ম্যাগাজিন রাইটিং পিটার স্নক
ইদানিং ম্যাগাজিন সাহিত্য সম্বন্ধে এক বই হাতে পেয়েছি। পড়লাম।
ম্যাগাজিন সাহিত্যে ফরাসি আর ইংরেজরা অনেক উন্নতি করেছে, সত্য বটে। তবে আমেরিকানদের চেয়ে তারা অনেক, অনেক বেশি এগিয়ে।
আমরা, আমেরিকানরা কি করি? আমরা অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে তা ছাপাই। তারপর তা মনোযোগ দিয়ে পড়ি।
আমরা ম্যাগাজিনের আত্মাকে বুঝতে পারি না–যার ব্যাখ্যা হয় না, সংজ্ঞাও নেই।
সত্যি কথা বলতে কি, ম্যাগাজিনের ক্ষমতা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ম্যাগাজিনের ক্ষমতাকে আমরা খর্ব করে–দাবিয়ে রেখেছি। আবার সংবাদপত্রের ক্ষেত্রকেও আমরা একই রকমভাবে খর্ব করে রেখেছি। যে ক্ষেত্র অসীমতাকে সঙ্কুচিত করে আমরা সীমিত গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখেছি।
ফরাসি আর ইংরেজরা তাদের ম্যাগাজিনকে বৈচিত্র্য দিয়ে শক্তিশালী করে তোলেনি, শক্তিশালী করেছে বিষয়ের উৎকর্ষতা দিয়ে। আর এভাবেই তারা আমাদের টপকে চলে গেছে। আর এ কারণেই আমরা পিছিয়ে না পড়ে পারিনি।
এবার আমেরিকান মাগাজিনের প্রসঙ্গে দু-চার কথা আলোচনা করা যাক। তাদের ম্যাগাজিন খুব কমই আমাদের মনে রেখাপাত করতে পারে। বিদেশি লেখা পড়লে আমাদের মন সহজেই দুর্বল হয়ে পড়ে, গলে যায়।
আর ম্যাগাজিনের লেখার ওপর কাজ সারা যায় না, বিবরণে যাওয়া দরকার হয়ে পড়ে–সেখানই তো প্রকৃত আবিষ্কার।
এখন ভেবে দেখা দরকার, প্রকৃত মৌলিকতা কি? আবেগ-উচ্ছ্বাস বা প্রেরণার আধিক্য কখনই প্রকৃত মৌলিকতা হতে পারে না। যদি একরম ভাব হয় তবে এটাই হবে সবচেয়ে বড় ভুল।
মৌলিক সৃষ্টি খুবই কঠিন, স্বীকার করতেই হবে। কারণ, গভীরভাবে ভেবেচিন্তে, ধৈর্য সহকারে অনেক, অনেক যত্নসহকারে মৌলিক কিছু লিখতে হয়।
আমেরিকানরা কেন লিখতে গিয়ে গভীরে যেতে, বিশদভাবে মনোভাব ব্যক্ত করতে পারেন না কেন? এর উত্তর একটাই–বেশ কিছু সংখ্যক আমেরিকান লেখক লিখতে বসে বিশদে যাওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা সত্ত্বেও ব্যর্থ হওয়ার পিছনে একটাই কারণ, পত্রিকার প্রকাশকরা লেখককে সম্মান দক্ষিণা এতই কম দেন যে, তাদের পরিশ্রম ও সময়ের দাম প্রাপ্য অনুযায়ী পান না। ফরে তাদের পোষায় না। এ কারণ তো অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, আর এ ছাড়াও অনেক খুবই সঙ্গত কারণের জন্য আমরা সাহিত্যের এই খুবই গুরুত্বপূর্ণ শাখায় যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তবে এও খুবই সত্য যে, এ শাখাটার গুরুত্ব দিন দিনই দ্রুততালে বেড়ে চলেছে। আর এও আশা করা যাচ্ছে, অচিরেই সাহিত্যের যাবতীয় শাখার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। আর এটাই সম্ভব, এটাই স্বাভাবিক।
আমরা যে কেবলমাত্র প্রকৃত আবিষ্কারের ক্ষেত্রেই দারুণভাবে পিছিয়ে পড়েছি তা-ই নয়, শিল্পকলার দিক থেকেও আমাদের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে।
কোন আমেরিকান সমালোচককে সমালোচনা লিখতে বসে পাঠকদের কেবলমাত্র সমালোচনার কথার ফুলঝুড়ি ছাড়া আরও অনেক কিছু উপহার দেবার জন্য মানসিক দিক থেকে তৈরি থাকতে হয়।
সমালোচনা নিজেই একটা আকর্ষণীয় শিল্পে পরিণত হয়ে উঠুক, সমালোচনার দাবি নিরপেক্ষভাবে করতে পারে এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিন্তাধারা কজনের ভেতরে আছে বলুন তো?
আমরা গল্প-সমৃদ্ধ ম্যাগাজিনের কথা লিখতে বসে নিজেদের অযোগ্যতার কথাই চূড়ান্তভাবে পাঠক-পাটিকার সামনে তুলে ধরি, ঠিক কিনা?
বড় জোর তিন-চারজন ছাড়া আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে দক্ষ লেখক যে আরও থাকতে পারে তা আমরা ঘুণাক্ষরেও ভাবি না বা ভাবতেই পারি না। দেখুন, গল্পকথা লেখার প্রসঙ্গে আমেরিকান আর ইংরেজ লেখকদের তুলনা করার কাজেই যখন হাত দিয়ে বসলাম তখন এক ইংরেজ কথাশিল্পীর লেখা পিটার স্নক গল্পটার কাহিনী সংক্ষেপে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
পিটার স্নক ছিল এক বস্ত্র ব্যবসায়ী। বিশপগেটে সে একটা কাপড়ের দোকান চায়। সে নিজে আর একজন কর্মচারী মিলে দোকানটা চালায়। দোকানটা খুব বেশি বড়সড় না হলেও সাজানো গোছানো তো বটেই। আর কাপড়ও রাখে হরেক রকমের। কোন ক্রেতা একবার তার দোকানে ঢুকলে, পছন্দসই কাপড় মিলল না অজুহাত দেখিয়ে, কোন খদ্দেরকেই সাধারণত ফিরে যেতে হয় না।
পিটার স্নকই এ কাহিনীর মুখ্য চরিত্র। লোকটা বোকার হদ্দ, কিন্তু আত্মম্ভরী। যাকে বলে একেবারে নিরেট আহাম্মক। তবে লোক হিসেবে তাকে ভালো বলতেই হবে। কথাবার্তা মিষ্টি, ব্যবহার অমায়িক। একটা ব্যাপার কারো নজর এড়ায় না, দোকানী পিটার স্নক সর্বক্ষণ মুখের ভাব এমন করে রাখে, যেন দারুণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
সত্যি কথা বলতে কি, গোড়ার দিকে তার কারবার ভালোই চলছিল। অধিকাংশ সময়েই তার দোকানে খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকত। কিন্তু সে আর কতদিন? যতদিন না মিস ক্লারিন্ডা বডফিনেরর সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় হয় ততদিনই তার কারবার রমরমা ছিল।
মিস বডফিনকে ঠিক যুবতি বলা চলে না। বরং যৌবনের প্রায় শেষ সিঁড়িতে পা দিয়েছে বলাই ভালো। তার বয়স বছর তিরিশের খুব বেশি কম হবে বলে মনে হয় না। তবে এক নজরে দেখেই মনে হয় দেহে যৌবনকে এখনও ধরে রেখেছে। মুখশ্রী সুন্দরই বলা চলে। আর কথাবার্তা চালচলন মনে দাগ কাটার মতো। সবদা হেসে হেসে কথা বলে। হাসি যেন মুখে সব সময় লেগেই থাকে।
মেয়েদের সৌখীন টুপি, ফিতে আর লেস প্রভৃতি তৈরির ব্যাপারে তার দক্ষতা প্রশংসার যোগ্য।
মিসেস বড়ফিন এসে পিটার স্নকের দোকানে চাকুরি নিল। ব্যস, খেল শুরু হয়ে গেল, জমেও গেল অল্পদিনের মধ্যেই। প্রেম আর অর্থোপার্জনের উচ্চাভিলাস বেঁটেখাট লোকটার মনটাকে টলিয়ে দিল। আগের মতো মন দিয়ে কারবার চালানো তার পক্ষে সম্ভব হলো না।
পিটার স্নক ভাবলেন, মিস বড়ফিনকে বিয়ে করে যদি ঘর বাধেন, যদি সহধর্মিনী হিসেবে সর্বক্ষণ কাছাকাছি পাশাপাশি পেয়ে যান তবে দোকানটার দুটো বিভাগ খুলে দেবেন।
দোকানটাকে দুটো ভাগ করে নিয়ে একদিকে মেয়েদের, আর অন্যদিকে ছেলেদের পোশাক পরিচ্ছদ রাখতে পারলে উভয় ব্যবসাই রমরমা হয়ে উঠবে। একই দোকানের পাশাপাশি বিভাগ থেকে যদি প্রযোজনীয় যাবতীয় পোশাক পরিচ্ছদ পেয়ে যায় তবে আর খদ্দেররা অন্য দোকানে যেতে উৎসাহি হবে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিক্রিবাট্রা অনেকগুণ বেড়ে যেতে বাধ্য। আর দোকান ভাড়া দিতে হবে মাত্র একটার জন্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দোকান হবে দুটো, একঘরে দু-দুটো কারবার, এতে কাজকর্মও খুব আরামদায়ক হয়ে উঠবে।
এরকম ভাবনায় মশগুল হয়ে আমাদের নায়ক প্রেমের দিকে একটু-একটু করে গলা বাড়িয়ে দিতে লাগল।
মেয়েটা, মিস বডফিন একটু-আধটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে হলেও তার প্রেমে ক্রমে সাড়া দিতে আরম্ভ করল।
পিটার স্নক এবার থেকে যেখানে পাঁচ-দশজন জড়ো হয় সেখানে তার প্রেমিকা মিস বড়ফিনকে প্রায়ই নিয়ে যেতে আরম্ভ করল।
দিনের পর দিন মেলামেশার পর মিস বডফিন-ই একদিন প্রেমিক প্রবরকে প্রস্তাব দিল–চল, কোথাও থেকে বেরিয়ে আসা যাক।
পিটার স্নক প্রেমিকার কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত একটা প্রস্তাব পেয়ে যেন আনন্দে একেবারে আটখানা হয়ে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল বেড়াতে যেতে চাচ্ছ!
হ্যাঁ, এক জায়গায় দিনের পর দিন থাকায় খুব এক ঘেয়ে লাগছে। তাই ভাবছি কোথাও থেকে বেড়িয়ে এলে দুজনের মন একটু হালকা হবে।
প্রস্তাবটা নিঃসন্দে খুবই ভালো।
তবে চল, বেরিয়েই পড়া যাক।
কিন্তু কোথায় যেতে চাচ্ছ?
চল, মার্গেট ভ্রমণে যাওয়া যাক।
চমৎকার! তবে চল, কালই বেরিয়ে পড়া যাক।
আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হল, মিস বডফিন আগে যাত্রা করবে। তারপর খুবই জরুরি কিছু কাজকর্ম মিটিয়ে পিটার স্নক তার পিছন-পিছন রওনা হয়ে যাবে।
এদিকে পিটার স্লকের কাজকম মিটতে মিটতে জুলাই মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেল। এবার জাহাজ ধরে সে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে গেল। গন্তব্যস্থলে নিরাপদে পৌঁছেও পিটার স্নক দু-একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলল। সেগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে, দোকান থেকে নতুন কায়দা কৌশলে তৈরি কিছু কোট-প্যান্ট সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। সবই নিজের ব্যবহারের জন্য।
জাহাজ থেকে নামবার পোশাকের সে থলেটা হঠাৎ জলে পড়ে যায়। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে সেটা পানিতে তলিয়ে গিয়ে একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেল।
দোকান থেকে যাত্রা করার আগে মিস বডফিন কিন্তু তাকে বার বার বলে গিয়েছিল, সে যেন কিছুতেই পুরনো কোট-প্যান্ট পরে তার সামনে না যায়।
আর দ্বিতীয় অঘটনটা হচ্ছে, জাহাজ থেকে হুড়মুড় করে নামবার সময় নায়ক ভাই আচমকা হোঁচট খেয়ে হাঁটুর তলাকার অনেকটা জায়গার চামড়া তুলে ফেলল। পরিস্থিতি এমন হলো যে, শল্য চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে উপায় রইল না। চিকিৎসক ওষুধপত্র যা দেবার তা তো দিলেনই উপরন্তু সর্বনাশের কথা যা শোনালেন তা হচ্ছে, তিনি বার বার সতর্ক করে দিলেন, বেশ কিছুদিন যেন প্রেমিকার সঙ্গে নাচানাচিতে না মাতেন। যদি তার নির্দেশ না মানেন তবে পা নিয়ে চূড়ান্ত ভোগান্তিতে যে তাকে পড়তে হবে এতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। সর্বনাশের ওপর সর্বনাশ।
আরও আছে, ব্যস্ত-হাতে একটা বোতলের ছিপি আচমকা ছুটে এসে পিটার স্নকের একটা চোখে আঘাত করল। ব্যস, সাময়িকভাবে সে কানা হয়ে গেল।
এসবের পিছন পিছন এল আর এক রকমের অঘটন। যাকে বলে একেবারে সোনায় সোহাগা। ব্যাপারটা ঘটল মি. লাস্ট নামক এক ভদ্রলোকের আকস্মিক আগমনের ফলে। মি. লাস্ট জুতোর কারিগর। জুতো তৈরি করে পেটের ভাত যোগার করে। কারবারটা জুতোর হলে কি হবে, দেখলে মনে হয় যেন জবরদস্ত এক মিলিটারি। তালগাছের মতো ইয়া লম্বা, চওড়াও সে তুলনায় কম নয় মানানসই। সব মিলিয়ে সুপুরষ না বলা গেলেও হেয় করার মতো চেহারা অবশ্যই নয়।
ভদ্রলোক করিতকর্মা সন্দেহ নেই। পিটার স্নক কাজকর্ম সেরে আসতে গিয়ে যে কদিন দেরি করেছিলেন এর মধ্যে মিস বডফিনের পিছনে ঘুরঘুর করতে লেগে যায়। কাজও হাসিল করে ফেলে। তার সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলায় মেতে যায়।
শেষপর্যন্ত পিটার স্নক সেখানে পৌঁছনোর পর নাটক রীতিমত জমে উঠল। প্রেমিক দুজন আর প্রেমিকা একজন। কেউ, কারো অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। অতএব জোর সংঘাত বেঁধে গেল।
নায়িকার দখল নিয়ে শেষপর্যন্ত দুই প্রেমিকের মধ্যে বিবাদ হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেল। প্রেমিক লাস্ট মোক্ষম এক ঘুষি হাঁকিয়ে দিল পিটার স্নকের মুখে। দেখতে দেখতে মুখ ফুলে একেবারে ফুলে হাড়ি হয়ে গেল।
বেগতিক দেখে বেচারা পিটার স্নক অসহায় অবস্থায় চোখের পানি মুছতে মুছতে জাহাজে গিয়ে উঠল। মিস বডফিনও তাকে পথের কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ায় সেখান থেকে সরে পড়া ছাড়া পিটার স্নকের অন্য কোন গতিও তো কিছু রইল না।
যা-ই হোক, প্রেমিকার কাছ থেকে অবহেলিত পিটার স্নক পথের ভিখারী হয়ে জাহাজে চেপে বাড়ির দিকে রওনা হলো। সে যে জাহাজে চেপে প্রেমিকার সঙ্গে মিলিত হতে এসেছিল আবার সে জাহাজেই দেশে ফিরে গেল।
পথে এক জায়গায় জাহাজ নোঙর করল। বহু যাত্রী মজা লোটার জন্য জাহাজ ছেড়ে ডাঙায় নেমে গেল।
বেচারা পিটার স্নক তো পথের ভিখারী। মজা লোটার ব্যাপার স্যাপার তার শিকেয় উঠে গেছে অনেক আগেই। তার ওপর দেহ-খাঁচাটাও ভাঙাচোরা। তাই বাধ্য হয়ে সে মনস্থির করল, জাহাজে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেবে।
তার মাথায় হরেক রকমের দুশ্চিন্তা প্রতিনিয়ত চক্কর মারছে। সবচেয়ে বড় চিন্তা, পরের দিনই এক পাওনাদারকে মোটা টাকা মেটাতে হবে। টাকাগুলো ঠিকমতো শোধ না দিতে পারলে রীতিমত ইজ্জৎ নষ্টের ব্যাপার।
পিটার স্নক দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। এটা-ওটা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। একটু বাদে কয়েকজন খালাসি পিটার স্নককে নিয়ে রঙ্গ তামাশায় মেতে গেল। জোর করে তার গলায় মদ ঢেলে দিল। মদের নেশা তাকে জেঁকে ধরল। খালাসিরা ধরাধরি করে তাকে ফেলে দিল সমুদ্রের পানিতে। ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল।
তারপর পিটার স্নককে তার দোকানে দেখা গেল। কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলছে, ওই পাওনাদারের টাকাটা না মিটালে আর ইজ্জৎ থাকবে না।
তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখে কর্মচারীটা বোঝাতে লাগল–এর জন্য এত ভাববেন না। টাকা তো ক্যাশ বাক্সেই রয়েছে। আমি হিসাবপত্র দেখে টাকা মিলিয়ে রেখেছি। টাকা, কম পড়বে না।
ভালো কথা। তবে আমি মালপত্রের অর্ডার দিয়ে আসছি। তুমি দোকানেই থেকো। ইতিমধ্যে কেউ মালপত্র নিয়ে এসে আলমারিতে গুছিয়ে রেখো। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। কর্মচারীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পিটার স্নক দোকান থেকে বেরিয়ে পথে নামল।
সে দোকান থেকে বেরিয়ে প্রথমেই গেল ব্যাংকে। সেখানে তার নামে টাকা যা জমা রয়েছে, প্রায় সবই তুলে নিল।
কোটের পকেটে নোটের তোড়া খুঁজতে খুঁজতে সে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে এলো।
এবার হাঁটতে হাঁটতে পথের ধারের কয়েকটা বড় বড় মদের দোকানে ঢুকল। সব কটা দোকানে বড় বড় মদের বোতল অর্ডার দিয়ে আবার পথে নামল। তবে মদেও দোকানদারদের প্রাপ্য টাকাটা সব মিটিয়ে না দিয়ে অগ্রিম স্বরূপ অল্প-অল্প টাকা দিয়েছে।
পিটার স্নকের টাকা কোন ব্যাংকে জমা থাকে, সেটা সবারই জানা রয়েছে আর সব সময়ই তার নামে প্রচুর অর্থ জমা থাকে এ ব্যাপারেও সবাই নিশ্চিত। তাই বাকি টাকা মিটিয়ে দেবার জন্য কেউ ওজর আপত্তি করেনি।
পিটার স্নক সন্ধ্যার কিছু আগে দোকানে ফিরে এলো। কর্মচারীকে নিয়ে ব্যস্ত হাতে দোকানের যাবতীয় জিনিসপত্র বাঁধাছাদা সেরে ফেলল। অত্যাশ্চর্য তৎপরতার সঙ্গেই সে কাজটা সারল।
পরদিন কাকডাকা ভোরে কর্মচারীকে নিয়ে যাবতীয় মালপত্তর গাড়িতে তুলে ফেলল। গাড়ি উল্কার বেগে ছুটে চলল, জাহাজ ঘাটার দিকে। একই রকম তৎপরতার সঙ্গে মালপত্রের বস্তাগুলোকে জাহাজে তুলে নিল। ব্যস, কর্মচারীকে সঙ্গে করে সে শহর ছেড়ে চম্পট দেওয়ার ব্যবস্থা সেরে ফেলল। এখন জাহাজ ছাড়তে যা দেরি।
তারপরই পাওনাদাররা বিল হাতে করে ৮ি টার স্নকের দোকানের দরজায় হাজির হলো। সবাই দেখল, দোকান বন্ধ। জানতে পারল সে গাট্টিবোঁচকা নিয়ে জাহাজঘাটার দিকে গেছে।
পাওনাদাররা মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে উধ্বশ্বাসে ছুটল জাহাজঘাটার দিকে। জাহাজ তখনও নোঙর তোলেনি। জাহাজে উঠে তারা পিটার স্নককে ধরে ফেলল।
পাওনাদারদের সঙ্গে একজন উকিলও জাহাজে উপস্থিত হয়েছে। উকিল দেখে তো পিটার স্নকের পিলে চমকে গেল।
সে জাহাজের খোলে ভেতরে পিটার সকের কর্মচারী আর গাট্টাগোট্টা চেহারার তিনটি লোককে। সবারই হাত-পা বাঁধা। পিঠমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় খোলে মেঝেতে পড়ে তারা অনবরত গোঙাচ্ছে।
এ কী আজব ব্যাপার! পিটার স্নকের মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! ব্যর্থ প্রেমে তার কি মাথার দোষ দেখা দিয়েছে?
পাগল? না, পিটার স্নকের কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে না তার মাথার দোষ দেখা দিয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় অমায়িকভাবেই কথা বলছে।
তবে? ব্যাপার কি? সাধু-সজ্জন ব্যবসায়ী পিটার স্নক এমন ধাপ্পাবাজি কারবারে মাতল কেন? কেন হঠাৎ এমন জাল-জোচ্চুরির পথ বেছে নিল? এমন আচরণ তো
ভুলেও কেউ তার কাছ থেকে আশা করেনি।
সত্যি পিটার স্নকের কথায় পাওনাদাররা যেন রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে গেল–আকাশ থেকে পড়ল।
পিটার স্নক গলা ছেড়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিল–উকিল? আরে ধ্যুৎ! আইন আমার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না।
তবে তার কথা যদি সত্যি হয় তবে আইন তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবে না।
কিন্তু কথাটা কী? কী বলছে পিটার স্নক?
পিটার স্নকের বক্তব্য শুনতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে, তাকে মদ খাইয়ে জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার ঘটনায়।
সমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে সে বুঝতে পেরেছিল, তার বগলে দাঁড় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই সে দুহাতে দাঁড়টাকে চেপে ধরল। এবার টানাটানি করে তাকে একটা নৌকার ওপর তুলে নেওয়া হলো। তারপর নৌকাটা তাকে নিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে একটা জাহাজের গায়ে ভিড়ল। তাকে জাহাজে উঠিয়ে নেওয়া হলো।
জাহাজের ক্যাপ্টেন বড় ভালো মানুষ। অমায়িক ব্যবহার। তারই মতো বেটেখাট চেহারা। ক্যাপ্টেন তাকে একটা কেবিনে নিয়ে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। খাবার দাবারের ব্যবস্থাও করে দিলেন।
কাপ্টেনের কাছ থেকে সহৃদয় আচরণ পেয়ে পিটার স্নক যারপরনাই খুশি হলো। আনন্দের চোটে ক্যাপ্টেনের কাছে তার দুঃখের কথা সবই বলে ফেলল। তারপর ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসায়, এক সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন চোখ মেলে তাকিয়েই চমকে উঠল। দেখল, তার উকিল আর পাওনাদারের দল দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখন কি করে বলা যায়, সে দোষী?
তার কথাবার্তা শুনে উকিল সাহেবের তো চোখ দুটো কপালে ওঠার যোগাড়।
তবে আসল ব্যাপারটা কী? তবে কি তাকে কেবিনে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তারই পোশাক পরে, ভোর রাতে অন্ধকারে সহকারীর চোখে ধূলো দিয়ে কোনো এক বড়সড় জোচ্চোর প্রবঞ্চণা করে বেরিয়েছে? কারণ, জাহাজের ক্যাপ্টেন বলে যে লোকটা নিজের পরিচয় দিয়েছে, সে-ও তো তারই মতো বেটেখাট।
পিটার স্লকের গল্প এখানেই শেষ। মূল কাহিনীতে এর বিশদ বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। তবে যেখানে যা বলা দরকার, যাতে গল্পটা সুখপাঠ্য হয় সে দিকে দৃষ্টি রেখেই লেখক ঘটনার বিন্যাস করেছেন, সন্দেহ নেই। সত্যি বলছি মূল গল্পটা যে বা যিনি পড়বেন। তাকে আদ্যোপান্ত রুদ্ধ নিশ্বাসে পড়ে তবেই বইটা হাত থেকে নামাতে হবে। শুধু কি এ-ই? পড়া শেষ করার পরও পাঠককে গালে হাত দিয়ে বসে অন্তত আধঘণ্টা কাহিনীটা সম্বন্ধে ভাবতে হয়।
এমনটা না হলে তাকে কি আর গল্প বলা চলে?