মীরাবাঈয়ের নির্বাচিত ভজন ও তার ভাষান্তর
”নৈনা লোভী রে বহুরি সকে নহিঁ আয়।
রোম-রোম নখ-সিখ সব নিরখত, ললচ রহে ললচায়।।
মৈঁ ঠারী গৃহ আপনে রে, মোহন নিকসে আয়।
সারঙ্গ ওট তজে কুল অঁকুশ, বদন দিয়ে মুসকায়।।
লোককুটুম্বী-বরজ-বরজ হোঁ, বতিয়া কহত বনায়।
চঞ্চল চপল অটক নহিঁ মানত, পরহথ গয়ে বিকায়।।
ভলী কহো কোই চুরি কহো মেঁ, সবলই সীস চঢ়ায়।
মীরা কহে প্রভু গিরিধর কে বিন, পল ভর রহ্যো ন জায়।।”
—আমার রূপাতুর দৃষ্টি দুটি আর ফিরল না। তার তনুবাহারের দিকে তাকিয়ে আমি কেমন যেন হয়ে গিয়েছি। আমি তার রূপ—অমৃত নাম করতে চাইছি।
আমি তো আমার ঘরে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ আমার মোহন সামনে এসে দাঁড়াল।
আঁচলের আড়ালে ছিল আমার চোখ দুটি। তবু তা কুল—সম্মান ছাড়ল। ঠিক এই সময় মোহন আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হেসেছিল।
আত্মীয়স্বজন আমাকে নিষেধ করলেন। তাঁরা নানা নীতিকথা শোনালেন। এইভাবে তাঁরা আমার তপস্যার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেন। আমার জলচঞ্চল চোখ দুটি কোনও বাধা মানল না। পরের হাতে তা বিকিয়ে গেল।
এখন কেউ আমাকে ভালো বলুক, অথবা মন্দ বলুক, আমি সব কিছু মাথা পেতে নেব।
মীরা বলছে, সে তার নাগর গিরিধারীকে ছেড়ে আর থাকতে পারছে না।
***
”তুমারে কারণ সব সুখ ছোড়্যো, অব মোহিঁ ক্যূঁ তরসাবো।।
বিরহ বিথা লাগি উর অন্দর, সো তুম আয় বুঝাবো।।
অব ছোড়্যো নহিঁ বনৈ প্রভুজী, হুঁস কর তুরত বুলাবো।।
মীরা দাসী জনম জনম কী, অঙ্গ সূঁ অঙ্গ লগাবো।।”
—তোমার জন্য আমি হাসতে হাসতে আমার সকল সুখ বিসর্জন করেছি। তুমি কেন এখনও আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছো? তোমার বিরহের জ্বালায় আমি সর্বদা জ্বলে—পুড়ে মরছি। ওগো নাগর, তুমি এসে আমার সামনে দাঁড়াও। তোমাকে দেখে আমার সকল জ্বালা জুড়িয়ে যাক।
এখন তুমি আমাকে ছাড়লে আমি তা মানব কেন? তুমি আমায় কাছে ডাকো। তুমি কি জানো আমি তোমার এজন্মের দাসী নই, আমি তোমার জন্ম—জন্মের সেবিকা।
আজ আমার সব মনোস্কামনা তোমায় মেটাতে হবে। দর্শন, স্পর্শন আর আলিঙ্গনে আমাকে নিজের করে নাও। তবেই আমার জ্বালা মিটবে।
***
”ম্ঁহারে ঘর আজ্যো প্রীতম প্যারা,
তুমবিন সব জগ খারা।। টেক।।
তন-মন-ধন সব ভেঁট করূঁ মৈঁ, ঔর ভজন করূঁ থাঁরা।।
তুম গুণবন্ত বড়ে গুণ সাগর, মৈ হূঁ জী ঔগুণ হারা।।
মৈঁ নিগুণী গুণ একো লাহিঁ, তুঝ মেঁ জী গুণ সারা।।
মীরা কহে প্রভু কবহি মিলৌগে, বিন দরসন দুখিয়ারা।।”
—ওগো আমার পরম প্রিয়, তুমি আমার ঘরে এসো। তুমি ছাড়া আমার সংসার একেবারে অচল হয়ে যাবে। আমার জীবন এখন নীরস। আমার দেহ—মন—আত্মা—সবকিছু তোমার শ্রীচরণে উৎসর্গ করেছি। তোমাকে বারবার ডাকছি, তুমি গুণবন্ত এবং গুণসাগর। আমার মধ্যে কোনও গুণ নেই।
তোমার মধ্যে সব গুণ আছে। হে গুণসাগর, তুমি আমার নাগর, কবে তুমি দেখা দেবে? তোমাকে দেখতে না পেলে আমি কীভাবে দিন কাটাব।
***
”গোবিন্দ সূঁ প্রীতি করত, তবহিঁ ক্যুঁ ন হটকী।
অব তো বাত ফৈল লরী, জৈসে বীজ বটকী।।
বীজ কো বিচার নাহী, ছায়পরী তট কী।
অব চুকো তো ঠৌর নাহিঁ, জৈসে কলা নটকী।।
জল কী ঘুরী গাঁঠ পরী, রসনা গুণ রটকী।
অব তো ছুড়ায় হারী, বহুত বার ঝটকী।।
ঘর-ঘর মেঁ ঘোল কঠৌল, বাণী ঘট ঘটকী।
সবহী কর সীস ধারি, লোকলাজ পটকী।।
মদ কী হস্তী সমান, ফিরত প্রেম লটকী।
দাস মীরা ভক্তিবৃন্দ, হিরদয় বিচ গটকী।”
—ওগো মন, প্রেম করার সময় চিন্তা করলে চলবে কেমন করে? এখন চারদিকে কথা ছড়িয়ে পড়ছে, বুঝি বট বীজ। বীজের কোনও বিচার আছে কি?
সময় ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। আমার চিন্তা হচ্ছে, কবে এক বিরাট বটগাছ তার শাখা—প্রশাখা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে। যদি একবার সেই বটগাছ ভেঙে যায়, তাহলে কোথায় যাব আমি?
মনে হচ্ছে এসব বুঝি নটের দড়ির খেলা। পা পিছলে পড়ে গেলে বাঁচার কোনও উপায় নেই। জলে ভিজে দড়ির গাঁট আরও শক্ত হয়ে যায়। আমার রসনায় নামরসে প্রীতির গ্রন্থি আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। বহুবার চেষ্টা করেছি তার গাঁট খুলতে, কিন্তু পারিনি। বরং আমার টানে সে আরও বেশি শক্ত হয়ে গেছে। আমার আচরণ নিয়ে লোকে নানা কথা বলে। আমায় দেখলে ব্যঙ্গ—বিদ্রূপ করে। তোমার জন্য আমি সকল লোকনিন্দাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।
লোকলজ্জার সেই গাঁটটি পথের একপাশে ফেলে রেখেছি। এখন আমার মন—প্রাণ সবকিছু তোমায় সমর্পণ করেছি। আমার দেহ হয়ে গেছে মাতাল হাতির মতো। কোথায় যাব, কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।
মীরাদাসী বলছে, সে হরিভক্তির অমৃতবিন্দু পান করেছে। সেই বিন্দু তার মন—প্রাণকে ঠান্ডা করেছে। তার জীবনের সব জ্বালা জুড়িয়ে গেছে।
***
”মেরে পরম সনেহী রামকী, নিত ওলুঁড়ী আবে।। টেক।।
রাম হমারে হম হৈঁ রামকে, হরি বিন কুছ ন সুহাবৈ।।
আবন কহ গয়ে অজহুঁ ন আয়ে, জিবড়ো অতি উকলাবৈ।।
তুম দরসন কী আস রমইয়া, নিস-দিন চিতবত জাবৈ।।
চরণ কঁকল কী লগন লগী অতি, বিন দরশন দুখ পাবৈ।।
মীরা কূঁ প্রভু দরসন দীহ্না, আনন্দ বরণ্যে ন জাবৈ।।”
—সবসময় পরম প্রিয় রামের কথা মনে পড়ছে। রাম আমার এবং আমি রামের। হরি ছাড়া অন্য কিছু আমার এক মুহূর্তের জন্য ভালো লাগে না। হরি বলেছিল এখানেই ফিরে আসবে। কিন্তু আমাকে রেখে সে কোথায় গেল? আমার চিত্ত তার জন্য অত্যন্ত আকুল হয়েছে। ওগো, তোমার পথ চেয়ে আমি যে বসে আছি। আর কতক্ষণ এভাবে আমাকে চেয়ে থাকতে হবে? তুমি কি জানো না তোমার চরণ—পদ্মে আমার মন আসক্ত। ওই দুটি রাঙাচরণ কবে দেখব?
প্রভু মীরাকে আজ দেখা দিয়েছে। আমার আনন্দ আকাশ ছুঁয়েছে।
***
”প্রেম নীরে প্রেম নীরে প্রেম নীরে,
মন লাগি কটারী প্রেম নীরে।। টেক।।
জল জমুনা মাঁ ভরবা গয়া তাঁ, হতী গাগর সাথে হেম নীরে।।
কাঁচে তে তাঁত হরিজীয়ে বাঁধি, জেম খেচে তেমনী রে।।
মীরাকে প্রভু গিরধর নাগর, সাঁবলী সুরত সুভ এমনী রে।।”
—ওগো, প্রেমের আকাল লেগেছে। আমার মনেও প্রেমের কাটারি লেগেছে। আমি যমুনায় গিয়েছিলাম জল ভরতে। আমার মাথায় ছিল সোনার কলস। কাঁচা সুতো দিয়ে শ্যাম আমাকে বেঁধে ফেলেছে। তার কথা মতো এখন আমাকে পথ চলতে হচ্ছে।
মীরা বলছে, তার প্রভু গিরিধারী নাগরের মুখখানা সত্যিই সুন্দর।
***
”বংশীবারো আয়ো মঁহারে দেস,
থাঁরী সাঁবরী সুরত বালী-বৈসা।। টেক।।
আউঁ-আউঁ কর গয়া সাঁবরা, কর গয়া কৌল অনেক।
গিণতে-গিণতে ঘিস গঈ উঁগলী, ঘিস গঈ উঁগলী কী রোখ।।
মৈঁ বৈরাগিন আদি কী, যাঁরে মু্ঁ হারে কদ কো সনেস।
বিন পানী বিন সাবুন সাঁবরা, হুই গই ধুই সপেদ।।
জোগিন হুই জঙ্গল সব হেরূঁ, তেরা ন পায়া ভেস।
তেরী সুরতলে কারণে, ধর লিয়া ভগবা ভেস।।
মোর মুকুট পীতাম্বর সৌহৈ, ঘুঁঘর বালা কেস।
মীরা কো প্রভু গিরধর মিল গয়ে, দূণা বঢ়া সনেস।।”
—বংশীধর এসেছে আমার দেশে। সে বয়সে কিশোর। অথচ এখনই অনন্য রূপ—লাবণ্যের অধিকারী। তাকে আমি ভালোবেসেছি। কতদিন ধরে তার পথ চেয়ে আমি বসেছিলাম।
অবশেষে সে এল না। দিন গুনতে গুনতে আমার আঙুলের রেখাগুলি ক্ষয়ে গেল। আঙুলগুলিও ক্ষয়িত হল। আমি তো আজকের বৈরাগিনী নই। প্রথম থেকেই আমি তার নামে সংসার ত্যাগ করেছি।
তোমরা কি জানো, আমার আর শ্যামের ভালোবাসা আজকের নয়। আমরা জন্ম—জন্মান্তরে পরস্পরের সাথী।
তার ভালোবাসায় আমি জল আর সাবান ছাড়া নিজেকে পরিষ্কার করতে গেলাম। ধুয়ে সাদা হয়ে গেলাম। আমি যোগিনী হয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। ওগো তোমরা কি জানো, আমার শ্যামের জন্য আমি এমন গৈরিক বেশ ধারণ করেছি।
তার মাথায় আছে ময়ূর পেখমের মুকুট। তার দেহে আছে পীত অম্বর। তার মুখে কেশদাম।
মীরা অবশেষে তার প্রভু গিরিধারীকে দেখতে পেল। এতে তার ভালোবাসা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
***
”হেলী ম্হাঁসূঁ হরি বিন রহ্যো ন জায়।। টেক।।
সাসু লড়ে মেরী ননদ খিজাবে, রাণা রহে রিসায়।।
পহরো ভী রাখ্যো চৌকী বিঠার্যাে, তালা দিয়ো জড়ায়।।
পূর্ব্বজন্ম কী প্রীত পুরানী, সো ক্যূঁ ছোড়ী জায়।।
মীরাকে প্রভু গিরধর নাগর, ঔর ন আবে ম্হাঁরী দায়।।”
—ওগো সই, হরিকে ছেড়ে যে একমুহূর্ত থাকা যায় না। এজন্য শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া হয়। ননদ নানা কথা বলে বিরক্ত করে। রাণা রাগ করে। রাণা আমার চারপাশে চৌকি বসিয়ে দিয়েছে। দরজায় দিয়েছে তালা। কী অবোধ সে, সে কি জানে এভাবে আমাকে আটকানো সম্ভব হবে না। আমার আর শ্যামের ভালোবাসা জন্ম—জন্মান্তরের। তাকে কি আমি ভুলে যাব?
মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর। অন্য কোনও নাগরকে তার ভালো লাগবে কেমন করে?
***
”মৈ হরি বিন ক্যোঁ জিউঁ রী মায়।। টেক।।
পিয় কারণ বৌরী ভঈ, জস কাঠহি ঘুন খায়।
ঔষধি মূল ন সঞ্চরৈ, মোহিঁ লাগে বৌরায়।।
কমঠ দাদুর বসত জল মঁহ, জলহি তেঁ উপজায়।
মীরা জলকে বীছুরে তন, তলফি কে মরি জায়।।
পিছু ঢূঁঢ়ণ বন-মন গঈ, কহুঁ মুরলী ধুন পায়।
মীরাকে প্রভু লাল গিরধর, মিলি গয়ে সুখদায়।।”
—ওগো সখী, হরি ছাড়া আমি বাঁচব কী করে? আমি তো সেই প্রিয়তমকে কাছে পাওয়ার জন্য একেবারে পাগল হয়ে গেছি।
যেমনভাবে কাঠ ঘুণে খায়, সেইভাবে তার বিরহ আমাকে জর্জর করেছে। এই প্রেমরোগ তাড়ানোর জন্য কোনও ওষুধের প্রয়োজন নেই।
আমায় যেসব সখীরা পাগল করে তুলেছে, তারা কেমন আছে? দেখো সখী, কাছিম আর দাদুর জলে জন্মে। জলেই ওদের বাস। জল ছাড়া ওরা বাঁচবে কী করে? মাছকে যদি জলছাড়া বাইরে ফেলে রাখা হয়, মাছ মরে যায়। আমারও এখন হরিভক্তির চরম অবস্থা এসেছে। আমার কানে প্রবেশ করেছে শ্যামের মোহিনী বাঁশী। আমি উন্মাদিনীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছি। অরণ্যে গিয়ে তাকে খুঁজছি।
মীরা বলছে, তার সুখদাতা প্রভু গিরিধারীলালের সন্ধান সে পেয়েছে।
***
”সখী মেরী নীদ নসানী হো।। টেক।।
পিয়া কো পন্থ নিহারতে, সবরৈণ বিহানী হো।।
সখিয়ন মিলকে সীখ দঈ, মন এক ন মানী হো।
বিন দেখে ফল না পরে, জিয় ঐসী ঠানী হো।।
অঙ্গ ছীন ব্যাকুল ভঈ, মুখ পিয়-পিয় বাণী হো।।
অন্তর বেদন বিরহ কী, বহ পীর না জানী হো।
জ্যোঁ চাতক ঘনা কো রটে, মছরী জিমি পানী হো।
মীরা ব্যাকুল বিরহিনী, সুধু-বুধ বিসরানী হো।।”
—হে সখী, আমার অনিদ্রা রোগ হয়েছে। সারারাত অনিদ্রিত অবস্থায় জেগে আছি। তার সাথে দেখা হবে বলে।
সখীরা আমাকে উপদেশ দিয়েছিল, হায়, আমি কেন তাদের নীতিকথা শুনলাম না।
আমার হৃদয়ের অবস্থা এমন হয়েছে যে, তাকে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারছি না। তার অদর্শনে আমার দেহ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠছে। আমার মন হছে ব্যাকুল। মুখে কেবল ‘পিয়া’ ‘পিয়া’ শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে। ওগো সই, সকলে আমার মনের দুঃখ—ব্যথা বুঝতে পারল, কিন্তু সে কেন বুঝল না?
চাতকিনী মেঘের জন্য উন্মাদিনী হয়, মীন উতলা হয় জলের জন্য, তেমন— ভাবে আমি তার জন্য হয়েছি বিরহিণী। আমি বোধহয় এখন চেতনাও হারিয়েছি।
***
”শ্যাম মোসূঁ ঐড়ঁ ডোলে হো।। টেক।।
ঔরণ সূঁ খেলে ধমার, মহাঁসূঁ মু খহূ ন বোলে হো।।
ম্হাঁরী গালিয়াঁ না ফিরে, বাকে অঙ্গণ ডোলে হো।।
ম্হাঁরী অঁগুলি না ছুবে, বাকে বহিয়াঁ মোরে হো।।
ম্ঁহারে অঁচরা না ছুবে, বাকে ঘূঁঘট খোলে হো।।
মীরা কে প্রভু সাঁবরো, রঙ্গ-রসিয়া ডোলে হো।।”
—শ্যাম আমাকে নানা ছলাকলা দেখাচ্ছে. আমি জানি সে এখন অন্য নারীর সাথে হোলি খেলায় মত্ত। আমাকে দেখে একটি কথা পর্যন্ত বলে না। আমার পথের ধারে আসে না। অন্যদের আঙিনায় ঘুরে বেড়ায়। আমার আঙুল পর্যন্ত স্পর্শ করতে তার তীব্র অনীহা। অথচ অন্যদের হাতে হাত রেখে কত না খুনসুটি করে।
আমার আঁচল ছোঁবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে, অথচ অন্য নারীদের ঘোমটা খোলার জন্য পাগল।
মীরার প্রভু শ্যামল একজন সুরসিক নাগর। সে এখন ব্রজধামে রঙ্গ করে বেড়াচ্ছে।
***
”রাম মিলন রো ঘনো উমাবো, নিত উঠ জোউঁ বার্বড়িয়াঁ।। টেক।।
দরসন বিন মোহিঁ জল ন সুহাবৈ, কল ন পড়ত হৈ অঁখড়িয়াঁ।।
তলফ-তলফ কে বহুদিন বীতে, পড়ী বিরহ কী ফাঁসড়িয়াঁ।।
অব তো বেগ দয়া করে সাহিব, মৈঁ হুঁ তৈরী দাসড়িয়াঁ।।
নৈন দুখী দরসন কো তরসে নাভিন বৈঠে সাঁসড়িয়াঁ।।
রাত-দিবস য়হ আরত মেরে, কব হরি রাখে পাসড়িয়াঁ।।
লগী লগন ছুটন কো নাহি, অব কঁভূ কীজে আঁটড়িয়াঁ।।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর, পুরো মন কী আসড়িয়াঁ।।”
—রাম, তোমার সাথে কবে আমার মিলন হবে? প্রতিদিন সকালে আমি পথের দিকে তাকিয়ে থাকি অনিমেষ নয়নে। তোমাকে দেখতে না পেলে মন ভালো লাগে না। এক মুহূর্তের জন্য আমি শান্তি পাই না। হে প্রভু, তুমি আমাকে কৃপা করো। আমি তোমার দাসী। আমার ব্যথিত নয়ন তোমাকে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে। দুঃখের আবেগ আমার শ্বাসরোধ করছে। আমি আর বাঁচতে চাইছি না। আমি দিবারাত্রি কামনা করছি কবে তুমি এসে আমাকে তুলে নেবে।
যে প্রেম একবার হয়েছে, তাকে কি উপেক্ষা করা সম্ভব? এ নিবিড় প্রেম কখনও ভাঙবে না। তবু তুমি কেন আসছো না?
ওগো মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর, তুমি এসে মীরার মনের আশা পূর্ণ করো।
***
”রমৈয়া বিনা নীদঁ ন আবে।
নীঁদ না আবে বিরহ সতাবৈ, প্রেম কী আঁচ ঢুলাবে।। টেক।।
বন পিয়া জোত মঁদির অধিয়ারো, দীপক দায়ন আবে।
পিয় বিন মেরী সেবজ অলুনী, জাগত রৈণ বিহাবে।
পিয়া কর রে ঘর আবে।।
দাদুর মোর মণিহরা বোলৈ, কোয়ল সবদ সুনাবৈ।
যুমঁড় ঘটা উলরে হোই আতু, দামিন দমন ডরাবে
নৈন মের লাবৈ।।
কহা করূঁ কিত জাউঁ মোরী সজনী, বেদন কুন বুতাবে।
বিরহ নাগন মেরী কায়া ডসী হৈ, লহর লহর জিব জাবে।।
জড়ী ঘস লাবে।।
কো হৈ সখী সহেলী সজনী, পিয়া কূঁ আন মিলাবৈ।
মীরা কূঁ প্রভু কব রে মিলোগে, মনমোহন মোহি ভাবে।।
কবৈ হঁস কর বতরাবৈ।।”
—প্রিয়তমকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্ত থাকতে পারি না। রাতে আমার চোখে ঘুম আসে না। বিরহ প্রতি মুহূর্তে আমাকে শোকসন্তপ্ত করেছে। প্রেমের আগুন আমাকে করেছে দগ্ধ। আমি সবসময় অস্থির হয়ে উঠেছি। প্রিয় ছাড়া আমার এই মন্দির একেবারে অন্ধকার। আলোর মুখে কে যেন কালোর ঘোমটা পরিয়ে দিয়েছে। প্রিয়তম ছাড়া আমার শয্যাসুখ শূন্য। এই শয্যা রচনা করে কি হবে? আমাকে তো জেগে জেগে সারারাত কাটাতে হবে। হায়, কবে আমার প্রিয় ঘরে আসবে।
দাদুর, ময়ূর আর পাপিয়া ডাকছে। কোকিলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখছি বলো তো? দেখছি শ্যামল মেঘ জলভারে নত হয়ে আসছে। তার মধ্যে ক্ষণিকা বারবার তার দীপ্তি প্রকাশ করছে। এই দৃশ্য দেখে আমার দু’চোখ দিয়ে নামছে অবিরল অশ্রুধারা।
ওগো সখী, আমার বেদনা এখন কে শান্ত করবে? এই ভাঙা মন আর অসুস্থ শরীর নিয়ে আমি কোথায় যাব? আমি যে কী করব তা বুঝতে পারছি না। বিরহ—নাগিনী আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। তার বিষাক্ত দংশন আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। এই বিষের কি কোনও ওষুধ আছে?
এখন যদি সে এসে আমার সামনে দাঁড়াত, তাহলে আমার সকল জ্বালা—যন্ত্রণা জুড়িয়ে যেত।
এখন এমন কোনও সখী বা সহচরী আছে, যে আমার প্রিয়তমকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে?
মীরার প্রভু, তুমি কবে দেখা দেবে? ওগো মনোমোহন, তুমি ছাড়া আমার কোনও কিছু ভালো লাগে না, তুমি কি আমার মানসিক অশান্তির কথা বুঝতে পারছো না?
***
”গোবিন্দ কবহূঁ মিলে পিয়ামেরা।। টেক।।
চরণ কমল কো হঁস করি দেখোঁ, রাখোঁ নৈনন নেরা।।
নিরখন কী মোহি চাব ঘনেরী, কব দেখোঁ মুখ তেরা।।
ব্যঅকুল প্রাণ ধরত নহিঁ ধীরজ, মিল তূঁ মীর্তা সবেরা।।
মীরা কহে প্রভু গিরধর নাগর, তাপ তপন বহুতেরা।।”
—আমার স্বামী গোবিন্দ কোথায় আছে? কোথায় গেলে তাঁর চরণপদ্ম আমার চোখে পড়বে?
তাকে দেখার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছি। কবে তার মুখ আমি দেখতে পাব? ওগো আমার প্রিয়, আর ধৈর্য্য ধরে থাকতে পারছি না। আমি অনেক করে নিজের মনকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।
ওগো আমার বন্ধু, তাড়াতাড়ি দেখা দাও। এই মীরা তোমার বিরহতাপে দগ্ধ হয়েছে।
***
”ঘড়ী এক নহিঁ আবড়ে, তুম দরসন বিন মোয়।
তুম তো মেরে প্রাণ জী, কসূঁ জীবন হোয়।।
ধাম ন ভাবে নীদঁ ন ভাবে, বিরহ সতাবে মোয়।
ঘায়ল সী ঘূমত ফিরূঁ রে, মেরো দরদ ন জানে কোয়।।
দিবস তো খায় গমায়ো রে, রৈণ গমায়ো সোয়।
প্রাণ গমায়ো ঝুরতাঁ রে, নৈন গমায়ো রোয়।।
জ্যো মৈঁ ঐসা জানতী রী, প্রীত কিয়ে দুখ হোয়।
নগর টিঢ়োরা ফেরতী রে, প্রীত করে জানি কোয়।।
পন্থ নিহারূঁ, ডগর বুহারঁ, উবী মারগ জোয়।
মীরা কে প্রভু কব রে মিলোগে, তুম মিলিয়াঁ সুখ হোয়।”
—তোমায় না দেখলে এক মুহূর্তের জন্য আমার ভালো লাগে না। তুমি আমার প্রাণের পতি। তুমি ছাড়া আমার জীবন অন্ধকার। আহারে রুচি নেই। চোখে ঘুম নেই। সবসময় মনের ভেতর বিরহ। আহতের মতো আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার হৃদয় রক্তাক্ত হয়। আমার ব্যথা কেউ বুঝবে কি?
আমি প্রতিদিন অনাহারে ছিলাম। শুয়ে শুয়ে রাত কেটে গেছে। চোখে এসেছে কান্না, প্রাণ হারিয়েছি শোকে।
আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার জীবনের অন্তিম সময় এসে গেছে। সাধনা করেও কি আমি আমার সাধের ধনকে পেয়েছি?
প্রীতির পরিণাম যে এত দুঃখ আনতে পারে তা আমি জানতাম না। জানলে নগরে ঢাক পিটিয়ে বলতাম, ভালোবাসা তুমি দূরে চলে যাও।
তোমার পথ চেয়ে আর কতদিন আমি এভাবে বসে থাকব? তুমি কি জানো না, আমি এক অবলা নারী? তোমার পথ এখন পরিষ্কার। আর আমি ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছি না।
ওগো মীরার প্রভু, কবে তোমার সঙ্গে দেখা হবে? তোমার সঙ্গে মিলন না হলে আমি সুখী হব কেমন করে?
***
”জাও হরি নিরমোহড়া রে, জানী যাঁরী প্রীত।। টেক।।
লগন লগী জব ঔর ছী, অব কুছ অবঁলী রীত।।
অমৃত পায় বিষৈ কভু দীজৈ, কৌন গাঁব কী রীত।।
মীরা কহে প্রভু গিরিধর নাগর, আপন গরজ কে মীত।।”
—ওগো নির্দয়! তুমি যাও, তুমি ভালোবাসার মর্ম বোঝো না। আমার ভুল হয়েছে তোমাকে ভালোবেসে।
যখন প্রণয় শুরু করলে তখন তুমি ছিলে একেবারে অন্য। এখন পাল্টে গেছো।
অমৃত খাইয়েছো, আবার কেন বিষ দিচ্ছো? এই কি তোমার রীতি?
মীরা বলছে, ওগো আমার প্রভু গিরিধারী নাগর, তুমি হলে স্বার্থের সুহৃৎ।
***
”জোগিয়া নে কহিয়ো রে আদেস।।
আউঁগী মৈঁ নাহিঁ রহুঁ রে, কর জটাধারী ভেস।।
চীর কো ফাড় কন্থা পহিরূঁ, লেউঁগী উপদেস।
গিনতে-গিনতে ঘিস গঈ রে, মেরী উঁগলিয়োঁ কী রোখ।।
মুদ্রা মালা ভেষ লুরে, খপ্পড় লেউঁ হাথ।
জোগিন হোয় জগ ঢুঢ়সুঁ রে, রাবলিয়া কে সাথ।।
প্রাণ হমারা বহাঁ বসত হৈ, য়হাঁ তো খালী থোড়।
মাতা-পিতা পরিবার সূঁ রে, রথী তিনকা তোড়।।
পাঁচ পচীসো বস কিয়ো রে, মেরা পল্লা ন পকড়ৈ কোয়।
মীরা ব্যাকুল বিরহিনী, কোই আন মিলাবৈ মোয়।।”
—আমার যোগীর কাছে আমার খবর দিও। তাকে না দেখে আমি ক্ষণিক সময়ও থাকতে পারছি না।
আমি জটাধারিণীর বেশ ধারণ করব। আমি তার কাছে যাব। আমার কাপড় দিয়ে আমি কাঁথা বানাব। সেই কাঁথা গায়ে দিয়ে আমি গ্রহণ করব গুরুমন্ত্র।
যোগিনী হয়ে পথে প্রান্তরে তাকে খুঁজে বেড়াব। আমি তার অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্ষয় করে ফেলেছি আমার আঙুল। আমি মুদ্রা নেব, আমি ভেক ধারণ করব। আমার হাতে থাকবে খর্পর। আমি হব এক যোগিনী। স্থলে—জলে—অন্তরীক্ষে তার খোঁজ করব।
সখী, তোমরা কি জানো, আমার সমস্ত মন—প্রাণ সর্বদা আমার গোপীর কাছেই পড়ে থাকে? এখানে শুধু দেহটা আছে। আত্মা চলে গেছে তার কাছে।
মা—বাবা, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক আমি ত্যাগ করেছি। তারা বুঝি আমার কাছে তৃণ।
আমি পাঁচ ইন্দ্রিয় আর পঁচিশ প্রকৃতিকে বশ করেছি। এখন আমায় আর কে আটকাবে?
বিরহিণী মীরা যোগীর বিরহে ব্যাকুল হয়েছে। আহা, এমন কেউ কি নেই, যে আমাদের মধ্যে মিলন করিয়ে দেবে?
***
”মৈঁ তো রাজী ভঈ মেরে মন মেঁ,
মোহি পিয়া মিলে এক ছিন মেঁ।। টেক।।
গিয়া মিল্যা মোহিঁ কৃপা কীহ্নী, দীদার দিখায়া হরি নে।।
সতগুরু সবদ লখায়া অঁসরী, ধ্যান লগায়া ধুন মেঁ।।
মীরা কে প্রভু গিরধর নাগর, মগন ভঈ মেরে মন মেঁ।।
—আমার প্রিয়তম আমার অন্তরে এসেছে। এক মুহূর্ত লাগল না তাকে আমি চিনে ফেলেছি। তাকে দেখে আমি হলাম আহ্লাদিতা।
সে আমার ওপর বিশেষ কৃপা করে। শেষ পর্যন্ত সে নিজেই এসে দেখা দিয়েছে।
সত্যগুরু দিয়েছেন তাঁর মন্ত্র। সেই মন্ত্রবলে আমি বুঝতে পেরেছি যে, অবিনশ্বরের অংশ আমার মধ্যে আছে।
আমি ধ্যানের মাধ্যমে তাঁকে দেখেছি।
মীরা বলছে, আমার প্রভু গিরিধারী নাগর। তাকে লাভ করে, আমার হৃদয় দিব্য আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
***
”জাবা দে রী জাবা দে, জোগী কিসকা মীত।। টেক।।
সদা উদাসী মোরী সজনী, নিপট অটপটী রীত।।
বোলত বচন মধুর সে মীঠে, জোরত নাহিঁ প্রীত।।
হুঁ জানুঁ য়া পার নিভেগী, ছোড় চলা অধবীচ।।
মীরা কহৈ প্রভু গিরধর নাগর, প্রেম পিয়ারী মীত।।”
—সই, যেতে দাও, আমাকে যেতে দাও। কবে যোগী কার বন্ধু হয়েছে বলো তো?
যোগী সর্বদা উদাসীনতার মুখোশ পরে বসে থাকে। তার রীতিনীতি বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তার মুখ থেকে ছিটকে আসা বাক্যগুলি আমার হৃদয়ের ভেতর প্রবেশ করে। কিন্তু সে কেন প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে না? আমি তো তাকে মন উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সে আমার ভালোবাসার প্রত্যুত্তর দেবে। কিন্তু সে কি আমার পরপারের সঙ্গী হবে? সে কেন আমাকে মাঝদরিয়াতে ছেড়ে গেল?
মীরা বলছে, প্রভু গিরিধারী নাগর, তুমি আমার কাছে কবে প্রেম নিয়ে হাজির হবে।
***
”হে রী মৈঁ তো প্রেম দিবানী,
মেরা দরদ ন জানে কোয়।। টেক।।
সূলী উপর সেজ হমারী, কিস বিধ সোব না হোয়।
গগন মঁডল পৈ সেজ পিয়া কী, কিস বিধ মিলনা হোয়।।
ঘায়ল কী গতি ঘায়ল জানে, কী জিন লাঈ হোয়।
জৌহরী কী গতি জৌহরী জানৈ, কী জিন জৌহর হোয়।
দরদ কী মারী বন-বন ডোলূঁ, বৈদ মিল্যা নহিঁ কোয়।
মীরা কী প্রভু পীর নিটৈগী, বৈদ সাঁবলিয়া হোয়।।”
—সখী, আমি রামের জন্য উন্মাদিনী হয়েছি। আমার ব্যথা তোমরা কেউ বুঝবে না। আমার শয্যা কিন্তু ফুলের ওপর স্থাপিত হয়নি, আমি এখন শূলের ওপর শুয়ে আছি। সেখানে আমি কেমন করে থাকব? ওই দেখতে পাচ্ছি, অনন্ত আকাশ জুড়ে আমার স্বামীর সুখশয্যা পাতা হয়েছে।
কীভাবে আমি আমার স্বামীর সাথে মিলিত হব?
এক আহতের ব্যথা কেমন, এক রক্তাক্ত মানুষ তা জানে। আর জানে, যে আঘাত হেনেছে।
সখী, এক জহুরীর মর্ম আর এক জহুরী বুঝতে পারে। আর বুঝবে সে, যে হল জহুরীর জহুরী।
আমি ব্যথার্ত মনে বনে বনে ঘুরে বড়োই। ওগো, আমার এ রোগ সারাবার মতো কবিরাজ কোথাও আছে কি?
ওগো সখী, আমার রোগ তখনই সেরে যাবে, যখন শ্যামল কবিরাজ হয়ে আমার কাছে আসবে। তার হাতে আমি রাখব হাত। সে আমার নাড়ী টিপে আমার অসুখের উৎস সন্ধান করতে পারবে। কবে আসবে আমার সেই কবিরাজ?
***
”প্যারে দরসন দীজ্যো আয়, তুম বিন রহ্যো ন জায়।। টেক।।
জল বিন কবল, চন্দন বিন রজনী, ঐসে তুম দেখ্যা বিন সজনী।।
যাকুল ব্যাকুল কিরূঁ রৈণ দিন, বিরহ কলেজো খায়।।
দিবস ন ভূখ, নীদ হহিঁ রৈণা, মুখ সূঁ কহত ন আঁবৈ বৈনা।,
কহা কহুঁ কুছ কহত ন আবৈ, মিলকর তপত বুঝায়।।
ক্যূঁ তরমারো অন্তরজামী, আয় মিলো কিরপা কর স্বামী।
মীরা দাসী জনম-জনম কী, পরী তুমারে পায়।।”
—হে প্রিয়, দয়া করে একবার দেখা দাও। তুমি ছাড়া আমি আর থাকতে পারছি না। জল ছাড়া পদ্ম কি বাঁচতে পারে? চাঁদ ছাড়া রাত্রি তার সব শোভা হারিয়ে ফেলে। তোমার বিরহে আমার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়।
আমি আকুল আর্তনাদ করি। ব্যাকুল চিত্তে ঘুরে বেড়াই। বিরহ আমার হৃদয়কে অধিকার করেছে। আমার খিদে চলে গেছে, রাতে ঘুম নেই। ওগো, আমার মুখে আজ আর কথা নেই। মীরা তোমার জন্ম—জন্মান্তরের দাসী, তুমি কবে এসে তার এই বিরহ জ্বালা দূর করবে।
***
”অলী রে মেরে নেনন বান পড়ী।। টেক।।
চিত্ত চঢ়ী মেরে মাধুরী মূরত, উর বিচ আন অড়ী।।
কব কী ঠারী পন্থ নিহারূঁ অপনে ভবন ঘড়ী।।
কৈসে প্রাণ পিয়া বিন রাখুঁ, জীবন মূল জড়ী।।
মীরা গিরধর হাত বিকানী, লোপ কহৈ বিগড়ী।।”
—ওগো সখী, অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি আমার প্রিয়তমকে দেখবার জন্য এইভাবেই তাকিয়ে থাকি।
তোমরা কি জানো, আমার হৃদয়পটে শ্যামের মূর্তিখানি চিরদিনের জন্য আঁকা হয়ে গেছে? আমি এক মুহূর্ত তাকে ভুলতে পারি না।
কবে থেকে আমি এইভাবে তার আশায় দাঁড়িয়ে আছি। তাকে না পেলে আমার জীবনের কোনও মূল্য থাকবে না।
তোমরা কি জানো মীরা আজ বিকিয়ে গেছে গিরিধারীর হাতে? লোকে বলে আমি নাকি কুপথে পা ফেলেছি।
***
”দবস বিন দূখন লাগে নৈন।। টেক।।
জব সে তুম বিছুয়ে মেরে প্রভুজী, কবহুঁ ন পায়ো চৈতন।।
সবদ সুনত মেরী ছতিয়াঁ কম্পে, মীঠে লগে তুম বৈন।।
এক টকটকী পন্থ নিহারূঁ, ভই ছমাসী রৈন।।
বিরহ ব্যথা কাসূঁ কহুঁ সজনী, বহু গই করবত ঐন।।
মীরাকে প্রভু কব রে মিলাগে, দুঃখ মেটন সুখ দেন।।”
—তোমাকে দেখবার জন্য আমার চোখ দুটি অধীর হয়ে উঠেছে। ওগো প্রভু, যখন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে তখন থেকেই আমি এইভাবেই দুঃখ সাগরে সাঁতার কাটতে বাধ্য হচ্ছি। তোমার পদধ্বনি শুনলে আমার শরীরের সর্বত্র এক অলৌকিক শিহরণ জেগে ওঠে।
হে প্রিয়, তোমার কথা কি মধুর। আমি তোমার পথের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। এভাবে আমার এক রাত যেন ছ’মাসের রাত হয়ে যায়।
ওগো আমার সই, আমি এ বিরহ ব্যথা কাকে বলব? মনে হয়, আমার বুকের ভেতর দিয়ে কে যেন করাত চালিয়ে দিয়েছে।
ওগো মীরার প্রভু, তুমি কবে আমার দুঃখ রাতের অবসান ঘটাবে?
***
”সাজন সুধ জ্যুঁ জানু ত্যূঁ লীজে হোক।। টেক।।
তুম বিন মেরে ঔর ন কোঈ, কৃপা রাবরী কীজে হো।।
দিবস ন ভূখ রৈন নহিঁ নিদ্রা, য়হ তন পল-পল দীজে হো।।
মীরা কহে প্রভু গিরিধর নাগর, মিল বিছুরণ নহিঁ কীজে হো।।”
—ওগো প্রিয়, তুমি যেমন করে হোক আমার খবর নিও। আমার অবস্থা দেখো। তুমি কি জানো এ পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই? তোমার কৃপা থেকে আমি যেন কখনও বঞ্চিত না হই। আমার দিনে খিদে নেই, রাতে নেই ঘুম। এই শরীর ধীরে ধীরে তোমার জন্য ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। মীরা বলছে, হে প্রভু, একবার মিলনের পর তুমি কেন বিচ্ছেদ আনলে?
***
”বসো মেরে নয়নন মেঁ নন্দলালা।। টেক।।
মোহনী মূরত সাঁবরি সূরত, নৈনা বনে বিসাল।।
অধর সুধা-রস মুরলী রাজিত, উর বৈজন্তী মাল।।
ছুদ্র ঘণ্টিকা কটিতট সোভিত, নূপুর-সব্দ রসাল।।
মীরা প্রভু সন্তন সুখদাঈ, ভক্তবছল গোপাল।”
—ওগো নন্দলাল, তুমি আমার নয়নের মধ্যে আছো। তোমার শ্যামল মূর্তির মোহিনী রূপ কী সুন্দর? তোমার নয়ন দুটিও সুন্দর। তোমার অধরে আছে অমৃতরসময়ী মুরলিকা। তোমার বক্ষপ্রান্তে বৈজয়ন্তীমালা শোভা পাচ্ছে। তোমার কটিপ্রান্তে আছে ক্ষুদ্র ঘণ্টিকা। তোমার চরণপ্রান্তে আছে নূপুর।
মীরা বলছে, তুমি তো সর্বদা ভক্তদের নিয়ে সুখে থাকো। তাই তোমাকে ভক্তবৎসল বলা হয়।
***
”রাণা তৈঁ জহর দিয়ো মৈঁ জানী।। টেক।।
জৈসে কঞ্চন দহত অগিন মৈঁ, নিকসত বারাবাণী।।
লোক-লাজ কুল-কাণ-জগত কী, দই বহায় জস পানী।।
অপনে ঘরকা পরদা করলে, মৈঁ অবলা বৌরাণী।।
তরকস তীর লগ্যো মেরে হিয় রে, গরক গয়ো সনকানী।।
সব সন্তান পর তন মন বারোঁ, চরণ কমল লপটানী।।
মীরা কে প্রভু রাখ লইহে, দাসী অপনী জানী।।”
—রাণাজি, তুমি যে আমায় বিষ দিয়েছো, তা আমি জানি। আগুনে কাঞ্চন পোড়ালে কী হয়? দ্বাদশ সূর্যের ন্যায় তার জ্যোতি বেড়ে যায়। আমি তেমনই দগ্ধ হয়েছি।
আমি একদিকে লোকলজ্জা, আর অন্যদিকে বংশমর্যাদা—এই দুটি জাগতিক বিষয়কে ভাসিয়ে দিয়েছি।
রাণাজি, তুমি তোমার ঘরে পর্দা করো। আমি এক অবলা নারী, তোমার জন্য আজ উন্মাদিনী হয়েছি।
তূণের তীর এসে অন্তরে যেমনভাবে লাগে, তেমনভাবেই গুরুর বাণী আমাকে বিদ্ধ করেছে। আমার মনন সঙ্গে সঙ্গে নির্মল হয়ে গেল।
আমি সদাসর্বদা আমার জীবন সাধু—সন্তদের জন্য উৎসর্গ করেছি।
মীরাকে তার প্রভু তাকে দাসী মনে করে সমস্ত দুঃখের হাত থেকে তাকে রক্ষা করেছে।
***
”চলাঁ বাহী প্রীতম পাবাঁ, চলাঁ বাহী দেস।। টেক।।
কহো কসুম্বী সারী রঁ গাবাঁ, কহো তো ভগবা ভেস।।
কহো তো মোতিয়ন মাঁগ ভরাবাঁ, কহো ছিটকাবাঁ কেস।।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর, সুনিয়ো বিরদ কে নরেস।।”
—যেখানে গেলে আমি আমার প্রিয়তমাকে পাব, চলো সেখানে চলে যাই। সখী, তুই বল সে দেশ কোথায়? আমি আজ কুসুম রঙের শাড়ি পরব। গৈরিক বসন পরে হব বৈরাগিনী। সিঁথিতে দিলাম মুক্তোমালা। আমি যাব মুক্তকেশী হয়ে। ওগো মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর, ওগো যশস্বী নরপতি, তুমি কেন তোমার দাসী মীরার মিনতি শুনছো না?
***
”মেরে প্রীতম প্যাঁরে রাম নে, লিখ ভেজূঁ রী পাতী।। টেক।।
স্যাম সনেসো কবহূঁ ন দীহ্নো, জান বুঝ গুবাবাতী।।
উঁচী চঢ়-চঢ় পন্থ নিহারূঁ, রোয়রোয় আঁখিয়া রাতী।।
তুম দেখ্যা বিন কল ন পরতহৈ, হিয়ো ফটত মেরী ছাতী।।
মীরা কহে প্রভু কব রে মিলোগে, পূর্ব জনমকে সাথী।।”
—আমি আমার প্রিয়তম শ্যামকে একটি চিঠি লিখব। যখন থেকে শ্যাম চলে গেছে, তখন থেকেই সে আমার আর খবর নেয় না। সে কি শুনে শুনে এখন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে? আমি উঁচুতে উঠে তাঁর আসার পথের দিকে অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছি। তাঁর বিরহে কেঁদে কেঁদে আমার চোখ দুটি লাল হয়ে উঠেছে। ওগো সখা, তোমাকে না দেখা পর্যন্ত আমি এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তি পাচ্ছি না। কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
মীরা বলছেন, ওগো প্রভু, তুমি আমার গত জন্মের সঙ্গী, তুমি কবে দেখা দেবে?
***
”পাতিয়াঁ মৈঁ কৈসে লিখুঁ, লিখিহী না জাঈ।। টেক।।
কলম ভরত মেরে কর কম্পত, হিরদো রহো ঘর্রাঈ।।
বাত কহুঁ মোহি বাত ন আবৈ, নৈন রহে ঝরাঈ।।
কিস বিধি চরণ কমল মৈঁ গাহিহো, সবহি অঙ্গ ধর্রাঈ।।
মীরা কহে প্রভু গিরধর নাগর, সব হী দুখ বিসরাঈ।।
—আমি কীভাবে আমার প্রিয়তম শ্যামলালার কাছে চিঠি পাঠাব? যখনই লিখতে বসি তখনই আমার হাত কাঁপে। কলম ধরতে পারি না। আমার সমস্ত শরীরে শিহরণ জেগেছে। কত কথা জমে আছে বুকের মাঝে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছি না। দু’চোখ দিয়ে শুধু অশ্রুধারা ঝরে পড়ছে। তাকে দেখতে পেলে কীভাবে তার চরণকমল স্পর্শ করব। আমার সর্বাঙ্গে কাঁপুনি।
মীরা বলছেন, তার নাগর গিরিধারী একদিন এসে তার সমস্ত দুঃখ—কষ্ট দূর করে দেবে।
***
”সাধন দে রহ্যো জোরা রে, ঘর আও জো স্যাম মোরা রে।।
উমড় ঘুমড় চহুঁ দিস সে আয়া গরজত হৈ ঘন ঘোরা রে।।
দাদুর মোর পপীহা বোলে, কোয়ল কর রহী সোরা রে।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, জ্যো বারূঁ সোহী থোরারে।।”
—শ্রাবণের অবিরাম বর্ষণ নেমেছে। শুধুই শোনা যাচ্ছে বৃষ্টিপাতের শব্দ। এখন কেন তুমি দূরে আছো? এই বর্ষণ মুখরিত রাতে তুমি কি আমার কাছে আসবে না? গুরু গুরু গর্জনে চারদিক অন্ধকার হয়ে উঠেছে। দাদুরী ডাকছে, কেকারব শোনা যাচ্ছে। কোকিল ডেকে উঠল।
ওগো মীরার প্রভু, আমি যে তোমার জন্য তৃপ্তি তাপিত হয়ে অপেক্ষা করছি। তুমি কবে এসে আমার সমস্ত বিরহ জ্বালা দূর করবে বলো।
***
”ভজ লে রে মন গোপাল গুণা।। টেক।।
অধম তরে অধিকার ভজন সূঁ, জোই আয়ে হরি কী সরণা।
অবিশ্বাস তো সাখি বতাউঁ, অজামেল গণিকা সদনা।।
জো কৃপাল তন মন ধন দীহ্নোঁ, নৈন নাসিকা মুখ রসনা।
জীকে রচত মাস দশ লাগে, তাহি ন সুমিরো এক ছিনা।।
বালাপন সব খেল গঁওয়ায়া, তরুণ ভয়ো জব রূপ ঘনা।
বৃদ্ধ ভয়ো জব আলস উপজ্যো, মায়া মোহ ভয়ো মগনা।।
গাজ অরু গীদহু তরে ভজন সূঁ, কোউ তর্যাে নহি ভজন বিনা।।
ধনা ভগত লীলা পুণি সেবরী, মীরা কী হুঁ করো গণনা।।”
—হে মন, জীবন থাকতে তুমি গোপালের গুণকীর্তন করে নাও। যারা অধম তারাও ভবসাগর পার হবে, যদি মন দিয়ে গোপালের নাম স্মরণ করে। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো না। অজামিল, গণিকা আর সদন কসাই এর সাক্ষী হিসাবে আছে। দয়াময় প্রভু আমাদের দেহ আর মন দিয়েছে। দিয়েছে আঁখি, নাসিকা, মুখ আর জিহ্বা। এই দেহটির গঠন করতে মায়ের দশমাস সময় লেগেছে। হে মন, সেই পরম পিতাকে কেন ক্ষণিকের জন্যও মনে করো না? শৈশবকাল কেটে গেল কেবল খেলা করে। তারুণ্য কাটালে রূপে বিভোর হয়ে। এখন যৌবন—সূর্য হয়েছে অস্তমিত। শরীর ভেঙে পড়েছে, তাই মনে এসেছে আলস্য। হে মন, মায়া মোহের কুহরে আকৃষ্ট হলে? গজ আর জটায়ু ভজন করে উদ্ধার পেল। ভজন ছাড়া কেউ কি ভবসাগর পার হতে পারে? তুমি একবার ধনা, ভগত, পীপা, ধ্রুব ও শবরীর কথা ভাবো। মন ভজন করো। এই নামাবলীতে মীরারও ভজন হবে।
কয়েকটি শব্দের অর্থ—
অজামিল—অজামিল ছিল এক দুরাচারী ব্রাহ্মণ। তার পুত্রের নাম ছিল নারায়ণ। মৃত্যু সময়ে সে পুত্রের নাম ধরে ডেকেছিল। পরে বিষ্ণুর দূত এসে তাকে যমরাজার দূতের হাত থেকে তুলে নিয়ে যায়।
গণিকা—এক বারবণিতা। তার একটি পোষা টিয়াপাখি হরিনাম করত। গণিকা তার মুখে হরিনাম শুনে উদ্ধার পেয়েছিল।
সদন—একজন কসাইয়ের নাম। জীবিকা নির্বাহের জন্য নিষ্ঠুর ভাবে জীব হত্যা করত। কিন্তু তার মন সবসময় ঈশ্বরের ধ্যান ও জপ করত। তাই সে উদ্ধার পেয়ে যায়।
গজ—একদিন একটি গজ (হাতি) খেলার জন্য নদীতে নেমেছিল। সেই নদীতে একটি কুমীর বাস করত। সেই কুমীর ছিল গজের পূর্বজন্মের শত্রু। জলে গজকে নামতে দেখে কুমীর সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার একটি পা কামড়ে ধরে। হাতি তখন প্রাণভয়ে নারায়ণের নাম ধরে ডাকতে থাকল। নারায়ণ এসে কুমীরকে হত্যা করে প্রিয় শিষ্য গজকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।
গীদ—জটায়ু। সীতাহরণের সময় রাবণ তাকে মেরে ফেলে। রামচন্দ্র তাঁর মৃতদেহ সৎকার করেছিলেন।
ধনা, ভগত, পীপা এবং ধ্রুব—এঁরা সকলেই ছিলেন ভগবানের ভক্ত। ভক্তি বলে তাঁরা ঈশ্বর অনুগ্রহ লাভ করেন।
শবরী—রামচন্দ্রের একনিষ্ঠ ভক্ত শবরীর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে রামচন্দ্র তাঁকে কৃপা করেছিলেন।
***
”ভজ মন চরণ কঁবল অবিনাসী।। টেক।।
জেতাই দীসে ধরণি গগন বিচ, তেতাই সব উঠি জাসী।
কহা ভয়ো তীরথ ব্রত কীহ্নে, কহা লিয়ে করবত কাসী।।
ইস দেহী কা গরব ন কর না, মাটী মেঁ মিল জাসী।
য়ো সংসার চহর কী বাজী, সাঁঝ পড়্যোঁ উঠি জাসী।।
কহা ভয়ো হৈ ভগবা পহর্যাঁ, ঘর তজ ভয়ে সন্যাসী।
জোগী হোয় জুগতি নহিঁ জানি উলটি জনম ফির আসি।।
অরজ করোঁ অবলা কর জোরে, শ্যাম তুমারী দাসা।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, কাটো জম কী ফাঁসী।।”
—হে মন, অবিনাশীর চরণতলে বসে থেকে ভজনা করো। ধরণী ও গগনে মধ্যে তুমি যা কিছু দেখছো, সবই নশ্বর। একদিন সব বিলীন হবে। কিছুই স্থির নয়, তাই বাহ্যাচার করে লাভ নেই। তীর্থভ্রমণ বা ব্রতসাধন করা বৃথা। এমনকি কাশীতে গিয়ে করাত দিয়ে নিজেকে দু’টুকরো করো, তাহলেও তোমার মুক্তি হবে না। তুমি মনে অহঙ্কার রেখো না। যে কোনও সময় এই শরীর মাটিতে মিশে যাবে। এই জগৎ হল চার প্রহরের ভোজবাজি। সন্ধ্যা অবসানে সব মিলিয়ে যাবে। তুমি যদি মোক্ষসাধনার জন্য গৈরিক বস্ত্র ধারণ করো, গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসজীবনের দুঃখ—কষ্ট সহ্য করো, তাহলেও কাজের কাজ কিছু হবে না। যোগী হলে মুক্তি যদি আয়ত্ত করতে না পারো তাহলে তোমাকে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে। হে শ্যাম, এই অবলা তোমার কাছে করজোড়ে মিনতি জানাচ্ছে। আমি মীরা, আমি তোমার দাসী, হে প্রভু, গিরিধারী নাগর, তুমি যমের ফাঁস খণ্ডিত করো।
***
”তুমি সুনো দয়াল মহাঁরী অরজী।। টেক।।
ভৌসাগর মেঁ বহী জাত হুঁ, কারো তো থাঁরী মরজী।।
য়ো সংসার-সগো নহিঁ কোঈ, সাচা সগা রঘুবরজী।।
মাতা-পিতা ঔর কুঁট কবীলো, সব মতলব কে গরজী।।
মীরাকো প্রভু অরজী সুন লো, চরণ লগাও তো থাঁরী মরজী।।”
—হে দয়াল, আমার একটা অনুরোধ শুনবে? এই সংসার—সাগরে আমি অসহায়ের মতো ভেসে চলেছি। তুমি দয়া করলে আমি উদ্ধার পাই। উদ্ধার পাওয়ার মতো কোনও সুকৃতি কি আমি কখনও করিনি? তাই আমি করজোড়ে তোমার কাছে মিনতি করছি। তুমি আমাকে এই সংসার থেকে রক্ষা করো। আমার আর কেউ নেই, তুমি আমার আপনজন। মা—বাবা, আত্মীয়—পরিজন সকলেই নিজের স্বার্থ খুঁজে বেড়ায়। মীরার নিবেদন রাখো, হে প্রভু, তোমার চরণতলে দয়া করে স্থান দাও।
***
”রাম নাম রস পীজে মনুআঁ, রাম নাম রস পীজে।। টেক।।
তজ কুসঙ্গ সতসঙ্গ বৈঠ নিত, হরি চরচা সুণ লীজে।।
কাম-ক্রোধ-মদ-লোভ-মোহ কুঁ, চিত সে বহায় দীজে।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, তাহি কে রঁগ মেঁ ভীঁজে।।”
—হে মন, রামনামের রস পান করো। কুসঙ্গ ত্যাগ করে সাধুসঙ্গ গ্রহণ করো। হরিচর্চায় মন দাও। কাম, ক্রোধ, মদ, মোহ এবং লোভকে দূর করো। মীরার প্রভু হল গিরিধারী নাগর, তার প্রেমে মত্ত হও।
***
”মন রে পরসি হরিকে চরণ।। টেক।।
সুভগ শীতল, কঁকল কোমল, ত্রিবিধ জ্বালাহরণ।
জিন চরণ প্রহ্লাদ পরসে, ইন্দ্র পদবী ধরণ।।
জিন চরণ ধ্রুব অটল কীনে, রাখি অপনী সরণ।।
জিন চরণ ব্রহ্মাণ্ড ভেট্যো, নখ সিখ সিরী ধরণ।
জিন চরণ প্রভু পরসি লীনো, তরী গোতম ঘরণ।
জিন চরণ কালীনাগ নাথো গোপিলীলা করণ।।
জিন চরণ গোবরধন ধার্যৌ, গর্ব্ব মঘবা হরণ।
দাসী মীরা লাল গিরিধর, অগম তারণ তরণ।।”
—মন, হরির যুগলচরণ স্পর্শ করো। সে কল্যাণদাতা। সে ঠান্ডা ও পদ্মের মতো কোমল। ত্রিবিধ জ্বালা সে নাশ করতে পারে। ওই চরণ দুটি স্পর্শ করে প্রহ্লাদ রাজ্যপদ পেয়েছিল। ধ্রুব এই চরণ দুটি আশ্রয় করে ধ্রুবত্ব লাভ করেছিল। ওই চরণদ্বয়ের স্পর্শে অহল্যা উদ্ধার হয়েছিল। তার চরণের স্পর্শে কালীয়নাগ হয়েছিল শান্ত। যে চরণ দুটি গোপিনীদের নিয়ে রাসলীলা করেছিল, আবার যে গোবর্ধনগিরি ধারণ করে ইন্দ্রের দর্প চূর্ণ করেছিল, সেই চরণ দুটির ওপর নিজের সব সত্তা নিবেদন করো। মীরা বলছে, আমার প্রভু গিরিধারীলালের সেই চরণদ্বয় আশ্রয় করে আমি ভবসাগর পার হব।
***
”মেরে মন রাম নামা বসী।।
তেরে কারণ স্যাম সুঁন্দর সকল লোগাঁ হঁসী।।
কোঈ কহে মীরা ভই বৌরী, কোই কহে কুল নসী।।
কোঈ কহে মীরা দীপ আগরী, নাম পিয়া সূঁ রসী।।
খাঁড় ধার ভক্তী কী ন্যারী, কাটি হৈ জম ফঁসী।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, শব্দ সরোবর ধঁসী।।”
—আমার মনে রামনাম বসে গেছে। আমি সর্বদা কীর্তনে বিভোর হয়ে আছি। ওগো শ্যামসুন্দর, আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে সকলে আমাকে সন্দেহ করে। কেউ বলে, আমি নাকি উন্মাদিনী হয়ে গিয়েছি। কেউ বলে, আমি এক নষ্টা মেয়ে। কেউ বলে, আমি কুলদীপিকা। আমি ‘নাম’এ তন্ময় হয়েছি। আমি জানি, তরবারির ধারাল পথ হচ্ছে ভক্তির পথ। এই পথে যে অবিচল থাকে, তাকে মৃত্যু ভয় দেখাতে পারে না। মীরা বলছে, সে তার প্রভু গিরিধারী নাগরের শব্দ—সরোবরে প্রবেশ করেছে।
***
”জগ মেঁ জীবনা থোড়া, রাম কুণ কহ রে জঞ্জার।। টেক।।
মাতা-পিতা তো জন্ম দিয়ো হৈ, করম দিয়ো কর তার।।
কই রে খাইয়ো কই রে ঘর চিয়ো, কই রে কিয়ো উপকার।।
দিয়া-লিয়া তেরে সঙ্গ চলে গা,
ঔর নহীত তেরী লার”
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর,
ভজ উতরো ভবপার।।”
—জগত—সংসারে মাত্র দু’দিনের জন্য আসা। মন, কেন রামনাম করো না? মাতাপিতা আমাদের জন্ম দিয়েছেন ঠিক কথা কিন্তু বিধাতা দিয়েছেন আমাদের ভাগ্য। কী খেলে, কী খরচ করলে, কতটা সুখভোগ করলে, তার হিসাব কি কখনও করেছো? এই দেওয়া—নেওয়া অর্থাৎ পাপ—পুণ্য তোমার সঙ্গে পরলোকে যাবে। অন্য কেউ তোমার সঙ্গে যাবে না। মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর। ওরে মন, তার ভজন করে ভবসংসার রূপ সাগর পার হও।
***
”জাগো বংসীবারে ললনা, জাগো মোরে প্যারে।। টেক।।
রজনী রীতি ভোর ভয়ো হৈ, ঘর-ঘর খুলে কি বারে।
গোপ দহি মথত সুনিয়ত হৈ, কঁকনা কে ঝনকারে।
উঠো লালজী ভোর ভয়ো হৈ, সুর-নর ঠাঢ়ে দ্বারে।
গ্বাল—বাল সব করত কুলাহল, জয়-জয় সবদ উচারে।
মাখন-রোটী হাত মেঁ লীনী, গউবন কে রখবারে।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, সরণ আয়া কুঁ তারে।।”
—ওগো বংশীধর, এবার জাগো। রাত যে শেষ হয়ে এল। ওই দেখো প্রভাত—সূর্যের আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ঘরে ঘরে দরজা খোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। গোপিকারা দই মন্থন করছে। তাদের হাতের কাঁকনের শব্দ কানে আসছে। ওগো প্রিয়, ওঠো, তুমি কি জানো, তোমাকে একবার চোখের দেখা দেখবে বলে দেবতা ও মানুষ সারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গোপ—বালকেরা কোলাহল করছে। তারা তোমার নামে জয়ধ্বনি করছে।
এবার প্রভু জেগে উঠল। মাখন—রুটি হাতে নিল। রাখালের বেশে সে এখন যাবে গোচরণে। সে যে গোপাল। মীরা বলছে, আমার প্রভু গিরিধারী নাগরের যে শরণাপন্ন হয়, তাকে সে যে কোনও বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে।
***
”মহাঁরো জনম মরণ কো সাথী, যানে নহিঁ বিসরূঁ দিন-রাতী।। টেক।।
তুম দেখ্যাঁ বিন কল ন পড়তে হৈ, জানত মেরী ছাতী।
উঁচী চড়-চড় পন্থ নিহারুঁ, রোয়-রোয় আঁখিয়াঁ রাতী।।
য়ো সংসার সকল জগ ঝূঁঠো, ঝূঁঠো ফুলরা নাতী।
দোউ কর জ্যোড়্যাঁ অরজ করত হূঁ সুন লীজ্যো মেরী বাতী।।
য়ো মন মেরো বড়ো হমারী, জ্যুঁ মদমাতী হাথী।
সতগুরু দস্ত ধর্যো সির উপর, আঁকুশ দে সমঝাতী।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, হরি চরণাঁ চিত রাতী।
পল পল তেরা রূপ নিহারুঁ, নিরখ-নিরখ সুখ পাতী।।”
—তুমি আমার জীবনের ধ্রুবতারা, মরণেও আমি তোমাকে সাথী হিসাবে পেয়েছি। আমি তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। তোমাকে না দেখলে আমি অশান্তির আগুনে দগ্ধ হই। তুমি তো জানো না একথা, জানে শুধু আমার হৃদয়। উঁচু থেকে আমি তোমার পথের দিকে চেয়ে থাকি। তোমার জন্যেই কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
প্রিয়তম, এই সংসারে যাবতীয় যা কিছু আছে সবই মিথ্যা। এখানকার বংশ মর্যাদাও মিথ্যে। আমি দুটি হাত জোড় করে তোমাকে মিনতি করছি, তুমি আমার কথা শোনো। আমি আমার এই মনটাকে কি দিয়ে বেঁধে রাখব? মনে হচ্ছে আমার হৃদয় বুঝি এক মদমত্ত হাতি।
সত্যগুরু হাত রেখেছেন আমার মাথায়। সেটাই হয়েছে আমার কাছে এক অঙ্কুশ। সেই অঙ্কুশ দিয়ে আমি আমার অশান্ত মনকে শাসন করার চেষ্টা করছি।
ওগো মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর, আমার সব কিছু তোমার প্রতি অর্পিত হয়েছে। আমি তোমার রূপ পলে পলে দেখছি। এ রূপ দর্শন করে আমি যে কী আনন্দ পাচ্ছি, তা তোমায় ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না।
***
”মতবারো বাদল আয়োরী রে, হরি কে সঁদেসো কুছ নহিঁ লায়োরে।। টেক।।
দাদুর মোর পপীহা বোলে, কোয়ল সব্দ সুনায়ো রে।
কারী অঁধিয়ারী বিজুলী চমকে, বিরহিন অতি ডর পায়ো রে।।
গায়ে বাজে পবন মধুরিয়া, মেহা অতি ঝড় লায়ো রে।
ফুঁকে কালী নাগ বিরহ কী জারী। মীরা মন হরি ভায়ো রে।।”
—জলভরা মেঘ এসে আকাশকে ছেয়ে ফেলেছে। আমার শ্যাম এখনও আমার কাছে এল না। দাদুর, ময়ূরী, পাপিয়া আর কোকিল ডাকছে। কালো মেঘের অন্ধকার। আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিরহিনী তাই দেখে ভীতা। বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছে। চারপাশে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। এ যেন বিরহের কালনাগিনী। মীরা বলছে, এমন দিনে হরি যদি আমার কাছে আসে, তাহলে বড়ো ভালো লাগে।
***
”হেলী সুরত সোহাগিন নার, সুরত মোরী রাম সে লগী।। টেক।।
লগনী লহঁগা পহির সোহাগিন, বীতী জায় বহার।
ধন জোবন দিন চার কা হে, জাতন লাগি বার।।
ঝুঠে বর কো ক্যা বরূঁজী, অধবিচ মেঁ তেজ যায়।।
বর বরাঁ লা রামজী মহাঁরো, চূড়ো অমর হো জায়।।
রাম নামকা চূড়ালো হো, নিরগুন সুরমো সার।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর, হরি চরণঁ কী মৈঁ দাস।।”
—ওগো ধ্যানের ত্রয়োনারী, আমার ধ্যানের মণি রাম। আজ আমি আমার পরম কাঙ্ক্ষিতের সাথে মিলব। পবিত্র কাপড় পারো। পরমানন্দের শুভলগ্ন সমাগত। এই ধন—যৌবন সব কিছু মাত্র ক’দিনের। আজ আছে কাল নেই। জগত মিথ্যা। এই মিথ্যা জগতের বরকে বরণ করে আমি কী করব? সব কিছু কি মাঝদরিয়াতে ছেড়ে যাব?
আমার বর আমার রাম। তাকে শরণ করলে আমার শাঁখা—সিঁদুর চিরস্থায়ী হবে।
ওগো, রামনাথের চুড়ি পরে নাও। নিরঞ্জনকে করো চোখের অঞ্জন।
মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর। ওগো প্রভু, আমি তোমার চরণের দাসী হয়ে দিন কাটাব।
***
”সোবত হী পলকা হেঁ মৈঁ তো, পলক লগী পল হোঁ পিউঁ আয়ে।। টেক।।
সেঁ জু উঠী প্রভু আদর দেন কুঁ, জাপ পরী পিয় ঢুঢ়ন পায়ে।।
ঔর সখী পিউ সূত গমায়ে, মৈঁজু সখী পিউ জাগি গমায়ে।।
আজ কী বাত কহা কহুঁ সজনী, সুপনা মেঁ হরি লেত বুলায়ে।।
বস্তু এক জব প্রেম কী পকরী, আজ ভয়ে সখী মনকে ভায়ে।।
বো মাহারো সুনে অরূ গুণি হে, বাজে অধিক বজায়ে।।
মীরা কহে সত্ত কর মানো, ভক্তি মুক্তি ফল পায়ে।।”
—আমি আমার শয্যাতে শুয়ে পড়লাম। তন্দ্রাঘোরে দেখলাম, শেষ পর্যন্ত অনেক প্রতীক্ষার পর আমার প্রিয়তম এসেছে। তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার ঘুম ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে আমার প্রিয়তম অদৃশ্য হয়ে গেল। অন্য সখীরা তাদের প্রিয়তমকে ঘুমিয়ে হারায়। আর আমি কিনা জেগে জেগেই তাকে হারালাম! আজকের কথা কি আর বলব সহেলি, স্বপ্নে দেখেছি, সে আমাকে ডাকছে।
আমার প্রেমের সাধনা আজ বোধহয় পূর্ণ হয়েছে।
হে সখী, তুমিই বলো, সত্যি কি আমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে? সে আমার কথা শুনবে, আর ভাববে, তাকে আমি কতখানি ভালোবেসেছি। আজ আনন্দের বাজনা আরও বেশি করে বাজুক। মীরা বলছে, সখী, তুমি সত্যি করে জেনে নাও, আজ আমি আমার প্রাণনাথের সঙ্গে মিলতে পেরেছি কিনা।
***
” আলী সাঁবরে কি দৃষ্টি মানো প্রেম কী কটারী হৈ।। টেক।।
লাগত বেহাল ভই তন কী সুধি বুদ্ধি গঈ।
অমন ব্যাপো প্রেম মানো মতবারী হৈ।।
সখিয়াঁ মিলি দুই চারী-বাবরী-ভঈ ন্যারী।
হৈঁ তো বাকো নীকে জানোঁ কুঞ্জ কৈ বিহারী হৈ।
চন্দ কো চকোর চাহৈ দীপক পতঙ্গ দহৈ,
জল বিনা মীন জৈসে তৈসে প্রীত প্যারী হে।।
বিনতী করোঁ হে শ্যাম, লাগোঁ মে তুক্ষারে পাম,
মীরা প্রভু ঐসে জানো দাসী তুক্ষারী হৈ।।
—হে অলি, শ্যামলের দৃষ্টি যেন প্রেমের কাটারি। সেই কাটারির আঘাত লাগামাত্র আমি ব্যাকুল হয়ে গেলাম। আমার শরীরের সমস্ত চেতনা লোপ পেল। তার প্রেম দেহ—মনে সঞ্চারিত হল। আমি মাতোয়ারা হয়ে গেলাম। আমার এই অবস্থা দেখে দু—চারজন সখী চিন্তিত হয়েছিল।
এ এক বিচিত্র রোগ। আমি তো তাকে ভালোভাবেই চিনি। সে যে কুঞ্জবিহারী। আমার সখীরা কি এ কথা জানে? চাঁদকে যেমনভাবে চকোরি চায়, প্রদীপ আকৃষ্ট করে পতঙ্গকে, জল ছাড়া মাছ লাফাতে থাকে, তেমনই শ্যামের জন্য আমার প্রাণ চঞ্চল হয়েছে। হে শ্যাম, তুমি তোমার এই দাসীকে কবে চরণে স্থান দেবে?
***
”ঐসে পিয়া জান ন দীজে হো।। টেক।।
চলো রী সখী মিলি রাখিকে, নৈনা রস পীজে হো।।
স্যাম সলোনো সাঁবরো, মুখ দেখে জীজে হো।।
জোই-জোই ভেষ সোঁ হরি মিলৈ, সোই সোই ভুল কীজৈ হো।।
মীরা কে গিরিধর প্রভু, বড় ভাগন রীঝো হো।।
—এমন প্রিয় বোলে কখনও তাকে বিদায় জানাতে নেই। ওগো সই, চলো, আমরা তাকে ধরে রাখি। তার নয়নের অমৃত পান করি।
শ্যামসুন্দরের মুখ দেখে আমাদের জীবন সার্থক হবে। যে বেশ ধরলে তাকে পাওয়া যায় আমি সেই বেশ ধারণ করব।
ভাগ্যে থাকলে মীরার প্রভু গিরিধারীলাল নিশ্চয়ই একদিন দেখা দেবে।
***
”সখী-রী মৈঁ তো গিরিধরকে রঙ্গ রাতী।। টেক।।
পঞ্চ রঁগ মেরা চোলা রঁগা দে, মে ঝুরমুট খেলন জাতী।
ঝুরমুট মৈঁ মেরা সাঙ্গ মিলে গা, খোল অডম্বর গাতী।।
চাঁদ জায় গা সুরজ জায় গা, জায় গা ধরন অকাসী।
পবন পানী দোনো হী জায় গে, অটল রহে অবিনাসী।।
সুরত-নিরত কা দিবলা সজো লে, মনসা কী কর লে বাতী।।
প্রেম হটী কা তেল বনা লে, জাগ করে দিন রাতী।।
জিনকে পিয়া পরদেস বসতে হৈঁ, লিখি-লিখি ভেঁজে পাতী।
মেরে পিয় মোঁ মাহিঁ বসত হৈঁ, কহুঁ না আতী-জাতী।।
পীপুর বসূঁ ন বসূঁ সাস ঘর, সতগুরু সব্দ সঁগাতী।
না ঘর মেরা না ঘর তেরা, মীরা হরি রঁগ রাতী।।”
—ওগো সখী, আমি আমার গিরিধারীর প্রেমে আজ মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছি। পাঁচ রঙে চোলি আমাকে পরিয়ে দাও। আমি সেই চেলি পরে কুঞ্জে গিয়ে তার সঙ্গে মিলন খেলায় অংশ নেব। সেখানে গিয়ে আমার প্রাণবল্লভের দেখা পাব। আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করব তখন আমার গায়ে মিথ্যা আড়ম্বরের আবরণ থাকবে না। আমি আলিঙ্গনে আবদ্ধ হব।
এই জগতে চাঁদ নশ্বর, নক্ষত্র নশ্বর। সূর্যও চিরকাল এভাবে আলো দেবে না। একদিন এদের পথ চলা শেষ হবে। যখন এরা থাকবে না, তখন আমাদের সাধের বসুন্ধরা ধ্বংস হবে। বাতাস আর জল মিশে যাবে কোথায় কে জানে! কিন্তু সেদিনও আমার এই অবিনশ্বর প্রেম অটল থাকবে।
মন, আমাকে সাজিয়ে দাও নানাভাবে। ধ্যানধারণার দেউটিতে প্রদীপ জ্বলে উঠুক। মনসার বাতি আনো। আনো প্রেমের হাট থেকে তেল। সেই তেলে প্রদীপ জ্বালো। সেই প্রদীপের আলোয় বসে দিবারাত্রি থাকো অপেক্ষায়। সেই আলোতে তুমি তোমার প্রিয়তমের মুখ দেখতে পাবে। যাদের প্রিয়তম পরদেশে থাকে তাদেরকে চিঠি লিখতে হয়। আমার প্রিয় আমার অন্তরেই রয়েছে। সে কোথাও যায় না। আমি বাপের বাড়িতে থাকি না, শ্বশুরবাড়িতেও যাই না।
এক সত্যগুরুর ‘শব্দ’ই আমার আপন জন। এই ঘর তোমার—আমার, কারও নয়। তাই মীরা হরির প্রেমে সবকিছু নিবেদন করেছে।
***
”দেখ বরষা কী সরসাঈ, মোরে পিয়া কী মন মেঁ আই।। টেক।।
নহ্নী-নহ্নী বৃন্দন বরসন লাগ্যো, দামিন দমকে ঝর লাঈ।।
শ্যাম ঘটা উমড়ী চহুঁ দিসতে, বোলন মোর সুহাঈ।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, আনন্দ মঙ্গল পাঈ।।”
—বর্ষার সরস শ্যামলী দেখছি। তাই দেখে শ্যামলের কথা মনে পড়ছে আমার। ছোটো ছোটো জলবিন্দু আজ বর্ষণ আরম্ভ করেছে। মেঘের কোণে অধীরা দামিনী জ্বলছে। চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। কেকারব শোনা যাচ্ছে। এই সময় মীরা তার কাঙ্ক্ষিত প্রেমিককে কাছে পেয়েছে। তার আনন্দ হয়েছে আকাশছোঁয়া।
***
”ফাল্গুনকে দিন চার রে, হোলী খেল মনা রে।।
বিন করতাল পখাবজ-বাজে, অনহদ কী ঝনকারে রে।।
বিন সুর রাগ দৃতীসূঁ গাবে, রোম-রোম কাঁ সার রে।।
উড়ত গুলাল লাল ভয়ে বাদল, বরসাত রঙ্গ আশার রে।।
ঘট কে কপট সব খেলে দিয়ে হৈঁ, লোক-লাজ সব ডার রে।।
হোলী খেল প্যারী প্রিয় ঘর আয়ে, সো প্যারী পিয় প্যার রে।।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর, চরণ কঁবল বলিহার রে।।”
—ওরে মন, ফাল্গুনের আর দু—চার দিন বাকি আছে মাত্র। দোলোৎসবের আনন্দে অংশ নিতে হবে। এখানে করতাল নেই, পাখোয়াজ নেই, অথচ অনাহত ধ্বনির ঝঙ্কার প্রতিনিয়ত কানে আসছে। এখানে বিনা সুরে ছত্রিশ রাগ—রাগিনীতে গান হচ্ছে। দেহের প্রতিটি রোমকূপে লেগেছে শিহরণ। আমি শীল আর সন্তোষের কেশরগুলো নিয়েছি। প্রেম আর প্রীতির পিচকিরি আমার হাতে। আজকের দিনে এত কুমকুম উড়ছে যে, আকাশের মেঘ লাল হয়ে গেছে। সেখান থেকে ঝরে পড়ছে রঙিন বৃষ্টি।
আজ কোনও পর্দা নেই, নেই কোনও লোকলজ্জা। ওগো প্রিয় সই, দোল খেলো, দোল খেলো। আজ প্রিয়তম ঘরে এসেছে।
আজ সেই প্রিয়া প্রিয় হবে যে খেলবে দোল তার প্রিয়তমের সঙ্গে।
মীরা বলছে, সে তার গিরিধারী নাগরের কাছে সবকিছু উৎসর্গ করে দিয়ে নিঃস্ব—রিক্ত হয়ে গেছে।
***
”জোগিয়ারী সূরত মন মেঁ বসী।। টেক।।
নিত প্রতি ধ্যান করত হুঁ দিল মেঁ, নিস-দিন হোত কুসী।।
কহা করূঁ র্কিত জাউঁ মোরী সজনী, মানো সরপ ডসী।।
মীরা কহে প্রভু কব রে মিলাগে, প্রীত রসীলী বসী।।”
—ওগো যোগী, তোমার মুখখানা আমার মনের পটে চিরদিনের জন্য আঁকা হয়ে গেছে। আমি রোজ তাকে স্মরণ করি। দিনে দিনে আমার আনন্দ বেড়ে চলেছে। কি করব? এখন কোথায় যাব? ওগো সই, তুই বলে দে, এখন আমার কর্তব্য কি?
মীরা বলছে, ওগো আমার প্রভু, কবে তুমি দেখা দেবে, তোমার সাথে আমি মেতে উঠব চিরন্তন আনন্দ খেলায়।
***
”জোগিয়া তূ কব রে মিলাগে আঈ।। টেক।।
তেরে হী কারণ জোগলিয়ো হৈ, ঘর-ঘর অলখ জগাই।।
দিবস ভূখ রৈণ নহি নিদ্রা, তুম বিন কুছ ন সুহাঈ।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, মিল কর তপত বুঝাঈ।।”
—ওগো যোগী, কবে তোমায় পাব? কবে তুমি আমার হবে? তোমার জন্য যোগিনী হয়ে কতদিন আর পথে—প্রান্তরে ঘুরে বেড়াব? দিনে খিদে নেই, রাতে ঘুম নেই চোখের তারায়। তোমাকে ছাড়া কোনও কিছু ভালো লাগে না।
মীরা বলছে, ওগো আমার প্রভু গিরিধারী নাগর, তুমি কবে আমার কাছে এসে আমার মনের যন্ত্রণা আর দেহের জ্বালা জুড়াবে?
***
”নন্দ-নন্দন বিলমাঈ, বদরা নে ঘেরি মাঈ।। টেক।।
ইত ঘন লরজে, উত ঘন গরজে, চমকত বিচ্ছু সবাঈ।।
উমড়-ঘুমড়-চহু র্দিস সে আয়া, পবন চলে পুরবাঈ।।
দাদুর-মোর-পপীহা বোলে, কোয়ল শব্দ সুনাঈ।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, চরণ কমল চিত লাঈ।।”
—ব্রজনন্দন বৃন্দাবনে দেরি করছে। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। চারপাশে শুধু মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। তার ওপরে বিদ্যুৎ যেন চমকাচ্ছে আরও বেশি।
মেঘে মেঘে চারপাশ আঁধার হয়ে এলো। বাতাস ওদের স্তরে স্তরে জড়ো করেছে।
দাদুরী—পাপিয়া—ময়ূর ডাকছে। মাঝে মাঝে কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে। মীরা বলছে, যদি এই সময় আমি আমার প্রিয় গিরিধারী নাগরের রাতুল চরণ দুটি মাথায় রাখতে পারতাম তাহলে বোধহয় জীবনে আর কিছু চাইতাম না আমি।
***
”রামৈয়া মৈতো যাঁরে রঁগবতী।। টেক।।
ঔরাঁ কে পিয় পরদেস বসতে হৈঁ, লিখ-লিখ ভেঁজে পাতী।
মেরে পিয়া মেরে রিদে বসত হৈ, গূঁজ করূঁ দিন-রাতী।
চূবা-চোলা পহির সখী রী, মৈঁ খুরমুট রমবা জাতী।
খুরমুট মেঁ মোহিঁ মোহন মেলিয়া, খোল মিলুঁ গলবাতি।।
ঔর সখী মদ পী-পী-মাতী, মৈঁ বিন পিয়াঁ মদমাতী।
প্রেম-ভটী কো মৈঁ মদ পীয়ো, ছকী ফিবুঁ দিন-রাতী।।
সুরত-নিরত কা দিবলা সঁজোয়া, মনসা পূরণ বাতী।
অগম ঘানি কা তেল সিঁচায়া, বাল রহী দিন-রাতী।।
জাউঁ নি পিহরিয়ে জাউঁ নি সাসুরিয়ে, সতগুরু সৈন লগাতী।
দাসী মীরাকে প্রভু গিরিধর, হরি চরণাঁ কী মৈঁ দাসী।।”
—হে রাম, আমি তোমার প্রেমে মত্ত। অপরের প্রিয় পরদেশে বাস করে, তাই তারা চিঠিতে লিখে পাঠায় তাদের মনের কথা। আমার প্রিয় আমার অন্তরে আছে বলে তার সঙ্গে সদাসর্বদা রহস্যালাপে মেতে উঠি। ওগো সই, লাল চোলি পরে আমি তার কুঞ্জে গিয়ে খেলা করি। সেই লতা বীথিতে আমি মোহনের সঙ্গে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হই। একে অন্যকে আরও বেশি করে সোহাগ দান করি।
অন্যরা মদ খেয়ে মাতাল হয়, আমি মদ না খেয়ে মাতোয়ারা হয়ে যাই। আমি যে প্রেম—ভাটির মদ পান করেছি। তাতেই দিন—রাত্রি সুখে আছি। আমার সামনে জ্বলছে প্রেম—আরাধনার প্রদীপ। মনকে আমি বাতি করেছি। ‘আগম’ দেশের তেল এনেছি। এই প্রদীপ কখনও নিভবে না। আমি পিতার ঘরে যাব না। শ্বশুরবাড়িতেও যাব না। আমি সত্যগুরুর নির্দেশতি পন্থায় এগিয়ে চলেছি। ওগো প্রভু গিরিধারী, তুমি জেনো আমি তোমার চরণের দাসী।
***
”সখীরী লাজ বৈরণ ভই।। টেক।।
শ্রীলাল গোপাল কে সঙ্গ, কাহে নাঁহী গঈ।।
কঠিন ক্রূর অক্রূর আয়ো, সাজি রথ কহঁ নঈ।।
রথ চড়ায় গোপাল লৈ গো, হাত মীজত রহী।।
কঠিন ছাত্রী শ্যামবিচ্ছুরত, বিরহ তেঁ তন তঙ্গ।।
দাস মীরা লাল গিরিধর, বিখর ক্যোঁ ন গঈ।।”
—হে সখী, লজ্জাই আমার শত্রু। শ্রী গোপাললালের সঙ্গে সে কেন মথুরাতে চলে গেল না? ক্রূর—অক্রূর রথ সাজিয়ে এল। সেই রথে করে গোপালকে নিয়ে গেল। আমি চোখের সামনে ওই দৃশ্য দেখে কেবল অনুতাপ করতে লাগলাম।
ওগো সখী, আমার হৃদয় বড়োই কঠিন। তা না হলে সেদিন আমি কেন শ্যামবিরহে আরও বেশি ক্রন্দসী হইনি? তাহলে তো আজ আমাকে এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না।
***
”রাণাজি, মৈঁ গিরিধর রে ঘর জাউঁ।।
গিরিধর মহাঁরো সাচো প্রীতম, দেখতে রূপ লুভাউঁ
রৈন পাড়ে তবহী উঠ জাঁউ, ভোর ভয়ে উঠ আউঁ।।
রৈন-দিনা বাকে সগঁ ডোলূঁ জ্যেঁ রীঝে, ত্যেঁ রিবাউঁ।।
জো বস্ত্র পহিরাবে সোই পাহিরূঁ, জোদে সোই খাউঁ।।
মেরে উনকী প্রীতি পুরানী, উন বিন পল ন রহাউঁ।।
জহঁ বৈঠাবে জিহী বৈঠুঁ, বেচে তৌ বিক জাউঁ।।
জন মীরা গিরিধর কে উপর, বার-বার বল জাউঁ।।”
—রাণাজি, আমি গিরিধারী লালের ঘরে যাব। গিরিধারীই আমার সত্যিকারের প্রিয়তম। সেই প্রিয়তমকে পেতেই হবে। তুমি আমাকে যা—ই বলো না কেন, আমি তার কাছে যাব। তার রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। রাত হলে সেখানে চলে যাই। ভোর হলে বাড়িতে ফিরে আসি।
দিন রাত্রি আমি তার সঙ্গে থাকি। সে যেভাবে খুশি হয়, তেমন আচরণ করি। তাকে খুশি করার সর্বদা চেষ্টা করি। সে যে কাপড় আমায় পরতে দেয়, আমি নির্দ্বিধায় সেই কাপড় পরি। সে যা খেতে দেয়, তাই খাই। তার সঙ্গে আমার অনেক দিনের ভালোবাসা। তাকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্ত থাকতে পারি না। সে আমাকে যেখানে বসতে দেয়, সেখানেই বসি। যদি সে আমাকে বিক্রি করে দেয়, আমি আনন্দে বিকিয়ে যাব।
***
”ছাঁড়ো লঁগর মোরী বহিয়াঁ গহো না।। টেক।।
মৈং তো নার পরায়ে ঘর কী, মেরে ভরোসে গুপাল রহো না।।
জো তুম মেরী বহিয়াঁ গাহত হো, নয়ন জোর মেরে প্রাণ হরো না।।
বৃন্দাবন কী কুঞ্জ গলী মেঁ, রীত ছোড় অনরীত করো না।।
মীরা কে প্রভু, গিরিধর নাগর, চরণকমল চিত টারে টরো না।।”
—ওগো চঞ্চল, আমার হাত ধোর না। আমি যে পরনারী। গোপাল আমার ভরসা। তোমার তো দরকার নেই। তুমি যদি আমার হাত জোর করে ধরো এবং তোমার নয়ন কটাক্ষে আমার প্রাণ হরণ করো, তাহলে গোপালকে আমার প্রিয়তম বলে ঘোষণা করব। বৃন্দাবনের এই কুঞ্জবীথিতে এসে তুমি আমার কাছে অন্যায় আবদার করো না।
মীরা বলছে, ওগো আমার প্রভু গিরিধারী নাগর, তোমার চরণ কমল থেকে আমার চিত্ত কখনও সরতে দিও না।
***
”দেখো সইয়াঁ হরি মন কাঠ কিয়ো।। টেক।।
আবন কহি গয়ো অজহুঁ ন আয়ো, করি-করি বচন গয়ো।।
খান-পান, সুখ-বুধ সব বিসরো, কৈসে হরি মৈঁ জিয়োঁ।।
বচন তুক্ষারে তুমহিঁ বিসারে, মন মেরো হর লিয়ো।।
মীরা কহে প্রভু গিরিধর নাগর, তুম বিন ফটত হিয়ো।।”
—দেখো সই, আমার প্রিয়তম হরি তার মন কতখানি কঠোর করে নিয়েছে। আসবো-আসবো করে সে কেন আসছে না? এভাবে সে কতবার কথা দিয়েছে, আবার কথা ভেঙেছে। তাঁর বিরহে আমি যে আর থাকতে পারছি না।
হরি ছাড়া আমি কি করে বাঁচব?
ওগো, তুমি তোমার নিজের কথাই ভুলেছো, আর তার সঙ্গে একথাও ভুলে গেছো যে, একদা তুমি আমার চিত্ত হরণ করেছিলে।
মীরা বলছে, হে আমরা গিরিধারী নাগর। তোমার বিরহে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
***
”প্রভুজী থেঁ কহাঁ গয়ো নেহড়ী লগায়।। টেক।।
ছোড় গয়া বিশ্বাস সঁগাতী, প্রেম কী বাতী বরায়।।
বিরহ সমঁদ মেঁ ছোড় গয়া ছো, নেহ কী নাব চলায়।।
মীরা কহে প্রভু কব রে মিলোগে, তুম বিন রহ্যো না জায়।।”
—আমাকে মিলন সূত্রে বেঁধে আমার প্রভু কোথায় গেছে জানি না। সে বিশ্বাসঘাতক, আমার চিত্তে প্রেমের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে পালিয়েছে।
প্রেমের নৌকোতে আমি একা বসে আছি। সেই নৌকো সে ভাসিয়ে দিয়েছে বিরহ—সাগরে, চিরদিনের জন্য।
মীরা বলছে, ওগো আমার প্রভু, আমি তোমার সাথে মিলিত হতে চাই। সেই শুভদিনটি কবে আসবে? তোমার বিহনে আমি কাতর হয়ে পড়ছি।
***
”হো গয়ে শ্যাম দূইজ কে চন্দা।। টেক।।
মধুবন জাই ভয়ে মধুবনিয়াঁ, হম পর ডারো প্রেম কো ফন্দা।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, অব তো নেহ পরো কচ্ছু মন্দা।।”
—দ্বিতীয়ার চাঁদ উঠেছে, ও আমার প্রিয় শ্যাম। সে গেছে মথুরাতে। মাথুপনা করে সে দিন কাটাচ্ছে মহাসুখে। আর আমি এখানে পড়ে আছি প্রেমের ফাঁদে, আমার প্রিয় সে কথা কি ভুলে গেছে?
মীরা বলছে, তার প্রভু গিরিধারী নাগরের প্রেমে বুঝি ভাটা পড়েছে।
***
”পপাইয়া বে পিয় কী বাণিন বোল।। টেক।।
সুনি পাবেলী বিরহনী, থাবো রালৈলী আঁখ মরোড়।।
চোঁচ কটাউঁ পপইয়ারে, উপরিকালর লুণ।
পিয় মেরা মৈ, পিয়া কী রে, তূ পিব কাহৈ ত কুণ।
মারা সবদ সুহাবনা রে, জো পিব মেলা আজ।
চোঁচ মঢ়াউঁ যারী সোবনী রে,
তু মেরে সিরতাজ।
প্রীতম কুঁ পতিয়াঁ লিখুঁ, কউবা তু লে জাই।
জাই প্রীতম জী সূঁ য়ূঁ কহৈ রে, থাঁরী বিরহিনি ধান ন খাই।
মীরা দাসী ব্যাকুলারে, পিব পিব করত বিহাই।”
বেগি মিলো প্রভু, অন্তরজামী, তুম নিব রহ্যো ন জাই।”
—ওরে পাপিয়া, প্রিয়তমের কথা আর বলিস না। কোনও বিরহিনীর কানে গেলে আর রক্ষে নেই, তোকে কানা করে ছাড়বে। আমিও ছাড়ব না। ঠোঁট কেটে নেবো। নুন ছিটিয়ে দেবো।
প্রিয়তম আমার, আমিও প্রিয়তমের। তুই অমাদের মাঝখানে ঢুকে কেন পিয়া—পিয়া করে মরছিস?
ওগো কাক, তোমার ডাক বড়ো মঙ্গলময়, মধুরও বটে। এ আমার প্রিয়তম আমার সুলক্ষণ। যদি তাই হয় তাহলে তোর ঠোঁট সোনা দিয়ে মুড়ে দেবো। তোকে আমি মাথায় করে রাখব।
প্রিয়তমের কাছে খবর পাঠাচ্ছি, প্রেমের চিঠি। ওগো কাক, তুমি আমার পত্রবাহক। পৌঁছে দাও আমার প্রিয়র কাছে। বলবে, আমার কথা। অন্ন—জল ত্যাগ করে আমি হয়েছি বিরহিনী। আমি তার দাসী। কেঁদে কেঁদে আমার চোখ ফুলে গেছে।