দীনবন্ধু মিত্র
১. দীনবন্ধু-জীবনী
বাংলা সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাবকালের পরিচয় দিতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন :
সেই ১৮৫৯/৬০ বাঙ্গালা সাহিত্যে চিরস্মরণীয়—উহা নূতন পুরাতনের সন্ধিস্থল। পুরাণ দলের শেষ কবি ঈশ্বরচন্দ্র অস্তমিত, নূতনের প্রথম কবি মধুসূদনের নবোদয়। ঈশ্বরচন্দ্র খাঁটি বাঙ্গালী, মধুসূদন ডাহা ইংরেজ। দীনবন্ধু ইহাদের সন্ধিস্থল। বলিতে পারা যায়, যে, ১৮৫৯/৬০ সালের মত দীনবন্ধুও বাঙ্গালা কাব্যের নূতন পুরাতনের সন্ধিস্থল।
বস্তুত, একদিকে নবযুগের মানববাদ ও বাস্তবপ্রবণতা, অন্যদিকে বাঙালি রুচি ও বাঙালি জীবনের চিরত্ব এক অপরূপ সমন্বয়লাভ করেছিল দীনবন্ধু মিত্রের রচনায়। বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসেও তাঁর ভূমিকা অসামান্য। আর মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচয় বঙ্কিমচন্দ্রই লিপিবদ্ধ করেছেন : ‘এরূপ পরদুঃখকাতর মনুষ্য আর আমি দেখিয়াছি কিনা সন্দেহ।’
নানা দুঃখকাতরতার মধ্যে দীনবন্ধুর জীবনের সূচনা হয়েছিল, সমাপ্তিও ঘটেছিল ওই পথে। তাঁর জন্ম হয় ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে,* নদিয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে। কলকাতা থেকে এ-গ্রাম খুব দূরে নয়, কাঁচড়াপাড়া স্টেশনের কয়েক ক্রোশ পূর্বোত্তরে। পিতা কালাচাঁদ মিত্র সামান্য বিষয়কর্ম করে কোনোমতে সংসারযাত্রা নির্বাহ করতেন। গ্রাম্য পাঠশালায় দীনবন্ধুর ছাত্রজীবনের সূত্রপাত হয়। জমিদারির কিছু কাজ শেখা হলে তাঁকে পড়াশুনা ছাড়িয়ে চাকরিতে নিযুক্ত করে দেন তাঁর পিতা। সে-জীবন দীনবন্ধুর ভালো লাগে নি। ইংরেজি শিক্ষায় তাঁর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাই কর্মত্যাগ করে, গৃহত্যাগ করে দীনবন্ধু একদিন কলকাতায় পালিয়ে আসেন।
কলকাতায় এসে তিনি এক আত্মীয়ের আশ্রয়লাভ করেন; বিনিময়ে সেই বাড়ির রন্ধনকার্য তাঁকে সমাপন করতে হতো। এই অবস্থায় তিনি হেয়ার সাহেবের স্কুলে (তখন তা কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল বা হিন্দু কলেজ ব্রাঞ্চ স্কুল নামে পরিচিত ছিল) প্রবেশ করেন এবং এ-সময়েই দীনবন্ধু মিত্র নাম গ্রহণ করেন। এ-সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী একটি কৌতুককর কাহিনি বলেছেন। দীনবন্ধুর প্রকৃত নাম ছিল গন্ধর্বনারায়ণ। লোকের মুখে তার সংক্ষিপ্ত রূপ হয় ‘গন্ধ’; সমবয়সীদের কল্পনাশক্তিতে তা পরিণত হয় ‘থু থু গন্ধ’রূপে। সেই যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি মুছে ফেলার জন্যেই সম্ভবত দীনবন্ধু নিজের নতূন নামকরণের উদ্যোগ নেন।
দীনবন্ধু যখন হেয়ার স্কুলের ছাত্র, তখন ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এ-সময়ে দীনবন্ধু বাংলা রচনায় উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত-সম্পাদিত সংবাদ সাধুরঞ্জন ও সংবাদ-প্রভাকর পত্রিকায় তাঁর রচনা স্থান পেতে থাকে। দীনবন্ধুর প্রথম রচনা—পয়ারছন্দে লেখা ১৪৬ চরণের কবিতা—‘মানবচরিত্র’ সাপ্তাহিক সাধুরঞ্জনে প্রকাশিত হয়। শিবনাথ শাস্ত্রী এটাকে ‘পদ্যগ্রন্থ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন; কিন্তু তা কখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেয়েছিল বলে মনে হয় না। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, কবিতাটি ‘অতি অল্প বয়সের লেখা, এজন্য ওই কবিতায় অনুপ্রাসের অত্যন্ত আড়ম্বর। ইহাও, বোধ হয়, ঈশ্বর গুপ্তের প্রদত্ত শিক্ষার ফল।… কিন্তু উহা আমাকে অত্যন্ত মোহিত করিয়াছিল।’ ১৮৫১ ও ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে সংবাদ-প্রভাকরে প্রকাশিত তাঁর ‘জামাই-ষষ্ঠী’ কবিতা দুটি যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল। এ দুটির রচনারীতিও ঈশ্বর গুপ্তীয়। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘বিজয়-কামিনী’ নামে একটি উপাখ্যান-কাব্য প্রভাকরে প্রকাশ করেন। এটি দশ বৎসর পরে রচিত নবীন তপস্বিনী নাটকের ভিত্তিস্বরূপ।
১৮৫০ সালে জুনিয়র বৃত্তি লাভ করে দীনবন্ধু হেয়ার স্কুল থেকে উত্তীর্ণ হন এবং হিন্দু কলেজের চতুর্থ শ্রেণিতে প্রবেশ করেন। পরের বছরের পরীক্ষায়ও তিনি জুনিয়র বৃত্তি পান এবং ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে সিনিয়র বৃত্তি পেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। এই দুই পরীক্ষায় তিনি বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকতাকর্মের পরীক্ষা দিয়ে তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে পাশ করেন। পর বছর ত্রিশ টাকার সিনিয়র বৃত্তি লাভ করে তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু এরপর তিনি আর পড়াশোনা করতে পারেননি।
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে দীনবন্ধু সরকারি ডাক বিভাগে কর্মগ্রহণ করেন। প্রথমে ১৫০ টাকা বেতনে পাটনার পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। দেড় বছর পরে উড়িষ্যা বিভাগের ইনস্পেকটিং পোস্টমাস্টার পদ লাভ করেন। এরপরে তিনি প্রথমে নদিয়া বিভাগে ও পরে ঢাকা বিভাগে বদলি হন। ঢাকায় অবস্থানকালেই তাঁর প্রথম নাটক নীলদর্পণ প্রকাশিত হয় (১৮৬০)। প্রকাশকালে নাট্যকার হিসেবে দীনবন্ধুর নাম ছিল না; তবে গ্রন্থকারের নাম বেশিদিন গোপন থাকে নি। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ‘A Native’ (মধুসূদন)-কৃত এর ইংরেজি অনুবাদ Nil Durpun or The Indigo Planting Mirror প্রকাশ পায়। নীলদর্পণ প্রকাশের ফলে দেশে এক সর্বব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, এর অনুবাদ প্রকাশিত হলে নীলকর ও তাঁদের সহযোগীরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ভূমিকায় দুটি দৈনিক পত্রের (ইংলিশম্যান ও হরকরা) সম্পাদককে দীনবন্ধু জুডাসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সেই অজুহাতে ইংলিশম্যান পত্রিকার সম্পাদক ওয়ালটার ব্রেট নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদের মুদ্রাকরের বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা দায়ের করেন। শুনানির সময়ে মুদ্রাকর মানুয়েল গ্রন্থের প্রকাশক হিসাবে রেভারেন্ড জেমস্ লঙের নাম প্রকাশ করেন তাঁরই নির্দেশানুযায়ী। ফলে পাদরি লঙের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা চলে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারে (১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে জুলাই) লঙের এক মাস কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ বিচারালয়ে উপস্থিত থেকে জরিমানার টাকা দিয়ে দেন।
অল্পকাল পর দীনবন্ধু ঢাকা বিভাগ থেকে বদলি হয়ে আসেন নদিয়া বিভাগে। কৃষ্ণনগরে অবস্থানকালে কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় তিনি একটি মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করেন। এখান থেকেই তাঁর দ্বিতীয় নাটক নবীন তপস্বিনী মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় (১৮৬৩)। এরপর দীনবন্ধু ঢাকা ও পরে উড়িষ্যা বিভাগে বদলি হয়ে আবার নদিয়া বিভাগে ফিরে আসেন। ১৮৬৬-৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বিয়ে পাগলা বুড়ো, সধবার একাদশী ও লীলাবতী প্রকাশলাভ করে। এরপরে দীনবন্ধুর রচনাপ্রকাশের ধারা আবার কিছুকাল রুদ্ধ হয়। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় সুপারনিউমররি ইন্সপেক্টটিং পোস্টমাস্টার নিযুক্ত হন। ১৮৭১-এ লুসাই যুদ্ধের ডাকের বন্দোবস্তের ভার তাঁর উপরে অর্পিত হয় এবং এ-কাজে তিনি বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দেন। এই সময়ে তিনি রায়বাহাদুর খেতাবে ভূষিত হন। এরপরে তিনি রেলওয়ে ডাকবিভাগের কাজে এবং পরে হাওড়া বিভাগে নিয়োগলাভ করেন। ১৮৭১ থেকে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দীনবন্ধুর অন্যান্য গ্রন্থ—সুরধুনী কাব্য (১ম ভাগ), জামাই বারিক, দ্বাদশ কবিতা এবং কমলে কামিনী প্রকাশিত হয়।
সরকারি কাজে অত্যধিক পরিশ্রমে দীনবন্ধুর শরীর ভেঙে পড়ে। তিনি যে কিছু কিছু ‘অবিহিতাচার’ করতেন, বঙ্কিমচন্দ্র সে-ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রথমে তিনি বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হন; পরে দারুণ বিস্ফোটকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এই অবস্থায়ও তাঁর স্বাভাবিক হাস্যরসপটুতা অব্যাহত ছিল। প্রথমে বিস্ফোটক দেখা দিয়েছিল তাঁর পৃষ্ঠদেশে, পরে বামপদে। এ-সময়ে কোনো বন্ধু তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করায় দীনবন্ধু উত্তর করেছিলেন : ‘ফোঁড়া এখন আমার পায়ে ধরেছে।’ শেষ পর্যন্ত ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বরে সে-হাস্যরসধারা চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেল।
২. দীনবন্ধু ও বাংলা নাট্যসাহিত্য
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে দীনবন্ধু মিত্রের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। যদিও তাঁর প্রথম নাটক নীলদর্পণ করুণরসাশ্রিত এবং শেষ নাটক কমলে কামিনী রোমান্সমূলক রচনা, তাহলেও তাঁর নিজস্ব অধিকার হাস্যরসে এবং হাস্যরসের নাট্যকার হিসেবে বাংলায় তাঁর সমকক্ষ বেশি নেই।
নাট্যকার হিসেবে দীনবন্ধুর কৃতিত্ব প্রধানত তাঁর ব্যাপক বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রবল সহানুভূতির উপর নির্ভরশীল। বঙ্কিমচন্দ্র নির্দেশ করেছেন যে, ‘প্রকৃত ঘটনা, জীবিত ব্যক্তির চরিত্র, প্রাচীন উপন্যাস, ইংরেজি গ্রন্থ এবং “প্রচলিত খোসগল্প” হইতে সারাদান করিয়া দীনবন্ধু তাঁহার অপূর্ব্ব চিত্তরঞ্জক নাটক সকলের সৃষ্টি করিতেন।’ এর মধ্যে প্রথম দুটিই দীনবন্ধুর মূলধন; যেখানে তিনি পরোক্ষ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল, সেখানে তাঁর সার্থকতা সীমাবদ্ধ। সুশীলকুমার দে খুব সুন্দর করে এই কথাটা বলেছেন : ‘তিনি চোখ দিয়া যেমন স্পষ্ট ও পরিষ্কার দেখিতেন চোখ বুজিয়া তেমন পারিতেন না।’
কর্মব্যপদেশে দীনবন্ধুকে যে দেশের বহু জায়গায় অবস্থান করতে হয়, তা তাঁর এই ব্যাপক অভিজ্ঞতাসঞ্চয়ে সাহায্য করেছে। তাঁর বহুদর্শিতা ও সর্বশ্রেণির মানুষের সঙ্গে অকাতরে মেলামেশার ক্ষমতার পরিচয় বঙ্কিমচন্দ্র দিয়েছেন। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা কীভাবে দীনবন্ধুর সৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়েছে, বঙ্কিমচন্দ্র তারও বর্ণনা দিয়েছেন :
“নীল-দর্পণে”র অনেকগুলি ঘটনা প্রকৃত; “নবীন তপস্বিনী”র বড় রাণী ছোট রাণীর বৃত্তান্ত প্রকৃত। “সধবার একাদশী”র প্রায় সকল নায়ক-নায়িকাগুলিন জীবিত ব্যক্তির প্রতিকৃতি; তদ্বর্ণিত ঘটনাগুলির মধ্যে কিয়দংশ প্রকৃত ঘটনা। “জামাই-বারিকে”র দুই স্ত্রীর বৃত্তান্ত প্রকৃত। “বিয়ে পাগলা বুড়ো”ও জীবিত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিয়া লিখিত হইয়াছিল।
এই বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর সর্বব্যাপী সহানুভূতির যোগ হয়েছিল বলেই দীনবন্ধুর সৃষ্টি এত সার্থক হয়েছিল। এ-প্রসঙ্গেও বঙ্কিমচন্দ্রের উক্তি স্মরণীয় :
সকল শ্রেণির লোকের সঙ্গেই তাঁহার তীব্র সহানুভূতি।… এই বিশ্বব্যাপী সহানুভূতির গুণেই হউক বা দোষেই হউক, তিনি সর্ব্বস্থানে যাইতেন, শুদ্ধাত্মা পাপাত্মা সকল শ্রেণির লোকের সঙ্গে মিশিতেন। … নিজে এই প্রকার পবিত্রচেতা হইয়াও সহানুভূতি শক্তির গুণে তিনি পাপিষ্ঠের দুঃখ পাপিষ্ঠের ন্যায় বুঝিতে পারিতেন। তিনি নিমচাঁদ দত্তের ন্যায় বিশুষ্ক-জীবন-সুখ বিফলীকৃত শিক্ষা, নৈরাশ্যপীড়িত মদ্যপের দুঃখ বুঝিতে পারিতেন, বিবাহ বিষয়ে ভগ্ন-মনোরথ রাজীব মুখোপাধ্যায়ের দুঃখ বুঝিতে পারিতেন, গোপীনাথের ন্যায় নীলকরের আজ্ঞাবর্ত্তিতার যন্ত্রণা বুঝিতে পারিতেন।…
…যাহার সঙ্গে তাঁহার সহানুভূতি, যাহার চরিত্র আঁকিতে বসিয়াছেন, তাহার সমুদয় অংশই তাঁহার কলমের আগায় আসিয়া পড়িত। কিছু বাদসাদ দিবার তাঁহার শক্তি ছিল না, কেননা, তিনি সহানুভূতির অধীন, সহানুভূতি তাঁহার অধীন নহে।…. তোরাপের সৃষ্টিকালে তোরাপ যে ভাষায় রাগ প্রকাশ করে, তাহা বাদ দিতে পারিতেন না। আদুরীর সৃষ্টিকালে আদুরী যে ভাষায় রহস্য করে, তাহা বাদ দিতে পারিতেন না। নিমচাঁদ গড়িবার সময়ে, নিমচাঁদ যে ভাষায় মাতলামি করে, তাহা ছাড়িতে পারিতেন না। …তাই আমরা একটা আস্ত তোরাপ, আস্ত নিমচাঁদ, আস্ত আদুরী দেখিতে পাই। রুচির মুখ রক্ষা করিতে গেলে ছেঁড়া তোরাপ, কাটা আদুরী, ভাঙ্গা নিমচাঁদ আমরা পাইতাম।…
এই সর্বব্যাপী সহানুভূতি তাঁকে শুধু বাস্তববাদী সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেনি, তাঁকে উচ্চশ্রেণির হাস্যরসিক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। দীনবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি বস্তুগত ছিল, নাট্যকারোচিত নৈর্ব্যক্তিকতা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন, আর হাস্যরসিকের যা শ্রেষ্ঠ গুণ—সমবেদনাবোধ—তাও তাঁর স্বভাবজ ছিল।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের শিষ্যরূপে দীনবন্ধু সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন। হাস্যরসে অধিকার ও বাস্তবপর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তিনি অনেকাংশে গুপ্ত কবির থেকে লাভ করেছিলেন। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই গুরুর চাইতে শিষ্যের কৃতিত্ব অধিক। সুশীলকুমার দে বলেছেন যে, দীনবন্ধু ‘করুণের মধ্যে হাস্য ও হাস্যের মধ্যে করুণের বিচিত্র অভিব্যক্তি দেখিতে পাইতেন।’ এই গুণ ঈশ্বর গুপ্তের আয়ত্তাধীন ছিল না। সৃষ্টিক্ষমতায়ও দীনবন্ধুর আসন ঈশ্বর গুপ্তের উপরে।
দীনবন্ধুর সৃষ্টিকৌশলের পরিচয় দিতে গিয়ে জলধর, জগদম্বা, মল্লিকা, নিমচাঁদ দত্ত প্রভৃতি চরিত্রের উল্লেখ করে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন :
তবে যাহা সূক্ষ্ম, কোমল, মধুর, অকৃত্রিম, করুণ, প্রশান্ত—সে সকলে দীনবন্ধুর তেমন অধিকার ছিল না। তাঁহার লীলাবতী, মালতী, কামিনী, সৈরিন্ধ্রী, সরলা, প্রভৃতি রসজ্ঞের নিকট তাদৃশ আদরণীয়া নহে। তাঁহার বিনায়ক, রমণীমোহন, অরবিন্দ, ললিতমোহন মন মুগ্ধ করিতে পারে না। কিন্তু যাহা স্থূল, অসঙ্গত, অসংলগ্ন, বিপর্য্যস্ত, তাহা তাঁহার ইঙ্গিতমাত্রেরও অধীন।
প্রধানত সধবার একাদশীর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অজিত দত্ত এই উক্তিকে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছেন। বস্তুত দীনবন্ধুর রচনায় কোমল, অকৃত্রিম ও করুণের অভাব নেই। ক্ষেত্রমণি, তোরাপ ও নিমচাঁদের নাম প্রথমেই মনে পড়ে। নিমচাঁদের সৃষ্টিতে সূক্ষ্মতা একেবারে অনুপস্থিত, একথা বললে দীনবন্ধুর প্রতি অবিচার করা হয়।
এ সত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্রের মূল বক্তব্য যথার্থই মনে হয়। অজিত দত্ত অন্যত্র যা বলেছেন, তাও বঙ্কিমচন্দ্রের সমালোচনার পরিপোষক :
…সেই পাশ্চাত্যশিক্ষা প্রণোদিত আদর্শবাদের যুগে তাঁর গুরু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মত সম্পূর্ণ বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা দীনবন্ধুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু মনে প্রাণে তিনি ছিলেন পুরোমাত্রায় বাস্তববাদী; বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর স্বভাবজ ছিল। যুগপ্রভাবে তাঁকে আদর্শবাদ গ্রহণ করতে হয়েছিল। শিল্পপ্রেরণার মূলে এই অন্তর্বিরোধ তাঁর সৃষ্টিকে অসম্পূর্ণ করেছে। তিনি বাংলায় নিখুঁত নাটক লিখেছেন, কিন্তু মহৎ নাটক লিখতে পারেননি। তিনি ছিলেন নাট্যশিল্পের অদ্বিতীয় শিল্পী, কিন্তু সূক্ষ্ম ও গভীর রসসৃষ্টি তাঁর সাধ্যায়ত্ত ছিল না। এই কারণে প্রহসনগুলিতেই দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র যাকে সূক্ষ্ম ও কোমল বলেছেন, দীনবন্ধুর বাস্তবতাবোধে তা ধরা পড়েনি। যেখানে পীড়ন ও বিকার আছে, অসংগতি ও বিপর্যয় আছে, বাস্তবের সেই রূপই দীনবন্ধুর দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করেছিল বেশি। প্রহসনে তাঁর নৈপুণ্যের মূলেও বাস্তবদৃষ্টির এই রূপই কার্যকর ছিল।
তবু জীবনশিল্পী হিসাবে দীনবন্ধু সেই অদেখা প্রশান্তি ও মাধুর্যেরও সন্ধানী ছিলেন। আর তার সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন সাহিত্যে—দেশি উপকথায় ও বিদেশি রোমান্সে। নবীন তপস্বিনী, লীলাবতী, কমলে কামিনীতে তারই প্রকাশ ঘটেছে। বাস্তব-অভিজ্ঞতার অভাবে তাঁর আহরিত জ্ঞান এসব ক্ষেত্রে নৈপুণ্যের সঙ্গে প্রযুক্ত হয়নি। এসব নাটকের প্রণয়দৃশ্য তাই একান্তই কৃত্রিম হয়েছে। দীনবন্ধুর অন্যান্য নাটকের তুলনায় লীলাবতীকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেও বঙ্কিমচন্দ্র এর নায়িকার কোর্টশিপের দৃশ্যকে অত্যন্ত অবাস্তব বলেই অভিহিত করেছিলেন। রোমান্সরস বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার সম্পূর্ণ উপযুক্ত ছিল—দীনবন্ধুর নয়। সুশীলকুমার দে বলেছেন :
রোমান্সের সূক্ষ্ম ভাবকল্পনা তাঁহার মত হাস্যরসিক ও বাস্তবশিল্পীর প্রতিভার উপযোগী ছিল না। বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনে যাহা নাই তাহাকে কল্পনা দিয়া পূরণ করিবার এই যে প্রচ্ছন্ন ভাবপ্রবণতা তাহার অপরিপক্ক ফল হইতেছে বিজয়-কামিনী, ললিত-লীলাবতী ও নবীনমাধব-সৈরিন্ধ্রীর কৃত্রিম গদ্যে ও পদ্যে আলাপ ও উচ্ছ্বাস। কেবল শিখণ্ডিবাহন-রণকল্যাণীর সর্বদোষনিষ্ক্রয়ী হাস্যপরিহাসপটুতা আছে বলিয়া তাহারা অনেকটা বাঁচিয়া গিয়াছে।
রোমান্স-রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনা এক নতুন জগতের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিল। নাটকের ক্ষেত্রে মধুসূদনও এই রসকে সার্থকতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। দীনবন্ধুর কৃতিত্ব এই যে, সম্পূর্ণ ভিন্নপথে পদচারণ করে তিনি বাংলাসাহিত্যে বাস্তবতার প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে রামনারায়ণ তর্করত্ন তাঁর পুরোগামী। রামনারায়ণের ত্রুটি তিনিও সর্বত্র পরিহার করিতে পারেননি। কিন্তু পূর্বসূরির তুলনায় দীনবন্ধুর বাস্তবতাবোধ ছিল তীক্ষ্ণ, পরিহাসক্ষমতা ছিল উজ্জ্বল আর সহানুভূতি ছিল ব্যাপক।
দীনবন্ধুর নাটকে সংলাপের ভাষা সম্পর্কে নানারকম প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে থাকে। যেখানে তিনি বাস্তবানুগামী, সেখানে তাঁর রুচির নিন্দা হয়েছে; যেখানে তিনি রুচিবান, সেখানে তাঁর ভাষার কৃত্রিমতা হয়েছে শিরঃপীড়ার কারণ। দীনবন্ধুর এই ভাষা-বিভ্রাটের একটি সংগত কারণ উল্লেখ করেছেন সুশীলকুমার দে। তিনি দেখিয়েছেন যে, ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা গদ্যরীতির একটা অস্থিরতার কাল গেছে। যদিও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এসে গেছেন, তবু রামনারায়ণ তর্করত্ন, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও নাট্যকার মধুসূদনের আবির্ভাবে বাংলা গদ্যের যে বহুধাবিভক্ত রূপ তখন দেখা দিয়েছিল, তাতে একধরনের বিশৃঙ্খলার কাল বলে তাকে চিহ্নিত করা যায়। মধুসূদনের নাটকে ও প্রহসনে ভাষার একাধিক রীতি অনুসৃত হয়েছে। সংস্কৃত নাটকের আদর্শে রামনারায়ণও উচ্চশ্রেণির ও নিম্নশ্রেণির পাত্রপাত্রীর ভাষার পার্থক্য রক্ষা করেছেন। দীনবন্ধুও সে-আদর্শ অনুকরণ করেছিলেন, কিন্তু কল্পনাশক্তির প্রবলতার পরিচয় দিতে পারেননি। জীবন্ত আদর্শ সামনে রেখে যেখানে তিনি কথ্য ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, সেখানে তাঁর সংলাপ যেমন স্বাভাবিক, তেমনি কার্যকর। যেমন, তোরাপের ভাষা, ক্ষেত্রমণির ভাষা, নিমচাঁদের ভাষা। ভাষার এই অকৃত্রিমতায় যাঁরা রুচিদোষ প্রত্যক্ষ করেন, মোহিতলাল মজুমদার তাঁদের জবাবে বলেন: ‘এ ভাষায় যে অশ্লীলতা আছে, তাহা ‘আর্টে’র অশ্লীলতা নয়, চরিত্রগত দুর্নীতি নয়, এ অশ্লীলতার ন্যায্য অধিকার কেবল এই চরিত্রেরই আছে; সে অধিকার হইতে তাহাকে বঞ্চিত করিতে চাহিবে, এত বড় রুচিবাগীশ ভগবানও নহেন…।’
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে, ভদ্রশ্রেণির চরিত্রের মুখে তিনি যে ভাষা দিয়েছেন, তা সাধুভাষা-মিশ্রিত, সমাসবহুল, তৎসম শব্দময়। এখানে ভাষা ও ভঙ্গি দু-ই কৃত্রিম। নীলদর্পণে বিন্দুমাধবের বিলাপ কিংবা তার লিপিহস্তে সরলতার স্বগতোক্তি এই কৃত্রিমতার নিদর্শন বলে বিবেচিত হবে। নাটকে কবিতার ব্যবহারেও দীনবন্ধু ব্যর্থ হয়েছেন। অমিত্রাক্ষরের মর্মমূলে প্রবেশ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। পয়ারের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি তাঁর সংলাপের ভাষার কৃত্রিমতাই শুধু প্রকাশ করেছে।
ভাষার এই তারতম্য দীনবন্ধুর চরিত্রসৃষ্টির তারতম্যের দ্যোতক। সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন, ‘অশিক্ষিত দরিদ্র লোকেরাই তাঁহার নাট্যরচনায় ভালো করিয়া ফুটিয়াছে। ব্যঙ্গরচনায় ছাড়া অন্যত্র দীনবন্ধু ভদ্রলোককে স্বাভাবিক করিয়া দেখাইতে পারেন নাই। ভদ্রলোকের আড়ষ্ট ভূমিকা ও “সাধু” ভাষা দীনবন্ধুর নাট্যরচনাকে বহু পরিমাণে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে। কিন্তু ভদ্রঘরের সন্তান হইয়াও যাহারা খুব নীচে নামিয়া গিয়াছে—মাতাল, নেশাখোর, নির্বোধ, অসহায়—তাহাদের চরিত্রাঙ্কন তুচ্ছ হয় নাই।’
নীলদর্পণ, বিয়ে পাগলা বুড়ো ও সধবার একাদশীতে দীনবন্ধু যে-কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, নবীন তপস্বিনী, লীলাবতী ও কমলে কামিনীতে তার পরিচয় নেই। জামাই বারিকের স্থান দু শ্রেণির মাঝামাঝি। দীনবন্ধু কেন তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্র—বাস্তব অভিজ্ঞতার—বাইরে গিয়ে নবীন তপস্বিনী প্রভৃতি লিখলেন ? বাঙালি জীবনের সংকীর্ণ পরিবেশে নাটকীয় উপাদান আর খুঁজে পেলেন না বলে ? নাকি, দেশীয় উপকথা ও রোমান্সরসের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন বলে ? মনে হয়, তাঁর এই ক্ষেত্রপরিবর্তনের পশ্চাতে এ দুটি কারণই ক্রিয়াশীল ছিল। যে-জীবনকে তিনি বাস্তবের খণ্ডতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার একটা চিরন্তন রসরূপসৃষ্টির আকাক্সক্ষা তাঁর মনে জেগে থাকবে। পরিণামে কিন্তু দেখা গেল, যা সাময়িক, যা কালগত, যা খণ্ডিত, তাই চিরন্তন, কালোত্তর ও মহিমময় রূপ লাভ করেছে।
৩. দীনবন্ধু ও বাংলা রঙ্গালয়
দীনবন্ধু মিত্রের নাটকাভিনয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা হয়, এ-ঘটনা নাট্যকার দীনবন্ধুর অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার (পরে শ্যামবাজার নাট্যসমাজ) ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁদের প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করেন প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রাধামাধব কর ও নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের নির্বাচিত নাটকটি ছিল সধবার একাদশী। প্রথম অভিনয় ভালো হয়নি। কিছুকাল পরে তাই এঁরা নবীনচন্দ্র সরকারের বাড়িতে এবং ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে রামপ্রসাদ মিত্রের বাড়িতে এ-নাটকের পুনরাভিনয় করেন। শেষবারে গিরিশচন্দ্র ঘোষ নিমচাঁদের ভূমিকায় এবং অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী জীবনচন্দ্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই অভিনয় দেখে দীনবন্ধু স্বয়ং মুগ্ধ হয়েছিলেন। সম্ভবত ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষ্মীনারায়ণ দত্তের বাড়িতে তাঁদের উদ্যোগে সধবার একাদশীর সপ্তম অভিনয় হয়েছিল; সেইসঙ্গে মঞ্চস্থ হয় বিয়ে পাগলা বুড়ো।
এ-সময়ে কলকাতার বাইরেও দীনবন্ধুর নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকে। কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্রেরা ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে কলেজগৃহে নবীন তপস্বিনী নাটকের অভিনয় করেন। দীনবন্ধু এই অভিনয়ের আংশিক ব্যয়ভার বহন করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ সুধীর উদ্যোগে চুঁচুড়ার মল্লিকবাড়িতে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে লীলাবতী নাটকের অভিনয় হয়।
প্রধানত এই দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হয়েই বাগবাজারের দল কলকাতায় রাজেন্দ্রনাথ পালের বাড়িতে একই বছরে লীলাবতী নাটকের অভিনয় করেন। এই অভিনয়ের অভাবিত সাফল্যের পর এঁরা কলকাতায় সাধারণ রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার আগে পর্যন্ত ধনী বা শৌখিন ব্যক্তির পারিবারিক মঞ্চ ছাড়া নাট্যাভিনয়ের স্থান ছিল না। চিৎপুরের মধুসূদন সান্যালের বাড়িতে বাগবাজারের দল সাধারণ রঙ্গমঞ্চ বা ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা করলেন ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে। এই পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হতে না পেরে গিরিশচন্দ্র দল ছেড়ে চলে যান।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর নীলদর্পণের অভিনয়ের মাধ্যমে জাতীয় রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন হলো। অর্ধেন্দুশেখর একইসঙ্গে উড সাহেব, সাবিত্রী, গোলোক বসু ও একজন রায়তের ভূমিকা গ্রহণ করেন। মতিলাল সুর রাইচরণ ও তোরাপের ভূমিকায়, অবিনাশচন্দ্র কর রোগ্ সাহেবের ভূমিকায় এবং অমৃতলাল বসু সৈরিন্ধ্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অর্ধেন্দুশেখরের অভিনয় অনবদ্য হয়েছিল। তাছাড়া বলা হয় যে, মতিলালের মতো তোরাপের এবং অবিনাশের মতো রোগ্ সাহেবের অভিনয় নাকি আর কেউ আজো করতে পারেননি।
ন্যাশনাল থিয়েটারের দ্বিতীয় অভিনয় হয় জামাই বারিক। তারপর আবার নীলদর্পণ। এরপর সধবার একাদশী, নবীন তপস্বিনী, লীলাবতী। তারপর বিয়ে পাগলা বুড়ো। মোটকথা, ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ৮ই মার্চ (ন্যাশনাল থিয়েটারের শেষ অভিনয়) পর্যন্ত এই রঙ্গমঞ্চে ১৭ রজনী নাটক মঞ্চস্থ হয়। তার মধ্যে নীলদর্পণ পাঁচবার, নবীন তপস্বিনী দুবার, বিয়ে পাগলা বুড়ো একবার, সধবার একাদশী একবার, লীলাবতী একবার ও জামাই বারিক দুবার অভিনীত হয়। আর কোনো নাট্যকারের রচনা এত জনপ্রিয়তা অর্জনে সমর্থ হয়নি। এই প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্র ঘোষের বক্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘মহাশয়ের নাটক যদি না থাকিত, এই সকল যুবক মিলিয়া ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ স্থাপন করিতে সাহস করিত না। এই নিমিত্ত আপনাকে রঙ্গালয় স্রষ্টা বলিয়া নমস্কার করি।’
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ন্যাশনাল থিয়েটার দু দলে ভাগ হয়ে যায়। ফলে অর্ধেন্দুশেখরের নেতৃত্বে হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার আর গিরিশচন্দ্র ঘোষের (তিনি গোড়ায় ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত না হলেও মধ্যে ফিরে আসেন) ন্যাশনাল থিয়েটার নামে দুটি পেশাদার নাট্যসংস্থার সূচনা হয়। এবারও ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন হয় নীলদর্পণের অভিনয় দিয়ে। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে তাঁরা টাউন হলে, রাধাকান্ত দেবের নাটবাড়ীতে এবং সান্যাল বাড়িতে আরো দুবার নীলদর্পণ এবং সধবার একাদশী, কমলে কামিনী ও লীলাবতী একবার করে মঞ্চস্থ করেন। হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটারের তৃতীয় অভিনয় হয় হাওড়া রেলওয়ে থিয়েটারে — তাও নীলদর্পণ। কয়েক মাসের মধ্যে তাঁরা ঢাকায় পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমিতে নীলদর্পণ এবং রাজশাহীতে নবীন তপস্বিনী নাটক মঞ্চস্থ করেন।
হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার অচিরেই গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নাম গ্রহণ করে। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম চার মাসে তাঁরা তিনবার নীলদর্পণ এবং কমলে কামিনী ও সধবার একাদশী একবার করে মঞ্চস্থ করেন। পরবর্তী বৎসরে ওই একই সময়ে তাঁদের মঞ্চে নীলদর্পণ দুবার এবং সধবার একাদশী ও জামাই বারিক একবার করে অভিনীত হয়। গ্রেট ন্যাশনাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি দল দি ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে। তাঁদেরও দ্বিতীয় অভিনয় ছিল নীলদর্পণ। এর অল্পকাল আগে গৌহাটিতে নাটকাভিনয়ের সূচনা হয়। জামাই বারিক সেখানে অভিনীত দ্বিতীয় নাটক।
৪. দীনবন্ধু-রচনাবলি
প্রকাশকাল-অনুযায়ী দীনবন্ধু মিত্রের রচনাবলির তালিকা দেওয়া গেল :
১. নীল দর্পণং নাটকং। ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৮৬০।
২. নবীন তপস্বিনী নাটক। কৃষ্ণনগর, ১৮৬৩।
৩. বিয়ে পাগলা বুড়ো। প্রহসন। কলিকাতা, ১৮৬৬।
৪. সধবার একাদশী। নাটক। কলিকাতা, ১৮৬৬।
৫. লীলাবতী। নাটক। কলিকাতা, ডিসেম্বর, ১৮৬৭।
৬. সুরধুনী কাব্য। প্রথম ভাগ। কলিকাতা, আগস্ট ১৮৭১।
৭. জামাই বারিক। প্রহসন। কলিকাতা, মার্চ ১৮৭২।
৮. দ্বাদশ কবিতা। কলিকাতা, মে ১৮৭২।
৯. কমলে কামিনী। নাটক। কলিকাতা, সেপ্টেম্বর ১৮৭৩।
১০. সুরধুনী কাব্য। দ্বিতীয় ভাগ। কলিকাতা, নভেম্বর ১৮৭৬।
১১. পদ্যসংগ্রহ। কলিকাতা, ১৮৮৬। সংবাদ সাধুরঞ্জন, সংবাদ প্রভাকর ও বঙ্গদর্শন থেকে সংকলিত বারোটি কবিতা। এর অধিকাংশই তাঁর বাল্যরচনা।
এ ছাড়া দীনবন্ধু কয়েকটি গদ্য-আখ্যান এবং ‘কুড়ে গরুর ভিন্ন গোঠ’ নামে একটি সংক্ষিপ্ত নাট্যচিত্র সাময়িকপত্রে প্রকাশ করেছিলেন।
নাটকগুলি সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য ও মন্তব্য নিম্নে সন্নিবেশিত হলো।
নীলদর্পণ
সাহিত্য-পরিষৎ-সংস্করণ নীলদর্পণ নাটকের ভূমিকায় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস নীলচাষের যে-বিবরণ দিয়েছেন, এখানে তা উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
রঞ্জনদ্রব্য হিসাবে নীলের প্রয়োগ খুব ব্যাপক, ইহা পৃথিবীর সর্ব্বত্র ব্যবহৃত হইয়া থাকে। অধুনা ইহা রাসায়নিক গবেষণাগারে প্রচুর পরিমাণে প্রস্তুত হয়। কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক প্রণালী আবিষ্কৃত হইবার পূর্ব্বে নীলনামীয় একরূপ গাছ হইতে এই রঙ সংগৃহীত হইত। ভারতবর্ষে নীলের চাষ বহু পুরাতন, ইণ্ডিগো নামেই তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি (১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) গোড়া হইতেই নীলের কারবার করিতেন। ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত কোম্পানি সাধারণভাবে সকলকেই নীল চাষের অধিকার দান করেন। বাংলা দেশ ও বিহারের কোনো কোনো অঞ্চল এই নীল গাছের চাষের অত্যন্ত উপযোগী ছিল। এই ব্যবসায় এতই লাভজনক ছিল যে, কোম্পানি অনুমতি দেওয়া মাত্রই শ্বেতাঙ্গ বণিকসম্প্রদায় বাংলা দেশে এবং বিহারে এই ব্যবসায় আরম্ভ করেন। প্রথমে দেশীয় জমিদারদিগকে প্রলুব্ধ করিয়া তাঁহাদের জমিতে তাঁহাদের প্রজাদের দ্বারাই এই চাষ চলিত। সাহেবরা সর্ব্বত্র নীলকুঠি স্থাপন করিয়া উক্ত জমিদার ও জোতদারগণের নিকট হইতে নীলের ফসল খরিদ করিয়া, এই সকল স্থানে রঞ্জনদ্রব্য নিষ্কাষণ করিতেন। ক্রমে ক্রমে অধিকতর লোভে এবং বিপুল সম্পত্তির বলে এই সাহেবরা নিজেরাই জমিদারি খরিদ করিয়া নীলের চাষ করিতে থাকেন এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ও অন্য জমিদারের প্রজাদের দাদন দিয়াও চাষ করিতে বাধ্য করেন। শেষ পর্য্যন্ত ইঁহাদের লোভ এতই বাড়িয়া যায় যে, অর্থ ও সামর্থ্যরে বলে ইঁহারা ইচ্ছামত প্রজাদের উৎকৃষ্ট জমিতে মার্কা দিয়া (“দাগ মারিয়া”) তাহাতেই নীলের চাষ করাইতেন, চাষিরা একান্ত প্রয়োজনীয় আহার্য্য শস্য উৎপাদনের অধিকার, সময় ও সুযোগ পাইত না। দুই-এক জন প্রজা ইহার প্রতিবাদ করিতে আরম্ভ করিলে কুঠিয়াল সাহেবরা অর্থবশীকৃত “বুনো” ও লাঠিয়ালদের দ্বারা শক্তিপ্রয়োগে প্রজাদিগকে পীড়ন করিতেন। এইভাবে নীলকরদের অত্যাচার আরম্ভ হইয়া ঊনবিংশ শতাব্দীর সূত্রপাত হইতেই তাহা দরিদ্র প্রজাদের পক্ষে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। স্ব স্ব ন্যায্য অধিকার দাবি করিতে গিয়া বহু প্রজা ভিটেমাটিসহ উচ্ছন্ন এবং তাহাদের সমর্থক বহু বর্দ্ধিষ্ণু গ্রামবাসী অকারণে কুঠিতে কয়েদ হইয়া বিপন্ন হয়। শক্তিমদমত্ততাজনিত এই অত্যাচারে নিতান্ত নিরীহ প্রজাদেরও ধৈর্য্যরে সীমা ছাড়াইয়া যায়। স্থানীয় ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুষ এবং অন্যান্য কারণে কুঠিয়ালদেরই পক্ষ অবলম্বন করাতে ন্যায়বিচার হয় নাই। ফলে নীলকরদের পীড়ন অবাধে চলিতে থাকে। ‘নীল-দর্পণ’ এই পীড়নেরই নিখুঁত চিত্র।
সুকুমার মিত্র উল্লেখ করেছেন যে, শুরু থেকেই নীলকরেরা চাষিদেরকে উৎপীড়ন করতেন এবং ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দের এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এই অত্যাচারের কিছু বিবরণও প্রকাশিত হয়েছিল। এ সত্ত্বেও রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো বাঙালি সমাজনেতারা নীলকরদেরকে সমর্থন করেছিলেন এই বলে যে, দেশীয় জমিদারদের তুলনায় তাঁদের এলাকায় রায়তেরা সুখে আছে। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের সনদে এদেশে ইউরোপীয়দের ভূম্যধিকার স্বীকৃত হয়। এতে নীলকরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চলে।
নীলকরদের সঙ্গে প্রজাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বোধ করি সর্বপ্রথম দেখা দেয় চব্বিশ পরগণায়, ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে। তিতুমীরের নেতৃত্বে সেখানকার রায়তেরা জমিদারদের সঙ্গে যে-সংগ্রামে লিপ্ত হন, তা নীলকরদের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয়। একটি নীলকুঠি আক্রমণ করে তার তত্ত্বাবধায়ককে তাঁরা বন্দী করে নিয়ে যান। অনতিবিলম্বে হাজী শরীয়তউল্লাহ ও তাঁর পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গে যে-ফারায়জী আন্দোলন দেখা দিয়েছিল, তাও নীলকরদের সঙ্গে অনিবার্য দ্বন্দ্বের পথ নিয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে অনেক নীলকর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ ক্ষমতা লাভ করেন; ফলে তাঁদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়াতেই সম্ভবত ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা দেশে দেখা দিয়েছিল ব্যাপক নীল বিদ্রোহ। শুধু যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার ষোলকূপা গ্রামেই ছ হাজার মুসলমান চাষির সঙ্গে নীলকরদের ভাড়াটে লাঠিয়ালদের প্রবল সংগ্রাম হয়েছিল। এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে নীলকরেরা করেন অবর্ণনীয় অত্যাচার। শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটরাও তাঁদের পক্ষ নিয়ে নিপীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি করেছিলেন। এই সময়ে সরকার ইন্ডিগো কমিশন নিযুক্ত করেন এবং তাঁদের সুপারিশের ফলে চাষিদের কিছু সুরাহা হয়।
নীলকরের অত্যাচারবিষয়ক প্রথম রচনা ‘বাপরে বাপ! নীলকরের কি অত্যাচার!’ ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। হিন্দু পেট্রিয়ট প্রেস থেকে প্রকাশিত ষোলো পৃষ্ঠার এই গদ্য-পদ্য সংলাপময় রচনায় গ্রন্থকারের নাম ছিল না। সুকুমার সেন নিঃসংশয়ে বলেছেন যে, নীলদর্পণ রচনার আগে দীনবন্ধু এ-রচনাটি পড়েছিলেন।
নীলদর্পণে যেসব প্রকৃত ঘটনার ছায়াপাত ঘটেছে, সুকুমার মিত্র তার পরিচয় সংকলন করেছেন। নদিয়ার অন্তর্গত গুয়াতেলির মিত্র পরিবারের দুর্দশা উপাখ্যানটির ভিত্তিভূমি। যে-নীলকুঠির সাহেবদের অত্যাচার এখানে চিত্রিত হয়েছে, আসলে তা মোল্লাহাটির নীলকুঠি : বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানির কনসার্ন। মেহেরপুরের নীলকর জেমস্ হিলের কর্মচারী মহেশ মুখোপাধ্যায় নাটকে গোপীনাথ দেওয়ানে পরিণত হয়েছেন। ক্ষেত্রমণির দুর্দশাচিত্রের মূলে আছে কৃষ্ণনগরের কৃষক-কন্যা হারামণির বৃত্তান্ত; কুলছিকাটা নীলকুঠির ছোট সাহেব আর্চিবল হিল্স হারামণিকে হরণ করে নিয়ে যান। যাকে নাটকে অমরনগরের দয়ালু ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়েছে, বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন ডব্লিউ.জে. হার্শেল—খ্যাতনামা জ্যোতির্বিদ হার্শেলের পৌত্র।
বঙ্কিমচন্দ্র নীলদর্পণকে অভিহিত করেছিলেন বাংলার Uncle Tom’s Cabin বলে। নীলচাষিদের দাসত্বমোচনে এ-নাটকের সক্রিয় ভূমিকার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ‘গ্রন্থকারের অভিজ্ঞতা এবং সহানুভূতি পূর্ণমাত্রায় যোগ দিয়াছিল বলিয়া নীলদর্পণ তাঁহার প্রণীত সকল নাটক অপেক্ষা শক্তিশালী।’
আধুনিক বিচারে নীলদর্পণ হয়তো এতটা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে না। এ-নাটকে কারুণ্য আছে, পতন ও মৃত্যু আছে, কিন্তু ট্র্যাজেডির মূলে যে সূক্ষ্ম ভাবকল্পনা ও গভীরতা থাকে, এখানে তা নেই। মোহিতলাল যথার্থই বলেছেন : ‘নীলদর্পণে’র ঘটনাবস্তু (action) melodrama–য় অবসিত হইয়াছে, মাত্রাতিরিক্ত emotion-এর উপর বিশেষ জোর দেওয়ার প্রয়োজনে লেখকের কল্পনা সংযম হারাইয়াছে; তা’ ছাড়া লেখক এখানে স্বল্পবস্তু সম্বল লইয়া, সাধারণ চরিত্র অবলম্বনে নাটকখানিকে ট্রাজেডির ছাঁচে ঢালিতে গিয়া বিফলমনোরথ হইয়াছেন।’
এ-সত্ত্বেও পল্লিজীবনের নিখুঁত ও করুণ চিত্রাঙ্কনে, বাস্তব-অনুভূতি ও সমবেদনার প্রকাশে এই নাটক মূল্যবান। ‘গ্রাম্য-ভূমিকাগুলির মধ্যে মানবজীবনের যে অনাবৃত খণ্ডিত রূপটুকুর চকিত দর্শন পাই,’ তাতে চিরন্তন জীবনসত্যের অকৃত্রিম প্রতিফলন ঘটেছে। এদিক দিয়ে এর একটা স্থায়ী সাহিত্যিক মূল্য আছে। দ্বিতীয়াঙ্ক প্রথম গর্ভাঙ্কে তোরাপ ও রাইয়তদের কথাবার্তা এবং তৃতীয়াঙ্ক তৃতীয় গর্ভাঙ্কে ক্ষেত্রমণির উপর পাশবিক অত্যাচারদৃশ্যের যে-সমালোচনা মোহিতলাল করেছেন, তাতেও নীলদর্পণের নাটকীয় সার্থকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর মতে, শেষোক্ত দৃশ্যে নাটকের অগ্নিপরীক্ষা ঘটেছে এবং সে পরীক্ষায় দীনবন্ধু অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
তোরাপ চরিত্রের মূলে মধুসূদনের বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনের (১৮৬০) হানিফ চরিত্রের প্রভাবের কথা কেউ কেউ বলেছেন। কথাটা ভেবে দেখবার যোগ্য।
নীলদর্পণে ব্যবহৃত কিছু দুর্বোধ্য শব্দের অর্থ এখানে অকারাদিক্রমে নির্দেশ করা গেল।
অক্ত—রক্ত।
অনতেরা—অন্ত, হদিস, তথ্য।
অবধান—মনোযোগ; এখানে প্রণাম।
অমাবস্যা—আমাশয়।
অরপুরুব—অপরূপ।
আইবুড়ো ভাত—গায়ে হলুদের পর এবং বিয়ের আগে কুমার-কুমারী অবস্থায় বরকনের শেষ ভাত খাওয়ার সংস্কার।
আজাদের—রাজাদের।
আদাখ্যাচড়া—এলোমেলো; অর্ধসম্পূর্ণ।
আসধান—আউস ধান।
আষ্ট—রাষ্ট্র।
অ্যাকন—এখন।
ইক্সুল—আইননির্দিষ্ট ধারামতে আটক।
এগোনের—পূর্বেকার।
এমান—ইমান।
এড়ো—আড়াআড়ি বি¯তৃত।
কস্বি—বেশ্যা।
কান্সারন—কন্সার্ন।
কামরাঙ্গা—কামরা।
কারকিত, কারকিতী, কারকীত—চাষকর্ম।
কুড়ো—বিঘা।
কোমেট্—কমিটি।
গত্তে—কত্তে, নীল করতে।
গল্লা—এক আঁটি [ধান], এক গোছা।
গস্তানি—কুলটা।
গাঁটি—গাঁটে, ট্যাঁকে।
গাঁতা—মিলিত কৃষিকর্ম।
গাঁতি—জমিদারের অধীন জমাজমি, যুক্ত ভূসম্পত্তি।
গারনাল—গভর্নর।
গোঁট বেঁদে—দল বেঁধে।
গোডা, গুওটা—গু-খেকোর ব্যাটা।
গৌণ—গাউন।
ঘোঁটা মাত্তি—তোলপাড় করতে।
ষোল বলাইয়েছে—জব্দ করেছে।
চাবালি—চোয়াল।
চুনুরি—চুমকি দেওয়া।
ছাবাল—সন্তান।
ছুট্—চুল বাঁধবার দড়ি।
জামা—জামাই।
জোরার—যমের।
ঝক্কোতে—ঝটিতি, শীঘ্র।
ঝম্কে—চম্কে।
ঝরকা—ঝরোকা, জানলা।
ঝাপটা—চুলে পাতা-কাটা; মাথার অলঙ্কারবিশেষ।
ঝোজানি—ঝুজিয়ে।
টিকিরি—ঠিকা মজুর।
ডবকা—উঠতি বয়সের।
ডেডলি কমিসন—নীলকরদের পক্ষে মারাত্মক ইন্ডিগো কমিশন।
তবাদি—পর্যন্ত।
তাইনে—হারে, প্রত্যেকে।
তেতো—তপ্ত।
তেরোনাল—তরবারধারী।
দই—দোহাই।
দাসদিগিতি—দাসদীঘিতে।
দ্বটি, দ্বটো—দুটি, দুটো।
নচা—রচা।
নটতো—রটতো।
নড়–ই—লড়াই।
নাকে—রাখে।
নাজি—রাজি।
নাঙ্গা পাকড়ি—লাল (রাঙা) পাগড়ি; পুলিশ।
নাতি—রাতি; রাত্রি।
নাদনা—দুষ্ট।
নাড়—রাঁড়; বিধবা।
নিচু—ছোট, নেহাৎ।
নেটেলা—লেঠেল; লাঠিয়াল।
নেয়েত—রায়ত।
নোনা ফেনা—নোনা জল লেগে নষ্ট অনুর্বর জমি।
ন্যাকাৎ—মতন।
পত্তি—প্রতি।
পত্তিবাসী—প্রতিবেশী।
পিল্—আপীল।
পুট্ঠাকুর—পুরুতঠাকুর।
পেটপোড়া খেব্য়েচে—সন্তাননিরোধ করবার ওষুধ খাইয়েছে।
পোঁচা—করতল।
ফ্যাবা—চীৎকার।
বটনেকা—বৈঠ্নেকা; বসবার।
বাউ—বাউটি।
বাউরা—পাগল।
বার—সময়।
বিদে কাটি—ক্ষেতে অতিরিক্ত ঘাস হলে যে অস্ত্র দিয়ে ঘাস উপড়ানো হয়।
বুনো—বুনো-জাতীয় কুলি-সম্প্রদায়।
বেওরাওয়ারি—জোর করে।
বেছাপ্পর—আশ্রয়হীন।
বেপালটে—বিপদে।
বেল—বেলা।
ব্যাম্রম—বাড়াবাড়ি; অত্যাচার।
ভাবরা—খাপরা।
ভেমো—বোকা।
ভোগোল—ওঝা, মন্ত্রব্যবসায়ী, চতুর।
ভ্যালা—কাপড়ে চিহ্ন দেবার রং।
মজুকুর—মজকুর; উল্লিখিত, বর্ণিত।
মাইন্দার—মাহিনাদার; চাকর।
মাচেরটক্—ম্যাজিস্ট্রেট।
মাদ্দা—মকদ্দমা।
মান্নি—মারানী।
মার্গ—মার্ক; দাগ।
মোজা—মৌজা।
ম্যাদ—মেয়াদ।
মৃত্যু—যম।
রামকান্ত—লার্মার নামে এক নীলকর-উদ্ভাবিত চাবুক।
রোকা—পত্র।
র্যাংরাজ—ইংরাজ।
লৌ—লহু; রক্ত।
শ্যামচাঁদ—চর্মনির্মিত চাবুক। এটাও লার্মারের উদ্ভাবন বলে পরিচিত ছিল।
সমে—সময়ে।
সাঁক্তি—শাঁক।
সাতান—সাতোয়ান; যে যথানিয়মে খাজনা দিতে সমর্থ।
সারাক্ষুণ্ডি—সারাক্ষণটি।
সাড়ে সইয়ে—সাড়ে সওয়া; সওয়া ও তার অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ।
সেদের—সাধুর।
সেবের—সাহেবের।
সেমন্তোনের—সীমন্তোন্নয়ন; দশ সংস্কারের অন্যতম।
সেঁসয়ে—শাসিয়ে।
সোদা—সিধে।
সোমোজ কত্তি—সমঝাতে; বুঝতে।
হদ্দ—সীমা, বড়জোর।
হাতের ন ক্ষয় যাক—হাতের লোহা হাতেই ক্ষয় হোক।
র্হি ভীতি—দুষ্টামি।
হিল্লে—উপায়; এখানে আশ্রয়।
হের—এর।
হ্যাংনামা—হাঙ্গামা।
হ্যাল মেরেছে—হ্যালো বলেছে।
নবীন তপস্বিনী
নবীন তপস্বিনী স্বনামে প্রকাশিত দীনবন্ধুর প্রথম নাটক। এতে দুটি কাহিনি শ্লথভাবে সংযুক্ত হয়েছে। বিজয়-কামিনী উপাখ্যান রূপকথা ও সত্য ঘটনার মিশ্রণ। জলধর-মালতীর প্রহসনমূলক বৃত্তান্ত শেকসপিয়রের Merry Wives of Windsor থেকে গৃহীত। হোঁদল কুৎকুতের ব্যাপার অবশ্য দীনবন্ধুর নিজস্ব সংযোজন। বস্তুতপক্ষে নাট্যপ্রতিভার অনুকূল হওয়ায় জলধর-উপাখ্যানই নাটকটিকে হাস্যরসের চমৎকারিত্ব দান করেছে। মনে রাখতে হবে যে, শেকসপিয়রের উল্লিখিত নাটকেও দুটি সমান্তরাল কাহিনি সামান্যসূত্রে গ্রথিত হয়েছে এবং সেখানে ফলস্টাফের কাহিনিই প্রধান আকর্ষণ।
সুকুমার সেন বলেছেন, ‘প্রহসন-অংশের ভাষা কথ্য এবং লঘু, কিন্তু অপর অংশের ভাষা—বিশেষ করিয়া পুরুষের উক্তি—নিতান্ত আড়ষ্ট ও কৃত্রিম। তাহার উপর মধ্যে মধ্যে মিত্রাক্ষর ও অমিত্রাক্ষর পয়ার থাকায় বিসদৃশতা বাড়িয়া গিয়াছে।’
বিয়ে পাগলা বুড়ো
বিয়ে পাগলা বুড়ো দীনবন্ধুর প্রথম প্রহসন। এর মূলে প্রকৃত ঘটনা ছিল; মধুসূদনের বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁর (১৮৬০) প্রেরণা থাকাও সম্ভব।
দীনবন্ধুর চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য এ-প্রহসনে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দীর্ঘ পদ্যের কথা বাদ দিলে এর ভাষাও স্বাভাবিক। এ-নাটকের প্রসঙ্গে মোহিতলাল মন্তব্য করেছেন :
বিয়ে পাগলা বুড়ো যখন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বিবাদ করিয়া, যুবা সাজিয়া নকল শালী-শালাদের কান-মলা সহ্য করিবার প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও শেষে কাঁদিয়া ফেলে, এবং ‘মলাম, গিচি, মেরে ফেলে,—ও রামমণি!’ বলিয়া তাহার বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র পালয়িত্রী ও রক্ষয়িত্রী বর্ষীয়সী বিধবা কন্যার নাম ধরিয়া চীৎকার করিয়া উঠে, তখন এই কৌতুকাভিনয়ের মধ্যেই মুহূর্তের জন্য মানুষের করুণতম অদৃষ্টই হাসিয়া উঠে। নিজ বার্দ্ধক্য অস্বীকার করিয়া যে-বৃদ্ধ বিগত-যৌবনের অভিনয় করিতেছে, সে যে কিছুতেই জরাকে ফাঁকি দিতে পারিতেছে না, নিমেষের মোহও টিঁকিতেছে না—সে যে সত্যই শিশুর মত অসহায়, এবং একটুকুতেই আকুল হইয়া মাতৃস্থানীয়া রামমণিকে তাহার স্মরণ করিতে হয়,—নিয়তির সহিত কঠিন সংগ্রামে বিমূঢ় মানবের এই অবস্থা যেমন হাস্যোদ্দীপক, তেমনই শোকাবহ। কিন্তু এই রীতিমত প্রহসনের দৃশ্যেও যে-কল্পনা রাজীবলোচনের মুখে ওই ‘ও রামমণি!’ বলাইয়াছে, তাহার কি নাম দিব ? প্রহসনের মধ্যেও এইরূপ হাস্যরসের দৃষ্টান্ত কি আর কোথাও মিলিবে ? দীনবন্ধুর প্রতিভার এই অনন্যসাধারণতা যে উপলব্ধি না করিল, বাংলা সাহিত্যের একটি নির্দিষ্ট রসাস্বাদ হইতে সে বঞ্চিত হইয়া আছে।
সধবার একাদশী
সধবার একাদশী দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ নাট্যরচনা। যদিও সাধারণত একে প্রহসন বলে উল্লেখ করা হয়, দীনবন্ধু একে নাটক বলে বিজ্ঞাপিত করেছিলেন। সধবার একাদশী কমেডি; সেই জাতীয় কমেডি যা ট্র্যাজেডির প্রান্তদেশবর্তী। সধবার একাদশীর এই বিশেষ গুণের মূলে আছে নিমচাঁদ-চরিত্রাঙ্কনে দীনবন্ধুর অসামান্য দক্ষতা।
এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন :
সধবার একাদশীর যেমন অসাধারণ গুণ আছে, তেমনি অনেক অসাধারণ দোষও আছে। এই প্রহসন বিশুদ্ধ রুচির অনুমোদিত নহে, এই জন্য আমি দীনবন্ধুকে বিশেষ অনুরোধ করিয়াছিলাম যে, ইহার বিশেষ পরিবর্ত্তন ব্যতীত প্রচার না হয়। কিছু দিন মাত্র এ অনুরোধ রক্ষা হইয়াছিল। অনেকে বলিবেন, এই অনুরোধ রক্ষা হয় নাই ভালই হইয়াছে, আমরা ‘নিমচাঁদ’কে দেখিতে পাইয়াছি। অনেকে ইহার বিপরীত বলিবেন।
বস্তুত নিমচাঁদ-চরিত্র দীনবন্ধুর নাট্যপ্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। নিমচাঁদ মদ্যপ; তার চরিত্র বিশুদ্ধ নয়; তার ভাষায় ও ভঙ্গিতেও সর্বত্র সুরুচি প্রকাশ পায় না। কিন্তু এটাই নিমচাঁদের একমাত্র পরিচয় নয়। সে কৃতবিদ্য; সাহিত্যের জগতে তার বাস; অধোগতি সত্ত্বেও মনুষ্যত্ববোধ সে বিসর্জন দেয়নি। ধনীর দুলাল ও নিত্যকার জীবনযাত্রার প্রতি তার অবজ্ঞা অপরিসীম; নিজের বিদ্যাবুদ্ধিগত স্বাতন্ত্র্যে যেখানে সে উজ্জ্বল—সেখানে সে আত্মবিশ্বাসী ও প্রবল। আশানুরূপ সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং পারিবারিক সুখশান্তি তার ভাগ্যে ঘটেনি। তাই মদ্যাসক্তি ও প্রলাপোক্তির মাধ্যমে সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধেই সে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমন একটি মহৎ চরিত্রের এই পরিণতি আর সকল ভাবকে আচ্ছন্ন করে আমাদের মনে দুঃখবোধ জাগায়। সহৃদয়ের চিত্তে এই সহানুভূতি উদ্রেক করার সামর্থ্যই দীনবন্ধুর নাট্যপ্রতিভার উজ্জ্বলতম স্বাক্ষর।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সংগতভাবেই লক্ষ করেছেন যে, নিমচাঁদ
একটা ব্যক্তিবিশেষ মাত্র নয়, একটা সমগ্র যুগের শীল-বৈশিষ্ট্য, একটি বৃহৎ শ্রেণির প্রতিনিধিত্বের সুদূর-প্রসারী তাৎপর্য তাহার মধ্যে সংহত হইয়াছে। তাহার অবয়বের মধ্যে এমন একটি আয়তনবিপুলতা আছে যে কেবল তাহার সম্মুখভাগ দেখিয়া আমরা তৃপ্ত হই না, তাহাকে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া চারিদিক হইতে দেখিবার ইচ্ছা হয়। নাট্যকার তাহার জীবনের যেটুকু আঁকিয়াছেন, তাহার পিছনে যে অতীত ইতিহাস ক্রিয়াশীল, তাহার মদোন্মত্ত বিকৃতির অন্তরালে যে উজ্জ্বল, ভাস্বর সম্ভাবনা চিরতরে অস্তমিত হইয়াছে, অন্তঃরুদ্ধ যে বহ্নি-সঞ্চয় হইতে তাহার শ্লেষের মর্মভেদী তীক্ষ্ণতা, অনুশোচনার ক্ষুব্ধ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ চারিদিকে অসহ্য উত্তাপ ও দাহ বিকীর্ণ করিয়াছে, তাহার জীবনের সেই অলিখিত অধ্যায়টি কল্পনা-সাহায্যে আমরা পুনরুদ্ধার করিতে চাহি। উচ্চতম শিক্ষা ও রসবোধের সহিত চরিত্রের ঘৃণিত অবনতি, আত্মমর্যাদার প্রায় সম্পূর্ণ বিলোপের সমন্বয় কেমন করিয়া সম্ভব হইল তাহা বুঝিতে হইলে শুধু মদ্যাসক্তিই পর্যাপ্ত কারণ নহে। তাহার মনস্বিতা ও সমাজে তাহার যথাযোগ্য সমাদরের মধ্যে যে উৎকট অসামঞ্জস্য, সমাজের ন্যায়-বিচারের বিরুদ্ধে তাহার যে নিগূঢ় অভিমান, উপেক্ষিত প্রতিভার আত্মধিক্কার তাহার মনে যে অর্ধ-পরিণত মানসবিকৃতিকে বীজরূপে অঙ্কুরিত করিয়াছিল তাহাই অবিরত সুরানিষেকে, মোসাহেবির মৃত্তিকারসে পরিপুষ্ট হইয়া বৃহৎ মহীরুহে পরিণত হইয়াছে। সাহিত্যের অমৃত ও সুরার হলাহল তাহার অভিমান-বিকৃত, অসংযত-ভোগপ্রবণ চিত্তে যে অপরিমিত বাষ্পস্ফীতির সৃষ্টি করিয়াছে তাহারই আবরণের ভিতর দিয়া তাহার প্রকৃতিটি অতিকায় দৈত্যের মত আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে অভ্রভেদী বন্ধুর মহিমায় দাঁড়াইয়াছে।… তাহার রসিকতার মধ্যে যে কটুত্বের ঝাঁঝ, যে আক্রমণাত্মক মনোবৃত্তির পরিচয় মিলে তাহা সমাজের অবিচারজনিত। তাহার সমস্ত দুষ্ক্রিয়াসক্তির মধ্যে মহত্ত্বের ধ্বংসাবশেষ অনুশোচনার জ্বালাময়ী স্মৃতি ও অটলের পারিবারিক শ্লীলতাহানির প্রস্তাবের প্রতিবাদে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। ঘটিরামের নিকট নিজ মানস আভিজাত্যের শ্রেষ্ঠত্ব-ঘোষণায় অপমানক্ষত হৃদয়ে আত্মশ্লাঘার প্রলেপ লাগানোর একটা ব্যর্থ-করুণ প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।… এ [নাটকে] অশ্লীলতার উদ্ভব বিকৃত রুচির জন্য নহে, যথাযথ চরিত্রাঙ্কনের অনিবার্য প্রয়োজনে।
বলা বাহুল্য, এই নাটকে দীনবন্ধুর হাস্যরসিকতা fun ও humour অতিক্রম করে wit বা বাগবৈদগ্ধ্যে পরিণতি লাভ করেছে। এ-নাটকের পাত্র-পাত্রীর সন্ধান দীনবন্ধুর বাস্তবজীবনে পেয়েছিলেন; কিন্তু এই উচ্চাঙ্গের হাস্য-রসসৃষ্টির ক্ষমতা—যা এক পর্যায়ে করুণের সঙ্গে মিশে গেছে—তা তাঁর নিজস্ব।
সধবার একাদশীর সংলাপে ইতস্তত বহু ইংরেজি উদ্ধৃতি ছড়িয়ে আছে। এখানে যথাসম্ভব তার মূল নির্দেশিত হলো। প্রথমে অঙ্ক ও গর্ভাঙ্কের উল্লেখ, তারপর উদ্ধৃতির দু-একটি শব্দ এবং শেষে মূল উৎসের পরিচয় দেওয়া গেল।
১.১ : “The mind…” Paradise Lost, Bk. I, ll 139-40.
১.১ : “To be weak…”এ , ll 157-158.
১.১ : “Rich…” : Dryden, Alexander’s Feast, ll 58-60.
১.১ : “If consequence…” Othello, Act II, Sc. iii, ll 58-59. [Iago-র উক্তি]
২.২ : “Man being…” Byron, Don Juan, Canto. ll, clxxix.
২.২ : “A Daniel…” Merchant of Venice, Act IV, Sc.i. ll 218-19. [Shylock-এর উক্তি]
২.২ : “Little learning…” Pope, An Essay on Criticism, ll 215-16.
২.২ : “A fool might…” ঐ, ll 7-8.
২.২ : “The undiscovered…” Hamlet, Act III, Sc. i, ll 79-80. [Hamlet-এর উক্তি]
২.২ : “This is my…” Othello, Act II, Sc. iii, l 106. [Cassio-র উক্তি]
২.২ : “The thirsty earth…” Abraham Cowley, “Drinking”.
২.২ : “Canst thou…” Macbeth, Act V, Sc. iii, ll 40-43. [Macbeth-এর উক্তি]
২.২ : “Therein…” H, ll 45-46. [Doctor-এর উক্তি]
২.২ : “You are…” Othello, Act I, Sc. i. l 109. [Iago-র উক্তি]
২.২ : “Let such…” Pope, An Essay on Criticism, ll 15-16.
২.২ : “Egregious ass”. Zzjbxq Othello, Act, II, Sc. i., l 303. [Iago-র উক্তি]
২.২ : “Into what…” Paradise Lost, Bk. I, l 91-92.
২.২ : “Macbeth…” Macbeth, Act IV, Sc, i, ll 71. [First Apparition-এর উক্তি]
২.৩ : “It is the east…” Romeo and Juliet, Act II, Sc. ii, ll 3-4.
[Romeo-র উক্তি; ‘moon’-এর বদলে নিমচাঁদ ‘দরওয়ান’ ব্যবহার করেছে।]
২.৩ : “Nacky, Nacky…” Otway, Venice Preserved, Act III, Sc. i, ll 14-19. [Antonio-র উক্তি]
২.৩ : “One more…” Othello, Act V, Sc. i. l 19. [Othello উক্তি : “One more and that’s the last.”]
২.৩ : “So sweet…” H, Act V, Sc. i, ll. 20-21. [Othello-র উক্তি]
২.৩ : “This is…” King Henry VIII, Act III, Sc. ii, ll 352-53. [Wolsey-র উক্তি]
২.৩ :“The tyrant…” Othello, Act I, Sc. iii, ll 229-31. [Othello-র উক্তি]
২.৩ : “It the Mountain…” Bacon, Essays, “Of Boldness”.
২.৩ “Come Sleep…” : Sidney, Astrophel & Stella, xxxix.
২.৩ : “Ay, past…” : Othello, Act. II, Sc. iii, l 252. [Cassio-র উক্তি]
২.৩ : “O Heavens…” : Merchant of Venice, Act iI, Sc. i, l 30. [Launcelot-র উক্তি]
২.৩ : “Hail! holy light!…” Paradise Lost, Bk, III, ll 1-3.
২.৩ : “Thou canst…” Macbeth, Act III, Sc. iv, ll 50-51 [Macbeth-এর উক্তি]
২.৩ : “Man but…” Othello, Act V, Sc. ii, ll 273-74. [Othello-র উক্তি]
২.৩ : “Drown cats…” H, Act I, Sc. iii, l 335 [Iago-র উক্তি]
৩.১ : “Superstitious…” Bacon, Essays, “Of Superstition” : “There is a superstition in avoiding superstition.””
৩.২ : “Their best…” Othello, Act III, Sc. iii, ll 207-8. [Iago-র উক্তি]
৩.২ : “I dare do…” Macbeth, Act I, Sc. vii, ll 46-47. [Macbeth–এর উক্তি]
৩.৩ : “Bloody…” Hamlet, Act II, Sc. ii, ll 575-576. [Hamlet-এর উক্তি]
৩.৩ : Once-Twice…” তুলনীয় “Out damned spot! Out I say. One, two!”— Macbeth, Act V, Sc. i, l 33. [Lady Macbeth-এর উক্তি]
৩.৩ : “As tedious…” King John, Act III, Sc. iv, l 108. [Lewis-এর উক্তি; মূলেLife is as tedious ইত্যাদি]
৩.৩ : “I look down…” Othello, Act V, Sc. ii, ll 289-90 [Othello-এর উক্তি]
৩.৩ : “To mourn…” Othello, Act I. Sc. iii, ll 204-05. [Duke-এর উক্তি]
৩.৩ : “If thou beest…” Paradise Lost, BK I, ll 84-87.
৩.৩ : “Now misery…” H, BK. I, ll 90-91.
৩.৩ : “Ease would…” H, BK. IV, ll 95-97.
৩.৩ : “The dear…” H, BK. II, ll 818-21.
লীলাবতী
বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, দীনবন্ধুর অন্যান্য নাটকের তুলনায় লীলাবতী ত্রুটিমুক্ত। লীলাবতীর প্রণয়ের দৃশ্য এবং মূল আখ্যানের জটিল গ্রন্থি বাস্তবসম্পর্কহীন হলেও এই নাটকে সুখদুঃখময় সমকালীন পারিবারিক জীবনের যে-চিত্র আছে, তা মূল্যহীন নয়। লীলাবতীর কাহিনি দুটি ধারায় প্রবাহিত। একদিকে লীলাবতীর প্রণয় এবং অন্যত্র বিবাহের সম্ভাবনা; অন্যদিকে অরবিন্দের নিরুদ্দেশ যাত্রা ও পুনরাগমন। ধনী ব্যক্তির পুত্রের নিরুদ্দেশ ও নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের প্রত্যাবর্তন লীলাবতীর আগে নবীন তপস্বিনীতে দেখা গেছে। জামাই-বারিকের সমস্যামোচনে সাহায্য করেছে অভয়ের নিরুদ্দেশ হওয়া। কমলে কামিনীতেও একই ব্যাপার ঘটেছে।
হেমচাঁদ, নদেরচাঁদ ও শ্রীনাথের ভূমিকা প্রাণবন্ত। এদের সংলাপের মাধ্যমেই কৌতুকরস পরিবেশিত হয়েছে। এই কৌতুকরসের অভাব ঘটলে লীলাবতীর নাটকীয় সার্থকতা একেবারেই কমে যেত।
লীলাবতীর দুর্বলতা অন্যান্য চরিত্রের আড়ষ্টতায়, দীর্ঘ পদ্য-সংলাপের কৃত্রিমতায়, উপস্থাপিত জটিলতার অবাস্তব সমাধানে এবং নীতিকথা-প্রচার-প্রবণতায়।
জামাই বারিক
নবীন-তপস্বিনী ও লীলাবতী এবং পরবর্তী কমলে-কামিনী’র মতো জামাই বারিকেও দুটি কাহিনির সংযোগ ঘটেছে। এর প্রধান আখ্যান অভয়কুমার-কামিনীকে নিয়ে রচিত; অপ্রধান কাহিনি পদ্মলোচন আর তার দুই স্ত্রীর। অভয়কুমারের আখ্যানে কলকাতার কোনো সন্ত্রান্ত পরিবারে ঘরজামাই রাখার ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষপাত আছে। প্রহসনের নামকরণও ঘটেছে এই সূত্রে। ‘বারিক’ শব্দটি ইংরেজি ‘ব্যারাক’ শব্দের বাংলা রূপান্তর; অভয়কুমারের শ্বশুরবাড়িতে জামাইদেরকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যারাকে স্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে অপেক্ষা করতে হতো।
সুকুমার সেন বলেছেন যে, অভয়কুমারের খোঁজে কামিনীর বৃন্দাবনগমন ইত্যাদি ঘটনায় কামিনীকুমার কাব্যের প্রভাব আছে।
অতিরঞ্জন সত্ত্বেও পদ্মলোচনের বৃত্তান্ত উপভোগ্য। চরিত্রসৃষ্টির নৈপুণ্য মোটামুটি সর্বত্রই লক্ষ করা যাবে। ভাষা-ব্যাপারে দীনবন্ধু এখানে দ্বিধামুক্ত হননি।
দীনবন্ধুর জীবদ্দশায় জামাই-বারিকের আর কোনো সংস্করণ হয়নি।
কমলে কামিনী নাটক
কমলে কামিনী নাটক দীনবন্ধুর সর্বশেষ রচনা—তাঁর মৃত্যুর স্বল্পকাল পূর্বে প্রকাশিত। নাটকটিতে তিনি ঐতিহাসিক রোমান্সের স্বাদ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বলতে এতে আছে শুধু কাছাড়ের ইতিবৃত্ত থেকে নেওয়া কয়েকটি চরিত্রের নাম। নবীন তপস্বিনীর সঙ্গে কমলে কামিনীর কাহিনিগত সাদৃশ্য আছে। সুকুমার সেন বলেছেন : ‘কমলে-কামিনীর ভূমিকাগুলি অতি রোমাণ্টিক হইয়াছে, নাটকীয় হয় নাই। শুধু মণিপুর-রাজকুমার মকরকেতনই স্বাভাবিক ভূমিকা। বক্কেশ্বরে পদ্মাবতী-নাটকের বিদূষকের প্রভাব আছে।’
‘এই নাটকের গুরুতর গাম্ভীর্য্যটুকু হাস্য-পরিহাসের তরল ধারায় লঘু ও স্নিগ্ধ হইয়াছে।’—এই মন্তব্য করে সুশীলকুমার দে লিখেছেন :
কমলে কামিনীর উপাখ্যান ভাবপ্রধান, কিন্তু ইহাকে বাস্তব-জগতের পরিসরের মধ্যে রাখিয়াছে ইহার নিরবচ্ছিন্ন হাস্যপরিহাসের উজ্জ্বলতা। এই রোমান্টিক ধরনের রচনাগুলি নাটক হিসাবে সম্পূর্ণ সার্থক হয় নাই, কিন্তু রোমান্স বাদ দিয়া বস্তুজগতের দুর্ব্বলতা ও নির্ব্বুদ্ধিতা যেখানে দীনবন্ধুর রসবুদ্ধিকে জাগ্রত করিয়াছে, সেইখানেই দেখিতে পাওয়া যায় প্রকৃত হাস্যরসিকের অনন্যসাধারণ প্রতিভার স্ফূর্তি।
গ্রন্থপঞ্জি
অজিত দত্ত, বাংলা সাহিত্যে হাস্যরস (কলিকাতা : জিজ্ঞাসা, ১৯৬০)।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম-রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড (কলিকাতা : সাহিত্য সংসদ, ১৩৬১), ‘রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী ও গ্রন্থাবলীর সমালোচনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ।
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র (‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’র ১৯ সংখ্যক পুস্তক; পঞ্চম সংস্করণ; কলিকাতা : বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩৬২)।
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস (তৃতীয় সংস্করণ; কলিকাতা : বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩৫৩)।
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস-সম্পাদিত, দীনবন্ধু-গ্রন্থাবলী, দু খণ্ড (কলিকাতা : বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩৫১ ইত্যাদি)।
মোহিতলাল মজুমদার, আধুনিক বাংলা সাহিত্য (চতুর্থ সংস্করণ; কলিকাতা : জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যাণ্ড পাব্লিশার্স লিমিটেড, ১৩৬৩), ‘দীনবন্ধু’ শীর্ষক প্রবন্ধ।
শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (নতুন সংস্করণ; কলিকাতা : নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড, ১৩৬২)।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রফুল্লচন্দ্র পাল-সম্পাদিত, সমালোচনা সাহিত্য (দ্বিতীয় সংস্করণ; কলিকাতা : এ. মুখার্জী অ্যাণ্ড কোং লিঃ, ১৩৬২), শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়-লিখিত ‘গ্রন্থ-পরিচিতি’ এবং ক্ষেত্রনাথ ভট্টাচার্য-রচিত ‘সধবার একাদশী’ প্রবন্ধ।
সুকুমার মিত্র, ঊনবিংশ শতকের বাঙলা সাহিত্যে বিদ্রোহের চিত্র (কলিকাতা : এভারেস্ট বুক হাউজ, ১৩৬৬)।
সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড (পঞ্চম সংস্করণ; কলিকাতা : ইস্টার্ণ পাবলিশার্স, ১৩৭০)।
সুশীলকুমার দে, দীনবন্ধু মিত্র (দ্বিতীয় সংস্করণ; কলিকাতা : এ. মুখার্জী অ্যাণ্ড কোং প্রাঃ লিঃ, ১৩৬৬)।
১৯৬৮
___
* বঙ্কিমচন্দ্র নির্দেশ করেছিলেন যে ১২৩৮ সালে দীনবন্ধুর জন্ম হয়। খ্রিষ্টাব্দের হিসেবে তা ১৮৩১ হয়। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন যে তাঁর জন্ম ১২৩৬ বা ১৮২৯ সালে। দীনবন্ধুর পুত্র ললিতচন্দ্র জানিয়েছেন যে, দীনবন্ধুর জন্ম হয় চৈত্র ১২৩৬-এ। এই তারিখই গ্রহণযোগ্য।