ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

বাংলা ব্যঙ্গরসমূলক রচনায় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্থান সমালোচকেরা ও সাহিত্যের ইতিহাসকারেরা এত উঁচুতে নির্দেশ করেছেন যে, কেউ কেউ তাঁকে এক্ষেত্রে অদ্বিতীয় বলতেও কুণ্ঠিত হননি। অথচ এখন তিনি প্রায় বিস্মৃত, তাঁর রচনাও দুর্লভ। এর কারণ এই নয় যে, তিনি পাঠযোগ্যতা হারিয়েছেন। এর কারণ, পূর্বগামী লেখকদের সম্পর্কে আমাদের একধরনের উদাসীনতা।

নিজের লেখার মতোই ত্রৈলোক্যনাথের জীবনকাহিনি কৌতূহলোদ্দীপক। দারিদ্রের সঙ্গে এত সংগ্রাম, এত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, পরিণামে এত প্রতিষ্ঠা ও সম্মান খুব কম মানুষের জীবনেই দেখা যায়। তাঁর জন্ম ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে (৬ শ্রাবণ ১২৫৪)। তাঁর পিতা দরিদ্র ব্রাহ্মণ বিশ্বম্ভর মুখোপাধ্যায়, বাস চব্বিশ পরগনা জেলার শ্যামনগরের কাছে রাহুতা গ্রামে। ত্রৈলোক্যনাথ জনক-জননীর দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর জ্যেষ্ঠ রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন কয়েকটি গদ্যপদ্য গ্রন্থের রচয়িতা।

গ্রামের স্কুলে ও পাঠশালায় ত্রৈলোক্যনাথের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। বারো বছর বয়সে তিনি হুগলি-চুঁচুড়ার ডফ সাহেবের স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে (এখনকার চতুর্থ শ্রেণিতে) ভর্তি হন এবং পরের বছর ডবল প্রমোশন পেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে উন্নীত হন। ১৮৬২ সালে ম্যালেরিয়ার প্রকোপে একে একে তাঁর পিতামহী, মাতা ও পিতার মৃত্যু হয়, তিনি নিজেও প্লীহাজ্বরে আক্রান্ত হন। তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, সেখানেই তাঁর আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে।

ত্রৈলোক্যনাথ শৈশবকালে যেমন দুরন্ত ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদ্ভাবনী প্রতিভার অধিকারী। ন বছর বয়সে নতুন এক ভাষাসৃষ্টিতে এবং তার উপযোগী বর্ণমালা উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হন। কাঠের ফলকে ও মাটির চাকতিতে এই বর্ণমালা খোদাই করে তিনি মুদ্রণের আয়োজন করেন। এই পদ্ধতিতে সেই অল্প বয়সেই তিনি হেঁয়ালি, শ্লোক ও গান রচনা করেছিলেন।

পিতামাতার মৃত্যুর পরে তিনি এক নিকটাত্মীয়ের আশ্রয়ে থাকেন, কিন্তু সেখানেও দারিদ্র প্রবল। ১৮৬৫ সালে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে মানভূমে এক আত্মীয়ের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যেখানে এসে তাঁর টাকাপয়সা ফুরিয়ে যায়, সেখান থেকে তাঁর গন্তব্য বনজঙ্গল-পর্বতময় এলাকা দিয়ে তিন দিনের হাঁটাপথ। তিনি হাঁটতে থাকলেন। পথে এক কুলি-সরবরাহকারীর পাল্লায় পড়েন। কুলির দল নিয়ে সে-ব্যক্তি যখন যাত্রা করেন, তখন পথের মধ্যে ত্রৈলোক্যনাথ পালিয়ে যান এবং কেবল বন্য কুল খেয়ে পদব্রজে মানভূমে পৌঁছোন।

তাঁর আত্মীয় তাঁকে স্কুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ঘটনাক্রমে সে-সময়ে স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রেরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রাঁচিতে মেলা দেখতে যায়। ত্রৈলোক্যনাথ তাঁদের সঙ্গ নেন। রাঁচি পাঁচ দিনের পথ। পথে তিনি এতরকম উৎপাত করতে থাকেন যে, দলের অভিভাবকেরা তাঁর ওপরে খুব বিরক্ত হন। রাঁচি পৌঁছে দল ছেড়ে একাই তিনি বনের পথে হাঁটতে থাকেন। পথে তস্করেরা তাঁর পরিধেয় বস্ত্র কেড়ে নেয়। তবু তিনি আবার রাঁচি হয়ে মানভূমে ফিরে আসতে সমর্থ হন। এখানে এক মৌলভির কাছে ভালো করে ফারসি শেখেন।

এরপর হঠাৎ করে তিনি স্বগ্রামে ফিরে আসেন। তারপর ইছাপুরে, যশোরের কোটচাঁদপুরে, বর্ধমানে, কাটোয়ায়, বীরভূমের কীর্ণাহারে, রামপুরহাটে হয় চাকরি করেন কিংবা চাকরির উমেদারিতে সকল সঞ্চয় ব্যয় করেন। যাত্রাপথে অপরিচিত গৃহস্থের অতিথি হয়ে থাকতেন। কিছুকাল পর তিনি বীরভূমের দ্বারকায় স্কুলশিক্ষক নিযুক্ত হন, সেখান থেকে রানীগঞ্জের উখড়া স্কুলে যান দ্বিতীয় শিক্ষক হয়ে। তখন তাঁর বেতন যৎসামান্য, কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে যথাসর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করতে তিনি পিছপা হননি। এ-সময়েই তিনি সংকল্প করেন যে, দেশে দুর্ভিক্ষনিবারণের কাজে আত্মনিয়োগ করবেন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পাবনার সাহজাদপুরে নিজের জমিদারিতে তাঁকে স্কুলশিক্ষক নিযুক্ত করেন, বেতন পঁচিশ টাকা। একবার ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁর প্রাণসংশয় হয়েছিল। অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে রক্ষা করে এক চণ্ডাল পরিবার। চৈতন্য ফিরে পেয়ে তিনি নিঃস্ব অবস্থায় পাবনায় ফিরে আসেন। সেখানে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। পাবনায় কর্মরত এক ইনজিনিয়ার তাঁকে কাপড়চোপড় কিনে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

এবারে কর্মের সন্ধানে কটক-যাত্রা—হেঁটে ও সাঁতরে। পথে নুন ও লঙ্কা দিয়ে চিঁড়ে খেয়ে কাটান। কটকে এসে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগলাভ করেন। এই পদে থাকতে তিনি নানা জায়গায় ভ্রমণ করেন, ওড়িয়া ভাষা শেখেন এবং ওড়িয়ায় একটি মাসিকপত্র সম্পাদন করেন। কটকে থাকতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে; কবি ও ডেপুটি কালেকটর রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখক ও সাব-জজ গঙ্গাচরণ সরকার, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা র্সা উইলিয়ম হান্টার। হান্টার কী-এক কাজে কটকে এসেছিলেন, সেখানেই পরিচয়; কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি নিজের অফিসে ত্রৈলোক্যনাথকে ১২৫ টাকার মাসিক বেতনে চাকরি দেন—সেটা ১৮৭০ সালের কথা। এই কাজে থাকতে তিনি Bengal District Gazetters, Statistical Account of Bengal Ges Bengal Manuscript Records সম্পাদনায় সাহায্য করেন। ১৮৭৫-এ হান্টার বিলেতে গেলে ত্রৈলোক্যনাথকেও সঙ্গে নিতে চান, কিন্তু নিকটজনদের আপত্তির ফলে তিনি সমুদ্রযাত্রা করতে পারেননি।

১৮৭৫ থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত ত্রৈলোক্যনাথ উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও অযোধ্যায় কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগে প্রথমে হেড ক্লার্ক, পরে হেড সুপারিনটেনডেন্ট এবং শেষে পরিচালক র্সা এডওয়ার্ড বকের ব্যক্তিগত সহকারীরূপে কাজ করেন। এখানে থাকতে তিনি স্থানীয় শিল্পবিস্তারে সাহায্য করেন। বড়ো হোটেলে ও রেলওয়ে স্টেশনে শিল্পদ্রব্য বিক্রি হওয়ার যে-ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাই, ত্রৈলোক্যনাথই তার প্রবর্তক। এখানেও দুর্ভিক্ষের সময়ে গাজরের উপকারিতা সম্পর্কে তিনি সরকারকে অবহিত করেন এবং সরকারি প্রয়াসে গাজরের চাষ উদ্বুদ্ধ করে বহু মানুষের প্রাণরক্ষা করা সম্ভবপর হয়।

ত্রৈলোক্যনাথের পরবর্তী কর্ম ভারত সরকারের রাজস্ব ও কৃষি বিভাগে— এখানেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে ক্রমশ পদোন্নতি লাভ করেন। ভারতের শিল্পদ্রব্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তিনি A Rough List of Indian Art Manufactures নামে একটি বর্ণনামূলক পুস্তিকা লিখে (১৮৮১-৮২) সকলকে চমৎকৃত করেন। অনেকে বলেন যে, ইউরোপ ও আমেরিকায় ভারতীয় শিল্পদ্রব্যের চাহিদাসৃষ্টিতে এই পুস্তিকার ভূমিকাই ছিল প্রধান। ১৮৮২-তে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্যে তিনি ভারতীয় উৎপন্নদ্রব্যের একটি বর্ণনামূলক তালিকা তৈরি করেন। এবারেও তাঁর আমন্ত্রণ ছিল হল্যান্ডে যাওয়ার, কিন্তু আত্মীয়স্বজনের প্রতিকূলতায় তাঁর বিদেশ যাওয়া হয়নি। তবে ১৮৮৬ সালে অনুরূপ বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি ব্রিটেনে যান এবং সেখান থেকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেন। কিছুকাল পরে তিনি আবার ইউরোপে যান, কিন্তু ফিরে এসে যথাবিধি প্রায়শ্চিত্ত করেন। কয়েক বৎসরের মধ্যে তাঁর A List of Indian Economic Products (1884), A Descriptive Catalogue of Indian Products (1888), A Handbook of Indian Products (1888) এবং ভ্রমণকাহিনি A Visit to Europe (1888) প্রকাশিত হয়।

এরপর রাজস্ববিভাগের কর্ম পরিত্যাগ করে তিনি কলকাতায় ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের অ্যাসিস্ট্যান্ট কিপারের পদগ্রহণ করেন। এ-সময়েই তাঁর বাংলা সাহিত্যসাধনার সূচনা হয়। স্বশিক্ষিত ত্রৈলোক্যনাথ বাংলা, ওড়িয়া, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় যেমন পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন, তেমনি ভূতত্ত্ব, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, উদ্ভিদবিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখায় অধিকার লাভ করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে অসুস্থতাবশত তিনি অবসরগ্রহণ করেন। অবসরগ্রহণের পর তিনি সাহিত্যচর্চায় অধিকতর মনোযোগ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালের ৩ নভেম্বর (১৭ কার্তিক ১৩২৬) পুরীর সমুদ্রতীরে তাঁর মৃত্যু হয়।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন, বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পের বিকাশ যাঁরা বর্ণনা করেছেন কিংবা বাংলায় রঙ্গব্যঙ্গরসের ধারার পরিচয় যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা সকলেই ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়কে অতি উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এর প্রধান কারণ এই যে, তাঁর মৌলিক প্রতিভা আমাদের সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন পথ তৈরি করে নিয়েছিল। ত্রৈলোক্যনাথ যখন সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখনো বাস্তব সমাজজীবনের চেয়ে রোমান্সের কল্পনারঙিন জগৎ বাঙালি লেখক ও পাঠকসমাজের প্রিয় ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র-প্রদর্শিত ঐতিহাসিক রোমান্সের পথে তিনি অগ্রসর হননি। আবার বঙ্কিমচন্দ্রের অনুসরণে সামাজিক উপন্যাস লিখতেও প্রবৃত্ত হননি। তিনি বাস্তবকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সে-বাস্তবের মধ্যে এমন অপ্রিয় কিছু লক্ষ করেছিলেন যা মানুষের উপযুক্ত বলে মনে করেননি। ফলে ভূতপ্রেত ও কাল্পনিক জীবজন্তুর এমন একটা জগৎ তিনি নির্মাণ করেছিলেন যার অভিনবত্ব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি একটা অবস্থায় পাঠককে বন্দি করে রাখে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই নির্দেশ করেছেন যে, ‘প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃত ঘটনার মেশামিশিতে তিনি যে বেপরোয়া, অকুতোভয় মনোভাব দেখাইয়াছেন, সেইখানেই তাঁহার বিশেষত্ব নিহিত।’ বস্তুত, যদি বলা যায়, ত্রৈলোক্যনাথের এক পা ছিল বাস্তব জগতে, অন্য পা কল্পলোকে, তাহলে খুব ভুল হবে না। তাঁর প্রথম রচনা কঙ্কাবতী পাঠকসমাজে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই কাহিনির সূচনা বাস্তব জগতে এবং সে-বাস্তবে সংশয়াতীতভাবে অমানবিকতা, ক্রূরতা ও ভণ্ডামির প্রাধান্য। গল্প কিছুদূর অগ্রসর হলে লেখক আমাদের যেখানে নিয়ে যান, তা সম্পূর্ণত রূপকথার জগৎ। আমরা যখন এ-কাহিনিকে বড়দের রূপকথা বলে প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়ি, তখন তিনি আমাদের ফিরিয়ে আনেন পূর্বের বাস্তব পৃথিবীতে এবং আমরা জানতে পারি যে, যাকে আমরা বড়দের রূপকথা বলে এতক্ষণ ঠাহর করেছিলাম, আসলে তা জ্বরবিকারের ঘোরে দেখা একরকম স্বপ্নজগতের ইতিবৃত্ত। ডমরু-চরিতে অনেক উপকরণ আছে যা অবিশ্বাস্য। গল্পের কথকের নির্বিকার মিথ্যা-ভাষণ বলে তার অনেকখানি চিহ্নিত করা যায়, তবে তার পরপরই আমরা উপলব্ধি করি যে, ঘটনা যদিও অবিশ্বাস্য পর্যায়ে চলে যায়, কিন্তু যে-মনোভাব অমন অবিশ্বাস্য ঘটনাকে প্রণোদিত করে, তার বাস্তব ভিত্তি আছে।

এই বাস্তবতাবোধ এমন পর্যায়ের যে, প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, ‘পর্যবেক্ষণশক্তি যেমন ত্রৈলোক্যনাথের প্রচুর পরিমাণে ছিল কল্পনাশক্তি তেমন ছিল না।’ কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে, মানবলোকে যা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাই আবার স্থাপন করেছেন অতিপ্রাকৃত জগতে। বস্তুত বাস্তব ও অবাস্তবের যে-সংমিশ্রণ তিনি ঘটিয়েছেন, তার মধ্যেই তাঁর কল্পনাশক্তির বিশেষত্বটি পরিস্ফুট হয়। সুকুমার সেনের মতে, কল্পনাশক্তি, সমবেদনা, মাত্রাজ্ঞান ও সরসতা—এইসব দুর্লভ গুণের সমাবেশ তাঁর রচনায় ঘটেছিল। তার ফলে, অদ্ভুত ও কৌতুক রসের মিলনে তাঁর রচনা অভিনব রূপ লাভ করেছিল। সুকুমার সেন অবশ্য মনে করেন যে, ত্রৈলোক্যনাথ কতকটা লুইস ক্যারলের আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু এ-কথা মনে হওয়া আরো সংগত যে, দেশীয় পরিস্থিতি ও আবহ এবং কাহিনিরচনায় দেশীয় ঐতিহ্যকেই তিনি মনে রেখেছিলেন বেশি। ত্রৈলোক্যনাথ কেবল অদ্ভুত ও অসম্ভবকে তুলে ধরেন নি, এসবের পেছনে কেবল কাহিনিকথনের ঝোঁক কার্যকর ছিল না; তিনি সমকালীন সমাজের কপটতা, স্বার্থপরতা ও হৃদয়হীনতাকে উদ্ঘাটন করেছেন, তার তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্যঙ্গে ও রঙ্গে।

ধর্মীয় আচারপরায়ণতা যেখানে আচারসর্বস্বতায় পরিণত হয়, রীতি যখন নীতির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখন ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে গুরুতর অসংগতি দেখা দিতে বাধ্য। এই অসংগতি ত্রৈলোক্যনাথের লেখার প্রিয় বিষয়। সুশীলকুমার গুপ্ত উল্লেখ করেছেন যে, ‘এমনকি যে স্বদেশী-দ্রব্যের উৎপাদন ও প্রচার সম্বন্ধে তিনি সারাজীবন চেষ্টা করিয়াছিলেন সেই স্বদেশীদ্রব্য প্রস্তুতি-প্রণালী লইয়াও তিনি রসিকতা করিতে ছাড়েন নাই।’ তবে তাঁর গুরুতর ক্রোধ অন্যত্র। তাঁর যে-চরিত্র বলে, ‘লোকে পাছে অলস হইয়া পড়ে, সেই ভয়ে ভিখারীকে কখন মুষ্টিভিক্ষা প্রদান করি না’, কিংবা যে দুআনা বেশি পাওয়ার লোভে জীবন্ত ছাগলের ছাল ছাড়ায়, কিংবা যে-ব্যক্তি মদ্যপানের অগৌরব কপালে ফোঁটা দিয়ে ঢাকতে চায়, কিংবা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েও যে-ব্যক্তি গোরক্ত দিয়ে তৈরি-করা বরফ খাওয়া সম্পর্কে নিতান্ত কটূক্তি করে, কিংবা যে-নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ পাঁঠীর মাংস বিক্রি করতে দ্বিধা করে না—এরাই ত্রৈলোকন্যাথের কথারাজ্যের অধিবাসী। সতীদাহ কি সমুদ্রযাত্রা সম্পর্কেও এমন সব চিত্তাকর্ষক উক্তি আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি টাইপই সৃষ্টি করে গেছেন, ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যপূর্ণ মানবচরিত্র তেমন আঁকেননি। চরিত্রাঙ্কনে তিনি বিশেষভাবে দক্ষ।

ত্রৈলোক্যনাথের আক্রমণের লক্ষ্য কেবল ব্যক্তি নয়, সমষ্টিও। তাই তিনি বলছেন, ‘কিছু একটা হুজুগ লইয়া বাঙ্গালী অধিক দিন থাকিতে পারে না। হুজুগ একটু পুরাতন হইলেই বাঙ্গালী পুনরায় নূতন হুজগের সৃষ্টি করে। অথবা এই বঙ্গভূমির মাটীর গুণে আপনা হইতেই নূতন হুজুগের উৎপত্তি হয়।’ কিন্তু সবার উপরে স্থান পাওয়ার মতো কথা ত্রৈলোক্যনাথের যম বলেছেন চিত্রগুপ্তকে: ‘পৃথিবীতে গিয়া মানুষ কি কাজ করিয়াছে, কি কাজ না করিয়াছে, তাহার আমি বিচার করি না। মানুষ কি খাইয়াছে, কি না খাইয়াছে, তাহার আমি বিচার করি। ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা, স্ত্রী-হত্যা করিলে এখন মানুষের পাপ হয় না, অশাস্ত্রীয় খাদ্য খাইলে মানুষের পাপ হয়।’ অধিক দৃষ্টান্ত নিষ্প্রয়োজন। এই কারণে অজিত দত্ত বলেছেন, ‘সর্বকালের মানবমনের শ্রেষ্ঠাংশের কাছেই তার [ত্রৈলোক্যনাথের রচনার] আবেদন।’

ত্রৈলোক্যনাথের রচনারীতির মৌলিকতাও আমাদের মুগ্ধ করে। তিনি কাহিনি বর্ণনা করেন বৈঠকি ঢঙে—যেন শ্রোতাকে সামনে রেখে কথা বলছেন। এই কথকতার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসাধারণ। তাঁর ভাষা সরল, সহজ, অনাড়ম্বর। ‘লেখ্য ভাষাকে কথ্যভাষার সঙ্গে এমনভাবে মিলাইয়া দিতে অল্প লেখকই পরিয়াছেন।’ আশা করা যায়, ভাষা ও ভঙ্গির এই অনায়াসস্বাচ্ছন্দ্য, অপ্রাকৃতের মধ্যেও একটা নিয়মের অনুসরণ এবং নিষ্ঠ জীবন-সমালোচনা কালান্তরেও পাঠককে আকর্ষণ করবে।

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের গ্রন্থাবলি

ক. বাংলা

১. কঙ্কাবতী (‘উপকথার উপন্যাস, সচিত্র’)। ১২৯৯/১৮৯২।

২. ভূত ও মানুষ (‘গল্প, সচিত্র’)। ১৮৯৬।

৩. ফোক্লা দিগম্বর (‘সামাজিক উপন্যাস’)। ১৩০৭/১৯০১।

৪. মুক্তা-মালা (‘উপন্যাস’)। ১৯০১ [১৯০২]।

৫. ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা। ইহার সংক্ষেপ বৃত্তান্ত ও অভাব। অমৃতলাল সরকার-সহযোগে। ১৯০৩।

৬. ময়না কোথায় (‘উপন্যাস’)। ১৩১১/১৯০৪।

৭. মজার গল্প (গল্প)। ১৩১২/১৯০৬।

৮. পাপের পরিণাম (‘উপন্যাস’)। ১৩১৫/১৯০৮।

৯. ডমরু-চরিত (‘গল্প’)। ১৯২৩।

খ. ইংরেজি

1. A Descriptive Catalogue of Indian Products (‘Contributed to the Amsterdam Exhibition. 1881’) Calcutta, 1883.

2. A Hand-book of Indian Products (‘Art Manufactures and Raw Materials’), Calcutta, 1883.

3. A List of Indian Economic Products (‘Compiled from the Catalogue of Economic Products of India, exhibited in the Economic Court, Calcutta International Exhibution, 1883-84’). Calcutta, 1884.

4. Art-Manufactures of India (‘Specially compiled from the Glasgow International Exhibition. 1888’). Calcutta, 1888.

5. A Visit to Europe (‘With a Preface by N.N. Ghose, Bar-at-Law’). Calcutta, 1889.

২০০১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *