পলাশের বীর

পলাশের বীর

ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন বীরশ্রেষ্ঠ

নোয়াখালী জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম বাঘচাপড়া—বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের যে-কোন একটির মতোই। সোনাইমুড়ি রেলস্টেশনে নেমে রিকশা নিতে হয়। নান্দীবাজার পর্যন্ত পৌঁছানোর পর রিকশাও আর চলে না। তখন শুধু হেঁটেই পৌঁছাতে হয় বাঘচাপড়া গ্রামে।

কিন্তু এই অতি সাধারণ ছোট্ট গ্রামে জন্মেছিলেন এক অসাধারণ মানুষ, মোহাম্মদ রুহুল আমিন—যাঁর দেশপ্রেম, বীরত্ব ও ত্যাগের জন্য বাঘচাপড়া গ্রাম চিরকালের মতো ইতিহাসের পাতায় মুদ্রিত হয়ে গেছে সোনার অক্ষরে।

রুহুল আমিনের বাবা আজহার পাটোয়ারী গ্রামের একজন মোটামুটি সচ্ছল গৃহস্থ ছিলেন। মার নাম জোলেখা খাতুন। ১৯৩৫ সালে আষাঢ়ের এক বর্ষণমুখর রাতে রুহুল আমিনের জন্ম। বাবা-মার প্রথম সন্তান, খুব আদরের ছিলেন। পরে তাঁর আরো দুটি ভাই ও চারটি বোন হয়। তা সত্ত্বেও, বিরাট সংসারে রুহুল আমিন বরাবরই বিশিষ্ট হয়ে থেকেছিলেন। নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনদের কাছে তো বটেই পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামের মানুষ-জনের কাছেও রুহুল আমিন এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী রুহুল আমিনকে সবাই ভালোবাসতেন, একদল লোকের মধ্যেও তাঁর মাথা সকলের উপরে জেগে থাকত, বহুদূর থেকে দেখেও তাঁকে চেনা যেত।

বাঘচাপড়া গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পড়া শেষ করে রুহুল আমিন পার্শ্ববর্তী থানা আমিষাপাড়ার হাইস্কুলে পড়া শুরু করেন।

প্রথমদিকে আজহার পাটোয়ারীর সংসারে অভাব-অনটন না থাকলেও সংসার বড় হওয়ার সাথে সাথে সচ্ছলতা কমতে শুরু করে। ফলে হাইস্কুলের পড়া শেষ করেই রুহুল আমিনকে ভাবতে হয় জীবিকার কথা। উপার্জন করে পিতাকে একটু আরাম দেবার কথা।

১৯৫৩ সালে তাই তিনি যোগ দেন নৌ-বাহিনীতে জুনিয়ার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। চাকরি হবার পর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেবার জন্য তাঁকে যেতে হয় করাচীর অদূরে আরব সাগরের মধ্যে অবস্থিত মানোরা দ্বীপে পিএনএস বাহাদুর-এ প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর পিএনএস কারসাজে ( নৌবাহিনীর কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ হয়। ১৯৬৫ সালে মেকানিশিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন এবং পিএনএস কারসাজে কোর্স সমাপ্ত করার পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পিএনএস বখতিয়ার নৌ-ঘাঁটিতে বদলি হন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রুহুল আমিন পিএনএস বখতিয়ার ঘাঁটি ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ২নং সেক্টরে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ২নং সেক্টরের অধীনে বহু স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টর থেকে নৌ-বাহিনীর সদস্যদের সেপ্টেম্বর মাসে আগরতলায় একত্রিত করা হয়। ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন নৌ-বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আগরতলায় একত্রিত হয়ে কলিকাতায় আসেন।

ভারত সরকার কলিকাতা বন্দরে কর্তব্যরত দুটি টাগ বোট বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী গঠনের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীকে উপহার দেন। টাগ-বোট দুটিকে কলিকাতার গার্ডেনরীচ নৌ-ওয়ার্কশপে আনা হয় এবং প্রত্যেকটি টাগ বোট কানাডীয় ধরনের দুটি বাফার-গান লাগিয়ে এবং ব্রিটিশ ধরনের ৫০০ পাউন্ড ওজনের চারটি মার্ক-মাইন বহন করার উপযোগী করে গানবোটে রূপান্তরিত করা হয়। ৭১-এর ১২ অক্টোবর কলিকাতার মেয়র প্রফুল্লকুমার ঘোষ গার্ডেনরীচ জেটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে গানবোট দুটিকে পানিতে ভাসান। এ দুটির নামকরণ করা হয় ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’।

‘পলাশের’ প্রধান ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় মোহাম্মদ রুহুল আমিনকে।

৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখল করে। মংলা বন্দরে পাকিস্তানী নৌঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর দখল করার উদ্দেশ্যে ‘পদ্মা’ ‘পলাশ’ এবং মিত্রবাহিনীর গানবোট ‘পানভেল’ হলদিয়া ঘাঁটি থেকে রওনা হয় বাংলাদেশের দিকে। সুন্দরবনের আড়াইবানকিতে ভারতীয় সীমান্ত-রক্ষীবাহিনীর পেট্রলক্রাস্ট ‘চিত্রাঙ্গদা’ ৮ ডিসেম্বর পদ্মা, পলাশ ও পানভেলের সঙ্গে যোগ দেয়। এই নৌ-অভিযানের অফিসার -ইন-টেকনিক্যাল কমান্ড ছিলেন ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ সামন্ত। ৯ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে কোনো বাধা ছাড়াই গানবোটগুলি হিরণ-পয়েন্টে প্রবেশ করে। হিরণ-পয়েন্টে রাত্রি যাপনের পর ১০ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে গানবোটগুলি মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পাকিস্তানী সৈন্যদের কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই সকাল সাড়ে সাতটায় মংলা বন্দরে পৌঁছায়। মংলা বন্দরে ভারতীয় সীমান্ত-রক্ষীবাহিনীর পেট্রলক্রাস্ট ‘চিত্রাঙ্গদা’ থেকে যায়।

সকাল সাড়ে নটায় শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযান। গানবোট পাভেল আগে, পিছনে পলাশ, তার পিছনে পদ্মা। প্রায় ১২টার সময় গানবোটগুলি যখন খুলনা শীপইয়ার্ডের কাছাকাছি, তখন অনেক উঁচুতে তিনটি জঙ্গী বিমান দেখা যায়।

শত্রুর বিমান অনুমান করে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। জবাবে ক্যাপ্টেন সামন্ত জানান— বিমানগুলি ভারতীয়, সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও, হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবেই বিমানগুলি নিচে নেমে এসে বোমাবর্ষণ করে প্রথমে গানবোট পদ্মার উপর, এবং পরে পলাশের উপর। গোলা সরাসরি পদ্মার ইঞ্জিনরুমে পড়ায় ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। বহু নাবিক হতাহত হয়। গানবোট পলাশ এবং পানভেল তখনো সচল। এমন সময় পলাশের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী আদেশ দেন, ‘জাহাজ ত্যাগ কর।’ ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার রুহুল আমিন ইঞ্জিনরুমে প্রাণপণে চেষ্টা করছিলেন ইঞ্জিন সচল রাখার জন্য। লে. ক. রায় চৌধুরীর জাহাজ ত্যাগ করার আদেশে তিনি ক্ষুব্ধ হন। উপরে এসে চিৎকার করে জানতে চান, জাহাজ থামাতে বলা হয়েছে কেন? পরাজয়ের গ্লানি বরণ করবেন, এ তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। চিৎকার করে সবাইকে অনুরোধ করে বলতে লাগলেন, মৃত্যুর ভয়ে আমরা ভীত নই। আমরা এগিয়ে যাবই। যুদ্ধ করে জয়ী হব। কিছুতেই উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হব না। কামানের ক্রুদের বললেন বিমানের দিকে গুলি করতে। নিজে ফিরে গেলেন ইঞ্জিনরুমে। একদিকে অধিনায়কের আদেশে এবং অন্যদিকে রুহুল আমিনের প্রতিবাদে বিভ্রান্ত সব নাবিক। এদিকে বিমানগুলি আবার ফিরে এসে পিছন থেকে গোলাবর্ষণ করে গানবোট পলাশের উপর।

ধ্বংস হল পলাশের ইঞ্জিনরুম।

পলাশের রঙ গায়ে মেখে শহীদ হলেন মোহাম্মদ রুহুল আমিন।

রুহুল আমিন অনায়াসেই জাহাজ ত্যাগ করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি। কারণ সেইমুহূর্তে তিনি সম্মুখ-সমরে অবতীর্ণ এক দুঃসাহসী বীর নাবিক। সেইমুহূর্তে নিজের প্রাণের চেয়েও মূল্যবান তাঁর রণতরী, সেই রণতরীকে রক্ষা করা তাঁর জীবনের পবিত্রতম দায়িত্ব। তাঁর কর্তব্যজ্ঞান এবং দেশপ্রেমের কাছে জীবনের মায়া তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। জাহাজের ভাগ্যের সঙ্গে নিজ ভাগ্যকে তিনি মিলিয়ে দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *