মীর মশাররফ হোসেন

মীর মশাররফ হোসেন

উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যস্রষ্টাব্দের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১১) নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। রচনার আধিক্যে ও প্রতিভার গৌরবে তিনি বাংলার সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে সুপরিচিত হয়েছেন। তাঁর চল্লিশ বছরের সাহিত্যসাধনায় আমরা পঁচিশটি প্রকাশিত গ্রন্থ ও সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় ছড়ানো আরো অনেক রচনা লাভ করেছি। বিষয় ও আঙ্গিকের দিক দিয়েও এগুলো বিচিত্র : এর মধ্যে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কবিতা, প্রবন্ধ, জীবনচরিত, ধর্মবিষয়ক রচনা—সবই আছে।

১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে নদিয়া জেলার অন্তর্গত লাহিনীপাড়া গ্রামে মশাররফ হোসেনের জন্ম হয়। তাঁর পিতা মীর মোয়াজ্জম হোসেন বিষয়সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। জগমোহন নন্দীর পাঠশালায়, কুষ্টিয়ার ইংরেজি-বাংলা স্কুলে, পদম্দীর নবাব-স্কুলে ও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে মশাররফ হোসেন শিক্ষাগ্রহণ করেন। কলকাতায় পিতৃবন্ধু নাদির হোসেনের গৃহে অবস্থানকালে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা লতীফ-উন-নেসার সঙ্গে তাঁর বিবাহ স্থির হয়, কিন্তু ঘটনাক্রমে বিবাহ সম্পন্ন হয় নাদির হোসেনের দ্বিতীয়া কন্যা আজীজ-উন-নেসার সঙ্গে (১৮৬৫)। এ-বিবাহ সুখের হয়নি। আট বৎসর পর তিনি বিবি কুলসুমকে বিবাহ করেন (১৮৭৩)। ‘মশাররফ হোসেন জীবনের বেশির ভাগ সময় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে ও ১৮৯১ সাল হইতে দেলদুয়ার এস্টেটে ম্যানেজারের পদে কাজ করিয়াছিলেন।’ ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

মশাররফ হোসেনের সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত হয় রামচন্দ্র গুপ্ত-সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় এবং কাঙাল হরিনাথ মজুমদার-সম্পাদিত গ্রামবার্তা-প্রকাশিকায় (১৮৬৩-৭৪)। তাঁর দীর্ঘকালের সাহিত্যজীবনকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায়ে (১৮৬৯-১৮৯৯) শিল্পসৃষ্টিই মুখ্য, দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৯০০-১৯১০) প্রধান হয়ে উঠেছে তাঁর ধর্মচেতনা।

তাঁর প্রথম বই রত্নবতী (১৮৬৯) রচনা হিসেবে অকিঞ্চিৎকর। নামপত্রে ‘কৌতুকাবহ উপন্যাস’ বলে বিজ্ঞাপিত হলেও উপন্যাসের লক্ষণ এতে নেই। এটি একটি রূপকথাজাতীয় উপাখ্যান, কিন্তু প্লট এবং ভাষা, দুদিক দিয়ে লেখাটি বড় দুর্বল। ধন বড়, না বিদ্যা বড়, এই নিয়ে গুজরাট নগরের রাজপুত্র সুকুমারের সঙ্গে মন্ত্রিতনয় সুমন্তের মধ্যে তর্ক উপস্থিত হয় এবং তার মীমাংসার জন্যে তাঁরা এক অচেনা দেশে গিয়ে পৌঁছোন। নানা ঘটনাজালে জড়িয়ে গিয়ে সুকুমার রাজগৃহে বন্দি হন। পরে সুমন্তের কৌশলে তিনি মুক্তি এবং সেইসঙ্গে রাজকন্যা রত্নবতীকে লাভ করেন। পুরস্কারস্বরূপ সুমন্ত সেদেশের মন্ত্রিকন্যাকে স্ত্রীরূপে পান।

মিশ্র ভাষারীতির কাব্যের মতো অতিপ্রাকৃতিক উপাদান এখানেও প্রাধান্য বিস্তার করেছে। তাই দেখি, এক সরোবরের পানি ছিটিয়ে দিলে মানুষ কপীরূপ ধারণ করে, আরেক সরোবরের পানিতে সে পূর্বরূপ ফিরে পায়। অঙ্গুরীয় হয়ে ওঠে অভীষ্ঠদাত্রী। কাল ও স্থানগত পটভূমি বলেও রচনাটিতে কিছু পাই না—যা কিনা উপন্যাসের পক্ষে অপরিহার্য। রচনারীতির লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তৎসম শব্দের আধিক্য :

একদা প্রভাকর দৈনিক কার্য্য সমাধানান্তর লোহিত বসনাবৃত হইয়া পশ্চিমাচলে গমনোদ্যোগ করিতেছেন, এমন সময় রাজনন্দন ও মন্ত্রিতনয় অত্যুৎকৃষ্ট বেশভূষায় ভূষিত হইয়া প্রদোষকালে বায়ু সেবন করিতে বহির্গত হইলেন।

ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় রত্নবতীর একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়। সমালোচক বইটির প্রশংসা করেননি, শেষে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, কোনো হিন্দু লেখক মুসলমানের ছদ্মনামে এটি রচনা করেছেন। সমালোচনাটির মূল বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেও শেষ বাক্যে এসে চমক না লেগে পারে না। তখনো—যাকে বলা হয়, সাধু বাংলা ভাষা—সেই ভাষায় বাঙালি মুসলমান লেখকেরা বিশেষ আত্মপ্রকাশ করেননি বলে এক্ষেত্রে তাঁদের প্রবেশ ছিল অপ্রত্যাশিত। তাই মশাররফ হোসেনের নামের অন্তরালে হিন্দু লেখক আত্মগোপন করে আছেন বলে ধরে নেওয়া হলো। এই মনোভাবের অপনোদন করতে মশাররফ হোসেন সমর্থ হয়েছিলেন,—বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর এ কীর্তি নগণ্য নয়।

বসন্তকুমারী নাটক (১৮৭৩) মশাররফ হোসেনের দ্বিতীয় রচনা। কোনো প্রচলিত উপাখ্যান-অবলম্বনে এটি লিখিত হয়। একই মূল অবলম্বন করে জি.সি. গুপ্ত লিখেছিলেন কীর্ত্তিবিলাস নাটক (১৮৫২) এবং কাঙাল হরিনাথ বিজয়বসন্ত উপাখ্যান। এই নাটক প্রকাশের অল্পকাল পূর্বেও সংস্কৃত নাটকের রীতিতে নাট্যরচনার যে-রেওয়াজ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল, বসন্তকুমারীতে তারই অনুসৃতি দেখতে পাই। নাটকের সূচনায় প্রস্তাবনার সংযোজনে এবং নট ও নটীর কথোপকথনে তিনি সেই ধারাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে প্রস্তাবনার কৌতূহলোদ্দীপক অংশ উদ্ধৃত করি :

নট ॥ আজকাল ভদ্র সমাজে নাটকের অভিনয়ই প্রধান আমোদ বলে গণ্য হয়েছে। অতএব প্রিয়ে! তোমায় আজ একটি নূতন নাট্যাভিনয় কোরতে হবে।

নটী ॥ আজকাল নব্য সমাজে নাটকের সমাদর হয়েছে বটে, কিন্তু এই সকল বিজ্ঞজনমণ্ডিত সভায় নাট্যাভিনয় করা সহজ কথা নয়।

নট ॥ (কিঞ্চিৎ নিস্তব্ধ থাকিয়া) কিছুদিন হলো শুনেছি বসন্তকুমারী নামে একখানি নাটক প্রকাশ করা হয়েছে, অদ্য তারই অভিনয় করা যাক।

নটী ॥ বসন্তকুমারী!!! কার রচিত ?

নট ॥ কুষ্টিয়া নিবাসী মীর মশাররফ হোসেন রচিত।

নটী ॥ ছি ছি!! এমন সভায় মুসলমানের লিখিত নাটকের নাম কোল্লেন!

নট ॥ কেন ? মুসলমান বলে কি একেবারে অপদস্ত হলো ?

নটী ॥ তা নয়, এই সভায় কি সেই নাটকের অভিনয় ভাল হয় ? হাজার হোক মুসলমান।

নট ॥ অমন কথা মুখে আনিও না। ঐ সর্ব্বনেশে কথাতেই ভারতের সর্ব্বনাশ হচ্ছে।

নটী ॥ নাথ! ক্ষমতা কোরবেন। আপনাদের আজ্ঞা আমার শিরোধার্য্য। কিন্তু বসন্তকুমারী নাটকের অভিনয় করে শেষে মনস্তাপ পাবেন, গঞ্জনার ভাগী হবেন। সভাস্থ মহোদয়গণের চিত্তরঞ্জন করা দূরে থাক বরং তাদের বিরক্তিই হবে।

যে-মনোভাব থেকে ক্যালকাটা রিভিউর সমালোচক রত্নবতীকে মুসলমানের লেখা বলে মনে করতে পারেননি, সেই মনোভাবেরই পরিচয় পাই নটীর উক্তিতে। উপরিউক্ত অংশটি তাই আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

রত্নবতী উপন্যাসে এবং বসন্তকুমারী নাটকে সমসাময়িক স্থান, কাল ও পাত্রপাত্রীর কোনো ছাপ নেই। কিন্তু বাস্তব প্রতিবেশ সম্পর্কে মশাররফ হোসেন যে অচেতন ছিলেন না, তার প্রমাণ এখানে পাই। শুধু তাই নয়। হিন্দু-মুসলমানের মিলন-কামনায় লেখক বিশেষ আগ্রহশীল, অথচ তাঁর সমকালীন মুসলমান সমাজে প্রধানত স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনারই লালনপালন চলছিল।

বসন্তকুমারী তিন অঙ্কের নাটক, মোট এগারোটি রঙ্গভূমি বা দৃশ্য আছে। প্রস্তাবনার গানটিসহ মোট আটটি গান এতে সংকলিত হয়েছে। কাহিনি সংক্ষেপে এই : সপত্নীপুত্র নরেন্দ্রের কাছে প্রণয়নিবেদন করে ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে ইন্দ্রপুরের রানি রেবতীর চিত্তে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। রাজা বীরেন্দ্রসিংহের কাছে নরেন্দ্রের নামে মিথ্যে অভিযোগ করে তিনি তার প্রাণদণ্ড ঘটালেন। নরেন্দ্রের স্ত্রী বসন্তকুমারী স্বামীর সহগমন করলেন। শেষ মুহূর্তে সমুদয় অবগত হয়ে বীরেন্দ্রসিংহ রেবতীকে হত্যা করে স্বয়ং মৃত্যুবরণ করলেন।

নাম-চরিত্র বসন্তকুমারীকে নায়িকা বলে অনুমান করা স্বাভাবিক হলেও নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছেন রেবতী। সংস্কৃত রীতি-অনুযায়ী রেবতীর রূপ-যৌবনের যে-বর্ণনা নাটকে আছে এবং তার যে-বুদ্ধিমত্তার পরিচয় এতে পাই, তার সঙ্গে তার বয়সের (প্রথম অঙ্ক, চতুর্থ রঙ্গভূমিতে বিমলা বলছে যে, রেবতী ১৪ পেরোয়নি) অবশ্য মিল নেই। চরিত্রগুলি মোটামুটি সু-অঙ্কিত, বসন্তকুমারী একটু প্রাণহীন। রচনারীতি প্রশংসনীয়, সংলাপ-রচনায় কাঁচা হাতের ছাপ নেই। পয়ার ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার মধ্যে মধ্যে আছে, তবে তাতে তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

তাঁর তৃতীয় রচনা গোরাই ব্রিজ অথবা গৌরী সেতু (১৮৭৩) বসন্তকুমারীর আগেই ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল। বঙ্গদর্শনে এর সমালোচনায় লেখা হয় :

গ্রন্থখানি পদ্য। পদ্য মন্দ নহে। এই গ্রন্থকার আরও বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার রচনার ন্যায় বিশুদ্ধ বাঙ্গালা অনেক হিন্দুতে লিখিতে পারে না।

ইহার দৃষ্টান্ত আদরণীয়। বাঙ্গালা হিন্দু-মুসলমানের দেশ—একা হিন্দুর দেশ নহে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান এক্ষণে পৃথক—পরস্পরের সহিত সহৃদয়তাশূন্য। বাঙ্গালার প্রকৃত উন্নতির জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে হিন্দু-মুসলমানে ঐক্য জন্মে। যতদিন উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদিগের মধ্যে এমত গর্ব্ব থাকিবে যে, তাঁহারা ভিন্ন দেশীয়, বাঙ্গালা তাঁহাদের ভাষা নহে, তাঁহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না বা বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দ্দু ফার্সির চালনা করিবেন, ততদিন সে ঐক্য জন্মিবে না। কেননা জাতীয় ঐক্যের মূল ভাষার একতা। অতএব মীর মশাররফ হোসেন সাহেবের বাঙ্গালা ভাষানুরাগিতা বাঙ্গালীর পক্ষে বড় প্রীতিকর। ভরসা করি, অন্যান্য সুশিক্ষিত মুসলমান তাঁহার দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইবেন।

