মুনলাইট সোনাটা – ৪

সুনন্দা বলল, তোমার সেই সুবীরদা কোথায়?

কী করে জানব?

আমরা যদি অমনি হতে পারতাম! পারতে তুমি?

আমি বললাম, যে যেমন ভাবে জীবন কাটায়, আমি মনে করি না ওই জীবন খুব আনন্দের, সুবীরদা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগই করল না, আমাদের ছেলেও তো সান-দিয়েগোতে থাকে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে।

ছেলের বিয়ের সময় অনেক কষ্টে ফোন নম্বর জোগাড় করে এক রাতে ফোন করেছিলাম সুবীর ভদ্রকে। কথা বলা যায়নি। রোগীর বাড়িতে বসে আছেন তখন। ধরেছিলেন এক মহিলা, খুব সম্ভবত দক্ষিণ ভারতীয়। ওই টানে ইংরেজিতে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে। বলতে তিনি জানালেন ডক্টরবাবু পেশেন্টের বাড়ি, ফিরলে সব বলা হবে, ইফ হি লাইকস, রিং ব্যাক করবেন আপনাকে।

বলতে বলতে ফোন কেটে দিয়েছিলেন তিনি। তারপর অবশ্য ফোন আর আসেনি। সুবীরদা হয়ত শুনে খুশি হননি যে আমার ছেলে অভিরূপ ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে থাকে। মামা মাসিদের পরিবারের ভিতর সুবীর সরকার সবচেয়ে মেধাবী, সেই প্রথম বিদেশ যাত্রা করেছিল। তারপর শুনেছিলাম বড়ো মাসির নাতনি গেছে। ওদের সঙ্গে আমার তেমন যোগযোগ নেই।

যাক এসব কথা কি আর নতুন? এ তো সব পরিবারে আছে। মেসো আক্ষেপ করতেন, সুবীর অত মেধাবী হয়েও শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে এল। আরও দুঃখের কথা, পড়ে থাকল কর্ণাটকের মফসসলে। আমার ছেলের বিদেশ যাওয়া যখন সেটল হল, মেসো আমাকে বলেছিলেন, যেন ফিরে না আসে। এ-দেশে থেকে কারওর কিছু হবে না। জীবনকে যদি ভোগ করতে হয় ওই আমেরিকা ইংল্যান্ডে যেতে হয়। সত্যিই তো, আমরা কী করলাম এ জীবনে? যা আনন্দ তা যেন ছেলেকে দিয়েই পূরণ করে নেব। ওকে বিদেশ পাঠাব, এ আমাদের পণ ছিল। দুজনেই ত্যাগ করেছি অনেক কিছু। আমার বউ-এর গলায় কতটা না গান ছিল, সে ছেড়েই দিল সব।

আমেরিকা থেকে উড়িয়ে নিয়ে এসে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলাম। খুব ধুম হয়েছিল তখন। বিনা পণে ছেলের বিয়ে দিয়েছি। বিয়েতে কোনো উপহার নিইনি। লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদই ছিল প্রার্থনীয়। লোকে ধন্য ধন্য করেছিল। ছেলে যেমন আমার একটি, বউমাও বাপ-মার এক মেয়ে। গান জানা মেয়ে। ওদেশের বঙ্গ সম্মেলনে গায় শুনেছি। প্রশংসাও পায়। আমরা যা করেছি, সব পাবে তারা। মানুষ শুধু নিজের সুখের জন্য জীবনপাত করে না, তার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, সাতপুরুষ যাতে সুখে থাকে তার ব্যবস্থাও পারলে করে রাখে। সাত পুরুষের জন্য টাকা পয়সা, ভূ-সম্পত্তির ব্যবস্থা করে যায়। তবে আমরা আর কী দেব ওদের। আছে যে ঢের। এর ভিতরে যা সঞ্চয়, তা আমাদের সারাজীবনে হয়নি।

আজকাল সুনন্দার সঙ্গে তেমন কিছু কথা হয় না। সেও বলে না, আমিও বলি না। সে টিভির সামনে বসে থাকে, আমিও। নানা রকম উত্তেজক খবর আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। ভোটের আগে, ভোটে কী হতে পারে তা নিয়ে আমরা খুব মগ্ন থাকতাম। যে যে চ্যানেলে পার্টি নিয়ে খুব কোঁদল হতো সেই সেই চ্যানেল নিয়ে পড়ে থাকতাম। বউ অবশ্য এরই ভিতর একটা গানের চ্যানেলেও শিফট করত। রবীন্দ্রসংগীত শুনত অনেক সময় ধরে। তখন আমি বিরক্ত হতাম। আমি আমাদের নিস্তব্ধ নিরুত্তাপ জীবনে টেলিভিশনের ওই সব কোঁদল, খুনজখমের বিবরণে একটু উত্তাপ আসত। আমি আমার উত্তেজনা প্রকাশ করতাম, বউ চুপ করে থাকত। কখনও কখনও ও উত্তেজিত হয়ে যে উঠত না, তা নয়। সেই যে এক বিডিওর মৃত্যু নিয়ে নানা মত, উপরওয়ালার চাপে সে আত্মহত্যা করেছিল, না তাকে হত্যা করা হয়েছে, এ নিয়ে আমাদের দুজনের ভিতরে মতানৈক্য প্রবল। তার মত হল, যাই হোক, ওই সৎ বিডিওকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যার দায় ওর উপরওয়ালা এড়াতে পারেন না। আমার মত তার বিপরীত। আমি সেই বড়ো কর্তা প্রশাসনের পক্ষে। বিডিও ছেলেটির উচিত ছিল বড়ো কর্তার মত অনুসরণ করা। আমার জীবনে কি আমি সব কাজ ঠিকঠাক করেছি, জানি করিনি। তাতে কি আমি বেঁচে নেই?

বিডিও তো অন্যায় না করেই মরেছে। আমার বউ সুনন্দা বলে।

তা হলে অন্যায়টা করতেই পারত। আমি বলি, এ জীবনটা শেষ করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আমার কথায় সুনন্দা রেগে যায়, বলে, সবাই তোমার সেই মজুমদার হতে পারে না, তুমি পেরেছিলে?

এই ভাবে আমাদের দিন যায়। এমনও হয় অনেকটা সময় আমরা বসে আছি একা। কেউ কোনো কথা বলছি না। টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছি, কিছুই দেখছি না। সুনন্দা চ্যানেলের পর চ্যানেল সার্ফ করে যাচ্ছে। কোথাও স্থির হয়ে থাকছে না। আমি উঠি, ব্যালকনির অন্ধকারে যাই, ফিরে আসি। টেলিভিশনে কোনো শব্দ নেই। তখন আমাদের ঘরে বোবা মানুষে কথা বলে, গান গায় নৈঃশব্দের ভাষায়।

সেই লোকটা আমার বাড়ির কাছে। কেমন চেনা লাগছে। হাঁটার ভঙ্গী চেনা। কে যেন, কার কথা মনে পড়ছে যেন। না সে হবে কী করে? আমি উপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। অনেকদিন বাদে আমাদের বাড়িতে একটা লোক এল মনে হচ্ছে। না হতেও পারে। এই সেদিন বৈশাখী নামের আবাসন থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল, তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল অনুপম, আমার সহকর্মী। এগোতে গিয়েই মনে পড়ে গেল অনুপম সুর বছর খানেক আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমার চেয়ে বছর সাত-আট ছোটো ছিল ও। হৈ হৈ করে বাঁচতে ভালোবাসত। চমৎকার ছিল গানের গলা, গাইত কিশোর কুমারের গান। গাতা রাহে মেরে দিল, … কী টান না দিতে পারত অনুপম, সুনন্দা ওর সঙ্গে গলা মেলাত। রফি আর লতা। একদিন হলো গাইড সিনেমার সব গান, রফি, কিশোর, … ওহ কৌন হে তেরা মুসাফির, জায়েগা কাঁহা — শচীনদেবও গাওয়া হয়েছিল। খবরের কাগজ পড়ে বুঝেছিলাম সেই অনুপম, বারাসতে অতিরিক্ত জেলা শাসক হয়েছিল। আমি সুনন্দাকে খবরটা দিইনি। কাগজটাই সরিয়ে রেখেছিলাম। টিভির চ্যানেল বদল করে দিয়েছিলাম। কেন তা আমি জানি না।

একদিন বিকেলে ব্যালকনিতে বসে দেখলাম লোকটি আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ, লোকটা আমাদের বাড়িই এসেছে। প্রায় বুড়ো, কিন্তু ঠাঁটে-বাটে বেশ। মাথার চুল ঘন কালো, ডাই করা বোঝায় যায়, জিনস, চেক হাওয়াই শার্ট, পায়ে দামি শ্যু। পকেট থেকে উঁকি মারছিল দামি সিগারেটের প্যাকেট। তাকে চিনলাম, তুমি মজুমদার না?

তখন বেলা পাঁচটার মতো। গ্রীষ্মের দিন তাই রোদ বেশ। মজুমদার বলল, আমাকে যে চিনতে পারবে তা ভাবিনি। অচিনপুরে আমরা এক সঙ্গে ছিলাম।

হ্যাঁ, মেদিনীপুরেও, এস ভিতরে এস।

মেদিনীপুরে আপনি ডেপুটি, আমি জয়েন্ট বিডিও।

অচিনপুরে তুমি ডি.এম.-এর কনফিডেনসিয়াল অ্যাসিস্টান্ট। আমি বললাম।

মজুমদার হাসে, ডাক দেয়, ম্যাডাম কেমন আছেন, আপনার ছেলে তো আমেরিকায়, জানতাম এদেশে থাকার নয়, আমার জামাই থাকে ইংল্যান্ড।

নিচে বসার ঘর। অতিথির জন্য সুন্দর করে সাজান। নরম গদিতে বসতে বসতে মজুমদার বলল, ঠিকানাটা ছিল তোমার ছেলের বিয়ের কার্ডে, বিয়েতে আসতে পারিনি, কার্ডটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম বলে আসতে পারলাম। দাদা, ম্যাডাম এখনও গান করেন?

তুমি রিটায়ার করে গেছ?

রি-এমপ্লয়মেন্টে আছি, যতদিন পারি করব, করব নাই বা কেন?

তা ঠিক, আমার আর ইচ্ছে করল না।

আমি তিন মাস বসে ছিলাম, বসে বসে হাঁপিয়ে উঠলাম। বুঝলাম পারব না। এত বছর চাকরি করলাম, এত চেনা, চিফ সেক্রেটারি পর্যন্ত, আমি তো সবাইকে সার্ভিস দিয়েছি, সবাই আমাকে লাইক করতেন, শেষে কিনা মিউনিসিপ্যালিটির এক্সিকিউটিভ অফিসার। আমি করিনি, পরে ভালো অ্যাসাইনমেন্ট পেলাম, করছি।

ঠিক সেই রকম রয়েছে মজুমদার। তার বৃত্তান্ত বেশ লাগছে। বহুদিন বাদে সেই অফিস, উপরওয়ালা, অধঃস্তন কর্মচারী, নানা প্রসঙ্গ ভেসে আসতে লাগল। পুরোনো কথার স্বাদ আলাদা। ভালোই লাগছে। সুনন্দা একটু বসে, চা দিয়ে কিচেনে ঢুকে গেছে। বহুদিন বাদে মজুমদার এসেছে, তাকে কিছু ভালোমন্দ খাওয়াবে। আমি মজুমদারকে জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলল, সেই শ্রেয়া ম্যাডামকে মনে আছে বাসু তোমার?

মুখ টিপে হাসলাম, বললাম, মজুমদার, তুমি শ্রীবাস্তবকে সুযোগ করে দিলে।

মজুমদার বলল, ম্যাম এখন দিল্লিতে, হোম মিনিস্ট্রিতে। সেইবারেই আই.এ.এস হয়েছিল, আমার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে।

তুমি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছ মজুমদার, শ্রীবাস্তব কোথায়?

গগন সাব পটনায়, যোগাযোগ আছে। গিয়েছিলাম দেখা করতে, আমাকে পটনায় চাকরি দিচ্ছিলেন, ভালো সুযোগ ছিল। কিন্তু শেষ অবধি না করলাম। স্যার বলেছেন যখন প্রয়োজন জানাতে। কলকাতায় এলে আমিই সব হাউস, গাড়ি থেকে সব ব্যবস্থা করে দিই।

কী ব্যবস্থা?

উনি যা চান। মজুমদার হাসল।

এখনো দরকার হয়? আমি জিজ্ঞেস করি।

আর্য রক্ত না, আর হলো কি ওঁর ওয়াইফ…। থেমে যায় মজুমদার। কথাটা সম্পূর্ণ করল না, জিজ্ঞেস করলাম, মজুমদার ব্যাপারটা মল্লিক সায়েবের কানে গিয়েছিল?

মজুমদার বলল, কী কানে যাবে বলতো?

ওঁর ভাগ্নী আর শ্রীবাস্তব?

মজুমদার হাসে। বলে, তুমি ভোলোনি তো।

না, কিছু কিছু কথা মন থেকে সরে যায় না।

তুমি কি সব শুনতে চাও? মজুমদার বলল।

এখন শুনলে কী হবে, হাই প্রোফাইল পার্সন, ওদের কত ক্ষমতা, ওদের কাছে ওসব কিছুই না। লাইফটাকে পাওয়ার দিয়ে এনজয় করতে জানে ওরা। কিন্তু একেই কি ভোগ করা বলে?

তাহলে কাকে ভোগ করা বলে? মজুমদার বলল।

আমি চুপ করে থাকি।

যে ভোগ করছে সে জানে কী ভাবে ভোগ করতে হয়। আরে এসব ওঁদের কাছে জাস্ট এনজয়মেন্ট, ফান। আর শ্রীবাস্তব সায়েবের আর্য রক্ত, তার তেজ কি কম হতে পারে? ওঁর কাছে সবটাই স্বাভাবিক, আরে আর্যরা তো রমনী লুট করত, আগের দিনের সুলতান বাদশাদের ভিতরও ওই রক্ত ছিল, হারেমের কথা শোনোনি? আর মেয়েটাও ছিল ওর যোগ্য, অমনি হয়, তারপর হয়ত ওদের দেখা হয়নি, দেখা হলেও হাই-হ্যালোতেই শেষ।

যোগাযোগ আছে তোমার?

হ্যাঁ, শ্রীবাস্তব সায়েবের ছেলে খুব ব্রিলিয়ান্ট। ওকে আই.এ.এস. করবেন।

তাই তো হবে, বংশপরম্পরায় শাসনের একটা মোহ থাকে।

সায়েবের বাবা বিহার স্টেট সার্ভিসে ছিলেন।

তুমি শ্রীবাস্তবকে যা দিয়েছিলে, সে তোমাকে মনে রাখবেই।

দুজনকেই দিয়েছিলাম সুযোগ করে, তবে সকলের মনে থাকে না, আর আমি তো ছিলাম পাহারাদার, ওরা দুজনেই যখন তা চাইছিলেন, আমি কী করব বাসু?

বড়ো সায়েব তোমাকে জিজ্ঞেস করেননি?

মজুমদার মাথা নাড়ে, বলতে থাকে, বড়ো সায়েব এতে মাথা দেননি। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করতে, শুনেছি, দুজনেই অস্বীকার করেছিল। গগন শ্রীবাস্তব ওকে ইন্টারভিউ-এর জন্য তৈরি করেছিল। এতে সন্দেহের কী আছে? বাসু জগৎটাকে তুমি জানলে না, এসব কিছু না। আমার সামনে ওঁরা বনবাংলোয় সমস্ত দুপুর, আমি অন্য ঘরে বসে আছি। মেয়েটি আর সায়েব হাসতে হাসতে ঘরে গিয়ে ঢুকেছে, ইন ফ্যাক্ট শ্রীবাস্তব সায়েব-ই ওকে টেনে নিয়ে ঢুকেছে বাংলোর নিঃঝুমতার ভিতর। আর সেই মেয়ে যেন খাঁচা ছাড়া পাখি, পাহাড়ি ময়না।

তোমার খারাপ লাগেনি?

খারাপ লাগবে কেন? আমি সামান্য মানুষ, জয়েন্ট বিডিও তে ঘষে ঘষে শেষে প্রমোশনে ডেপুটি। তবে আমি ছ’মাস ব্লক করেছি, উঠে এসেছিলাম মল্লিক সায়েব, আমাদের ডি. এম-এর সুপারিশে, গগন শ্রীবাস্তব তখন প্রথম এসেছে। আমি বুঝেছিলাম নিরাপত্তা আর ক্ষমতার জন্য ক্ষমতাধারীর ছায়ায় থাকতে হয়। তুমি কি ভাবতে আমি বলতে পারব না বাসু, কিন্তু আমি জানতাম প্রাইমারি টিচারের ছেলেকে আরো আরো উপরে উঠতে হবে, আরো সিঁড়ি ভাঙতে হবে। বাবাকে এক এস. ডি. ও-র রক্ষী ঘাড় ধরে চেম্বার থেকে বের করে দিয়েছিল। বাবা বাড়ি এসে বিষ খান, তুমি কি এসব জানো বাসু, প্রশাসন নির্মম হয় ক্ষমতাকে জাহির করতে, ধরে রাখতে।

পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল। মজুমদার এত বছর বাদে এল কেন তা আমি ধরতে পারছি না। শুধুই দেখা করতে? পুরোনো কথা বলাবলি করতে? যে কারণেই আসুক মজুমদার, সে-ই বলবে। ও বিষয়ে আমার কোনো কৌতূহল নেই। সুনন্দা এল, বলল, আপনি কি ড্রিঙ্কস নেবেন?

ম্যাডাম আমার বন্ধ।

ছেলে এনেছিল, ও একা বলে খায়নি।

আমি বসে আছি, বাসু নিক, আপনি নিন।

সুনন্দা হাসে, আমার গা গুলোয়, পারব না।

তাহলে থাক, আমাকে বারণ করেছে, এক ড্রপও লিভারের পক্ষে বিপজ্জনক।

আপনি কি খেতেন?

মজুমদার বলল, সায়েবরা বসলে আমাকে থাকতে হত, বসলে আমাকেও নিতে হত। তবে কি, আসলে যাঁরা খেলেন, তাঁদের কিছু হল না, প্রায় না খেয়েই আমার হেপাটাইটিস। দিল্লির এইমস-এ ছিলাম একমাস, ম্যাডাম শ্রেয়া চৌধুরী সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ওর জন্য বেঁচে গেছি। ভাজাভুজি খাই না, আপনি ভাববেন না, বসুন।

না আপনারা গল্প করুন, বউমা অন-লাইন আসবে একটু পরেই, উপরে যাই। বলতে বলতে সুনন্দা উঠে গেল। মজুমদার বিড়বিড় করল, আসলে ওসব সায়েবদের জন্য তৈরি, আমাদের কি সহ্য হয় বাসু? বনবাংলোয় ওঁরা পাশের ঘরে, আমাকে হঠাৎ ডাকলেন শ্রীবাস্তব সায়েব, মজুমদার, এই মুজুমডার, হ্যোয়ার আর ইউ মুজুমডার।

মজুমদারের তখন ঝিমুনি এসেছিল ভরা ভাদ্রের দুপুরে। নিঃঝুম বনবাংলো। লাঞ্চ প্যাকেট তার সামনের টিপয়ে। সায়েব ম্যাডাম ড্রিঙ্ক করে খাবেন। বড়ো একটি হুইস্কির বোতল সায়েবের হুকুমে এনেছে মজুমদার। তাঁরা দুজনে পাশের ঘরে। বনবাংলোর কর্মী বুড়ো সব ব্যবস্থা করে দূরে কোথাও আছে। হাঁক দিলেই সে এসে পড়বে। কোথায় কোন গাছের পাতার আড়ালে বসে একটা কুবো পাখি কুব কুব ডেকেই যাচ্ছিল কখন থেকে। মাঝে মাঝে সেই পাখি চুপ। হয়তো তার ভিতরেও ভয় ঢুকেছিল। মজুমদার ডাক শুনেই উঠে বসেছে। তার ঘর থেকে বেরিয়ে সায়েব ম্যাডামের ঘরের দরজায়, চাপা গলায় বলল, ইয়েস স্যার, কিছু বলছেন?

হাঁ হাঁ, বলছি তো সিওর, তুমি দরজায় থাকবে মুজুমডার, কেউ যদি চলে আসে। জড়ানো গলায় বলে শ্রীবাস্তব। নেশায় টলটল করছিল ঘরের নারী পুরুষ, চাপা গলায় হাসছিল শ্রেয়া চৌধুরী, ওহ, নটি, ওয়াট আর য়্যু ডুয়িং, লেট হিম গো।

কথাটা কানে আসতে মজুমদার সাহস পেয়ে বলেছিল, আসবে না স্যার, নো ওয়ান ইজ পারমিটেড টু কাম হিয়ার নাউ।

আয় নো ইট মুজুমডার, লেকিন তুম রহোগে, বাহারমে খাড়া রহো।

আমি পাশের ঘরে আছি স্যার, আপনারা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিন।

নো মুজুমডার, ওপেন থাকবে ডোর, তুমি গার্ড দিবে।

নো গগন, ক্লোজ দ্য ডোর। চাপা গলায় বলল শ্রেয়া চৌধুরী, হাই সুপারম্যান, দরোয়াজা বন্ধ করো।

নো, মায় লাভ, সুইটি, হা হা হা, ইটস মায় অর্ডার, য়্যু আর গোয়িং টু গেট দ্য পাওয়ার অব অ্যান অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। সি, হাও দ্য পাওয়ার ক্যান বি এনজয়েড। ডার্লিং, মেরা পাওয়ার তো টু হানড্রেড হর্স পাওয়ার, গেট রেডি।

ওহ, মেরি জান, প্লিজ ক্লোজ দ্য ডোর। মজুমদারকে সরিয়ে দাও।

নো সুইটি, মজুমদার গার্ড দিবে, হি ইজ আ লয়াল অফিসার, সে জানে কী ভাবে অর্ডার ক্যারি আউট করতে হয়।

মায় লাভ, প্লিইজ।

নো সুইটি।

তুমকো করনাই হোগা গগন, ইয়ে মেরা অর্ডার, গো অ্যান্ড ক্লোজ দ্য ডোর, আয় নিড আ প্রাইভেসি, ডু ইট ম্যান।

হা হা করে হাসে শ্রীবাস্তব, বলে, তুমি তো মল্লিক সায়েবের রিলেটিভ হচ্ছো। পাওয়ার তোমার আঙ্কেল ভালো বোঝে। বাট, আওয়ার প্রোমোটি কালেক্টর একটা ইডিয়ট, না হলে তোমাকে ইন্টারভিউ-এর টিপস নিতে আমার কাছে পাঠায়, আমি তোমাকে খেয়ে নেব।

কাম অন গগন, কে কাকে খায় দেখি।

হা হা হা, হাসতে হাসতে শ্রীবাস্তব ওঠে, তার পায়ের চটির ফটফট শুনতে পায় মজুমদার। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করে। কিন্তু শ্রীবাস্তব আসে না। টয়লেটে ফ্লাসের শব্দ শোনে। লোকটা বেরিয়েছে টয়লেট থেকে। আসছে দরজার দিকে। বিড়বিড় করছে, ওহ মুজুমডার, তবু তুমি বাইরে থাকবে, চেয়ার নিয়ে দরজার বাইরে বসো, তোমার ডিউটি তুমি করবে আমি দরওয়াজা বন্ধ করি বা না করি।

ইয়েস স্যার!

ক্লোজ দ্য ডোর মায় লাভ, তুমি বাহারমে ওয়েট করো মজুমদার স্যার, ডু ইট মজুমদার সাহাব। খিলখিল হাসি উড়ে এল ঘরের ভিতর থেকে, ইউ আর আ নাইস পার্সন মজুমদার আঙ্কেল। ইউ উইল গেট রিওয়ার্ড ফর দিজ সার্ভিস, আমি তোমার কালেক্টরকে বলে যাব।

দূর থেকে ভেসে আসা কথাগুলি শুনে মজুমদার কৃতজ্ঞতায় নুয়ে গিয়েছিল। মিস চৌধুরী বলে গেলে সে আরও ক্ষমতা পাবে। সে ক্ষমতার কাঙাল। ভালোবাসে ক্ষমতার গায়ে গা ঘষতে। নিজেকে তাদের কাছে নিয়ে গিয়ে ক্ষমতার বাতাস গায়ে লাগাতে চায়, বলল, থ্যাঙ্কিউ ম্যাম, সো গ্রেটফুল টু ইউ।

মোস্ট ওয়েলকাম আঙ্কেল, তোমার পুরো নামটা কি? শ্রেয়া জিজ্ঞেস করল ভিতর থেকে।

জগবন্ধু মজুমদার ম্যাম।

ওয়েল জগবন্ধু, আমি তোমাকে আরো পাওয়ার দিয়ে যাব। বলে খিল খিল করে হাসতে লাগল শ্রেয়া চৌধুরী, জ গ ব ন ন ধুউউউ, আমাদের ড্রাইভারের নাম, সে খুব ভালো ছেলে। আই লাইক ইউ জগবন্ধু, যা বলব তাই করে দেবে তো?

আয়াম অ্যাট ইয়োর সার্ভিস ম্যাম। বিগলিত গলা মজুমদারের।

ওহ, নাইস, নাইস! আড়াল থেকে কথা ভেসে এল, ওক্কে জগু তুমি রেস্ট নাও।

নো রেস্ট, শুন মুজুমডার, আমি চাই অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি মুজুমডার আমাদের গার্ড দিবে, হি ইজ দ্য মোস্ট কমপিটেন্ট পারসন টু ডু দিজ টাইপ অব জব। জড়ানো গলা গগন শ্রীবাস্তবের, আমি তো মুজুমডারকে নিয়েই ব্লক ভিজিট করি, হি ক্যান ম্যানেজ এভরিথিং।

মজুমদারের এক মুহূর্তের জন্য মনে হল ভিতরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু পরের মুহূর্তে নিজের স্বভাবে ফিরে আসে মজুমদার। পাথরের স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। তখন বছর তিরিশের শ্রীবাস্তব দরজায় এসে গেছে। তার অনাবৃত ফর্শা রঙের ভিতর লালচে ভাব। ছ-ফুটের উপর লম্বা সেই গগন সায়েবের দানবের মতো শরীর। কোমরে একটি ঘন নীল রঙের ফ্রেঞ্চি। তার নীচে পৌরুষ দপদপ করছিল। সায়েবকে ওই অবস্থায় দেখে কুঁকড়ে গেল মজুমদার। মনে হল গগন সায়েব যদি তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলো থেকে বের করে দেয়! বিপরীত সম্ভাবনাই মনের ভিতরে জেগে উঠল। সায়েব যদি তাকে কান ধরে উঠবস করতে বলে পাওয়ার শো করাতে, যদি তাকে অর্ডার করে শ্রেয়া চৌধুরীর বিছানায় উঠতে, সে কি পারবে? পারবে না। ভয়ে কুঁকড়ে যাবে, মরেই যাবে। এই সায়েব তা করতেই পারে। অন্তত তাকে উঠবস করতে বলতেই পারে ফুর্তির চূড়োয় উঠতে। মানুষের ফুর্তির কত না রকম আছে। কেউ মানুষকে বিড়ম্বিত করে আনন্দ পায়। গগন শ্রীবাস্তব সেই রকম। সাধারণ মানুষ, অধীনস্ত কর্মচারী, অফিসারকে মানুষ বলে মনে করে না। মনে করে সকলেই দ্রাবিড়, সে একা আর্যপুরুষ, সে জন্মেছেই তাদের শাসন করতে। সব কিছু অধিকার করতে।

শ্রীবাস্তব তাকে দেখল পর্দার সরিয়ে, চাপা গলায় বলল, গুড বয়, খাড়া রহো মুজুমডার, দরোয়াজা বন্ধ করে দিচ্ছি। কোথাও যাবে না, চুপচাপ খাড়া রহো।

ইয়েস স্যার।

গুড বয়। বলে তার চেয়ে দশ-বারো বছরের কম বয়সী গগন শ্রীবাস্তব দরজা বন্ধ করল। মজুমদার কী করবে বুঝতে পারল না। তার ঘরে গিয়ে বসবে, নাকি দরজার কাছে থাকবে? নেশা হয়ে গেলে শ্রীবাস্তব কখনও হিংস্র হয়ে ওঠে, কখনও খুব নরম। আজ কী হবে তা জানে না মজুমদার। সে ওই ঘরে, আর ধূর্ত শ্রীবাস্তব যদি দরজা খুলে পরখ করে মজুমদার আছে কি না, তখন তো না পেলে সে মনে করবে, তার আদেশ অমান্য করেছে মজুমদার। শ্রীবাস্তব ভিজিটে গিয়ে পাবলিকের কাছে খোঁজ নেয় বিডিও কেমন, ঠিক কাজ করছে কিনা। সব ব্লকে তার পেটোয়া স্টাফ আছে, তারা খবর দেয়, তাদের কথা বিশ্বাস করে বিডিওকে হেনস্থা করে শ্রীবাস্তব। তবে সকলকে নয়। যেগুলি নরম প্রকৃতির, যেগুলি সৎ, তাদের। নেশার ঘোরে তাকে হেনস্থা করতে পারে শ্রীবাস্তব। তার কারণে সে সায়েবের কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তা হবে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারা। সে কী করছে তা জানবে কী করে আর সবাই। দাঁড়িয়েই থাকবে।

মজুমদার দাঁড়িয়ে থাকল। তার শীত করে এল। ভয় করছিল। কিন্তু সে নড়ছিল না। শ্রীবাস্তব খুব রাগী তরুণ। তার কথায় না বলায় এক ডি-গ্রুপ কর্মচারীর গালে চড়। পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গিয়েছিল। তা নিয়ে কালেক্টরেটে গোলমাল হয়েছিল, কিন্তু তার কোনো দোষ পায়নি প্রশাসন। ক্ষমতার পাশে ক্ষমতাই থাকে। তা না হলে ক্ষমতাবান দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই কর্মচারী বদলি হয়ে গিয়েছিল দূরের ব্লকে। সোশ্যাল ওয়েল-ফেয়ার অফিসার তানিয়া সেন নিজেই ছোটাছুটি করে বদলি নিয়ে চলে গেছে জেলার বাইরে। শ্রীবাস্তব তার গায়ে হাত দিতে গিয়েছিল। কালেক্টরেটে গুঞ্জন উঠেও থেমে গিয়েছিল।

মজুমদার শুনতে পাচ্ছিল শীৎকার ধ্বনি। ভিতরে তখন শঙ্খ লেগেছে সাপ আর সাপিনীতে। ঝটপট আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল সেগুন কাঠের দরজা ভেদ করে। চাপা কন্ঠস্বর, নারীকন্ঠের প্রবল-উল্লাস-ধ্বনি। পৌরুষের রোষ। পুরুষের রোষ মানে অশ্লীল শব্দ। আর সেই শব্দে কল্লোলিত হয়ে উঠছিল যুবতি। তার সুরেলা কন্ঠেও বেজে উঠছিল পালটা রোষ। মজুমদার বিবাহিত। মজুমদার একটি কন্যার পিতা। মজুমদারের যৌবন ফুরোয়নি। স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারীর কথা সে ভাবেওনি কোনোদিন। ভাবতে ভয় করে। তার তখনও নিয়মিত স্ত্রী সংসর্গ হয়। কিন্তু ওভাবে হয় কি? সে তো এক আভ্যাসিক ক্রিয়া। ওভাবে যে হতে পারে তা সে জানল তখনই। সে বিস্মিত হয়ে কাঁপছিল। বড়ো সায়েব, ডি. এম-এর কথা মনে পড়ছিল। পাওয়ার, পাওয়ার ছাড়া জীবনকে এনজয় করা যায় না মজুমদার, শুনছ।

ইয়েস স্যার।

পাওয়ারকে কখনও ফিল করেছ?

নো স্যার।

পাওয়ারকে চিনতে হয়, সে যে চমকে দাঁড়ায় লুকিয়ে বেড়ায়, যায় না তারে ধরা, সোনার হরিণ, সে যে তোমার কাছে ধরা দিয়েছে তা বুঝতেই তোমর জীবন কেটে যাবে।

ইয়েস স্যার।

পাওয়ারকে ধরে রাখতে হয় মজুমদার।

হ্যাঁ স্যার।

তুমি কথা বলছ না কেন মজুমদার?

বলছি তো।

সায়েবের নেশা হলে তাকে পাওয়ারের কথা শোনায়। মজুমদারের মনে হচ্ছিল ক্ষমতার একটা রূপ সে দেখতে পাচ্ছে। বিমূর্ত ক্ষমতার আদল সে আন্দাজ করতে পারছে। ক্ষমতার নানা চেহারা, তার একটির কাছাকাছি হয়ে সে কাঁপছিল। বড়ো সায়েবও এই পাওয়ারকে চেনেনি। ক্ষমতার পৌরুষকে কেউ কোনোদিন ছুঁতেও পারবে বলে সন্দেহ হয়। মজুমদার নিজে তো নয়ই। তার বউটি ভয়ে উন্মাদিনী হয়ে যাবে, কেন্নোর মতো গুটিয়ে যাবে। ক্ষমতাবান ব্যতীত যৌনতাকে উপভোগ করবে কে? উপভোগ করার সাহস হবে কার? রতি রহস্যকেও জানা যায় পাওয়ার দিয়ে। পাওয়ার ব্যতীত যৌনতা ভিজে ব্লটিং। যৌনতা ক্ষমতার অধীন। কামদেব ক্ষমতাশালীর অনুগত। তার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করেন। পৃথিবীতে যৌনতাই সেরা পণ্য। যৌনতাই ভোগের শ্রেষ্ঠ উপায়, তা টের পায় মজুমদার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সময় গলে গলে পড়ে। ঘড়ির কাঁটা লম্বা হতে হতে বর্শার ফলা হয়ে যায়। মজুমদার দাঁড়িয়ে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *