বন-বন
বন-বন!
তার মতো ভয়ানক রেস্তোরাঁপ্রেমিক লোক আমি দ্বিতীয় আর একজন দেখিনি। যারা, যখনই ছোট এ-রেস্তোরাঁটায় ঢুকেছেন, তারাই বন-বন নামধারী লোকটাকে সেখানকার টেবিলে ঘাড় উঁচিয়ে বসে থাকতে দেখেছেন। এ-ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে, এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার।
আরও আছে, রোস্তোরাপ্রিয় ছাড়াও বন-বন লোকটার আরও একটা বিশেষ পরিচয় আছে–তিনি একজন কৃতি দার্শনিক। তার এ-ব্যাপারে যে যথেষ্ট দক্ষতা আছে, এতেও কেউ দ্বিমত পোষণ করেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। এ ব্যাপারটা লিখেও কেউ কারো সঙ্গে তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হবেন না।
বড় বড় যে কোনো পণ্ডিত ব্যক্তির তুলনায় তিনি অনেক বেশি পুঁথিপত্র পাঠের মাধ্যমে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন, সব কটা গ্রন্থাগারের পুঁথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। আর লিখে দিস্তা দিস্তা পাতাও ভরেছেন।
দার্শনিক বন-বন যা-কিছু লিখেছেন, সবই যে উন্নতমানের তা যেমন অনায়াসে বলা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনই বলা সম্ভব নয় তার যেকোনো লেখা পড়েই মর্মার্থ উদ্ধার করা, মানে তার বক্তব্য রপ্ত করা সম্ভব নয়।
পণ্ডিত বন-বনের অন্য সব লেখা যেমন তেমন, তার লেখা নীতিকথাগুলোকে মাথায় ঢোকানো খুবই কঠিন ব্যাপার। বহুবার পড়াশোনা করেও সেগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারার মতো ঘিলু কয়জনের মাথায়ই বা আছে?
তার লেখাগুলোকে কেন দুর্বোধ্য বলা হয়–তাই না? যারা তার লেখা, বিশেষ করে তার নীতিকথাগুলো পড়েননি, তাদের যে কিভাবে প্রকৃত সত্যটাকে বোঝানো যাবে, ভেবে পাচ্ছি না।
আরিস্টটল, প্লেটো আর পৃথিবীর বড় বড় দার্শনিকদের সঙ্গে আমাদের দার্শনিক পণ্ডিত বন-বনের কোনদিক থেকে তুলনাই চলতে পারে না।
সত্যি কথা বলতে কি, পণ্ডিত প্রবর বন-বন তো নিজেই চলমান একজন কৃতি দার্শনিক আর এ-কথা কেনই বা বলা যাবে না? দর্শন শাস্ত্রের যাবতীয় তথ্য যে তার ঠোঁটে সর্বস্ব হাজির থাকে।
আর বন-বন যে একজন ভয়ানক দর্শনপ্রিয় ব্যক্তি, এ-কথা তো গোড়াতেই বলে রেখেছি। আহারাদির ব্যাপারে তার এই যে অতুলনীয় প্রতিভা এ বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকতে পারে না, থাকা উচিতও নয়। তিনি নিজের এর জন্য কেবলমাত্র মনে মনে নন, সবার সামনেই, একেবারে প্রকাশ্যে অহঙ্কার প্রকাশ করে থাকেন।
পণ্ডিত দার্শনিক নিজের আহারাদির প্রতিভা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেন– তার এ বিশেষ প্রতিভার মূলে রয়েছে, তার পাকস্থলির শক্তি। পাকস্থলির সহযোগিতা, অর্থাৎ পাকস্থলির সক্রিয় সহযোগিতা না থাকলে তার পক্ষে এ বিষয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা কিছুতেই সম্ভব হত না।
আমি তার সম্বন্ধে যেটুকু দেখেছি আর বুঝেছি, আহারাদির ব্যাপারে চীনের মানুষের সঙ্গে তার সব দিক থেকে সাদৃশ্য বর্তমান। আত্মা পেটে থাকে, চীনের মানুষরা এ-কথা বলে। তবে আত্মার অবস্থান সম্বন্ধে গ্রীকরাই ঠিক কথা বলে। তাদের মতে, আত্মার অবস্থান উদরের খাঁচার ভেতরে আর মনের গহীনে।
ভুলেও এরকম কথা মনে স্থান দেবেন না যে, আমি পণ্ডিতদের পেটকু আখ্যা দিয়ে খুশি হতে চাচ্ছি। ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়ে থাকে। অতএব দার্শনিক বন বনের মোটেই ভুলচুক হতে পারে না, আমরা কি করে ভাবব, বলুন?
অতীত কাহিনী লিখতে বসে দার্শনিক বন-বন এবং একটা ভুলের কথাই আমি উল্লেখ করব। কথাটা হচ্ছে, সুযোগ পেলে কোনো জিনিস সম্বন্ধে দর কষাকষি করতে তিনি মোটেই ইতস্তত করেন না।
কিন্তু এরকম কথা কেউ ভুলেও মনে স্থান দেবেন না যে, পণ্ডিত বন-বন একজন অর্থলিলু, অর্থ পিশাচ ছিলেন।
মনে রাখবেন, পৃথিবীর কোনো দার্শনিকই কোনোদিন তার ধ্যান-ধারণাচ্যুত হয়ে, হন্যে হয়ে অর্থের পিছনে ছুটে বেড়িয়েছেন, অর্থকেই একমাত্র কাম্য–ধ্যান জ্ঞান, সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি তবে দর কষাকষিতে উৎসাহি হতেন কেন? এর উত্তর একটাই, নিজের স্বার্থ রক্ষিত হলো কিনা তা বোঝার জন্য। আর তা যদি সম্ভব করতে পারেন, তবে বেশ কয়েকদিন ধরে তার মুখে হাসির ছটা অক্ষুণ্ণ থাকত। তার পাণ্ডিত্য যে অন্তহীন–এ মুচকি হাসিটুকুই তার বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করে থাকে।
মুখমণ্ডল জুড়ে এরকম মুচকি হাসি বিরাজ করার জন্য তার অন্য আর একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হাসি অনেকেরই আজ অবধি নজরে পড়েনি। এ আবার কেমন হাসি রে বাবা! ভাবছেন, তাই নয়? দাঁত খিঁচিয়ে হাসি যাকে বলে।
লোকের মুখে-মুখে ঘুরে বেড়ানো যে উড়োখবর শোনা গেছে, তা থেকে জানা সম্ভব হয়েছে, পণ্ডিত বন-বন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হাসতে থাকেন তখন, যখন তার দর কষাকষি প্রধান উদ্দেশ্য, বদখেয়াল পরিপূর্ণ করার প্রচণ্ড ইচ্ছা, তবে কিন্তু নিতান্তই নিজের স্বার্থের তাগিদে।
দোষ বা দুবর্লতা যে শব্দ ব্যবহার করেই মনের ভাব ব্যক্ত করা হোক না কেন, প্রখ্যাত এ দার্শনিক পণ্ডিতের আরও বহু দুর্বলতা অথবা আচার ব্যবহারের দোষ ছিল। তবে এও সত্য যে, সে সব ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনায় লিপ্ত হওয়ার কোনো দরকার নেই।
যেমন মনে করা যেতে পারে, পৃথিবীতে এমন বহু প্রতিভাশালী ব্যক্তি আছেন, বোতলের প্রতি যার এতটুকুও লিপ্সা বা আসক্তি নেই। বোতলের প্রতি কারো কারো অস্বাভাবিক আসক্তি থাকতে দেখা যায়। কারণ কি? এতে আমরা কি মনে করব? আমরা মনে করব, বোতলের প্রতি তার যেমন আসক্তি রয়েছে, আবার প্রতিভাও কম নেই, নতুবা ভাবতে হবে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে পাঁচজনের হিত সাধনই তার প্রধানতম লক্ষ্য।
এবার দার্শনিক বন-বনের প্রসঙ্গে আশা যাক, তিনি বোতলকে আদর করে বকে জড়িয়ে ধরেন, দেবী জ্ঞানে পূজা করেন কখন? অবশ্যই সুযোগের সন্ধান পেলে, অথবা বিশেষ বিশেষ বোতলে বস্তু তাকে বিশেষ বিশেষ শক্তি-সামর্থ যোগায়।
আরও খোলসা করেই বলা যাক, কি বলেন? মনে করুন, পণ্ডিত বন-বন সেন্টপিরে মদের স্বাদ যখন গ্রহণ করেন, তখন যদি কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি মুখামি করে ন্যায়-অন্যায় নিয়ে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন তবে তাকে ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মতোই উড়ে যেতে হবে। মোদ্দা কথা, বন-বন রীতিমত ঝড় বইয়ে দেবেন।
আবার যদি বন-বন ক্লজ ডো ভোগো মদ গলা অবধি গিলে বুঁদ হয়ে পড়েন তখন তার সঙ্গে কেউ যদি যুক্তিতর্কে লিপ্ত হন তবে তাকেই নাজেহাল হয়ে কাড়াতে হবে। আর যদি তিনি চেম্বারলেন মদের শিকার হয়ে পড়েত সাবধান! –দোহাই ভাই, এখন প্রাণ গেলেও তার সঙ্গে তত্ত্বকথা নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতে যাবেন না যেন, আগেই বলে রাখছি, তবে তিনি কিন্তু আপনাকে একেবারে নাস্তানাবুদ–ঘোল খাইয়ে ছাড়বেন।
এমনই একজন স্বনামধন্য দার্শনিক পণ্ডিত বন-বন। রেস্তোরাঁ বিশেষজ্ঞ শহরের যেকোনো পেটুক, যেকোনো ভোজন-রসিকই তার প্রতিভার খবর কিছুক্ষণ রাখে। চমৎকার প্রতিভা! খাসা প্রতিভা!নিখাদ প্রতিভা! তার হুলো বিড়ালটা পর্যন্ত তার এ বিশেষ প্রতিভাটার খবর অবশ্যই রাখে। সে কিন্তু ভুলেও তার মনিবের সামনে ল্যাজ নাড়ে না।
কেবলমাত্র বিড়ালটার কথাই বলি কেন? তার এ অসামান্য প্রতিভাটার কথা কোনো অংশে কম রাখে না। অনন্য প্রতিভার সামনে সে কান দুটো নুইয়ে দিয়ে নিচের চেয়ারটাকে সরিয়ে ফেলে পিট পিট করে তাকিয়ে মনিবের অসামান্য ক্ষমতার কথা তন্ময় হতে ভাবতে থাকে।
এবার বিখ্যাত দার্শনিক পণ্ডিত বন-বনের চেহারার বিবরণ যৎকিঞ্চিত না দিলে আপনাদের মানসিক অস্থিরতা দূর হবার নয়, বুঝতেই পারছি।
সত্যি কথা না বলে পারছি না, তার চেহারাটা মোটেই অন্য পাঁচজন মানুষের মতো নয়। বলতে দ্বিধা নেই, মানুষ নয়, বনের হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গেই তাঁর চেহারার সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি।
কেবলমাত্র জন্তু-জানোয়ার বললেই যথার্থ বলা হবে না। বরং বলা চলে মানুষের সঙ্গে তার চেহারার যতটা না আছে সাদৃশ্য, তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় চার পেয়ে জানোয়ারের সঙ্গে। তবে এও সত্য যে, লোকটার মধ্যে অদ্ভুত একটা রাজা-রাজা ভাব প্রকাশ পায়। কেবলমাত্র আকৃতির জন্যই নয়, তার প্রকৃতির অবদানও কম নয়।
তার দৈহিক উচ্চতা তিন ফুট হলে কি হবে, তার মাথাটা কিন্তু একটা বেলের মতো এতটুকু। তবে তার জালার মতো পেটটা দৈহিক আয়তনের অভাব অনেকাংশে পূরণ করে দিয়েছে।
জালার মতো ইয়া বড় পেট–তাঁর যা-কিছু কৃতিত্ব, যত পরিচিতি সবই তার অতিকায় পেটটার দৌলতেই অর্জন করেছেন। সত্যি, এমন এক প্রতিভাশালী আত্মা থাকার উপযুক্ত জায়গাই বটে তার নাদুসনুদুস হুঁড়িটা।
প্রতিভাশালী দার্শনিক বন-বনের পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারেও কিছু বলার দরকার মনে করছি। বাহ! পোশাক আশাক দার্শনিকের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে কম তো নয়ই বরং যথেষ্টই বলা চলে।
তার পোশাক আশাকের কথা বলা শুরু করার আগে মাথার চুলের প্রসঙ্গে দু একটা কথা বলে নেবার প্রয়োজন বোধ করছি। তিনি সব সময়ই মাথায় চুলগুলো খুবই ছোট–এই এতটুকু করে কাটেন। তবে ছোট ছোট চুলগুলোকে চিরুনি দিয়ে চেপে কপালের সাথে মিশিয়ে রাখেন। আর মাথায় চাপিয়ে রাখেন গাধার টুপি বা শঙ্কুর আকৃতিবিশিষ্ট লম্বা একটা টুপি। টুপিটার চারদিকে ঝালর ঝুলে থাকে। গায়ে চাপান একটা অদ্ভুত কাটের ফতুয়া, যার রঙটাকে কড়াইশুটির রঙের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পরে। এরকম ফতুয়া তার আমলের অন্য কোনো রেস্তোরাঁ রসিকের মধ্যে চালু আছে বলে দেখা যায় না। তার হাতদুটো মাত্রাতিরিক্ত লম্বা। কুচ পরোয়া নেই, অসভ্য জংলিদের কায়দায় গুটিয়ে রেখে সমস্যা মিটিয়ে নেন।
রক্তের মতো লাল এক জোড়া বিচিত্র ধরনের চটি তিনি ব্যবহার করেন। তবে তাদের গায়ে সোনা-রূপার জরির কাজ করা থাকায় আরও অদ্ভুত দেখায়। কেবলমাত্র রঙের জন্যই অদ্ভুত দেখায় না। সামনের দিকটা হাস্যকর কায়দায় ছুঁচালো ও সরু হয়ে ওপরের দিকে গুটিয়ে থাকে। এ দুটোর দিকে নজর পড়লেই যেকোনো মানুষেরই হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হয়।
প্যান্টের কথা আর কী-ই বা বলব! মার্টিনের প্যান্টে ছুঁচের কেরামতি দেখলে চিত্ত চমৎকার হয়ে যেতে বাধ্য। লাল পুঁথির গায়ে জ্বালা ধরা নকসা কার আলখাল্লটার দিকে চোখ পড়তেই মনে হয়, ঘোড়সওয়ারের পিঠে চেপে বুঝি কুয়াশা শুন্যে ভেসে চলেছে।
তার বিদঘুঁটে চেহারা তো রয়েছেই, আর সে সঙ্গে কিম্ভুতকিমাকার পোশাক মিলে তাকে এমন একটা অদ্ভুত বা নিয়ে তোলে, যার নজির পাওয়া সত্যি ভার।
দার্শনিক পণ্ডিত বন-বন যখন পথ দিয়ে যাতায়াত করেন তখন পথচারীরা এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে জটলা করে, কানাকানি কওে, বন-বন কি স্বর্গের পাখি, নাকি নিজেই সাক্ষ্যৎ স্বর্গ?
সত্যি বলছি, আমি কিন্তু বন-বনের চেহারা ছবি বা অদ্ভুত পোশাক-আশাক নিয়ে কোনো মন্তব্যই করি না, ভবিষ্যতে করব না। লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কথা চালাচালি করা আমার স্বভাব নয়। একজন গবেষক, ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিকরা এ-কাজের দায়িত্বে তো রয়েছেই।
দার্শনিক পণ্ডিত বন-বন অধিকাংশ সময় রেস্তোরাঁয় বারোমাস চেয়ার আগলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান। সেখানে পা দিলেই মনে হবে মহাপুরুষদের সাধনা ক্ষেত্রে হাজির হয়েছি। এ-ভাবনাটা যাতে সহজেই মানুষের মাথায় আসে, সে জন্য রেস্তোরাঁর ফটকে একটা ইয়া মোটা বই আর একটা বড়সড় বোতল দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া। হয়েছে। আর এদের ঠিক পিছনে একটা থালার গায়ে বড় বড় হরফে লিখে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, বন-বনের খুপড়ি। এটা দেখলেই মনে হবে বার খুপড়িতে প্রবেশ করা হচ্ছে আর সেখানে কোনো প্রকার মগজের অধিকারী অবস্থান করছেন। সেটাকে রেস্তোরাঁ বলা হয় বটে। কিন্তু সেটা একটা বাজারের খানাপিনার ঘর ছাড়া কিছু নয়।
দার্শনিক পণ্ডিতপ্রবর বন-বন এখানেই মদের বোতল আর গ্লাস নিয়ে সর্বক্ষণ পড়ে থাকেন। আর এখানেই মগজে শান দেন। মগজ-চর্চায় লিপ্ত থাকেন। চারদিকে হরেক রঙ আর হরেক রকম নক্সাওয়ালা পর্দা ঝোলে। এক কোণে একটা খাটে সব সময় বিছানা পাতাই থাকে। তার শোবার ব্যবস্থা। আর নক্সাকরা চাঁদোয়া খাটের মাথায় ঝোলে। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে পুরো ঘরটাতে। ফকড়ামি করার জায়গা এটা নয়, তা ঘরে ঢুকেই বুঝে নেওয়া যাবে।
খুপড়িটার যে কোণে শোবার খাট পাতা রয়েছে তার বিপরীত দিকের কোণে রান্নার ব্যবস্থা আর পুঁথিপত্রের পাহাড়। থালা-ঘটি-বাটি, বইপত্র স্থূপাকার করে রাখা হয়েছে। তা-ও আবার যে সে বই নয়, পৃথিবীর বড় বড় দার্শনিকদের লেখা রয়েছে। সেগুলোর পাতায় পাতায়। সেগুলোর ফাঁক-ফোকড় দিয়ে উঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে। হাতা-খুন্তি–আরও কত কী রান্নার সরঞ্জাম।
সত্যি, উদরতুষ্টির সামগ্রী আর মগজের খোরাকের একই সঙ্গে অবস্থান দেখলে কার না মন-প্রাণ পুলকে নেচে উঠবে। আরও আছে ইয়া পেল্লাই একটা ফায়ার প্লেস দরজায় ঠিক সামনেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আগুন-দৈত্য যেন বিরাট গ্রীবা বিস্তার করে গিলে খাওয়ার জন্য ছোঁক ছোঁক করছে। আর মদিরার ফিরিস্তি দিতে গেলে রাত বুঝি কাবারই হয়ে যাবে।
এ বিশেষ খুপড়িটাতেই এক মাঝরাতে পণ্ডিত প্রবর একটা চেয়ার দখল করে বসেছিলেন। অদূরেই চুল্লির কাঠ লকলকে আগুন আর উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
আগুন! আগুন জ্বলছে পণ্ডিত বন-বনের মাথার ভেতরে ও বাইরে, কিন্তু হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। একে শীতকাল, তার ওপরে, মাঝরাত। হাড়ে রীতিমত কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। স্তাবকের দল এতক্ষণ পণ্ডিত প্রবরকে বেষ্টন করে বসেছিল। মস্তিষ্কের কেরামতি দীর্ঘসময় ধরে তারা অধীর উৎসাহের সঙ্গে শুনছিল। সবেমাত্র বকাবকি করে সবাইকে খুপড়িটা থেকে বের করে দিয়ে তিনি দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন।
এরকম একটা ভয়ানক রাত একশো বছরের মধ্যে বড়জোর একবার বা দুবার। আসে। বাইরে দুর্যোগ পূর্ণ আবহাওয়ার দাপাদাপি। অনবরত ঝর ঝর করে তুষার ঝরেই চলেছে। দৈত্যের দীর্ঘশ্বাসের মতো দমকা বাতাসে পুরো বাড়িটাই তিরতির করে অনবরত কেঁপেই চলেছে। প্রবল বেগে বাতাস চিমনিটার ভেতর দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসছে। ফলে দার্শনিকের খুপড়িটার সব কটা পর্দা দারুণভাবে কাঁপছে, নড়ছে আর দুলছে। বাসনকোসন দুমদাম করে পড়ছে আর ছোটাছুটি করছে, কাগজপত্র উড়ে গিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে আর মেঝের ওপরে মোটাসোটা বইগুলো দুম্ দাম করে আছড়ে পড়ছে–গড়িয়ে যে যেদিকে পারছে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যেন রীতিমত একটা প্রলয় কাণ্ড ঘটে চলেছে।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে পণ্ডিত প্রবরের মেজাজ যে তিড়িক্কি হয়ে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কি? সব বড় বড় দার্শনিকরাই মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য সাধ্য মতো চুল্লিটার কাছাকাছি ঘেঁসে বসেন। দার্শনিক বন-বনও তা-ই করলেন।
কেবলমাত্র আকস্মিক তুফানের জন্যই যে বন-বনের মাথাটা গরম হয়ে গেছে। তাই নয়, সারাদিনে অদ্ভুত বহু ঘটনা ঘটেছে। তাই তো তার ছোট মাথার খুলিটার ভেতরে কালবৈশাখীর দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য রকম শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।
পরিস্থিতি তাকে এমন উদ্ৰান্ত করে তুলেছে, মেজাজটা এমন করে বিগড়ে দিয়েছে যে, মদ গিলছেন মনে করে তিনি ভুল করে ওমলেটে জোরসে কামড়ে দিলেন।
পর মুহূর্তেই বিশেষ একটা নীতিসূত্র আবিষ্ককার করতে গিয়ে তিনি দুম করে ঝোলের বাটিটা দিলেন উলটে।
আবার বিশেষ একটা ব্যাপার নিয়ে অনবরত দরকষাকষি করতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটাই তিনি বানচাল করে দিলেন। দর কষাকষির ব্যাপারে তার যথেষ্ট নামডাক থাকা সত্ত্বেও তিনি নাস্তানাবুদ হচ্ছেন।
ভয়ানক উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে দার্শনিকের স্নায়ুচাপ আর সহ্য করতে পারছে না। সবাই যেন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে–একযোগে তার স্নায়ুগুলোকে আক্রমণ করে বসেছে। দার্শনিক বন-বনের পোষা কুকুরটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে রয়েছে। বহু মানুষ ভীত হয়ে পড়লে যে গানের সুর ভাজতে আরম্ভ করে, কুকুরটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বন বন প্রাণ খুলে শিস দিচ্ছেন আর উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ছোপ লাগা চোখে সুবিশাল ঘরের কোণগুলোর দিকে বার বার তাকাচ্ছেন–যেখানে আগুনের তাপ পৌঁছতে পারে না সেখানকার জমাটবাধা কালো ছায়া অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দিতে পারছে না।
দার্শনিক বন-বন কোণগুলোকে এমন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চাচ্ছেন যে, অন্ধকারের ভেতরে এমনকি আছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে উৎসাহি হয়েছেন। পারলেন না। ব্যর্থ হলো–হতাশায় জর্জরিত হলেন।
অনন্যোপায় হয়ে দার্শনিক বন-বন হতাশ হয়ে হাতলওয়ালা চেয়ারটায় দুম্ করে বসে পড়লেন। টেবিল থেকে কাগজ-কলম টেনে নিয়ে খসখস করে সুবিশাল সারগর্ভ পাণ্ডুলিপি লিখতে শুরু করলেন। লেখাটা আগামীকাল ছাপা হবে। রাতের মধ্যেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে। তিনি লেখা-ঝোকার মধ্যে মিনিট খানেক ডুবে ছিলেন। পর মুহূর্তেই ঘরটারই ভেতরে চাপা একটা গুনগুনানি শুরু হয়ে গেল।
বন-বন উৎসর্গ হয়ে শব্দটার অর্থ উদ্ধার করতে চেষ্টা করলেন। শুনতে পেলেন, কে যেন প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলছে–মি. বন-বন, আমার কিন্তু তাড়া নেই।
তড়াক করে লাফিয়ে কাহিনীর নায়ক চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ফলে টেবিলটা ছিটকে হাত কয়েক দূরে গিয়ে পড়ল। পণ্ডিত প্রবর বন-বন বড় বড় চোখ করে চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে দাঁতে ঘষে অধৈর্য ভরে বলে উঠলেন–হতচ্ছাড়া শয়তান পাজি।
শান্ত কণ্ঠে জবাবটা ফিরে এল সত্যি একদম সত্যি কথা।–সত্যি কথা! কীসের সত্যি কথা? কে তুমি?
বিপরীত দিকে কোনো উত্তর ভেসে এলো না। বন-বন ক্রোধে ফেঁটে পড়ার যোগাড় হলেন। এবার তিনি রীতিমতো অধৈর্যের সঙ্গে বলে উঠলেন–চুপ করে থেকো না। বল, কে তুমি? এখানে ঢুকলেই বা কিভাবে? গলা ছেড়ে চিৎকার করে কথা কটা বলেই দার্শনিক থেমে গেলেন, কারণ, হঠাৎ বিছানার দিকে তার নজর পড়েছে। চমকে উঠলেন। শরীরের সব কটা স্নায়ু একই সঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল।
দার্শনিক অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে-সুমলে নিলেন।
কিন্তু বন-বন এমনকি দেখলেন যার ফলে তিনি আঁতকে না উঠে পারলেন না? তিনি হঠাৎ একেবারে হঠাৎ দেখতে পেলেন, কে একজন তাঁরই খাটের ওপর টান টান হয়ে শুয়ে তার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে রয়েছে।
আগন্তুক বন-বনের প্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজনই বোধ করল না। তার কথার কিছুমাত্র গুরুত্ব না দিয়েই সে বলতে লাগল–তোমাকে যা বলতে চাই তা শোন–
সময় ফুরিয়ে এলেও আমি মোটেই ছটফট করি না। যে কাজের জন্য এখানে আসা, সেটাকে আমি খুবই জরুরি বলেও মনে করছি না। অল্প কথায় বলছি–তোমার হাটে হাঁড়ি ভাঙা, লেখাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি অনায়াসেই অপেক্ষা করতে পারি।
চমকে উঠে পণ্ডিত প্রবর বললেন–কী? কী বললে? হাটে হাঁড়ি ভাঙা লেখা! এই রে! আমি অবাক হচ্ছি, আমি যে হাটে হাঁড়ি ভাঙার ব্যাপার-স্যাপারই লিখেছি, তুমি জানলে কি করে শুনি?
ধূর ধূর। আগন্তুক চাপা গলায় প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল।
পরমুহূর্তেই আগন্তুক বাবাজী একেবারে যন্ত্রচালিতের মতো দুম্ করে লাফিয়ে বন-বনের সামনে এসে দাঁড়াল।
সাক্ষাৎ অপচ্ছায়াটাকে আসতে দেখামাত্র বন-বনের মাথার টুপির লম্বা শিখরটা দুমড়ে মুচড়ে পিছন দিকে চলে গেল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে, আগন্তুকের আসার পথের দিকে থাকবার মতো সাহস তার হলো না।
ব্যাপারটা দেখে দার্শনিক প্রবর বন-বন অবশ্যই যারপরনাই অবাকই হলেন।
এটুকু সময়ের মধ্যেই আগন্তুকের চেহারা আর পোশাক পরিচ্ছদ অনুসন্ধিৎসু নজরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না দেখে তিনি পারলেন না।
হতচ্ছাড়াটা অসম্ভব লম্বা আর লাঠির মতো রোগাটে চেহারা। লাঠি নয় জ্যান্ত একটা সুপারি গাছ যেন তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে। ইয়া লম্বা চেহারাটা কুচকুচে কালো কাপড়ে তৈরি, গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা পোশাক দিয়ে। বছরখানেক আগে যে পোশাক পথে-ঘাটে দেখা যেত। যে দর্জি এগুলো তৈরি করছে সে ছিল নিতান্ত এক বামন, ছোটখাট আকৃতির মানুষ। যার জন্য পোশাকটা লম্বায় এত ছোট হয়ে গেছে যে, ধিঙি লোকটার গোড়ালির কাছে প্যান্টটা অনেকখানি ওপরে উঠে রয়েছে।
পোশাকের গরীবিয়ানার বিপরীত লক্ষণ নজরে পড়ছে তার জুতা জোড়ায়। জুতা দুটোকে রীতিমত চাকচিক্য করে তুলেছে এক জোড়া দামি ও ঝকমকে বক্লস্।
মাথায় ইয়া বড় একটা টাক চকচক করছে। মাথায় চুলের নাম-গন্ধও নেই। কেবলমাত্র ঘাড়ের কাছে একগোছা লম্বা চুল। বেশি পাকানো। সেটা পিঠের ওপর দোল খাচ্ছে।
আর চোখ? সবুজ চশমা দিয়ে চোখ দুটোকে ঢেকে রেখেছে। তার দুধারেও সবুজ কঁচ সেঁটে দেওয়া। যাতে তিলমাত্র আলোও চোখের মণিতে আঘাত হানতে না পারে সেজন্যই এ বিশেষ ব্যবস্থা। এরকম অদ্ভুত ব্যবস্থা করে রাখায় দার্শনিক কিন্তু আগন্তুকের চোখ দুটো দেখতেই পেলেন না। চোখের গড়ন যে কেমন তা জানা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হলো না।
আরও আছে। ইয়া লম্বা একটা গলাবন্ধ দিয়ে ঘাড় আর গলার সবটুকু জড়িয়ে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে আগন্তুক এমন জবরদস্ত পোশাক গায়ে চাপিয়ে এসেছে যার ফলে কেউ তাকে ধর্মযাজক মনে করলেও তেমন ভুল করবে না। আবার কথাবার্তায় ধরন-ধারণ আর ভাবভঙ্গি দেখলে এরকম সম্ভাবনার কথাই সবার আগে মাথায় আসে।
আরও আছে, আগন্তুক বাবাজীর বাঁ কানের ফাঁকে একটা কলম গোঁজা, কেরানিরা মাঝে মধ্যে লেখার ফাঁকে যেভাবে কলম গুঁজে রাখে, ঠিক সে কায়দায়ই সে কলমটাকে রেখেছে। আর কোটের বুক পকেট থেকে মাথা বের করে রেখেছে মোটা একটা বই। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় সেটা বুঝি আশ্রয়স্থল থেকে উঁকি দিচ্ছে। সেটার রং কালো। ইস্পাতের ক্লিপ দিয়ে আচ্ছা করে আটকে দেওয়া হয়েছে। বইটার বেরিয়ে থাকা অংশটুকুতে বড় বড় হরফে লেখা ক্যাথেলিক ধর্মানুষ্ঠান।
বিচিত্র আগন্তুকের পকেটে ধর্মগ্রন্থ দেখা গেলেও তার চেহারা ছবি আর পোশাক পরিচ্ছদ দেখলে সাক্ষাৎ শয়তান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে উৎসাহই পাওয়া যায় না। কত আর বলব, তার গায়ের চামড়া পর্যন্ত শ্বেতী রোগীর–না, মড়ার মতো ফ্যাকাশে বিবর্ণ। আর কপালটাকে তো একটা ঢিবি ছাড়া ভাবাই যায় না আর চোখে লাগার মতো চওড়া বটে। সে সঙ্গে অসংখ্য বলিরেখা যেন সেখানে মানচিত্র এঁকে রেখেছে।
ঠোঁটের কোণ দুটো ভেতরের দিকে বেঁকে ঢুকে গেছে অনেকটা। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় কেউ বুঝি জোর করে ঠেলে কান দুটোকে ভেতর খুঁজে দিয়েছে।
আগন্তুকের দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালে মনের কোণে একটা ভাবনারই উদয় হয়–শয়তানটা যেন বৈষ্ণবের মতো বিনয়ের অবতার। আর বিনয়ের ভারে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই আগ্রহি।
আগন্তুক এবার সচল হলো। সে দুহাতের আঙুল দশটাকে লতার মতো একটা সঙ্গে অন্য আর একটাকে পেঁচিয়ে ধরে কাহিনীর নায়ক পণ্ডিত প্রবরের দিকে গুটিগুটি সামান্য এগিয়ে আসতেই তার গা থেকে পরম বিশুদ্ধতা যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করামাত্র দার্শনিক বন-বনের মুখমণ্ডল থেকে ক্ষোভের ছাপটুকু নিঃশেষে মুছে গেল।
বন-বন আগন্তুকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ব্যাপারটাও সেওে নিলেন। এবার মুখে প্রসন্নতার ছাপ ফুটে উঠল। পাশের একটা চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে অনুরোধ করলেন।
আগন্তুকের চোখে-মুখেও প্রসন্নতার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। হঠাৎ হ্যাঁ, এভাবে হঠাৎ-ই দার্শনিক প্রবরের মনের পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার মূলে হয়তো আগন্তুকের বিটকেলে ভাবভঙ্গি, চেহারা ছবি আর পোশাক-পরিচ্ছদের প্রভাব কিছু না কিছু ছিলই। আর এ যদি না হয় তবে দার্শনিক মারাত্মক ভুলের ফাঁদে পা দিয়েছেন।
তার সম্বন্ধে আমার অন্তত যেটুকু জানা আছে, দার্শনিক বন-বনকে কেউ বাহ্যিক ব্যক্তিত্বের সাহায্যে কোনোদিনই বার করতে পারেনি–পারবেও না। সত্যি কথা বলতে কি, বন-বনের পক্ষে আগন্তুকের চরিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ তো হওয়া অসম্ভবও নয়। শুধুমাত্র এটুকুই নয়, আগন্তুক একেবারেই যে-ঢঙের টুপি মাথায় চাপিয়েছে, তার কথা বলে শেষ করা যাবে না। একে তো সুপারি গাছের মতো ধিঙি এক চেহারা। তার ওপর এমন বেখাপ্পা। একটা টুপি মাথায় চাপিয়েছে কেন? ব্যাপারটা তো খুবই গোলমেলে। ব্যাপারটা আসলে কি? তলায় শিং গজায়নি তো। শিং দুটোকে ঢেকে ঢুকে রাখার জন্যই কি এ পথ বেছে নিয়েছে?
আরে বাবা! প্যান্টের পিছন দিকটা কিভাবে ঠেলেঠুলে ওপরে উঠে গেছে রে বাবা! কেন? এমনটাই বা কেন হল? আর ঠেলে ওপরে উঠে-আসা জায়গাটাই বা ধিকধিক করে কাঁপাকাপি করছিল কেন? ল্যাজওয়ালা কোটটার পিছনের দিকও সে বারবার কাঁপাচ্ছিল কেন? কোন অদৃশ্য বস্তুর কাঁপুনির জন্য এমন বিঘুঁটে কাণ্ডটা ঘটছিল।
সামান্যতম অন্তদৃষ্টি থাকলেই সে সন্দেহটা মাথায় উঁকি মারে তা নিতান্ত আজগুবি মনে হলেও যে সত্যি, তাতে কিছুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
হ্যাঁ, অনুমান অভ্রান্ত। আগন্তুকের গজিয়ে ওঠা ল্যাজটার জন্যই প্যান্ট আর কোটের পিছন দিকটা বারবার তিরতির করে কাঁপছিল।
এরকম লোকটা সম্বন্ধে দার্শনিক প্রবর বন-বন অন্তরের গোপন করে চিরদিনই এক অসঙ্গত সম পোষণ করে এসেছেন। তাই তো সে লোকটার আকস্মিক আবির্ভাবে তিনি অবাক হলে সন্তুষ্ট যে হয়েছেন, এতে এতটুকুও ভুল নেই–সংশয়ও নেই সামান্যতম।
তবে এও সত্য, হাবভাব আর কথা বলার মাধ্যমে দার্শনিক কিন্তু আগন্তুককে এতটুকুও টের পেতে দিলেন না যে, তিনি তাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আহ্লাদে গদগদ হয়ে পড়েছেন আর এমন একজন লোকের দেখা পাওয়া যে নিতান্ত ভাগ্যের ব্যাপার তাও তাকে তিলমাত্রও বুঝতে দিলেন না। লোকটা যে মহা দরিবাজ বুঝতে পেরেও তার কাছে কিছুতেই তিনি ধরা দিলেন না। উপরন্তু মহাদার্শনিক বন বন কথার কায়দা-কৌশলের মাধ্যমে আগন্তুকের কাছ থেকে বেশ কিছু নতুন তত্ত্ব বুঝে নেবার জন্য সাধ্যতীত ধান্ধা চালাতে লাগলেন। নতুন বইটা লেখার ব্যাপারে এটা কম-বেশি সাহায্য করলে করতেও পারে।
শত হলেও অদ্ভুতদর্শন আর আশ্চর্য পোশাক-পরিচ্ছদে আবৃত আগন্তুকের বয়স তো আর কিছু কম নয়। তার জ্ঞানগরিমা আর নীতিজ্ঞান তো পৃথিবী বিখ্যাত ব্যাপার। এমন একজন বিশ্বনন্দিত লোকের মগজ থেকে কিছু সংখ্যকও বিতিকিচ্ছিরি ধারণাটা ছিনতাই করে নেওয়া যায়, তবে মনুষ্য জাতির যে অশেষ উপকার সাধিত হবে, আর সে সঙ্গে পণ্ডিত প্রবর বন-বনও অমরত্ব লাভে ধন্য হবেন, সন্দেহ কি?
মহাধড়িবাজ দার্শনিক বন-বন সবকিছুর উপলব্ধি করেও চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে তাকে আদর-যত্ন করে বসতে অনুরোধ করলেন।
দার্শনিক প্রবর জব্বর পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু হতচ্ছাড়া আগন্তুকের উদ্বোধনী ভাষণটার ঠেলাতেই পুরো মতলবটা পুরোপুরি বানচাল হয়ে গেল।
আগন্তুক ফিক্ করে হেসে উঠে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠল–চমৎকার! বলিহারী স্মৃতি শক্তি বটে! চিনে ফেলেছে দেখছি! কথাটা বলে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার যোগাড় হলো। সে কি বিচ্ছিরি হাসির ছিরি রে বাবা! গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
অট্টহাসির সঙ্গে সঙ্গে আরও দু-দুটো কাঁপানো ঘটনা ঘটে গেল। গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসার মতো ব্যাপারই বটে। শয়তান কুকুর হতচ্ছাড়াটার দিকে তাকিয়ে দাঁতের পাটি বের করা ঘেউ ঘেউ শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই বিড়ালটাও বিকট শব্দে আর্তনাদ করতে করতে ঘরের একবারে কোণে গিয়ে বিচ্ছিরি স্বরে খ্যাক খ্যাক করতে লাগল। আর সে সঙ্গে ল্যাজটাকে ফোলাতেও ভুলল না। গলার শিরা ফুলিয়ে চিল্লিয়ে, পিছনের পা দুটোকে বার বার এমন ছুঁড়তে আরম্ভ করল যে, তার আর কুকুরটার নিরবচ্ছিন্ন চিৎকারে আগন্তুকের অট্টহাসি চাপা পড়ে গেল।
শয়তানটার বুক পকেট থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা বইটার রং অদ্ভুতভাবে বদলে গেল। এমনকি লেখাও গেল একই রকমভাবে বদলে। লেখাটা আগে ছিল কালোর ওপর সাদা দিয়ে লেখা। এখন সেটা রক্তের মতো লাল রং ধারণ করেছে। আর আগে লেখা ছিল, ক্যাথেলিক ধর্মানুষ্ঠান। আর এখন দেখা যাচ্ছে, আভিশাপের ডাইরী লেখা রয়েছে।
একই সঙ্গে দুটো অভাবনীয় ঘটনা ঘটে যাওয়ায় দার্শনিক বন-বনের স্নায়ুগুলো বিকল হয়ে যাওয়ার যোগাড় হলো। বিস্ময়ে যেন তিনি একেবারে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি কোনো কথা বলতে না পারায় কেবল অসহায়ভাবে ঠোঁট দুটো নাড়াতে লাগলেন।
আগন্তুক শয়তানটা তার বেহাল পরিস্থিতি দেখে বলে উঠল–
থাক থাক খুব হয়েছে, আমি বুঝতে পারছি। কথা বলতে বলতে অন্ধকারের রাজা, সে এক হেঁচকা টানে চোখ থেকে চশমাটা খুলে সোজা পকেটে চালান করে দিল।
প্রথমের ঘটনা দুটোতে দার্শনিক বন-বনের নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছিল। এবার চোখ দুটো একেবারে কপালে উঠে গেল। এমন আজব কাণ্ড চোখের সামনে ঘটতে দেখলে কার না পিলে চমকে উঠবে?
আগন্তুক শয়তানটার চোখ দুটোকে নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তাই দার্শনিক প্রবর করেছিলেন। মোটেই সুবিধা করতে পারেননি। কিন্তু এখন সবুজ চশমাটা উধাও হয়ে যাওয়ায় তার চোখ দুটোর আকৃতি আর রঙ দেখে তার নিজের চোখ দুটোই যেন কপালে উঠে যাওয়ার যোগাড় হয়েছে। আপন মনেই আঁতকে উঠলেন–আরে বাবা! এ কী দেখছি হতচ্ছাড়াটার চোখে!
দার্শনিক বন-বন অনুমান করেছিলেন নচ্ছাড়টার চোখের রং কালো। কিন্তু এখন দেখছেন আসলে তা নয়। তবে? তার চোখের রং কালো, নীল, ধূসর, হলুদ, পিঙ্গল, সাদা, বেগুনি বা লাল কোনোটাই নয়। আকাশের কোনো রং তো নয়ই, এমনকি পাতালের রং-ও তার চোখে লক্ষিত হচ্ছে না।
দার্শনিক স্পষ্ট লক্ষ্য করলেন, নচ্ছাড় শয়তানটার তো চোখের কোনো বালাই-ই নেই। চোখ দুটোর কোটরে যা দেখা যাচ্ছে, তাকে মড়া চামড়া ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না। অদ্ভুত কোনো ঘটনার মুখোমুখি হলে তাকে মনের কোণে চেপেচুপে রাখা দার্শনিক প্রবর বন-বনের কোষ্ঠীতে লেখা নেই। তিনি মুখ খোলার আগেই শয়তানটার অনুচ্চকণ্ঠ শোনা গেল–
কি হে বনবন, আমার চোখ দেখবে বলে বড় আশা করেছিলে, তাই না? অকর্মার ঢেকী! জনা কয়েক চিত্রশিল্পী রং আর তুলির টানে আমার চোখ আঁকবে বলে বহু চেষ্টা করেছে। কয়েকটা আজে-বাজে নমুনাও কিছু বাজারে ছেড়েছিল বটে। সেগুলোর দিকে তাকালে ভেতর থেকে হাসি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। সেগুলোকে আমার চেহারা। আর চোখের বর্ণনা এমন লাগাম ছাড়া হয়ে পড়েছিল যে, প্রত্যেকটা ছবিকে রদ্দিমার্কা জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না। বন-বন, মানুষের কাছে নাকি চোখের কদর খুবই বেশি। চোখ ছাড়া কারো এতটুকুও চলার উপায় নেই। চোখ! হ্যাঁ, তোমার দু দুটো চোখ আছে, কিন্তু আমার একটাও নেই।
কিন্তু দার্শনিক সাহেব, মনে রাখবেন, আমার দৃষ্টি কিন্তু বড়ই অন্তর্ভেদী। কি? প্রমাণ চাচ্ছ? ভালো কথা, প্রমাণ দিচ্ছি। ওই যে ঘরের কোণায় বসে হুলো বিড়ালটা অনবরত ফুঁসে চলেছে, সেটাকে আমি যেমন দেখতে পাচ্ছি, তুমি কিন্তু মোটেই তা দেখতে পাচ্ছ না। চিন্তা-ভাবনা তার চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট, আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, তুমি তা পারছ না।
আরও আছে, তার ধারণায় আমি একজন পরম ধার্মিক-গীর্জার ধর্মযাজক। আর তুমি? তুমি একজন চালাকের পোশাকে বোকা দার্শনিক ছাড়া কিছু নও। তার মগজ ক্ষমতা, তার বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় কি, তুমিই বল?
অতএব এতেই প্রমাণ হচ্ছে, আমি মোটেই অন্ধ নই, মানছ তো?
সত্যি কথা বলতে কি, আমার কাছে চোখ দুটো নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ ছাড়া কিছুই নয়।
কথাগুলো বলেই আগন্তুক বাবাজী টেবিল থেকে মদের বোতল আর দুটো গ্লাস টেনে নিয়ে মদ ঢালল। তার একটা গৃহকর্তার দিকে বাড়িয়ে দিল আর নিজের হাতেরটা ঠোঁটের কাছে তুলে নিল।
এক চুমুক মদ গিলেই দার্শনিক বন-বনকে গ্লাসটা নামিয়ে টেবিলে রেখে দিতে বলল।
হুকুম হওয়ামাত্র দার্শনিক নিতান্ত বাধ্য শিশুর মতো হাত থেকে গ্লাসটা নামিয়ে টেবিলে রেখে দিলেন। শয়তানটা তার কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল–শোন দার্শনিক, বইটা কিন্তু ভালোই লিখেছ। তবে আমি বলব, তোমার ধ্যান-ধারণাকে আরও একটু গোছগাছ করে নিতে পারতে। আমি লক্ষ্য করেছি, অ্যারিস্টটলের চিন্তা ভাবনার সঙ্গে তোমার চিন্তার অনেকটাই মিল রয়েছে। যে কজন বড় বড় দার্শনিকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল, তাদের মধ্যে এ ভদ্রলোকও একজন। তিনি বস্তা-বস্তা লিখেছেন সত্য। কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যি কথা লিখেছেন মাত্র একটা। আমি তাকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম কথাটা নিতান্তই বিঘুঁটে।
আমি তাকে কি বলেছিলাম জানতে ইচ্ছা করছে, তাই না? তবে বলেই ফেলি, শুনুন–
আমি তাঁকে বলেছিলাম–ভাই, হাঁচি দিলেই অতিরিক্ত কথাগুলো নাকের ছিদ্র দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে যায়।
খ্যাক খ্যাক করে হেসে দার্শনিক বন-বন বলে উঠলেন–অবশ্যই। অহেতুক কথা বলেছেন ভাই!
আগন্তুক শয়তানটা আবার মুখ খুলল–এবার প্লেটোর কথা কিছু বলছি–সে ছিল আমার এক গ্রামের বন্ধু। চিনতে পারছ তো? বহুৎ আচ্ছা, বহুৎ আচ্ছা, আমি মার্জনা ভিক্ষা করছি।
আমি একদিন একটা খাঁটি সূত্র ধরিয়ে দিয়ে পিরামিডের ওপর গিয়ে বসলাম।
নিজের আচরণের কথা ভাবতে লাগলাম। মনে মনে বললাম–কাজটা মোটেই ঠিক করিনি। দার্শনিক-বন্ধু প্লেটোকে সাহায্য করতে গিয়ে এমন একটা খাঁটি মন্তব্য করা মোটেই ঠিক হয়নি। সত্যি কথা সব সময় কাউকে মুখের ওপর বলা মোটেই সঙ্গত নয়।
আমি আর মোটেই সময় নষ্ট না করে সোজা এথেন্সে ফিরে এলাম। বন্ধুবর পে টো তখন গ্রীক ভাষায় লিখতে আরম্ভ করেছে।
আমি তখন তার পাশে বসেছিলাম। আচমকা একটা টোকা মেরে লাম্বাডা অর্থাৎ রোমানস এলকে দিলাম উলটে, একেবারে চিৎ করে। ব্যস, মূল সূত্রটা গেল সম্পূর্ণ বদলে। আর সেটাই তার দর্শনের মূলসূত্রে পরিণত হয়ে গেল।
দার্শনিক বন-বন তার সারি থেকে চেম্বারলেন মদের বোতল বের করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন–আপনি রোমে গিয়েছিলেন কী?
রোমে?
হ্যাঁ, রোমে গিয়েছিলেন?
গিয়েছিলাম বটে, তবে মাত্র একবারই।
তাই বুঝি? মাত্র একবার?
আগন্তুক শয়তানটা এবার পাঠ্য বইয়ের পড়া মুখস্ত করার মতো এক নাগাড়ে বলতে আরম্ভ করল–দেশের মানুষ যখন গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে যাচ্ছিল, তখনই মাত্র একবার রোমের মাটিতে পা দিয়েছিলাম।
হুম! মাত্র একবার, তা–ও আবার বেশ কয়েক বছর আগে?।
দেশজুড়ে তুমুল আন্দোলন চলছিল। তাই তখনকার দর্শনশাস্ত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটার তেমন সুযোগ আমার মেলেনি।
ফিক ফিক করে হেসে বন-বন এবার বললেন–এপিকিউরাস সম্বন্ধে আপনার মতামত কি?
আরে ধ্যুৎ! ভাই, আপনি যে কি বলছেন তা আপনিই বোধহয় ভালো জানেন!
চোখ দুটো কপালে তুলে পণ্ডিত প্রবর এবার বলে উঠলেন–তার মানে? কি বলতে চাইছেন, খোলসা করে বলুন তো?
আপনি তো এপিকিউরাসের কথা জিজ্ঞেস করলেন? আরে ভাই, আমি নিজেই তো এপিকিউরাস।
আপনি, আপনিই–
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আগন্তুক শয়তানটা দাঁত বের করে বিশ্রি স্বরে হাসতে হাসতে বলল–হা-হা, আমি সেই দার্শনিক। আমি ক্রমান্বয়ে তিনশো নিবন্ধ রচনা করেছিলাম।
দার্শনিক বন-বন গুলি খাওয়া বাঘের মতো গর্জে উঠল–বাজে কথা!
বাজে কথা! আপনি বলছেন, আমি বাজে কথা বলছি? আমি দার্শনিক এপিকিউরাস নই?
না, অবশ্যই না। ধাপ্পা দেওয়ার আর জায়গা পাননি ভাই!
কি বললেন, আমি ধাপ্পা দিচ্ছি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি ডাহা মিথ্যে কথা বলছেন–সমানে ধাপ্পা দিয়ে চলেছেন। কথাটা বলেই দার্শনিক বন-বন মুখে ফি ফিক্ করে বিশ্রি একটা স্বর করলেন।
আগন্তুক শয়তানটা এবার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল–কি আর বলব, আপনি যা খুশি ভাবতে পারেন, বলতে পারেন।
তার কথায় বন-বনের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি এবার চেম্বারলেন-এর খালি বোতলটা টেবিলে রেখে আবার আলমারির দিকে এগোতে এগোতে স্বগতোক্তি করলেন–যাক, এবারও আমি বাজিমাত করেছি। তবে খুশির প্রমাণস্বরূপ মদের দ্বিতীয় বোতলটা খুলে শরীর ও মনটাকে একটু চাঙা করে নেওয়া যাক।
আগন্তুক শয়তানটা তার হাতের বোতলটার দিকে মুহূর্তের জন্যও না তাকিয়েই পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলল–সে কথা বলছি না, আপনার লেখাটা কিন্তু জুতসই হয়নি।
দার্শনিক চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালেন। সে বলে চলল–আমি কিন্তু হাজারবার বলতে রাজি আছি যে, আপনার লেখা মোটেই মনে দাগ কাটার মতো হয়নি। এটাকে আকর্ষণীয় করতে হলে প্রচুর পরিবর্তন-পরিবর্ধনে করা দরকার। ভালো কথা, আত্মা বলতে কী বোঝেন, বলুন তো?।
আত্মা? –আত্মা কি জানতে চাইছ, এই তো?
হ্যাঁ, আত্মা সম্বন্ধে আপনার মতামত জানতে চাই।
আত্মা?–আত্ম তো? ফিক্-ফিক্-ফিক্ আত্মা কি? কথা বলতে বলতে টেবিলের ওপরে রক্ষিত পাণ্ডুলিপির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আবার যেই মুখ খুলতে যাবেন, অমনি আগন্তুক শয়তানটা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল
থাক, থাক! আর বলার দরকার নেই।
বন-বন বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলেন।
আগন্তুক কথার খেই ধরে রেখেই বললেন–আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি এমন আত্মার দুটা ব্যাখ্যা হাজির করে বসবেন, ঠিক কিনা?
বন-বন আগের মতোই নীরবে তাকিয়ে রইলেন।
আগন্তুক বেশ কড়া স্বরেই বলে উঠল–দ্যুৎ! ভাই ওসব কোনটাই ঠিক নয়। যত্তসব বস্তাপচা ঘ্যান ঘ্যানানি!
দার্শনিক মহাপ্রভু বন-বন এবার আর উঁত করতে পারলেন না। হেরে গিয়ে আবার স্বগতোক্তি করলেন–যাক, যা হবার নয় তাই হয়ে গেল! এবার তবে চেম্বারলেনের তৃতীয় বোতলটা খোলা যাক। নেতিয়ে পড়া মনকে চাঙা করতে হলে মদই একমাত্র ভরসা।
ঢক ঢক করে মদ গিলে দার্শনিক প্রবর এবার ঘোলাটে চোখে আগন্তুক শয়তানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আত্মার ব্যাখ্যা দুটাকে তুমি যদি আমল না-ই দাও তবে আত্মা বলতে তুমি কি বলতে চাইছ, বল?
আরে ভাই আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যা করে কারো মধ্যে ধারণা জন্মানো কি এতই সহজ? চোখে বহু, বহু দুরাত্মাই তো দেখলাম।
কথা বলতে বলতে সে বুক পকেটের বইটার ওপর বার কয়েক হাত বুলিয়ে নিল। ঠিক সে মুহূর্তেই প্রবল হাঁচির উদ্রেক ঘটল। কোনোরকমে দম আটকে গিয়ে পরিস্থিতিটাকে সামাল দিয়ে নিল।
হাঁচিটাকে ঠেকিয়ে রাখার মতলবেই সে অতীতের বড় বড় দার্শনিক নাম এক নাগাড়ে বলে যেতে লাগল। কেবলমাত্র নামই নয়, তাদের কাণ্ডকারখানার কথাও একই। সঙ্গে বলে চলল। দার্শনিক বন-বন আগন্তুকের কথার জোয়ারে ভাসতে থাকলেও মদের গ্লাস কিন্তু হাত থেকে নামালেন না। বোতল থেকে গ্লাসে বার বার মদ ঢেলে অনবরত গলায় ঢালতে লাগলেন। একটু পরপরই নতুন বোতল আলমারি থেকে। নামাতে লাগলেন।
অন্ধকারের বাসিন্দা আগন্তুকও সমান তালেই মদ গিলে চলল। মদের নেশা তাকে জেঁকে ধরে কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর সে সঙ্গে একটু পর পর প্রবল হচির ব্যাপারটাও অব্যাহতই রইল।
দার্শনিক বন-বন তাকে এমন অদ্ভুত হাঁচির কারণ জিজ্ঞাসা করলে আগন্তুক শয়তানটা স্বাভাবিক কণ্ঠেই জবাব দিল। আরে ভাই, আর বলবেন না, স্যাঁতাতে জায়গায় থাকার জন্যই আমার ঠাণ্ডা লেগে এমন হাঁচি রোগ সৃষ্টি হয়েছে।
স্যাঁতস্যাঁত জায়গা? ব্যাপারটা ঠিক মাথায় গেল না তো! দার্শনিক ভ্রূ কুঁচকে কথাটা ছুঁড়ে দিলেন।
বুঝছেন না ভাই, মড়া ঘেঁটে ঘেঁটে আত্মাদের টেনে আনা তো আর কম কষ্টের ব্যাপার নয়!
মড়া। আত্মা! আত্মা-টাত্মা আবার কোত্থেকে এলো, বুঝছি না তো!
কোত্থেকে আসে সেটা বড় কথা নয়। আত্মার প্রকৃতি কেমন সেটা আগে শুনুন।
দার্শনিক বন-বন আর কথা না বাড়িয়ে আগন্তুক শয়তানের মুখ থেকে তার পরবর্তী বক্তব্য শোনার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় রইলেন।
আগন্তুক শয়তানটা পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলল–যে কথা বলছিলাম, আত্মা জিনিসটা কিন্তু প্রকৃতই খাসা। অভাবনীয়! অপূর্ব! আত্মাকে মূলত ছায়া ছায়া একটা পদার্থ মনে করা যেতে পারে।
একটা কথা তো আর কারো অজানা নয় যে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কালেই তো কতজন শয়তানের কাছে আত্মা বাধা রাখে।
দার্শনিক চোখের তারায় বিস্ময় ও অবিশ্বাসের ছাপ এঁকে তার মুখের দিকে তাকালেন।
তার বিস্ময়টুকু কিন্তু আগন্তুক শয়তানটার নজর এড়াল না। সে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে এবার বলল–কেন, মিথ্যে বলেছি? বহুলোকই শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বেঁধে দিয়ে আখের গুছিয়ে নেবার ধান্ধায় মেতে যায়।
এবার বুক পকেটের খাতাটা দেখিয়ে সে বলল–তাদের নামধাম সম্পূর্ণ বিবরণ এতে স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। শয়তান তাদের কত রকম উপকারই যে কওে, তার ইয়ত্তা নেই। কথা বলতে বলতে সে বার কয়েক ফাঁচ ফাঁচ করে হাঁচি দিয়ে নিল।
আগন্তুক শয়তান হাঁচির এ বে-আদপটাকে রুখতে গিয়ে নতুনতর আর একটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে বিশ্রি শব্দ করে বার বার ঢেকুর উঠতে আরম্ভ হয়ে যায়। মনে হল, তার বুক আর পেট বুঝি ফেটে একাকার হয়ে যাবে।
মহাধড়িবাজ দার্শনিক বন-বন তার এ সমস্যাটাকে নিজের কাজে লাগিয়ে নিজের মতলটাকে কাজে লাগাবে ভাবল। তাই তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়লেও নিজের স্বার্থের কথা মাথার ভেতরে ঠিক ধরে রেখেছেন।
হঠাৎ-ই তিনি বলে উঠলেন–আপনি তো একটু আগেই বললেন, আত্মা জিনিসটা মূলত ছায়া-ছায়া একটা পদার্থ–ঠিক কি না?
হ্যাঁ, তা তো বলেছিই। কথাটা বলেই আগন্তুক শয়তানটা ফাঁচ ফাঁচ করে বার দু-তিন হাঁচি দিল।
ফিক ফিক করে হেসে দার্শনিক প্রবর বললেন–আমার ধারণা কিন্তু অন্য রকম।
অন্য রকম? আত্মা সম্পর্কে আপনার বিশ্বাস কী? কথাটা বলেই আগন্তুক বার কয়েক ভেউ ভেউ করে ঢেকুর তুলে ফেলল। তারপর দার্শনিক মুখ খুলল–দেখ হে, আত্মা মানে চাটনি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আগন্তুক সচকিত হয়ে বলে উঠল–সে কি কথা! আপনি বলছেন, আত্মা মানে চাটনি!
ভালো কথা, যদি চাটনি বলে মেনে নিতে না পারো তবে মনে করো আত্মা মানে চপ-কাটলেট।
চপ-কাটলেট!
তা যদি ওটাও মেনে নিতে না পারো তবে মনে করো আত্মা মানে সসেজ–এবার আশা করি মানতে গড়রাজি নও, কি বল?
আত্মাকে আপনি সসেজ বলছেন!
হ্যাঁ, বলছি। একবার নয়, হাজারবার বলতে পারি–আত্মা মানে সসেজ।
কথাটা বলতে বলতে দার্শনিক বন-বন ফিক ফিক করে হেসে বার কয়েক আগন্তুক শয়তানটার পিঠ চাপড়ে আবারও বললেন–আত্মা মানে সসেজ, বুঝলে বাছাধন?
অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখে আগন্তুক শয়তানটা ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। চেয়ারটাকে পিছন দিকে ঠেলে দিয়েই আবার ফাঁচর ফাঁচর করে হাঁচতে শুরু করে দিল। আর সে সঙ্গে থেকে থেকে ভেউ ভেউ করে ঢেকুর তুলতেও ছাড়ল না। তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল–আপনার কথাবার্তা মোটেই ভদ্রজনোচিত মানে মার্জিত নয় মোটেই। অসভ্য বর্বরের মতো যা খুশি তাই বলে যাচ্ছেন! অসভ্য বর্বর কোথাকার!
শেষ শব্দটা উচ্চারণ করেই অন্ধকারের রাজা আগন্তুক শয়তানটা বাতাসে গোত্তা মেরে কি করে যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, দার্শনিক বন-বন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। কুকুরটা অনবরত অসভ্যের মতো ঘেউ ঘেউ আওয়াজ করে চলেছে। আওয়াজটাকে মুহূর্তে মেনে নিতে না পেরে অস্থিরভাবে প্রচণ্ড জোরে তার গায়ে একটা লাথি হাঁকিয়ে দিলেন।
আর আগন্তুক শয়তানটাকে লক্ষ্য করে চরম আক্রাশে দুম করে আস্ত একটা বোতল ছুঁড়ে দিলেন।
কিন্তু হায়! বোলতটা বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে উড়তে উড়তে ঝুলন্ত বাতিটার শেঁকলটায় গিয়ে আঘাত হানল। সরু-দুর্বল শিকলটা বোতলটার আঘাত সইতে না পেরে দুম্ করে ছিঁড়ে গেল ব্যস, আর যাবে কোথায়, বাতিটা আছাড় খেয়ে পড়ল দার্শনিক বন-বনের একেবারে ব্রহ্মতালুতে।
মহাদার্শনিক বিকট আর্তনাদ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।