মুক্ত বিহঙ্গ
ফ্লাইট লেফটেনান্ট মতিউর রহমান বীরশ্রেষ্ঠ
কোনো কোনো মানুষ এ পৃথিবীতে জন্মায় ভবিষ্যতের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তার চারপাশের সবকিছুর প্রতি তার যে মনোযোগ থাকে না, এমন নয়। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান পরিবৃত তাঁর জীবনের কেন্দ্রে সে পরিপূর্ণভাবে সজাগ থাকে, দায়িত্ব পালন করে। যার-যা প্রাপ্য তাকে তা দেয়। এ-সব সত্ত্বেও তার দৃষ্টি প্রসারিত হয়ে থাকে সামনের দিকে— চারপাশের গণ্ডির ভেতরে আবদ্ধ সবকিছুর উপর দিয়ে দূরে— অনেক দূরে।
ফ্লাইট লেফটেনান্ট মতিউর রহমান বীরশ্রেষ্ঠ এমনি একজন মানুষ ছিলেন।
জন্মেছিলেন ১৯৪২ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশের আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো সচ্ছল, শিক্ষিত এক পরিবারে। পিতা মৌলভী আবদুস সামাদ ছিলেন ঢাকা কালেক্টরেটে অফিস-সুপারিনটেনডেন্ট। দেশের বাড়ি হল ঢাকার অদূরে রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। ঢাকায় আগা সাদেক রোডে বাড়ি বানান। ১৯৩৯ সাল থেকে সেখানেই বাস। তবে গ্রামের বাড়িতে প্রায় সর্বদাই যাতায়াত ছিল।
মতিরা নয় ভাই, দুই বোন। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। জন্মেছিলেন, ঢাকায়, আগা সাদেক রোডের বাড়িতে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। তারপর পিতার একান্ত ইচ্ছায় পড়তে চলে যান তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সারগোদার পাকিস্তান বিমানবাহিনী পাবলিক স্কুলে। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে, পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমিতে যোগদান করেন। দু’বছর পরে বৈমানিক হিসাবে কমিশন পান ১৯৬৩ সালের জুন মাসে।
মতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছাত্র ছিলেন। অন্যান্য ছাত্রের তুলনায় খুব কম সময় পড়া-লেখা করেই বেশ ভালো ফল করতেন। তবু প্রথম, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে পারতেন না। কারণ দুটি— প্রথম, বেশিক্ষণ পড়াশোনা করা তাঁর ধাতে সইত না। দ্বিতীয়, তিনি কিছুতেই উর্দু পড়তে চাইতেন না। সেই ১০-১২ বছর বয়স থেকেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন— উর্দু তাঁর মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও জোর করে শেখানো হয়। তাই তিনি ওটা কিছুতেই পড়তে চাইতেন না। ফলে উর্দুতে নম্বর পেতেন খুব কম। অন্যান্য বিষয়ে নম্বর ভালো পেলেও উর্দুর জন্য টোটালে নম্বর কম হয়ে যেত।
মতি খুব প্রাণচঞ্চল, দুরন্ত, ডানপিটে ছিলেন। স্কুলের সবরকম খেলা, অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অংশ নিতেন। খেলাধুলায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন। নিজের হাউসকে সর্বদাই জয়যুক্ত করাতেন খেলাধুলায় নিজের যোগ্যতার বলে।
হোস্টেলের ছেলেদের মাথায় সবসময়ই কিছু-না-কিছু দুষ্টুবুদ্ধি গিজগিজ করে। তার মধ্যে মতিও কম যেতেন না। প্রায় রাত্রেই হোস্টেলের বাতি নিবলে ৭-৮ জন ছেলের দল চুপেচুপে বিছানা ছেড়ে পাঁচিল টপকে চলে যেতেন আশেপাশের গ্রামে মাল্টা-বাগানে ফল চুরি করতে।
মাল্টা-বাগানের পাঞ্জাবি মালিকেরা পালা করে রাত জেগে পাহারা দিত, যাতে কেউ ফল চুরি করতে না পারে। একরাত্রে— কপাল মন্দ, মালিকরা টের পেয়ে যায়। ওরা ছুটে পালিয়ে আসে। লাঠিসোটা হাতে পিছুপিছু ধাওয়া করে ক্রুদ্ধ গ্রামবাসীরা। ওদের মধ্যে একটি ছেলে বেশ মোটা ছিল, বেশি জোরে ছুটতে পারেনি, ধরা পড়ে যায় পাঞ্জাবিদের হাতে। বাকিরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে হোস্টেলে ফিরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এইসব দেহাতি পাঞ্জাবিরা সভ্যতা থেকে দূরে বাস করে। খুন-খারাবি এদের স্বভাব।
ছেলেরা বুঝে পায় না কী করবে। কিন্তু মতি হঠাৎ বলে উঠে ‘না, ওকে এভাবে ফেলে রেখে আমরা বসে থাকতে পারি না। ওকে ফিরিয়ে আনতেই হবে’–এই বলে অন্যদের কিছু বলার বা ভাববার অবকাশ না দিয়েই মতি আবার ফিরে যায়। মাল্টা-বাগানটা ছিল প্রায় তিনমাইল দূরে। মতি আবার পাঁচিল টপকে সেই তিনমাইল পথ বেয়ে বাগানের মালিকদের কাছে চলে যায়। তাদের কাছে দোষ স্বীকার করে, ভবিষ্যতে আর করবে না—এই কথা দিয়ে বন্ধুটিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। সে-সময় মতির বয়স ১২ কি ১৩। এই অল্পবয়সে এরকম বন্ধুর প্রতি দায়িত্ববোধ্ন, হিংস্র পাঞ্জাবিদের হাতে মার খাওয়ার ভয়কে তুচ্ছ করে বন্ধুকে উদ্ধার করতে যাওয়া সচরাচর দেখা যায় না। অতি অল্পবয়স থেকেই মতির মধ্যে এসব গুণের বিকাশ ঘটেছিল। তাঁর ছিল অটুট স্বাস্থ্য, অমিত সহ্যশক্তি, অদম্য সাহস, একরোখা জেদ-কোনো এক অপার্থিব আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তিনি এ পৃথিবীতে এসেছিলেন।
বিমানবাহিনীর স্কুল ও একাডেমিতে লেখাপড়ার সঙ্গেসঙ্গে হাতে-কলমেও অনেকরকম শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। এ-রকম একটি শিক্ষার নাম সারভাইভাল টেস্ট। জঙ্গলে, পাহাড়ে বা বরফাকীর্ণ প্রান্তরে বিমান বিধ্বস্ত হলে কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে ও টিকে থাকা যায় অথবা যুদ্ধকালে শত্রুভূমিতে নেমে কীভাবে আত্মরক্ষা করা যায় সে সম্পর্কে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সহিষ্ণুতা লাভের উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন ধরনের সারভাইভাল টেস্টের ব্যবস্থা থাকে পাঠ্যসূচিতে।
মতিউরের বয়স তখন ১৭ কি ১৮। একমাসব্যাপী একটা সারভাইভাল টেস্ট শুরু হয়েছে এক জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে। নিয়ম হল দুইজন করে ক্যাডেট তিন-চারদিনের জন্য জঙ্গলে-পাহাড়ে পালাতে থাকবে। তাদের পেছনে ধাওয়া করবে সৈন্যদল। কোনো ক্রমেই ধরাপড়া চলবে না। ধরা পড়লেই ওই তিন-চার দিনের অভিযানটা বাতিল হয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে এবং ধরাপড়ার জন্য নম্বরও কাটা যাবে। ক্যাডেটদের সঙ্গে খাবার, পানি, টাকা-পয়সা কিছুই দেয়া হয় না। গাছের ফল পেড়ে বা গৃহস্থের বাড়ি থেকে চেয়ে খাওয়া যাবে।
এই টেস্টে মতিউর রহমানের সঙ্গে ছিলেন আরেক বাঙালি ক্যাডেট মোমতাজ উদ্দিন আহমদ। তিনদিন ধরে পাহাড়-জঙ্গলে লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে থাকার ব্যস্ততায় তিনদিন কোথাও কোনো খাওয়া জোটাতে পারা যায়নি, পানি পেটে পড়েনি একফোঁটা। তিনদিন ধরে ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, ক্লান্তিতে মোমতাজ অজ্ঞান হয়ে যান। তখন মতি তিনমাইল হেঁটে দূরের এক গ্রামে গিয়ে সেখান থেকে খাবার ও পানি সংগ্রহ করে বন্ধুর কাছে ফিরে আসেন। অজ্ঞান বন্ধুর মাথায় পানির ঝাপটা দিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরান। জ্ঞান ফিরলে বন্ধুকে খাওয়ান। মতিও তিনদিন ধরে না-খাওয়া, দৌড়াদৌড়িতে তিনিও কম পরিশ্রান্ত ছিলেন না, তবু তিনি বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব ও মমত্ববোধে শরীরের শেষবিন্দু শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে খাড়া রেখেছিলেন— বন্ধুর প্রাণ বাঁচানোর জন্য যাতে তিনমাইল পথ হেঁটে খাবার নিয়ে আবার তিনমাইল পথ পাড়ি দিয়ে ফিরতে পারেন।
এই ঘটনার পর মোমতাজ মতির প্রাণের বন্ধু হয়ে যান।
১৯৬৩ সালে কমিশন পেয়ে দুজনেরই পোস্টিং হয় একই জায়গায় –রিসালপুরে। মতিউরের প্রাণের ভয় বলতে একেবারেই কিছু ছিল না। তাঁর ধরন-ধারণ কার্যকলাপ দেখে মনে হত জীবনমৃত্যু তাঁর পায়ের ভৃত্য। বিমানবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে একটা বিপজ্জনক প্রবণতা ছিল, মাঝেমাঝে দুই বন্ধুর মধ্যে কে বিমান চালনায় উত্তম এটা প্রমাণ করার জন্য একে অন্যকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসত। তখন দুইবন্ধু দুটো বিমান নিয়ে আকাশে উড়ত। একে অপরকে পরাজিত করার চেষ্টা করত। একে বলা ডগফাইট। বিমানবাহিনীর নিয়মাবলীতে এটা নিষিদ্ধ ছিল, তবু এই ডগফাইটে নেমে পড়ত প্রায়ই কোনো বন্ধুযুগল। কারণ ডগফাইট না করলে বোঝাও যায় না জঙ্গী বিমান নিয়ে কে কত ভালো যুদ্ধ করতে পারবে। প্লেন নিয়ে যুদ্ধ করার নৈপুণ্য বোঝার জন্য ডগফাইট অপরিহার্য। খুব দুঃসাহসী, বেপরোয়া যারা, তারাই এ-রকম চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসত–কারণ এটা খুবই বিপজ্জনক ছিল। যারা ডগফাইটে আকাশে উড়ত, তাদের নীতিই ছিল হয় জয় নয় মরণ— এর মাঝামাঝি কিছু নেই। এ-রকম একবার ঘটে দুই পাকিস্তানী বৈমানিক-বন্ধুর মধ্যে— তাতে দুজনই মারা যায়, দুটো প্লেনই বিধ্বস্ত হয়। দুজনের কারো মৃতদেহ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনার দিন-পনের পরেই মতি তাঁর এক পাকিস্তানী সহকর্মীকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসে ডগ-ফাইটের। মোমতাজ শুনে তিরস্কার করেন মতিকে। বলেন, ‘মাত্র পনের দিন আগেই এ-রকম শোকাবহ ঘটনা ঘটে গেছে। দুটো প্লেন নষ্ট, দুটো অমূল্য প্ৰাণ নষ্ট। তোমরা আবার এ-রকম মরণ-খেলায় মাততে চাও?’
মতি আর মোমতাজ একই ঘরে থাকতেন। সেদিন রাত্রে মোমতাজ অনেকক্ষণ ধরে মতিকে বোঝালেন, মতি সব শুনে চুপ করে থাকেন। মোমতাজ মনে করলেন, মতি তাঁর কথায় বুঝ মেনেছেন। কিন্তু মতির মাথায় একবার যা ঢুকত, তা তিনি না-করে ছাড়তেন না। মতি তাঁর কথা না-মেনে পরদিন সকালে পাকিস্তানী সহকর্মী বৈমানিকের সঙ্গে ডগফাইটে যাবেন, তা মোমতাজ ভাবতেও পারেননি। পরদিন সকালে মোমতাজ যথারীতি বেরিয়ে গেছেন। ফ্লাইং করে ফিরে এসে দুপুরে অফিসে বসে আছেন, মতির সেই পাকিস্তানী সহকর্মীটি অফিসে ঢুকেই মোমতাজকে দেখে কেঁদে ফেলেছেন। বলেন, সকালে তাঁরা ডগ-ফাইটে গিয়েছিলেন, মতির প্লেনে আগুন ধরে প্লেন বিধ্বস্ত হয়েছে, কিন্তু মতি প্যারাসুট দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে বের হতে পেরেছেন কিনা তা তিনি দেখতে পারেননি। বোধ হয় তিনি আর বেঁচে নাই। শুনে চারদিকে ভয়ানক হৈচৈ পড়ে গেল। সবাই দৌড়ে গেলেন দুর্ঘটনার স্থানে। প্লেনটা তখনো মাটিতে দাউদাউ করে জ্বলছে। তার বেশকিছুটা দূরে একটা জায়গায় অনেক লোকের জটলা। অন্যান্য অনেকের সঙ্গে মোমতাজও সেখানে গিয়ে দেখেন, সেই জটলার মাঝখানে একটা দড়ির চারপাইয়ে মতি শুয়ে—গ্রামের লোকেরা তাকে মহাখাতির করে দুধ, দই, লাচ্ছি, ফল এসব খাওয়াচ্ছে।
পরে মতির মুখেই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানা গেল। ডগফাইটের সময় প্লেনের গতিবেগ কম রাখলে যুদ্ধটা ভালোমতো করা যায়। কিন্তু একটা নিম্নতম গতি আছে। তার নিচে গেলে প্লেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মতি ডগফাইটে এমনই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে হঠাৎ তাঁর প্লেনের গতিবেগ খুব বেশি কমে যায় এবং মতি প্লেনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তখন প্লেনটা একখণ্ড ভারী পাথরের মতো সোজা নিচের দিকে দ্রুতবেগে পড়ে যেতে থাকে। মাটি থেকে কমপক্ষে দু-হাজার ফিট উপরে থাকা অবস্থায় প্যারাসুট নিয়ে পাইলটকে ঝাঁপ দিতে হয়। তা নাহলে পাইলটের মৃত্যু অনিবার্য। মতি কোনোমতে তিনহাজার ফিট উপর থেকে প্যারাসুট নিয়ে প্লেন থেকে ঝাঁপ দিতে সক্ষম হন।
ডগফাইট করার অপরাধে মতির কোর্টমার্শাল হয়। শাস্তিস্বরূপ দু-বছর তাঁকে গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয় অর্থাৎ এই দুইবছর তিনি আকাশে উড়তে পারবেন না। এ সময় তাঁকে অন্যান্য ডিউটি দেওয়া হয়েছিল।
মতি কখনো বেহিসেবি খরচ করতেন না, ফলে পাঁচবছর চাকুরি করার পরই পনের হাজার টাকা জমিয়ে ফেললেন এবং সেই টাকা দিয়ে লেটেস্ট মডেলের টয়োটা করোনা গাড়ি কিনে ফেললেন। কিন্তু ঐ যে বেপরোয়া স্বভাব— করাচী থেকে গাড়ি নিয়ে লাহোরের পথে এমন জোরে গাড়ি ছোটালেন যেন পায়ের তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন। ফলে যা হবার তাই হল। হঠাৎ একটা দেহাতি লোক রাস্তা পার হতে গিয়ে আচমকা গাড়ির সামনে এসে পড়ে। লোকটাকে বাঁচাতে প্রচণ্ড গতির উপরই জোরে ব্রেক কষেন মতি। সঙ্গেসঙ্গে গাড়ি যায় উলটে। সঙ্গে ছিল এক বন্ধু, তিনি গুরুতর আহত হন। গাড়িটিও চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়। কিন্তু কী আশ্চর্য! মতির গায়ে একটি আঁচড়ও লাগেনি।
এই দুটো ঘটনার উল্লেখ করে মতি প্রায়ই বলতেন, দু-দুবার দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেছি। তিনবারের বার যদি বাঁচি তাহলে দেখো আর কোনোদিনও দুর্ঘটনায় মরব না।
প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল মতিউর রহমানের। আর ছিল মাতৃভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পশ্চিম-পাকিস্তানী শাসকবর্গ-যে পূর্ব-পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত ফেলে পশ্চিম-পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য সর্বস্ব পণ করেছিল, এটাতে মতিউর খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। সে-সময় তাঁর বড় ভাই খোরশেদ আলম সিএসপি পশ্চিম পাকিস্তানেই চাকরিরত ছিলেন। মতি প্রায়ই এ-বিষয়টি নিয়ে ভাইয়ের কাছে নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন।
জীবনের দশ-এগার বছর বয়স থেকে পশ্চিম-পাকিস্তানে বাস করা সত্ত্বেও অঞ্চলের প্রতি মতির কোনোরকম আকর্ষণ বা মমতা জন্মায়নি। দুই দেশের জলবায়ু, ভাষা, জীবনযাপন প্রণালী, মানসিকতা— সবকিছুর মধ্যেই যে আকাশ-পাতাল তফাৎ, সেটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। কিংবা বলা যায়, তাঁর মতো এমন করে অন্য অনেকে হয়তো উপলব্ধি করতেন না। সুযোগ ও প্ররোচনা থাকা সত্ত্বেও তিনি অবাঙালি মেয়ে বিয়ে করেননি, তাঁর বন্ধুরাও যাতে না করে সেদিকেও খেয়াল ছিল মতির। তাঁর সন্তানেরা যাতে বাংলায় সহজে কথা বলতে শেখে, তার জন্য বাসায় উর্দুভাষী কাজের লোক পর্যন্ত রাখতেন না। অনেক খরচ ও হাঙ্গামা করে দেশ থেকে বাঙালি কাজের লোক নিয়ে যেতেন।
১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর মতিউরের দ্বিতীয় কন্যা জন্মগ্রহণ করে। আড়াই বছরের মেয়ে মাহিন ও দুই সপ্তাহের ছোট্ট মেয়ে তুহিনকে নিয়ে মিলি রহমান ১৯৭১ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা যান। মতিউরও দুইমাসের ছুটিতে দেশে যান জানুয়ারির শেষে।
১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ সারা পূর্ববাংলা জনগণের স্বাধিকারের আন্দোলনের দাবিতে উত্তাল তরঙ্গায়িত। মতিউরের চেতনাতেও ছড়িয়ে পড়ে সে তরঙ্গের দোলা।
গণহত্যা যে-রাত্রে শুরু হয়, সে-সময় তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। তাঁর বড় আরেক ভাই আতাউর রহমানও ঐদিনই ময়মনসিংহ থেকে রামনগর গ্রামে গিয়েছেন। ২৭ মার্চের রাত্রে অন্ধকার বাড়িতে বসে ব্যাটারি-চালিত রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ শুনতে পেলেন কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।
শোনামাত্র তখনি মতিউর লাফ দিয়ে উঠে একটা কেরোসিনের খালি টিন জোগাড় করে বড়ভাই ও একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের রাস্তায় বেরোলেন। কেরোসিনের টিন পিটিয়ে সারা গ্রামে জানানো হল পরদিন সকালে এক মিটিং হবে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান সেখানে বক্তৃতা করবেন। মজার ব্যাপার এই যে, সেই রাত্রেই শ’য়ে শ’য়ে গ্রামবাসী বেরিয়ে এসে মতিউরের সঙ্গেসঙ্গে চলতে লাগলেন।
মতিউর গ্রামে ছিলেন একমাস। এর মধ্যে তিনি আশপাশের অনেক গ্রামের লোকজনদের একত্রিত করে সংঘবদ্ধ করেন। কিভাবে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিহত করা যেতে পারে, সে সম্পর্কেও আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। গ্রামের মাঠে সংঘবদ্ধ লোকজনদের প্রাথমিক সামরিক ট্রেনিংও কিছু দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নরসিংদী, রায়পুরা, ভৈরব, আশুগঞ্জ ঐসব এলাকায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণ মতিউরকে ভয়ানকভাবে বিচলিত করে। তিনি নিজে পাইলট, অথচ একটা প্লেনের অভাবে তিনি বাংলার এক গ্রামে পিঞ্জরাবদ্ধ ব্যাঘ্রের মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছেন। আর তাঁরই দেশের লোকের উপর সেই প্লেন বোমা ফেলছে। পরে তিনি ঢাকা ফিরে মিলিকে বলেছিলেন, ‘জানো যে-পাইলটরা আজ আমার দেশের উপর বোমা ফেলছে, ওদেরকে আমি ট্রেনিং দিয়েছি।’
২৩ এপ্রিল বড় মেয়ে মাহিনের জন্মদিন ছিল। ঐদিন তিনি ঢাকায় ফেরেন। কিন্তু মানসিকভাবে খুবই বিচলিত ছিলেন। ঢাকায় তিনি বাশার ও সুলতান মাহমুদের সঙ্গে পরামর্শ করেন ভারতে যাবার জন্য। কিন্তু নিজের ও স্ত্রীর, দুই পক্ষেরই মুরুব্বিস্থানীয় আত্মীয়দের বাধা দানের ফলে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। বাশার ও সুলতান মাহমুদ এপ্রিলের শেষে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান।
ভগ্নহৃদয় মতিউর স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে করাচী ফিরে যাওয়া সাব্যস্ত করেন। এবং ৬ই মে ফিরেও গেলেন। সঙ্গেসঙ্গে তার জীবনধারাও যেন পালটে যায়। বাড়িতে মাত্র এক তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ার নিয়ম প্রবর্তন করলেন। কোনো অবাঙালির বাড়িতে বেড়াতে যেতেন না। কেউ সালাম দিলেও তাঁর কানে যেন ঢুকত না। পূর্ববাংলার পাকসেনাদের বর্বরতা তাঁকে এতটাই বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ করেছিল।
মিলি বুঝতেন মতিউর নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন।
করাচী ফিরে যাওয়ার পর থেকে যে-চিন্তা মতিউরকে আচ্ছন্ন করে রাখত, তা হল একটি প্লেন হাইজ্যাক করে ভারতে পালিয়ে গিয়ে তারপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া।
জুলাই মাসে পিআইএ-র একটি বোয়িং বিমান হাইজ্যাক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত প্ল্যানটি শেষমুহূর্তে ফাঁস হয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত কোনো বাঙালি অফিসারের নাম জানাজানি হয়নি। তবে এর ফলে হঠাৎ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বাঙালি বৈমানিককেই গ্রাউনডেড করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এখন থেকে কেউ আর বিমান নিয়ে আকাশে উড়তে পারবেন না। বিমান চালানো ছাড়া আর সব কাজেই তাদের নিয়োজিত করা হল। ফ্লাইট লেফটেনান্ট মতিউর রহমানকে করাচী মসরুর বিমানঘাঁটিতে বেসফ্লাইট সেফটি অফিসারের পদে রাখা হল। ফ্লাইট লেফটেনান্ট মোমতাজউদ্দিন আহমদকে এক অজ পাহাড়ি এলাকায় বিমানবাহিনীর এক স্কুলের হেডমাস্টার করে পাঠানো হল।
জুলাই মাসে পিআইএ বোয়িং হাইজ্যাক প্ল্যান বানচাল হওয়াতে মতিউর আরো মরিয়া হয়ে উঠলেন।
ছুটিতে দেশে যাবার আগে তিনি পাইলট অফিসার রাশেদ মিনহাজকে জেটবিমান উড্ডয়ন শিক্ষা দিতেন। মতিউর মনে মনে পরিকল্পনা নিলেন, মিনহাজ যখন প্লেনে চড়ে উড়তে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তে তিনিও ঐ প্লেনে চড়ে মিনহাজসহই বিমানটি হাইজ্যাক করবেন এবং সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আকাশে প্রবেশ করবেন। তখন কাছাকাছি গুজরাটের জামনগর বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করা তার পক্ষে কঠিন হবে না।
এই পরিকল্পনার কথা তিনি কাউকেই বলেননি। এমনকি তাঁর স্ত্রী মিলিও তার কথাবার্তা হাবভাবে বুঝতে পারেননি যে মতিউর এতবড় একটা অ্যাকশন করতে যাচ্ছেন।
মতিউর রহমান ২০ আগস্ট শুক্রবারকে বেছে নেন তার পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য। ঐদিন সকাল এগারটার দিকে পাইলট অফিসার মিনহাজের টি-৩৩ বিমান নিয়ে উড়বার শিডিউল ছিল। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রত্যেক বিমানের একটা সাংকেতিক নাম থাকে। টি-৩৩ বিমানটির নাম ছিল ব্লু-বার্ড ১৬৬। পাইলট অফিসার মিনহাজ ব্লু-বার্ড ১৬৬ নিয়ে উড়বার অনুমতি চাইলে কন্ট্রোল টাওয়ার তাঁকে নিয়মমাফিক অনুমতি অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ারেন্স দেয়। কন্ট্রোল টাওয়ারে তখন ডিউটিতে ছিলেন বাঙালি পাইলট অফিসার ফরিদউজ্জামান এবং পাকিস্তানী বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেনান্ট আসিম।
পাইলট অফিসার মিনহাজ যখন টি-৩৩ বিমানটি নিয়ে ২৭ নং রানওয়েতে ঢোকার জন্য ৪নং ‘ট্যাক্সি-ট্রাক’ দিয়ে এগিয়ে টিলার আড়ালে পৌঁছেন, তখন ফ্লাইট লেফটেনান্ট মতিউর রহমান নিজের গাড়ি চালিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে গেলেন ৪নং ট্যাক্সি-ট্রাকে। তিনি মিনহাজকে বিমান থামানোর সংকেত দেখালেন। নিয়ম হল কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমান নিয়ে উড়বার ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরও যদি ফ্লাইট সেফটি অফিসার কোনো বিশেষ কারণে বৈমানিককে বিমান থামানোর সংকেত দেখান, তাহলে বৈমানিক বিমান থামাতে বাধ্য থাকেন। ফ্লাইট সেফটি অফিসার মতিউরের সংকেতে মিনহাজ বিমান থামিয়ে ক্যানোপি (বৈমানিকের বসার স্থানের উপর স্বচ্ছ আবরণ ) খোলেন। মতিউর দ্রুতগতিতে ককপিঠে উঠে যান। তার আগে তিনি নিজের মোটরগাড়িটিকে বিমানের পিছনে এমনভাবে পার্ক করেছিলেন যাতে অন্য কোনো বিমান তাড়াতাড়ি টি-৩৩ কে ধাওয়া করতে না পারে।
রানওয়েতে, ট্যাক্সি-ট্রাকের মাঝপথে বিমানটিকে থেমে গিয়ে ক্যানোপি খুলতে দেখে, কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে পাইলট অফিসার ফরিদউজ্জামান ব্লু-বার্ড ১৬৬-কে জিজ্ঞাসা করেন কোনো রকম অসুবিধা আছে কিনা? ব্লু-বার্ড ১৬৬ থেকে কোনো জবাব আসেনি। হঠাৎ ব্লু-বার্ড ১৬৬ দ্রুত রানওয়ের দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তার আগেই একটি বিমান অবতরণ করায় রানওয়ে খালি হয়ে গিয়েছিল। এই সুযোগে ব্লু-বার্ড ১৬৬ আকাশে উঠে যায়। উঠার সময় দেখা যায় বিমানটি ভীষণভাবে ডাইনে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে দুলছে। একে তো কন্টোল টাওয়ার থেকে অনুমতি না নিয়ে কোনো বিমানেরই রানওয়েতে ঢোকার কথা নয়, অথচ এই বিমানটি রানওয়েতে ঢুকে আকাশেও উঠে গেছে।
আসলে ককপিটের ভিতরে তখন মতিউর ও মিনহাজ প্রচণ্ড ঝাপটা ঝাপটি করছিল বিমানের নিয়ন্ত্রণ দখলের জন্য। রানওয়ের মাত্র কয়েকফুট উপর দিয়ে বিপজ্জনকভাবে বিমানটি উড়ে গেল এবং এর পরপরই বিমান থেকে কন্ট্রোল টাওয়ারে খবর গেল—’ব্লু-বার্ড ১৬৬ ছিনতাই হয়েছে।’
কন্ট্রোল টাওয়ারে ডিউটিরত পাইলট অফিসার ফরিদউজ্জামান হতচকিত হয়ে জানতে চাইলেন, ছিনতাই নিশ্চিত করে জানাও। বেতার-সেটে মতিউরের পরিষ্কার কণ্ঠস্বর ভেসে এল—নিশ্চিত।’
রাডারে যাতে বিমানের অবস্থান ধরা না যায় তারজন্য ব্লু-বার্ড খুব নিচু দিয়ে উড়ে গেল। বিমানের ডানা দুটি তখনও জোরে কাঁপছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমানটি দিগন্তে মিলিয়ে গেল।
এদিকে কন্ট্রোল টাওয়ারে তখন হুলুস্থুল পড়ে গেছে। পাকিস্তানী ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আসিম সঙ্গেসঙ্গে বেস-কমান্ডারকে ব্লু-বার্ড ছিনতাইয়ের খবর জানালেন। বেস-কমান্ডারও খবর পাওয়া মাত্র দ্রুত কন্ট্রোল টাওয়ারে চলে এলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুটি এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান ব্লু-বার্ড ১৬৬-এর খোঁজে উড়ে গেল। বাম্বীন এবং থাট্টার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রাডার-স্টেশনকে ব্লু-বার্ডের অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ দিতে বলা হলে তারা জানায় কেউই বিমানটির গতিবিধি বুঝতে পারছে না। মতিউর জেনে-শুনেই ব্লু-বার্ডকে খুব নিচু দিয়ে উড়িয়েছিল যাতে রাডার প্লেনটির অবস্থান ধরতে না পারে।
সারাদিনে অনেক চেষ্টা করেও ব্লু-বার্ডের কোনো হদিস করা গেল না। বিকালের দিকে খবর পাওয়া গেল — থাট্টার অদূরে ব্লু-বার্ড বিধ্বস্ত হয়েছে এবং দুজন বৈমানিকই নিহত হয়েছেন।
স্বাধীনতা-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় মতিউর রহমান স্ত্রী-কন্যা-পরিবার-ভবিষ্যৎ সব ভুলে গিয়েছিলেন। জীবনের প্রতি মায়াও মনে হয় চলে গিয়েছিল। তা না হলে কী উন্মাদনায় তিনি পাইলটের পোশাক এবং প্যারাস্যুট ছাড়াই বিমানে উঠেছিলেন? ধারণা করা হয় যে, খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাবার শেষমুহূর্তে পাইলট অফিসার মিনহাজ প্যারাসুটের সাহায্যে নামার চেষ্টা করেছিলেন এবং ভূমি থেকে বিমানের উচ্চতা কম হওয়ার দরুণ প্যারাস্যুটটি খোলেনি এবং মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মতিউরের দেহ মাটিতে ছিটকে-পড়া সত্ত্বেও প্রায় অক্ষত ছিল। অনুমান করা হয়, প্লেনটিও মাটিতে বিধ্বস্ত হবার পূর্বক্ষণে মতিউরের দেহ ছিটকে পড়ে।
পাকিস্তানীরা পরে ফ্লাইট লেফটেনান্ট মতিউর রহমানকে মশরুর বিমানঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থানে জানাজা এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কবর দেয়।