মুনলাইট সোনাটা – ৬

মজুমদার বলল, সায়েব ওকে ফাঁদে ফেলে ধরেছিল, একেবারে কালেক্টরেটের ভিতরে। একহাজার টাকা ঘুষ নিচ্ছিল শুভময় সেন, নোটে সায়েবের স্বাক্ষর ছিল।

হয় না, আমি এটা বিশ্বাস করি না।

হয়েছিল, ওকে গান লাইসেন্স দপ্তর দেওয়া হয়েছিল, আসলে ও ছিল ডিজ-অনেস্ট।

বিশ্বাস করি না। আমি বললাম।

মানুষকে চেনা যায় না বাসু। মজুমদার বলল।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ও আলাদা ছিল।

আলাদা তো ছিলই, ও সাসপেন্ড হল। পরে চাকরি ফিরেও পায়, তার জন্য মল্লিক সায়েবকেই ধরতে হয়েছিল। তুমি এসব জান না?

না জানি না।

না জানাটাই তো অদ্ভুত! বলল মজুমদার। তবে মল্লিক সায়েবই বিষয়টা গোপন করে দিয়েছিলেন। সেন ওয়াজ দ্য পার্ট অফ দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। তিনি প্রশাসক, তিনি ব্যাপারটা মিটিয়ে দেন। ২৪ ঘন্টা জেল কাস্টডিতে থাকতে হয়েছিল তাকে, তারপর তিনদিন পুলিশ কাস্টডি, তারপর জামিন। জামিন পেয়ে সে অচিনপুর ছাড়ে এক ভোরে, আর ফেরেনি।

আমি অবাক হচ্ছিলাম। কিছুই জানি না! সেনকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল লোকনাথ মল্লিক। মনে পড়ল সায়েবের মুখের ত্রুরতা। সেই ডেভলপমেন্ট মিটিং, সুবিমলের রিপোর্ট, অনাহার নিয়ে আলোচনা। ক্ষিপ্ত মল্লিক সায়েব বলছিলেন, চাকরি কারও ফানডামেন্টাল রাইট নয়, খেয়ে নিতে কতক্ষণ। ইউ, বাসু, সাবধান হও, আমি কী পারি তা তুমি জান না, সবাই জেনে রাখো, তোমরা সরকারের লোক, সরকার বিপদে পড়ে এমন কোনো কিছু হলে শেষ করে দেব।

শুভময় সেন মন্তব্য করেছিল, কত তোর ক্ষমতা দেখি না। লিখেছিল চিরকুটে, আমাকে দিয়েছিল। সেই শুভময়কে জেল খাটিয়ে নিরুদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল লোকনাথ মল্লিক। তার দাদা এসে খোঁজ নিয়ে গিয়েছিল, শুনে স্তম্ভিত হয়েছিল। বিশ্বাস করেনি শুভময় ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়তে পারে। কেন নেবে ঘুষ, তার কোনো আকর্ষণই ছিল না টাকা পয়সায়। কতজনকে সাহায্য করে তাও বলে গেল। ধার নিয়ে কতজন তার টাকা মেরে দিয়েছে, তাও বলল। বলে গেল নির্মম জেলা শাসক ওর জীবন শেষ করে দিয়েছে।

তোমাকে বলে গিয়েছিল? আমি মজুমদারকে জিজ্ঞেস করলাম।

সে নির্লিপ্ত গলায় বলল, হ্যাঁ।

তুমি কী বলেছিলে?

মজুমদার বলল, শুনেছিলাম সে বাড়ি ফিরেছিল, কিন্তু সার্ভিসে আর আসেনি।

না না, তুমি কী বলেছিলে?

কিছুই না, শুনেছিলাম কথাগুলো।

তুমি কি মনে করো কাজটা ঠিক হয়েছিল?

ও থামছিল না। ওকে থামানোর দরকার ছিল। সায়েবের ক্ষমতাটা শো করার দরকার ছিল। ও প্রশাসনকে নষ্ট করে দিচ্ছিল। আর ও তো সত্যিই টাকাটা নিয়েছিল, ওর ড্রয়ারে পাওয়া গিয়েছিল।

সুনন্দা উঠে গেছে অনেক সময়। বিরক্ত হয়েছে। আবার সেই অচিনপুর! মজুমদারকে দেখে চঞ্চল হয়েছে সে। তার মনের ভিতরে হয়তো পুরোনো অপমানের স্মৃতি ফিরে আসছে। মজুমদার এসে ঠিক করেনি। সুনন্দার গানের গলা ছিল। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেনি। আমি জেলায় জেলায় চাকরি করেছি, সেখানে গানটা নতুন করে শেখা হয়নি, অফিসারদের নানা জমায়েতে গান গেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ওকে। সবাই বলত, বাহ, দারুণ, আপনি আপনার গান নিয়ে অনেকদূর যাবেন। জেলা শাসক, অতিরিক্ত জেলা শাসক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটদের যে জগৎ গড়ে ওঠে, সেখানে আমার বউ সুনন্দা বেশ ভালো জায়গা করে নিয়েছিল। গান তাকে করতেই হত। বাড়িতে কেউ এলেও গান শোনাতে হত তাকে। ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে তার গান বাধা। রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তীতে সুনন্দা ব্যতীত ছোটো শহরটিতে চলে না। গান শেখাতও রবিবারে। কত অনুরোধ, উপরোধে যে হার্মোনিয়ম নিয়ে বসতে হত তাকে, গাইতে হতো ”আজি যত তারা তব আকাশে ….”, সেই সময়টা আমাদের ভালো কেটেছিল অনেকদিন। আমাদের ছেলের তখন তিন বছর বয়স। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল সেই জেলা শহরের এক নার্সারি ইস্কুলে। অফিসের গাড়ি তাকে নিয়ে যেত, ফিরিয়ে আনত। সুনন্দাও যেত ছেলের সঙ্গে ওই ইস্কুলে। সে একটা চাকরি নিয়েছিল। তাকে খুশি করার লোকের অভাব হত না তখন। আমার হাতে এমন সব দপ্তরের ভার ছিল যে সবাই আমাকে খুশি করতে চাইত। ক্ষমতার একটা রং আছে, সেই রঙে সুখ আছে, সেই সুখ আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু তা চলেও যায় লোকনাথ মল্লিক জেলাশাসক হয়ে এলে। আমার ক্ষতি করে দিল সাংবাদিক বন্ধু সুবিমল।

নতুন জেলা শাসক মল্লিক সায়েবের বউ গান জানেন, রবীন্দ্র সংগীত শিখেছেন নাকি খোদ শান্তিনিকেতনে, তিনি বিশ্বভারতীর ছাত্রী, এসব খবর রটে যেতে দেরি হল না। মজুমদার নিজেই সেই কথা বলতে লাগল সবাইকে। আমাকেও বলল, খোদ শান্তিনিকেতনে শেখা, তা কি সুনন্দা বউদির মতো হবে? সকলের সামনেই কথাটা বলতে লাগল। ম্যাডামের ক্যাসেট বের করবার জন্য তিনটে কোম্পানি ঘুরছে। দূরদর্শনে তিনি কতবার গেয়েছেন। আকাশবাণীতেও।

মজুমদার জানত ক্ষমতার দরজা কোনদিকে। কোন পথে গেলে ক্ষমতার ছায়ায় দাঁড়াতে পারবে সে? তখন সেও ক্ষমতার ছিটেফোঁটা পাবে। সে তার ডিউটি আওয়ার্স বদলে নিয়েছিল নতুন ডি.এম. আসতেই। সকালে বাজার করে বাংলোয় হাজির হত। নীচে বসে থাকত। সায়েব বা মেম সায়েব কখন ডাকবেন। সকাল আটটা থেকে রাজ আটটা পর্যন্ত ছিল তার ডিউটি আওয়ার্স। বাংলোর অফিসে মজুমদার পড়ে থাকত। তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সুবিধে-অসুবিধে দেখত। লোকে বলত মজুমদার এমনই ছিল কর্তাভজা, যে বললে সে কর্তা গিন্নির জামাকাপড় কেচে দিতেও পারে। কিন্তু কেন, মজুমদার কী পেয়েছিল এর পরিবর্তে? পেয়েছিল অপরিমেয় ক্ষমতা। সে অসন্তুস্ট হলে জেলা শাসকও অসন্তুষ্ট হবেন, এটা আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল। জেলা শাসকের অনুগ্রহ পেতে সে ছিল সবচেয়ে বড়ো খুঁটি।

নতুন জেলা শাসকের বউ শান্তিনিকেতন ফেরত এ কথা জানার পর মজুমদার সুনন্দাকে বাদ দিয়ে দিল আগের জেলা শাসকের ফেয়ারওয়েলে তার গানের পর। সেখানে নতুন জেলা শাসক লোকনাথ মল্লিকের স্ত্রীও ছিলেন। তিনি গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান। তারপর সুনন্দা। সুনন্দার গলায় মধু। আগের জেলা শাসক কী প্রশংসাই না করে বিদায় নিলেন জেলা থেকে। তাতে মল্লিক সায়েবের স্ত্রী একটু অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু সুনন্দা তো গেয়েই যাচ্ছিল। মল্লিক সায়েবের স্ত্রী তাকে পছন্দ করত না এটাও জানি। কিন্তু আমার বন্ধু সাংবাদিক সুবিমল রায় যখন জেলায় অনাহারে মৃত্যুর রিপোর্ট করল, আমি এবং সুনন্দা জেলা শাসক ও তাঁর স্ত্রী বিষ নজরে পড়ি। বড়ো সায়েব পছন্দ করেন না, তাই মজুমদারও অপছন্দ করতে লাগল। জেলা উৎসব থেকে বাদ গেল সুনন্দা। মজুমদার জেলা শাসক ও তাঁর স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে কোনো কিছু করতেই পিছপা হত না। এই ঘটনা শ্রেয়া চৌধুরীর ঘটনার পরে ঘটে। জেলা উৎসবে সুনন্দা ডাক না পেয়ে অবাক। আমি মজুমদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মজুমদার বলেছিল, সেই স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছতে পারেনি সুনন্দা।

কোন স্ট্যান্ডার্ড?

আরে ম্যাডামের ক্যাসেট বেরিয়ে গেছে, টিভিতে তাঁর গান দেখায়, উনি তো সিলেক্টর।

কিন্তু ওর গানের গলা তো ভালো না।

কে বলল ভালো না, সবাই বলছে দারুণ, সুচিত্রা মিত্রর মতো।

দেখ মজুমদার, ওঁর গানে ভুল থাকে অনেক, আমার যেন রোখ চেপে গিয়েছিল।

মজুমদার দলল, তুমি ভুল ধরতে পার?

সুনন্দাই বলে।

তোমার বউ গান জানে? নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করে মজুমদার।

তোমার কি মনে হয়? রাগ চেপে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

দ্যাখো অচিনপুর উৎসব কোনো পাড়ার ফাংশন নয় যে এলি-তেলি সবাইকে স্টেজে তুলে দেওয়া হবে। বাইরে থেকে কত লোক আসবে তখন। বদনাম হয়ে যাবে। বড়ো ম্যাম সমস্ত প্রোগ্রাম তৈরি করছেন, উনি যা বলবেন তাই হবে।

বড়ো ম্যাম গাইবেন?

সে উনি জানেন। উনি তো নিজেকে রাখেননি। এম.পি., এম.এল.এ, সবাই বলল, কী করবেন উনি, তারাই বলেছে ওঁকে গাইতে হবেই, সত্যিই তো, ওঁর শিল্পী সত্তা নিয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই, এম.পি. ওঁকে দিল্লিতে বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসবে নিয়ে যাবেন, মার্চের এন্ডে।

সেদিন দেখেছিলাম মজুমদারের চেহারা। যেন আমাকে আর সুনন্দাকে অপমান করতেই আমার চেম্বারে এসেছিল সে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ধীরে ধীরে কথাগুলি বলে যাচ্ছিল সে। কী রকম অনায়াস ছিল তার উচ্চারণ। বলছিল সে অনেক চেষ্টা করেছিল সুনন্দাকে রাখতে, হতেও পারে যদি সুনন্দা একবার মিসেস মল্লিকের কাছে যায়। একটা অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে ওঁর হাতে দেয়। লোকাল আর্টিস্টদের জন্য দুপুরে একটা স্লট রাখার কথা ভাবা হচ্ছে।

আমি বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ মজুমদার, থাক এসব কথা।

মজুমদার বলেছিল, তুমি মিসেসকে বলো বড়ো ম্যামের কাছে যেতে, আমিই নিয়ে যাব।

খুব অপমানিত লেগেছিল। আমি বলেছিলাম, ধন্যবাদ মজুমদার, কোনো প্রয়োজন নেই।

যাবে না!

না। আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, থাক এসব কথা।

উনি চাইছেন সুনন্দা বাসু ওঁকে রিকোয়েস্ট করুন।

চাইলে তো হবে না, সে যাবে না।

ম্যাম ডাকলে তো যেতে হবে বাসু।

কেন বলো দেখি?

মজুমদার বলল, তোমার প্রয়োজনেই তোমার বউকে ম্যামের কাছে যেতে বলো।

কী প্রয়োজন? আমি বিস্মিত হয়েছি।

তুমি কি জান না?

কী জানব? আমি আরো অবাক।

তোমার বিরুদ্ধে সার্ভিস রুল ব্রেকের চার্জ আসছে, তুমি জান না?

না, আমি কী করলাম?

মজুমদার বলল, তুমি ডি. এম. স্যারের কাছে যাও।

কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলো দেখি।

তুমি কী সব মিথ্যে রিপোর্ট দিয়েছিলে তোমার রিপোর্টার বন্ধুকে, অনাহার কেস।

আমি! কে বলল?

তুমিই তো তাকে বড়ো সায়েবের কাছে নিয়ে এসেছিলে, সে বলে গিয়েছিল যা যা জানার সব জেনে নেবে তোমার কাছ থেকে। এনকোয়্যারি হয়েছে, অনাহারের মতো কোনো ঘটনা এখানে নেই, গাড়ির লগ বুক বলছে তুমি ওই মার্চে ধুলোপাড়ায় গিয়েছিলে, সঙ্গে ছিল তোমার ওই বন্ধু।

বুঝতে পারছিলাম সুবিমলের রিপোর্ট আমাকে বিপদে ফেলেছে। ঘটনা সত্যি। সুমিবলকে আমি ঘুরতে নিয়ে গেছিলাম সরকারি গাড়িতে করে। এটা তো হয়েই থাকে। সে ধুলোপাড়ায় যেতে চেয়েছিল। ট্রাইবাল গ্রাম দেখবে। তারিখ উল্লেখ ছিল তার প্রতিবেদনে। গাড়ির লগ বুকের সঙ্গে মিলে গেছে সেই তারিখ। অস্বীকারের কোনো জায়গা নেই।

মনে হয়েছিল, মজুমদার ওই কথা নিয়েই এসেছে আমার কাছে। সুনন্দার বাদ যাওয়া ওই কারণে। মজুমদার চাইছে আমি ডি. এমের কাছে গিয়ে মার্জনা চেয়ে আসি। চিঠি বেরনোর আগে তা হলে হয়তো আমি বেঁচে যাব। সে ব্যবস্থা মজুমদার করবে। রিপোর্টার বন্ধুই তোমাকে ফাঁসিয়েছে বাসু, ওরা জীবনে এই রকম ক্ষমতার অলিন্দে আসতে পারবে না, তাই যত রাগ সরকারি চাকুরেদের উপর। সত্য-মিথ্যায় তাদের ফাঁসায়।

কথাটা অসত্য নয়। সুবিমল আমাকে বলেওনি অথচ লিখে দিল, সে ওটা ঠিক করেনি। আমার চাকরিকে সুবিমল কি ঈর্ষা করেছিল? লিখবে ওই খবর তা আমাকে জানায়নি কেন? জানালে আমি ওকে ডি. এমের কাছে নিয়ে যেতাম না। কিন্তু পাওয়ারের সঙ্গে লড়ার সাধ্য কি সুবিমলের আছে? রিপোর্ট হল, কদিন হৈ হৈ হল, জেলাশাসক মিটিঙে বললেন, সরকারি তথ্য যিনি দিয়েছেন, তার চাকরির বারোটা বাজিয়ে দেবেন তিনি। তাঁর কী রোষ সেই ডেভলপমেন্ট মিটিঙে। আমার অ্যানুয়াল কনফিডেনসিয়াল রিপোর্টে চাকরির ক্ষতি তিনি করেছিলেন। চার্জশিট তৈরি হয়েছিল, শেষে দুটো ইনক্রিমেন্ট বাদ গেছিল। আমার বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ আনা হয়েছিল। জেলা থেকে বদলি হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অনেকদিন লেগেছিল প্রশাসনের কাছে বিশ্বাস অর্জন করতে। আর সেই অনাহারের রিপোর্ট মিথ্যে বলে প্রশাসন জবাব দিয়েছিল। এনক্যোয়ারি করেছিল মজুমদার। বড়ো সায়েব যেমন চেয়েছিল সে তেমন রিপোর্ট দিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *