মুনলাইট সোনাটা – ১

মিস শ্রেয়া চৌধুরীকে পথ চিনিয়ে চিনিয়ে আসছে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মজুমদার, ইয়েস ম্যাডাম, এই দিকে, মোস্ট ওয়েলকাম ম্যাডাম, ওয়েলকাম টু আওয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং।

মজুমদারের কথার তালে তালে পা ফেলছে জেলা শাসকের ভাগ্নী, বছর সাতাশের অহঙ্কারী যুবতি কন্যা। প্রকৃতির নিয়মে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় সে অতিবাহিত করছিল তখন। ঈশ্বর তাকে তখন দু-হাত ভরে দিয়েছেন। সেই বয়সটা ছিল প্রকৃতির কাছ থেকে নেওয়ার। পেয়েছিলও সে, যেমন রূপ, তেমন মেধা। যৌবনে সে ঐশ্বর্যশালিনী। হাঁটা চলায় কী দর্প! ঘাড় ফিরিয়েও তাকায় না, পথের দু-পাশে কে আছে কে নেই, তা দেখতে। মনে হয় মাটির উপরে পা পড়ে না তার। বাতাসে ভাসে ফুলের গন্ধের মতো। গোপনে, পরম এক উদাসীনতায় দেখে নেয় কে বা কারা তার দিয়ে লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আগুন আগুন! শিগগির সেই মেয়ে সিভিল সার্ভিসে যাবে, সে কেন মাথা নীচু করে হাঁটবে? আমার মনে আছে তার রূপ। বসন্ত দিনে রম রম করছিল শ্বাস প্রশ্বাস, নাকের পাটা ফুলছিল। আমাদের অচিনপুরের নিরর্থক বয়ে যাওয়া দিনে শ্রেয়া চৌধুরী এনেছিল উষ্ণ রঙিন বাতাস। আলোড়ন তুলেছিল বিবাহিত, অবিবাহিত, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ হয়ে আসা পুরোনো কেরানি থেকে সকলের ভিতর। ডি-গ্রুপ কর্মচারী থেকে সাব-ডেপুটি, ডেপুটি পর্যন্ত। বাংলোয় ফাইফরমাস খাটা দৈনিক বেতনের লোকটির ভিতরে পর্যন্ত।

আমাদের সেই অচিনপুরের কথা বলি। সেই যে সেই জাহ্নবী নদীর তীরের জেলা শহর। আমি আর সুনন্দা, জেলা শাসক লোকনাথ মল্লিক সায়েব, অতিরিক্ত জেলা শাসক গগন শ্রীবাস্তব সায়েব, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মজুমদার, জেলা শাসকের ভাগ্নী মেধাবী সুন্দরী শ্রেয়া চৌধুরী, আমার বন্ধু, সাংবাদিক সুবিমল সেন — আমরা সবাই নানা দিক থেকে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই জেলা শহরে। নবীন বয়স, কখনও ভাবিনি বুড়ো হয়ে, ক্ষমতাহীন হয়ে বেঁচে থাকব সেই এম. পি. পার্থ সান্যালের মতো। যাঁকে আমরা সবাই, এমন কি জেলা শাসকও মান্য করতেন অসম্ভব। মান্যতা মানে তাঁর প্রতি আনুগত্য। তাঁর ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য। ক্ষমতাকে ভয়। কখনও কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, ওই ছোটো-বড়ো পদে কত ক্ষমতা, আমার সব ক্ষমতা একদিন চঞ্চলা কমলার মতো অদৃশ্য হয়ে যাবে। কী সুন্দর বলতেন সেই জেলা শাসক মল্লিক সায়েব, পাওয়ার লাইজ ইন গভর্নমেন্ট অর্ডার, সার্কুলার, মেমোজ, কিপ দোজ পেপারস উইথ ইউ, এনজয় ইয়োর পাওয়ার, কাগজ কথা বলবে। আইন কথা বলবে। আইন তোমার ক্ষমতা, আইন তোমাকে রক্ষা করবে। কেউ কেউ বলেন, মানুষের জন্য আইন, মানুষের স্বার্থে তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে, দরকারে আইনের বাইরে গিয়ে ব্যতিক্রমী কিছুও করা যায় মানুষের স্বার্থে। আই ডু নট থিংক সো। আইন আইনের পথে চলবে, আইনের পথেই চলতে হবে মানুষকে। আইন প্রণয়ন করা হয়েছেই তো মনুষ্য সমাজকে শাসনের ভিতর নিয়ে আসার জন্য। শাসক কী দিয়ে শাসন করবে, আইন দিয়ে। সব ক্ষমতা আইনেই। জেলা শাসক বলতেন, দরকারে আইনের মোড়কে আইন ভাঙতে হয়, কখন তা করতে হয় তা আপনা আপনি বুঝে যায় একজন প্রশাসক। কখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার উপরেই নির্ভর করে তাঁর সফলতা, ব্যর্থতা। প্রশাসককে রাজনৈতিক নেতার কথা মতো চলতে হয়, কিন্তু তিনি যদি পারেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিজের মতো করে প্রভাবিত করতে, তিনিই দক্ষ প্রশাসক। আসলে দেশটা তো প্রশাসকই চালান, তা আরম্ভ হয় ব্লক স্তর থেকে, ব্লক, মহকুমা, জেলা, ডিভিশন হয়ে গোটা রাজ্য। আমাদের কী সুন্দর বোঝাতেন আমাদের জেলা শাসক লোকনাথ মল্লিক।

ক্ষমতাবান জেলা শাসক। তাঁর কথায় গোটা কালেক্টরেট ওঠে বসে। জেলার দন্ডমুন্ডের কর্তা তিনি। আমাদের তখন নতুন চাকরি, তাঁর বেশ কয়েক বছর হয়েছে। তিনি প্রমোশনে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস। ওর চেয়ে ভালো চাকরি আর নেই এদেশে। বিশুদ্ধ চাকরি। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি। হাসতে হাসতে বলতেন বড়ো সায়েব, ‘নো নো, জানতেন না উনি, এর চেয়ে বিশুদ্ধ চাকরি আছে আর?’

নেই। তা জানত মজুমদার। জানত বলে সে শ্রেয়া চৌধুরীর দায়িত্ব পেয়ে বর্তে গিয়েছিল। সকাল থেকে জেলা শাসকের ভাগ্নীর ফাই-ফরমাস খাটছে হাসি মুখে। সেই মেয়ে আই.এ.এস. হতে যাচ্ছে। ইন্টারভিউ পেয়েছে, মামার কাছে এসেছে সহবৎ শিক্ষা নিতে। চাকরির প্রাথমিক পাঠ নিতে। প্রশাসকের চাকরির অনেক রীতি নীতি আছে। অনেক রকম ভাব আর ভঙ্গী আছে, তা আয়ত্ত করতেই না তার আসা আমাদের সেই অচিনপুরে। আর মজুমদার তো বর্তে গিয়েছিল সেই যুবতির সেবা করতে পেরে। ধন্য হয়ে গিয়েছিল। সে জানত খুব তাড়াতাড়ি ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করছেন মিস চৌধুরী। প্রভুত্ব অর্জন করবেন মিস শ্রেয়া চৌধুরী। আমাদের ভিতরে আলোচনা হতো, মেয়েটি কেমন ডাকছে ওকে ‘মজুমদার মজুমদার’ করে। মজুমদারের বয়স চল্লিশ পার, সে সাতাশ। ডাক শুনলেই মজুমদার, ইয়েস ম্যাডাম, ইয়েস ম্যাডাম করে উঠে দাঁড়ায়। আমরা অন্য ডেপুটিরা দেখেছিলাম সেই দৃশ্য। আমাদের সঙ্গে মেধাবী, সুন্দরী, যৌবনমদমত্তা সেই শ্রেয়ার আলাপ করিয়েছিলেন জেলা শাসক এক সন্ধেয়। আমরা বসেছিলাম, মজুমদার কখনও বসে, কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও শ্রেয়ার চেয়ারের পিছনে, কখনও দূরে। তাকে ‘মজুমদার তুমি’ বলেন জেলা শাসক, শ্রেয়াও তাই বলল। আর তাতে মজুমদারের মুখ উদ্ভাসিত আলোয় ঝলমল করতে লাগল। শ্রেয়ার মুখের কাছে কান নিয়ে গেল, সে গোপনে তাকে কিছু বলল, তাতে, ইয়েস ম্যাডাম, ইয়েস ম্যাডাম করতে করতে মজুমদার তার চেয়ারে ফিরে গম্ভীর মুখে জেলা শাসকের দিকে তাকিয়ে থাকল। আমার সহকর্মী শুভময় সেন আমাকে পরে বলেছিল, স্যানিটারি ন্যাপকিনের অর্ডার দিয়েছিল মেয়েটা, নাজিরখানা পে করবে, বড়ো সায়েবের ভাগ্নী বলে কথা, মজুমদার ডিয়েমের ঝাড়ুদার, বউ ভাগ্নীর শায়া ব্লাউজও কেচে দেয়, ওর জন্য এ জেলার ডেপুটিদের কেউ সম্মান করে না। চাকরিটাকে ছোটো করে দিয়েছে মজুমদার।

মজুমদার কথায় কথায় বলছিল, সবাই চায় ক্ষমতার সেবা করতে, কিন্তু পারে কে, সুযোগ পায় কে, ডিয়েমের ঝাড়ুদার সবাই, আমি লোকের কথায় ইয়ে করি, বসের ভালোবাসা ক’জন পায়, ওই চাকরি করতে পারবি সারা জীবনে, ওই ক্ষমতা?

সত্যই তো, প্রভুত্ব, দম্ভ, দর্প, ভোগ-বিলাস, ক্ষমতার প্রতিটি মুখ এই চাকরিতে। চাকরি নয়, এ হলো সত্যকারের প্রভুত্ব অর্জন। কিন্তু এও সত্য, পৃথিবীতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কোথাও নেই। প্রভুরও প্রভু থাকে। তাঁরও প্রভু থাকে। শেষ পর্যন্ত তা কোথায় গিয়ে পৌঁছয় তা জানা নেই। এখন এই সব মনে হয়। মনে হয় প্রভুত্ব আর ক্ষমতার এক রূপ আছে, তাকে সম্ভ্রম করতে হয়, ভয় পেতে হয়। তা না হলে সে হীনবল হয়ে পড়ে। আর এই কারণে ক্ষমতাবানরা ক্ষমতা রক্ষায় মনোনিবেশ করেন সবচেয়ে বেশি। বিশেষত রাজনৈতিক প্রভুরা। তাঁরা অনাদিকালের কথা ভাবেন। তাঁরা তাঁদের উত্তরাধিকারীদের জন্য ক্ষমতার অলিন্দ রেখে যান। ক্ষমতাবান আমলারাও স্বপ্ন দ্যাখেন, তাঁর সন্তান তাঁরই রেখে যাওয়া চেয়ারে গিয়ে বসবে। মানুষ যা করে সারাজীবন ধরে তা শুধু তার নিজের জন্য নয়, বৈধ-অবৈধ উপায়ে যে সম্পদ তৈরি করে, তা তার উত্তরপুরুষের জন্য। সাত পুরুষের ব্যবস্থা করে যেতে পারলে উপরে গিয়ে তার আত্মা শান্তি পায়। একথা রাজনীতিক, আমলা, কেরানি — সকলের ক্ষেত্রে একই ভাবে সত্য।

জেলা শাসক যে ঘরে দরবার বসাতেন, তা ছিল মস্ত। তার ভিতরে চার-পাঁচটা ঘর ঢুকে যেত। জেলা শাসকের চেয়ারের পিছনের দেওয়ালে সেগুন কাঠের প্যানেলে পর পর জেলা শাসকদের নাম আর কার্যকালের বিবরণ। প্রথম তিনজন ছিলেন খাঁটি সায়েব। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় জেলা শাসক। আর আছে সেই প্যানেলের উপরে দুটি তলোয়ার আড়াআড়ি করে রাখা, তার উপরে যোদ্ধার শিরস্ত্রাণ। বাংলো কী নিস্তব্ধ! বাংলোয় আসতে গেলে পুরোনো জেলখানার মস্ত প্রাচীরের গা ঘেঁষে আসতে হয়। বাংলোর মস্ত গেটে বন্দুকধারী, ঢুকে অনেকটা খালি জমি, তারপর আভিজাত্যের প্রতীক রাজপুরুষের সেই গৃহ, বসতবাটি। ঘাড় তুললে বড়ো ব্যালকনি, তার মাথায় কোনো ছাদ নেই। সেখানে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় জেলা শাসক সপরিবারে বিশ্রাম নেন। শীতের সকালে রোদ পোয়ান। বিঘে চার জমি নিয়ে গড়ে ওঠা বাংলোর প্রাচীরের গায়ে বহু প্রাচীন মেহগনি, শিরীষ। সব মিলিয়ে ওই নিস্তব্ধতায় এক কঠোরতাও টের পাওয়া যায়। ক্ষমতা কখনও কঠোরতা ব্যতীত হয় না। জেলা শাসকের বাংলোই ছিল ক্ষমতার সম্পূর্ণ এক চেহারা। রাজপুরুষের আবাস, তার ভিতরেই সমস্ত ক্ষমতা নিহিত।

সমস্তদিনের শেষে আমরা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটরা তাঁর বাংলোর মস্ত চেম্বারে তিন সারি চেয়ারে সারি দিয়ে বসতাম। পদ মর্যাদা আর সিনিয়রিটি অনুযায়ী সামনের সারি, পরের সারি, শেষ সারি। এই গদি আঁটা সারি চেয়ারের দশ বারো ফুট পিছনে সোফা সেট, টি টেবল। সেই খুব দামী সোফা সেটের একটিতে এসে বসেন এম.পি। কখনও কোনো মন্ত্রী জেলা সফরে এলে তিনি বা তাঁর সঙ্গী কেউ। বাঁ-দিকের সিঙ্গল সোফায় ওই মাপের ভি আই পি, লম্বা তিনজনের উপযোগী সোফায় তাঁর সঙ্গী, ডান দিকের সোফায় জেলা শাসক। আমি অনেকদিন দেখেছি জেলা শাসক বসেননি, দাঁড়িয়ে নোট নিচ্ছেন। মন্ত্রী, এম.পি. ব্যতীত ডিভিশনাল কমিশনার, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি জাতীয় উচ্চ পদস্থ রাজপুরুষ এলে বসতেন, মিটিং করতেন। এই বাংলো ব্রিটিশদের নির্মাণ। সেই সব নির্মাণে ছিল রাজকীয় ঔদ্ধত্য। মস্ত উঁচু সিলিং, মস্ত বড়ো বড়ো ঘর। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটি ছিল কাঠের। খুব চওড়া, লাল কার্পেটে মোড়া। দেওয়ালে নানা নিসর্গ-চিত্র। জেলার বড়ো ম্যাপ। মন্ত্রীর সঙ্গে জেলা শাসকের ফোটো। কোনো অনুষ্ঠান উদ্বোধনের ছবি। রবীন্দ্রনাথের ছবিও একটি রাখা হয়েছিল, কেন তা বুঝতে পারিনি। বাংলোয় জেলা শাসকের দরবারে, আমাদের সন্ধ্যার মিটিঙে কোনোদিন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় হয়নি। কখনও উঠলে সেই প্রসঙ্গ সরেও গেছে অচিরে। স্যার বলতেন, দুর্বৃত্ত কর্মচারীকে কীভাবে কোথায় শায়েস্তা করেছেন সেই কথা। কী ভাবে তাঁর অনুগত কর্মচারীকে বাঁচিয়েছেন নানা অপরাধের শাস্তি থেকে, সেই কথা। এক স্টেট সার্ভিসের অফিসার অফিসের ডি-গ্রুপ তরুণীকে মোলেস্ট করার অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিল, তাকে কীভাবে তিনি বাঁচিয়েছিলেন সেই বৃত্তান্ত। তরুণীটিকে তিনি বদলি করে দিতে পেরেছিলেন ক্ষমতার জোরে। অথচ অপরাধ ছিল সত্য। ধর্ষিতা হয়েছিল তরুণীটি। সেই ঘটনা জেনেও ছিল সবাই। কেউ কিছু বলতে পারেনি। ডি. এম. যা বলবেন তাই হবে। কমিটি গড়ে দোষীকে নির্দোষ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি। কারণ অফিসারটি তাঁর খুব অনুগত ছিল। তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিল। সেই তরুণীটি ছিল চূড়ান্ত সেক্সি, স্যারের গাড়িতে করে ফিরত। সবার আগে অফিসে এসে সবার শেষে যেত। কম বয়সী বিধবা। ফলে যা হওয়ার তা হয়েছিল। ঘি আর আগুন কাছাকাছি এলে এমনই হয়ে থাকে। সেই অভিযুক্ত ডেপুটির কোনো দোষ ছিল না। মতিভ্রমকে মতিভ্রম হিসেবেই দেখা উচিত।

মনে হয়েছিল ক্ষমতার অপব্যবহারই ক্ষমতার প্রকাশ। অপরাধীকে না বাঁচাতে পারলে কিসের ক্ষমতা? চুপ করে ছিলাম। মজুমদার মুগ্ধ দৃষ্টিতে জেলা শাসকের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাঝে মাঝে, বিবশ গলায় উচ্চারণ করছিল, স্যার …. স্যার ….। যেমন আমরা বলতাম উপরওয়ালার ফোন এলে, তাঁর কথা শুনতে শুনতে।

শোনো তোমরা, শোনো, লাইফটাকে এনজয় করতে হলে, প্রশাসনকে ব্যবহার করতে শিখতে হবে তোমাকে। মনে রেখ, একদিন সব পাওয়ার হবে আমাদের, পোলিটিশিয়ানদের কাছ থেকে একদিন সব পাওয়ার আমরা কেড়ে নেবো। এখন আমরা চুপ করে আছি, ডে’জ উইল কাম সুন, সেদিন আমরা কথা বলব, যে ভাবে দেশ চলছে, চলতে পারে না, এর একটা বিহিত তো হবেই একদিন। ব্যুরোক্রেসিতে কারা আছে, ক্রিম অফ দ্য সোসাইটি, সব চেয়ে শিক্ষিত যুবকরা। তারাই এই সমাজের অভিজাত শ্রেণি। অভিজাতরা শাসন করলে শাসন ভালো হয়, সমাজ উন্নত হয়। আমি মনে করি না তার বাইরে কোথাও কিছু হয়েছে কোনো কালে। তুমি ভেবে দ্যাখো প্রলেতারিয়ান ডিকটেটরশিপ, চিনে নাকি তাই চলছে, আসলে চলছে অভিজাত কম্যুনিস্টদের শাসন। গরিবের কাছে কোনোদিন ক্ষমতা যায় না। গরিব কখনও ক্ষমতাশালী হয় না।

শুনতে শুনতে তানিয়া সেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কিছু বলতে চাইলে জেলা শাসক বললেন, শুনতে খারাপ লাগছে, কিন্তু এইটাই রিয়ালিটি। যে কোনো শাসন দ্যাখো, ক্ষমতায় গেলে গরিব তো বড়োলোক হয়ে ওঠে, ট্রাজেডি এখানেই, গরিবমানুষ শাসন করবে, এটা কখনও সত্য হতে পারে না। গরিবিয়ানা কখনও পাওয়ারের সংস্পর্শে যেতে পারে না।

মজুমদার শুধু ঘাড় নেড়ে তার প্রভুকে সমর্থন জানাত। জেলা শাসকের প্রতিটি কথায় সে অভিভূত হয়ে পড়ত। সহকর্মী শুভময় সেন আমাকে বলত, দ্যাখ দ্যাখ, লেজ নাড়ছে কেমন।

হুঁ। আমি সাড়া দিয়ে চুপ করে যেতাম। ভয় হতো, মজুমদার সব জেনে যাবে। কী করে জেনে যায় মজুমদার, তা আমাদের মাথায় ঢুকত না। মজুমদার বলত, ক্ষমতার সঙ্গে থাকলে বোঝা যায় সব, সেই ক্ষমতা আছে ক্ষমতার।

কেউ কেউ বলত, ‘মজুমদার হলো জেলাশাসকের স্পাই। গুপ্তচর। কোথায় কে কী বলছে তা মজুমদারই স্যারের কাছে পৌঁছে দেয়।’

কথাটা অসত্য মনে হত না। মজুমদারকে কখনও কখনও ভয়ই লাগত। অথচ সে প্রোমোটি অফিসার। সিনিয়রিটিতে আমাদের অনেক নীচে। কিন্তু সেবা-ধর্ম(!) তাকে সবার মাথায় নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল ধীরে ধীরে। উপরওয়ালার সেবা করেই যে ক্ষমতার ছিটোফোঁটা তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায় তা মজুমদার আমাদের প্রতি মুহূর্তে দেখিয়ে দিত। কখনও কখনও আমাদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাত। শুভময় সেনই শুধু বলত, সারমেয় ল্যাজ নাড়ে আবার তেড়েও আসে, এ শুধু ল্যাজ নাড়তে শিখেছে।

জেলা শাসকের কথাগুলো কখনও ধ্রুব মনে হতো, কখনও মনে দ্বিধা আর প্রশ্নের জন্ম দিত। আমাদের এই জেলা শাসক মিঃ মল্লিক বলতেন, পাওয়ার অ্যান্ড পাওয়ার, একদিন পিপল বলবে, নো পোলিটিসিয়ান, নো পোলিটিকস। কিন্তু পাওয়ার তো কেউ না কেউ নেবে। কে নেবে? শোনো মজুমদার, পাওয়ার হচ্ছে বিউটিফুল ওম্যান, সি কান’ট লিভ অ্যালোন, সে কারও না কারওর কাছে থাকবেই, হু উইল এনজয় হার? ব্যুরোক্র্যাটস।

মজুমদার ঘাড় নেড়ে বলত, ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার।

শুভময় সেন আমার কানে কানে চাপা গলায় বলত, পাওয়ার হল ওর ওই ভলাপচুয়াস ভাগ্নীটা, শ্রীবাস্তবটাকে ও-ই খেয়েছে। টাইগ্রেস। কোনো কোনো রমণী এমন হয়। গিলে খেয়ে নেয় পুরুষকে। দ্যাখ দুজনে কেমন উঠে গেল পর পর।

উঠে গেছে শ্রীবাস্তব আগে, তারপর শ্রেয়া। শ্রেয়া ছিল দেড় মাস। আমাদের সান্ধ্য সভায় তাকে ডেকে নিতেন স্যার মল্লিক। সে শুনবে কথাবার্তা, বুঝবে কীভাবে প্রশাসন চলে। তাকে সবই শেখাবে দেরাদুন ট্রেনিং সেন্টারে, কিন্তু তার আগে তো ইন্টারভিউ।

শুভময় বলত, ফুর্তি করতে এসেছে মেয়েটা, মামার বাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই।

আমাদের ভিতরে এই সব কথা হতো। তার ভিতরে কি আমাদের দীর্ঘশ্বাস থাকত না? এখন মনে হয় থাকত। হ্যাঁ, সেই গগন শ্রীবাস্তবও কম ছিল না। সেও সিভিল সার্ভিসের, অতিরিক্ত জেলা শাসক। তাকে গিলে নেবে কি শ্রেয়া চৌধুরী, দুজনেই যে দুজনকে গিলে ফেলার সামর্থ্য রাখত। সে-ই গগন ছিল ভীষণ পুরুষও। বলত, সে খাঁটি আর্য রক্ত বহন করছে তার ভিতরে। কার কাছে বলেছিল, ‘ব্যুরোক্র্যাটস আর পিওর আরিয়া, দে হ্যাভ অ্যাবসলিউট পাওয়ার টু রুল দিজ কানট্রি।’

আর্যরাই পৃথিবী ভোগের অধিকারী। রমণী আর গোধনে তাদেরই অধিকার। গো-ধন এখন কাঞ্চন, ক্ষমতায় তা অধিকার করা সম্ভব। ক্ষমতাবান তার ক্ষমতাতেই অধিকার করে সব।

মল্লিক সায়েবও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথাই তো বলতেন। নব ভারতের আর্য ব্যুরোক্র্যাটরা।

তবে গগন শ্রীবাস্তবের মতো নিজেকেও তিনি আর্য রক্তের বলে দাবী করতেন না। তিনি ছিলেন সাদামাটা চেহারার মানুষ, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, গড় বাঙালির অধিক কিছু নন। মেধাবী ছিলেন, বুদ্ধিমান ছিলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অপরিমেয় ক্ষমতা ছিল তাঁর। স্টেট সার্ভিস থেকে সিভিল সার্ভিসে উন্নীত হয়েছিলেন। এখন মল্লিক সায়েবের কোনো খবর পাই না। শুনেছিলাম অবসরের পর তিনি কোনো একটা বড়ো কোম্পানির অ্যাডভাইসার ছিলেন। একবার ইলেকশনে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন। আমি সমস্তজীবন আমার মতো ক্ষমতা এনজয় করেছি। যার যতটুকু ক্ষমতা তা ব্যবহার করেই সে জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারে। আমিও তো স্টেট সার্ভিসে ছিলাম। সরকারের কেরানিরও ক্ষমতা থাকে কম নয়। যে কেরানির যত বুদ্ধি সে তত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। যেমন ছিল আমাদের মজুমদার, প্রমোশনে প্রমোশনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। জেলার কর্তা আর উপরওয়ালাদের সার্ভিস দিয়ে দিয়ে ক্ষমতা অসীম। মজুমদারই শেষ কথা। মজুমদারকে ধরলে ডি. এম, এ.ডি.এমরা সব কাজেই হঁযা করেন। মজুমদারকে আমরা ঈর্ষা করতাম। আড়ালে বলতাম, ডিয়েমের ঝাড়ুদার। মজুমদার তা জানত, হাসত। বলত, আমি জানি কী করছি, গভর্মেন্ট সার্ভেন্ট মানে উপরওয়ালার সার্ভেন্ট, এটা সকলেই জানে, কিন্তু সার্ভিস দেওয়ার ক্ষমতা সবার নেই, সায়েবের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই নেই।

সেই মজুমদার এখন কোথায় জানা নেই। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা, রোগাটে গড়ন, ধূর্ত দুটি চোখ, সাজ-পোশাকে সবসময় ফিটফাট, শীতের সময় দামী স্যুট, গরমে দামী কাপড়ের হাওয়াই শার্ট, ট্রাউজার্স, দামী শ্যু, তখনই বাটা কোম্পানির অ্যাম্বাস্যাডর পরত মজুমদার। ভোরবেলা থেকে তার কাজ আরম্ভ হতো। কালেক্টরেটের একটি গাড়ি তার সঙ্গে জুড়ে থাকত সব সময়। মজুমদার সেই গাড়িতে চেপে সায়েবদের ঘুম ঠিক হয়েছে কিনা সেই খোঁজ নিতে বাংলোয় হাজির। হাসি মুখ, সায়েবের গিন্নির অনুরোধ মতো বড়ো বড়ো কাঁকড়া নিয়ে এসেছে বাজার থেকে কিনে। কিন্তু দাম নেবে না। তখন সায়েব বলবেন, নাজিরখানা থেকে নিয়ে নিয়ো মজুমদার। বড়ো সায়েব বলেন। ঘাড় কাত করে মজুমদার। এবার সে যাবে মেজ সায়েব গগন শ্রীবাস্তবের বাড়ি।

”গুড মর্নিং স্যার, বলে দিয়েছিলাম সকালের ভিতর যেন আপনার বাংলোয় গরু নিয়ে এসে সামনে দুধ দুইয়ে দিয়ে যায়, বাচ্চার দুধ, ভেজাল হলে ফাটকে ভরে দেব।” বলতে বলতে মজুমদার হাসতে থাকে। মেজ সায়েব অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট গগন শ্রীবাস্তব, বিহারে বাড়ি, আর্যপুত্র। খাঁটি গোরুর দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছেন, ওই সব প্যাকেটের দুধ কেন তাঁর বাচ্চা খাবে? তা দুধের শিশুর দুধের জন্য একটি গোরু কিনে নেবেন বলেছিলেন, মজুমদার তা সংগ্রহ করে দেবে বলেছিল, কিন্তু সায়েবের সুন্দরী স্ত্রী না করেছেন, গরু রাখা যাবে না বাংলোর পিছনে। পরিবেশ নষ্ট হবে। অগত্যা সেই মজুমদারই ভরসা। সায়েবের একটিই সন্তান, তাঁর ইচ্ছা খাঁটি গোরুর দুধ খাওয়াবেন তার পুত্রকে, তা না হলে আর্য-রক্ত তৃপ্ত হয় না। মজুমদার ব্যবস্থা করেছে। ক্ষমতা অর্জনের একটি পথ মজুমদার আমাদের দেখিয়েছিল। আরও শিখিয়েছিল বড়ো সায়েবের ক্ষমতা বড়ো সায়েব কী ভাবে অধঃস্তন অফিসারকে ডেলিগেট করেন। বিলি করেন তাঁর ভার কমানোর জন্য। ক্ষমতা ভোগের নিয়ম হলো একটু একটু সুতো ছাড়া। সুতোর মূল তোমার কাছে রেখে, একটু ছেড়ে দাও, তাহলে তোমার ক্ষমতা মূলের চেয়েও বেশি হয়ে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *