুলিয়ে নামিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য, ভেবে পুরোটা গিলে নিয়েছিলাম। ঠিক সেই সময় কেউ একটা টান মারল আর একটা বড়ো বঁড়শি আমার মুখে আটকে গেল। আমি ধরা পড়েছিলাম। ব্যথা লাগছিল। যতটা শক্তি দিয়ে পারি আমি লড়াই করছিলাম, আশেপাশে যা কিছু পাই তাইই আঁকড়ে ধরে, কিন্তু নাহ, আমায় জল থেকে টেনে তুলে ফেলা হল। শেষমেশ আমি বুঝতে পারলাম, আমায় ঠিক কী করতে হবে। আমি মাছধরা সুতোটাকে পাথরের চারপাশে জড়িয়ে দিলাম আর হুকটাকে আমারই শরীরের একটুকরো মাংস-সহ ছাড়িয়ে নিলাম। সেই ক্ষত থেকে তখনও রক্ত ঝরে পড়ছিল। প্রথম যখন সেটা লক্ষ করি, বেশ একটা অস্বাভাবিক লেগেয়েছিল। আমি নিজেকেই খেয়ে ফেলতে চাইছিলাম। এর জন্য জেলেগুলোই দায়ী। আমি এর শোধ তুলব। মেফিস্টো।’

মে ৩০ ‘…সারাটা দিন গুহার মধ্যে শুয়ে রইলাম, শুয়ে শুয়ে নিজের জীবনের কথাই ভাবছিলাম। শেষ অবধি সিদ্ধান্তে এলাম এই যে আমাকে আরও শক্তিশালী আর ধূর্ত হতে হবে। সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে ধূর্তরাই যত চায় তত ভালো খাবার খেতে পারে আর আরামদায়ক গুহায় ঘুমোতে পারে। আমাকেও অমনি হতে হবে। এখানে খেলার যা নিয়মকানুন তাইই আমায় মানতে হবে।’

জুলাই ১ ’…একটা স্কর্পিনা ধরেছি, তোমার কথামতো, কিন্তু ওটা আমাকে হুল ফুটিয়ে প্রায় মেরেই ফেলছিল। আমার জন্য একটুও দুঃখ হয় না তোমার, বাবা? কিংবা হয়তো আমায় ঝেড়ে ফেলতে চাও… বলো তো, অস্ত্রোপচারের সময় আমার পুরোনো শরীরটা কি আমার পাশেই শোয়ানো ছিল? ওটা নিয়ে কী করলে তুমি? কখনো কখনো আমার মনে হয় ওটা কাছেপিঠেই কোথাও আছে আর একদিন দেখতেও পাব ওটাকে।’

জুলাই ৭ ‘আজ, অসহ্য সব দৃশ্য মাথার ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছিল। শব্দেরা ভোঁ ভোঁ করছিল ভেতরে। সেসব শব্দ আর কোনোদিন উচ্চারণ করতে পারব না আমি।’

জুলাই ১৭ ‘গতকাল আমায় প্রায় খেয়ে ফেলেছিল। আমি সাংঘাতিক ভয়ে কোনোমতে পালিয়ে আসি, পাথরের আড়ালে। কিছু একটা আমার মাথার ওপরে একঝলক দেখা গেল, চোয়াল হাঁ করা। ঠিক হাঙর নয়, তবে ওরকমই কিছু, এ-জিনিস তুমি কখনোই দেখতে পাবে না। অক্টোপাসের জন্য একটা কন্টেনার বরাত দাও। হাঃ হাঃ!’

জুলাই ১৮ ‘…আমি খুব একলা, বাবা। আমাকে ফিরিয়ে নাও আর সমুদ্রের জলভর্তি কোনো জালার মধ্যে রাখো, ওপরে, তোমার কাছে কাছে। শোচনীয় অবস্থা আমার, ভালো নেই মোটেই।’

‘…কী শক্তিশালী আমি। আজই কাকভোরে, সাঁতার কাটছিলাম, বেশ জোরেই। জল কেটে কেটে একেবারে ওপরে উঠে আসছিলাম, আরও আরও দ্রুত। ম্যাকারেলগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠল এক ঝাঁক, একটা রুপোলী রিবনের মতো। আমি জল থেকে ছিটকে ওপরে উঠলাম, তোমাদের দমবন্ধ করা পৃথিবীতে, তারপর আবার সমুদ্রে এসে পড়লাম।

‘জলের ছিটেয় আমার সারা দেহ ধুয়ে গেল। আমি যারপরনাই খুশি হলাম, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ টিকল না। আমি আমার গুহায় ফিরে সমস্ত কিছু নিয়েই ভাবতে বসলাম, আর আবার আমার খারাপ লাগতে থাকল…

‘একটা ম্যাকারেল ধরে খেয়ে নিলাম। ভালোই খেতে, কিন্তু কাঁকড়া এর চেয়েও ভালো। কেবল ঝিনুক কাঁকড়ার চেয়েও সুস্বাদু। আমি এইভাবে ওগুলো শিকার করতে যাইঃ একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে চুপিসাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঝিনুকটার কাছে পৌঁছাই আর ওর খোলার ঢাকনাদুটো খুললেই তার মাঝখানে রেখে দিই। তারপর চারপাশে নজর রাখতে রাখতে একটু একটু করে ওর মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাই।’

কে জানত পনেরো বছর পর খবরের কাগজের সাংবাদিকরা ওকে দানব স্কুইড বলে ডাকবে? সাংবাদিকদের তখন আমি সত্যি সত্যি ভয় পেতাম, কিন্তু এখন আমার ওদের জন্য অবজ্ঞা আর ঘৃণা ছাড়া কিছুই নেই।

“…আজকে আমি এক কিলোমিটার গভীর অবধি গিয়েছিলাম। বেশ কষ্টকর আর আতঙ্কের। এখানে এত ঘন অন্ধকার, যে তুমি কল্পনাতেও আনতে পারবে না। কিন্তু এই অন্ধকার হাজার হাজার আলোয় উদ্ভাসিত, আমাকে রাতের শহরের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি দেখতে পেলাম একটা স্পার্ম হোয়েল, সেই গভীর থেকে উঠে আসছে। একটা বিশাল স্কুইড ওটাকে কামড়ে দিল। স্কুইডটা, নাক-বোঁচা তিমিটার মুখের চারপাশে ঝিলমিল করছিল উজ্জ্বল বলয়ের মতো। উজ্জ্বল আর বুড়বুড়ি কাটা কিছু একটা এই ভয়ংকর অথচ সুন্দর জোড়ার চারপাশ ঘিরে, বা বলা চলে একেবারে সারা গায়ে লেপা ছিল। এই জিনিসটা অন্ধকারে ওদের দেহরেখাটা ঠিকঠাক বুঝতে সাহায্য করছিল। আমি আশা করছিলাম স্কুইডটা জিতবে।

‘আমি একেবারে সমুদ্রের তলায় গিয়ে বেশ অনেকটা সময় সেখানে কাটালাম। ওখানে চারপাশে কয়েকটা তারামাছ আর কয়েক জোড়া সমুদ্র-শশা ছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম, শেষে একটা চ্যাপটা আঁশওয়ালা গিরগিটি দেখতে পেলাম হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, আর অতিকষ্টে মাথাটা আস্তে আস্তে ঘোরাচ্ছে। সম্পূর্ণ অন্ধকার সত্ত্বেও আমি ওর ধীর নড়াচড়াটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, এবং লক্ষ করলাম কীভাবে ও গভীর সামুদ্রিক উদ্ভিদ খুঁটে তুলছে আর একেবারে কোনো তাড়াহুড়ো না করে চিবোচ্ছে। ওটার মাথার ওপরে লাল রঙের চোখ। বুঝতে পারলাম, আমি দেখতে পাচ্ছি কারণ আমার অবলোহিত দৃষ্টিশক্তি। গিরগিটিটা আমাকে লক্ষ করেনি, যদিও ওটা আমার খুব কাছ দিয়েই গিয়েছিল। বারটনকে বোললা, আভাস দিও, ওর গভীর সমুদ্রের ছবিগুলো জীবনের সত্যের খুব কাছাকাছি।’ (আমি বলেছিলাম, কিন্তু বারটন আমার কথা বিশ্বাস করেনি। পরে ওর ইয়টটা, যেটার ওপর আমার খুব লোভ ছিল –কোনো চিহ্নমাত্র না রেখে সমুদ্রে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।)।

‘…সাদাটে পাখনার ডলফিন ধরলাম। ওটা আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নানারকম শব্দ করতে লাগল। ঝাঁকের বাকিরা লুকিয়ে পড়ল। আমি এটাও খেয়াল করলাম, প্রথমদিকে ওর বিপদসংকেতটা অন্যরকম ছিল। পুরো ঝাঁকটা ওর দিকেই সাঁতরে আসছিল কিন্তু তারপর যেই আমি আমার হাত-পাগুলো পুরো টানটান করে দিলাম, ও অন্য স্বরে। আওয়াজ করতে লাগল, আর ঝাঁকটা ফিরে গেল। ও ওদের সতর্ক করে দিয়েছিল। ডলফিনরা কথা বলতে পারে কি পারে না সেটা প্রতিষ্ঠা করা না করায় আমার কিছু যায় আসে না, আমি ওর খুলিটা ফাটিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। খেয়েদেয়ে পেট ভরে গেলে আমি গুহায় ফিরে গেলাম আর অনেকক্ষণ ডলফিনের জীবন নিয়ে ভাবতে থাকলাম। ওরা অনেক উন্নতি করবে। ওরা বুদ্ধিমান, নিজেদের একটা ভাষা আছে, সামাজিক বিন্যাস আছে। মনে হয় ডলফিনরাই আগামী দিনের সমুদ্রের শাসনকর্তা।’

‘…না, শক্তিমানেরা সমুদ্র শাসন করে, আর ডলফিনরা দুর্বল। সমুদ্র শাসন করে ক্রাকেনরা*। আমি মাঝেমধ্যে এক-একখানা দেখতে পাই, আর ভীষণ ভয়ে থাকি। যত জোরে পারি দুদ্দাড় করে ছুটে পালাই আর শেষকালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুহার মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকি।

‘…মাঝে মাঝে মানুষজন দেখতে পাই। ওরা প্রায় স্থিরই থাকে। কেবল জলের ঢেউয়ে মাথার চুল অল্পস্বল্প নড়তে থাকে। ধীরে ধীরে গভীরে নেমে আসে ওরা, তোমার সঙ্গে এত মিল, বাবা, যে আমায় ভয় পাইয়ে দেয় আর অমনি আমি পালিয়ে যাই। বুঝতে পারি আমি ওদের মতো ওরকম স্থির হয়ে যেতে ভয় পাই। কিন্তু ওদের দেখে কৌতূহলও হয়, আমার লুকিয়ে থাকার জায়গা থেকে ওদের লক্ষ করি। ওরা অদ্ভুতরকম স্থির হয়ে সাঁতার কাটতে থাকে। কিন্তু আমার মনে হয় ওরা আমায় তাড়া করে ধরে ফেলবে। কিছু

একটা বেদনাদায়ক ব্যাপার-স্যাপার করবে আমার ওপর, আর আমি ব্যথা পছন্দ করি না।

‘আমি কী পছন্দ করি? আমি অনেক অনেক খেতে ভালোবাসি। আমি অন্য প্রাণীদের ধরে মেরে ফেলতে ভালোবাসি।’

‘আমি কী পছন্দ করি না? যখন অন্য কেউ আমাকে খেতে চায়। আমি মানুষদের পছন্দ করি না, পাথরের মধ্যে দিয়ে ছিটকে ওঠা জল পছন্দ করি না। বিমূর্ত জ্ঞান যা আমায় একসময় আকর্ষণ করত তার বদলে মাথায় এখন ভাবনা কীভাবে আত্মরক্ষা করব। আর পেট ভরাব।

‘… অদ্ভুত ধরনের কিছু মাছ দেখলাম –কালো, বিরাট মাথা, ছোটো ছোটো করাতের মতো দাঁত বেরিয়ে আছে মুখ থেকে। মাছগুলো একঝাঁপটায় চলে গেল, ঘন। নীল। আমি কয়েকটা ধরলাম। আমার সমগ্র সত্ত্বা চিৎকার করে উঠল, খেও না ওদের, খেও না। কিন্তু আমার মগজ বলল, যে না খাওয়া অবধি আমি বুঝতে পারব না আমার প্রবৃত্তি ঠিক ছিল, নাকি ভুল।

‘আমি আটটা মাছ ধরেছিলাম। আমি তোমায় ছ’টা দিয়েছি আর বাকি দুটো গিলে খেয়েছি। আর এখন আমি ওদের খেয়ে ফেলে সত্যিই পস্তাচ্ছি। ভেতরটা জ্বলছে। খুব শিগগির আমি মারা যাব, আর স্থির হয়ে পড়ে থাকব। বাঁচাও আমায়, বাবা!

(তারপর কতগুলো বোদা, বিষণ্ণ, যন্ত্রণার শব্দ লেখা)

‘…বেঁচে উঠেছি। তুমি কোনোভাবেই কোনোদিন আমায় সাহায্য করোনি। আমাকে কেবল নিজের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। আমি বাদে সবাইই আমার শত্রু। সারা দিনরাত গুহায় বসে বসে ক্ষমতার কথা ভাবি। কী দিয়ে তৈরি সেটা? শক্তি, দাঁত অথবা পাখনা? আমি একটা কাঁকড়া, একটা মাছ বা একটা অক্টোপাসের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। আমার মগজটা মানুষের আর সেটা শক্তিধর।

‘ভেবে দেখেছি, তোমায় বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই, বাবা।’

‘আজ, আমি একটা বিশাল ক্রাকেন দেখেছি। ওটা খুব ধীরে ধীরে সাঁতার দিচ্ছিল আর সীমাহীন তার বিস্তার। কী চকচকে তার চোখ, কী বিরাট নখ, কী লম্বা আর মোটা ওর হাত! ও ছিল দৈত্যাকৃতি অপরূপ। ওরকম প্রকাণ্ড হয়ে ওঠা যে কতটা বিস্ময়কর।

‘…আমি একেবারে তলদেশ অবধি ডুব দিয়েছি, কারণ তুমি বলেছিলে যেতে। আমি ধীরে ধীরে অনেকটা নীচে নেমেছি, কিলোমিটারের পর কিলোমিটার, আমার হাত-পা আর সাইফনকে কাজে লাগিয়ে। শলা-চিংড়িগুলো আমার দিকে অনুপ্রভ রস ছুঁড়ে দিয়েছে।

‘নীচে, আরও নীচে নেমে গিয়েছি আমি, একেবারে তলদেশে পৌঁছব বলে। চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। চোখের সামনে ফুলঝুরি দেখছিলাম। নিঃশ্বাস নেওয়া ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছিল। আমার হাত দুর্বল হয়ে উঠছিল, প্রচণ্ড চাপে আমার শরীরটা যেন গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল। এক-একসময় মনে হচ্ছিল বিরাট একটা দাঁত-ছাড়া মাছ যেন আমায় চিবিয়ে চলেছে।

‘আমার সারাটা শরীর আর্তনাদ করে উঠছিল, ‘ফিরে চলো! তুমি এরপর শেষ হয়ে যাবে!’ কিন্তু আমার মন বলছিল আর কিছুক্ষণ সহ্য করো, আর একটু, হয়তো এমন নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলব আমি যেটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। শেষ অবধি আমি সমুদ্রের নীচে পৌঁছলাম। এটা একেবারে নিথর নিঝুম প্রাণহীন জায়গা। কেবল কিছু জিনিস, অনেকটা বড়ো চাদরের মতো, অল্প অল্প নড়ছে। প্রাণীটা চ্যাপটা, কালো আর গায়ে আবছা সবুজ আলোর ছিটছিট।

‘বিষাক্ত তীক্ষ্ণ শক্তির একটা অনুভূতি এই চাদরের মতো জিনিসটা থেকে বয়ে আসছিল।

‘ওটার পাশেই অদ্ভুত একটা ন-মুখো তারা। আমি ওটা পাকড়ে নিয়ে জলের ওপরে উঠতে শুরু করলাম। কালো রঙের প্রাণীটা আমায় তাড়া করল, যেন উড়ে এল।

‘আমি প্রাণপণে উপরের দিকে চললাম আর শিগগিরই জলের উপরে উঠে এলাম। দেহে আর শক্তি ছিল না, ওখানেই পড়ে রইলাম, আমার ওপর দিয়ে একের পর এক ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। না, আমায় কিছুই আক্রমণ করেনি।

‘খানিকটা বিশ্রাম নেবার পর আমি তোমার কাছে সাঁতরে এসেছিলাম। এবারে আমার প্রশ্নঃ এইরকম কিছু অখাদ্য জঞ্জালের জন্য আমার জীবন বিপন্ন করা কতটা যুক্তিযুক্ত?’

‘…আজ, আমার মাথায় যে চিন্তাটা এল সেটা জলের গভীরের স্রোতের মতোই শীতল। আমি সেসব বিষয়ে নীরব রইলাম। নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে গিয়ে এমন বিভোর ছিলাম যে গুহার মুখটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম, ফলে তিনটে ইল মাছ সাঁতরে ভেতরে চলে এসেছিল। আমি ওদের মাথাগুলো খুঁড়িয়ে দিয়ে খেয়ে ফেলেছিলাম।’

দু-বছর পরঃ ‘…আমি একটা নতুন গুহা খুঁজছি। আমি যেখানে খুশি সেখানেই ঘুমোতে পারি কেননা এই অঞ্চলে চারপাশের যত প্রাণী সবাই আমায় ভয় পায়। কিন্তু তবুও কেন শুধু শুধু ঝুঁকিটা নেব? সবসময় কোনো না কোনো উজবুক থাকেই যাদের মুখটা মগজের চেয়ে বড়ো। গুহার ভেতরটা আরামদায়ক আর নিরাপদ। আমি প্রায়। সবকিছুই খাই এবং বেশিরভাগ সময় খাবার কথা ভেবেই কাটাই। তোমার প্রয়োজনীয় মাছটা আমি আসার পথে খেয়ে ফেলেছি। আরও কিছু মাছ না ধরা অবধি তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু বলতেই হবে, ওগুলো খেতে খুব একটা ভালো ছিল না। ভালো কথা, তুমি কখনো সাঁতার কাটতে যাওনি কেন? আমি কত লোককে সমুদ্রতীরে দেখেছি স্নান করতে, কিন্তু তোমায় দেখিনি কখনো।’

‘…আজকে একটা ভালো গুহা খুঁজে পেয়েছি। একদল অক্টোপাস থাকত ওটাতে। ওরা জায়গা ছেড়ে দিতে খুব একটা রাজি ছিল না। মাথাটা জলে ফুলিয়ে টসটসে করে আমার দিকে চেয়েছিল ওরা। আমি একটা কড ধরে ওদের দেখালাম। এইভাবে ক্রমে লোভ দেখিয়ে চালাকি করে ওদের বাইরে এনে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললাম।

‘…একটা কাজের মতো পাথর খুঁজে পেয়েছি, ওটাকে নিয়ে এসেছি, গুহার দরজা। হিসেবে ব্যবহার করব। তুমি মোটা মাথার কচ্ছপ নিয়ে আগ্রহী ছিলে। তাই বলছি। ওরা মোটেই খেতে খুব একটা ভালো নয়, কিন্তু যদি খেতেই হয় তো খেতে পারো। আজ, কয়েকটা বোকা লোক আমার জন্য কিছু জ্যান্ত টোপ নামিয়ে দিয়েছিল। একটা বঁড়শিতে ছিল দুটো ছোটো মাছ –একটা টুনা, আরেকটা বাচ্চা উড়ুক্কু মাছ। রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি, সাঁতরে ওপরে উঠে এলাম, নৌকোটার একটা দিক ধরে উলটে দিলাম। এখন দুর্ভাগা জেলেটা আমার পাশেই চুপচাপ ভাসছে। আমি ওর ওপর একটা পাথর রেখে দিলাম যাতে ঢেউয়ে ভেসে চলে না যায়। এখন আমি ওকে নিয়ে করবটা কী? খেয়ে ফেলব?’

‘…কোন সাহসে তুমি আমায় আদেশ করো! আমি ওকে খেয়েছি প্রতিশোধ নিতে যদিও ও খুবই শক্ত আর মোটেই ভালো খেতে ছিল না। গলায় আটকে গিয়েছিল প্রায়, কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ, শেষ অবধি আমি একটা উপায় বার করে নিই ঠিকই। তুমি বরং একটা ডাইভিং মুখোশ পরে এখানে এসে একবার দেখে যাও আমাকে। আমি অপেক্ষা করছি। মেফিস্টো।’

আরও তিন বছর কেটে গেলঃ

‘…আমি প্রকাণ্ড আর ক্ষমাহীন। তার ওপর এখানকার সবার চেয়ে আমি অনেক বেশি চালাক। তুমি ভাবতেই পারবে না এখানে চারপাশে কী বোকাদের দল! একটা উদাহরণ দিইঃ চারটে বিশাল স্কুইড একটা স্পার্ম তিমিকে আক্রমণ করল। প্রথমটা ওর মাথাটা পেঁচিয়ে ধরল, আর বাকি তিনটে তিমিটাকে মারার আগেই ওটাকে নিয়েই নিজেদের মধ্যে মারপিট করতে থাকল। তিমিটা জল ছেড়ে লাফিয়ে উঠে প্রথম আক্রমণকারীটাকে আগে খেয়ে ফেলল, তারপর বাকি যে তিনটে লড়াই করছিল সেদিকে নজর দিল। ওদের মধ্যে একটা আবার তিমিটাকে আক্রমণ করল, বাকি দুটো নিজেদের মধ্যে মারপিট জারি রাখল। ওদের গুঁড়ের টুকরো-টাকরা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছিল, বোকার হদ্দগুলো! ভয়। পেয়ো না –আমি মানুষ খাই না। আমি ডলফিন আর বাচ্চা স্পার্ম তিমি খাই।’

‘…তুমি আমার সঙ্গে একটা চুক্তি করতে চেয়েছঃ আমি নতুন প্রজাতির মাছ ধরে দেব তোমার জন্য আর তুমি আমায় খাওয়াবে। ভুলে যাও! আমি কারো বশংবদ নই। এখন আমাকে তোমার প্রয়োজন। কিন্তু ভবিষ্যতে কী ঘটবে কে বলতে পারে? তুমি আমায় ঈর্ষা করো, আমার বুদ্ধি আর শক্তিকেও, আমাকে বিষ দিতে চাও তুমি। আমি তোমাকে বা অন্য কাউকেই আর বিশ্বাস করি না। আমি একা, একাকী। একাকিত্বই শক্তি।

‘…গতকাল আমার প্রথম পূর্ণবয়স্ক স্পার্ম তিমি মেরেছি আমি। আমি একটা বিরাট স্কুইডের অপেক্ষায় ছিলাম ওই মাংসের পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে ধরার জন্য, তারপর চুপিসাড়ে গিয়ে আমি ওটার খুলিটা ফাটিয়ে দিলাম। বিরাট স্কুইডটা এরপর আমায়। আক্রমণ করল, ফলে ওটাকেও মারতে হল।

‘…এই জলভূমিতে আমি সবচেয়ে বড়ো আর শক্তিশালী প্রাণী। কাউকে ভয় করি না আমি। এবারে আমি আমার শক্তি পরীক্ষা করব আরও কোনো চ্যালেঞ্জিং প্রতিপক্ষের সঙ্গে –মানুষ। গতকাল একটা ইয়ট দেখতে পেয়েছি। ঠিকঠাক হিসেব করে নিয়ে, ওটার ডানদিক দিয়ে গিয়ে ধরেছি, ধরে আমার সবখানি শক্তি দিয়ে টেনে ওটাকে উলটে দিয়েছি। তারপর একেবারে সমুদ্রের তলায় শুয়ে শুয়ে লক্ষ করলাম হাঙরেরা নাবিকগুলোর দ্রুত গতি করে দিল। কুড়িজনমতো তড়িঘড়ি সাতাঁর কেটে উঠে এসেছিল, তাদের লম্বা ছায়া নিয়ে, আমি জলের তলায় ডুবোপাহাড়ের ওপর শুয়ে দেখছিলাম কী ঘটছে। আমি বিশাল, অবিশ্বাস্যরকম অসাধারণ এবং চরম নিষ্ঠুর। পরেরবার একটা। বড়ো জাহাজকে উলটে দেবার চেষ্টা করব।’

‘…একই কাজ করেছি জাহাজটার সঙ্গে। এটার নাম সেইন্ট অ্যান। আমি জানি আরও বহু বহু বছর ধরে আমি বাড়তেই থাকব। এখন আমি জানি, আমি নিজেই একটা ক্রাকেন। আমি ক্রমশ শক্তিশালী হব। ইতিমধ্যেই আমি বুদ্ধিমান। মহাসমুদ্রের গভীরে আমিই ভয়ের কারণ। আমার বিস্তীর্ণ বিশাল ঠান্ডা সাম্রাজ্য আমিই শাসন করব। আমি চিরকাল বেঁচে থাকব আর ত্রাসের সঞ্চার করব। যে আমার বশ্যতা স্বীকার করবে তার প্রতি নির্লিপ্ত থাকব আর শত্রুদের জন্যে থাকব ক্ষমাহীন। সব্বার মনের মধ্যে প্রবল ভয় ঢুকিয়ে দেব, মহাসমুদ্র আমিই শাসন করব আমার উন্নত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, আমার শারীরিক শক্তি দিয়ে আর আমার আদিম ধূর্ততা দিয়ে খেয়ে ফেলা ভালো, কিন্তু অন্যের মনের ভেতর ত্রাসের সঞ্চার করে দেওয়া আরও ভালো।’

‘একটা অক্টোপাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল –বিশাল আকারের, প্রায় দুই টন ওজন হবে। আমাকে দেখেই ব্যাটা ফ্যাকাসে মেরে গেল আর ভান করল যে মরে গেছে। ছেড়ে দিলাম ওকে। যাই হোক, ওদের তো বশবর্তী হওয়া শেখাতে হবে! আমি জেলেদের একটা নৌকোর দিকে সাঁতরে গেলাম। আমায় দেখে ওদের মুখ রক্তশূন্য, ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠল, আমি দয়া করে ওদের ছেড়ে দিলাম।’

‘…আজ একটা ক্রাকেন দেখেছি, সীমাহীন তার দৈর্ঘ্য আর শক্তি। তবে ওটা নির্ঘাত একটা বোকা প্রাণী ছিল। বললাম, ‘ছিল’, কারণ বুরবকটা আর নেই। আমি ওর মাথাটা

দু-টুকরো করে দিয়েছি। এখন আমি ওর জায়গায়, সর্বোচ্চ অবস্থানে বসে আছি আর আরও বড়ো হয়ে উঠছি, আরও বড়ো।’

‘…আমি নিজেই এক বিভীষিকা, সমুদ্রের আতঙ্ক। জলের ওপরে উঠে এলে গোটা সমুদ্র তটস্থ হয়ে ওঠে। জীবন্ত যা কিছু তক্ষুনি লুকিয়ে পড়ে। এমনকি তোমরাও, মানুষেরা, আমার শক্তির কাছে মাথা নামিয়ে নিয়েছ।’

‘…আমি আমার নিজের রাজত্বে ফিরে যাচ্ছি, নিঃসঙ্গ এবং সম্পূর্ণ শব্দহীন। বিদায় দু-পেয়ে তুচ্ছ মানুষ, কখনো তুমি আমার বাবা ছিলে। মেফিস্টো।’

…সোনার রঙ ছড়িয়ে সূর্য অস্ত গেল। উপসাগরের জলে প্ল্যাঙ্কটন ভর্তি থাকায় অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে। কালো জলের গভীরতায় ওপর থেকে নামানো কেবলের। তারের গা হালকা প্রতিভা ছড়িয়ে রেখেছে। এই তারটা গভীর জলের কত না রহস্য প্রকাশ করেছে –বোধ হয় প্রায় সবটাই কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটা হল –মেফিস্টো নিজেই।

সম্ভবত ও এখন প্রকাণ্ড চেহারার। কারো কোনো ধারণাই নেই, এই বয়েসে একটা দানব স্কুইড কত বড়ো হতে পারে।

এরকমটা বলা যেতে পারে, মেফিস্টো ছিল সাগরের গভীরে ছেড়ে দেওয়া তার বাবার অহমিকা। না, বরং সে ছিল বিজ্ঞানের অহমিকা।

সেই সাগরের মধ্যে তার লোভাতুর চোখ ছিল মেফিস্টো, তার খুঁজে বেড়ানো হাত সাগরের গভীরের দূরবর্তী যত আনাচ-কানাচে পৌঁছে যেত। তারপর আসবে নম্র ভদ্র জো-এর কথা, মৃত্যু যাকে দু-ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল–একই সঙ্গে বাগানের এককোণে ছোট্ট কবরের নীচে শুয়ে আবার এই প্রকাণ্ড স্কুইডটার দেহের মধ্যেও থাকা।

“দানব স্কুইড, আর আমি তার বাবা। অদ্ভুত পাগলের প্রলাপ। এর মানে তো একটা রকেট, একটা গাড়ি, একটা জাহাজ বা একটা বিদ্যুৎচমককে ছেলে হিসেবে দেখার মতো।”

“কফি, হেনরি!”

আহ এই যে কফি, গরম এবং সুগন্ধি। কফি! সুখের সুঘ্রাণ আর তার সঙ্গে দুঃখের কামড়, ফুলের সুগন্ধের সঙ্গে শুকনো পাতার তিতকুটে স্বাদ।

“আমি বেরিয়ে পড়েছি, মেফিস্টো।”

…কী যে স্যাঁতসেতে রাস্তা, ভেজা পাতাগুলো এসে গালে এসে লাগছে, ঠান্ডা ভেজা হাতের মতো। সমুদ্রের গভীরে জল শুষে নেওয়া শুড়ের মতো আমায় স্পর্শ করছে। যেন একেবারে তলাকার বালিতে চুপচাপ শুয়ে, নরম সোনালি বালিতে। আর একটা রেলিং দেওয়া সিঁড়ি, যারা রাস্তাগুলো ভালোভাবে চেনে তাদের কাছে অবশ্য রেলিংটা বাহুল্য।

চাঁদের আলোয় চারদিক উদ্ভাসিত। আমি কি কল্পনা করেছিলাম মেফিস্টো একটা দানব হয়ে উঠবে?

স্যর রাদারফোর্ড কি কখনো গোড়াতে হাইড্রোজেন বোমার কথা ভাবতে পেরেছিলেন?

…কালো জলটা নড়ে উঠল। চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল তাতে। একটা তেলতেলে চকচকে ভাব ভেসে উঠল জলের ওপর। সমুদ্রে এখনো অগণিত রহস্য– এতরকম যে সমস্ত আবিষ্কার করে ফেলাটা অসম্ভব ছিল।

আর ওই সমস্ত রহস্যই এসেছে আশা আর আতঙ্ক বহন করে। ওঁর হাত কাঁপছিল, বুকটা ধকধক করছিল। চারপাশের সবকিছুই কাঁপছিল। বিদায় হেনরি। কফিটা চমৎকার ছিল।

বিদায়, আমার সম্পদ এবং ওরই উপহার দেওয়া অপরিমিত স্বাধীনতা। সমস্ত কিছুর জন্য তোমায় ধন্যবাদ পিতা! তুমি খুব দয়ালু আর ভালো ব্যবসায়ী।

“মেফিস্টো, আমি অপেক্ষা করছি!”

শব্দটা জলের ওপরটা ভেদ করে এক মুহূর্ত প্রতিফলিত হল, তারপর সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে গেল। সমুদ্রটা শান্ত। কাঁধ ঝুঁকে আসা বুড়ো মানুষটা জলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। উনি ভাবতে শুরু করেছিলেন কিছুই ঘটবে না, কিছুই নেই কোখাও। খুব চিন্তায় তাঁর হাই উঠতে শুরু করেছিল আর নিশ্চিত হয়ে পড়ছিলেন যে পরদিনটা নিশ্চয়ই গরম হবে। এর ফলে উনি আচমকা পরিবর্তনটা খেয়ালই করেননি, আর যখন খেয়াল করলেন, ভয়ে জমে গেলেন, হাপরের মতো বুক ওঠানামা করছিল, উনি বুকে হাত চাপা দিয়ে বসলেন।

জলটা শান্তই ছিল এতক্ষণ, কিন্তু জলের তলায় যা ঘটে চলেছিল তাতে জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। প্রায় বোঝা যায় না এমন সামান্য নড়াচড়ায় চাঁদের আলো ছিতরে যাচ্ছিল।

জলে প্রতিফলিত মিটমিটে আলোগুলোর নড়াচড়া ক্রমশ দ্রুত হয়ে উঠছিল। চকচকে বাদামি রঙের উড়ুক্কু মাছ এদিক ওদিক ছিটকে যাচ্ছিল, জেলে-নৌকাগুলোও অদৃশ্য।

হঠাৎ সমুদ্রটা ফুলে ফেঁপে, প্রবলভাবে ফুঁসে উঠল, জলের ওপরের ফেনা ছিটকাচ্ছিল চারদিকে। শুড়গুলো ঝলসে উঠল, পাড়ের দিকেই গড়িয়ে আসছিল তারা। অসংখ্য শুড় পাক দিয়ে দিয়ে টানটান হয়ে উঠছিল, যেন জঙ্গলের গাছপালা।

শুড়গুলো পাইনগাছগুলো অবধি পৌঁছে সেগুলোকে পেঁচিয়ে ধরল। গাছের গুঁড়িগুলো মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। ঘড়ঘড় আওয়াজ করে পাথরগুলো গড়াচ্ছিল। পাশ দিয়ে জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারের ভেতর থেকে স্কুইডের বিশাল কালো রঙের দেহটা জেগে উঠল, যেন বহুদিন আগে ডুবে যাওয়া কোনো জাহাজ।

বৃদ্ধ লোকটা দু-হাতে বুক চেপে তাঁর জায়গায় পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো ধারালো কিছু তার বুকে ফুড়ে গিয়েছিল। ব্যথায় দম আটকে আসছিল তার। একেবারেই নড়তে পারছিলেন না লোকটা, এমনকি যখন পাইনগাছের চেয়ে মোটা একটা বিশাল শুড় নেমে এল ওঁর ওপরে তখনো না। চোষকগুলো পাথর, পাটাতন, নৌকো যা পেল তার পথের সামনে, সমস্তই পাকড়ে ধরল। আর একটা চোষক মেফিস্টোর বাবাকেও ধরল, যেন ও-ও আরেকটা ছোটো পাথর। জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে চারদিকে ঢেউ তুলে মেফিস্টো গভীর জলে ফিরে গেল।

…সমুদ্রের পাড়ে আলোর মশাল আর মানুষের বেঁটে বেঁটে আবছায়া দেখা যাচ্ছিল। ওদের অস্ফুট আর্তনাদ জলের ওপর মিলিয়ে গেল।

………..

*ক্রাকেন– স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উপকথার সামুদ্রিক দানব।