এই সমালোচনায় কথিত বাংলা ভাষা সম্পর্কে অভিজাত মুসলমানদের মনোভাব লক্ষণীয়। এই কারণেই, মুসলমানের লেখা বাংলা রচনামাত্রই অমুসলমান পাঠক ও সমালোচকের কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হতো। মশাররফ হোসেনের এই প্রথম কাব্যগ্রন্থটি রচনা হিসেবে অকিঞ্চিৎকর, এক স্থানে লর্ড মেয়োর প্রশস্তি আছে।

একই বছরে তাঁর জমীদার দর্পণ নাটক প্রকাশিত হয় (১৮৭৩)। এটির মূলে যে দীনবন্ধুর নীলদর্পণ নাটকের (১৮৬০) প্রভাব কার্যকর ছিল, তা যেমন এর নামকরণে, তেমনি ঘটনাবিন্যাসেও সুস্পষ্ট। দীনবন্ধুর নাট্যরচনার উদ্দেশ্য যেমন নীলকরদের অত্যাচারের চিত্র পরিস্ফুট করে তোলা, মশাররফ হোসেনের উদ্দেশ্য তেমনি জমিদারদের অত্যাচারের চিত্র অঙ্কন করা। তিনি ইঙ্গিত করেছেন যে, ঘটনাটি সত্যমূলক।

প্রসঙ্গক্রমে উনিশ শতকের বাংলার হঠাৎ-নবাবদের সম্পর্কে শ্লেষোক্তি সন্নিবেশিত হয়েছে :

সূত্র [ধর] ॥ (ক্ষণকাল নিস্তব্ধে) আচ্ছা মফস্বলে এক রকম জানওয়ার আছে জানেন তারা কেউ কেউ সহরেও বাস করে, সহরের কুকুর কিন্তু মফস্বলে ঠাকুর! সহরে তাদের কেউ চেনে না, মফস্বলে দোহাই ফেরে।… বলব কি জানওয়ারেরা আপন আপন বনে গিয়ে একেবারে বাঘ হয়ে বসে।… এ জানওয়ারদের চারখানা পাও নাই। এরা খাসা পোষাক পরে, দিব্বি সরুচালের ভাত খায়। সাড়ে তিন হাত পুরুগদীতে বসে, খোসামোদের কুকুরেরাও গদীর আশেপাশে ল্যাজ গুড়িয়ে ঘিরে বসে থাকে।… এরা আবার দুই দল।

নট ॥ দল আবার কেমন ?

সূত্র ॥ যেমন হিন্দু আর মুসলমান।

জমীদার দর্পণ তিন অঙ্কের নাটক। দুশ্চরিত্র জমিদার হায়ওয়ান আলীর লালসার অগ্নিতে জনৈক রায়তের পত্নী নুরুন্নেহার অনিচ্ছুক আত্মাহুতিদানই নাটকটির মূল ঘটনা। জমিদারের স্বেচ্ছাচার ও অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে আমিরনের উক্তি উদ্ধৃতিযোগ্য :

মাটির হাকিম মেরে ফেল্লে তুমি কি কর্ব্বে ? তার নামে তো আর সাএবদের কাছে নালীস কর্ত্তে পার্ব্বে না ? নালীস কল্লে এই হবে, এক দিনে তোমার ভিটেয় পুকুর করে দেবে। জমীদারের সঙ্গে কার কথা সে কি না কর্ত্তে পারে ?

আপন ক্ষমতামদমত্ত জমিদার কিন্তু স্বেচ্ছাচারের প্রবৃত্তি সত্ত্বেও ইংরেজ আইনকে ভয় করেন :

ওহে আমাদের তেজ না আছে এমন নয়, আমরা যে কিছু না কর্ত্তে পারি তাও নয়, তবে সে এককাল ছিল, এখন ইংরেজি আইন, বিষ-দাঁত ভাঙ্গা!… আগে আগে আমরা মফস্বলে কত কি করিছি, কার সাধ্য যে মাথা তুলে একটা কথা বলে ? এখন পায় পায় জেলা পায় পায় মহকুমা, কোণের বউ পর্যন্ত আইন আদালতের খবর রাখে, হাইকোর্টের চাপরাসীরাও ইকুইটি আর কমন লর মারপ্যাঁচ বোঝে!

ইংরেজ শাসনব্যবস্থার, বিশেষ করে তার বিচার বিভাগের, অপরিসীম ক্ষমতার প্রতি যে-সশ্রদ্ধ অভিবাদন নাট্যকার এখানে করতে চেয়েছেন, তা আমাদের উনিশ শতকী পরিবেশের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল। দ্বিতীয় অঙ্ক, তৃতীয় গর্ভাঙ্কে বিপন্ন নুরুন্নেহারও কাতর আবেদন জানিয়েছে মহারানি ভিক্টোরিয়াকে :

শুনেছি যে মহারানী সকলের ওপরে বড়, ঐ সাএবদের ওপরেও বড়, আমরা যেমন তোমার প্রজা, তেমনি তুমিও তাঁর প্রজা। তিনি কি এর বিচার কর্ব্বেন না ? প্রজার প্রজা বলে কি আর দয়া হবে না ? মা! তুমি বেলাতে থাক, তোমার প্রজার প্রতি এই দৌরাত্ম্য হচ্ছে তুমি কি তা জান্তে পাচ্ছো না ? কেবল বড় বড় লোকই কি তোমার প্রজা ? আমরা গরীব বলে কি তুমি আমাদের মা হবে না ?

উনিশ শতকের অনেক বাঙালি লেখকের এবং সমাজকর্মীর মতো মশাররফ হোসেনও অন্যায়-অত্যাচার দেখে শঙ্কিত হয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন, প্রতিবাদের প্রেরণা অনুভব করেছেন। কিন্তু সেইসব অন্যায়-অত্যাচারকে অসংলগ্ন ঘটনা বলে মনে করেছেন—এসব যে একটা বিশেষ সামাজিক বা শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফল, এ-উপলব্ধি তাঁদের চিত্তে জাগেনি। চিন্তাধারার এই অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও তাঁদের বেদনাবোধের যে একটা বিশেষ মূল্য আছে, তা অস্বীকার করা যায় না।

এই বেদনাবোধের প্রকাশে এবং—তার চাইতেও যা বড় কথা—সম্পূর্ণ সম্প্রদায়নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তনে মশাররফ হোসেন আমাদের শ্রদ্ধা দাবি করেন। সমসাময়িক জীবনযাত্রা নিয়ে লেখা এটিই তাঁর প্রথম সাহিত্যকর্ম। মুসলমান জমিদার মুসলমান প্রজার উপরেই কেবল অত্যাচার করেছেন, তা নয়, আদালতে তাঁর পক্ষ সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছে হরিদাস বৈরাগী আর তিতু মোল্লা—দুই সম্প্রদায়ের দুই ধর্মপ্রাণ চরিত্র। জীবনের অভিজ্ঞতায় মশাররফ হোসেন দেখেছিলেন যে, এই ধরনের চরিত্র ধর্মের কথা বলে কীরকমভাবে লোক ঠকিয়ে থাকে। সেই অভিজ্ঞতার রূপায়ণ এখানে ঘটেছে।

বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত এই নাটকটির সমালোচনা বেশ চিত্তাকর্ষক। জমীদার দর্পণ নাটকের রচনানৈপুণ্যের আংশিক প্রশংসা করে সমালোচক বলেছেন যে, জমিদারদের সঙ্গে প্রজাদের আচরণ অনেক সময়ই সমর্থনযোগ্য নয়। পাছে প্রজারা উচ্ছৃঙ্খল কার্যে প্ররোচিত হয়, সেই আশঙ্কায় সমালোচক এর প্রচার বন্ধ করার পরামর্শ দেন। শ্রেণিগত স্বার্থবুদ্ধি ও পরিবেশের প্রভাব সাহিত্য-সমালোচককে কীভাবে বিভ্রান্ত করে, এই সমালোচনাটি তার প্রকৃত দৃষ্টান্ত। নাটক হিসাবে জমীদার দর্পণ ত্রুটিমুক্ত নয়। নীলদর্পণের অনুকৃতি খুবই স্পষ্ট। সঙ্গীতের আধিক্য বিরক্তিকর। চরিত্রচিত্রণ ও সংলাপে কিছু দক্ষতা আছে। কিন্তু মূলগত অভিপ্রায়ের জন্যেই নাটকটি মূল্যবান। বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক হিতসাধনের উদ্দেশ্য (যা নব্য লেখকদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং উপদেশ দিয়েছিলেন) নিয়ে লেখা নাটক বলে এর প্রশংসা আমরা করতে পারি। কিন্তু বঙ্গদর্শন সে-কারণেই বেদনা অনুভব করেছেন।

এর উপায় কি ? (১৮৭৫) স্ত্রীকে অবহেলা করে স্বামীর গণিকা-সংসর্গ এবং বান্ধবীর কৌশলে স্ত্রী কর্তৃক দুষ্কৃতি সম্পর্কে স্বামীর চেতনা-সঞ্চারের কাহিনি। এই বিষয়বস্তু মৌলিক নয়, বহুব্যবহৃত। তবু যে মীর মশাররফ হোসেন এই বিষয়ে প্রহসন-রচনায় উদ্যোগী হন, তার কারণ শুধু পরানুকরণ নয়। মনে হয়, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁকে এই প্রহসন-রচনায় প্রবৃত্তি দিয়েছিল। আমরা জানি যে, ১৮৬৫ সালে প্রথম বিবাহের সময় থেকে ১৮৭৩ সালে দ্বিতীয় বিবাহ পর্যন্ত মশাররফ হোসেনের দাম্পত্যজীবন অত্যন্ত অশান্তিতে কেটেছিল এবং এর ফলে তিনি চরম উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। বিবি কুলসুমের সঙ্গে পরিণয়ের পরে তাঁর উৎকেন্দ্রিক জীবনে অনেকখানি শান্তি ফিরে আসে, যদিও তাঁর চরিত্র যে সম্পূর্ণরূপে সংশোধিত হয়েছিল, তা বলা যায় না। কেননা, বিবি কুলসুম একবার তাঁর বাড়ির দাসীকে স্বামীর অনুগৃহীতা বলে সন্দেহ করেছিলেন এবং প্রেমময়ী দ্বিতীয়া পত্নীর সঙ্গে সুখভোগকালেই এক ইঙ্গ-বঙ্গ বারবনিতার গর্ভে মশাররফ হোসেনের পুত্রসন্তান জন্মেছিল। এসব কথা তিনি নিজেই বলেছেন আমার জীবনীর জীবনী—কুলসুম জীবনীতে। গাজী মিয়ার বস্তানীতে (১৯০০) বারাঙ্গনা-সমাজে ভেড়াকান্ত অর্থাৎ মশাররফ হোসেনের জনপ্রিয়তার উল্লেখ আছে।

এর উপায় কি ? রচিত হয় নাট্যকারের দ্বিতীয় বিবাহের দুবছর পরে। একথা তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, নিজের চরিত্রদোষের অভিজ্ঞতা এবং তার জন্য আংশিক অনুতাপবোধ থেকে এই প্রহসন-রচনার প্রেরণা তিনি লাভ করেছিলেন। তবে শুধু তাই নয়। বিজ্ঞাপনে নাট্যকার দাবি করেছেন যে, এই রচনায় তিনি ‘সত্যতত্ত্ব’ উদ্ঘাটন করেছেন। এই প্রহসনে তিনি হয়তো কোনো কোনো পরিচিত ব্যক্তির চিত্ররচনা করেছিলেন এবং সেই চিত্রাঙ্কন এই প্রহসন-রচনার একটি মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে অনুমান করি।

প্রহসনটিতে এমন দুটি চরিত্র আছে, নাট্যসৃষ্টিতে যাদের আবশ্যকতা স্পষ্ট নয়। একজন সন্ন্যাসীদাস, অন্যজন হাকিম নগেন্দ্রবাবু। এসব চরিত্রের বাস্তব ভিত্তি থাকা সম্ভবপর। সন্ন্যাসীদাসের পিতৃ-পিতামহের বাসভূমির বিস্তৃত বর্ণনার মধ্যে তার সত্য পরিচয় লুকিয়ে আছে বলে সন্দেহ হয়। হাকিম নগেন্দ্রবাবুর আবির্ভাবও শুধু সধবার একাদশীর কেনারামের অনুকরণে নয়, কেননা নাটকে শুধু তারই পরিচয় স্পষ্টভাবে দেওয়া আছে। নগেন্দ্র হুগলি কলেজে ‘চাপদেড়ে থোয়েটে’র বকুনি-খাওয়া ছাত্র; ‘টাম্সন ডাক্তারের’ সার্টিফিকেট নিয়ে ‘ক্যাম্বেল বাহাদুরে’র দয়ায় ‘সব ডিপুটি’ হয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য যে, এর উপায় কি ? প্রকাশের অব্যবহিত পূর্বে মশাররফ হোসেন হুগলি কলেজের ছাত্রদের আনুকূল্যে চুঁচুঁড়া থেকে মাসিক আজীজন নেহার (এপ্রিল ১৮৭৪) প্রকাশ করেন এবং তিনি বেশ কিছুকাল সেখানে বাসও করেন। সুতরাং এটা খুবই সম্ভবপর যে, এর উপায় কি ?-র বিভিন্ন চরিত্র নাট্যকারের পরিচিত ব্যক্তিদের আদলে গড়া। এ-অনুমানের সপক্ষে আরেকটি বক্তব্য আছে। এর উপায় কি ? প্রহসন যে ‘প্রিয়তম বন্ধু ভ্রাতাকে’ উৎসর্গ করা হয়েছিল, তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন। সেজন্যে দ্বিতীয় সংস্করণে তাঁকে উৎসর্গ করা হয় ‘মনে মনেই’। সম্ভবত প্রহসনে অঙ্কিত চরিত্রসমূহে যাঁদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা হয়, তাঁদের সঙ্গে উপহারপ্রাপ্ত সুধীর ব্যক্তিগত পরিচয়ই এই লজ্জার কারণ হয়েছিল।

এর উপায় কি ? প্রকাশিত হলে অন্তত দুটি পত্রিকায় তা সমালোচিত হয়। বান্ধব পত্রিকায় (আশ্বিন ১২৮৩) যে-সমালোচনা প্রকাশিত হয়, তা এরকম :

এর উপায় কি ? শ্রী মীর মশাররফ হোসেন প্রণীত। ইহাও আর একখানা প্রহসন। এ দেশের মুসলমান ভদ্রলোকেরা সাধারণত সাহিত্যে বীতস্পৃহ; বাঙ্গালা সাহিত্যের সহিত তাঁহাদিগের কোন সম্বন্ধ নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং যখন তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কদাপি সখ করিয়া বাঙ্গালা লিখিতে ইচ্ছা করেন, তখন আমরা নিতান্ত সুখী হই, এবং তাঁহাদিগের প্রশংসা করিতেই প্রাণপণে যত্ন করি। কিন্তু যদি তাঁহারা যশোলাভের এমন সহজ পথ থাকিতেও কল্পনায় ও ভাষায় যারপর নাই জঘন্য রুচির পরিচয় দেন,—অশ্লীল পদাবলীর ছড়াছড়িকেই কাব্যরসে রসিকতা মনে করেন, তখন এই গ্রন্থকারের ন্যায় আমরাও বিপন্ন হইয়া ইহাই জিজ্ঞাসা করি, এর উপায় কি ?

দ্বিতীয় সমালোচনা প্রকাশ পায় সুলভে। এই পত্রিকায় সুরাপান ও বারাঙ্গনা-গমনের বিরুদ্ধে যদিও প্রচার করা হতো, তবু তাঁরা প্রহসনটির দোষই কীর্তন করেছিলেন। সুলভের সমালোচনা এখন দুর্লভ। তবে দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে মশাররফ হোসেন জানিয়েছেন যে, ‘সুলভ প্রভৃতি কয়েকখানি পত্রিকা বিশেষ সম্বোধনে সম্বোধন করিয়া যাহা বলিবার বলিয়াছিলেন।’

এর উপায় কি ?-র বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু তা অগ্রাহ্য। কোনো তুলনা না করেই স্মরণ করা যেতে পারে যে, একেই কি বলে সভ্যতা ও সধবার একাদশী সম্পর্কেও অনেকে একই আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন। এ-দুটি প্রহসনের কথা স্বতন্ত্র; কিন্তু বাংলা প্রহসনে সর্বত্র সুরুচির পরিচয় নেই, বিশেষত এই ধরনের বিষয়ে রচিত প্রহসনে। বিষয় যে ভাষাকে নিয়ন্ত্রিত করবে, এ-কথা স্বীকার্য। মশাররফ হোসেন বিষয়াতিরিক্ত অশ্লীলতা আমদানি করেছেন, একথা বললে অসংগত হবে। গাজী মিয়ার বস্তানীর তুলনায় এর উপায় কী ? অনেক সংযত রচনা।

তবে যে ‘প্রথম সংস্করণের পুস্তকগুলি কীটের উদরস্থ’ হয়েছিল এবং দ্বিতীয় সংস্করণের বইগুলিরও প্রচার নিতান্ত সীমাবদ্ধ হয়েছিল, তার কারণ, এর বহু-ব্যবহৃত বিষয়বস্তু। মশাররফ হোসেনের দায় এইটুকু যে তাঁর রচনা অসাধারণ হয়নি। সুতরাং এর নতুন কোনো আবেদন ছিল না। এর বিষয়বস্তুর প্রকৃতি এমন যে, পাঠক বা দর্শক আগে থেকেই পরিণতি অনুমান করতে পারেন এবং সে-অনুমান যখন সত্যে পরিণত হয়, নতুন কোনো চমক সৃষ্টি করে না, নাটকে নতুন কোনো ব্যক্তিত্ব উদ্ভাসিত হয় না, তখন বেশিদিন তার স্মৃতি পাঠকের বা দর্শকের মনে বাসা বাঁধতে পারে না।

হয়তো এসব কারণেই এর উপায় কি ? প্রহসনের প্রথম সংস্করণ কোথাও পাওয়া যায় না এবং দ্বিতীয় সংস্করণও দুর্লভ। মশাররফ হোসেন সম্পর্কে যাঁরা আলোচনা করেছেন, এই প্রহসন-প্রসঙ্গে তাঁদের একমাত্র অবলম্বন ছিল সমালোচনা। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে আকস্মিতভাবে দ্বিতীয় সংস্করণের একটি বই আমি পেয়ে যাই। এর নকল তখনই সংগ্রহ করেছিলাম— অনেক পরে পাঠকদের সামনে তা গ্রন্থাকারে (১৯৭৪) উপস্থিত করি।

গো-জীবন (১৮৮৮) প্রবন্ধটি মশাররফ হোসেনের একটি বিশেষ মানসিকতার পরিচয় দেয়। ইতিপূর্বে তাঁর অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ করেছি। হিন্দু-মুসলমানের মিলনসাধনের জন্য তাঁর আন্তরিক উদ্বেগ এ-প্রবন্ধ রচনার প্রেরণা দিয়েছে। এই দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ নির্মূল করবার উপায়স্বরূপ তিনি প্রস্তাব করেছেন যে, মুসলমানদের উচিত গোমাংস-ভক্ষণ ত্যাগ করা। অল্পকাল পূর্বে দয়ানন্দ সরস্বতীর গোহত্যানিবারণী আন্দোলন (১৮৮২) হয়তো সমস্যাটি সম্পর্কে তাঁকে সচেতন করে তোলে।

আমি মোসল্মান—গো জাতির পরম শত্রু। আমি গো-মাংস হজম করিতে পারি, পালিয়া পুষিয়া বড় বলদটীর গলায় ছুটি বসাইতে পারি, ধর্ম্মের দোহাই দিয়া দুগ্ধবতী গাভী, দুগ্ধপায়ি গো-বৎস্যের প্রাণ সংহার করিয়া পোড়া উদর পরিপোষণ করিতে পারি, কিন্তু ন্যায়চক্ষে যাহা দেখিতেছি, যুক্তি ও কারণে যাহা পাইতেছি, তাহা কোথায় ঢাকিব, স্বাভাবিক ভাব কোন্ ভাববশে গোপন করিব ?…

আর একটি কথা। এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মোসল্মান উভয় জাতি প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্ম্মে ভিন্ন, কিন্তু মর্ম্মে এবং কর্ম্মে এক—সংসার কার্য্যে ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে বিপদে সুখে দুঃখে সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই। এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কি ?

কালে আমরা রাজাকে পরিত্যাগ করিতে পারি। রাজাও আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারেন। কিন্তু হিন্দু-মোসল্মানে কেহই কাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারিবে না।…

জানিবেন ভারতে হিন্দু-মোসল্মান একত্র হইয়া একযোগে কোন কার্য্য না করিলে কখনই তাহা সিদ্ধ হইবে না। একপক্ষ শত বর্ষ মাথা কুটিলেও ঈশ্বর সদয় হইবে না।…

গো-জীবন প্রবন্ধ রচনার জন্যে রক্ষণশীল মুসলমানের ক্ষোভ জাগ্রত হওয়া অকারণ না হতে পারে, কিন্তু একথা স্বীকার করতে হবে যে, হিন্দু-মুসলমানের মিলনসাধন সম্পর্কে মশাররফ হোসেন যেসব মন্তব্য করেছেন, তা যুক্তি ও বাস্তববুদ্ধির দ্বারা প্রণোদিত। তবে ইংরেজ শাসনব্যবস্থার প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ বিশ্বাসের প্রকাশ এতেও ঘটেছে :

এ ব্রিটিশ রাজ্য, ব্রিটিশ সিংহ ইহার শাসনকর্ত্তা, ন্যায্য কথা বলিতে কোন বাধা নাই— ভয়েরও কোন কারণ নাই। সুতরাং লিখনি ক্ষান্ত হইবার নহে।

এই বিশ্বাস, এই আস্থা মশাররফ হোসেনের ব্যক্তিগত নয়— বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উদীয়মান মধ্যবিত্তমাত্রই এই ধরনের আশ্বাস সযত্নে লালন করেছেন।

গো-জীবনের প্রথম প্রস্তাব ‘গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ আহমর্দী “পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হলে আখবারে এসলামীয়া পত্রে তার প্রতিবাদ বের হয়। প্রতিবাদকারী মতে, মূল প্রবন্ধলেখক ‘মুসলমান নহেন’। এই উক্তির সমর্থনে আরো রচনা পত্রস্থ হয় এবং টাঙ্গাইলের সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৌলভী শফীউদ্দীনের বাসগৃহে ধর্মসভা অনুষ্ঠান করে লেখককে ‘কাফের’ স্থির করা হয় এবং তাঁর স্ত্রী তালাক হবার ফতওয়া দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ মশাররফ হোসেন এঁদেরকে আদালতে অভিযুক্ত করেন এবং শেষ পর্যন্ত একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মামলা-মোকদ্দমা, বাদ-প্রতিবাদের এই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে পণ্ডিত রেয়াজ অল-দীন আহমদ মশহাদীর অগ্নি-কুক্কুট (১৮৮৯)”। এই সমুদয় ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, রক্ষণশীল মুসলমানদের সামাজিক বৃত্ত থেকে দূরে সরে যাওয়া মশাররফ হোসেনের পক্ষে স্বাভাবিক হয়ে পড়ে।

উদাসীন পথিকের মনে কথায় (১৮৯০) লেখকের পারিবারিক ইতিহাসের কিছু উপাদান আছে। আবেগের প্রাবল্যে অতিশয়োক্তির যে-প্রবণতা মশাররফ হোসেনের রচনাবলিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি, তার একটি উল্লেখযোগ্য অভিব্যক্তি এতে আছে। জনক-জননীর প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। তাঁর পিতা বিলাস-ব্যসনে কালক্ষয় করতেন এবং নর্তকী ও বাইজিদের নৃত্যগীতে অতিরিক্ত আসক্ত ছিলেন, একথা উল্লেখ করার পরও তিনি বলেছেন যে, ‘মীর সাহেব মোসলমান সমাজের সমুজ্জ্বল রত্ন’। আর তাঁর গর্ভধারিণী ‘দৌলতননেসা পবিত্রা মহাপবিত্রা, দয়াবতী, পূণ্যবতী এবং আজীবন চিরসতী’। শুধু তাই নয়, তাঁর মতো নারী ‘মুসলমান রমণী-মধ্যে অনেক খুঁজিলাম, পাইলাম না’—এমন কি, হজরত মুহম্মদের স্ত্রী-কন্যা, মুঘল সম্রাজ্ঞী ও সাহিত্যের নায়িকাদের তুলনায়ও তিনি শ্রেষ্ঠ, একথা লেখক বলেছেন। এই উক্তিতে মাতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা ও সাহসের পরিচয় থাকলেও তাঁর ঔচিত্যবোধের অভাব পীড়াদায়ক।

উদাসীন পথিকের মনের কথায় ব্যক্তিগত পটভূমিটি সুবিস্তৃত হলেও একমাত্র নয়। পারিবারিক ইতিহাস, বাস্তব ঘটনা এবং উপন্যাসের একটি মিশ্রিত রূপ এতে ধরা পড়েছে। কুষ্টিয়া-অঞ্চলে নীলকরের অবাধ অত্যাচারের চিত্র উদ্ঘাটন করাই ছিল মশাররফ হোসেনের লক্ষ্য। নীলকরদের অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর ভূমিকা সম্পর্কে লেখক স্বয়ং বলেছেন :

স্বার্থই অনর্থের মূল, স্বার্থই দুর্দ্দশার সোপান, জগতে স্বার্থই পতনের মূল কারণ— প্যারীসুন্দরী বলিয়াছেন, দেশের লোকই দেশের শত্রু, দেশের অনিষ্টকারী। কেনী বিলাত হইতে লোকজন সঙ্গে করিয়া এদেশে আসেন নাই। দেশের লোক দিয়াই স্বদেশীয়ের সর্বস্বান্ত করিতেছেন।

দেশের লোকের এক ক্ষুদ্রাংশ যেমন নীলকরের করতলগত তেমনি এর অধিকাংশ নানাভাবে বিভক্ত; এই বিভেদ দূর করার কোনো চেষ্টা তাদের মধ্যে দেখা যায় না। প্যারীসুন্দরী লেখকের মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করেই বলেছেন :

প্রকাশ্যে যাহাই করুক, হিন্দু-মুসলমানকে এক ভাবা চাই। শত্রুতা বিনাশ করিতে একতা শিক্ষা করা চাই। একতাই সকল অস্ত্রের প্রধান অস্ত্র। জাতিভেদে হিংসা, জাতিভেদে ঘৃণা, দেশের মঙ্গলের জন্য একেবারে অন্তর হইতে চিরকালের জন্য অন্তর করা চাই।

কেনীর মুখ দিয়েও আমাদের অনৈক্যের প্রতি শ্লেষসূচক ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু লেখক দেখে প্রীত হয়েছেন যে, নীল আন্দোলন বাঙালির এই দুর্নাম—আংশিক হলেও—দূর করতে পেরেছে। তিনি যখন বর্ণনা করেন,

হিন্দু মুসলমান একত্রে একযোগে পূর্ণ উৎসাহে বক্ষ বিস্তার করিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিল। কাহারও কোন কথা কানে করিল না। কারও বাধা মানিল না।… হিন্দু মুসলমান একত্রে আপন আপন ইষ্ট দেবতার নাম করিয়া সার বাঁধিয়া পথে বাহির হইল।… সকলেই যেন জেল হইতে খালাস পাইয়াছে।

তখন এই বর্ণনার পেছনে লেখকের যে-আবেগ সক্রিয় ছিল, তার স্বরূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দীনবন্ধুর মতো তিনিও নীল-আন্দোলনকে কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী নীলকরের কার‌্যাবলির প্রতিবাদ-রূপে দেখেছেন। ইংরেজ সরকার যে-স্বার্থবুদ্ধিপ্রণোদিত হয়ে নীলচাষের উদ্যোগ করেন এবং সমগ্র অন্যায়-অত্যাচার যে তার ফল, সেটা এঁরা অনুভব করেননি। তাছাড়া, সামগ্রিকভাবে ইংরেজ শাসনব্যবস্থার মাহাত্ম্য এঁরা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাই মশাররফ হোসেন লিখেছেন :

মাননীয় হর্সেল বাহাদুর ভারতীয় সিভিল সার্ভিস আকাশে পূর্ণ জ্যোতি সহকারে, পূর্ণ কলেবরে, পূর্ণ চন্দ্ররূপে দেখা দিয়াছেন। প্রজার আর্ত্তনাদে বঙ্গেশ্বরের আসন পর্য্যন্ত টলিয়াছে। মহামতী লাট বাহাদুর প্রজার দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখিবার জন্য নীলকরের দৌরাত্ম্য স্বয়ং তদন্ত জন্য… মফস্বলে বাহির হইয়াছেন।

নীলকর আমাদের রাজা নহে। তাহারাও প্রজা, আমরাও প্রজা,—রাজার চক্ষে সকলেই সমান তখন আর ভয় কি ?

উদীয়মান মধ্যবিত্তের পক্ষে এই আস্থা প্রকাশ করা স্বাভাবিক এবং পরবর্তীকালে এই আশাভঙ্গের সুতীব্র বেদনাও তাকে মর্মে মর্মে অনুভব করতে হয়।

ইংরেজ-শাসনব্যবস্থার প্রতি এই স্বাভাবিক বিশ্বাস সত্ত্বেও উদাসীন পথিকের মনের কথায় হিন্দু-মুসলমানের যে-মিলনকামনা আছে, তার গভীর তাৎপর্য স্বীকার করতে হয়। কেবল হিন্দু-মুসলমানের মিলনকামনা নয়, কেবল ঐক্যমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করা নয়, মাতৃভূমিকে যথার্থ ভালোবাসার প্রেরণা এতে আছে:

“হোম” যে কি জিনিষ, “হোম” কথাটি যে কত মিষ্টি তাহা বিলাতী অন্তর না হইলে আমাদের অনুভব করার সাধ্য নাই। আমরা বাঙালি, আমাদের “হোম”কে আমরা কেবল পদতলেই দলিত করিতে শিখিয়াছি। কি প্রকারে পূজিতে হয় তাহা জানি না।… আমাদের মন স্বাধীন। হোমের আবার নির্দ্দিষ্ট কি ? জগৎময় হোম। সমুদয় জগৎ আমাদের হোম। কনষ্টান্টিনোপল কি আমাদের হোম নহে ? সেন্ট পিটার্সবর্গ কি আমাদের হোম নহে ? হোম কি আমাদের হোম নহে ? যে দেশে যে স্থান ভাল সেই আমাদের হোম।

এ তো লাক কথার এক কথা, এ কথার উত্তর নাই। আমি উদাসীন পথিক। মনের কথা বলিতেছি।—এ জগতে আমার কেহই নাই, সে কথা আগেই বলিয়াছি। ধরিবার লক্ষ্য নাই, পা রাখিবার স্থান নাই। ইহার পরেও সময় সময় অনেকের নিকট পাগল সাব্যস্ত হইতে হয়। এ অবস্থাতেও পাঠক! হোমের জন্য পথিকের প্রাণ কাঁদে।

এই কথাগুলো যে বিশেষ করে দেশীয় মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা, সতর্ক পাঠকের কাছে তা অনায়াসে ধরা পড়ে। সেকালে দুনিয়ার চাইতে আখেরাতের ভাবনায় মুসলমানেরা বেশি চিন্তিত ছিলেন, বর্তমানের চাইতে অতীত তাদের প্রিয় ছিল, ভারতবর্ষ বা বাংলাদেশ সত্যি সত্যি আমাদের মাতৃভূমি কি না, এ সন্দেহও অনেকের মধ্যে জেগেছিল। মশাররফ হোসেনের সতর্কবাণী তাই তাঁর সজাগ মানসিকতার পরিচায়ক।

উদাসীন পথিকের মনের কথায় সত্য ও কল্পনার মিশ্র উপাদানে সৃষ্ট এমন একটি সাহিত্যরূপ ধরা পড়েছে, যা আমাদের পরিচিত আঙ্গিকসমূহের কোনো একটির অঙ্গীভূত করা চলে না। হয়তো লেখকের মানসিকতা ইতিহাসরচনার অনুকূল ছিল না, উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে যথেষ্ট নির্লিপ্ততা রক্ষা করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁর রচনারীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য আত্মগত উক্তি এতে যথেষ্ট আছে। মধ্যে মধ্যে উপভোগ্য ব্যঙ্গোক্তি আছে:

সাহেব অশ্বকে সজোরে কশাঘাত করিয়া চম্পট দিলেন না— প্রস্থান করিলেন না—রণে ভঙ্গ দিয়া পালাইলেন না— আত্মরক্ষা করিলেন।

তবে realistic details দিতে গিয়ে মশাররফ হোসেন কোথাও কোথাও রুচিগত শৈথিল্য প্রকাশ করেছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ শৈথিল্য অমার্জনীয় মনে হয়, যেমন কেনীর অসুস্থতার বিবরণ (পৃ ১৯৩-৯৪)। এই ত্রুটি ব্যতিরেকে রচনাটি উপভোগ্য।

তবে নীল-আন্দোলনের চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে মশাররফ হোসেন কিছুটা মানসিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছেন। প্রকৃত ঘটনাকালে তাঁর পিতা—যাঁর প্রতি তাঁর সশ্রদ্ধ মনোভাবের কথা উপরে উল্লেখ করেছি—ছিলেন নীলকরের পক্ষে। চাষিদের নেতা ছিলেন তাঁদেরই আত্মীয়, কিন্তু ইনি লেখকের পিতার সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা করেছেন। ফলে, অনুগত পুত্র ও বিবেকী লেখকের চিন্তা একই কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হয়নি। আন্দোলনের প্রশংসা করেও লেখক রায়তদের নেতার নিন্দা করেছেন, আবার নীলকরের অত্যাচার প্রতিবিম্বিত করেও তাঁদেরকে সমর্থন করার যুক্তি খুঁজেছেন।

তাঁর সুবিখ্যাত বিষাদ-সিন্ধুর তিনটি পর্ব প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৮৮৫, ১৮৮৭ ও ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে। কারবালার বিষাদান্ত ঘটনা এই গ্রন্থের বর্ণিতব্য বিষয়। গ্রন্থকার বলেছেন, ‘পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া বিষাদ-সিন্ধু বিরচিত হইল।’ মশাররফ হোসেন আরবি-ফারসি জানতেন কি না, তার স্পষ্ট উল্লেখ কোথাও পাই না। মকতুল হোসেন, জঙ্গনামা ও শহীদে কারবালা প্রভৃতি মিশ্র ভাষারীতির কাব্যে এই ঐতিহাসিক ঘটনার যে কাল্পনিক বিবৃতি আছে, বিষাদ-সিন্ধুতে আমরা তারই পরিচয় পাই। সম্ভবত মিশ্র ভাষারীতির কাব্যকেই তিনি অনুসরণ করেছিলেন এবং তার একটি সাধু গদ্যরূপ পাঠকদের উপহার দিয়েছিলেন।

তা হলেও লেখকের মানসিকতার বিশেষ পরিচয় বইটিতে ধরা পড়েছে। শিয়া মতাবলম্বী ফারসি কাব্য-রচয়িতাদের কাছে যেমন, তেমনি মিশ্র ভাষারীতির কবিদের কাছেও এই কাহিনি-কথনের অন্তরালবর্তী আবেগ তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গস্বরূপ ছিল। এজিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা, হাসান-হোসেনের প্রতি প্রবল ভক্তির উচ্ছ্বাস তাঁদের হৃদয় থেকে স্বতোৎসারিত হয়েছে। মশাররফ হোসেন কিন্তু ধর্মবুদ্ধির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে উপাখ্যান রচনা করতে বসেননি—ঐতিহাসিক চেতনার দ্বারা প্রণোদিত হয়ে তো নয়ই। কারবালা-কাহিনির মধ্যে নিয়তি-নিপীড়িত মানবভাগ্যের যে-করুণ লীলাখেলা প্রত্যক্ষ করে মাইকেল মধুসূদন এই বিষয় নিয়ে মহাকাব্য-রচনার প্রেরণা অনুভব করেছিলেন,১০ ধর্মনিরপেক্ষ সেই প্রবল মানবীয় চেতনাই মশাররফ হোসেনকে বিষাদ-সিন্ধু-রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।

হাসান-হোসেনের সঙ্গে এজিদের বিরোধ রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বমাত্র, এ-কথা ঐতিহাসিক সত্য। মশাররফ হোসেনের রচনায় এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ এজিদের অনিবার্য রূপতৃষ্ণার উদ্ভ্রান্তকারী শক্তি সম্পর্কে মাবিয়ার মহিষীর জবানিতে লেখক বলেছেন :

এজিদ যে ফাঁদে পড়িয়াছে, সে ফাঁদে জগতের অনেক ভাল লোক বাঁধা পড়িয়াছেন। শত শত মুনি-ঋষি, ঈশ্বরভক্ত কত শত মহাতেজস্বী, জিতেন্দ্রিয়, মহাশক্তিবিশিষ্ট মহাপুরুষ এই ফাঁদে পড়িয়া তত্ত্বজ্ঞান হারাইয়াছেন, তাহার সংখ্যা নাই। আসক্তি প্রেম ও ভালাবাসার কথা ধর্ম্মপুস্তকেও রহিয়াছে। ভাবিয়া দেখিলে প্রতীত হয়, মানুষের মনেই ভালবাসার জন্ম, ইহাকে শিক্ষা দিতে হয় না, দেখাদেখিও কেহ শিক্ষা করে না, ভালবাসা স্বভাতঃই জন্মে। বাদশা নামদার! ইহাতে নূতন কিছুই নাই। আপনি যদি মনোযোগ দিয়া শুনেন, তবে আমি এই প্রণয় প্রসঙ্গ অনেক শুনাইতে পারি, দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইতেও পারি। জগতে শত শত ভালবাসার জন্ম হইয়াছে, অনেকেই ভালবাসিয়াছে, তাহাদের কীর্ত্তিকলাপ আজ পর্য্যন্ত কেন, জগৎ বিলয় না হওয়া পর্য্যন্ত মানব-হৃদয়ে সমভাবে অঙ্কিত থাকিবে। বলিবেন, পাত্রাপাত্র বিবেচনা চাই। ভালবাসারূপ সমুদ্র যখন হৃদয়াকাশে মানসচন্দ্রের আকর্ষণে স্ফীত হইয়া উঠে, তখন আর পাত্রাপাত্র জ্ঞান থাকে না। পিতা, মাতা, সংসার, ধর্ম্ম, এমন কি ঈশ্বরকেও মনে থাকে কিনা সন্দেহ। ইহাতে এজিদের দোষ কি বলুন দেখি ? এই নৈসর্গিক কার্য্য নিবারণ করিতে এজিদের কি ক্ষমতা আছে ? না, আমার ক্ষমতা আছে না, আপনারই ক্ষমতা আছে ? যাহাই বলুন মহারাজ! ভালবাসার ক্ষমতা অসীম।

সর্ববন্ধন-ছেদনকারী ভালোবাসার এই অপরিসীম ক্ষমতাকে মশাররফ হোসেন সামাজিক মনের দ্বারা চালিত হয়ে নিন্দা করেন নি, শিল্পীমনকে জাগ্রত রেখে সবিস্ময়ে অবলোকন করেছেন। এই প্রেমের মধ্যে তিনি দেখেছেন নিয়তির অদৃশ্য হস্তের খেলা। তাই রূপতৃষ্ণার দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে এজিদ যে রোষবহ্নির সূত্রপাত্র করেছে, তাতেই একে একে প্রেরিত পুরুষের প্রায় সকল বংশধর সানুচর আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। এজিদ যেমন, তেমনি তার প্রণয়ও এই সর্বনাশী ঘটনার উপলক্ষ মাত্র।

ভবিতব্য সম্পর্কে পূর্ব-ধারণা এই ট্রাজেডিকে গভীরতাদান করেছে।

যেদিন, প্রভু মোহাম্মদ প্রধান শিষ্যমণ্ডলী মধ্যে উপবেশন করিয়া ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিতেছিলেন, সেই সময়ে স্বর্গীয় প্রধান দূত জেব্রাইল আসিয়া তাঁহার নিকট পরম কারুণিক পরমেশ্বরের আদেশবাক্য কহিয়া অন্তর্ধান হইলেন।

সেদিন সকলেই অনাগত ঘটনাপ্রবাহের বিষাদান্ত পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হলেন। তারপর থেকে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা এড়িয়ে যাবার কত চেষ্টাই না হয়েছে! কিন্তু মাবিয়ার স্ত্রীসংসর্গত্যাগ ও পুত্রনিধনের সংকল্পের মতোই একে একে সকল প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। অদৃষ্টের নাগপাশ থেকে হাসান ও হোসেনের মুক্তিলাভ-প্রচেষ্টার কী করুণ ইতিহাসই না পাঠকের সম্মুখে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে; কিন্তু এই চেষ্টার পথে প্রতিটি পদক্ষেপ তাঁদেরকে টেনে নিয়ে গেছে ধ্বংসের অতল গহ্বরে। আবার যে মুহূর্তে শত্রুজিৎ এজিদ সাফলের বরমাল্য লাভ করেছে, সেই মুহূর্তে সর্বনাশী নিয়তি তাকে গ্রাস করার জন্যে ছুটে চলেছে। তারপর এজিদের পতন। এই পতনের জন্য দায়ী হানিফা আবার তখন আত্মসংযমে অক্ষম হওয়ায় নিয়তিনির্ধারিত দণ্ড লাভ করেছেন। বিষাদ-সিন্ধুর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মানবজীবনের এই অদৃষ্টলাঞ্ছিত মূর্তির আলেখ্য—পুরুষকারের এই শোচনীয় পরিণামের কাহিনি—ধীরে ধীরে উদ্ঘাটিত হয়েছে।

মানবভাগ্যের এই আবেগময় রূপায়ণের জন্যেই বিষাদ-সিন্ধু মূল্যবান। রচনারীতির পারিপাট্য, কাহিনির নাটকীয়তা, ঘটনার চমৎকারিত্ব ও চরিত্রচিত্রণের যে-পরিচয় প্রথম পর্বে আছে, পরবর্তী পর্ব-দুটিতে তা অনেকখানি শিথিল হয়ে এসেছে। তবু, মশাররফ হোসেনের রচনাবলির মধ্যে এটি যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তা যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

ঘটনার গতি রুদ্ধ করে আত্মগত ভাবনার সংযোজন মশাররফ হোসেনের গদ্যরচনার একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এই কৌশল তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে লাভ করেছেন বলে মনে হয়, তবে বঙ্কিমের তুলনায় মশাররফ হোসেনের এই জাতীয় উক্তি দৈর্ঘ্যে ও সংখ্যায় বেশি। বঙ্কিমচন্দ্র স্বল্প কথায় যা বলেছেন, তার চেয়ে বুঝিয়েছেন অনেক বেশি: সতর্ক পাঠকমনে তাঁর অনুক্ত বক্তব্যও স্পষ্ট রূপ লাভ করেছে। মশাররফ হোসেন তাঁর ছোট বক্তব্য বেশি কথায় বলেছেন এবং কিছুই বলতে বাদ রাখেন নি। উদাসীন পথিকের মনের কথায় এবং গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে এ-ধরনের অনেক উক্তি আছে, তবে বিষাদ-সিন্ধুতেই পাই সর্বাধিক।১১ মশাররফ হোসেনের চিন্তাভাবনা এ-সব ক্ষেত্রে প্রায় প্রগলভতায় রূপান্তরিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না—যদিও কখনো কখনো তা উপভোগ্য হয়।

বিভিন্ন চরিত্রের মুখ দিয়ে লেখক অনেক কথা বলেছেন। সমসাময়িক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এমনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি হচ্ছে বন্দিদশায় মাবিয়ার প্রধানমন্ত্রী হামানের উক্তি :

রাজার অভাব হইলে রাজ্য পাওয়া যায়, রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটিলে তাহারও শান্তি হয়, রাজ্যমধ্যে ঘোর বিদ্রোহানল প্রজ্বলিত হইলেও যথাসময়ে অবশ্যই তাহার নির্ব্বাপণ হয়, উপযুক্ত দাবি বুঝাইয়া দিলে সে দুর্দ্দমনীর জেদও একেবারে বিলীন হইয়া উড়িয়া যায়।… কিন্তু স্বাধীনতা-ধনে একবার বঞ্চিত হইলে সহজে সে মহামণির মুখ আর দেখা যায় না। বহু আয়াসেও সে মহামূল্য রত্ন আর হস্তগত হয় না। স্বাধীনতা-সূর্য্য একবার অস্তমিত হইলে তাহার পুনুরুদয় হওয়া বড়ই ভাগ্যের কথা।… রাজা প্রজারক্ষক, বিচারক, প্রজাপালক এবং করগ্রাহক। কিন্তু রাজ্যের যথার্থ অধিকারী প্রজা। দায়িত্ব প্রজারই অধিক। রাজ্য রক্ষার দায়িত্ব প্রজার—বাসিন্দামাত্রেরই। যদি রাজ্যমধ্যে মানুষ থাকে, হৃদয়ে বল থাকে, স্বদেশ বলিয়া জ্ঞান থাকে, পরাধীন শব্দের যথার্থ অর্থবোধ থাকে, জন্মভূমির মূল্যের পরিমাণ জ্ঞান থাকে, একতাবন্ধনে আস্থা থাকে, ধর্ম্মবিদ্বেষে মনে মনে পরস্পর বৈরীভাব না থাকে, জাতিভেদ হিংসা ঈর্ষা এবং ঘৃণার ছায়া না থাকে, অমূল্য সময়ের প্রতি সর্ব্বদা লক্ষ্য থাকে, আলস্যে অবহেলা এবং শৈথিল্যে বিরোধী যদি কেহ থাকে, বিদ্যার চর্চা থাকে, আর সর্ব্বোপরি ঈশ্বরে ভক্তি থাকে, তবে যুগ-যুগান্তরে হউক, শতাব্দী পরেই হউক, সহস্রাধিক বর্ষ গতেই হউক, কোন কালেই হউক, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরাধীনতা-গগনে স্বাধীনতাসূর্য্যরে পুনরুদয় আশা একবার করিলেও করা যাইতে পারে।

গভীর আশায় উজ্জীবিত হয়ে মশাররফ হোসেন এই কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু কেবল আশাবাদ নয়, এখানে তাঁর পরিচ্ছন্ন ও অগ্রসর চিন্তাধারার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর আছে। ‘রাজ্যের যথার্থ অধিকারী প্রজা’—এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার মতো শিক্ষা তিনি বাইরে থেকে লাভ করতে পারেননি—এই বোধ তাঁর পক্ষে অনেকখানি অনুভূতিলভ্য এবং তা বড় কম কথা নয়। সাম্য (১৮৮০) বইতে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম এই ধরনের ধারণা প্রকাশ করেছিলেন,১২ কিন্তু তিনি নিজেই আবার এই বইটিকে অযথার্থ বলে বাতিল করে দেন। মশাররফ হোসেন যে আবার স্বাধীনতালাভের স্বপ্ন দেখেছেন, তা তাঁর সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাবজাত হতে পারে (১৮৭৫-এ শিশিরকুমার ঘোষের ইন্ডিতয়ান লীগ, ১৮৭৬-এ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাদ্যায়ের ভারত-সভা এবং ১৮৮৫-তে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়)। কিন্তু এই স্বাধীনতালাভের উপায়স্বরূপ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে প্রীতিসঞ্চার ও ঐক্যপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার উপরে তিনি যে-জোর দিয়েছেন, তা সেকালের অনেক সমাজহিতৈষীর চেতনায় এতখানি গুরুত্ব লাভ করতে পারেনি।

কিন্তু এই চেতনাকে মশাররফ হোসেন শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারেননি। গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে (১৮৯৯) তাঁর চিন্তাধারার রূপান্তর আরম্ভ হয়। তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্বের অন্যান্য গ্রন্থ—সঙ্গীত-লহরী (১৮৮৭), বেহুলা গীতাভিনয় (১৮৮৯) ও পঞ্চনারী পদ্য (১৮৯৯)—বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। সঙ্গীত-লহরী থেকে সাহিত্য সাধক-চরিতমালায় চারটি গান সংকলিত হয়েছে।১৩ তার মধ্যে দুটি বাউল ভাবের, একটি বিষাদ-সিন্ধুর শেষোক্ত উক্তির প্রায় প্রতিধ্বনি :

ওরে ভারত জাগ জাগ দিন গেল।

ঘুমের ঘোরে থেকে তোমার সর্ব্বনাশ হইল ॥

মৃত্যুজীব জাগিতেছে গলাবাজীর বোলে।

ভারতসভা জাতিসভা হচ্ছে দলে দলে রে ॥

নাই ভেদাভেদ কোন প্রভেদ হিন্দু মুসলমান।

ক্রমে ক্রমে হইতেছে এক দেহ এক প্রাণ রে ॥

দেশের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেরণা এখানে হয়তো আছে, তার চেয়ে বেশি আছে তাঁর আন্তরিক কামনাকে বাস্তবে রূপায়িত দেখার আকাক্সক্ষা।

সাহিত্যিক-জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে কিন্তু মশাররফ হোসেনের মনোভাব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রূপ লাভ করেছে। সেখানে তিনি উগ্র স্বাতন্ত্র্যপন্থী মুসলমান। গাজী মিয়াঁর বস্তানী থেকে তাঁর চিন্তাধারার পর্বান্তর ঘটেছে। জীবনের ঐশ্বর্য নয়, বিকৃতিকেই তিনি এখানে বড় করে দেখেছেন, সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে নিজেই তার শিকার হয়েছেন।

গাজী মিয়াঁর বস্তানী-রচনার মূলে বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তরের (১৮৭৫) প্রেরণা থাকলেও রচনানীতির দিক দিয়ে দুটি সগোত্র নয়। কমলাকান্তের প্রবন্ধ ও নকশাগুলিতে জীবন-সমালোচনার পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির স্বাক্ষর আছে: তার বুদ্ধির দীপ্তি, হাস্যরসের প্রেরণা, চিন্তার খোরাক ও কল্পনার বিলাস—সবই জীবনের প্রত্যক্ষ ক্ষেত্র থেকে আহরিত। গাজী মিয়াঁ একটি সম্পূর্ণাবয়ব কাহিনি বলতে চেয়েছেন: জীবনের সমাগ্রিক রূপটি তিনি তুলে ধরেননি—সমালোচকের চোখে তার ত্রুটি, তার অসম্পূর্ণতা, তার গ্লানিময় দিকটি উদ্ঘাটিত করেছেন। সমাজ-সমালোচনা হিসেবে মশাররফ হোসেনের রচনা বিচার্য; জীবনের গভীরতর উপলব্ধি ও রূপায়ণের সামগ্রিকতার দিক দিয়ে, স্বতোৎসারিত দার্শনিকতায়, প্রকাশের অত্যুজ্জ্বল ভঙ্গিতে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা সমৃদ্ধ। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে মশাররফ হোসেনের ঋণ অন্যভাবে আছে। সপ্তদশ নথিতে মনিবিবির মৃত্যুর দৃশ্য চন্দ্রশেখর উপন্যাসে (১৮৭৫) বর্ণিত শৈবলিনীর নরকযন্ত্রণার দৃশ্যের (ষষ্ঠ খণ্ড, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: “যোগবল না Psychic force) প্রভাব লক্ষ করা যায়।

তথাকথিত অভিজাত সমাজে কতদূর নৈতিক অধঃপতন ও সামাজিক দুর্নীতি প্রবেশ করেছে, গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে মশাররফ হোসেন তা উদ্ঘাটিত করেছেন। অরাজকপুরের হাকিম ভোলানাথ ও অন্যান্য পুরুষের সঙ্গে কুঞ্জ-নিকেতনের বেগম পয়জারুন্নেসার অন্তরঙ্গতার একটি কাহিনি এবং জমদ্বার গ্রামের জমিদার সোনাবিবি ও তাঁর ‘বেয়ান’ মনিবিবির পারস্পরিক শত্রুতা নিয়ে আরেকটি কাহিনি গড়ে উঠেছে।

গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে যে-সমাজ-সমালোচনা আছে, তা নিরপেক্ষ নয়। গ্রন্থের বিভিন্ন পাত্রপাত্রী বাস্তব জগতের মানুষ, লেখকের ব্যক্তিগত অনুরাগ-বিরাগ তাঁদের চরিত্রকে উজ্জ্বলতা বা কালিমা দান করেছে। ফলে কোনো সুস্থ মনোভাবের পরিচয় এতে নেই।১৪ পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে ইতস্তত বিচরণ করে তিনি নিজেও পঙ্কমুক্ত হতে পারেননি। তবে মধ্যে মধ্যে উপভোগ্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আছে, যদিও তার নিদর্শন খুব বেশি নেই। অরাজকপুরের জমিদার সবলোট আলীর লাম্পট্যের বিবরণ এমনি বিদ্রুপ ও হাস্যরসে কৌতুকাবহ হয়ে উঠেছে। নারীসঙ্গলিপ্সু জমিদার উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যে লোক পাঠিয়ে অপেক্ষা করছেন :

দরজার নিকট যাইয়া অর্দ্ধ শরীর পর্য্যন্ত দরজার বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন—কাহারও সাড়াশব্দ পাইলেন না! দরজার নিকটে দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিলেন—“দেখ ত বেটা কি পাজি! রাত্র প্রভাত হয়ে যায় কোন খোঁজ খবর নাই। এরা নিজের লাভ নিয়েই ব্যস্ত; আমার দিকে আর কেউ ফিরে চায় না।”

দূরে ভেড়–য়া খাঁ গৃহ-দ্বারের নিকট আসিয়া বলিল—“হুজুর! সে এল না। তার জ্বর হয়েছে।”

“তোর খালা কি বলিল ?”

“না, সেও আজ আসতে পারবে না। তার জামাই, দুই ছেলে নিয়ে, সন্ধ্যার সময় এসেছে!”

“তারপর উপায় ?”

“উপায় আর কি ? শেষে নসার মার কাছে গিয়েছিলেম। সেও এল না, বল্লে শরীর খারাপ।”

সবলোট আলী রাগতভাবে বলিলেন, ‘যা, বেটা তোর মাকে ডেকে নিয়ে আন।”

ভেড়–য়া খাঁর ত্রস্তপদে গমন। এদিকে দরওয়াজা বন্ধ।

এখানে জমিদারের অপরাধের জন্যে পাঠকমন যত বিদ্রোহী হয়, তার চেয়ে বেশি কৌতুক অনুভব করে তাঁর হতাশায় এবং তাঁর দুষ্কৃতির সহায়কদের বিপন্ন অবস্থায়।

এরকম আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। হাকিম ভোলানাথ এসেছেন পয়জারুন্নেসার গৃহে। মহিলা স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা প্রণোদিত হয়ে অনেকের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা করে থাকেন, কিন্তু তাঁরই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে হাকিম বলছেন :

আমি আজ এত সুখী হয়েছি যে মুখে প্রকাশের সাধ্য নাই। মুসলমান মধ্যে এরূপ ইন্লাইটেন, এত উন্নত মন, উন্নত চিন্তা, উন্নত আশা, উন্নত চক্ষু, উন্নত হৃদয়, উন্নত বক্ষ আমি কখন দেখি নাই। ধন্য শিক্ষা, ধন্য সাহস, শত সহস্র ধন্যবাদ হাজার থাঙ্ক, হাজার হাজার কোরনিস, হাজার হাজার নমস্কার আপনার চরণ যুগলে। ধন্য ধন্য মেহমুডেন লেডী! এত উন্নত! ধন্য ধন্য পাড়াগাঁয়ের পর্দ্দানসীন জানানা! এত উন্নত!

পরিস্থিতির grotesque রূপটি সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠলেও পর্দার পেছনে লেখকের বিদ্রুপাত্মক মুখভঙ্গিও আমাদের কল্পনায় ধরা দিতে বিলম্ব করে না।

গাজী মিঁয়ার বস্তানীতে লেখকের নারী-স্বাধীনতাবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। এই রচনার অপর লক্ষণীয় বিষয় তাঁর সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির পরিচয়। তাঁর হিন্দু চরিত্র যেমন বলছেন,

ভায়া। নেড়ে জাত আমার চক্ষুর শূল। আমার ক্ষমতা থাকলে বাঙ্গালা দেশ থেকে সব মুসলমানগুলকে তাড়িয়ে দিতাম।

তেমনি মুসলমান চরিত্রও হিন্দুদের সম্পর্কে বিদ্বেষভাব পোষণ করছেন মনে মনে। নামাজের সময়ে গান-বাজনা বন্ধ করার আবেদন নিয়ে যে-সব মুসলমান ঋতুরাজবাবুর কাছে এসেছিল, তাঁদেরকে তিনি বললেন :

আমার কাছারি সময় একেবারে সমুদায় নামাজ সেরে নিলেই হয়। তবে বাকি রইল এক রবিবার, আচ্ছা সেদিনের জন্য না হয় একরূপ বন্দোবস্ত কর্ত্তে পারি।

এর প্রত্যুত্তরে যখন গানের আসরের উপরে হামলা হলো, তখন দেখা গেল ধর্মের সম্মানরক্ষার চাইতে এই উপলক্ষে আসরে উপস্থিত মহিলাদের সম্মানহানি করাটাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

হিন্দু-মুসলমানের এই বিরোধচিত্রের পাশাপাশি ইংরেজের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি লাভ করেছে :

গাজী মিয়া বলিতেছেন, তাই ইংরেজ আমাদের রাজা।… ইংরেজ চক্ষে অবিচার, অত্যাচার স্থান পায় না। … ইংরেজ রাজা নির্বিঘ্নে রাজত্ব করুন, সমগ্র ধরার আধিপত্য লাভ করুন কায়মনে ঈশ্বর সমীপে প্রার্থনা করি।

মশাররফ হোসেন যাঁদের অনুগৃহীত ছিলেন—যেমন নবাব আবদুল লতিফ (এঁকে তিনি বসন্তকুমারী নাটক উৎসর্গ করেছিলেন) বা দেলদুয়ারের গজনভীরা—তাঁদের চরিত্রে এই ইংরেজ-বশ্যতা প্রবল ছিল। তাঁদের সান্নিধ্য মশাররফ হোসেনের এই ইংরেজ রাজ-প্রীতির উদ্বোধনে সহায়তা করেছিল, এমন অনুমান স্বাভাবিক মনে হয়।

অথচ পূর্ববর্তী বৎসরে হিন্দু-মুসলমান-সমস্যা সম্পর্কে মশাররফ হোসেন যা বলেছেন, তা স্বতন্ত্র মনোভাবের পরিচায়ক :

…‘হিন্দু-মুসলমানে বিবাদ’ কি লইয়া বিবাদ ? কিসের জন্য বিবাদ ? সামান্য চৌকিদারের চক্ষু রাঙ্গানী পর্ব্বে হিন্দু-মুসলমান একইভাবে থতমত, অগ্রের পদ পশ্চাতে স্থাপিত। লালপাগড়ি নয়নে পড়িলেই ভয়ে আড়ষ্ট। দারোগার নাম শুনিলে হয়তো পেটের ভাত চালে পরিণত। গোরা পল্টনের নামে প্রায় জ্ঞানহত। বঙ্গে সাহস ও বলবীর্য্যে উভয় জাতিই প্রায় সমান। এ অবস্থায় বিবাদ-বিসম্বাদ, মনান্তর কথাটা, খোসগল্পের এক অঙ্গ ভিন্ন আর কি বলা যায় ?… হিন্দু-মুসলমান উভয়ে ব্রিটিশ সিংহের পদ-প্রসাদ ভিখারী। উভয়েই নত শিরে, ভক্তি সহকারে চির আজ্ঞাকারী।…

যেমন ভ্রাতায় ভ্রাতায় বিবাদ, আত্মীয় স্বজনে কলহ, পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে মেয়েলী ঝগড়া। যেমন এ পাড়ায় ও পাড়ায় দলাদলি, হরিসভা ব্রাহ্মসভায় বচসা। যেমন সাহিত্য সমিতি ও জাতীয় সমিতির মধ্যে মর্ম্মগত, আত্মগত, ব্যক্তিগত, অব্যক্ত মনোমালিন্য যেমন শাক্ত বৈষ্ণবে দ্বন্দ্ব, লিবারেল কনযারভেটিভে মনান্তর। বিচারগৃহে বাদী প্রতিবাদী উভয়-পক্ষের মোক্তারদলের কর্কশভাব, রোষের লক্ষণ। যেরূপ চিরভালবাসা স্বামী-স্ত্রীর সামান্য কোন কথায় মনোভঙ্গ—অভিমানের সমাবেশ।

এই ত বিবাদ! তুমি কলাপাতার যে দিক পরিশুদ্ধ জ্ঞান কর, আমি সেদিক ঘৃণা করি। আমি তোমার তক্তাপোষের নিকট যেই গিয়াছি, অমনি তোমার হুকোর জল কি যেন হইয়াছে।…

কথাতেই কথা আইসে। আমাদের মধ্যে আজকাল একদল লোক মাথা তোলা দিয়াছেন। ইহারা রাজ-প্রসাদভোগী নূতন চাকুরিয়া। ইহাদের আক্ষেপ এই যে কাচারীময় সকলেই হিন্দু। উপার্জ্জন উন্নতি আমাদের একেবারেই নাই। সকলেই আপন আপন জাতীয় টান টানিয়া থাকেন। কথা মিথ্যা নহে!১৫

মশাররফ হোসেন এখানে বিস্ময়কর মুক্তদৃষ্টি ও বাস্তব-সচেতনতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি লক্ষ করেছেন যে, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ রাজনৈতিক নয়, প্রধানত অর্থনৈতিক এবং অংশত সামাজিক। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখিয়েছেন যে হিন্দু কর্মচারী ছাড়া মুসলমান জমিদার বা সংবাদপত্র-পরিচালকদের চলে না। সুতরাং এভাবে পরস্পরসমর্থিত দুই সম্প্রদায়ে মৌলিক বিরোধের সুযোগ নেই। তাই আত্যন্তিক কামনা করেছেন যে, এই কল্পিত বিরোধ যেন আমরা বিস্মৃত হই।

সাহিত্যজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে মশাররফ হোসেনের এই মনোভাবের রূপান্তর কেন ঘটল, সে-প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ নয়। সমসাময়িক কালে মুসলিম বাংলার নবজাগরণের আন্দোলন তাঁর উপরে হয়তো প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু সেটা একমাত্র কারণ হতে পারে না। বাংলাদেশে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনার উন্মেষ হয় অনেক আগেই : ১৮৬৩-তে কলকাতায় মেহোমেডান লিটারারি সোসাইটির প্রতিষ্ঠা তার দিগ্দর্শন। ব্যক্তিগত জীবনে মশাররফ হোসেন যখন এই সমিতির কর্ণধার নবাব লতিফের ঘনিষ্ঠ সংস্রবে রয়েছেন, তখন তিনি হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যের কথা বলেননি—বরঞ্চ মিলনকামনার প্রকাশে এক শ্রেণির মুসলমানকে ক্ষুব্ধ করতে পশ্চাৎপদ হননি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে তিনি ধর্মজীবনের মাহাত্ম্যগান করলেন এবং হিন্দু-মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যের উপরে জোর দিলেন। মশাররফ হোসেনের প্রথম জীবন নানা কারণে উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে কেটেছে—এর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি তাঁর আমার জীবনী ও বিবি কুলসুমে আছে। পরিণত বয়সে গত জীবন সম্পর্কে গ্লানিবোধ তাঁকে ধর্মাশ্রয়ী করতে পারে। আমরা দেখতে পাই যে, এ-সময়ে তিনি ধর্মীয় প্রচার-সভায় যোগ দিচ্ছেন এবং বক্তৃতা করে ধর্মীয় আবেগকে জাগাতে চাইছেন।১৬

তবে দ্বিতীয় পর্বের রচনাগুলি মনোযোগ দিয়ে পড়লে আমরা লক্ষ করতে পারব যে, ধর্মচর্চা নয়, ধর্মীয় আবেগের শস্তা ও জনপ্রিয় রূপায়ণই মশাররফ হোসেনের লক্ষ্য। এখানে তিনি ফিরে গেছেন মিশ্র ভাষারীতির কাব্যের জগতে— লেখক হিসেবে এ-পরিণতি শোচনীয়। এই অবস্থা সম্পর্কে তিনি যে অচেতন ছিলেন তা মনে হয় না। বিবি খোদেজার বিবাহের ভূমিকায় তিনি বলেছেন যে, ‘সমাজের চৌদ্দ আনা লোকের’ (যারা অল্পশিক্ষিত এবং পুঁথি সাহিত্যের রসগ্রহণ করে থাকে, তাদের) জন্যে তিনি এই কাব্য রচনা করেছেন। শেষ জীবনের সমস্ত রচনাই এই শ্রেণির পাঠককে মনে রেখে লেখা। অতএব, ভাবে, ভাষায়, আঙ্গিকে কিছুমাত্র সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি বোধ করেন নি। এসব রচনা বহুলপ্রচারিত হয়ে লেখকের ইচ্ছাপূরণ করেছে। এ-পর্যায়ের রচনাবলির অন্যতম লক্ষণ হিন্দু সমাজ সম্পর্কে প্রবল বিতৃষ্ণার প্রকাশ। এর মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে যথার্থ দৃষ্টিতে দেখবার অক্ষমতা; ব্যবহারিক জীবনে কোনো কোনো হিন্দুর কাছে প্রতারিত হয়ে তিনি সমস্ত সম্প্রদায় সম্পর্কে সাধারণভাবে বিরাগ পোষণ করেছেন।

এ পর্যায়ে মৌলুদ শরীফ১৭ (১৯০৫) বোধহয় সর্বপ্রথম রচনা। মৌলুদ শরীফের বঙ্গানুবাদ ছন্দোবদ্ধ, টীকা গদ্যে লেখা। হজরতের জীবনকাহিনি এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি এতে সংবলিত হয়েছে। অলৌকিক ঘটনাবলিতে আস্থার পরিচয় সর্বত্র আছে। বেহেশ্তের বর্ণনায় তিনি খুব বর্ণাঢ্য করে শরাবন তহুরার স্রোত এবং অপূর্ব যুবতী নারীর সমাবেশের কথা বলেছেন। তারপর আরেক ভরসা দিয়েছেন :

 দাঁড়ী গোঁপ না উঠিবে

 জরা ভাব না রহিবে

 স্থায়ীভাবে রহিবে যৌবন।

এই বর্ণনা আধুনিক মনের কাছে রুচিকর বলে প্রতিভাত হবে না। তবে, ধর্মসভায় যাঁদের উদ্দেশে এই রচনা লেখক পাঠ করতেন, সেই ধর্মভীরু ও অশিক্ষিত লোকের কাছে এর আবেদন হয়তো ছিল—রূপক বলে এই বর্ণনা ব্যাখ্যা করলে তাঁদের কাছে এর মূল্য থাকত না।

এ-পর্যায়ে দ্বিতীয় রচনা বিবি খোদেজার বিবাহে (১৯০৫) খোদেজাকে যতদূর সম্ভব কুমারী নায়িকার গৌরবদানের চেষ্টা আছে। খোদেজা তাই বলেছেন :

 বিধবা হয়েছি কবে কিছু মনে নাই।

 লোকে বলে ছিল স্বামী আমি দেখি নাই ॥

ইতিহাসের এ-ধরনের বিকৃতি এ-জাতীয় রচনার সর্বত্র পাওয়া যাবে। তৌরাতে হজরত মুহম্মদের দেহ-সৌষ্ঠবের বর্ণনা আছে, একথা তিনি বলেছেন, আর হজরতের অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় অনেক দিয়েছেন।

হজরত ওমরের ধর্ম্মজীবন লাভ (১৯০৫) রচনা হিসেবে অকিঞ্চিৎকর। ভাষা ও ছন্দের শৈথিল্য ধর্মের আবরণ ভেদ করে প্রকাশ পেয়েছে। এর পরে তিনি লেখেন হজরত বেলালের জীবনী (১৯০৫) ও হজরত আমীর হামজার ধর্ম্মজীবন লাভ (১৯০৫)।

মদিনার গৌরব (১৯০৬) ছন্দোবদ্ধ রচনা। কোরেশদের অত্যাচারে মক্কা থেকে হজরত সানুচর হিজরত করে এলেন মদিনায়। সেখানে তিনি বিবি আয়েশাকে বিবাহ করলেন এবং হজরত আলির সঙ্গে ফাতেমার পরিণয়দান করলেন। এই দুই ঘটনার জন্যে এবং মদিনায় ইসলামের শক্তিবৃদ্ধি হলো বলে মদিনার গৌরব। এই হচ্ছে কাব্যের বিষয়বস্তু। অনল্পপরিসর রচনাটিতে কাব্যিক সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে আকস্মিক এক-আধটি চরণে, যেমন, ‘অন্তরের অন্ধকার হয়েছে অন্তর’। অন্যত্র গতানুগতিক ভাবের প্রাণহীন প্রলম্বন মাত্র। রচনারীতির শৈথিল্যের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য নমুনা :

 খ্রীষ্টের ছয় শত বাইশ সনের

 বিশে জুন তারিখের শেষাংশ রাত্রের।

 হজরত ছাড়িয়া মক্কা যান মদিনায়,

 বাঙ্গালা হিসাবে জ্যৈষ্ঠ মাস কহা যায়।

অন্য একটি বর্ণনার ভঙ্গিও খুব রুচিকর নয় :

 আরবের স্বাভাবিক জলবায়ু গুণে

 বালিকারা খাড়া হয় আসিয়া যৌবনে।

 তাহাতেও হজরত সাত বছরের

 পাত্রীকে [আয়েশাকে] বিবাহ করা ভাবিয়া দোষের।

 তাই সে সময় বিয়ে হয় না মক্কায়,

 কিন্তু কথা স্থির ছিল জানিত সবায়।

সবচাইতে কৌতুককর হচ্ছে অনাবশ্যকভাবে হিন্দু সমাজের প্রতি শ্লেষোক্তি। মক্কায় কাফেরদের সভায় বৃদ্ধবেশী শয়তান বক্তৃতাপ্রসঙ্গে বলেছে :

 এক দেশ আছে ভাই নাম হিন্দুস্থান,

 দেবদেবী ভক্ত তারা হিন্দুর সন্তান।

 আমার(ই) স্বজ্ঞাতি তারা আমার(ই) বংশধর,

 উজ্জ্বল করেছে তারা গৌরব দেশের।

 হিন্দুস্থানে নানাস্থানে দেবপূজা হয়,

 বড় সুশ্রী করে তারা প্রতিমা গড়ায়।

 ছেলেপিলে হইয়াছে তবু সে যুবতী।

 মন টলে যায় গলে দেখিলে মূরতি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অনেক হিন্দু লেখকের রচনায় মুসলমানদের সম্পর্কে যে-বিরূপ মনোভাব দেখা দিয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় সাহিত্যের নামে এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে।

মোস্লেম-বীরত্বেও (১৯০৮) একই মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। বদর, ওহোদ ও খায়বরের যুদ্ধে মুসলমানেরা যে-শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দেন তাই এতে পয়ার ছন্দে, মধ্যে মধ্যে গদ্যে, বর্ণিত হয়েছে। ‘অগ্রে পাঠ্য’ শীর্ষক ভূমিকায় লেখক তাঁর রচনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন :

শান্তিপ্রিয় মুসলমান কি কারণে তরবারি হস্তে করিয়াছিলেন, বীরত্বের সহিত বিধর্ম্মীর মুণ্ডপাত করিয়া বিজয় নিশান উড়াইয়া ছিলেন, তাহারই কিঞ্চিৎ আভাস দেখাইতে “মোস্লেম-বীরত্ব” প্রকাশ হইল।

এই ঐতিহাসিক মনোভঙ্গি এবং এর অন্তরালবর্তী ধর্মীয় আবেগের প্রশংসা করলেও রচনাটির দুর্বলতার কথা অস্বীকার করা যায় না।

 খৃষ্টের ছয় শত তেইশ সনের

 নবেম্বর মাসে এল খবর যুদ্ধের।

এই ধরনের বহু চরণকে কবিতা বলে স্বীকার করা যেমন কঠিন, তেমনি অন্য ধর্মাবলম্বীর প্রতি তীব্র বিরাগকেও ধর্মসম্মত মনোবৃত্তি বলে গ্রাহ্য করা দুষ্কর। উদাহরণস্বরূপ, ইহুদিদের সম্পর্কে তাঁর উক্তি স্মরণ করা যায়। শত্রুর প্রতি হজরতের ক্ষমাপ্রদর্শনের চিত্র বারবার প্রদর্শিত হয়েছে বটে, কিন্তু লেখকের যে-মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা এই যে, বিধর্মীকে ক্ষমা করে লাভ নেই— সুযোগ পেলেই তারা যন্ত্রণা দেবে। শিল্পীমনের পক্ষে এই মানসিক আবহাওয়া যে অনুকূল নয়, তা বলাই বাহুল্য।

ইতিহাসের ঘটনা-অবলম্বনে রচিত হলেও এসলামের জয় (১৯০৮) গ্রন্থে কল্পনার স্থান অনেকখানি। ঐতিহাসিক উপন্যাসের ঢঙে বর্ণাঢ্য বর্ণনা, কাল্পনিক সংলাপ ও চরিত্রচিত্রণের প্রচেষ্টা এতে দেখা যায়—প্রসঙ্গত জীবন ও জগৎ সম্পর্কে এবং বর্ণনাধীন বিষয় সম্পর্কে গ্রন্থকার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছ্বাসময় আত্মগত উক্তি সংকলন করেছেন। মদিনায় অবস্থানকালে হজরত মুহম্মদের জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এর ‘প্রথম শাখা’য় দশটি ‘মুকুলে’ কথিত হয়েছে। ‘দ্বিতীয় শাখা’য় তেরোটি ‘মুকুলে’ বিবৃত হয়েছে মক্কাবিজয় এবং তার পরবর্তী ঘটনাসমূহ। বইটিতে লেখক মন্থর ও সুবিস্তৃত বর্ণনার সাহায্যে শ্লথ ঘটনাবলিকে একত্র করেছেন, এক্ষেত্রে ভাষার আবেগময়তাই তাঁর রীতিগত সাফল্য। ধর্মীয় আবেগের অকৃত্রিম প্রকাশ এতে আছে—যদিও তা কোথাও কোথাও অপর ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু ও অশ্রদ্ধার পরিচায়ক। প্রসঙ্গক্রমে তিনি দেশপ্রীতি ও স্বাধীনতা সম্পর্কে যেসব উক্তি করেছেন, তা মূল্যবান। যেমন,

জন্মভূমি কাহার না আদরের ? মানুষের ত কথাই নাই—পশুপক্ষী কীট পতঙ্গগণও জন্মস্থানের মায়া মমতা বোঝে,—আদর ও যত্ন করে। কোন শাস্ত্রে বলিতেছে জন্মভূমি স্বর্গ হইতে গরীয়সী।…

হায়রে জন্মভূমি। জন্মভূমির দৃশ্য নয়ন-মনঃপ্রীতিকর। বসবাসে আনন্দে সুখোচ্ছ্বাসে, হৃদয়ের শান্তি। যাহার প্রীতিপ্রদ স্থান, মহা পবিত্র পুণ্যক্ষেত্র, ধূলিময়লা আবর্জ্জনা—প্রকৃত সুসন্তান পক্ষে স্বর্ণ রজত অপেক্ষাও মূল্যবান।… মাতৃদ্রোহী সন্তানের পক্ষে নহে, স্বদেশদ্রোহী কুলাঙ্গারের পক্ষে নহে, জন্মভূমিবৈরী নিষ্ঠুর পামরের পক্ষে নহে। স্বরাজই যদি পররাজ হইল, তবে গোলামী করিয়া জীবন ধারণ করা অপেক্ষা জীবনপাত করাই শ্রেয়ঃ।… নিজ জীবন রক্ষা করিতে স্বদেশের স্বাধীনতারত্ন যাহারা পরহস্তে তুলিয়া দেয়, তাহাদের ন্যায় কুলাঙ্গার দেশবৈরী আর কে আছে ? পবিত্র জন্মভূমি অপরের পাদুকাতলে দলিত হইবে, স্বাধীন জীবন পরাধীনতা শৃঙ্খলে বাঁধা পড়িবে, গলায় রজ্জু দিয়া বাঁদর নাচন নাচাইয়া লইয়া বেড়াইবে, ইহা কোন্ প্রাণে সহ্য হইবে ?

ধর্মাবেগপ্রধান আরো দুটি বই তিনি লেখেন : হজরত ইউসুফ (১৯০৮) এবং খোৎবা। তাঁর সাহিত্যিক জীবনের এই পর্বে পাঠ্যপুস্তকজাতীয় একটি বইও— মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা (প্রথম ভাগ ১৯০৩; দ্বিতীয় ভাগ ১৯০৮)—প্রকাশ করেন। বাজীমাত (১৯০৮) সমাজ-সমালোচনামূলক পদ্যরচনা।১৮ গাজী মিয়াঁর বস্তানীর ধারাটিই এখানে ফিরে এসেছে আরো স্থূল হয়ে। এক স্বৈরিণী ভূম্যধিকারিণীর কাহিনি এতে বর্ণিত হয়েছে। নন্দনগ্রামে সেরাজদ্দীর সঙ্গে এঁর অসামাজিক সম্পর্ক যখন বেশ গড়ে উঠছে, এমন সময়ে হিন্দু কর্মচারীদের কৌশলে সেরাজদ্দী বিপদগ্রস্ত হয় এবং পরিণামে এই মহিলাকে বিস্মৃত হতে না পেরে আত্মহত্যা করে। মশাররফ হোসেন খুব মনোযোগ দিয়ে বইটি লেখেননি, তার প্রমাণ, প্রথমার্ধে যে-চরিত্রটি সেরাজদ্দী নামে পরিচিত হয়েছে, শেষার্ধে তাকেই তিনি বলেছেন মনিরুদ্দী। স্থূলতার চরম প্রমাণ হিন্দুবেশী মনিরদ্দীর সত্য পরিচয় উদ্ঘটিত হবার উপায়ে :

 চক্ষে পড়ে শরীরের কোন এক স্থান,

 দেখে কহে নহে এই হিন্দুর সন্তান।

হিন্দুদের সম্পর্কে লেখকের ক্ষোভ প্রচ্ছন্ন থাকে নি। তিনি যখন বলেন :

 হিন্দু আমলা কারসাজি**** খেলে তারা ভেল্কিবাজী

 চক্ষে ধাঁধাঁ সবারই লাগায়,

 একমাত্র মুসলমান****তবু ফেটে যায় প্রাণ

 দেখ তারে কেমনে ভাগায়।

কিংবা তাঁর হিন্দু চরিত্র যখন বলেন,

 নেড়ের গায়ের গন্ধ গেলে নাসিকায়,

 অন্নপ্রাসন অন্ন পেট হতে উঠে যায়।

তখন তাঁর মনে কোনো বাস্তব ঘটনার স্মৃতি থাকা অসম্ভব নয়। তবে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ এখন তাঁকে কেবল বিব্রত ও পীড়িত করে না, বরঞ্চ পক্ষাবলম্বন করতে প্ররোচিত করে। তাই তিনি বলেন :

 ১. বিশ্বাসঘাতক হিন্দু দুষ্ট প্রবঞ্চক,

 যেই পাত খায় ফোঁড়ে এমনি পাতক।

 ২. তারা যে হিন্দুর পুত্র সংসারের পোকা।

 ৩. সাজাইতে মিথ্যা কথা হিন্দু বাহাদুর।

জীবনের শেষভাগে মশাররফ হোসেন দুটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেন : আমার জীবনী (১৯০৮-১০) এবং বিবি কুলসুম (১৯১০)। প্রথমটিতে বারো খণ্ডে প্রথম বিবাহ পর্যন্ত তাঁর জীবনকাহিনি বলা হয়েছে। বংশপরিচয়, নিজের অধঃপতন এবং প্রথম প্রণয়বৃত্তান্তের আবেগময় রূপায়ণ এতে আছে। ডারউইনের তত্ত্ব সম্পর্কে শ্লেষোক্তি এবং পর্দা-প্রথার সমর্থন তাঁর সংকীর্ণ চিন্তার পরিচয় দেয়। মিশ্র ভাষারীতির কাব্যপাঠে তিনি যে আনন্দ বোধ করতেন, সেকথা এখানে বলেছেন। স্বভাবসিদ্ধ অতিশয়োক্তি সত্ত্বেও বইটি উপভোগ্য। আমার জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুমে নিজের অধঃপতন চিত্রের আরেকটু সবিস্তার বর্ণনা আছে। দ্বিতীয়া পত্নী কুলসুম এমন সময়ে তাঁর গৃহে এলেন এবং তাঁর উন্নতিসাধন করলেন। দ্বিতীয় বিবাহের পরও তাঁর চারিত্রিক শৈথিল্য যে একেবারে দূর হয়নি, সে-পরিচয় এই বইতেই আছে। তবে কুলসুমের মতো প্রেমময়ী পত্নীর আশ্রয়ে তাঁর উৎকেন্দ্রিক জীবনে অনেকখানি শ্রী ফিরে আসে এবং তিনি স্ত্রীর প্রেরণায় সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হন ও সাফল্য লাভ করেন। কুলসুমের মৃত্যু হয় ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর মশাররফ হোসেন মাত্র দু বছর জীবিত ছিলেন (মৃত্যু ১৯ নভেম্বর ১৯১১)।

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় আজীজন নেহার নামে একটি মাসিক পত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘হুগলী কলেজের কতিপয় মুসলমান যুবকের উদ্যোগে চূঁচুড়া হইতে ইহার প্রচার আরম্ভ হয়’।১৯ তাছাড়া, প্রথমে লাহিনীপাড়া থেকে ও পরে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক হিতকরী (প্রথম প্রকাশ ১৮৯০) পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন।২০

মশাররফ হোসেনের সাহিত্যকর্মের মধ্যে তাঁর চিন্তাধারার যে-মূলগত পরিবর্তনের পরিচয় আমরা পাই, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যে প্রথম জীবনের হিন্দু-মুসলমান মিলন-কামনা ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করলেন, তার জন্যে অনেকখানি দায়ী—আমরা যদি বলি—সমসাময়িক পরিবেশের অনুদারতা, তাহলে খুব ভুল হয় না। যে-কালে এঁরা সাহিত্যচর্চায় প্রবৃত্ত হলেন, সে-কালেই হিন্দু পুনর্জাগরণবাদ বাংলার সাহিত্যে ও সমাজে আত্মপ্রকাশ করল। তার একটি দিক ছিল হিন্দু ও মুসলমানের—সমন্বয়-ধারার নয়—বিরোধ-স্মৃতির চর্চা করা, যার অপরিহার্য ফল হিন্দু-মানসে মুসলিম-বিদ্বেষের সূচনা। এর প্রতিক্রিয়ায় এবং সেইসঙ্গে স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতির প্রভাবে মুসলিম-মানসে জাগল হিন্দুর শুভবুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ এবং তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্পৃহা। অতএব, মিলন-কামনা আর কিছুতেই সাহিত্যে ও সমাজে খুব প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। মশাররফ হোসেনের মনোভাবের পরিবর্তনের পেছনে এই অনুদার পরিবেশের দান যে অনেকখানি, সেটা স্বীকার না করে উপায় নেই। কেবল তাঁর নয়, সেকালের সব লেখকই যে এই অবস্থার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেটা সুখকর হয়নি। তবে মশাররফ হোসেনের গৌরব এখানে যে, তাঁর যা কিছু রচনা সাহিত্যপদবাচ্য, তা এই সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমুক্ত।

তথ্য-নির্দেশ

১.  ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন (দ্বি-স; কলিকাতা ১৩৫০), পৃ ৬।

২.  Calcutta Review, no, 99 235.

৩.  ‘প্রাপ্ত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’, বঙ্গদর্শন, পৌষ ১২৮০।

৪.  ‘প্রাপ্ত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’, বঙ্গদর্শন, ভাদ্র ১২৮০।

৫.  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’, বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড : বঙ্কিম-রচনাবলী (কলিকাতা, ১৩৬১), ২ : ২৭২।

৬.  ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, পৃ ৪২-৪৩; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাময়িকপত্র, ২ (দ্বিতীয় সং; কলিকাতা, ১৩৫৯) : ১৪।

৭.  কাজী আবদুল মান্নান, আধুনিক বাঙলা-সাহিত্যে মুসলিম-সাধনা (রাজশাহী, ১৯৬১), পৃ ১৩১-এ উদ্ধৃত।

৮.  ব্রজেন্দ্রনাথ, বাংলা সাময়িক পত্র, ২ : ৪৯ : ‘আহমদী (পাক্ষিক) : শ্রাবণ ১২৯৩। ময়মনসিংহ-এর টাঙ্গাইল হইতে করিমন্নেছা খানম চৌধুরাণীর আনুকূল্যে প্রকাশিত। সম্পাদক—আবদুল হামিদ খান ইউসুফজয়ী।’

৯.  টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত। সম্পাদক—মৌলভী নইমুদ্দীন।

১০.  রাজনারায়ণ বসুকে লেখা মধুসূদনের পত্র। উদ্ধৃত, নগেন্দ্রনাথ সোম, মধু-স্মৃতি (দ্বি-স; কলিকাতা, ১৩৬৯), পৃ ৬১১।

১১.  যেমন : ‘হায় রে পাতকী অর্থ! তুই জগতের সকল অনর্থের মূল। জীবের জীবনের ধ্বংস, সম্পত্তির বিনাশ, পিতা-পুত্রে শত্রুতা, স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, ভ্রাতা-ভগ্নীতে কলহ, রাজা-প্রজায় বৈরীভাব, বন্ধু-বান্ধবে বিচ্ছেদ, বিবাদ, বিসম্বাদ, কলহ, বিরহ, বিসর্জ্জন, বিনাশ,—এসকলই তোমার জন্য; সকল অনর্থের মূল কারণই তুমি। তোমার কি মোহিনী শক্তি! কি মধুমাখা বিষসংযুক্ত প্রেম! রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই তোমার জন্য ব্যস্ত—মহাব্যস্ত—প্রাণ ওষ্ঠাগত!’

তুলনীয়, উদাসীন পথিকের মনের কথা, : ‘রে টাকা! তোর অসাধ্য কিছুই নাই। পরের জন্য, পরের প্রয়োজনীয় মাথার জন্য জলে ঝাঁপ, সম্মুখ শত্রুর অস্ত্রের মুখে বক্ষবিস্তার, লাঠির তলে মস্তকদান! রে টাকা! তোর জন্যই কেনীর বিলাত পরিত্যাগ, তোর জন্যই নীলের ব্যবসা, জমীদারীর পত্তন। তোর জন্যই নিরীহ বঙ্গের প্রজার প্রতি অত্যাচার-পিশাচি! তোর জন্য আজ এই বাঙ্গালী যুদ্ধ। পরিণাম ফল ভবিষ্যৎগর্ভে। জয় পরাজয় অবশ্যই হইবে। পরাজয় পক্ষেও তুমি, জয় পক্ষেও তুমি। তোমারই জয়, জগতে তোমারই জয়।’

১২.  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাম্য, বঙ্কিম-রচনাবলী, ২ : ৩৮০-৮৬।

১৩.  ব্রজেন্দ্রনাথ, মীর মশাররফ হোসেন, ১৯-২২।

১৪.  মুনীর চৌধুরী ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’, বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, বৈশাখ-আষাঢ়, ১৩৬৯ দ্রষ্টব্য।

১৫.  মীর মশাররফ হোসেন, ‘সৎপ্রসঙ্গ’, কোহিনুর, ভাদ্র ১৩০৫।

১৬.  ইসলাম-প্রচারক, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৯০২।

১৭.  শেখ মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন তাঁর আসল বাঙ্গালা গজল (নবম-স; কলিকাতা, ১৩২০) বইতে উল্লেখ করেছেন যে, ‘১৩০৭ সালের ২৬শে বৈশাখ তারিখে কুষ্টিয়ার নিকটস্থ ছেউড়িয়ার সভায় সুবিখ্যাত সুলেখক জনাব মীর মশাররফ হোসেন সাহেব তাঁহার প্রণীত বাঙ্গালা মৌলুদ শরীফ পাঠ করেন।’ পরবর্তীকালে মৌলুদ শরীফের (পঞ্চম-স; কলিকাতা, ১৩২৪) সঙ্গে ‘আরবি উর্দ্দু বাঙ্গালা জুময়া ও ঈদের খোতবা’ যুক্ত হয়।

১৮.  মোহাম্মদ ইদরিস আলী, ‘বাজীমাত’, বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, ভাদ্র-চৈত্র ১৩৬৫।

১৯.  ব্রজেন্দ্রনাথ, বাংলা সাময়িক পত্র, ২ : ১৪।

২০.  মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (ঢাকা, ১৯৫৬), পৃ ২৪৬।

১৯৬৫; পরিবর্ধন ও পরিমার্জন ২০১৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *